আমিও মানুষ – ৮

ইকতিদার আলির কথামতো উকিল আসির উদ্দিন মুক্তাদীরের চারতলা বাড়ির দোতলা বাদে সব ভাড়া দিয়েছেন। মাঝে মাঝে নিজেরা এসে থাকার জন্য দোতলাটা ভাড়া দিতে নিষেধ করেছেন এবং পুরোনো কাজের মেয়েও লোকদেরও রেখে দিতে বলেছেন ইকতিদার আলি।

আফসানার বিয়ের একসপ্তাহ আগে ইকতিদার আলি স্ত্রী ও নাতনিকে নিয়ে ঢাকায় এলেন।

স্বামীর গাড়ি থাকা সত্বেও সালমা বেগম কখনো গাড়িতে চাপেন নি। আজ দীর্ঘ পথ গাড়ি করে আসার সময় খুব আনন্দ উপভোগ করেছেন। তারপর গাড়ি যখন ঢাকা শহরের উপর দিয়ে আসে তখন উঁচু উঁচু বিল্ডিং, নানারকম গাড়ি ও লোকজনের ভীড় দেখে যেমন অবাক হলেন, তেমনি আরো বেশি আনন্দ পেলেন।

পরের দিন সকালে ইকতিদার আলি নাতনিকে নিয়ে উকিলের বাসায় যখন গেলেন তখন আসির উদ্দিন কোর্টে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। খবর পেয়ে তাড়াতাড়ি এসে ইকতিদার আলির সঙ্গে সালাম ও কুশলবিনিময় করে বললেন, আজ একটা কেসের হিয়ারিং-এর শেষ দিন। এক্ষুনি যেতে হবে। চা-নাস্তা খেয়ে যাবেন। বিকেলে আমি আপনার বাসায় আসব, আপনাকে আসতে হবে না। কাল থেকে পনেরো দিন কোর্টে যাব না। এখন থাকতে পারছি না বলে মাফ চাইছি। তারপর নিগারকে বলল, আফসানা বাসায় আছে, তুমি ভিতরে গিয়ে তোমার। চাচিআম্মাকে চা-নাস্তা পাঠিয়ে দিতে বল।

ইকতিদার আলি বললেন, না-না, মাফ চাইছ কেন? জরুরি কাজে তো যেতেই হবে। তারপর নিগারকে বললেন, তুমি ভিতরে যাও। আমি যাই, এই কথা বলে আসির উদ্দিনকে বললেন, চা-নাস্তা খেয়েই এসেছি। আর কিছু খেতে পারব না। চল একসঙ্গে বেরই বলে উঠে দাঁড়ালেন।

উকিল-চাচা ও দাদাজী বেরিয়ে যাওয়ার পর নিগার ভিতরে গেল। বারান্দায় আফসানার মায়ের সঙ্গে দেখা হতে সালাম দিয়ে বললেন, চাচিআম্মা, কেমন আছেন?

হালিমা খাতুন বললেন, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছ?

জি ভালো।

তোমার দাদা-দাদিআম্মা ভালো আছেন?

জি ভালো আছেন। ওঁরাও তো এসেছেন।

ওমা তাই নাকি? তা ওঁরা এলেন না যে?

দাদিআম্মা পাড়াগাঁয়ের মেয়ে। কখনো শহরে আসেন নি। দু’একদিন পরে নিয়ে আসব। দাদাজী এসেছিলেন, চাচার সঙ্গে এইমাত্র বেরিয়ে গেলেন। চাচা নিজেই বলেছেন, বিকেলে আমাদের বাসায় যাবেন।  

হালিমা খাতুন বললেন, আজ থেকে আত্মীয়স্বজন আসতে শুরু করবে। তাদের রুম গোছাতে হবে, আমি এখন যাই। তুমি আফসানার রুমে যাও, ও রুমেই আছে।

নিগার আফসানার রুমে এসে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছিস? বিয়ের কথা ভেবে খুব অ্যাংজাইটি ফিল করছিস তাই না? তারপর হাতে বই দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করল, কী বই পড়ছিলি?

.

আফসানা “মুসলিম দাম্পত্য জীবন” পড়ছিল। সালামের উত্তর দিয়ে বলল, বিয়ের আগে তো ভালো থাকতেই হবে। আর অ্যাংজাইটি তো হবেই। তোর যখন বিয়ে হবে তখন তোরও হবে। তারপর বইটা দেখিয়ে বলল, তুইও পড়িস। দাম্পত্য জীবনের অনেক কিছু জানার আছে।

নিগার বলল, ওসব কথা বাদ দিয়ে হবু বরের ছবি থাকলে দেখা। দেখি তোর ইঞ্জিনিয়ার বরটা কেমন।

ছবি দেখে আর কী হবে? কয়েকদিন পরে আসল মানুষকেই তো দেখবি?

তা তো দেখবই, ছবি থাকলে দে না দেখি।

ছবি থাকলে তো দেব। তা হ্যাঁরে, দাদু এসেছেন?

শুধু, দাদু নয়, দাদিআম্মাও এসেছেন?

তাই নাকি?

হ্যাঁরে তাই।

কী খাবি বল। মাকে বলে আসি। তোর সঙ্গে জরুরি আলাপ আছে।

এক্ষুনি নাস্তা খেয়ে এসেছি, পরে খাব। জরুরি আলাপটা বল আগে শুনি।

শোন, আফজাল ভাই দুদিন আগে এসে তোকে একটা চিঠি দিয়ে গেছেন। চিঠিটা দিচ্ছি বলে আফসানা টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা মুখবন্ধ খাম এনে তার হাতে দিল। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোর সঙ্গে আফজাল ভাইয়ের ভালোভাবে তেমন আলাপও হয় নি, তবু তার প্রতি এরকম সিদ্ধান্ত নিলি কেন বলবি?

নিগার বলল, যেদিন গভীর রাতে বাসায় গিয়ে জসীম, হাসিব ও জয়নালের হিংস্র থাবা থেকে বাঁচালেন এবং কুরআন-হাদিসের যেসব কথা বললেন, সেদিন তার চোখ মুখে যে জ্যোতি আমি দেখেছিলাম, তা আমাকে এত প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে যে, তার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। তারপর থেকে মনে হয়, ওঁকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পার না। যদি ওঁকে না-ও পাই তবুও।  

কিন্তু তোর দাদিআম্মা রাজি থাকলেও দাদাজী তো রাজি নন জানিয়েছিলি। আমার ধারণা, তিনি আফজাল ভাইয়ের সাথে কিছুতেই তোর বিয়ে দেবেন না।

সে-কথা আমিও ভালো করেই জানি। তারপর এ ব্যাপারে দাদাজীর সঙ্গে যা কিছু আলাপ হয়েছে বলল।

আফসানা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, সত্যি, তোর জন্য আমার খুব দুশ্চিন্তা হয়।

নিগার হেসে উঠে বললে, তকদিরে যা লেখা আছে, তা হবেই। আমার জন্য দুশ্চিন্তা করে বিয়ের আনন্দটা মাটি করবি না তো? আফজাল ভাই চিঠিতে কী লিখেছেন, পড়ার পর তোকে জানাব। তারপর দুজনে পরামর্শ করব।

তা হলে এক্ষুনি বাসায় গিয়ে চিঠিটা পড়, বিকেলে আসিস। বাবা তো বিকেলে দাদুর সঙ্গে কথা বলার জন্য তোদর বাসায় যাবে। তার আগে আসবি আলাপ করা যাবে।

হ্যাঁ, তাই যাই। চিঠিটা পড়ার জন্য মনটা ছটফট করছে।

আফসানা হেসে উঠে বলল, তা আর বুঝি না? তাই তো তোকে যেতে বললাম। আশা করি, ভালো খবর জানাবি।

বাসায় ফিরে নিগার খাম থেকে চিঠিটা খুলে দুরুদুরু বুকে পড়তে শুরু করল।

মেহের নিগার,

আসোলামু আলাইকুম। পর সমাচার ভাসিটিতে প্রথমদিন আলাপ করার সময় কেন জানি মনে হয়েছিল, আপনার মতো মেয়েই আমার পছন্দ। কয়েকদিন পর আফসানার কাছে আপনি উদ্ধৃঙ্খলতার পথে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছেন শুনে মনে আঘাত পাই। তাই একদিন রাতে আফসানার বাবার সঙ্গে আলাপ শেষে ফেরার সময় আপনাকে ঐ পথ থেকে ফেরাবার জন্য কিছু সাবধানবাণী শোনাবার জন্য আপনাদের বাসায় যাই এবং আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় কিছু বলেও ছিলাম। পরে আফসানার কাছেই আপনার ও আপনার বন্ধুদের পরিবর্তনের কথা শুনে খুব আনন্দিত হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছি। তখন থেকে আপনার স্মৃতি আমার অন্তরে চব্বিশ ঘণ্টা গোলাপের খুশবু ছড়াচ্ছে। সেই খুশবুতে মোহিত হয়ে আপনার মনের খবর জানার জন্য দু’বার গ্রামের বাড়িতে দেখা করতে যাই। সেখানে আমাদের সাক্ষাৎ হোক, আল্লাহ বোধহয় তা চান নি। তাই সে আশা আমার পূরণ হয় নি। কিছুদিন আগে প্রয়োজনের তাগিদে উকিল-চাচার কাছে এসেছিলাম। তিনি আফসানার বিয়ের কার্ড দিয়ে আসতে বললেন। জিজ্ঞেস করলাম, আপনাকে বা আপনার দাদাজীকে নিমন্ত্রণ করবেন কি না। বললেন, কয়েকদিন আগে কার্ড পাঠিয়ে দিয়েছি। বন্ধুর বিয়েতে আপনি নিশ্চয় আসবেন ভেবে গোলাপকে দেখার ও তার খুশবু প্রাণভরে নেওয়ার জন্য এবং বিশেষ করে গোলাপটা অন্তরে স্থায়ী বাসা বাঁধবে কি না জানার জন্য এই চিঠি লিখে আফসানার হাতে দিয়ে আপনাকে দিতে বলেছিলাম। আমি সিওর, আফসানা আপনাকে চিঠিটা দেবেন এবং চিঠি পড়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। যোগাযোগের ফোন নাম্বার আফসানাকে দিয়েছি। চিঠিতে কেন দিলাম না, তা সাক্ষাতে বলব। যদি ফোনে যোগাযোগ না করেন, তা হলে বুঝব গোলাপের কোনো মনের মানুষ আছে অথবা গোলাপের উপযুক্ত আমি নই। যেটাই হোক-না কেন, ভবিষ্যতে কোনোদিন আপনাকে এতটুকু ডিস্টার্ব করব না। উতলা মনকে বলব, “তকদিরকে কি তুমি বিশ্বাস কর না? অস্থির হচ্ছ কেন? হৃদয়ে যে গোলাপের খুশবু পাচ্ছ, বাস্তব গোলাপ না পেলেও তার খশরু থেকে তোমাকে বঞ্চিত করব না। আজীবন অন্য গোলাপের খশরু হৃদয়ে জায়গা পাবে না।” কলেবর অনেক বড় হয়ে গেল। তাই আল্লাহ পাকের দরবারে আপনার ইহজীবন ও পরজীবনের সুখ-শান্তি কামনা করে বিদায় নিচ্ছি, আল্লাহ হাফেজ।

ইতি
আল্লাহর এক নাদান বান্দা
আফজাল

চিঠি পড়ে নিগারের হৃদয়ে আনন্দের স্পন্দন এত বেড়ে গেল যে, এই স্পন্দন থামাবার জন্য চিঠিতে অসংখ্যবার চুমো খেয়ে অনেকক্ষণ বুকে চেপে ধরে রাখল। তারপর কখন সে ঘুমিয়ে পড়ল নিজেই জানতে পারল না। ঘুমের মধ্যে বড় অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখল। সে যেন চট্টগ্রামের বাটালী হীলে একা বেড়াতে গেছে।

বাটালী হীল খুব উঁচু। এখান থেকে প্রায় সারা চট্টগ্রাম শহর দেখা যায়। আর পশ্চিম দিকে তাকালে সমুদ্রও দেখা যায়। তাই প্রতিদিন সব বয়সের নারী-পুরুষ ও ছেলে-মেয়েরা এখানে বেড়াতে আসে। আগে পাহাড়ে ওঠার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। লোকজন পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে পা রেখে উঠত। দর্শনার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সরকার এখন পাকা সিঁড়ি করে দিয়েছে।

নিগার তন্ময় হয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখছিল। দেখতে দেখতে সন্ধে হয়ে গেলেও তার নামতে মন চাইল না। অন্যান্য যারা এসেছিল, তারা চলে গেলেও সে গেল না। রাতের আলোকউজ্জ্বল শহর দেখতে লাগল। হঠাৎ পুরুষকণ্ঠের আওয়াজ পেল, এই যে ম্যাডাম, আসুন আগে অমৃত পান করি, তারপর ফুর্তি করা যাবে।

নিগার এতক্ষণে বাস্তবে ছিল না। তাদের কথা শুনে বাস্তবে ফিরে এসে দেখল, তিনজন যুবক ছেলে তিনটে মদের বোতল হাতে লোভাতুর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ভয় পেয়ে বলল, আপনারা কী বলছেন, ঠিক বুঝতে পারছি না।

তাদের একজন বোতলের ছিপি খুলে ঢকঢক করে দু’তিন ঢোক খেয়ে বলল, আহা কচি খুকি? মদ খেয়ে ফুর্তি করার কথা কিছু বোঝ না?

অন্যজন বলল, এই শালা, দু’তিন ঢোক খেয়েই তার নেশা হয়ে গেল? দেখছিস না ভদ্রঘরের মেয়ে। সম্মান দিয়ে কথা বলবি তো।

তৃতীয়জন বলল, আরে শালা, ও তো দু’তিন ঢোক খেয়ে নেশাগ্রস্ত হয়েছে আর তুই তো না খেয়েই হয়েছিস। ভদ্রঘরের মেয়ে হলে, সন্ধের পর এখানে কি থাকত? তার আগেই চলে যেত। তারপর নিগারকে বলল, বেশ্যা হলেও চেহারাটা ভদ্রঘরের মেয়ের মতো। তাই দ্রভাবে বলছি, এস মাই ডিয়ার, একসঙ্গে অমৃত পান করে একে একে তোমার মধু পান করব।

নিগার ভয় পেয়ে বাঁচাও বাঁচাও বলে ছুটে পালাতে গেল।

তিন যুবক তার পথরোধ করে দাঁড়াল। তারপর তাকে ধরার জন্য এগিয়ে আসতে লাগল।

নিগার পিছনে ফিরে ছুট দিল। তখন খেয়াল নেই পাহাড়ের চূড়াটা বেশি বড় নয়। অন্ধকারের জন্য তা বুঝতেও পারল না। একদম শেষপ্রান্তে এসে বুঝতে পেরে দাঁড়াতে গেল কিন্তু দৌড়ানোর টান সামলাতে না পেরে পড়ে গেলে ভয়ে জ্ঞান লোপ পাওয়ার সময় অনুভব করল, কেউ যেন তাকে দুহাতে ধরে ভেসে ভেসে নেমে এসে মাটিতে শুইয়ে দিল। নির্ঘাত মৃত্যু জেনে নিগার পড়ার সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিয়েছিল। এতটুকু আঘাত না পেয়ে বেঁচে আছে বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে দেখল, একজন আলখেল্লাধারী বুড়োলোক দাঁড়িয়ে আছে। ভাবল, ইনিই তা হলে তাকে নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন? নিগার নির্বাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

বুড়ো লোকটা মৃদু হেসে বললেন, ভ্যাগ্যিস আমি এখান থেকে যাচ্ছিলাম, নচেৎ নির্ঘাৎ তোমার মৃত্যু হতো। শোন মেয়ে, আর কখনো একা বেড়াতে এস না। আর বাইরে বেরোবার সময় বোরখা ব্যবহার করবে। মনে রেখ, বোরখা মেয়েদের রক্ষাকবজ। এস আমার সঙ্গে তোমাকে গাড়িতে তুলে দিই।

এমন সময় সালমা বেগমের ডাকাডাকিতে নিগারের ঘুম ভেঙে গেল। শুনতে পেল, এখন ঘুমাচ্ছিস কেন? উঠে পড়, আজান হয়ে গেছে। নামায পড়ে খেয়ে তারপর না-হয় ঘুমাবি। তখন তার চিঠির কথা মনে পড়তে দেখল, সেটা বুকের উপর হাত চাপা দেওয়া আছে। ভাবল, বারেক দাদিআম্মা চিঠিটা দেখতে পায় নি। বলল, আপনি যান, আমি নামায পড়ে আসছি।  

বিকেল পর্যন্ত নিগার ধৈর্য ধরতে পারল না। নামায পড়ে খেয়ে উঠে দাদিআম্মাকে বলল, দাদাজী খোঁজ করলে বলবেন, উকিল-চাচার মেয়ে আফসানার কাছে গেছি। তারপর চিঠিটা নিয়ে আফসানার রুমে এসে তাকে শোয়া অবস্থায় রিসিভার তুলতে দেখে চুপিচুপি মাথার দিকে এসে দাঁড়াল।

আফসানা নামায পড়ে খেয়ে এসে খাটে শুয়েছিল। ফোন বেজে উঠতে হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছ?

বিয়ের দিন ঠিক হওয়ার পর থেকে হবু বর রিয়াজ প্রতিদিন ঠিক এই সময়ে আফসানাকে ফোন করে। আজ আফসানার কথা শুনে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আমি প্রতিদিন এই সময়ে ফোন করি; কিন্তু অন্য কেউও তো করতে পারে? কে ফোন করেছে না জেনে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করা কি ঠিক?

তা হয়ত ঠিক নয়। তবে আমি সিওর ছিলাম, তুমি ফোন করেছ।

ধন্যবাদ বলে রিয়াজ বলল, তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছে, কী করা যায় বলো তো? আচ্ছা তোমারও কি আমাকে দেখতে ইচ্ছা করছে না?

তোমার থেকে বোধহয় বেশিই করছে।

তা হলে একটা উপায় বের করছ না কেন?

এক্ষুনি বাসায় চলে এস। তোমার জায়গায় আমি হলে তাই করতাম।

আমারওতো তাই ইচ্ছা করছে; কিন্তু লজ্জা এসে বাধা দিচ্ছে।

আফসানা হেসে উঠে বলল, লজ্জা তো মেয়েদের ব্যাপার। তাই আমি যেতে পারছি না।

তুমি তো পুরুষ, তোমার আবার লজ্জা কিসের?

কেন হাসিদে পড় নি? “লজ্জা ইমানের অর্ধেক? যার লজ্জা নেই, তার ইমান নেই।” এখানে কিন্তু নারী-পুরুষ উভয়কে বোঝানো হয়েছে।

হ্যাঁ, পড়েছি। তোমার লজ্জা আছে জেনে খুব খুশি হলাম।

ধন্যবাদ বলে রিয়াজ বলল, যা বলছি শোন, তুমি চারটের সময় চিড়িয়াখানার পাশে বোটানিক্যাল গার্ডেনে চলে এস, আমি গেটে অপেক্ষা করব।

বিয়ের আগে তো এভাবে দেখা-সাক্ষাৎ ইসলামে নিষেধ?

তা আমিও জানি।

তা হলে যেতে বলছ কেন?

কী করব? তোমাকে না দেখে যে থাকতে পারছি না। গত দু’রাতে চোখে একফোঁটা ঘুম আসে নি।

কিন্তু আমি যে আজ এনগেজড। বিকেলে আমার বন্ধু নিগারকে আসতে বলেছি।

আমি তোমার কোনো অজুহাত শুনব না, আসতেই হবে। তা না হলে আজ রাত জেগে কাটাতে হবে।

আফসানা হেসে উঠে বলল, ঠিক আছে, আজ আর রাত জাগাব না, আসব। বন্ধুকে না-হয় কাল আসার জন্য বলে দেব।

ভেরি গুড, মেনি থ্যাংকস। এবার রাখি বলে রিয়াজ সালামবিনিময় করে লাইন কেটে দিল।

আফসানা রিসিভার ক্র্যাডেলে রেখে অনুচ্চস্বরে বলল, পাগল। নিগার হেসে উঠে বলল, তিনি পাগল হলে তুইও পাগলি।

আফসানা হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল, কখন এলি?

তুই তো বললি বিকেলে আসবি? এখন এলি যে?

তোর দুশ্চিন্তা দূর করব বলে নিগার চিঠিটা দিয়ে বলল, পড়ে দেখ।

আফসানা পড়ে ফেরত দিয়ে বলল, ৩/৪ অংশ দুশ্চিন্তা দূর হল।

নিগার আবার হেসে উঠে বলল, বাকি অংশ দাদাজীর মতামতের ব্যাপারটা তো? ও নিয়ে দুশ্চিন্তা করবি না। আল্লাহ যখন চারভাগের তিনভাগ নিশ্চিন্ত করেছেন তখন বাকি একভাগও তিনি করবেন। ফোন নাম্বারটা দে।

কেন রে, এক্ষুনি ফোন করবি?

হ্যাঁ করব।

আজ থাক, কাল করিস।

কেন?

রিয়াজ, মানে আমার হবু বর চারটের সময় মীরপুর বোর্টানিক্যাল গার্ডেনে যেতে বলেছে। গেটে অপেক্ষা করবে। তারপর ঘড়ি দেখে বলল, হাতে তেমন সময় নেই, যেতে আধঘণ্টা সময় লাগবে। এর মধ্যে অবশ্য ফোনটা সেরে ফেলতে পারিস। আর শোন, কাল আলাপ করব। কিছু মাইন্ড করলি না তো?

হবু বরের সঙ্গে দেখা করতে যাবি মাইন্ড করব ভাবলি কী করে? শোন তা হলে, তুই যখন ফোন ধরিস তখন এসেছি। যা কিছু আলাপ করেছিস, সব শুনেছি। নাম্বারটা দে। আফজাল ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে নিই। তোর তো আবার দেরি হয়ে যাবে।

আফসানা সেটের পাশ থেকে টেলিফোন ইনডেক্স খুলে নাম ও নাম্বারটা দেখিয়ে বলল, আলাপটা সংক্ষেপে করিস।

নিগার ডায়েল ঘোরাতে ঘোরাতে মৃদু হেসে বলল, চারপাঁচ দিন পর তো সব সময় কাছে পাবি, এখন দেখার জন্য একটু তর সইছে না বুঝি?

আফসানা কিছু না বলে শুধু মৃদু হাসল।

দু’বার রিং হওয়ার পর পুরুষ কণ্ঠ ভেসে এল, হ্যালো, কাকে চান?

নিগার সালাম দিয়ে বলল, এখানে কি আফজাল ভাই থাকেন?

সালামের উত্তর দিয়ে লোকটি বলল, আপনি কে বলছেন?

আমি মেহের নিগার। উনি থাকলে দিন। নাম বললে চিনবেন।

ধরুন দিচ্ছি।

একটু পরে আফজাল ফোন ধরে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন।

নিগার আফজালের গলা চিনতে পেরে কেঁপে উঠল। তারপর সামলে নিয়ে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?

আমিও আপনার মতো। গতকাল এসেছেন নিশ্চয়?

জি।

ফোন যখন করেছেন, আমার ভাবা কি অনুচিত হবে, যে গোলাপ অহর্নিশ আমার হৃদয়ে খুশবু ছড়াচ্ছে, তাকে সহধর্মীনি হিসাবে পাব?

চিঠি পড়ার সময় যেমন আনন্দে নিগারের হৃদয় স্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল, আফজালের কথা শুনে সেইরকম হলো। ভাবল, তার হৃদয়ের স্পন্দন আফজাল ভাই শুনতে পাচ্ছেন না তো? স্পন্দন কমাবার জন্য অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।

এতক্ষণ চুপ করে আছেন কেন? উচিত-অনুচিত কিছু একটা বলুন।

নিগার সংযত হয়ে বলল, নিশ্চয় উচিত।

আলহামদুলিল্লাহ বলে আফজাল বলল, উত্তর পেতে দেরি হতে খুব নার্ভাস ফিল করছিলাম। আর আল্লাহকে জানাচ্ছিলাম, যেন পজেটিভ উত্তর পাই। তিনি তাঁর এক নাদান বান্দার দোয়া কবুল করেছেন জেনে আবার শুকরিয়া আদায় করছি।

আপনার চিঠি পড়ে ও এখন আপনার কথা শুনে হৃদয়ে আনন্দের তুফান বইছিল। সেই তুফান সহ্য করার জন্য কিছুক্ষণ সময় নিয়েছি। মাফ করে দিন, আমারই বোঝা উচিত ছিল।

মাফ চাইছেন কেন? তারপর বলল, এখন আর আপনি নয় তুমি, কেমন?

এটাই তো স্বাভাবিক।

চারটের মধ্যে মীরপুর বের্ডানিক্যাল গার্ডেনে আসতে পারবে? আমি গেটে তোমার জন্য অপেক্ষা করব।

নিগার আফসানার দিকে একপলক তাকিয়ে ইনশাআল্লাহ পারব বলে বলল, এখন তা হলে রাখি? নচেৎ সময়মতো পৌঁছাতে পারব না।

ঠিক আছে, আমিই রাখছি বলে আফজাল সালামবিনিময় করে লাইন কেটে দিল।

নিগার রিসিভার ক্র্যাডেলে রেখে বলল, তোর হবু বর আজ যেখানে যটার সময় যেতে বলছেন, আফজাল ভাইও একই কথা বললেন। ব্যপারটা বুঝতে পারছি না।

তাই নাকি? আমিওতো বুঝতে পারছি না।

সেখানে গেলেই বোঝা যাবে বলে নিগার বলল, তুই তৈরি হয়ে গাড়ি বের কর, আমিও তৈরি হয়ে তাড়াতাড়ি আসছি। কথা শেষ করে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল।

বাসায় এসে নিগার ড্রেস চেঞ্জ করে বেরোবার সময় দাদিআম্মাকে বলল, আমি আফসানার সঙ্গে বাইরে যাচ্ছি। ফিরতে দেরি হতে পারে, দাদাজী জিজ্ঞেস করলে বলবেন।

.

গাড়ি থেকে নেমে রিয়াজ ও আফজালকে শাদা পাজামা-পাঞ্জাবিতে পাশাপাশি টিকিট হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিগার ও আফসানা ভীষণ অবাক হলো। কয়েক সেকেন্ড একে অপরের দিকে তাকিয়ে থেকে আফসানা নিগারের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ব্যাপারটা বুঝতে পারছিস?

নিগার বলল, মনে হয় ওরা দু’জন বন্ধু। আমাদেরকে সারপ্রাইজ অথবা বোকা বানাবার জন্য কিছুই বলে নি।

আফসানা বলল, তোর কথা হয়ত ঠিক। তবু কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছি না।

ওদেরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রথমে রিয়াজ সালাম দিয়ে নিগারকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনি নিশ্চয় আফসানার বন্ধু মেহের নিগার?

নিগার সালামের উত্তর দিয়ে জি বলে মাথা নিচু করে নিল।

আমার পরিচয় জানতে চাইলেন না যে?

নিগার মাথা তুলে মুখে স্বলাজ হাসি ফুটিয়ে বলল, আপনি যে আফসানার হবু বর, তা আমি বুঝতে পেরেছি। তাই জানতে চাই নি।

এবার আফজাল সালাম দিল।

সালামের উত্তর দিয়ে আফসানা জিজ্ঞেস করল, রিয়াজের সঙ্গে আপনার কত দিনের বন্ধুত্ব?

ঠিক বন্ধুত্ব নয়, আলাপি বলতে পারেন। যখন উকিল চাচা আপনার বিয়ের কথা বলেন তখন একদিন ওদের বাসায় গিয়ে আলাপ করেছিলাম। তারপর বলল, চলুন ভিতরে যাই।

গার্ডেনের ভিতরে ঢুকে আফজাল, রিয়াজ ও আফসানাকে উদ্দেশ্যে করে বলল, কিছু মনে করবেন না, মেহের নিগারের সঙ্গে আমার কিছু আলাপ আছে।

ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে আফসানা বলল, না-না, মনে করার কী আছে? আপনি ওকে নিয়ে যান। আমরাও একটু বেড়াই। একঘণ্টা পরে গেটের সামনে দেখা হবে।

আফজাল নিগারকে আসতে বলে হাঁটতে লাগল।

আফসানা রিয়াজকে বলল, ওরা যে একে অপরকে ভালোবাসে এবং বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা কি তুমি জান?

রিয়াজ বলল, না। তবে এখন তাই মনে হচ্ছে।

আফসানা বলল, তোমাকে আফজাল ভাইয়ের সঙ্গে দেখে মনে হয়েছিল, তুমি ওদের ব্যাপারটা জান। আচ্ছা আফজাল ভাই সম্পর্কে তুমি কতটা জান?

একরকম কিছুই জানি না বলতে পার।

তুমি অবাক করলে, আলাপ যখন আছে তখন জানতে চাও নি?

শোনো আফসানা, আলাপ হলেও ঘনিষ্ঠভাবে হয় নি। আফজাল একবারমাত্র বাসায় এসে আলাপ করেছিলেন। তারপর আজ আসার সময় গাড়ি নিয়ে গেট থেকে বেরিয়ে দেখি, উনি হাত তুলে থামাতে বলছেন। গাড়ি থামার পর কাছে এসে আমি কিছু বলার আগেই বললেন, আপনি কোন দিকে যাবেন? বললাম, মীরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাব।

বললেন, আমিও ওখানে যাব, যদি একটু লিফট দিতেন।

আমি আপত্তি না করে গেট খুলে দিলাম। উঠে বসার পর গাড়ি ছেড়ে দিয়ে চিন্তা করলাম, গার্ডেনের ভিতরেও সঙ্গে থাকতে চাইবেন কি না কে জানে? এখন মনে হচ্ছে, আলাপ করার সময় যতটা ট্যালেন্ট মনে করেছিলাম, তার থেকে অনেক বেশি ট্যালেন্ট।  

আফসানা বলল, আমার সঙ্গে প্রায় দেড়-দু’বছর পরিচয়। খুব ট্যালেন্ট তো বটেই। তা ছাড়াও ওঁর মধ্যে অনেক গুণও আছে। কিন্তু ওঁর আসল পরিচয় আজও জানি না।

কেন? জিজ্ঞেস করনি?

করেছি, বলেননি।

তোমার সঙ্গে পরিচয় হল কী করে?

বাবা ওঁর মায়ের সম্পত্তি উদ্ধারের ব্যাপারে মামলা চালাচ্ছেন। তারপর কিভাবে তার সঙ্গে পরিচয় হয়, আফসানা সবকিছু বলল।

নিগার নিশ্চয় ওঁর আসল পরিচয় জানে?

না, তবে আমি যতটুকু জানি, নিগারও ততটুকু জানে।

আশ্চর্য? যাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার আসল পরিচয় জানেন না তা কী করে হয়?

সে সুযোগ নিগার পায় নি। কারণ বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মাত্র দু’বার আফজালের সাথে আলাপ হয়েছে।

রিয়াজ অবাককণ্ঠে বলল, তা কী করে সম্ভব?

আফসানা বলল, দুনিয়াতে অনেক কিছু অসম্ভব ঘটনাও সম্ভব হয় ওদের ঘটনাটাও ঐ রকম। সবকিছু শুনলে আরো অসম্ভব বলে মনে হবে। ওদের হিস্ট্রি অনেক। বলতে গেলে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে। পরে একদিন তোমাকে শোনাব। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ব্যথা করছে। চল, কোনো গাছের ছায়ায় বসে নিজেদের কথা বলি।

রিয়াজ বলল, দুঃখিত। ওঁদের কথা শুনতে শুনতে নিজেদের কথা ভুলেই গেছি।

এদিকে আফজাল নিগারকে নিয়ে যেদিকে ঘন গাছপালা, সেদিকে এসে দুটো গাছের মাঝখানে মুখোমুখি বসল। তারপর একদৃষ্টে অনেকক্ষণ নিগারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

এ দিকটায় ঘন গাছপালা থাকায় লোকজন তেমন একটা আসে না? তাই নির্জন। শুধু পাখিদের কলতান শোনা যাচ্ছে। এলাকাটা বেশ ভূতুড়ে-ভূতুড়ে ভাব।

নিগার ভূতটুত বিশ্বাস না করলেও নির্জনতার কারণে তার একটু ভয়-ভয় করতে লাগল। ভয় কাটাবার জন্য বলল, এতক্ষণ ধরে কী দেখছ?

আফজাল, বলল, তোমার নামের অর্থ জান?

জানি, চাঁদের আলো।

আফজাল মৃদু হেসে বলল, আমি চাঁদের আলোর সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম।

লজ্জা পেয়ে নিগার মাথা নিচু করে বলল, তোমার নামের অর্থটা জানতে ইচ্ছা করছে।

বিজয়ী।

তোমার কী মনে হয় জীবনসগ্রামে তুমি বিজয়ী হবে?

আফজাল মৃদু হেসে বলল, আশা করি, ইনশাআল্লাহ হব।

তোমার নাম ছাড়া কিছুই জানি না। তাই দাদাজীকে যখন তোমার কথা বললাম তখন তিনি পরিচয় জানতে চাইলে নাম ছাড়া কিছুই বলতে পারি নি।

আফসানার কাছে আমার পরিচয় শোন নি?

শুনেছি; কিন্তু সেটা তো আমার আসল পরিচয় নয়। তা ছাড়া গ্রামের নাম মা-বাবার নাম, কতদূর লেখাপড়া করেছ, এখন কী করছ, সে-সব তো আফসানা কিছুই বলতে পারে নি।

জন্মস্থান শিঙ্গিমারী, মামার বাড়ি গোদ্দীমাড়ী। জেলা-লালমনিরহাট। মা বাবার নাম মরহুমা আফরিদা খাতুন ও মরহুম খলিলুর রহমান। মামার নাম আসাদুজ্জামান। প্রথমে কুরআন হেফজ করি। তারপর মাদ্রাসা থেকে কামিল পাশ করে একবছর হল ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছি।

ওমা, তা হলে তো তুমি ঢাকাতেই থাক? তারপর জিজ্ঞেস করল, উকিল চাচা একথা জানেন?

জানেন, তাঁকে বলতে আমি নিষেধ করেছি।

আফসানার কাছে শুনেছি, সাত বছর বয়সে তোমাকে একজন আলখেল্লাধারী লোক নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। তিনিই তা হলে তোমাকে লেখাপড়া করিয়েছেন?

হ্যাঁ, তিনিই আমাকে ছেলের মতো মানুষ করেছেন।

ওঁর বুঝি কোনো ছেলেমেয়ে নেই?

তা জানি না।

নিগার অবাক হয়ে বলল, জান না মানে?

জানি না মানে জানি না।

তোমাকে উনি ছেলের মতো মানুষ করেছেন বললে না?

তা বলেছি। সাত বছর বয়সে আমাকে এনে প্রথমে হাফেজী মাদ্রাসার বোর্ডিং এ রেখে হাফেজী পড়ান। তারপর আলিয়া সিস্টেমের মাদ্রাসা-বোডিং-এ রেখে কামিল পর্যন্ত পড়িয়ে শিক্ষকতার চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। উনি কোথায় থাকেন, কী করেন, আমি কিছুই জানি না। বছরে দু’তিনবার আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। আজ একবছর হতে চলল, উনি আর আসেন না।

উকিল-চাচার কাছে তা হলে বিশ বছরের কথাটা মিথ্যে করে বলেছিলে?

না, সত্যটাই বলে গোপন রাখতে বলেছিলাম। তাই হয়ত উনি কথাটা বানিয়ে বলেছেন।

তা হলে তুমি ওঁর পরিচয় জান না?

না।

জানতে চেয়েছিলে?

চেয়েছিলাম, মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, “আমার পরিচয় নিয়ে তুমি কী করবে? যদি দরকার হতো, আমি নিজেই বলতাম।” শেষবার যখন দেখা করতে এসেছিলেন, তখন কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন। সে-সময় মনে হয়েছিল, উনি হয়ত আর কখনো আসবেন না।

কী উপদেশ দিয়েছিলেন?

“কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, হিংসা ও অহংকার থেকে দূরে থাকবে। শয়তান মানুষের মনে প্রবেশ করে ঐ সব করার জন্য উৎসাহিত করে। তাই সবসময় সৎ চিন্তা ও আল্লাহকে স্মরণ করবে। তা হলে শয়তান তোমার মনে প্রবেশ করতে পারবে না। মানুষের সুখে সুখী ও দুঃখে দুঃখী হবে। সাধ্যমতো মানুষের উপকার করবে। দুস্থের সেবা করবে। কারো উপকার করা সাধ্যের বাইরে হলে তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া চাইবে। অন্যায়কে কোনোদিন প্রশ্রয় দেবে না। কুরআন হাদিসের যে জ্ঞান তুমি অর্জন করেছ, তা নিজে যেমন মেনে চলবে, তেমনি সাধ্যমতো অন্যকেও সেই জ্ঞান বিতরণ করে মেনে চালাবার চেষ্টা করবে।” এই পর্যন্ত বলে আফজাল কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, আর কিছু মনে পড়ছে না। মনে হয় এইগুলোই বলেছিলেন।

নানার সম্পত্তি পাওয়ার পর চাকরি ছেড়ে কি গ্রামে চলে যাবে?

অর্ধেক মা-বাবার নামে ওয়াকফ করে দুঃস্থদের জন্য কিছু করব।

যেমন?

গ্রামের দুঃস্থ লোকেরা যেন কাজ করে সংসার চালাতে পারে, সে-রকম উৎপাদনমূলক কিছু একটা করব। আর গরিব ও এতিম ছেলেদের জন্য এমন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করব, যেন বড় হয়ে নিজেরাই নিজেদের কর্মসংস্থান করতে পারে। তারপর ঘড়ি দেখে বলল, আফসানা আমাদেরকে একঘণ্টা সময় দিয়েছেন। আধঘণ্টা আমার কথা শুনলে, বাকি আধঘণ্টা তোমার কথা শুনব।

আফজালের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা শুনে নিগারের অন্তরটা জুড়িয়ে গেল। বলল, আমার সবকিছু তুমি তো আফসানার কাছে শুনছ। আর কী শুনতে চাও বল।

তোমার দাদাজী কি আমার সঙ্গে তোমাকে বিয়ে দিতে রাজি হবেন?

কালীগঞ্জে তুমি যখন প্রথম গিয়েছিলে এবং দাদজী তোমার কথা শুনে পাগল ভেবে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন তখন তোমাকে যে আমি ভালোবাসি এবং তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করব না, সে কথা বলেছিলাম। শুনে দাদাজী তোমার পরিচয় জানতে চান। তারপর যা কিছু কথাবার্তা হয়েছিল বলে বলল, লাঠিয়াল বাহিনী যে-দিন সোহরাব আলিকে পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে আসে, সেদিনের ঘটনার পর থেকে জাদুকর মনে করে তোমাকে ভুলে যাওয়ার জন্য আমাকে বলেন। আমি প্রতিবাদ করে বলি, তুমি জাদুকর নও এবং তোমাকে ছাড়া যে অন্য কাউকে বিয়ে করব না, সে-কথা আবারও বলি। দাদাজীর মনে বদ্ধ ধারণা, তুমি জাদুকর অথবা ম্যাসমেরিজিয়ান।

আর তোমার দাদিআম্মার মতামত?

দাদিআম্মা আমার ফরে। তিনি বিশ্বাস করেন না তুমি জাদুকর।

তোমার দাদাজী ও দাদিআম্মার মতামত আমি আগেই জেনেছি। তোমার দাদাজী ম্যানেজার সামসুদ্দিনের সঙ্গে বিয়ে দিতে চান। এ ব্যাপারে তোমার দাদি-আম্মা প্রথম দিকে তোমার ফরে থাকলেও এখন তোমার বিরুদ্ধে। তুমি জান কি না জানি না, সামসুদ্দিন তোমার দাদিআম্মার আপন ভাইপো। ভাইপোর হাতে তিনিও তোমাকে দিতে চান। সেই জন্য তোমার দাদাজী সামসুদ্দিনকে সে কথা জানিয়ে আমার খোঁজ নিতে বলেছেন। সামসুদ্দিন ভালো ছেলে হলেও রাজকন্যার সাথে রাজ্য পাওয়ার কথা শুনে লোভ সামলাতে পারেন নি। তাই তিনি আমার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

আফজালের কথা শুনে নিগার এত বেশি অবাক হলো যে, বেশ কিছুক্ষণ নির্বাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। কোনো কথা বলতে পারল না।

আফজাল মৃদু হেসে বলল, খুব অবাক হয়েছ তাই না? ভাবছ, তুমি যা জান না, তা আমি জানলাম কী করে?

নিগার আরো বেশি অবাক হয়ে ভাবল, আমি এখন যা ভাবছি, তাও বলে দিল কী করে? হঠাৎ তার দুপুরের স্বপ্নের কথা মনে পড়ল। বাটালী হীল থেকে পড়ে যাওয়ার সময় যে আলখেল্লাধারী শূন্যে তাকে ধরে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছিলেন; তাকে মানুষের মতো দেখতে হলেও এখন মানুষ বলে মনে হলো না। কারণ কোনো মানুষই শূন্যে ভাসতে পারে না। জিনেরা যে ইচ্ছেমতো যে-কোনো প্রাণীর সুরৎ ধরতে পারে ও উড়ে বেড়াতে পারে, নিগার তা জানত। ভাবল, আলখেল্লাধারী লোকটা জিন না তো? তার মন বলে উঠল, তোমার অনুমান ঠিক। আর ঐ জিনই আফজালকে মানুষ করেছেন। শুনেছি জিনেরা জাদু জানে। তা হলে ঐ লোকই কী আফজালকে জাদু শিখিয়েছেন?

তাকে এতক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে আফজাল বলল, কী হলো? কথা বলছ না কেন? মনে হচ্ছে কিছু একটা ভাবছ?

নিগার যেন এতক্ষণ বাস্তবে ছিল না। আফজালের কথা শুনে বাস্তবে ফিরে এসে বলল, তুমি তো মানুষের মনের কথা জানতে পার, বল না কী ভাবছিলাম?

মানুষের মনের কথা বা গায়েবের কথা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানতে পারে না। এটা কুরআন পাকের কথা।

তা হলে একটু আগে আমি যা ভাবছিলাম, তা বলে দিলে কী করে? শুনেছি, জিনেরা নাকি বলতে পারে?

আফজাল হেসে উঠে বলল, আমাকে কি জিন বলে তোমার মনে হয়?

না, তবে ঐ লোকটা তোমাকে এমন কিছু বিদ্যা শিখিয়েছেন, যার দ্বারা তুমি মানুষের মনের কথা জানতে পারে?

এক্ষুনি বললাম, না, “আল্লাহ ছাড়া মানুষের মনের কথা কেউ জানতে পারে না?” মনে রেখ, কেউ যদি একথা বিশ্বাস করে, তা হলে তার ইমান চলে যাবে। যা কিছু বলেছি অনুমান করে বলেছি। আমার অনুমান বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সঠিক হয়।

ম্যানেজার সামসুদ্দিন, দাদাজী ও দাদিআম্মার কথাও কি অনুমান করে বলেছ?

কিছু অনুসন্ধান আর কিছু অনুমান করে বলেছি।

এরকম অসম্ভব জিনিস বিশ্বাস করতে বলছ?

দুনিয়াতে এমন অনেক অসম্ভব জিনিস সম্ভব হচ্ছে, যার খবর বেশিরভাগ মানুষ জানে না।

আচ্ছা, যিনি তোমাকে মানুষ করেছেন, তিনি দেখতে কেমন ও কী পোশাকে থাকেন বল তো?

আফজাল কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে বলল, হঠাৎ এ প্রশ্ন?

পরে বলব, আগে তুমি বল।

বেশ লম্বা-চওড়া শরীর, মিশমিশে কালো, মাথায় টুপি, মুখ ও হাতের কব্জি ছাড়া সারা শরীর ঢিলে পোশাকে ঢেকে রাখেন।

তুমি তার কখনো পা দেখেছ?

এই কথা শুনে আফজাল চমকে উঠে ক্ষণিকের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। সাথে সাথে সামলে নিয়ে বলল, না, পা-ও পোশাকে ঢাকা থাকে। তারপর ঘড়ি দেখে বলল, কথায় কথায় একঘণ্টা পার হয়ে গেছে। ওঁরা দু’জন গেটে অপেক্ষা করছেন। চল, ওঠা যাক।

ওরা এখন সময়ের কথা ভুলে বিয়ের পর কী করবে না-করবে চিন্তায় বিভোর। ওদের কথা বাদ দাও, বলছি শোন, তোমার চিঠি পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমের মধ্যে একটা স্বপ্ন দেখি। তারপর নিগার স্বপ্নটা বলল।

স্বপ্নের ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেও আফজাল বলল, স্বপ্ন স্বপ্নই। এরকম স্বপ্ন মানুষ অনেক দেখে।

তা দেখে, কিন্তু তোমাকে যিনি মানুষ করেছেন, তাঁর চেহারার ও পোশাকের যে বর্ণনা দিলে, স্বপ্নে যিনি আমাকে শূন্যে ধরে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে। আমার মনে হচ্ছে, দু’জনে একই লোক এবং উনি জিন।

আফজাল যা বোঝার বুঝে গেল। বলল, তা হতে পারে, তবে উনি জিনই হোন আর মানুষই হোন, তা নিয়ে মাথা ঘামাবার কিছু নেই।

নিগার গাল ভার করে বলল, তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাচ্ছ।

আফজাল হেসে উঠে বলল, তাই যদি মনে কর, তা হলে তাই। তারপর নিগারের একটা হাত ধরে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, প্রায় আধঘণ্টা লেট হয়ে গেল। তারপর তার হাত ছেড়ে দিয়ে চলতে শুরু করল।

নিগারও তার পাশে চলতে শুরু করে বলল, তুমি আমার কাছে কিন্তু রহস্যই রয়ে গেলে?

আফজাল হেসে উঠে বলল, আসল পরিচয় দিয়েও রহস্যই রয়ে গেলাম?

হ্যাঁ।

কারণ?

কারণটা নিজের মনকে জিজ্ঞেস কর।

ঠিক আছে, বিয়ের পর সব রহস্য দূর করে দেব। এবার হলো তো?

হলো, কিন্তু বিয়েটা কিভাবে হবে বললে না তো?

সবার যেভাবে হয়, আমাদেরও ঠিক সেইভাবে হবে।

কিন্তু দাদাজী ও দাদিআম্মা যে ষড়যন্ত্র করছেন, তার কী হবে?

কিছুই হবে না। মানুষ অনেক কিছুই করতে চায়; কিন্তু তার সব কি করতে পারে? ততটুকু পারে, যতটুকু তার তকদিরে লেখা থাকে। তোমার যা কর্তব্য তুমি কর। আমিও আমার কর্তব্য করব। বাকি আল্লাহর যা মর্জি তাই হবে। আর একথা তো সবাই জানে, আল্লাহ যার সঙ্গে যার জোড়া করে পয়দা করেছেন, তার সঙ্গে জোড়া হবেই। আফসানার বিয়ের আগে হোক, পরে থোক, তোমার দাদাজীর সঙ্গে আমি দেখা করব। এ নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা কোরো না।  

ততক্ষণে তারা গেটের কাছে চলে এসেছে। আফসানা ও রিয়াজকে দেখতে পেয়ে নিগার বলল, দেখলে তো, আমার কথা ঠিক কি না?

আফজাল মৃদু হেসে বলল, তুমিও দেখলে তো, আমার কথাও ঠিক কি না? নিগার তার কথা বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে বলল, তুমি আবার কী বললে? আমিই তো বললাম, ওরাই আসতে লেট করবে?

আফজাল আবার মৃদু হেসে বলল, আমি যা বললাম, তা বুঝতে পার নি।

তা হলে বুঝিয়ে দাও।

ওঁদের ব্যাপারে যা বলেছিলে তা অনুমান করে, তাই না?

হ্যাঁ তাই।

তুমি যদি অনুমান করে সঠিক কিছু বলতে পার, তা হলে আমার অনুমানকে বিশ্বাস করলে না কেন?

নিগারও মৃদু হেসে বলল, আমার অনুমান স্বাভাবিক, আর তোমারটা যে অস্বাভাবিক?

যাদের চিন্তাশক্তি প্রখর তাদের অস্বাভাবিক অনুমানও সঠিক হয়।

এ কথা বলে যা কিছুই বোঝাতে চাও না কেন, বিয়ের পর রহস্যের উদ্ঘাটন করলে ছাড়ব না। এই কথা বলে নিগার হেসে উঠল।

রিয়াজ ও আফসানাকে আসতে দেখে আফজাল বলল, এই, হাসি থামাও, ওঁরা আসছেন।

কাছে এসে আফসানা নিগারের দিকে তাকিয়ে বলল, আধঘণ্টা লেট করে ফেললাম, মাফ করে দে।

আফসানা থেমে যেতে রিয়াজ বলল, ওর জন্যই আপনাদেরকে আধঘণ্টা কষ্ট দিলাম, কিছু মনে করবেন না।

নিগার কিছু বলার আগেই আফজাল হেসে উঠে বলল, মাফ চাওয়ার দরকার নেই। আর আমাদের মনে কিছু করারও নেই। মেহের নিগার আগেই জানতেন, আপনাদের ফিরতে লেট হবে। তাই একঘণ্টা পরে আমি যখন বললাম, এবার চল যাই তখন বলল…।

কথাটা তাকে শেষ করতে না দিয়ে নিগার মিষ্টি ধমকের স্বরে বলল, এই কী হচ্ছে? যা বলেছি, বললে ভালো হবে না কিন্তু।

হাসিমুখে আফজাল আফসানার দিকে তাকিয়ে বলল, বিয়ের আগেই আপনার বন্ধু ধমকাতে শুরু করেছে, বিয়ের পর কী করবে কী জানি। তারপর বলল, আপনিও নিশ্চয় রিয়াজ ভাইকে ধমকে লেট করিয়েছেন?

আফজালের কথা শুনে রিয়াজ হেসে উঠল।

আফসানা কিন্তু হাসল না। আবাক কণ্ঠে বলল, কিন্তু আশ্চর্য হচ্ছি, আপনি জানলেন কেমন করে?

এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? অনুমান করে বলেছি। তা ছাড়া মেয়েদের স্বভাব প্রায় একই রকম হয়।

নিগার বলল, তা হলে সব ছেলেদের স্বভাবও তো একইরকম হয়?

কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়। আমি তোমাকে লেট হওয়ার কথা যা বলেছিলাম, রিয়াজ ভাই আফসানাকে তাই বলেছেন কি না জিজ্ঞেস করলেই আমার কথার প্রমাণ হয়ে যাবে।

নিগার বুঝতে পারল, আফজালের কথাই ঠিক। তাই ঐ ব্যাপারে কিছু না বলে বলল, অত আর প্রমাণ করাতে হবে না, ফিরি চল।

আফজাল বলল, ফিরি বললেই তো ফেরা চলে না। কিছু নাস্তা-পানি করতে হবে। তার আগে চিড়িয়াখানার মসজিদে আসরের নামায পড়ে নিই চলুন। ওখানে মেয়েদেরও সব কিছুর ব্যবস্থা আছে। তারপর রিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি নামায পড়েন তো?

রিয়াজ বলল, অফকোর্স। মুসলমান হয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দ.) এর হুকুম মানব না, তা কী করে হয়?

নিগার বলল, শুধু কলেমা, নামাজ, রোযা, হজ ও যাকাত আদায় করলেও প্রকৃত মুসলমান হয় না।

রিয়াজ বলল, কেন হয় না? এগুলো তো ইসলামের মূল স্তম্ভ? আপনি ঠিক বলেন নি।

নিগার আফজালের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কী ভুল বললাম?

আফজাল বলল, না ভুল বল নি। তবে রিয়াজ ভাইয়ের কথাটাও ঠিক।

নিগার বলল, বুঝলাম না।

আফজাল বলল, বোঝাতে গেলে নামাযের ওয়াক্ত চলে যাবে। নামায পড়ে বোঝাব। চলুন আগে নামাযটা পড়ে নিই।

নামায পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে নিগার বলল, এক জায়গায় বসে আলাপ করলে ভালো হতো না?

আফসানা বলল, হ্যাঁ, সেটাই ভালো হবে?

চিড়িয়াখানার ভিতরে আম, জাম, কাঁঠাল, সুপারি ও প্রচুর পেয়ারা গাছ আছে। সেসব গাছের তলায় অনেক জায়গায় পাকা বেঞ্চও আছে। ওরা একটা বেঞ্চের উপর এসে বসল।

বসার পর আফসানা বলল, আফজাল ভাই, পেটে কিছু দিতে হবে। যা বলার একটু সংক্ষেপে বলবেন।

নিগার বলল, তুই থাম তো। সেই ছাত্রজীবন থেকে তোর শুধু পেটের চিন্তা। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে কী করবি কি জানি।

রিয়াজ বলল, তাই নাকি? তা হলে তো যা আয় করব, আপনার বন্ধু একাই অর্ধেক সাবাড় করে দেবে। এই কথায় সবাই হেসে উঠল।

আফসানা কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে দিয়ে আফজাল বলল, ঝগড়া-ঝাটি বাসায় গিয়ে করবেন। এখন যা বলছি শুনুন রিয়াজ ভাই যে স্তম্ভের কথা বলেছেন, তা অভ্রান্ত। ইসলামের মূল স্তম্ভ পাঁচটি। কলেমা, নামায, রোযা, হজ ও যাকাত। যে অর্থ বুঝে কলেমা মুখে পড়ে ও অন্তরে বিশ্বাস করে তাকে মুসলমান বলে। এই বিশ্বাস অর্থাৎ ইমান হলো ইসলামের ভীত। আর নামায, রোযা, হজ ও যাকাত হলো ঐ ভীতের উপর স্তম্ভ স্বরূপ। এই চারটি স্তম্ভের উপর ইসলামের সৌধ নির্মাণ হয়। সৌধ নির্মাণ করতে যেমন সিমেন্ট, বালি, রড ও মেহনত দরকার, তেমনি প্রকৃত মুসলমান হতে হলে ইসলামের জ্ঞান ও জ্ঞানের অনুশীলন ও অনুসরণের মেহনত করে আখলাক অর্থাৎ আদর্শ চরিত্র তৈরি করতে হবে। তা না করে কলেমা, নামায, রোযা, হজ ও যাকাত সম্পাদন করে শুধু ভীত ও স্তম্ভই তৈরি হবে, সৌধ নির্মাণ আর হবে না। অর্থাৎ প্রকৃত মুসলমান হতে পারবে না। বর্তমান যুগে মুসলমানরা শুধু ঐ পাঁচটি জিনিসকেই ধর্মের আইন মনে করে। আর মৌলবিদের মুখে শুনে, এইগুলো করলে আল্লাহ তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেবেন। তাই অনেকে এই পাঁচটি জিনিস মেনে চললেও আখলাকের (চরিত্রের) দিকে মোটেই লক্ষ রাখে না। তারা যেকোনো অন্যায় কাজ করতেও দ্বিধাবোধ করছে না। একদিকে যেমন ঐ পাঁচটি কাজ করছে, অপরদিকে তেমনি সুদ, ঘুষ, জুয়া, মদ, লটারি, মিথ্যে কথা, ধোঁকাবাজি ও সন্ত্রাসী করে জীবিকা নির্বাহ করছে। তাদের অধিকাংশ জানে না, এই সব করে জিবীকা নির্বাহ করলে নামায, রোযা, হজ, যাকাত ও দান-খয়রাত আল্লাহর কাছে কবুল হবে না। যদি এইসব কবুলই না হবে, তা হলে গুনাহ মাফ হবে কী। করে? একথা মসজিদের ইমাম বা মৌলবিরা বলেন না। এমন অনেক মুসলমান আছেন, যারা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে বিধর্মীদের ধর্মীয় উৎসবে টাকা দেয়। আর যারা প্রশাসনিক বিভাগে আছেন, তারা বিখ্যাত মৃত লেখক, কবি, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, রাজনীতিবিদ ও অন্যান্য জ্ঞানী-গুণীজনদের মূর্তি বানিয়ে বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করছেন। বিভিন্ন মাদকদ্রব্য বিক্রি ও আমদানি করার ও পতিতাবৃত্তির লাইসেন্স দিচ্ছেন। এই সমস্ত জিনিসকে আল্লাহ কুরআনপাকে হারাম করিয়াছেন। আজ মুসলমানরা শয়তানের ধোঁকাবাজিতে পড়ে কুরআন-হাদিসের বাণী উপেক্ষা করে নিজের নফসের ও মানুষের মতবাদ অনুসরণ করছে। অথচ আল্লাহ কুরআনপাকে বলিয়াছেন, “আমি কি তোমাদেরকে সতর্ক করিয়া দিই নাই হে আদম সন্তানগণ, (এবং জিনগণ) তোমরা শয়তানের পূজা করিও না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। আর ইহা (ও) যে, তোমরা কেবল আমারই ইবাদত কর; ইহাই সরল পথ। এবং (ইহাও জানাইয়া দেওয়া হইয়াছিল যে) সে পথভ্রষ্ট করিয়া দিয়াছে তোমাদের মধ্যকার এক বিরাট দলকে, তবুও তোমরা বুঝলে না?” [সূরা ইয়াসিন পারা ২৩, আয়াত- ৬০/৬১/৬২] যারা আল্লাহ ও রাসুল (দ.) এর বিধি নিষেধ মেনে চলে মানুষকে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে নিষেধ করেন, তাঁদেরকে ঐ তথাকথিত মুসলমানরা মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যায়িত করছেন। আর পশ্চিমা দেশগুলোর প্রশাসকরা মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িকের সাথে সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করেছেন এবং কূটনৈতিক চাল চেলে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর প্রশাসকদের দ্বারা তাঁদের উপর অত্যাচারের স্টিম রুলার চালাচ্ছেন। এটা যে মুসলিম জাতির জন্য আল্লাহর গজব তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আল্লাহ কুরআনপাকে বলিয়াছেন, “আর তোমাদের উপর যে-কোনো বিপদ (গজব) আপতিত হয়, তাহা তোমাদেরই হস্তের অর্জিত কার্যসমূহের দরুণ এবং বহু বিষয় তো তিনি ক্ষমা করিয়া দেন।” [সূরা-শূরা, পারা- ২৫, আয়াত-৩০] আজকাল অনেক মসজিদের ইমাম সাহেবরা শুধু সওয়াব কামাবার কথা জানাবার জন্য কুরআন-হাদিসের বিভিন্ন বাণী জুম্মার খুৎবার আগে বলে থাকেন। মসজিদকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করার জন্য মসজিদে দান করার ফজিলত বয়ান করেন। কিন্তু মুসলমানদের আখলাক (চরিত্র) গঠনের যে-সব বাণী কুরআন-হাদিসে বর্ণনা আছে, সেসব বয়ান করেন না। এমনকি মসজিদে হালাল উপার্জনের টাকা ব্যতীত হারাম উপার্জনের টাকা যে দেওয়া যাবে ন, সেকথাটা পর্যন্ত বলেন না। আজকাল মাদ্রাসাগুলোতেও আখলাকওয়ালা শিক্ষকের বড় অভাব। শিক্ষকরা যদি আখলাকওয়ালা না হলো, তা হলে ছাত্রদের কী করে আখলাক তৈরি হবে? শিক্ষকরা ও ছাত্ররা যদি আখলাকওয়ালা হতেন, তা হলে ছাত্ররা নকল করে পাশ করত না এবং হাজার হাজার ছাত্র নকল করতে গিয়ে ধরা পড়ে পরীক্ষার হল থেকে বিতাড়িত হতো না। মুসলমান কারা, আমরা মুসলমান হয়েও তা জানি না। যদি জানতাম, তা হলে কোনো নামাযি, রোযাদার, হাজি ও যাকাতদার কখনো সুদখোর, মদখোর, মিথ্যাবাদী, ব্যাভিচারী হতে পারতাম না। এগুলো শয়তানি কাজ। তাই আল্লাহ কুরআনপাকে বলিয়াছেন, “হে মমীনগণ, তোমরা পরিপূর্ণ ভাবে ইসলামে দাখিল হও, এভাবে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া চলিও না। বাস্তবিকই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” [সূরা বাক্বারা, পারা–১, ৮৫ নং আয়াতের শেষ দিকের অংশ] অন্যত্র আরো বলিয়াছেন, “তবে কি তোমরা ইমান রাখ কিতাবের কোনো কোনো অংশের প্রতি এবং অবিশ্বাস কর কোনো কোনো অংশকে। সুতরাং কি শাস্তি হইতে পারে তাহার যে তোমাদের মধ্যে এরূপ করে, পার্থিব জীবনে লাঞ্চনা এবং কিয়ামত দিবসে ভীষন আযাবে নিক্ষিপ্ত হওয়া ব্যতীত। আর আল্লাহ বেখবর নহেন তোমাদের কার্যালাপ সম্বন্ধে।” [সূরা- আযহাব, পারা-২২, ৩৬ নং আয়াত] কুরআনপাকে আল্লাহ আরো বলিয়াছেন, “মহান আল্লাহ তাঁর রাসুল (দ.) কোনো বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোনো মুমীন পুরুষ বা নারীর সে-বিষয়ে ভিন্নমত পোষণের অধিকার থাকবে না।” [সূরা বাক্বারা, পারা-২, ২০৮ নং আয়াত] যাই হোক সংক্ষেপে বলতে গিয়ে অনেক লম্বা করে ফেললাম। সেজন্য আপনারা বিরক্ত হলে, ক্ষমাপ্রার্থী। এবার চলুন, কিছু খেয়ে বাসায় ফেরা যাক। নচেৎ আরো দেরি করলে বাসায় গিয়ে মাগরিবের নামায পড়া যাবে না।

সবাই চলতে শুরু করার পর রিয়াজ বলল, আপনি খুব মূল্যবান কথা বলেছেন। বিরক্ত হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *