আমি কি বাঙালি – ৩

বিশ্ব বইমেলা এবং প্রবাসে বাংলা

প্রথম দিন

আগের বার প্রায় দিন দশেক ছিলাম, তাই ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরটি বেশ চেনা হয়ে গিয়েছিল। টামে চেপে বইমেলায় যাতায়াত করতাম। এইবারেও ১৬ নম্বর টামে চেপে নামলাম ‘বুক মেসে’ বা বইমেলার গেটের সামনে। কিন্তু নেমে আর গেট খুঁজে পাই না। মাত্র তিন বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে, প্রবেশ দ্বারটি এখন অন্যত্র এবং সুবিশাল। পাশেই গম্বুজের মতন একটি বহুতল বাড়ি উঠছে, সেটাও বইমেলার অন্তর্গত হবে।

আগেরবার ছিলাম আমন্ত্রিত, এবার রবাহুত দর্শক মাত্র। তবে বিদেশ থেকে কেউ এলেই তাকে একটি সিজন কার্ড দেওয়া হয় বিনামূল্যে, এই সৌজন্যটুকু বইমেলা কর্তৃপক্ষ প্রদর্শন করেন। পাসপোর্ট দেখিয়ে কার্ড সংগ্রহ করে ভেতরে ঢুকতে যেতেই সশস্ত্র প্রহরীর সম্মুখীন। মনটা বিবশ হয়ে গেল। বইমেলার মধ্যেও পিস্তল-বন্দুক। আজকাল বিমান ভ্রমণে এতরকম সিকিউরিটির ঝঞ্ঝাট যে সব আনন্দই মাটি হয়ে যায়। হুমদো হুমদো চেহারার লোকেরা গায়ে হাত দিয়ে টিপে টিপে দেখে, আমি আবার পুরুষ মানুষের স্পর্শ একেবারে সহ্য করতে পারি না। বইমেলাতেও সেই উৎপাত! শুধু যে হাত-ব্যাগই পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে তাই-ই নয়। প্রহরীদের সামনে শ্রীগৌরাঙ্গের চ্যালাদের মতন হাত তুলেও দাঁড়াতে হচ্ছে।

ফ্রাঙ্কফুর্টের মেলা এলাকাটা এবার যেন আরও বড় মনে হল। অনেকগুলি প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড হল, তিন-চারতলা করে। সেগুলির এক-একটি ঘুরে দেখতেই পা ব্যথা হয়ে যায়। মেলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বিনা পয়সার বাস চলে, হলের সিঁড়িগুলি চলন্ত, তবু হাজার হাজার বইয়ের স্টলের গোলকধাঁধার মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলতে হয়। প্রথমে ঢুকে তো আমি ভারতীয় প্রকাশকদের জন্য নির্দিষ্ট অংশটি খুঁজেই পাই না। চর্তুদিকে নতুন বইয়ের গন্ধ।

ভারতীয় বিভাগটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ন্যাশনাল বুক টাস্টের। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রকাশকদের বই তাঁরাই নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন, তারপর প্রকাশকরা ওখানে গিয়ে আলাদা আলাদা দোকান সাজিয়ে বসেন। ন্যাশনাল বুক টাস্টের নিজস্ব একটি প্রদর্শনীও থাকে। ভারতীয় প্রকাশকদের মধ্যে দিল্লিরই আধিপত্য, কিছু বম্বের, মাদ্রাজ অঞ্চলের প্রকাশকদের সংখ্যা খুবই কম। কলকাতার বেশ কয়েকজন প্রকাশক আছেন বটে, তবে অধিকাংশই ইংরিজি বইয়ের, এঁদের মধ্যে সদাব্যস্ত বিমল ধরের উপস্থিতি সর্বত্র বিরাজমান। ভারতীয় স্টলগুলির মধ্যে একটিতে এক ঝকঝকে ধারালো চেহারার রমণীর দিকে বারবার চোখ চলে যায়, কেমন যেন চেনা চেনা লাগে। পরে জানা গেল, ইনি নর্তকী ও অভিনেত্রী মল্লিকা সারাভাই, পিটার ব্রুকসের মহাভারতে দ্রৌপদীর ভূমিকায় অভিনয় করে যিনি বিশ্বখ্যাতি পেয়েছেন। মল্লিকাদেরও পারিবাকির প্রকাশনা ব্যবসা আছে, এ-বছর তাঁরা ইংরিজি মহাভারতের একটি সংস্করণও প্রকাশ করেছেন।

ছিয়াশি সালে এসে বাংলা বইয়ের অনেকগুলি দোকান দেখেছিলাম। সে বছর মেলা-কর্তৃপক্ষ ভারতকে মুখ্য আকর্ষণ বলে ঘোষণা করেছিলেন। এ-বছরের মুখ্য আকর্ষণ যেমন ফ্রান্স। সেবারে কলকাতার অধিকাংশ চেনা প্রকাশককে দেখেছিলাম এই মেলায়, এ-বছর বাংলা বই টিমটিম করছে মাত্র দুটি স্টলে, আনন্দ পাবলিশার্স ও ফার্মা কে এল মুখোপাধ্যায়ের। ভারতীয় এলাকার বাইরেও বাংলা বই রয়েছে অন্যত্র আরও দুটি জায়গায়, থার্ড ওয়ার্লড কারি এলাকায়, যেখানে কলকাতার মন্দিরা নামে এক প্রকাশক এবং বাংলাদেশের এক প্রকাশক আমন্ত্রিত।

এত বৃহৎ বিশ্ব বইমেলায় ভারতের স্থান নগণ্য, বাংলা বইয়ের উপস্থিতি নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর বলা যেতে পারে। যদিও বাংলা সারা পৃথিবীর সপ্তম প্রধান ভাষা। এই বইমেলায় পশ্চিমী দেশগুলির বই-ব্যবসাই প্রধান, তাদেরই রমরমা। আনন্দ পাবলিশার্সের বাদল বসু প্রতি বছর এই মেলায় বাংলা বই সাজিয়ে বসে থাকেন। একটা প্রেস্টিজ-এর ব্যাপার আছে ঠিকই, এই এলাহী বইমেলায় কলকাতার বাংলা বইয়ের প্রকাশক অকুতোভয়ে অংশ গ্রহণ করছেন, বিশ্ব প্রকাশকদের তালিকায় তাঁদেরও নাম স্থান পাচ্ছে, কিন্তু ব্যবসায় কোনও সুরাহা হয় বলে মনে হয় না। এখানে বইয়ের খুচরো বিক্রির প্রশ্ন নেই, হোল সেল বিক্রির চুক্তি এবং অনুবাদের শর্ত বিনিময় হয়। বাংলা বইয়ের ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত সেরকম কিছু ঘটেছে বলে শুনিনি।

প্রায় ছেলেবেলা থেকেই আমি বইয়ের জগতের সঙ্গে জড়িত, মাছ যেমন জলের মধ্যে সাবলীল থাকে, সেইরকমই এত নতুন বইয়ের প্রদর্শনী আমাকে মুগ্ধ করে রাখে, যেসব ভাষা বুঝি না, সেইসব ভাষারও বইয়ের মলাট দেখে দেখে সময় কাটাই।

অনেক দেশের বড় বড় প্রকাশকরা কিছু কিছু উপহারও দেয়। যেমন কলম কিংবা পেপার ওয়েট কিংবা নানারকম ঝোলানো ব্যাগ। ব্যাগের আকর্ষণই বেশি। বিনা পয়সায় কিছু পেতে শুধু যে আমাদের মতন গরিবদেশের মানুষদেরই উৎসাহ তাই-ই নয়, সচ্ছল শ্বেতাঙ্গরাও ঘুরে ফিরে সেইসব সংগ্রহ করে, কোনও কোনও স্টলের অতি সুদৃশ্য ব্যাগ কেউ কেউ নানা ছলে একাধিকও সংগ্রহ করে।

ভারতীয় কোনও স্টলেই কোনও উপহার নেই, বইয়ের মলাট ও ছাপা-বাঁধা পশ্চিমী প্রকাশকদের তুলনায় ম্লান, তাই এই তল্লাটে ভিড়ও কম।

একসময় এসে পড়লাম পেঙ্গুইন স্টলের সামনে। এবারে পেঙ্গুইন যেন কিছুটা আত্মগোপন করে আছে। ভাইকিং-এর সঙ্গে ভাগাভাগি করে একটা মাঝারি আকারের স্টলে বইগুলি সাজানো, কর্মীদের মুখে চোখে চাপা উদ্বেগ। কাছাকাছি সেপাই শান্ত্রীদের জমায়েত না দেখে একটু অবাক লাগছিল, পরে দেখি যে অনেক সশস্ত্র পারী-প্রহরী এখানে-সেখানে আত্মগোপন করে আছে।

পেঙ্গুইনের ওপর একটা আক্রমণের হুমকি সর্বক্ষণই রয়েছে। যদিও এঁরা সালমন রুশদির বিতর্কিত বইটি এবার রাখেননি।

মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে একখানি বই ও তার লেখককে নিয়ে এত আলোড়ন আগে কখনও ঘটেনি। এই লেখকের মৃত্যু দণ্ডাজ্ঞা প্রকাশ্যে ঘোষিত হয়েছে, আততায়ীকে বিপুল পুরস্কার দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিভিন্ন দেশ ও ব্যক্তি। অনেকগুলি দেশের রাষ্ট্রনায়ক এই লেখকের পক্ষে বা বিপক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন, কূটনৈতিক সম্পর্ক বিপন্ন বা ছিন্ন হয়েছে এই একখানি বইকে কেন্দ্র করে। এক বছরেরও অধিককাল সেই লেখক প্রাণ ভয়ে আত্মগোপন করে আছেন।

এবারের বইমেলার প্রবেশ দ্বারে সিকিউরিটির এত কড়াকড়ির মর্ম ক্রমশ জানা গেল।

স্যাটানিক ভার্সেস বইটির জার্মান অনুবাদ এই সময়ে প্রকাশের কথা ছিল। পশ্চিম জার্মানির সরকার গোলমালের আশঙ্কায় এই অনুবাদের প্রকাশ নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ওসব গণতান্ত্রিক দেশে কোনও বই নিষিদ্ধ করা সহজ কথা নয়। জার্মান প্রকাশকদের সংস্থা সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে দেয়, বাক-স্বাধীনতার ওপর এই হস্তাক্ষেপ আদালতে গ্রাহ্য হয়নি। মামলায় জিতে সেই অনুবাদের প্রকাশক বইটি এবারের বইমেলাতেই সাড়ম্বরে উদ্বোধন করতে চেয়েছিলেন।

বইমেলা কর্তৃপক্ষ পড়ে যান বিপদে। বহু ফ্যানাটিক সংস্থা এবং রাষ্ট্র হিসেবে ইরান এখনও প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য উন্মুখ। বইমেলার মধ্যে বোমাবাজি হলে সাংঘাতিক ভয়ের ব্যাপার, চতুর্দিকে কাগজের সমুদ্র, একবার আগুন লেগে গেলে সেই বহ্ন্যুৎসব হবে পৃথিবীর সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনা।

মেলাকর্তৃপক্ষ সেইজন্য জার্মান প্রকাশকদের সঙ্গে একটা আপোসে এসেছেন। স্যাটানিক ভার্সেস-এর জার্মান অনুবাদ মেলার মধ্যে উদ্বোধন করা হবে না, পরে যে-কোনও একদিন হতে পারে। এর বিনিময়ে, কর্তৃপক্ষ এই মেলা থেকে ইরানকে বিতাড়িত করেছেন। ইরান যতদিন না একজন লেখকের ওপর থেকে মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা তুলে নেয়, ততদিন ইরানকে বিশ্ব বইমেলায় অংশ গ্রহণ করতে দেওয়া হবে না।

তবু চোরা-গোপ্তা আক্রমণের ভীতি রয়ে গেছে। তা ছাড়া গোপন সূত্রে নাকি খবর পাওয়া গেছে যে পুরুষের বদলে সশস্ত্র নারী গেরিলারা এবার পেঙ্গুইন বা অন্য স্টলের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে। তাই ঢোকার মুখে এবার মেয়েদেরই বেশি তল্লাশ করা হচ্ছে। বিভিন্ন হলেও মেয়ে-পুলিশদের প্রাধান্য।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য কোনও আক্রমণের উদ্যম দেখা যায়নি। তবে একটি স্টল দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গেছি। নরওয়ে-র স্টলে পৃথিবীর বহু লেখকের ছবি টাঙানো রয়েছে, তার মধ্যে রুশদির ছবি! বহু বিতর্কিত বইটির নরওয়েজিয়ান অনুবাদও অকুতোভয়ে তাঁরা সাজিয়ে রেখেছেন। কোনও কোনও দেশে যেমন যখন-তখন বই নিষিদ্ধ করা হয়, তেমনই বিপরীত ভাবে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলিকে বাক স্বাধীনতা কিংবা যা খুশি লেখার ও পড়ার অধিকারের দাবি অত্যন্ত উগ্র।

এক একসময় ক্লান্ত হয়ে বাংলা বইয়ের স্টলে এসে বসি। অন্য দেশীয়দের জনস্রোত পাশ দিয়ে চলে যায়, বাংলা বইয়ের র‍্যাকগুলির দিকে তাদের চোখ থামে না। বাংলা ভাষা কিংবা বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে যেন কারুর কোনও আগ্রহ নেই। অন্যদের আকৃষ্ট করার মতন তেমন উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। ইংরিজি ও জার্মান ভাষায় উল্লেখযোগ্য বাংলা বইগুলির সিনঅপসিস, লেখক-পরিচিত, কিংবা সাধারণতভাবে বাংলা সাহিত্য নিয়ে ভালোভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করা উচিত সমবেতভাবে বাংলা প্রকাশকদের। আনন্দ পাবলিশার্স একটি ইংরিজি ক্যাটালগ এনেছেন। কিন্তু সেটাও যথেষ্ট নয়। আরও অনেক তথ্যপূর্ণ, চকচকে, ঝকঝকে তালিকার প্রয়োজন।

ক্কচিৎ দু-একজন বাংলা জানা জার্মান আসেন, কিংবা অন্য কোনও দেশের প্রকাশক সত্যজিৎ রায়ের বইয়ের অনুবাদের জন্য আগ্রহ দেখান। পশ্চিমবাংলার কোনও কোনও বাঙালি আসেন আড্ডা দিতে কিংবা আত্মীয়-বন্ধুদের খোঁজ নিতে, আর আসেন বাংলাদেশীয়রা।

প্রবাসে বাংলা সাহিত্যপ্রেমী

হফট বানহফ অর্থাৎ প্রধান রেল স্টেশনের সিঁড়ি দিয়ে একদিন উঠে আসছি, একটি যুবক আমার পাশে এসে ইংরিজিতে বিনীতভাবে জিগ্যেস করল, আপনার নাম কি অমুক? নিশ্চিন্ত হয়ে সে অতি উৎসাহের সঙ্গে ডেকে আনল তার বন্ধুদের, এবং প্রায় জোর করেই আমাকে, বাদল বসুকে এবং ফার্মা কে এল-এর রণজিৎ মুখার্জিকে নিয়ে গেল তার বাড়িতে।

ছেলেটির নাম বাবুল। সে এবং তার অতি তরুণী সুন্দরী স্ত্রী থাকে বইমেলার কাছেই এক অ্যাপার্টমেন্টে। বাবুল ও তার বন্ধুরা আমাদের রান্নাবান্না করে খাওয়ালো এবং কয়েকটা দিন হইচই ও আড্ডায় মাতিয়ে রাখল। এইসব বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত, কেউ ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার, কেউ ফটোগ্রাফার, কেউ বা হোটেলে কাজ করে। কিন্তু বাংলা সাহিত্য নিয়ে তাদের উৎসাহ সবসময় টগবগ করছে। সেই তুলনায় পশ্চিম বাংলার বাঙালিরা দুর্গাপুজো কিংবা গান বাজনার জলসায় যতটা আগ্রহী, সাহিত্য সম্পর্কে তেমন নয়। একজন ফিল্ম স্টার কিংবা গায়ক-গায়িকাদের নিয়ে তাঁরা মাতামাতি করতে পারেন, কিন্তু সাহিত্যকদের খোঁজ খবর তাঁরা বিশেষ রাখেন বলে মনে হয় না। পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলিতে এখন অনেক বাঙালি থাকেন, তাঁদের অবস্থাও মোটামুটি সচ্ছল, কিন্তু তাঁরা সাহিত্য নিয়ে কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন করছেন, এমন কটা শোনা যায়?

বাবুল ও তার বন্ধুরা আমাদের সঙ্গে এমন আন্তরিক ব্যবহার করতে লাগল, যেন আমরা তাদের অনেক কালের আত্মীয়। আমরা তিনজনেই উঠেছিলাম এক জার্মান পরিবারে পেয়িং গেস্ট হয়ে, কিন্তু বাবুলরা এমন করতে লাগল, যেন আমাদের খাওয়ানো/পরানোর দায়িত্বও ওদের। ওদের প্রত্যেকের বাড়িতেই বেশ কিছু বাংলা বই রয়েছে, বাংলা পত্রিকা রাখে, কথায় কথায় বাংলা সাহিত্য থেকে নানারকম উদ্ধৃতি দেয়, প্রবাসী হয়েও মাতৃভাষার সেবা ও সম্মান করতে তারা একটুও ভোলেনি।

হাইডেনবার্গের কাছাকাছি হিসবার্গ শহরে থাকেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। ইনি বহুকাল ও-দেশবাসী হলেও দেশের সঙ্গে পুরোপুরি সংযোগ রেখেছেন, প্রত্যেক বছর কলকাতায় এসে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে যান। এখানকার কোন লিটল ম্যাগাজিনে কী লেখা বেরিয়েছে, সে সম্পর্কে অলোকরঞ্জন এতসব খবর রাখেন, যত আমিও জানি না। অলোকরঞ্জন জার্মানিতে অক্লান্তভাবে বাংলা সাহিত্যের জন্য পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ও সেমিনারে তিনি বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে বলেন, নিজে অনেক অনুবাদ করেছেন এবং অন্যদের অনুবাদে উদ্বুদ্ধ করাচ্ছেন। এসবই অশোকরঞ্জনের ভালোবাসার পরিশ্রম।

অলোকরঞ্জন আমাকে ও বাদল বসুকে ধরে নিয়ে গেলেন তাঁর বাড়িতে। সেখানে তাঁর পত্নী টুডবার্টার আদরযত্ন এবং তাঁর জননীর স্নেহচ্ছায়ায় আমার অবস্থা যেন অতি প্রশ্রয় পাওয়া কোনও বালকের মতন। টুডবার্টা এক অসাধারণ রমণী, যেমন বিদূষী ও বুদ্ধিমতী, তেমনি তাঁর কর্মক্ষমতা। তিনি চারবেলা নানারকম রান্নাবান্না করে আমাদের খাওয়াচ্ছেন, তারই মধ্যে আমাদের সঙ্গে গল্প করছেন, আবার কখনও গাড়ি চালিয়ে আমাদের নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছেন। টুডবার্টা বাংলা সাহিত্য সম্পর্কেও অনেক খবর রাখেন, বাংলা গান ও ভারতীয় মার্গসঙ্গীত তাঁর প্রিয়, গাড়ি চালাতে চালাতে সেই সব গান-বাজনা শোনেন।

টুডবার্টার সেবা যত্নেরও তুলনা নেই। আমার শীতে কষ্ট হবে, ঠান্ডা লেগে যাবে ভেবে (শীত লাগছিল না) তিনি প্রায় জোর করেই তাঁর ক্লোসেট থেকে একটি ওভারকোট আমাকে পরিয়ে দিলেন। মাসিমার পায়ে ব্যথা, সেই জন্য টুডবার্টা হাঁটু গেড়ে বসে তাঁর শ্বাশুড়ির পায়ে একদিন জুতো পরিয়ে দিচ্ছিলেন, সেই দৃশ্যটি দেখে আমার মনে হচ্ছিল, শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে এরকম বর্ণনা পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু ইদানিং এমন দৃশ্য দুর্লভ।

ওই বাড়িতে একদিন মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন লোথার লুৎসে। ইনি শুধু আমার নন, অনেক ভারতীয় লেখকেরই পূর্ব পরিচিত। লোথার হিন্দি খুব ভালো জানেন, বাংলা জ্ঞানও যথেষ্ট। ভরাট স্বাস্থ্য, উৎসাহে সর্বক্ষণ টগবগ করছেন, ইনি দাশগুপ্ত পরিবারের একজন বিশিষ্ট বন্ধু।

এক বিশেষ ধরনের সুস্বাদু জার্মান স্যুপে চুমুক দিতে দিতে লোথার আমাকে জিগ্যেস করলেন, সুনীল, তুমি তোমার কোন বইয়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এসেছ?

আমি বললাম, সেরকম কিছু না তো। আমার কোনও বইয়ের অনুবাদ তো বেরুচ্ছে না।

লোথার জিগ্যেস করলেন, তা হলে তুমি এসময় ফ্র্যাঙ্কফুর্টে এসেছ কেন?

আমি বললাম, এমনিই। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করতে।

লোথার আমার দিকে বিমূঢ়ভাবে তাকিয়ে রইলেন।

ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে আমার কিছু কাজ আছে, যাবার পথে আমি ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা ঘুরে যাচ্ছি, কারণ, এতে অতিরিক্ত বিমান ভাড়া লাগবে না। শুধু এই কারণে এসেছি, তা লোথার লুৎসের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় লেখকরা বিশেষভাবে আমন্ত্রিত না হলে আসেন না। কোনও কোনও প্রকাশক নতুন বই প্রকাশ উপলক্ষে সেই লেখককে নিয়ে আসেন, তাঁকে নিয়ে কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন করে প্রচার মাধ্যমগুলির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। বাংলা বইয়ের লেখকদের নিয়ে সেরকম কোনও অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা নেই এখানে, বাংলা বইয়ের অনুবাদও হয় কদাচিৎ, তাও অনেকটা যেন উপরোধে ঢেঁকি গেলার মতন। অনুবাদ বেরুলেও বিক্রি হবে কেন? বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে অন্যান্য দেশের পাঠকদের মধ্যে আগ্রহ সঞ্চারের কোনও ব্যবস্থা নেই। বাংলা ভাষার নামই এখনও অনেকে জানে না।

লোথার লুৎসে বইমেলাতে একদিনও যাননি, তার কারণ ওই মেলায় বাণিজ্যই প্রধান। নতুন বই বিক্রিরও কোনও ব্যবস্থা নেই।

সত্যি, ফ্রাঙ্কফুর্টের বিশ্ব বইমেলা দেখলে মনে হয়, মোটর গাড়ি, ফ্রিজ, টিভি ইত্যাদির মতন বই নিয়েও এক বিশাল বাণিজ্য চলছে। সেই বাণিজ্য প্রায় পুরোপুরিই পশ্চিমী প্রকাশকদের আওতায়। তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির (এই তৃতীয় বিশ্ব আখ্যাটা শুনলেই আমার গা জ্বলে যায়।) প্রকাশকদের অবস্থা যেন নেমন্তন্ন বাড়িতে হরিজনদের মতন।

লন্ডনে বাংলা সাহিত্য

অন্য কোনও দেশে যাওয়া-আসার পথে লন্ডনে থেকে যাওয়া সহজ। তা ছাড়া আমার খুব ছেলেবেলার বন্ধু ভাস্কর দত্ত এখানে থাকেন, তাঁর সঙ্গে একবার দেখা না করে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না, সেই জন্য আমি বেশ কয়েকবার লন্ডনে গেছি।

এই প্রথম আমি লন্ডনে এলাম আমন্ত্রিত হয়ে। না, ঠিক প্রথম নয়, বহুকাল আগে একবার এসেছিলাম, ইংলন্ডেশ্বরীর আমন্ত্রণে, শুনতে গালভারি শোনালেও সেটা আসলে অতি ফর্মাল ব্যাপার ছিল। এবারে এসেছি বাংলা ভাষাভাষীদের ডাকে।

এবারে যেন দেখলাম এক নতুন লন্ডন। আমার কাছে এক সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। এখানকার ক’জনই বা জানেন যে কলকাতা ও ঢাকার পর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের তৃতীয় কেন্দ্র এখন লন্ডন।

‘বাংলা সাহিত্য পরিষদ’ নামে একটি সংস্থা নেমন্তন্ন করেছেন শামসুর রাহমান এবং আমাকে। তিন দিনের সাহিত্য সম্মেলন এবং একদিন টেমস নদীতে বজরা ভ্রমণের ব্যবস্থা। এই সংস্থার সভাপতি কাদের মাহমুদ এবং সম্পাদক সৈয়দ শাহীন।

প্যারিস থেকে ভাস্কর, বাদল বসু ও আমার লন্ডনে পৌঁছোনোর কথা সকাল সাড়ে ন’টায়, বিমানের গণ্ডগোলে আমরা হিথরো এয়ারপোর্টে পা দিলাম বিকেল পাঁচটায়। সেই সকাল ন’টা থেকে সৈয়দ শাহীন ও তার বন্ধু বেলাল এয়ারপোর্টে ঠায় বসে আছে। তাদের অকৃত্রিম আন্তরিকতার সেই প্রথম পরিচয়।

ভাস্কর তার বাড়িতে আমাকে নিয়ে যাবেই। কিন্তু শাহীনদের দাবি, তারা আমাকে আমন্ত্রণ করেছে, সুতরাং এবার তাদের কাছেই আতিথ্য নিতে হবে। দু-একদিন পরে গিয়ে অবশ্যই থাকব, এই কথা দিয়ে সেদিনকার মতন ছাড়া পাওয়া গেল।

অন্যান্যবার লন্ডনে এসে পরিচিত ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। কিছু কিছু বাঙালি গোষ্ঠী যে সানডে স্কুল বা রবিবারের বাংলা স্কুল খুলেছেন, সে খবরও জানি, ভাস্করের সঙ্গে গিয়ে একটা স্কুল দেখেওছি। এখানে আছে টেগোর সোসাইটি ও টেগোরিয়ান নামে সংস্থা। দেশ থেকে গান-বাজনা-নাচের দল প্রায়ই ইংল্যান্ডে গিয়ে অনুষ্ঠান করে আসেন। কিন্তু আধুনিক বাংলা সাহিত্য নিয়ে বড় ধরনের কোনও অনুষ্ঠান কিংবা কবি সম্মেলনের ব্যবস্থা লন্ডনের বাঙালিরা কখনও করেছেন বলে শুনিনি।

লন্ডনে পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালিদের তুলনায় বাংলাদেশিদের সংখ্যা অনেক বেশি। তাদের উপস্থিতি সর্বত্র টের পাওয়া যায়, দক্ষিণ লন্ডনের কোনও কোনও পাড়ায় সিলেটিদের পাড়া বলা যেতে পারে। সেখানকার স্কুলগুলিতে বাংলা পড়ানো হয়, অনেক জায়গায় বিভিন্ন সরকারি নোটিশ লেখা থাকে বাংলায়।

এখানকার বাংলাদেশি লেখকদের মধ্যে কয়েকজন আমার বন্ধুস্থানীয়, বিবিসি-র বাংলা বিভাগের অনেকের সঙ্গে আড্ডা হয় রুশ হাউজে গেলে। কিন্তু বাংলাদেশিরা যে বাংলা নিয়ে এখানে এত কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে চলেছেন, সে সম্পর্কে আমার বিশেষ ধারণা ছিল না।

এখন ইংল্যান্ড থেকে সাতখানি বাংলা পত্রিকা বেরোয় নিয়মিত। সেগুলি সখের পত্রিকা কিংবা লিটল ম্যাগাজিন নয়, রীতিমতো ব্যবসায়িকভাবে চলে, অনেক ছেলেমেয়ে সেখানে কাজ করে, সেটাই তাদের জীবিকা। লন্ডনে বাংলা ছাপারও কোনও অসুবিধে নেই আর, এইসব পত্রিকা মূলত রাজনীতি এবং সংবাদমূলক, সাহিত্যের জন্য আলাদা পৃষ্ঠাও বরাদ্দ আছে। অদূর ভবিষ্যতে লন্ডন থেকে কোনও বাংলা দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

লন্ডন থেকে বাংলা বই ছাপাও শুরু হয়ে গেছে। ওখানকার লেখকদের আর কলকাতা কিংবা ঢাকার ওপর নির্ভর না করলেও চলবে। এর মধ্যে প্রায় ষাটখানি বাংলা বই প্রকাশিত হয়েছে লন্ডন থেকে। প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, উপন্যাস জাতীয় কয়েকটি বই আমি দেখেছি, ছাপা-টাপা বেশ ভালো। পশ্চিমবাংলা ও বাংলাদেশের পরবর্তী প্রজন্মের কিছু কিছু লেখকের বইও প্রকাশিত হতে পারে লন্ডন থেকে।

এইসব কিছুরই উদ্যম বাংলাদেশিদের। পশ্চিমবাংলার বাঙালিদের কেমন যেন উদাসীন মনে হয়। অনেকেই বাংলা বইটই পড়েন না। তবে, তাঁরা কিছুই করছেন না, এটা বলাও ঠিক নয়। হিরন্ময় ভট্টাচার্যের ‘সাগর পারে’ একটি সুপরিচিত পত্রিকা, আরও কয়েকজন বই লিখে লন্ডন থেকে প্রকাশ করছেন।

বন্ধুবর আবদুল গাফফর চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হল অনেকদিন পর। তিনি সহৃদয়ভাবে আলিঙ্গন করলেন আমাকে। আমি বললাম, আপনি ‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপ্যাসের একটি চরিত্র, তিনি বললেন, আমিও আপনাকে নিয়ে একটি গল্প লিখেছি। দেখা হল প্রাবন্ধিক হাসন মুরশেদ এবং সম্পাদক শফিক রেহমান এবং আরও অনেকের সঙ্গে। নতুন পরিচিত বহু অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েদের উৎসাহ দেখে আমি মুগ্ধ। কয়েকজন কী চমৎকার আবৃত্তি করে। বাইশ থেকে তিরিশ বছর বয়স্ক প্রবাসী পশ্চিমবঙ্গীয়রা অনেকেই ভালো করে বাংলায় কথাই বলতে পারে না, বাংলা কবিতা পাঠ তো দূরের কথা।

প্রথম অনুষ্ঠানটি হল লন্ডন ইউনির্ভাসিটির ম্যানিং হলে। প্রেক্ষাগৃহটি বিশেষ বড় নয়, কিন্তু একসময় সব আসন পূর্ণ, কিছু কিছু লোকজন দাঁড়িয়েও ছিল। আজকাল বিদেশের সাহিত্য অনুষ্ঠানগুলিতে লোকজন বিশেষ হয় না, এখানে এই জনসমাগম দেখে হকচকিয়ে যাবার মতন অবস্থা। গোটা অনুষ্ঠানটি আগাগোড়া বাংলায়, দু-একজন সাহেব আলো-মাইক ঠিক করছিল, না হলে বোঝবারই উপায় নেই যে ব্যাপারটা লন্ডন শহরে ঘটছে।

পরবর্তী দুটি অনুষ্ঠান বাংলাদেশ সেন্টার ও টয়েনবি হলে। যদিও শনি-রবিবার ছুটির দিনে ব্যবস্থা, কিন্তু ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছিল, সেই সঙ্গে নভেম্বরের শীতল বাতাস। লন্ডনের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত বহুদূর, তবু উৎসাহীদের সংখ্যা কম নয়। কলকাতা ও ঢাকা থেকে আমরা দুজন, আর বিলেতের অনেক লেখক-প্রাবন্ধিক শিল্পী অংশগ্রহণ করলেন। প্যারিস প্রবাসী বাংলাদেশের মুকাভিনয় শিল্পী পার্থপ্রতিম মজুমদারও দুর্দান্ত মুকাভিনয় দেখালেন একদিন।

লম্বা বক্তৃতায় বদলে আমি কিছুটা সময় প্রশ্নোত্তরের প্রস্তাব করেছিলাম। বক্তৃতা দিয়ে সাহিত্যের কোনও সুরাহা হয় না। শ্রোতা ও দর্শকদের মধ্য থেকে প্রশ্ন এলে বোঝা যায়, তাঁরা সাহিত্য সম্পর্কে কতদূর খোঁজ খবর রাখেন, সাম্প্রতিক লেখাজোখার সঙ্গে কতটা ওয়াকিবহাল। এখানে অনেকেই বেশ পড়াশুনো করেছেন মনে হল। শামসুর রাহমানের সঙ্গে শ্রোতাদের প্রশ্নোত্তর বেশ জমে উঠেছিল। শামসুর চমৎকার কবিতা পাঠ করেন, সুবক্তাও বটে।

অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা এবং অংশগ্রহণকারী অধিকাংশই বাংলাদেশি তো বটেন, দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যেই তাই! অনিন্দ্য রায় কিংবা অমলেন্দু বিশ্বাসের মতন দু-একজন কবির যথেষ্ট উৎসাহ আছে বটে কিন্তু অন্য অনেককেই এই সব অনুষ্ঠানে দেখা গেল না। বাংলাদেশিদের সঙ্গে পশ্চিমবাংলার বাঙালিদের ঝগড়া নেই বটে, ব্যক্তিগতভাবে এদিকের সঙ্গে ওদিকের কারুর কারুর বন্ধুত্বও আছে, কিন্তু সমবেতভাবে কোনও কিছু করার বিশেষ প্রয়াস দেখা যায় না। আমি অনেক সময় বলি, আর কিছুদিন পর বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারক হবেন বাংলাদেশিরাই, ভারত থেকে বাংলা ক্রমশ মুছে যাবে। এতে অনেকে চটে যান। কিন্তু পৃথিবীতে এখন বাংলা ভাষা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবেই ক্রমশ পরিচিত হয়ে উঠছে, ভারতের এই প্রাদেশিক ভাষা সম্পর্কে অনেকের খেয়াল থাকে না। ভারতীয় বাঙালিরা মাতৃভাষাকে তেমন মর্যাদা দিচ্ছেন কোথায়? প্রবাসের সচ্ছল বাঙালিরা কতটুকু সময় দান করছেন মাতৃভাষার জন্য? কিন্তু পৃথিবীর বহু দেশেই বাংলাদেশিরা মাতৃভাষার জন্য গর্বিত, এই ভাষার প্রসার ও সম্মানবর্ধনের জন্য যত্নশীল।

দু-একজন বাংলাদেশি তরুণ অভিমান ভরে আমাকে বলেছেন, ভারতীয় বাঙালিরা তাঁদের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশিদের আমন্ত্রণ জানান না। কিন্তু বাংলাদেশিদের অনুষ্ঠানে ভারতীয় বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানানো হয়, কার্ড পাঠানো হয়, তবু প্রায় কেউই আসেন না। এই অভিযোগ কতদূর সত্য তা আমি জানি না, আমি কতটুকুই বা দেখেছি। কিন্তু আমার মনে হয়, ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে রাজনৈতিক ব্যবধান যাই-ই থাকুক, অন্যান্য ব্যাপারে যতই মতবিরোধ ঘটুক, সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দুনিয়ার সমস্ত বাংলা ভাষা-ভাষীদের এককাট্টা হয়ে থাকা উচিত। দুই বাংলার বাঙালিরা একসঙ্গে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধির জন্য প্রয়াস চালালে, বিশ্বের কাছে এই ভাষা সংস্কৃতির গৌরব বর্ধন হবে, তাতে তো সকলেরই লাভ। এটা আমার আশা, সকলে যে মানবেন তার কোনও মানে নেই!

স্বাধীন বাংলাদেশ

সবুজ রঙের বনেদ—অর্থাৎ শস্য শ্যামল ভূ-প্রকৃতির প্রতীক, মাঝখানে উজ্জ্বল লাল রঙের বৃত্ত—দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গীকৃত শহীদের রক্ত চিহ্ন, তার ওপরে সোনালি রঙে আঁকা পূর্ব বাংলার মানচিত্র। এই পতাকা উড়ছে এখন স্বাধীন বাংলাদেশে। সেখানকার নতুন জাতীয় সঙ্গীত, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। আমাদেরও সবার ভালোবাসা যুক্ত হয়ে আছে বাংলাদেশের সঙ্গে।

একজন উত্তরপ্রদেশীয় ভদ্রলোক আমার প্রশ্ন করলেন কয়েকদিন আগে, ওপারের ওরা যে নিজেদের দেশকে পুরোপুরি বাংলাদেশ নাম দিয়েছে, তাহলে ওইটুকুই কি শুধু বাংলাদেশ? বাঙালি বলতে বাংলাদেশের মানুষকে বোঝায়, তাহলে ওরাই শুধু বাঙালি? ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী যারা, সেই তোমরা তা হলে কী?

সরাসরি উত্তর না দিয়ে, আমি পালটা প্রশ্ন করলুম, আগে বলুন, ওদিকের ওরা যে স্বাধীনতা ও মনুষ্যত্বের অধিকারের জন্য জীবন মরণ লড়াই করছে, আপনি সেটা সমর্থন করেন তো?

কথাবার্তা হচ্ছিল অপরিস্ফুট ইংরেজিতে কারণ উত্তর প্রদেশীয় ভদ্রলোকটি বাংলা জানেন না, ‘আমি হিন্দি জানি না। আমার প্রশ্ন শুনে তিনি রীতিমতন উত্তেজিত হয়ে বললেন, নিশ্চয়ই! শুধু সমর্থন কেন, যে-কোনওরকম সাহায্য করতেও আমরা প্রস্তুত। পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার লড়াইয়ের প্রতি সারা ভারতবর্ষ মাদ্রাজ থেকে পাঞ্জাব সবাই তো সমর্থন জানিয়েছে একবাক্যে। ধিক্কার জানিয়েছে ইয়াহিয়া চক্রকে।

আমি বললাম, তাহলে আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তর জানাই। পূর্ব বাংলা যখন ‘বাংলাদেশ’ নাম নিল, তখন পশ্চিম বাংলার প্রায় কেউই আপত্তি জানায়নি, কেউ ঈর্ষা প্রকাশ করেনি। কারণ, ওদের অস্তিত্ব বিপন্ন, বাঙালিত্বের গর্ব বা পরিচয়ই ওখানকার মানুষকে এক করতে পারে, পেরেছে। আমাদের অস্তিত্ব সেরকমভাবে বিপন্ন হয়নি এখনও। তা ছাড়া, যখন ওদিকের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান এবং এদিকের নাম পশ্চিমবঙ্গ—তখনও ওদিকের এদিকের আমরা সবাই বাঙালিই ছিলাম। এর পরেও থাকব। পশ্চিমবঙ্গের নাম বদলে এর পরে আমরা ‘বাংলা রাজ্য’ করে নিতে পারি। তাড়াহুড়োর কিছু নেই।

উত্তরপ্রদেশীয় ব্যক্তিটিকে বিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি আরও বললাম, আর একটা কথা জানেন তো? আপনি বা আমি যদিও একই দেশের নাগরিক, কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার যতটা সম্পর্ক—তার চেয়ে অনেক বেশি নিকট সম্পর্ক ওই অন্যদেশ, বাংলাদেশের যে-কোনও মানুষের সঙ্গে। কারণ, আমরা বাঙালি আমরা একই বাংলা ভাষাতে কথা বলি।

তিনি বললেন, তোমরা বাঙালিরা বড্ড ভাবপ্রবণ।

আমি তৎক্ষণাৎ মেনে নিয়ে জানালাম, হ্যাঁ, সে কথা ঠিক। এই ভাবপ্রবণতা আমাদের একটা দোষ, আবার এই ভাবপ্রবণতাই আমাদের বন্ধন। প্রত্যেক সচেতন মানুষই নিজের মাতৃভাষাকে ভালোবাসে। কিন্তু বাঙালির মতন বাংলা ভাষা নিয়ে এতটা বাড়াবাড়িও আর কেউ করে না। এটা তৈরি হয়ে উঠেছে ইতিহাসের কয়েকটি বিশেষ পাকচক্রে।

বিরলে বসে চিন্তা করলে টের পাই, আমি নিজে যেমন, তেমনি অধিকাংশ বাঙালিই প্রখর যুক্তিবাদী নয় একটু বেশি ভাবপ্রবণ। এদেশে যে তীক্ষ্ন যুক্তিবাদী কেউ নেই তা নয়, আছেন কিছু কিছু কিন্তু তাঁদের কথায় জনচিত্তে এমন তুমুলভাবে সাড়া জাগায় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গে এই যে প্রবল উদ্দীপনা, দলমত নির্বিশেষে সবাই এখানে ওদের সাহায্যের জন্য বদ্ধপরিকর, হাজার হাজার যুবক মনে মনে পোটেনশিয়াল সৈনিক হয়ে আছে, এর মর্ম কী? এই রচনা লেখার মুহূর্ত পর্যন্ত ভারত সরকার স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি বটে, কিন্তু পশ্চিম বাংলার সরকার কার্যত স্বীকৃত জানিয়ে অনুরূপ অনুরোধ জানিয়েছে কেন্দ্রের কাছে। পৃথিবীর আর কোথাও কি এমন হতে পারত? কয়েকটা প্রশ্ন তো উঠতই— কূটনৈতিক সুবিধে অসুবিধে, বিশ্বে শক্তির ভারসাম্য টসকায় কি না কিংবা এতে আমাদের নিজস্ব কোনও লাভ আছে কি না। এখানে সেসব কিছু চিন্তা করার অবকাশই আসেনি, শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হৃদয়ের জাগরণ হল, বিনা দ্বিধায় আমরাও বলে উঠলাম, ওই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যতদিন লড়াই চলবে, ততদিন আমরাও সঙ্গে আছি। বাঙালি হিসেবে আমরাও সহযোদ্ধা।

স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক মোটেই শুধু পাশাপাশি রাষ্ট্রের নয়, তার চেয়েও অনেক বেশি। মুজিবুর বলেছেন, আমাদের সম্পর্ক ভৌগোলিক নয়, ঐতিহাসিক।

স্বাধীন বাংলাদেশ আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠুক, আমরা তার জন্য গর্ব বোধ করব। ওই দেশ আমাদেরও দেশ। তেইশ বছরের দুঃস্বপ্নের পর বাংলাদেশ আবার বাংলাদেশ। ‘পূর্ব পাকিস্তান’ এই নাম আর সে কখনও বহন করবে না। পাকিস্তান ধারনার মৃত্যু হয়েছিল সেইদিন—শেখ মুজিবুর স্বাধীনতা ঘোষণা করার অনেক আগে—যেদিন আওয়ামী লিগ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, বাংলাদেশ আর ইসলাম রাষ্ট্র থাকবে না, বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ। ধর্মরক্ষার নামেই পাকিস্তানের জন্ম। নতুন সংবিধানে যদি সেই গোঁড়ামিকে আর প্রশ্রয় না দেওয়া হয়, তাহলে দেড় হাজার মাইল ব্যবধানে বিচ্ছিন্ন দুটি আলাদা ভূখণ্ডে সম্পূর্ণ আলাদা জাতি চরিত্র ও সংস্কৃতিসম্পন্ন মানুষের একই রাষ্ট্র পতাকার তলে থাকার কৃত্রিম চেষ্টার মানে কী?

কিংবা পাকিস্তানের মৃত্যুসূচিত হয়েছিল তার জন্মের অব্যবহিত পরেই, যখন পাকিস্তানের সর্বেসর্বা জিন্না কড়া গলায় বলেছিলেন, আমি মহম্মদ আলি জিন্না বলছি, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। তখন ঢাকার ছাত্ররা নির্ভীকভাবে উত্তর দিয়েছিল না! আমরা বাংলা ভাষা চাই। ধর্মকে ছাপিয়ে সংস্কৃতির অধিকারের সেই গোড়া পত্তন। তারপর থেকে পূর্ব বাংলার বুদ্ধিজীবী ও সুস্থ লেখক সমাজ একবারও ভুল করেননি।

আমি হিন্দু নই, যেমন মুসলমান হিসেবে পরিচিত আমার কয়েকজন বন্ধুও মুসলমান নন। আমি ঈশ্বর মানি না, কোনও পরম ব্রহ্ম বা সূক্ষ্ম শক্তিও মানি না। শুধু মানি না বলব না, ওসব ব্যাপার নিয়ে মাথাও ঘামাতে চাই না। আমার ওই কয়েকজন বন্ধুও তাই। ঈশ্বর-উদাসীন ব্যক্তিদের হিন্দু বা মুসলমান বা খ্রিস্টান নামে অভিহিত করার কি কোনও যুক্তি থাকতে পারে? যদিও কিছু কিছু পারিবারিক বা সামাজিক আচরণ থেকেই যায়—কিন্তু সেটা ধর্ম নয়, সংস্কৃতির অঙ্গ। আধুনিককালের উভয় বাংলার শিক্ষিত হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সেইরকম আচরণগত বিভেদ কতটুকু? এই সরল সত্যকে উপেক্ষা করে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগেও ধর্মের নামে একটি রাষ্ট্র চালানোর চেষ্টা কী অসম্ভব মূঢ়তা! যারা বন্দুক-কামান নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে তারা কালচার নামে ব্যাপারটাকে একেবারে গ্রাহ্যই করতে চায় না। কোনও জাতির কালচারও যে বন্দুক-কামানের প্রবল প্রতিপক্ষ হতে পারে, এটা তাদের মনেই আসে না কখনও। পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা নানান দেশ থেকে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করেছে—টাকা শুষেছে পূর্ব বাংলা থেকে। তারা খবর রাখেনি, বাঙালিদের মধ্যে একটা হাজার বছরের পুরোনো সংস্কৃতি আছে—এর ভিত্তি আজ এত সুদৃঢ় যে ধর্ম বা সামরিক জিগির তুলে কিছুতেই একে ভাঙা যাবে না। দরিদ্র, শিক্ষাহীন এবং দুর্বল মানুষদের ধর্মের আফিমে ঘুম পাড়িয়ে রাখার চেষ্টা অনেক পুরোনো। কিন্তু বাঙালিরা দরিদ্র এবং কিছুটা দুর্বল হলেও সংস্কৃতিহীন নয় বলেই সাংস্কৃতিক ঐক্যের চেয়ে ধর্মের বিভেদকে শেষ পর্যন্ত বড় করে দেখতে পারে না। বদরুদ্দীন ওমর এক জায়গায় এই ব্যাপারটাই সুন্দর ভাবে বলেছেন : ‘এ সংকট উত্তীর্ণ হওয়ার একমাত্র পথ সাম্প্রদায়িকতাকে সর্বস্তরে এবং সর্বভাবে খর্ব করা এবং উত্তীর্ণ হওয়া। এ প্রচেষ্টায় সফলকাম হলে, আমরা বাঙালি, না মুসলমান না পাকিস্তানি—এ ধরনের অদ্ভুত প্রশ্ন বাঙালি মুসলমানরা আর কোনওদিন নিজেদের কাছে উত্থাপন করবে না। এবং তখনই তারা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে সক্ষম হবে নিজেদের জাতীয় এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়।’

ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার হয়ে থাকুক। ধর্মের আর কোনও সামাজিক ভূমিকা নেই পৃথিবীতে। ধর্মের নামে এ পর্যন্ত পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ খুন হয়েছে। সব ধর্মেরই মূলকথা সাম্য ও মৈত্রী, কিন্তু তার জন্যই এত নররক্তপাত! অহিংসার কথা সবচেয়ে বেশি আছে খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মে কিন্তু ওই দুই ধর্মাবলম্বী দেশগুলিই পৃথিবীতে ঘটিয়েছে দুটি মহাযুদ্ধ। কমিউনিজম না ইহুদি ন্ধিন—এই দোটানায় পড়ে গিয়ে রোমান ক্যাথলিকদের ধর্মগুরু পোপ ইহুদি ন্ধিনই সমর্থন করেছিলেন। এই খুনের বিষাক্ত নেশা কত সাংঘাতিক যে ধর্ম বাদ দিয়ে অন্য কোনও আদর্শ অবলম্বন করলেও মানুষ তা ভুলতে পারে না। ধর্মকে বাদ দিয়ে যে আদর্শ সাম্য ও মৈত্রীকেই প্রধান বলেছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শ্রেণি বৈষম্যই পৃথিবীর সব সংঘর্ষের মূল কারণ বলে যেখানে সঠিকভাবে নির্ধারিত করা হয়েছে সেখানেও এই আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষকে খুন না করলে চলে না। অনেক সময় আদর্শের চেয়ে খুনোখুনিই বড় হয়ে যায়। এখন পৃথিবীতে তারাই মহৎ রাষ্ট্র নায়ক, যাদের হাত মানুষের রক্তে রঞ্জিত।

পূর্ব বাংলা স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত হবার জন্য যে যুদ্ধে নেমেছে, ইতিহাসে তার কোনও তুলনা নেই। ধর্মের নামে নয়, পররাজ্য আক্রমণের লোভে নয়, স্বজন্ধংসী বিপ্লবের নামে নয়—শুধু সংস্কৃতির বন্ধনে যে একটা দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে—তার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হল পৃথিবীতে। প্রমাণিত হল, সৎ নেতৃত্ব ও সৎ আহ্বান পেলে একটা দেশে সকল শ্রেণির মানুষ প্রাণ তুচ্ছ করে উঠে দাঁড়াতে পারে। সামরিক শিক্ষা না পেয়েও সাধারণ গ্রামবাসী প্রবল শত্রুর বিরুদ্ধে তুলে ধরতে পারে অস্ত্র। পারে, কারণ এই সংগ্রামের যুক্তির মধ্যে কোনও ভেজাল নেই। ভিয়েতনামে এই শতাব্দীর যে মহৎ লড়াই চলছে, তারই নবতর রূপ প্রকাশিত হল স্বাধীন বাংলায়।

দাবি আদায় করার জন্য বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপূর্ণ পথের সবক’টিই পরীক্ষা করে দেখেছে। কে কবে ভাবতে পেরেছিল যে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের একজন নেতা দেশের সমস্ত মানুষের হৃদয়ের সমর্থন পেতে পারে? দেশের সকলে একটি মাত্র দলের পতাকার তলায় দাঁড়ায়? স্বৈরাচারের এর চেয়ে বড় জবাব আর কী হতে পারে? গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থারও এক নতুন রূপ সূচিত হল। নির্বাচন ব্যবস্থার অনেক ত্রুটি আছে—টাকার খেলা, ভয় দেখানোর খেলা অনেক কিছুই চলে। হিটলারও ভোটাভুটির খেলা খেলে দেশের সর্বময় কর্তৃত্ব নিয়েছিল। হিটলার ভোট পেয়েছিলেন বন্দুকের নল উঁচিয়ে, আর এখানে শেখ মুজিবুরের দিকেই বন্দুকের নল তোলা ছিল। দেশের সামরিক শাসক স্পষ্টত শেখ মুজিবুরের বিপক্ষে এবং টাকাওয়ালা লোকেরা অবশ্যই সামরিক শাসকদের পক্ষে—তবু শেখ মুজিবুরের পাশে দাঁড়াল, তাঁর দেশের শতকরা ৯৯ জন মানুষ। যে মুসলিম লিগ পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল, সেই মুসলিম লিগই পূর্ব বাংলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। পৃথিবীর রাষ্ট্রনৈতিক ইতিহাসে এবার নতুন অধ্যায় জুড়তে হবে।

নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হয়েও শেখ মুজিবুরকে ক্ষমতা দেওয়া হল না। তখনও তিনি সামরিক শাসকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পথ খোলা রেখে ছিলেন। অনেকে এই আলাপ-আলোচনার ব্যাপারটা পছন্দ করেননি। আমার কিন্তু সর্বান্তঃকরণ সমর্থন আছে। রক্তপাত এড়ানোর সবক’টি পথই শেষ পর্যন্ত দেখা উচিত। তার জন্য সম্পূর্ণ অধিকার পেতে যদি কয়েকটি স্তর পার হতে হয়—যদি দু-এক বছর দেরি হয়ে যায়, তাতেও মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না। যারা কথায় কথায় রক্তপাথের পথ দেখায়, নিজে বেঁচে থেকে অপরের মৃত্যুতে উল্লাস করে, তাদের অসুস্থ, হিস্টিরিয়া রোগি মনে হয় আমার। শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা করে দেখার জন্যই সামরিক শাসকগোষ্ঠীর মুখোশ সম্পূর্ণ খুলে গেল, দস্তানা খোলা হাতে দেখা গেল বাঘ নখ। আলোচনা চালাতে অস্বীকার করে শেখ মুজিবুর হঠাৎ এক তরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করলে, দেশের একটা অংশের মানুষের মনে হয়তো এমন খটকা লাগা অস্বাভাবিক ছিল না যে ইয়াহিয়া খাঁ বোধহয় শেষ পর্যন্ত নিজেই ক্ষমতা ছেড়ে দিতেন, শেখ মুজিবুরের হঠকারিতার জন্যই খুনোখুনি লেগে গেল। কিন্তু এখন আর কোনও মোহ রইল না।

ঘরে আগুন লাগলে কেউ স্বপ্ন দেখে না। বাংলাদেশে এখন বাস্তবযুদ্ধ। আত্মরক্ষা ও অধিকার অর্জনের জন্য বাঙালি আজ যুদ্ধ করছে, যুদ্ধের অন্য কোনও কলঙ্ক তাকে স্পর্শ করেনি। পৃথিবীর যেসব দেশ গণতন্ত্রের গর্ব করে যারা ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার সমর্থক, তারা যদি আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে এখনি না এগিয়ে আসে, তা হলে পৃথিবীর আসরে তারা যেন আর কোনওদিন ওসব কথা বলতে না আসে। যেসব দেশের নাগরিকদের গলা ধাক্কা দিয়ে ঢাকা থেকে তাড়িয়ে দিল সামরিক বাহিনী, সেসব দেশের নীরবতার মর্মোদ্ধার কে করবে? যেসব দেশ এতকাল বলে এসেছে তারা নিপীড়িত জনগণের সবসময় পক্ষে—তারা আজ কোথায়? তাদেরই দেওয়া অস্ত্রে নৃশংস পশ্চিমী সৈন্যরা লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে খুন করছে। বাংলাদেশে আজ কে অত্যাচারী আর কে অত্যাচারিত সে কথা জলের মতন স্পষ্ট—কোনও থিয়োরি বা অঙ্ক কষার দরকার নেই—তবু অত্যাচারিতের পাশে এসে সেই সব রাষ্ট্র দাঁড়ায়নি। আরও কি প্রমাণ দরকার যে শেষ পর্যন্ত কোনও আদর্শই আন্তর্জাতিক নয়? সবাই নিজের দেশের স্বার্থ আগে দ্যাখে দর কষাকষি করে কোন দিকে গেলে তার বেশি সুবিধা। আমি যে রাজনীতি বুঝি না তার প্রমাণ আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না, কী করে ইয়াহিয়া খাঁর বর্বর বাহিনীর হাতে একইসঙ্গে মার্কিন দেশ ও চিনের অস্ত্র থাকতে পারে! মার্কিন ও চিনা অস্ত্রে বাংলা দেশের হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এ কথা বাঙালি কখনও ভুলতে পারবে?

আমাদের কাছে এটা অন্য দেশের ব্যাপার নয়। আমরা ভাবপ্রবণ, তাই আমাদের কাছে এটা বাঙালিদের লড়াই। বাঙালি আজ যুদ্ধ করছে। এমন গৌরবময় যুদ্ধ বাংলাদেশে কখনও হয়নি। আমার কাছে এটা যেমন প্রবল গৌরবের, তেমন লজ্জারও। আমিও জন্মেছি পূর্ববাংলায়। ওই নদী প্রান্তর, পাট খেত, ধান খেত আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বলে হয়ে আছে। আমারই ভাই ও বন্ধুরা ওখানে প্রাণপণ লড়াই করছে এখন আমি অংশ গ্রহণ করতে পারলাম না! যুদ্ধ দীর্ঘদিন চললে নিশ্চয়ই আমাকেও যেতে হবে। ধর্মভিত্তিক পূর্ব পাকিস্তান আমি ছেড়ে এসেছি, গত আট ন’বছরের মধ্যে অনেকবার যেতে ইচ্ছে হয়েছে, ধর্ম নিরপেক্ষ স্বাধীন বাংলায় আবার ফিরে যাব। আমি যুদ্ধনীতির বিরোধী, কিন্তু বাংলাদেশের এই যুদ্ধে প্রাণ দেওয়া যে-কোনও বাঙালির পক্ষেই গৌরবের।

গত আট-দশ বছর ধরে পশ্চিম বাংলার চেহারা দেখতে দেখতে কী বীভৎস হয়ে গেল! কী সাংঘাতিক নৈতিক অধঃপতন! এখানকার একজন নেতাকেও শ্রদ্ধা করা যায় না, এখানে কেউ সত্যি কথা বলে না, কেউ ভুল স্বীকার করে না, কেউ দোষ করলে ক্ষমা চায় না। উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য যে-কোনও অসৎ পথ অবলম্বন করতেও দ্বিধা নেই কারুর। দিনের পর দিন মন খারাপ হয়েছে আমাদের। আর এই ক’বছরেই পূর্ব বাংলার চেতনা ক্রমশ বিশুদ্ধ হয়ে উঠেছে।

স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান এক সঙ্গে মরছে, এক সঙ্গে লড়াই করছে। স্বাধীন বাংলাদেশ ধর্ম নিরপেক্ষতার নীতি নিয়েছে। এরপর যেন আমাদের পশ্চিমবাংলাতেও ধর্মভেদ বা সাম্প্রদায়িকতার কথা কোনওদিন না ওঠে। আজ বাঙালি হিসেবে একাত্ম হবার যে সুযোগ এসেছে তা যেন আর কোনওদিন না হারাই এই তেইশ বছরের মধ্যে অনেকবার আমরা নিজেদের মধ্যে হানাহানি করেছি, সেসব কথা আর মনে করার দরকার নেই। পুরোনো কথা থাক, এখন নতুন দিন এসেছে।

এ লড়াই কতদিন চলবে জানি না। যতদিনই চলুক এর পরিণতি একটাই, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। এই লড়াইতে অংশ গ্রহণ করার জন্য পশ্চিম বাংলার অসংখ্য যুবকের প্রাণ ছটফট করছে। কিন্তু অসংগঠিতভাবে ছুটে গেলে যুদ্ধের কোনও সাহায্য হয় না। লড়াই জোরদার করার জন্য এখনই দরকার স্বাধীন বাংলাদেশকে ভারত সরকারের স্বীকৃতি দেওয়া। ভারত সরকার বাংলাদেশকে আলাদা দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিলে তখন আর পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপারে হস্তক্ষেপের অজুহাত টিঁকবে না। তখন স্বাধীন বাংলার সরকারের আহ্বানে এবং প্রয়োজনে এখানকার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী অনায়াসে যেতে পারবে ওদিকে। আমরা অনেকেই যাব।

সীমান্তে দুবার

এর মধ্যে দুবার আমি পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে ঘুরে এলুম। গত একুশ বছরের মধ্যে আমি আর সীমান্তের ওপারে যাইনি, সীমান্তও দেখিনি।

প্রথমবার গেলাম জগন্নাথ লালার সঙ্গে। জগন্নাথ একটি চমৎকার ছেলে, কুড়ি-বাইশ বছর বয়েস, কুচকুচে কালো রং, কালো রঙের মলাটে সে ‘অসুখ’ নামে পত্রিকা বার করে, জগন্নাথের মুখে একটুও শহরে ছাপ পড়েনি—কথায় বেশ বাঙাল টান, লেখাপড়া খুব বেশি করেছে বলে মনে হয় না—সে প্রায়ই আমার স্ত্রীর কাছে এসে বলে, বউদি, আমাকে একটু ফ্রেঞ্চ ল্যাঙ্গোয়েজ শিখিয়ে দিন না! একদিনে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সে ফরাসি শিখে নিতে চায়—তারপরই কোনও একদিন সে ফরাসি দেশে চলে যাবে। হয়তো জগন্নাথের ধারণা, একমাত্র পাকিস্তান ছাড়া পৃথিবীর আর কোনও দেশে যেতেই পাসপোর্ট লাগে না, কিংবা কোনও বাঁধা আসতেই পারে না! পূর্ব বাংলা থেকে কিছুদিন আগে মাত্র এসেছে—এখনও ফাঁক পেলেই জগন্নাথ বর্ডার পেরিয়ে ওপার থেকে ঘুরে আসে।

জগন্নাথের বাড়ি বনগাঁয়। গত বছর এক রবিবার সেখানে বেড়াতে গিয়ে চলে গেলাম হরিদাসপুরের চেকপোস্ট দেখতে। দমদমে যে যশোর রোডের কাছে আমার বাড়ি সেই যশোর রোডই হরিদাসপুর পেরিয়ে ওপাশে পাকিস্তানে ঢুকে গেছে, রাস্তার মাঝখানে দু-দেশের সীমান্ত ঘাঁটি। নো ম্যানস ল্যান্ডের পাশে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম, জগন্নাথ একেবারে ছটফট করছে, আমাকে অনবরত দ্যাখাচ্ছে—ওই যে দেখুন পাকিস্তানের বাস, ওই যে বাঁশবন তার অর্ধেকটা এদিকে, অর্ধেকটা ওদিকে—যাব, এক দৌড়ে ছুটে যাব?

ওপাশে পাকিস্তানি কাস্টমস ও পুলিশের লোকেরা বেশ হাসি-মস্করা করছেন, কলকাতার কী একটা খেলার রেজাল্টও জানতে চাইলেন। জগন্নাথও চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে জিগ্যেস করতে লাগল, আহসান হাবীব কেমন আছেন? রফিকুল আমেদ?

জগন্নাথের তুলনায় আমি অনেক পোড়খাওয়া মানুষ। ওরকম চাঞ্চল্য আমাকে মানায় না। কিন্তু কিছুক্ষণ আমিও জগন্নাথের সমবয়েসি হয়ে গিয়ে, ওরই মতন উত্তেজনা বোধ করছিলুম।

সেখান থেকে ফিরে আমরা একটা মরা রেলস্টেশন দেখলাম। সে জায়গাটায় গিয়ে আমি সত্যিই অভিভূত হয়েছিলাম—কারণ, এরকম কোনও নির্জন দৃশ্য আমি আগে কখনও দেখিনি। এখন বনগাঁতেই রেললাইন শেষ, কিন্তু যখন সরাসরি টেন ঢুকে যেত যশোরে—তখন বনগাঁর পরেও আর একটি স্টেশন ছিল—সেটা এখন সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত। বুকিং কাউন্টার, ওয়েটিং রুম, সিগনাল পোস্ট সবই আছে একটাও লোক নেই, লাইনের মাঝখানে আসশ্যাওড়ার জঙ্গল, প্ল্যাটফর্মে দুব্বো গজিয়েছে, সিগন্যাল জড়িয়ে রয়েছে ধুধুলের লতা। গমগমে আওয়াজ ও মানুষগুলোর চিৎকারের স্মৃতি আছে বলেই জায়গাটা অদ্ভুত ধরনের নিস্তব্ধ মনে হল। দেশভাগ হয়ে যাবার পরেও—পাসপোর্ট চালু হবার আগে জগন্নাথ এখানে টেনে যাতায়াত করেছে। ওর স্পষ্ট মনে আছে যশোর থেকে টেন এ-পাশে এলেই চা-গ্রাম এর সঙ্গে সঙ্গে হকারের চিৎকার শুনতে পেল, ইন্ডিয়া চানাচুর! ইন্ডিয়া চানাচুর!

ফেরার পথে মিলিটারি পুলিশ পোস্ট থেকে আমাদের পরীক্ষা করে ছেড়ে দিল। একজন বিশালাকায় কনস্ট্রেবল, ধপধপে ফরসা রং, ভাজহীন পোশাক ও মাথায় সুরেঠা রাজপুত বলে মনে হয় তাকে—অদ্ভুত সরল তার মুখ—সে বলল ভাঙা বাংলায়, শুধু দেখার জন্য চার টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে গিয়েছিলেন হরিদাসপুরে; কী দেখার আছে ওখানে? কিছু নয়! বাঙালিরা অদ্ভুত লোক!

আমিও পরে ভাবছিলুম, সত্যিই, এতখানি আবিষ্টতা কি বাড়াবাড়ি নয়? দৈবাৎ জন্মেছিলুম পূর্ববঙ্গের এক গ্রামে, কিন্তু কলকাতা আমার নিয়তি ছিল, পাকিস্তান না হলেও থাকতাম কলকাতাতেই—ক্কচিৎ কখনও হয়তো দেশের বাড়িতে বেড়াতে আসতাম। আসলে নিষেধ থেকেই এত যাতনা! এখন যখন ইচ্ছে হলেই দুমকা কিংবা পূর্ণিয়ায় বেড়াতে যাই—তেমনি ঢাকা কিংবা বরিশালে যেতে পারি না বলেই অসন্তোষ। শুধু কি তাই? বনগাঁ থেকে ফেরার পথে আমার মনের মধ্যে একটা চাপা অভিমানবোধ রয়েই গেল—যেন কেউ কথা দিয়ে কথা রাখেনি। যাদের জন্ম পূর্ব বাংলায় নয়, তারা এই অনুভূতিটা হয়তো ঠিক বুঝতে পারবে না।

আমি পৃথিবীর অনেক জায়গা ঘুরেছি। বিদেশ থেকে ফেরার পর আমি প্রায়ই একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতাম, জানি না, মনস্তাত্ত্বিকরা এর কী ব্যাখ্যা দেবেন। আমি স্বপ্নে দেখতাম আমি একটা নতুন শহরের পথে পথে ঘুরছি, যে শহরের প্রত্যেকটি বাড়িই গোল গোম্বুজের মতন—প্রত্যেকটা বাড়ির গবাক্ষে হাসিমাখা নারী-পুরুষের জীবন্ত মুখ—রাস্তাগুলো বুনো মোষের গায়ের মতন মসৃণ—হাঁটতে হাঁটতে আমার মনে হয়—যতগুলো জায়গা দেখলাম তার মধ্যে এই শহরটাই সবচেয়ে ভালো। এই শহরের কোনও রাস্তাই আমার অচেনা নয়! অন্তত তিনবার আমি ওই স্বপ্নটা দেখেছি কিন্তু ওরকম কোনও শহর আমি সত্যিই দেখিনি—পৃথিবীতে ওরকম কোনও শহরের অস্তিত্ব আছে কিনা জানি না। লন্ডন বা প্যারিস, রোম-নিউইয়ক নিয়ে আমি কোনও স্বপ্নে দেখিনি। এ ছাড়া, ওসব জায়গা ঘুরে আসার পর, মাত্র দু-তিনবছরের মধ্যেই আমি লন্ডন, রোম বা আথেন্সের রাস্তাঘাটের কথা মনশ্চক্ষে দেখতে পাই না, সব রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু চব্বিশ বছর আগে দেখা ফরিদপুরে একটা গ্রামের রাস্তাঘাট আমার হুবহু মনে আছে—এমনকী শাপলাভরা বিলের মধ্যে কোনাকুনি ঠিক কোন পথে নৌকো যেত তাও মনে আছে। আমি পশ্চিম বাংলা ও বিহারের অনেক গ্রাম অঞ্চলে ঘুরেছি, কিন্তু লেখার সময় কোনও গ্রামের দৃশ্য ভাবলেই বারবার সেই চব্বিশ বছর আগে দেখা গ্রামের কথাই মনে পড়ে। এ একেবারে গাঁথা হয়ে গেছে, আর তাড়ানো যাবে না। আট বছর আগে, আমার বাবা মৃত্যুর ঠিক দু-একদিন আগে বলেছিলেন, জানিস হঠাৎ স্পষ্ট দেখলাম, আমি মাদারিপুরে স্টিমার থেকে নামলাম, এবার বাড়ি যাব বাড়ির রাস্তা সেই একইরকম আছে, চৌধুরী কাকার সঙ্গে দেখা—স্বপ্ন নয়, একেবারে সব স্পষ্ট। বলার সময় বাবার মুখ চোখ যেরকম হয়েছিল, তাতেই বুঝেছিলাম ওঁর মৃত্যুর আর দেরি নেই বোধহয়। মৃত্যুর আগে অনেকে স্বর্গের কথা ভাবে, আমার বাবা দেশের বাড়ির কথা ভেবেছিলেন এখানে এটুকু ও বলা দরকার—পূর্ব পাকিস্তানে আমরা কোনও সম্পত্তি ফেলে আসিনি সেখানে ছিল আমাদের অতি দরিদ্র অবস্থা—আমার ঠাকুর্দা ছিলেন পাঠশালার পণ্ডিত, মাটির ঘরে থাকতাম—জমিজমা কিছুই ছিল না—সুতরাং পার্থিব সম্পত্তি যা হারিয়েছি—তা অতি নগণ্য। তবু, কেন এই টান?

কয়েকদিন আগে মুর্শিদাবাদ গিয়েছিলাম আমি আর ইন্দ্রনাথ মজুমদার। এ পৃথিবীর সমস্ত ছোটখাটো জায়গাই ইন্দ্রনাথের চেনা—এবং সবখানেই তার বন্ধু আছে। এ-বেলা লালবাগ, ও-বেলা আজিমগঞ্জ এইভাবে ঘুরছি, ভগবানগোলা ও লালগোলা নাম দুটো পড়েছি নাটকে ও শিকার কাহিনিতে—সে জায়গাও দেখা হয়ে গেল। লালগোলায় এসে ইন্দ্রনাথ বলল, সামনেই পদ্মা, ওপারে পাকিস্তান—দেখবে নাকি? ইন্দ্রনাথ আর আমি দুজনেই জন্মেছি ওপার বাংলায়, দুজনের চিনচিনে টান—দুজনেই ইমোশন লুকোতে জানি।

রেলস্টেশন থেকে একটুদূর হেঁটেই নদীর পার। কতদিন পদ্মা দেখিনি পদ্মার ওপর দিয়ে বাল্যকালে স্টিমারে চেপে যাওয়ার কথা অবিকল মনে আছে—সেই বিশাল নদী, ইলিশ ধরা নৌকো, চরের মাঝখানে রোদা পোহাতো কচ্ছপের ঝাঁক আর মেছো কুমির। এবার পদ্মা দেখা গেল না। পদ্মার মাঝখানে বিশাল চর উঠেছে—সেখানে চাষবাস হচ্ছে, এ-পাশে নদীর ধারা শুকিয়ে গেছে, শুকনো খাতে উলটে আছে গুটি কয়েক নৌকো চরের মাঝামাঝি এলাকা থেকে পাকিস্তান, ঘন গাছপালায় কিছু দেখা যায় না। হেঁটে হেঁটে চরের ওপর দিয়ে যাব কিনা ভাবছিলুম, একজন চাষি বলল, আমরা সে চেষ্টা করলেই পুলিশে ধরবে। বিনা পাসপোর্টে অনেকেই যায় অবশ্য, কিন্তু তারা আমাদের মতন বাবুর পোশাক পরে না, তারা চাষা সেজে চাষাদের সঙ্গে যায়। অতটা গরজ নেই। শুকনো পদ্মার পারে একটু ছায়া খুঁজে নিয়ে ঘাসের ওপর বসলুম আমরা দুজনে। ইন্দ্রনাথ ঝোলা থেকে রামের বোতল বার করল। পূর্ব বাংলার দিকে মুখ করে আমরা দুজনে রাম টানতে লাগলুম।

চলো, আমরাও যাই

যার সঙ্গেই দেখা হয়, তাকেই বলতে শুনি ইচ্ছে হয়, এক্ষুণি চলে যাই ওদের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করি। চেনা-অচেনার কোনও বিভেদ নেই। চায়ের দোকানে, পানের দোকানের সামনে রাস্তার মোড়ে মোড়ে, যুবকদের মুখে মুখে একই কথা, চলো আমরাও যাই। ওইসব যুবক কে কোন পার্টির সমর্থক? জিজ্ঞাসে কোন জন? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর আজ কান্ডারি।

বাঙালির মধ্যে এমন অকৃত্রিম আকাঙ্ক্ষা ও উত্তেজনা বহুদিন দেখা যায়নি। ইদানীং বাংলাদেশে দেশপ্রেম কিংবা নিজস্ব সংস্কৃতিকে উপেক্ষার চোখে দেখার হুজুগ এসেছিল। কিন্তু আজ প্রমাণিত হল বইপড়া তত্ত্ব কিংবা শুকনো অঙ্কের মতন হৃদয়হীন যুক্তি শুধু নিজেদের মধ্যে হানাহানিই ঘটাতে পারে—কিন্তু দেশ ও ভাষার প্রতি ভালোবাসা একটা দেশের সমস্ত মানুষকে বিনা দ্বিধায় এক সংগ্রামের সঙ্গী করে নিতে পারে।

বাংলাদেশে বহুদিন কোনও যুদ্ধ হয়নি। আজ যে যুদ্ধ বেধেছে, এর চেয়ে সত্যতর কোনও কারণে কোনও যুদ্ধ হতে পারে না। এইরকম যুদ্ধে কোনও গ্লানি নেই, রক্তস্রোতে কোনও পাপ নেই, এই যুদ্ধ যেন একটা উৎসবের মতন এতে প্রাণ দেবার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যায়।

পাশের বাংলায় যে যুদ্ধ চলেছে, তার আঁচ যে এখানেও লাগবে, তা তো আমাদের বেঁচে থাকার মতনই স্বাভাবিক ঘটনা। তাই এদিকের অসংখ্য মানুষও ওই যুদ্ধে অংশীদার হতে প্রস্তুত, প্রাণ দিতেও প্রস্তুত, তাই পথে-ঘাটে সর্বত্র শোনা যাচ্ছে, চলো, আমরাও যাই।

স্পেনের মুক্তি যুদ্ধে পৃথিবীর নানা দেশের স্বাধীনতাপ্রেমীরা যোগ দিতে গিয়েছিলেন, কিন্তু স্পেনের উদাহরণ দিয়ে লাভ নেই, ওদিকের বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যে কত নিবিড়—তা আর নতুন করে বলার দরকার নেই এখন। শুধু যে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালরাই ওপারের জন্য ছটফট করছেন তাই নয়, আজ বাঙালি মাত্রই এই মুক্তি যুদ্ধে উন্মাদনা বোধ করছেন। বাংলাদেশই বা কেন, গোটা ভারতবর্ষে—দিল্লি, বোম্বাই, মাদ্রাজ, পাঞ্জাবেও জনসভা হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থনে। ভারতের প্রতিটি রাজনৈতিক দল ধিক্কার দিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বরতাকে।

চলো, আমরাও যাই! কী করে যাওয়া হবে? একথা ঠিক, ভাবাবেগের বশে অনেকে মিলে সীমান্ত পেরিয়ে ওপারে ছুটে গেলে প্রকৃত-কোনও সাহায্যই হবে না। এটা উৎসব নয়, বাস্তব যুদ্ধ। দয়া-মায়া বিবেক শূন্য, অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই। এখন সুশৃঙ্খল প্রতিরোধ বাহিনী দরকার। হাতিয়ার যাদের নেই, হাতিয়ার চালাবার শিক্ষা যাদের নেই—তেমন লোকেরা এলোমেলোভাবে ছুটে গেলে যুদ্ধে অসুবিধেই সৃষ্টি করা হবে! এখনও স্বাধীন বাংলাদেশে যুদ্ধ করার জন্য মানুষের অভাব হয়নি, ওদের দরকার অস্ত্রের।

আমার মনে হয়, আবেগবশত এক্ষুণি ছুটে না গিয়ে, যাবার ইচ্ছেটা মনের মধ্যে টিঁকিয়ে রাখা দরকার। প্রতিজ্ঞার আগুন যেন অনির্বাণভাবে জ্বলতে থাকে। বাঙালির আত্মসম্মান বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনে প্রাণ দেবার শপথ যেন অটুট থাকে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দলের উদ্যোগে সম্মিলিতভাবে একটি কমিটি গঠন করে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলা দরকার। যাতে ওদিক থেকে ডাক পড়লেই ছুটে যেতে পারে এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। বিভিন্ন দলের উদ্যোগে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হলে তারা ওদিকে গিয়েও পরস্পরের সঙ্গে মারামারি করবে না তো? তার থেকে বড় কেলেঙ্কারি আর কী হতে পারে?

এই মুহূর্তে আমাদের প্রধান দায়িত্ব, স্বাধীন বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেবার দাবিতে দেশব্যাপী প্রবল ধ্বনি তোলা। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ কে কবে স্বীকৃতি দেবে না দেবে জানি না, ভারতই প্রথম স্বীকৃতি জানান। স্বাধীন বাংলাদেশকে সরকারিভাবে মেনে নিলে আমাদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে। বাইরের অস্ত্র সাহায্য ছাড়া এই ধরনের লড়াই অনর্থক রক্তক্ষয়ী হয়। জয় হবেই, শুধু আরও রক্তক্ষয়। স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থনে এখানে হরতাল ডাকা হয়েছে সেদিন মিছিলে মিটিং-এ সোচ্চার হয়ে উঠুক এই দাবি, কূটনৈতিক কচকচির বদলে—আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ এবং অস্থায়ী সরকারের স্বীকৃতি চাই।

ওদের সংগ্রামের দিকে তাকিয়ে আমরা

বছরের পর বছর ধরে দুঃখ-হতাশা-বিভ্রান্তিই আচ্ছন্ন করেছিল আমাদের সামগ্রিক জীবন। এতদিন পর একটা সত্যিকারের আনন্দের সংবাদ পেলাম। আমার বাংলাদেশ আজ সম্পূর্ণ স্বাধীন।

আমার বাংলাদেশ? হ্যাঁ, জোর দিয়ে বলছি, আমারও। আমার জন্ম দেশ বিভাগের আগে, ফরিদপুরে। এখন আমি কলকাতায় বসতি নিয়েছি। বিদেশে যাবার প্রয়োজনে পাসপোর্টে নাগরিকত্ব বোঝাবার জন্য আমি নিশ্চিত ভারতীয় তবু মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমার জন্মভূমির টান অস্বীকার করতে পারব না। বাংলাদেশ এখন আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র, অধিবাসীর সংখ্যা সাড়ে সাতকোটি, তা ছাড়াও এ-পারের আরও কয়েক কোটি মানুষ ওই বাংলাদেশের আত্মিক নাগরিক হয়ে থাকবে। আমি কবিতা লেখার সময় যে বাংলার কথা লিখব তা কি শুধু পশ্চিম বাংলা? পশ্চিমবঙ্গ শব্দটাই কবিতায় ঠিক খাপ খায় না।

যুদ্ধের সঙ্গে কোনওদিন নিজেকে এতখানি জড়িয়ে ফেলিনি। বাষট্টি আর পঁয়ষট্টিতে ব্যক্তিগতভাবে বেশ খানিকটা দুঃখিতই বোধ করেছিলাম। কিন্তু এই তেরোদিন ধরে সারাক্ষণ রেডিয়োতে কান, টেলিপ্রিনটারের কাছে, ঘোরাঘুরি মনের মধ্যে একটা ছটফটানি। এই জয়-পরাজয়ের মধ্যে যেন আমার অস্তিত্ব জড়িত। নিছক নিরাপত্তা নয়, অস্তিত্ব ও বিশ্বাস। শুধু বাঙালি প্রীতি নয়, ন্যায়, সত্য ও সভ্যতার যেসব ধারণা নিয়ে বেঁচে আছি তার অপমৃত্যু হত। নিছক বর্বর সামরিক শক্তি বারোশো মাইল দূর থেকে সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা দমিয়ে রাখবে, চরম অর্থনৈতিক শোষণ হবে, বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হবে, হঠাৎ খেয়াল খুশি মতন সৈন্য লেলিয়ে দিয়ে পাঁচ লাখ কি দশ লাখ মানুষকে মেরে ফেলা হবে, কোটি খানেক মানুষকে সর্বহারা করে তাড়িয়ে দেওয়া হবে দেশের বাইরে—আর সারা পৃথিবী জিভ দিয়ে ছদ্ম সহানুভূতির চুকচুক আওয়াজ করবে কিন্তু প্রতিবাদের জন্য একটি আঙুলও তুলবে না—এটাই যদি শেষ সত্য হত—তা হলে সর্বক্ষণ মুখে নিমপাতা দিয়ে শুধু বেঁচে থাকার জন্যই বেঁচে থাকতাম। তা হয়নি, যে ভারতবর্ষের আমি নাগরিক, সেই দেশই এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করেছে—এই জন্য আমার গর্ব। আমরা মানুষের মুক্তি চাই।

এই জয়ের গর্ব আরও অনেক বেড়েছে, তার কারণ আমরা প্রায় গোটা পৃথিবীর অন্যায় ভ্রুকুটি গ্রাহ্য করিনি। রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশ দুঃসময়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বলে আমরা কৃতজ্ঞ—কিন্তু আমরা একা দাঁড়াবার জন্যও প্রস্তুত ছিলাম। ধ্বংসের ঝুঁকি নিয়েও আমাদের একা দাঁড়াতেই হত। মহা শক্তিধর আমেরিকার শক্তিবর্গ চূর্ণ হয়ে গেল। ধর্ম-গোঁড়া অবাস্তব রাষ্ট্রের বন্ধন ছিঁড়ে জন্ম নিয়েছে গণ প্রজাতন্ত্রী, ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন বাংলাদেশ।

আজ বড় আনন্দের দিন। আমি স্বচক্ষে দেখেছি, আজ অনেক বাড়িতে কান্নার ধূম পড়ে গেছে। অতিরিক্ত আনন্দে যেরকম কান্না আসে। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে কান্না। ন’মাস যারা দেশ ছাড়া, আজ তাদের স্বাধীন দেশে ফিরে যাওয়ার আনন্দ। কত প্রিয়জন হারানোর দুঃখ কত বীভৎস অত্যাচারের স্মৃতি নতুন দেশ গড়ার কত স্বপ্ন। সব আজ মিলে মিশে একাকার।

এখনও ব্ল্যাক আউট ওঠেনি, অন্ধকার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় আমিও কি ফিরে যাব না? আমি এখন কলকাতার মানুষ, এই শহর আমরা মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে গেছে—এর মোহিনী মায়া বোধহয় আমি আর ছাড়তে পারব না। তবু ঢাকায় প্রথম দিনের বিজয়োৎসবে যোগ দিতে আমার সাধ হয়। এ তো আমারও বাংলাদেশের স্বাধীনতা। একবার দেখে আসব না, জন্ম-ভূমির সেই গ্রাম, শ্মশানখোলার পাশে সেই বিশাল বটগাছ, অদৃশ্য হয়ে লুকিয়ে যাওয়ার মতন পাটখেত, দুর্দান্ত আড়িয়েল খাঁ নদী—আমার প্রথম কৈশোরের কত নিশ্বাস ওখানে ঘুরেছে। একবার যেতেই হবে। নাদের আলিকে বলব, এবার আমাকে সেই তিন-প্রহরের বিল দেখাও, দত্ত বাড়িতে গিয়ে অমলাদিকে বলব, খাওয়াও তেমার নিজের হাতে তৈরি করা নারকেলের তক্তি, ব্রজ পণ্ডিত মশাইকে প্রণাম করে বলব, চিনতে পারছেন না, আমি আপনার সেই অকৃতী অধ্ম ছাত্র ছেলেবেলার বন্ধু ইউসুফকে বলব…। অনেককেই দেখতে পাব না জানি, অনেক কিছু ধ্বংস হয়েছে, অনেক বদলেছে, তবু একবার যেতে হবে। এখান থেকে মাত্র, একশো মাইল দূরে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ চলছে। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে উড়ে আসছে ভিন্নজাতীয় সামরিক বাহিনী। মানবিকতার সমস্তরকম মান অগ্রহ্য করে আধুনিকতম অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে খুন করছে নিরস্ত্র বাঙালিদের। আমিও একজন বাঙালি, শুধু তাই নয়—যেসব এলাকার এখন প্রবল যুদ্ধ চলছে, তারই কোনও এক অংশে আমার জন্ম। অথচ, আমরা এখন এখানে চা খাচ্ছি, গল্প করছি, সিনেমা-থিয়েটার সবই চালু, পাড়ায় পাড়ায় খুনোখুনি রেসের মাঠে ভিড়—সবই চলছে। আমরা বড়জোর কখনও একটু উত্তেজিত আলোচনা চালাচ্ছি, রেডিয়োর প্রতি উৎকর্ণ দু-একটা মিটিং, কিছু লেখালেখি। ওদিকে অপর বাঙালিরা বীরের মতন লড়াই করে মারছে ও মরছে। নাটক নভেলে এইরকম অবস্থাকেই বোধহয় বলে নিয়তির পরিহাস।

বারবার মনে হয় যাই, যাই। কোথায়? সে সম্পর্কে ঠিক স্পষ্ট ধারণা করা যায় না। এ যেন স্বপ্নের যাওয়া। স্বপ্নের মধ্যে ইচ্ছেপূরণ। পথের নিশানা নেই, পাথেয়র প্রয়োজন নেই, পথ যানের চিন্তা নেই—হঠাৎ হাজির হয়ে গেছি রণাঙ্গনে, আমার হাতে রাইফেল, বাঙালি মুক্তিসেনার পাশে দাঁড়িয়ে আমিও শত্রুর দিকে রাইফেল তুলে অব্যর্থ লক্ষে…। যদিও আমি এ পর্যন্ত কখনও রাইফেল ছুঁয়ে দেখিনি। তবু স্বপ্নের মধ্যে অবিরাম যাই, যাই—।

গাঢ় লাল রং আমি খুবই অপছন্দ করি। রক্তের দৃশ্য আমার সহ্য হয় না। নরহত্যা আমার কাছে খুবই অরুচিকর মনে হয়। কোনও মহৎ আদর্শের জন্যও হত্যাপন্থী হওয়া আমার পক্ষে ইহজীবনে আর সম্ভব হবে না। যে পাঞ্জাবি সৈনিকরা বাংলাদেশে লড়াই চালাতে গিয়ে প্রাণ দিচ্ছে, তাদের জন্যই আমার কষ্ট হয়। তারাও তো পাঞ্জাবের কোনও গ্রাম্য কৃষক পরিবারের ছেলে নিছক বেতনভুক এবং বিবেকহীনতার শিক্ষা পেয়েছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলায় এখন যে যুদ্ধ চলেছে, একমাত্র এইরকম যুদ্ধেই আমি মনপ্রাণ দিয়ে অংশ নিতে পারি। ন্যায়সম্মত দাবি যারা খর্ব করতে চায় শক্তির অহংকার তাদের প্রতিনিবৃত্ত করতে গিয়ে প্রাণ দেওয়াও গৌরবের। আমার বিপ্লবের স্বপ্ন এইরকম।

আমি এখনও যাইনি, কারণ যাওয়ার সুযোগ নেই। কিংবা প্রয়োজন আসেনি এখনও। শেষ মুহূর্তে ডাক এলে নিশ্চয়ই যাব। আমিও তোমাদের সঙ্গে আছি। মনের মধ্যে বারবার ঘুরে ফিরে আসে আছি, আছি।

বাংলাদেশ কিছুটা অজানা, অচেনা

দিল্লি থেকে ঢাকার দূরত্ব অনেক, কিন্তু কলকাতা থেকে খুব কাছে।

আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ইত্যাদি যাবতীয় সম্পর্ক ঢাকার সঙ্গে দিল্লির, কলকাতার সঙ্গে কিছুই না। দিল্লির সরকারের চোখে বাংলাদেশ দ্বিখণ্ডিত পাকিস্তানের একটি নতুন দেশমাত্র কিন্তু কলকাতা বা পশ্চিম বাংলার পক্ষে সে ভাবে বাংলাদেশকে দেখা কোনওক্রমেই সম্ভব নয়। পশ্চিম বাংলার অসংখ্য অধিবাসীর চোখে বাংলাদেশ এখনও প্রাক্তন জন্মভূমি কিংবা পিতৃ-পিতামহের স্মৃতি বিজড়িত স্থান। বাংলাদেশের কিছু লোক যদি সীমান্ত পার হয়ে এদিকে আসতে চায়, তাহলে দিল্লির সরকারের চোখে সে ঘটনা হবে বিদেশি নাগরিকদের বে-আইনি অনুপ্রবেশ, আর এখানকার অনেকের কাছে তা বিপন্ন আত্মীয়স্বজনদের আশ্রয়লাভের চেষ্টা। বিলেতে ভারতীয়দের অবাধ গমন বন্ধ হলে আমরা বিরক্ত হই, আবার বাংলাদেশের নাগরিকরা ভারতে বসবাস করতে চাইলেও অনেক বিরক্ত হন।

বাংলাদেশ আমাদের এত কাছে, কিন্তু সেখানকার খবর আমরা সবচেয়ে কম জানি। আমাদের সংবাদপত্রগুলিতে আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া, চিন সম্পর্কে যত খবর ছাপা হয়, তার চেয়ে অনেক কম ছাপা হয় বাংলাদেশ সম্পর্কে। খবরের অভাব অনেক সময় ভুল ধারণার সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের যে খবর এখানে ছাপা হয়, তা শুধুই নৌকাডুবি, দুর্ভিক্ষ, খুন, রাজনৈতিক পালাবদল এবং সীমান্তে গুলি। অর্থাৎ মনে হতে পারে যেন এই গুলি বাদ দিয়ে বাংলাদেশে কোনও স্বাভাবিক জীবন নেই, কিংবা সেখানে কোনও সুস্থ, সাংস্কৃতিক ঘটনা ঘটে না। ঘটে, আমরা জানতে পারি না। এরই পরিপূরকভাবে বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলিতে ছাপা হয় শুধু ভারতের দাঙ্গার খবর, খেলা, বন্যা বা রাজনৈতিক কেলেঙ্কারির সংবাদ। বাংলাদেশের টেলিভিশন রাত্রের সংবাদের শেষে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজধানীর উল্লেখযোগ্য ক্রিয়াকলাপের কথা বলা হয়, লন্ডন, রোম, টোকিও-র খবর নিয়মিত থাকে, দিল্লির উল্লেখ হয় অতি কদাচিৎ। কলকাতার তো প্রশ্নই ওঠে না।

বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলিতে ভারতের দাঙ্গার উল্লেখ ফলাও করে থাকে। একথা ঠিক সম্প্রতি গত এক বছর ধরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতন কুৎসিত ব্যাপার আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আলিগড়, জামসেদপুরের ঘটনা শুধু লজ্জার নয়, গভীর শোকের। বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় এই সংবাদ ছাপার মধ্যে এরকম মনোভাব ফুটে ওঠে যে বাংলাদেশে তো ইদানীং আর দাঙ্গা হয় না। ভারতে হয় কেন? বাংলাদেশে যে এখন আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় না, সেটা অত্যন্ত প্রশংসার বিষয়। পাকিস্তানেও দাঙ্গা হয় না এমনকী লন্ডনেও হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা হতে পারে কখনও, কিন্তু পাকিস্তানে আর কোনওদিন হবে না। দাঙ্গা সেখানেই হয়, যেখানে দুটি পক্ষ থাকে। ভারতের মতন বিশাল দেশে, আদিবাসী বনাম উচ্চবর্ণ, পার্বতী-সমতলবাসী, এক প্রদেশি—অন্য প্রদেশি, হিন্দু-মুসলমান, এমনকী শিয়া-সুন্নির মধ্যেও হানাহানি হয়। ভারতের বর্তমান সরকার দুর্বল বলেই এরকম কু-ঘটনা ঘটতে পারছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা এখন অতি সংখ্যালঘু এবং নির্জীব। বাংলাদেশের সরকার সবল, তবু এক শ্রেণির লোক সে দেশ ছেড়ে অনবরত চলে আসতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশের হিন্দুরা ভারতের দিকে এক পা উঁচিয়ে আছে, এরকমই ওখানে গ্রামের দিকের অনেক লোকের ধারণা, এবং অনেকটা সত্যও বটে। অধিকাংশ পরিবারেরই ছেলেমেয়েদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতে, বুড়োবুড়িরা জায়গা আঁকড়ে পড়ে আছে। সেই বুড়োবুড়িদের প্রস্থান ত্বরান্বিত করার জন্য যে সুযোগ সন্ধানীদের চেষ্টার কোনও ত্রুটি নেই, এটা একটা বাস্তব ঘটনা। কিংবা এর নাম ইতিহাসের নিয়তি। এ ব্যাপার রোধ করার ক্ষমতা ভারত বা বাংলাদেশ সরকারের আছে কি না কে জানে, অথবা সেই জন্যই দু-সরকার এই ব্যাপারে কিছু না জানার ভান করে থাকাই শ্রেয় মনে করেন। এর ফলে সবচেয়ে ভারগ্রস্ত হচ্ছে অবশ্য পশ্চিম বাংলা।

বাংলাদেশের একজন প্রবীণ সংবাদ ভাষ্যকার বলেছেন যে ইতিহাসে দেখা যায়, ইসলাম হয় কোনও রাজ্যে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অথবা সেখান থেকে হটে এসেছে। যেমন হটে এসেছিল স্পেন থেকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর মুসলমান সংখ্যাধিক্য নিয়েও ধর্মসহিষ্ণু রাষ্ট্র পরিচালনার পরীক্ষা হয়েছিল তা ব্যর্থ হয়েছে অনেকখানি। ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পর তাতে কখনও একটু আধটু চিড় ধরলেও কখনও ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়নি। তা হলে, ভারত ইতিহাসে ব্যতিক্রম। মধ্যপ্রাচ্যের প্রবল ধর্মীয় জিগির সম্পন্ন রাষ্ট্র চালনার যে জোয়ার এসেছে, পাকিস্তানও যা গ্রহণ করল, বাংলাদেশেও তার ছোঁয়াও লেগেছে কিছুটা। বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা পড়লে বোঝা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের যারা বিরোধিতা করেছিল, যারা পাকিস্তানের সমর্থক ছিল, তারা অনেকে এখন ফিরে এসেছে শাসন ক্ষমতায়। রাষ্ট্রপতি জিয়া নিজে অবশ্য একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনের পর কিছুটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। ভারতে আমরা যেরকম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের কথা জানি, বাংলাদেশে সেরকম হয়নি, সেখানে নির্বাচন হয় সামরিক শাসনের আওতায়। তবু, নতুন শাসন ব্যবস্থায় অনেক সুফল দেখা যাচ্ছে। সরকার বিরোধীপক্ষ পাচ্ছেন, মতামত প্রকাশের সুযোগ, আইন শৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছে। ঢাকা শহরের চেহারা আগের চেয়ে অনেক পরিচ্ছন্ন ও শোভন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে, যদিও নিয়ন্ত্রণের আইনগুলি রদ করা হয়নি এখনও। ভারতীয় মুদ্রার তুলনায় বাংলাদেশের টাকার মূল্য কম কেন, এই নিয়ে প্রশ্ন আছে ওখানকার অনেকের মনে। তবে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে সোনার দামও প্রায় দ্বিগুণ।

বাংলাদেশের একটি চিত্র এদিকে অনেকের কাছেই অজানা। বাংলাদেশের যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে শিল্প, সাহিত্য, মুক্ত বুদ্ধি ও চিন্তায় যেন একটি নব জাগরণ এসেছে। ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই পুরোপুরি না দেখে যদি বাঙালি দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখা যায়, তাহলে মনে হবে, বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার যুব সমাজের মধ্যে যথেষ্ট মানসিক মিল আছে। সেখানে ধর্মের চেয়েও ভাষা ও সংস্কৃতির যোগসূত্র অনেক বড় কথা। পশ্চিম বাংলার বইপত্র চোরাচালান হয়ে বাংলাদেশে কিছু যায়, সেই তুলনায় বাংলাদেশের বই পশ্চিম বাংলায় খুব কম আসে। আমার মনে হয়, একতরফাভাবেই বাংলাদেশের বইপত্র পশ্চিম বাংলায় অবাধে আসার ব্যবস্থা করা উচিত। এ ব্যাপারে ভারত সরকারের কোনওরকম মাথাব্যথা না থাকতে পারে, কিন্তু পশ্চিম বাংলার সরকার ভেবে দেখতে পারেন।

সেদিনের স্মৃতি

সাতক্ষীরায় একজন সৌম্য দর্শন বৃদ্ধ হাসতে হাসতে আমাকে জিগ্যেস করেছিলেন, এরপর কী? তখন তাঁর হাসিটাও একটু অস্বাভাবিক লেগেছিল।

ডিসেম্বর মাসের গোড়ার দিকে সাতক্ষীরা শহরের পতনের দু-একদিন পরেই বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন প্রতিনিধি ও মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কলকাতা থেকে আমরা কয়েকজন গিয়েছিলাম। বসিরহাটের কাছে ইটিন্ডা থেকে ইছামতী নদী পেরিয়ে তিন মাইল গেলেই ভোমরা, তারপর থেকেই বাংলাদেশের মাটি। খুলনা-সাতক্ষীরা যাতায়াতকারী একটি লঝঝরে বাস তখন মুক্তি বাহিনীর দখলে, সেটি চেপে কিছুদূর যাওয়ার পরই বাসটি ছেড়ে দিতে হল, বাসটির অন্য প্রয়োজন ছিল, তখন পায় হাঁটা।

বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম পা দিয়েই এক ধরনের রোমাঞ্চ হয়। যদিও তার কোনও যুক্তি নেই। এ মাটি তো আলাদা কিছু নয়। অদূরের বসিরহাট—হাসনাবাদ আর এই ভোমরার ভূপ্রকৃতিতেও তফাত কিছু নেই, একই দেশ, একই মানুষ—মাঝখানে কয়েকবছর একটা অবাস্তব দেয়াল তোলা ছিল। সেই নিষেধের ভ্রুকুটিই মনের মধ্যে এই বাষ্প তৈরি করে দিয়েছে।

রাস্তার দুপাশে যুদ্ধের ক্ষত বিক্ষত চিহ্ন। অজস্র বাঙ্কার আর ফক্স হোল আর আগুনে পোড়া বাড়ি। তখনও খুলনা শহর এলাকায় তুমুল যুদ্ধ চলছে, ঢাকা আত্মসর্ম্পণের সম্ভাবনাও দেখা যায়নি। আমি তো নিজে যুদ্ধ করিনি, তাই সেই যুদ্ধসঙ্কুল আবহাওয়ার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেশ একটা সুখ মিশ্রিত শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছিল।

সাতক্ষীরা শহরের পার্কে মিটিং—সেখানে নবীন বাংলাদেশ সরকার তাঁদের নীতি ঘোষণা করবেন। সাতক্ষীরার যুদ্ধে মুক্তি বাহিনীরই ছিল প্রধান ভূমিকা—ভারতীয় সেনাবাহিনী শুধু শেষ ধাক্কা দিয়ে সাহায্য করে খুলনার দিকে এগিয়ে গেছে। সাতক্ষীরা শহর এলাকায় কিংবা মিটিং-এ একজনও ভারতীয় সৈনিক নেই। ভারতীয় বলতে আমরা কয়েকজন নিছক অসামরিক মানুষই উপস্থিত। কয়েকশো মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র ভূমিতে নামিয়ে রেখে মিটিং-এর মাঝখানে বসেছে। মঞ্চের দুপাশে দুটি তরুণ পাহারা দিচ্ছে স্টেনগান হাতে নিয়ে।

মিটিং-এর প্রথম দিকে খুব বেশি লোক হয়নি। আস্তে আস্তে ভিড় বাড়ে। অধিকাংশ মানুষেরই মুখ ভাবলেশহীন। মঞ্চ থেকে যখন জ-য় বাং-লা ধ্বনি তোলা হচ্ছিল, আমি লক্ষ করেছিলুম, অনেকেই গলা মেলায়নি। অনেকেই মিটিং থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে সতর্কভাবে সব ব্যাপারটা লক্ষ করেছিল। তাতে আমার একটু খটকা লাগে। আমরা ধারণা করেছিলুম, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষই স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সেটা বাস্তবে সত্যি হতে পারে না। বহু নিরন্ন শিক্ষাহীন মানুষের কাছে স্বাধীনতার মর্মটাই পরিষ্কার নয়। দারিদ্র্য তাদের চিরকাল পরাধীন করে রেখেছে, শুধু শাসক বদলেছে মাত্র। পাকিস্তানি সৈন্যদের নারকীয় অত্যাচারে সকলেই সহ্যের শেষ সীমায় এসেছিল ঠিকই, তারা বিতাড়িত হওয়ায় স্বস্তি পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু নতুন শাসন ব্যবস্থার চরিত্র সম্পর্কে সন্দীহান। আবার কি হিন্দু রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে চলল নাকি? সাতক্ষীরা শহরে তখন একজনও হিন্দু নেই—আবার কি পাক সেনাবাহিনীর হাতে অত্যাচারিত নিগৃহীত হিন্দুরা প্রতিশোধ নিতে ফিরে আসবে? কিংবা যুদ্ধ তো তখনও শেষ হয়নি—হঠাৎ যদি সীমান্তের একদিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে চিনা সৈন্য, ভারতীয় বাহিনী তা হলে সেই সীমান্ত বাঁচাতে বাংলাদেশ ছেড়ে দৌড় দেবে—তাহলে আবার ফিরে আসবে পাকিস্তানিরা—তখন এই জয় বাংলা ধ্বনি দেবার জন্য প্রত্যেকের গলা কাটবে না? কিংবা ভারত মহাসাগর থেকে মার্কিন সপ্তম নৌবাহিনী যদি সত্যিই কামান দেগে বসে, ভারতের সাধ্য আছে যুদ্ধ চালাবার? মুক্তিবাহিনী আর কোনও দিন সীমান্ত পেরুতে পারবে তাহলে?

মুখে অবশ্য এই সংশয়ের কথা কেউ বলেননি। সকলেই আমাদের বলছিলেন, পাকিস্তানিরা গেছে আপদ গেছে। আমরা তো এই স্বাধীনতাই চেয়েছিলাম।

মিটিং-এর বক্তাদের জোরালো বক্তৃতায় ক্রমশ আবহাওয়া বদলায়। অনেকেই আরও কাছাকাছি চলে আসে ও শ্লোগানে গলা মেলায়। উত্তাল জয় বাংলা ধ্বনিতে দিক দিগন্ত ভরে যায়।

মিটিং শেষ হবার পর আমি বাইরে ঘুরছি সেই সময় সেই বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা। মাথা ভরতি ধপধপে সাদা চুল, মুখেও সেইরকম সাদা দাড়ি। বার্ধক্যের যে একটা সৌন্দর্য আছে, এইরকম বৃদ্ধকে দেখলে তা বোঝা যায়। সঞ্জীবচন্দ্রের ভাষা ব্যবহার করে বলতে হয়, এমন প্রসন্নতা ব্যঞ্জক ওষ্ঠ খুব কম দেখা যায়।

বৃদ্ধ আপন মনে মিটিমিটি হাসছিলেন। সেই হাসিটিই আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট করে। এখানে এসে আর যাই দেখি, হাসি দেখিনি। মুখে মুখে অত্যাচার ও নিপীড়নের কাহিনি। অনেকেরই মনের মধ্যে চাপা শঙ্কা—কাকে কখন কোলাবরেটার বা দালাল বলা হবে ঠিক নেই। নতুন শাসকরা কাকে কীরকম শাস্তি দেবে কে জানে! এই সময় কারুর মুখে হাসি আসতে পারে না।

আমি বৃদ্ধের কাছে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলাম, আপনার কেমন লাগছে?

বৃদ্ধ আমাকে আপাদমস্তক দেখে জিগ্যেস করলেন, তুমি বাবা বুঝি ইন্ডিয়ার লোক?

আমার চেহারায় বা পোশাকে সেরকম কী পরিচয় ছিল জানি না। বছর পঁচিশেক আগে হলে ইনি নিশ্চয়ই জিগ্যেস করতেন, তোমার বাবা কোন জেলায় বাড়ি। এখন জেলার বদলে দেশ।

উত্তর দিলাম, হ্যাঁ।

বৃদ্ধ পূর্ববৎ হাসতে হাসতে বললেন, এরপর কী? এরপর কী? কেন, এ কথা বলছেন কেন?

বৃদ্ধ সেই মিটিং ভাঙা ভিড়ের দিকে হাত দেখিয়ে বললেন, মাত্র সাতদিন আগে ঠিক এই জায়গায়, ঠিক এই সময় আর একটি মিটিং হয়েছিল। এতগুলোন মানুষই এসেছিল। তখন আর্মির লোকেরা আর শহরের মুরুব্বীরা বক্তৃতা দিলে, সবাই বললে, মুক্তিবাহিনী আমাদের দুশমণ, ভারতের দালাল। ওরা আসছে আমাদের ধর্ম, মান-ইজ্জত কেড়ে নিতে। সবাই আল্লার কাছে প্রার্থনা করলে, ওইসব দুশমন নিপাত যাক। আজ যারা জয় বাংলা বলে চেঁচাচ্ছে—তাদের অনেকেই সেদিন একরকম ভাবে আল্লা হো-আকবর বলে চিৎকার করছিল : তা, সেদিন দেখলুম একরকম, আজ আবার অন্য রকম। এখন কথা হচ্ছে, আর সাতদিন পর আবার কী দেখব?

তখনও যুদ্ধ শেষ হয়নি। আমরা ভারতে বসে নিশ্চিত জানতুম—এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় যৌথ সংগ্রাম দু-চারদিনের মধ্যে জয়যুক্ত হবেই। কিন্তু দখলীকৃত এলাকায় বসে অনবরত পাকিস্তানি প্রচার শুনতে শুনতে সেখানকার মানুষের পক্ষে এরকম বিশ্বাস খুব দৃঢ় হওয়া সম্ভব ছিল না। এরকম প্রশ্ন উঠতে পারেই। বৃদ্ধ সেটা প্রকাশ্যে বলে ফেললেন।

কিন্তু চকিতে আমার মনে অন্য একটা কথা এসেছিল। এরপরে কী—এই প্রশ্নের মধ্যে অনেক রকম আশঙ্কা। বিজয়ের পর আবার কত রক্তপাত শুরু হবে? মুক্তিবাহিনীর কোনও কোনও যোদ্ধার মুখে শুনতাম, আমরা যখন ভেতরে ঢুকব, মারতে মারতে ঢুকবে! যারা দালালি করছে, আমাদের বাংলারই মানুষ হয়েও আমাদের বাড়ি-ঘর লুট করছে—মা-বোনের ওপর অত্যাচার করছে, তাদের ছাড়বো? একজন বলেছিল সবুর খানকে খুন না করে আমি আর দেশের ভাত খাবো না! এসব বড় ভয়ংকর কথা। সদ্য স্বাধীনতার পর মারামারি কাটাকুটি শুরু হলে সে দেশ নিজের পায়ে দাঁড়াবে কী করে? বিদেশি শকুনরা তো সেই সুযোগের জন্য ওঁৎ পেতে আছে। এখন প্রতিশোধের চেয়ে ক্ষমাই বেশি শক্তিশালী।

আমি বৃদ্ধকে আবার জিগ্যেস করলাম, সে পরে যা হওয়ার তাই হবে। আজকের দিনটায় আপনার কেমন লাগছে?

বৃদ্ধ বললেন, আমি আর ক’দিনই বা বাঁচব? আমার কথায় কী যায় আসে!—না, তবু বলুন! আপনার মতামত শুনতে চাই।

—শুধু ধম্মো ধম্মো করলে কি আর দেশ চলে? মানুষকে খেতে পরতে না দিলে আল্লাও দয়া করেন না তাদের। মারামারি কাটাকাটি না করে সবাই যদি মিলে মিশে থাকে, তবে তো ভালোই। কিন্তু তা থাকবে কি? দেখলাম তো সারাটা জীবন ধরো—

এরপর ঠিক তিনমাস কেটে গেছে। মিথ্যে প্রমাণিত হয়ে গেছে অনেক আশঙ্কা। এর মধ্যে আমি বাংলাদেশের অনেক জায়গায় আবার ঘুরে এসেছি। মুক্তি বাহিনী যে আশ্চর্য সংযম দেখিয়েছে তার নজীর পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। দু-একটা ছোটখাটো ঘটনা যা ঘটেছে, তা এতই নগন্য যে তার উল্লেখ করা উদ্দেশ্যমূলক অভিসন্ধি ছাড়া আর কিছুই নয়। হিন্দু রাজত্বও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ইন্দিরা গান্ধি যে ক’টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার প্রত্যেকটি রক্ষা করেছেন। এই যুদ্ধ যে সাম্প্রদায়িকতার ওপর একটা বড় আঘাত, সে বিষয়ে আমার অন্তত কোনও সন্দেহ নেই। হঠাৎ একদিনে সব মুছে যাবে এরকম আশা কেউ করে না। বরং বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের এই ঐতিহাসিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার চির অবসানের একটা উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

ঢাকা শহরে গিয়ে হাজার হাজার সাহসী তরুণ মুগ্ধ দেখে বুকখানা গর্বে ভরে যায়। দুঃসাহস ও বিজয়গর্ব তাদের মুখে অপরূপ সৌন্দর্য দিয়েছে। তারা প্রত্যেকে দেশ গড়ার কাছে অংশীদার।

তবু নিভৃতে কারুর সঙ্গে আলোচনা হলে, সেই প্রশ্নটি আবার শোনা যায়, এরপরে কী?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের মাঠে বসে এই প্রশ্নটি আমি আবার শুনতে পাই। বৃদ্ধ নয়, অনতিনবীন চিন্তিত মুখ। আমি বললাম, আপনি কী হিসেবে বলছেন? অনেকে এখন থেকেই মাথা ঘামাচ্ছেন, পাঁচ বছর বাদে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কীরকম হবে। আমি মাথা ঘামাতে চাই না।

তিনি বললেন, না, সেকথা নয়। স্বাধীনতা পাওয়া গেল, জয়ের আনন্দও আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে আসবে। কিন্তু তারপর? সমস্ত মানুষের সুখ-সমৃদ্ধির কী হবে? যে সমাজতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল, সেটা কী করে আসবে?

—কেন আসবে না?

—আপনাদের ইন্ডিয়াতেও তো সমাজতন্ত্রের কথা ঘোষণা করা হয়েছে।

—কিন্তু বাস্তবে কতটা হয়েছে।

—ভারত অনেক বড় দেশ। অনেক অনেক জটিল তার সমস্যা। সেখানে সব কিছুই আস্তে আস্তে বদলায়। আপনাদের নবীন উৎসাহ—আপনারাই অনেক তাড়াতাড়ি সেই প্রতিশ্রুতি সার্থক করে তুলতে পারবেন। ভারত আপনাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে।

তিনি বললেন, কিন্তু দু-চার বছরের মধ্যে যদি প্রতিক্রিয়াশীলরা আবার মাথা তুলে দাঁড়ায়? যদি চিনি মাখিয়ে আবার ধর্মের বিষ খাওয়াতে চায়?

আমি বললাম, ইতিহাস কি কখনও কিছুটা সামনের দিকে এগিয়ে আবার পেছনে ফেরে? আমি অন্তত সেরকম বিশ্বাস করতে চাই না।

একুশে ফেব্রুয়ারির গভীর রাত্রে

রাত্তির একটার সময় মনে হল, শুধু শুধু ঘরে বসে থাকার কোনও মানে হয় না, রাস্তায় বেরিয়ে পড়তেই হবে।

ঢাকায় পৌঁছেছি ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধেবেলা। প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল রাত বারোটার পর থেকে একুশে ফেব্রুয়ারির উৎসব দেখা এই উৎসব আমি প্রথম দেখেছিলাম ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের একুশে ফেব্রুয়ারির সারা রাত। সেই শোক-আনন্দ মেশা উন্মাদনার রাতটির কথা মনে পড়লে আজও রোমাঞ্চ হয়। সেই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার জন্য আবার ফিরে এসেছিলাম ১৯৭৪ সালে, তখন শেখ মুজিব এ দেশের কর্ণধার। সে-রাতেও একফোঁটা ঘুমোইনি। কলকাতার বন্ধুপরিজনের কাছে এই একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের কত যে গল্প করেছি তার শেষ নেই।

এবার আমরা এসেছি ছোটখাটো একটি দলে মিলে। এসেছেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, একাত্তরের সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলিতে বেতারে যাঁর আবেগময় কণ্ঠ বহু মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে, এবং তরুণ আবৃত্তিকার সৌমিত্র মিত্র, দুই বাংলার কবি ও আবৃত্তিকারদের সেতুবন্ধন ঘটাতে যিনি অক্লান্ত কাজ করে যাচ্ছেন। সঙ্গে আমাদের অর্ধাঙ্গিনীগণ এবং প্রকাশক বাদল বসু। উঠেছি ধানমুন্ডির এক অতিথিনিবাসে। সন্ধের পর থেকেই সেখানে জড়ো হয়েছেন ঢাকার বন্ধু-বান্ধবরা, আড্ডা চলছে তুমুল, কলকাতা কিংবা ঢাকা, জলপাইগুড়ি কিংবা যশোর, যে-কোনও জায়গাতেই আমরা বাঙালিরা আড্ডা দিতে সবচেয়ে ভালোবাসি। কিন্তু রাত্তিরবেলা শহিদ মিনারের কাছে যাওয়া হবে না?

ঢাকার শুভার্থীরা পরামর্শ দিলেন এই রাতে আর পথে না-বেরুলেই ভালো। এবারের পরিস্থিতি কিছুটা আশঙ্কাজনক। মাত্র কয়েকদিন আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, একদিকে যুক্ত সংগ্রাম পরিষদ, অন্যদিকে জামাতে ইসলামির ছাত্র শাখা। সংগ্রাম পরিষদ বিজয়ী হলে বিজিতরা তা খেলোয়াড়সুলভ মনোভাব নিয়ে মেনে নিতে পারেনি, হাঙ্গামা ও মারামারি হয়েছে নানা জায়গায়, সবচেয়ে দুঃখের কথা, ছাত্রীদের এক বিজয় মিছিলের হামলায় আহত হয়েছে কয়েকটি ছাত্রী। ঢাকার সংগ্রামী ঐতিহ্যবাহী ছাত্ররা, তারা যে-দলেরই হোক, পরাজয়ের ক্ষোভে নিজেদের সহপাঠিনীদের গায়ে হাত তুলেছে, এরকম ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। এটা বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা। বাংলাদেশে তখন সামরিক শাসন। মাঝে মাঝেই জ্বলে ওঠে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও সংঘর্ষের আগুন।

২০ ফেব্রুয়ারির দিবাগত রাতে অনেকেই সেজন্য সন্ত্রস্ত! শহিদ মিনারে উৎসবের কর্তৃত্ব নিয়ে আজ আবার রেষারেষি ও লড়াই হতে পারে। সেই আশঙ্কায় সাধারণ নাগরিকরা প্রায় কেউই ওদিকে যাচ্ছেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলিতেও আজ রাতে বাইরে বেরুনো নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে। বন্ধুরা বললেন, এবারে রাত্তিরে বিশেষ কিছু দেখবার নেই। কাল সকালবেলা শহিদ মিনারে গেলেই তো হয়।

তবু আমার অন্তরটা ছটফট করে, বাহাত্তর সালের সেই রাত্রিটার কথা মনে পড়ে। ঢাকায় একুশে ফেব্রুয়ারি রাতের সেই স্বতঃস্ফূর্ত মানুষের জোয়ার, তা কি থেমে যাওয়া সম্ভব? সে যে সাংঘাতিক দুঃখের কথা, সে যে সাংঘাতিক পরাজয়! একবার দেখে আসতেই হবে। আমরা উঠে দাঁড়ালাম, অগত্যা ঢাকার কয়েকজন বন্ধুও সঙ্গী হলেন।

আমাদের সঙ্গে কোনও গাড়ি নেই, এত রাতে যানবাহন পাওয়ারও আশা করা যায় না। হেঁটেই যেতে হবে। ধানমুন্ডি থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা খানিকটা দূর আছে বটে, তবু বড়জোর একঘণ্টা লাগবে! এবারের দীর্ঘস্থায়ী শীতে, এই রাতেও বেশ ফিনফিনে ঠান্ডা বাতাস বইছে। গায়ে চাদর জড়িয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম রাস্তায়।

ঢাকার বেশ কয়েকটি রাস্তাই কলকাতার তুলনায় অনেক বেশি প্রশস্ত, এখানকার বাড়িগুলি পরস্পরের সঙ্গে সবসময় ঠেলাঠেলি করে না, শহর থেকে প্রকৃতি একেবারে অদৃশ্য হয়ে যায়নি, এখনও আছে কিছু ফাঁকা জায়গা, শহরের মধ্যে মধ্যেই চোখে পড়ে খাল ও পুকুর, অনেক গাছপালা, কবি জসিমুদ্দিনের বাড়ির পশ্চাতে আমি ছোট ধানখেত পর্যন্ত দেখেছিলাম মনে আছে। এখানকার এই খোলামেলা রাস্তাটি কিন্তু মধ্যরাত্রির পরেও একেবারে নিশুতি জনমানবশূন্য নয়, কিছু কিছু গাড়ি ও সাইকেল চলাচল করছে, হেঁটেও যাচ্ছে কেউ কেউ। ধানমুন্ডি আবাসিক এলাকা ছাড়িয়ে শহরের কেন্দ্রের দিকে মিনিট পনেরো হাঁটতেই আমরা পেয়ে গেলাম কয়েকটি সাইকেল-রিকশা। ঢাকায় হাতে টানা রিকশা নেই, এবং সাইকেল-রিক্সার নাম শুধু রিকশা। এরপর যতই এগোই ততই মানুষের সংখ্যা বাড়ে দূর থেকে শোনা যায় শিহরণ জাগানো সেই গান :

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি…

শাহাবাগ ও জাতীয় জাদুঘরের মোড়টার সামনে এসে রিকশা থেকে নামতে হল। হেলমেট-বন্দুকধারী পুলিশ এখানে রাস্তা কর্ডন করে আছে, কোনও গাড়ি আর যেতে পারবে না শহিদ মিনারের দিকে। সেখানে কয়েক মুহূর্ত আমরা অভিভূত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। উলটোদিকের রাস্তা লোকে লোকারণ্য, কোথাও আতঙ্কের চিহ্নমাত্র নেই, বিভিন্ন দিক থেকে শোনা যাচ্ছে সমবেত গান, কয়েকটি পুলিশেরও যেন সেই গানের সুরে ঠোঁট নড়ছে মনে হল।

শাহাবাগের মোড়ে এত রাত্রেও বিক্রি হচ্ছে ফুল। কয়েকটি মালা কিনে নিয়ে আমরাও গেলাম সেই মানুষের স্রোতে। আমাদের ভিতরে ভিতরেও গুঞ্জরিত হতে লাগল সেই গান।

এই গানের লেখককে আমরা অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে চিনি। বাহান্ন সালে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি-মিছিলে গুলি চলেছিল এই ঢাকা শহরে, শহিদ হয়েছিল চারজন তরুণ, আহত হয়েছিল আরও অনেকে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেডে বুলেটবিদ্ধ এক যুবার শিয়রে বসে থাকতে থাকতে এই কবিতাটি লিখেছিলেন আবদুল গফফার চৌধুরী। পরের বছর একুশে ফেব্রুয়ারি প্রথম শহিদ দিবস হিসাবে পালিত হয়েছিল, তখন কবিতাটিতে সুর দিয়ে গাওয়া হয়েছিল। আবদুল গফফার চৌধুরী আরও অনেক কবিতা-গল্প লিখেছেন, সাংবাদিক হিসাবেও তিনি প্রসিদ্ধ। কিন্তু তাঁর এই একটি রচনা সমস্ত বাংলাভাষী মানুষের মর্মে গেঁথে আছে। এখন যারা এই গান গায়, তারা হয়তো রচয়িতা কিংবা সুরকারের নামও জানেন না। আমাদের সামনে একটি তরুণের দল হাত উঁচু করে দীপ্ত কণ্ঠে এই গান গাইতে গাইতে আসছে, এদের বয়েস কুড়ি-বাইশ-এর বেশি নয়। এরা বাহান্নর ভাষা-আন্দোলন তো প্রত্যক্ষ করেনি বটেই, এমনকী স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের জন্মক্ষণটিও দেখেনি বা তার স্মৃতি নেই। দেখতে দেখতে এই নবীন রাষ্ট্রেরও তো বয়েস হয়ে গেল বেশ! তবু, নতুন প্রজন্মের এই যুবকেরা এই গান থেকে প্রেরণা পায়। আমি এই গানটি জীবনে কতবার যে শুনেছি তার ইয়ত্তা নেই, তাও প্রত্যেকবারই আবেগে কণ্ঠে বাষ্প জমে যায়। এই রাতে গানটি যেন আরও বেশি অর্থময় হয়ে ওঠে।

মানুষের স্রোতে হাঁটতে হয় না, স্রোতই টেনে নিয়ে যায়। এই রাত্রিতে যেন অন্ধকার নেই, যেন মেরুপ্রদেশের হোয়াইট নাইট! বিভিন্ন সংগঠন আসছে তাদের পতাকা ও মিছিল নিয়ে, কেউ কারুর পথ আটকাচ্ছে না, এক দলের গানের সঙ্গে অন্য দলের গানের সংঘর্ষ নেই। আমাদের সঙ্গী ঢাকার বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলি, কী হে, তোমরা যে বলেছিলে, আজ রাতে বিশেষ কেউ আসবে না? এই তো কত মানুষ এসেছে! তারা বললে, অন্যান্য বছর আরও অনেক বেশি ভিড় হয়। কিন্তু ভিড়ের আয়তন দেখেই কি শুধু প্রাণের স্পন্দন পরিমাপ করা যায়? চতুর্দিকে উদ্দীপিত মুখ, শুধু ছাত্রই নয়, দেখতে পাচ্ছি অনেক মাঝবয়সি মানুষও, তবে আমাদের সঙ্গিনীরা ছাড়া মহিলা বিশেষ চোখে পড়ছে না তা ঠিক। বাহাত্তর সালের সেই রাতে ঢাকায় মেয়েদের কোনও বাধা নিষেধ ছিল না।

শহিদ দিবস আসলে শোকের দিন হওয়ার কথা। কিন্তু চতুর্দিকে আনন্দের উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনা দেখে বোঝা যায়, একুশে ফেব্রুয়ারি এখন জয়ের দিনে রূপান্তরিত হয়েছে। চারজন তরুণ ঢাকার রাজপথে রক্ত দিয়েছিল, তাদের এই আত্মদানে অনুপ্রাণিত হয়ে সমস্ত দেশ প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছিল। তারপর পাকিস্তানি আমলেই বাংলা ভাষা পেয়েছিল রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি, এখন বাংলাদেশে তো বাংলাই একমাত্র ভাষা এবং সারা বিশ্ব এই ভাষাকে মেনে নিয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারির জয় তবু সেখানে থেমে থাকেনি, এই দিনটি এখন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার দিন, এই দিন নতুন সংগ্রামের শপথ নেওয়ার দিন। সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ যে অসংখ্য তরুণের দল এই গভীর রাত্রে গান গাইতে গাইতে আসছে, তারা অতীতকে আঁকড়ে ধরে নেই, তারা শুধু পিছনের দিকে তাকিয়ে থাকে না, তাদের চোখে বিচ্ছুরিত হচ্ছে ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষা।

অন্যান্য বছরের ভিড়ের সঙ্গে তুলনা করে লাভ নেই, এখন চতুর্দিকে দেখতে পাচ্ছি শুধু চলমান মানুষ, রাত্তিরের বাতাস বয়ে আনছে অনবরত সংগীত। এক সময় আমরা এসে পৌঁছলাম শহিদ মিনারের কাছে। আমার বুক কাঁপে, ইতিহাস মনে পড়ে। একাত্তর সালের পঁচিশে মার্চ এখানকার শহিদ মিনার কামান দেগে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, কাছাকাছি রাস্তায় পড়েছিল যুবকদের লাশ। যারা সেদিন কামান-বন্দুক চালিয়েছিল তারা আজ কোথায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, নতুন প্রজন্মের জয়ধ্বনিতে কোথাও দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা যায় না।

শহিদ মিনারের রক্তিম বৃত্তটি আমাদের চুম্বকের মতো টানে। জুতো খুলে রেখে আমরা আস্তে আস্তে উঠে যাই সিঁড়ি দিয়ে। এখানে মাইক্রোফোনে শোনা যাচ্ছে নানারকম ঘোষণা ও বিভিন্ন গোষ্ঠীর গান। রাত এখন কত তার হিসাব নেই। অনেকের হাতে ঝলসে উঠছে ক্যামেরা। এত মানুষ, তবু কেউ ঠেলাঠেলি করছে না। দূরে কোথায় যেন দুম করে একটা শব্দ হল, বোমা না পটকা? তাতেও কোনও চাঞ্চল্য দেখা গেল না, ছুটে পালাল না কেউ, বরং সেই বিকট ধ্বনির উত্তরে কারা যেন আরও জোরে গান গেয়ে উঠল। একটি কিশোর চেঁচিয়ে উঠল—ফুল চাই, ফুল?

চমৎকার জ্যোৎস্নাময় স্নিগ্ধ রাত। আমরা আমাদের হাতের মালাগুলি ছুড়ে দিলাম অন্য মালার স্তূপে। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম চুপ করে। শুনছি সেই গান :

আমার শহিদ ভাইয়ের আত্মা ডাকে

জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাঁকে

দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বালাবো ফেব্রুয়ারি

একুশে ফেব্রুয়ারি, একুশে ফেব্রুয়ারি…

প্রথম সেই চারজন শহিদের গায়েবি জানাজায় ইমাম সাহেব মোনাজাত করে বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ, আমাদের অতি প্রিয় শহিদানের আত্মা যেন চিরশান্তি পায়। আর যে জালিমরা আমাদের প্রিয় ছেলেদের খুন করেছে তারা যেন ধ্বংস হয়ে যায় তোমার দেওয়া এই দুনিয়ার বুক থেকে।’

আমার প্রার্থনা-টার্থনা ঠিক আসে না। সেই মুহূর্তে একটা কথাই আমার মাথায় ঘুরতে লাগল, অনর্থক তরুণ-তরুণীদের রক্তে এই পৃথিবীর মাটি যেন আর কখনও না ভিজে যায়! পৃথিবী তো সব মানুষের জন্যই!

কয়েকটি ছোটখাটো জরুরি বিষয়

ভূতপূর্ব পূর্ব-পাকিস্তান থেকে যখন কোনও কোনও কবি, গল্পকার বা অধ্যাপক কলকাতায় আসতেন, তখন তাঁদের সঙ্গে আলাপের প্রথম কয়েকটি মুহূর্তে একটা সূক্ষ্ম অসুবিধা বোধ করতাম। পরস্পর নাম জানাজানির পর প্রথম সম্বোধনটা কীরকম ভাবে হবে?

হিন্দু পরিবারভুক্ত বাঙালিরা সদ্য পরিচয়ের পর হাত তুলে বলে, নমস্কার। করতল দুটি যুক্ত হয়ে কপাল বা বুকের কাছে চলে আসে। অভ্যেসবশত আমিও প্রথম প্রথম তাই করতাম। কিন্তু লক্ষ করেছি, বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে হাতজোর করে নমস্কার প্রথা সাধারণভাবে প্রচলিত নেই, কেউ কেউ আমার নমস্কারের উত্তরে ওই ভঙ্গিতে প্রতি নমস্কার করেননি।

তারপর থেকে আমি পূর্ব বাংলার সদ্য পরিচিত মুসলমান বন্ধুদের দেখাদেখি শুধু ডান হাতখানা কপালের কাছাকাছি তুলে সেলামের ভঙ্গি করতাম। সম্প্রীতির বিনিময় একই প্রকারের না হলে ঠিক সাবলীল হওয়া যায় না। মাঝখানে একটু ব্যবধান থেকেই যায়। সাহেবদের সঙ্গে পরিচয় হলে আমরা তাদেরই প্রথায় শেক হ্যান্ড করি। পশ্চিম বাংলার অনেক মুসলমান বন্ধু আমাদের সঙ্গে ঠিক একইভাবে হাত তুলে বলেন নমস্কার। যদিও, পশ্চিম বাংলার গ্রামে মফসসলে সাধারণ অপরিচিত মুসলমানকে কখনও হাত তুলে নমস্কার করতে দেখিনি সাধারণ হিন্দুও ডান হাত তুলে সেলাম করতে চায় না।

এক সময় আদাব শব্দটি খুব প্রচলিত ছিল, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে, এখন আর প্রায় শোনাই যায় না। মুসলমানরা হিন্দুদের প্রতিও সম্বোধনে বলে, আসসালাম আলায়কুম, (অনেক সময় তাড়াতাড়িতে সালাম আলাকুম, কিংবা স্লাম আলেকুম) আর হিন্দুরা প্রত্যুত্তরে আলাকুম আসলাম বলতে পারে না।

একাত্তর সালের পর স্বাধীন বাংলার একজন মুক্তিসেনার সঙ্গে পরিচয় হবার সময় আমরা দুজনেই দু-এক মুহূর্ত দ্বিধা করার পর হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলাম।

তারপর থেকেই ভেবেছি, স্বাধীন বাংলা ও পশ্চিম বাংলার সমস্ত হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সম্বোধন ও প্রীতি বিনিময়ের একটি সাধারণ প্রথা থাকা কি উচিত নয়?

সাহেবদের সঙ্গে করমর্দন করি, তারা খ্রিস্টান বলে নয়—অখ্রিস্টান সমাজতান্ত্রিক দেশের সাহেবদের সঙ্গেও ওইরকম ব্যবহার। সাহেবদের থেকে আমাদের কালচার একেবারে আলাদা। এদিকে, দুই বাংলার মুসলমান-হিন্দু নির্বিশেষে আমরা একই ভাষা ও কালচারের অধীন। সাধারণ সামাজিক আচার ব্যবহারে আমাদের সবরকম ব্যবধান দূর করে ফেলাই তো সঙ্গত।

নববর্ষে আমরা অনেক শপথ নিই। এইসব ব্যাপারে একটা নতুন কিছু ঠিক করা যায় না? স্বাধীন বাংলাদেশ আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য এবং আমাদের আন্তরিক প্রতিবেশী স্বাধীন বাংলাদেশের মুসলমান-হিন্দু এবং পশ্চিম বাংলার সঙ্গে তার সাবলীল নিকট সম্পর্ক স্থাপনের জন্য এইসব ছোটখাটো গরমিলগুলো দূর করার উপায় এখুনি খুঁজে দ্যাখা দরকার।

হাতজোড় করে নমস্কারের ভঙ্গি এবং কথাটার মধ্যে কোনও হিন্দুয়ানি আছে কিনা আমি জানি না। খ্রিস্টানরা গির্জায় গিয়ে ওই একই ভঙ্গিতে অনেক সময় হাতজোড় করে। যদিও হিন্দুরা মূর্তি পূজা কিংবা অন্য কোনও পূজার সময় নানাভাবে নমস্কার ও প্রণাম করে, হাতজোড় বা হাঁটু গেড়ে বসে পড়া বা সাষ্টাঙ্গে, কিন্তু সামাজিক শিষ্ঠাচারে আত্মীয়দের সঙ্গে হাতজোড় করে নমস্কার করাই প্রথা। হিন্দু বাঙালি মেয়েরা কোনও সাহেবের সঙ্গে পরিচিত হলে করমর্দন করে না, হাতজোড় করেই নমস্কার জানায়। এরকম ক্ষেত্রে মুসলমান মেয়েরা কী করে আমি জানি না। অপরপক্ষে, কপালের কাছে ডান হাত ঠেকিয়ে সালাম আলেকুম বলা সারা পৃথিবীর মুসলমানদের মধ্যে পরিচিত সাহেবেদের সঙ্গে মুসলমানরা সাহেবি প্রথা মেনে করমর্দন করে, হিন্দুদের প্রতি নমস্কার করে না। আবার, বাঙালি হিন্দু যদি দারোয়ান বা বেয়ারার চাকরি নেয়, তখন বড় সাহেবকে দেখলেই (হোক না কালো রঙের বাঙালি হিন্দু সাহেব)—কপালে এক হাত ছুঁইয়ে অবিকল সেলামের ভঙ্গি করে। কিন্তু সে তার সমঅবস্থার মুসলমান প্রতিবেশীকে সেলাম জানায় না।

নমস্কার বা সেলামের বদলে যদি করমর্দনও সাধারণ বাঙালির প্রীতি বিনিময়ের রীতি হয়, তা হলেও আপত্তি জানাবার কোনও কারণ নেই, ব্যক্তিগত রুচির কথা আলাদা, কিন্তু সামাজিক ভাবে একটা নির্দিষ্ট রীতি থাকা ভালো। তাতে বিভেদ অনেক কমে। সেই রীতিটা কী হওয়া উচিত সে সম্পর্কে আমার মতামত দেওয়ার কোনও অধিকার নেই, দেশের সুধী ব্যক্তিরা ঠিক করুন।

সৌভাগ্যের বিষয়, স্বাধীন বাংলাদেশে এবং পশ্চিম বাংলার মধ্যে ভাষার তফাত প্রায় নেই। একই বাংলা ভাষা হয়েও দু-দিকে আলাদা অনেকটা হতে পারত। সেটা হয়নি, তার কারণ, পূর্ব বাংলার শিক্ষিত মানুষ সাহিত্য ও যোগাযোগের ভাষা হিসেবে কৃষ্ণনগর তথা কলকাতার ভাষাকে গ্রহণ করেছিলেন। ফলে, পূর্ব বাংলার খবরের কাগজ, রেডিয়ো, টেলিভিশনে এই কলকাতার ভাষা প্রচারিত হবার ফলে সমস্ত শিক্ষিত বাঙালির কাছে আজ এই ভাষা বোধগম্য। কলকাতার ভাষা মোটেই পশ্চিমবঙ্গের ভাষা বা হিন্দুদের ভাষা নয়, এটাই এখন বাংলা সাহিত্যের ভাষা। এবং এটা ঠিক হয়েছে, স্বাধীনতা বা ভারতভাগের অনেক আগে—মোটামুটি হিসেবে বলা যায়, যখন রবীন্দ্রনাথ ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসটি লিখলেন।

বাঙালি হিন্দু অনাত্মীয় পরিচিত পুরুষদের নামের পরে বাবু যোগ করার প্রথা আছে। অনেক হিন্দু বাঙালি অবশ্য পরস্পরের সঙ্গে মিঃ বোস কিংবা মিঃ চ্যাটার্জি বলে সম্বোধন করেন—কিন্তু সেটাকে সংস্কৃতির বিকৃতি ছাড়া আর কী বলা যায়? মুসলমানদের সঙ্গে অবশ্য অনেক সময় আমরা বাধ্য হয়েই মিঃ আতাহার বা মিঃ রহমান বলি, ইউরোপীয়দের সঙ্গে করমর্দনের মতন। মুসলমানদের সঙ্গে বাবু যুক্ত হয় না। এক্ষেত্রে সাধারণ কোনও সম্বোধনের কথা ভাবা যায় না যা হিন্দু-মুসলমান সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? মুসলমানদের নামের সঙ্গে অনেক সময় সাহেব যোগ করে ডাকার রেওয়াজ আছে—যেমন রহমান সাহেব বা আতাহার সাহেব। কিন্তু আবু সয়ীদ আইয়ুব-এর মতন বিদগ্ধ ব্যক্তি একবার জানিয়েছিলেন যে তিনি ‘আইয়ুব সাহেব’—এরকম সম্বোধন পছন্দ করেন না এবং বাঙালি মুসলমানের নামের সঙ্গে সাহেব যোগ করার কোনও যুক্তি নেই। বাংলাদেশে অনেকে ভাই যোগ করেন, যেমন রহমানভাই, আতাহারভাই। শুনেছি এক সময় বাঙালি ব্রাহ্মণরাও এরকম করতেন। তবে ভাই বলতে বয়সে বড়দেরই বোঝায়, সমবয়সি বা কিছুটা ছোটদের ক্ষেত্রে কী হয়?

পোশাকের দিক থেকে হিন্দু-মুসলমাদের বিশেষ কোনও গরমিল নেই। পাজামা-পাঞ্জাবি বাঙালি হিন্দুদের মধ্যেও বেশ প্রচলিত। অনেকেই বাড়িতে লুঙ্গি পরেন। তবে, লুঙ্গি পরে বাইরে যাতায়াত করার মতন রেওয়াজ ক্রমশই কমে যাচ্ছে হিন্দুদের মধ্যে। আবার, বাঙালি মুসলমান সাধারণত ধুতি পরেন না। সে যাই হোক, ধুতির ব্যবহার তো প্রায় উঠেই যাচ্ছে। মুসলমান ও হিন্দুদের লুঙ্গিতেও কিছু তফাত আছে। মুসলমানরা ব্যবহার করে চেক লুঙ্গি, হিন্দুদের লুঙ্গি এক রঙা। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সব ছেলে ছোকরা, চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীরা শার্ট-প্যান্টালুন পরে। চাষি মজুর ও নিম্নবিত্ত মানুষের মধ্যে মুসলমানরা শুধু লুঙ্গি ও হিন্দুরা হেটো ধুতি ব্যবহার করে। কিন্তু অর্থনীতির চাপে পিষ্ট গরিব মানুষরা পোশাক-আশাকের তফাতের মতন ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবার সময়ই পায় না। এবং শিক্ষিত সমাজের ছোঁয়া তাদের মধ্যে আস্তে আস্তে আসবেই। আজ থেকে পাঁচ কি দশ বছর বাদে, যদি বাংলাদেশের এবং পশ্চিম বাংলার চাষিদের খাটো প্যান্ট পরে চাষবাস করতে দেখা যায়, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ সেটাই সস্তা ও সুবিধাজনক। ভিয়েতনামের গরিব চাষিরাও তাই পরে।

আমার নিবেদন, দেশের সুধী ব্যক্তিরা এইসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে একটু ভাবুন। এ কথা অবশ্য ঠিক, মুষ্টিমেয় কয়েকজন মিলে ঠিক করে দিলেই যে দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষ রুচি ও আচার ব্যবহার পাল্টে ফেলবে, তার কোনও মানে নেই। কিন্তু ইতিহাসের কোনও কোনও আবেগময় মুহূর্তে এরকম ঘটে যায়। এখন সেইরকম সময়—এটা যেন আমরা চিনতে ভুল না করি। এখন মিলনের ইচ্ছা আন্তরিক।

আর একটা ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব আছে। সাধারণত শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান মাত্রই কিছু কিছু রামায়ণ-মহাভারত ও রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক গান ইত্যাদির কথা জানেন। কারণ কাব্য সাহিত্যে এসবের বহুল ব্যবহার। কিন্তু অনেক শিক্ষিত হিন্দু বাঙালিও কোরান হাদিস বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। অনেকে সুফি-দরবেশের জীবনী, এমনকী বিষাদ সিন্ধুর মতন অমর গ্রন্থেরও খোঁজ রাখেন না। এ জন্য, পশ্চিম বাংলার প্রাথমিক শিক্ষার স্তর থেকেই স্কুল পাঠ্য পুস্তকেই এসব বিষয়ে কিছু কিছু রচনা অবশ্য থাকা দরকার। এবং এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে অবিলম্বে, নইলে ইতিহাসের এই মূল্যবান সন্ধিক্ষণটি অবহেলা করে আমরা আর একবার অন্ধত্বের পরিচয় দেব।

পাশাপাশি এসে দাঁড়ানোই বড় কথা

প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে বন্ধু-বান্ধবের মুখে প্রায়ই একটা আলোচনা শুনি।

এখন সেই স্বাধীন দেশের মানুষরা বাঙালি না বাংলাদেশি? বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির উত্তরাধিকারের দাবিতেই পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। স্বাধীনতার দাবি উঠেছে অনেক পরে, তখনও আলাদা রাষ্ট্রটির নাম ঠিক ছিল না। একাত্তরের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর শেষ বক্তৃতায় বলেছিলেন, জয় বাংলা!

রাষ্ট্রের নামেই দেশের নাগরিকদের নাম হয়। বাংলাদেশ নামই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবার পর সে দেশের নাগরিকরা দেশ-বিদেশে বাংলাদেশি নামেই পরিচিত হয়ে উঠছে। তবে কি তারা আর বাঙালি থাকছে না? কিংবা বাঙালি আর বাংলাদেশি কি সমার্থক নয়? এ বিতর্কের এখনও মীমাংসা হয়নি।

স্বাধীনতার আগেই অখণ্ড বাংলার একটি অংশের চলতি নাম ছিল পূর্ব বাংলা, যা পরবর্তীকালে হয় পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ব থাকলেই পশ্চিম-এর বাস্তব অস্তিত্ব থাকে। পূর্ব অদৃশ্য হয়ে গেলে পশ্চিমবঙ্গ নামটা কৃত্রিম হয়ে পড়ে। এতদিন সেই কৃত্রিম নামটাই চলে আসছিল। কেউ কেউ বলছেন, ইতিহাস রক্ষার প্রয়োজনেই পশ্চিমবঙ্গ নামটা টিকিয়ে রাখা দরকার, তাতে বঙ্গ ব্যবচ্ছেদের ইতিহাস বিধৃত থাকবে! এ কেমন ধরনের ছেঁদো ইতিহাস? ইতিহাসের কারণে প্রতিবেশী রাষ্ট্রটির নাম তো ‘পূর্ব বাংলাদেশ’ নয়! দু-টুকরো হয়ে যাওয়া ভারতের নামও তো নয় ‘খণ্ড ভারত’! দুই রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত পাঞ্জাবও শুধুই পাঞ্জাব। ইতিহাস রক্ষার দায় শুধু পশ্চিমবঙ্গের?

এতদিন পশ্চিমবঙ্গ নাম বজায় থাকলেও এ-রাজ্যের মানুষ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গী হয়নি। বাইরেও সবাই বাঙালি বলে। ইংরেজিতেও শুধুই বেঙ্গলি। তার ফলে আমাদের জাতি-পরিচয় বদলাবার প্রশ্ন নেই। বাঙালিদের এই রাজ্যটির নাম বাংলা হওয়াই স্বাভাবিক।

স্বাধীনতার পরই, কংগ্রেসি আমল থেকেই এ-রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের ‘বিমাতৃসুলভ ব্যবহার,’ এই শব্দবন্ধে আমরা অভ্যস্ত। খণ্ডিত পাঞ্জাব কেন্দ্রের কাছ থেকে যতটা সাহায্য পেয়েছে, খণ্ডিত বাংলা পেয়েছে তেমনই বঞ্চনা। বাঙালি উদ্বাস্তুদের প্রতি ব্যবহারে মানবতার কোনও চিহ্ন ছিল না। শরণার্থী সমস্যা আমাদের আজও ঘোচেনি। সেরকম কোনও তেজ-সম্পন্ন বাঙালি নেতা কেন্দ্রীয় সরকারে স্থান পাননি, যাঁরা গিয়েছেন, তাঁরা বাংলা তথা পশ্চিম বাংলার উন্নতি সম্পর্কে বিশেষ উচ্চবাচ্য করেননি, পাছে তাঁদের গায়ে প্রাদেশিকতার ছাপ পড়ে। বিরোধী পক্ষ গলা ফাটিয়েছেন, কেন্দ্রে এবং রাজ্যে। তারপর কয়েকবার সরকার বদল হয়েছে, অবস্থা বিশেষ বদলায়নি। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলিতে বড় বেশি রাজনীতি, শুধুই রাজনীতি, ভাষা-সংস্কৃতি-সামাজিক ব্যবহার সম্পর্কে স্পষ্ট কোনও নীতি নেই! আধখানা শতাব্দী পার হয়ে গেল, তবু নামমাত্র শিক্ষিতের হারও পঞ্চাশ শতাংশ পেরুল না, এর থেকে লজ্জার আর কী হতে পারে? অর্থনৈতিক দারিদ্র্যের চেয়ে শিক্ষার দারিদ্র্য কম মারাত্মক নয়। কিংবা এরা যে পরস্পরের পরিপূরক, তা আমরা আজও বুঝলাম না।

বাংলাদেশ বাংলা ভাষার স্থান করে দিয়েছে সারা বিশ্বে, সেখানে আমাদের স্থান কোথায়? আমরা যে বাংলা ভাষাকে ক্রমশ হারাতে বসেছি, সে বোধটাও কি আমরা হারিয়ে ফেলেছি? ভাষা-ভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের পর সব রাজ্যগুলিতেই সে রাজ্যের ভাষা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে, শুধু পশ্চিম বাংলায় পায়নি। সব স্কুলে বাংলা পড়ানো বাধ্যতামূলক নয়, সে জন্য অনেক বাঙালি ছেলেমেয়েও আর বাংলা শেখে না। সরকারের সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহার সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে অনেকবার স্তোকবাক্য দেওয়া হয়েছে, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বাংলা টাইপ রাইটার, বাংলা টাইপিস্ট-এর অভাব, এসব হাস্যকর অজুহাত। আসল কারণ, উদ্যোগের অভাব। আমাদের বিধানসভাতেও নাকি অনেক বাঙালি সদস্য ইংরেজিতে বাগাড়ম্বর করেন। ইংরেজি জানে না, কিংবা ইংরেজি কম জানে, এ বলে অনেককে আড়ালে হেয় করার চেষ্টা এখনও চলে। ইংরেজিতে দিগগজ হলেও কি বাংলা জানতে নেই? ইংরেজি তো শিখতেই হবে, তা বলে বাংলা ভুলব কেন? কিংবা মাতৃভাষার মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন থাকব না কেন? খুবই দুঃখের বিষয়, আমাদের পশ্চিম বাংলার তিনজন দীর্ঘকালীন মুখ্যমন্ত্রী, বিধানচন্দ্র রায়, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এবং জ্যোতিবসু এঁদের মধ্যে বহুরকম বৈপরীত্য এবং অমিল থাকলেও একটি বিষয়ে মিল আছে, এঁরা কেউ কখনও বাংলায় এক কলমও লেখেননি। ব্যক্তিগত চিঠিও বাংলায় লিখেছেন কি না সন্দেহ!

বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন না হলে লোকের রাস্তায় দাঁড়িয়ে যেখানে সেখানে পেচ্ছাপ করাও বন্ধ করা যাবে না, এক সময় এই ছিল মূল উপপাদ্য। বিপ্লবও হল না, রাস্তায় যত্রতত্র পেচ্ছাপও চলতে লাগল, এই হয়েছে এখনকার অবস্থা। বিপ্লবের বরাদ্দ দিয়ে অনেকে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়েছে, অনেকে বহুরকম দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে। কোন ধরনের সমাজ পরিবর্তনের জন্য বিপ্লব, এখন এই প্রশ্নটাই একটা সাংঘাতিক ধাঁধা। তাই চট করে এখন আর কেউ বিপ্লবের কথা মুখে আনে না। তার ফলে চলছে চরম অরাজকতা। আন্তর্জাতিকতাবাদের বন্দনা করতে করতে আমরা নিজেদের জাতিসত্তা হারাতে বসেছি।

বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি যে এখন সবদিক থেকে সঙ্কুচিত হয়ে আসছে, তা অনেক বাঙালিও দিব্যি মেনে নিয়েছে। যেন এটাই ভবিতব্য। কেউ কিছু প্রতিবাদ বা দাবি তুললে এরাই ‘শিবসেনা’, ‘আমরা বাঙালি’, ‘ফ্যাসিস্ত’ এইসব গালাগালি ছুঁড়ে দেয়, এর কারণ কী? কোনও কিছুই বদলাবার দরকার নেই, যেমন চলছে তেমনই চলুক, এরকম কথাও তারা বলে, অনেক কলকারখানা বন্ধ, অর্থনৈতিক অবস্থা অবনতির দিকে, সুতরাং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিও ডুবে যাক, শেষ হয়ে যাক, এরকম স্থূল কথা বলতেও তাদের মুখে আটকায় না। আবার প্রশ্ন করছি, এর কারণ কী? ইংরেজদের কাছে মীরজাফর, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভরা যেমনভাবে বাংলার স্বাধীনতা বিক্রি করে দিয়েছিল, এ-যুগের এরাও কী সেরকম কোনও শক্তির স্বার্থে বাংলাকে বিকৃত করতে চাইছে। তা হলে যে ধরে নিতে হয়, সেরকম কোনও শক্তি আবার বাংলা সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা হরণ করতে চাইছে। তামিলনাড়ুতে রাজনৈতিক দলগুলি অন্য সব বিষয়ে নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করে, কিন্তু তামিল ভাষা মর্যাদার প্রশ্নে সকলেই সমস্বরে একই দাবি জানায়। কোনও বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয় না। এবং তামিল ভাষা-সংস্কৃতির স্বাধীনতা হরণ করার মতো সাহসও কোনও বহিঃশক্তির নেই!

একটা কিছু করতে হবে। তার প্রথম প্রয়াস, মাথা ঝাঁকানি দিয়ে উঠে দাঁড়ানো। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বাঙালিকে ব্যবসায়ে নামতে প্রবৃত্ত করেছিলেন। উৎসাহের সঙ্গে নেমেও পড়েছিলেন অনেকে। তাঁদের বংশধররা সেসব রক্ষা করতে পারেনি। এখন যদি আবার সেরকম একজন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র নাও পাওয়া যায়, সমবেতভাবে কিছু বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ বাংলার শিল্প-বাণিজ্যকে উজ্জীবিত করতে পারেন। সেই জন্যই তো তৈরি হয়েছে নগজাগরণ মঞ্চ। অনেক বাধা তো আসবেই, ভেতর ও বাইরে থেকে। বাঙালির একটা অস্ত্র আছে, নিষ্কর্মাদের বিদ্রূপ, তাও বর্ষিত হবে যথেষ্ট, রাঘববোয়ালদের স্বার্থে ঘা পড়লে তারা ধারালো দাঁত দেখাবে, সে সবের বিরুদ্ধে যদি আমরা শক্ত হয়ে দাঁড়াতে না পারি, তা হলে বেঁচে থাকার মানে কী?

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রের বিনিময় হয়েছিল রাজশেখর বসুকে কেন্দ্র করে। রাজশেখর বসু বিজ্ঞানী হয়েও চলে এসেছিলেন সাহিত্যের অঙ্গনে। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিজ্ঞানচর্চার অবশ্যই প্রয়োজন আছে, তা বলে সাহিত্য অবহেলিত হবে কেন? নিজের বিশাল কাঁধে বাংলা সাহিত্য-সঙ্গীত-শিল্পকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু তারও তো সঙ্গীসাথীর প্রয়োজন ছিল। অসাধারণ কৌতুকরসের গল্পগুলি ছাড়াও রামায়ণ-মহাভারতের সারানুবাদ ও গীতার প্রাঞ্জল অনুবাদ করে রাজশেখর বসু বাংলার কী উপকারই না করে গেছেন! এখন আর রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া যাবে না, সব যুগে ওরকম মানুষ আসে না। কিন্তু ছোট ছোট মাটির প্রদীপ তো আছে অনেক। পাশাপাশি অনেক প্রদীপ জ্বললেও কম আলো হয় না।

পাশাপাশি এসে দাঁড়ানোটাই বড় কথা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *