আগে বাংলা অনুষ্ঠানের জন্য একটা আলাদা চ্যানেল চাই
প্রশ্ন : সুনীলদা, প্রথমেই আপনাকে জিগ্যেস করি, দূরদর্শেনে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি কোণঠাসা বলে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, আপনি তাতে যুক্ত হতে গেলেন কেন?
উত্তর : বিবেকের দায়ে আমি এসেছি বলা যেতে পারে। বাংলা ভাষার একজন কর্মী হিসেবে বাংলার অপমান আমার গায়ে লাগে। অনেকেই আমাকে বলে যে আপনি তো আনন্দবাজারের লোক। আপনি এতে কেন? এর সঙ্গে আনন্দবাজার বা আমার চাকরির কোনও সম্পর্ক নেই।
প্রশ্ন : কোণঠাসা বলতে আপনারা ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন? ভারতের অন্যান্য দূরদর্শন কেন্দ্রগুলিতে অঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতির তুলনায়ও কি বাংলা অবহেলিত?
উত্তর : কোণঠাসা বলতে যা বোঝাতে চাইছি তা এই যে যাকে বলে ‘প্রাইম টাইম’ (৬টা থেকে ১০টা,) সেই সময়ে পশ্চিমবাংলায় বাস করে আমি কেন দূরদর্শনের কোনও একটা ‘চ্যানেলে’ বাংলা অনুষ্ঠান দেখতে পাব না? রেডিও-তে তো পাই। তার সম্বন্ধে তো এই অভিযোগ ওঠেনি। অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার ক্ষেত্রেও আমি মনে করি প্রত্যেকের নিজস্ব চানেল থাকা উচিত। গুয়াহাটি থেকে অসমিয়া, ভুবনেশ্বর থেকে ওড়িয়া ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচারিত হওয়া উচিত।
প্রশ্ন : এই যে ‘প্রাইম টাইমে’ হিন্দি অনুষ্ঠান দেখতে হয়,—এটাকে কি আপনি হিন্দির আগ্রাসন বলে মনে করেন?
উত্তর : নিশ্চয়ই।
প্রশ্ন : তা হলে কিন্তু আরও একটা প্রশ্ন ওঠে, দূরদর্শন তো কেবল নয়, হিন্দি চাপিয়ে দেবার এই চেষ্টা তো অন্যভাবেও হয়েছে। হিন্দি সিনেমা, গান, ক্যাসেট ইত্যাদি। দূরদর্শনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামলে, এসবের বিরুদ্ধেও তো কিছু বলতে হয়। নয় কি?
উত্তর : হিন্দি ভাষার বিরুদ্ধে আমার আপত্তি নেই। হিন্দি সাহিত্য আমি পছন্দ করি। কিন্তু কুরুচিপূর্ণ হিন্দি অনুষ্ঠান, যা দূরদর্শনে প্রচারিত হয়, আমার আপত্তি সেইখানে। আর হিন্দি সিনেমা, সে তো তুমি ইচ্ছে করলে নাও দেখতে পারো। ছেলেমেয়েদের নাও দেখাতে পারো। কিন্তু দূরদর্শন যে শয়নকক্ষে এসে হাজির হয়েছে। একে ঠেকানো যাবে কী করে? আপাতত তাই দূরদর্শন দিয়েই আন্দোলন শুরু হোক।
প্রশ্ন : আপনার কি মনে হয় যে দূরদর্শন সরকারি বলেই, এই বিক্ষোভ? অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, সরকারিভাবে কুরুচিপূর্ণ অনুষ্ঠান প্রচারিত হওয়ার বিরুদ্ধেও কি এই বিক্ষোভ?
উত্তর : সরকারের ভুল নীতিই এর জন্য দায়ী। বেসরকারি উপদেষ্টা কমিটি যদি থাকত, তা হলে তাঁরা ভাষা ও অনুষ্ঠানের মানের উন্নতির দিকে নিশ্চয়ই নজর দিতেন।
প্রশ্ন : এ ক্ষেত্রে, আরও একটা প্রশ্ন ওঠে, তা হল, দূরদর্শন কিন্তু অনেকটাই এখন বেসরকারি হাতে। বিজ্ঞাপনদাতা ও বেসরকারি প্রয়োজকের হাতে সময় বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এর পিছনে আছে রাজনৈতিক দলগুলির বহুদিনকার দাবি। সুতরাং আন্দোলন যদি করতেই হয় তা হলে বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে করতে হয় না?
উত্তর : না। বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে করতে হয় না। সময় বিক্রি করতে হলে, প্রথমেই শর্ত হবে আঞ্চলিক চ্যানেলগুলিতে আঞ্চলিক ভাষার অনুষ্ঠান করতে হবে। বাংলা সময় বিক্রি হয়ে গেল বোম্বাইয়ের কোম্পানির কাছে—যারা হিন্দি অনুষ্ঠান করবে, তা হবে না। তারপর সেই অনুষ্ঠানের মান কেমন হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আর একটা কথা, সময় বিক্রি হচ্ছে ঠিক কথা—কিন্তু সরকারি একটা নিয়ন্ত্রণও আছে।
প্রশ্ন : দূরদর্শন থেকে যে বাংলা অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়, সিনেমা এবং গান উপলক্ষে, আমরা দেখি যে বাঙালি শ্রোতা সে বস্তুকে বেশ উপাদেয়ই মানে করে। তা কিন্তু মূলত হিন্দিরই অনুকরণ। সে ক্ষেত্রে ভাষার প্রশ্ন বাদ দিলে, অনুষ্ঠানের গুণগত মান কিন্তু কিছু পালটাচ্ছে না। এবিষয়ে আপনি কী বলেন?
উত্তর : বাংলা অনুষ্ঠানের মান খারাপ। আমি সাধারণভাবে বলছি। দেশ সদ্য স্বাধীন হবার পর অনেকে বলত যে ইংরেজ রাজত্বই ভালো ছিল। বাংলা অনুষ্ঠান খারাপ বলাটা সেইরকমই মূর্খের মতো কথা। আসলে বাংলা অনুষ্ঠানের স্বাধীনতা এত কম—টাকা এত কম দেয়, হিন্দিকে জনপ্রিয় করার জন্য ইচ্ছে করে বাংলাকে কোণঠাসা করা হয়। যদি বাংলার অধিকারটা স্বীকৃত হয়, তা হলে বাংলা অনুষ্ঠানের মানেরও পরিবর্তন হবে। অনেক ভালো ভালো পুরোনো, নতুন বাংলা সিনেমা আছে। তার বদলে হিন্দির অনুকরণে তৈরি বাংলা সিনেমাই দেখানো হয়। বাংলা থিয়েটার কত উন্নত—কিন্তু দূরদর্শনের নাটক দেখলে, সে কথা একবারও মনে হবে?
প্রশ্ন : কথা হচ্ছে, বেসরকারি হাতে দূরদর্শনের চ্যানেল চলে গেলে, সাধারণ এবং অধিকাংশ দর্শক যা পছন্দ করেন, অর্থাৎ হালকা আমোদ-প্রমোদ—তাঁরা তাই দেখতে চাইবেন। কারণ তাঁদের মূল লক্ষ হবে মুনাফা—সুস্থ সংস্কৃতির প্রসার নয়।
উত্তর : ব্যবসা-বাণিজ্যর কথা আমরা চিন্তা করব না। ওটা আমাদের বিষয় নয়, অনুষ্ঠানের মানের উন্নতির জন্য দরকার হলে, দ্বিতীয় পর্যায়ে আন্দোলন শুরু হবে। কিছু কিছু হস্তক্ষেপ দরকারই।
প্রশ্ন : ‘দূরদর্শনে বাংলা চাই’—এই স্লোগান খুবই আন্তরিকতাপূর্ণ কিন্তু এটা তো বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। আজকে যে ‘খোলা বাজারের’ নীতি মেনে নেওয়া হয়েছে তাতে গোটা দুনিয়াকেই বাজার হিসেবে ভাবা হচ্ছে। ভারতও তার অংশীদার। এই গোটা নীতিরই একটা অংশ সংস্কৃতি। তাকে কী ভাবে আলাদা ভাবে চিন্তা করা যাবে? এই ব্যবস্থায় সংস্কৃতিও পণ্য মাত্র। এই ব্যাপারে কিন্তু প্রতিবাদ হয়নি। তাহলে আজ প্রতিবাদ করে কী হবে?
উত্তর : তুমি যা বললে, তার সঙ্গে আমাদের দাবির কোনও সংঘাত তো নেই। বাংলা ভাষায় একটা চ্যানেল থাকবে, তাতে আমি ইচ্ছে করলেই বাংলা অনুষ্ঠান দেখতে পাব—এই দাবির সঙ্গে ‘খোলা বাজারের’ নীতির কোনও বিরোধ নেই।
প্রশ্ন : আরও একটা কথা : আজকের দূরদর্শন কঠিন এক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মুখোমুখি। উপগ্রহের সাহায্যে বিদেশি অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ আছে। সে ক্ষেত্রে একটা চ্যানেল যদি বাংলাকে দেওয়াও হয়, তা হলে কি বাঙালি দর্শক-শ্রোতা তাতে মন দেবেন? এই প্রতিযোগিতায় বাংলা চ্যানেল টিকে থাকতে পারবে?
উত্তর : এই প্রতিযোগিতাতে নামতেই হবে। এখন তো, অসম প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতায় নামতেই দিচ্ছে না। তা হলে আর তার উৎকর্ষ প্রমাণিত হবে কী করে? তোমার কোনও ‘চয়েস’ থাকবে না কেন? এখনই বাংলা অনুষ্ঠান দুর্বল বলছ। সুযোগ না পেলে, আরও দুর্বল হবে। দূরদর্শনে লোক সংগীতের কোনও স্থানই প্রায় নেই। রবীন্দ্রসঙ্গীত কমতে কমতে প্রায় পাঁচ মিনিটে এসে ঠেকেছে। এভাবে কী হবে! যে হিন্দি অনুষ্ঠানের জন্য তিন লক্ষ টাকা বরাদ্দ সেই অনুষ্ঠান বাংলায় হলে পঞ্চাশ হাজার দেওয়া হয়। এ ভাবে কি কোনও প্রতিযোগিতা হয়? আর তুমি যে প্রশ্ন করছ, বাঙালি দেখবে কি না? আমি বলব বাঙালির মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি সেই অনুরাগ আছে। তার একটা প্রমাণ যখন ‘ন্যাশানাল প্রোগ্রাম’ হয়, তখন অনেক বাঙালিই বাংলাদেশ দেখেন, বাংলাদেশের অনুষ্ঠান ভালো হয় বলে অনেকেই মনে করেন। এর কারণ তাতে জোর দেওয়া হয়।
প্রশ্ন : বিদেশি প্রতিযোগিতাকে নিয়ন্ত্রণ করার ওপর জোর দিয়ে লোকসভায় বিল এসেছে। তার প্রতিবাদও শোনা গেছে। কেউ কেউ একে সেন্সরশিপের সঙ্গে তুলনা করেন। আপনি কি মনে করেন এই ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক বিল প্রত্যাহার করা উচিত?
উত্তর : বিলটা এখনও পর্যন্ত ঠিকমতো আকার পায়নি। চব্বিশ ঘণ্টা দেখাবে, এইরকম বিদেশি চ্যানেলকে যদি সময় দেওয়া হয়, তা সেন্সর করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। যেমন বিবিসি-র সংবাদ—তা কোথাওই সেন্সার করা যায় না। তা হলে তারা দেখাবেই না। বিলটা এখনও খুব স্পষ্ট নয় তাই মন্তব্য করতে পারছি না। এ ছাড়াও, অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। যেমন ধর, এখানে মদের বিজ্ঞাপন দেওয়া নিষেধ। কিন্তু স্টার টিভি-তে দেওয়া যায় এবং তা এখানে আমরা দেখছি। আমাদের বিজ্ঞাপনদাতারা কোটি কোটি টাকার বিদেশি মুদ্রায় সেইসব বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। সেটা আটকানো উচিত কি না, আগে সেই নীতি ঠিক করা দরকার।
যে প্রশ্নের উত্তর এখনও জানি না
বাংলাদেশ গেলে প্রত্যেক বারই একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। যার উত্তর আমি জানি না।
আমি সবজান্তা নই, ভালো ছাত্রও ছিলাম না। সুতরাং অনেক প্রশ্নেরই উত্তর আমার না-জানা হতেই পারে। কিন্তু এ এক এমন প্রশ্ন, যা শুনলেই অপরাধ বোধ হয়।
বাংলাদেশ ঘড়ির দিকে থেকে আমাদের চেয়ে আধ ঘণ্টা এগিয়ে। আমাদের এখানকার অনেক টিভি চ্যানেলে দুরকম সময় দেওয়া থাকে। কোনও অনুষ্ঠান এখানে সাড়ে ছ’টায় শুরু হলে বাংলাদেশে দেখা যাবে সাতটায়।
সত্যিই কি সেসব অনুষ্ঠান দু-দেশে একসঙ্গে দেখা যায়? এটা নিছক বিজ্ঞাপন নয়, সত্যি দেখা যায়। এখানকার কোনও কোনও অনুষ্ঠান বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়। এবং শুধু বাংলা নয়, হিন্দি চ্যানেলও পাওয়া যায় কয়েকটি। কিছু কিছু ধারাবাহিক সোপ দেখার নেশা আছে অনেকের। বেশ। কিন্তু বাংলাদেশ টিভি-র কোনও অনুষ্ঠানই কলকাতা কিংবা ভারতের কোথাও দেখা যায় না কেন? কেন এই বৈষম্য? এটাই সেই কঠিন প্রশ্ন।
এ প্রশ্নের উত্তর আমি এখানে অনেকের কাছে জানতে চেয়েছি। এমনকী দিল্লিতেও। কিন্তু কোথাও যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা পাইনি। আমাদের মতন, বাংলাদেশেও একটি সরকারি চ্যানেলের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বেসরকারি চ্যানেল রমরমিয়ে চলে। সেগুলি দেখার সুযোগ কেন পাব না আমরা? বেশ কিছু বছর আগে কিন্তু দিব্যি পাওয়া যেত। হুমায়ুন আহমেদের ধারাবাহিক নাটক দেখার নেশা জন্মে গিয়েছিল অনেকের, আমি জানি। কী করে সেসব বন্ধ হয়ে গেল, কোন কলা-কৌশলে, কার স্বার্থে? অনেকেই বলেন, রাষ্ট্রীয় ভাবে বাঙালি ও বাংলা দুভাগ হয়ে গেছে বটে, কিন্তু ভাষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে আমরা বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন হব না। এই কি তার নমুনা? এখন বাংলাদেশের কেউ কেউ যদি উগ্রভাবে দ্বিতীয় প্রশ্ন করে যে, এটা ওদেশের ওপর ভারতের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বা সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের চেষ্টা, তারই বা উত্তর দেব কী করে?
বই ও পত্র-পত্রিকার বিনিময় নিয়েও প্রশ্ন আছে। ভারত, বিশেষত পশ্চিম বাংলা থেকে প্রকাশিত যত বেশি সংখ্যক বই ও পত্র-পত্রিকা বাংলাদেশে যায়, সেই তুলনায় বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বই আসে অনেক কম। পত্র-পত্রিকা প্রায় কিছুই আসে না। এ প্রশ্নের উত্তর অবশ্য তেমন জটিল নয়। শুধু বিধিনিষেধ নয়, চাহিদারও একটা ব্যাপার আছে। হয়তো তা সময়সাপেক্ষ। বাংলাদেশের কোনও কোনও অতি জনপ্রিয় লেখকের বই পশ্চিম বাংলায় প্রকাশিত হলেও পাঠকদের মধ্যে এখনও তত বেশি আগ্রহের সৃষ্টি হয়নি। আবার এ কথাও ঠিক, পশ্চিম বাংলার কয়েকজন লেখকের রচনা বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে সমাদৃত। তবে, ওখানকার কিছু প্রকাশক এ সমস্যার এক সহজ সমাধান করে ফেলেছেন। পশ্চিম বাংলায় সেইসব লেখকের গ্রন্থ প্রকাশ মাত্রই ওদেশে জাল সংস্করণ বেরিয়ে যায়। তাতে মূল লেখক ও প্রকাশকের ভাগ্যে জোটে লবডঙ্কা! এমনকী কলকাতায় প্রকাশের আগেই ঢাকায় পাওয়া যায় জাল বই। কী করে? হয়, তা-ও হয়।
রক্তকরবী না শক্তকরবী?
সেবারে রবীন্দ্রনাথ সপরিবার গিয়েছেন শিলং। রথী আর প্রতিমা, কন্যা মীরা। মীরার মেয়ে বুড়ি আর রথীদের দত্তক কন্যা পুপে। এবং কাশী থেকে আনানো হয়েছে সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ রাণুকে। রাণু অধিকারী, পরবর্তী কালে লেডি রাণু মুখোপাধ্যায়। সেসময় এই উজ্জ্বল মেয়েটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিশেষ স্নেহ ও সখ্যের সম্পর্ক হয়েছিল। তাঁর সে সময়ের কোনও কোনও রচনায় এর ছায়াও লক্ষ করা যায়।
সেখানে রবীন্দ্রনাথ একটি নতুন নাটক লিখতে শুরু করেন। প্রাথমিক নাম দেন ‘যক্ষপুরী’। প্রধান চরিত্র তিনটি।
রবীন্দ্রনাথ ভালো অভিনেতা ছিলেন। নিজের নাটকে অভিনয় করেছেন বহু বার। নতুন নাটক লেখার সময় নিজের জন্যও একটা চরিত্র নির্মাণ করতেন। ঠাকুরদা কিংবা বৈরাগীর মতন গায়ক-অভিনেতা হিসাবে তিনি সার্থক। আবার ‘বিসর্জন’ নাটকে তিনি কখনও ‘জয়সিংহ’, কখনও ‘রঘুপতি’র মতন সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী দুটি ভূমিকায় অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। এই নতুন নাটকে তাঁর ভূমিকা কোনটি। গায়ক বিশু পাগল, না রাজা? বিশু পাগলে নাট্যবস্তু কম, রাজার চরিত্রেই ফুটেছে স্রষ্টার আসল ব্যক্তিত্ব ও কণ্ঠস্বর। আর মুক্তির দূতী নন্দিনীকে পুরোপুরি রাণুর আদল। আর কাহিনির নায়ক রঞ্জন-এর কল্পনা বিশ্বসাহিত্যেই দুর্লভ, সমগ্র নাটকে তার কোনও সংলাপ নেই। তাকে একমাত্র দেখা যাবে শেষ দৃশ্যে, মৃতদেহ রূপে। এই চরিত্র রচনার সময় কবির মনে লেওনার্ড এলমহার্স্ট নামে ইংরেজ যুবকটির কথা মনে এসেছিল, সে তখন শান্তিনিকেতনের পরিপার্শ্বে সাধারণ মানুষের মধ্যে সমাজসেবামূলক কাজে জড়িত এবং রাণুর সঙ্গেও খেলাধুলোতে উৎসাহী। এই নাটক মঞ্চস্থ করার অভিপ্রায় ছিল রবীন্দ্রনাথের, প্রথম দুটো চরিত্র তো ঠিক হয়েই আছে। আর রঞ্জনের চরিত্রে এলমহার্স্ট, ঠিক বাংলা উচ্চারণ করতে পারবেন না, তাই কি তার মুখে একটিও সংলাপ নেই?
তবে রবীন্দ্রনাথ এ নাটক মঞ্চস্থ করে যেতে পারেননি। আমরা যখন এই নাটক পড়ি, তখনই মনে হয়েছিল পাঠ্যনাটক হিসেবে অসাধারণ হলেও অভিনয়ে জমিয়ে তোলা খুবই শক্ত। তার প্রধান কারণ, প্রায় সব সংলাপই উপমাবহুল, কথ্য ভাষায় যা কৃত্রিম শোনাতে বাধ্য।
কিন্তু আমাদের সেই সংশয় চুরমার করে দিল বহুরূপীর ‘রক্তকরবী’ প্রোডাকশন। এখন তা ইতিহাস। বাংলার পেশাদারি থিয়েটারের প্রায় অবসান ঘটিয়ে সেই শুরু হল গ্রুপ থিয়েটারের জয়যাত্রা। এরপর পঞ্চাশ বছরে আরও কয়েকটি দল ‘রক্তকরবী’ মঞ্চস্থ করেছে। সেগুলি দেখতে গিয়ে বারবার আমাদের মনে এসেছে বহুরূপীর সেই প্রোডাকশনের সঙ্গে তুলনা। কানে ভেসে আসে শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্রের কণ্ঠস্বর।
সম্প্রতি ‘পূর্ব-পশ্চিম’ দলের ‘রক্তকরবী’ দেখার পর আমার মনে একটা খটকা লেগেছে। বারবার বহুরূপীর সঙ্গে তুলনা করাটা কি ঠিক? সত্যিই কি বহুরূপীর সেই প্রোডাকশন ততটাই সার্থক হয়েছিল, না এ আমাদের নিছক স্মৃতিকাতরতা? শম্ভু মিত্র এবং তৃপ্তি মিত্র, দুজনেরই কণ্ঠস্বর ও স্বরক্ষেপণ ছিল অ্যাফেকটেড, অস্বাভাবিক ও কৃত্রিম, যা অনেকটা আবৃত্তিসুলভ। একালের সচেতন অভিনেতারা সেই দুর্বলতা বা বিশেষত্ব থেকে মুক্ত। নন্দিনী রূপে তৃপ্তি মিত্রের তুলনায় চৈতী ঘোষালের আর্তি কি কম অভিঘাত তোলে? সেই ‘রক্তকরবী’তে সর্দারের ভূমিকায় কে অভিনয় করেছিলেন তা আমার মনে নেই। এখানে সৌমিত্র মিত্রের অভিনয় দেখে কোনও প্রতিতুলনা তাই মনে এল না। ভিলেনের ভূমিকায় অতিনাটকীয়তা এবং গর্জনটর্জন বর্জন করা সোজা কথা নয়। এই অভিনেতা চাপা অভিনয়ে এক অসাধারণ আদর্শ স্থাপন করেছেন। জালের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা রাজার সঙ্গে সর্দারের একটা সংঘর্ষের দৃশ্য। যা মূল নাটকে নেই, তা-ও সামান্য ইঙ্গিতে সংযুক্ত করে পরিচালক গৌতম হালদার (এঁর নামের পাশে ‘চলচ্চিত্র’ লেখা থাকে) বেশ সৌকর্যের পরিচয় দিয়েছেন। একটু বাড়াবাড়ি করলেই সবটা মাটি হয়ে যেতে পারত।
মোট কথা, সাধারণ ভাবে আমরা অনেক সময়েই মনে করি যে, আগেকার যা কিছু অনেক ভালো বা উন্নত ছিল (যেমন, আগেকার বাংলায় ছিল গোলা ভরা মাছ, পুকুর ভরা দুধ, গোয়াল ভরা ধান ইত্যাদি) সেই তুলনায় এখনকার সব কিছুই দুর্বল। এটা একপ্রকার অতীতচারী রোগ বিশেষ। যাঁরা পথপ্রদর্শক, তাঁরা যোগ্যতাতেও সর্বকালের শ্রেষ্ঠ না হতে পারেন, তবু তাঁদের কীর্তি একটুও ন্যূন হয় না। ‘ন্যূন’ কেটে দিয়ে ‘কম’ লিখলেও ক্ষতি কী?
যুগ্মপ্রচেষ্টা
শিবরাম চক্রবর্তী থাকতেন ঠনঠনে কালীবাড়ির কাছে মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে। এক মেসবাড়ির একখানা ছোট ঘরে। দেওয়াল ভরতি সব ঠিকানা লেখা। এক দিন মাঝরাতে খুটখাট আওয়াজে ঘুম ভাঙার পর দেখলেন, ঘরের মধ্যে একটা ছায়ামূর্তি। শিবরাম জিগ্যেস করলেন, কে? ছায়ামূর্তি স্মার্টলি উত্তর দিল, আমি একজন চোর স্যার। শিবরাম আবার জিগ্যেস করলেন, চোর তো এখানে কী করছ? সে বলল, কিছু টাকাপয়সা খুঁজছি। শিবরাম বললেন, টাকাপয়সা? দাঁড়াও, দাঁড়াও। আমি উঠছি। তারপর দুজনে ভালো করে খুঁজব।
বাঙালি কোথায় নেই? বাঙালি এখন কোথায়?
পাঞ্জাবের অমৃতসর শহরে, শিখদের অতি পবিত্র স্বর্ণমন্দিরের কাছেই জালিয়ানওয়ালাবাগ উদ্যান। সব শহরেই এরকম দু-চারটে পার্ক থাকে। জালিয়ানওয়ালাবাগের দৃশ্যত আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য নেই, তবু সারা ভারতের মানুষ এই বাগানটির নাম জানে (না, সব মানুষ নয়, শিক্ষিত শ্রেণির কিছু, এবং স্থানীয় লোকজন।) তার কারণ, ব্রিটিশ রাজত্বে নানান কুকীর্তির মধ্যে এই উদ্যানে এক দিনের ঘটনা অতি কলঙ্কের ইতিহাস হয়ে আছে আজও দগদগ করে।
সে ইতিহাস বিস্তৃত ভাবে বলার দরকার নেই, বর্তমানের প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ। সংক্ষেপে এইটুকু বলা যায়, প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে। বহু পাঞ্জাবি সৈনিক ইংরেজদের পক্ষ নিয়ে প্রাণ দিয়েছে সেই যুদ্ধে। যুদ্ধ চলার সময় ভারতে স্বায়ত্তশাসনের টোপ দেওয়া হয়েছিল। যুদ্ধ শেষে সেসব আর উচ্চারণও করে না শাসকরা। বিক্ষুব্ধ, অশান্ত পাঞ্জাবে চলছে ধরপাকড়, গ্রেফতার হয়েছেন গান্ধিজি, অমৃতসরে সবরকম জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এরই মধ্যে, এপ্রিলের ১৩ তারিখ (১৯১৯ সাল) বৈশাখী পূর্ণিমা, গ্রাম থেকে দলে দলে মানুষ আসে শহরে, তারা ওই সব ১৪৪ ধারা-টারার কথা জানে না। তারা অনেকেই এসে জড়ো হয়েছে ওই পার্কে, একটা মঞ্চও বাঁধা হয়েছে। পার্কটা এমনই যে বাইরে থেকে দেখা যায় না, দুপাশের বাড়ির মধ্য দিয়ে একটা সরু প্রবেশ পথ, চার দিকে বড় বড় বাড়ি ও দেওয়াল, বেরোবার রাস্তাও ওই একটাই। হঠাৎ এক সময় জেনারেল ডায়ার নামে এক বীরপুঙ্গব তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে এসে ওই পথটা আটকাল। জনতাকে ছত্রভঙ্গ হওয়ার জন্য কোনও সাবধানবাণীও উচ্চারিত হল না, হুকুম দিল গুলি চালাবার। সেই বীভৎস দৃশ্য কল্পনা করাও শক্ত, প্রতিবাদহীন, নিরস্ত্র, নিরিহ মানুষ, নারী, শিশু, বৃদ্ধ তাদের খুন করতে পারে মানুষই? কান্না, আর্ত চিৎকার, হুড়োহুড়ির মধ্যে সরকারি হিসেবেই মৃত্যু হয় ৩৭৯ জনের। আহত কয়েক হাজার। বেসরকারি মতে, মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। সৈন্যদের বন্দুকের গুলি ফুরিয়ে গিয়েছিল বলেই তারা সবাইকে হত্যা করতে পারেনি।
ব্রিটিশ সরকারের এমন বর্বরতার কাহিনি সারা দেশ জানতে পারেনি, কারণ তখন সমস্ত সংবাদপত্রে কঠোর ভাবে সেন্সরশিপ জারি ছিল। ক্রমশ প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে কিছু কিছু তথ্য নেতাদের কানে আসে। কিন্তু তাঁরা তখনই কোনও প্রতিবাদ-আন্দোলন করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, কারণ তখন ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে কিছু কিছু ক্ষমতার দরাদরির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল।
রাজনৈতিক নেতারা আবেগে চালিত হন না। কিন্তু এক কবিকে এই ঘটনা দারুণ ভাবে বিচলিত করেছিল। রবীন্দ্রনাথ তখন গান্ধিজি ও চিত্তরঞ্জন দাশকে এর প্রতিবাদের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ওঁরা এড়িয়ে যান। এক নিদ্রাহীন রাত্রির পর রবীন্দ্রনাথ নিজেই এককভাবে জ্বলন্ত ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়ে জরুরি চিঠি পাঠান ভারতের বড়লাটকে, তাঁর নাইটহুডও ফিরিয়ে দেন।
হঠাৎ এত দিন পর এই প্রসঙ্গ কেন? এখন রবীন্দ্রনাথের জন্মের দেড়শো বছর উপলক্ষে নানান অনুষ্ঠান হচ্ছে সারা দেশ জুড়ে। তারই অঙ্গ হিসেবে একটি কবি-সম্মেলনের আয়োজন করা হয় ওই জালিয়ানওয়ালাবাগ উদ্যানের মধ্যেই ম্যারাপ বেধেঁ। সারা দেশ থেকে নানান ভাষার কবিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, কলকাতা থেকে গিয়েছিলেন অমিতাভ চৌধুরী। প্রতিবাদ নয়, রবীন্দ্রনাথের প্রতি কবিদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। সাহিত্য অকাদেমির এই পরিকল্পনা খানিকটা অভিনব তো বটেই।
প্রথম দিনের অনুষ্ঠান শেষে ফেরার সময় একটা তথ্য দেখে আমি চমকে উঠলাম। সেই বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে, নারকীয় তাণ্ডবের মধ্যে একজন বাঙালিও ছিলেন! তাঁর নাম ডাক্তার ষষ্ঠীচরণ মুখোপাধ্যায়, গুলি চালনার সময় তিনি কোনওক্রমে মঞ্চটার তলায় ঢুকে পড়ে প্রাণে বেঁচে যান। পরে তিনি ওই উদ্যানটিতে নিহতদের স্মৃতিরক্ষা ব্যবস্থায় অগ্রণী হয়েছিলেন। ওঁরই বংশধর সুকুমার মুখোপাধ্যায় এখনও সপরিবারে ওই পার্কের প্রবেশ পথের ধারেই এক বাড়িতে থাকেন, একতলার একটি ঘরে একটা সংগ্রহশালাও চালাচ্ছেন।
এইসব দেখতে দেখতে আমার এক সঙ্গী সবিস্ময়ে বলে উঠল, বাঙালি কোথায় নেই?
ঠিক। তবে, এই কথাটা শুনলেই আমার মনে হয়, বাঙালি এখন কোথায়?
কবিতা লেখার জন্য কারাগারে
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কেটে গেল তেষট্টি বছর। এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য কত মানুষ আত্মত্যাগ করেছে, সেসব এখন ইতিহাস। অনেকে ইতিহাসেও স্থান পাননি। আন্দামানের জেলে ১৬০০ রাজবন্দির নাম দেখেছি, তাঁদের ক’জনের কথা লোকে মনে রেখেছে? মনে রাখা স্বাভাবিকও নয়।
কিন্তু কবিতা লেখার জন্য যাঁদের কারাবরণ করতে হয়েছিল, তাঁদের কথা একেবারে ভুলে যাওয়া অন্তত সাহিত্যজগতের পক্ষে অনুচিত। বাঙালিদের মধ্যে সেরকম ক’জন ছিলেন তার একটি তালিকা প্রস্তুত করার ভার কি কেউ নেবে?
সেরকমই এক জনের নাম দয়াল কুমার, এ বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘বিংশ শতাব্দী’ বাজেয়াপ্ত হয়েছিল এবং ‘১৯০৮ আর ১৯৩১’ শীর্ষক একটি কবিতার জন্য তিনি কারারুদ্ধ হয়েছিলেন তিরিশের দশকে। তার পরেও তিনি কয়েক বার জেল খেটেছেন, এমনকী দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও।
দয়াল কুমার প্রায় সারা জীবনই ছিলেন রাজনীতির সঙ্গে বিশেষ ভাবে জড়িত। দেশ সেবার আদর্শে তিনি প্রথম দিকে ছিলেন গান্ধিজির প্রতি আকৃষ্ট, তারপর সাম্যবাদী আর কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। চুঁচড়োয় বাড়ি, তিনি ছিলেন সেই অঞ্চলের সকলের পরিচিত দয়ালদা। তাঁর পরিবারটি ছিল সেকালের কমিউনিস্টদের একটি আর্দশ প্রতিচ্ছবি। তাঁর স্ত্রী মুক্তাও ছিলেন সমাজকর্মী, ছেলেমেয়েদেরও রাজনীতির সংস্পর্শ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়নি। দারিদ্র ছিল নিত্যসঙ্গী। বিষয় ভোগ কিংবা ক্ষমতার লোভ এইসব মানুষের মধ্যে সামান্যতম স্থানও পেত না, বরং দারিদ্র্য নিয়ে অহংকার ছিল। নজরুল ইসলামের লেখা—’হে দারিদ্র তুমি মোরে করেছো মহান’—অনেকে জীবন দিয়ে বিশ্বাস করতেন। অভাবে সংসার, অনেকগুলি ছেলেমেয়ে, তবু স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে যখন ভারত সরকার তাঁকে পেনশন ও তাম্রপত্র দিতে চায়, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
দয়াল কুমার ছিলেন নজরুল ইসলামের খুব ভক্ত, সেই ধারারই কবি। এ কালের দৃষ্টিভঙ্গিতে তাঁর রচনাগুলি কতটা স্লোগানধর্মী আর কতটা কাব্যরসসম্পৃক্ত, তা নিয়ে মতভেদ হতেই পারে। কিন্তু এমন মানুষের জীবন অবশ্যই এখনও স্মরণীয়।
এবং অধৃষ্য কুমার
দয়াল কুমারের এক সন্তান তাঁর বাবার আদর্শকেও ছাড়িয়ে নকশালপন্থী নেতা হয়ে ওঠেন সেই ষাট-সত্তরের দশকে। ধরা পড়ে জেলও খেটেছেন। পরিচিতরা অনেকেই তাঁর নাম বলতেন, এখনও বলেন, অদৃশ্য কুমার। শুনলেই মনে হয় ছদ্মনাম। কিংবা কোনও রোমহর্ষক ডিটেকটিভ গল্পের প্রতিনায়ক। তা কিন্তু নয়, কুমার এঁদের পারিবারিক পদবি, প্রথম নামটি অদৃশ্য নয়, অধৃষ্য। সংস্কৃতগন্ধী হলেও এটা একটা বাংলা শব্দ, কেন না বাংলা অভিধানে স্থান পেয়েছে। এর অর্থ, যাকে দমন করা যায় না।
আগামী বছরে দুর্গোৎসব হবে ডিসেম্বর মাসে
তাহলে এটাই ঠিক হল যে আগামী বছরে দুর্গাপুজো আর উৎসব হবে ডিসেম্বর মাসে।
আমাদের আকাশ তো জানিয়েই দিয়েছে যে সেপ্টেম্বর আর অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত কোনও উৎসব সম্ভব নয়। পরপর পাঁচ বছর দুর্গোপুজোর সময় বৃষ্টি হয়েছে। বাচ্চাকাচ্চাদের আনন্দ মাটি, পুজোর উদ্যোক্তাদের অসুবিধের একশেষ। তার চেয়ে ডিসেম্বর মাসে বাতাস অতি মনোরম, পরীক্ষাটরীক্ষা শেষ, ফসলও তোলা হয়ে যায়, সেই তো উৎসবের উপযুক্ত সময়। আবহাওয়াবিদদেরও মত এই যে, বর্ষাকাল ক্রমশ বিলম্বিত হচ্ছে। তবে সেই বর্ষা আর যাই হোক, ডিসেম্বর মাসকে ছুঁতে পারবে না।
শারদীয় দুর্গোৎসবকে বলা হয় অকালবোধন। এর সঙ্গে রামায়ণের কাহিনি জড়িত। এ সম্পর্কে ভুল ধারণাও অনেক। একটি বেশ বড় গোছের পুজো কমিটির কর্তাব্যক্তিকে বলতে শুনেছি, সমুদ্রের বুকে সেতুবন্ধনের সময় রাম দেবী দুর্গার অকালবোধন করেছিলেন। বলাই বাহুল্য, তিনি রামায়ণ পড়েননি। এজন্য তাঁকে বিশেষ দোষও দেওয়া যায় না। অনেকেই তো এখন রামায়ণ পড়েন না। টিভি সিরিয়াল দেখেন। কোনও সিরিয়ালে এসব আছে কি না জানি না। বাল্মীকির রামায়ণে এরকম কিছু নেই। সেই মহাকাব্যের রাম সমুদ্রকে শাসন করার জন্য জগৎ কম্পিত করে বজ্রনাদে শর মোচন করেছিলেন, যাতে মহার্ণব একেবারে শুষ্ক হয়ে যায়। তখন স্বয়ং সমুদ্র এসে কৃতাঞ্জলি হয়ে রামকে সেতুবন্ধনের পরার্মশ দেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণেও প্রসঙ্গটি প্রায় একইরকম।
বাল্মীকির সঙ্গে কৃত্তিবাসের প্রধান প্রভেদ রাবণ বধের বৃত্তান্তে। মূল রামায়ণেও যোদ্ধা হিসাবে রাবণের প্রতি খানিকটা অবিচার করা হয়েছে। রামকে সাহায্য করতে এসেছেন অনেক দেবতা ও মহর্ষি। ইন্দ্র পাঠিয়েছিলেন বহু অস্ত্রশস্ত্র সমেত রথ ও সারথি মাতলিকে আর অগস্ত্য মুনি এসে শিখিয়েছিলেন আদিত্যহৃদয় নামে এমনই স্তোত্র, যাতে যুদ্ধে জয় হবেই। রাম স্নান-টান করে সূচি হয়ে সুর্যের উদ্দেশে তিন বার সেই স্তোত্র পাঠ করলেন। রামের পুজো বলতে এইটুকুই। তারপর আর রাবণ বধের বেশি দেরি হয়নি।
কৃত্তিবাস রাবণ বধ পালাটি অনেকখানি বিস্তারিত করেছেন। রাম-রাবণের ঘোর যুদ্ধের সময় রাবণ অম্বিকার স্তব করে পেলেন তাঁর দয়া ও অভয়। আর রাবণের রথে সেই দেবীকে দেখে রাম চরম হতাশ হয়ে ধনুর্বাণ ফেলে দিলেন। এখন উপায়? বাঙালির মতন এখানে রাম খুব কান্নাকাটি করেছেন। তারপর ব্রহ্মার পরামর্শে রাম করেছেন ‘অকাল শরতে কৈল দেবীর বোধন’। এখানেই সেই একশো আটটি নীল পদ্ম উৎসর্গের কাহিনিও আছে। রাম এখানে মৃন্ময়ী মূর্তি গড়িয়েও পুজো করলেন। (মহাকবি কৃত্তিবাস সম্ভবত জানতেন না যে, রামায়ণ-মহাভারতের আমলে মূর্তি পুজোর কোনও রীতি বা বিধিই ছিল না।)
যাই হোক, সেই দৃষ্টান্তেই প্রতি বছর শরৎকালে মহিষমর্দিনী দেবী দুর্গার মূর্তি পুজোর প্রবর্তন। এখানে একটা সামান্য প্রশ্ন আছে। শাস্ত্র মতে, শরৎকাল সূর্যের দক্ষিণায়ন, তখন দেবতাদের ঘুমের সময়। রাবণ বধের জন্য রাম বাধ্য হয়ে অসময়ে দেবীর আরাধনা করতে বাধ্য হন। আমরা এখন যে দেবী দুর্গার পুজো করি, তাঁর সঙ্গে তো রাবণ বধের কোনও সম্পর্ক নেই, এই দেবী তো মহিষাসুরকে বধ করতে উদ্যত এবং তিনি চিরজাগ্রত। সুতরাং এখন তো তাঁর পুজো যে-কোনও সময়েই হতে পারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই বদলায়, ঋতুও বদলায়, আর উৎসবের সময় বদলাতে পারে না? বাংলার আর একটি বড় উৎসব ঈদ পালিত হয় চন্দ্রমাস অনুযায়ী, সেই উৎসবের তারিখও প্রতি বছরই বদলে যায়।
অনেককের মুখেই এরকম দাবি শোনা যায়। আগেও অনেক লেখালেখি হয়েছে। এই তো কিছুদিন আগে পত্রান্তরে নন্দদুলাল রায়চৌধুরী নামে একজন লেখক বিস্তৃত ভাবে লিখেছেন।
পঞ্জিকাকার, বিশিষ্ট পুরোহিতগণ কিংবা বারোয়ারি পুজোর উদ্যোক্তাবৃন্দ কারা এই পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেবেন, তা অবশ্য আমি জানি না।
পুলিশ কেন আসে না?
সকাল এগারোটা। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ছুটছে গাড়ি। ছায়া ছায়া দিন, মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। এই মসৃণ রাজপথটি অতি সুগম, শান্তিনিকেতন পৌঁছে যাওয়া যায় সাড়ে তিন ঘণ্টার মধ্যে। আমাদের দেশে একশো দশ-কুড়ি কিলোমিটার বেগে গাড়ি চলবে, এ কথা কয়েক বছর আগে আমরা স্বপ্নেও ভাবেনি।
হঠাৎ গাড়ির গতি কমে এল। তারপর নিশ্চল। সামনে ও শেষে আছে গোটা পঞ্চাশেক। উলটো দিকটা ফাঁকা। অর্থাৎ দুদিকের পথই বন্ধ। ক্রমশ শোনা গেল, সামনে এক জায়গায় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। খুবই মর্মান্তিক। একটি মোটর সাইকেলের ধাক্কায় এক জন পথচারী প্রাণ হারিয়েছেন। কেউ কেউ বলল বটে যে ঠিক নিহত নয়, আহত, তার সত্যি-মিথ্যে বোঝা দুষ্কর, কারণ, অকুস্থলটি বেশ দূরে। শোনা গেল, কিছু কিছু গাড়ি ভাঙচুর হচ্ছে সেখানে।
যাদের স্বজন হারিয়েছে, তাদের শোক-দুঃখ থেকে ক্রোধের উদয় হওয়া স্বাভাবিক। বেছে বেছে যে শুধু মোটর সাইকেলই ভাঙা হবে তার কোনও মানে নেই। যাদের গাড়ি নেই, গাড়িওয়ালা লোকদের সম্পর্কে তাদের রাগ বা কিছু একটা থাকতেই পারে। দলে দলে গ্রাম থেকে ছুটে আসছে মানুষ। এ-দিককার কিছু গাড়ির চালক বা যাত্রীও কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেছে সামনের দিকে। এরপর কী হবে, পুলিশ এসে নিশ্চয়ই পরিষ্কার করে দেবে এই ব্যস্ত রাস্তাটি! হঠাৎ কৌতূহলীরা অনেকে যেন প্রাণভয়ে দৌড়ে ফিরে আসতে লাগল, ওদিকে নাকি ইট-পাথর ছোড়াছুড়ি শুরু হয়ে গেছে। কেউ বলল, গ্রামবাসীরা নাকি এ দিকেই তেড়ে আসছে।
খবরের কাগজে প্রায়ই পড়ি, কোথাও এমন গণ্ডগোল হলে পুলিশের খবর পেতে পেতেই নাকি দু-তিন ঘণ্টা কেটে যায়। কিংবা গড়মসি করে পুলিশ আসে না। দিনের বেলা এমন প্রকাশ্য রাস্তায় পুলিশের খবর না পাওয়ার তো কোনও কারণ নেই। এর মধ্যে নানান গাড়ির নানান রকম প্যাঁপ্যোঁ শুরু হল, যে যে-দিকে পারছে গাড়ি ঘোরাচ্ছে। আমাদেরও আর এখানে অপেক্ষা করাটা সুবিবেচনার পরিচয় হবে না, এরপর গাড়িতে গাড়িতে ঠোকাঠুকি লাগবে, আমাদের গাড়ির চালক খুব দক্ষতার সঙ্গে গাড়িটি উলটোদিকে নিয়ে যেতে সমর্থ হল। এখন ছোটখাটো গ্রাম্য রাস্তা ধরে বর্ধমানের দিকে যাওয়াটাই যুক্তিযুক্ত হবে।
উলটোদিকে কিছুটা যাওয়ার পর একটা সেতুর তলা দিয়ে ডান দিকে ঘোরা যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে জনা পাঁচেক পুলিশ। সঙ্গে তাদের গাড়ি। এরা এখানে দাঁড়িয়ে কি ভেরেণ্ডা ভাজছে? এগিয়ে গিয়ে গণ্ডগোলটা থামাচ্ছে না কেন?
কারণটা পরের মুহূর্তেই জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। ও-দিকে পঞ্চাশ-ষাট জন উগ্র মেজাজের মানুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে ঘুরছে, ইট-পাটকেল ছুড়ছে, সেখানে এই পাঁচ জন পুলিশ গিয়ে কী করবে? বেধরক মার খাবে। এদের কোমরে রিভালভার আছে বটে, কিন্তু উত্তেজিত জনতার দিকে গুলি চালানো এখন প্রায় নিষিদ্ধই বলতে গেলে। তাই পুলিশের প্রতি তাদের ভয় বা সমীহ নেই। পুলিশকে ইট মারতে তারা দ্বিধা করে না।
পুলিশ তাই নিরাপদ দূরত্বে ব্রিজের তলায় দু-তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করে। বেলা পড়লে খিদের তাড়নায় জনতা এমনিতেই অনেকটা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে। তারপর যাবে পুলিশ।
তুমি মনস্থির করো
অত্যন্ত অশান্ত, অস্থির আর যার একেবারেই মনস্থির নেই, এটা সেই লেখিকার কবিতার বই। নবনীতা দেব সেন। এই বিদূষী, প্রতিভাময়ী লেখিকাটি সম্পর্কে এক দিন শোনা যাবে, ইনি খুবই অসুস্থ। পরের দিন শোনা যাবে, তিনি আলাস্কায় চলে গেছেন কোনও অভিযানে।
এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই ছোট ছোট, স্ফুলিঙ্গধর্মীয়। শেষ কবিতাটি এরকম :
তুমি যতো বলো,
”চিরদিন চিরদিন”
আমি শুনি শুধু
”আজকেই আজকেই!”
মঞ্চে আবার যেন সোনালি যুগ
পাথুরিয়াঘাটার প্রখ্যাত প্রয়াত প্রসন্নকুমার ঠাকুরের দৌহিত্র নগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের শখ হয়েছিল, তিনি একটা নতুন মঞ্চ নির্মাণ করে থিয়েটার চালাবেন। নিতান্ত ব্যবসার কারণে নয়, উচ্চাঙ্গের নাটকের অভিনয়, যা ইংরেজদের থিয়েটারের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে। এ জন্য তিনি প্রায় নির্বাসন থেকে ফিরিয়ে আনলেন গিরিশচন্দ্রকে।
স্টার থিয়েটার গড়ে তোলার জন্য অভিনেত্রী বিনোদিনীকে শরীর বিক্রয় করতে হয়েছিল। সেই বিনোদিনীকেও এক সময় স্টারের সঙ্গে সংস্রব ত্যাগ করতে হয়। আর গিরিশচন্দ্রও এক সময় তাঁর অতিপ্রিয় স্টারের জন্য মস্তক বিক্রয় পর্যন্ত করেছিলেন। তাঁকেও বিতাড়িত হতে হয় সেই মঞ্চ থেকে। সে সব কাহিনি এখানে অপ্রাসঙ্গিক। অপমানিত গিরিশচন্দ্র থিয়েটারের জগৎ থেকেই দূরে সরে গিয়েছিলেন। কিন্তু মঞ্চ-মায়ায় যিনি একবার আবদ্ধ হয়েছেন, তাঁর পক্ষে কি বেশিদিন এই অভিমান টিকিয়ে রাখা সম্ভব? নগেন্দ্রবাবুর প্রস্তাবে তিনি আবার পাদপ্রদীপের সামনে ফিরে আসতে রাজি হলেন। শুধু নাট্যকার হিসেবেই নয়, অনেক কাল পর তিনি আবার ধরাচুড়ো পরে অভিনয়ও করবেন।
ইংরেজদের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার জন্য উপযুক্ত নাটক চাই। তাই অনেক পরিশ্রমে গিরিশচন্দ্র অনুবাদ করলেন শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ-এর মতো শক্ত নাটক। ভাবানুবাদ নয়, একেবারে সাহেব-মেমদের মতো পোশাক পরে, উপযুক্ত সেটে অনুষ্ঠান। গিরিশচন্দ্র স্বয়ং সাজলেন ম্যাকবেথ। নতুন মঞ্চটির নাম মিনার্ভা। সেখানে ম্যাকবেথের প্রথম অভিনয় হয়েছিল ২৮ জানুয়ারি, ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ।
তার পর তো এতগুলি বছরে মিনার্ভা থিয়েটার অনেক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে গেছে। একবার আগুনে ভস্মীভূত হয়েছিল। তার পরেও জোড়াতালি দিয়ে মাঝে মাঝে চালাবার চেষ্টা হয়েছিল। ইদানীং একেবারেই পোড়োবাড়ির হাল হয়েছিল। সরকারি উদ্যোগে আবার আমূল সংস্কার করে, পুরোনো রূপটি অনেকটা ফিরিয়ে এখন চালু করা হয়েছে। এবং মঞ্চস্থ হচ্ছে শেক্সপিয়রেরই অন্য একটি নাটক, ‘কিং লিয়ার’। প্রধান ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। একশো সতেরো বছর পর পুনর্নির্মিত মিনার্ভাকে জীবন্ত করে তোলার জন্য আবার শেক্সপিয়রেরই নাটক মঞ্চস্থ করা উদ্যোক্তাদের পরিকল্পিত কি না তা জানি না। তবে শুনেছি, রাজা লিয়ারের ভূমিকায় অভিনয় করার শখ সৌমিত্রর অনেক দিনের। অনেক কাল আগে অধ্যাপক সুনীল চট্টোপাধ্যায়ের অনূদিত রূপটিই খানিকটা মাজা-ঘষা করে নেওয়া হয়েছে।
কেমন হয়েছিল গিরিশচন্দ্রের সেই প্রোডাকশন? সেই সময় তিনি হাঁপানিতে ভুগছিলেন। তবু নাকি তিনি সিংহবিক্রমে দাপাদাপি করেছেন মঞ্চে। দেশীয় অনেক জ্ঞানী-গুণী ম্যাকবেথের প্রভূত প্রশংসা করেছিলেন তো বটেই, এমনকী সাহেবদের পত্রিকা ‘দি ইংলিশম্যান’ পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল যে, বাঙালির এই প্রশংসনীয় উদ্যম ইংরেজদের মঞ্চের সঙ্গে তুলনীয়।
কিং লিয়ারের এই প্রোডাকশন সম্পর্কে এ কালের ইংলিশম্যানরা কী বলছেন জানি না, তবে আমি বা আমার মতো অনেকেই এমনই অভিভূত যে মনে হয়েছে, দেশ-বিদেশের অন্য অনেক শেক্সপিয়র নাট্য প্রযোজনার সঙ্গে মিনার্ভার এই অনুষ্ঠানের তুলনা তো অনায়াসেই করা যায়, এমনকী এটি হয়তো উৎকৃষ্টতর। কী অসাধারণ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়, কোনও প্রশংসাই যেন যথেষ্ট নয়। এক কালের বাংলা সিনেমার সেই রোমান্টিক প্রেমিক, সত্যজিৎ রায় যাঁকে বহু ভাবে ব্যবহার করেছেন, উত্তমকুমারের পাশাপাশি যাঁর নাম উচ্চারিত হয়েছে, অনেক পথ পেরিয়ে এসে সেই সৌমিত্র এখন বাংলা মঞ্চের রাজা। একের পর এক নাটক মঞ্চস্থ করে যাচ্ছেন, বিভিন্ন আঙ্গিকে। ‘হোমাপাখি’ কিংবা ‘তৃতীয় অঙ্ক, ‘অতএব’-এর তুলনায় কিং লিয়ারের ভূমিকায় তাঁর সম্পূর্ণ অন্য রূপ। দার্ঢ্য ও করুণ রস সমানভাবে পাশাপাশি। গিরিশচন্দ্র যখন ‘ম্যাকবেথ’ করেন তখন তাঁর বয়স ঊনপঞ্চাশ। এরপর তিনি আর বিশেষ কোনও নতুন নাটকে মঞ্চাবতরণ করেননি। আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বয়স এখন ছিয়াত্তর। তবু তাঁর পরিশ্রম করার কী অসীম ক্ষমতা, কত দিকে ছড়িয়ে রেখেছেন নিজেকে।
কিং লিয়ার নাটকে অনেক চরিত্র। শুধুমাত্র নায়কের অভিনয় নৈপুণ্যে এমন নাটক সার্থক হতে পারে না। সে কৃতিত্ব পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়ের। আমরা আগেই লক্ষ করেছি, (যেমন ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’) মঞ্চে বহু চরিত্রের উপস্থিতি নিখুঁতভাবে চালনা করায় সুমন বিশেষ দক্ষ। এই নাটকেও এত চরিত্র, ইংরেজ ও ফরাসি সৈন্য সমেত। কোথাও তাদের পোশাক ও পদক্ষেপের ভ্রান্তি চোখে পড়ে না। অন্যান্য অভিনেতাও যথেষ্ট পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। সেটটিও চমৎকার।
এই নাটক দেখার পর এ কথাও অবশ্যই মনে আসে, সম্প্রতি যেন বাংলার নাট্যজগতে আবার একটা সোনালি যুগ এসেছে। বছরে একটা দুটোও বাংলা সিনেমা দেখার যোগ্য হয় কি না সন্দেহ। কিন্তু মঞ্চ-নাটকগুলির প্রয়োগ, অভিনয়, শিল্পগুণ অনেক উন্নতমানের। মফসসলের দলগুলিরও অনেক প্রয়াস অভিনব।
এক সময় বাংলার তুলনায় মহারাষ্ট্রের থিয়েটার আন্দোলন অনেকটা এগিয়ে ছিল। এখন যেন সেখানে খানিকটা ঝিমোনো ভাব এসেছে। বাংলার নাট্যজগৎ এখন বেশ চাঙ্গা। প্রবীণদের মধ্যে নান্দীকারের রুদ্রপ্রসাদ ও স্বাতীলেখা এখনও সমান সক্রিয়। সদ্য-প্রয়াত কুমার রায়ের বহুরূপী দলও নতুন নাটক মঞ্চস্থ করে চলেছে। মারীচ সংবাদ-এর অরুণ মুখোপাধ্যায়কেও দেখা যায়, কখনও সখনও। আর বিভাস চক্রবর্তী নিজের দল ছাড়াও অন্য অনেক দলের সার্থক পরিচালক। মেঘনাদ ভট্টাচার্য পরিচালক ও অভিনেতা হিসাবে সার্থক। উষা গঙ্গোপাধ্যায়ের রঙ্গকর্মী-র নতুন নতুন প্রোডাকশন বাংলা বা হিন্দিতে খুবই উল্লেখযোগ্য। ব্রাত্য বসু একই সঙ্গে নাট্যকার, পরিচালক ও অভিনেতা—এই তিন দিকেই প্রতিভার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। কৌশিক সেনের প্রযোজনার আঙ্গিক ও তাঁর নিজস্ব অভিনয় আমার খুব প্রিয়। রমাপ্রসাদ একজন পাকা অভিনেতা ও সার্থক নাট্য রূপকার। স্কুলের বাচ্চাদের দিয়ে তাঁর একটি নাটকের অভিনয় দেখতে দেখতে আমি চোখের জল সামলাতে পারিনি। (এই লেখার পর হঠাৎ শুনলাম রমাপ্রসাদ বণিক আর নেই, শুনে আবার আমার চোখের জল আসার উপক্রম হল) ‘পূর্ব পশ্চিম’ নামের নতুন দলটির পরপর প্রকল্পগুলির একটা দেখলে অন্যগুলিও দেখার অদম্য ইচ্ছে হয়। আরও কত দলের ভালো নাটকের নাম শুনি। সময় করে দেখা হয় না বলে আফশোশ থেকে যায়। অনেকের কথা উল্লেখ করা হল না, বাদ রয়ে গেল। মোট কথা, এ কথা বেশ জোর দিয়ে বলা যায়। এই মুহূর্তে বাংলায় যে বাংলার দু-একটি ব্যাপার নিয়ে গর্ব করতে পারি, তার মধ্যে নাট্য আন্দোলনের স্থান অবশ্যই প্রথমে।
এলেবেলে খেলুড়ে
কৌশিক বসু একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ। কিছু দিন আগে তিনি আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। এখন ভারত সরকারের অর্থ মন্ত্রকের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। তাঁর একটি গ্রন্থের নাম ‘The Retreat of Democracy’-এর প্রথম অধ্যায়টির নাম ‘Ele Bele, The Subversion of Democracy’ এই ‘Ele Bele, কিন্তু কোনও ল্যাটিন শব্দ নয়, কথ্য বাংলায় এলেবেলে। প্রসঙ্গটি বেশ মজার। ছেলেবেলায় যখন আমরা কয়েকজন মিলে কোনও খেলা করতাম, তখন অন্তরঙ্গ কয়েকজন খেলার সঙ্গী ছাড়া অন্য কেউ এসে যোগ দিলে কিংবা অন্য কাউকে চাপিয়ে দেওয়া হলে তা আমাদের মোটেও পছন্দ হত না। ধরা যাক, আমাদের কোনও মাসি বেড়াতে এসেছেন তাঁর ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে। গুরুজনেরা বলতেন, সেই ছেলেকেও আমাদের খেলার মধ্যে নিতে হবে। আমরা নিতে বাধ্য হতাম। কিন্তু বন্ধুদের মধ্যে চোখে চোখে কথা হয়ে যেত—ও আছে বটে, কিন্তু ধতর্ব্যের মধ্যে নয়, ও এলেবেলে। তেমনই অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিশ্বের অনেক দেশের মতামত নিয়ে যেখানে নীতি নির্ধারণ করার কথা, সেখানে আসল কলকাঠি নাড়ে কয়েকটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের একটা ছোট গোষ্ঠী। বাকিরা সবাই এলেবেলে। আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও বাণিজ্য নীতির ক্ষেত্রে আসল খেলুড়ে মাত্র কয়েকটি, এলেবেলের সংখ্যাই অনেক বেশি।
অরণ্যের রাজবাড়ি
”আমাকে যেমন বলা হল, তেমনই স্নানের সময় কোমরে গামছা জড়িয়ে খালি পায়ে লাফাতে লাফাতে বাথরুমে ঢুকলাম। এখন হয়েছে কি, বাথরুম থেকে বেরিয়ে কুয়োতলা যাবার পথে একটা তারে ধোওয়া-জামাকাপড় মেলা ছিল। আমাকে আসতে দেখেই পিসিমা কোনও কথা না বলে একটি লাঠির ডগা দিয়ে ধোওয়া জামাকাপড়গুলি উঁচু করে, আমার মাথায় যাতে না লাগে সেইরকম করে তুলে ধরলেন।
” ‘ও হো, স্নান না করে ধোওয়া জামাকাপড় তো ছোঁওয়া চলবে না’—তাই না? আমি হাসতে হাসতে পিসিমাকে এই কথা বলতে পিসিমাও হাসতে হাসতে জবাব দিলেন…”
এই উদ্ধৃতি পাঠ করলে কি একটু বোঝার উপায় আছে যে, এর লেখক বাংলাভাষী নন, দূর বিদেশি? আসলে ‘অরণ্যের রাজবাড়ি’ নামের গ্রন্থটি রচনা করেছেন জাপানের অধিবাসী শ্রীনাওকি নিশিওকা। তিনি জাপানি ভাষারও একজন সুখ্যাত লেখক ও গবেষক। শান্তিনিকেতনে যাওয়া আসার সূত্রে বাংলা শেখা। এমন স্বচ্ছ, সাবলীল গদ্যে তাঁর রচনা অত্যন্ত উপভোগ্য।
ইদানীং কালে বেলজিয়ান পাদ্রি ফাদার দ্যতিয়েনের ‘ডায়েরির ছেঁড়া পাতা’য় অত্যন্ত রসমাধুর্য পূর্ণ বাংলা গদ্য লিখে আমাদের মুগ্ধ করেছেন। ফাদার দ্যতিয়েনকে তাঁর শেষ বয়সে, এ বছরই রবীন্দ্র পুরস্কার দেওয়াটা একটা পুণ্য-কাজ হয়েছে। নাওকি নিশিওকা-র মতো বাংলা গদ্য অনেক বাঙালি লেখকের কাছেই ঈর্ষণীয় মনে হবে। এই বইয়ের পাঁচটি রচনা অনেকটা ছোট গল্প আর ভ্রমণ অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ। অতি সাধারণ মানুষজনকেও তিনি বড় মায়াময় দৃষ্টিতে ফুটিয়ে তুলেছেন। সত্যি, এটি বাংলা ভাষার একটি ‘অতি’ উল্লেখযোগ্য বই।
***