আমি কি বাঙালি – ১

আসলে, মায়ের কখনও মৃত্যু হয় না

পৃথিবীটা নাকি এখন একটা গ্রাম হয়ে গেছে। গ্লোবাল ভিলেজ কথাটা প্রায় প্রতিদিনই দেখা যায়। পৃথিবীর এই নতুন আখ্যার তাৎপর্য ঠিক কী? গ্রাম বলতে সাধারণত যা বোঝায় তা নিশ্চয়ই নয়। একটি গ্রামের মানুষের ভাষা, ধর্ম, আহার্য, পোশাক, সামাজিক রীতিনীতি প্রায় একই হয়। কিছুটা বৈচিত্র্য থাকলেও তফাত বিশেষ থাকে না। তবে কি সারা বিশ্বে সমগ্র মানবসমাজের মধ্যে সমতা স্থাপনের সেই স্বর্ণযুগ এসে গেল? এরকম অবস্থা কল্পনা করতে আনন্দের শিহরন হয় বটে। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের বাস্তব অবস্থা দেখে তা এক বিন্দুও বিশ্বাস করা যায় না। দেশগুলির সীমারেখা ক্রমশ ভাঙছে, যুদ্ধ লেগেই আছে কোথাও না কোথাও, শোষক ও শোষিতদের ব্যবধান প্রকট, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িক বিরোধ বেড়েই চলেছে। উগ্র, হিংস্র, সন্ত্রাসবাদের আক্রমণে কাঁপছে মানবসভ্যতা।

বিগ ব্যাং তত্ত্ব অনুযায়ী ছোট্ট একটা বিন্দুর বিস্ফোরণের পর সৃষ্টি হয় এই মহাকাশের, অজস্র গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্রপুঞ্জ নিয়ে এই যে বিশাল ব্যাপ্তি, তা এখনও বিস্ফারিত হচ্ছে, আরও বেড়েই চলেছে সীমানা। মানবসভ্যতারও তুলনা করা যায় এর সঙ্গে। আফ্রিকার কোনও অঞ্চলে মানবজাতির যাত্রা শুরু, তারপর ছোট্ট একটা মানবগোষ্ঠী ছড়িয়ে পড়তে থাকে নানা দিকে, একদল যায় মধ্য এশিয়ায়, সেখান থেকে পারস্য, ভারত, চিন হয়ে পৌঁছে যায় অস্ট্রেলিয়ায়। অন্য ধারাটি ইউরোপের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ার পর বেরিং সাগর পেরিয়ে ঢুকে পড়ে আমেরিকা ও ক্যানাডায়। তারপর মাত্র কয়েক লক্ষ বছরে এই মানবজাতিরই চেহারায় পোশাক ও আচার আচরণে কত পরিবর্তন হয়। এখন মহাকাশের গ্রহ নক্ষত্রের মতনই মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর বিশাল সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি বলা যেতে পারে। মানবগোষ্ঠীর সঙ্গে পার্থিব অন্যান্য প্রাণীর একটা প্রধান তফাত এই যে, মানুষের যৌনজীবন যেমন অন্যরকম, তেমনই মানুষেরই একটা সুসংবদ্ধ ভাষা আছে। ভাষার জন্যই মনুষ্যজাতি একতা সূত্রে আবদ্ধ, আবার ভাষার জন্যই মানুষে মানুষে এত বিভেদ। আফ্রিকার সেই ক্ষুদ্র মানবগোষ্ঠীর যোগাযোগের একটিই ভাষা ছিল এমন যদি ধরে নেওয়া যায়, তাহলে সেই হোমো সেপিয়ান্সদের মধ্যে এখন অন্তত আট হাজারেরও বেশি ভাষা প্রচলিত। একজন হাঙ্গেরিয়ান, একজন তামিল এবং একজন অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী। এই তিনজনই এই পৃথিবী নামের গ্রহের মানুষ, কিন্তু এদের ভাষার বিন্দু বিসর্গ মিল নেই, মুখোমুখি দেখা হলে এরা বোবা হয়ে থাকবে।

বর্তমানে যদি নানান সীমানা ও কাঁটা তারে ঘেরা বহু বিভক্ত দেশের মানুষ একটি গ্লোবাল ভিলেজের ধারণায় ফিরে আসে, তা হলে তাদের আদিম ধর্ম ও ভাষা কী হবে। আপাতত আমরা ধর্মের প্রশ্নে যাচ্ছি না, ভাষাই আমাদের প্রধান বিবেচ্য। এবং বলাই বাহুল্য, সেই ভাষা হবে ইংরিজি।

ইংরিজি ভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং উন্নত হলেও প্রায় সমান সমান অন্য দু-তিনটি ইউরোপীয় ভাষার চেয়ে অগ্রাধিকার পেয়ে গেছে ঐতিহাসিক কারণে। কলোনি স্থাপনের যুগে ইংরেজরা অন্যান্য ইউরোপিয়ানদের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে ছিল। প্রায় অর্ধেকেরও বেশি পৃথিবী তারা দখল করে রেখেছিল। ইংরেজরা গর্ব করে বলত, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কোথাও সূর্যাস্ত হয় না! তারপর ঔপনিবেশিক যুগের অবসান হলেও ইংরেজের পরিত্যক্ত কলোনিগুলি কিন্তু ইংরিজি ভাষা পরিত্যাগ করেনি। গোটা অস্ট্রেলিয়া এবং উত্তর আমেরিকার অনেকখানিই ইংরিজি ভাষাকেই অবলম্বন করে থেকেছে। এমনকী ভারতবর্ষেও ইংরিজি অন্যতম জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। এবং ইংরিজি ভাষার পতাকাও ব্রিটেনের হাত থেকে আমেরিকায় হাতে চলে যায়, সে দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অসাধারণ উন্নতির কারণে। কমপিউটার ও ইনফরমেশন টেকনোলজির ব্যাপক প্রভাবের ফলে ইংরিজি ভাষা আজ সব ভাষার মাথায় চড়ে বসেছে। এক সময় ফরাসি আর স্প্যানিশ ভাষার সঙ্গে ইংরিজির বেশ রেশারেশি ছিল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরেও ফরাসিরা নিজেদের ভাষার প্রতি অহংকারবশত একটা ইংরিজি বাক্যও উচ্চারণ করত না। এখন শুধু ইংরিজি জ্ঞান নিয়েই ইউরোপের সব দেশেই যে-কেউ মোটামুটি কাজ চালিয়ে নিতে পারে।

ইংরিজি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনের ভাষা হিসেবে অবশ্যই স্বীকৃত। তা হলে অন্যান্য ভাষাগুলির কী হবে? কেউ কেউ বলছেন, অন্য ভাষাগুলির আস্তে আস্তে অবলুপ্তি ছাড়া অন্য কোনও গতি নেই। আগামী একশো বছরের মধ্যে সেরকমই ঘটবে। এই ভবিষ্যৎবাণীর দুটি দিক আছে। অন্য ভাষাগুলির কি সহজ, স্বাভাবিকভাবে ধীরে ধীরে মৃত্যু হবে, জোর করে গলা মুচড়ে মেরে ফেলা হবে? দ্বিতীয়টি নিশ্চিত সম্ভব নয়। বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে ফেলার উপমাও এখানে খাটবে না। কারণ, ইংরিজি যতই বড় মাছ হোক, অন্য বেশ কয়েকটি ভাষা মোটেই ছোট মাছের পর্যায়ে পড়ে না, তারাও এমনই বৃহৎ যে তাদের একটি একটি করে গিলে ফেলার ক্ষমতা ইংরিজিরও নেই। চিন ও ভারতীয় ভাষাগুলি পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষের মাতৃভাষা। স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, রাশিয়ান, জাপানি ভাষার ভিত অনেক শক্ত; ফরাসি ও জার্মান ভাষাভাষীর সংখ্যা খুব বেশি না হলেও ঐতিহ্যের ঐশ্বর্যে এই দুই ভাষার প্রভাব সুবিস্তৃত। এর মধ্যে যে-কোনও একটি ভাষার ওপর উদ্দেশ্যমূলক ভাবে আঘাত হানতে গেলে যে প্রবল বিক্ষোভের সম্মুখীন হতে হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ভাষার আবেগে কোথাও কোথাও মানুষ প্রাণ দিতেও কুণ্ঠিত হয় না। তার একটি উদাহরণ, ভারত বিভাগের ফলে পাকিস্তান নামে নবীন রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার মাত্র সাত বছরের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বাংলাভাষায় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে, পুলিশের গুলিতে ঢাকা শহরে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি চারজন শহীদ হয়। শুধু ভাষার দাবিতে এমন প্রাণদানের নজির সারা পৃথিবীতেই বিরল। পরবর্তীকালে পাকিস্তান আবার দ্বিখণ্ডিত হলে যে বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রের জন্ম হয়, তার অন্যতম কারণও সেখানকার গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবি। এর ফলেই পরবর্তীকালে এই একুশে ফেব্রুয়ারি দিবসটিকে UNESCO থেকে পৃথিবীর প্রতিটি দেশেরই মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ভারতে আসামের কাছাড় অঞ্চলে প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা, কিন্তু রাজ্য সরকার সেই ভাষার কোনও অধিকারই দেয়নি বলে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিল শুরু হয় শিলচর শহরে। সেখানও মিছিলের ওপর দায়িত্বজ্ঞানহীন পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়, মৃত্যু হয় এগারোজন মানুষের। ১ মে, ১৯৬১ সালে। এই চরম শোকাবহ ও লজ্জাজনক ঘটনা বেশি প্রচারিত হয়নি, বরং চাপা দেওয়ারই চেষ্টা হয়েছে।

ভারত ও চিন এই দুটি পাশাপাশি দেশ দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ বলে সারা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কিন্তু ভাষার প্রশ্নে এই দুটি দেশের দুরকম সমস্যা। চিনে শতকরা পঁচানব্বই ভাগ লোকের ভাষা ম্যান্ডারিজ, সুতরাং অধিবাসীদের মধ্যে ভাষার ব্যবধান নেই বললেই চলে, কিন্তু ইংরিজি শিক্ষায় সে দেশ এখনও অনেক পিছিয়ে। আবার ভারতে ইংরিজি শিক্ষার অনেক অগ্রগতি হলেও বিভিন্ন রাজ্যের মানুষের মধ্যে মাতৃভাষার ব্যবধান দুস্তর। ভারতে প্রচলিত আছে প্রায় ৮০০টি ভাষা, তার মধ্যে প্রধান ভাষাগুলির মধ্যে ২২টি ভারত সরকার কর্তৃক স্বীকৃত (সাহিত্য আকাদেমি আরও দুটি ভাষাকে গ্রহণ করেছে)। এর মধ্যে হিন্দি, বাংলা, তামিলের মতন এগারোটি ভাষারই পৃথক জনসংখ্যা এক এক কোটির বেশি। হিন্দি এবং বাংলা পৃথিবীর প্রধান পাঁচটি ভাষায় অন্তর্গত। স্বাধীনতার পর কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল যে, ইংরিজি এবং হিন্দিই হবে সারা দেশের যোগাযোগের ভাষা, এবং আশা করা হয়েছিল যে তিরিশ বছরের মধ্যে ইংরিজিকেও সরিয়ে দিয়ে হিন্দিই হবে প্রধান ভারতীয় ভাষা। সেই আশা বাস্তাবায়িত হলে খুব ভালোই হত। যেমন এক কালের বহু ভাষায় বিভক্ত চিনকে এক সম্রাটের আদেশে ম্যান্ডারিজ ভাষা সারা দেশকে একতাবদ্ধ করেছে, সেইরকম গণতান্ত্রিক ভারতে হিন্দি সর্বজনগ্রাহ্য হলে অনেক সমস্যা এড়ানো যেত। কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বাধীনতার পর ষাট বছর কেটে গেলেও সেই আশা সার্থক হয়নি। বিশ্বের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের ভারতেও ইংরিজিই এখন প্রধান ভাষা। এটা ইংরিজি ভাষার প্রতি মুগ্ধতা বা ভালোবাসার জন্য ঘটেনি। ইংরিজির প্রতি আনুগত্য এসেছে নিতান্তই প্রয়োজনের খাতিরে। এবং এখন আর কিংস ইংলিশের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য অনেকেই তোয়াক্কা করে না। আমেরিকান ও অস্ট্রেলিয়ান ইংলিশের মধ্যে ইন্ডিয়ান ইংলিশ দিব্যি চালু হয়ে গেছে।

ইংরিজির এই প্রাধান্য আমরা বাধ্য হয়েই মেনে নিয়েছি। কিন্তু অন্য ভাষাগুলির কী হবে? ইংরিজিকেই একমাত্র ভাষা হিসেবে অবলম্বন করে কি অন্য ভাষাগুলি পরিত্যক্ত হয়ে যাবে? এখন নানান কারণে বহু মানুষই ভ্রাম্যমান, বেশ কিছু ভারতীয়ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বসতি নিয়েছে, তাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম মাতৃভাষা শিক্ষার কোনও সুযোগই পায় না। তারা শুধু ইংরিজি নির্ভর হয়েই বেড়ে ওঠে। কিন্তু এখানে এদের সংখ্যা খুব বেশি নয়, ভারতের বিপুল জনসংখ্যার তুলনায় তারা নগণ্য, অধিকাংশ ভারতীয়ই মাতৃভাষা থেকে বিচ্যুত হয়নি। তা হলে কি সব মানুষকেই দ্বিভাষী হতে হবে? কেউ কেউ বলছেন, অন্যান্য ভাষাগুলির যদি দ্রুত অবলুপ্তি নাও হয়, তা হলেও সেগুলি ক্রমশ বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যাবে। অর্থাৎ মা-বাবা, কাজের লোকদের সঙ্গে মাতৃভাষা আর বাড়ির বাইরে অন্য সব প্রয়োজনে ইংরিজি। তা হলে কাব্য-সাহিত্য, দর্শন ইত্যাদি রচিত হবে কোন ভাষায়? আপাত দৃষ্টিতে এগুলি অপ্রয়োজনীয় কিন্তু এসবের ওপর নির্ভর করেই সভ্যতা এগিয়ে চলে। দু-চারজন আত্মম্ভরি লেখক যাই বলুন, এখনও পর্যন্ত কাব্য-সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদগুলি লেখকদের মাতৃভাষাতেই রচিত। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় লেখকরা তাঁদের মাতৃভাষা ইংরিজিতেই লেখেন, তাদের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় নামতে হয় অন্য লেখকদের। এ পর্যন্ত সৃষ্টিশীল রচনায় দ্বিতীয় দলের সাফল্য নামমাত্র।

ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা যতই প্রাসঙ্গিক হোক, এ কথাও সত্য যে, বর্তমান কালে গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের মধ্যে ভাষা নিয়ে যথেষ্ট আবেগ আছে। যত ছোট ভাষাই হোক, অনেকেই মাতৃভাষাকে ভালোবাসে। মাতৃভাষার বিলুপ্তি রক্ষা করার জন্য কেউ কেউ এখানে প্রাণ দিতে রাজি আছে। এ সম্পর্কে একটা কৌতুককর বিবরণ এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে।

আইজাক বাশেভিস সিঙ্গার (Issac Bashevis Singer) Yiddish ভাষার প্রখ্যাত লেখক। নোবেল প্রাইজও পেয়েছিলেন। অনেকেরই ধারণা ইডিশ একটা মুমূর্ষু ভাষা। নোবেল পুরস্কার গ্রহণের সময় সিঙ্গার এই কথাগুলি বলেছিলেন।

People ask me often, why do you write in a dying language? And I want to explain it in a few words.

Firstly, I like to write ghost stories and nothing fits a ghost better than a dying language. The deader the language the more alive is the ghost. Ghosts love yiddish and as far as I know, they all speak it.

Secondly, not only do I believe in ghosts, but also in recorrection, I am sure that millions of yiddish speaking corroses will rise from their graves one day and their first question will be—Is there any new yiddish book to read? for them yiddish will not be dead.

Thirdly, for 2000 years Hebrew was considered a dead language. Suddenly it became strongely alive. what happened to Hebrew may also happen to yeddish one day, (although I haven’t the slighest idea how this miracle take place.)

There is still a fourth minor reason for not forsaking yiddish and this is yiddish may be a dying language, but it is the only language I know well. Yiddish is my mother language and a mother is never really dead.”

বাংলা ভাষার আত্ম-পরিচয়

পৃথিবীর জনসংখ্যা এখন ছ’শো কোটি ছাড়িয়ে গেছে, তার এক তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ দুশো কোটিরও কিছু বেশি মানুষের বাসস্থান দুটি মাত্র দেশে। চিন এবং ভারত। খণ্ডিত ভারতের তুলনায় চিন আয়তনে এবং জনসংখ্যায় ভারতের চেয়েও বড়, এবং চিনের আরও একটি বিশেষ সুবিধে এই যে, এই বিশাল জনসংখ্যার শতকরা পঁচানব্বই অংশেরই ভাষা এক, ভাষার সূত্রে চিন সমগ্র দেশে ঐক্যবন্ধন বজায় রাখতে পেরেছে। চিনের এই ভাষানীতি এমনই কঠোর যে সেখানে মুসলমানদেরও আরবি নাম গ্রহণ করতে দেওয়া হয় না। পৃথিবীর সমস্ত দেশেই যেসব মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, তাঁদের সকলকেই আরবি নাম গ্রহণ করতে হয় (যেমন, আমেরিকার প্রখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা ক্যাসিয়াস ক্লে হয়েছে মহম্মদ আলি) এবং আজান ও কোরান পাঠ করতে হয় আরবি ভাষায়। একমাত্র চিনে সে অধিকার নেই। সে দেশের মসজিদেও কোরান পাঠ হয় চিনা ভাষায়।

ভারতীয় জনগণ বহু ভাষা, বহু ধর্ম ও বহু জাতিতে বিভক্ত। ভাষা অনেক সময়ই জাতীয়তার ভিত্তি। এই জন্যই ভারতীয় জাতীয়তার সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করা শক্ত। ভারত গণতান্ত্রিক ও ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এই দুটি নীতির মধ্যেই যে উদারতা রয়েছে, তাতে বিচ্ছিন্নতার প্রচেষ্টাও প্রশ্রয় পায়। এই সমস্যায় ভুগতে হয়েছে স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের জন্মকাল থেকেই। এবং অনেক বাধা বিঘ্ন সত্ত্বেও নানান স্থানীয় বিভাজনের মধ্যেও ঐক্য স্থাপনের চেষ্টাও চলেছে। বিদেশে ভারতীয় সাহিত্য বলতে অনেকে বেদ-উপনিষদ, রামায়ণ-মহাভারতের সময়কালীন সাহিত্য মনে করেন। কিন্তু আধুনিক ভারতীয় সাহিত্যের কোনও নির্দিষ্ট রূপ নেই। বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যের ঐতিহ্য এবং আঙ্গিকে অনেক তফাত। জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন, Indian literature is one, but written in many languages, কথাটা শুনতে ভালো। কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে কোনো মিল নেই। একজন শিক্ষিত ভারতীয় ইওরোপ-আমেরিকার সাহিত্য সম্পর্কে যত খবর রাখেন, সেই তুলনায় অন্য ভারতীয় ভাষাগুলির সাহিত্য সম্পর্কে তাঁকে অজ্ঞই বলা যায়। তবু, ভারতের এমন কয়েকটি ভাষা আছে, যেগুলি সারা বিশ্বের প্রধান ভাষাগুলির সমপর্যায়ের। চিনে-ভাষা অবশ্যই এক নম্বর ভাষা। ইওরোপের দেশগুলি ছোট ছোট, সেখানকার কয়েকটি ভাষা খুবই সমৃদ্ধ, কিন্তু এক-একটি দেশের জনসাধারণের মাতৃভাষা শুধু সংখ্যার বিচারে এশিয়ার ভাষাগুলির সমকক্ষ হতে পারে না। এর মধ্যে ইংরেজ ও স্প্যানিশরা বিভিন্ন মহাদেশে কলোনি স্থাপন করে নিজেদের ভাষা ছড়িয়ে দিয়েছে। যেমন আমেরিকা এবং ক্যানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ায় ইংরিজি ভাষার প্রাধান্যের জোরেই এখন ইংরিজি পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রধান ভাষা। স্প্যানিশ ভাষাও প্রাধান্য পেয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার অনেকখানি রাজ্যে, তার স্থান তৃতীয়। কিন্তু ভারতীয়রা কলোনি বিস্তার করতে পারেনি বা চায়নি, তা সত্ত্বেও তাদের দুটি ভাষা, হিন্দি ও বাংলা জনসংখ্যার ভিত্তিতে পৃথিবীতে চতুর্থ ও পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে। (একেবারে সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে স্প্যানিশ ভাষাকে পেছনে সরিয়ে দিয়ে হিন্দি ও বাংলা চলে এসেছে তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে।)

বাংলা ভাষার ইতিহাস বেশ বিচিত্র। হিন্দি পুরোপুরি ভারতীয় ভাষা। কিন্তু বাংলা ভাষা তা নয়। পূর্বতন বঙ্গদেশ রাজনৈতিক কারণে বিভক্ত হয়ে, তার দুই তৃতীয়াংশ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। বর্তমানে তা বাংলাদেশ নামে স্বাধীন রাষ্ট্র। সেখানকার রাষ্ট্রভাষা বাংলা। ভারতেও বাংলা ভাষা অন্যতম জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃত, পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা এই দুটি রাজ্যের ভাষা বাংলা। আসামের একটি জেলাও বাংলাভাষী। পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের দাবিতে যেমন চারজন শহিদ হয়েছিলেন, সেরকম আমাদের কাছাড় জেলাতেও বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে প্রাণ দিয়েছেন এগারোজন। বাংলাদেশ ও ভারতের বাইরেও বাংলাভাষী বহু মানুষ ছড়িয়ে আছে সারা পৃথিবীতে। সব মিলিয়ে মোট বাঙালির সংখ্যা পঁচিশ কোটির বেশি। অর্থাৎ বাঙালির সংখ্যা আমেরিকানদের সংখ্যার প্রায় সমান সমান।

সাধারণভাবে একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে বাংলাভাষা প্রাচীন সংস্কৃত ভাষারই একটি কন্যা। এটা ঠিক নয়। বাংলার সঙ্গে সংস্কৃতের সম্পর্ক অতি সুদূর। ইতিহাসপূর্বকালে এশিয়া-ইওরোপে যে ভাষার প্রচলন ছিল, তার নাম দেওয়া হয়েছে Indo-European Language, তার নিদর্শন এখন খুঁজে পাওয়া খুবই শক্ত। তবে Germanic, Italic, Hellenic Slavic এবং Indo-Iranian ভাষাগুলির উৎস হিসেবে সেই ভাষাকেই ধরা হয়। ইওরোপের ল্যাটিন এবং ভারতের সংস্কৃত ভাষার সৃষ্টি ওই একই উৎস থেকে। ইংরিজি ভাষা যেমন ল্যাটিন থেকে সরাসরি আসেনি, এসেছে Low German থেকে, সেইরকম সংস্কৃত ভেঙে পালি এবং অনেকগুলি প্রাকৃত ভাষার উদ্ভব হয়, তারই একটি, মাগধী প্রাকৃতের সঙ্গে বাংলা ভাষার কিছুটা সম্পর্ক আছে। সংস্কৃত ক্রিয়াপদ এবং বাক্যের Syntax থেকে বাংলা ভাষা অনেকখানি সরে এসেছে, যদিও সংস্কৃত শব্দভাণ্ডার থেকে অনেক শব্দ এখানে অবিকৃতভাবে সরাসরি চলে এসেছে বাংলায়, সেইসব শব্দকে বলা হয় তৎসম, আর যেসব শব্দ কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে, সেগুলি তদভব। এর সঙ্গে সহজভাবে মিশে আছে আরও বহু দেশি ও বিদেশি শব্দ। অন্য ভাষা থেকে প্রচুর শব্দ আহরণ করতে পেরেছে বলেই বাংলা ভাষা দ্রুত এত উন্নত ভাষা হতে পেরেছে।

বাংলা ভাষার আর একটি বৈশিষ্ট্যও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান ও খ্রিস্টান, এই চার ধর্মেরই মানুষ রয়েছে বাঙালিদের মধ্যে এবং এই প্রত্যেক ধর্মেরই কিছু কিছু প্রভাব পড়েছে বাংলা ভাষায়। প্রায় এক হাজার বছর আগেকার বাংলা ভাষার যে আদিরূপের নিদর্শন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল থেকে সংগ্রহ করে এনেছিলেন, চর্যাপদ নামে সেই ছোট ছোট কবিতাগুলি বৌদ্ধদের রচনা। একসময় সারা ভারতেই হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদকে হটিয়ে দিয়ে বৌদ্ধরা প্রধান হয়ে উঠেছিল। কয়েক শতাব্দী পরে ব্রাহ্মণ্যবাদ আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, হিন্দু সমাজের শিরোমণিরা চতুর কৌশলে বুদ্ধকে হিন্দু অবতার হিসেবে ঘোষণা করে, অর্থাৎ বৌদ্ধধর্ম হিন্দুত্বের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। এবং তখনও যারা বৌদ্ধ জীবনচর্যা পালন করছিল, মারতে শুরু করা হয় তাদের। অনেক বৌদ্ধ তখন লুকিয়ে সমাজের নীচু তলায় আশ্রয় নেয়, তারাই রচনা করে এই চর্যাপদগুলি। বৌদ্ধরা সবসময়েই সাধারণ মানুষের সুবোধ্য ভাষায় এবং মুখের ভাষায় ধর্মপ্রচার করেছে, সেই জন্যই বৌদ্ধ শাস্ত্র ও সাহিত্য সরে গেছে সংস্কৃত থেকে। চর্যাপদগুলির ভাষাও একেবারে নীচু তলার মানুষের মুখের ভাষায় রচিত। সুতরাং অভিজাত ও উচ্চশিক্ষিতদের ভাষার বদলে সেই আদি বাংলা ভাষার ভিত্তি হয় জনগণের ভাষা।

ভারতে ইসলাম ধর্মের আগমনের পরেই তা অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। মোগল-পাঠানরা সাতশো বছর ধরে ভারতে রাজত্ব করেছে বটে, কিন্তু শুধু রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতাতেই ইসলামের এতখানি জনপ্রিয়তা সম্ভব ছিল না। এ জনপ্রিয়তার কারণ হিন্দুদের নিজস্ব দুর্বলতা। হিন্দু সমাজ তখন নানান শ্রেণি ও বর্ণে বিভক্ত। উঁচুতলার লোকেরা নীচুতলার মানুষদের সমস্ত মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। যুক্তিহীন অন্ধ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়েছিল এমনকী শিক্ষিত সম্প্রদায়ও। বৈশ্য ও শূদ্ররা ছিল অস্পৃশ্য, এক কুয়ো বা পুকুর থেকে উচ্চবর্ণের সঙ্গে তাদের জল পানেরও অধিকার ছিল না। হিন্দু মন্দিরে বিড়াল বা ছাগলও ঢুকে পড়তে পারত, কিন্তু কোনও তথাকথিত অন্ত্যজ শ্রেণির শিশু মন্দির এলাকায় ভুল করে ঢুকলেও মার খেত। (ভারতের অনেক অঞ্চলে এইসব কুৎসিত প্রথা এখনও রয়ে গেছে।) ইসলাম এসে শ্রেণিহীন সমাজ ও সমভ্রাতৃত্বের ডাক দেয়, তাতেই আকৃষ্ট হয় হিন্দু সমাজের নির্যাতিত, অপমানিত মানুষের দল। এদেরই সংখ্যা ছিল বেশি। (মুসলমানদের মধ্যে সমভ্রাতৃত্বের আদর্শ যদিও বাস্তবে পুরোপুরি সত্য নয়, সেখানেও শ্রেণিভেদ আছে। তবু তা হিন্দু সমাজের তুলনায় অনেক বেশি সংযত।) ক্রমে বাঙালিদের মধ্যে মুসলমান জনসংখ্যা হিন্দুদেরও ছাড়িয়ে যায়।

মুসলমান শাসকদের সঙ্গে আসে আরবি ও ফার্সি ভাষা। সাধারণ মুসলমানদের ধর্ম চর্যার জন্যও আরবি ভাষা অত্যাবশ্যক। তার ফলে অনেক আরবি শব্দ ও কিছু কিছু ফার্সি শব্দ ঢুকে পড়ে বাংলা ভাষায়। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সেইসব শব্দ গ্রহণ করে এবং সাহিত্যেও স্থান পায়। (যেমন পরবর্তীকালে ইংরেজদের আগমনের পর আমরা গ্রহণ করেছি প্রচুর ইংরেজি শব্দ, ফরাসি সংস্পর্শে তাদেরও কিছু শব্দ ঢুকেছে বাংলায়, এমনকী পর্তুগিজ জলদস্যুরাও কয়েকটি শব্দে তাদের চিহ্ন রেখে গেছে।) গত চার-পাঁচশো বছরের মধ্যে বাংলা হয়ে ওঠে পুরোপুরি একটি মিশ্রভাষা। সংস্কৃত থেকে বাংলা কত দূরে সরে এসেছে, তার প্রমাণ এখন অসংস্কৃত শব্দ বাদ দিয়ে পরপর তিনটি বাক্য লেখাও শক্ত।

আমি একসময় কাশ্মীরের রাজা জয়াপীড়-কে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখেছিলাম। রাজ্যচ্যুত হয়ে জয়াপীড় সুদূর কাশ্মীর থেকে ঘুরতে ঘুরতে বাংলায় এসে উপস্থিত হন এবং পরে এখানেই একটি রাজ্য স্থাপন করেন। এটা সপ্তম শতাব্দীর ঘটনা, যখন ভারতে ইসলামের নাম-গন্ধ কিছুই ছিল না। সুতরাং এই উপন্যাস লিখতে গিয়ে আমার মনে হয়েছিল, এর ভাষায় আরবি-ফার্সি শব্দ থাকা উচিত নয়। কিন্তু কয়েকলাইন লিখেই আমি থমকে গিয়ে বুঝেছি, এই শুদ্ধতা রক্ষা করা অসম্ভব। জোর করে লিখতে গেলেও তা হবে কৃত্রিম। অনেক আরবি-ফারসি শব্দ, যেগুলিকে এক সময় বলা হত মুসলমানি শব্দ, তা আমাদের অস্থি-মজ্জায় এমনভাবে গেঁথে গেছে যে তার কোনও প্রতিশব্দই এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। উদাহরণ হিসেবে পছন্দ শব্দটি উল্লেখ করা যায়, যা এসেছে পসন্দ থেকে। বাংলায় পছন্দ শব্দটির কোনও বিকল্প আছে কি? ইসলাম-পূর্ব অতীতে নিশ্চয়ই কোনও শব্দ ছিল, কিন্তু তা হারিয়ে গেছে। এখন আবার তা খুঁজে আনাও অর্থহীন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কিছু কিছু পণ্ডিত নির্বোধের মতন আরবি-ফারসি শব্দগুলির বদলে নতুনভাবে সংস্কৃত শব্দ প্রয়োগের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাতে শুধু বিভ্রান্তিই ঘটেছে। যেমন আমরা সবাই কলম দিয়ে লিখি। কোনও কোনও পণ্ডিত কলমের বদলে লেখনী ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কলম আর লেখনী এক নয়। ওড়িশার তালপাতার ওপর আঁচড় কাটবার জন্য এক ধরনের লোহার শলাকা ব্যবহার করা হত, তার নাম লেখনী, তাতে কালির দরকার হয় না। সেইরকমই দোয়াত-এর বদলে মস্যাধার বললে তা হাস্যকর শোনাবে। বাংলায় লেখা হয় অন্যরা কিংবা অন্যদের, এই বহুবচনের রা ও দের সরাসরি মুসলমানদের কাছ থেকে পাওয়া। এসব এখন বদলাবার কোনও প্রশ্নই নেই।

এক সময় কিছু কিছু মুসলমান লেখকও সংস্কৃত শব্দে হিন্দুয়ানির গন্ধ পেয়ে যতদূর সম্ভব অপ্রচলিত আরবি-ফারসি শব্দ চালাবার চেষ্টা করেছিলেন। তাকেই বলা হত মুসলমানি বাংলা। সেসব লেখায় গ্রন্থের বদলে কিতাব, সুন্দর-এর বদলে খুবসুরৎ ইত্যাদি ব্যবহার করা হতে লাগল জোর করে। মীর মোশারফ হোসেন, এস ওয়াজেদ আলি প্রমুখ লেখকেরা এধরনের মৌলবী বাংলা থেকে বাংলা ভাষাকে উদ্ধার করেন। পূর্ব পাকিস্তানেও এক সময় সামরিক শাসকরা বাংলা ভাষা থেকে হিন্দুয়ানির গন্ধ তাড়াবার জন্য জোর করে বেশি বেশি উর্দু ও আরবি শব্দ মেশাবার জন্য ফতোয়া জারি করেছিল। কিন্তু ভাষা প্রবাহিত হয় স্বাভাবিক নিয়মে, জোর জবরদস্তি করে তা বদলানো যায় না। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান লেখকরা এই ফতোয়া একেবারে মানেননি, বরং উলটোটাই হয়েছে বেশি, আমি লক্ষ করেছি, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের লেখকদের ভাষায় বেশি বেশি সংস্কৃতঘেঁষা শব্দ স্থান পেত, সেই তুলনায় পশ্চিম-বাংলায় লেখকদের রচনায় অবাধ ছিল উর্দু ও আরবি শব্দ।

বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে মুসলমানদের অবদান অনেকখানি। মধ্যযুগে বঙ্গভূমি বা বাংলা নামে কোনও বড় রাজ্য ছিল না। ভৌগোলিকভাবে এই অঞ্চল ছিল অনেকগুলি ছোট ছোট রাজত্বে বিভক্ত। সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ এই ছোট ছোট রাজ্যগুলিকে জয় করে এক সীমানার মধ্যে নিয়ে আসেন। তখন পর্যন্ত বাংলা ভাষার নিজস্ব কোনও রূপরেখা গড়ে ওঠেনি। যুক্ত হবার পর বিভিন্ন অংশের সঙ্গে যোগাযোগের ভাষা অর্থাৎ Lingua franca হিসেবে বাংলা ভাষা গড়ে ওঠে। কিন্তু তখন এই ভাষার নাম কী ছিল? বাঙালিরা তাদের মাতৃভাষার নাম যে বাংলা, তা জেনেছে অনেক পরে। তখন সাধারণ মানুষ দুটি ভাষার কথা জানত, শাস্ত্রের ভাষা বা পণ্ডিতদের ভাষার নাম সংস্কৃত আর জনসাধারণের ভাষার নাম দেশি ভাষা, অথবা শুধু ভাষা। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ফারসি ভাষা-ভাষী মুসলমানরাই প্রথমে এই দেশীয় ভাষার নাম দেয় বাঙ্গলহ বা Bangalla। মা হুয়ান নামে এক চিন দেশীয় মুসলমান পঞ্চাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে সমুদ্র অভিযানে বেরিয়ে বাংলা অঞ্চলেও এসেছিলেন, তিনি লিখেছিলেন যে এই দেশের লোক প্রধান যে ভাষাটি ব্যবহার করে তার নাম বঙ্গ-কো-লি। অর্থাৎ বঙ্গালি বা বাঙ্গালি। অর্থাৎ মা হুয়ানের রচনাতেই প্রথম বাংলা ভাষার নামটি পাওয়া যায়। সুলতানি আমলে হিন্দুদের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানরাও এই বাংলা ভাষাতে সাহিত্য রচনা শুরু করেন।

সৌভাগ্যবশত সংখ্যা গরিষ্ঠতার সুযোগে কিংবা রাজনৈতিক কারণে মুসলমানদের জন্য আলাদা ধরনের কোনও বাংলা ভাষা গড়ে উঠতে পারেনি। বঙ্কিম-মীর মুশারফ-রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের সৃষ্টিতে যে অত্যন্ত শক্তিশালী ও আধুনিক বাংলা ভাষা বর্তমানে রূপ পেয়েছে, তাতে কিন্তু মুসলমানের সমান উত্তরাধিকার। স্বাধীনতার পর দেশভাগ হবার সময় বাংলা ভাষাও ভাগ হবার একটা সম্ভাবনা ছিল। সেই সময় প্রখ্যাত পণ্ডিত ও ভাষাবিদ ড. শহিদুল্লা একটি বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করেন। পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষার রূপ কী হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলায় বিভিন্ন জেলার কথ্য ভাষা ভিন্ন ভিন্ন। যশোর জেলার সঙ্গে চট্টগ্রামের ভাষার এতই তফাত যে প্রায় এক ভাষা বলে বোঝাই যায় না। শুধু উচ্চারণ নয়, শব্দ ব্যবহার এবং ক্রিয়া পদেও অনেক অমিল। কোনও কোনও জেলায় অতীত ক্রিয়াপদ দিয়ে ভবিষ্যৎ বোঝানো হয়। সুতরাং কোনও বিশেষ একটি জেলার ভাষাকে স্ট্যান্ডার্ড বাংলা হিসেবে ধরে নিলে প্রচুর গোলমালের সম্ভাবনা ছিল। সেই সময় ড. শহিদ্দুলা বলেছিলেন, পশ্চিমবাংলার কৃষ্ণনগর অঞ্চলের ভাষার সমগ্র বাঙালির ও বাংলা সাহিত্যের স্ট্যান্ডার্ড ভাষা হিসেবে আগেই গৃহীত হয়ে আছে, সুতরাং তার থেকে সরে গেলে পূর্ব বাংলার ভাষা বাংলা ভাষার মূল স্রোত থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এই সাহসী সিদ্ধান্তের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সংবাদপত্রে, রেডিয়োতে এবং টিভিতে যে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হয় তা মূল স্রোতের বাংলা। বাংলাদেশ ও ভারতের এবং পৃথিবীর বহু দেশে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিদের ভাষা একই রয়ে গেছে। ভাষাই যেহেতু সংস্কৃতির প্রধান বাহন, তাই রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিভেদ যতই মাথা চাড়া দিয়ে উঠুক মাঝে মাঝে, ভাষার সূত্রে সমস্ত বাঙালিদের আত্মীয়তা কখনও বিচ্ছিন্ন হয়নি। ভাষার শক্তিতে বিশ্বের পঁচিশ কোটি বাঙালি যতদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকতে পারবে, ততদিনই বাংলা ভাষা বিশ্বের অন্যতম প্রধান ভাষা হিসেবে গণ্য হবে।

টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের অন্তর্গত

বাংলা বিভাগে প্রদত্ত ভাষণ। ২২ নভেম্বর ২০০২।

আ মরি বাংলা ভাষা

আজকাল খুব আশ্চর্যের সঙ্গেই একটা বিষয় লক্ষ করি, বেশ কিছু বাঙালি, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে এক ধরনের হীনমন্যতায় ভোগেন। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বাঙালির এই আত্মসন্মান বোধের অভাব আজকাল খুবই চোখে পড়ে। আসলে ব্যাপারটা এই যে, বাংলা নিয়ে আমাদের হীনমন্যতা। আমরা সব জায়গায় বাংলা বলি না, আমাদের ছেলেমেয়ে বাংলা না শিখলে আমরা গর্ববোধ করি। এটা হচ্ছে আত্মসম্মান বোধের অভাব। কেন না, মানুষের চরিত্র তৈরি হয় তার ভাষার প্রতি ভালোবাসা থেকে। তাই ভাষা একটা মানুষের ব্যক্তিত্বকে তৈরি করার ক্ষেত্রে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা নেয়। যারা এটা ভুলে যায়, তারা জীবনে খুব বেশি উন্নতি করে বলে আমি মনে করি না। কিছু কিছু জাগতিক বিষয় তাদের কব্জায় আসতে পারে কিন্তু শেষ পর্যন্ত খুব একটা সুখী তারা হয় না। আমি এরকম অনেক উদাহরণ জানি।

বিদেশে আমি দেখেছি। কিছু কিছু লোক যারা প্রাণপণ চেষ্টা করে মাতৃভাষা ভুলে গেছে, বাঙালিদের সঙ্গেই মিশতে চায় না, বাংলা গান শোনে না, তারা ওদেশে গিয়ে সাহেব হবে। সাহেব তারা জীবনে হতে পারবে না; গায়ের রং কোনওদিন পালটাতে পারবে না, পাল্টানো যায় না। আর যতই সাজ পোশাক করুক, সাহেবরা তাদের নেটিভ বা কালো লোকই বলবে। আমরা যাদের খুব ফরসা বলি তারাও ওদেশে কালো। কেন তারা কালো হয়ে থাকল জানি না।

এই যারা এই জায়গা থেকে বিচ্যুত হতে হতে ওদেশের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিতে চায়, এক প্রজন্মে এটা সম্ভব হয় না। আমি কিছু কিছু লোককে দেখেছি যাদের সবই আছে। বিদেশে বাড়ি আছে, দু-তিনখানা গাড়ি আছে, ফুটফুটে ছেলেমেয়ে আছে। সুন্দরী শিক্ষিত স্ত্রী আছে কিন্তু অদ্ভুত একটা অসুখী ছাপ তাদের মনে, তারা ভীষণ নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। এটার কারণটা যারা মনোচিকিৎসক তারা বলেছেন, মাতৃসংস্কৃতি থেকে বিচ্ছেদের জন্য এটা হচ্ছে। সবই আছে কিন্তু কিছুই ভালো লাগছে না। একটা অদ্ভুত ছটফটে ভাব, একটা অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা। তারা কেউ প্রচুর মদ খাওয়া শুরু করে, কেউ কেউ জুয়া খেলে, কেউ কেউ ব্যভিচার করে। অর্থাৎ কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারে না। এটা প্রথম জীবনে যে অন্যায়, তার আঘাতটা পায় শেষে। যারা মাতৃভাষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তাদের খুব একটা লাভ হয় না। জাগতিক সুখ পাচ্ছে কিন্তু আসলে পাওয়া যায় না।

দ্বিতীয় কথা এই, আমরা কোনও অদ্ভুত কারণে পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে থাকি, কখনও পূর্বে তাকাই না। আমাদের পূর্বের দেশগুলো কী করে, সে সম্বন্ধে আমরা খুবই কম জানি। আজকের চিন বা কোরিয়া বা মালয়েশিয়া— এদের ভাষা নিয়ে গর্ব দেখলে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। এমনকী জাপান, যদিও কারিগরি বিষয়ে এত উন্নতি করেছে যে দেশ, সেই দেশের বহুলোকই একবর্ণ ইংরেজি জানে না, ইংরেজি না জেনেও চ্যালেঞ্জ করে তারা সবকিছুতেই উন্নত হয়েছে। চিনেও তাই, চিনে বেশির ভাগ লোকই ইংরেজি জানে না, একটা শব্দও বোঝে না। তারা শিক্ষিতলোক, তারা সমস্ত কিছুই পারে, কাজেই এটা সম্ভব।

আমরা কি বাংলায় পারি না? এটা আমরা কি কোনও ভারতীয় ভাষায় পারি না, আমরা কি এতই খারাপ, আমাদের ভাষা কি এতই দুর্বল? তা তো নয়। ভাষাতাত্বিকরা বলেন, বাংলা ভাষায় এত ঐশ্বর্য, শুধু সংস্কৃত নয়, আমাদের দরজা খোলা, সব ভাষা থেকে এখানে শব্দ গ্রহণ করি। আর করি বলে বাংলা ভাষার সম্পদ অত্যন্ত বেশি, যে-কোনও ভাবই আমরা বাংলায় প্রকাশ করতে পারি। সেই ভাষা নিয়ে আমাদের গর্ব থাকবে না! একমাত্র চিনে ও জাপানে ইংরেজি শেখা আরম্ভ হয়েছে, তার কারণ, কম্পিউটার নামক যন্ত্রটি। ভিন্ন ভাষায় কম্পিউটার হবে না। কারণ, তাতে তার জটিলতা বেড়ে যাবে। কেবল কম্পিউটার নামক যন্ত্রটির ভাষা ইংরেজিতে হবে—এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর চিন, জাপান ও রাশিয়াতেও মানুষ ইংরেজি শিখছে কম্পিউটারে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য। কিন্তু তার জন্য তারা নিজের ভাষা তো ছাড়ছে না। আজকে দুজন চিনার যখন দেখা হয়, তারা একবর্ণ ইংরেজি বলে না, চিনা ভাষায়ই কথা বলে। কাজেই অন্য একটি ভাষা শিখতে গেলে বা অন্য একটা ভাষাকে প্রয়োজনীয় মনে করলে যে মাতৃভাষাকে ত্যাগ করতে হবে এটা অতি মূর্খতা। এটা বারবার বলে লাভ নেই। যখন প্রয়োজন একটাই, প্রয়োজন হচ্ছে এই যে, আমাদের কিছুদিন ধরে একটা আলস্য উদাসীনতা এসেছিল। বাংলা ভাষা বা সংস্কৃতি আস্তে আস্তে যে পিছনে সরে যাচ্ছে এটা খেয়াল করিনি, এখন এটা আমাদের আটকাতে হবে, ছেলেমেয়েদের সেদিকে ফেরাতে হবে।

এখন আমাদের দেখতে হবে উদাসীনতার ফলে এই ভাষা থেকে, এই সংস্কৃতি থেকে যেন একেবারে বিচ্যুত হয়ে না যাই। উদাসীনতার কারণটা ছিল, অনেকে বুঝতে পারেননি ভাষা নিয়ে আবার কী করার আছে। এই তো ভাষা ঠিকই আছে, এই তো আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি। ছেলেমেয়েরা শিখছে না ওতে কী এসে যায়। বাংলা সিনেমার জায়গায় হিন্দি সিনেমা, তাতেই বা কী ক্ষতি। বাংলা গানের জায়গায় হিন্দি গান, ইংরেজি গান তাতেই বা কী ক্ষতি। এই ক্ষতির ফলে আস্তে আস্তে বাংলা আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছিল। ভাষাকে সবসময় পরিবর্ধনের চেষ্টা করতে হয়। তার মর্যাদা রক্ষার চেষ্টা করতে হয়। আসলে, চোখ একটু অন্যদিকে ফেরালেই ভাষা আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে যায়। নদীর মতন, অনেক নদী পৃথিবী থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। ভাষাও তাই। এককালে বহু ভাষা ছিল, সেখানকার মানুষদের অসচেতনতার ফলে সেইসব ভাষা হারিয়ে গেছে।

আমরা কি বাংলা ভাষাকে সেভাবে হারাতে দেব? পৃথিবী বাংলাভাষাকে শুধু বাংলাদেশের ভাষা বলেই জানবে, আমাদের ভাষা বলে কেউ জানবে না? এটা নিজেদের প্রশ্ন করা উচিত।

দুই দশকেরও বেশি সময়ে পশ্চিমবাংলার দৃশ্যপটে, মনোজগতে পরিবর্তন ঘটে গেছে অনেক। বিস্ফোরণ ঘটেছে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে। প্রমোদ উপকরণে নানান উৎপাত ঢুকে পড়েছে। এমনকী মানুষের শয়নকক্ষেও। বাংলা ভাষা যেমন মর্যাদা হারিয়েছে তেমনি বাংলার সংস্কৃতিও পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে আজ এক বিশেষ সংস্কৃতির অবরোধে। বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কিছু কিছু সঙ্গীতধারা একেবারে লুপ্ত হবার পথে। অনেকদিন আমরা ওই ব্যাপারে উদাসীন থেকেছি, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম মাতৃভাষা বিমুখ হয়ে পড়েছে, তা দেখেও না দেখার ভান করেছি আমরা। এই বাংলায়, বাঙালির অধিকারচ্যুত হবার উপক্রম হলে আমরা প্রতিকারের কথা চিন্তা করিনি। এই ক্লৈব্যে আমরা হারাতে বসেছিলাম বাংলার যা কিছু গর্বের সম্পদ।

সব ভাষা ও সংস্কৃতিই পরিচর্যা দাবি করে, আমরা তা বিস্মৃত হয়েছিলাম। কিন্তু কোনও এক সময় এই সব কিছু পুনরুজ্জীবনের উদ্যোগ না নিলে, আমরা জাতির ইতিহাসে আত্মসম্মানহীন, অপদার্থ হিসাবে গণ্য হব না কি? সুখের বিষয়, বেশ কিছু ছোটপত্রিকা, এমনকী পশ্চিমবাংলার সরকারও এ সমস্যার গুরুত্ব বুঝে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আয়োজন করে চলেছে। আসলে, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রবাহমানতার দায় আমাদেরই, যা বিভিন্ন কর্মধারায় বহন করতে হবে।

এগিয়ে আসছে অবশ্যই ছোটপত্রিকাগুলো। বইমেলা, লিটন ম্যাগাজিন মেলা জেলায় জেলায় মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত করছে মাতৃভাষার মাহাত্ম্য। ছোটপত্রিকাই তো প্রাণ, তারাই তো পারে সুসংগঠিতভাবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষার কাজে যথার্থ উদ্যোগী হতে। এই তো ‘ভাষা শহিদ স্মারক সমিতি’ নিষ্ঠা ভরে করে যাচ্ছে সে কাজ। ছোট পত্র-পত্রিকার সম্পাদক, কবি, লেখক ও সাহিত্যকর্মীদের সম্মিলিত চেষ্টা আর ভালোবাসাই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মরা গাঙে আবার জোয়ার আনতে পারে। মাতৃঋণ পরিশোধের এর চেয়ে বড় আর কী-ই বা উপায় হতে পারে।

আমরা স্বপ্ন দেখি।

অনুপাতে কম হলেও ভাষার (ও সাহিত্যের) ওপর একটা অবক্ষয়ের চাপ পশ্চিমবাংলায়ও ক্রমে ক্রমে দেখা দেবে মনে হয়। এখনই দেখা দিচ্ছে। বাংলা একদিন কোটি কোটি লোকের ভাষা ছিল, বাংলার বাইরে নানা দিকে তার পরিব্যাপ্তি ছিল, মর্যাদা ছিল; কয়েক বছর আগেও দেশের পরিধি প্রায় তিনগুণ বড় ছিল। মননের ও কাজের নানা দিকে বাঙালির ভারতীয় খ্যাতি ছিল। সব কিছুই এত বেশি সঙ্কুচিত হয়ে গেছে, বিপর্যয় এত বেশি, টাকাকড়ির কুশৃঙ্খলা এত কঠিন যে ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে চিন্তা করবার সময় খুব সম্ভব দেশের নেই আজকাল। ভাষা লোকের মুখে ভেঙে গড়ে সাহিত্যিকদের হাতেই বিশেষভাবে অগ্রসর হয়। বাংলার লোকদের অনেকেই আজ উৎখাত। এবং প্রায় সব বাঙালিই আজ টাকা ও অন্নের সমস্যায় কষ্ট পাচ্ছে, বেকার, আধ-বেকার, আধপেটা খাওয়া লোক প্রায় ঘরে ঘরে আজ। চাকরি নেই, ঘর নেই, ভাত নেই—এরকম দুঃখ-কষ্ট বাঙালি শীগগির বোধ করেনি। এই সমস্যাই আজ সব চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে; বাংলার লোকের হাড়মাংস চিত্তের থেকে মুখের ভাষা-উপভাষার নতুন নতুন বিকাশের পথ আজ আশা করা কঠিন। যে বাংলা একদিন ভাত-কাপড়ে ঘরে তৃপ্তি পেয়ে গল্প রূপকথা বচন ছড়া ইত্যাদি তৈরি করেছিল বাংলার সে হৃদয় নেই এখন, সেসব লোক নেই, সে প্রবাদ, ছড়া লেখা-লেখন নতুন যুগে কোনও যুক্তিঘন ক্রমবিকাশ লাভ করল না, মরেই গেল—মানুষই মরে যাচ্ছে বলে।

বাংলার সাধারণ জনতাপট আজ এরকম। এদের সাহিত্য আজ নিস্তব্ধ। সাহিত্যিকদের সাহিত্য বেঁচে আছে অবশ্য; তারই থেকে সাধারণজনও কিছুটা তৃপ্তি সংগ্রহ করে নিজেদের রুচি বৃদ্ধি অনুসারে। বাংলাদেশে এখনও বড়, মাঝারি অনেক সাহিত্যিক আছেন। বিশিষ্ট সাহিত্যিকেরা সকলেই প্রায় প্রবীণ, প্রৌঢ়। সাহিত্যে তেমন কোনও নতুন বড় সূচনার লক্ষণ শীগগির দেখা দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।

—জীবনানন্দ দাশ

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ

এ বার সমস্ত বিদ্যালয়ে বাংলা আবশ্যিক

কলকাতা শহর কোনও দিনই শুধু বাঙালিদের শহর ছিল না। এখনও তা নেই। এবং ভবিষ্যতেও হবে না। নানান জাতির, নানান ভাষার, নানান ধর্ম ও সংস্কৃতির বেশভূষা ও খাদ্য অভ্যাসের মানুষের সমাবেশে এই শহরটি বর্ণময় হয়ে উঠেছে এবং এ শহরের এই কসমোপলিটান চরিত্রটাই আমরা বজায় রাখতে চাই। ভবিষ্যতের জন্য সেটা আরও বেশি দরকার। কিন্তু কলকাতা যে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিরও প্রধান কেন্দ্র, তা-ও কি অস্বীকার করা যায়? এবং অন্যান্য ভাষাভাষীদের অধিকার রক্ষা কিংবা কসমোপলিটান চরিত্র বজায় রাখার দায়ে বাংলা ভাষাকে পিছু হঠিয়ে দেওয়া কিংবা বিলুপ্ত করে দেবার চেষ্টাও কি সমর্থনযোগ্য? আমরা উদার হতে গিয়ে নিজেদের অধিকার বোধও ভুলে যাব? সেই রকমই ঘটেছে ধীরে ধীরে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে। ইংরিজির ব্যবহার সর্বত্র, হিন্দিও ইচ্ছে মতন ব্যবহার করা যায়, কিন্তু বাংলা ভাষায় কোনও কাজই হয় না। বেসরকারি সংস্থাগুলিতে তো বটেই, সরকারি কাজে বাংলা ভাষা অচল হয়ে গিয়েছিল—ব্যাঙ্কে, পোস্ট অফিসে, আদালতে বাংলা বর্জিত। থানায় বাংলায় অভিযোগ দায়ের করা যাবে না। কোনও নির্যাতিতা মহিলা রাজ্য সরকারের কাছে বাংলায় প্রতিকার প্রার্থনা করে চিঠি লিখলে উত্তর পাবেন না, এ কোন ধরনের গণতন্ত্র? বাংলার এই অবমাননার ফলে কলকাতা শহরের দৃশ্যপট থেকেও মুছে যেতে লাগল বাংলা। স্বাধীনতার পরেও বেশ কয়েক বছর কলকাতার বহু সাইনবোর্ড লেখা থাকত বাংলায়, সাহেব-কোম্পানিগুলি অবশ্যই ইংরিজির পাশাপাশি ব্যবহার করতেন বাংলা। এমনকী হিন্দি সিনেমায়ও কিছু কিছু পোস্টার লেখা হত বাংলা অক্ষরে।

বছরছয়েক আগে আমরা কয়েকজন এসপ্লানেডে দাঁড়িয়ে আবিষ্কার করলাম, চতুর্দিকে মুণ্ডু ঘুরিয়েও একটাও বাংলা অক্ষর চোখে পড়ে না। শুধু এসপ্লানেডে কেন প্রধানত বাঙালি পাড়াগুলিতেও নাম ফলকে বাংলা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আমরা ছেলেবেলায় গলির মোড়ে মিষ্টির দোকানে বড় বড় অক্ষরে লেখা নাম দেখতাম ‘অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। চোখের সামনে প্রতিদিন ওই বাংলা অক্ষর দেখে দেখে অন্নপূর্ণা বানানটা মনে গেঁথে গেছে। এখন সেই অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারও ইংরিজিতে লেখা হয়। এর নাম সংস্কৃতির সমন্বয়? জুতোর দোকানের নাম শ্রীচরণে-শু দেখে মজা পেতাম। এখন আর সেই সব মজাটজা পাবার প্রশ্ন নেই। বাংলা ভাষার অ-ব্যবহারে এখনকার বাঙালি শিশুরাও অভিভাবকদের অনিচ্ছায় বাংলা পাঠে অমনোযোগী, রাস্তায় বেরিয়ে তারা চোখের সামনেও বাংলা অক্ষর দেখতে পায় না। বাঙ্গালোরও তো আন্তর্জাতিক মানের কসমোপলিটান শহর, সেখানে তো স্থানীয় কন্নড় ভাষার যথেষ্ট স্থান আছে!

ভাষার এই অবনয়ন কোনও এক সময় তো রুখতেই হয়। তাই শুরু হয়েছিল আন্দোলন। কয়েক বছরের চেষ্টায় তাতে কিছু কাজও হয়েছে। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বাংলা ভাষাপ্রেমী, তিনি বুদ্ধিজীবীদের দাবির যৌক্তিকতা মেনে নিয়েছেন। সরকারি কাজে কিছু কিছু বাংলা ভাষার ব্যবহার শুরু হয়েছে (সর্বত্র নয় এখনও), আদালতে বাংলা একেবারে অচ্ছুৎ নয়, এমনকী থানাতেও ভুলভাল ইংরিজির বদলে বাংলাতেও অভিযোগপত্র দায়ের করা যায়। সেই আন্দোলনেরই অন্যতম পরিণতি, সম্প্রতি কলকাতার মেয়রের ঘোষণা সমস্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্টানেই টেড লাইসেন্স নিতে গেলে বাংলা ভাষার ব্যবহার আবশ্যিক করতে হবে। আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভে (৩/৬/০৬) সেই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। এ জন্য মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যকে ধন্যবাদ। আনন্দবাজার পত্রিকাকেও ধন্যবাদ। তার পরেও আমার সামান্য কিছু নিবেদন আছে।

কলকাতার মেয়র স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই ঘোষণা করেননি হঠাৎ। এর পেছনে আছে সরকারি সমর্থন এবং একটি আন্দোলনের ছোট্ট ইতিহাস। কিন্তু কোথাও কোথাও বিকৃত করা হচ্ছে সেই ইতিহাসকে, তথ্যভ্রান্তি ঘটিয়ে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে তির্যক মন্তব্য। তির্যক মন্তব্য অনেক সময় উপভোগ্য হয়। কিন্তু গুরুতর তথ্যভ্রান্তি থাকলে তা উপহাস্যযোগ্য হবার সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং আমি বিনীতভাবে সেই ছোট্ট ইতিহাসেরও অতি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতে চাই। ইতিহাসে ভুল থাকবে কেন?

আন্দোলনের প্রথম পর্বে থাকে আবেদন নিবেদন। সেই সময় কলকাতার নাম পরিবর্তনেরও দাবি তুলেছিলাম আমরা। লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিধি দল নিয়ে একাধিকবার মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে দাবিপত্র পেশ করা হয়েছে। বহু জন স্বাক্ষরিত সেই দাবিপত্র আমি রচনা করেছি, অতএব কোনওরকম স্মৃতিভ্রান্তির সুযোগ নেই। স্পষ্টভাবে তাতে বলা হয়েছিল যে, সাইনবোর্ড বা নামফলকে বাংলা ভাষার জন্য এক-তৃতীয়াংশ স্থান রাখতে হবে। মনে রাখা দরকার, এক-তৃতীয়াংশ, অর্ধেকও নয়, অর্থাৎ বেশিরভাগ জায়গাই ছেড়ে দিয়েছি অন্য ভাষার জন্য। পরবর্তীকালেও আমাদের সমস্ত ঘোষণাপত্রেও ওই এক-তৃতীয়াংশের কথাই বলা আছে। তবু আমরা ইংরেজি হঠিয়ে দিতে চেয়েছি কিংবা অন্য ভাষার ওপর জোরজুলুম করেছি, এই অভিযোগ তোলা হয়েছে কেন? এটা ইতিহাসের বিকৃতি।

আবেদন-নিবেদনের পর প্রত্যক্ষ অভিযান। রাস্তায় নেমে আমরা বিভিন্ন বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান এবং দোকানপাটে গেছি বাংলা ভাষার দাবি নিয়ে। ভাষা শহিদ স্মারক সমিতি, নবজাগরণ মঞ্চ এবং ভাষা-চেতনা সমিতি নামে তিনটি সংস্থা বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির উন্নয়নের জন্য কিছু না কিছু কাজ করে চলেছে। এই তিনটি সংস্থাই নিজেদের মধ্যে বিভেদ ভুলে, একযোগে স্পষ্ট নীতি নির্ধারণ করে অভিযানে শামিল হয়েছে। সেই নীতিটি হল, কোনওরকম ভয় প্রদর্শন কিংবা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটাবে না কেউ। এটা এক দিকে যেমন রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, তেমনি সমাজবিরোধীরা যাতে কোনওক্রমে ঢুকে না পড়ে, সে দিকে প্রখর নজর রাখতে হবে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার এই, আমার মতন শান্ত প্রকৃতির মানুষ অধৈর্য হয়ে কিছুটা চোখরাঙানির পক্ষে ছিলাম। আমার চেয়ে প্রাজ্ঞ ও বিবেচকরা আমাকে নিরস্ত করেছেন। রোদ্দুর, বৃষ্টি উপেক্ষা করে বহু বিশিষ্ট নাগরিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, লেখক, খেলোয়াড়, সংগীতজ্ঞ, অভিনেতা এবং নাম না-জানা বহু বাংলা ভাষাপ্রেমী যোগ দিয়েছেন সেই অভিযানে। চৌরঙ্গিতে, শ্যামবাজারে, গড়িয়াহাটে, পার্ক সার্কাসে, আরও কয়েক জায়গায়, অনেক বার। কোনও প্রতিষ্ঠানেই খারাপ ব্যবহার পাইনি। অনেক অবাঙালি দোকানদার বিস্মিতভাবে বলেছেন, তাই নাকি, বাংলাতেও নাম লিখতে হবে? ঠিক আছে, লিখব। কেউ কেউ লিখেছেনও!

দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে, সেরকম ঘটেছেও একটি মাত্র জায়গায় এবং তা দুর্ঘটনাই, ইচ্ছাকৃত নয়। চৌরঙ্গির একটি দোকানে ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলিতে কাচের শো-কেস ভেঙে যায়। সে জন্য ক্ষমা চাওয়া হয়েছে এবং কাচ মেরামতির খরচও আমরা দিতে চেয়েছিলাম, অথচ সেই তুচ্ছ ঘটনা উপলক্ষ করেই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে অভিযোগ করা হয়েছে, আমরা অনেক জায়গায় জোর-জবরদস্তি করেছি, হিংসার আশ্রয় নিয়েছি। যদি তেমনই হবে, তবে পুলিশ সেইসব দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার করল না কেন? কোনও থানাতেই একটাও অভিযোগ জমা পড়েনি ভাঙচুরের। তবু আমাদের বলা হয়েছে ভাষা-মৌলবাদী। আমরা সবরকম মৌলবাদের বিরুদ্ধে, সামান্য এক-তৃতীয়াংশের দাবিদার, এই অভিযোগ তো আমাদের গায়ে লাগবেই। বরং আমরা বেশি উদার হতে হতে উদাসীন হয়ে পড়েছিলাম।

আমরা এখনও অনেক ব্যাপারেই রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টান্ত টেনে আনি। রবীন্দ্রনাথ বহু ব্যাপারে আমাদের পথ নির্দেশক। কিন্তু অনেকে ভুলে যান, রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার প্রয়োগের প্রশ্নে আমাদের চেয়েও উগ্র ছিলেন। বাঙালিকে বাঙালির ইংরেজিতে চিঠি লেখা, দুই বাঙালির কথোপকথনে ইংরেজির ব্যবহার তিনি ঘোর অপছন্দ করতেন। সেই ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবে তাঁর প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। যে ঠাকুরবাড়ির ছেলেরা কখনও মোজা ছাড়া জুতো পরত না, সেই ঠাকুরবাড়ির ছেলে হয়ে সব আভিজাত্য বিসর্জন দিয়ে রবীন্দ্রনাথ খালি পায়ে রাস্তায় বেরিয়ে বিরোধী মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন, নাখোদা মসজিদের অভ্যন্তরে ঢুকে রাখি পরাতে গিয়েছিলেন মৌলবাদীদের। ১৯৪৭-এর সত্যিকারের বঙ্গভঙ্গের সময় রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে তাঁর মনের অবস্থা কীরকম হত, ভাবলেও বুক কাঁপে। আর এই একবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় যদি পাওয়া যেত যুবক রবীন্দ্রনাথকে, তা হলে তিনি নিশ্চয়ই যোগ দিতেন সাইনবোর্ডে বাংলা ভাষার দাবির অভিযানে। শঙ্খ ঘোষের পাশে পাশে হাঁটতেন। আর বাংলার সীমানার বাইরে বাংলা ভাষার প্রসার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের যা অভিমত ছিল, এখন তা আমরা ভুলেও উচ্চারণ করব না। রবীন্দ্রনাথ এখন উপস্থিত থাকলে তাঁকে বলতাম চুপ, চুপ, গুরুদেব, (না, আমি গুরুদেব সম্বোধন করতাম না। আমি ডাকতাম রবিদাদা) ও-রকম কথা আর এক বারও বলবেন না। পাশের রাজ্যে দাঙ্গা বেঁধে যাবে।

বছর দু-এক আগে এক সাংস্কৃতিক সম্মেলনে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং প্রাক্তন মেয়র সুব্রত মুখোপাধ্যায়। ওঁদের সামনেই সমস্ত নামফলকে বাংলা ব্যবহার আবশ্যিক করার জন্য সোজাসুজি আবেদন জানানো হয়। মুখ্যমন্ত্রী নীতিগতভাবে সমর্থন জানান। সুব্রতবাবুও তাঁর ভাষণে আন্তরিকভাবে বলেন, হ্যাঁ, এটা অবশ্যই হওয়া উচিত, আমি দেখছি। কিন্তু তিনি দেখার সময় পাননি।

গত বছরেও ওই একই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং নবীন মেয়র। এ বারেও ওই দাবি উত্থাপিত হয় আরও জোরালো ভাষায়। মুখ্যমন্ত্রী সম্মতি জানিয়েছেন, মেয়রও বাংলা ভাষাপ্রেমী। তিনি একমত হয়েছেন তো বটেই, কার্যকর করার জন্য উদ্যোগ নিতে দেরি করেননি। তাঁকে আবার ধন্যবাদ।

এখনও অনেক কাজ বাকি আছে। তার অন্যতম, পশ্চিমবাংলার সমস্ত বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা শিক্ষা আবশিক করা। না, এটাও জোর-জবরদস্তি কিংবা অন্যের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ কিংবা ভাষা-মৌলবাদ নয়। সুপ্রিম কোর্টের সুস্পষ্ট নির্দেশ। ভারতে অনেক রাজ্যেই স্ব-রাজ্যের ভাষা আবশ্যিক হয়ে গেছে। অতি সম্প্রতি তামিলনাড়ুতে হল সব বিদ্যালয়ে তামিল ভাষা দশম শ্রেণি পর্যন্ত।

পশ্চিম বাংলায় সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশ পালনে এখনও দ্বিধা কেন?

(আনন্দবাজার পত্রিকা—২৪ জৈষ্ঠ ১৪১৩)

বাংলা আছে, থাকবে

ছেলেবেলায় নেতাজি আমাদের কাছে খুব একজন আদর্শ ছিলেন।

স্বাধীনতার আগে স্বদেশি হাওয়া তো ছিলই, স্বাধীনতার পরেও সেই ভাবটা বেশ বজায় ছিল। ছেলেবেলার পয়লা বৈশাখগুলোয় আমরা সব দলবল মিলে প্রভাতফেরিতে বেরোতাম। একটা সময় অবধি বিশ্বাসও করতাম যে নেতাজি ফিরে আসবেন। একটা গান বেশ মনে পড়ে এখনও, ‘আদেশ ছিল দিল্লি চলো, দিল্লি মোরা জয় করেছি আজ তুমি কোথা নেতাজি’। খুব বিশ্বাসের সঙ্গে গাইতাম। আমার নেশা ছিল বিউগল বাজানোর দিকে। প্র্যাকটিস করতে করতে একবার খুব কাশি হল। তখনকার দিনে তো কাশি মানেই সবাই ধরে নিত টিবি হয়েছে। বাবা বলতেন, টিবি হয়ে যাবে, আর বিউগল বাজাতে হবে না। আর বাজালাম না বটে, তবে বিউগল-এর প্রতি মনটা পড়েই থাকে। এই নববর্ষ এলে যেমন বেশি করেই একটু মনে পড়ে।

আমি ছেলেবেলায় মোটামুটি আবৃত্তি করতাম। বড় বড় কবিতা গোটা মুখস্ত বলে যেতে পারতাম। আর বড়রা হাসি হাসি মুখে শুনত। আমার এক মাস্টারমশাই ছিলেন, তিনি আমায় অনেক কবির কবিতার সঙ্গে নজরুল ইসলাম-এর কয়েকটি কবিতা মুখস্ত করিয়েছিলেন। পয়লা বৈশাখের দিন নজরুল ইসলাম ধুতিটুতি পরে, গলায় একটা মালা পরে এসে বসতেন আর সবাই তাঁকে দর্শন করে যেত, যদিও তাঁর তখন মানসিক ভারসাম্য আর ছিল না। একবার আমার মাস্টারমশাই আমায় নিয়ে নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। তারপর অনেক করে খোঁচাতে লাগলেন, ‘একটা কবিতা শোনা না, শোনা না’। অনেক খোঁচা খেয়ে আমি ‘বিদ্রোহী’ আবৃত্তি করতে শুরু করেছি। কিছু দূর হওয়ার পর উনি কীরকম অস্বাভাবিক আচরণ করতে আরম্ভ করলেন। গলা মালাগুলো নিজেই ছুড়তে আরম্ভ করলেন। আমার তো ভয়ে হয়ে গিয়েছে। সবাই চলে যাচ্ছে দেখে আমিও ছুটে বেরিয়ে গেলাম, কিন্তু যাওয়ার আগে নজরুলের গলার মালার কিছুটা টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে দৌড় লাগালাম। মাস্টারমশাই কবিতাটা পুরো শুনিয়ে যাওয়ার জন্য পেছন থেকে কত ডাকাডাকি, কিন্তু কে তখন কার কথা শোনে? সেই মালার টুকরোটা অনেক দিন অবধি আমার কাছে ছিল।

আরও বড় হলাম, লেখালিখি শুরু করলাম। তখন নববর্ষে নতুন বই প্রকাশ হত। প্রকাশকের অফিসে অফিসে বড় বড় লেখকরা আসতেন। আমরা বন্ধুরা মিলে ভিড় জমাতাম সেইসব জায়গায়। বৈশাখে নতুন বইয়ের গন্ধ দারুণ লাগত। এখনও প্রকাশকদের অফিসে যাই। কিন্তু নতুন বই প্রকাশের সঙ্গে নববর্ষের যে উন্মাদনার যোগ ছিল, সেটা আর নেই।

এখনকার ছেলেমেয়েরা নিশ্চয়ই এখনকার মতো করে নববর্ষ কাটায়। আমার তো বেশ ভালোই লাগে। যার যার যেমন ইচ্ছে, তেমন করে যদি উৎসবের দিন কাটাতে না পারে, তা হলে আর কীসের উৎসব, কীসের আনন্দ? শহরের ছেলেমেয়েদের দেখে মনে হয়, তাদের বাংলায় বিশেষ মতি নেই। কিন্তু শহর দিয়েই তো সবটা নয়। অনেক ছেলেমেয়ে আছে যারা বাংলা নিয়ে পাগল। যারা বাংলা পড়বে না, ক্ষতি তাদের। বাংলা ভাষার নয়। আমি নৈরাশ্যবাদী নই, তাই বাংলা সম্বন্ধে যে গেল গেল রব উঠেছে, সেটা ঠিক নয়। বাংলা আছে, থাকবে।

যদি নীরার সঙ্গে নববর্ষের দিন বেরোই, তা হলে কী করব?

—বলব না।

(আনন্দবাজার পত্রিকা—১৫ এপ্রিল ২০০৯)

বাঙালি ও বাংলা ভাষা

এখন পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সংকুচিত হয়ে আসছে ক্রমশ।

গোর্খাল্যান্ডের বদলে গোর্খা হিল কাউন্সিল নামে যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানে বাংলা সিনেমা দেখার কথা ভাবাই যায় না। লাউডস্পিকার থেকে কানে যে গান ভেসে আসে তাও হিন্দি গান। পশ্চিমবঙ্গের অন্যত্রও এক শ্রেণির বাঙালি যেন বাংলা সংস্কৃতির চিহ্নগুলি নিজেদের শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে উঠেছে। যেন ব্রাউন সাহেবদের আধিপত্য শুরু হয়ে গেছে। একদল অভিভাবক বলতে ভালোবাসেন, তাঁদের ছেলেমেয়েরা বাংলা বলা তেমন পছন্দ করে না। আসলে কথাটা সত্য নয় মোটেই। সত্যটা হল ওই অভিভাবকরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত ভেবে বাংলা পড়তে দিতে চায় না। তাঁরা ভাবছেন কাজের ভাষা ইংরেজি বা অন্য কিছু ভালো করে রপ্ত করলে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। বাংলার কোনও ভবিষ্যৎ নেই। এই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে অভিভাবকদের এইরকম আচরণের ফলে বাংলা বই, বাংলা গানের সঙ্গে সম্পর্ক গুটিয়ে যাচ্ছে। উচ্চবিত্ত পরিবারগুলিতে অনেক ক্ষেত্রেই শোনা যাবে মাইকেল জ্যাকসনের নাকি সুরে চিৎকার। অনেকেই তো আবার প্রবলভাবে সাহেব হওয়ার বাসনায় কাটা চামচ দিয়ে ইলিশ মাছ খাওয়ার প্রাণান্তকর পরিশ্রম করে। ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজ গড়ে তোলার জন্য এদের কী মরিয়া চেষ্টা! ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজ তো বাংলাদেশেও আছে। সেখানেও জিনস ও গেঞ্জি পরা ছেলে, সবসময় ইংরেজি বলা মেয়েদের দল দেখা যায়। মা-বাবারা বিদেশি ম্যাগাজিন পড়েন। কিন্তু বাংলার শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। এদেরই একজন রসিকতা করে আমাকে বলেছিলেন, পয়লা ফেব্রুয়ারি আমরা বাঙালি হয়ে যাই। আবার আঠাশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভুলি। তবুও তো তাঁরা এক মাস বাঙালি সাজতে লজ্জা পান না। আর পশ্চিমবঙ্গে ব্রাউন সাহেবের দল ২৫শে বৈশাখেরও ধার ধারে না। এদের ছেলেমেয়েরা পয়লা বৈশাখ কবে তার হদিস জানে না।

একদিন ধর্মতলায় কী খেয়াল বশে দোকানগুলোর সাইনবোর্ডের দিকে নজর রেখেছিলাম। ধর্মতলা থেকে সোল অ্যাভিনিউ ধরে অনেকটা দূর পর্যন্ত দোকানগুলোর সাইনবোর্ডে—যা নামফলক বলাই ভালো, বাংলা হরফের চিহ্ন খুঁজে পাইনি। পরে বাংলা ভাষাকে যারা মর্যাদা দিতে চায় তারা নানা সংগঠন গড়ে দোকানগুলোতে নামফলকের একটি অংশে অন্তত বাংলা লেখার দাবি তুলে পথে নেমেছিল। অন্য ভাষা নামফলকে থাকলে আপত্তি করার কিছু নেই। তবে বাংলা থাকাটা জরুরি। এটা রাজ্য সরকার এবং পুরসভাকেও বুঝতে হবে। পুরসভাকে বলা হয়েছিল, তাঁরা যেন ‘টেড লাইসেন্স’ নবীকরণ করার সময় ব্যবসায়ীদের নির্দেশ দেয় যে, অন্তত নামফলকের তিন ভাগের এক ভাগের জায়গায় যেন বাংলা লেখা থাকে। ওরা নীতিগতভাবে একমত হয়ে জানিয়েছিল যে, এটা করতে গেলে আইন বানাতে হবে। তো আইন বানালেই হয়। বিধানসভায় শাসকপক্ষের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। বিরোধীপক্ষ এবিষয়ে বাধা দেবে বলেও মনে হয় না। আইনটাইন যা করতে হয় করা হোক। মোট কথা নামফলকে বাংলা থাকাটা জরুরি। সুখের কথা বর্তমান পুরসভা বাংলায় নামফলক লেখার ব্যাপারে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। আন্দোলন এবং ওই উদ্যোগের ফলে এখন অল্প হলেও কিছু পরিবর্তন হচ্ছে।

আসলে সরকার বাংলার মর্যাদা বাড়ানোর ব্যাপারে অনেক প্রস্তাবের সঙ্গে নীতিগতভাবে একমত হয়। তবে সরকারের ওই যা দোষ, কাজটা ঠিকমতো করে হওয়া ওঠে না। যেমন পশ্চিমবঙ্গে সব স্কুলে বাংলা পড়াটা আবশ্যিক করা দরকার। অর্থাৎ বাংলা আবশ্যিক পাঠ্য হবে। বাংলা পরীক্ষায় পাশ করতে না পারলে তাকে ফেল থাকতে হবে। রাজ্য সরকার সব স্কুলে এই ব্যবস্থা করার জন্য আলোচনার সময় একমত হয়েছিল নীতিগতভাবে। কিন্তু কাজটা এক কদমও এগোয়নি। অথচ মহারাষ্ট্রে অর্থের দিক থেকে বিত্তবান গুজরাটি সমাজ মহারাষ্ট্রে তাদের তৈরি স্কুলগুলোতে মারাঠি পড়াতে রাজি ছিল না। মহারাষ্ট্র সরকার তাদের বিরুদ্ধে মুম্বই হাইকোর্টে মামলা করেছিল। রাজ্য সরকার জিতেছিল। গুজরাটি সমাজ দরবার করেছিল সুপ্রিমকোর্টে। সুপ্রিমকোর্ট তাদের রায়ে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল, মহারাষ্ট্রে স্কুল করতে হলে মারাঠি ভাষা আবশ্যিক করতে হবে। সুপ্রিমকোর্টের এরকম একটি নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে কেন তা চালু করে বাংলা পড়ানো হচ্ছে না সব স্কুলে, এই প্রশ্নের জবাব পাইনি। হয়তো ভবিষ্যতে পেয়ে যাব। এই না পাওয়ার পেছনে ভোটের কোনও অঙ্ক আছে কি না বা বিত্তবানদের কোনও চাপ আছে কি না আমার জানা নেই।

এই প্রসঙ্গে সরকারি কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহারের কথাও উঠে আসে। এ দাবি অনেক দিনের এবং অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সংগঠনের। রাজ্য সরকার এব্যাপারেও নীতিগতভাবে একমত। কিন্তু সরকারের যা হাল, ওই করে উঠতে না পারার জন্য এই বিষয়টাও পুরো এগোয়নি। সরকারের বিভিন্ন কাজে ইংরেজি ব্যবহারের ঝোঁকটা প্রবল। কোনও কোনও মন্ত্রী বা অফিসার মাঝেমধ্যে বাংলায় নোট যে দেন না এমন নয়। তবে সেটা ব্যতিক্রম হিসেবেই থেকে যাচ্ছে। যে কাজগুলোর সঙ্গে সরাসরি সাধারণ মানুষ যুক্ত, সেই কাজগুলোর ক্ষেত্রেও বড় একটা কেউ বাংলা লেখেন না। সাধারণ মানুষও এর ফলে ভাবে যে, ইংরেজিতে না লিখলে তার কাজটা হবে না। কিন্তু মুশকিল হল স্বাধীনতার ৬০ বছর পার হয়ে গেলেও এখনও ১০০-র মধ্যে ৬৮ জনের বেশি মানুষকে আমরা স্বাক্ষর করে তুলতে পারিনি। স্বাক্ষর মানে কোনও মতে নিজের নাম লিখতে পারা, একটু ১ ২ ৩ লেখা ও চিনতে শেখা। এই স্বাক্ষররা বই পড়ায় সড়গড় নয়। বাংলা চিঠি লিখতে হলেও তাদের সাহায্য করার জন্য লোক খুঁজে বেড়াতে হয়। ইংরেজিতে তাদের আবেদনপত্র লিখবেন কী করে, লেখাবেনই বা কাকে দিয়ে। তবু বাংলায় লেখা হলে তারা তাদের বক্তব্যটা মোটামুটি বুঝিয়ে দিতে পারে, কেউ লিখে দিলে সেটা পড়ে শোনাবার পর বেশিরভাগটাই বুঝতে পারে। ইংরেজি হলে তো মস্ত বিপদ। সকলকেই সচেতন হয়ে সরকারি কাজকর্মে বাংলা ব্যবহার করার জন্য কথাবার্তা তোলা উচিত, চাপ তৈরি করা উচিত। সরকারেরও উচিত শুধু নীতিগতভাবে একমত না হয়ে এ ব্যাপারে কাজের কাজ করা। অন্যদিকে কলকাতা থেকে ঢাকা গেলেই প্রথমে মনে হবে এটাই স্বভূমি। নামফলকগুলি এবং বেশিরভাগ বিজ্ঞাপন বাংলায় লেখা। যানবাহনের নম্বর কিংবা গন্তব্য স্থানও বাংলায়। সেখানকার অল্প শিক্ষিত লোকদের সরকারের সঙ্গে কাজকারবার চালাতে ইংরেজির আশ্রয় নেওয়ার জন্য লোক খুঁজতে হয় না। বাংলাতেই কাজ চলে যায়। যদিও শিক্ষার হারের দিক থেকে তারা পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে তেমন এগিয়ে নেই।

শুধু সরকারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় বাঙালিদের একটি পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বাংলা জানা দুজন মানুষ যেন পরস্পরকে ইংরেজিতে না লেখেন, ইংরেজিতে শুভেচ্ছা বিনিময় না করেন, কথাবার্তা ইংরেজিতে না বলেন। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে ছিল, বাঙালিরা তাদের জীবনে বাংলা ভাষাকেই অবলম্বন করবে। এই পরামর্শ মেনে চলেন না অনেকেই। একটা ভুল ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যাচ্ছে যে, গড়গড় করে ইংরেজি না বললে, শিক্ষিত হিসেবে কল্কে পাওয়া যাবে না। অনেক সময় এমনও দেখা যায় যে, বাংলা মাস্টারমশাই এবং অধ্যাপকরাও এই ধারণা থেকে তাদের কথাবার্তায় খানিকটা ইংরেজি বলে নেন। এটা এক ধরনের হীনমন্যতা। মনে হয় ইংরেজ দাসত্বের রেশ এখনও কাটিয়ে ওঠা যায়নি। এটা দুর্ভাগ্যজনক।

ভারতে এমন কয়েকটি ভাষা আছে যেগুলি সারা পৃথিবীর প্রধান ভাষাগুলির সমপর্যায়ে। চিনে ভাষা নিশ্চয়ই এক নম্বর ভাষ্য। পশ্চিমের দেশগুলি ছোট ছোট, কিন্তু সেখানকার অনেক ভাষাই সমৃদ্ধ। তবুও এর কোনও একটি দেশের মাতৃভাষা সংখ্যার বিচারে এশিয়ার ভাষাগুলির কাছাকাছি নয়। ইংরেজ ও স্প্যানিশরা বিভিন্ন মহাদেশে উপনিবেশ তৈরি করে নিজেদের ভাষা চাপিয়ে দিয়েছিল। যেমন আমেরিকা, কানাডা ও অষ্ট্রেলিয়ার দখলদার ইংরেজদের ভাষার প্রাধান্যে ইংরেজি এখন পৃথিবীর দ্বিতীয় বড় ভাষা। দক্ষিণ আমেরিকার অনেকগুলি রাজ্য দখল করে নিয়ে স্প্যানিশরা তাদের ভাষাভাষির সংখ্যা বিশ্বের তিন নম্বর স্থানে নিয়ে গিয়েছে। ভারত কখনওই কলোনি বিস্তার করেনি বা চায়নি। তা সত্ত্বেও ভারতের দুটি ভাষা হিন্দি ও বাংলা জনসংখ্যার ভিত্তিতে চতুর্থ ও পঞ্চম স্থান অধিকার করে আছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যাবে স্প্যানিশভাষিরা তৃতীয় স্থানটি থেকে সরে গিয়ে পঞ্চমে চলে যাচ্ছে। হিন্দি ও বাংলা তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে উঠে আসছে। কাজেই বাঙালিদের হীনমন্যতায় ভোগার কোনও কারণ নেই তার ভাষা নিয়ে। বাংলা ভাষায় যে সাহিত্য রচিত হয়েছে এবং হচ্ছে তা বিশ্বমানের চেয়ে পিছিয়ে আছে এমন নয়। বাংলা শিখলে ভবিষ্যতে কাজেকর্মে সাফল্য পাওয়া যাবে না বলে যারা ভাবছেন তাদের মনে রাখা উচিত, ইংরেজি পড়েও সকলে যথেষ্ট সুবিধা করতে পারছে না। আসলে আর্থিক জীবনে সাফল্য আসার পিছনে তো শুধু ভাষার ব্যাপারই নেই। দেশের অবস্থা উন্নত না হলে, যথেষ্ট শিল্পবিকাশ না হলে আর্থিক সাফল্য পাওয়া সহজ হবে না। ইংরেজি অবশ্যই শিখতে হবে। এখন যেভাবে ইংরেজি শেখানো হয় তার চেয়েও ভালোভাবে শেখাতে হবে। এর সঙ্গে বাংলা ভাষা শেখার কোনও বিরোধ নেই। বিরোধ নেই অন্য কোনও বিদেশি বা ভারতীয় ভাষা শেখারও। যে যার মাতৃভাষাকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে শিখুক এবং সঙ্গে সঙ্গে যে যে ভাষাকে তার কাজের সাফল্যের ভাষা মনে করে সেটাও শিখুক। এমনই হওয়া উচিত। নিজেদের রাজ্যের ভাষা যাতে নিজেদের রাজ্যে ব্যাপকতা লাভ করে এটা যেমন সব বাঙালিকেই বুঝতে হবে তেমনই সরকারকেও এদিক থেকে সহযোগিতার পরিমাণ বাড়াতে হবে। এ কাজটা খুব শক্ত নয়। অন্য প্রদেশগুলোতে এ কাজ করে দেখিয়েছে অন্যেরা। এ ছাড়া সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ যেখানে বাংলা ভাষায় কথা বলেন সেই বাংলাদেশের উদাহরণ আমাদের হাতের কাছেই রয়েছে।

বাংলাদেশের বাঙালিরা শুধু বাংলায় কথা বলে, সরকারি কাজকর্ম চালিয়ে ক্ষান্ত নেই। তারা বাংলা সংস্কৃতিকে প্রসারিত করার জন্য সবসময় চেষ্টা করে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় যে উৎসবটা হয় সেটা বর্ষবরণের উৎসব, পয়লা বৈশাখ। ওদেশে কয়েক শতাংশ মানুষ বাদ দিলে ধর্মের দিক থেকে সবাই মুসলমান। ইদ উৎসব তারা পালন করে। কিন্তু পয়লা বৈশাখ তাদের জীবনে সবচেয়ে বড় উৎসবের স্থান দখল করে আছে। এ ছাড়া ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার শহীদদের স্মরণে অনুষ্ঠান তাদের জাতীয় জীবনে এক বিরাট মর্যাদা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত। তাদের সাংস্কৃতিক জীবনে নানা জেলা থেকে বৈচিত্র্যময় লোকগীতি উঠে আসে। আমাদের দেশে দেশাত্মবোধক গানের চর্চা লুপ্ত হতে চলেছে। অথচ ও দেশে রচিত হচ্ছে আবেগময় দেশাত্মবোধক সংগীত।

তারা এক জায়গায় কয়েকজন লোক একত্র হলে যে গান গায় তা হিন্দি বা উর্দু নয়, বাংলা গান। যে-কোনও অনুষ্ঠানেই তারা দেন আলপনা। বাংলাদেশের জন্যই সারা পৃথিবীতে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি। বাঙালি শব্দটির বদলে আস্তে আস্তে পৃথিবীতে বাংলাদেশি নামটি পরিচিত হয়ে উঠছে। কারণগুলির মধ্যে একটি অন্যতম বিষয় হল প্রবাসে যে বাঙালিরা থাকেন তারাও সহজে বাঙালিত্ব বিসর্জন দেয় না। তারা এখানকার একদল হিন্দুর মতো বলে না—ওরা হিন্দু, আমরা বাঙালি। যেমন এদেশে শোনা যায়—ওরা মুসলমান। আমরা বাঙালি।

ঈশ্বর কিংবা আল্লাহ আমাদের মাথায় থাকুন, ধর্ম থাকুক, ধর্ম থাকুক ঘরে ঘরে, রাজনীতির বিভেদ নিয়ে মত্ত থাকুক রাজনীতিবিদরা। ভাষা এবং সংস্কৃতিকে এসব কিছুর ঊর্ধ্বে না রাখতে পারলে কোনও জাতি পরিপুষ্ট হতে পারে না। কারণ ভাষা অনেক সময়ই জাতীয়তার ভিত্তি। আর সেইসঙ্গে একথা তো মনে রাখতেই হবে যে বাঙালি তার আত্ম পরিচয়কে খুইয়ে ফেললে জাতি হিসাবে তার অস্তিত্বটাই লোপাট হয়ে যাবে।

বাঙালি কে? আমি কি বাঙালি?

মাইকেল মধুসূদন একটি কবিতায় প্রশ্ন তুলেছিলেন, কবি ঠিক কাকে বলা যায়? শুধু শব্দে শব্দে যে বিয়ে দেয়, সেই কি সে যম-দমী? এ প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেই একটা দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তা নিয়ে সত্যিকারের মীমাংসা আজও হয়নি। সেইরকমই, এখন অহরহ এই প্রশ্ন উচ্চারিত হয়, বাঙালি কে? এ প্রশ্নও একটা ধাঁধার মতন।

গত দু-এক দশক ধরে বাঙালিবাবুর প্রথাসিদ্ধ চিত্র হচ্ছে, কোঁচা লুটোনো ধুতি পরা, গিলে-করা পাঞ্জাবি গায়ে, বাংলা-বলা, মাছভক্ত এক প্রজাতি। এটা আসলে বাস্তব নয়, ব্যঙ্গচিত্র। ধুতি জিনিসটা খুব একটা পুরোনো নয়, কয়েক শতাব্দী আগেও এর অস্তিত্ব ছিল না, অধিকাংশ স্থানীয় বাসিন্দারাই ছোট আকারের কাপড় দিয়ে নিম্নাঙ্গ ঢাকতেন। শাড়িও তাই, কোনও প্রাচীন চিত্রে বা গুহাগাত্রে শাড়ি-পরা নারী নেই। এমনকী মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের দৃশ্যে অধিকাংশ মানুষেরই ধারণা যে দুঃশাসন দ্রৌপদীর শরীর থেকে টান মেরে শাড়ি খুলে ফেলার চেষ্টা করেছিল এবং কৃষ্ণ একটা লাটাই থেকে অনবরত শাড়ি সরবরাহ করে গেছেন। আসলে মহাভারতে এরকম কিছু নেই, শাড়ির উল্লেখ একবারও পাওয়া যায় না, শুধু বলা হয়েছে বস্ত্র, এবং লজ্জা নিবারণের জন্য দ্রৌপদী কৃষ্ণের উদ্দেশে প্রার্থনা জানালেও কৃষ্ণ এসে পৌঁছোবার আগেই অন্তরাল থেকে ধর্ম অলৌকিক ভাবে নানারঙিন বস্ত্র পাঠিয়ে দ্রৌপদীর শরীর ঢেকে দিচ্ছিলেন।

যারা বাংলা বলে, বাংলা যাদের মাতৃভাষা, তারাই শুধু বাঙালি? বাংলা ভাষার বয়েস তো বেশি নয়, অনেকে বলেন হাজার বা এগারোশো বছর। কিন্তু চর্যাপদ ঠিক আদি বাংলাগ্রন্থ কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে, অন্য ভাষারও দাবি আছে, তাতে বাংলা ভাষার বয়েস আরও কমে যায়। সত্যেন দত্ত লিখেছেন, ‘আমাদের সেনা যুদ্ধ করেছে সজ্জিত চতুরঙ্গে/দশাননজয়ী রামচন্দ্রের প্রপিতামহের সঙ্গে।’ অর্থাৎ কালিদাসের ‘রঘুবংশ’ কাব্যে উল্লেখ আছে সুহ্ম এবং বঙ্গের যোদ্ধাদের কথা। মহাভারতেও এক বঙ্গরাজ দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন। এঁরা নিশ্চিত বাংলা ভাষার অস্তিত্বের কথাই জানতেন না।

খাদ্য অভ্যেস দিয়ে কোনও জাতির পরিচয় ঠিক করা যায় না। অনেকের ধারণা, ইলিশ বুঝি একটা বাঙালি-মাছ। পৃথিবীর বহু দেশেই ইলিশ পাওয়া যায় বিভিন্ন নামে। আমেরিকায় শ্যাড আমাদের ইলিশের চেয়েও আকারে বড় ও নধরকান্তি, তবে বেশি তৈলাক্ত বলে বাঙালিদের রসনায় ঠিক স্বাদ পাওয়া যায় না, তাই অনাবাসী বাঙালিরা বরফ দেওয়া দেশি ইলিশের খোঁজ করে বাংলাদেশি দোকানে।

রাঢ়, বঙ্গ, বরেন্দ্রভূমি এইসব নিয়ে বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলা যে মিলিত ভূখণ্ড, সেখানকার অধিবাসীরাই কি শুধু বাঙালি? (এখন ত্রিপুরা এবং অসমের কাছাড় জেলায় অনেকখানি অংশকেই ধরতে হয়।) এক কালের আর্যবর্জিত এই অঞ্চলে বহু মানুষই এসেছে বাইরে থেকে। কোন দল কবে এসেছে, তার ইতিহাস আজও ঠিক ভাবে নির্ণয় করা যায়নি। ঠিক কতদিন আগে কিংবা ক’পুরুষ ধরে এখানে বসবাস করলে তাঁদের বাঙালি বলে গণ্য করা হবে, তার কোনও সীমারেখাও নির্দ্ধারিত হয়নি। এক কালে রাজস্থান কিংবা উত্তর ভারত থেকে যেসব ভাগ্যান্বেষী বাংলা মুলুকে পাড়ি জমিয়ে এখানেই স্থায়ী হয়ে গেছেন, যাঁদের পদবি সিংহানিয়া কিংবা সারাওগি কিংবা দুগার, এবং যাঁরা অনর্গল বাংলা বলতে পারেন, বাংলা-সংস্কৃতি সম্পর্কেও যথেষ্ট অবহিত, তাঁদের কেন বাঙালি বলে মনে করা হবে না? আমি নিজেও কি খাঁটি বাঙালি? শোনা যায়, উপাধ্যায় শ্রেণির কিছু ব্রাহ্মণকে সেন রাজারা আনিয়েছিলেন কনৌজ থেকে। তা হলে তো আমারও কোনও মধ্যযুগীয় পূর্বপুরুষ ছিলেন বাংলা না-জানা এক কনৌজিয়া!

সাধারণত বাঙালিরা পদবি দেখেই বাঙালি না অবাঙালি তা বুঝে নেয়। তা-ও চট্টোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, ঘোষ-বোস-মিত্তির ইত্যাদি কিছু পদবি মাত্র। অথচ, এই অঞ্চলে বহুদিন যাবৎ বসবাসকারী এবং পুরোপুরি বঙ্গভাষী অন্য অনেকরকম পদবিও আছে। যেমন, গণ, শ, সনাতন, সমশ্রমী, পাহাড়, পড়েল, দণ্ডী এরকম বহু। এবং মুসলমানদের তো কোনও পদবিই থাকে না।

প্রকৃত পক্ষে, ইংরেজি শিক্ষার আগে বাঙালি তার আত্মপরিচয় খোঁজেনি। ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামায়নি বিশেষ কেউ। সীমিত গণ্ডির বাইরে কারও দৃষ্টি যেত না, ধর্মবিশ্বাসেও এসে গিয়েছিল কূপমণ্ডুকের সংকীর্ণতা। রামমোহন-বঙ্কিমের আমল থেকেই জাতীয় চেতনার উদ্ভব। আমরা যাকে নবজাগরণ বলি, দেড়শো বছর আগে তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন উচ্চশ্রেণির হিন্দুরা। তাঁরা অনেক সৎকাজ করেছিলেন বটে, একটা মারাত্মক ভুলও করেছিল। তাঁরা মুসলমানদের কথা একেবারেই মনে রাখেননি! ওই লোকটি বাঙালি না মুসলমান—এই নির্বোধ প্রশ্ন প্রায় সকল শ্রেণির হিন্দুদের মুখে শোনা যেত। (এখনও মাঝে মাঝে শোনা যায়।)

এই প্রশ্নের উত্তরে, পরবর্তী কালে মুসলমানরা এই হিন্দুদের মুখে একেবারে ঝামা ঘষে দিয়েছে বলা যায়। স্বাধীনতার দশ বছর আগেই বোঝা গিয়েছিল, বঙ্গদেশে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের সংখ্যা অনেক বেশি। ১৯৩৭ সালে বিধানসভার নির্বাচনে মোট ২৫০টি আসনের মধ্যে মুসলমান সদস্যই ১১৭ জন, বাকিদের মধ্যে ইংরেজ, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, ভারতীয় খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি ও ইহুদিদের জন্যও আলাদা আলাদা কোটা, বর্ণহিন্দু মাত্র ৫২টি আসনে। অনেক মুসলমানও আগে নিজেদের বাঙালি বলত না, ধর্মীয় পরিচয়টাই ছিল একমাত্র। কিন্তু এই সময় তাদেরও জাতীয় চেতনা জাগে। হিন্দু সদস্যরা সাহেবি পোশাক পরে এসে বক্তৃতায় ইংরেজির ফুলঝুরি ছোটাতেন, লুঙ্গির ওপর পাঞ্জাবি পরা গ্রামের মুসলমানরা প্রথম বক্তৃতা শুরু করলেন বাংলায়।

মুসলমান না বাঙালি, অনেকটা এই প্রশ্নেই বাংলা ভাগ হল। তারপর কিছু বছর পর ওই দিকের স্বাধীন রাষ্ট্রটি, আমাদের মতামত না নিয়েই নাম গ্রহণ করল বাংলাদেশ। এখন পৃথিবীর অনেক দেশেই ধারণা হতে শুরু করেছে, বাংলাদেশেই শুধু বাঙালিদের বাস। এবং অদূর ভবিষ্যতে কেউ হয়তো জিগ্যেস করতে পারে, ভারত নামে দেশটাতেও বাঙালি থাকে নাকি? কিংবা—হিন্দুরাও বাঙালি হয়?

আর কতদিন সহ্য করব?

আমরা আর পিছোতে পিছোতে কতটা পিছোব? বাংলা ভাষার অবমাননা দেখতে দেখতে আমরা আর কতখানি কাপুরুষের মতন অসহিষ্ণু হব?

কলকাতা শহরে এমন অনেক দোকান আছে, এমন অনেক হোটেল আছে, যেখানে বাংলায় কথা বলা যায় না, বাংলায় কিছু জিগ্যেস করলেও উত্তর পাওয়া যায় না। এমন বহু-অফিস আছে, যেখানে বাংলায় চিঠি কিংবা দরখাস্ত লেখার প্রশ্নই ওঠে না। আমরা সারা বিশ্বে বাংলা ভাষার কেমন সমাদর তা নিয়ে মাথা ঘামাই, অথচ খোদ কলকাতা শহরেই বাংলা ভাষার এই দুর্দশা। চিন-রাশিয়ার কথা তো বলাই বাহুল্য, বুলগেরিয়া কিংবা রোমানিয়ার মতন ছোট্ট দেশেও সেখানকার স্থানীয় ভাষায় সর্বোচ্চ স্তরে মত বিনিময় করা যাবে না, এমন ভাবাই যায় না। এবং আমাদের পাশের দেশ বাংলাদেশেও।

বিশ্বের প্রধান ভাষাগুলির মধ্যে বাংলার স্থান ষষ্ঠ, জনসংখ্যার হিসেবে ফরাসি স্প্যানিশেরও ঊর্ধ্বে, সেই বাংলা আজ যতখানি বরণীয় বাংলাদেশে, ততখানিই অবহেলিত ভারতে।

দিল্লি-বোম্বাই-এলাহাবাদ-কাশী-পাটনার বাঙালি ছেলেময়েরা এখন আর কেউ বাংলা পড়ে না। কারণ বাংলা শেখার সঙ্গে জীবিকার যোগ নেই। ওইসব জায়গায় প্রচুর ছেলেমেয়েকে দেখেছি, যারা কোনওক্রমে বাংলায় কথা বলতে পারে বটে, কিন্তু বাংলা অক্ষরজ্ঞান নেই। বাংলা বই পড়ে না, বাংলা গান শোনে না। বিলেত-আমেরিকায় যেসব বাঙালি পরিবার এক যুগের বেশি

স্থায়ী হয়ে গেছে, তাদের ছেলেমেয়েরা আর বাঙালি রইল না বলে আমরা হা-হুতাশ কিংবা হাসিহাসি করি, কিন্তু আমাদের নিজের দেশেও তো প্রায় সেই অবস্থা। এমনকী কলকাতা শহরেও। এই শহরে যেসব লম্বা লম্বা আট-দশতলা বাড়ি উঠেছে, তার যে-কোনও বাড়ির লিফট দিয়ে উঠতে উঠতে বাঙালি ছেলেমেয়েদের মুখে বাংলা শোনা যাবে না। হয় ট্যাঁশ ইংরেজি অথবা একটা জগাখিচুড়ি ভাষা। মাতৃভাষা না জানাটা যে একটা লজ্জার ব্যাপার, সেটা বোধটাই চলে যাচ্ছে একটা প্রজন্ম থেকে। দোষ এইসব ছেলেমেয়েদের নয়, তাদের মা-বাবাদের। শিক্ষানীতির। আমাদের শাসকদের সম্মানজ্ঞানের অভাবও এর একটি কারণ। বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলির এখন দুয়োরানির ছেলেমেয়েদের মতন অবস্থা। নেহাত বাধ্য না হলে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বাচ্চাদেরও এখন পাড়ার বাংলা স্কুলে পাঠানো হয় না। যেসব বাবা-মায়েরা নিজেরা বাংলা স্কুলে পড়েছে এবং জীবনে খুব একটা খারাপ কিছু করেনি, তারাও ছেলেমেয়েদের এখন কিছুতেই বাংলা স্কুলে পাঠাবে না। একটু ভালো চাকরির ক্ষেত্রে ফুরফুর করে ইংরেজি বলতে পারাটাই প্রাথমিক যোগ্যতা। নিয়োগকারীরা প্রথমেই দেখে নেয় প্রার্থী কোন স্কুলে পড়াশুনো করেছে। সেন্ট জেভিয়ার্স? ঠিক আছে। তীর্থপতি? মাস্টারির চেষ্টা করুন! আমাদের রাজ্য সরকার, কংগ্রেস বা বামপন্থী, মাঝে-মাঝেই হুঙ্কার ছাড়ে, এবার থেকে সব সরকারি কাজ বাংলায় হবে! আসলে কিচ্ছু হয় না! বিধানচন্দ্র রায় পরপর তিনটি বাক্য শুদ্ধ বাংলায় বলতে পারতেন না। সিদ্ধার্থ রায়ের মুখে বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে কয়েকটি উক্তি শুনে আমার পক্ষে হাসি চাপা শক্ত হয়েছিল। জ্যোতি বসু অসমাপ্ত বাক্যে বাংলা বক্তৃতা বেশ ভালোই চালিয়ে যান, তিনি বাংলা লিখতে পারেন কি না তা বলতে পারবেন তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা। আমাদের নকশাল বন্ধুদেরও ধন্যবাদ। সত্তরের দশককে মুক্তির দশক করার উন্মাদনায় তাঁরা কিছু কিছু বাংলা স্কুল পুড়িয়ে দিলেন, মফস্সলের বহু স্কুলের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেল, ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলগুলিকে নকশালরা স্পর্শও করলেন না। সেই থেকে অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের হাত ধরে পাগলের মতো ছুটতে লাগলেন ইংরেজি স্কুলগুলির দিকে। ব্যাঙের ছাতার মতন সেইরকম স্কুল গজাতেও লাগল। যাওয়া-আসার পথে দেখতে পাই কোনও বিখ্যাত স্কুলের আশপাশের রাস্তার ফুটপাথে-রকে-গ্যারেজে দুপুর রোদে বসে থাকেন মহিলারা, বহুদূর থেকে ছেলেমেয়েকে সেই স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ফিরে না-গিয়ে, আবার বিকেল বেলা সন্তানদের সঙ্গে নেবার জন্য অপেক্ষা করেন। এইরকম হাজার হাজার মাকে পথে বসিয়েছে আমাদের শিক্ষানীতি। রাষ্ট্রভাষা প্রসারের ছুতোয় হিন্দি ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে জোর করে। হিন্দি শিখলে ক্ষতি নেই, যে-কোনও ভাষা শিক্ষাই সুফল দেয়, কিন্তু জোর করে চাপানো ভাষা কেউ গ্রহণ করে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার অন্যতম কারণ যে অঙ্গ রাজ্যগুলির ওপর রুশ ভাষার জবরদস্তি, তা আমাদের কত্তারা খেয়াল করেন না।

হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতি ও বোম্বাই মার্কা হিন্দি সিনেমা এক নয়। হিন্দি ভাষার ভালো দিকগুলি জানবার আগেই হিন্দি সিনেমার বিকট সংস্কৃতি চেপে বসল আমাদের ওপর। খারাপ টাকা যেমন ভালো টাকাকে বাজার থেকে তাড়িয়ে দেয়, তেমনই বিকৃত রুচির হিন্দি সিনেমা ভালো বাংলা সিনেমাকে একেবারে নির্মূল করছে। সত্যজিৎ-মৃণাল-গৌতম-বুদ্ধদেবের নাম টানার দরকার নেই, পঞ্চাশটা বাংলা ফিল্মের মধ্যে একটি-দুটির বেশি দেখার যোগ্য নয়। ষাটের দশক পর্যন্ত বেশ কিছু পরিচ্ছন্ন বাংলা ছবি তৈরি হত, মহৎ কিছু না হলেও বেশ উপভোগ্য। সেসব বাংলা ছবি গেল কোথায়? গত তিরিশ বছর ধরে কুৎসিত হিন্দি ফিল্মগুলো প্রবল দাপটে এমনকী গ্রামের দর্শকেরও রুচি নষ্ট করে দিয়েছে। এখন আত্মসম্মান জ্ঞানহীন একদল লোক হিন্দির অনুকরণে আরও খারাপ ফিল্ম তৈরি করে। চোখের সামনে আমরা বাংলা ফিল্মের সুস্থ ঐতিহ্য নষ্ট হতে দিয়েছি। মৃণাল-গৌতম-বুদ্ধদেবকেও এখন বাধ্য হয়ে হিন্দি ভাষায় ছবি বানাতে হয়।

বাংলা-ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর নবতম আক্রমণ চলেছে টিভি-তে। দূরদর্শন নামটা আক্ষরিক অর্থে সত্যি নয়, রুপালি পরদার ছায়াছবি এখন এসে পড়েছে ঘরের মধ্যে, নিজের বিছানায় বসে অপরের বেডরুম সিন দেখা যায়। ইচ্ছে থাক বা না থাক, টিভি দেখতেই হয়। অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের তো অবশ্য দ্রষ্টব্য। বাড়িতে একটা টিভি সেট রাখা সামাজিক সম্মানের ব্যাপার হয়ে গেছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ি, এমনকি বস্তিতেও দেখা যায় টিভি অ্যান্টেনা। এখন ছেলেমেয়েরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়তে যায়, বাড়িতে হিন্দি অনুষ্ঠান দ্যাখে। বাংলার স্থান কোথায়?

দূরদর্শনে প্রথম থেকে আঞ্চলিক কার্যক্রম ও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম নামে দুটি ব্যাপার ছিল। রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম মানেই হিন্দি বা ইংরেজি। তারপর এল দ্বিতীয় চ্যানেল, যার পুরোপুরি সময়টাই আঞ্চলিক ভাষার প্রাপ্য। কিন্তু তার মধ্যে হিন্দি খবর শোনা ছিল বাধ্যতামূলক! বাংলা-ইংরেজি-হিন্দি খবরের মধ্যে বিশেষ হেরফের নেই। যার যেটা খুশি শুনবে। কিন্তু বাংলা খবর শুনে যে সবকিছু জেনে নিয়েছে, সে হিন্দি বা ইংরেজি সংবাদও শুনতে কেন বাধ্য হবে? এখন কী একটা উদার নীতি না খোলা নীতির ব্যাপার চলছে, যার ফলে দ্বিতীয় চ্যানেল থেকেও বাংলা প্রায় উধাও! টিভি খোলা থাকলেই দেখা যায় হিন্দি ফিল্মে গানের দৃশ্য, একইরকমের হুটোপুটি নাচ, যৌন আবেদন জাগাবার চেষ্টায় নিকৃষ্টতম অঙ্গভঙ্গি। শিল্পরুচির কোনও চিহ্ন নেই। বাংলার সংগীত শিল্পী, বাংলার নাট্যদল, বাংলার ধারাবাহিক নির্মাতারা রক্তাল্পতায় ভুগছে, ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে।

এই অবস্থা আমরা কতদিন সহ্য করব? নাঃ, আবেদন-নিবেদনে আর আমার কোনও বিশ্বাস নেই। পশ্চিম বাংলার দলমত নির্বিশেষে এখনই যদি আমরা সবাই এক সঙ্গে প্রতিরোধে না নামি, তাহলে এই অধোগতির আর কোনও সীমা থাকবে না। আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশই বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির পূর্ণ উত্তরাধিকার নিয়ে নেবে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে তা মুছে যাবে।

বাঙালি, বাঙালিত্ব—জাতি ও সংস্কৃতি

অনেক রক্তপাত অনেক চোখের জল আছে এর পেছনে। তবু ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতিতে আমাদের ধ্যান ধারণার বাংলার যে চিন্ময়ী রূপটি ছিল তার সম্মান প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল।

একদিন রবীন্দ্রনাথ সারা পৃথিবীর কাছে বাংলাদেশের কথা পৌঁছে দিয়েছিলেন আজ মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী তরুণরা পৃথিবীর কাছ থেকে বাঙালি জাতির জন্য অন্য একরকমের সম্মান আদায় করে নিল।

এই জাতটার ওপর দিয়ে কম ঝঞ্ছা—দুর্দিন যায়নি। বিদেশি শক্তির চক্রান্তে কয়েক শতাব্দীর মধ্যে দুটো বিশাল দুর্ভিক্ষ ঘটিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাতে মারা গেছে লক্ষ-নিযুত মানুষ। ব্রিটিশ আমলে ভয়ংকরভাবে শোষিত ও অত্যাচারিত এই ভূখণ্ড। ১৯০৫ সালে বাংলাকে দু-ভাগ করে দেবার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে সত্যিই দু-ভাগ হয়ে গেল। বাংলা বিভাগের দুঃখ হয়তো আমাদের কোনওদিন ঘুচবে না, কিন্তু এতদিন পর তার একটি খণ্ড যে বাংলাদেশ নাম নিয়ে স্বাধীন রাজ্য হতে পারল—এ আনন্দেরও অবধি নেই। ধর্মের প্রশ্নে দেশ ভাগ হয়েছিল, আজ স্বাধীন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নারী-পুরুষের সমান অধিকার।

আর্য সভ্যতার প্রথম যুগে অবজ্ঞাত এই বাঙালিরা বিভিন্ন আদিবাসী কৌমের সংযোগে গড়ে উঠেছে, তৈরি করেছে নিজেদের আলাদা সংস্কৃতি। পরবর্তীকালে আর্য ও ইসলাম সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে—কিন্তু বাঙালি তা আত্মসাৎ করেছে। তার মধ্যে হারিয়ে যায়নি। আদি অস্ট্রেলিয় বা ভেড্ডিড, মঙ্গোলীয় শাখার প্যারোইয়ান, ইন্দো-আর্য ও শক-পামিরীয় উপাদান, এবং মালয়-ইন্দোনেশীয়দের সংমিশ্রণে তৈরি হল যে জাত তারা খুব বেশি লম্বাও নয় বেঁটেও নয়, মাথার গড়ন দীর্ঘও নয় গোলও নয়, নাক খুব টিকোলোও নয় থ্যাবড়াও নয়, গায়ের রং খুব ফর্সাও নয়, ঘোর কৃষ্ণবর্ণও নয়। এই জাত সম্পর্কে বিদেশিরা নানারকম ধাঁধায় পড়েছে। কেউ বলেছে এই জাত অতি বুদ্ধিমান কিন্তু ভীরু, খুব খেতে ভালোবাসে অথচ কাজ করে না। অতিরিক্ত বাক্যবাগীশ কিন্তু পরাধীনতা মানে না।

রণ-দুর্মদ জাতি হিসেবে বাঙালিদের কোনও প্রসিদ্ধি নেই, যদিও দশাননজয়ী রামচন্দ্রের প্রপিতামহের সঙ্গে নাকি বাঙালি সৈন্যরা সজ্জিত চতুরঙ্গে যুদ্ধ করেছিল, দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় পাণিপ্রার্থী ছিলেন তিনজন বাঙালি রাজা—যুদ্ধ করেছিলেন কৃষ্ণার্জুনের বিরুদ্ধে। টলেমি লিখেছেন গঙ্গাহৃদি (গংগারিডি) জাতির ঐরাবত বাহিনীর প্রতাপেই নাকি আলেকজান্দার ভারত পরিত্যাগ করেন। তবু গৌরব হয়নি বাঙালির—ভেতো বাঙালি বলেই পরিচিতি। তিতুমীর, সূর্য সেন প্রভৃতির বীরত্ব অনেকটা ব্যক্তিগত কীর্তি হিসেবে চিহ্নিত,—হঠাৎ ১৯৭১ সালে বাঙালিরা দেখিয়ে দিল নিছক সন্ত্রাস সৃষ্টিই নয়, সংঘবদ্ধভাবে তারা কী অসম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করতে পারে। পঁচিশে মার্চ পূর্ব বাংলায় শুরু হল তাণ্ডব, তার পরদিন থেকেই তৈরি হয়ে গেল প্রতিরোধ বাহিনী। সুশৃঙ্খল এবং আধুনিকতম অস্ত্রে সজ্জিত নিষ্ঠুর পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায় নিরস্ত্র বাঙালি জাতির এই রুখে দাঁড়ানো পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। মুক্তিবাহিনীর অপারেশন আমি নিজের চোখে দেখতে গিয়েছি কয়েকবার—দেখেছি কী অসীম মনোবল তাদের, অসম্ভব কষ্ট সহ্য করেও প্রতিজ্ঞা পালনের কী অদ্ভুত দৃঢ়তা। বাঙালি হিসেবে তখন গর্ব অনুভব করেছি। ঠোঁট-কাটা বিদেশি সাংবাদিকরাও মুক্তিবাহিনীর প্রশংসা না করে পারেনি, বিলেতি পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদন বেরিয়েছে যে, কোনও কোনও দিকে বাঙালি গেরিলারা ভিয়েৎনামী গেরিলাদের থেকেও বেশি সার্থক। বাংলাদেশের মানুষ লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন করছে।

বাংলা দু-ভাগ হবার দুঃখ আমরা অনেকেই কোনওদিন ভুলব না, কিন্তু মেনে নেব। ইতিহাসের গতি আঁকাবাঁকা হলেও জোর করে বদলানো যায় না। খণ্ডিত বাংলার এক অংশ বাংলাদেশ নামে স্বাধীন হল। এ পাশে পড়ে রইল যে পশ্চিমবাংলা, সে কি আর তা হলে বাংলা নয়, সেখানকার মানুষ নয় বাঙালি? ব্রিটিশ আমলে যা ছিল বাংলাদেশ বা বেঙ্গল, ইতিহাসে কোনওদিনই তা স্থায়ী ভাবে এক রাজ্যের অধীন ছিল না, অনেক সময় নামও বদলেছে, পুণ্ড্র, গৌড়, রাঢ়, সুহ্ম, বজ্র, সমতট ইত্যাদি আঞ্চলিক নাম উদ্ভূত হয়েছে। বরং ইতিহাসের সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে পাওয়া যায়, পূর্ব বাংলারই বাংলাদেশ নামের ওপর অধিকার বেশি। আকবরের আমলে পূর্ব-পশ্চিম ভূখণ্ড সুবে বাংলা নামে চিহ্নিত হওয়ায় গৌড়-জনবাসীরাও বাঙালি হয়েছিল। যাই হোক, ১৯৪৭-এর পর আমরা মর্মে মর্মে বুঝেছি, বাঙালিত্ব কোনও ভৌগোলিক সীমানার ওপর নির্ভরশীল নয়—ধর্মের প্রশ্নে নয়, সাংস্কৃতিক মিলেই আমরা বাঙালি। এবং এর পরেও তাই থাকব।

একথাও ঠিক, বাঙালি সংস্কৃতিকে অধুনা উজ্জীবিত করেছে পূর্ব বাংলার মানুষই বেশি। দেশ বিভাগের পর, উভয় দেশের রেষারেষির ফলে পূর্ব বাংলার মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল পশ্চিম বাংলা থেকে। কিন্তু অত্যাচারী পাকিস্তানিদের সঙ্গে তাদের রুচি ও সংস্কৃতির এতই অমিল যে ধর্মের দোহাই দিয়েও তারা মিশে যেতে পারেনি শাসকদের সঙ্গে। আত্মরক্ষার জন্যই তারা সংস্কৃতির দিক থেকে সুসংহত হয়েছে, তারা নতুনভাবে আবিষ্কার করেছে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দকে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের অত্যাচার তাদের কাছে শাপে বর হয়েছে, তারা কৃত্রিমভাবে পাকিস্তানি হয়নি বেশি করে বাঙালি হয়েছে। এদিকে, পশ্চিমবঙ্গের দিকে সমগ্র উত্তর ভারত খোলা, সেখানকার ঢেউ মাঝে মাঝে ঝাপটা দিয়েছে। এদিকে হিন্দি ফিলমের কুরুচি ঢুকে গেছে অনেক গভীরে, আমাদের অনেকের কাছেই বাংলার সংস্কৃতি ঝাপসা।

স্বাধীন গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্ম হল। বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচনের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার চেয়েছিল, পাকিস্তানি শাসকরা বর্বর উপায়ে তা দমন করতে চেয়েছিল। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রী দেশ হিসেবে ভারত প্রতিবেশী রাজ্যের এই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে এসেছে। গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ঘোষণাকারী আমেরিকা এই সময়ে নিয়েছে ঘৃণিত ভূমিকা। ব্রিটিশের ভূমিকা ক্লীবের মতন। বিশ্বের শোষিত জনগণের নেতা হিসেবে গণ্য হতে চায় যে প্রজাতন্ত্রী চিন—বাংলাদেশের মানুষের ওপর ইতিহাসের জঘন্যতম অত্যাচারের কথা জেনেও মুখ ফিরিয়ে রইল কোন যুক্তিতে জানি না। রাশিয়া অপ্রত্যক্ষ সাহায্য করেছে বলে আমরা কৃতজ্ঞ। ভারত এই ঐতিহাসিক ভূমিকা না নিয়ে যদি কোনওরকম বিচ্যুতি দেখাত—আমাদের লজ্জা রাখবার জায়গা থাকত না। এই বিবেকসম্মত ভূমিকা নিতে পেরেছে বলে আজ আমাদের অসম্ভব গর্ব।

দুই বাংলার বাঙালি

এপার-ওপার মিলিয়ে বাঙালির সংখ্যা এখন কত? সঠিক সংখ্যাটা জানি না, তবে অন্তত ১৬ কোটি তো হবেই। এই ভূখণ্ডে আর যা কিছুরই অভাব থাকুক, মানুষের অভাব নেই! কল্পনা করা যাক, এই ১৬ কোটি মানুষ দু-বেলা যথেষ্ট খেতে পায়, সকলেরই নিজস্ব বাড়ি-ঘর আছে, সকলেরই আছে উপযুক্ত পোশাক, সকলেই পায় শিক্ষার সুযোগ, যান-বাহনেরও মোটামুটি সমস্যা নেই, এবং এই মানুষেরা ধর্মের নামে যখন-তখন নিজেদের মধ্যে মারামারি করে না। এটা এমন কিছু কষ্ট কল্পনা নয়, পৃথিবীর সভ্য দেশগুলিতে এই সবই জীবনযাত্রার সাধারণ মান। এইগুলি যদি সত্য হত, তা হলে ১৬ কোটি মানুষের এই বিশাল জাতি হতে পারত কত শক্তিশালী। স্প্যানিশ, ইতালিয়ান, ফ্রেঞ্চদের তুলনায় বাঙালিরা গণ্য হত অনেক বড় জনগোষ্ঠী হিসাবে, পৃথিবীতে বাঙালিরা একটি বিশেষ স্থান আদায় করে নিতে পারত।

ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী ভাষা-ভিত্তিক জনসংখ্যার হিসাবে বাঙালিদের স্থান সারা বিশ্বে এখন পঞ্চম। ফরাসি-জার্মান-ইতালিয়ানদের অনেক উপরে। কিন্তু ওই সব ভাষার খ্যাতি ও সমৃদ্ধির তুলনায় বাংলার স্থান নগণ্য। সমস্ত পৃথিবীর শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমান সমাজ বাংলা ভাষাকে পাত্তাই দেয় না। অনেকে বাংলা ভাষার অস্তিত্বই জানে না। হাঙ্গেরিতে গিয়ে দেখেছি, রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিফলকে লেখা আছে, তিনি একজন ‘হিন্দু’ কবি, এবং ‘হিন্দু’ বলেই তারা ধরে নিয়েছে রবীন্দ্রনাথের রচনার ভাষা হিন্দি।

বাংলায় কথা বললেই কি বাঙালি হয়? এপার-ওপার মিলিয়ে এই যে ১৬ কোটি মানুষ, তিন-চতুর্থাংশই লেখা-পড়ার ধার ধারে না। হালে একটি সাক্ষরতা অভিযান চলছে বটে, অক্ষর জ্ঞান সম্পন্নদের সংখ্যা সম্ভবত কিছু বেড়েছে, কিন্তু তাদেরও ঠিক লেখা-পড়া জানা বলা যায় না। যারা এখনও দু-বেলা খেতে পায় না, তাদের মধ্যে লেখা-পড়ার চল হওয়া কি সম্ভব? অনেকে বাংলায় কথা বলে বটে, কিন্তু তারা নিজেরাই জানে না তারা বাঙালি কি না! তারা মানুষ কি না, এই ব্যাপারেও তাদের সন্দেহ আছে। সমাজের উঁচু শ্রেণির লোক যে তাদের সঙ্গে মানুষের মতন ব্যবহার করে না আজও। ডোম-চাঁড়াল-ধোপা-নাপিত-মেথরদের কি আমরা নিজেরাই বাঙালি বলে গণ্য করি? যে-মেথর প্রতিদিন আমাদের বাড়ির মধ্যে ঢোকে, কিংবা যে ধোপা আমাদের জামা-কাপড় নিতে আসে, তাদের নামটাও তো আমরা অনেকে জানি না বা জানার প্রয়োজনও মনে করি না।

যারা অর্ধাহারী, যারা শিক্ষার সুযোগ পায় না, যারা অর্থনগ্ন, তাদের আসলে কোনও জাত নেই। ১৬ কোটি বাঙালি মিলে আমরা বিশাল একটি জাত, এ গর্ব মিথ্যা, মনকে চোখ ঠারা।

দুই বাংলা মিলিয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয় কতজন ছাত্র-ছাত্রী? বড়জোড় ১০ লাখ। শতকরা একজনেরও কম। আধুনিক পৃথিবীতে এ জাতি গর্ব করতে গেলে হাস্যাস্পদ হবে।

ভারত ভেঙেছে, পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। বিশ্বের মানচিত্রে বাঙালিদের একটি নিজস্ব দেশ স্থান পেয়েছে, যদিও বড় বড় শক্তিশালী দেশগুলির চোখে সে দেশ করুণার পাত্র। যে দেশ স্বনির্ভর হয়ে নিজস্ব শক্তি অর্জন করতে পারে না, সে দেশকে হীনম্মন্যতায় ভুগতেই হয়। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত জাপান কয়েক বছরের মধ্যেই নিজস্ব তেজে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সারা দুনিয়া। ভারত যুদ্ধ-বিধ্বস্ত হয়নি, কিন্তু দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও জাত-পাতের লড়াইয়ে অনবরতই বিধ্বস্ত হয়ে চলেছে। ভারতীয় দর্শন, প্রাচীন কাব্য-সাহিত্য, সংস্কৃতি বা অহিংসার বাণীকে কেউ আর এখন তেমন মূল্য দেয় না। যে দেশে গৌতম বুদ্ধ থেকে মহাত্মা গান্ধী পর্যন্ত অহিংসার দর্শন প্রচার করেছেন কতবার, সে দেশে সর্বক্ষণ লকলক করছে হিংসা। ভারত যা পারেনি, চিন তা পেরেছে অনেকটা। সেখানে ধর্মীয় দাঙ্গা হয় না, ভাষা ও খাদ্য ব্যবহার নিয়ে কোনও দ্বন্দ্ব নেই। আঞ্চলিক বৈষম্য ও বাক-স্বাধীনতার অভাব আছে, তা জোর করে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। বেজিং-এর তিয়েনয়ানমেন স্কোয়ারে কয়েক বছর আগে গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে বিদ্রোহী ছাত্র-ছাত্রীদের উপর ট্যাঙ্ক ও গুলি চালিয়ে তিন হাজার জনকে হত্যা করা হয়েছিল। মানবতার বিরুদ্ধে এটা একটি জঘন্য অপরাধ নিশ্চয়ই। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিনই গুলি চালিয়ে কয়েকজনকে মেয়ে ফেলা হয়। সারা বছরের হত্যাকাণ্ড যোগ দিলে খুব কম হবে না।

বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বটে, কিন্তু সে-দেশে শান্তি আসেনি। যেসব আদর্শ নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা, তার বিপরীত শক্তিগুলি মাথা চাড়া দিয়েছে এখন। মুক্তিযোদ্ধারা কোণঠাসা। ধর্মনিরপেক্ষতা মুছে দেওয়া হয়েছে সংবিধান থেকে, আরবি মদতে মৌলবাদীরা শক্তিবৃদ্ধি করছে অনেকখানি, প্রাক্তন রাজাকাররাও দখল করছে ক্ষমতার বিভিন্ন শিখর। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রাঙ্গণে গুলিগোলা চলে অনবরত।

খণ্ডিত বাংলার পশ্চিম খণ্ডে দেশ বিভাগের ঘা দগদগ করছে এখনও। উদ্বাস্তু সমস্যার পুরো সমাধান আজও হয়নি, রেল লাইনের পাশে, রাজসড়কের দুধারে ঝুপড়িতে মনুষ্যেতর জীবনযাপন করে লক্ষ লক্ষ মানুষ। দণ্ডকারণ্য কিংবা আন্দামানে নির্বাসিত উদ্বাস্তুরা এখনও বাঙালি কি না তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।

এক অদ্ভুত রাজনৈতিক ডামাডোল চলছে পশ্চিমবঙ্গে কয়েক দশক ধরে। যতদিন কংগ্রেস সরকার ছিল, ততদিন ক্ষমতাবানদের ছত্রছায়ায় একদল সমাজবিরোধী দাপিয়ে বেড়িয়েছে, যেখানে যতটুকু শাঁস ছিল তা চুষে খেয়েছে। কংগ্রেসিয়া বিপক্ষ দলগুলিকে গণতান্ত্রিক অধিকার দিতে চায়নি, নেতাদের জেলে ভরেছে যখন-তখন। পশ্চিমবঙ্গীয় কংগ্রেসিদের অবস্থা এক এক সময় মনে হয়েছে হাস্যকর। দিল্লির কাছে তাদের কান বাঁধা। এদিকে বিধান রায়-অতুল্য ঘোষের মতন ব্যত্তিত্বের প্রস্থানের পরে দিল্লির কর্তারা পশ্চিম বাংলাকে নীচু নজরে দেখতে শুরু করেছিল, এককালের আত্মম্ভরী বাঙালিদের ঢিট করতে চেয়েছিল দিল্লি। খণ্ডিত পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিক জোরও ছিল না। দিল্লির কাছ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জেনেও পশ্চিম বাংলার কংগ্রেসিরা মুখ খুলতে পারেনি। আর কেন্দ্রীয় বঞ্চনার কথা তুমুলভাবে প্রচার করে, সেটাকে কাজে লাগিয়েই ক্ষমতায় এসেছে মিলিত বামপন্থী দলগুলি।

বামপন্থী রাইটার্স বিল্ডিং দখল করার পরেই স্কুল-কলেজ, অফিস-কাছারি, পুরসভা মিউনিসিপ্যালিটিতে রাতারাতি নিজেদের লোকজন বসাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একদা যে-বামপন্থী নেতারা ছিলেন পুলিশের নিন্দায় মুখর, এখন তাঁরাই দু-বেলা পুলিশের গুণগান করেন। সেই একই পুলিশ, একইরকম পুলিশি চরিত্র, সামান্য কারণে গুলি চালিয়ে পুলিশ মানুষ মারে, মুখ্যমন্ত্রী পুলিশের হয়ে সাফাই গান।

পশ্চিম বাংলার যেসব মানুষ কখনও রাজনীতির ধার ধারত না, তারাও রাজনীতি নিয়ে মত্ত হয়ে উঠল। শিক্ষক, অধ্যাপক, ডাক্তার, বৈজ্ঞানিক, লেখক, শিল্পী, নাট্যকর্মী—এঁদের অনেক সময় ব্যয় হয় রাজনীতির চর্চায়। শুধু কথার ফুলঝুরি আর তর্কে টেবিল ফাটানো, আর যাকে তাকে প্রতিক্রিয়াশীল বলে উড়িয়ে দেওয়া। রাজনৈতিক খুঁটি ধরে থাকতে পারলে কাজ করতে হয় না। শিক্ষক-অধ্যাপকদের আর পড়াবার দরকার নেই, পার্টির নামে জয়ধ্বনি দিলেই চলে। আদর্শ-টাদর্শ গোল্লায় গেল, বামপন্থী হওয়াটা স্রেফ স্বার্থের ধান্দা। সত্যিকারের আদর্শবাদী বামপন্থী নেতারাও কেউ বললেন না যে বিশেষ ধরনের কর্মে যাঁরা নিযুক্ত, তাঁদের সর্বক্ষণ রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নেই। ফলে, শিক্ষা বিজ্ঞানচর্চা, শিল্প-সাহিত্য-নাটকে অধঃপতন দেখা দিল। নিম্ন মানের সৃষ্টিকে রাজনৈতিক কারণে বাহবা দেওয়া হতে লাগল। কলকাতার ডাক্তারদের একসময় কত সুনাম ছিল, হাসপাতালগুলির এমন হাল হল যে, বাংলার মানুষ সুচিকিৎসার জন্য ছোটে মাদ্রাজ, বোম্বাই; তাতে কারুর হুঁশ নেই।

বিপ্লব শব্দটা হল বাচ্চাদের একটা চুষি কাঠির মতন। কেউ তাতে বিশ্বাস করে না। বিপ্লবের পরে কী হবে সে-সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই, তবু মিথ্যে মিথ্যে বিপ্লবের স্লোগান দিয়ে ছেলে ভোলাবার পালা চলল। আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ খুব খারাপ জিনিস নিশ্চয়ই, কিন্তু একচক্ষু হরিণের মতন শুধু সেদিকে তাকিয়ে থেকে, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির ভিতরে ভিতরে যে কত ক্ষয় চলছে সেদিকে কেউ লক্ষ করল না। কিংবা জানলেও গোপন করে গেল। সমাজতন্ত্রের পরীক্ষা যে ব্যর্থ হচ্ছে, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে যে উৎপাদন কমে যায়, প্রতিযোগিতা ছাড়া মানুষ অলস হয়ে পড়ে, এইসব কঠোর বাস্তব সত্যগুলিকে উপেক্ষা করে অর্থনীতি চলল ধ্বংসের পথে।

বামপন্থীরা কেউ বাঙালি বা ভারতীয় নয়। মার্কসবাদ তো বিশ্বমানবিক আদর্শ। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক টয়েনবি যে বলেছিলেন, কমিউনিজমের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হবে ন্যাশনালিজম, তাতে তাঁরা কর্ণপাত করেননি। মার্কসবাদী হয়েও চিন ও রাশিয়া নিজেদের সীমানা সম্পর্কে স্পর্শকাতর, সমাজতন্ত্রী হয়েও যে হাঙ্গেরি ও রুমানিয়ার মধ্যে তিক্ত ঝগড়া লেগেই ছিল, তাও তাঁরা দেখেও দেখতে চাননি। এবং দেশের উগ্র বামপন্থীরা বাঙালির যা কিছু গর্বের বস্তু, তাকে ভাঙতে বসলেন। রামমোহন সামন্ততন্ত্রের প্রতিভু, বিদ্যাসাগর সিপাহিবিদ্রোহ সমর্থন করেননি সুতরাং প্রতিক্রিয়াশীল, রবীন্দ্রনাথ বুর্জোয়া কবি, সুভাষ বোস ফ্যাসিস্ত! বিবেকানন্দ উল্লেখেরও অযোগ্য। তাঁদের সভা-সমিতিতে মার্কস-লেনিন-স্তালিনের বড় বড় ছবি ঝুলছে, বাঙালি তথা ভারতীয় কেউ স্থান পাননি। এমনকি মুজাফ্ফর আহমেদের ছবিও না। মহাত্মা গান্ধী কংগ্রেসের সম্পত্তি, সুতরাং বামপন্থীদের কাছে অচ্ছুত।

উগ্রতর বামপন্থীরা চিনের চেয়ারম্যানকে আমাদের চেয়ারম্যান বলে ঘোষণা করল এবং বিদ্যাসাগরের মূর্তি থেকে মুণ্ডু লুটিয়ে দিল ধুলোয়। স্কুল-কলেজে লেখাপড়া শিখলে শুধু মূর্খ তৈরি হয়, এই স্লোগান আকৃষ্ট করল স্কুল-পালানো ছেলেদের, নানা স্কুলে আগুন লাগতে লাগল, মাস্টারমশাইরা ছুরি খেতে লাগলেন, একজন ভাইস চ্যান্সেলার পর্যন্ত নিহত হলেন ছাত্রদের হাতে। এইসব বিপ্লবীরা কিন্তু শুধু বেছে বেছে বাংলা স্কুল পোড়াতে লাগলেন, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলিতে হাতও দিলেন না। তারপর থেকেই পশ্চিম বাংলার নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলি দৌড় শুরু করল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলির দিকে। সেইসব বাড়ি থেকে বিদায় নিতে লাগল বাংলা বই, বাংলা গান। সেই আমলে কিছু সম্পন্ন চাষি, ছোট ছোট ব্যবসায়ী খুন হতে লাগল এলোপাহাড়ি ভাবে, কিন্তু একজনও অবাঙালি ব্যবসায়ীর গায়ে হাত পড়ল না, পাছে ওইসব বিপ্লবীদের নামে কেউ প্রাদেশিকতার বদনাম দিয়ে ফেলে। কুৎসিত হিন্দি সিনেমা এসে বাংলা ছায়াছবির বাজার ও জনরুচি ধ্বংস করে দিল, তবু শাসকদল কোনও প্রতিবাদের মধ্যে গেলেন না, কারণ তাঁরা তো বাঙালি নন, বিশ্বমানব।

আর পশ্চিম বাংলার হেরে যাওয়া কংগ্রেসিরা এই সময় শুধু ইন্দিরা গান্ধির অন্ধ স্তাবকতা করে গেল। ইন্দিরা গান্ধির ভুরুর সামান্য ইঙ্গিতে কংগ্রেসি নেতারা দিল্লিতে ছুটে যান, কলকাতায় ফিরে এসে নিজেদের মধ্যে মারামারি খেয়োখেয়ি শুরু করে দেন। পশ্চিমবাংলার অর্থনীতি ও শিল্প সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁদের যেন কোনও দায়িত্বই নেই। শ্রমিক আন্দোলনের ধাক্কায় বন্ধ হয়ে গেল অসংখ্য ছোটখাটো কারখানা, বড় বড় কোম্পানিগুলি সরে যেতে লাগল অন্য রাজ্যে, দমদম বিমান বন্দরে বিদেশি বিমান নামা বন্ধ হতে লাগল একটার পর একটা, কলকাতা বন্দরে কমে গেল জাহাজ আসা। পশ্চিমবাংলায় তখন রাজনৈতিক গলাবাজি চলছে শুধু।

ওদিকে, বাংলাদেশে, পূর্ব পাকিস্তানের আমল থেকেই অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল এক বাঙালি জাতীয়তাবাদের। মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্রের দাবিতে সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তান। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই বোঝা গেল, শুধু ধর্মের আশ্রয়ে বাঁচা যায় না, মুসলমানরাও মুসলমানদের শোষণ ও অত্যাচার করতে পারে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক শ্রেণি পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের শুধু যে শোষণ করে তা-ই নয়, তাদের নীচু চোখে দেখে, অবজ্ঞা করে। তখন থেকে শুরু হল বাঙালি মুসলমানদের স্বদেশ যাত্রা।

মুসলমানরা বাঙালি হতে পারে কি না এই নিয়ে অনেক হিন্দুর মনে বরাবরই একটি সন্দেহ ছিল। ‘আমি তো ভেবেছিলাম ও মুসলমান, ও বাঙালি নাকি?’ এই ধরনের কথা অনেক হিন্দুর মুখে শুনে অনেক মুসলমানের অপমানে গা জ্বলে যেত। এরজন্য মুসলমানরাও যে একেবারে দায়ী নয়, তা বলা যায় না। অনেক সাধারণ মুসলমান বাংলায় কথা বললেও মনে করত তাদের পিতৃভূমি আরব দেশ। বাংলার অনেক সামাজিক রীতিনীতিকেই তারা মনে করত হিন্দুয়ানি। পুরোনো পুলিশ রিপোর্টে দেখা যায়, যশোরে গ্রামের মুসলমানরা নিজেদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলত, এখানে মোট পাঁচ ঘর বাঙালি, বাকি সবাই মুসলমান।

কিন্তু মুসলমানরা যখন বাঙালি হতে শুরু করল, তখন তারা প্রবল ভাবে এগিয়ে যেতে লাগল। জিয়া চেয়েছিলেন গোটা পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, রুখে দাঁড়াল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা। বাংলা ভাষার দাবিতে পুলিশের গুলি খেয়ে প্রাণ দিল চারজন, ৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। বাংলা সাহিত্যের সিংহভাগ জুড়ে ছিল হিন্দু লেখকরা, কিন্তু বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিল চারজন মুসলমান যুবক। সেই রক্তদান বৃথা যায়নি। পূর্ব পাকিস্তানে যে সব বাঙালি বেশি বেশি মুসলমান, যারা বাঙালিত্বকে হিন্দুত্বের সমতুল্য মনে করত, তারা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের অভিপ্রায়ের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ওখানকার লিখিত বাংলায় প্রচুর পরিমাণে উর্দু শব্দ মেশাবার চেষ্টা করল, তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ লেখক উর্দু শব্দ সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে একেবারে বিশুদ্ধ বাংলা লিখতে লাগলেন, উর্দুর বদলে খাঁটি সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করতেও তাঁরা দ্বিধা করেননি। ডক্টর শহীদুল্লাহ পূর্ব পাকিস্তানের কোনও বিশেষ জেলার ভাষার বদলে বাংলা সাহিত্যের আগে থেকেই স্বীকৃত ভাষা হিসাবে কৃষ্ণনগরের ভাষাকেই পূর্ব পাকিস্তানের লিখিত এবং বেতার সম্প্রচারের ভাষা হিসাবে গ্রহণ করার সুপারিশ করছেন। সুতরাং পশ্চিম বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রবাহিত হতে লাগল একই বাংলা ভাষা। পূর্ব পাকিস্তানে অনেক শক্তিশালী লেখকের দেখা পাওয়া গেল। পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ হলে তার প্রতিবাদ হিসাবে দারুণ ভাবে শুরু হল রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা। অনুরূপ ভাবে শুরু হল থিয়েটার আন্দোলন। সাহিত্য সংস্কৃতির মাধ্যমে সেখানে গড়ে উঠল বাঙালি জাতীয়তাবাদ, যার পরিণতিতে বাংলাদেশের জন্ম।

সেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়নি বটে, ধর্মীয় মাতামাতির জন্য মুক্ত চিন্তা কখনও কখনও ব্যাহত হয়েছে, দেশটাকে পাকিস্তান ও আরব দেশগুলির দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি শক্তি সক্রিয়, তা হলেও সেখানকার গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ বাঙালি হিসাব গর্বিত, বাংলা ভাষার সমৃদ্ধির জন্য সংস্কৃতিকর্মীরা নিষ্ঠাবান। বাংলাদেশের মানুষ বাঙালি থাকবেন না বাংলাদেশি হবেন, এই নিয়ে একটি টানাপোড়েন চলছে, কিন্তু বাংলার সংস্কৃতি সেখানে উজ্জ্বল ভাবে বিকশিত হচ্ছে দিন দিন।

ভারত সরকার হিন্দির প্রসারে বদ্ধপরিকর বলে বাংলা সমেত অন্যান্য রাজ্যের ভাষাগুলি দিল্লি থেকে কোনও সাহায্য পায় না। কিন্তু কোনও কোনও রাজ্য, যেমন তামিলনাড়ু বা গুজরাত নিজেদের ভাষা সর্বস্তরে কাজে লাগায়। পশ্চিম বাংলায় আজও বাংলা ভাষা সরকারি ভাবে ব্যবহৃত হয় না। বিচিত্র এক শিক্ষানীতির ফলে বাংলা স্কুলগুলিতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি পড়ানোই হয় না, আর ব্যাঙের ছাতার মতন গজিয়ে ওঠা অসংখ্য ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলে বাংলা প্রায় কিছুই শেখানো হয় না, তারা শুধু ইংরেজি শেখে। অর্থাৎ কিছু সংখ্যক ছেলেমেয়ে বাংলা শিখছে না, আর যারা বাংলা স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষার পর পড়া ছেড়ে দিচ্ছে, তারা পোস্ট অফিসে গিয়ে একটা মানি অর্ডার ফর্মও ভরতি করতে পারবে না। বাংলা শিখেও তারা অশিক্ষিত থেকে যাবে।

যাঁরা নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করেন, যাঁরা আন্তর্জাতিক মানসকিতার অধিকারী বলে মনে করেন নিজেদের, তারা ভুলে যান যে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে পরিপূর্ণ ভাবে অবহিত না হলে কোনও মানুষেরই মানসিক গঠন সম্পূর্ণ হয় না। যার পা দুটি গাঁথা থাকবে নিজের দেশের মাটিতে চোখ থাকবে নিজস্ব পারিপার্শ্বিকে আর চিন্তায় থাকবে সারা পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাস, সেই প্রকৃত আন্তর্জাতিক মানুষ। অ্যারিস্টটল থেকে মাও জে ডং পর্যন্ত অনেকেই এমন কথা বলে গেছেন। বাঙালির ঐতিহ্যকে অগ্রাহ্য করে প্রগতিশীল হওয়া যায় না।

সরকারি ভাবে বাংলা ভাষার পৃষ্ঠকপোষকতা করা হয়নি পশ্চিম বাংলায় রাজনৈতিক দলগুলির মাথা ঘামাবার সময়ই নেই, সেইজন্যই সাধারণ মানুষের মধ্যেও উদাসীনতার ভাব এসে গিয়েছে। পৃথিবীর নানাদেশে এখন ছড়িয়ে আছে পশ্চিম বাংলার বাঙালিরা, তারা অতি দ্রুত বাংলা ভাষার সঙ্গে সংস্রব ত্যাগ করে, ছেলেমেয়েদের বাংলা শেখায়ই না। চিনারা পৃথিবীর যেখানেই যাক, তারা চিনেই থেকে যায়। যে-ইংরেজ মালয়েশিয়াতে রবার চাষ করে, তার ছেলেমেয়েরা ইংরেজই থেকে যায়। বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরাও পৃথিবীর যেখানেই থাকুক, বাঙালিই থাকে, বাংলা সাহিত্য-সংগীতের চর্চা করে। পশ্চিম বাংলায় ছেলেমেয়েদের চেয়ে তারা অনেক বেশি দুঃসাহসী। এখানকার বেকাররা দু-পা দূরে যেতে চায় না। ওখানকার বেকাররা দারুণ ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেয়। জাপানে পশ্চিমবাংলার বাঙালির সংখ্যা ২০০, বাংলাদেশের বাঙালির সংখ্যা ১০ হাজার।

কলকাতা শহরের গুরুত্ব যত কমে যাচ্ছে, ঢাকা শহরের গুরুত্ব ততই দিন দিন বাড়ছে। কলকাতা একটি নোংরা নগরী হিসাবে আজ সারা পৃথিবীতে কুখ্যাত, ঢাকা সেই তুলনায় অনেক পরিচ্ছন্ন। কলকাতার সাহিত্য সংস্কৃতির সব দিকেই একটা ঝিমোন ভাব, আর ঢাকায় রয়েছে নব যৌবনের উদ্দীপনা।

তবে উদ্দীপনা থাকলেই যে সবসময় উচ্চ মানের সৃষ্টি হবে তার যেমন মানে নেই, সেইরকম পুরোনো বনেদ থাকলে মাঝে মাঝে এক-একটি ব্যক্তিগত সাফল্য দারুণ বিস্ময়ের সৃষ্টি করতে পারে। বাংলা চলচ্চিত্রের মুমূর্ষু দশা হলেও এখানে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনের মতন প্রতিভাধরদের বিকাশ সম্ভব।

রবীন্দ্রসংগীত ছাড়া বাংলা গানের সাধারণ মান বেশ নীচে নেমে গেলেও সলিল চৌধুরীর মতন একজনকে পাওয়া যায়। আলি আকবর, রবিশংকর, শম্ভু মিত্ররা এখন কলকাতার গর্ব। ভারতের অন্যান্য ভাষার সাহিত্যিকরা এখনও পশ্চিমবাংলার লেখকদের ঈর্ষা করেন কি অকারণে?

আমার কল্পনা করতে ভালো লাগে, ১৬ কোটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষ অদূর ভবিষ্যতেই খাদ্য সমস্যার সমাধান করে ফেলবে, বসন ও বাসস্থান পাবে উচিত মতো, ঘুচে যাবে দারিদ্র্য। তারা গর্ব বোধ করবে মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির জন্য। বাংলাদেশ থাক পৃথক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, পশ্চিমবাংলা থাক ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়ে, কিন্তু মিলিতভাবে বাঙালিরা সারা পৃথিবীর চোখে একটি শক্তিশালী জাতিগোষ্ঠী হিসাবে গণ্য হবে। নতুন শতাব্দীর শুরু থেকেই শুরু হোক না সেই প্রক্রিয়া, আমি আশাবাদী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *