বাংলাদেশের সঙ্গে আমার নাড়ির টান
বাংলাদেশের সঙ্গে আমার নাড়ির টান আছে। আমি সেখানেই জন্মেছি।
অফিসে আমার টেবিলের বাঁ-পাশে লেখা আছে ‘আই লাভ বাংলাদেশ’। দেশভাগ হওয়ার পর আমি ৪৮ সালে একবার মাত্র আমার জন্মস্থানে গিয়েছিলাম। ওদেশে অনেকবার গিয়েছি, যেখানে জন্মেছি তার পাশ দিয়েও গিয়েছি। কিন্তু ঠিক জন্মস্থানের জায়গায় যাবার আমার কোনও ইচ্ছে নেই। জানি সেই জায়গাটার অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমাদের বাড়িঘর কিছু নেই। সব ভেঙে গেছে অথবা ভেঙে ফেলা হয়েছে। পুরোনো যেসব স্মৃতি আছে, যে চিত্রটা আমার মনে আছে, সেগুলো এখন আর কিছুই দেখতে পাব না। আমি চাই আমার পুরোনো স্মৃতির চিত্রটাই মনের মধ্যে থাকুক।
বাংলাদেশের মানুষের অতিথি বাৎসল্য একটু বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। ওখানে গেলে আমার খেয়ে খেয়ে প্রায় মরে যাবার উপক্রম হয়। কাজেই একটু আতিথ্যটা কম করলেই ভালো হয়, অন্তত খাওয়ানোটা একটু কম করলে ভালো হয়। তবে ওখানে গেলে সবসময়ই মনে হয় নিজের লোকের মধ্যে এসেছি। কারুর কারুর কাছ থেকে এমন ব্যবহার পাই—এমন বন্ধুর মতো আত্মীয়র মতো যে মনে হয় পৃথিবীতে অন্য কোনও জায়গার বদলে বাংলাদেশটাই আমার সবচেয়ে আপন জায়গা।
বাল্যকালে কাটানো বাংলাদেশের কিছু কিছু স্মৃতি এখনও আমার মধ্যে রয়ে গেছে। ‘অর্জুন’ উপন্যাসে কিংবা ‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাসে বাংলাদেশের প্রকৃতি অনেকখানি এসেছে। বিশেষ করে নদীগুলোর কথা আছে। বাংলাদেশের এইসব বর্ণনা আমার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার বদলে কৈশোর স্মৃতি বা বাল্যস্মৃতি থেকে উঠে আসে। ‘একা এবং কয়েকজন’ উপন্যাসেও বাংলাদেশের প্রসঙ্গ অনেকখানি আছে।
বাংলাদেশ নামে যে রাষ্ট্রটির ২৫ বছর পূর্ণ হল, সেই রাষ্ট্রটি সম্পর্কে আমি ভীষণ ভাবে আগ্রহী। ওখানকার ঘটনাপ্রবাহ আমি সবসময় লক্ষ রাখি, নিজে যাই, নিজের চোখে দেখি। আমি মনে করি বাংলাদেশের ভবিষ্যতের দিকেই তাকানো উচিত, অতীতের দিকে তাকানোর কোনও যুক্তি নেই।
এটা নিশ্চয়ই আমাদের কাছে গর্বের বিষয় যে এখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রপুঞ্জের বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিতে পারে এবং বাংলা বিশ্বে একটা স্বীকৃত ভাষা হয়েছে। এটা বাংলাদেশের জন্যই সম্ভব হয়েছে। তবে বাংলাদেশে এখনও অনেক লোকে অকারণে ইংরিজিতে কথা বলে। যে সময় উৎসব হয় তখন অনেকেই পাজামা পাঞ্জাবি পরে বাঙালি সাজে কিন্তু অন্যসময় স্যুট-বুট পড়ে, জিনস পড়ে। তখন আর অতটা বাঙালি থাকে না। পশ্চিমী আকর্ষণের প্রভাব বাংলাদেশেও আছে তবে সব মিলিয়ে বাংলাদেশে বাংলা ভাষার ব্যবহার অনেক বেশি, এটাই খুব আনন্দের কথা।
বাংলাদেশের মানুষের একটা অভিযোগ আছে যে এখানকার লেখকদের লেখা ওঁরা বেশি পড়ে কিন্তু সে তুলনায় এখানকার পাঠক ওদের লেখা পড়েন কম। কথাটা অনেকটাই সত্যি। তবে এর পেছনে অনেকগুলো কারণও আছে। বাংলাদেশে এখনও কিন্তু লেখকের সংখ্যা বেশি নয়। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বেশি, পাঠক বেশি সেই তুলনায় গল্প-উপন্যাস লেখকের সংখ্যা এখনও কম। দু-একজন সেখানে খুবই জনপ্রিয় হয়েছে কিন্তু হিসেব করলে দেখা যাবে যে তাদের সংখ্যা তুলনায় কম। পশ্চিম বাংলার যেহেতু একটা অনেকদিনের ঐতিহ্য রয়েছে, এখানে গল্প-উপন্যাসের চর্চা খুব বেশি হয়। ওখানকার পাঠকদের যে একটা ক্ষুধা আছে সেটা ওখানকার সাহিত্য দিয়ে মেটানো যায় না বলে এখানকার লেখা ওরা পড়ে। কবিতার দিক থেকে অবশ্য বাংলাদেশ বেশ উন্নত। বাংলাদেশে বহু কবিতা লেখা হয়, কবির সংখ্যাও অনেক। অনেকেই পশ্চিম বাংলায় ওদের কবিতা পাঠ করেন। বাংলাদেশের অনেক কবিই পশ্চিম বাংলায় বেশ জনপ্রিয়। এখন দু-দেশের আদানপ্রদান অনেকটা সহজ হয়ে এসেছ বলে যাওয়া আসা হয়। বাংলাদেশের কবিদের কবিতার বইও এখানে ছাপা হচ্ছে। বাংলাদেশের কিছু কিছু উপন্যাস লেখকের বইও এখানে ছাপা হতে শুরু হয়েছে। তাঁরা ইদানীং বেশ জনপ্রিয়ও হচ্ছেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতন আমাদের তুলনায় অনেক বেশি হয়েছে। প্রথম কথা একটা অত্যন্ত রক্তাক্ত এবং ভয়ঙ্কর যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ওই দেশের জন্ম, তার পরেও বিভিন্ন সময় ওখানে রাষ্ট্রনায়করা খুন হয়েছেন, সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। গণতন্ত্র বিপন্ন হয়েছে। সেই সবসময় ওখানে অন্যান্য মানুষদের মতন শিল্পীরাও এগিয়ে এসেছেন তাঁদের কণ্ঠস্বর দিয়ে প্রতিবাদ করতে। সুতরাং বাংলাদেশের কবিতার মধ্যে এই প্রতিবাদী সুরটা বেশি করে ফুটে উঠেছে। প্রতিবাদ করতে গেলে গলাটা একটু উচ্চকণ্ঠ হয়ে যায়। সে জন্যই বাংলাদেশের কবিতার মধ্যে একটু উচ্চকণ্ঠ টের পাওয়া যায়। একটু বেশি মাত্রায় আবেগও রয়েছে। সে তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে এত বেশি উত্থান পতন ঘটেনি। পশ্চিম বাংলায় একদিকে যেমন ভাষা শিল্পের চর্চাটা বেশি হয়েছে আবার তেমনি হয়তো অনেকে যাঁরা মার্কসবাদে বিশ্বাসী তাঁরা তা নিয়েও কিছু কবিতা লিখেছেন তাঁদের কবিতার মধ্যেও উচ্চকণ্ঠ এসেছে। তবে পশ্চিম বাংলার কবিতার মূল সুরটা কিন্তু শিল্পের সূক্ষতার সাধনার দিকেই বেশি।
বাংলাদেশ সম্পর্কে বলতে গেলে তসলিমা প্রসঙ্গ এসেই যায়। তসলিমা একটি সাহসী মেয়ে। তাঁর ঝকঝকে গদ্য ভাষা দিয়ে সে নারী নির্যাতন বা ধর্মের নামে মানবিকতা কোথায় কোথায় বিচ্যুত হয়, তা নিয়ে খুব তীক্ষ্ন ভাষায় লিখেছিলেন। সে কারণে একটা আলোড়নের সৃষ্টি হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় তসলিমা শিল্প সাহিত্য চর্চা করবার খুব একটা সময় পাননি। মাত্র কয়েক বছরেই তাঁর সাহিত্য জীবনে বিরাট পরিবর্তন ঘটে যায়।
অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত দেশত্যাগ করতে হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাড়িতে বসে নিবিড়ভাবে সাহিত্যচর্চা করার সুযোগ থেকে তসলিমা বঞ্চিত হয়েছে। আপাতত আমি বাংলাদেশে দেখি তসলিমা সম্পর্কে সকলেই নিরুত্তাপ, কেউ কোনও কথাই বলতে চায় না। যেন অনেকেই তাঁকে ভুলে গেছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে যেহেতু আমার নাড়ির টান আছে তাই তুচ্ছ তুচ্ছ কারণে যখন আমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয় তখন তা আমার খুবই খারাপ লাগে। গঙ্গার জলের ওপর সকলেরই অধিকার আছে। বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে যখন পদ্মা প্রবাহিত হচ্ছে তখন যদি সেখানে জল কম পড়ে তবে আমাদের তো জল দিতেই হবে। আবার কলকাতা বন্দরকেও বাঁচাতে হবে। এবারে যে চুক্তি হয়েছে তা অনেকটা যেন দু-দেশের পক্ষেই সুবিধাজনক শর্ত। সুতরাং আমার মনে হয় ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে। গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বইবে। ওঁরা পানি নেবে আমরা জল নেব এবং আদান-প্রদানটা আরও বেশি বাড়বে।
ধনসম্পদ গেছে, মানসম্মানও যেতে বসেছে
ভারতবর্ষের মধ্যে যখন আমি ঘুরে বেড়াই, তখন কিন্তু আমি ভারতীয় না, বাঙালি। ক্রিকেট টেস্ট কিংবা পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের সময়টুকু বাদ দিলে, দেশের সমস্ত মানুষকে আমরা দু-ভাগে ভাগ করে রাখি, বাঙালি ও অবাঙালি। আমরা সবাই ভারতীয় হই বিদেশে গিয়ে, যখন পাসপোর্ট দেখাতে হয়।
তাও পুরো ভারতীয় নয়, আধা। অর্থাৎ বিদেশিদের কাছে ভারতীয় বলে নিজেদের পরিচয় দিই, কিন্তু অন্য কোনও ভারতীয়ের সঙ্গে দেখা হলে প্রথমেই মনে মনে অনুধাবন করি, লোকটি কি গুজরাতি, না পাঞ্জাবি, না মহারাষ্ট্রীয়? ভারত-মানচিত্রের তলার অংশের মানুষদের কখনও পূর্ণ ভারতীয় হতে দেওয়া হয় না, তারা সাউথ ইন্ডিয়ান! বিদেশের বড় বড় শহরে, যেখানে প্রচুর ভারতীয়ের বসতি, সেখানেও পঞ্জাবি, গুজরাতি, মালয়ালি, বাঙালিরা আলাদা আলাদা গোষ্ঠীতে বিভক্ত, সামাজিক মেলামেশা ওই গোষ্ঠীর মধ্যেই প্রধানত আবদ্ধ। সবাইকে মেলাবার কিছু কিছু চেষ্টা হয়েছে, তেমন সার্থক হয়নি।
এই দেশটাই এরকম। এতগুলি জোরালো ভাষা, তাই ভাষাভিত্তিক জন-গোষ্ঠী স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখবেই। আবার সবাই আলগা ভাবে ভারতীয়। এই বিচিত্র অবস্থাটি অন্য অনেক দেশেরই নেই। যেমন চিনের সঙ্গে এ দেশের ঠিক তুলনা চলে না। সে দেশে নব্বই শতাংশ মানুষ এক ভাষাতে কথা বলে, সেখানেও কিছু কিছু গোষ্ঠী আছে বটে, কিন্তু ভাষা-বিভেদ নেই, খাদ্য-অভ্যাসও প্রায় একইরকম।
আমরা বাঙালি সংস্কৃতির কথা বলি, আবার আমরা ভারতীয় সংস্কৃতিও উত্তরাধিকারী। চণ্ডীদাস-ভারতচন্দ্র আমাদের কবি, কালিদাস-জয়দেবও কি নন? রামায়ণ-মহাভারতে বাংলার উল্লেখ প্রায় নেই-ই বলতে গেলে, তবু ওই দুটি মহাগ্রন্থ আমাদের জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। আবার বাংলা ভাষার তীব্র টানে, আমরা অন্য কোনও ভারতীয় ভাষাকে গ্রহণ করতে পারিনি। শুধু হিন্দু বাঙালি নয়, বাঙালি মুসলমানদেরও জোর করে ধরানো যায়নি উর্দু জবান। দেশ ভাগের অনেক আগে, বাংলার অ্যাসেমব্লিতে মুসলমান সদস্যরাই প্রথম বাংলায় বক্তব্য প্রকাশের দাবি তোলেন।
বাঙালি কে? বাংলা ভাষায় যে কথা বলে, সে-ই বাঙালি। যেমন অ্যান্টনি কবিয়াল, যেমন সখারাম গণেশ দেউস্কর, যেমন আবু সয়ীদ আইয়ুব। বাঙালি পরিবারে জন্মেও যারা বাংলা ভাষা শেখে না, তাদের আর বাঙালি বলে গণ্য করা ঠিক নয়। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, কলকাতাতেও কিছু নারী-পুরুষ ইংরেজির মোহে আকৃষ্ট হয়ে বাংলা ভাষা একেবারেই ব্যবহার করে না, তাদের বাঙালি সমাজ থেকে নাম কেটে দেওয়া উচিত। তারা মধ্যবর্তী কোথাও ঝুলে থাকুক। কিংবা ট্যাঁস ফিরিঙ্গি হতে চায় হোক।
আগেকার বঙ্গদেশ দু-খণ্ড হয়ে এক অংশ স্বাধীন রাষ্ট্র হয়েছে বটে, কিন্তু ভারতস্থিত পশ্চিম বাংলার মানুষদের বাংলা ভাষার সূত্রেই বাঙালি হিসাবে পরিচিতি।
নানান ঐতিহাসিক কারণে দেড় শতাব্দী ধরে এই বাঙালিদের মধ্যে একটা উচ্চম্মন্যতা এসে গিয়েছিল। সে কারণগুলি আর বিশদ করে বলার দরকার নেই। রাজনীতি আর সাহিত্যে বাঙালিরা অন্য ভারতীয় জনগোষ্ঠী থেকে অনেকখানি এগিয়ে ছিল। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনেই এ-দেশে প্রকাশ্য গণ-আন্দোলনের শুরু। সর্বভারতীয় কংগ্রেস পার্টিতে অনেকদিন পর্যন্ত ছিল বাঙালিদেরই আধিপত্য। পরে বোমা-বন্দুকের বিপ্লবের মহড়াতেও বাঙালিরা অগ্রণী। শিক্ষক-চিকিৎসক-উকিল-কেরানি উৎপাদনেও বঙ্গভূমি ছিল খুবই উর্বর। এইসব কারণে বাঙালিরা অন্য প্রদেশে বা অন্য রাজ্যে গিয়ে সেখানকার মানুষদের দিকে নীচু চোখে তাকাত। অন্য প্রদেশের মানুষদের ডাকা হত অবজ্ঞাসূচক নামে। খোট্টা, মেড়ো, উড়ে, আসামী, পাঁইয়া, বাঁধাকপি ইত্যাদি শব্দগুলি শুধু মুখে মুখে নয়, ছাপার অক্ষরেও দেখা গেছে।
এই উচ্চম্মন্যতা থেকে আসে এক ধরনের ফাঁকা আত্মম্ভরিতা। অন্য প্রদেশের মানুষদের ভাষা, সংস্কৃতি সম্বন্ধে কিছু জানার চেষ্টা না করে অবহেলা ভরে উড়িয়ে দেওয়া হত। তৎকালীন বাঙালিরা চিন্তাও করেনি যে অবজ্ঞার প্রত্যুত্তরে অবজ্ঞাই ফিরে আসে, তারপর ক্রোধ ও ঘৃণা। হয়েছিলও তাই। এক সময় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী বাঙালির সংখ্যাধিক্যের জন্য অন্য প্রদেশের মানুষরা তাদের দিকে প্রথমে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে তাকাত। কিছুটা হীনম্মন্যতাও ছিল। তারপর তা রূপান্তরিত হয় ক্রমান্বয়ে অবজ্ঞা, ক্রোধ ও ঘৃণায়।
বাঙালি ও মহারাষ্ট্রীয়রা উচ্চশিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিল আগে, কিন্তু কিছু পরে পরে অন্য জনগোষ্ঠীও যে সেই সুযোগ পাবে, এটাই তো স্বাভাবিক। তারাও জেগে উঠবে। কোথাও কোথাও তারা বাঙালি ও মহারাষ্ট্রীয়দের থেকেও এগিয়ে যাবে, বাঙালিরা তা বোঝেনি বা বুঝতে চায়নি। স্বাধীনতার পরে চিত্রটি সম্পূর্ণ বদলে যায়। দেশ বিভাগের চরম আঘাতে পশ্চিম বাংলা এমনই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে যে মেরুদাঁড়া ভাঙা প্রাণীর মতন অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে যায়। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের মধ্যে আর একটি বাঙালিও সর্বভারতীয় কংগ্রেস দলের সভাপতি হতে পারেনি। এমনকী সে দাবি পর্যন্ত তোলা যায়নি। বস্তুত সুভাষচন্দ্রের পর ওই পদের দাবিদার হওয়ার যোগ্যও কেউ নেই। বিধানচন্দ্র রায়ের পর বাংলার কংগ্রেসি নেতাদের ভূমিকা শুধু দিল্লির নেতাদের পদলেহী ও চাটুকারের। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বাঙালিদের স্থান হয়ে গেল নগণ্য, অর্থনীতিতেও অত্যন্ত হীনবল। প্রতিবাদী শক্তি হিসাবে বামপন্থীরা সংগঠিত হয়ে শক্তি বৃদ্ধি করায় তবু খানিকটা সমীহ আদায় করে নিয়েছে।
এখন বাঙালির ধনসম্পদ তো গেছেই, মানসম্মানও যেতে বসেছে। সর্বত্র শোনা যায়, বাঙালির আর কিছু নেই, যে সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে বাঙালির এত গর্ব ছিল, তাও নেমে গেছে অনেক নীচে। এর কিছুটা চেষ্টাকৃত প্রচার। এই চেষ্টার মূলে আছে কিছুটা প্রতিশোধ স্পৃহা। তবু এই অবনমন কতখানি সত্য, তাও তো বিচার করে দেখতে হবে। সব দিকগুলি নিয়ে বলার অধিকার আমার নেই, সাহিত্য সম্পর্কে কিছুটা জানি, অন্য প্রধান ভাষাগুলির সাম্প্রতিক সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি বিষয়ে কিছুটা খোঁজ খবর রাখি।
এক সময়ে, ধরা যাক স্বাধীনতার আগেকার মোটামুটি আশি বছরে, অন্যান্য ভারতীয় ভাষার তুলনায় বাংলা সাহিত্য যে অতি দ্রুত অনেক উন্নত হয়েছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সবক’টি ভাষাতেই প্রথম দিকের ঔপন্যাসিকরা বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে ঋণী। আমাদের সৌভাগ্য এই যে গদ্য সাহিত্য শুরুর সময়েই বঙ্কিমচন্দ্রের মতন একজন বড় মাপের প্রতিভাবান লেখক কলম ধরেছিলেন। প্রথম থেকেই তিনি উঁচু তারে বেঁধে দিয়েছিলেন কথাসাহিত্য। তা অন্যান্য আঞ্চলিক লেখকদের প্রভাবিত করেছে। নোবেল প্রাইজ পাওয়ার আগে রবীন্দ্রনাথের সর্বভারতীয় পরিচিতি ছিল খুবই সীমিত। স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো জয়ের মতনই, সাহেবদের দেশ থেকে রবীন্দ্রনাথের এত বড় পুরস্কার প্রাপ্তিতে সারা ভারতের দৃষ্টি তাঁর দিকে আকৃষ্ট হয়। তারপর থেকে তিনি বিশ্বকবি, সুতরাং সারা ভারতের শ্রেষ্ঠ কবি হিসাবে তো স্বীকৃতি পাবেনই। কিন্তু গান বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথের মহিমা অনেকখানি কমে যায়, অন্য ভাষায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের রস ঠিক মতন পাওয়া যায় না, রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাস-কবিতা অন্য সব ভাষায় অনুদিত হলেও শুধু উচ্চশিক্ষিতদের কাছেই আদৃত হয়েছে, জনসাধারণের কাছে পৌঁছোয় না। রবীন্দ্রনাথের নাম যতখানি শ্রদ্ধেয়, তাঁর রচনা ততখানি পঠিত নয়।
সেই কৃতিত্বের অধিকারী শরৎচন্দ্র। কোনও বড় পুরস্কারই পাননি তিনি, শুধু গল্প নির্মাণের কুশলতায় এবং সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলায় তিনি সর্বশ্রেণির মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন। ভারতের এমন কোনও ভাষা নেই, যেখানে শরৎচন্দ্রের রচনা এখনও আগ্রহের সঙ্গে পঠিত হয় না। অনেক ভাষার সাধারণ পাঠকরা জানেই না যে শরৎচন্দ্র একজন বাঙালি, মনে করে তাদেরই ভাষার লেখক। অনুবাদে চট্টোপাধ্যায় পদবিটা বাদ দেওয়া হয়। আমি কিছু কিছু গুজরাতি পাঠকের মুখে শুনেছি যে, তাদের ধারণা শরৎচন্দর একজন গুজরাতি লেখক।
কিন্তু তারপর? অন্য ভাষার তুলনায় বাংলা সাহিত্য অধঃপাতে গেছে? কিছু কিছু বাঙালি এখনও আত্মম্ভরি, অর্ধশিক্ষিত এবং ফাঁকা দাম্ভিকতায় পূর্ণ। তারা গায়ের জোরে বলতে চায় বাংলা সাহিত্য এখনও শ্রেষ্ঠ! কিন্তু গায়ের জোরে বললেই বা তা মানছে কে? বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র-নজরুলের গৌরব নিয়ে আর কতদিন ধুয়ে খাওয়া হবে, পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে সমসাময়িক অন্য ভাষার সাহিত্যের তুলনা তো করতেই হবে। কুরুতুলুন হায়দার, নির্মল ভার্মা, কৃষ্ণা সোপতি, এম টি বাসুদেবন নায়ার, ইউ আর অনন্তমূর্তির মতন শক্তিশালী লেখকদের সঙ্গে বাঙালি পাঠকদের পরিচিতি নেই। গোপালকৃষ্ণ আডিগার মতন কবির রচনা কজন পড়েছে? মলয়ালম সাহিত্য, হিন্দি সাহিত্য বহু অনুবাদে সমৃদ্ধ। সেই তুলনায় বাংলায় প্রায় কিছুই অনুবাদ হয় না অন্য ভারতীয় সাহিত্যের। অন্যান্য ভাষার উন্নতি সম্পর্কে অজ্ঞ বাঙালি এখনও বাস করছে মূর্খের স্বর্গে।
এহ বাহ্য। এর পরেও বলা যায় যে জীবনানন্দ দাশের মতন সম্পূর্ণ মৌলিক স্টাইলের স্রষ্টা কোনও কবি এখনও কোনও ভারতীয় ভাষায় নেই। জীবনানন্দ দাশ একাই যেভাবে বাংলা কবিতার রূপান্তর ঘটিয়ে দিয়েছেন, তেমন প্রতিভা অন্য ভাষায় আসেনি। তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমকক্ষ ঔপন্যাসিক এখনও অন্য ভাষায় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এঁদের মধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ই বাংলার বাইরে সবচেয়ে কম পরিচিত, কিন্তু যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের মুগ্ধ বিস্ময়ের খবর জানি। সতীনাথ ভাদুড়ির ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’-এর তুল্য উপন্যাস অন্য ভাষায় লেখা হয়নি আজও। ফণীশ্বরনাথ রেণু-র প্রসিদ্ধ উপন্যাস ‘ময়লা আঁচল’-এ সতীনাথের প্রভাব আছে। রেণুজি তা স্বীকার করেও গেছেন। কমলকুমার মজুমদারের ভাষারীতি এমনই যা অনুবাদ করা প্রায় অসাধ্য ব্যাপার। যেমন জেমস জয়েসের ‘ফিনেগানস ওয়েক’ অনুবাদ করা যায় না। কিন্তু অন্য ভারতীয় ভাষায় আমি এমন কোনও উপন্যাসের কথা শুনিনি, যা অনুবাদ করা দুঃসাধ্য।
আমার সমসাময়িক বাঙালি লেখকদের সঙ্গে অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় সাম্প্রতিক সাহিত্যের প্রতিতুলনা থেকে আমি বিরত হলাম। কেন না, তাতে হয়তো আমারও আত্মম্ভরিতা প্রকাশ পেয়ে যেতে পারে!
পশ্চিমবঙ্গে বাংলা চাইছি, আনন্দবাজারের আপত্তি কেন?
ভাষা-শহিদ-স্মারক সমিতির পক্ষ থেকে লেখক-বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি বাংলা ভাষা প্রসারের জন্য রাজ্য সরকারের সাময়িকভারপ্রাপ্ত মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে অনেকগুলি দাবি জানাতে গিয়েছিলেন। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশতি হয়েছে তার পরস্পরবিরোধী ও ভ্রান্ত প্রতিবেদন। আনন্দবাজার পত্রিকাতেও ১৪ জ্যৈষ্ঠ দ্বিতীয় সম্পাদকীয়তে প্রচুর বিদ্রূপ বর্ষিত হয়েছে সেই প্রতিনিধি দলের প্রতি। অবশ্য রচনাটির শিরোনাম ‘আ মরি বাংলা ভাষা’ দেখে ঠিক বোঝা যায় না, বিদ্রূপ ওই প্রতিনিধিদলের প্রতি, না বাংলা ভাষার উদ্দেশে। এবং ‘মড়াকান্না’, ‘পাগলের প্রলাপ’ এই ধরনের ভাষা ব্যবহার দেখলে মনে হয়, যুক্তি যখন দুর্বল তখনই মানুষ গালিগালাজ অবলম্বন করে; আমি অবশ্য তার প্রত্যুত্তর দেব না, প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য হিসেবে ভ্রান্তিগুলি সংশোধনের চেষ্টা করব।
আনন্দবাজারের পক্ষ থেকে মূল দাবিগুলি অনুধাবন করা হয়নি, জানতেও চাওয়া হয়নি। মূল দাবি শুধু কলকাতার নাম পরিবর্তন বা মোটর গাড়ির নাম্বার প্লেট বদল ইত্যাদি নয়, মূল দাবি এই রাজ্যের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার। তা নিয়ে বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় দৈনিকের কী আপত্তি থাকতে পারে! সংবিধান অনুযায়ী ইংরেজি ও হিন্দি ভারত সরকারের যোগাযোগের ভাষা, রাজ্যগুলির প্রধান ভাষা জাতীয় ভাষা বা ন্যাশলান ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে স্বীকৃত, কিন্তু কার্যত হিন্দিকে রাজভাষা হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে, সেজন্য কেন্দ্রীয় সরকার ব্যয় করছেন বহু কোটি টাকা। বাংলা ভাষা ভারতের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষা, তার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও মাথা ব্যথা নেই, অন্যান্য জাতীয় ভাষাগুলিই বা বঞ্চিত হবে কেন? এই ব্যাপারে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করাই আমাদের প্রধান দাবি।
এই রাজ্যে সরকারি কাজকর্মে বাংলাভাষা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া হয়ে গেছে, আমরা চেয়েছি তার প্রয়োগ ত্বরান্বিত করতে। পশ্চিমবঙ্গ ও নাগাল্যান্ড ব্যতীত, ভারতের সবক’টি রাজ্যে বিদ্যালয় স্তরে রাজ্যের ভাষা পঠন পাঠন আবশ্যিক। অর্থাৎ তামিলনাড়ু বা মহারাষ্ট্রে যদি বাঙালি ছেলেমেয়েরা পড়াশুনো করে, তাদের তামিল বা মরাঠি ভাষা পড়তেই হবে। সেই জন্যই আমরা চেয়েছি, পশ্চিম বাংলাতেও অন্তত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা শিক্ষা অবিলম্বে বাধ্যতামূলক করা হোক। শুধু সরকারি নয়, বে-সরকারি, ইংলিশ মিডিয়াম, হিন্দি মিডিয়াম, সব স্কুলে। এত কাল এই ব্যাপারে আমরা অবহেলা করেছি বলে অনেক বাঙালির সন্তানও ইংলিশ বা হিন্দি মিডিয়াম নেয়, বাংলা পড়ে না। দিল্লি-মুম্বই-চেন্নাইয়ের দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙালি ছেলেমেয়েরা বাংলা লিখতে পড়তে শেখে না। আমরা কি ক্রমাগত বাঙালির সংখ্যা হারাতেই থাকব? অন্য রাজ্য থেকে জীবিকা বা অন্যান্য প্রয়োজনে যাঁরা পশ্চিম বাংলায় বসবাস করবেন, তাঁদের ছেলেমেয়েরা বাংলা শিখবে, বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে কিছুটা পরিচিত হবে, এ দাবি কি অস্বাভাবিক? অনেকে স্বেচ্ছায়ও বাংলা শেখেন। যাঁরা বাংলা জানেন, তাঁরাই বাঙালি, ঘোষ-বোস-চট্টোপাধ্যায়-মুখোপাধ্যায় হওয়ার দরকার নেই। পাণ্ডে-দুবে-বাজপেয়ী-নায়ারও বাঙালি হতে পারেন।
সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, আমরা দূরদর্শনে হিন্দি অনুষ্ঠান বাতিল করতে চেয়েছি। এটাকে মিথ্যে বললে কম বলা হয়, এমন কথা আমরা উচ্চারণই করিনি, আমরা অন্য কোনও ভাষার বিরোধী নই, আমরা চেয়েছি, একটি পূর্ণাঙ্গ রুচিসম্মত, বাংলা অনুষ্ঠানের চ্যানেল চালু করতে। যেমন ইন্টারনেটে ইংরেজিতে বাঙালিদের যে কুৎসা রটনা চলছে অশ্লীল ভাষায়, তার জবাব আমরা দিতে চাই না, কেন না মনোরোগীরাই ওরকম ভাষা ব্যবহার করে, কিন্তু ইন্টারনেটে বাংলার সুস্থ সংস্কৃতির পরিচয়মূলক একটি নতুন জানলা খোলার উদ্যোগ নেব না কেন? কলকাতার রাস্তায় অধিকাংশ হোর্ডিং সাইনবোর্ড ইংরেজি বা হিন্দি ভাষায়, তা থাক না, আমাদের দাবি শুধু বাংলা অক্ষরও তাতে জুড়ে দিতে হবে। কলকাতা কসমোপলিটন শহরই থাকুক, কিন্তু এ শহর যে পশ্চিম বাংলার রাজধানী, এ পরিচয় একেবারে মুছে যেতে দেব না কিছুতেই!
ক্যালকাটার বদলে কলকাতা, আর ওয়েস্ট বেঙ্গলের বদলে পশ্চিমবঙ্গ, এই পরিবর্তনের দাবিতে যাঁরা শিবসেনার গন্ধ পান, তাঁরা হীনম্মন্যতায় ভুগছেন। চেন্নাই, তিরুবন্তিপুরম, ভাদোদারা, এমনকী ঘরের কাছে গৌহাটির বদলে গুয়াহাটি, এইসব পরিবর্তনের পেছনেও বুঝি শিবসেনা রয়েছে? কলকাতা নামের ইতিহাস নিয়ে অনেক বিতর্ক ও কচকচি আছে, সে ব্যাপারে আমিও নেহাত কম জানি না, কিন্তু সে সবের মধ্যে যেতে চাই না। ইংরেজরা নাম দিয়েছে ক্যালকাটা, গত আড়াইশো বছর ধরে বাঙালিরা বলে কলকাতা, এখন সর্বত্র বাংলায় কলকাতাই লেখা হয়, অবাঙালিরাও বলে কলকাত্তা, একমাত্র দিশি সাহেবরাই বলে ‘খ্যালখাটা’! যে নামে আমরা এই শহরটাকে ডাকি, ইংরেজিতেও সেই নামটা লিখতে পারব না কেন? একই শহরের দুরকম নাম বজায় রাখার কী যুক্তি থাকতে পারে? আর কোথাও আছে নাকি? পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনের প্রসঙ্গ উঠলেই অনেকে মাথা ঝাড়া দেন।
বঙ্গ, বঙ্গদেশ, বঙ্গভূমি, গৌড় ইত্যাদি নিয়ে নানা মুনির নানা মত, তাই আমরা নাম পরিবর্তনের ঝামেলায় যেতে চাই না, শুধু দাবি করেছি, পশ্চিমবঙ্গ নামটির ইংরেজি অনুবাদ অপ্রয়োজনীয়। মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, হিমাচল প্রদেশ যদি ইংরেজি হরফে লেখা যেতে পারে তা হলে পশ্চিমবঙ্গই বা যাবে না কেন? এর পরেও যাঁরা ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল’ বজায় রাখার পক্ষপাতী, আমি তাঁদের দাস মনোভাবসম্পন্ন বলতে বাধ্য। আর যাঁরা বলেন, যেমন আছে তেমনই থাক না, বদলাবার দরকার কী, তাঁদের জানাতে চাই যে, যা বদলায় না তা ক্রমশই ক্ষয় পায়, সেই ক্ষয় রোগই আমাদের পেয়ে বসেছে। কেউ কেউ বলেন, এ-রাজ্যে এত বেকার, শিল্প-বাণিজ্যের এত দুর্দশা, সেই সব সমস্যা দূর না করে বাংলা ভাষা নিয়ে মাতামাতি করার কী আছে? যাঁরা এই কথা বলেন, তাঁরা ওই সব বড় বড় সমস্যা দূর করার জন্য নিজেরা কিছু করছেন কি! যদি করতে চান, করুন না। দেশে বেকার সমস্যা আছে বলে ভাষার অবমাননা সহ্য করে যেতে হবে? আমরা যদি বলি, বাংলা না জানলে এ-রাজ্যে কারুকে চাকরি দেওয়া চলবে না, সেটা কি মূল মূল সমস্যাকেও খানিকটা ছুঁয়ে যায় না?
এই দাবিগুলি মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হঠাৎ খেয়ালপ্রসূতও নয়। একটি সংস্থা গঠন করে এক বছর আগে, বাংলা ভাষার জন্য যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন ঢাকা ও শিলচরে, তাঁদের স্মরণে সুরেন্দ্রনাথ পার্কে একটি শ্বেত পাথরের শহিদ বেদি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অদূরে স্থাপিত হয়েছে খোলা মঞ্চ, লালন মঞ্চ নামে, যেখানে প্রতি শনিবার বাংলার কিছু কিছু লুপ্তপ্রায় সংস্কৃতি, যেমন জারি গান, সারি গান, কবির লড়াই, জেলেপাড়ার সং, রায় বেঁশে ইত্যাদি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে। তারই পরবর্তী কার্যক্রম বাংলা ভাষার প্রসার ও সমৃদ্ধির জন্য সর্বাত্মক আন্দোলন। মিউজিয়ামের আশুতোষ শতবার্ষিকী হলে বহু বিশিষ্ট ও বিদ্বজ্জনের সমাবেশে এই দাবিগুলি আলোচিত ও গৃহীত হয়েছে। পশ্চিম বাংলার অনেক সংস্থা এই দাবিগুলির সঙ্গে একমত। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলিরও কোনও ভেদাভেদ নেই।
না, শুধু আবেদন নিবেদনের পর্যায়েই এই দাবি থেমে থাকবে না। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার জন্য প্রয়োজন হলে আমরা পথে নামব। ইংরেজি পত্রিকাগুলোতে যারা বাঙালিদের বং বলে সম্বোধন করে, সেইসব পত্রকারদের ঝুঁটি নেড়ে দিতে হবে। বাঙালি ছেলে-মেয়েরা যদি নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে কথা বলে তবে তারা হবে প্রকাশ্যে উপহাসের পাত্র। যেসব বাবা-মা সন্তানদের বাংলা শেখাতে অবহেলা করে, তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করা দরকার। যে-কোনও দোকানে, অফিসে, ব্যাঙ্কে, হোটেলে বাংলায় প্রশ্ন করলে যদি উত্তর না পাওয়া যায়, তবে তাদের বোঝাতে হবে চোখরাঙানির ভাষা। অন্যান্য ক্ষেত্রে আরও কঠিন ব্যবস্থা।
ময়দানে প্রতিষ্ঠিত শহিদবেদি আমাদের এই কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় যে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য হয়তো এই পশ্চিম বাংলাতেও রক্ত দিতে হতে পারে। দল নির্বিশেষে বহু তরুণ-তরুণী যে তার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
নাম বদলের সৎ প্রস্তাব তাতেই এত বিরুদ্ধ হইহল্লা?
এই রাজ্যের বিধানসভায় সর্বসম্মত ভাবে কলকাতার নাম ইংরেজি অক্ষরেও কলকাতা এবং রাজ্যের প্রচলিত নাম বাংলা ও ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লেখার প্রস্তাব গৃহীত হওয়ায় গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ আনন্দিত। কিছু মানুষ ও প্রতিষ্ঠান বিরুদ্ধ মতও প্রকাশ করছেন। বিরুদ্ধ মত থাকতেই পারে, তা যুক্তিসম্মত হলে মাথা পেতে মেনেও নেওয়া যায়, কিন্তু যুক্তির বদলে তা বিদ্রূপ, আস্ফালন ও গালমন্দপূর্ণ হলে সেই সব বিরুদ্ধবাদীর উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ জাগে। কোনও একটি শক্তির ধামা ধরার সুর ফুটে ওঠে।
এ প্রস্তাবে সরকার পক্ষ ও বিরুদ্ধ দলের একমত হওয়াটা কোনও কোনও মহলের পছন্দ হয়নি। আশ্চর্য! যদি দাঙ্গাবিরোধী প্রস্তাব ওঠে, এমনকী হাসপাতালে ধূমপান নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব ওঠে, তাতেও বিরুদ্ধ পক্ষ আপত্তি জানাবেন? তেমনই, যাতে রাজ্যের অধিকাংশ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত, তাতে জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একমত হওয়াই স্বাভাবিক। এতে রাজনীতি টেনে আনাটাই মূর্খামি। কোনও দল যদি বিধানসভায় সম্মতি জানিয়ে, পরে কারও উস্কানিতে পশ্চাদপসরণ করতে চান, তা বিশ্বাসঘাতকতারই নামান্তর। কোনও কোনও নেতা বা নেত্রী যদি বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতা করে নির্বাচনী প্রচারে তা কাজে লাগাতে চান, তার ফল যথাসময়ে বুঝতে পারবেন আশা করি। বাংলার জনমানস এখনও আত্মসম্মানবোধ হারায়নি।
বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষার দাবিতে কোনও রাজনীতি নেই। এই দাবি যে গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের, তাতেও সন্দেহ নেই। বিশেষ বিশেষ পল্লিতে সমীক্ষা চালিয়ে বাংলা-বিরোধিতার চিত্র তুলে ধরাটা অসততারই নামান্তর। ভোটের সময় কারচুপির কথা আমরা জানি, সংবাদপত্রের জনমত সমীক্ষাতেও কি সেরকম কারচুপি শুরু হল? প্রথম যে প্রতিনিধিদলটি দাবিপত্র নিয়ে তৎকালীন অস্থায়ী মুখ্যমন্ত্রী শ্রীবুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা করেন, তাতে ছিলেন সর্বশ্রী কুমার রায়, অমলেন্দু দে, বিভাস চক্রবর্তী, উষা গঙ্গোপাধ্যায়, আজিজুল হক, বাঁধন দাস, অধৃষ্যকুমার, রতন বসু মজুমদার। এঁরা প্রত্যেকেই স্বক্ষেত্রে বিশিষ্ট, রাজনৈতিক মতামতে ভিন্ন কিংবা আমার মতন রাজনীতিনিরপেক্ষ। এঁরা ছাড়াও দাবিপত্রে স্বাক্ষর করেছেন, অরুণ মিত্র, হীরেন মুখোপাধ্যায়, সোমনাথ হোর, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, ভি. বালসারা, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, সুবিনয় রায়, মহাশ্বেতা দেবী, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, হোসেনুর রহমান, শুভাপ্রসন্ন, যোগেন চৌধুরী, দিব্যেন্দু পালিত, অমিয় বাগচী, শ্রীনিরপেক্ষ, গৌতম ঘোষ প্রমুখ দুশো জন, বাংলা সংস্কৃতির শীর্ষে যাঁদের অবস্থান। তিন-চারজন মাত্র অতি বিশিষ্ট ব্যক্তি স্বাক্ষর করতে সম্মত হননি। ভাষা শহিদ স্মারক সমিতির পক্ষ থেকেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারে, বাগবাজারে, গড়িয়াহাটে, বেহালায় পথসভা করে বোঝানো হয়েছে, অনেকে সাগ্রহে স্বাক্ষর করেছেন। শান্তিনিকেতন, নৈহাটি, হুগলি প্রভৃতি অঞ্চলে সংগৃহীত হয়েছে হাজার হাজার স্বাক্ষর, অনেক যুবকযুবতী এগিয়ে এসে বলছেন, বাংলা ভাষার জন্য স্বেচ্ছায় কিছু করতে চান। ভাষা-চেতনা সমিতি ও অন্যান্য সংগঠনও সমর্থকদের জড়ো করছেন। এই অজস্র মানুষের মতামতের মূল্য নেই? বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ নির্দ্ধারণ করবেন কিছু ইংরেজি-নবিশ? বাংলা শব্দটা শুনলেই যাঁদের কালিকারের কথা মনে পড়ে, তাঁরা বাংলা ভাষাটাকেও হয়তো মনে করেন চাকরবাকরের ভাষা! মাইকেলি আমলের মতো। সেই আমল থেকে এঁরা কিছুই শিক্ষা গ্রহণ করেননি? ইংরেজির জামা গায়ে দিয়ে এখনও পরের কাছে ভিক্ষাবৃত্তি?
কেউ কেউ গুলিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন যে বাংলা নিয়ে আন্দোলন মানেই ইংরেজি বর্জন। মোটেই তা নয়, আমরা বরং ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের পক্ষে। বর্তমান পরিবেশে ইংরেজি শিক্ষায় অবহেলা আত্মহত্যার সমান। কিন্তু ইংরেজিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বাংলাকে অবহেলা করব কেন? জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, সত্যজিৎ রায়, অমর্ত্য সেন প্রমুখের দৃষ্টান্ত কি আমরা মনে রাখব না? এখন যে সব ইংরেজিওয়ালা বাংলাকে অশ্রদ্ধা করেন, তাঁরা আমাদের করুণার পাত্র! আমরা হিন্দিরও বিরোধী নই, অনেক হিন্দিভাষী আমাদের বন্ধু, আমরা হিন্দি সাহিত্যের অনুরাগী। কিন্তু বাংলা ভাষা-সংস্কৃতিকে হঠিয়ে পশ্চাৎ দ্বার দিয়ে হিন্দি চাপাবার চেষ্টা হলে প্রতিরোধ করতেই হবে।
এরকমও শোনা যাচ্ছে যে কলকাতা ও বাংলার নাম বদল করা এমন কী জরুরি ছিল, না করলে কী ক্ষতি হত? ঠিকই, পরিবর্তন না করলেও কোনও ক্ষতি ছিল না। পালটা প্রশ্নও করা যায়, পরিবর্তনেই বা ক্ষতি কী? এতে যদি বাঙালিদের অধিকারবোধের খানিকটা প্রশ্রয় দেওয়া হয়, অন্যদের আপত্তি কেন? এই মেটোপলিটানের অবাঙালি অধিবাসীদের গায়ে কি এতে ফোস্কা পড়বে? সর্বভারতীয় পত্রপত্রিকায় পরিবর্তন প্রস্তাবের প্রতিবাদের প্রাবল্য দেখে সন্দেহ হয়, বাঙালিদের এই অধিকারবোধটাই অনেকে কেড়ে নিতে চায়। এই অধিকার কাড়তে গেলে সংঘর্ষ অনিবার্য।
রাজ্য ও রাজধানীর ইংরেজি নাম বদল একটা প্রতীক মাত্র। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য আরও অনেক ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু নাম বদলের প্রস্তাবেই এই হইচই, এত কটু-কাটব্য সত্যি বিস্ময়কর। আরও বিস্ময়কর, এর মধ্যে খেমকা নামে এক বিকৃতরুচি ব্যক্তির গ্রেফতারের ঘটনা জড়িয়ে ফেলা। সে ব্যক্তিটি ইন্টারনেটে বাংলার শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের নামে অপপ্রচার করছিল। সেই কুৎসিত ভাষা যদি কেউ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে চান করুন। আমরা তাকে শাস্তি দেবার কথা বলিনি। সে অবহেলার যোগ্য। কিন্তু জাতিবিদ্বেষ ছড়াবার দায়ে পুলিশ যদি তাকে গ্রেফতার করে, আইন তার নিজস্ব পথ নেবে, তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতে যাব কেন? এই নিয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা গেল গেল রব কতটা যুক্তিসঙ্গত? আদিরসাত্মক গালাগালি আর মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে যাঁরা এক করে দেখতে চান দেখুন। সেই ব্যক্তিটির জামিন পাবার সংবাদ কোনও পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় স্থান পায়, কোথাও পাঁচ কলম হেডিং! সংবাদটি এতই গুরুত্বপূর্ণ? সাংস্কৃতিক খবর দূরে থাক, দুর্ভিক্ষ বা বন্যার খবরও তো পাঁচ কলম পায় না! আর একটা কথা, কোনও পত্রিকায় যদি এই ব্যক্তিকে উপলক্ষ করে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার ব্যাপারে সম্পাদকীয়র পর সম্পাদকীয়তে (তাতে আবার ডিরোজিও-র নাম টেনে এনে তুলেনা, কী অপূর্ব ইতিহাস-জ্ঞান!) কুম্ভীরাশ্রু ঝরানো হয়, অনাবশ্যক আক্রমণ করা হয় আমাদের, সেই পত্রিকাতেই কী করে খুশবন্ত সিংহ একটি বই বাজেয়াপ্ত করা ও লেখকের গ্রেফতার সমর্থন করেন? হরিন্দর সিংহ নামে এক লেখক ‘ভ্যানিটি ইনকারনেট’ নামে উপন্যাস লিখেছেন। তাতে পঞ্জাবের বিভিন্ন নেতা, বিশেষ করে শেষ দুজন শিখ গুরুর নামে কুৎসা করা হয়েছে এই অপবাদে বইটির সমস্ত কপি বাজেয়াপ্ত করে পুলিশ লেখককে জেলে দিয়েছে। খুশবন্ত লিখেছেন : I came to the sad conclusion that the Punjab government was right in confiscating all copies of the novel and taking the author in custody. (The Telegraph 26 July, ’99). পঞ্জাবিদের বিরুদ্ধে গালাগাল শাস্তিযোগ্য, বাঙালিদের বিরুদ্ধে গালাগাল মত প্রকাশের স্বাধীনতা? নির্লজ্জ ডাবল স্ট্যান্ডার্ড আর কাকে বলে?
নাম বদলের প্রসঙ্গে অনেকে ইতিহাস নিয়ে টানাটানি করছেন। যেসব রাজনৈতিক নেতা দেওয়ালের লিখনও পড়তে পারেন না, তাঁরা যখন ইতিহাসের কথা আওড়ান, হাস্য সংবরণ করা দায় হয়। ‘আইন-ই-আকবরি’-তে কলকাতার উল্লেখ বস্তাপচা তথ্য। কম্পানির ডেসপ্যাচ আর কলকাতা নামের ইতিহাস নিয়ে অনেক কচকচি হয়েছে, অনেকেই তা জানে, নতুন করে পণ্ডিতি ফলাবার সুযোগ নেই। ইতিহাস যাঁরা চর্চা করেন তাঁরা জানেন ইতিহাস কোনও অনড় অক্ষয় ব্যাপার নয়, বহু বার, বহুরকম পট পরিবর্তনেই ইতিহাসের আসল রোমাঞ্চ। ইতিহাস কথাটার মানেই ‘যা ছিল’, সেই যা ছিল’র সঙ্গে বর্তমানের অমিল থাকতেই পারে। বহু দেশে বহু নগরের নাম বারবার পরিবর্তিত হয়েছে, নতুন নাম থেকে পুরোনো নামে ফিরে যাওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলা, নতুন পরিবর্তনও নয়, পুরোনো একটা নামে ফিরে যাওয়া। আগে বাংলাদেশ বা বঙ্গদেশ নামে দেশ ছিল না, ভারতের অন্তর্গত প্রদেশটির নাম ছিল বাংলা বা বেঙ্গল। একাত্তরের পর বাংলাদেশ নামে স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বাকি অংশটির নাম বাংলা হওয়াই তো ইতিহাসসম্মত। আর, মানুষ ইতিহাস আঁকড়ে ধরে বাঁচে না, বর্তমানের বাস্তবতা নিয়ে বাঁচে। বাংলা নাম বর্তমানের দাবি। ইতিহাস অবলম্বন করে যাঁরা বিরুদ্ধ যুক্তি শানান, তাঁরা অনতি-অতীত ইতিহাসে ভুল করে ফেলেন। বর্তমান লেখক কখনও হাংরি জেনারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তাঁদের নীতির সমর্থকও ছিলেন না, শুধু হাংরি লেখকদের প্রতি পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছিলেন; ‘আত্মপ্রকাশ’ উপন্যাস ১৯৬৩-তে প্রকাশিত হয়নি, ১৯৬৬-তে, এক প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ এই সামান্য বিষয়ে ভুল লিখেছেন, পরবর্তী বা যৌথ প্রতিবেদনে সংশোধনের চেষ্টা নেই। অপ্রাসঙ্গিক ভাবে কোনও লেখকের ছেলে আমেরিকায় থাকে সেই প্রসঙ্গ টেনে চরিত্রহননের মতন নীতিহীন সাংবাদিকতার মধ্যেও ইতিহাসের দোহাই দেখতে পাই।
একটি শেষ কথা বলি। আগের একটি লেখায় আমি বলেছিলাম যারা বাঙালিদের ‘বংগস’ বলে বিদ্রূপ করে, তাদের ঝুঁটি নেড়ে দেওয়া হবে। যাঁদের ভাষার সূক্ষ্মতা জ্ঞানের অভাব, তাঁরা ধরে নিয়েছেন, এতে বুঝি আমি হিংসার প্রশ্রয় দিয়েছি। ঝুঁটি নেড়ে দেওয়া মানে বাচ্চাদের সঙ্গে কৌতুকের মতন, এতে রাগারাগির কোনও ব্যাপার নেই। ঠিক আছে, ‘ঝুঁটি নেড়ে দেওয়া’ কথাটা প্রত্যাহার করছি, তার বদলে, বগলে কাতুকুতু দেওয়া হবে! এ বার রসিকতাটা বোঝা গেল তো? অনেকে কাতুকুতু না দিলে রসিকতা বোঝেন না। তবে চোখ রাঙানির ভাষা প্রত্যাহারে আমি রাজি নই। যারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির অপমান করবে, তাদের আমরা চোখ রাঙাবই। আমরা মানে কোটি কোটি বাঙালি।
রাকা রায় ওদিকে একলা লড়াই চালাবেন?
একটি কৌতুক-কাহিনি দিয়ে শুরু করি। গত বছর অক্টোবর মাসে কানাডার রাজধানী অটোয়া শহরে একটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে আমাকে যোগ দিতে হয়েছিল। ‘আন্তর্জাতিক’ নামে হলেও খুব বিশাল কিছু ব্যাপার নয়, সাত-আটটি ভাষার তিরিশ-পঁয়ত্রিশ জন লেখক-লেখিকা এসেছেন, স্থানীয়দেরই প্রাধান্য, সপ্তমবর্ষের এই উৎসবে ভারত থেকে এবছরও প্রথম দুজন লেখক ডাক পেয়েছেন।
আমাদের রাখা হয়েছে যে হোটেলে, তার একটি সুইট মিলন কেন্দ্র, লেখক-লেখিকারা সেখানে গিয়ে অন্যদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করতে পারেন, চা, কফি, লাল-সাদা সুরা ও স্যান্ডউইচ পাওয়া যাবে চব্বিশ ঘণ্টা। এক সন্ধ্যায় আড্ডায় যোগ দিতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল। আমাকে কেউ চেনেন না সুতরাং আত্মপরিচয় দেবার জন্য আমাকে বলতে হল আমি একজন বাংলা ভাষার লেখক। অন্যদের মুখের রেখা দেখে আমার মনে হল, বাংলা ভাষাটার নামই এঁদের কাছে অপরিচিত। দু-একজন আমতা আমতা করে বললেন, স্যানসক্রিটের সঙ্গে বোধহয় কিছু সম্পর্ক আছে? তখন আমি বললাম, বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন, তোমরা কি রবীন্দ্রনাথের নাম শুনেছ? কয়েকজন মুখ ফিরিয়ে অন্য আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, আমার সামনাসামনি দু-তিন জন অপরাধীর মতন মুখ করে বললেন, তাঁরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিষয়ও কিছু জানেন না। এঁরা অবশ্য নোবেল প্রাইজকে তেমন গুরুত্বও দেন না!
পরদিন সেখানকার জাতীয় গ্রন্থাগারের মধ্যে আমার কবিতা পাঠের জন্য বরাদ্দ ২০ মিনিটের মধ্যে অর্ধেক সময় কেটে নিয়ে আমি আমার পূর্বরাত্রির অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করে জানালাম যে বাংলা সারা বিশ্বের প্রধান ভাষাগুলির মধ্যে চতুর্থ কিংবা পঞ্চম। প্রায় ২৫ কোটি মানুষের মাতৃভাষা, ইতালিয়ান বা ফ্রেঞ্চ বা জার্মান ভাষা এর ধারে কাছে আসে না, বাংলায় প্রচুর বই ছাপা হয়, বেশ কয়েকজন লেখকের সাহিত্য রচনাই জীবিকা, হুমায়ুন আহমেদ নামে একজন লেখকের উপন্যাস দু-মাসে পঞ্চাশ হাজার কপি বিক্রি হয়, ইংরেজিতেও এরকম লেখকের সংখ্যা অঙ্গুলিমেয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু কাব্যনাটক লিখেছেন তা নয়, সারা পৃথিবীর বহু সাধারণ মানুষকেও গভীর ভাবে আপ্লুত করেছিলেন একসময়। এখনও ইউরোপের কয়েকটি দেশে, বিশেষত পূর্ব ইউরোপে, রাশিয়ায়, চিনে ও জাপানে যথেষ্ট রবীন্দ্রচর্চা হয়। আমেরিকা ও কানাডার লেখকরাই দেখছি রবীন্দ্রনাথকে মনে রাখেননি।
আসল কৌতুকটি এর পরে। অনুষ্ঠান শেষে বাইরে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছি, একজন মধ্যবয়েসি মহিলা এসে বিনীত ভাবে বললেন, আমি এখানকার গ্রন্থাগারিক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে আপনি আমাদের যে ভর্ৎসনা করলেন, তা হয়তো ঠিকই। আপনার কাছে একটা ব্যাপারে সাহায্য চাই, আমাদের এখানে কয়েকজন লেখকের ছবি আছে তার মধ্যে একজনকে আমরা ঠিক চিনতে পারি না, একটু এসে দেখবেন! লাইব্রেরির বড় হলঘরের এক দিকের সুউচ্চ কাঠের দেওয়ালে পরপর কয়েকজন বিশ্ববিখ্যাত লেখকের ছবি, তাঁদের মধ্যে শেষজন নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথ! অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ এখনও বিরাজমান, ওঁরা মনে রাখুন বা না-রাখুন।
আমরা বাংলাকে সারা বিশ্বের একটি প্রধান ভাষা বলে বড়াই করি, কিন্তু সারা বিশ্ব যে বাংলা ভাষা নিয়ে মাথাই ঘামায় না। চাইনিজ, ইংরেজি ও স্প্যানিশ-এর স্থান নির্দিষ্ট হয়ে আছে, চতুর্থ ও পঞ্চম স্থান হিন্দি এবং বাংলার, কোনও কোনও মতে বাংলা এবং হিন্দির। কিন্তু যারা এক বর্ণ চিনা ভাষা বোঝে না তারাও চিনা ভাষার নাম জানে। সে তুলনায় বাংলা ও হিন্দি সম্পর্কে অন্যান্য দেশের মানুষদের অজ্ঞতা সীমাহীন। যেহেতু ইন্ডিয়ান নামে কোনও ভাষা নেই তাই ইন্ডিয়া নামের দেশটির নিজস্ব ভাষা কী, তা অনেকেই বুঝতে পারে না। বেশির ভাগ দেশের নাম ও ভাষার নাম কাছাকাছি। একটি দেশ অথচ বহু ভাষা, দক্ষিণের ভাষা উত্তরে কেউ বোঝেই না, এটাও তো খুব অদ্ভুত। চিনের এ সমস্যা নেই।
কিছু কিছু বিশ্বকোষ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথকে বলা হয়েছে ‘হিন্দু’ কবি। তাঁর মৌলিক রচনাগুলি কোন ভাষায় লেখা তার উল্লেখ থাকে না। রবীন্দ্রনাথ কোনও বাংলা বইয়ের জন্য নোবেল পুরস্কার পাননি, পেয়েছিলেন তাঁর নিজস্ব ইংরেজিতে লেখা ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য। ফরাসি, জার্মান তো বটেই, পোলিশ কিংবা চিনে ভাষায় রচিত গ্রন্থ নোবেল পুরস্কার পেতে পারে, সেগুলির ইংরেজি অনুবাদ নয়, কিন্তু সেই ভাবে বাংলা ভাষায় রচিত কোনও গ্রন্থ নোবেল পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই।
বিপুল টাকা ছাড়া নোবেল পুরস্কারের তেমন সম্মান আর নেই। নির্বাচনে সাহিত্যমূল্য ছাড়াও অন্য অনেক কিছু বিবেচ্য। সুতরাং নোবেল পুরস্কার নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। পুরস্কারের নিরিখে সাহিত্যের সুবিচার হতে পারে না। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যে বিপুল ঐশ্বর্য আছে, সারা বিশ্বে তার পরিচয় ঘটানোই প্রকৃত প্রয়োজনীয়। এক সময় নানা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা পড়াবার ব্যবস্থা ছিল, অনেকগুলিই উঠে গেছে, কোথাও কোথাও টিমটিম করছে। এই বিভাগগুলি চাঙ্গা করার জন্য কিছু ব্যবস্থা করতে পারে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার। অর্থাভাব বা অস্থিরতা যে কারণেই হোক বাংলাদেশ সরকার এ দিকে মন দেয় না, আর ভারত সরকারের বাংলা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই। তাদের যাবতীয় উদ্যম অযৌক্তিকভাবে হিন্দি ভাষাতেই সীমাবদ্ধ।
এবারে এই লেখাটির প্রাসঙ্গিকতার কথা বলি। উত্তর আমেরিকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ানো হয় বলে একটা ধারণা চালু আছে, কিন্তু সেটা নিতান্তই ভ্রান্ত। একমাত্র শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগে আছে বাংলা শাখা, জীবনানন্দ দাশের জীবনী রচয়িতা ক্লিন্টন সিলি-র অধীনে। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ন’-দশ জন। আমি দেখে এসেছি বছর তিনেক আগে। অপর দু-তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগ আছে নামমাত্র। হয় সব সময়ের শিক্ষার্থী নেই, অথবা পূর্ণ সময়ের শিক্ষক নেই। আমেরিকার সবচেয়ে বিখ্যাত দুটি বিশ্ববিদ্যালয় বস্টন-এর হার্ভার্ড এবং বার্কলের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া। এই দুটিতে অস্তিত্ব নেই বাংলা বিভাগের। যদিও এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে আছেন দুজন বাঙালি, হার্ভার্ডে শ্রীসুগত বসু এবং বার্কলেতে শ্রীমতী রাকা রায়।
শ্রীসুগত বসু তাঁর বিভাগের কার্যক্রম নানাভাবে প্রসারিত করার জন্য উদ্যম নিয়েছেন শুনেছি। আমি এখানে বার্কলের কথা কিছু বলি। বার্কলেতে হিন্দি, সংস্কৃত, উর্দু, তামিল এবং পাঞ্জাবি ভাষাও পড়ানো হয়, কিন্তু বাংলা বাদ। সেজন্য সেখানকার চেয়ারপার্সন রাকা রায়ের মনোবেদনার শেষ নেই। রাকা কলকাতার লোরেটো কলেজে পড়া মেয়ে, তারপর পাড়ি দিয়েছেন আমেরিকায়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে অনেক বছর বিশেষ সংযোগ ছিল না। বিদেশেই অনেক সময়ে মাতৃভাষার প্রতি টান নতুন করে ফিরে আসে। পাঁচটি ভারতীয় ভাষা পড়ানো হয় অথচ বাংলা অবহেলিত, এটা শ্রীমতী রায় সহ্য করতে পারছেন না। এই গৌরবময় বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, একা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ওঁর সঙ্গে কথা বলে মনে হল রাকা তাঁর মা ভারতী রায়ের (বিশিষ্ট গবেষক, এক সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য) মতনই জেদি।
ও দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বিভিন্ন বিভাগ। গবেষণা চালাতে গেলে বাইরে থেকে টাকা আনতে হয়। বিভাগগুলি নানারকম স্পনসরশিপের উপরও নির্ভর করে। ক্যালিফোর্নিয়ার পঞ্জাবি এবং তামিল গোষ্ঠী নিজেদের উদ্যোগে অর্থ সংগ্রহ করে তাঁদের ভাষায় পঠন-পাঠন চালু রেখেছেন। ক্যালিফোর্নিয়া তথা গোটা আমেরিকায় ধনী বাঙালির অভাব নেই। কিন্তু তাঁরা বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারে উদাসীন।
টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ প্রণিধানযোগ্য। সেখানকার এক সহৃদয় বাঙালি, স্ত্রী বিয়োগের পর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা শিক্ষার জন্য বেশ কয়েক লক্ষ ডলার দান করেছেন। স্থানীয় বাঙালিরা আরও কিছু টাকাপয়সা জোগাড় করেছেন, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগে বাংলা ভাষা শিক্ষা ও সাহিত্য পাঠ চলছে পূর্ণ উদ্যমে। দু-বছর আগে উপস্থিত হয়েছিলাম সেখানকার ছাত্রছাত্রীদের সামনে। প্যারিসের সোরবন, লন্ডনের ‘সোয়াস’, পোল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকার সুযোগ আমার ঘটেছে। কোথাও টরেন্টোর মতন এত বেশি ছাত্রছাত্রী দেখিনি। উনিশ জন। (এঁদের মধ্যে সতেরো জনই বাংলাদেশি, দুজন ক্যারিবিয়ান মহিলা। ওই মহিলাদ্বয়কে আমি নিবেদন করেছিলাম, তাঁদের বাংলা শেখার আগ্রহের কারণ কী? ওঁরা বললেন, ওঁদের ঠাকুমা বা দিদিমা সম্ভবত বাঙালি ছিলেন, তাই শিকড় খুঁজতে এসেছেন। পশ্চিমবঙ্গীয় ছাত্রছাত্রী একজনও নেই। অথচ বাংলা বিভাগটি চাঙ্গা রাখতে যে স্থানীয় বাঙালিরা উৎসাহী ও সময় ব্যয় করছেন তাঁরা সবাই পশ্চিমবঙ্গীয়। তাঁদের ছেলেমেয়েরা বাংলা শিখতে যায় না।)
তবে, প্যারিসে, পোল্যান্ডে, লন্ডনে, শিকাগো এবং নর্থ ক্যারোলাইনাতে যারা বাংলা শিখতে যায় তাদের অনেকেই অ-ভারতীয়, তথা প্রতীচ্যের। সেরকম ছাত্রছাত্রী কাম্য। বার্কলে ছাত্রমহলে একটা আন্তর্জাতিক আবহাওয়া বরাবরই থাকে। বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রীরা যদি বাংলা শিখতে আগ্রহী হয় তাতেই এই বিভাগের সার্থকতা। বাংলা শেখাটা নিতান্ত শখেরও নয়, এজন্য ক্রেডিটও পাওয়া যায়।
কিন্তু রাখা রায় কতদিন একা লড়াই চালাবেন? উত্তর আমেরিকায় প্রতি বছরই খুব ধুমধাম করে বঙ্গ সম্মেলন হয় বিভিন্ন শহরে। খরচ হয় লক্ষ লক্ষ ডলার। কিছু কি উদ্বৃত্ত হয় না, কিংবা বাঁচিয়ে রাখা যায় না কিছু অর্থ? বঙ্গ সম্মেলনের উদ্যোক্তারা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ক্লাস চালু করতে পারলে নিজেরাই গর্ব বোধ করবেন। বার্কলে থেকেই তা শুরু হতে পারে। দু-হাজর সালে প্রবাসী বাঙালিদের উদ্যোগে কলকাতায় হয়েছিল বিশ্ব বঙ্গ সম্মেলন।
তখন বেশ কিছু অর্থ উদ্বৃত্ত হয়েছিল বলে শুনেছি। সেই অর্থে একটা কোনও স্থায়ী কাজ করা হবে এমন ঘোষণাও শোনা গিয়েছিল। কিন্তু হয়েছে কি? পশ্চিমবঙ্গেই লেখাপড়া শিখে অনেক রমণী ও পুরুষ বিদেশে গিয়ে জীবিকার্জনে বিশেষ সার্থক হয়েছেন, তাঁরা কি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি প্রসারের জন্য কিছু কিছু সাহায্য করে কিঞ্চিৎ মাতৃঋণ শোধ করার কথা চিন্তা করতে পারেন না? তাঁদের কাছে এই আমার বিনীত আবেদন।
যত দূরেই যাই
বাঙালি কে? দ্বিখণ্ডিত বাংলার দু-দিকের মানুষজনই শুধু বাঙালি? ত্রিপুরা রাজ্যের গরিষ্ঠ সংখ্যক বাংলাভাষীরা তবে কী? কিংবা অসমের কাছাড় জেলায়, কিংবা বিহার, ওড়িশার কিছু অংশে, বারাণসী বা দিল্লিতে, এমনকী, ইউরোপ, আমেরিকায় ছড়িয়ে থাকা বঙ্গভাষীদের কী বলা হবে? অর্থাৎ বাংলা যার ভাষা, সে-ই বাঙালি হবার যোগ্য! কিন্তু, যাদের মাতৃভাষা বাংলা নয়, অথচ অনেক বাঙালির চেয়েও ভালো বাংলা জানেন, বাংলায় উল্লেখযোগ্য রচনা লিখেছেন, যেমন সখারাম গণেশ দেউস্কর, আবু সঈদ আইয়ুব, বসন্ত গোবিন্দ পোৎদার, আমাদের সহকর্মী বিক্রমণ নায়ার, তাঁদের কী বলা হবে?
বাঙালি হওয়া কি পুরুষানুক্রমের উত্তরাধিকার? ঠাকুরদা স্বদেশি আমলে জেল খেটেছেন, বাবা বিদেশে বসবাসকারী ধনাঢ্য চিকিৎসক, ছেলেমেয়েরা এক বর্ণ বাংলা জানেন না, এই তৃতীয় প্রজন্মও কি বাঙালি, না তাদের নাম কেটে দেওয়া হবে? শুধু বিদেশে কেন, এ দেশে, এমনকী কলকাতাতেও এই তৃতীয় প্রজন্ম দেখা যায়। অপর পক্ষে, যাঁদের আমরা অবাঙালি বলি পদবি দেখে, এই ভৌগোলিক সীমানাতেই আছেন কয়েক পুরুষ, এখন দিব্যি গড়গড়িয়ে বাংলা বলেন, তাঁরা বাঙালি পদবাচ্য হবেন না?
পদবি দেখে বিচার করতে গেলে, মুসলমানদের তো পদবিই থাকে না। কলকাতা শহরের হিন্দুরা বিভিন্ন পেশায় অবাঙালি মুসলমানদের দেখে অভ্যস্ত বলে হঠাৎ কোনও নবাগত মুসলমানকে দেখে বলে ফেলেন, ওই লোকটি মুসলমান, না বাঙালি? এই অবোধেরা জানেন না যে উভয় বঙ্গ মিলিয়ে বাংলাভাষীদের মধ্যে মুসলমানরাই অনেক বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠ। ইতিহাসের দিক দিয়ে দেখতে গেলে, সুলতানি আমলেই প্রথমে বাংলা ভাষা দানা বেঁধে ওঠে। ব্রিটিশ আমলেও যখন শিক্ষিত হিন্দু বাঙালিরা ইংরেজিতে তুবড়ি ফাটাতেন, তখন বিধানসভায় মুসলমান সদস্যরাই প্রথম বাংলা ভাষায় ভাষণ দেবার দাবি তোলেন। তারপর তো পাকিস্তানি আমলে উনিশশো বাহান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তপাত। শিলচরেও বাংলার দাবিতে এগারো জন প্রাণ দিয়েছিলেন, কিন্তু সেই বাঙালিদের পশ্চিমবঙ্গবাসীরাও তেমন মনে রাখেনি।
বাঙালিরা সাধারণত বাক্যবাগীশ এবং নিরীহ ধরনের প্রানী হিসেবে পরিচিত। যদিও স্বাধীনতার যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং আন্দামানে কারাদণ্ড ভোগ করেছে। পরবর্তীকালেও বাংলার তরুণরা স্বপ্ন দেখেছে সশস্ত্র বিপ্লবের এবং তার জন্য প্রাণ দিতে দ্বিধা করেনি। আবার, বাঙালির অজ্ঞতা ও আন্তম্ভরিতাও প্রচণ্ড। যেমন, তারা ঘোষণা করে, ক্ষুদিরামই ফাঁসির দড়িতে প্রথম শহিদ। প্রকৃত পক্ষে তার অনেক আগে মহারাষ্ট্রে ইংরেজকে হত্যা করে চাপেকররা তিন ভাই এক সঙ্গে ফাঁসির দড়িতে মৃত্যু বরণ করেছিলেন। বাঙালি জাতির চরিত্র বহু বৈপরীত্যে ভরা।
দৃশ্যপটে বাংলা : প্রয়োজনে চাই ভাষা-পুলিশ
একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখটি রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে, পৃথিবীর সব দেশেই মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রতিবছর পালিত হবে, এরকম ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ এই দিনটির তাৎপর্য শুধু বাংলা ভাষা-ভাষীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, এর আবেদন আন্তর্জাতিক।
কিন্তু মাতৃভাষা দিবস হিসেবে তারিখটি পালিত হবে কী ভাবে? শুধু নামকাওয়াস্তে দু-চারটি সরকারি কিংবা বে-সরকারি অনুষ্ঠান? মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষণার মর্মই এই যে মাতৃভাষার বিশেষ পরিচর্যার দরকার। নিজের মাকে তাঁর জন্মদিনে শুধু একটি শাড়ি কিনে দেওয়া কিংবা কার্ড পাঠিয়েই দায়িত্ব স্খালন করা অমানবিকতারই নামান্তর। মা ও মাতৃভাষার স্বাস্থ্যরক্ষা এবং নিরন্তর পরিচর্যার প্রয়োজন।
এই পরিচর্যার দুটি দিক আছে। প্রথমত, ভাষা ও ব্যাকরণের বিশুদ্ধতা রক্ষা, নতুন নতুন আহরিত শব্দের স্বীকৃতি এবং অভিধানের আধুনিকীকরণ। দ্বিতীয়ত, ভাষার প্রসার ও বিস্তার। অনেক বছর ধরে আমাদের বাংলা ভাষা প্রসারিত হবার বদলে বরং সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। অন্য ভাষার যে বহুসংখ্যক মানুষ কলকাতা তথা পশ্চিম বাংলায় বসতি স্থাপন করেন, এক কালে তাঁরা সবাই বাংলা ভাষা শিখে নিতেন, এখন প্রবাহ উলটো দিকে, এখন বাঙালিরাও তাঁদের সঙ্গে হিন্দি বা ইংরেজিতে কথা বলেন। শিক্ষানীতির গলদের জন্য পশ্চিম বাংলার সব স্কুলে বাংলা পড়ানো বাধ্যতামূলক করা হয়নি, তার ফলে বহু বাঙালি ছাত্রছাত্রীই এখন আর বাংলা শেখে না। উত্তর বাংলার বহু অঞ্চলে, দার্জিলিঙে টেলিভিশন, রেডিয়ো অর্থহীন, কলকাতার কোনও বাংলা অনুষ্ঠান সেখানে পৌঁছয় না। বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি থেকে তারা বিচ্ছিন্ন বলেই সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথা চাড়া দেয়। পশ্চিম বাংলার অন্তর্গত দার্জিলিঙের নেপালিরা অনেক প্রজন্ম ধরে এখানে রয়েছে, তারা কি বাংলা ভাষা শিখতে অস্বীকার করেছে, না তাদের আমরা বাংলা ভাষা থেকে বঞ্চিত করেছি?
যাই হোক, এসব বিষয় নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। এখন শুধু একটি বিষয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে চাই। ভারতে যে-কোনও শহরে গেলে চতুর্দিকে তাকিয়ে বোঝা যায়, সেখানকার প্রধান ভাষা কী। একমাত্র কলকাতাই তার ব্যতিক্রম। কলকাতার দৃশ্যপট থেকে বাংলা ভাষা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। এসপ্লানেডের মোড়ে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে চতুর্দিকে দেখলে কোনও হোর্ডিং-এ, পোস্টারে, দোকানের সাইনবোর্ডে একটিও বাংলা অক্ষর চোখে পড়ে না। রতন বসু মজুমদারের নেতৃত্বে একটি সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, কলকাতার অধিকাংশ রাস্তায়, যেমন ধর্মতলা থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত সোল অ্যাভিনিউতে শতকরা আশি ভাগ হোর্ডিং-সাইনবোর্ডে বাংলা অদৃশ্য। টামে-বাসে বাংলার ব্যবহার নেই।
আমরা কলকাতাকে একটা কসমোপলিটান শহর বলে গণ্য করতে ভালোবাসি। সেই কসমোপলিটান চরিত্রও যে এ শহর অনেকখানি হারিয়ে ফেলেছে এবং বিশেষ এক ভাষা-ভাষীর কুক্ষিগত হতে চলেছে, সে খেয়াল করি না। যাই হোক, আমরা ইংরেজি বা হিন্দির বিরোধী নই, সব ভাষারই পক্ষপাতী, যে যেমন খুশি ভাষায় সাইনবোর্ড লিখবেন, কিন্তু তার কোনও একটি অংশে বাংলাও থাকবে না কেন? সেটা না থাকার অর্থ, এ রাজ্যের ভাষা বাংলাকে অগ্রাহ্য করার মনোভাব, এবং আমরা তা এতদিন প্রশ্রয় দিয়েছি। এ রাজ্যের ছেলেমেয়েরা রাস্তায় বেরিয়ে যদি কোথাও দৃশ্যপটে বাংলা না দেখতে পায়, তা হলে বাংলা ভাষা সম্পর্কে তাদের চেতনাই হবে না। বাংলা সম্পর্কে সচেতন করার জন্যই দৃশ্যপটে বাংলা রাখা বিশেষ জরুরি।
রাজ্য সরকার কিংবা পৌরসভা এই ব্যবস্থা অনায়াসেই করতে পারেন, কিন্তু করেননি। এজন্য জোর-জবরদস্তির প্রয়োজন নেই, হোর্ডিং-সাইনবোর্ডের জন্য লাইসেন্স নিতে হয়, তাতে এরকম একটা শর্ত জুড়ে দেওয়া খুব স্বাভাবিক ছিল। একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে, কানাডার মিয়েল-কুইবেক অঞ্চলে ইংরেজির বদলে ফরাসিই প্রধান ভাষা। সেখানকার সমস্ত হোর্ডিং-সাইনবোর্ডে ফরাসি লেখা বাধ্যতামূলক। ব্যবসায়ীরা এই নিয়ম মান্য করছে কি না তা দেখার জন্য ভাষা-পুলিশ আছে। সেই পুলিশ কর্মীরা পথে ঘুরে ঘুরে দেখেন, কোথাও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হলে, অর্থাৎ কোথাও শুধু ইংরিজি সাইনবোর্ড থাকলে তা খুলে ফেলতে বাধ্য করা হয়। এরকম আমি স্বচক্ষে দেখেছি।
আমাদের এখানেও সেরকম ভাষা-পুলিশের দরকার। এই পুলিশদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র থাকার দরকার নেই, এঁরা সমস্ত দোকানদার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে সবিনয় অনুরোধ জানাবেন, আংশিক, অন্তত এক তৃতীয়াংশ বাংলা রাখার জন্য। হয়তো সকলেই মেনে নেবেন—আগে তো তাঁদের এ বিষয়ে কেউ সচেতন করেননি। যদি কেউ তেড়িয়া ভাব দেখান, তা হলে একটু আধটু চোখরাঙানি দেওয়া যেতে পারে। তার বেশি কিছু নয়।
এই ভাষা-পুলিশ গঠন করবে কে? আমি মাঝে মাঝেই ভাবি, যে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন ও বাংলা ভাষা নিয়ে মেতে আছে, তাদের প্রতি আহ্বান জানালে সাড়া পাওয়া যাবে না? অনেকেই যে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসবেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবু, এরকম আহ্বান জানাবার আগে দ্বিধারও কারণ আছে। ভাষা-পুলিশের এই অভিযানের সময় সত্যিকারের সৎ ও নিষ্ঠাবান বাংলা ভাষা-প্রেমীদের মধ্যে যদি কিছু হল্লাবাজ ও দুষ্ট লোক ঢুকে পড়ে এবং দোকানের সাইনবোর্ড সংশোধনের অনুরোধের বদলে অত্যুৎসাহে সে দোকান লুটপাট শুরু করে দেয়, তবে তার দায়িত্ব কে নেবে? সে সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না। আমরা এরকম অনাচার একেবারেই চাই না। কলকাতায় এমনিতেই নানারকম অনাচার ঘটে, ভাষার নামে সেরকম অনাচার বৃদ্ধি একেবারেই বরদাস্ত করা যাবে না। আমরা ভাষা-প্রেমিক হতে পারি কিন্তু উগ্রপন্থী হতে পারি না, ওদের হৃদয়ে কোনওরকম প্রেমই থাকে না।
সুতরাং সরকারেরই উচিত উদ্যোগ নিয়ে, দায়িত্ববান ব্যক্তিদের দিয়ে ভাষা পুলিশ না হোক, ভাষা-স্বয়ংসেবক বাহিনী গড়ে তোলা। নানা উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে একে যুক্ত করা। ভাষার উন্নয়নও একটি জাতির ইতিহাসের পক্ষে খুবই প্রয়োজনীয়।
সামনে তাকালে বাংলা অক্ষর চোখেই পড়ে না!
আমার কিছু কিছু বন্ধু মাঝেমধ্যেই অভিযোগ করেন, বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান হয়েছে। এ বন্ধুরা পাশাপাশি এটাও স্বীকার করেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুটো উৎসবের একটি হল—নববর্ষ। অন্যটি—একুশে ফেব্রুয়ারি। দুটোই ধর্মনিরপেক্ষ। পশ্চিমবঙ্গের বড় উৎসব একটাই। সেটা—দুর্গাপুজো। পুরোটাই ধর্মীয়।
বাংলা সন-তারিখ আমাদের এখানে এখন আর কেউ মনে রাখে না। মফস্সলে, গ্রামেগঞ্জে বাংলা তারিখ-টারিখের চল রয়েছে এখনও। শহরের শিক্ষিতরা পঁচিশে বৈশাখ বাংলা তারিখটা মনে রাখেন রবীন্দ্রনাথের কারণে। পয়লা বৈশাখও যে বাঙালিরা একদম ভুলে গেছেন এমন নয়। ওইদিন যাঁদের ছুটি, তাঁরা মনে রাখেন।
বাংলাদেশের জেলায় জেলায়, মহকুমা শহরে মফসসলে, গ্রামে পয়লা বৈশাখে মঞ্চ বেঁধে নাচ-গানের মাধ্যমে ধূমধাম করে বর্ষবরণ হয়। সমস্ত সাধারণ মানুষ এই উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে যান। একুশে ফেব্রুয়ারিতেও তাই। আমাদের এখানে অনেকেই এখনও একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য জানেন না।
আমাদের পশ্চিমবঙ্গেই, সামনে তাকালে চট করে বাংলা অক্ষরে দেখাই মেলে না। হাজরার দিকে যেতে ‘সত্যনারায়ণ মিষ্ঠান্ন ভাণ্ডার’ আর ভিআইপি রোড ধরে বিমানবন্দরের দিকে যেতে রাস্তার বাঁ-দিকে ‘ঋত্তিক’ কত বড় পয়সাওয়ালা লোকের বাড়ি, কিন্তু বাংলা বানানের কী দূরবস্থা! নন্দন চত্বরেই চার-পাঁচটা জায়গায় বাংলা বানান ভুল রয়েছে। স্বয়ং শঙ্খ ঘোষ আঙুল দিয়ে ওই ভুলগুলো কর্তৃপক্ষের নজরে এনেছেন। বলেছেন বেশ কয়েকবার। সরকার নড়ে না, চড়ে না।
পয়লা বৈশাখ, নববর্ষ মানে তো বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে মনে করিয়ে দেওয়া। ক্লাব, যারা ফুটবল খেলার আয়োজন করে, ক্যারাম খ্যালে, সাঁতার প্রতিযোগিতা করে, ক্রিকেটের আসর বসায় তাঁদেরই বাংলার এই সংস্কৃতিকে মনে করিয়ে দিতে হবে। উদ্যোগী হতে হবে। দলমত নির্বিশেষে সমস্ত রাজনৈতিক দল যদি এই কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসতে পারত, তাহলে রাজনৈতিক হানাহানিটাও অনেক কমে যেত। স্বদেশি, আমলে সাংস্কৃতিক উৎসবের ঘটা ছিল, তার প্রভাবও ছিল ব্যাপক। স্বাধীনতার পর ইংরেজরা দেশ ছেড়ে চলে গেল, আমরা বেশি বেশি করে ইংরেজির ভক্ত হয়ে গেলাম। কথায় কথায় ইংরেজি বলি, আর ভুল-ভাল বাংলাও।
মহারাষ্ট্রে, ওড়িশায় সে যে স্কুলেই পড়ো সেখানকার ভাষা পড়তেই হবে। একমাত্র আমাদের পশ্চিম বাংলায় সেসবের বালাই নেই। সরকারকে বারবার বলেছি, বাংলা ভাষাকে গুরুত্ব দিতে হবে, স্কুলমাত্রেই বাংলাকে আবশ্যিক করতে হবে, মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী সবাই নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছেন, তারপর অবাস্তব হাস্যকর সমস্ত কারণে এই সিদ্ধান্ত কাজে লাগানো হয়নি।
ছোটবেলায় আমরা সাইনবোর্ড দেখে বাংলা শিখেছি। ইংরেজিও। আমার প্রস্তাব, অন্তত এক তৃতীয়াংশ সাইনবোর্ড বাংলায় লিখতে বাধ্য করা হোক। ইংরেজি, উর্দু, হিন্দি থাকবে না—একবারও বলছি না। কিন্তু জোর দিতে চাইছি, সাইনবোর্ডে বাংলা লেখা থাকাটা বাধ্যতামূলক করা হোক। সাইনবোর্ড অর্থাৎ দোকান পরিচিতিতে ভুল বাংলা লিখলে, চলচ্চিত্রের পরিচয়লিপি, দূরদর্শন সহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ভুল বাংলা লেখা এবং বলার অপরাধের জন্য জরিমানার ব্যবস্থা হোক।
উত্তর কলকাতায় থাকতাম। ইচ্ছে থাকুক না থাকুক বাবা-মায়ের সঙ্গে হালখাতার দিন বিভিন্ন দোকানে দোকানে যেতে হত। মিষ্টি, শরবত খেতাম। সে সময় নববর্ষের দিনে প্রভাতফেরি হত। সাদা হাফ প্যান্ট, সাদা হাফ শার্ট পরে সেই প্রভাতফেরিতে আমিও যোগ দিয়েছি। ব্যান্ড বাজতো। বিউগিলও। আমিও বাজিয়েছি। এখন সেসব কোথায়? এখন তো সবেতেই ইংরেজি-কে তা। ১লা জানুয়ারিতেই সবাই নববর্ষ নিয়ে মাতোয়ারা।
প্রথম শ্রেণি থেকে ইংরেজি শেখানো হোক, তাতে আমার পূর্ণ সমর্থন। আমরাও তো সেভাবেই পড়ে এসেছি। কোনও অসুবিধেই হয়নি। তবে এখন যারা শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন, তাঁরা অধিকাংশই শুদ্ধভাবে ইংরেজি উচ্চারণ করতে পারেন না। ঠিক হয়েছে, ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে ওঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।
বাংলার সঙ্গে সমান যত্ন নিয়ে ইংরেজি শিখলে দোষের তো কিছু নেই। ইংরেজির প্রাথমিক জ্ঞানটা থাকলে যেখানেই যাক মাইলপোস্ট পড়তে অন্তত অসুবিধে হবে না। বাংলা, ইংরেজি—সবই শিখতে হবে শেখার মতো করে। কষ্ট হলেও বলা উচিত, বিদেশে যে বাঙালিরা থাকেন, সেই বাঙালিদের পুরোনো প্রজন্ম বাংলা ভাষায় কথা বলা, বই পড়া, গান শোনা, লেখার জন্য যেরকম আকুলি-বিকুলি করেন, নতুন প্রজন্মের মধ্যে তার কিছুমাত্র আগ্রহ নেই।
আগে পয়লা বৈশাখে বইপাড়ায় লেখকদের ডেকে শুধু মিষ্টিমুখই করানো হত না সঙ্গে বই প্রকাশের উৎসবও হত। কত বই বেরোত তখন। এখন বইটই সব বেরোয় বইমেলায়। প্রকাশকরা নববর্ষে লেখকদের আমন্ত্রণ করেন, একটু মিষ্টিমুখ, অনেকদিন বাদে একজনের সঙ্গে, অন্যজনের দেখা এসবই হয়টয়।
জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, Indian literature is one, but written in many languages, কথাটা শুনতে ভালো। কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে কোনও মিল নেই। একজন শিক্ষিত ভারতীয় ইউরোপ-আমেরিকার সাহিত্য সম্পর্কে যত খবর রাখেন, সেই তুলনায় অন্য ভারতীয় ভাষাগুলির সাহিত্য সম্পর্কে তাঁকে অজ্ঞই বলা যায়। তবু, ভারতের এমন কয়েকটি ভাষা আছে যেগুলি সারা বিশ্বের প্রধান ভাষাগুলির সমপর্যায়ের। চিনে ভাষা অবশ্যই এক নম্বর ভাষা।
ইউরোপের দেশগুলি ছোট, ছোট, সেখানকার কয়েকটি ভাষা খুবই সমৃদ্ধ। কিন্তু এক-একটি দেশের জনসাধারণের মাতৃভাষা শুধু সংখ্যার বিচারে এশিয়ার ভাষাগুলির সমকক্ষ হতে পারে না। এর মধ্যে ইংরেজ ও স্প্যানিশরা বিভিন্ন মহাদেশে কলোনি স্থাপন করে নিজেদের ভাষা ছড়িয়ে দিয়েছে। যেমন আমেরিকা এবং ক্যানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ায় ইংরেজি ভাষার প্রাধান্যের জোরেই এখন ইংরেজি পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রধান ভাষা। স্প্যানিশ ভাষাও প্রাধান্য পেয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার অনেকগুলি রাজ্যে, তার স্থান তৃতীয়। কিন্তু ভারতীয়রা কলোনি বিস্তার করতে পারেনি বা চায়নি, তা সত্ত্বেও তাদের দুটি ভাষা, হিন্দি ও বাংলা জনসংখ্যার ভিত্তিতে পৃথিবীতে চতুর্থ ও পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে। একেবারে সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে স্প্যানিশ ভাষাকে পেছনে সরিয়ে দিয়ে হিন্দি ও বাংলা চলে এসেছে তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে। টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলাম, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে মুসলমানদের অবদান অনেকখানি। মধ্যযুগে বঙ্গভূমি বা বাংলা নামে কোনও বড় রাজ্য ছিল না। ভৌগোলিকভাবে এই অঞ্চল ছিল অনেকগুলি ছোট ছোট রাজত্বে বিভক্ত। সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ এই ছোট ছোট রাজ্যগুলিকে জয় করে এক সীমানার মধ্যে নিয়ে আসেন। তখন পর্যন্ত বাংলা ভাষার নিজস্ব কোনও রূপরেখা গড়ে ওঠেনি। যুক্ত হওয়ার পর বিভিন্ন অংশের সঙ্গে যোগাযোগের ভাষা অর্থাৎ Lingua franca হিসেবে বাংলা ভাষা গড়ে ওঠে। কিন্তু তখন এই ভাষার নাম কী ছিল? বাঙালিরা তাদের মাতৃভাষার নাম যে বাংলা, তা জেনেছে অনেক পরে। তখন সাধারণ মানুষ দুটি ভাষার কথা জানত, শাস্ত্রের ভাষা বা পণ্ডিতদের ভাষার নাম সংস্কৃত আর জনসাধারণের ভাষার নাম দেশি ভাষা, অথবা শুধু ভাষা। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ফারসি ভাষাভাষী মুসলমানরাই প্রথমে এই দেশীয় ভাষার নাম দেয় বাঙ্গলহ বা Bangalla। মা হুয়ান নামে এক চিন দেশীয় মুসলমান পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে সমুদ্র অভিযানে বেরিয়ে বাংলা অঞ্চলেও এসেছিলেন, তিনি লিখেছিলেন যে এই দেশের লোক প্রধান যে ভাষাটি ব্যবহার করে তার নাম বঙ্গ-কো-লি। অর্থাৎ বঙ্গালি বা বাঙ্গালি। অর্থাৎ মা হুয়ানের রচনাতেই প্রথম বাংলা ভাষার নামটি পাওয়া যায়। সুলতানি আমলে হিন্দুদের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানরাও এই বাংলা ভাষাতেই সাহিত্য রচনা শুরু করেন।
সৌভাগ্যবশত সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগে কিংবা রাজনৈতিক কারণে মুসলমানদের জন্য আলাদা ধরনের কোনও বাংলা ভাষা গড়ে উঠতে পারেনি। বঙ্কিম-মীর মুশারফ-রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের সৃষ্টিতে যে অত্যন্ত শক্তিশালী ও আধুনিক বাংলা ভাষা বর্তমানে রূপ পেয়েছে, তাতে, হিন্দু মুসলমানের সমান উত্তরাধিকার। স্বাধীনতার পর দেশভাগ হওয়ার সময় বাংলা ভাষাও ভাগ হবার একটা সম্ভাবনা ছিল। সেই সময় প্রখ্যাত পণ্ডিত ও ভাষাবিদ ডঃ শহিদুল্লা একটি বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করেন। পূর্ব-পাকিস্তানের বাংলা ভাষার রূপ কী হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলায় বিভিন্ন জেলার কথ্য ভাষা ভিন্ন ভিন্ন। যশোর জেলার সঙ্গে চট্টগ্রামের ভাষার এতই তফাত যে প্রায় এক ভাষা বলে বোঝাই যায় না। শুধু উচ্চারণ নয়, শব্দ ব্যবহার এবং ক্রিয়া পদেও অনেক অমিল। কোনও কোনও জেলায় অতীত ক্রিয়াপদ দিয়ে ভবিষ্যৎ বোঝানো হয়। সুতরাং কোনও বিশেষ একটি জেলার ধরে নিলে প্রচুর গোলমালের সম্ভাবনা ছিল। সেই সময় ডঃ শহিদুল্লা বলেছিলেন, পশ্চিম বাংলার কৃষ্ণনগর অঞ্চলের ভাষায় সমগ্র বাঙালির ও বাংলা সাহিত্যের স্ট্যান্ডার্ড ভাষা হিসেবে আগেই গৃহীত হয়ে আছে, সুতরাং তার থেকে সরে গেলে পূর্ব বাংলার ভাষা, বাংলা ভাষার মূল স্রোত থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এই সাহসী সিদ্ধান্তের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সংবাদপত্রে, রেডিয়োতে এবং টিভিতে যে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হয় তা মূল স্রোতের বাংলা। বাংলাদেশ ও ভারতের, এবং পৃথিবীর বহু দেশে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিদের ভাষা একই রয়ে গেছে। ভাষাই যেহেতু সংস্কৃতির প্রধান বাহন, তাই রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিভেদ যতই মাথা চাড়া দিয়ে উঠুক মাঝে মাঝে ভাষার সূত্রে সমস্ত বাঙালিদের আত্মীয়তা কখনও বিচ্ছিন্ন হয়নি। ভাষার শক্তিতে বিশ্বের পঁচিশ কোটি বাঙালি যতদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকতে পারবে, ততদিনই বাংলাভাষা বিশ্বের অন্যতম প্রধান ভাষা হিসেবে গণ্য হবে।
প্রতিবাদের ভাষা কেন কলুষিত হবে?
সংবাদপত্রের পাতায় নন্দীগ্রাম নিয়ে কোনও না কোনও খবর প্রায় প্রতিদিনই উঠে আসছে। গত ১৪ মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত নন্দীগ্রামকে ঘিরে এক ধারাবাহিক ঘটনাপ্রবাহ চলছেই। সেদিন পুলিশের গুলিতে নন্দীগ্রামে চোদ্দো জন নারী-পুরুষের মৃত্যু, অথচ পুলিশের প্রতি প্রত্যাঘাতের তেমন কোনও নিদর্শন নেই, এ খবর শুনে প্রথমে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এ তো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার নিমিত্ত ও নয়, সেসব ক্ষেত্রে ধেয়ে আসা জনতার দিকে বন্দুকের নল নীচু করে পায়ে আঘাত করাই নীতি, নানা ছবিতে তেমন কোনও বিশাল উন্মত্ত জনতাও দেখা যায়নি। এ যে অকারণ নিষ্ঠুরতা, ঠান্ডা মাথায় হত্যা! পুলিশের এই আচরণের জন্য যে বা যারাই হোক, শেষ পর্যন্ত অভিযুক্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং তার প্রধান হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী। প্রাথমিক বিস্ময়ের পর নানা দিকে জেগে ওঠে ক্ষোভ, হতাশা, বেদনা ও ক্রোধ। নানা রঙের বিরোধী দলগুলি তো শুধু কথায় নয়, ভাঙচুরের পথেও প্রতিবাদ করবেনই (কংগ্রেসি আমলে যদি এরকম নৃশংস ব্যাপার ঘটত, এরকম ঘটেছেও কয়েকবার, তখন কি বামপন্থীরাও প্রতিবাদে লণ্ডভণ্ড করতেন না?)। কিন্তু এবারে সমাজের সর্বস্তর থেকে, লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী-অভিনেতা-নাট্যকর্মী, চিকিৎসক প্রমুখের যে প্রতিবাদ, তাকে বলা চলে অভূতপূর্ব। বিবৃতি, ইস্তাহার, জনসভা ও মিছিলে অংশগ্রহণ করেছেন এঁরা। মনোবেদনা নিয়ে নিভৃতচারী হয়ে থাকা, কিংবা যাঁর যাঁর নিজ সৃষ্টি ও কর্মের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদের দিন আর নেই, এঁদেরও এখন প্রকাশ্যে সরব হতে হয়।
বিভিন্ন জনের প্রতিবাদের ভাষা ও ধরন বিভিন্নরকম হতেই পারে। কিন্তু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও শিল্পী-সাহিত্যিকদের ভাষা কি একরকম হওয়া সম্ভব? এবারে অনেক ক্ষেত্রে সেরকম মিল দেখে আতঙ্কিত হয়েছি। রাজনীতির মানুষেরা অনেক সময়ই ভাষা ব্যবহারের সুরুচির সীমা ছাড়িয়ে অশালীন শব্দ ব্যবহার করেন। মানুষের যখন যুক্তির অভাব হয়, তখনই সে গালাগালির আশ্রয় নেয়। রাস্তা-ঘাটে, টামে-বাসে, বিধানসভা-লোকসভায় এরকম অজস্র উদাহরণ আমরা দেখেছি। শুধু বিরোধীরাই নন, সরকারপক্ষও এই দুরাচার থেকে বাদ যান না। কিন্তু লেখক-শিল্পীরা ভাষায় দুর্গন্ধ ছড়াবেন কেন, ভাষার শুদ্ধতা রক্ষার দায়িত্ব তো তাঁদেরই। মুখ্যমন্ত্রীর ওপর যতই রাগ হোক, তাঁর পোশাক কিংবা খাদ্যরুচি নিয়ে মন্তব্য করা কি শিষ্টাচার সম্মত? ক্রোধের বশে তুলনা কিংবা উপমা ব্যবহারে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হলে অনেক সময় সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং অতি দক্ষিণপন্থীদেরই যে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, তা কি তাঁরা খেয়াল করেন না? হঠাৎ হঠাৎ হিটলারের প্রসঙ্গ এসেছে, তবে কি হিটলারের প্রকৃত নারকীয় কীর্তির কথা তাঁরা জানেন না? লেখক-শিল্পীদের উপমাই তো অব্যর্থ হওয়ার কথা। কোনও গায়ক যদি অস্ত্র হাতে নিয়ে কোনও রাজনৈতিক দলের কর্মীদের খুন করার হুমকি দেন, তাঁর সঙ্গে এক মঞ্চে বসা কি অন্য লেখক-শিল্পীদের মানায়?
এই সরকারের প্রতি বিরাগে অনেকেই নানারকম সরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা অবৈতনিক কমিটি থেকে সদস্যপদ ত্যাগ করেছেন। তা তো করতেই পারেন, সেটা তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার। তবে কেমন যেন হুড়োহুড়ির ভাব আছে। অনেকে যেন নন্দীগ্রামের ঘটনার সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিকভাবে অকস্মাৎ উপলব্ধি করলেন, এইসব প্রতিষ্ঠান বা কমিটিগুলিই অপ্রয়োজনীয় বা ক্ষতিকর। আগে বোঝেননি? বেশ কয়েকজন বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত (পাঁচ-দশ বছর আগেরও) সরকারি পুরস্কার ফিরিয়ে দিলেন। সেইসব অর্থ নন্দীগ্রামের আর্তদের সাহায্যকল্পে দানের কথাও ঘোষণা করেছেন। এটাকেও একটা মহৎ প্রস্তাব বলা যেতে পারত, শুধু একটি ছোট্ট কাঁটা খচখচ করে। দানের কথাটা কি প্রচারমাধ্যমে জানানো খুব দরকার ছিল? ঢাক-ঢোল পিটিয়ে দান করলে দানের মর্যাদা কি কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয় না? শঙ্খ ঘোষ সরকারি-বেসরকারি যত পুরস্কার পেয়েছেন, তার অধিকাংশ অর্থই তিনি দিয়ে দিয়েছেন বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানকে। কোনওরকম প্রচারের মধ্যে না গিয়ে, নিঃশব্দে। আমরা এই তথ্য জেনেছি, কারণ আমরা এরকম দু-একটি গ্রহিতা-প্রতিষ্ঠানের কাজকর্মের সঙ্গে কিছুটা যুক্ত।
কৃষি ও শিল্পায়নের মধ্যে যে প্রকৃত কোনও সংঘর্ষ নেই, তা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝিতে দেশে হঠাৎ যেন একটা আপৎকাল এসেছে। এরকম সময়ে বুদ্ধি ও যুক্তিবোধ সুস্থির রাখাই তো দরকার।
নিজস্ব ভাষা
আমি এখনও কোনও পাখির ভাষা জানি না বটে, কিন্তু গাছের ভাষা জানি। একরকম দুরকম গাছ নয়, অনেকরকম গাছের। সুতরাং ইস্টিকুটুম পাখিটির সঙ্গে কথা বলবার জন্য আমি দেবদারু গাছকে অনুবাদক হবার জন্য অনুরোধ করি।
আমাদের সংলাপের মধ্যপথে পাশের রাধাচূড়া গাছটি হেসে ওঠে। হাসির কোনও অনুবাদ করবার দরকার হয় না, পাখিটি ও আমি একসঙ্গে বুঝি।
পাখিটি তখন জানাল, যে খবর তুমি গোপনে চেয়েছিলে, তা সর্বজনীন হয়ে গেল। এমন অনুবাদের ভাষায় কথা কইতে গিয়ে আমি আগেও অনেকবার নিরাশ হয়েছি। যেমন, প্রিয় নারীর ভাষা বোঝা কত শক্ত। তার চেয়েও শক্ত তাকে আমার ভাষা বোঝানো। সেই নারী রাজপথকে মনে করে মশারি। আর দুঃখকে মনে করে সাঁতার। সেই জন্য আমি পাহাড় ও নদীর সাহায্য চেয়েছি। নদীর ভাষা নারীরা বোঝে, কিন্তু নদীমাত্রই বিশ্বাসঘাতক। নদীও নারীকে চায়। আমার কথা না জানিয়ে, নদী সেই নারীকে তার নিজস্ব আকাঙ্খার কথা জানায়।
পাহাড়েরও পক্ষপাতিত্ব আছে। সে এক নারীর বদলে অন্য নারীর প্রতি উপমা বদল করে। যাকে আমি মরাল গ্রীবা বলেছি, তাকে সে মাধবীলতা বলে।
একমাত্র বিশ্বাস করা যায় রাত্রির আকাশকে। উদার উন্মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে। কিন্তু প্রকৃত নিঃসঙ্গ না হলে সেরকম আকাশ কেউ দেখতে পায় না কখনও।
তাই বলা হয় না, বলা হয় না, কিছুই বলা হয় না!