আমি অর্জুন – সমরেশ মজুমদার

আমি অর্জুন – সমরেশ মজুমদার

কদমতলার মোড়ে পানুর চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে আড্ডা মারছিল অর্জুন। অনেকদিন বাদে স্কুলের বন্ধুরা একসঙ্গে হওয়ায় আড্ডাটা জমেছিল। কলেজ পার হয়ে ওদের অনেকেই এখন ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরে ভাল চাকরি করছে। জলপাইগুড়িতে আসাই হয়ে ওঠে না, যখন আসে তখন সবাই একসঙ্গে হয় না। এবার হয়েছে। শঙ্কর বলল, “তুই বেশ আছিস অর্জুন!”

“কীরকম?” অর্জুন চায়ে চুমুক দিল।

“গোলামি করতে হয়না। সবসময় অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে থাকিস। আর সেইসঙ্গে বিদেশে ঘুরে আসছিস। কপাল করেছিলি বটে!”

সুবোধ বলল, “তবু কিন্তু ওর নিশ্চয়তা নেই। মানে, কাল কোনও কেস আসবেই এমন তো কথা নেই। না এলে ঝুঁকি বাড়বে। আমাদের মতো মাস গেলে মাইনের নিশ্চয়তা ওর নেই।”

শঙ্কর প্রতিবাদ করল, “একজন উকিল বা ডাক্তারও একই কথা বলতে পারেন। আর অর্জুনের প্রফেশন ততদিন থাকবে যতদিন পৃথিবীতে মানুষ বাস করবে। খুনখারাপি এবং প্রতারণা তো বন্ধ হবে না কখনও।”

অর্জুন কিছু বলছিল না। সে মিটিমিটি হাসছিল আর চা খাচ্ছিল। সত্যসন্ধানী হওয়ার পর আত্মীয়স্বজনের ধারণা হয়েছে অর্জুনের ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। এ-দেশে শার্লক হোম্‌স হওয়ার চেষ্টা করা বোকামি। কিন্তু অর্জুন সেই বোকামিই করতে চায়।

অজিত বলল, “এতদিন পরে আমরা একসঙ্গে হলাম, চল ডুয়ার্সের কোনও বাংলোয় গিয়ে আমরা একরাত কাটিয়ে আসি।”

ব্যাপারটা সবার মনে ধরল। কোন বাংলোয় যাওয়া হবে এই আলোচনা চলল। সবাই কথা বলছে তাদের স্কুলজীবনের শোনা অভিজ্ঞতা থেকে। শেষপর্যন্ত অর্জুন বলল, “যেতে হলে চাপড়ামারি চল।”

অজিত জিজ্ঞেস করল, “চাপড়ামারি?”

অর্জুন বলল, “জলপাইগুড়ি থেকে তিস্তা নদী পেরিয়ে বার্নিশ, ময়নাগুড়ি, লাটাগুড়ি হয়ে হাইওয়ে ধরে ডান দিকে ঘুরে খুনিয়ার মোড়। সেখান থেকে বিন্দুর দিকে কিছুটা এগিয়ে গেলে ডান দিকে চাপড়ামারি ফরেস্ট। জঙ্গলটা বেশ ঘন, প্রচুর বন্যপ্রাণী ঘুরে বেড়ায়।”

শঙ্কর জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে যাব আমরা?”

অজিত বলল, “একটা অ্যাম্বাসাডারেই সবাই যেতে পারব। কাকার গাড়িতে হয়ে যাবে। জঙ্গলে গিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে শুধু আড্ডা মারব। আঃ!”

গাড়িটা অজিতই চালাচ্ছিল। ওর কাকার বুড়ো ড্রাইভারকে সঙ্গে আনেনি, এতে একটু জায়গা যেমন বাড়ল তেমনই বন্ধুদের মধ্যে খোলামনে কথাও বলা যাবে। অর্জুন ডি এফ ও অফিসে ফোন করে বাংলোয় জায়গা করে রেখেছিল। ওরা রওনা হয়েছিল দুপুরে, খেয়েদেয়ে। লাটাগুড়ি বাজারে পৌঁছে গাড়ি থামাল অজিত। ভালমন্দ খেতে হলে এখান থেকে বাজার করে নিয়ে যেতে হবে। সুবোধ আর শঙ্কর বেরিয়ে পড়ল।

অজিত বলল, “জায়গাগুলো খুব পালটে গেছে, তাই না?”

অর্জুন বলল, “পালটালেও মূল চরিত্র একই আছে।”

অজিত বলল, “ডুয়ার্সের সৌন্দর্য অসাধারণ। ঠিকমতো প্রচার হলে টুরিস্টরা দলে দলে আসবে। কেন যে প্রচার হয় না?”

ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল তার সামনেই একটা চায়ের দোকান। দোকানের বাইরে বেঞ্চিতে তখন একজনই খদ্দের বসে চা খাচ্ছিলেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে অর্জুনের মনে হল, ইনি স্থানীয় মানুষ নন। সঙ্গে একটা ঝোলা আর ক্যামেরা নিয়ে স্থানীয় মানুষ এখানে বসে চা খাবেন না।

মাঝবয়সি ভদ্রলোক চায়ের দাম মিটিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন। অর্জুন বুঝল উনি বাসের জন্যে অপেক্ষা করছেন।

এই সময় সুবোধরা ফিরে এল। এক রাতের জন্যে ওরা যা বাজার করেছে তার অর্ধেকও শেষ হবে না। মুরগিই নিয়েছে তিন-তিনটে। ওগুলো গাড়ির ডিকিতে তুলতেই ওই ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন, “এক্সকিউজ মি।”

শঙ্কর সাহেবি কেতায় মাথা নাড়ল, “ইয়েস।”

ভদ্রলোক ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা কি ন্যাশনাল হাইওয়ের দিকে যাচ্ছেন? আসলে আমি এখানে আউটসাইডার। বাস কখন আসবে বুঝতে পারছি না। যদি আপনাদের অসুবিধে না হয় তা হলে একটা লিফট চাই।”

অজিত জিজ্ঞেস করল, “আপনার পরিচয়?”

ভদ্রলোক কার্ড বের করে অজিতকে দিলেন। অজিত সেটা দেখে অর্জুনকে দিল। অর্জুন পড়ল, আর এন প্রসন্ন, ফ্রিলান্স জার্নালিস্ট, হিন্দু অ্যান্ড ন্যাশনাল জিওগ্রাফি। বাঙ্গালোরের ঠিকানা।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, “আপনি এখানে?”

“ছবি তুলতে। ডুয়ার্সের জঙ্গলের ওপর স্টিল ছবি তুলে যদি মনে হয় ইন্টারেস্টিং তা হলে পরে ভিডিও নিয়ে আসব ডিসকভারি চ্যানেলের জন্যে। আমি জলদাপাড়া থেকে আসছি। যে ট্যাক্সিটা নিয়েছিলাম সেটার ইঞ্জিন গোলমাল করাতে ড্রাইভার আমাকে এখানে নামিয়ে দিয়ে গেল।”

“আপনি এখন কোথায় যাবেন?”

“ম্যাপ বলছে ন্যাশনাল হাইওয়ের ওপাশে গভীর জঙ্গল আছে। ওখানে যদি থাকার জায়গা পাওয়া যায় তা হলে—।”

“পাশেই তো গোরুমারা ফরেস্ট বয়েছে। সেখানে যাচ্ছেন না কেন?”

“জলদাপাড়ায় যাওয়ার পথে গিয়েছিলাম। বড্ড ফাঁকা, ইন্টারেস্টিং ফিচার কিছু পাইনি। বড্ড বেশি মানুষের যাতায়াত ওখানে।”

অর্জুন বলল, “ঠিক আছে, আপনি গাড়িতে উঠতে পারেন।”

ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, “অনেক ধন্যবাদ আপনাদের।”

গাড়ি চালাতে চালাতে অজিত জিজ্ঞেস করল, “আপনি যখন বাঙ্গালোরের তখন এরাপল্লি প্রসন্ন নিশ্চয়ই আপনার কেউ হন, তাই না মিস্টার প্রসন্ন?” অজিতের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটেছে, আয়নায় দেখতে পেল অর্জুন।

“নো, নো। উনি কত বড় ক্রিকেটার। আমরা ওঁর জন্যে গর্বিত। কিন্তু আমার সঙ্গে আত্মীয়তা দূরে থাক, আলাপ পর্যন্ত নেই।” মিস্টার প্রসন্ন বললেন।

“কিন্তু আপনি যদি বলতেন উনি আপনার দাদা, তা হলে আমরা তাই মেনে নিতাম, আপনারও খাতির বেড়ে যেত।” অজিত হাসল।

“সরি মিস্টার। আমি যা নই তা সাজার মতো ইচ্ছে যেন কখনও আমার না হয়। মিথ্যে কথা বলা আমি ঘেন্না করি।” বেশ জোরের সঙ্গে কথাগুলো বললেন মিস্টার প্রসন্ন।

ভদ্রলোককে ভাল লেগে গেল অর্জুনের। বাঙ্গালোরের একটি মানুষ এতদূরে চলে এসেছেন জঙ্গলের ছবি তুলবেন বলে, এটাও তো কম কথা নয়।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, “মিস্টার প্রসন্ন, আপনি কি খুব অল্পে উত্তেজিত হন?”

ভদ্রলোক হকচকিয়ে গেলেন, “কেন?”

“আমার বন্ধু আপনার সঙ্গে রসিকতা করছে। আপনি কিছু মনে করবেন না।” অর্জুন কথাগুলো বলতেই মিস্টার প্রসন্ন হাসলেন।

দু’পাশে জঙ্গল, মাঝখানে সরু পিচের রাস্তা ধরে গাড়ি ছুটে যাচ্ছিল। গোরুমারা ফরেস্ট ঢোকার পথটা পেরিয়ে এল ওরা। অজিত বলল, “ছেলেবেলায় তো কেউ আমাদের জঙ্গলে নিয়ে যায়নি। তখন গোরুমারার নাম শুনলেই মনে হত জঙ্গলের গোরুদের বাঘ মেরে খেয়ে নেয় বলেই ওই নামকরণ।”

সুবোধ হাসল, “তা হলে সেগুলো বুনো গোরু।”

সবাই হাসল। শুধু মিস্টার প্রসন্ন চুপচাপ। তিনি বাংলা বোঝেন না।

হাইওয়েতে পড়ে ডান দিকে বাঁক নিয়েই অর্জুন বলল, “মিস্টার প্রসন্ন আমরা চাপড়ামারি ফরেস্টে যাচ্ছি। আপনি কোথায় যাবেন?”

মিস্টার প্রসন্ন একটা নোটবই বের করে দেখে নিয়ে খুব খুশি হয়ে বললেন, “তা হলে তো খুব ভাল হল। ওই ফরেস্টের নাম আমার ডায়েরিতে রয়েছে। ওখানেই যাই হলে।”

শঙ্কর বলল, “কিন্তু থাকবেন কোথায়? আপনার তো বুকিং নেই।”

মিস্টার প্রসন্ন মাথা নাড়লেন, “একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”

অর্জুন বুঝল এইভাবে বাংলো পর্যন্ত মিস্টার প্রসন্নের সঙ্গে জুটে যাওয়া বন্ধুরা পছন্দ করছে না। কিন্তু ভদ্রলোককে তো জোর করে নামিয়ে দেওয়া যায় না। খুনিয়ার মোড় থেকে বিন্দুর রাস্তাটা আরও সুন্দর। সোজা গেলে জলঢাকা হাইড্রোইলেকট্রিক্যাল প্রজেক্টে পৌঁছনো যায়। দু’পাশে শুধু জঙ্গল। বাঁক ঘুরতেই অজিত ব্রেক কষল। তিরিশ গজ দূরত্বে রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক হাতি। তার মুখ খাড়ির দিকে। অজিত চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী করব?”

সুবোধ ফিসফিস করল, “ব্যাক কর। বুনো হাতি। ডেঞ্জারাস।”

অর্জুন বলল, “না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক। এখন নড়াচড়া করলেই ও তেড়ে আসবে। স্টার্ট বন্ধ করে দে।”

অজিত তাই করল। হাতিটা নড়ছে না। মিনিট-তিনেক সময়কে অনন্তকাল বলে মনে হচ্ছিল ওদের। তারপর শুঁড় তুলে হাতিটা আওয়াজ করতেই পাশের জঙ্গল থেকে পিলপিল করে গোটাদশেক হাতি বাচ্চাসমেত বেরিয়ে এল। তারপর লাইন বেঁধে রাস্তা পার হয়ে উলটো দিকের জঙ্গলে ঢুকে গেল। শেষ হাতিটি চলে গেলে শুঁড়টি নেড়ে বড় হাতিটি রাস্তা ছেড়ে অনুসরণ করল সঙ্গীদের।

ইতিমধ্যে ক্রমাগত ক্যামেরার শাটার টেপার আওয়াজ হচ্ছিল। রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেলে শঙ্কর বিরক্ত হয়ে বলল, “আপনি তো অদ্ভুত লোক। ক্যামেরার শব্দ শুনে হাতি যদি এগিয়ে আসত তা হালে আমরা সবাই মারা পড়তাম। এই সময় কেউ ছবি তোলে?”

কথাগুলো ইংরেজিতে বলায় মিস্টার প্রসন্ন বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দিলেন, “শাটারের শব্দ তো খুব হালকা, ও শুনতে পায়নি। তা ছাড়া এত কাছ থেকে ওদের দেখে ছবি না তুললে সারাজীবন আফসোস থেকে যেত। কিন্তু একটি ব্যাপার আমাকে খুব অবাক করেছে।”

অজিত গাড়ি চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করল, “সেটা কী?”

“ওদের লিডারের শরীরের পেছন দিকে কিছু একটা আটকে আছে। জিনিসটা কী বুঝতে পারিনি। কিন্তু কোনও ফরেন এলিমেন্ট হাতি শরীরে কিছুতেই রাখবে না। অথচ এ রেখেছে।”

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, “আপনি সেটার ছবি তুলেছেন?”

“হ্যাঁ। জুম করে ওটাকে ধরেছি। কিন্তু প্রিন্ট না করা পর্যন্ত বোঝা যাবে না।” বিষণ্ণ দেখাল মিস্টার প্রসন্নকে।

অর্জুন অজিতকে বলল, “এই, গাড়ি ঘোরা।”

“কেন?” অজিত অবাক হল।

“নাগরাকাটায় যাব। কাছেই। আধঘণ্টা নষ্ট হবে।”

চাপড়ামারি ফরেস্ট বাংলোটি সত্যি সুন্দর। বাংলোকে ঘিরে প্রায় পনেরো ফুট লম্বা দশ ফুট গভীর খাদ কাটা রয়েছে, যাতে বন্য জন্তু ঢুকতে না পারে। একটা কাঠের সাঁকো দিনের বেলায় খাদের ওপর ফেলে রাখা হয় যাতায়াতের জন্যে। নীচের লনে নুড়ি-পাথর ছড়ানো। খাদের চারপাশে ঘন জঙ্গল, শুধু সামনের দিকটায় ঢালু জমি নেমে গিয়েছে বিরাট এক জলাশয়ে। প্রথম ও শেষ রাতে ওখানে বনের পশুদের জল খাওয়ার আসর বসে।

বাংলোর ওপরে দুটো ঘর, চারটে বিছানা। সামনে বারান্দা। সেখানকার বেঞ্চের চেয়ারে বসে গল্প করছিল ওরা। মিস্টার প্রসন্ন ওপরে ওঠেননি। তিনি গাড়ি থেকে নেমেই তাঁর ক্যামেরা নিয়ে ঢুকে গেছেন জঙ্গলে। এই সময় চৌকিদার চা নিয়ে এল, “উনি কোথায় গেলেন?”

প্রশ্নটা যাঁকে নিয়ে তিনি যে এ-দলের কেউ নন তা লোকটা জানে না। অর্জুন বলল, “বোধহয় ছবি তুলতে গিয়েছেন।”

“তা হলে ওঁকে ডাকুন স্যার। ক’দিন থেকে একটা চিতাবাঘ এদিকে ঘুরছে। হাতির সঙ্গে লড়াই করে জখম হয়েছে বেচারা। মাথা ঠিক নেই।”

সুবোধ বলল, “হাতির সঙ্গে লড়াই করেছে কেন?”

চৌকিদার হাসল, “কখনও কখনও এমন হয় স্যার। ওঁকে ডাকুন।”

অর্জুন বলল, “আমরা কোথায় খুঁজব ওঁকে?”

কিন্তু কিছুই করতে হল না। মিস্টার প্রসন্নকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল পাশের জঙ্গল থেকে। তাঁর বাঁ হাতে ক্যামেরা আর ডান হাতে একটা লম্বা সাপের মাথা মুঠোয় ধরা।

অজিত উঠে দাঁড়িয়ে রেলিং-এ ঝুঁকে চেঁচাল, “এ কী! আপনি সাপ ধরেছেন? কী সাপ ওটা?”

“আমি সাপ চিনি না। এ-ব্যাটা আমাকে দেখে ছোবল তুলেছিল, আমি চট করে ধরে ফেললাম। এখন ছাড়তে পারছি না। আপনারা আমাকে সাহায্য করবেন? প্লিজ!” মিস্টার প্রসন্ন চেঁচিয়ে বললেন।

ওরা চা ফেলে রেখে দুদ্দাড় করে নীচে নেমে এল। মিস্টার প্রসন্ন তখন কাঠের সাঁকোর ওপর এসে দাঁড়িয়েছেন। চৌকিদার বলে উঠল, “আই বাপ। এ তো শঙ্খচূড়। ভগবানের সাপ। একবার দাঁত বসালে ভগবানও বাঁচাতে পারবে না। আপনি এঁকে ধরেছেন? সাপুড়েরাও ওকে ধরতে ভয় পায়।” কথাগুলো বলতে বলতে লোকটা বারংবার নমস্কার করে যাচ্ছিল।

শঙ্খচূড়। অর্জুন ভাল করে দেখল। শরীর থেকে অনেকটা দূরে হাত সরিয়ে রাখায় সাপটা কোনও অবলম্বন না পেয়ে ক্রমাগত বেঁকেচুরে যাচ্ছে। শঙ্খচূড়ের মাথায় যে ছাপ থাকে তা দেখা যাচ্ছে না ওটা মুঠোর মধ্যে আটকে থাকায়। মিস্টার প্রসন্ন আবার বললেন, “হেল্প মি প্লিজ।”

ততক্ষণে চৌকিদার একটা দড়ি নিয়ে এসেছে। দড়িটা সাপের শরীরের মাঝ বরাবর তিনবার ফাঁস দিয়ে আটকে তার এক প্রান্ত সামনের গাছের ডালে

বেঁধে দিল সে। দিয়ে বলল, “সাপকে ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে সরে যান।”

মিস্টার প্রসন্ন বাংলা না বুঝলেও ব্যাপারটা অনুমান করতে পারলেন। চকিতে হাত ছেড়ে দৌড়ে গেলেন তিনি খানিকটা দূরে। সাপটা এবার গাছের ডালে বাঁধা। দড়ির শেষে ঝুলতে লাগল। প্রাণপণে সে এ মাথাটাকে ওপরে তুলে দড়িটাকে জড়িয়ে ধরতে চাইছিল। ওর পেটে দড়ি চেপে বসে যাওয়ায় শক্তি যথেষ্ট কমে গিয়েছিল কিন্তু তাতে রাগ পড়েনি। মাঝে মাঝেই তার আস্ফালন শোনা যাচ্ছিল।

মিস্টার প্রসন্ন কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কি বিষাক্ত সাপ?”

অর্জুন দোলনার মতো দুলতে থাকা সাপটার দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ। কামড়ালে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।”

“মাই গড।”

কিন্তু ওইভাবে সাপটাকে ঝুলিয়ে না। রেখে মেরে ফেলাই ভাল। অর্জুন সেটা বলতে চৌকিদার তীব্র আপত্তি করল। ওটা ভগবানের সাপ, মারলে ভগবানই মারবেন। ও যাতে কাউকে না কামড়ায় তাই এই ব্যবস্থা। ওকে মারলে ওর জোড়া সাপটি যদি দেখতে পায় তা হলে আর রক্ষে থাকবে না। বরং এইভাবে ঝুলতে ঝুলতে ও আপনিই মরে যাবে।

অর্জুনের ভয় হচ্ছিল। কেউ যদি না দেখে ওর কাছাকাছি চলে আসে তা হলে নির্ঘাত সাপের ছোবল খাবে। এটা শুনে সুবোধ বলল, “ভালই হল। আমাদের আর একজন পাহারাদার বাড়ল।”

মিস্টার প্রসন্ন সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেললেন। তারপর চৌকিদারের সঙ্গে গল্প করতে লাগলেন। তিনি নাকি নীচের ডাইনিং রুমেই রাত কাটাবেন। ডাইনিং রুমটি মন্দ নয়। মেঝের ওপর কার্পেট পাতা, টেবিল-চেয়ারের সঙ্গে লম্বা সোফাও রয়েছে।

বিকেল হয়ে গিয়েছিল। চার বন্ধু বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে সামনের জলাশয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। ঝিঁঝির বীভৎস একটানা তীক্ষ্ণ শব্দ ছাপিয়ে এখন শ’য়ে -শ’য়ে পাখির ডাকে চারপাশ মুখরিত। সন্ধের মুখে যে যার গাছের ডালে ফিরে আসছে ওরা। গোটাপঞ্চাশেক টিয়া জলাশয়ের ওপর চার-পাঁচবার এমনভাবে পাক খেয়ে গেল যেন তারা সার্কাসের খেলা দেখাচ্ছে। সামনের গাছের ডালে সাপটা তখনও লড়ে যাচ্ছে প্রাণপণে।

ঝুপঝুপ করে সন্ধে নয়, একেবারে রাত নেমে গেল জঙ্গলে। প্রথমেই ঘন অন্ধকার। বাংলোয় ইলেকট্রিক নেই। চৌকিদার দু’-দুটো বড় হারিকেন জ্বেলে দিয়ে গেল দু’ঘরে। অর্জুন তাকে জিজ্ঞেস করল, “ফোটোগ্রাফার সাহেব কী করছেন?”

“ডাইনিং রুমের সোফায় শুয়ে আছেন।”

“এখানে কী কী দেখতে পাওয়া যায় ভাই?” সুবোধ জানতে চাইল।

“কপাল ভাল হলে হাতি, বাইসন, হরিণ তো পাবেনই, ভেতরের দিকে চিতাও দেখতে পারেন। আজ তো দেরি করে চাঁদ উঠবে।”

ঘন অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে অজিত বলল, “চাঁদ উঠবে!”

“হ্যাঁ। দু’দিন আগে পূর্ণিমা গেল না?”

চৌকিদার নীচে নেমে গেলে অর্জুনরা গল্প শুরু করল। তাদের স্কুল-জীবনের মাস্টারমশাইদের গল্প। সুশীলবাবু, কমলাকান্তবাবু, সুধাময়বাবু, শিশিরবাবু থেকে হেডমাস্টারমশাই নারায়ণচন্দ্র চন্দ মশাইয়ের কথা আন্তরিকভাবে বলাবলি করতে লাগল ওরা। অর্জুনের ভাল লাগছিল। তারপরেই হঠাৎ আলোচনা বাঁক ঘুরে চলে এল অর্জুনের গল্পে। সবাই জানতে চাইল লাইটার রহস্যের সমাধানে আমেরিকায় গিয়ে কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল? হঠাৎ অর্জুন কী করে সত্যসন্ধানের ক্ষমতা অর্জন করল? অমল বোস লোকটি কীরকম? ইত্যাদি।

নিজের কথা বলতে অস্বস্তি হয় অর্জুনের। তবু বন্ধুদের কৌতূহল সে মেটাচ্ছিল। এই সময় একটা ইঞ্জিনের আওয়াজ হল। তারপর জঙ্গলের মধ্যে আবছা আলো দ্রুত এগিয়ে আসছে— দেখতে পেল ওরা। হঠাৎই জঙ্গল ছেড়ে সেই আলো গাড়ির হেডলাইট হয়ে জলাশয়ের ওপর বাঁক খেয়ে বাংলোর ওপর আছড়ে পড়ল। এখন খাদের ওপর সাঁকোটা নেই। সন্ধের আগেই ওটাকে সরিয়ে রেখেছে চৌকিদার। হেডলাইট না নিভিয়ে হর্ন বাজাতে লাগল গাড়িটা।

অর্জুন উঠে দাঁড়িয়েছিল। সে দেখল চৌকিদার বাংলা থেকে বেরিয়ে নুড়িপাথরের ওপর এসে দাঁড়াল।

গাড়ি থেকেই হুকুম হল, “ব্রিজ লাগাও।” হুকুমটা হল হিন্দিতে।

“বাংলোতে জায়গা নেই সার।”

“জায়গা আছে কিনা আমরা বুঝব। যা বলছি তাই করো।”

“কিন্তু সার অর্ডার নিয়ে বাবুরা এসে গিয়েছেন। তাঁদের ঘর খুলে দিয়েছি। আপনারা অন্য কোথাও চেষ্টা করুন।” চৌকিদার বলল।

“এটা দেখতে পাচ্ছ? কথা না শুনলে তোমাকে মরতে হবে। আজ এখানে থাকতে আসিনি। কাজ শেষ করে চলে যাব।” লোকটা জানলা দিয়ে তার যে হাতটি বাড়িয়ে ধরল তাতে কিছু একটা ধরা আছে। চৌকিদার এবার কাঠের সাঁকো টেনে খাদের ওপর তুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে চারজন নেমে পড়ল।

সুবোধ বলল, “মনে হচ্ছে এরা গুণ্ডা। কী করবি?”

অর্জুন বলল, “কিছু করার দরকার নেই। চুপচাপ বসে থাক।”

ওরা বেতের চেয়ারে বসতেই লোকগুলো দুপদাপ শব্দ করে ওপরে উঠে এল। একজনের হাতে রিভলভার, বাকিরাও হিংস্র প্রকৃতির, সন্দেহ নেই। ওরা পাশাপাশি ঘর টয়লেট দেখে বাইরে এল। রিভলভারধারী হিন্দিতে বলল, “টর্চ ফেল।”

সঙ্গে সঙ্গে টর্চের আলো পড়ল অর্জুনদের মুখে। একে একে চারজনকে দেখে নিল ওরা। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার? কী চাইছেন আপনারা?”

“লোকটা কোথায়?” চাপা গলায় বলল রিভলভারধারী।

“কোন লোক?”

“দেখুন ভাই, আপনাদের সঙ্গে আমার কোনও শত্রুতা নেই। কিন্তু আজ এখানে আসার সময় লাটাগুড়ির বাজারে দাঁড়িয়েছিলেন?”

“হ্যাঁ।”

“সেখানে একজন লোক, ফোটোগ্রাফার আপনাদের কাছে লিফট চেয়েছিল?”

অর্জুন এতক্ষণে বুঝতে পারল, “আপনারা। জানলেন কী করে?”

“লোকটা যে চায়ের দোকানের চা খেয়েছে তার দোকানদার মিথ্যে কথা বলবে না। তার জানের ভয় আছে।”

“আচ্ছা। হ্যাঁ ওঁকে লিফট দিয়েছি আমরা।”

“কেন?”

“আশ্চর্য। উনি এদিকের লোক নন, বিপদে পড়ে সাহায্য চাইছেন, গাড়িতে যখন জায়গা আছে তখন বলব কেন?”

“লোকটা কোথায় নামল?”

“আপনি তখন থেকে রিভলভার উঁচিয়ে কথা বলছেন এটা আমার ভাল লাগছে না। ওটা নামিয়ে ভদ্রভাবে কথা বলুন।” অর্জুন বলল।

সঙ্গে সঙ্গে একটা বিশ্রী গালাগাল করল লোকটা। করে বলল, “আমার সঙ্গে কেউ এভাবে কথা বলার সাহস করে না। লোকটা কোথায় না বললে তোকেই মালবাজারে তুলে নিয়ে যাব।”

“আচ্ছা! মালবাজারের লোক আপনারা। কার লোক? সুচা সিংহ না লড্ডন খান? এর বাইরে তো ওখানে কারও দল নেই।”

লোকটা বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি লড্ডন খানকে চেনেন?”

“চিনি। আপনি ওকে অর্জুনের নাম বলবেন। আর সেইসঙ্গে বলবেন এইভাবে রিভলভার দেখিয়ে তুই-তোকারি করেছেন কিন্তু আমি ভদ্রতা বজায় রেখেছি।”

লোকটা কিছু ভাবল। তারপর রিভলভার পকেটে ঢুকিয়ে বলল, “মনে হচ্ছে আপনি জানাশোনা লোক। কিন্তু ওই লোকটাকে আমার চাই।”

“কেন?”

“ও জলদাপাড়ায় যেসব ছবি তুলেছে তারপর ওকে ছেড়ে দেওয়া যায় না।”

“কী ছবি তুলেছে?”

“তা আমি জানি না। যে আমাকে কাজটা দিয়েছে সেটা তার সমস্যা। শুধু ওকে খুঁজে দেওয়াই আমার কাজ।”

“তার মানে তুমি টাকা নিয়ে কাজটা করছ?”

“যার যা কাজ তা তাকে করতেই হয়।” লোকটা বলল, “কিন্তু লোকটাকে এখানে খুঁজে পাচ্ছি না। অবশ্য এই অন্ধকারে জঙ্গলে গিয়ে লুকিয়ে পড়লে ওকে পাওয়া যাবে না।”

এই সময় নীচ থেকে একটা চিৎকার ভেসে এল। ওরা কাঠের রেলিং ধরে নীচের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল চতুর্থ লোকটি চৌকিদারকে চেপে ধরেছে এবং সে যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে বলছে, “একটু আগে নীচেই ছিল, এখন কোথায় গিয়েছে বলতে পারব না।”

সঙ্গে সঙ্গে এই তিনজন নীচে নেমে গেল। বাংলোর চারপাশে গভীর খাদ। সেটা ডিঙিয়ে বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। ওরা বাংলোচত্বর, চৌকিদারের ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজল কিন্তু মিস্টার প্রসন্নকে কোথাও পাওয়া গেল না।

শেষপর্যন্ত ওদের নেতা কাঠের সাঁকোর দিকে তাকাল। তারপর বলল, “আমরা যখন ভেতরে ঢুকেছিলাম তখন ও কোথাও লুকিয়ে ছিল, ফাঁক বুঝে ওই ব্রিজ দিয়েই বাইরে চলে গিয়েছে।”

“তা হলে কী হবে ওস্তাদ?” একজন জানতে চাইল।

“যাবে কোথায়? জঙ্গলের ভেতরে ঢুকলে মারা পড়বে আর হাইওয়ের দিকে গেলে আমরা আছি। নাঃ, আজ রাতের ঘুমটা আর হবে না। চলো।” বলে সে চৌকিদারের দিকে ঘুরে দাঁড়াল, “আমরা চলে গেলে এই ব্রিজটা তুলে নেবে। কাল সকালের আগে যেন এটা আর না লাগে। বুঝতে পেরেছ?”

চৌকিদার মাথা নাড়তে ওরা কাঠের সাঁকো বেয়ে এগোতেই চাঁদ উঠল। হালকা আলো ফুটল জঙ্গলে। দু’জন গাড়িতে উঠল, আর বাকি দু’জন বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল নিচু গলায়। বাংলার বারান্দা থেকে অর্জুনরা কোনও সংলাপই শুনতে পাচ্ছিল না।

অর্জুন জঙ্গলের দিকে তাকাল। চাঁদ উঠলেও তার শরীর এখন ছোট। যে হালকা জ্যোৎস্না এখন পৃথিবীতে নেমেছে তা জঙ্গলের শরীর ভেদ করতে অক্ষম। ফলে গাছপালাকে জমাট অন্ধকার বলেই মনে হচ্ছে। তার কোথায় মিস্টার প্রসন্ন লুকিয়ে আছেন তা কেউ বলতে পারবে না। হঠাৎ একটা আর্ত চিৎকার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। এমনকী পাখিরাও চমকে ডেকে উঠল গাছে গাছে। ততক্ষণে গাড়ির ভেতর থেকে টর্চের আলো পড়েছে বাইরে। একটি লোক হাত চেপে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। আর টর্চের আলোয় দেখা গেল শঙ্খচূড়টা প্রবলভাবে দুলছে দড়িতে বাঁধা অবস্থায়। কিন্তু দড়ির বাঁধন অনেক নীচে নেমে গিয়েছে। দুলতে দুলতে ঝুপ করে পড়ে গেল সাপটা। সঙ্গে সঙ্গে রিভলভারের গর্জন শোনা গেল।

বন্ধুরা ওপরে দাঁড়িয়ে থাকলেও অর্জুন দ্রুত নীচে নেমে এল। যে লোকটি ছোবল খেয়েছে সে মাটিতে ছটফট করছে। একটু দূরেই মৃত সাপটা পড়ে রয়েছে। তিনজন লোক কী করবে বুঝতে পারছিল না। অর্জুন দৌড়ে বাইরে এসে লোকটার জামা ছিঁড়ে দেখল কনুইয়ের কাছে দাঁত বসেছে। লোকটা হয়তো কথা বলতে বলতে ওপরে হাত তুলেছিল। অর্জুন সঙ্গে সঙ্গে ছেঁড়া জামার টুকরো দিয়ে কনুইয়ের ওপরে বাঁধন দিতে লাগল। তারপর চেঁচিয়ে বলল গাছের দড়িটা টেনে নামাতে। সেটা নামানো হলে আরও শক্ত বাঁধন কনুই থেকে প্রায় কাঁধ পর্যন্ত সে শক্ত করে বাঁধল। লোকটা গোঙাচ্ছে। অর্জুন বলল, “তাড়াতাড়ি ওকে হাসপাতালে নিয়ে যান। বিষ যদি এর মধ্যে ভেতরে চলে না গিয়ে থাকে তা হলে ও বেঁচে যাবে।”

তাড়াতাড়ি করে লোকটাকে গাড়িতে তুলল ওরা। তীব্রবেগে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল হেডলাইটের আলোয় অন্ধকার কেটে।

ততক্ষণে বন্ধুরা নেমে এসেছে নীচে। অজিত বলল, “আশ্চর্য ব্যাপার। ওই সাপটা এতক্ষণ বেঁচে ছিল? লোকটা ঠিক মরে যাবে।”

“সম্ভবত নয়।” অর্জুন বলল।

ঠিক তখনই মিস্টার প্রসন্নকে দেখা গেল। পাশের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, “প্লিজ, আমাকে বাঁচান।”

উনি হাঁটতে পারছিলেন না ভাল করে। কোনওরকমে বাংলোর একতলায় নিয়ে আসার পর দেখা গেল ওঁর সমস্ত শরীরে মোটা মোটা পাহাড়ি জোঁক ঝুলছে। এমনকী জামাপ্যান্টের ভেতরেও ঢুকে গেছে সেগুলো। রক্ত খেয়ে ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। সুবোধ বলল, “এত জেঁক ধরল কী করে?”

ডাইনিং টেবিল থেকে লবণ নিয়ে জোঁক ছাড়াতে ছাড়াতে অর্জুন বলল, “ভয়ে নড়াচড়া করতে পারেননি। শব্দ হলে ধরা পড়ে যেতেন।”

সুবোধ গুনল। প্রায় ছত্রিশটা জোঁক ছাড়ানো হল মিস্টার প্রসন্নর শরীর থেকে। চৌকিদার আলু কেটে তার রস ক্ষতস্থানগুলোতে লাগিয়ে দিতে দিতে বলল, “দু’দিনেই ঠিক হয়ে যাবে।”

কাঠের সাঁকোটা খুলে নেওয়া হল। রাত বাড়লে খাওয়াদাওয়ার পর মিস্টার প্রসন্ন একটু সুস্থ হলেন। সুস্থ হয়েই ব্যাগ থেকে একটা টিউব বের করে মলম লাগাতে লাগলেন ক্ষতস্থানগুলোতে। অর্জুন তাঁর পাশে এসে বসল, “কী হয়েছিল?”

মিস্টার প্রসন্ন মাথা নাড়লেন, “বিশ্বাস

করুন, আমি কিছু জানি না।”

“নিশ্চয়ই অকারণে ওরা এতদূরে ছুটে আসেনি?” অর্জুন জিজ্ঞেস করল, “ওরা আপনাকে জলদাপাড়ায় কিছু বলেনি?”

“হ্যাঁ বলেছে। পরশু বিকেলে আমি জঙ্গলে ঢুকে ছবি তুলছিলাম। তুলতে তুলতে সন্ধে হয়ে গেল। আমি হলং-এর বাংলোয় জায়গা পেয়েছিলাম। হঠাৎ একটা লোক এসে আমাকে বলল আজ যেসব ছবি আমি তুলেছি তার ফিল্ম দিয়ে দিতে হবে। আমি রাজি না হওয়ায় সে খুব শাসাল। সে চলে যাওয়ার পর একটা নেপালি কর্মচারী এসে চুপিচুপি বলে গেল, ‘সাব আপ ভাগ যাইয়ে। আপকো জান খতরামে হ্যায়।’ শোনার পর সত্যি আমি ভয় পেলাম। আমার তোলা ছবিগুলো কেন ওদের দরকার বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু আমি পালালাম। হলংয়ের জঙ্গল এত ঘন নয়। মাদারিহাটে পৌঁছে সেই রাত্রেই একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে অনেকটা পথ চলে এসেছিলাম। ভোরের দিকে ট্যাক্সি খারাপ হল। তারপর হাঁটতে হাঁটতে লাটাগুড়িতে পৌঁছে অনেকক্ষণ বিশ্রাম করে ভেবেছিলাম ওদের হাত থেকে বাঁচতে পেরেছি। কিন্তু ওরা যে এখানেও পৌঁছে যাবে তা আমি বুঝতে পারিনি।” মিস্টার প্রসন্ন বললেন।

“ঠিক আছে। আপনি আজ বিশ্রাম করুন। আপনার কোনও ভয় নেই।” অর্জুন উঠে গেল।

রাত্রে ওরা হাতিদের জল খাওয়া দেখল জ্যোৎস্নায়। হাতিরা চলে গেলে এল বাইসনদের দল। নিজেদের মধ্যে মারামারি করল তারা। তারপর এল হরিণের ঝাঁক। ভোরের দিক তখন।

সকালের চা দিতে এসে চৌকিদার জানাল মিস্টার প্রসন্ন নেই। খাদের ওপর কাঠের সাঁকো টেনে তিনি বেরিয়ে গেছেন।

অর্জুন বলল, “অনুমান করেছিলাম। তাড়াতাড়ি চা খেয়ে বেরিয়ে পড়। ভদ্রলোক হেঁটে নাগরাকাটায় পৌঁছবার চেষ্টা করছেন।”

“কেন?” অজিত জিজ্ঞেস করল।

“যে-কোনও শিল্পীর যেমন তাঁর সৃষ্টির ওপর সবচেয়ে বেশি দরদ থাকে ঠিক তেমনই মিস্টার প্রসন্নর আগ্রহ ও মমতা থাকবে নিজের তোলা ছবিগুলোকে পাওয়ার। গতকাল এখানে আসার পথে আমরা নাগরাকাটার ফোটোর দোকানে যে ফিল্মগুলো প্রিন্ট করতে দিয়ে এসেছিলাম সেগুলো উনি হাতছাড়া করতে চাইছেন না। সেটাই স্বাভাবিক।”

গাড়ি চালাতে চালাতে অজিত বলল, “একদিনেই দারুণ অভিজ্ঞতা হল। তুই যেখানেই যাবি সেখানেই এরকম হবে, তাই না অর্জুন?”

অর্জুন হাসল। গাড়ি জঙ্গলের পথ ধরে এগোচ্ছিল। হঠাৎ একটা গাছের নীচে কিছু একটা পড়ে থাকতে দেখে গাড়ি থামাতে বলল অর্জুন। নেমে কাছে গিয়ে দেখল একটা বড় ঝোলা। তাতে জামাপ্যান্ট ইত্যাদি। সে ওপরের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করল, “মিস্টার প্রসন্ন নেমে আসুন।”

অনেক ওপরে ভদ্রলোককে দেখা গেল। অসহায়ভাবে ডাল ধরে বসে আছেন। কোনওরকমে নেমে এলেন। এবার তার শরীর জুড়ে লাল পিঁপড়ে দেখা গেল। ওদের কামড়ে মুখ ফুলে ঢোল। জানা গেল ভোরের পথে চলতে চলতে হাতির দলের সামনে পড়েছিলেন। প্রাণ বাঁচানোর জন্যে গাছে ওঠার সময় ঝোলা পড়ে গিয়েছিল নীচে।

তাঁকে গাড়িতে তুলে অর্জুন বলল, “আমাদের অবিশ্বাস করলেন কেন! আপনার তোলা ছবি আপনারই থাকবে।”

মিস্টার প্রসন্নকে এখন খুব লজ্জিত এবং সংকুচিত দেখাল।

নাগরাকাটার ছবির দোকান খুলল সকাল দশটায়। প্রিন্ট হয়ে গিয়েছিল। প্যাকেট বের করে প্রৌঢ় দোকানদার জিজ্ঞেস করলেন, “এই ছবি কোন জঙ্গলে তোলা হয়েছিল?”

অর্জুন বলল, “কেন?”

“এ ছবি আমি দিতে পারব না। আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। আমি থানা হয়ে আসছি। ওই যে পুলিশ এসে গিয়েছে।”

দোকানদার বলতেই একটি পুলিশের জিপ এসে দাঁড়াল। দারোগাবাবু দোকানে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন, “কই, কী ছবি দেখি?”

দোকানদার দেখালেন। দারোগা বললেন, “আরে। এ তো লড্ডন খান। পরিষ্কার মার্ডার। এঁরা কে?”

দোকানদার বললেন, “এঁরাই প্রিন্ট করতে দিয়েছিলেন।”

অর্জুন বলল, “ইনি প্রফেশনাল ফোটোগ্রাফার। জঙ্গলের ছবি তুলেছিলেন। ছবিটা দেখতে পারি? হ্যাঁ, এটি লড্ডন খান। মুখ পরিষ্কার উঠেছে।”

দারোগা জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা। আপনি লড্ডনকে চেনেন। মহাশয়ের নাম কি জানতে পারি?”

“আমি অর্জুন। জলপাইগুড়িতে থাকি।”

“অর্জুন? মানে—মানে—মানে!”

অজিত বলল, “হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন।”

দারোগা উচ্ছ্বসিত, “আরে মশাই, আপনার নাম এত শুনেছি। উঃ। চোখে দেখব ভাবতে পারিনি। লড্ডনকে ফাঁসাতে পারছিলাম না। এই ছবি খুব কাজে লাগবে। আপনারা আসুন, থানায় বসে এক কাপ চা খেয়ে আমাকে ধন্য করুন।”

অর্জুন বলল, “শুধু চা হলে চলবে না। ব্রেকফাস্ট চাই।”

“অবশ্যই।”

থানার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল গাড়ি দুটো। মিস্টার প্রসন্ন নিচু গলায় অজিতকে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। উনি কী বললেন? আমি অর্জুন। মানে কী? অর্জুন তো মহাভারতের চরিত্র। আমি মানে কী?”

অজিত হাসল। তারপর বলল, “আমি মানে আই। আই অ্যাম অর্জুন। আন্ডারস্ট্যান্ড?”

২৩ ডিসেম্বর ১৯৯৭

অলংকরণ: কৃষ্ণেন্দু চাকী

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *