চতুর্থ খণ্ড (স্নেহের দীপঙ্কর আচার্য এবং সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়)
পঞ্চম খণ্ড (বন্ধুবর স্নেহপ্রতিম শ্রী নিতীশ রায় ও বউদিকে)
4 of 6

আমি ক্ষুদ্র প্রাণ এক

আমি ক্ষুদ্র প্রাণ এক

যদি সন্দেহ হয় ঈশ্বর আছেন কিনা, তাহলে কী খুব অন্যায় হবে? পৃথিবী জুড়ে মানুষ যেভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে! জীবনের খোল-নলচে সব খুলে যাওয়ার জোগাড়। দেবতারা সব পাথরের মূর্তি হয়ে মন্দিরে মন্দিরে বসে আছেন। সকালসন্ধে মহাসমারোহে পুজো আরতি। সেবার ঘটা। বিশ্বাসী মানুষের প্রত্যাশা নিয়ে অহরহ মাথাকোটা। কার কোন প্রত্যাশা পূর্ণ হচ্ছে। যিনি চাকরি চেয়েছিলেন তাঁর কী চাকরি জুটেছে? যিনি সন্তানের আরোগ্য কামনা করেছিলেন তাঁর সন্তান কী সুস্থ শরীরে হাসপাতাল থেকে ফিরে এসেছে? যিনি সকালসন্ধ্যা দেব-আরাধনা না করে জলগ্রহণ করেন না, তাঁর স্বামীটি কেন দুর্ঘটনায় মারা গেলেন? সাজানো সংসার কেন তছনছ হয়ে গেল? কারণটা কী?

বিশ্বাসী মানুষের সেই এক কথা, সেই এক বিশ্বাস—যে করে আমার আশ আমি করি তার সর্বনাশ। সব কেড়েকুড়ে নিয়ে পথে বসিয়ে ছেড়ে দেন। সব মানুষকে ভোঁতা করে দেয়, স্থূল করে দেয়, অনুভূতিশূন্য দানব বানিয়ে ছেড়ে দেয়। সুখীমানুষ, ভোগীমানুষ না ঈশ্বরবাদী না নিরীশ্বরবাদী। তিনি বোঝেন, বাড়ি, গাড়ি, রোজগার, হাইপ্রেসার, লোপ্রেসার, সুগার হার্ট। পাড়ায় থাকেন একঘরে হয়ে। আত্মীয়স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন। বলা যায় না যদি কেউ কিছু চেয়ে বসে! কেড়ে না নিলে হাত দিয়ে জল গলে না। ভিখিরি যখন ট্র্যাফিক সিগনালে আটকে থাকা ধনী মানুষের ঝকঝকে গাড়ির সামনে হাত পাতে, তখন দাঁতখিঁচুনি ছাড়া প্রায়শই কিছু পায় না। তবে মাস্তান যখন পাঁচশো টাকার চাঁদার বিল বাড়িয়ে ধরে, তখন কান্নাহাসি মুখে ড্রয়ারে হাত চলে যায়। অনেকের ঘরের দেওয়ালে গুরুদেবের ছবি ঝোলে, মাল্যভূষিত, গুরুর নির্দেশ কেউ কিন্তু পালন করেন না।

ঈশ্বর সেই কারণেই না কী সুখ কেড়ে নেন। পাশ থেকে প্রিয়জনকে সরিয়ে নেন। যত রকমের দুর্বিপাক আছে সব ঢেলে দেন ঘাড়ের ওপর। মানুষ তখন আকাশের দিকে মুখ তুলে বলে, হা ভগবান! দুর্ভোগের বেদিতে তাঁর অধিষ্ঠান। হাবুডুবু না খেলে তিনি ঝুঁটি ধরে তোলেন না। পৃথিবীর তাবৎ দুর্ভাগা তাঁর কৃপাধন্য।

তবু সংশয় আসে। ঈশ্বর কী আছেন? না নিৎসের কথাই সত্যি, গড ইজ ডেড। ঈশ্বর ঠিকই আছেন। মারা যাননি। সভ্য মানুষের বিশ্বাসে তিনি মৃত। দু’কলম পেটে পড়ামাত্রই দাম্ভিকের প্রশ্ন, হু ইজ গড। গডফড আমি মানি না। ও সব কুসংস্কার। আবার যেই বদ্যি এসে বললেন, না মশাই, আমি ভালো বুঝছি না। সন্দেহ হচ্ছে ক্যানসার। একটা বায়পসি করা যাক। ক্যানসার? সে তো সারে না। আধুনিক অ্যালাপ্যাথিতে কোনও ওষুধ নেই। ভরসা দৈব। তখন নাস্তিক আস্তিক হয়ে গেলেন। পুরো বাহুতে ঝুলে গেল তাগা-তাবিজ। এসে গেল তান্ত্রিকের ওষুধ। বাড়িসুদ্ধ সবাই তখন ঘোরতর ঈশ্বরবিশ্বাসী। অনুসন্ধান শুরু হয়ে গেল, কোথায় সেই দৈব পুরুষ। যার অঙ্গুলিস্পর্শে দেহ রোগমুক্ত হয়। রোগের আবার মুক্তি কী? ভাইরাস অথবা ব্যাকটিরিয়া জম্পেস করে ধরেছে। এ তো বিজ্ঞান! হয় তারা ধীরে ধীরে শেষ করবে, না হয় তুমি তাদের শেষ করবে। কিছু আছে, অতি প্রবল। ধরলে আর রক্ষা নেই। কিন্তু দু:খের কথা, বিজ্ঞানের বাইরেও যে অনেক কিছু আছে। যে জানে সে জানে। ভেষজ আর দৈবে যে ক্যানসার ভালো হয়ে গেল, অভিজ্ঞ চিকিৎসক বললেন, কি জানি কী হল। আমরা তো বলেই দিয়েছিলাম। যাক সেরেই যখন গেছে তখন ও নিয়ে আর মাথা ঘামিয়ে কী হবে!

জ্ঞান আপেক্ষিক! আমার জ্ঞানের চেয়ে আর একজনের জ্ঞান অনেক বেশি হতে পারে। অর্থের মতো জ্ঞানও বর্জন করতে হয়। আমি দুই আর দুয়ে চার শিখেছি। কোয়ান্টাম থিওরির আমি কি বুঝব। আমার চোখ মাইলখানেক দূরের জিনিস দেখতে পায়। শক্তিশালী দূরবিন নক্ষত্রলোকের খবর রাখে। আমি যা জানি না, আমি যা দেখি না তা নেই, এমন আমি ভাবতে পারি, তবে তা হল মুর্খের ভাবনা।

পাঁচশো বছর আগে পৃথিবী অনেক ছোট ছিল। পৃথিবীর চারপাশে সূর্য ঘুরত। মানচিত্রের অধিকাংশই ছিল রহস্যময় এলাকা। মানুষের কল্পনায় এক এক এলাকা এক একরকম চেহারা নিত। যেমন পশ্চিমি মানুষের কল্পনায় ভারত ছিল বাঘ, ভাল্লুক, রাজা-মহারাজা, যাদুকরের ভুতুড়ে দেশ। আজ আর পৃথিবীতে একটিও অজানা, অচেনা দেশ নেই। এমনকি ডার্কেস্ট আফ্রিকাও অন্ধকার থেকে আলোয় সরে এসেছে। মানুষের পাঠানো উপগ্রহ পৃথিবীর চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে।

বাইরের জ্ঞান যত বাড়ছে ভেতরের জ্ঞান তত কমছে। মানুষ থেকে মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে। ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাস, বিজ্ঞানে বিশ্বাস মানে দানবীয় আচরণ করা নয়। অনেক টাকা রোজগার, মাল খাই, মেয়েছেলে চটকাই, গোটাকতক ডিগ্রি ডিপ্লমা আছে, সুতরাং আমি সব জানি। আমি যা বলছি সেইটিই শেষ কথা। বুদ্ধদেব ছিলেন এসকেপিস্ট, শ্রীচৈতন্য ছিলেন উন্মাদ, শ্রীরামকৃষ্ণ মুর্খ। স্বামী বিবেকানন্দ হ্যালুসিনেসানে ভুগতেন। তা হবে। একেই বলে মতুয়ার বুদ্ধি। আমি মরে ভূত হয়ে যাব। আমার কোনও চিহ্নই থাকবে না। ঠ্যাঙে দড়ি বেঁধে চিতায় চাপিয়ে দিয়ে আসবে। দেহের সঙ্গে সব পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। দ্বিতীয় কর্তা এসে টাটে বসবে। পাসবই হাতড়ে দেখবে জ্ঞানের ভুড়ভুড়ি ক্যাশে আর কাগজে কত রেখে গেছে। শ্রাদ্ধ একটা ঘটা করে হবে। একদল পাড়া-প্রতিবেশী হইহই করে এসে রইরই করে খেয়ে যাবে। মৃতের নিন্দে করতে নেই, তাই সকলে বলবে, আহা, এমন মালের আর দ্বিতীয় এডিশন হবে না। তা বাবা রাধাবল্লভিটা বেড়ে বানিয়েছে। একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছে। গরম গরম আর কয়েকখানা একবার ঘুরিয়ে দাও। আহা, আলুবকরার চাটনিটা বেশ জমেছে। খেজুরে, কিশমিশে জজবজ করছে। আমি তখন ভূত হয়ে কার্নিসে বসে, বায়ুর স্বরে বলব, খুব হয়েছে ব্যাটা এবার ওঠ। বেশ সাঁটিয়েছিস। রতনে রতন চেনে, ভাল্লুকে চেনে শাঁকালু। যেমন ছিলুম আমি, তেমনি ছিলে তোমরা। আমি মাঝরাতে হার্টের গড়গড়িতে টেঁসে গেলুম, আর কিছুকাল থাকলে আরও কত জ্ঞান দিতুম। আরও কিছু লোককে বাঁশ দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। প্রাণবায়ু অসময়ে পাংচার হয়ে বেরিয়ে গেল। রাত আড়াইটের সময় এঁটোপাতা নিয়ে কুকুরের খেয়োখেয়ি। যারা গান্ডেপিন্ডে গিলে গেল, তারা চিত হয়ে খাটে শুয়ে ভুঁড়িতে বউকে দিয়ে তেল মালিশ করাতে করাতে বললে, শালারা আজ ঘুমের বারোটা বাজালে। ঘুম না হলেই কাল সকালে বদহজম। একে নিরামিষ, তায় ঘুম নেই। শ্রাদ্ধে মাছমাংস করলে ক্ষতিটা কী। ভূত কুকুর তাড়াতে কার্নিস থেকে নেম এল। ফল হল উলটো। কুকুর স্পিরিট চেনে। তারস্বরে আরও চিৎকার জুড়ে দিল। আমার স্মৃতি ক্রমশই অস্পষ্ট হয়ে আসবে। অবশেষে ঝাপসা। এক ব্যাটা ছিল, এখন আর নেই। খুব রয়াবি ছিল। পাজামা আর মিহি পাঞ্জাবি পরে ছুটির দিন কাপ্তেনি করতে বেরত। কি না জানত, গদার থেকে রঁদাঁ। কেবল নিজের শেষটা জানত না।

বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীরা পদার্থবিজ্ঞানের এই চরম উন্নতির যুগে বলছেন, ঈশ্বর! তিনি কে, স্বর্গে অবস্থান, না মর্তে, জানা নেই। তবে এইটুকুই জানি, বিশাল এক শক্তি এই জগৎকারণের পেছনে নীরবে নিভৃতে কাজ করে চলেছে। সেই শক্তি হল চিৎশক্তি। একটা বিশাল, বিরাট ব্রেন। কোথায় লাগে মানুষের তৈরি বৃহৎ কম্পিউটার। সেই শক্তির যৎসামান্য প্রকাশ নিউক্লিয়ার ফিউসানে, আণবিক বোমার বিস্ফোরণে। ভারতীয় ঋষির সঙ্গে তাঁরা এখন সম্পূর্ণ একমত :

 He who, dwelling in all things

 Yet is other than all things,

 Whom all things do not know

 Whose body all things are

 Who controls all things from within

 He is your Soul, the inner Controller.

 The immortal

তপোবনচারী, ঋষিরা হাওয়া গাড়ি চড়তেন না, কোনও বড় ফার্মের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন না, পাটকল, কী কাপড়কল, অতএব আমাদের মতুয়াদের কাছে তাঁরা ছিল ইললিটারেট। টাইবাঁধা অ্যাংলোর কাছে ইংরিজি খিস্তি শেখেননি। ওদিকে ইংরেজ বিজ্ঞানীরা অনেক গবেষণার পর বলে বসলেন, [quantum theory and relativity theory-both force us to see the world very much in the way a Hindu, Buddhist or Taoist sees.]

[The parallels to modern physics appear in only in the Vedas of Hindusim, in the Ching, or in the Buddhist Sutras….]

কলেজি শিক্ষার যেটুকু জিয়ার্ডিক ছিবড়ে ভেতরে আছে, সেইটুকু সম্বল করে জগৎকারণের অনুসন্ধান। তেরো বাই বারো মাপের ঘরে একটা খাট। খাটে পনেরো টাকা দামের এক্সপোর্ট কোয়ালিটি বেডশিট। নিলামে কেনা রাজ্যের ফার্নিচার। তাকে সাজানো গোটাকতক পেপারব্যাক। এই মঞ্চে পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছি, আমি এক জ্ঞানদাস। মাউথপিস একবার ঘুরছে এঁচোড়েপাকা ছেলের দিকে, আর একবার খেঁকুরে মার্কা স্ত্রীর দিকে। বিনা প্রতিবাদে এই সব প্রাণী ছাড়া কে আমার কথা শুনবে। আমার তখত-এ-তাউস, পাড়ার চায়ের দোকান, অফিসের টেবিল। ওখানে বসে আমি ফুটবল খেলি। বেকেনবাওয়ারের খেলার ভুল ধরি। ওইটাই আমার ক্রিকেট পিচ। অলিম্পিক ক্ষেত্র। ওইখানে বসে আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ট চলচ্চিত্র বানাই। ওইখানে বসে এক-এক দিকপাল লেখককে তুলি আর ফেলি। ইন্দ্রিয়ের ঘুলঘুলিওয়ালা এই ঋষির পীঠস্থান, তপোবন হল চায়ের দোকান, অফিসের টেবিল, বন্ধুর বৈঠকখানা। বিজ্ঞানের খবরও রাখি না। আধ্যাত্মিকতার ধারও ধারি না। বিজ্ঞানী চেপে ধরলে কুঁইকুঁই। অতি বিজ্ঞানীরা সামনে অধোবদন। তীক্ষ্ম অনুসন্ধানী, আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে ভেতর ধরা পড়ে যায়। থরে থরে সাজানো অন্ধকার। সেই দৃষ্টির সামনে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র হতে হতে একেবারে পিপীলিকাবৎ। তখন আর নিজেকে খুঁজে পাই না।

 সেই ঘটনাটি মনে পড়ছে। ভূমিকম্পে জনপদ দুলছে। সমস্ত মানুষ ছুটে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। ফড়িং-এর মতো একটি লোক খুব বীরত্ব দেখাচ্ছে। ভূমিকম্প! ভয়ের কী আছে! ন্যাচারাল ফেনোমেনা। কয়েক সেকেন্ড দুলেই থেমে যাবে। পাশে দাঁড়িয়েছিল এক বৃদ্ধ, তিনি মৃদু হেসে বললেন, ছোকরা, সবই তো বুঝলুম, তবে কোনও রকমে প্যাণ্টটা যদি পরে আসতে পারতে। একেবারে উদোম হয়ে বেরিয়ে এসেছ!

ঈশ্বর। তিনি কে জানি না। এটুকুও যদি জানতুম, বৃহতের পদতলে আমি ক্ষুদ্রপ্রাণ এক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *