আমি আমার মতো নই – আবুল বাশার
পাঁজাকোলা করে আমি আর ভীম নব্বুই বছরের মামাকে একতলা থেকে দোতলায় ওঠাচ্ছি। বড় মামা বয়সের ভারে এখন একটা পুঁটলির মতো হয়েছে। ডাকসাইটে এক জন উকিলের এমন রগছাড়া অবস্থা কল্পনা করা যায় না। রোজ এই রকম সিঁড়ি ভেঙে তোলা এবং সন্ধ্যার পর নামিয়ে আনা কত বড় ফ্যাসাদ, কাকেই বা বলব। মউলিকে বলতেও চাইনি। ও আজ আমার পিছু পিছু এই পর্যন্ত চলে এসেছে। মামা সম্বন্ধে ভাল ভাল কথা ওকে কত দিন কত বার যে বলেছি, ইয়ত্তা নেই। এমনকী বলেছি, আমি মামার মতো। আর বলেছি, মউলি তুমি, মামির মতো লম্বা ফর্সা। মামা বিদ্বান, ক্ষুরধার বুদ্ধি, চমৎকার মানুষ। তলায় এরা দু’জন পাশাপাশি ঘরেও থাকতে চাইছেন না। মউলি অবাক হয়ে জানতে চাইল, কেন থাকবেন না একসঙ্গে? বললাম, একসঙ্গে কী, পাশাপাশি ঘরেও থাকতে চাইছেন না।
ভীম কুচকুচে কালো, তেলুক গা-হাত-পা এবং হোঁতকা গোছের লোক। একই সঙ্গে মালি এবং বাড়ির কাজ করে। রান্নার এক জন ঠিকে কাজের মেয়ে আছে, দু’বেলা রেঁধে দিয়ে যায়। ভীম কথা বলতে পারে না ভাল। কী বলে, বোঝা যায় না। মামিই কেবল ওর কথা বুঝতে পারে। কিন্তু মাঝে মাঝেই এসে দেখি, মামা দোতলায়, নীচে মামি। ইদানীং আমাকেও ভীমের সঙ্গে হাত লাগাতে হয়। যখনই আসছি। প্রশস্ত সিঁড়ি, তোলাপাড়ায় তেমন অসুবিধে নেই। আমরা তুলছি, তীব্র বিস্ময়ে মউলি প্রশ্ন করতে করতে আমাদের সঙ্গে সিঁড়ি ভেঙে উপরে চলে আসছে। ও বেশ ধন্দে পড়েছে। আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছি। পড়েছি এক ঝামেলায়। বলতে কী, বিপদেই পড়া গেছে। এঁরা যে এমন করবেন, কে জানত!
অবস্থাকে প্রধানত ঘনিয়ে তুলেছেন মামা। এই সেই মামা, ভাবতেই পারছি না। এই মামাই বলতেন, যত দিন বিস্ময়বোধ, তত দিনই বাঁচা, সেই বিস্ময়-ক্ষমতা তুই জেনেটিক্যালি আমার গ্রে-ম্যাটার থেকে পেয়েছিস। আমার রক্তে সেটা ছিল, তোর মধ্যে চালান হয়েছে— নইলে তোর বাপ তো বোবা। ভাল মানুষ। কিন্তু অবাক হয় না। মউলি ফের জানতে চাইলে, এঁরা একসঙ্গে থাকবেন না কেন? কী হয়েছে এঁদের? বললাম, হয়েছে।
—হয়েছে, সেটা তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু হয়েছেটা কী?
—এঁরা ডিভোর্স চাইছেন এখন। আমাকে ব্যবস্থার জন্য দু’জনই ধরেছেন। তাই রোজই আসতে হচ্ছে। সব শুনছি, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না। তোমাকে যে বলব, কী বলব বল তো?
—অ। মউলির বিস্ময় আরও বাড়ল। মামাকে দোতলার খাটে শুইয়ে দেওয়া হল। মউলির বিস্ময়বোধক প্রশ্ন উনিও চোখ বুজে শুনছেন। চোখের ডিম বোজা-পাতার মধ্যে ঘনঘন নড়ছে। জানলা অল্প খুলে দিলাম। এক পয়েন্টে রাখা হল পাখা।
মউলি বলল, এই-ই তা হলে তোমার মামা! এত বয়সে ডিভোর্স!
—হ্যাঁ, নব্বুই। মামি যেন কত, বেশ ছোট।
—জানি।
—তোমাকে তো সবই বলেছি। লজ্জায় কোথায় যে সেঁধিয়ে যেতে হচ্ছে। একটা গন্ধ পাচ্ছেন মামা।
—কী বললে?
—‘খুব খারাপ একটা গন্ধ পাচ্ছি স্বর্ণাভ। মনে হচ্ছে, তোর মামির গা থেকে আসছে। চোখে দেখি না তো!’ ইত্যাদি। মউলিকে বলে বোঝানোর চেষ্টা করি অগত্যা। মউলি মূঢ়-বিস্ময়ে বলে, ইত্যাদি মানে! বললাম, আমি এলেই এই সব বলছেন। তখন দোতলায় ওঠানো। সন্ধ্যায় ঠাণ্ডা পড়লে নামিয়ে দেওয়া। গন্ধটা কখন পাবেন ঠিক নেই। তবে বেলা বাড়লে পাচ্ছেন।
—ডাক্তার দেখিয়েছ?
—সবই দেখানো হয়েছে। করা হয়েছে।
—উনি দেখতে পান না?
—না।
—গন্ধ পান?
—হ্যাঁ।
—তোমার মামির গায়ের গন্ধটা কি সত্যি?
—মোটেও না।
—অ।
ভীম নস্কর মামাকে তুলে দিয়ে বাগানে চলে গেছে খুরপি হাতে। আমরা দোতলার ছাদে উঠে এসেছি। ছাদের কোনায় অতি দীর্ঘ লগিতে টঙের চালি বাঁধা। চালিতে এক দল সাদা আর মেঘ পায়রা। মামার শখের জিনিস। বিকেলের সিঁদুরে আলোয়। আকাশে ছন্দিত করে জাকির হোসেনের তবলার আঙুল, তারপর মেঘের স্বর্ণচূড় রথে ও মিনারে ডুবে যায়। মামা হাঁ করে চেয়ে থাকতেন। লজ্জা করছে সে কথা ভাবতে, চোখে জল আসছে। বললাম, ওঁর কতই তো চেনাজানা এবং আন্ডারে কাজ করা উকিল। ওঁরা আসছেন।
—ওঁরা কী বলছেন?
—কী বলবেন! কত রকম করে বোঝাচ্ছেন। এই বয়েস, আপনার ছেলেমেয়েরা বাইরে সবাই প্রতিষ্ঠিত। তাদের বাপ-মা আপনারা, নাতিপুতি হয়েছে। মান-সম্মান ধরছি না, যদিও ধরা উচিত। ওদের কষ্টের কথাটা অন্তত ভাবুন। মামা কান পেতে সবই শুনছেন। তার পর শুনেটুনে একজন বাচ্চা উকিলের হাত ঠাউরে চেপে ধরে সেদিন বললেন, ‘তালাকটা আমার কিন্তু চাই সুধাকর’। বলে আমি চোখে হালকা জল নিয়ে চালির আকাশে একটি সাদা-পায়রাকে বিন্দুবৎ মেঘে ঢুকে পড়তে দেখি— সব কেমন ফুটকি-ফুটকি হয়ে যাচ্ছে পায়রাগুলো। মউলি কাছে সরে এসে বলল, তুমি কত কথাই যে বলেছ, মামা অমুক, মামা তমুক। আমি বিশ্বাস করেছি স্বর্ণাভ! মউলির একটা হাত নিঃশব্দ কাতর ভঙ্গিতে চেপে ধরি। বলি, সব তোমাকে বানিয়ে বলেছি। আসলে বুঝতে পারিনি। এত বিজ্ঞাপন ভাল হয়নি। ভেবেছিলাম, এই ভাবে বললে, এই যে মামার বিস্ময়বোধ, দেখো, এই চালি, এত পায়রা, না, আজ আর বলতে পারি না। আমি তো লোভে পড়ে করেছি।
—লোভ!
—তোমাকে পাওয়ার লোভ। তুমি বেশি লম্বা, মামির মতো ফর্সা। পাশে দাঁড়ালে নিজেকে ছোট মনে হত। মামার পার্সোনালিটি, বিদ্যা, যুক্তি, প্রখর বুদ্ধি, সার্থকতা— সব বলে বলে একটা কী হল, তুমি হাইহিল ছাড়লে। বললে, আগে জানলে আধবিঘত বেঁটেই হতাম স্বর্ণাভ।
—হাইহিল পছন্দ করবে না জেনেই, তা ছাড়া তুমি তো মামারই মতো।
—না।
—নও?
—আমার বাবা খুব বোবা প্রকৃতির মানুষ। দুঃখ হচ্ছে মউলি, আমি তাঁর কথা বলিনি তোমাকে। সেই বাবা সব শুনে কেমন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।
—সবই তো বুঝলাম। ভাবছি, আমার বাবা-মা শুনলে কী মনে করবেন। ওঁরা তো এই বয়েসে এই রকম ভাবতেও পারেন না। মামার খুব বুঝি ইগো!
—মামিরও।
—তা কী করে হয়! কই, মামি কি খারাপ গন্ধ পাচ্ছেন।
—উনিও ডিভোর্সে রাজি। বলছেন, ‘তালাক আমারও চাই। তুই স্বর্ণাভ ব্যবস্থা দ্যাখ।’
—তাঁরও তো মান-সম্মান আছে স্বর্ণাভ।
—এ ভাবে দেখছ কেন মউলি!
—কেন!
—না, মানে, মানুষের সব কিছু কি আমরা জানি!
মউলি এ বার চোখ ঘোর আর ঘন করে আমার চোখে চেয়ে থেকে আলতো করে বলল, আমারও সেই কথা। আজকাল বিয়ের আগে ডাক্তার পাত্র-পাত্রীর রক্ত পরীক্ষা করতে বলছেন, জানো তো! বলে অদ্ভুত ভাবে হেসে উঠল। তখন অদৃশ্য আকাশ-গ্রন্থি পটপট করে ছিঁড়তে ছিঁড়তে চালিতে বসে থাকা অবশিষ্ট পায়রাগুলো মেঘের গহ্বরে চলে যেতে লাগল সিঁদুর ছিন্নভিন্ন করে।
আমরা নীচে নামলাম। মউলি মামির ঘরে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে ভিতরে ঝুঁকে মামিকে দেখতে দেখতে অল্প করে নিঃশব্দে একটা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলল ঠোঁটে। মামি সেই হাসির জবাবে যেন কত চেনা এমন স্বাভাবিক অন্তরঙ্গতায় নিঃশব্দেই হাসল। ওই রকম হৃষ্ট হাসি মামির আজকাল দেখা যায় না।
বিদায় নেবার আগে মউলি বলল, যেমন করে হোক, ডিভোর্স ঠেকাও স্বর্ণাভ। নইলে আমাদের হবে না। চলি। বাই। ভাল কিছু হলে জানাবে আমাকে। বলেই ছুটে গিয়ে রাস্তায় বাস ধরল।
আজ বাড়ি ফিরে বোবা বাবার কাছে এলাম, যা কখনও আসি না। এতটা নুইয়ে বাবার কাছে এসে বসা, তা-ও কখনও হয় না। বললাম, তুমি আছ কেমন বাবা, সবই তো শুনেছ।
মা এসে বলে গেল, ওকে শুনিয়ে আর কী হবে! ও কি কাউকে বোঝাতে-সমঝাতে পারে! যা করবার তুমিই করো। দরকার হলে দাদার ছেলেপুলেদের ডাকো।
—মা! মউলি বলেছে, আমাদের আর হবে না।
—সে কী! কী হবে না?
—মামা-মামির ছাড়াছাড়ি হলে, সেই বদনাম মাথায় করে ও আর এই বাড়ির বউ হতে পারবে না। আমাকে ‘তালাক’ ঠেকাতে বলেছে।
—তাই নাকি! তা, তুমি কী করে পারবে। এই সব কি কারও হাতের জিনিস!
—আচ্ছা মা, আমি কি বাবার মতোও কিছুটা নই! সবটাই মামার মতো! মউলিকে এনে দেখাব, আমার বাবা কতটা বোবা! কত সরল। বাবা কি সত্যিই অবাক হয় না! হও না তুমি বাবা! বল, কেন হও না, কী হয় তোমার। ভয় পাও, কীসের ভয়, কাকে ভয়! আমাকেও কি ভয় কর? আমি তো ছেলে, তোমার ছেলে! কিন্তু তুমিও মনে কর, আমি মামার মতো হয়েছি। মামা এই রকম করছে কেন বাবা! তোমার কি মনে হয় মামা-মামি দু’জন দু’জনকে কখনও ভালবাসেনি! তা হলে এত দিন একসঙ্গে রইল কী করে! রইলই যদি, তা হলে এখন থাকতে পারবে না বলছে কেন! তালাক হয়ে গেলে আমি মউলিকে হারাব। আমরই দোষ, তোমাকে কখনও গুরুত্ব দিইনি, তুমি যে আছ, তাই-ই ভাবিনি। কীসের লোভে ‘মামা-মামি’ করেছি, তুমি যে তুমি, আমারই অস্তিত্ব, তোমারই অংশ আমি বাবা!
বলতে বলতে শেষের দিকে গলা বসে জড়িয়ে এমনই ফ্যাসফ্যাসে হয়ে গেল যে, বাবা আমার কথার শেষ অর্ধেক বুঝতেই পারল না। পারল না, কিন্তু ওঁর চোখ হঠাৎ ছলছল করে উঠল। মউলির কথায় আঘাতটা বড্ডই পেয়েছি। শুনতে শুনতে বাবার চোখমুখ কেমন হয়ে গেল। ঠোঁট দু’টো থরথর করে কাঁপছে। কপালে ঘামের ফোঁটা।
কাঁপা গলায় বাবা বলল, এক মাস অফিসে ছুটি নাও স্বর্ণাভ। মামা-মামির কাছে থাকো। ব্যস। এইটুক বলেই বাবা চুপ করে গেল। অদ্ভুত পরামর্শ। তাই শুনে মা মুখ ঈষৎ বাঁকা করে বলল, মানুষটা বরাবরের এই, দুনিয়াকে সহজ মনে করে। এক মাস অফিস কামাই দিয়ে কাছে থাকলেই ওরা যেন বশ হবে! দ্যাখ, যা করবার কর, তবে জিনিসটা যেন কাঁচা না হয়।
—কাঁচা!
—তোর বাবার আর পাকা বুদ্ধি কবে! কথা না বলতে পারো বোলো না, বললে যদি, তা এই, পাশে থাকো! হুঁহ্!
মায়ের ওই তাচ্ছিল্য করা ‘হুঁহ্’ সত্ত্বেও এক মাস ছুটি নিলাম অফিসে। কেন যেন বাবার ওই কাঁচা সরল নির্দেশই মনে ধরে গেল। মনে হল, হবে। তা ছাড়া অন্য কিছু মাথাতেও এল না। না আসার আরও কারণ, মউলি আর যোগাযোগই করছে না। ফোন করলে, যত বারই করছি, হয় ওর মা, নয় বাবা, কিংবা ছোট ভাই ধরছে। ও এড়িয়েই যাচ্ছে তা হলে। ভাবছি, হাইহিলটা তা হলে কী! প্রেমের ব্যাপারে রক্তবংশই সব হল, হৃদয় কিছু নয়! দোষ তো আমারই। আমিই তো রক্তবংশজিন, গ্রে-ম্যাটার বলেছি। আমার ব্যুৎপত্তির জন্য মামা এক উৎকট গর্ব। ব্যাপারটা ধাক্কা খেয়ে গেল। মউলি ভাবছে, মামার মতো আমিও হব ভবিষ্যতে। আমারও থাকবে কোনও কড়া গুমোর এবং অ-ভালবাসা। হব আত্মপরায়ণ একটা চাপা ঔদ্ধত্য, খারাপ গন্ধ পাব মউলির গা থেকে, যৌবন ফুরালে বউয়ের ঘ্রাণ অসহ্য হবে। এটা কি কোনও অসুখ!
—মামাবাবু, আমি তোমার জন্য এক মাস অফিসে যাইনি। তুমি কত হালকা হয়ে গেছ, বাচ্চা হয়ে গেছ, অবুঝ হয়ে গেছ মামা। সেই জন্য বাবা বলল, ছুটি নিয়ে তোমার কাছে থাকতে।
—দ্যাখো, আমার সম্পত্তি তুমি পাবে, তার জন্য অফিস কামাই করার দরকার নেই। আমি তোমার মামিকে ভরণ-পোষণ দেব, কিন্তু এক বিঘত জমি কি এক মুঠো সম্পত্তি, স্থাবর-অস্থাবর, কিছুই ‘উইল’ হবে না। পারলে লড়ে নেবে। প্রাণে ধরে ওকে কিছুই দেওয়া যায় না স্বর্ণাভ। কিন্তু তালাক হতেই হবে। তাই ভাগের ভাগ দিয়ে দিতেই চাই। সুধাকরকে বলেছি, যাক, সম্পত্তি যাক, আমি চাইছি রেহাই। আমি হাত পর্যন্তও ধরেছি সুধাকরের।
—কেন মামা, কেন! এমন কেন করছ! আমি মামিকে সুন্দর সাবান, গন্ধতেল, চমৎকার পারফিউম, দামি ট্যালকম পাউডার, একটা আড়াই হাজার টাকার বেগমবু আতরের ছোট শিশি— সব এনে দিয়েছি। মামি মাখছে।
—শোনো স্বর্ণাভ। এ সব বাজে খচ্চা হচ্ছে। ওই রকম লোল, ও আর সুগন্ধবতী হবে না। দিন যত যাবে, ততই বাজে গন্ধ ছাড়বে। কারণ ওকে আমি আর বিশ্বাস করি না।
—কেন!
—ওকে তাড়াও, ওকে তাড়াও স্বর্ণাভ।
—আমার দিকটা দেখবে না তুমি মামাবাবু।
—সম্পত্তি পাবে, বললাম তো।
—সম্পত্তির কথা নয় মামাবাবু। ও অন্য কথা। কতক মানুষ তো এখনও সম্পত্তি ছাড়ে, প্রেম ছাড়ে না। বোকাই হয়তো তারা, কিন্তু বোকারাও তো সংসারে থাকে। তোমাদের দেখে মউলি কী যেন হয়ে গেল! ওর চোখ সরু আর মুখটা কেমন পানসে-পান্ডুর হয়ে গেল মামা, যখন শুনল… মামা, তুমিই তো আমার হিরো, শেষে জীবনটাকে এমন ছন্নছাড়া, এতটা ভেঙে ফেলতে চাইছ কেন! আর ক’টা দিন তো বাকি…
—অনেক দিন বাকি স্বর্ণাভ। এক-একটা দিন এক-এক বছর। সুখ নেই কিনা! অবিশ্বাস মানুষের বিস্ময়বোধ নষ্ট করে দেয়। তুমি কি ভাবো, এক জন বুড়ো বিষ খেতে পারে না! ভুল ধারণা স্বর্ণাভ। ‘তালাক’ জিনিসটা যৌবন-বার্ধক্য-গরিব-বড়লোক-বেকার সাকার-সিজন নির্ভর নয়। এটা কখন হবে, কেউ জানে না। এর কোনও রাতদিন নেই। বাইরে তাকাও, ভাল লাগবে। আমাকে ঘেঁটো না।
—মামাবাবু!
—নাটক কোরো না স্বর্ণাভ। ভীমকে ডেকে দাও। মউলি না কী যেন নাম বললে, শোনো, বঙ্কিমবাবু লিখেছেন, যৌবনে কুক্কুরীও সুন্দর, যখন লোল হবে, বুঝবে কথাটা। গন্ধ এখন পাবে না, পরে পাবে। যাও, হটাও মামিকে, আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
মামিকে বললাম, মামি তুমি পার না! সে দিন মউলিকে দেখে হাসলে তুমি!
মামি বলল, আমাকে রোদে দাও, রোদে।
আমার ভেতরটা কেমন শিরশির করে গেল। বললাম, এমন কোনও স্মৃতি নেই মামি, যা দিয়ে মামাবাবু জাগবে, অবাক হবে! নেই? তোমাদের কত কত বছরের সম্পর্ক। যেন তিন-চার জন্ম একসঙ্গে। আমাদের তো তিন-চার বছর জানাশোনা, তাই-ই কত স্মৃতি মামিমা। ও তো সালোয়ার-কামিজ-উড়নির ওপর বড় ফাইল চেপে হাঁটে, পাতলা চটি পরে যখন পাশে পাশে হাঁটে, ঝাড়ালো তোমার মতো, তাই আমার জন্যে খাটো হতে পিঠ সামান্য কুঁজো করে নেয়। করতে করতে এখন আর অন্য রকম সিধে হতেই ভুলে গেছে।
মামি ফের বলল, রোদে দাও আমাকে। রোদ, স্বর্ণাভ, রোদ!
এই এক মাস গলা দু’হাতে চেপে মামাবাড়ির আলো-অন্ধকারে একা-একা শুকিয়ে গেলাম। ভীমও আমার রোগা হয়ে যাওয়া চোপসানো মুখ দেখল। ব্যস। এ দিকে মউলিও কেমন চুপ করে গেছে। ধীরে ধীরে মনে হল, কেনই বা আর এখানে পড়ে থাকা! বাইরে গন্ধ ঢেলেও মামিকে তাজা করা গেল না। জীবনটা বাবার পরামর্শে হয়ে দাঁড়াল একটি কাঁচা গল্প।
ওঁদের ডিভোর্সের সইসাবুদের দিন এগিয়ে এল। আমি ভয়ে পালিয়ে এলাম। সন্ধ্যার পর ঘটনা আনুষ্ঠানিক হবে। হঠাৎ মনে হল, পালাচ্ছি কেন, মউলিকে বলতে পারব, কেমন করে ওঁরা ওঁদের ছিঁড়লেন বিচ্ছেদপত্রে। তাই পা বাড়াই, জীবন-সন্দিগ্ধ থ্যাঁতলানো পশুর মতো।
গেটের মুখেই জিনস-টি-শার্ট-হাইহিল—চড়া সজ্জিত মউলি। হা ঈশ্বর! বুকটা আশ্চর্য খাঁ খাঁ করে উঠল। নিজেকে সামলে নিতে গিয়ে দেখি, বোকা-বোবা ভীম মুখে একটা বোঁ-বোঁ দুর্বোধ্য আওয়াজ করে কোন দিকে দিক্ভ্রান্ত হয়ে ছুটে গেল। কী একটা সর্বনাশ ঘটে গেল বাড়ির ভিতরে। ছুটলাম আমি। পিছনে মউলি।
চওড়া বারান্দার মাঝখানে এসে পড়ি, তার পর সব মাতৃরক্ত ঠাণ্ডা বরফ হয়ে যায়, ঠিক সেই বরফ, যা দিয়ে মাছের পচন ঠেকায় মানুষ, যাতে মীনের অক্ষিতে মৃত্যুর কুয়াশা জমে থাকে। আঁতকে উঠে ঝুঁকে পড়লাম, হাঁটু ভেঙে বসলাম, ওঁরা এত কাছে এসেছিলেন! যেন দুই ক্রীড়ারত স্তব্ধ মীন। দু’জনের ওষ্ঠাধর ফুরিত, চুম্বন-উদ্যত, প্রসন্ন, মৃত। চোখে কী আকুতি! মুখ দিয়ে কেবল বেরিয়ে এল, এই ভাবে মরলে মামাবাবু! মনে হল, মামি এখনও রোদ চাইছে ভাগ্নের কাছে।
বললাম, আমি তালাক ঠেকিয়ে দিয়েছি মউলি। বললাম, আমি মামার মতো নই, বাবার মতো, বিশ্বাস করো।
মউলি হাইহিলে দাঁড়িয়ে টলমল ক’রে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করতে গিয়ে পারল না। ফুঁপিয়ে উঠল, বলল, প্লিজ। আমাকে ধরো স্বর্ণাভ!
একটি বিস্ময়কর অন্ধ-চুম্বনের দিকে রাত্রি গড়াচ্ছে। জোড়া লাশ তুলতে হবে।
১৬.০৫.২০০৪
লেখক পরিচিতি
আবুল বাশার: ১৯৫১ সালে মুর্শিদাবাদ জেলার নতুন হাসানপুর গ্রামে জন্ম। সাড়া জাগানো গল্প ‘চ্যুতি’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৫-র ডিসেম্বরের দেশ পত্রিকায়। আর ১৯৮৫-র শারদীয় দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত বিতর্কিত ‘ফুলবউ’ উপন্যাস তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে। ভোরের প্রসূতি, সঈদাবাই, সিমার, মাটি ছেড়ে যায় প্রভৃতি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। ১৯৮৮-তে পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার।