‘আমি’ এক ঢিপি
কেন ডাকব ভগবানকে? কোন প্রয়োজন আছে কি? কার কবে কোন্ ডাক তিনি শুনেছেন? কার কোন্ প্রত্যাশা তিনি পূরণ করেছেন? কার চোখের জল তিনি মোছাতে এসেছেন? যার যা হওয়ার তার তাই হয়। কেন তাহলে ডাকব তাঁকে?
এইরকম পাটোয়ারি প্রশ্নের সপাট জবাব—তাঁকে ডাকতেই হবে, না ডেকে পারা যাবে না, থাকা যাবে না। মন কেমন করবে। একটা বিষণ্ণতা আসবে। পৃথিবীর ব্যাপার পৃথিবীরই ব্যাপার। সেখানের যা নিয়ম-ফেল কড়ি মাখ তেল। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার। পয়সাওয়ালা খেয়ে খেয়ে মরবে, গরিব মরবে না খেয়ে। অতি ভোগে সুগার, ক্যান্সার, থ্রম্বোসিস। দুর্ভোগের ঢিপি। এখানে কেউ মারবে, কেউ মরবে। ছেলে যখন বিদেশে তখন সোহাগী বাবা-মায়ের কিছু করার থাকে কি? ছেলেরও কি সবসময় মনে থাকবে মা-বাবার কথা? আমেরিকার কোন ফার্মের এক্সিকিউটিভ। দায়িত্ব, কাজের চাপ, ভ্রমণ, আমোদপ্রমোদ, বন্ধুবান্ধব। ঘাত-প্রতিঘাত, বিচার, অবিচার, দুর্ব্যবহার, বঞ্চনা। বাবা-মা কি করবেন! তাঁরা বসে আছেন হাজার হাজার মাইল দূরে পঞ্চাননতলার ভাঙা বাড়িতে। যোগ নেই, কিন্তু যোগ আছে। স্কুলে নেই সূক্ষ্মে আছে। গভীর রাতে পঞ্চাননতলার মা ভাবছেন, পিটসবার্গে ছেলেটা আমার কি করছে! কেমন আছে, কি খাচ্ছে! কে তার যত্ন করছে! পিটসবার্গের ছেলে গভীর রাতে তার জগৎ থেকে গুটিয়ে আসার মুহূর্তে মায়ের চেহারা চকিতের জন্য দেখছে। স্বপ্ন দেখাও অসম্ভব নয়। মা যেন ডাকছেন—”খোকা! ওঠ, বেলা হলো। গাড়ি চালাবার সময় অত অন্যমনস্ক হয়ে যাস কেন?”
না, এই উত্তরে সন্তুষ্ট হওয়া গেল না। বাবা-মাকে দেখেছি, সঙ্গ করেছি, সম্পর্ক গড়েছি। কিন্তু ঈশ্বর কে? নেমলেস, হেডলেস, হোমলেস, হার্টলেস সামওয়ান। একটা কল্পনা, অনুমান, উন্মাদনা মাত্র। মানুষের কল্পনা নানা রূপ গড়েছে, শাস্ত্র, বিধি, বিধান, আচার-অনুষ্ঠান তৈরি করেছে। সংস্কার এসেছে, সঙ্কোচ এসেছে। লক্ষ মানুষ মেনেছে এই মেনে, না মানলেও ক্ষতি নেই। কোম্পানির মালিককে না মানলে, ভজনা না করলে, তিনি তেলে মেরে তেলানি বন্ধ করে দেবেন। ভগবানের সেই ‘পাওয়ার’ নেই। তিনি জগৎ ঘোরাতে পারেন, মানুষকে ঘোরাতে পারেন না। যাঁরা বলেন, তাঁর ইচ্ছে না হলে গাছের একটি পাতা নাড়াবার ক্ষমতা তোমার নেই, তাঁদের পালটা বলা যেতে পারে- ইচ্ছে হলেও ভগবান কিন্তু পৃথিবীর ঘোরাটা বন্ধ করতে পারবেন না। যা একবার ঘুরে গেছে তা ঘুরতেই থাকবে। তাঁর জগত্রচনা গণিত আর প্রাকৃতিক নিয়মাবলীর দখলে চলে গিয়ে বহুশাখাবিশিষ্ট বিজ্ঞানে পরিণত হয়েছে। স্রষ্টা নিরাসক্ত দর্শক মাত্র। সংসারে গ্র্যান্ড পেরেন্টসদের অবস্থার মতো।
ঠাকুরকে প্রশ্ন করলেন, এই একই প্রশ্ন—”ঈশ্বরকে ভাববই বা কেন?” উত্তর দিলেন ঠাকুর—”এ-বোধ যদি থাকে তাহলে তো জীবন্মুক্ত।” তুমি জীবন্মুক্ত। তুমি যাতে আছ, তোমাতে যিনি আছেন, সব যদি একাকার হয়ে যায়, তাহলে কে তুমি, কে তিনি! সব এক। জন্ম আর মৃত্যু একটি প্রহেলিকা মাত্ৰ। এই হলো জ্ঞান। দুটি নির্দেশ—
“সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি।
ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ।।” (গীতা, ৬।২৯ )
“যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি।
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি।” (ঐ, ৬।৩০)
সর্বভূতে ভগবান, নিজের আত্মার সঙ্গে অভেদজ্ঞান। এই জ্ঞানসাধনা করতে পারলেই ‘আমি’র কেল্লা ফতে। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন—
“ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে
ও বন্ধু আমার।
আকাশের যত তারা
চেয়ে রয় নিমেষহারা
বসে রয় রাত-প্রভাতের পথের ধারে।
তোমারি দেখা পেলে সকল ফেলে
ডুববে আলোক-পারাবারে।”
যতক্ষণ পর্যন্ত ঐকান্তিক সাধনায় সেটি না হচ্ছে, যতদিন না সে-বোধ জাগছে, ঠাকুর বলছেন : “এ-বোধ যদি থাকে তাহলে তো জীবন্মুক্ত। কিন্তু সকলের এটি বিশ্বাস নাই, কেবল মুখে বলে। ঈশ্বর আছেন, তাঁর ইচ্ছায় এসমস্ত হচ্ছে—বিষয়ীরা শুনে রাখে, বিশ্বাস করে না।” (সংযোজন : হোমিওপ্যাথি করছে বটে, কিন্তু অ্যালোপ্যাথি ক্যাপসুল খাচ্ছে। মুখে বলছে, সর্বনাশ হয়ে গেল, সাইড এফেক্ট, পেটের ফ্লোরা-ফনা সব গেল রে ভাই!)
“বিষয়ীর ঈশ্বর কেমন জান? খুড়ি-জেঠির কোঁদল শুনে ছেলেরা যেমন ঝগড়া করতে করতে বলে, আমার ঈশ্বর আছেন।” বিশ্বাসে নেই। কথার কথায় আছেন। বালকটিকে যদি বলা হয়, ভয় কি বাবা! বনের পথে তোমার মধুসূদন-দাদা আছেন। বালক অবিশ্বাস করেনি। পোড়খাওয়া বয়স্ক মানুষ তার পাটোয়ারি বুদ্ধি সম্বল করে বলবে, সে আবার কে? গালগল্পে বিশ্বাস করে ইহকাল পরকাল খুইয়ো না। টাকা ছাড়া পৃথিবীতে মানুষের আর কেউ নেই। ছুরি-কাঁচিতে বিশ্বাস রাখ। এক টুকরো জমি, ভাল মাইনের একটা চাকরি— ভজনা করতে হলে ভজ মালিক, তেল দাও, স্তোত্রপাঠ কর, আখের গুছাও। আর তিনি যাতে সন্তুষ্ট থাকেন তার জন্য সত্যনারায়ণ, মন্দিরে মায়ের চরণে লকলকে জবা, দেদো সন্দেশ। ঠাকুর বলেছেন, কে চায়? তাঁকে ঠিক ঠিক কে চায়? তাঁর ঐশ্বর্যই চায়। সবাই ভিখারি। আমি কিছুই চাই না, শুধু তোমাকেই চাই। তুমি আমাকে কি দেবে, সে তুমিই জান। দুঃখ, আনন্দ, শান্তি, অশান্তি— তুমি জান।
রজনীকান্ত লিখলেন এই একই দর্শন—
“ওরা চাহিতে জানে না দয়াময়
ওরা চাহে ধনজন আয়ু আরোগ্য বিজয়
করুণার সিন্ধুকূলে বসিয়া মনের ভুলে
এক বিন্দু বারি তুলে মুখে নাহি লয়
তীরে করি ছোটাছুটি ধূলি বাঁধে মুঠি মুঠি
পিয়াসে আকুল হিয়া আরো ক্লিষ্ট হয়
ওরা চাহিতে জানে না দয়াময়।।”
ঠাকুর বলছেন : “সব্বাই কি তাঁকে ধরতে পারে? তিনি ভাল লোক করেছেন, মন্দ লোক করেছেন, ভক্ত করেছেন, অভক্ত করেছেন, বিশ্বাসী করেছেন, অবিশ্বাসী করেছেন। তাঁর লীলার ভিতর সব বিচিত্রতা, তাঁর শক্তি কোনখানে বেশি প্রকাশ, কোনখানে কম প্রকাশ! সূর্যের আলো মৃত্তিকার চেয়ে জলে বেশি প্রকাশ, আবার জল অপেক্ষা দর্পণে বেশি প্রকাশ।”
আবার ভক্তদের ক্ল্যাসিফিকেশন করছেন ঠাকুর, বলছেন : “আবার ভক্তদের মধ্যে থাক থাক আছে–উত্তম ভক্ত, মধ্যম ভক্ত, অধম ভক্ত।” বলছেন : “ভক্তিই সার। ঈশ্বর তো সর্বভূতে আছেন, তবে ভক্ত কাকে বলি? যাঁর মন সর্বদা ঈশ্বরেতে আছে। অহঙ্কার, অভিমান থাকলে তা সম্ভব হয় না। ‘আমি’রূপ ঢিপিতে ঈশ্বরের ‘কৃপা’রূপ জল জমে না, গড়িয়ে যায়।” আমি আর অভিমান ভিতরে বসে লেজ নাড়ছে। তারই যাবতীয় সংশয়াত্মক প্রশ্ন— ভগবানকে কেন ডাকব?
“আমি মুক্তি দিতে কাতর নই,
শুদ্ধাভক্তি দিতে কাতর হই।
আমার ভক্তি যেবা পায়, তারে কেবা পায়,
সে যে সেবা পায়, হয়ে ত্রিলোকজয়ী।।”
গান শেষ করে ঠাকুর সকলের পানে তাকিয়ে বললেন : “পাণ্ডিত্য দ্বারা তাঁকে পাওয়া যায় না। আর তাঁর বিষয় কে বিচার করে বুঝবে—তাঁর পাদপদ্মে ভক্তি যাতে হয়, তাই সকলের করা উচিত।”