আমি কি বাঙালি – ২

ইতিহাসের পরিহাস

ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে বিশ্ব বইমেলায় যোগ দিতে গিয়ে একবার আমি একটি বাড়িতে পেয়িংগেস্ট হয়েছিলাম। সেই বাড়ির মালিক পরিবারটি জার্মান নয়, কিছুক্ষণ আলাপ পরিচয়ের পর বুঝেছিলাম, তারা ম্যাসিডোনিয়ান এবং নিজেদের মধ্যে নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। ম্যাসিডোনিয়া নামটি ইতিহাসের পৃষ্ঠার বাইরে বিশেষ চোখে পড়ে না। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পরেই ম্যাসিডোনিয়ার গৌরব অস্তমিত হয়। একদা ভুবন বিখ্যাত সেই রাজ্যটি টুকরো টুকরো হয়ে গ্রিস, যুগোশ্লোভিয়া ও অন্য দু-একটি রাজ্যের মধ্যে ছড়িয়ে আছে। একবার যুগোশ্লোভিয়ায় গিয়ে আমি সেখানে ম্যাসিডোনিয়ান ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন দেখেছি। ফ্রাঙ্কফুর্টে আমার আশ্রয়দাতা পরিবারটি সব টুকরোগুলো মিলিয়ে স্বাধীন ম্যাসিডোনিয়া রাজ্য স্থাপনের এক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের আদর্শ পুরুষ আলেকজান্ডার। সেই পরিবারের একজন ব্যক্তি কোনও চাকরি-বাকরি করেন না, জার্মানিতে যত ম্যাসিডোনিয়ান অধিবাসী রয়েছে, তাদের সংঘবদ্ধ করার কাজে তিনি স্বেচ্ছায় নিযুক্ত। এঁদের সঙ্গে কথা বলে আমি খুবই বিস্মিত হয়েছিলাম। জন্মভূমি কিংবা পূর্বপুরুষদের জন্মভূমির ভাবমূর্তির প্রতি টান এত তীব্র হতে পারে? প্রায় দু-হাজার তিনশো বছর আগে মৃত এক দুঃসাহসী, হঠকারী, দিগ্বিজয়ী যুবাকে আদর্শ করে এঁরা আবার এই বিংশ শতাব্দীতে সেই ম্যাসিডোনিয়া রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখছেন, যা প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে। এই পরিবারটির কথা শুনে মনে হয়েছিল, জার্মানিতে বসেও এঁরা ম্যাসিডোনিয়ান অঞ্চল থেকে বিচ্ছেদের বেদনা প্রতিদিন অনুভব করেন।

আমি নিজে দেশ-ভাগের শিকার। নিজের জন্মস্থান এবং পূর্বপুরুষদের ভূমি থেকে উৎখাত হবার আঘাত আমি আজও ভুলিনি। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম, এই কষ্ট আমার বাবা-মা এবং আমার পরেই শেষ হয়ে যাবে। আমার ছেলে তার পিতৃপুরুষের জন্মস্থানের কথা চিন্তা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে না। সে যেখানে জন্মেছে এবং বাল্যকাল থেকে যে পরিবেশে বর্ধিত হয়েছে, সেটাই তার স্বদেশ।

আমার বাবা দেশ-ভাগের দগদগে ক্ষত বুকে নিয়েই মারা গেছেন। ১৯৪৭-এ ভারত দ্বিখণ্ড হবার পর আমরা পূর্ব বাংলায় আমাদের বসতবাড়ি ও সংলগ্ন জমি ত্যাগ করে পশ্চিম দিকে চলে আসি। তারপর আমার বাবা আরও ১৪ বছর বেঁচে ছিলেন কিন্তু কখনও ওদিকে আর ফিরে যাবার চেষ্টা করেননি। মৃত্যুর ঠিক দুদিন আগে গভীর আচ্ছন্ন অবস্থার মধ্যে তিনি কলকাতা এবং কাছাকাছি মানুষজনের কথা একেবারে ভুলে গেলেন। পূর্ববঙ্গে তাঁর জন্মস্থান এবং সেখানকার মানুষদের কথাই বলতে লাগলেন শুধু। শেষ নিশ্বাস ফেলার আগে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বাড়ি যাচ্ছি’।

আমার প্রথম যৌবনে আমি প্রায়ই পশ্চিম বাংলার সীমান্তে পদ্মানদীর পারে গিয়ে বসে থাকতাম। বিশাল চওড়া নদীর ওপারেই পূর্ব বাংলা। যেখানে আমাদের ছোট বাড়ি। তার পেছনের বাগান, আমার প্রিয় একটি আমগাছ এবং একটি পুকুর, যেখানে আমি সাঁতার শিখেছি এবং ছিপ দিয়ে অনেক মাছ ধরেছি, সেইসব ছবি স্পষ্ট আমার চোখে ভাসত। কিন্তু সেখানে ফিরে যাবার কোনও উপায় ছিল না।

বার্লিনে উন্টার ডেন লিনডেন নামে অতি সুরম্য রাজপথটি দেখলেই আমার মনে পড়ত আমাদের দেশের যশোর রোডের কথা। যশোর রোড অত সুন্দর না হলেও দুপাশে বিরাট বিরাট প্রাচীন গাছের জন্য ভারী মনোরম। উন্টার ডেন লিনডেন রাস্তাটার মাঝখানে উঠেছিল কঠিন প্রাচীর। আর আমাদের যশোর রোডের মাঝখানে খানিকটা নো ম্যানস ল্যান্ড ও দু-দেশের কাস্টমস। দুটো দেশ আলাদা হয়ে গেলেও দু-দিকেই রাস্তাটির নাম আজও একই। কিন্তু দুই জার্মানির সঙ্গে দুই বাংলার একটি বড় তফাত আছে। জার্মানি বিভক্ত হয়েছিল অন্য কয়েকটি যুদ্ধ বিজয়ী রাষ্ট্রের নির্দেশে, আর বাংলা তথা ভারত বিভাগের ব্যাপারে কলোনিয়াল ব্রিটিশদের প্ররোচনা থাকলেও অভিভক্ত ভারতের নেতারা এটা মেনে নিয়েছিলেন। জার্মানি বিভাগের মূলে ছিল অর্থনীতি, ধনতন্ত্রের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, আর ভারত বিভাগের মূলে ছিল ধর্ম। ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া যেমন অসম্ভব, ভারতীয় নেতাদেরও তেমনি ধর্মীয় বিভেদের ভিত্তিতে দুটি আলাদা রাষ্ট্রগঠনের ব্যাপারে পরিষ্কার, সুনির্দিষ্ট চিন্তা ছিল না। পাকিস্তানের প্রবল প্রবক্তারা ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য একটা পিতৃভূমি, একটা নতুন রাষ্ট্র দাবি করলেন কিন্তু সেই রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে বসবাসকারী অ-মুসলমান নাগরিকদের ভাগ্য কী ভাবে নির্দ্ধারিত হবে, সে সম্পর্কে কোনও নীতি ঠিক করা হল না। আর মূল ভারতভূখণ্ডের রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিনিধি জওহরলাল নেহরু ধর্মবিভেদের বাস্তবতাকেই পুরোপুরি অস্বীকার করলেন, স্বাধীন ভারতকে তিনি ঘোষণা করলেন ধর্মনিরপেক্ষ, সব ধর্মের মানুষেরই সেখানে সমান অধিকার। আদর্শ হিসেবে নেহরুর নীতি অনেক বেশি আধুনিক এবং মহৎ। এবং সেই মহৎ আদর্শের দাম দিতে কয়েক কোটি মানুষ তাদের বাড়ি-ঘর-সম্পত্তি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। কয়েক লক্ষ মানুষ দাঙ্গায় কিংবা অনাহারে কিংবা রোগ-ভোগে প্রাণ দিয়েছে। আমার বাবা পশ্চিম বাংলার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, আমরা সপরিবারে সেখানেই একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জানলাম, পূর্ব বাংলায় আমাদের নিজস্ব বাড়ি ঘর, বাগান, পুকুর অন্য একটি রাষ্ট্রের মধ্যে পড়ে গেছে। সেখানে ফিরে যেতে হলে আমাদের একটি নবগঠিত রাষ্ট্রের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থাকতে হবে। আমরা আর ফিরে যাইনি।

ভৌগিলিক দিক দিয়ে পাকিস্তান একটি অদ্ভুত রাষ্ট্র। যার পূর্ব ও পশ্চিম এই দুই দিকের মধ্যখানের ব্যবধান এক হাজার মাইলেরও বেশি। দু-দিকের মধ্যে রেল বা সড়ক পথে কোনও যোগাযোগ নেই। মানুষের ইতিহাসে এরকম কোনও রাষ্ট্র আগে দেখা যায়নি। পাকিস্তানের এই দু-দিকে চরিত্রও আলাদা। পশ্চিম পাকিস্তানিরা রাজনৈতিক এবং সাময়িকভাবে বেশি শক্তিশালী, আরব দেশগুলির কাছাকাছি অবস্থান বলে তারা ধর্মবিশ্বাসেও অতি কট্টর। আরবের মুসলমান দেশগুলিতে অ-মুসলমানদের নাগরিকত্ব প্রায় দেওয়াই হয় না বলতে গেলে, সুতরাং পশ্চিম পাকিস্তানেও হিন্দু বিতাড়নের জন্য শুরু হয়ে গেল দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও খুনোখুনি। সীমান্তের এপারে ভারতেরও দেখা গেল তার প্রতিক্রিয়া। পশ্চিম থেকে এক টেনে ভরতি হিন্দুদের মৃতদেহ এলে এদিক থেকেও পাঠানো হতে লাগল এক টেন ভরতি মুসলমানের লাশ। সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগল দু-দিকের উদ্বাস্তুদের স্রোত। দু-দিকেই বহু নৃশংসতা ও বহু সাংঘাতিক অমানবিক ঘটনার পরেও কিন্তু অচিরকালের মধ্যেই দু-দিকে সম্পূর্ণ নাগরিক বিনিময় ঘটে গেল। দ্বিধাবিভক্ত পাঞ্জাবের পাকিস্তান অংশে রইল না কোনও হিন্দু, ভারতীয় পাঞ্জাব অংশে রইল না কোনও মুসলমান প্রায়, অর্থাৎ যৎসামান্য।

পূর্ব বাংলায় ঠিক এরকম ঘটনা ঘটেনি। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালিরা নরম প্রকৃতির, শিল্প-মনস্ক, এবং হিংস্রতায় অনভ্যস্ত। মাত্র কয়েক পুরুষ আগে এখানকার মুসলমানরা ধর্মান্তরিত হয়েছে বলে আরব দেশগুলির সঙ্গে তাদের যোগসূত্র নামমাত্র। দুই বাংলার হিন্দু-মুসলমান বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি এবং গৌরবময় বাংলা ভাষার সমান অংশীদার। সুতরাং পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু-মুসলমান মিলে মিশে থাকা অসম্ভব কিছু ছিল না। কিন্তু পূর্ব বাংলার শাসক শ্রেণি পশ্চিম পাকিস্তানি, তারা বাংলার সংস্কৃতিকে মনে করে হিন্দুঘেঁষা এবং বাংলা ভাষার মধ্যেও খুঁজে পায় হিন্দুত্ব, সেইজন্য এই দুটিকেই অবজ্ঞা করে। দুই পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ব বাংলার জনগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই শাসকশ্রেণির স্বার্থে এখানে হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ ঘটনা এবং যথাসম্ভব হিন্দু বিতাড়ন প্রয়োজন ছিল।

পূর্ব পাকিস্তানে খুব বড় আকারের দীর্ঘস্থায়ী দাঙ্গা কিংবা ব্যাপক গণহত্যা হয়নি। কিন্তু এক শ্রেণির মুসলমান হঠাৎ বুঝতে পারল যে প্রতিবেশী হিন্দুদের ওপর চাপ দিলে কিংবা ভয় দেখালেই তারা ভারতে পালিয়ে যায়। তাদের বাড়ি ও জমি খালি পড়ে থাকে। ক্রমে সেগুলো দখল করে নেওয়া যায়। পুলিশ কিংবা প্রশাসন হস্তক্ষেপ করে না। প্রতিবেশীর বাগান কিংবা জমির প্রতি মানুষের লোভ প্রায় সর্বজনীন। এই লোভের বশেই সাধারণ, নিরীহ মুসলমানরাও তাদের সাধারণ নিরীহ প্রতিবেশীদের তাড়াতে তৎপর হয়ে উঠল। পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের মধ্যে একটা ভয় ঢুকে যায় প্রথম থেকেই, মুসলমানদের জন্য প্রতিষ্ঠিত রাজ্যে তারা পূর্ণ নাগরিক অধিকার আশা করেনি। দলে দলে হিন্দু যখন পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে আসতে লাগল, অনেক ক্ষেত্রেই কিন্তু তাদের শরীর বা সম্পত্তি ওপর প্রত্যক্ষ কোনও আঘাত আসেনি, কিন্তু যে-কোনওদিন আঘাত আসতে পারে, এই আশঙ্কাটাই তাদের ঘর ছাড়া করছে। দেশ বিভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান অংশ থেকে যে উদ্বাস্তুদের স্রোত শুরু হয়েছে আজও তা থামেনি।

ভারত থেকে বহু মুসলমান পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে বিভিন্ন কারণে। পাকিস্তানে সেই উদ্বাস্তু সমস্যা আজও মেটেনি। তাদের ট্যাজেডি কম নয়। ইসলামে সম ভ্রাতৃত্বের কথা থাকলেও হিন্দুদের মতনই তাদেরও জাতি ভেদ আছে।

পশুজগতের সঙ্গে মানুষের তফাত শুরু হয়েছে সেই থেকে, যেদিন মানুষ শস্য সংগ্রহ করতে শিখেছে। পশুকে প্রতিদিন খাদ্য খুঁজে নিতে হয়, মানুষকে তা হয় না বলে যাযাবর জীবন ছেড়ে গ্রাম, নগর এবং সভ্যতার পত্তন করেছে। কিন্তু যাযাবর প্রবৃত্তি মানুষের মন থেকে কখনও যায়নি। ঘর-বাড়ি বানিয়ে মানুষ নিরাপত্তা খুঁজেছে বটে, কিন্তু তার মধ্যেও কান পেতে শুনেছে সুদূরের আহ্বান। চেনা গণ্ডির বাইরে মানুষ পা বাড়িয়েছে বারবার। সমুদ্রতীরে দাঁড়ালে আজও আমাদের মনে হয়, এই বিশাল জলরাশির যেন পরপার নেই। কিন্তু বহু যুগ আগে আমাদের যে পূর্বপুরুষ প্রথম সমুদ্র পার হয়ে নতুন দেশের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিল, কত বড় সাহসী ছিল সে! দুর্লঙ্ঘ্য পর্বত, দিগন্তবিস্তৃত মরুভূমি কিংবা হিংস্র অরণ্যের মতন কোনও বাধাই মানুষ মানেনি। নিজের ঘর-বাড়ি ছেড়ে, দেশ ছেড়ে, দারুণ অনিশ্চয়তার ঝুঁকি নিয়েও মানুষ বসতি স্থাপন করেছে নতুন নতুন ভূমিতে। মানুষের সভ্যতার ইতিহাসের অনেকখানিই এই ভূমি জয়ের ইতিহাস। এই নেশাতেই মানুষ এখনও চাঁদ কিংবা গ্রহ-গ্রহান্তরে পাড়ি দিতে চাইছে।

কিন্তু নিজের ইচ্ছেতে কিংবা দুঃসাহসিক অভিযান স্পৃহায় যখন মানুষ কোনও অচেনা ভূমিকে বাসযোগ্য করে তোলে, তখন সেটা হয় মানুষের অদম্য প্রাণশক্তির গৌরবগাথা। আর যখন একজন মানুষ জোর করে ভয় দেখিয়ে, হিংসার আশ্রয় নিয়ে আর একদল মানুষকে ঘর-ছাড়া, দেশ-ছাড়া করে তখন সেটা হয় এক নিকৃষ্ট ট্যাজেডি। মানুষের সভ্যতায় এই দুরকমই চলছে।

বাংলা দু-ভাগ হবার পর পূর্ব দিক থেকে যে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু এসেছে, অবর্ণনীয় কষ্ট ও দুর্ভোগ তাদের সইতে হয়েছে প্রথম দিকে। অসংখ্য শিশু ও বৃদ্ধ মারা গেছে, মাঝ পথে বহু নারী ধর্ষিতা হয়েছে। ভারত সরকার এদের জন্য যে রিলিফ ক্যাম্প খুলেছিলেন, তা সংখ্যার তুলনায় যৎসামান্য। অধিকাংশ উদ্বাস্তু এদিকে এসে আশ্রয় নিয়েছে গাছতলায় কিংবা রেলওয়ে স্টেশনে। কিছুদিন পর মরিয়া হয়ে তারা যেখানেই খালি জমি বা বাড়ি দেখেছে, তা জোর করে দখল করে নিয়েছে। ভারত একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও এখানে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার ক্ষুণ্ণ হতে লাগল, পশ্চিম বাংলার যেসব মানুষের জমি কিংবা বাড়ি উদ্বাস্তুরা দখল করে নিল, তারা সরকারের কাছ থেকে কোনও সাহায্য পেল না। এই জন্য পশ্চিম বাংলার সাধারণ মানুষ প্রথম দিকে উদ্বাস্তুদের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন থাকলেও উদ্বাস্তুদের সংখ্যা যখন লক্ষ থেকে কোটিতে পৌঁছোল তখন তাদের প্রতি সকলেই বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল। দেশের সমস্ত সমস্যার জন্য তারা দায়ী করতে লাগল উদ্বাস্তুদের। চল্লিশের দশকে কলকাতা ছিল একটি সুন্দর পরিচ্ছন্ন, সুশৃঙ্খল শহর। কুড়ি বছরের মধ্যে তার জনসংখ্যা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়ে শহরটা হয়ে পড়ল নোংরা, কুৎসিত অস্বাস্থ্যকর। কলকাতার কাছাকাছি থেকেও এক টুকরো খালি জমি পড়ে রইল না। অন্যের জমি দখল করে যেখানে সেখানে অপরিকল্পিত কলোনি গড়ে তুলতে লাগল উদ্বাস্তুরা, সরকারও তাদের বাধা দিতে পারল না। দুর্বল চেহারা না খেতে পাওয়া উদ্বাস্তুদের বিপুল সংখ্যাই একটা প্রবল শক্তি। কয়েক মিলিয়ান দুর্বল মানুষের বিরুদ্ধে পুলিশও কোনও প্রতিরোধ করতে পারে না। বাংলা ভাগের জন্য কংগ্রেস দলকে দায়ী করে উদ্বাস্তুরা প্রথম থেকেই সরকার বিরোধী; সেই সুযোগ নিল বিরোধী পক্ষ অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টি। পশ্চিম বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যুত্থান ও শক্তিবৃদ্ধির মূলে আছে উদ্বাস্তুরা। ক্রমশ কমিউনিস্টরা পশ্চিম বাংলায় ক্ষমতা দখল করে ওদেরই সাহায্যে, যাদের বলা যেতে পারে ‘External Proletariat’।

দেশ বিভাগের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পরিবারটিও উদ্বাস্তু হয়ে গেল বটে, কিন্তু আমরা কোনও সরকারি সাহায্য নিইনি, জবর দখল কলোনিগুলোতেও আশ্রয় নিতে হয়নি। আমার বাবার একটা ইস্কুল মাস্টারির চাকরি ছিল, তখনকার দিনে তার মাইনে ছিল যৎসামান্য। আমাদের চার ভাইবোন ও মা ছাড়াও পূর্ববঙ্গ থেকে আগত কিছু কিছু আত্মীয়স্বজনকে সেই সময় আশ্রয় দিতে হয়েছিল, সবাই মিলে আমরা ভাড়া বাড়িতে থাকতাম, এবং কোনওক্রমে আত্মসম্মান বজায় রেখে বেঁচেছিলাম। আমি তখন ১৩ বছরের কিশোর, দারিদ্র্যের কষ্ট বিশেষ অনুভব করতাম না, কিন্তু বাড়ির বাইরে বেরুলে কিংবা স্কুলে গেলে টের পেতাম, অন্যরা আমাদের বহিরাগত বলে মনে করে। উদ্বাস্তুদের সংখ্যা যখন এক কোটির কাছাকাছি হয়ে গেল, সেই বিরাট সংখ্যার মানুষ সারা পশ্চিম বাংলায় বিশৃংঙ্খলা ঘটিয়েছিল, তখন আমার সহপাঠীদের কেউ কেউ আমার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলত, আমিও সেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের একজন। অবিভক্ত বাংলায় আমি ছিলাম যাদের সঙ্গে সমান সমান, বাংলা ভাগ হবার সঙ্গে সঙ্গে আমি হয়ে গেলাম তাদের চোখে অবাঞ্ছিত।

আমাদের কৈশোর হল খুব সংক্ষিপ্ত। আমাদের গুরুজনরা অনবরত বলতেন, যে-কোনও উপায়ে, যে-কোনও একটা জীবিকা জোগাড় করো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। এখানে বাঁচার একমাত্র উপায় খুব দ্রুত উদ্বাস্তু পরিচয়টা মুছে ফেলে মূল স্রোতের সঙ্গে মিশে যাওয়া। স্কুলের ছাত্র অবস্থাতেই আমি জীবিকা অর্জন শুরু করি কিন্তু উদ্বাস্তু পরিচয়টা কখনও মুছে ফেলতে পারিনি।

যখন আমি যৌবনে পৌঁছোলাম, তখন আমি সমস্তরকম ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্ত। ধর্মের নামে দেশ ভাগ, দাঙ্গা, মারামারি, কাটাকাটি ও অসংখ্য মানুষের অবর্ণনীয় দুর্দশা দেখে ধর্ম জিনিসটার ওপরেই আমার ঘেন্না ধরে গিয়েছিল। ঈশ্বরের নাম নিয়েই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষ খুন হয়েছে। আমাকে কেউ হিন্দু বলে সম্বোধন করলে আমার রাগ হত, কিন্তু হিন্দু পরিবারে যে আমার জন্ম তা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। প্রাচ্য দেশগুলিতে শুধু নাম শুনলেই চেনা যায় কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে বৌদ্ধ, কে খ্রিস্টান, এটা একটা বিশ্রী প্রথা। আমি মনে প্রাণে কোনও ধর্মেই বিশ্বাসী নই, তবু সমাজ আমাকে হিন্দু বলে চিহ্নিত করবে। মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করলে হয়তো আমি আমার জন্মস্থানে ফিরে যেতে পারতাম, কিন্তু যে ব্যক্তি কোনও ধর্মেই বিশ্বাস করে না, তার পক্ষে ধর্মান্তরিত হওয়াটাই হাস্যকর। দরিদ্র ভারতীয়-পাকিস্তানিদের একমাত্র মুক্তির পথ যে নাস্তিকতা, তা আমি বলার চেষ্টা করলেও কেউ গ্রাহ্য করেনি।

ষাটের দশকে আমরা কলকাতার কাছাকাছি দমদমে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। তখন আমাদের আর্থিক অবস্থা অনেকটা সচ্ছল হয়েছে, পোশাক-পরিচ্ছদ ভদ্রস্থ, আমাদের মুখের ভাষার সঙ্গে খাঁটি কলকাতার ভাষার কোনও তফাত নেই। আমাদের দেখলে উদ্বাস্তু বলে চেনা যায় না। কিন্তু আমাদের সেই বাড়ির খুব কাছেই ছিল কয়েকটি জবরদখল উদ্বাস্তু কলোনি, প্রতিদিন যাওয়া-আসার পথে সেগুলি দেখতাম। বাঁশ-খড়-টিন দিয়ে কোনওরকমে জোড়াতালি দেওয়া সার সার ঘর, এক-একটা ঘরে থাকে পাঁচ-সাত জন, তাদের ছেঁড়া ময়লা পোশাক, প্রতিদিনের খাদ্যের কোনও ঠিক নেই, বাচ্চারা স্কুলে যায় না, ধুলোর মধ্যে খেলা করে, পুরুষরা হন্যে হয়ে ঘোরে যে-কোনও জীবিকার সন্ধানে। যুবতী মেয়েদের দিক বাইরের লোকদের লোভী দৃষ্টি। আমার মনে হত—আমিও ওদেরই একজন। ভাগ্যের সামান্য এদিক-ওদিক হবার জন্য আমি এই বস্তির নারকীয় পরিবেশে না থেকে দোতলা পাকা বাড়িতে জায়গা পেয়েছি, তবু আমি ওদের সমগোত্রীয় তো বটেই, কিন্তু ওদের রাগ, তিক্ততা, ঘৃণার অংশ আমি নিতে পারি না। ওদের কোনও সাহায্য করতে গেলেও ওরা আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়।

ওই কলোনিগুলির একটি বাড়ি ছিল আমারই এক কলেজের বন্ধু পরিবারের। সেটা এককালে ছিল একটা চমৎকার বাগানবাড়ি, সেখানে ছিল একটা মস্ত বড় দিঘি, অনেক দুর্লভ ফুল ও ফলের গাছ, একটি অর্কিড হাউজ, মূল বাড়িটির মধ্যে ছিল একটা প্রশস্ত নাচঘর, ঝাড়লণ্ঠন দিয়ে সাজানো। উদ্বাস্তুরা বাড়িটা জোর করে দখল করে নিয়ে একেবারে তছনছ করে ফেলেছে, ভেঙে ফেলেছে অর্কিড হাউজ, মূল্যবান গাছগুলি কেটে ছোট ছোট ঘর বানিয়েছে, নাচঘরটায় তিনটে পরিবার ঠাসাঠাসি করে থাকে। আমার বন্ধুটি অমন সুন্দর বাড়ি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার জন্য উদ্বাস্তুদের নামে আদ্যশ্রাদ্ধ করলে তার প্রতি আমার একবার সহানুভূতি হত, আবার মনে পড়ত ওই একটা বাগানবাড়িতে ৮০টি পরিবার আশ্রয় পেয়েছে, তাদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবার অধিকার কারুর নেই, সুতরাং আমি ওদেরই সমর্থক।

আমার পক্ষে ওদের সমর্থন করার একমাত্র হাতিয়ার আমার সাহিত্য। প্রথম জীবনে আমি শুধু কবিতাই লিখতাম। কিন্তু কবিতা খানিকটা abstract হতে বাধ্য, তা বিশেষ কোনও বক্তব্যের বাহন হতে পারে না। আমার প্রথম উপন্যাস আত্মপ্রকাশের পটভূমিকা দেশভাগ ও দেশত্যাগের পরবর্তী শিকড়হীনতা। কিছুদিন পরে আমার বন্ধুর বাগানবাড়িতে জবরদখল উদ্বাস্তু কলোনিটি নিয়ে লিখি আর একটি উপন্যাস ‘অর্জুন’। কিন্তু এই চিত্রগুলি খণ্ডিত। পরবর্তী কালে ‘পূর্ব পশ্চিম’ উপন্যাসে আমি সমগ্র বিষয়টিকে দেখার চেষ্টা করি ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে।

বার্লিনের দেওয়াল ভেঙে গেছে, দুই জার্মানি আবার এক হয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের পুনর্মিলনের সুদূরতম সম্ভাবনা এখনও দেখা যাচ্ছে না। পাকিস্তানের একটা অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ হয়েছে। তবু বাঙালি জাতির মিলনের কোনও চিহ্ন নেই, বরং দূরত্ব আরও বাড়ছে। বিংশ শতাব্দী শেষ হয়ে এল, এখনও ধর্মীয় উন্মত্ততা মনুষ্যজাতির প্রধান অসুখ।

ফ্রাঙ্কফুর্টে দেখা সেই ম্যাসিডোনিয়ানদের সেই আন্দোলন আমার অলীক ও অবান্তর মনে হয়েছিল, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির পতনের পর যুগোশ্লোভিয়া ভেঙে গিয়ে ম্যাসিডোনিয়া নামে একটি রাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু দুই বাংলার মিলনের সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতে আছে বলে মনে হয় না। কেউ সে কথা উচ্চারণ করে না। তবে বাংলাদেশে যখন আমাকে বিদেশি অতিথি বলে পরিচয় দেওয়া হয়, তখন কেমন যেন লাগে। না, ঠিক দুঃখ নয়, ইতিহাসের এই পরিহাসের সঙ্গে গলা মিলিয়ে হাসতে ইচ্ছে করে।

ভাষার সূক্ষ্মতা ও সংস্কার

কোনও সাহেব যখন বাংলা শিখতে শুরু করেন তখন গোড়ার দিকে, তাঁকে কতকগুলি সাংঘাতিক অসুবিধের সম্মুখীন হতে হয়। তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে এই ভাষার অনেক কিছুই মেলে না। হ্রস্বই, দীর্ঘঈ, হ্রস্বউ দীর্ঘউ, ণ ন, শ ষ স, রেফ, চন্দ্রবিন্দু, হসন্ত ইত্যাদি দেখে তিনি দিশাহারা হয়ে যেতে পারেন। তাঁর বাঙালি শিক্ষক লজ্জিত বিব্রত মুখে বলেন, সত্যিই আমাদের ভাষায় অনেক গণ্ডগোল।

শুধু সাহেব কেন, আমাদের নিজেদের শিশুরাই যখন প্রথম লিখিত ভাষা শিক্ষা করতে শুরু করে, আজও তাদের হিমসিম খেতে হয় কয়েক বছর। বানান ভুলের ভীতি শৈশবের অনেকখানি আচ্ছন্ন করে রাখে। তখন অনেকেরই মনে হয়েছে, তিনটে স যদি না থাকত কিংবা দুটো ন!

এখন কথা হচ্ছে, শিশু বা বিদেশিদের শিক্ষার সুবিধার জন্য কোনও ভাষার আমূল সংস্কারের প্রয়োজন আছে কি না। এরকম প্রস্তাব বারবার শোনা গেছে। প্রস্তাবটি অতিশয় অদ্ভুত। শিশু বা বিদেশিদের সুবিধার্থে ভাষার অতি সরলীকরণ সে ভাষার সমূহ ক্ষতি করতে পারে। কারণ, ভাষা তো শুধু শিক্ষার্থীদের জন্যই নয়, পরিণতবুদ্ধি মানুষের জন্যও, বা জন্যই, প্রধানত। অশিক্ষিত ব্যক্তিরা, শিশুরা বা বিদেশিরা ভাঙা ভাঙা ভাষায়, সীমিত সংখ্যক শব্দ নিয়ে, ভুল ব্যাকরণেও মোটামুটি কাজ চালিয়ে দেয়। কিন্তু ভাষার বিশুদ্ধতা, সৌন্দর্য ও শিল্প নির্মাণ করেন পরিণত বুদ্ধির এবং পরিশীলিত মানুষেরা। তাঁদের জন্যই ভাষা বাঁচে এবং শ্রীসম্পন্ন হয়। কঠিন পরিশ্রম ও অভিনিবেশ ছাড়া কোনও কোনও ভাষাই সম্পূর্ণ রপ্ত করতে পারে না। যে কারণে, শিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রই ভাষা-অভিজ্ঞ নন। চিকিৎসা শাস্ত্রজ্ঞ, ভৌত বিজ্ঞানী বা যন্ত্র-কলাকুশলীরা অনেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে কীর্তিমান হলেও ভাষাজ্ঞান দীন হতে পারেন। এঁরা হয়তো ভাষা অধ্যয়নে সময় পাননি। অথচ এঁদের সকলের সুবিধের জন্য একটি উন্নত ভাষাকে লঘু ভাষায় পরিণত করা ফিলিস্টিনিজমেরই নামান্তর।

কিছু কিছু ব্যবহারিক সুবিধের জন্য বানান সংস্কারের দাবি ওঠে। কিন্তু ছাপার হরফ বা টাইপ রাইটারের কথা চিন্তা করে আমাদের বানানের নিয়ম সম্পূর্ণ পরিবর্তন করতে হবে, এটা একটা অদ্ভুত কথা। একটি জীবন্ত ভাষায় লিখিত রূপের প্রয়োজনেই ছাপার হরফ ও টাইপ রাইটারের ব্যবহার। এগুলিকেই সে ভাষার উপযোগী হয়ে উঠতে হবে। মানুষের জন্য পোশাক না পোশাকের জন্য মানুষ? বানান রীতির গুরুতর পরিবর্তন ভাষার মূল কাঠামোকে আঘাত করে। একটা ভাষা বা বানান পদ্ধতি গড়ে ওঠে বহুকালের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। এর গতি বড় বিচিত্র। কোনও বিশেষ একজন বা কয়েকজন লোক মিলে হঠাৎ ভাষার ওপর দর্জিগিরি করা একটা অস্বাভাবিক ঘটনা। কোনও ভাষাই এই স্বৈরতন্ত্র সহ্য করে না। ভাষার শারীরিক পরিবর্তন হয় খুব আস্তে আস্তে, পরিবর্তন হয়েই চলেছে, কিন্তু তক্ষুনি তক্ষুনি সেটা অনুভব করা যায় না। যেমন পৃথিবী ঘুরছে, আমরা বুঝতে পারি না। খুব সন্তর্পণে মাঝে মাঝে দুটো একটা পরিবর্তন চেষ্টা করে করা হয় বটে, তাতেও লক্ষ রাখতে হয়, ভাষার শরীরে যেন আঘাত না লাগে।

সংস্কৃত এবং বাংলা এখন দুটি আলাদা ভাষা, এ কথা ঠিক। আলাদা কিন্তু সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন নয়। ত্রিপুরা এবং পশ্চিম বাংলা যেমন দুটি আলাদা রাজ্য। ভারত ও বাংলাদেশ যেমন দুটি আলাদা দেশ। রাজনৈতিক ভাবে এইসব রাজ্য বা দেশের মধ্যে কৃত্রিম উপায়ে সম্পর্ক ছিন্ন করা যায়, কিন্তু সংস্কৃতি বা ভাষার ক্ষেত্রে সেরকম তড়িঘড়ি কোনও কাজ হয় কি? স্বৈরাচারীরাই শুধু সেরকম চেষ্টা করে এবং ভুল করে।

সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক এখন জননী আর দুহিতার নয়, কিন্তু কোনও একটা রক্তের সম্পর্ক রয়েই গেছে। হঠাৎ একদিন সিদ্ধান্ত নিয়ে এই সম্পর্ক একেবারে ছিন্ন করা, আমার মতে, বাতুলতা। সংস্কৃত উচ্চারণ থেকে বাংলা উচ্চারণের অনেক দূরে সরে আসা মানে এই নয় যে মাঝখানে একটা প্রাচীর তুলে দিতে হবে। অন্তত এখনও সে সময় নিশ্চয় আসেনি। আরও দু-চারশো বছর পর অপরিচয়ের দূরত্বে যদি কেউ কারুকে আর না চিনতে পারে, তখন স্বাভাবিক ভাবেই বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হবে।

সংস্কৃত এবং বাংলা উচ্চারণে অনেক তফাত হয়েছে, এবং বাক্য গঠন রীতির অনেক বদল হলেও বাংলা ব্যাকরণ এখনও সংস্কৃতের অনুসারী। শুদ্ধ বাংলা ব্যাকরণ বলে কিছু আছে নাকি? সেরকম ব্যাকরণ রচনার কথা আজও কেউ চিন্তাও করেনি। বাংলা শব্দের বানানকে আমরা সম্পূর্ণ সংস্কৃত প্রভাব থেকে মুক্ত করে তখনও সংস্কৃত অনুসারী ব্যাকরণ পড়ে যাব? এ যে এক ভয়াবহ অবস্থা!

শব্দ সম্পদ বৃদ্ধির জন্য আমরা এখন যে-কোনও ভাষা থেকে শব্দ আহরণ করতে পারি। আরবি, ফার্সি, ইংরেজি, ফরাসি, পর্তুগিজ প্রভৃতি ভাষা থেকে হাজার হাজরা শব্দ এসেছে, এখনও আসছে। মানুষ কখনও গ্রহান্তরে বসতি স্থাপন করলে এবং সেখানে মানুষের মতন কোনও প্রাণী থাকলে তাদের কিছু কিছু শব্দও আমরা বাংলায় নিতে পারব। কিন্তু বাহির বিশ্ব বা বহির্বিশ্ব থেকে শব্দ আহরণ করাই একটা ভাষার পক্ষে যথেষ্ট নয়। সঙ্গে সঙ্গে অনেক নতুন শব্দ তৈরি করতেও হয়। লেখকরা অনেকেই কিছু কিছু নতুন শব্দ উপহার দিয়ে যান তাঁদের ভাষাকে। দেশজ এবং আঞ্চলিক শব্দ থেকেও মাঝে মাঝে এক-একটি নতুন শব্দ আবিষ্কারের আনন্দ পাই। এই আবিষ্কারের বিস্ময় ও আনন্দ যে কতখানি, তা শুধু ভাষাজীবীরাই বুঝবেন।

পরিভাষা খোঁজবার জন্য আমরা এখনও সংস্কৃতের দ্বারস্থ হই। এর অভিজ্ঞতা সবসময় সুখকর হয় না। অনেক সময় অকারণ খটোমটো শব্দ এনে ঝঞ্ঝাট বাড়ানো হয়। আবার এ কথাও ঠিক, এরই মধ্যে থেকে কয়েকটি শব্দ আমাদের মনোমতন হয়ে যায়, এবং থেকে যায়। এবং সরাসরি যাকে আনা হবে, তার সঠিক বানানও রাখতে হবে। Isobar-এর প্রতিশব্দ সমপ্রেষ রেখা। এটাকে শমপ্রেশ রেখা লিখলে কারুর মানে বোঝার সাধ্য থাকবে?

মুখের উচ্চারণ অনুযায়ী শব্দের চেহারা আস্তে আস্তে বদলায়। সেইভাবেই তদ্ভব শব্দগুলি এসেছে। কিন্তু কোনও একদিন মিটিং করে সমস্ত শব্দের বানান একেবারে মুখের উচ্চারণ অনুযায়ী লেখার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে হবে, এটা একটা অবাস্তব কথা।

কেনই বা সব শব্দ মুখের উচ্চারণ অনুযায়ী হবে? শিশু এবং অনুদ্যমীদের সুবিধের জন্য? ভাষার নানানরকম সূক্ষ্মতা এবং গোপন সৌন্দর্য সব ছেটে ফেলে তাকে করে ফেলতে হবে অতি সরল এবং নিরেট?

উচ্চারণ বলতেই বা কী বোঝায়? কার উচ্চারণ? কোন সময়ের উচ্চারণ? বাংলার সব জেলার মানুষের উচ্চারণ যে এক নয়, সে সম্পর্কে কিছু বলাই বাহুল্য। এখানে নিশ্চয়ই স্ট্যান্ডার্ড বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে কৃষ্ণনগর-শান্তিপুর এবং হুগলির অববাহিকার ভাষা, অধুনা যা কলকাতার শিক্ষিত সমাজের ভাষা বলে স্বীকৃত। ডক্তর শহীদুল্লাও বাংলাদেশে লিখিত বাংলা ভাষা বা চলিত বাংলা ভাষার স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে প্রমথ চৌধুরী প্রবর্তিত বাংলাকেই স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সেই জন্যই বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার ছাপার অক্ষরে বাংলা ভাষা একইরকম। কিন্তু এদিকে বাঁকুড়া ও ওদিকে চট্টগ্রামে উচ্চারণের তফাত বিস্তর। এই কলকাতার ভাষারই কি কোনও নির্দিষ্ট উচ্চারণের স্ট্যান্ডার্ড আছে? উনিশশো সাতচল্লিশের পর রাশি রাশি বাঙালের প্রাদুর্ভাব হল এই শহরে। প্রথমে ছিল ঢেউ, তারপর শুরু হল বন্যা। বালিগঞ্জ, টালিগঞ্জ, যাদবপুর, যোধপুর প্রভৃতি কলকাতার নতুন বসতিগুলো ভরে গেল বাঙালে। বাংলা উচ্চারণের ক্ষেত্রে শুরু হয়ে গেল এক তাণ্ডব! এখন কলকাতাবাসীদের তুলনায় বহিরাগতদের সংখ্যা নিশ্চিত অনেকগুণ বেশি। আগেকার কলকাতার সুমধুর অনেক শব্দ, যেমন, নেবু, নংকা, নুচি ইত্যাদি এখন আর শোনাই যায় না প্রায়। পরিশীলিত উচ্চারণে এইচি, খেইচি, ডাঁড়িয়ে ইত্যাদি চাপা পড়ে গেল অন্যরকম চ্যাঁচামেচিতে। বললুম আর বললাম, দেখেছিলুম আর দেখেছিলাম ইত্যাদিতে তৈরি হল জগাখিচুড়ি। ওমিয়োবাবুরা রাতারাতি হয়ে গেলেন অমিঅবাবু!

এখনও আমরা নিশ্চিন্ত নই যে ছাত বলব, না ছাদ! কাক না কাগ? ইট না ইঁট? একই শব্দের দুরকম উচ্চারণ অভিধানিক স্বীকৃতি পেতে পারে না বা পাওয়া উচিত নয়। বিশেষত বাংলায় এরকম শব্দের তালিকা, সুদীর্ঘ ইংরেজি ফরাসী অভিধানগুলিতে প্রত্যেকটি শব্দে পাশে উচ্চারণ নির্দেশ দেওয়া থাকে, বাংলা ভাষাকে কি সেই স্তরে আনা যাবে? যদি একটিমাত্র উচ্চারণকেই নির্দিষ্ট করা যায় তা হলে কোনটা নেব? যদি ছাত, কাক বা ইট-এর স্বপক্ষে ভোটো দেওয়া যায়, তাহলে সেটা হবে খাঁটি কলকাতাবাসীদের ওপর বাঙালদের আধিপত্যের উদাহরণ। আমি নিজে বাঙাল হয়ে এই নতুন ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তির সমর্থন করতে পারি না। অথবা অনুকরণ করতে হবে সেই সংস্কৃত মূল শব্দের। সেটাও তো এক ধরনের পিছু হাঁটা।

উচ্চারণ ঘন ঘন বদলায়। সুতরাং খাঁটি মুখের উচ্চারণ অনুযায়ী বানান সংস্কার করতে গেলে কুড়ি-তিরিশ বছর অন্তত অন্তর অভিধানগুলি পুরো পালটে ফেলতে হবে এবং বঙ্কিম-রবীন্দ্র রচনাবলী ছাপতে হবে আমূল বদলে।

উচ্চারণের বৈচিত্র্য অনেক সময় ভাষার মধ্যে মজা আনে। গল্প শোনা যায়, ছাপার অক্ষরে লেখা আছে বিড়াল, তবু বরিশাল জেলার ছাত্র সেটাকে পড়ল নেকুর। প্রায় এর কাছাকাছি উদাহরণ অন্য ভাষায় আছে অনেক। লেখা আছে ককবার্ণ কিন্তু উচ্চারণ হয়ে গেল কোবর্ণ, কিংবা স্পষ্ট লেখা থাকে হোম তবু স্যার অ্যালেকের পদবি হিউম। আর ফরাসি শব্দের বানান দেখে ফরাসি উচ্চারণ শিখতে যায় যদি কেউ তাহলে প্রথম বেশ কদিন সে নাকানি চোবানি খেয়ে মরবে।

হঠাৎ কিছু বৈপ্লবিক পরিবর্তন না করে, সামান্য সামান্য সংস্কারের প্রয়োজনের কথা চিন্তা করলে বরং বাংলা ভাষার বেশি উপকার হবে। ফরাসি আকাদেমির ধাঁচে একটি প্রতিষ্ঠান থাকার প্রয়োজনীয়তা আমরা অনেকেই অনুভব করি। কোনও নতুন শব্দ ফরাসিতে ব্যবহৃত হতে শুরু করলে এই আকাদেমি তার সঠিক বানানটি ঠিক করে দেন। আমাদের শাড়ি শব্দটি ফরাসি কাগজে দেখেছিলাম। এই প্রতিষ্ঠানটিকে সর্বজনমান্য হতে হবে। এই দলাদলি ও স্বজনপোষণের দেশে সেরকম কোনও প্রতিষ্ঠান গড়া সম্ভব কি না আমি জানি না। হলে ভালো হত! বিশেষত, হলে, হ’লে, হোলে এই ধরনের বানান বিভ্রাটের ক্ষেত্রে একটা সমতা আনতে বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এরকম কাজ যত শীঘ্র হয় ততই মঙ্গল।

শ, ষ, স-এর বদলে একটা শ, য-জ এর বদলে শুধু জ, ণ ন এর মধ্যে শুধু ন আর হ্রস্রি দীর্ঘী জ্ঞান লোপ পাইয়ে দেবার কথাও অনেকেই আগে আগে বলেছেন। এগুলির সত্যি কি। কোনও তফাত নেই? কোনও বালকের কাছে না থাকতে পারে, শিক্ষাহীন গ্রাম্য লোকের কাছে না থাকতে পারে, কিন্তু ভাষাকে যারা ভালোবাসেন, ভাষার প্রতি যাঁদের মনোযোগ রয়েছে, তাঁদের কাছেও নেই? এটা কি ঠিক কথা হল?

প্রাণ আর গান এই দুটি শব্দের ণ ও ন এর উচ্চারণ কি এক? বিষাণ আর নিশান এর শেষ দুটি অক্ষরের উচ্চারণ দুটি শব্দেই একরকম হতে পারে? তফাতটা অত্যন্ত সূক্ষ্ম বটে, কিন্তু তফাত আছেই। এই সূক্ষ্মতা মুছে ফেলে বাংলাভাষাকে একটা মোটা দাগের ভাষা করে তোলার জন্য আমাদের এত ব্যস্ততা কীসের?

দিন আর দীন, এর উচ্চারণ এখনও পর্যন্ত এক নয়, কিছুতেই নয়, কোনও সুদূর ভবিষ্যতে হবে হয়তো। দীনবৎসল, কোনও রাজা সম্পর্কে এই বিশেষণটি প্রয়োগের পর প্রশ্ন উঠেছিল যে, তিনি গরিবদের রক্ষণাবেক্ষণ করেন, না তাদের বেছে বেছে রোগা গরু দান করেন। দিনবৎসল, এই বানানে এরকম কোনও মজা পাওয়া যাবে?

যুক্তাক্ষর ভেঙে সর্বক্ষেত্রে হসন্ত ব্যবহারের প্রস্তাব দেখে শনিবারের চিঠির সেই পুরোনো রসিকতাটা মনে পড়ল। ছাপার যন্ত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যে হসন্ত ভেঙে উড়ে বেরিয়ে যায়, তা আমরা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানি। সেই সুবাদে শনিবারের চিঠিতে লেখা হয়েছিল, সটেশন আর সটিমার। এ কী সটাইল রে বাবা।

(দেশ-৮/৪/১৯৭৮)

আমাদের হ্রস্সি দীর্ঘি জ্ঞান

সিউড়ি শহরে একটি ছবির প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছিলাম কিছুদিন আগে, নানা বয়সের স্থানীয় শিল্পীদের চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও হাতের কাজের সমাবেশ। ঢোকার মুখেই দেখি, বেশ বড় অক্ষরে শিল্পী বানান লেখা আছে শিল্পি। উদ্যোক্তাদের ধমক দিতে যাচ্ছিলাম ভুল বানান লেখার জন্য, সামলে নিলাম শেষ মুহূর্তে। আমি ছবি দেখতে এসেছি, আমার অত জ্যাঠামশাইগিরি করার দরকার কী?

তবু, বাংলা ভাষা ও বাংলা অক্ষর নিয়ে তো জড়িয়ে মড়িয়ে আছি অনেকগুলি বছর। কোথাও ভাষা-ভ্রান্তি দেখলে মনটা খচখচ করে। ঘুরতে ঘুরতে এক সময় আমার হঠাৎ মনে হল, বর্তমান নতুন রীতিতে শিল্পি বানান হয়তো ভুল নাও হতে পারে। এখন যে বানান সংস্কার চলছে, তাতে হ্রস্ব-ই-রই তো জয়যাত্রা, দীর্ঘ-ঈ বেচারির খুবই দুরবস্থা। যেমন রানী হয়েছেন রানি, কাহিনী এখন কাহিনি ইত্যাদি। সুতরাং শিল্পী না শিল্পি, কোনটা সঠিক তা দেখতে হবে তো!

একালের প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ্গণ প্রায় সকলেই একমত হয়ে বানান সংস্কারের কয়েকটি নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন, বহিরাগত বা বিদেশি শব্দের সবই হ্রস্ব-ই হবে, দীর্ঘ-ঈ অপ্রয়োজনীয়, বাংলা উচ্চারণেও দীর্ঘ-ঈর প্রচলন বিশেষ নেই। যেসব শব্দ সংস্কৃত থেকে সরাসরি এসেছে অর্থাৎ তৎসম, সেগুলি থাকবে অপরিবর্তিত। সেগুলিতেও দীর্ঘ-ঈর প্রয়োজনীয়তা থাকুক বা না থাকুক, সংস্কৃতের প্রতি সম্মান জানাতেই বোধহয় সেগুলির বদল হবে না। এ নির্দেশ শিরোধার্য। আর যেসব সংস্কৃত শব্দ কিছুটা রূপান্তরিত হয়েছে, অর্থাৎ তদ্ভব, সেগুলিতে আর দীর্ঘ-ঈ কিংবা দীর্ঘ-উ-র প্রয়োজন নেই। সেই যুক্তিতেই সংস্কৃত রাজ্ঞী থেকে তদ্ভবে হয়েছে আগেকার আমলের রানী। এখনকার বিচারে রানি। সংস্কৃত ব্যাকরণ মতে, স্ত্রীবাচক শব্দের শেষে দীর্ঘঈ-কার কিংবা আ-কার যোগ হয়, কিন্তু বাংলায় তা মানবার দরকার নেই। কারণ, সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলার কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রবীন্দ্রনাথ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বলেছেন বাংলা একটি পৃথক ভাষা, তার ব্যাকরণও আজও লিখিত হয়নি বটে, কিন্তু নতুন ভাবে বানান সংস্কার শুরু হয়েছে। এই নতুন বানান-বিধিতেই রচিত হবে পাঠ্য বই।

একটা সংশয় থেকেই যায়। কোন শব্দটি তৎসম আর কোন শব্দটি তদ্ভব, তা বোঝা যাবে কী করে? আমাদের বয়েসি পাঠকরা ছাত্রাবস্থায় বাধ্যতামূলকভাবে কিছু কিছু সংস্কৃত শিখেছি, এখন তো আর সে বালাই নেই। এখনকার ছেলেমেয়েরা সংস্কৃতর ধার ধারে না। তারা একটি নতুন শব্দ পেলে সেটি খাঁটি সংস্কৃত না বাংলা না বিদেশি তা বুঝবে কী করে? এর উত্তর হচ্ছে, তাদের অভিধান মুখস্থ করতে হবে। যেমন ইংরেজিতে সব বানানই মুখস্থ করতে হয়। বাংলায় অবশ্য সেরকম নতুন মানদণ্ডের অভিধান এখনও সংকলিত হয়নি, প্রচলিত পূর্ণাঙ্গ অভিধানগুলিতে পুরোনো বানানই চলছে। এখন কয়েকবছর ছাত্রছাত্রীদের কপালে দুঃখ আছে।

অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী বলেই মাঝে মাঝে আমাদের খুব মুশকিলে পড়তে হয়। তৎসম শব্দ কি সবসময় চিনতে পারি? জানি কি তার রূপভেদ?

বাল্যকাল থেকেই শিল্পী বানান দেখে আসছি, সব অভিধানেই আছে, তবু কেন সংশয়? হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ দেখার পর মনে হল, শিল্পি বানানও তো চলতেই পারে। শিল্পিন থেকে শিল্পী। কিন্তু শিল্পিজন, শিল্পিশালা, শিল্পিসংঘ, এর কোথাও দীর্ঘ-ঈ নেই, তাহলে কি দুরকম বানানই চলবে? তা হলে আর সরলীকরণ হল কোথায়? একই শব্দের দুরকম বানান রাখা যে-কোনও ভাষার পক্ষেই অতি দুর্বলতা। তা হলে কি শিল্পীকে দীর্ঘ-ঈ-তে রাখতে গেলে, সংস্কৃত নিয়ম অগ্রাহ্য করে অন্যগুলিও শিল্পীজন, শিল্পীশালা, শিল্পীসংঘ করা উচিত নয়? নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, পবিত্র সরকার, জ্যোতিভূষণ চাকী প্রমুখ কী বলেন?

একই প্রশ্ন অনেকদিন থেকে উঠেছে মন্ত্রী বিষয়ে, অভিধানে মন্ত্রি এবং মন্ত্রী দুই-ই আছে, দুটিই সিদ্ধ। কিন্তু বাংলায় অনেককাল ধরে শুধু মন্ত্রীই চলছে, বোধহয় দীর্ঘ-ঈ দিলে গুরুত্ব বাড়ে। কিন্তু মন্ত্রিবর, মন্ত্রিমশাই, মন্ত্রিসভা, মন্ত্রিগণ ইত্যাদি বেশির ভাগ শব্দেই হ্রস্ব-ই। দুটোই থাকবে? একমাত্র মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষেত্রে দীর্ঘ-ঈ রেখে বাকি সব মন্ত্রিদের দৈর্ঘ্য কমিয়ে দিলে কেমন হয়? সুধী ও কি সুধি হলে ওজন কমে যায়?

একই শব্দের দুরকম বানানের আরও কয়েকটি উদাহরণ মনে পড়ে। মহাদেবের মাথায় চাঁদও থাকে, সাপও থাকে। তাই তাঁর অন্য দুটি নাম শশিভূষণ ও ফণিভূষণ। কিন্তু শুধু চাঁদ হলে শশী, আর শুধু সাপ হলে ফণী। এ তো মহা ঝামেলা। সংস্কৃতের এই সূক্ষ্ম নিয়ম আমরা মানতে যাব কেন? সংস্কৃতের কাছে আমাদের এমনকী দায়বদ্ধতা আছে? একই অর্থবিশিষ্ট কোনও শব্দেরই দুরকম বানান থাকবে না, এরকম নীতি যদি আমরা গ্রহণ করি, তাহলে সাপ ও চাঁদের পক্ষে এখন ফণি এবং শশি হওয়াই যুক্তিযুক্ত। মেঘদূতের পূর্বমেঘে আছে নবশশিভৃৎ।

তৎসম বলতে ঠিক কী বোঝায়, তার বিশদ ব্যাখ্যা প্রয়োজন। কোন সংস্কৃত-সম? সংস্কৃত ভাষারও তো বিভিন্ন স্তর আছে। একই তৎসম শব্দেরও আছে বানানভেদ। তা ছাড়া, তৎসম ভেঙে প্রাকৃত, অপভ্রংশ, অবহটঠ, সৌরসেনি ইত্যাদি সৃষ্টি হয়, সেই প্রক্রিয়া কি এখন থেমে গেছে? যেসব তৎসম শব্দকে অবিকৃত রাখার কথা, এ যুগেও কি আমরা সেইসব কুলীন সংস্কৃত শব্দগুলিকে কিছু কিছু ভাঙতে পারি না প্রয়োজনে?

একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কিছু কিছু শব্দের তৎসম এবং প্রাকৃত রূপ দুটিই প্রচলিত আছে। যেমন মাছ এবং মৎস্য। আমরা সবাই মাছ বলি বটে। কিন্তু মৎস্যও দিব্যি চালু আছে। মাছ-মন্ত্রি কি লেখা হয় কখনও? মাছ ধরা যাঁদের জীবিকা, তাঁদের সমিতির নাম মৎস্যজীবী সমিতি। ঠিক আছে, ‘মৎস্য’ যদি রাখতেই হয়, তার য-ফলাটি কি এখন ত্যাগ করা যায় না? বৎস শব্দে য-ফলা নেই। অথচ ধ্বনির দিক থেকে বৎস এবং মৎস্যর নিখুঁত মিল। মৎস্যের য-ফলাটি নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় নয় কি?

মজার ব্যাপার এই যে, যে মাছ ডিম পাড়ে, সেই স্ত্রী জাতীয় মাছ কিন্তু মৎসী। অর্থাৎ য-ফলা লোপ। কেন? কোনও উত্তর নেই। সংস্কৃতে পুরুষবাচক এবং স্ত্রীবাচক শব্দে এরকম অনেক ভেদাভেদ আছে। বলাই বাহুল্য, আমাদের দেবভাষাটি সর্বত্রই পুরুষতান্ত্রিকতার চিহ্নে ভরা। (আমার মনে হয়, বাংলায় পুংলিঙ্গ এবং স্ত্রী লিঙ্গের বদলে পুরুষবাচক এবং স্ত্রীবাচক শব্দ ব্যবহার করা উচিত। কারণ, আগের শব্দ দুটি দৃষ্টিকটু এবং শ্রবণকটু। সব শব্দই এক একটি ছবি আনে আমাদের মানসে, যেমন আকাশ, যেমন নদী যেমন হরিণ ইত্যাদি। সেই অনুযায়ী পুংলিঙ্গ এবং স্ত্রী লিঙ্গের ছবি যখন-তখন মনে আনা শোভন বা রুচিসঙ্গত নয়।)

সংস্কৃত ভাষায় কতখানি নির্লজ্জভাবে পুরুষ প্রাধান্য, তার একটি প্রকট উদাহরণ ‘স্বর্ণগর্ভা’। এর সঠিক অর্থ কী আমরা সবাই জানি? ইন্দিরা গাঁধী কিংবা নবনীতা দেবসেন-এর মা কিন্তু স্বর্ণগর্ভা নন, এঁরা যতই কৃতী হোন না কেন। কারণ, ক এদের কোনও ভাই নেই। স্বর্ণগর্ভা বা স্বর্ণকুমারী অর্থ হল, যে মহিলা তাঁর গর্ভে পুত্ররত্ন ধারণ করেন! আশাকরি বাংলা অভিধানে এর অর্থ বদল হবে।

বাঙালি রমণীদের মধ্যে স্বাতী একটি পরিচিত নাম। মূল বানান স্বাতি এবং পুরুষবাচক। বিকল্পে স্রী-বাচক স্বাতী। এই নক্ষত্র কুঙ্কুম সদৃশ এবং এক তারক। এর অধিদেবতা পবন। এই নক্ষত্রের প্রভাবে জন্মালে নর রূপবান, কান্তার প্রতি প্রীত, অনুরক্ত, প্রসন্ন হয়, এবং মহামতি মহাধনী হয়। নারী হলে কী হয়, তার কোনও উল্লেখ অভিধানে নেই। এই নামটি পুরুষদের পক্ষেই বেশি গ্রহণীয়, এর একটি অর্থান্তর আছে, খড়গ, তাও পুরুষবাচক। কিন্তু ই-কারান্ত বলে পুরুষরা এই নাম গ্রহণ করে না। বিকল্পটিই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যেমন সবিতা অর্থ জলজ্যান্ত সূর্য হলেও আ-কারান্ত বলে মেয়েরা নাম হিসেবে ব্যবহার করে।

স্বামী শব্দটিতে একালের নারীবাদীদের ঘোর আপত্তি আছে। কারণ এতে আছে প্রভুত্বের গন্ধ। কিন্তু স্বামী শব্দটি এতই প্রচলিত যে বাংলা ভাষা থেকে জোর করে বাদ দেওয়া তো যাবে না, বরং এর দীর্ঘ-ঈ-কার হরণ করে গুরুত্ব খানিকটা কমিয়ে দেওয়া যেতে পারে। স্বামি অবশ্যই অভিধানসম্মত। সমাসবদ্ধ হলেই স্বামিন থেকে স্বামি, যেমন স্বামিকার্য, স্বামিসম্বন্ধ, স্বামিদুহিতা, স্বামিস্নেহ, স্বামিস্বভাব লক্ষণ। এছাড়া স্বামিত্ব, স্বামিঘ্ন এরকম উদাহরণ অনেক।

স্বামির পর শ্বশুর। বাংলায় শব্দের প্রথমেই ব-ফলা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবান্তর, অন্তত উচ্চারণের ক্ষেত্রে। এর উদাহরণ অজস্র। যাই হোক, শ্বশুর-এর স্ত্রীবাচক শব্দ শ্বশ্রূ, এই শব্দটি দেখতেই এমন ভজকট যে অবিলম্বেই বাংলায় তা হয়ে গেল শাশুড়ি, স্বাভাবিকভাবেই খসে গেল বফলা, কিন্তু শ্বশুরের বেলায় রয়ে গেল কেন? অধিকাংশ শ্বশুর, শাশুড়ির থেকে বেশি লম্বা বলে? শ্বশুর রয়ে গেলেন তৎসম আর শাশুড়ি শুধু তদ্ভব নয়, ড য়ে শূন্য ড় এনে হয়ে গেলেন প্রায় দেশজ। এখন শ্বশুর-এর ব-ফলা খসিয়ে শশুর এবং শাশুড়িকে সম পর্যায়ে আনা উচিত নয় কি!

ছাত্র বয়সে সন্ন্যাসী বানানটি আমার প্রায়ই ভুল হত। ন-এর দ্বিত্ব, তার পরেও একটি য-ফলা থাকার কারণটি মাথা ঘুলিয়ে দিত। বাংলায় যুক্তাক্ষর হয়তো পুরোপুরি বর্জন করা যাবে না। কিন্তু তিনতলা অক্ষর রাখার কোনও প্রয়োজন নেই, বিশেষত কম্পিউটারের যুগে। (এখন যুক্তাক্ষরকে ভেঙে ঠিকঠাক চেহারায় লেখার প্রস্তাব এসেছে। আকাঙ্ক্ষা-কে ভেঙে কীভাবে লেখা হবে আমি জানি না। ক-এ মূর্ধন্য ষ-এ ক্ষ অক্ষরটিই বড়ই বিভ্রান্তিকর, উচ্চারণের দিক থেকে ষ-এর কোনও অস্তিত্বই নেই এর মধ্যে। অথচ ক্ষ এমনই প্রয়োজনীয় এবং বহুব্যবহৃত যে স্বয়ং অক্ষর-এর মধ্যেই সে ঢুকে বসে আছে, সুতরাং এর রূপের পরিবর্তন কীভাবে করা যাবে?) সন্ন্যাসীতে একটি ন অথবা য-ফলা অবশ্যই বর্জন করা সম্ভব, তৎসম ভেঙে তদ্ভব করার প্রক্রিয়ায়। সন্যাসী দেখতে খারাপ লাগে না।

সাক্ষ্য-তে য-ফলার কোনও ভূমিকা নেই। শুধু সাক্ষ হলে প্রথম প্রথম দেখে অস্বস্তি বোধ হতে পারে, পরে হয়তো চোখ সওয়া হয়ে যাবে। দীর্ঘ ঈ-কারের মতন চুল মেলা রানীরা এখন হ্রস্ব চুলের রানি হয়েছে, তা তো এখন দিব্যি মেনে নিয়েছি।

অভিধানের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে কয়েকটি বিচিত্র ব্যাপার চোখে পড়ে। যেমন যজ্ঞ থেকে উৎপন্না বলে দ্রৌপদীর আর এক নাম যাজ্ঞসেনী, আমরা সবাই জানি। বেশ সুশ্রাব্য নাম। কিন্তু দ্রৌপদীরও আগে তার এক দাদাও উঠে এসেছিল যজ্ঞের আগুন থেকে, তার নাম শিখণ্ডী। সে দাদা না দিদি তা বলা শক্ত। পূর্বজন্মে যে নারী ছিল, এ জন্মেও সে প্রথম পৃথিবীতে আসে বালিকা হয়ে, বর্ধিত হয় পুরুষ হিসেবে। তার বিয়ের পর তার পুরুষত্বের অভাব দেখে বঞ্চনার অভিযোগ ওঠে, যুদ্ধেরও উপক্রম হয় তার শ্বশুর দশার্ণরাজ হিরণ্যবর্মার সঙ্গে রাজা দ্রুপদের। তখন শিখণ্ডী, যে আসলে শিখণ্ডিনী, এক বনে গিয়ে তপস্যা করতে করতে পুরুষত্ব প্রাপ্ত হয়। সে আবার সংসারে ফিরে পুরুষত্বের প্রমাণ দিলে দুই শ্বশুরের মধ্যে দ্বন্দ্ব মিটে যায়। মহাভারতে এই শিখণ্ডীকেও বলা হয়েছে যাজ্ঞসেনি। আর দ্রৌপদী যাজ্ঞসেনী। হ্রস্ব-ই আর দীর্ঘ-ঈর তফাত আছে দুজনের নামে। এই তফাত কি টিকিয়ে রাখা সঙ্গত? বরং শিখণ্ডীর লিঙ্গ সম্পর্কেই যখন সন্দেহ আছে (এখানে লিঙ্গ শব্দটি সঠিক অর্থে প্রযোজ্য) তখন তাকে হ্রস্ব-ই, দীর্ঘ-ঈ-র এলাকা থেকেই বাদ দেওয়া হোক, বাংলা অভিধানে যাজ্ঞসেনি শব্দটি একেবারে বিলুপ্ত হোক, শুধু যাজ্ঞসেনী হয়ে থাকুন দ্রৌপদী।

এইসব বাদ দেওয়া হবে কোন নিয়মে? তা ঠিক করবেন ভাষাবিদরা। আমরা শুধু দু-একটি প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারি। সংস্কৃত ব্যাকরণের খুঁতখুঁতুনি না মেনে এইসব পরিবর্তন হতে পারে বাংলা মতে। সেই জন্যই তো বিশুদ্ধ বাংলা ব্যাকরণ রচনা করা অবিলম্বে অতি প্রয়োজনীয়!

(দেশ-২ জুলাই ২০০৪)

প্রবাসে বাংলা ভাষা

নিউজার্সির রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকোলাস মিউজিক সেন্টারটির নির্মাণশৈলী ভারী চমৎকার। শব্দ প্রক্ষেপণ অতি স্বাভাবিক। দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে অধিকাংশই খয়েরি ও উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বাঙালি এবং কিছু শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান। নভেম্বরের শেষ, থ্যাংকস গিভিং-এর ছুটি, বাইরের বাতাস বেশ ঠান্ডা। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন অফ আমেরিকার সান্ধ্য অনুষ্ঠানে মঞ্চে শুরু হল অর্কেস্ট্রা, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘সার্কল অফ হারমোনি’। ভায়োলিন, স্যাক্সোফোন, বাঁশি, ক্লারিওনেট আর কি-বোর্ডের সামনে বসে আছে বিভিন্ন বয়েসের কয়েকটি ছেলেমেয়ে এবং দুজন প্রৌঢ় পুরুষ, এরা বাজাচ্ছে বাংলা গানের সুর, লোকসঙ্গীত থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত। এরকম তো কতই হয়, এখানকার অনুষ্ঠানটির বৈশিষ্ট্য এই যে যারা বাজাচ্ছে, তারা সকলেই বাঙালি নয়, কেউ কেউ বাংলা ভাষা জানেই না। বাংলা গানের পশ্চিমি স্টাফ নোটেশন করা হয়েছে, তা দেখে দেখে এরা সাবলীলভাবে বাজিয়ে যাচ্ছে। এই অর্কেস্ট্রার পরিচালক এবং প্রকল্পক দুজনের নাম রিচার্ড টরস্ট্রিক আর অ্যান্ডর ক্যারিয়াস।

ইউরোপ-আমেরিকায় বাঙালিদের যেসব অনুষ্ঠান হয়, তাতে শুধু বাঙালিরাই আসে, বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার, বড়জোর কোনও বাঙালির মেম বউ বা কোনও মেয়ের সাহেব স্বামী হাসি হাসি মুখ করে না-বোঝার আনন্দ নিয়ে উপস্থিত থাকে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উদ্দেশ্য কিছুটা পৃথক, তারা বাংলা সংস্কৃতি পশ্চিমি মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার ব্রত নিয়েছে। এদের অনুষ্ঠান হয় বাংলা ইংরেজি দুটি ভাষাতেই যুগপৎভাবে। বাংলা কবিতা কেউ পাঠ করলে সঙ্গে সঙ্গে শুনিয়ে দেওয়া হয় তার ইংরেজি অনুবাদ, আমেরিকান শ্রোতাদের কিছু না বুঝে বসে থাকতে হয় না, কেউ কেউ সবিস্ময়ে বলে ওঠে, বাংলা ভাষায় যে এত আধুনিক চিন্তাধারার কবিতা লেখা হয় তা তো আমরা এতদিন জানতুম না! বাংলা গানের অর্কেস্ট্রাতেও তাদের অনেকের অন্তর স্পর্শ করে। স্টাফ নোটেশনের অভাবে এর আগে তারা শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে রসগ্রহণ করতে পারেনি। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা নূপুর লাহিড়ী। বহুকাল প্রবাসী, পেশায় চিকিৎসক এবং সার্থক চিকিৎসক। সার্থক হলেই ব্যস্ততা খুব বেশি হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই রমণী গান-বাজনা, ছবি আঁকা, কবিতা লেখা, নাটকে অভিনয়ে সময় ব্যয় করেন মহানন্দে। বাংলার সংস্কৃতি গেঁথে আছে তাঁর মর্মমূলে।

বেঙ্গল ফাউন্ডেশন সদ্য প্রতিষ্ঠিত। কয়েক বছর আগেই নূপুর গড়ে তুলেছেন একটা বাংলা বইয়ের লাইব্রেরি। নিজের বাড়িতে, তাঁর বাবার নামে। ওঁর বাবা ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক নির্মল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর ভ্রমণ ও ইতিহাসমূলক রচনাগুলি খুবই উঁচু মানের। ‘দেশ’ পত্রিকাতেও তাঁর রচনা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। নির্মল গঙ্গোপাধ্যায়ের দুটি বই আমার খুব প্রিয়, ‘শংকর-নর্মদা’ এবং ‘খাজুরাহো চান্দেল্ল স্মৃতি’। নির্মলবাবুর চার ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনজনই আমেরিকা প্রবাসী। তবু দেশ ছেড়ে বিদেশে যাবার কোনও আগ্রহ ছিল না তাঁর। বড় মেয়ের খুব অনুরোধে একবারই তিনি আমেরিকা পাড়ি দিয়েছিলেন, কিন্তু আমেরিকায় তাঁর কিছুই দেখা হয়নি। নিরিবিলিতে বসে বাবা লিখবেন বলে নূপুর চেয়ার টেবিল সাজিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু সেখানে নির্মলচন্দ্রের বসা হল না। ওদেশে পৌঁছোবার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই নির্মলচন্দ্র শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।

এখন প্রিন্সটনের নির্মল পাঠাগারে আছে এক হাজার বাংলা বই, এবং দুশো বাংলা সাহিত্য সম্পর্কিত ইংরেজি বই। এমন সুনির্বাচিত গ্রন্থরাজি খুব কম জায়গাতেই দেখা যায়। যে-কোনও আগ্রহী পাঠক বিনা চাঁদায় এই পাঠাগার ব্যবহার করতে পারে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে কিছু কিছু বাংলা বইয়ের ইংরিজি অনুবাদেরও পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। নিউ ইয়র্কের অতগুলি রঙ্গমঞ্চে কোথাও না কোথাও বিদেশি নাটকেরও অভিনয় হয়, বাংলা নাটক কেন হবে না? নূপুরের এই প্রশ্ন। তাঁর জেদ, ব্রডওয়েতে কোনও বাংলা নাটক মঞ্চস্থ করতেই হবে, তাই তিনি নিজেই রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’-র আধুনিক ইংরিজি অনুবাদ শুরু করেছেন।

আমেরিকার পূর্ব উপকূলে যেসব বাঙালি লেখক, বুদ্ধিজীবী রয়েছেন, তাঁদের একটি অংশ বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমে উৎসাহের সঙ্গে অংশ গ্রহণ করেছেন। ছিলেন জ্যোতির্ময় দত্ত, মীনাক্ষী দত্ত। অনেক অভিযানের নায়ক জ্যোতি এখন কর্মসূত্রে ‘ইন্ডিয়া অ্যাব্রড’ পত্রিকার সঙ্গে জড়িত হয়ে নিউইয়র্কে বসবাস করলেও কলকাতা থেকে বাংলা পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। ওই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী ও সহায়কদের মধ্যে আরও ছিলেন লেখিকা আলোলিকা মুখোপাধ্যায় আর তাঁর সুগায়ক স্বামী ভবানী মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক শিবাজী সেনগুপ্ত, সমাজতাত্ত্বিক ডক্টর মণি নাগ এবং করবী নাগ, টেগোর সোসাইটির অন্যতম আদি সদস্যা স্নিগ্ধা মুখোপাধ্যায়, ডাক্তার শ্যামশ্রী সেনগুপ্ত, কবিতা-পাগল গৌতম দত্ত, যিনি নিজের বাড়িতে প্রায়ই কবিতা পর্বের আসর জমান, নাট্য পরিচালক সুদীপ্ত ভৌমিক, লালী বিশ্বাস, আঞ্জম হোসাইন, মেহরিন হোসাইন, ধ্রুবনারায়ণ কুণ্ডু, মেরি অ্যান উইলিয়ামস, প্যাট উইস্টার ডেভিডসন, এডোয়ার্ড জাজ, চার্লি ডোরিয়া, অ্যান্ডর কেরিয়াস প্রমুখ।

বিশেষ করে বলতে হয় শেষোক্তজনের কথা। জার্মানি-জাত এই আমেরিকান পুরুষটির নাম Andor আসলে And/or, বাংলায় এবং অথবা। নিজেই এ নাম গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে তাঁর জীবনদর্শন। বিশ্বসংস্কৃতির সঙ্গে ব্যক্তির সংযোগ। তিনি যে দেশেই যান, সে দেশের ভাষা তার নাম হয় এবং/অথবা, যেমন জাপানে সোশিতে/মাতা! তিনি বিশ্বাস করেন, প্রত্যেক মানুষই নিজস্ব সংস্কৃতি বজায় রেখে বিশ্বসংস্কৃতির সঙ্গে মিলিত হতে পারে। আমেরিকায় বহু ভাষা, বহু জাতি, বহু সংস্কৃতির মানুষ এসে মিশেছে, যাকে বলা হয় মেল্টিং পট। এটা অ্যান্ড অর-এর পছন্দ নয়, ফুটন্ত পাত্রে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যায়, তিনি বরং উপমা দিতে চান স্যালাড-এর সঙ্গে। স্যালাডে যেমন সবক’টি উপাদানই আলাদা থাকে, অথচ সব মিলিয়ে একটা স্বাদ হয়, তেমনই আমেরিকাতেও বাংলাভাষী এবং অন্যান্য ভাষাভাষী বহিরাগতরা নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি অক্ষুণ্ণ রেখে আমেরিকান সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। অ্যান্ড অর নানারকম বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শী। ছবি আঁকতে পারেন, গাইতেও পারেন। বাঁশিতে তিনি দিব্যি বাজিয়ে দেন নানারকমের বাংলা গান। ‘একী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ প্রাণেশ হে’র মতন কঠিন গান গেয়ে ওঠেন যখন-তখন। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় গান অবশ্য, ‘ডুব ডুব ডুব ডুবসাগরে আমার মন’।

নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইট অঞ্চলে ঢুকে পড়লে মনে হয়, এ যেন এক বাঙালিটোলা। অনেক দোকানের নামই বাংলায় লেখা। রাস্তায় শোনা যায় বাংলায় কথাবার্তা, পাওয়া যায় বাঙালি রান্নার গন্ধ। তিনটি বাংলা বই ও বাংলা গানের ক্যাসেটের দোকানও আছে। ‘মুক্তধারা’ নামে বইয়ের দোকানটিতে কখনও কখনও ঢাকা বা কলকাতা থেকে কোনও কোনও খ্যাতিমান লেখক যান, ক্রেতাদের বইতে স্বাক্ষর দেন। সে খবর পেলে শত শত মানুষ ছুটে আসে, অনেকে অফিসের কাজে ছুটি নিয়ে, কেউ কেউ একদিনের উপার্জন নষ্ট করে। লেখক স্বাক্ষরিত বাংলা বই সংগ্রহ করার জন্য এঁদের উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখবার মতো। এঁদের অধিকাংশই অবশ্য বাংলাদেশি। পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের মধ্যে এমন উৎসাহীর সংখ্যা দিন দিনই কমে আসছে। অনেকগুলি পত্র-পত্রিকাও প্রকাশিত হয় এখান থেকে, শুধু লিটল ম্যাগাজিন নয়, পূর্ণাঙ্গ পত্রিকা। খবরের কাগজের সাইজের একটি পত্রিকার নাম ‘বাংলা কাগজ’। টিউব টেনে সবাই খবরের কাগজ পড়তে পড়তে যায়, তার মধ্যে কারুর হাতে একটি বাংলা খবরের কাগজ দেখলে বিস্ময়ের সঙ্গে গর্ববোধও যুক্ত হয়।

টেগোর সোসাইটি নিউ ইয়র্কের একটি পুরোনো প্রতিষ্ঠান। এটা শুধু বাঙলিদের জন্য নয় যদিও, কিন্তু বাঙালি সদস্যদেরই প্রাধান্য। বর্তমানে এর প্রেসিডেন্ট একজন মার্কিন মহিলা। বঙ্গ সম্মেলন নামে একটি বাৎসরিক বিরাট উৎসব হয় উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন শহরে। প্রায় পাঁচ-ছ’হাজার বাঙালি নারী-পুরুষ সমবেত হন সেখানে, এক সঙ্গে এত বাঙালির সমাবেশ আমাদের দেশের কোনও সভা-সমিতিতেও দেখা সম্ভব নয়। এই সম্মেলনের উদ্যোক্তা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা, বাংলাদেশিরা কোথাও কোথাও যোগ দেন। কোথাও কোথাও দূরে থাকেন। তাঁদের উদ্যোগে আলাদা সম্মেলনও হয় প্রায়ই। পশ্চিম উপকূলে, এবং মধ্যবর্তী অনেক শহরেই বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, প্রায় সবগুলির উদ্যোক্তা বাংলাদেশের বাঙালিরা। এখন কিছু কিছু স্কুলে বাংলা পড়ানো হচ্ছে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে, সেরকম একটি স্কুলের সঙ্গে যুক্ত আছেন মীনাক্ষী দত্ত। তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, বাংলার ছাত্রছাত্রীরা প্রায় সকলেই বাংলাদেশ থেকে আগত ছেলেমেয়ে।

ক্যানাডার টরেন্টো শহরে বেঙ্গলি ক্লাবের একটি বিশেষ কৃতিত্ব আছে। এঁরা নিজস্ব বেশ বড় একটা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। সারা বছরই নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় সেখানে। টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়েও এখন সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ-এ বাংলা পঠনপাঠন স্বীকৃত হয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে শুরু হয়েছে এই কার্যক্রম। প্রধান উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং অর্থসাহায্য করেছিলেন দীপক মজুমদার এবং তাঁর স্ত্রী পলিন। গতবছর মহাদেব চক্রবর্তী নামে এক সহৃদয় প্রাক্তন বঙ্গবাসী ষাট হাজার ডলার দান করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা নিয়ে গবেষণার জন্য স্কলারশিপ প্রবর্তন করেছেন। আমেরিকার যে-কোনও শহরের তুলনায় লন্ডনে বাংলাভাষীর সংখ্যা অনেক বেশি। পূর্ব লন্ডনেই অধিকাংশ বাঙালির বসতি। টাওয়ার হ্যামলেট এলাকায় কয়েকটি রাস্তার নাম বাংলায় লেখা দেখে প্রথমবার বেশ পুলকিত হয়েছিলাম। ব্রিক লেনে হাঁটতে হাঁটতে শোনা যায়, কোনও রেস্তোরাঁ থেকে ভেসে আসছে বাংলা গান।

লন্ডনের বেশ কিছু স্কুলে বাংলা পড়ানো হচ্ছে অনেকদিন থেকেই। এখন ‘ও’ লেভেল পর্যন্ত বাংলা স্বীকৃত। বাঙালিদের নিজস্ব অনেকগুলি স্কুল আছে, প্রতি রবিবার সকালে কোনও একটা জায়গায় মিলিত হয়ে ছেলেমেয়েদের বাংলা শেখাবার চেষ্টা হয়। ও-দেশে যারা জন্মেছে, যাদের বলা হয় সেকেন্ড জেনারেশন, সেইসব ছেলেমেয়ে যাতে বাংলা সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ না থাকে, সেই জন্যই বাবা-মায়েদের এই উদ্যোগ। হ্যারোতে এইরকমই একটি ক্লাবের নাম মিতালি, এদের সানডে স্কুল থেকেই বাংলা পড়াবার উপযুক্ত সিলেবাস তৈরি করা হয়। ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলটি যখন আমি দেখতে গিয়েছিলাম, তখন এর সভাপতি ছিল আমার বাল্যবন্ধু ভাস্কর দত্ত। স্বভাবে সে বেশ অলস ও অগোছালো। তবু যে সে এরকম একটা দায়িত্ব নিয়ে মনোযোগী হয়েছে, তা দেখে বিস্মিতই হয়েছিলাম।

শুধু লন্ডন নয়, পুরো ইংল্যান্ডেই এরকম ক্লাব ও সানডে স্কুল অনেকগুলি। বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরাই সিংহভাগ ছাত্রছাত্রী। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবি বাংলাদেশ নামে নবীন রাষ্ট্রটি সৃষ্টির অন্যতম কারণ। এই বাংলাদেশের মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়লেও ভাষার কথা ভোলে না। পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালিদের অনেকেরই ছেলেমেয়ে বাংলা একেবারেই শেখে না, না শেখার জন্য লজ্জাবোধও করে না। (ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।) কিন্তু আমি স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, এমন কোনও বাংলাদেশি পরিবার আমি দেখিনি, যার ছেলেমেয়েরা বাংলা জানে না।

যারা বাংলায় কথা বলে, বাংলা বই পড়ে, জন্ম যেখানেই হোক, তারাই বাঙালি। কিন্তু দ্বি-খণ্ডিত বাংলার একটি দিকের নাম এখন পশ্চিমবঙ্গ, অন্য দিকে কিন্তু পূর্ববঙ্গ নেই, সেখানে এখন স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্র। পাকিস্তানি আমলে এই দু-দিকের বাঙালিদের মধ্যে যোগাযোগ অনেকখানিই বিচ্ছিন্ন হয়েছিল, এখন আর সেরকম পরিবেশ নেই, তবু যেন খানিকটা দূরত্ব তৈরি হয়েই গেছে। লন্ডনে পশ্চিমবঙ্গীয় ও বাংলাদেশি বাঙালিদের মেলামেশা অবাধ নয়। দু-দিকের মানুষদেরই ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান আছে, কিন্তু পরস্পর মিলিতভাবে তেমন কিছু নেই। বাংলাদেশের কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, তাঁরা তবু পশ্চিমবঙ্গীয়দের মাঝে মাঝে আমন্ত্রণ জানান, কিন্তু বিশেষ সাড়া পান না, অপরপক্ষে পশ্চিমবঙ্গীয়রা তাদের আদৌ আমন্ত্রণই জানান না।

দু-দিকের বাঙালিদের উৎসবের তারতম্য আছে। পশ্চিমবঙ্গীয়, তথা ভারতীয় বাঙালিদের দারুণ উৎসাহ দুর্গাপুজোয়। লন্ডন শহরে ধুমধাম করে দুর্গাপুজো হয় অনেকগুলি। বেলসাইজ পার্কের পুজোর আয়োজন তো বিশাল। এই ধর্মীয় উৎসবে মুসলমানদের যোগ দেবার প্রশ্নই ওঠে না। সরস্বতী পুজো, এমনকী সত্যনারায়ণের সিন্নিতেও পশ্চিমবঙ্গীয়দের যথেষ্ট আগ্রহ আছে। অপরপক্ষে, বাংলাদেশের লোকেরা মেতে ওঠে নববর্ষ উৎসবে, প্রতি বছর নিয়মিত পালন করে একুশে ফেব্রুয়ারি। তা বলে কি তারা ঈদ বা সবে-বরাত পালন করে না? তা নয়, তাও অবশ্যই করে, এবং ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন নববর্ষ ও একুশে ফেব্রুয়ারিও বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে মান্য করে।

সাহিত্যচর্চাও বাংলাদেশিরাই করে বেশি। পশ্চিমবঙ্গীয় হিরন্ময় ভট্টাচার্য ‘সাগর পারে’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করছেন অনেকদিন থেকে, বেশ উন্নতমানের পত্রিকা। কিন্তু সম্প্রতি হিরন্ময় ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা হবার পর জানা গেল, তিনি আর সে পত্রিকাটি চালিয়ে যেতে পারছেন না। বাংলাদেশিদের উদ্যোগে পাঁচ-ছ’টি পত্রিকা চলছে রমরমিয়ে। তার মধ্যে দু-একটি পত্রিকা এমনই মজবুত যে সেখানে যোগ দিয়ে কয়েকটি তরুণ জীবিকা নির্বাহ করে। এদের ব্যবস্থাপনায় সাহিত্য আলোচনা ও কবিতা পাঠের আসর বসে লন্ডনের পাড়ায় পাড়ায়। একটি বাংলাদেশি সংস্থার উদ্যোগে প্রতি বছর বড় আকারে সাহিত্য সম্মেলন হয়, ঢাকা এবং কলকাতা থেকে কয়েকজন সাহিত্যিককে তাঁরা আমন্ত্রণ জানিয়ে, বিমান ভাড়া দিয়ে নিয়ে যান। পশ্চিমবঙ্গীয়দের উদ্যোগে লন্ডনে এরকম কোনও সাহিত্য সম্মেলনের ব্যবস্থা করার কথা শুনিনি, অন্তত দশ-পনেরো বছরের মধ্যে তাঁরা কলকাতা-ঢাকা থেকে কোনও সাহিত্যিককে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, এরকম আমার জানা নেই। এঁদের বেশি ঝোঁক গান-বাজনার দিকে। যে ছেলেমেয়েরা পরিষ্কার বাংলায় কথা বলতে পারে না, তারাও দু-একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখে। অবশ্য লন্ডনেও আছে টেগোর সোসাইটি, বেশ সম্ভ্রান্ত প্রতিষ্ঠান, এঁদের গ্রন্থাগারটি খুব সমৃদ্ধ, সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত। বিলিতি পত্র-পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক যাবতীয় সংবাদ ও রচনার একটি মূল্যবান সংকলন এঁরা প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রভক্তরাও লন্ডনে দ্বিধাবিভক্ত। টেগোরিয়ান নামে আছে একটি পৃথক প্রতিষ্ঠান।

শুধু পত্র-পত্রিকা নয়, লন্ডন থেকে এখন কিছু কিছু বইও প্রকাশিত হচ্ছে। কেউ কেউ দাবি করছেন, অদূর ভবিষ্যতে কলকাতা ও ঢাকার পর বাংলা বই প্রকাশনার তৃতীয় কেন্দ্র হবে লন্ডন। কমপিউটারের কল্যাণে এখন যে-কোনও জায়গা থেকেই বাংলা মুদ্রণের কোনও অসুবিধে নেই।

ইন্টারনেটে বাংলা পত্রিকাও শুরু হয়ে গেছে। ‘পরবাস’ সম্ভবত পৃথিবীতে প্রথম ইন্টারনেট বাংলা পত্রিকা। বস্টনের ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত, জাপানের মনিরুজ্জামান, টেক্সাসের পারমিতা দাশ ও সৌম্য দাশগুপ্ত, নিউ জার্সির সম্বিৎ বসু, সমীর ভট্টাচার্য, অনুব্রত চক্রবর্তী, ওহায়োর অর্ণব গুপ্ত, ওয়াশিংটন ডিসি-র ইন্দ্রাণী দাশগুপ্ত, নিউ ইয়র্কের সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়—এঁরা সকলে সকলকে সাক্ষাতে চেনেন না। কিন্তু কমিপিউটারের মাধ্যমে এই পত্রিকার পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দিয়েছেন। বাংলাদেশ, ভারত এবং পৃথিবীর যে-কোনও জায়গা থেকেই ইন্টারনেটে এই পত্রিকাটি পাওয়া যাবে, এর মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে চারটি সংখ্যা, যাতে আছে ধারাবাহিক উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ—রম্যরচনা এবং অবশ্যই কবিতা, সঙ্গে রঙিন ছবি। অভিনব ব্যাপার নিশ্চিত। সম্পাদক সমীর ভট্টাচার্য এবং বাকি সকলেরই পেশা বিজ্ঞান, তবু বাংলা সাহিত্যের প্রতি আছে নাড়ির টান। পরবাসের ইলেকটনিক ঠিকানা : http://www.Parabas Com।

আজ পৃথিবীতে বাঙালির সংখ্যা কুড়ি কোটি কিংবা তারও বেশি। এই জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশই বাংলাদেশি। পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা, ভারতের এই দুটি রাজ্যের ভাষা বাংলা, কিন্তু বাংলাদেশ নামে স্বাধীন দেশটির বাংলা হল রাষ্ট্রভাষা। সেই সুবাদে বাংলা এখন বাংলাদেশের ভাষা হিসাবেই ক্রমে ক্রমে পরিচিত হচ্ছে সারা পৃথিবীতে। অন্যান্য দেশে ইমিগ্রান্টদের মধ্যে ভারতীয় বাঙালিদের তুলনায় বাংলাদেশিদের সংখ্যা অনেক বেশি। জাপানে গিয়ে শুনেছিলাম, সেখানে ভারতীয় বাঙালিদের সংখ্যা দুশো আর বাংলাদেশিদের সংখ্যা দশ হাজার। এতটাই তফাত! ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা, আর্থিক ঝুঁকি, এমনকী জীবনের ঝুঁকি নিয়েও বাংলাদেশের বেকার যুবকরা দেশ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে, বিদেশে গিয়ে অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে জীবিকার সন্ধান করে, তারপর কোনও না কোনওভাবে পায়ের তলায় মাটি পেয়ে যায়। এই অ্যাডভেঞ্চারস্পৃহা ভারতীয় বাঙালি বেকারদের মধ্যে দেখা যায় না। এদিক থেকে যারা যায়, তারা চাকরির নিরাপত্তা কিংবা পড়াশুনো চালিয়ে যাবার ব্যবস্থা নিয়ে যায়, সেই জন্যই এত সংখ্যাল্পতা। বাংলাদেশের ছেলেরা প্রবাসে গিয়ে যখন অনেক কষ্ট করে গ্রাসাচ্ছাদন চালায়, তখনও কিন্তু তারা তাদের ভাষা-সংস্কৃতি ভোলে না। এক ঘরে গাদাগাদি করে চার-পাঁচজন থাকে। নিজেরাই ভাত-ডাল ফুটিয়ে খায়, তবু তাদের বাংলা বই পড়া চাই-ই। এক জায়গায় কয়েকজন মিলিত হলে বাংলা সাহিত্য নিয়ে আলোচনা বা তর্ক করে, এবং একটি পত্রিকা বার করে। জাপানে প্রখ্যাত রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ কাজুও আজুমা মহাশয় টোকিও-তে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। সেখানে মাঝে মাঝে সাহিত্যসভা ও সেমিনারের ব্যবস্থা হয়। তাঁর সহযোগী হিসেবে একবার কবীর নামে বাংলাদেশি এক যুবককে দেখেছিলাম, যার ঘর-সংসার, চাকরি, টাকা-পয়সা কোনও দিকে মন ছিল না, শুধু নিজস্ব পত্রিকা প্রকাশ ও ওই সম্মেলনের সাফল্যের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিল। তুলনামূলকভাবে প্রবাসী ভারতীয় বাঙালিদের বাংলা সাহিত্যের প্রতি এমন আন্তরিকতা দুর্লভ। অনেকেই হয়তো বই সংগ্রহ করে পড়েন। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের প্রসারের জন্য সংঘবদ্ধভাবে উদ্যোগ খুবই কম। বাংলাদেশিদের মধ্যে লেখকের সংখ্যা ও উচ্চমানের লেখা ক্রমশই বাড়ছে, প্রবাসী বাংলাদেশিরা তাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে থাকে, কিছুকাল পরে ঢাকাই হবে বাংলা সাহিত্য প্রকাশনা এবং সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র। ভারতীয় বাঙালিরা যেন ইচ্ছে করেই হেরে যাওয়ার খেলা খেলছেন।

রেষারেষি বা প্রতিযোগিতা নয়, কুড়ি কোটি বাঙালি যদি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নতি ও প্রসারের জন্য মিলিতভাবে উদ্যোগ নিত, তাহলে অনায়াসেই এই সাহিত্য-সংস্কৃতি এক সময় ফরাসি, ইতালিয়ান, জার্মান, স্প্যানিশ ভাষার পাশাপাশি স্থান করে নিতে পারত। কিন্তু তা হবার নয়। এই কুড়ি কোটি বাঙালির সকলেরই যদি অন্নবস্ত্রের সংস্থান করা যেত, যদি সকলেই পেত শিক্ষার সুযোগ, সকলেরই যদি থাকত কিছু কিছু ক্রয়ক্ষমতা, তাহলে এই বাঙালিরা হয়ে উঠত বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী জাতি। কিন্তু সে সুখস্বপ্ন আমাদের ইহজীবনে বাস্তব হবে কি?

আমাদের এখানে অনেকেরই ধারণা, যারাই বিদেশে চলে যায়, তারা ধীরে ধীরে বাংলার সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত হয়, তাদের ছেলেমেয়েরা একেবারেই বাংলা শেখে না। বিদেশে কেন স্বদেশেই দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাইয়ের বাঙালি পরিবারগুলির কী অবস্থা? সেখানকার দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বাংলা লিখতে পড়তে জানে না, তাদের শেখাবার কোনও ব্যবস্থা নেই, এবং ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োজন নেই বলে তারা শিখতেও চায় না। পরাধীন ভারতে বাংলা ভাষায় যে সর্বভারতীয় মর্যাদা ছিল স্বাধীন ভারতে তা হু-হু করে কমে আসছে। আপাতত সে আলোচনায় আর যাচ্ছি না। প্রবাসে সম্পূর্ণ চিত্রটাই যে নৈরাশ্যজনক নয়, তা বোঝাবার জন্যই কয়েকটি দেশের কয়েকটি সমষ্টিগত দৃষ্টান্ত দিলাম। এরকম অন্যান্য দেশে নিশ্চিত আরও অনেক আছে, সব জানা তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়! দিল্লি, মুম্বইতে বাঙালির সংখ্যা কম নয়, কিন্তু ওই দুই শহরের তুলনায় ইউরোপ-আমেরিকার কোনও কোনও শহরে বাংলা ভাষা-সাহিত্য নিয়ে মাতামাতি বেশি হয়। বিদেশ থেকে ইদানীং যত বাংলা পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়, তিরিশ বছর আগে তা কল্পনাও করা যেত না।

একটা মজার গল্প দিয়ে শেষ করি। গল্প নয়, ঘটনা। সুইজারল্যান্ডে এক বাঙালি পরিবারের কর্তা এক কঠোর নিয়ম জারি করেছেন, বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে ছেলেমেয়েদের সর্বক্ষণ বাংলা বলতে হবে। বাড়ির বাইরে তারা ফরাসি, জার্মান বা ইংরাজি, যা খুশি বলুক, বাড়িতে থাকার সময় বাংলা ছাড়া অন্য ভাষার একটি অক্ষরও উচ্চারণ করা যাবে না। সে বাড়ির বড় ছেলে একদিন বাইরে থেকে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরছে, তার বাবাকে কোনও জরুরি ব্যাপার জিগ্যেস করতে হবে। দরজা খুলেও সে থমকে দাঁড়িয়ে গেল চৌকাঠের ওপরে। একটি জার্মান শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ তার কিছুতেই মনে পড়ছে না। সে তখন অসহায়ভাবে বলল, বাবা এই জার্মান কথাটার আমি বাংলা জানি না, তা হলে কি বাড়ির মধ্যে ঢুকতে পারব না?

(দেশ—২১/২/৯৮)

প্রবাসী বাঙালি : সার্থকতা ও পরের প্রজন্ম

নিউ জার্সিতে আলোলিকা ও ভবানী মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে প্রথম আলাপ হয়েছিল ধ্রুব কুণ্ডুর সঙ্গে। কুড়ি-একুশ বছর আগের কথা, সে তখন সুঠাম, স্বাস্থ্যবান যুবক, অত্যন্ত সুপুরুষ এবং বলশালী, কিছুটা সংগ্রামের পর ওখানকার জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত, ক্যাডিলাক (সম্ভবত, আমি গাড়ির নাম মনে রাখতে পারি না) গাড়ি চালায় এবং জীবনরসে ভরপুর। সেই সময়েই কথা প্রসঙ্গে সে বলেছিল, আমি বুড়ো হয়ে এদেশে মরতে রাজি নই, এখানে আমার সবকিছু আছে, তবু আমি দেশে ফিরে যাব! এরকম কথা অনেকেই বলে, অনেকেই কোনও কোনও আবেগময় রাতে খুব শিগগিরই দেশে ফিরে যাবার সঙ্কল্প নিয়ে ঘুমোতে যায়, পরদিন সকালে উঠে ওই ধরনের চিন্তাই ছেলেমানুষি মনে হয়। যারা ভাগ্যান্বেষণে বিদেশে যায়, সেখানে বিদ্যা ও অর্থ দুটোই ভালোভাবে অর্জন করতে পেরে যায়। ওদেশের সুখ-সম্ভোগে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তারাই আবার সমস্যাসঙ্কুল স্বদেশে ফিরে আসার জন্য হঠাৎ হঠাৎ উতলা হয়ে ওঠে কেন? এর কোনও সহজ উত্তর নেই। দেশপ্রেম? মা-বাবা কিংবা বন্ধু-বান্ধবদের টান? কোনওটাই তেমন জোরালো নয়। এর পরেও থাকে বিস্ময়, নিজস্ব, অতি ব্যক্তিগত ভালো-লাগা বা ভালো-না-লাগা। তারও কোনও ব্যাখ্যা নেই।

ধ্রুব কুণ্ডু যৌবন বয়েসেই ফিরে এল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্মেসির ডিগ্রি নিয়ে সে আমেরিকার ওষুধ কোম্পানিতে ভালো কাজ পেয়েছিল, এ দেশেও ওষুধ কোম্পানিতে উচ্চপদ পেতে তার অসুবিধে হল না। কিন্তু বনিবনা হল না সে চাকরিতে, কিছুদিন পরেই সে ফিরে গেল। এটাও একটা পরিচিত ফর্মুলা। আবেগের বশে যারা দেশে ফিরে আসে, তারা গ্রিন কার্ড কিংবা ফেরার পথ খোলা রাখে, এদেশের গরম যেমন তাদের সহ্য হয় না, তেমনই বুরোক্র্যাটদের মেজাজ, সরকারি দফতরগুলিতে গয়ংগচ্ছ ভাব, এমনকী ব্যাঙ্কে হয়রানি, টেন বা প্লেনের টিকিট পেতেও ঝামেলা ইত্যাদি তাদের দুর্বিষহ মনে হয়, বুকের মধ্যে রাগ বা অভিমান নিয়ে তারা ফিরে যায়।

ধ্রুব কুণ্ডু গেল বটে, কিন্তু আর চাকরি নিল না। আসলে চাকরি তার ধাতে নেই, তাদের পরিবারে কেউ কখনও চাকরি করেনি। সে হুগলির ইটাচুনার জমিদার বাড়ির সন্তান, এখন আর জমিদারির ঠাটবাট নেই বটে, কিন্তু ইটাচুনার বিশাল প্রাসাদটি অটুট আছে, কলকাতাতেও তাদের সুরম্য হর্ম্য। পরের অধীনে কাজ করতে পারবে না বলে সে আমেরিকায় শুরু করল ব্যবসা, মূলত চামড়ার ব্যাগের, কলকাতার আর্ট কলেজের ছাত্ররা নতুন নতুন ডিজাইন এঁকে দেয়। কুণ্ডুদেরই কারখানায় তৈরি ব্যাগ বিদেশে বিক্রি হয়। এ ব্যবসায়ে সার্থকতা আসতে দেরি হয়নি, ম্যানহাটনে ও নিউ জার্সিতে তার দুটি আউট-লেট, তবু হঠাৎ আবার তার মন উচাটন হল, সেসব ছেড়েছুড়ে ফিরে এল দেশে। ধ্রুবর স্ত্রী বৃতিও খুব গুণী মেয়ে, সে বেশ ঈর্ষণীয় চাকরি করে, স্বামীর সঙ্গেই না ফিরে সে ঠিক করেছিল, আরও দু-এক বছর চাকরি চালিয়ে ভালো টাকা জমিয়ে নিয়ে আসবে। তা ছাড়া তার বাবা-মায়ের কাছে কিছু কিছু অর্থ পাঠাবার দায়িত্ব নিয়েছিল। মাঝে মাঝেই সে টেলিফোনে দুঃসংবাদ দেয়। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, তার আবার একটা প্রমোশন হয়েছে, এত উপার্জন ছেড়ে কি হুট করে চলে আসা যায়?

ধ্রুব এখন কলকাতায় দিব্যি জমিয়ে বসেছে। গ্রামের বাড়িতে পোলটি আর কলকাতায় ওষুধের দোকান খুললেও কোনও ধরাবাঁধা কাজের সঙ্গে সে আর যুক্ত নয়। তার দিন ও রাত্রিগুলি স্বাধীন, সে যখন-তখন স্বেচ্ছাচারী হতে পারে। বছরে অন্তত দুবার সে আমেরিকায় গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে কয়েকটি সপ্তাহ কাটিয়ে আসে, বৃতিও বছরে একবার কলকাতা ঘুরে যায়। তাদের দাম্পত্য সম্পর্কে কোনও ফাটল নেই। শুধু টেলিফোনের বিল খুব বেশি দিতে হয়।

আমি প্রথমেই ধ্রুব কুণ্ডুর কথা লিখলাম, তার কারণ, যত প্রবাসী বা অনাবাসী বাঙালি আমি দেখেছি তাদের মধ্যে ওর দৃষ্টান্তটি অনন্য। (কমও তো দেখলাম না, আমি আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে গিয়েছিলাম ১৯৬৩ সালে, এবছর সেই ঘটনার চল্লিশ বর্ষপূর্তি হল। এর মধ্যে ওদেশে গেছি আরও বেশ কয়েকবার, কোনও-না-কোনও বিশ্ববিদ্যালয় বা সংস্থার আমন্ত্রণে, আমেরিকার বঙ্গ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলাম প্রথম বছরেই। পরিচয় ও সখ্য হয়েছে কত মানুষের সঙ্গে, আতিথ্য পাবার সৌভাগ্য হয়েছে বেশ কিছু পরিবারের) অবশ্য ধ্রুব কুণ্ডু যে এমন ব্যতিক্রম হতে পেরেছে, তার দুটি কারণ, আর্থিক অসচ্ছলতার কোনও আশঙ্কা ছিল না, এবং এই দম্পতি স্বেচ্ছায় নিঃসন্তান।

ছেলেমেয়েদের কথা চিন্তা করেই অনেকে নিজেদের ইচ্ছেটাকে ঘুম পাড়িয়ে আর পাকাপাকি দেশে ফিরতে পারে না। ছেলেমেয়েদের চোখ ফুটলে আর স্কুলে যাওয়া শুরু করলে সে দেশটাকেই তারা আপন জ্ঞান করে, বাবা-মায়ের দেশে এসে তারা স্বস্তি বোধ করে না। একটু বড় বয়েসে এসে এ দেশের স্কুল-কলেজে ভরতি হলে তারা অকূল পাথারে পড়ে, সব কিছুই আলাদা এবং ভাষার ব্যবধানে তারা দিশেহারা হয়ে যায়। সেটা তাদের প্রতি অবিচার হয়।

টরেন্টোর নীলাদ্রি চাকী একটা চমৎকার কথা বলেছিল। পঞ্চাশ বছর বয়েসে নীলাদ্রি সবকিছু গুটিয়ে সপরিবারে ফিরে এসেছিল কলকাতায়। ওই দম্পতির দুটি ছোট মেয়ে এখানকার ইস্কুলে ভরতি হয়ে বাংলা ভাষাতেও বেশ সচ্ছন্দ হয়ে গেল। কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনে সাজিয়ে-গুছিয়ে বসেছিল, নীলাদ্রিকে কেউ যদি জিগ্যেস করত, তুমি ফিরে এলে কেন, তার উত্তরে সে সহাস্যে বলত, জীবনের পঁচিশ বছর পড়াশুনো করেছি, তার পরের পঁচিশ বছর জীবিকার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছি (নীলাদ্রি ইঞ্জিনিয়ার), আর যদি পঁচিশ বছরও বাঁচি, তাহলে আর কোনও কাজ করব না, আড্ডা দেব, বই পড়ব, থিয়েটার-ছবির প্রদর্শনী দেখব, গানের জলসায় যাব, বেড়াব। নীলাদ্রি কলকাতার সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে বেশ যুক্ত হয়ে পড়েছিল, তার নিজস্ব শখ ছিল দুর্লভ কোনও আর্টের উপাদান সংগ্রহ করা। তার মেয়েরা খানিকটা বড় হবার পর কিছু একটা সমস্যা হল, তা আমি ঠিক জানি না। প্রায় সাত-আট বছর পর আবার নীলাদ্রি এদিককার সব পাট চুকিয়ে ফিরে গেল কানাডায়, সেখানে তাকে নতুন করে ঢুকতে হল জীবিকার জগতে।

কবি উৎপলকুমার বসু ঠিক করেছিল তাদের একমাত্র সন্তানকে বিদেশি আবহাওয়ায় মানুষ করবে না, ছেলের তিন-চার বছর বয়েসেই সে ও তার স্ত্রী সান্ত্বনা লন্ডনের সংসার গুটিয়ে ফিরে আসে কলকাতায়। তাদের উদ্দেশ্য সার্থক হয়েছে, ছেলে এখানে মানিয়ে নিতে পেরেছিল, সেই ছেলে এখন রবীন্দ্র ভারতীর অধ্যাপক।

এককালে ‘উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ যাত্রা’ এই শিরোনামে সংবাদপত্রে খবর কিংবা বিজ্ঞাপন ছাপা হত, তার সঙ্গে পোস্টেজ স্ট্যাম্পের সাইজের সেই কৃতী ছাত্র বা ছাত্রীর ছবি। এখন আর এসব দেখা যায় না, কারণ প্রতি বছর রাশি রাশি ছেলেমেয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে অন্য দেশে। আমরা প্রাচ্যদেশীয় হলেও আমাদের মুখ পশ্চিম দিকে। আমরা চিন বা জাপান সম্পর্কে যতটুকু জানি, সেই তুলনায় ইউরোপ, আমেরিকা সম্পর্কে প্রায় সবজান্তা। চায়ের দোকানে বা রকের আড্ডায় একটা কথা চালু ছিল, বি এন জি এস, অর্থাৎ ‘বিলেত-না-গিয়েও-সাহেব’।

সত্যিই কেউ কেউ লন্ডনের রাস্তাঘাটের নামও বলে দিতে পারত কলকাতায় বসে। আর এখন দশবার বিলেত ঘোরা কাউকেও সাহেব বলে পাত্তা দেওয়া হয় না।

বিদেশ যাওয়ার ঝোঁক হঠাৎ খুব বেড়ে যায় ষাটের দশকে। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা তখন লক্ষ থেকে নিযুতে পৌঁছে যাচ্ছে, এমনকী ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করলেও উপার্জনের নিশ্চয়তা ছিল না, তাই যাদের পক্ষে জাহাজ ভাড়ার টাকা জোগাড় করা সম্ভব হত, তারাই পাড়ি দিতে শুরু করল পশ্চিমের ধনাঢ্য দেশগুলিতে। এখন ভিসায় এত কড়াকড়ি, কিন্তু শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হবে, দু’দশক আগেও ইংল্যান্ড, জার্মানি, সুইডেন, কানাডায় ভারতীয়দের কোনও ভিসার প্রয়োজন হত না। আমেরিকার ভিসাও ছিল সহজলভ্য, এই তো সেদিনও আমেরিকার ভিসার জন্য একটা পয়সাও খরচ লাগত না। যুদ্ধোত্তর জার্মানিতে পুরুষের সংখ্যা এত কমে গিয়েছিল যে অন্য দেশ থেকে আগত শিক্ষিত-অশিক্ষিত, দক্ষ-অদক্ষ কর্মী সকলেরই কিছু না কিছু কাজ জুটে যেত সেখানে। জার্মান পুরুষদের তুলনায় নারীর সংখ্যা অনেক গুণ বেশি, সুতরাং বিবাহযোগ্য পাত্রীরা গিসগিস করছে, সেই জন্য সে আমলের বহিরাগতদের প্রায় সকলেরই জার্মান বউ। তবে ভারতের থেকেও আরব দেশগুলি থেকে পুরুষ কর্মী জার্মানিতে গেছে অনেক বেশি, পরে তাদের নিয়ে নানা সমস্যাও হয়েছে, ফাসবিন্ডারের চলচ্চিত্রে তা প্রতিফলিত হয়েছে।

কানাডা বিশাল দেশ। অথচ জনসংখ্যা খুবই কম। সে দেশ গড়ার জন্যও নানাধরনের কর্মী প্রয়োজন। মধ্য ষাটে কানাডা হাট করে তার দরজা খুলে দিয়ে দু-হাত বাড়িয়ে অতিথিদের আহ্বান করেছে। উন্নততর নতুন সুযোগের সন্ধানে জার্মানি থেকে অনেক ভারতীয় তথা বাঙালি পাড়ি দিয়েছে কানাডায়। ইংল্যান্ড থেকেও অনেক গিয়েছে। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের মতন জার্মানি থেকে আসা আর ইংল্যান্ড থেকে আসা বাঙালিদের মধ্যে কিছুটা রেষারেষির ভাব কানাডায় ছিল অনেকদিন।

জাহাজ ভাড়া কিংবা বিমান ভাড়া না দিয়েও দেশ ছেড়ে গেছেন কেউ কেউ। তারা খুব সাহসী, তাদের বুকে ছিল অভিযানস্পৃহা। ‘সাইকেলে বিশ্বভ্রমণ’ কিংবা ‘পদব্রজে ইউরোপ’, এরকম সংবাদ প্রায়ই বেরুত। সামান্য টাকা সম্বল করে ও শুভার্থীদের দেওয়া ফুলের মালা গলায় নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন তাঁরা, পথে বিপদের সম্ভাবনা অগ্রাহ্য করে। বিখ্যাত রামনাথ বিশ্বাস কিংবা বিমল মুখোপাধ্যায়ের মতন দু-চারজন ফিরেও এসেছেন, আবার অনেকে ফিরে আসেননি, থেমে গেছেন মাঝপথে।

এরকম দু-একজনকে আমি চিনি। বেলঘরিয়ার ছেলে দীপ্তেন্দু চক্রবর্তী কেরানি হিসেবে জীবিকাজীবন শুরু করেছিল। এ দেশের কেরানিরা শেষজীবনে বড় জোর খুদে অফিসার হয়, কিন্তু দীপ্তেন্দু সেভাবে জীবন কাটাতে রাজি ছিল না। সে অন্য ধাতুতে গড়া। একটা সাইকেল নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল অনিশ্চিত ভবিষ্যতের রাস্তায়। দিল্লিতে পৌঁছবার পর লেখক-সাংবাদিক নিমাই ভট্টাচার্যের সহায়তায় দেখা করতে পারল ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে, তিনি তাকে উৎসাহ দিয়ে শংসাপত্র দিয়েছিলেন। ওরকম দু-একটা পরিচয়পত্রের দরকার হয়, না হলে কোনও প্রতিকূল দেশে গুপ্তচর সন্দেহে গ্রেফতার হওয়ার বা মারধর খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দীপ্তেন্দুর স্বভাবটা ডাকাবুকো ধরনের। তাই অনেক বাধা অনায়াসে পেরিয়ে সে পৌঁছয় লন্ডনে। তাই সাইকেলটি তখন অচল হয়ে গেছে। লন্ডনে নানারকম টুকটাক কাজ করার পর সে আটলান্টিক পেরিয়ে এল কানাডায়। সেখানেও সে প্রথম দিকে জীবিকার জন্য কোনও পেশাই অগ্রাহ্য করেনি, এমনকী পুলিশের কাজও করেছে। তবে এসব ছেলে ধরাবাঁধা চাকরিতে মানানসই হয় না। শুরু করল রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা, জমি কেনা-বেচা, বাড়ি বানানো, এক সময় অনেক সম্পদের অধিকারী হল, আবার সে ব্যবসায়ে হঠাৎ খুব নিম্নগতি হলেও হার মানেনি, এখন সে স্বাধীনভাবে চালাচ্ছে ট্যাভেল এজেন্সি! বিবাহিত, সংসারী দীপ্তেন্দুর মন কিন্তু যখন-তখন উড়ে যায় দেশের দিকে, প্রতিদিন ইন্টারনেটে দেশের সমস্ত খবর খুঁটিয়ে পড়ে, নিজে বাংলা-ইংরিজিতে দেশের পত্র-পত্রিকায় লেখে, কী করে পশ্চিম বাংলার উন্নতি হবে সবদিক দিয়ে, এই চিন্তায় সে এক-একদিন বেশি নেশা করে ফেলে।

নকশাল আমলেও অনেক ছেলেমেয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিল। তাদের মধ্যে একটি মেয়ের কাহিনি চমকপ্রদ। কৃষ্ণকলি সরকারের (আসল নাম নয়) জন্ম বামপন্থী রাজনৈতিক পরিবারে। নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিল, পুলিশ তাকে খোঁজাখুঁজি করছে এবং ধরতে পারলে কী অবস্থা হবে তা অনুমেয়, সেই অবস্থায় উনিশ বছরের তরুণীটি দেশ ছেড়ে পালায়। হিচ হাইকিং করে সে আফগানিস্তান পেরিয়ে আরবের মরুভূমির মধ্য দিয়ে গেছে একা একা, কখনও দস্যুদলের সঙ্গেও রাত কাটিয়েছে। সে এক রোমহর্ষক কাহিনি। তা নিয়ে উপন্যাস লিখলে মনে হবে অবাস্তব, অবিশ্বাস্য। অসম্ভব মনের জোর সে যুবতীর, কোনওক্রমে পৌঁছল লন্ডনে, কিছুদিন পর আমেরিকায়। সেখানে হরেকরকম জীবিকার সঙ্গে যুক্ত থেকেছে। আমার সঙ্গে তার যেবার প্রথম দেখা হয়, তখন সে একজন বিখ্যাত আমেরিকান লেখকের গবেষণা-সহায়িকা। ও দেশের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকরা এরকম তিন-চারজন রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট রাখেন।

দেশ ছেড়ে বিদেশে, বিশেষত পশ্চিমি দেশে যাওয়ার মূল কারণ অবশ্যই দুটো। উচ্চতর বিদ্যালাভ এবং অর্থ উপার্জন। তবে বিদ্যালাভ শেষ করার পর বেশি অর্থের লালসায় সবাই ওসব দেশে থেকে যায়, এটা মনে করা ঠিক নয়। অনেকেই স্বদেশে এসে অধীত বিদ্যার প্রয়োগে আগ্রহী, তার জন্য উপার্জন কিছু কম হলেও মেনে নিতে পারে। কিন্তু দেশে ফিরে যদি সুযোগও না পাওয়া যায়, তখন মন ভেঙে যায়, তারা আবার ফিরে যায়, কেউ কেউ দেশের প্রতি বিদ্বেষী হয়ে ওঠে। এরকম অনেককে দেখেছি, কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে সমস্ত ব্যবস্থা কত খারাপ, সেই নিন্দেতে অক্লান্ত। এই খারাপ ব্যবস্থা বদলাবার কোনও দায়িত্ব অবশ্য তাঁদের নয়, তাঁরা বিদেশের নিশ্চিন্ত জীবন পেয়ে গেছেন।

পরাধীন আমলে বা তারও কয়েক দশক পর পর্যন্ত অনেকেই কিন্তু দেশে ফিরে আসতেন। আমরা এক সময় কত বিলেতফেরত ডাক্তার দেখেছি, কত এম আই টি থেকে পাশ করো ইঞ্জিনিয়ার, কত অক্সফোর্ডের ডিগ্রিধারী অধ্যাপক। তখন এঁদের জন্য জায়গা খালি ছিল, এখন যে-কোনও কাজের জন্য নিদারুণ প্রতিযোগিতা! আমার এক দূর সম্পর্কের বন্ধু ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় প্রায় পনেরো বছর বিজ্ঞানের অধ্যাপনা করার পর ঝোঁকের মাথায় দেশে ফিরে এলেন, দেশের ছেলেমেয়েদের পড়াবেন। সায়েন্স কলেজে পুরোনো মাস্টারমশাইয়ের কাছে গিয়ে জানালেন তাঁর মনোবাসনা। বিভাগীয় প্রধান জানালেন যে তাঁকে একটি জুনিয়ার লেকচারারের পদ দেওয়া যেতে পারে। এ কী অদ্ভুত প্রস্তাব! সাহেবদের দেশে পনেরো বছর পড়াবার অভিজ্ঞতার কোনও মূল্য দেওয়া হবে না। তাঁকে শুরু করতে হবে প্রথম থেকে? বন্ধুটি মনঃক্ষুণ্ণ তো হতেই পারেন। সায়েন্স কলেজের এক অধ্যাপক তাকে বললেন, ভাই, তুমি আশা করছ, আমাদের কয়েকজনকে ডিঙিয়ে তোমাকে রিডার কিংবা প্রফেসার পদ দেওয়া হোক। তোমার আর আমার রেজাল্ট ছিল একইরকম। তুমি বিদেশে চলে গেলে, আর আমার বিধবা মা একা থাকতে পারবেন না বলে ওদেশের দু-একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও আমি যাইনি। আমার এই বিদেশ না-যাওয়াটা কি অপরাধ? এটাও অকাট্য যুক্তি।

এখন সরকারি নিয়ম হয়েছে যে বিদেশে ডিগ্রিধারী ডাক্তারদের আলাদা কোনও বিশেষ স্বীকৃতি দেওয়া হবে না। ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপকদের সম্পর্কেও সম্ভবত এ নিয়ম প্রযোজ্য। বিদেশে শিক্ষাপ্রাপ্তদের এখন আর না ফিরে আসার সিদ্ধান্তের এটাই বোধহয় বড় কারণ।

ইংল্যান্ড বা জার্মানির তুলনায় আমেরিকা-কানাডায় যাবার ঝোঁকই এখন খুব বেশি। কারণ, ওই দুই দেশে উপার্জন অনেক বেশি। কাজ পাওয়াও কঠিন নয়। কিন্তু আমেরিকায় যাওয়ার সুযোগ পেয়েও যায়নি এমন একজনকে জানি। তার নাম অসীম রায়। কলকাতায় বিএসসি পাশ করে অসীম চাকরি পেয়েছিল স্টেট ইলেকটিসিটি বোর্ডে, পোস্টিং হয়েছিল বর্ধমানের একটি গ্রামে। সেখানে একটা ছোট ঘর ভাড়া করে থাকত, খেতে হত নিজে রান্না করে, পরে একটা রান্নার লোকও বোধহয় জুটেছিল, ঘুরতে হত গ্রামে গ্রামে। এরকম তো অনেকেই এখানে চাকরি করে, তাদের মধ্যে দু-একজনের মনই হঠাৎ ছটফটিয়ে ওঠে। অসীম হঠাৎ সে চাকরি ছেড়ে কোনওক্রমে গিয়ে পড়ল ইংল্যান্ডে। সেখানে চাকরি করতে করতে পড়াশুনা, ক্রমে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভ। প্রায় আট বছর সেখানে কাজ করার পর তার ইচ্ছে হল দেশ বদলাবে। আমেরিকা থেকে সে ডাক পেয়েছিল, কিন্তু চলে এল ফ্রান্সে। আমেরিকায় সে গেল না কেন? ওখানে ছুটি কম। ফরাসিদের জীবনযাত্রা অনেকটা ঢিলেঢালা, সেখানকার সাংস্কৃতিক পরিবেশও অসীমের পছন্দ হয়ে গেল। এখন সে ফরাসি নাগরিক। অসীমের এক বন্ধু কোকো মুখার্জি কিন্তু ব্রিটিশ নাগরিক হয়েও ফিরে এসেছেন দেশে। আস্তানা গেড়েছে শান্তিনিকেতনে, এখন আলস্যই তার বিলাস। আড্ডাতেই তার আরাম, বিলেতের কথা উচ্চারণই করে না।

অন্যান্য দেশের তুলনায় ফ্রান্সে পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালিদের সংখ্যা বেশ কম। একটি ছোট গোষ্ঠী, তবু তাদের নিজস্ব পাঠাগার ও ক্লাব আছে। ইংলন্ডে বহুদিন প্রবাসী অথচ ইংরিজি সাহিত্য সম্পর্কে কিছুই জানে না, এমন বাঙালির সংখ্যা যথেষ্ট। কিন্তু ফরাসি দেশে যারা থাকে, তাদের পেশা যাই-ই হোক, সে দেশের শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে তারা সচেতন, এমনই একটা সামাজিক বাতাবরণ। যেমন ডক্টর ভূপেশ দাশ, তিনি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, কিন্তু সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখা সম্পর্কে অবহিত। শিল্পী শক্তি বর্মন আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছেন। ওদেশেই থেকে গেছেন চল্লিশ-বেয়াল্লিশ বছর, কিন্তু এখনও বাংলা সাহিত্য, বাংলা গান সম্পর্কে যেমন আগ্রহী, তেমনই ফরাসি শিল্প-সাহিত্যে নিমজ্জিত। বাঘা যতীনের নাতি পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বহুবছর ধরে ফরাসি ও বাংলা সংস্কৃতির সেতুবন্ধন করে আসছেন। ব্যবসায়িক সাফল্য পেয়েছেন সম্বিৎ সেনগুপ্ত, তিনিই আবার শিল্পী ও গীতিকার। বহরমপুরের মেয়ে প্রীতি আর ময়মনসিং-এর ছেলে বিকাশ সান্যাল প্যারিসে কাটিয়ে দিলেন তিন দশকের বেশি সময়। বিকাশ এক সময় নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ ছিলেন, এখন প্যারিসে ইউ এন-এর শিক্ষা উপদেষ্টা। পৃথিবীর বহু ছোট-বড় দেশে তাঁকে ঘুরে বেড়াতে হয়। সেসব জায়গার শিক্ষা সংস্কারের কাজে, এমনকী যুদ্ধ পরবর্তী আফগানিস্থানেও। ইংরেজিতে বই লিখেছেন অনেকগুলো, ফরাসি ভাষা জানেন জলের মতন, এবং তিনি মনেপ্রাণে এখনও খাঁটি বাঙালি ও বাঙাল। ময়মনসিং-এর নাম শুনলেই তাঁর মনটা হু-হু করে। প্রীতি একজন গদ্য লেখিকা এবং কবি। ‘দেশ’ পত্রিকায় বহুদিন ‘প্যারিসের চিঠি’ লিখেছেন। নিজের উংসাহে ফরাসি সাহিত্য ও শিল্পের খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করেন, এখন মেতেছেন অকালমৃত পর্তুগিজ কবি ফের্নান্দো পেসোয়াকে নিয়ে। বিকাশ মেইজোঁ দ্য ল্যাঁদ, অর্থাৎ ইন্ডিয়া হাউজেরও পরিচালক। এই দম্পতির আন্তরিক আতিথ্যের কথা সুবিদিত।

প্যারিসের আর একজন শিল্পী সাহাবুদ্দিনও যেমন খ্যাতিমান তেমনই আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। তবে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কথা আমাদের আলাদা করে অন্য সময় লিখতে হবে। পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের চেয়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ। কিন্তু বিদেশে, অনেকগুলি দেশে, পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালিদের তুলনায় বাংলাদেশিদের সংখ্যা অনেক গুণ বেশি। একটা হিসেব পেয়েছিলাম জাপানে। টোকিও শহরে বাংলাদেশিদের দশ হাজার! তার কারণ কি, আমাদের এদিককার বাঙালিরা ঘরকুনো, ঝুঁকি নিতে ভয় পায়? কত বেকার ছেলে নিষ্কর্মা হয়ে থেকে থেকে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে, তবু দেশের বাইরে যেতে চায় না। আমার এক বন্ধু কয়েকটি হাত কচলানো বেকার যুবককে বলেছিল, আমার চাকরি দেবার ক্ষমতা নেই। কিন্তু তোমাদের আন্দামানে যাবার জাহাজ ভাড়া দিচ্ছি। সেখানে গিয়ে দেখো না কিছু চেষ্টা করে। সেখানে কাজ জুটে যেতে পারে। আন্দামান শুনেই চোখ গোল গোল করে তারা পিছিয়ে গেছে।

ইউরোপ-আমেরিকায় যেসব পশ্চিমবঙ্গীয়দের দেখা যায়, তারা অধিকাংশই ভালো ছাত্রছাত্রী, প্রথম দিকে পড়াশুনো ও নতুন চাকরিতে প্রচুর পরিশ্রম করতে হলেও কিছুদিন পরে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশের ভালো ছাত্রছাত্রী ও বিদ্বানদের সঙ্গে সঙ্গে তেমন লেখাপড়া না জানা হাজার হাজার মানুষ চরম অনিশ্চয়তা নিয়েও দেশ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে, দারুণ কষ্ট সহ্য করতে পারে, রেস্তোরাঁয় বাসন মাজার মতন যে-কোনও ছোট চাকরি নিতেও রাজি হয়ে যায়। তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক পরবর্তী জীবনে সাফল্যও অর্জন করে।

বাংলাদেশির মধ্যে অনেক খ্যাতিমান চিকিৎসক, স্থপতি, অধ্যাপক আছেন। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা ব্যবসা-বাণিজ্যে উদ্যোগী হয় না। প্রায় সবাই চাকুরিজীবী, বাংলাদেশিরা অনেকরকম ব্যবসা শুরু করে। নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইট নামে অঞ্চলটি প্রায় বাংলাদেশিরাই দখল করে নিয়েছে। ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট নামে যেগুলি চলে, তার অনেকগুলিরই মালিক বাংলাদেশি কিংবা পাকিস্তানি। সাহেবরা ইন্ডিয়ান ফুড চেনে, বাংলাদেশি বা পাকিস্তানি ফুড নামে কিছু এখনও জনপ্রিয় হয়নি। কোনও পাকিস্তানি শিল্পী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গাইলেও তা ইন্ডিয়ান মিউজিক। আমরা সবাই ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টের মানুষ, এই ভৌগোলিক পরিচয়টা মেনে নিলেই ঝামেলা চুকে যায়, কিন্তু অনেকের ‘ইন্ডিয়ান’ শব্দটি উচ্চারণেই আপত্তি।

অন্যান্য দেশের তুলনায় আমেরিকায় ছুটি কম, কাজ বেশি। মাইনে বেশি দেয়, তাই প্রচুর খাটিয়ে নেয়। চাকরির কোনও নিরাপত্তা নেই। যত উঁচু পদের কাজই হোক, যে-কোনওদিন ছাঁটাই হতে পারে যে কেউ। কোম্পানি তিন মাসের মাইনে ধরিয়ে দিয়ে বলবে, কাল থেকে আর আসতে হবে না। সেই জন্য প্রত্যেক দিনই নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়। ধ্রুব কুণ্ডু বলেছিল, আমেরিকায় সকাল বলে কিছু নেই, হয়তো সেই কারণেই সে আমেরিকায় থাকতে চায়নি। আমাদের এখানকার সকাল অনেক প্রলম্বিত, বিছানায় শুয়ে চা খাওয়া, অনেকক্ষণ ধরে খবরের কাগজ পড়া, তারপর থলি হাতে বাজার যাওয়া, যাওয়া-আসার পথে এর-তার সঙ্গে কুশল বিনিময়, সংক্ষিপ্ত আড্ডা, তারপর বাড়ি ফিরে অফিস যাওয়ার প্রস্তুতি, অনেকেই বাইরে লাঞ্চের বদলে ভাত-ডাল-মাছের ঝোল খেয়ে যায় বাড়ি থেকে। আর আমেরিকায় ভোরবেলা ঘুম ভাঙার পরই তড়াক করে লাফিয়ে নামতে হয় বিছানা থেকে। নিজেকেই বানাতে হয় চা কিংবা কফি, তাতে চুমুক দিতে দিতেই দাড়ি কামানো, তারপর টয়লেট, তারপর স্নান। চলতি ভাষায় যাকে বলে শেভ, শিট অ্যান্ড শাওয়ার, সবই অতি দ্রুত। তারপর একটা স্যান্ডুইচ কোনওক্রমে নাকেমুখে গুঁজে দৌড়। সে বাইরে ঝড়-বৃষ্টি হোক বা অবিরাম তুষারপাত, যেতেই হবে। বছরে বেশ কয়েক মাস এই সময়টা বাইরে অন্ধকার থাকে। অনেককেই গাড়ি চালিয়ে যেতে হয় এক ঘণ্টা বা তারও বেশি, অর্থাৎ কর্মস্থল পঞ্চাশ-ষাট মাইল দূরে, একটু বেলা করে বেরুলেই প্রবল ট্রাফিক জ্যামের সম্ভাবনা, তা নিয়ে প্রতিদিনের উৎকণ্ঠা। হয়তো এই জন্যই অনাবাসীদের মধ্যে হৃদরোগীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। স্বামী-স্ত্রীর সংসারেরও এই একই রুটিন, শতকরা পঁচানব্বইটি পরিবারে দুজনেই কাজে যায়, দুটি গাড়ি, একইরকম ব্যস্ততা। মেয়েদের অবশ্য দাড়ি কামাতে হয় না, কিন্তু তাদের চুল আঁচড়াতে বেশি সময় লাগে।

ভোরের আলো ফোটার আগেই যারা বেরিয়ে যায়, তারা ফেরে দিনের আলো শেষ করে। আসা-যাওয়াতেই যে সময় লাগে অনেক। তারপর ক্লান্ত শরীরে অন্য কিছু করার আর উদ্যম থাকে না, কিছুটা রান্নাবান্না করতেই হয়। আহারপর্ব শেষ করেই ঘুমের সাধনা, কেননা, পরদিন আবার ভোরে উঠতে হবে। রবিবারেও ছুটি নেই। অন্য কোনও কাজের লোক তো নেই, তাই বাগানের ঘাস ছাঁটা (না ছাঁটলে প্রতিবেশী বাঁকা মন্তব্য করবে কিংবা নিজের লন মোয়ার ধার দিতে চাইবে) থেকে শুরু করে রান্নাঘর পরিষ্কার, কার্পেটের ওপর ভ্যাকুয়াম ক্লিনার চালানো, (ঠান্ডার দেশ বলে মেঝেতে কার্পেট পাততেই হয় এবং নিয়মিত কার্পেটের ধুলি-মুক্তি না ঘটালে হাঁপানি হবার সম্ভাবনা থাকে) জামা-প্যান্ট কাচা, বাথরুমের কল সারানো, এমনকী ছাদের টালি মেরামত, এরকম হাজারটা কাজ থাকে। রবিবারই যেন পরিশ্রম বেশি।

এ তো এক যান্ত্রিক জীবন। অনেকেই এই যান্ত্রিকতা মেনে নেয়। মানুষের সভ্যতার যা শ্রেষ্ঠ ফসল, শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, এসব থেকে তারা বঞ্চিত। তুলনামূলকভাবে পশ্চিমবঙ্গীয়দের চেয়ে বাংলাদেশিরা যে জাতীয় সংস্কৃতি ও ভাষাকে ধরে রাখার ব্যাপারে অনেক বেশি নিষ্ঠার পরিচয় দেয়, তা অবশ্য স্বীকার্য। তারা ছেলেমেয়েদের বাংলা শেখায়, বাড়ির মধ্যে ইংরেজি বলে না। পশ্চিমবঙ্গীয়রা ছেলেমেয়েদের বাংলা শেখাবার চেষ্টাই করে না অনেকে, আর অনেকে প্রথম প্রথম একটু চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দেয়, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে শুধু ইংরিজিতে কথা বলে, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়াও পুরো ইংরিজিতে। মিয়েলে রাজ্জাক হাওলাদারের কিশোর পুত্র লম্বা একটা বাংলা কবিতা মুখস্থ শুনিয়ে আমাকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। কোনও প্রবাসী পশ্চিমবঙ্গীয়র বাড়িতে এমন অবাক হবার সৌভাগ্য আমার হয়নি।

ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। আলোলিকা এবং ভবানী মুখোপাধ্যায়ের একমাত্র কন্যার মুখে আমি কখনও কবিতা শুনিনি বটে কিন্তু তার বাংলা একেবারে নির্ভুল, উচ্চারণ নিখুঁত। ইঞ্জিনিয়ার হয়েও ভবানীর ওপর কাজের চাপের কোনও ছাপ পড়েনি। সদা প্রফুল্ল, আপন মনে গুনগুন করে গান গায়, সে তার ব্রাহ্মণত্বও বজায় রেখেছে, অনেক পুজোর পুরোহিত, আবার নাটকদলে বিশিষ্ট অভিনেতা। আলোলিকা বাচ্চাদের নাচ-গান শেখায়, অনেক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত, এবং নিয়মিত লেখিকা, বাংলার পাঠকদের কাছে সে পরিচিত।

ওয়াশিংটন ডিসি-র রমেন পাইন, জুলি তাদের দুই মেয়েকে যত্ন করে বাংলা শিখিয়েছে। ছোট মেয়েটি নৃত্যশিল্পী। রমেন-জুলি এক সময় চলে এসেছিল দেশে, এখানে টেলিভিশনে সংবাদ পাঠক হিসেবে প্রায়ই দেখা যেত রমেনকে। কিন্তু তার এক ছেলে প্রতিবন্ধী, তার চিকিৎসার প্রয়োজনেই ওরা আবার ফিরে গেছে। তার জন্য রমেনের মনোবেদনা রয়ে গেছে এখনও। আমেরিকার তুষারপাত দেখতে দেখতে রমেনের মনে পড়ে কোলাঘাটের কাছে কোথাও রাস্তার ধারে চায়ের দোকানে বসে ভাঁড়ের চা খাওয়ার কথা। প্রতি বছর সে আসে দেশে।

নূপুর লাহিড়ি অত্যন্ত ব্যস্ত ডাক্তার। নিজস্ব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানও চালাতে হয়, তবু সাহিত্য-সঙ্গীতের সঙ্গে তার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। সে কবিতা-গল্প লেখে, নিজের গানের ক্যাসেট আছে, বাড়িতে বাংলা বইয়ের লাইব্রেরি করেছে,

বেঙ্গল ফাউন্ডেশন নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে সে ওদেশের মানুষদের মধ্যে বাংলা সংস্কৃতি প্রচারের চেষ্টা চালিয়েছে। আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডাও দিতে পারে, চোখের নিমেষে রেঁধে ফেলতে পারে দশ-পনেরো জনের সুখাদ্য, তার এক শরীরে যেন পাঁচ রমণীর জীবনীশক্তি। একবার কলকাতায় এসে এয়ারপোর্ট থেকে সে সোজা চলে এসেছিল বইমেলায়। দীর্ঘ বিমানযাত্রার পর ক্লান্ত শরীরে বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নেবার বদলে বইমেলা দেখতে যাবার মতন ইচ্ছে এবং জীবনীশক্তি সারা পৃথিবীতে বোধহয় একমাত্র নূপুরেরই আছে। সেবার বইমেলায় আগুন লেগেছিল, বহু স্টল পুড়ে যায়। পরে, ক্ষতিগ্রস্ত প্রকাশকদের সাহায্যকল্পে কিছু পোড়া বই নিলাম হয়েছিল, সর্বোচ্চ দাম দিয়ে একটি অর্ধদগ্ধ গ্রন্থ এই নূপুর লাহিড়িই কিনে নিয়ে যায় সুভেনির হিসেবে।

এবং গৌতম দত্ত। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, তবে চাকরির বদলে তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান। খুবই ব্যস্ত থাকার কথা, তবু সে কবিতা লেখে, কবিতার আলোচনায় মশগুল হয়ে যায়। এবং তার প্রবল নেশা নাটকে। শুধু অভিনয় নয়, পরিচালনা এবং প্রযোজনায়। ইংরিজি এবং বাংলা নাটক। গত বছরই সে ‘প্রথম আলো’ নামে একটি নাটকের প্রযোজনা ও পরিচালনার দায়িত্ব নেয়, বিরাট লম্বা নাটক, অভিনেতা-অভিনেত্রী প্রায় তিরিশজন। কর্মব্যস্ত এতগুলি মানুষকে জড়ো করে মাসের-পর-মাস রিহার্সালের ব্যবস্থা করা কম কথা নয়, তারপর পূর্ব উপকূলের সাতটি শহরে, এর মধ্যে খোদ নিউ নিয়র্কের ম্যানহাটনেও ঘুরে ঘুরে হয়েছে এই নাটকের অভিনয়। পুরো সেট ও লটবহর নিয়ে যেতে হয়েছে টাক ভাড়া করে ও নিজেরা টাক চালিয়ে, প্রত্যেক জায়গায় মঞ্চসজ্জা ও তা গুটোনার ভারও নিতে হয়েছে নিজেদের, এসব নিদারুণ পরিশ্রমসাধ্য কাজ। অবশ্য গৌতমকে সবসময় সাহায্য করেছে তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দেশের ছেলেরা দেশে থাকলে এত পরিশ্রম করতে চায় না, হয়তো আবহাওয়ারই দোষ, বিদেশে গিয়ে তারা কোনও পরিশ্রমের কাজেই পিছু-পা হয় না। গৌতম ও তার বন্ধুরা যে এত খাটাখাটনি করেছে, তাতে তাদের অন্য কোনও লাভের প্রশ্ন নেই, নিছক নাটকের প্রতি ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের টান। শুধু অভিনয় নয়, এঁদের অনেকের সঙ্গীতপ্রতিভাও বিস্ময়কর। গৌতমের স্ত্রী মুনিয়া এমনই অসাধারণ অভিনয় করে যে দেশে থাকলে সে অনায়াসে সিনেমার হিরোইন হতে পারত।

অনেক আসরে কারও কারও গান শুনে কিংবা নাচ দেখে মনে হয়েছে, দেশে থাকলে তাদের প্রতিভা আরও বিকশিত হত, বিখ্যাতও হতে পারত। কারও কারও কবিতা বা গল্প দেখেও মনে হয়, আরও একটু চর্চা থাকলে তারা সার্থক লেখক হতে পারত, বিদেশে বসে তার সুযোগ খুব কম।

জ্যোতির্ময় দত্তর কথা মনে পড়লেই আমার এক ধরনের কষ্ট হয়। সাধারণত অধিকাংশ ছেলেমেয়েই দেশ ছেড়ে যায় অল্প বয়েসে, জ্যোতি দত্ত আর মীনাক্ষী গেলেন প্রায় মধ্য বয়েসে। জ্যোতির বিদেশে থিতু হওয়ায় বাংলা সাংবাদিকতায় ও সাহিত্যে এক দারুণ ক্ষতি হয়ে গেল! জ্যোতি ওখানেও ইংরিজি সাংবাদিকতা করছেন, কিন্তু সেরকম তো আরও কতই আছেন, কিন্তু কলকাতায় তিনি ছিলেন এক অনন্য রঙিন ব্যক্তিত্ব। সবসময়ই তিনি কিছু-না-কিছু অভিনব পরিকল্পনায় শহর মাতিয়ে রাখতেন। মীনাক্ষীও কলকাতার একটি বিশেষ আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বুদ্ধদেব বসু-প্রতিভা বসুর বাড়ির আড্ডা চালিয়ে যাচ্ছিলেন মীনাক্ষী, চলে গেলেন নিউ ইয়র্ক। অবশ্য মীনাক্ষী ওখানকার টেগোর সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।

উজ্জ্বল ব্যতিক্রমী কিছু কিছু মানুষ ছড়িয়ে আছেন এত বড় দেশে, তাঁদের অনেকের কথাই আমি জানি না। যেমন ইংল্যান্ডে আমি অনেকবারই গেছি বটে, কিন্তু সেখানকার বেশি বাঙালিদের সঙ্গে আমার পরিচয়ের সুযোগ ঘটেনি। আমার বাল্যবন্ধু ভাস্কর দত্ত প্রতিবার এয়ারপোর্টে এসে খপ করে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেত তার বাড়িতে। তারপর আর ঘোরাঘুরি করা হত না। ভাস্কর চরম আড্ডাবাজ, সে বলত বোস না, কোথায় যাবি? মলয় ঠাকুর, অমলেন্দু বিশ্বাসের মতন কয়েকজন এসে যোগ দিত সেই আড্ডায়। ১৯৬৫ সালে দেশ ছাড়ার সময় ভাস্কর বলেছিল, বিলেতে আমার নামে একটা রাস্তা করে তারপর দেশে ফিরব। ওর নামে রাস্তা হয়নি বটে, কিন্তু ভাস্কর দুটো কারখানা কিনেছিল, সেখানকার ইংরেজ কর্মচারীরা ভাস্করকে দেখে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে গুড মর্নিং মিস্টার ডাটা বললে ভাস্কর আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপত। আমরা পরাধীন আমলে জন্মেছি, তাই বিলেতে গিয়ে সাহেব মুচি দিয়ে জুতো পালিশ করিয়ে পরম শ্লাঘা বোধ করেছি। চাকরিজীবনে ভাস্কর যখন-তখন আমাদের পেয়ে গেলেই বলত, আজ আর অফিস যেতে ভালো লাগছে না। কারখানার মালিক হবার পর আর ওকে পায় কে, আমি নানা কারণে ফ্রান্স, জার্মানি কিংবা বেলজিয়ামে গেলে ভাস্করও সেখানে উপস্থিত। উদ্দেশ্য, স্রেফ আড্ডা।

আর কখনও কখনও গিয়ে থেকেছি রাখী ও নবকুমার বসুর বাড়িতে। সেটা অবশ্য লন্ডন শহর থেকে অনেক দূরে—স্ক্যানথর্প নামে একটি জায়গায়। এই দম্পতি দুজনেই ডাক্তার। নবকুমারের মতো বাংলা সাহিত্য সঙ্গীতকে এমন প্রাণের সঙ্গে আঁকড়ে ধরার মতো উৎসাহ কম লোকেরই দেখা যায়। ব্যস্ত ডাক্তার হয়েও সে প্রতিদিন লিখতে বসে। এ ছাড়া সে চমৎকার গান গায়, তবলা ও হারমোনিয়াম বাজায়। সুতরাং তার বাড়িতে গেলে চমৎকার সময় কাটে। রাখী ডাক্তার হিসেবে ব্যস্ততর। তবু সে ফাঁকে ফাঁকে যেমন রান্না করে, তেমনই বাংলা বই ও বাংলা সাহিত্যের সব খবর রাখে।

তবু এর মধ্যে অক্সফোর্ডে একবার গিয়েছিলাম নীরদচন্দ্র চৌধুরীর বাড়িতে। তখন তাঁর বয়েস চুরানব্বই। তাঁর পাণ্ডিত্য ও স্মৃতিশক্তির চেয়েও তাঁর শারীরিক তৎপরতার অহংকার বেশি বিস্মিত করেছিল। একটা হাতলহীন চেয়ার দেখিয়ে তিনি জিগ্যেস করেছিলেন, কিছু না ধরে এই চেয়ারে উঠে দাঁড়াতে পারবেন? আমরা (সঙ্গে বাদল বসু ও ভাস্কর) চেষ্টা করারই সাহস পাইনি, চুরানব্বই বছর বয়স্ক গ্রন্থকীটটি কিন্তু সেটা অনায়াসে করে দেখালেন।

ওঁরই প্রতিবেশী ছিলেন প্রখ্যাত দার্শনিক বিমলকৃষ্ণ মতিলাল। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে তেমন সৌহার্দ্য ছিল না বোধ হয়। নীরদচন্দ্র যেমন প্রতি কথায় টুকটুক করে আদিরসাত্মক ইয়ার্কি ঢুকিয়ে দিতেন, সে তুলনায় বিমলকৃষ্ণ মতিলাল শান্ত, লাজুক ধরনের। কীভাবে মৃত্যুকে জয় করা যায়, এ বিষয়ে খুব সুন্দর আলোচনা করেছিলেন। তিনি জানতেন, তাঁর মৃত্যু আসন্ন।

বৈদগ্ধ্য ও পাণ্ডিত্যের জন্য যিনি আন্তর্জাতিক প্রসিদ্ধি পেয়েছেন, সেই তপন রায়চৌধুরী ঘরোয়া আলাপে তাঁর পরিচিতদের নানান রসিকতায় মুগ্ধ করে রাখেন। তাঁকে বলা যায় সৈয়দ মুজতবা আলীর উত্তরসুরি। এক দিকে যেমন রচনা করেছেন, ‘ইউরোপ রিকনসিডারড’, তেমনই বাংলায় লিখেছেন চমৎকার উপভোগ্য বই, ‘রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা’। তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় অবশ্য যৎসামান্য।

অপর এক ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ সাবলর্টান হিস্ট্রির জন্য প্রসিদ্ধ, থাকেন ভিয়েনায়। আমি কখনও অস্ট্রিয়ায় যাইনি, ওঁর সঙ্গে একবার মাত্র দেখা হয়েছে কলকাতায়। আমাকে অবাক করে উনি আলোচনা করেছিলেন বাংলা কবিতা এবং কৃত্তিবাস পত্রিকা বিষয়ে। ইতিহাস বিষয়ে যে আমি একেবারেই অজ্ঞ, তা উনি কী করে যেন বুঝে গিয়েছিলেন। পাতলা চেহারা, ছোটখাটো মানুষটি, বয়েস হয়েছে, তিনি দুবার বললেন, আমার বোধহয় আর ইহজীবনে কলকাতায় আসা হবে না। সে কথাটা আমার কানে এখনও বাজে।

জার্মানিতেও আমার পরিচয়ের পরিধি খুব কম। গেলে প্রধানত দেখা হয় অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর সঙ্গে। কিংবা বার্লিনে পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়, মাধুরীর বাড়িতে। এবং ফ্রাঙ্কফুর্টের হাবিবুল্লাহ বাবুল আমি যেখানেই থাকি তার বাড়িতে ধরে নিয়ে যাবেই। তারপর সে আর তার স্ত্রী বকুল কত কী যে রান্না করবে তার ঠিক নেই, দলে দলে এসে পড়বে ওদের বাংলাদেশি বন্ধুরা। তখন আমিও বাংলাদেশি হয়ে যাই। জন্মসূত্রে সে দাবি তো আমার আছেই।

ষাট সত্তরের দশকে যাঁরা বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন, তাঁরা অনেকেই এখন পরবর্তী প্রজন্ম সম্পর্কে চিন্তিত। ওদেশে জন্ম, ওদেশে স্কুল-কলেজে শিক্ষা, সেইসব ছেলেমেয়েদের গায়ের রং ছাড়া আর কোনও বাঙালি বা ভারতীয় পরিচয় কি অবশিষ্ট থাকবে? মাতৃভাষা কিংবা পিতৃভাষা প্রায় কেউই শেখে না, কেউ কেউ কথা বলতে পারলেও অক্ষর জ্ঞান হয় না, সুকুমার রায় বা রবীন্দ্রনাথের স্থান থাকবে না তাদের জীবনে? অনেক পরিবারেই বাবা-মায়েরা হাল ছেড়ে দিয়েছেন, আবার সুইজারল্যান্ডের পূর্ণেন্দু চৌধুরীর মতনও কেউ কেউ আছেন, যিনি তাঁর ছেলেকে কঠোর নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন, বাইরে থেকে এসে সদর দরজা পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকলেই সমস্ত কথা বাংলায় বলতে হবে। তাঁর স্ত্রী শিখা একদিন হাসতে হাসতে বলেছিলেন, একদিন ছেলেটা দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, কী একটা বাংলা কথা মনে পড়ছে না, সেজন্য ভেতরে ঢুকতেই পারছে না।

কোথাও কোথাও অভিভাবকরা রবিবার সকালে নিজস্ব একটা স্কুল চালাবার চেষ্টা করেন। কাছাকাছি বাঙালি পরিবারের ছেলেমেয়েদের জড়ো করে শেখানো হয় বাংলা ভাষা, বাংলা গান, তাদের দিয়ে অভিনয় করানো হয় ছোট ছোট নাটক। যদি এর কিছু অন্তত পরবর্তী জীবনে মনে রাখতে পারে। নিউ ইয়র্কের লং আয়ল্যান্ডে ডাক্তার কুমারশঙ্কর মণ্ডলের সমুদ্রের ধার ঘেঁষা বাড়িতে তাঁর বন্ধুবান্ধবদের সহায়তায় এরকম একটি স্কুল চলে, সেখানে ছোট ছেলেমেয়েদের আবৃত্তি, নাচ ও নাটক দেখেছি। ব্যস্ত ডাক্তার, তাঁর বন্ধুরাও ব্যস্ত, তবু ছেলেমেয়েদের মধ্যে কিছুটা অন্তত বাংলা সংস্কৃতির ছোঁয়া রাখতে তাঁদের পরিশ্রমের ক্লান্তি নেই। বিদেশে বসে বাংলা পত্রিকাও প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। লন্ডনের হিরন্ময় ভট্টাচার্য বহুদিন ধরে সম্পাদনা করেছেন ‘সাগর পারে’। ওহায়ো’র কলম্বাস থেকে তনুশ্রী ভট্টাচার্য ও প্রভাত দত্ত এক সময় বার করেছেন অতলান্তিক। নিয়মিতভাবে পত্রিকা প্রকাশ করা খুবই শক্ত, অর্থসংকটের চেয়েও ভালো লেখা সংগ্রহ করা বেশ কঠিন। এখন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে দেবী ও সুকান্ত ঘোষ প্রকাশ করে চলেছেন উৎসব। বলাই বাহুল্য, এ ব্যাপারে বাংলাদেশিদের উদ্যম অনেক বেশি। শুধু নিউ ইয়র্ক অঞ্চল থেকেই প্রকাশিত হয় ওঁদের ন’টি বাংলা পত্রপত্রিকা, পশ্চিমবঙ্গীয়দের একটাও নয়।

পশ্চিমবাংলার বাঙালিরা ব্যবসা করে না, এ কথাটা লেখা আমার ভুল হয়েছে। অন্তত তিনজন বড় আকারের বাঙালি ব্যবসায়ীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে কানাডায়, তাঁদের কারখানা কিংবা অফিসও দেখেছি। টরেন্টোর গোরা আদিত্যকে সবাই এক ডাকে চেনে। সুপুরষ গোরা আদিত্য প্রথম জীবন শুরু করেছিলেন সাধারণ কেমিস্ট হিসেবে, এখন এক কোটি ডলারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। তাঁর মেড-কেম ল্যাবরেটরিজ-এ কর্মচারীর সংখ্যা পাঁচশোরও বেশি এবং অন্টারিও প্রদেশে এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্লিনিক। খুব ফরসা রং, প্রথম দর্শনে তাঁকে দেখে মনে হয় পাক্কা সাহেব, কিন্তু অসম্ভব প্রীতি আছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। এবং কলকাতার প্রতি প্রবল টান।

আবার দীপ্তি দত্তর চেহারায় একটুও সাহেবি ছাপ নেই, খাঁটি বাঙালি মুখ, কিন্তু একটাও বাংলা কথা উচ্চারণ করেন না। তাঁর পরিচালনায় এম অ্যান্ড আই পাওয়ার কর্পোরেশন একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ উৎপাদনের বয়লার বিশেষজ্ঞ দীপ্তি দত্ত খুবই সার্থক, সারা পৃথিবীর বড় বড় কোম্পানির কাছ থেকে অর্ডার পাচ্ছেন, খুবই ব্যস্ত, তবু তিনি পশ্চিমবাংলার মান্ধাতার আমলের বয়লারগুলির মেরামতি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নতিতে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে, লাভের চিন্তা না করে। কারণ, তিনি এক সময় গরিব অবস্থায় ছাত্রজীবন কাটিয়েছেন এই কলকাতায়, সেই ঋণ শোধ করতে চান। কিন্তু সরকারি বিভাগের গড়িমসি ও ফাইল চালাচালিতে তিনি বিরক্ত, ক্রুদ্ধ ও বেদনার্ত। আমাকে তিনি বললেন, কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংসের লোকেরা একের পর এক চিঠি লিখে যাচ্ছে, তারা চিঠি লিখতে ভালোবাসে, আমি বুঝি কাজ। চিঠি লেখা মানে সময় নষ্ট, সময় নষ্ট মানেই আর্থিক ক্ষতি।

দীপ্তি দত্ত একটাও বাংলা বলছিলেন না কেন? এমনকী কথা প্রসঙ্গে হঠাৎ শরৎচন্দ্রের কথা এল, অর্থাৎ তিনি বাংলা বই পড়েছেন, তবু সে কথাও ইংরিজিতে। ইনি নিশ্চয়ই বাংলা ভুলে যাননি, ষোলো বছর বয়েস পর্যন্ত মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, তা সারা জীবনে ভোলে না। তাঁর আদি নিবাস ছিল পূর্ববঙ্গে, আমার মনে হল, তাঁর বাংলা উচ্চারণে খুব সম্ভবত বেশিরকমের পূর্ববঙ্গীয় (বাঙাল) অ্যাকসেন্ট রয়ে গেছে, বিশেষত সিলেট ও চিটাগাং-এর মানুষদের থেকে যায়, সেই জন্যই অন্যদের সামনে বাংলায় মুখ খুলতে চান না।

শঙ্কর সরকার আবার খাঁটি বাঙালি। তাঁর জেনারেল ইলেকটিক সুইচ অ্যান্ড গিয়ার বেশ বড় কারখানা, তিনি একার উদ্যমে গড়ে তুলেছেন। কারখানার শেডে বিরাট বিরাট যন্ত্রে উৎপাদন চলছে, তিনি ঘুরে ঘুরে দেখালেন, যেন সেসব তাঁর স্বপ্নের সার্থকতা। অনেক বাঙালিকে সেখানে কাজ দিয়েছেন তিনি। নিজের ছেলেকেও বসিয়েছেন। আমাকে ও দীপ্তেন্দু চক্রবর্তীকে নিয়ে তিনি দুপুরবেলা খেতে গেলেন এক রেস্তোরাঁয়, শোনালেন তাঁর ভবিষ্যতের অনেক পরিকল্পনা, তাঁর কথাবার্তা যেন অনেকটা কোনও ধুতি-পাঞ্জাবি পরা অধ্যাপকের মতন। কয়েকদিন পরেই হঠাৎ শুনলাম, শঙ্কর সরকার পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। এখনও রয়ে গেছে তাঁর স্বপ্ন।

বাঙালিয়ানার প্রশ্নে আমার এমন একজনের কথা মনে পড়ে, যাঁর তুল্য মানুষ আমি পৃথিবীতে আর একজনও দেখিনি। তাঁর নাম কান্তি হোর। ১৯৯২ সালে তিনি ছিলেন টরেন্টোর বঙ্গ সম্মেলনের সভাপতি। এই বঙ্গ সন্মেলনের বিভিন্ন শহরে আমি কয়েকবার গেছি, কিন্তু কান্তি হোরের নেতৃত্বে সেবারের উৎসব ছিল সবচেয়ে সুশৃঙ্খল এবং আকর্ষণীয়। সেই থেকে তাঁর সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ রয়ে গেছে।

আমার চেনাজানাদের মধ্যে কান্তিবাবুর প্রবাসজীবনই সবচেয়ে দীর্ঘ, পঞ্চাশ বছরেরও বেশি তিনি দেশ ছাড়া। এর মধ্যে বেশ কিছু বছর তিনি কাটিয়েছেন ইকুয়েডরের মতন এমন জায়গায়, যেখানে একজনও বাঙালি নেই। অথচ কান্তিবাবুর বাংলা এখনও নির্ভুল ও সাবলীল, তিনি ইংরিজি ও জার্মান ভাষার মতন স্প্যানিশও জানেন খুব ভালো, অথচ বাংলা বলার সময় অন্য ভাষা মিশিয়ে ফেলেন না। এই টেলিফোন ও ই-মেলের যুগেও কান্তিবাবু চিঠি লিখতে ভালোবাসেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে তাঁর চিঠি পাই বাংলায়, নির্ভুল বাংলায় এবং তাঁর হস্তাক্ষর সত্যিই মুক্তোর মতন। অর্ধেক শতাব্দীরও বেশি সময় দেশের বাইরে থেকে তিনি বাংলা ভাষাকে এরকমভাবে ধরে রাখতে পেরেছেন, আশ্চর্য, আশ্চর্য! মানুষটি দারুণ আড্ডাপ্রিয়, বয়েস সত্তর ছাড়িয়ে গেছে, তবু যুবকের মতন রাত্রি জাগরণ, আড্ডা, বিয়ার পান ও ধূম্র পানে তাঁর জুড়ি নেই। কলকাতায় বেশি আসতে পারেন না। তবু তিনি এখানকার সাহিত্য, থিয়েটার, সিনেমার সব খবর রাখেন এবং ভদ্রতার প্রতিযোগিতায় তাঁর সঙ্গে খুব কম মানুষই এঁটে উঠতে পারবেন।

স্বভাবে মিল নেই, তবু কান্তিবাবুর সঙ্গে এখন বিশেষ বন্ধুত্ব হয়েছে মিয়েল ছেড়ে টরেন্টোতে আসা অশোক চক্রবর্তীর। ইনি কবিতা লেখেন, তবে মানুষটি ছটফটে ধরনের, ধূমপান বিরোধী এবং অ্যালকোহলেও বিশেষ আসক্তি নেই। বিপরীত স্বভাবের হলেই বোধ হয় বন্ধুত্ব বেশি হয়। মিলও আছে এক জায়গায়। অশোক চক্রবর্তী বাংলা ভাষার প্রসার ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ উৎসাহী, ওঁর স্ত্রী ভারতীয় শিল্প-সাহিত্যের গুণগ্রাহী এবং অতিথিবৎসল। কান্তি হোড় অবশ্য চিরকুমার।

ক্যালিফোর্নিয়ার ডাক্তার মদনগোপাল মুখোপাধ্যায়ও জাগতিক বিষয়ে অত্যন্ত সার্থক হয়েও কায়-মন-বাক্যে খাঁটি বাঙালি রয়ে গেছেন। ওঁর স্ত্রী ডলিও সুযোগ্যা সহধর্মিণী, ছেলে মেয়ে দুটিও স্বাভাবিকভাবে বাংলা বলে, ওঁদের প্রাসাদোপম বাড়িতে বেশ বাংলা বাংলা পরিবেশ। মদন খুবই ব্যস্ত ডাক্তার। তবু তিনি বাংলা সাহিত্যে নিমগ্ন, সুদীর্ঘকাল ‘দেশ’ পত্রিকায় আমেরিকা চিঠি লিখেছেন, তাঁর নাটকের বইও আছে।

আমেরিকা যৌবনের দেশ। বুড়ো-বুড়িদের অবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই করুণ, কেউ খোঁজখবর নেয় না। আমাদের অনাবাসীরা অনেকেই মধ্যজীবনে ভেবেছেন যে রিটায়ার করার পর লক স্টক অ্যান্ড ব্যারেল ফিরে যাবেন দেশে। কেউ কেউ সল্ট লেকে ফ্ল্যাট বা শান্তিনিকেতনে বাড়ি করে রেখেছেন। কিন্তু সেরকমভাবে অনেকেরই ফেরা হয় না। ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে, তাদের জন্য বা নাতি-নাতনিদের জন্য মায়া থেকে যায়। বৃদ্ধ বয়েসে অনেকের আরও মনে হয়, অসুখবিসুখ হলে দেশের চিকিৎসা খুবই খারাপ, হাসপাতালগুলোর যা বীভৎস অবস্থা, তার থেকে ওইসব দেশে চিকিৎসার জন্যই থেকে যাওয়া ভালো। অবশ্য আমেরিকায় চিকিৎসা যেমন ব্যয়সাধ্য, সেরকম টাকা খরচ করলে এদেশে রাজার হালে থাকা যায়, ডাক্তার আসবে বাড়িতে, চব্বিশ ঘণ্টার নার্স রাখা যাবে।

অনেকে পাকাপাকি না ফিরে শীত-গ্রীষ্মের অবস্থান দুরকম করে নিয়েছেন। ওদেশে শীতের সময় বেশ কষ্ট হয়। এদেশে শীত বেশ উপভোগ্য। এদেশের গরম অসহ্য, তখন ওদেশ বেশ মনোরম। প্রতিবছর তিন মাস দেশে কাটিয়ে গেলে দেশের স্বাদ-গন্ধ, টাটকা সবজি ও মাছের স্বাদ পাওয়া যায়, এখানকার শীতকালেই তো নানারকম সাংস্কৃতিক উৎসব হয়।

সেরকমই প্রতি বছর আসেন করবী নাগ ও মণি নাগ। মাস কয়েকের জন্য তাঁরা কলকাতা বা শান্তিনিকেতনের নানান অনুষ্ঠানে হাজিরা দেন। মণিদা কিছু কিছু সামাজিক কাজের সঙ্গেও যুক্ত এখানে। শান্তিনিকেতনের রাস্তায় বাচ্চু রায়কে (হিতব্রত রায়, রজনীকান্ত সেনের নাতি, নিজেও চমৎকার গান করেন) হাঁটতে দেখলেই বোঝা যায় ভার্জিনিয়ার দিকটায় শীত পড়ে গেছে, তিনি সেখান থেকে উড়ে এসেছেন। বাচ্চু রায়কে মনে হয় চিরতরুণ, তিনি গানে-গল্পে মাতিয়ে রাখেন সবাইকে। দেখতে পাওয়া যায় লন্ডনের নিমাই ভট্টাচার্যকে। তিনিও খুব আড্ডাবাজ। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত তাঁর স্ত্রী টুডবার্টাকে নিয়ে শীতকাল ছাড়াও কোনও কোনও গ্রীষ্মকালেও এসে পড়েন। যেমন ব্রুকলিনের যামিনী মুখোপাধ্যায়। সাহিত্য ও শিল্প দুটোতেই সমান আকর্ষণ। কলকাতার শিল্পীমহলে তিনি বিশেষ পরিচিত। তাঁর স্ত্রী সুমিত্রা চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে সম্প্রতি, অনেকেরই তিনি খুব প্রিয় ছিলেন। আরও আসেন অনেকেই। এঁদের বলা হয় শীতের পাখি। এঁদের আগমনে কলকাতা শহরটা বর্ণময় হয়ে ওঠে।

বাঙালিদের মধ্যে ঐশ্বর্য ও খ্যাতিতে অনেকেই খুব উচ্চস্থানে উঠেছেন। তাঁদের সঙ্গে আমার পরিচয়ের সুযোগ হয় না। দু-হাজার সালে কলকাতায় বিশ্ব বঙ্গ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাতে সারা বিশ্বের সব দেশ থেকে কৃতি বাঙালিদের এখানে আহ্বান করে আনার কথা ছিল। সে উৎসব অবশ্য শেষ পর্যন্ত তেমন জমেনি। সেই উপলক্ষে একটি বৃহদাকার স্মারকগ্রন্থ সম্পাদনার ভার পড়েছিল আমার ওপর। কবি সুবোধ সরকারের সহায়তায় উৎসবের শুরুতেই সেটি প্রকাশ করতে পেরেছিলাম, সেটাই এক মাত্র। আরও অনেক পরিকল্পনা বাতিল হয়ে গিয়েছিল। সেই স্মারকগ্রন্থটিতে বহু কৃতি বাঙালির পরিচিতি ও ছবি আছে। তাঁরা প্রায় সকলেই ডাক্তার কিংবা বিজ্ঞানী কিংবা ব্যবসায়ী বা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদাধিকারী। সেই সময় রটে গিয়েছিল যে আমেরিকার বাঙালিদের মধ্যে সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি ড. মণিলাল ভৌমিক। বাংলায় তাঁর একটি জীবনীগ্রন্থও বেরিয়ে গেল। তাঁর উত্থানকাহিনি রূপকথার মতন। তমলুকের কাছে একটি অকিঞ্চিৎকর গ্রামে তাঁর জন্ম, স্কুলে যেতেন খালি পায়ে। মেধা ও পরিশ্রমের সহযোগে আজ তিনি বিশিষ্ট এক বিজ্ঞানী। পঞ্চাশের ওপর গবেষণাপত্র এবং এক ডজন মার্কিন পেটেন্ট। বহু সম্মানে যেমন তিনি ভূষিত, তেমনই এসেছে প্রচুর অর্থ।

আমাদের স্মারকগ্রন্থটির জন্য খরচ হয়েছিল প্রচুর। তার কমিটি মেম্বাররা ঠিক করেছিলেন অনাবাসী সম্পন্ন বাঙালিদের কাছ থেকে ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনের বিনিময়ে ভালোরকম অর্থ আদায় করা হবে। যে-কোনও প্রকাশনার চতুর্থ মলাটটিই বিজ্ঞাপনের জন্য সবচেয়ে দামি, আমরা সেই মলাটটি ড. মণিলাল ভৌমিকের জন্য ধার্য করে রেখেছিলাম, একেবারে শেষ মুহূর্তে ফ্যাক্স বার্তা এল, ওই জায়গায় নাম যাবে ডাঃ কালীপ্রদীপ ও সুনন্দা চৌধুরীর। ইনিই নাকি ধনসম্পদ অধিকারী হিসেবে এক নম্বর। ডঃ মণিলাল ভৌমিক ফিজিক্স-এর বিজ্ঞানী, আর ডাঃ কালীপ্রদীপ চৌধুরী আগে ছিলেন চিকিৎসক, পরে বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ও চিকিংসা প্রতিষ্ঠানের মালিক, রিয়েল এস্টেট এবং বিনোদন শিল্পেও তাঁর বাণিজ্য বিস্তৃত। ক্যালিফোর্নিয়ার হ্যামেট ভ্যালিতে তাঁর নামে একটি রাস্তা হয়ে গেছে, চৌধুরী সার্কল।

হলদিয়া পেটোকেমিক্যালস এবং অন্যান্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্য পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের নাম এখানে যথেষ্ট পরিচিত। আমাদের এখানকার আই আই টি-র ছাত্র এবং বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পি এইচ ডি পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় তুলনামূলকভাবে অল্প বয়েসেই শিল্প-বাণিজ্যের জগতে তাঁর মেধার জোরে খুব বড় ভূমিকা নিতে পেরেছেন। আবার এ দেশে অনেকেই যাঁর নাম জানেন না, কিন্তু হলিউডের তারকারা যাঁর কাছে ছুটে যান, সেই বাঙালিটির নাম বিক্রম চৌধুরী। যোগাসনের শিক্ষার জন্য তিনি প্রসিদ্ধ। এলিজাবেথ টেলর, মাইকেল জ্যাকসন, ব্রুক শিল্ড প্রমুখ তাঁর রুগি। বেভারলি হিলস-এ তাঁর যোগাসন কলেজ।

সার্থক বাঙালি হিসেবে পরিতোষ চক্রবর্তী, ডাঃ ব্রজদুলাল মুখার্জি, ডঃ কানু চ্যাটার্জি, ডঃ শান্তনু দাশ, দিলীপ মল্লিক, ডঃ কিরণময় দাশ, স্বাতী এল মৈত্র, রণজিৎকুমার দত্ত, কৃষ্ণা লাহিড়ী, অজিতকুমার রক্ষিত প্রমুখদের নাম দেখেছি, কিন্তু এঁদের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানি না।

আর অমর্ত্য সেন? তাঁর কথা এর কোনও তালিকাতেই আঁটানো যায় না। তিনি অনন্য। এবং এখনও তিনি ভারতের নাগরিক। কিংবা বলা যায়, বাঙালি হয়েও বিশ্ব নাগরিক।

এই পর্যন্ত লেখার পর মনে পড়ল, অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে তো কিছু লেখা হল না। এখন সে-মহাদেশেও বহু সংখ্যক বাঙালি ও বাংলাদেশির বসতি। তাঁদের অনেকের মতে ইউরোপ-আমেরিকার চেয়েও অস্ট্রেলিয়ার জীবনযাত্রা অনেক বেশি আরামের এবং টেনশন কম। বর্ণবিভেদ এবং জাতিগত বিভেদ অনুভবই করা যাবে না। কেউ কেউ এখন আমেরিকা ছেড়ে চলে আসছেন অস্ট্রেলিয়ায়। যেমন শ্রীমন্ত মুখোপাধ্যায়, এক সময় থাকতেন বস্টনে, এখন সিডনিতে। শ্রীমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণে আমি সস্ত্রীক সিডনিতে গেছি, তার স্ত্রীর নাম মিষ্টি (ভালো নাম নিশ্চয়ই একটা আছে, কিন্তু এই নামটাই তাকে ঠিক ঠিক মানায়) আমাদের কত যত্নই না করেছে। ওদের ব্যবস্থাপনায় আমরা অস্ট্রেলিয়ায় বেশ কয়েকটি জায়গায় ঘুরেছি, বহু বাঙালির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। অনেকের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছি। অনেকেই সেখানে কৃতি হয়েছেন। তাঁদের কথা লিখতে হলে আর একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় দরকার। কিন্তু আর সময় নেই যে! বারান্তরে দেখা যাবে।

দেশ

কিন্তু মাতৃভাষা ছাড়া কি সাহিত্যসৃষ্টি সম্ভব?

জোসেফ কনরাড জাতে পোলিশ, কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যের প্রতিষ্ঠিত লেখক। নবোকভ আগে লিখতেন রুশ ভাষায়, কিন্তু দেশত্যাগ করার কিছুদিন পর দিব্যি ইংরেজিতে লিখতে শুরু করলেন। ‘লোলিটা উপন্যাসটির বিশেষ আকর্ষণই হল এর ভাষার খেলা। জর্জ বার্নার্ড শ কথ্য ইংরেজি মুখস্ত করতে করতে যুবা বয়সে লন্ডনে এসেছিলেন, তারপর তিনি ইংরেজি ভাষায় দিগবিজয় করেন। বস্তুত বেশ কয়েকজন আইরিশ নিজেদের মাতৃভাষা কেলটিক ছেড়ে ইংরেজি সাহিত্যের মহারথী। ইয়েটস, জেমস জয়েস—এরকম কত নামই তো করা যায়। আর এক আইরিশ, স্যামুয়েল বেকেট আবার তাঁর বিশ্ববিখ্যাত বইগুলি লেখেন ফরাসি ভাষায়। তবু এগুলোকেও ব্যতিক্রম বলেই গণ্য করতে হয়। মাতৃভাষা ছাড়া সাহিত্য সৃষ্টি হয় না। এরকমই তো আমাদের বিশ্বাস। অন্য ভাষা শিখে প্রবন্ধ কিংবা দুর্বোদ্য, নীরস গবেষণাপত্র রচনা করা যায়। কিন্তু রসসাহিত্য সৃষ্টি করতে পারে ক’জন? আমাদের চোখের সামনেই তো বহুকাল ধরে জাজ্জ্বল্যমান উদাহরণ মাইকেল মধুসূদন।

টি এস এলিয়টের নির্বাচিত কবিতার শেষ দিকে তাঁর লেখা কয়েকটি ফরাসি কবিতা আছে। আমার ফরাসি জ্ঞান নেই, তবে আমার এক ফরাসি বান্ধবী বলেছিল এ কবিতাগুলোতে ঘামের গন্ধ কবিত্বকে ছাপিয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ নিজের কিছু কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন, সেগুলো বিষয়গুণে তখন বিদেশের বহু মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল কিন্তু মৌলিক ইংরেজি কবিতা হিসেবে গ্রাহ্য হয়নি। সারা জীবনে একটা ভাষাই শিখে শেষ করা যায় না, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ভাষা কাজ চালাবার জন্য শেখা যেতে পারে, কিন্তু সেই সব ভাষায় কলম চালানো অনেক সময় ছেলেখেলার পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু ইংরেজ, ফরাসি, স্প্যানিশ কলোনিগুলিতে ওই সব ভাষার উচ্ছিষ্ট টুকরো পড়ে থাকবেই। আমরা সেই টুকরোগুলো পরিবর্ধন করেছি। পরাধীন আমলে আমাদের যে দেশাত্মবোধ ছিল, আমরা যে ‘এক জাতি, এক প্রাণ, একতা’ বলে গান গেয়েছি, ইংরেজ চলে যাবার পর আমরা হঠাৎ আবিষ্কার করলুম যে আসলে আমরা এক জাতি নই! সারা ভারতবর্ষকে এখনও বেঁধে রেখেছে ইংরেজি ভাষা! দক্ষিণ ভারত কিংবা গুজরাটে গেলে ইংরেজি বাদ দিয়ে অনেকের সঙ্গে একটি বাক্য বিনিময়ও সম্ভব নয়। তাই ইংরেজি হল ভারতের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা, সঙ্গত কারণেই। আগেকার তুলনায় এখন অনেক বেশি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, ইংরেজিতে যারা ফ-র-র-র-ফ-র-র-র করে কথা বলতে পারে না এখনকার ভারতবর্ষের কোনও ক্ষেত্রেই তারা কল্কে পাবে না। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিং ভালো ইংরেজি বলতে পারতেন না বলে অনেক পত্রপত্রিকায় বিদ্রূপ করা হয়েছিল। তবু, ইংরেজিকে আমরা কাজ চালাবার ভাষা বলেই গণ্য করি। কিন্তু অনেকে মাতৃভাষা ছেড়ে ইংরেজিতে গল্প, উপন্যাস, কবিতাও লেখে, আমার মনে হত ওসব এক ধরনের হ্যাংলামি, সাহেবদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা কিংবা এক লাফেই সর্বভারতীয় পরিচিতি আদায় করার বাসনা। আমরা ভাবতুম, ইংরেজি গল্প, উপন্যাস পড়তে হলে সাহেবদের লেখাই পড়ব, শুধু শুধু নেটিভদের ইংরেজি পড়ে সময় নষ্ট করি কেন?

কিন্তু স্বাধীনতার পর এত দিনে একটা দ্বিতীয় প্রজন্ম এসে গেছে। ইংরেজির গুরুত্ব এবং বাজার দর এত বেশি বলে অনেক বাবা-মা এখন ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষা শেখার ব্যাপারে জোরই দেন না, তারা শুধু ইংরেজি শেখে, বাবা-মাকে ইংরেজিতে চিঠি লেখে, ইংরেজি গান গায়, সেই সঙ্গে নাচে, ইংরেজিতে স্বপ্নও দেখে বোধহয়। দিল্লি এয়ারপোর্টে একটি এক বছরের হামাগুড়ি দেওয়া শিশুকে তার পাঞ্জাবি মা বেবি, কাম হিয়ার, ডোন্ট গো দ্যাট সাইড ইত্যাদি বলছিল, তাই শুনে আমার মনে হল, জন্মসূত্রে ভারতীয় হলেও এই শিশুটির মাতৃভাষাই তো ইংরেজি! স্কুলে গেলেই ইংরেজি শিখতে হবে, তাই তার মা তাকে আর পারিবারিক ভাষা শেখানোর ঝামেলাই নিচ্ছে না। আমরা পছন্দ করি না করি, এটা একটা বাস্তব ঘটনা। একটা প্রজন্ম তৈরি হয়ে গেল, তারা ইংরেজিতেই ভাবনা-চিন্তা করে এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ যদি সাহিত্য, সংগীত রচনা করতে চায়, সেটাও আশ্চর্যের কিছু নয়।

বিদেশে কেউ পাত্তা পেলে তখন দেশে আমাদের টনক নড়ে। এই দ্বিতীয় প্রজন্মের ভারতীয় বা বাঙালি লেখকদের মধ্যে দু-একজন মাঝে মাঝে বিদেশে সাড়া জাগায়। ‘টাইম’ সাপ্তাহিকের প্রচ্ছদে একবার বাঙালি লেখিকা ভারতী মুখার্জির ছবি ছাপা হয়েছিল। ভারতী অবশ্য এখন আর বাঙালি বা ভারতীয়ও নয়, মুখার্জিও নয়, তার পদবি ব্লেইজ, স্বামী ক্যানেডিয়ান। ‘দা গোন্ডেন গেইট’ লিখে হঠাৎ বিখ্যাত বিক্রম শেঠ-এর জন্মই শুধু কলকাতা, সে বাংলা জানে কিনা সন্দেহ। কিন্তু সম্প্রতি দুজন বাঙালি লেখক ইংরেজি উপন্যাস লিখে যথেষ্ট সার্থক হয়েছেন।

অমিতাভ ঘোষ-এর ‘দা সার্কল অফ রিজন’ উপন্যাসটি আমি পড়তে শুরু করেছিলুম খানিকটা হেলাফেলার সঙ্গে। কিন্তু কয়েক পাতা পড়ার পরই বোঝা যায়, এই লেখক প্রকৃত লেখক। তাঁর ইংরেজি ভাষা কোথাও প্রকটভাবে ইংরেজি নয়। স্বাভাবিক, সাবলীল ইংরেজি। এই উপন্যাসের নায়কের নাম আলু এবং প্রয়োজনে বাংলা শব্দ ব্যবহার করতে তিনি দ্বিধা করেননি। একজন তরুণ লেখকের প্রথম উপন্যাস হিসেবে এই বইটি বিস্ময়কর রকমের পরিণত।

উপমন্যু চ্যাটার্জির ‘ইংলিশ, অগাস্ট—অ্যান ইন্ডিয়ান স্টোরি’-ও এক তরুণ আই এ এস অফিসারের প্রথম উপন্যাস। ইংরেজিতে লেখা হলেও এই উপন্যাসের নায়ক রবীন্দ্রসংগীত শোনে, কাকাকে ‘আংকল’ বলে না, কাকুই বলে, এর চরিত্ররা ব্যথা পেলে ‘উঃ’ বলে, ‘আউচ’ শব্দ করে না। ভারতীয় মাটিতে যে লেখকের শিকড় তা অস্বীকার করেননি। পড়তে পড়তে মনে হয়, আমেরিকান ইংরেজি, অস্ট্রেলিয়ান ইংরেজি তৈরি হয়ে গেছে, ভারতীয় ইংরেজি তো এইরকমই হওয়া উচিত। ইংরেজি ভাষা ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, এখন ভারতীয় ইংরেজিতে সাহিত্য সৃষ্টির বাধা থাকার কথা নয়।

বাংলায় এখন যে ধরনের গল্প-উপন্যাস লেখা হয়, তার সঙ্গে এই উপন্যাস দুটির তুলনা মনে এসেই যায়। এই বাঙালি পদবিধারী লেখকদ্বয় যদি বাংলাতেই বই দুটি লিখতেন, তা হলে তা কতটা উল্লেখযোগ্য হত? আমার মতে, বাংলাতেও বই দুটি যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করত। সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্য এমন জোরালো উপন্যাস লেখা হয়নি বলা যেতে পারে। আমি জোরালো বলেছি, গভীর বলতে পারছি না, কারণ, দুটি উপন্যাসই বর্ণনামূলক, আধা-বাস্তব ভঙ্গিতে লেখা প্রথমটি খানিকটা বিমূর্তও বটে, দ্বিতীয়টিতে ইয়ার্কি বিদ্রূপের স্টাইল, কিন্তু হৃদয়ের কথা তেমন বলা নেই, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের জটিলতা বিশেষ স্থান পায়নি। সেখানেই তো উপন্যাসের প্রকৃত মর্ম। লেখকদ্বয় যে ওইসব বিষয় নিয়ে লিখতে পারেন না, তা বলছি না, কিন্তু প্রথম উপন্যাসে ওই দিকে যাননি।

উপমন্যু চ্যাটার্জির উপন্যাসটি প্রথম থেকেই টানে। আজকাল ইংরেজিতে চার অক্ষরের কথা, কিংবা যৌন চিন্তা যা খুশি লেখা যায়, বাংলায় এসব এখনও অব্যবহার্য। ধারালো বিদ্রুপের জন্য যদৃচ্ছ শব্দ ব্যবহার যথেষ্ট প্রয়োজন, বাংলায় তার সীমাবদ্ধতা আছে। উপন্যাসটি আমার খুবই ভালো লাগলেও একটি ব্যাপারে ব্যক্তিগত আপত্তি আছে। নায়কের কলকাতার বান্ধবীর নাম নীরা কেন? ওই নামটি ব্যবহার করা উচিত হয়নি।

২৫/০৯/১৯৮৮

আনন্দবাজার পত্রিকা

বাঙালি সংস্কৃতির উত্তরাধিকার

ঢাকার এক বন্ধু একদিন জিগ্যেস করলেন, পশ্চিম বাংলায় সবচেয়ে বড় উৎসব নিশ্চয়ই দুর্গাপুজো, আমাদের বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় উৎসব কী বলুন তো? এর উত্তরে ঈদ বলেই আমি বোকা বনে যেতাম, তাই ধাঁধার উত্তর জানার ভঙ্গিতে তাকিয়েছিলাম বন্ধুরই দিকে। বন্ধুটি সহাস্যে বললেন—নববর্ষ।

বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে শতকরা নব্বইজন মুসলমান, তারা ঈদের উৎসব করেন অবশ্যই, অনেকে রোজা রাখেন, মসজিদে কিংবা মাঠের জমায়েতে নামাজ পড়েন, কিন্তু দুর্গাপুজোর মতন পাড়ায় পাড়ায় ম্যারাপ বেঁধে, ঢাক-ঢোল-সানাই বাজিয়ে উৎসব হয় না। অথচ প্রায় সেইরকমই বাংলাদেশে, নববর্ষের সময় অনেক ছোটখাটো শহরেও সেই উৎসবে কোনও ধর্মীয় ব্যাপার থাকে না, হয় গান বাজনা, কবিতা পাঠ, নৃত্যনাট্য ইত্যাদি। পশ্চিম বাংলায় আবার নববর্ষে কোনও মাতামাতি নেই, ওই দিনটিতে ছুটি থাকে বটে কিন্তু উদযাপন করার ব্যাপারে কারও বিশেষ ছাড় নেই। সবদিক দিয়ে পয়লা জানুয়ারিই তো এখন প্রকৃত নববর্ষের দিন। পরাধীন ভারতে এইসব ছিল জাতীয়তাবাদের প্রকাশ। স্বাধীনতার পরেও কিছু বছর তার রেশ থেকে গিয়েছিল, এখন পশ্চিম বাংলায় জাতীয়তাবাদ শব্দটাই কেমন যেন অদ্ভুত শোনায়।

পাকিস্তানি আমলে পূর্বপাকিস্তানের মানুষ নিজেদের বাঙালিত্বের ওপর জোর দেবার জন্যই বাংলা নববর্ষের উৎসব পালনের প্রতি জোর দিয়েছিলেন। আজ সেখানকার বাঙালিদের নিজস্ব রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তবু এইসব উৎসব ম্লান হয়ে যায়নি।

বাংলাদেশের আর একটি অসাম্প্রদায়িক উৎসব হল একুশে ফেব্রুয়ারি, শহিদ দিবস। মূলত ছাত্রছাত্রীরাই এই দিনটিকে মেতে ওঠে বটে, কিন্তু এই উৎসবের ছোঁয়া লাগে সারা দেশে। দলমত নির্বিশেষে পশ্চিম বাংলার সব ছাত্ররা কোনও একটা বিশেষ উপলক্ষে উৎসবে মাতবে, পশ্চিম বাংলায় এটা এখন প্রায় অকল্পনীয়। আমাদের এদিককার ছাত্ররা এখন বড় আকারে কোনওরকম সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন করে কি? রাজনীতিই এখন একমাত্র সংস্কৃতি।

বাংলাদেশে একুশে ফেব্রুয়ারি উৎসবে আমি দেখেছি ব্যাংক কর্মচারী সমিতি কিংবা কৃষিজীবী সমবায় ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সদস্যরাও মিছিল করে আসে। সে দেশের রাষ্ট্রপতিও যেমন প্রতি বছর এই দিনটিকে স্মরণ করেন, তেমনি অনেক সাধারণ গৃহস্থ বউ-ছেলে-মেয়ের হাত ধরে শহিদ বেদি পর্যন্ত দর্শন করতে আসেন। বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে বাহান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি চারজন তরুণ প্রাণ দিয়েছিল ঢাকায়। সেই অনুসারে এই শহিদ দিবসটি শোক দিবস হিসেবে প্রতি বছর পালিত হবার কথা ছিল। কিন্তু এখন সেটা জয় দিবস কিংবা ভবিষ্যতের জন্য শপথ নেবার দিন। আজকের যারা তরুণ-তরুণী, যাদের বয়স কুড়ি-একুশ, তারা সেই বাহান্ন সাল দেখেনি তো বটেই, বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিও তাদের নেই, তবু একুশে ফেব্রুয়ারির উৎসব উদযাপনে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মহিমা বিবর্ধনের জন্য তাদের আবেগ ও উন্মাদনা দেখে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। হিন্দু জনপ্রতিনিধিরা সাহেবদের উচ্চারণ নকল করে জ্বালাময়ী ইংরেজিতে বক্তৃতা দিলেই আত্মশ্লাঘা বোধ করতেন। উচ্চশিক্ষিত মুখ্যমন্ত্রী (তখন প্রধানমন্ত্রী বলা হত) ফজলুল হক সাহেবও মাঝে মাঝে বাংলা বাক্য উচ্চারণ করতেন সাহেবদের নাকের ডগায়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাহান্ন সালেরও অনেক অনেক আগে কায়েদ-এ-আজম জিন্না এক জনসভায় আব্বাসউদ্দিনের গান সম্পর্কে আপত্তি তুলেছিলেন। তখন সাধারণ মুসলমান শ্রোতারা পাকিস্তানের মহামহিমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শোরগোল তুলেছিল। শেষ পর্যন্ত আব্বাসউদ্দিনের গান দিয়েই সভা শুরু হয়েছিল।

আজ পশ্চিমবাংলায় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সংকুচিত হয়ে আসছে ক্রমশ। গোর্খাল্যান্ডের বদলে গোর্খা হিল কাউন্সিল নামে যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানে বাংলা সিনেমা দ্যাখার কথা কেউ কল্পনা করতেই পারে না। লাউড স্পিকারে বাজে শুধু হিন্দি গান। এই ঠুঁটো পশ্চিম বাংলাতেও এক শ্রেণির বাঙালি বাংলা সংস্কৃতির সব চিহ্ন গা থেকে মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর। চতুর্দিকে এখন ব্রাউন সাহেবদের আধিপত্য। বাংলা বই সম্পর্কে মন্তব্য—আমারও স্ত্রী পড়েন মাঝে মাঝে, তবু স্ত্রীরা এখনও পড়ছেন, তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বাংলা বই, বাংলা গানের সব সম্পর্ক ঘুচে গেছে। উচ্চবিত্ত সমাজের বাড়িতে গেলেই শোনা যাবে এখন মাইকেল জ্যাকসনের নাকি সুরের চিৎকার। কোনও কোনও বাড়িতে আমি কাঁটা চামচ দিয়ে ইলিশ মাছ খেতে দেখেছি! ওঃ সে কী পরিশ্রম।

বাংলাদেশেও কি ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজ নেই? আছে। জিনস ও গেঞ্জি পরা ছেলে, সবসময় ইংরেজি বলা মেয়েদের দল, বিদেশি ম্যাগাজিন পড়া মা-বাবা, এরকম একটা শ্রেণি আছে সেখানে।

কিন্তু বাংলা শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। তাদের একজন রসিকতা করে আমাকে বলেছিলেন, পয়লা ফেব্রুয়ারি বাঙালি হয়ে যাই, আবার ২৮শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভুলে যাই। তবু তো একটা মাস তারা বাঙালি সাজতে লজ্জা পান না। আমাদের এখানকার ব্রাউন সাহেবরা অনেকে ২৫শে বৈশাখেরও তোয়াক্কা করেন না। বাংলা নববর্ষ কবে, সে ধাঁধার উত্তর তাদের ছেলেমেয়েরাও দিতে পারবে না।

বাংলাদেশের ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজটি বিশেষ বড় নয়। তার বাইরে যে বিশাল জনসংখ্যা তারা বাংলা সংস্কৃতিতে লালিত হচ্ছে। তাদের মুখের ভাষাই হয়ে উঠেছে প্রকৃত বাংলা। অনেক বাঙালি হিন্দুরই একটা নির্বোধ অভিযোগ আছে, মুসলমানেরা জলকে পানি বলে কেন? ওদের কথায় আরবি-ফরাসি শব্দ থাকে কেন? আসলে কিন্তু মুসলমানরা জলকে পানি বলে না, পানিকেই পানি বলে, যেমন সারা ভারতের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই পানিকে পানিই বলে। বাঙালি হিন্দুই একমাত্র জল শব্দটি আঁকড়ে বসে আছে। আমার মতে, বাঙালি হিন্দুদের লেখায় জল এবং পানি দুটোই ব্যবহার করা উচিত। বাংলাদেশের মুসলমান লেখকরা অনেকেই লেখার মধ্যে জল শব্দটি ব্যবহার করতে দ্বিধা করেন না। অন্যান্য বৈদেশিক শব্দের মতো প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে, আরও নতুন নতুন শব্দ যোগ হলে এই ভাষারই উপকার হবে। আরবি-ফারসি শব্দ বাদ দিয়ে পরপর আট-দশটি বাংলা বাক্যরচনা করা এখন সংস্কৃত পণ্ডিতদের পক্ষেও দুঃসাধ্য। আমি নিজেই একবার সে চেষ্টা করে বিপদে পড়েছি। সপ্তম শতাব্দীর পটভূমিকায় কাশ্মীরের রাজা জয়াপীড়কে নায়ক করে একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখতে গিয়ে এই বিপদ ঘটেছিল। বাংলাদেশে মৌলবাদীদের সংখ্যা বাড়ছে, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। এখন সেটাকে ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, অথচ সেখানকার মানুষ নববর্ষ ও একুশে ফেব্রুয়ারির মতন দুটি অসাম্প্রদায়িক উৎসব নিয়ে মাতামাতি করে, এটা খুব আশ্চর্যের নয়?

ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে সরকারিভাবে ঘোষিত হলেও বাংলাদেশের সব মানুষ তা মেনে নেয়নি। আওয়ামি লিগ তো বটেই, অন্যান্য সব বিরোধী দলগুলোই এর বিপক্ষে। ইসলামি রাষ্ট্রের সব রীতিনীতি প্রযুক্ত হলে শুধু যে সংখ্যালঘু হিন্দু-বৌদ্ধদেরই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থাকতে হবে তাই নয়, মুসলমান সমাজেও প্রগতির পথ রুদ্ধ হবে, মেয়েদের শিক্ষা-সংস্কৃতির স্বাধীনতা খর্ব হবে। আরবের টাকার চাপে বাংলাদেশ সরকারকে অনেক কিছু মেনে নিতে হচ্ছে বটে, কিন্তু বাঙালি মুসলমান পুরোপুরি আরবের অনুসরণ করবে না কখনও।

মৌলবাদীরা মাথা চাড়া দিচ্ছে ঠিকই তার পিছনে উস্কানি ও প্ররোচনা আছে। কিন্তু কিছু পত্র-পত্রিকায় মৌলবাদীদের বেশ হুঙ্কার শোনা যায়, কিন্তু সেইসব মৌলবাদীরাও নববর্ষ ও একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। নববর্ষ সম্পর্কে তাদের আপত্তিরও কিছু থাকার কথা নয়, ইচ্ছে করলে তারা এই দিনটিকে উৎসব বলে মানতে পারে, বাংলা নববর্ষের সঙ্গে ইসলামেরও যোগ কম নয়। আর একুশে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে আপত্তি তুলবে এমন বুকের পাটা বাংলাদেশে কারও নেই।

পশ্চিমবাংলায় একমাত্র অসাম্প্রদায়িক উৎসব বলতে পঁচিশ বৈশাখ। হ্যাঁ, এখন জেলায় জেলায় গ্রামে গ্রামেও পঁচিশে বৈশাখের উৎসব হয়। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ এত গান, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য লিখে গিয়েছিলেন। নজরুল এবং সুকান্তরও জন্মদিন পালিত হচ্ছে নানা জায়গায়, সেই তুলনায় বঙ্কিম কিংবা শরৎচন্দ্র তেমন কল্কে পান না। দেখা যাচ্ছে কবিদেরই শেষ পর্যন্ত জয় হয়। বাংলাদেশেও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মাতামাতি হয় যথেষ্ট, সেখানকার অনেক শিল্পীর কণ্ঠের রবীন্দ্রসংগীত অতি চমৎকার, রবীন্দ্রনাথের একটি গান ওদেশের জাতীয় সংগীত, নজরুল ওদের জাতীয় কবি এবং সুকান্ত চর্চার একটা কেন্দ্রও আছে ঢাকায়, আমি নিজে দেখেছি। দেশভাগ হলেও বাংলাদেশিরা সমগ্র বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিরই উত্তরাধিকারী। সেই তুলনায় এদিকে আমরা ওদিকে সাহিত্য-সংস্কৃতির কতটা অগ্রগতি হচ্ছে তার কিছুই প্রায় খবর রাখি না। ইদানিং টিভিতে বাংলাদেশের অনুষ্ঠান দেখে কেউ কেউ অবাক হয়ে বলে আরে ওরা তো বেশ ভালো নাটক করে, ওদের গান এত ভালো?

যুক্ত বাংলায় এতকাল হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি থাকলেও কিছুতেই যেন সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ঘটেনি। তার জন্য অনেকটাই দায়ী হিন্দু উন্নাসিকতা। বাঙালি হিন্দুরা বহুকাল ধরে বলে এসেছে—আরে ওই লোকটা তো মুসলমান, ও আবার বাঙালি নাকি? যেন মুসলমানরা বাঙালি হতে পারে না। অধিকাংশ হিন্দুই জানে না কিংবা খেয়াল করে না যে বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষার যাবতীয় লড়াই বাঙালি মুসলমানরাই করেছে। একটু আগে থেকে শিক্ষা পাবার সুযোগে হিন্দুদের মধ্যে অনেক বড় বড় লেখক জন্মেছেন বটে, কিন্তু সংঘবদ্ধভাবে বাঙালি হিন্দুরা বাংলা ভাষার জন্য কিছুই করেনি। মুসলমানরা সেটা শুরু করেছে পাকিস্তানি আমলেরও অনেক আগে, সেই উনিশশো সাইত্রিশ সাল থেকে। সেবারই প্রথম সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে নির্বাচন হল। যশোর, খুলনা, রাজশাহী থেকে অনেক লুঙ্গি বা ধুতি পরা মুসলমান নির্বাচিত হয়ে এলেন কলকাতার বিধানসভায়। সেই সময়, সেই ব্রিটিশ আমলেই তারা দাবি তুলেছিলেন তাদের বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করতে দিতে হবে।

বাংলাদেশে শিক্ষিত মানুষেরা কথ্য ভাষায় পরিচিত আরবি-ফারসি শব্দ কদাচিৎ ব্যবহার করেন, লিখিত ভাষায় তৎসম শব্দই বেশি। সেই তুলনায় আমরা অনেক অপ্রয়োজনীয় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি। ইচ্ছে করে কিছু আরবি-ফারসি শব্দ মিলিয়ে চমৎকার এক বাংলা লিখতেন সৈয়দ মুজতবা আলী। তিনি বাংলা গদ্যের এক প্রধান লেখক। গদ্যের স্টাইলে তিনি প্রমথ চৌধুরীর সমতুল্য।

আজ পশ্চিমবাংলায় বাংলা গানের এক অদ্ভুত অবস্থা। বাংলা গান যারা ভালোবাসতেন, তাদের অবলম্বন রবীন্দ্রসংগীত কিংবা নজরুলগীতি, অতুলপ্রসাদ-রজনীকান্ত-দ্বিজেন্দ্রলালের গান ফিরে আসছে। পুরাতনী বাংলা গানও আসর জমাচ্ছে, কিন্তু নতুন গান কোথায়? অন্তত দু-দশকের মধ্যে কোনও নতুন বাংলা গান জনপ্রিয় হয়নি। পল্লিগীতির নামে যেগুলো চলে, সেগুলো শহুরে বাবুদের লেখা। এ যেন একতরফের ভালোবাসা, আমরা বাংলা গান ভালোবাসতে চাই, কিন্তু নতুন গান নেই। বাংলাদেশেও আধুনিক গান তেমন উচ্চাঙ্গের নয়, কিন্তু নানা জেলা থেকে বৈচিত্র্যময় লোকগীতি উঠে আসছে। রচিত হচ্ছে আবেগময় দেশাত্মবোধক গান, (আমাদের এখানে তো দেশাত্মবোধক গান উঠেই গেছে) তারা এক জায়গায় কয়েকজন সমবেত হলে হিন্দি, উর্দু গান না করে বাংলা গানই গায়। যে-কোনও অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে ওদের আলপনা অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখার মতো, আমাদের কলেজের ছেলেমেয়েরা আলপনা দিতে এখনও শেখেনি। বাংলাদেশের জন্যই সারা পৃথিবীতে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি। বাঙালি শব্দটির বদলে আস্তে আস্তে বাংলাদেশি নামটি পরিচিত হয়ে উঠেছে। প্রবাসে যেসব বাংলাদেশি থাকে, তারাও সহজে বাঙালিত্ব বিসর্জন দেয় না। বাঙালি বলবে না, পাবর্ত্য চট্টগ্রামে যে চাকমারা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, তারাও কিন্তু বাঙালি, তারা বাংলা ভাষার মাধ্যমে লেখাপড়া শেখে। বাংলাদেশের একজন অল্পশিক্ষিত চাষিকে মানি অর্ডার ফর্ম পূরণ করার জন্য অন্যের সাহায্য নিতে হয় না। কলকাতা থেকে ঢাকায় গেলে প্রথমেই সকলের মনে হয় এটাই বাংলার স্বভূমি। দুদিকে বাংলার সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান না হলে ক্ষতি হবে পশ্চিমবাংলারই বেশি। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে আমাদের আগ্রহে দিন দিন না বাড়ালে আমাদের সংস্কৃতিও শুকিয়ে যাবে। নচেৎ আজ থেকে তিরিশ কিংবা পঞ্চাশ বছর পর বাংলাদেশিরা যদি বলে—ভারতে বাঙালি থাকে সে আবার কী—তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

ঈশ্বর কিংবা আল্লা আমাদের মাথায় থাকুন, ধর্ম থাকুক, ধর্ম থাকুক ঘরে ঘরে, রাজনৈতিক বিভেদ নিয়ে মত্ত থাকুক রাজনীতিবিদরা। ভাষা এবং সংস্কৃতিকে এসব কিছুর ঊর্ধ্বে না রাখতে পারলে কোনও জাতিই জাতি হিসেবে পরিপুষ্ট হতে পারে না। জার্মানিও দু-ভাগ হয়েছিল, সেই দুই অংশের মধ্যে যাতায়াত ভারত-বাংলাদেশের চেয়েও কঠিন ছিল, তবু জার্মান জাতের মধ্যে সমভ্রাতৃত্ববোধ কখনও নষ্ট হয়নি। বার্লিনের যে দেয়াল লিখনটি এ সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক, সেটি এখানে উদ্ধৃত করার বাসনা সংবরণ করতে পারছি না : Live alone and free, like a tree, but in the brotherhood of the forest.

(বঙ্গ সংস্কৃতি উৎসব ১৪১২)

আগামী প্রজন্মের বাঙালি

বাণিজ্য বিস্তারের নামে অস্ত্রধারী ইংরেজ হানাদারেরা ভারতে এসেছিল সমুদ্রপথে। মাদ্রাজ উপকূলে এবং বঙ্গোপসাগর দিয়ে গঙ্গা নদীতে ঢুকে অরক্ষিত স্থানে তারা প্রাথমিক উপনিবেশ স্থাপন করে। ভারতের রাজধানী দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছতে তাদের অনেক সময় লেগেছিল।

সাম্রাজ্য জয়ের বাসনা তারা স্বপ্নেও স্থান দেয়নি প্রথম দিকে, বাণিজ্যের নামে শোষণ ও লুণ্ঠনই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু দিল্লির কেন্দ্রীয় শক্তি ছিল তখন খুবই দুর্বল, সারা দেশ জুড়ে অরাজক অবস্থা। বাংলার সিংহাসনে তখন এক অতি তরুণ, মূর্খ, দুশ্চরিত্র ও রাজনৈতিক জ্ঞান শূন্য নবাব। তার সভাসদ ও অন্য সবাই চরম বিক্ষুব্ধ তার বিরুদ্ধে। আড়ালে চলেছে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। সেই সুযোগ নিয়ে ইংরেজ বণিকরা অনায়াসেই বাংলার ক্ষমতা দখল করে নেয়। এমন সস্তায়, এত সামান্য যুদ্ধে এত বড় রাজ্য জয়ের ঘটনা ইতিহাসে বিরল।

ক্রমে ইংরেজরা গোটা ভারতবর্ষ অধিকার করে নিয়েও দিল্লির বদলে কলকাতার মতন একটা তুচ্ছ, অর্বাচীন, ক্ষুদ্র শহরে রাজধানী স্থাপন করে। এটাকে বলা যায় ঐতিহাসিক নিয়তি। কেন না, এর আগে, বহু শতাব্দী ধরে বাংলা বা বাংলার কোনও শহরেরই কোনও সর্বভারতীয় গুরুত্ব ছিল না। ইংরেজ শাসনের প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠায় কলকাতার দ্রুত শ্রীবৃদ্ধি হতে থাকে, অচিরেই কলকাতা হয়ে ওঠে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় প্রধান নগরী, ‘প্রাসাদ-নগরী’ হিসেবেও এর খ্যাতি হয়। পশ্চিমী শিক্ষা ও বিজ্ঞানের সংস্পর্শে এসে বাঙালি জাতির মধ্যেও এক নবজাগরণ ঘটে। ব্যবসা-বাণিজ্যে, শিক্ষা-দীক্ষায়, সংস্কৃতিতে ও আধুনিক মনস্কতায় বাঙালিরা হয়ে ওঠে সারা ভারতে অগ্রগণ্য। বাঙালি শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী ও সাংবাদিকরা ছড়িয়ে পড়ে ভারতের সর্বত্র। এই শতাব্দীর গোড়ায় রাজনৈতিক নেতৃত্বেও বাঙালিরা প্রধান ভূমিকা নেয়।

১৯১১ সালে ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হলেও কলকাতার গৌরব কিছু মাত্র কমেনি। কলকাতা হয়ে ওঠে প্রকৃত অর্থে এ যুগের মেটোপলিস। সারা পৃথিবীতে দিল্লির তুলনায় কলকাতার গুরুত্ব ছিল বেশি। সারা বিশ্ব থেকে গুণী-জ্ঞানী, ব্যবসায়ী, সৌভাগ্য সন্ধানীরা কলকাতায় এসে ভিড় জমিয়েছে।

ব্রিটিশ ভারতে কলকাতার এক গৌরবময় স্থান অব্যাহত থাকলেও হঠাৎ তার বিপরীত অবস্থা এসে যায় স্বাধীনতার পর। ভারতবর্ষ পেল স্বাধীনতা, আর বাংলা পেল দেশ বিভাগের চরম আঘাত। স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালির ছিল প্রধান ভূমিকা, তার প্রতিদানে বাঙালি জাতি হয়ে গেল দু-টুকরো, বহু লক্ষ বাঙালি হল বাস্তুচ্যুত এবং চরম ট্যাজেডির সম্মুখীন। অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবাংলা হয়ে গেল সংখ্যালঘু, দিল্লির শাসকদের মধ্যেও বাঙালিদের বিশেষ স্থান হল না। এক কোটির বেশি উদ্বাস্তুদের আগমনে পশ্চিমবাংলা যখন জর্জরিত, হঠাৎ অতিরিক্ত জন সংখ্যার চাপে কলকাতার নাগরিক জীবন বিপর্যস্ত, তখন এসব কিছুর সুরাহা ও সাহায্য করার কোনও উদ্যোগ নেয়নি কেন্দ্রীয় সরকার। পশ্চিমভারতে পাঞ্জাবও দ্বিখণ্ডিত হয়েছে, কিন্তু সেই দু-খণ্ডের নাগরিক বিনিময়ও হয়ে গিয়েছিল, তাই সেই ক্ষত শুকোতে খুব বেশি সময় লাগেনি। বাংলার দুদিকে নাগরিক বিনিময় হতে দেওয়া হয়নি, পূর্ব বাংলা থেকে জনস্রোত এসেছে পশ্চিমবাংলায়, এখনও তা অব্যাহত, ফলে পঞ্চাশ বছরেও মেটেনি উদ্বাস্তু সমস্যা।

পশ্চিমবাংলা ও তার প্রাণকেন্দ্র কলকাতার এই দুঃসময়ে দিল্লি থেকে আন্তরিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবার বদলে মাঝে মাঝে ছুড়ে দেওয়া হয়েছে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ। কেউ বলেছেন, ‘মিছিল নগরী’, কেউ বলেছেন ‘দুঃস্বপ্নের শহর’, কেউ বলেছেন ‘মুমূর্ষু নগরী’!

ভারতের রাজনীতি ও বাণিজ্যিক ক্ষমতা এখন যাদের হাতে, তারা অনেকেই দিনে একবার বাঙালিদের নিন্দে না করে জল খান না। এ এক ধরনের হীনমন্যতা চাপা দেবার চেষ্টা, এক সময় বাঙালিরা সব বিষয়ে আধিপত্য করেছে বলে এখন যে-কোনও প্রকারে তাদের নীচে ঠেলে দেবার উদ্যোগ চলেছে। বাংলায় প্রবাদ আছে ‘হাতি কাদায় পড়লে ব্যাঙেও লাথি মারে’, অনেকটা যেন সেইরকম অবস্থা। নানানভাবে প্রচার করে এমন একটি ধারণা তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে, যেন বাঙালি জাতটা একেবারেই অধঃপতনে গেছে।

বাঙালি অধঃপতনে যায়নি, তবে অবস্থার অনেক অবনতি হয়েছে, তা অনস্বীকার্য। এ জন্য আত্মসমীক্ষারও প্রয়োজন আছে। এযুগে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও উৎপাদন—বাণিজ্যের অগ্রগতি না থাকলে কোনও জাতির শিল্প-সংস্কৃতিরও শ্রীবৃদ্ধি হতে পারে না। ওই প্রধান দুটি বিষয়েই বাঙালি এখন দুর্বল। এর জন্য অনেকটা নিজেরাই দায়ী। বাঙালির অনেক গুণ থাকলেও একটি বড় দোষ এই যে, তারা জানে না কাকে বলে ‘একতা’। সমবেত ভাবে কিছু করা তাদের ধাতে নেই। এ জন্যই বাঙালিদের মধ্যে অনেক একক ব্যক্তিত্বের উত্থান হয়েছে, যাঁরা বিশ্ববরেণ্য, কিন্তু সামগ্রিক উন্নতির দৃষ্টান্ত প্রায় নেই। রাজনীতিতে শুধু দলাদলি নয়, পারস্পরিক খুনোখুনিও এখানেই সবচেয়ে বেশি ঘটে। বড় বড় শিল্প-বাণিজ্য সংস্থাগুলি যখন পশ্চিমবাংলা থেকে তাদের কেন্দ্র সরিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করে, তখনও দলাদলিতে মত্ত থেকে আমরা রোধ করার কোনও চেষ্টাই করিনি। তার ফলে সমস্যা বেড়েছে, জাতিগত ভাবে দুর্বলতা ও রক্তশূন্যতা এসে গেছে।

বাঙালির আর একটা দোষ, তারা যতটা অতীত বিলাসী, ততটা ভবিষ্যৎমুখী নয়। গত শতাব্দী নিয়ে বাঙালিরা গৌরব করে, আগামী শতাব্দী সম্পর্কে তাদের কোনও পরিকল্পনা নেই। একসময়ে বাঙালিরা সর্বভারতীয় নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু অন্যান্য রাজ্যের মানুষও এগিয়ে আসবে, এটাও তো স্বাভাবিক। শিক্ষিতের হারে বাঙালিরা যে দক্ষিণ ভারতীয়দের তুলনায় অনেক পিছিয়ে গেছে, এটাও বাস্তব সত্য।

তবে, ইতিহাস সরলরেখায় চলে না, তা অনেকটা ঢেউয়ের মতন। উত্থান ও পতন চলতেই থাকে। অবস্থার বিপাকে বাঙালির অনেকখানি পতন হলেও আবার যেন একটা উত্থানের সূচনা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এটা নিছক আশাবাদ নয়। খাদ্য উৎপাদনে পশ্চিমবাংলা অনেকখানি এগিয়েছে, শিল্প-বাণিজ্যেরও খানিকটা পুনরুত্থান দেখা যাচ্ছে, দাঙ্গা-হাঙ্গামা প্রায় নির্দ্ধারিত। বাঙালিদের যারা নিন্দে করে, ভুল সমালোচনা করে, তাদের উত্তর দেবার এই তো যোগ্য সময়।

প্রথম প্রয়োজন, হীনমন্যতা কাটিয়ে ওঠা। গালাগালি খেতে খেতে অনেক বাঙালির ধারণা হয়ে গেছে যে তারা চিরকালের মতন হেরে গেছে। অনেক বাঙালি পরিচয়টাই লুকোতে চায়। আবার অনেক অবাঙালিও বাংলাকে ভালোবেসে, কিংবা কাজকর্মের সূত্রে বাংলার জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। এই পঞ্চাশ বছরে বাঙালির জনসংখ্যাও অনেক বেড়েছে। ত্রিপুরায়, অসমে, ওড়িশায়, বিহারে বহু বাঙালি ছড়িয়ে আছে। এইসব বাঙালিদের মধ্যে কারুর কোনও কৃতিত্বের পরিচয় পাওয়া গেলেই তা প্রচার করা উচিত। স্কুল-কলেজের প্রতিভাবান ছেলে-মেয়েদের নিয়ে আসা দরকার পাদপ্রদীপের আলোয়। বেশ কিছু ফাউন্ডেশনের দরকার, যেখান থেকে স্কলারশিপ দেওয়া হবে বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীতে কৃতী তরুণ-তরুণীদের। বর্তমান প্রজন্ম পরবর্তী প্রজন্মের কাছে দায়বদ্ধ। যদি এমন একটা উদ্দীপনার সঞ্চার করা যায় যে কেউ যদি কোথাও কোনও ভালো কাজ করে তবে তার স্বীকৃতি পাওয়া যাবে, তা হলে ভালো কাজ করতে অনেকেই এগিয়ে আসবে। কলকাতা থেকে বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবির দল যদি বছরে একবারও মফসসলের কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে গিয়ে তাদের মনোবল জাগাবার ভার নেন, তাতে অনেক কাজ হতে পারে।

ক্যাচ দেম ইয়াং। সেই কাজটাই এতদিন করা হয়নি।

বাঙালি অনেক, মুছে যাচ্ছে বাংলা

প্রথমবার গিয়েছিলাম প্রায় ছাব্বিশ-সাতাশ বছর আগে। কোনও আমন্ত্রণে নয়, সেখানে আমার পরিচিত কেউ নেই, আমার মুখখানাও তখন পাঠকদের কাছে চেনা হয়নি। সে সময় পর্যটন শিল্পকে উৎসাহ দেওয়া হত না, হোটেলের সংখ্যা ছিল নগণ্য আর আমাদের মতন প্রতিবেশী রাজ্যের মানুষকেও আন্দামানে যেতে হলে সেখানকার শাসন-কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আগে অনুমতি নিতে হত। যথাবিহিত সেসব নিষ্পন্ন করে আমি একদিন জাহাজের টিকিট কেটে ভেসে পড়েছিলাম বঙ্গোপসাগরে। আমার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে কেউই তখনও পর্যন্ত আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ দ্যাখেনি, সঠিক ধারণাও নেই, কয়েকজন আমাকে জিগ্যেস করেছিল, হঠাৎ একা একা আন্দামান যাচ্ছ কেন? আমি সঠিক উত্তর এড়িয়ে গেছি, অনায়াসে বলা যেত বিকজ ইট ইজ দেয়ার। আসল কারণ হল, আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামের সশস্ত্র বিপ্লবীদের মধ্যে যাঁরা আন্দামানে দণ্ডিত হয়েছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে যাঁরা তখনও বেঁচে আছেন, তাঁদের নিয়ে একটি উপন্যাস রচনা করার বাসনা আমার মনে ঘুরঘুর করছিল। নিজেই ঠিক করেছিলাম, কুখ্যাত সেলুলার জেলটি স্বচক্ষে না দেখে এরকম রচনায় হাত দেওয়া উচিত নয়।

সেই মুখ্য উদ্দেশ্যটি ছাড়াও ভ্রমণের টান তো ছিলই। সঙ্গীবিহীন অপরিকল্পিত ভ্রমণের স্বাদই আলাদা, আমি উপভোগ করেছিলাম খুবই। ইচ্ছেমতন এক-একটা দ্বীপে গিয়ে থেকেছি। এমন গাঢ় নীল সমুদ্র, এমন বৃষ্টির লুকোচুরি খেলার আকাশ, এমন নিবিড় অরণ্য, যেদিকে তাকালে মনে হয় ব্রহ্ম-স্বাদের মতন অনুচ্ছিষ্ট। শুনেছি জারোয়াদের সম্পর্কে অনেক রোমাঞ্চকর গল্প, দেখেছি পাল পাল হরিণ, নির্জন বেলাভূমিতে কতরকম ঝিনুক ও শঙ্খ।

একটিই মাত্র ভদ্রগোছের সরকারি হোটেল ছিল, সেখানে আমি জায়গা পেয়েছিলাম বটে, তবে বেশ মজার শর্তে। প্রত্যেকদিন দুপুরবেলা বারোটা থেকে চারটে পর্যন্ত ঘর ছেড়ে দিতে হবে। কারণ ওই সময় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের ফ্লাইট আসে, পাইলট ও অন্য কর্মীরা স্নান খাওয়াদাওয়া করে ওই হোটেলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন, পুরো হোটেলটা তাঁদেরই দখলে থাকে (ঘর ছিল মাত্র ছ’-সাতখানা)। অর্থাৎ প্রতিদিন চার ঘণ্টা আমি উদ্বাস্তু।

তখন অনেক জায়গাতেই দেখা যেত বাঙালি মুখ, পথেঘাটে শোনা যেত বাংলা কথাবার্তা। অতুল স্মৃতি সমিতি নামে বাঙালিদের একটি পুরোনো প্রতিষ্ঠানে যেতাম খবরের কাগজ পড়তে। অনেকের মুখেই খেদোক্তি শুনেছি, এই আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ অনায়াসেই একটি বাঙালিপ্রধান রাজ্য হতে পারত, ত্রিপুরার মতন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু আসছিল, পশ্চিমবঙ্গের তখন উপচে ওঠার মতন অবস্থা। তাদের আর স্থান দেওয়া যাচ্ছিল না। বিধানচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে, কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মতিতে বাঙালি উদ্বাস্তুদের আন্দামানে পাঠাবার পর বিরোধী পক্ষ দারুণ কোলাহল ও প্রতিবাদ শুরু করে দেয়। যেন বেড়াল পার করার মতন বাঙালি উদ্বাস্তুদের কালাপানি পার করে পাঠানো হচ্ছে নির্বাসনে। প্রতিবাদের ফলে আন্দামানে উদ্বাস্তু পাঠানো বন্ধ করে পাঠানো শুরু হয় দণ্ডকারণ্যে।

আন্দামানের মতন দণ্ডকারণ্যের উদ্বাস্তু শিবিরগুলিও ঘুরে ঘুরে দেখার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার আছে। দণ্ডকারণ্যেই আসলে বাঙালি উদ্বাস্তুরা প্রকৃত নির্বাসিত এবং উপেক্ষিত। সেই কঠিন পাথুরে মাটির পরিবেশে বাঙালি উদ্বাস্তুরা ফসল ফলাতে পারেনি, দশকের-পর-দশক তারা সরকারের গলগ্রহ এবং ডোল-নির্ভর থেকেছে, এক সময় বেপরোয়া হয়ে তারা দলে দলে ছুটে এসেছিল সুন্দরবনের মরিচঝাঁপিতে, তাদের ঘাড় ধাক্কার চেয়েও বেশি অপমান করে বিতাড়িত করা হয়েছে। অপরপক্ষে আন্দামানে যে কয়েক ব্যাচ উদ্বাস্তু পাঠানো হয়েছিল, তারা চতুর্দিকে জল ও নরম মাটি পেয়ে মাছ ধরা ও চাষবাসে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে অবিলম্বে। অনেকে রীতিমতো স্বচ্ছল। গুজব শুনেছি, কোনও কোনও প্রাক্তন উদ্বাস্তু নাকি প্লেন চার্টার করে পশ্চিমবঙ্গে বিয়ে করতে আসে। সত্যি হতেও পারে।

যদি আরও লাখ দু-এক উদ্বাস্তুকে পাঠানো যেত আন্দামানে, তাদের জন্য অঢেল জায়গা ছিল। এটা আমাদের বিরোধী পক্ষের অদূরদর্শিতা তো বটেই। বিরোধী পক্ষের দু-চারজন প্রতিনিধি যদি আন্দামানে গিয়ে স্বচক্ষে সেখানকার পরিবেশ দেখে আসতেন, তা হলে নিশ্চিত এমন প্রতিবাদ কিংবা কালাপানি সম্পর্কে কুসংস্কারের পরিচয় দিতেন না।

সাতাশ বছর বাদে আমি ফিরে গেলাম আন্দামানে, এবারে এক ত্রিভাষা সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে, সস্ত্রীক। প্রথমটায় আমার হতভম্ব হওয়ার মতন অবস্থা, পোর্টব্লেয়ার শহরটি যেন চিনতেই পারছি না। আমার স্ত্রীকে যা গল্প বলেছিলাম, তার কিছুই প্রায় মেলে না। এখন প্রচুর দোকানপাট, প্রচুর বাড়ি, কোনও কোনও এলাকা বেশ ঘিঞ্জি, বেশ কয়েকটি হোটেল ও গেস্টহাউস হয়েছে, তার মধ্যে চার-পাঁচ তারা হোটেলও আছে। এখন পর্যটনকেও উৎসাহিত ও প্রবর্ধিত করা হচ্ছে, ফরসা ফরসা বিদেশি মুখও দেখা যায়।

উন্নতি হয়েছে অবশ্যই, তবে পিছু হটে গেছে বাঙালিরা। আগে শিক্ষক, চিকিৎসক, সরকারি অফিসারদের মধ্যে বাঙালির সংখ্যাই বেশি দেখেছিলাম, এখন তামিল, তেলুগু, মালয়ালি, এমনকী পাঞ্জাবিই অধিকাংশ। যেমন কলকাতা থেকে আন্দামানের জাহাজ ছাড়ে, তেমনই জাহাজ আসে চেন্নাই ও ভাইজাগ থেকে। দক্ষিণ ভারতীয়দের উদ্যম বেশি, অধিকাংশ দোকানের মালিক তাঁরাই। সুদূর পাঞ্জাব থেকে এসে অনেকে এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য চালাচ্ছে, রীতিমতো পাঞ্জাবি সেটলমেন্ট। একসময় কলকাতা বন্দরে জাহাজ ধর্মঘটে মাসাধিককাল আন্দামানের জাহাজ বন্ধ ছিল, সেই সুযোগে চেন্নাইয়ের তৎপরতা বেড়ে গেছে। জারোয়ারাও আর তেমন নেই, কেউ কেউ শহরে এসে ভিক্ষা করে।

এক সময়ে এখানকার স্কুল-কলেজগুলি ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। এখন তা চলে গেছে পণ্ডিচেরিতে। বিচারব্যবস্থা শুধু রয়ে গেছে কলকাতার উচ্চ আদালতের আওতায়। প্রথমবার যখন আসি, এখানকার জঙ্গলে হরিণের সংখ্যা খুব বেড়ে গিয়েছিল। মূল ভূখণ্ড থেকে হরিণ এনে ছাড়া হয়েছিল, বাঘ-সিংহ নেই বলে হরিণের বংশবৃদ্ধি হচ্ছিল হুহু করে। ফসলের খেত ধ্বংস করত, তাই হরিণ মারা নিষিদ্ধ ছিল না। যত্রতত্র হরিণের মাংস ও চামড়া বিক্রি হত। মাংস ছিল চার টাকা কিলো। তখন চিংড়িও ছিল চার টাকা। এখনও হরিণের মাংস পাওয়া যায়, পঞ্চাশ থেকে ষাট টাকা কিলো। শুনলাম, চিংড়ি বেশ দুর্লভ আর সবজির খুব দাম। ফুলকপি ষাট টাকা, কাঁচা লঙ্কা কখনও দুশো টাকা কিলোও হয়।

সরকারি ভাষা মূলত ইংরেজি ও হিন্দি। দ্বিতীয়বার পৌঁছবার পরই একটা করুণ কাহিনি শুনেছিলাম। পোর্টব্লেয়ার কলেজের বাংলা অনার্স ক্লাসে দুটি মাত্র ছাত্রী ছিল, তারা হঠাৎ বাংলা ছেড়ে অন্য বিষয়ে চলে গেছে। দুজন অধ্যাপক আছেন, একজনও ছাত্রছাত্রী নেই। আগের বছরও এমন হয়েছিল। এর পরে বাংলা বিভাগটি যদি তুলে দেওয়া হয়, তাতে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বাংলা পড়তে চায় না। কারণ, প্রয়োজন ছাড়াও বাংলার সাংস্কৃতিক পরিবেশও নেই। একটি ছেলে আমাকে বলল, সে আগে বাংলা কবিতা লিখত, এখন লেখে উর্দুতে। উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে আমার বলার কিছুই নেই, শুনতে বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু যারা মাতৃভাষা ছাড়ে, তারা সাধারণত ইংরেজি গ্রহণ করে, তার বদলে উর্দু হলে একটু তো খটকা লাগবেই।

ম্রিয়মাণ অবস্থার মধ্যেও কিছু কিছু বাঙালি বাংলার সংস্কৃতি ও ভাষাকে এখনও আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বাংলা সিনেমা এখানে অতি দুর্লভ, আদিত্য নাট্য আকাদেমি নামে একটি সংস্থা মাঝে মাঝে মঞ্চস্থ করে নাটক। অনিয়মিত হলেও বেরোয় কয়েকটি সাময়িক পত্রিকা, যেমন বাকপ্রতিমা, দ্বীপবাণী, সমুদ্রমেখলা, আহেলী। রয়েছেন রবীন রায়চৌধুরীর মতন গ্রন্থকার। একটি বাংলা গ্রন্থাগার আছে, পৃষ্ঠপোষকের অভাবে বেশ মলিন। এই বাঙালিদের কি আমরা একেবারেই দূরে সরিয়ে রাখব? এরা চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে বাংলা সংস্কৃতি থেকে? পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচিত, অবিলম্বে পোর্টব্লেয়ারে একটি সংস্কৃতি কেন্দ্র স্থাপন করা। সেটা তথ্যকেন্দ্র ও বাংলা আকাদেমির মিলিত রূপ হতে পারে। ছোট আকারের হলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উপস্থিতি স্থানীয় বাঙালিদের মনে ভরসা জোগাবে।

‘বাকপ্রতিমা’-র সম্পাদক অনাদিরঞ্জন বিশ্বাস আমাকে এমন একটা কথা বলেছিল, যা আমার বুকে গেঁথে আছে। বিবাহিত গৃহস্থ, পরিবার তেমন সচ্ছল নয়। কষ্ট করে, নিছক ভালোবাসার টানে পত্রিকাটি প্রকাশ করে। সে বলেছিল, বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য এক সময়ে ঢাকায় প্রাণ দিয়েছে চার জন, শিলচরে প্রায় দিয়েছে এগারো জন। যদি আবার বাংলাভাষার ওপর তেমন আক্রমণ আসে, তীব্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে আবার প্রাণ দিতে হয়, তা হলে, সুনীলদা, অনুগ্রহ করে আমাকে একেবারে সামনে দাঁড়াবার সুযোগ দেবেন। প্রথম গুলিটায় আমি প্রাণ দিতে চাই।

হিস্ট্রি চ্যানেল হিন্দিতে কেন, বাঙালি আজও সর্বংসহা

আমি হিন্দি ভাষার মোটেই বিরোধী নই। কোনও ভাষারই বিরোধী নই। কিন্তু কিছু কিছু ঔচিত্যবোধের কথা তো বলতেই হবে! কলকাতা তথা পশ্চিমবাংলায় বাংলায় ফিল্মের তুলনায় হিন্দি ফিল্ম অনেক বেশি সংখ্যায় দেখানো হয়, কিন্তু তা জোর করে বন্ধ করার কোনও প্রশ্নই তোলা উচিত নয়। সরকার কিংবা শাসকদল সে বিষয়ে নীতি নির্ধারণ করবেন অথবা করবেন না। বাংলা ফিল্মের কলাকুশলীরা সে ব্যাপারে আন্দোলন করবেন অথবা করবেন না। ফিল্মের ব্যবসা সম্বন্ধে আমি মতামত দেবার অনধিকারী।

টিভি চ্যানেলগুলিতে হিন্দি অনুষ্ঠানেরই আধিক্য। সে বিষয়েও বলার কিছু নেই, দর্শকদের চাহিদা মেটাতেই বোধহয় ব্যবসায়ীরা সে উদ্যোগ নেয়। বাংলা, এমনকী ইংরেজি পত্রিকাগুলিতেও ইদানীং হিন্দি অনুষ্ঠানের আলোচনা এবং ছবি ফলাও করে ছাপা হয়, সেটাও নিশ্চয়ই জনরুচির ব্যাপার। হিন্দি ভাষাতে বেশ কিছু উৎকৃষ্ট ফিল্মও তৈরি হয়, কিন্তু নিকৃষ্ট ফিল্মের সংখ্যাই বেশি। নিকৃষ্টগুলিই প্রাধান্য পায়। সমাজের গতিই তো সেই দিকে। আমার মতন চুটোপুঁটি তা রোধ করতে পারবে না। তবে একটা মজার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। টিভির চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে দেখা যায়, দশটার মধ্যে ছ’-সাতটাতেই একদল ছেলেমেয়ে অবিকল একই ভঙ্গিতে নাচছে, যদি তাকে নাচ বলা যায়। ভারতীয় জনগণের মধ্যে নাচ যে এত জনপ্রিয় তা তো বাস্তব চক্ষু মেলে দেখতে পাইনি কখনও।

টিভি-তে অন্যান্য ভাষার অনুষ্ঠানও থাকে। সেটাই সঙ্গত। বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ নিজেদের পছন্দ মতন অনুষ্ঠান বেছে নিতে পারবে। সেটাই স্বাভাবিক। হিন্দি যদি বেশি জনপ্রিয় হয়, তা হলে হিন্দি অনুষ্ঠান বেশি থাকবে।

ইংরেজি ইংরেজিই থাকুক

আমার আপত্তি, সম্প্রতি ইংরেজি অনুষ্ঠানগুলিও যে হিন্দিতে পরিবেশন করার ঝোঁক দেখা যাচ্ছে, সে বিষয়ে। বিষয়টি গুরুতর। ডাবিং সম্পর্কে কিছু নির্দিষ্ট বিধি আছে। বাংলা অনুষ্ঠান হিন্দিতে কিংবা হিন্দি অনুষ্ঠান বাংলায় ডাব করা চলে না। ইংরেজি অনুষ্ঠান বিষয়ে বুঝি কোনও নীতি নেই? ইতিহাস ও বিজ্ঞান বিষয়ক অনেক অনুষ্ঠান আসে বিদেশ থেকে। সেগুলির হিন্দিকরণ রীতিমতন অন্যায়। বাংলায় ডাব করলেও অন্যায় হত। কলকাতা শহরে বাঙালি, হিন্দিভাষী ছাড়াও বহু বহু অন্য ভাষাভাষী মানুষ তাকে, ইংরেজি অনুষ্ঠানগুলি তাঁদের সকলের জন্য। পটনা কিংবা ইলাহাবাদের মতন শহরে ইংরেজির বদলে হিন্দি চালাবার চেষ্টা করা হলে তবু মানে বোঝা যায়, কিন্তু কলকাতা একটি কসমোপলিটান শহর। এখানে সব ভাষার মানুষেরই অনুষ্ঠান নির্বাচনের স্বাধীনতা থাকা উচিত।

ডাবিং ব্যাপারটাই আমার হাস্যকর লাগে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এর চল কমে যাচ্ছে। কল্পনা করুন তো, গ্রেগরি পেক কথা বলছেন চিনে ভাষায় আর মেরিলিন মনরো প্রেম করছেন তামিলে। মনে আছে, একবার ব্যাঙ্কক শহরের হোটেলে শুয়ে টিভি-তে স্যার লরেন্স অলিভিয়েরের মুখে তাই ভাষা শুনে হাসতে হাসতে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। কোনও হিন্দিভাষীরও নিশ্চয়ই একই অবস্থা হত। ছবিটি ছিল খুবই সিরিয়াস। এখানেও ইতিহাস-বিজ্ঞানের অনুষ্ঠানগুলিতে সাহেব-মেমদের মুখে হিন্দি শুনলে শুধুমাত্র ওই ভাষার মানুষরা পুলকিত হতে পারেন, কিন্তু অন্যদের হাস্যকর মনে হবেই।

বরং সাবটাইটল চলতে পারে

ডাবিং-এর বদলে তবু সাব টাইটল বসানো যেতে পারে। সেটাই সর্বস্বীকৃত রীতি। এখানকার কেবল-অপারেটররা যদি হিন্দি ভাষায় অত্যুৎসাহী হন, তা হলে হিন্দি সাবটাইটেল ব্যবহার করুন। কেউ আপত্তি করবে না। যদি কেউ কেউ বলেন যে, টিভির অনুষ্ঠান চোখে দেখার ও কানে শোনার জন্য, সেই জন্যই যাঁরা লেখাপড়া তেমন জানেন না, তাঁদের জন্যই ডাবিং করা হচ্ছে, তা হলে এই যুক্তি মূর্খতার ধার ঘেঁষে যাবে। অল্পশিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিতদের জন্য অনুষ্ঠানের ধরনটাই অন্যরকম হওয়া দরকার। ইতিহাস-বিজ্ঞানের অনুষ্ঠানগুলি অ-আ-ক-খ থেকে শুরু হয় না। যাঁরা হাবল টেলিস্কোপ বা ব্ল্যাক হোলের কথা কিছুই জানেন না, কিংবা মেসোপটেমিয়ার নাম শোনেননি, তাঁরা মহাকাশ বিজ্ঞান কিংবা ইতিহাসের অনুষ্ঠান শুধু হিন্দি ভাষায় দেখে কী বুঝবেন? তাঁরা ওই সব অনুষ্ঠান দেখবেনই না, তাঁরা নাচ-গান দেখবেন।

আমি হিন্দি ভাষা অনেকটা বুঝি, উত্তর ভারতে গেলে হিন্দিতেই কথা বলি। কিন্তু বিজ্ঞান ও ইতিহাসের সূক্ষ্ম বিষয় ইংরেজিতেই পড়তে শুনতে অভ্যস্ত। তা ছাড়া, চোখের সামনে যখন দেখি সাহেব-মেমরা ঠোঁট নাড়ছে আর কথা ভেসে আসছে হিন্দিতে (অযথা নাটকীয় ভাবে), তখন ক্রমশই বিরক্তি জমতে থাকে। তার পর বন্ধ করে দিই। আমার ধারণা, হিন্দি ভাষার বিদগ্ধ ব্যক্তিরাও অন্য কোনও ভাষাকে দমন করে তার ওপর হিন্দি ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়া পছন্দ করেন না। দক্ষিণ ভারতে কী হয়? তারা জোর করে হিন্দি অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয় বলে এই অত্যুৎসাহীরা তাদের ভয় পায়। বাংলা কত দিন সর্বংসহা হয়ে থাকবে? আমার মতন নিরীহ মানুষেরও এক এক সময় ইচ্ছে হয়, দলবল জুটিয়ে নিয়ে এই সব প্রচার দফতরে ভয় দেখাতে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *