আমিও মানুষ – ৬

সবকিছু দেখাশোনা করার জন্য ইকতিদার আলি যে দশ-বারোজন লোক কাছারিবাড়িতে রেখেছেন, তাদেরকে পরিচালনা করার জন্য আগে যিনি ম্যানেজার ছিলেন, তিনি সালমা বেগমের বাবা জহিরউদ্দিন। জহিরউদ্দিনের বাড়ি কালীগঞ্জ থেকে প্রায় আট-দশ মাইল দূরে চন্দ্রপুর গ্রামে। তিনি খুব ধার্মীক লোক ছিলেন। তার সততা ও কবর্ত্যনিষ্ঠা ইকতিদার আলিকে আকৃষ্ট করে। তাই তাকে তিনি যেমন খুব বিশ্বাস করতেন তেমনি ভালোবাসতেন। ষাট বছর বয়সে যখন তিনি আবার বিয়ে করার কারণ বলে পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের শিক্ষিত কুমারী মেয়ের খোঁজ নিতে বলেন তখন জহিরউদ্দিন আনন্দিত মনে মেয়ের খোঁজ নিতে থাকেন। কিন্তু ঐ রকম মেয়ের কোনো বাবাই বুড়ো ইকতিদার আলির সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হলেন না। জহিরউদ্দিনের এক ছেলে ও মেয়ে। মেয়েকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়িয়েও আর্থিক কারণে বিয়ে দিতে পারেন নি। মেয়েটি দেখতে-শুনতে ভালো হলেও বিয়ে না দিতে পারার আরো একটা কারণ, তার দু’হাতেই ছয়টি করে আঙুল। ইকতিদার আলির কথামতো মেয়ের সন্ধান না পেয়ে জহিরউদ্দিন নিজের মেয়েকে ইকতিদার আলির সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার মনস্থ করেন। স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে মেয়েকে রাজি করান এবং ইকতিদার আলিকে তাঁর কথামতো পাত্রী না পাওয়ার কারণ জানিয়ে নিজের মেয়ের সব কিছু বলে প্রস্তাব দিলেন।

বিষয়-সম্পত্তির লোভে নিজের মেয়ের কথা বলছে ভেবে ইকতিদার আলি খুব রেগে গিয়ে তিরস্কার করে বললেন, তুমি খুব সৎ লোক জানতাম, কিন্তু মনেমনে এত লোভ-লালসা তা জানতাম না।

জহিরউদ্দিন আসলেই খুব ধার্মিক, সৎ, ও সহজ-সরল মানুষ। মেয়ের প্রস্তাব দিলে জমিদার যে তাকে তিরস্কার করে এই সব বলবে না, তা ভাবেন নি। কেঁদে ফেলে বললেন, আমার মনে এতটুকু লোভ-লালসা আছে কি না আল্লাহ ভালো জানেন। আপনি যে-রকম মেয়ে চান, সে-রকম না পেয়ে আপনাকে খুশি করার জন্য নিজের মেয়ের কথা বলেছি। এছাড়া যদি আমার মনে অন্য কোনো দুরভিসন্ধি থাকে, তা হলে আল্লাহ আমার উপর গজব নাজিল করবেন।

ইকতিদার আলি জহিরউদ্দিনের কথা অবিশ্বাস করতে পারলেন না। বললেন, ঠিক আছে, মেয়ের ফটো এনেছ?

তিনি আগেই বলেছিলেন, পাত্রীর খোঁজ পেলে তার ফটো নিয়ে আসবে। তাই জহিরউদ্দিন মেয়ের ফটো এনেছিলেন। বললেন, জি এনেছি। তারপর পকেট থেকে ফটোটা বের করে তার হাতে দিলেন।  

মেয়ের গড়ন ও চেহারা দেখে ইকতিদার আলির পছন্দ হলো। বললেন, জান জহিরউদ্দিন, ময়ের মুখে শুনছিলাম, যে মেয়ের হাতের আঙুল পাঁচটার বেশি হয়, সে ভাগ্যবান। কথাটা তখন বিশ্বাস না করলেও এখন করছি। সতিই তোমার মেয়ে ভাগ্যবতী। তা না হলে সুন্দরী ও শিক্ষিতা হলেও এতদিন বিয়ে হলো না। কেন? আমি রাজি। তবে খুব সাবধান, তোমার মেয়েকে বিয়ে করছি, একথা তুমি তোমার স্ত্রী ও তোমার মেয়ে ছাড়া অন্য কেউ যেন না জানে। তোমার আত্মীয় স্বজন জানবে, মেয়ের বিয়ে দিচ্ছ কালীগঞ্জে। পাত্র ও তার মা-বাবা সবাই বিদেশে থাকে। বিয়ের পর বৌকে নিয়ে বিদেশে চলে গেছে। আর বিয়ের ব্যাপারে যা কিছু করার আমি করব।

মাস খানেকের মধ্যে ইকতিদার আলি ম্যানেজার জহিরউদ্দিনের মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে আনেন। সেই মেয়েই সালমা বেগম। বিয়ের কয়েক বছর পর সালমা বেগমের পেটে যখন সন্তান এল না তখন ইকতিদার আলি একদিন জাহিরউদ্দিনকে বলেছিলেন, সন্তানের আশায় তোমার মেয়েকে বিয়ে করলাম; কিন্তু সে-আশা আমার পূরণ হলো না। মনে হয় এটাই আমার তকদির। অবশ্য এ ব্যাপার নিয়ে আমার দুঃখ থাকলেও তোমার মেয়ের অন্যান্য সবকিছুতে আমি খুশি। সব থেকে বড় কথা, আমাকে পাপের পথ থেকে ফিরিয়েছে।

জহিরউদ্দিন মনেমনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললেন, আল্লাহর হুকুম ছাড়া সারা মাখলুকাতে কিছুই হয় না। আমার মন বলছে, আপনার ছেলে বেঁচে আছেন এবং আল্লাহর ইচ্ছায় একদিন ফিরে আসবেন।

ইকতিদার আলি একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, তোমার কথা শুনে আমারও তাই মনে হচ্ছে।

মেয়ের বিয়ে দেওয়ার দশ বছর পর জহিরউদ্দিন মারা যান।

নতুন একজনকে জহিরউদ্দিনের জায়গায় নিয়োগ করার জন্য ইকতিদার আলি লোক খোঁজ করতে লাগলেন।

দীর্ঘ দশ বছর মা-বাবার মতো সালমা বেগমও ঘটনাটা চেপে রেখেছিলেন। কিন্তু গোপনে বাবার কাছ থেকে তাদের বাড়ির সব খোঁজ-খবর রাখতেন। ভাই এর ছেলে সামসুদ্দিন বি.এ. পাশ করে বেকার রয়েছে তাও জেনেছেন। তাই বাবা মারা যাওয়ার পর স্বামী যখন নতুন লোকের খোঁজ করছে শুনলেন তখন গোপনে সামসুদ্দিনকে একজন বিশ্বস্ত লোক মারফত ইকতিদার আলির সঙ্গে দেখা করতে বলেন।

লোকটা যখন সামসুদ্দিনকে কথাটা জানাল তখন সামসুদ্দিন তার পরিচয় জানতে চাইল।

লোকটা বলল, আমার পরিচয়ের দরকার কী? দরকার আপনার চাকরির। আপনার দাদাজী আজীবন উনার ম্যানেজার ছিলেন। পরিচয় পেলে চাকরিটা হয়ে যেতে পারে।

সামসুদ্দিনও ভেবেছিল, একদিন ইকতিদার আলির সঙ্গে দেখা করে বলবে, দাদাজীর পোস্টে না হলেও অন্য কোনো পোস্টে যেন নিয়োগ করেন। লোকটার কথা শুনে বলল, আমি দু’একদিনের মধ্যেই ইকতিদার আলির কাছে যাব। তারপর তাকে আপ্যায়ন করিয়ে বিদায় দিল।

পরের দিন মা-বাবাকে বলে সামসুদ্দিন কালীগঞ্জে গিয়ে ইকতিদার আলিকে পরিচয় দিয়ে চাকরি করার কথা জানাল।

সামসুদ্দিনের সুন্দর স্বাস্থ্য দেখে ও তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে ইকতিদার আলি খুশি হয়ে বললেন, তোমাকে ম্যানেজারের পদেই অস্থায়ী হিসাবে নিয়োগ করা হলো। সততা ও কর্মদক্ষতা যদি তোমার দাদাজীর মতো দেখাতে পার, তা হলে স্থায়ী হয়ে যাবে।

সামসুদ্দিন ভক্তি-গদগদ কণ্ঠে বলল, ইনশাআল্লাহ, আমি দাদাজীর পথ অনুসরণ করব।

আজ পাঁচ-ছয় বছর খুব সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সামসুদ্দিন এখানে কাজ করছে। ইকতিদার আলি তার প্রতি এত সন্তুষ্ট হয়েছেন যে, নাতনি নিগারের খোঁজ পাওয়ার আগে ভেবেছিলেন, তার নামে কিছু সম্পত্তি লেখাপড়া করে দিয়ে বাকি সবকিছু মরার আগে দেশ ও দশের জন্য দান করে দেবেন। তারপর নিগারকে পাওয়ার পর আগের চিন্তা বাদ দিয়ে সামসুদ্দিনের সঙ্গে নাতনির বিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করেছেন। কিন্তু সেকথা সালমা বেগমকে এখনো জানান নি। নাতনি নিগারের মুখে আফজালের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা শোনার পর থেকে চিন্তা করছেন, কিভাবে নিগারের জীবন থেকে আফজালকে সরান যায়। যেভাবে আফজালকে সরানোর প্লান করেছিলেন, আজকের ঘটনায় তা ভেস্তে পেছে। তাই সামসুদ্দিনকে দিয়ে নতুন প্লান তৈরি করলেন এবং নিগারকে কিভাবে আফজালের বিরুদ্ধে বিষিয়ে তোলা যায়, সেই চিন্তা করতে লাগলেন।

রাত্রে ঘুমাবার সময় স্বামীকে উশখুশ করতে দেখে সালমা বেগম বুঝতে পারলেন, তার ঘুম আসছে না। জিজ্ঞেস করলেন, শরীর খারাপ লাগছে?

ইকতিদার আলি বললেন, না, শরীর ঠিক আছে। খুব টেনশান ফিল করছি।

নিশ্চয় নিগার ও আফজালের কথা ভাবছ?

হ্যাঁ, ঠিক ধরছে।

ওদের নিয়ে অত ভাবছ কেন? শুনেছি, জন্ম, মৃত্যু, ও বিয়ে আল্লাহর হাতে। তিনি যার সাথে নিগারের জোড়া করে রেখেছেন, তার সাথেই হবে। ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়।

ঘুমাতে চাচ্ছি, কিন্তু মন তো আর চাকর-চাকরানি না যে, হুকুম করলেই শুনবে? শোন, চিন্তার কারণটা বলছি। নিগারকে পাওয়ার পর চিন্তা করেছিলাম, ম্যানেজার সামসুদ্দিনের সঙ্গে ওর বিয়ে দেব। তাই ঠিক করছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজটা সেরে ফেলব।

সালমা বেগম বিয়ের পর দশ বছর বাবাকে দেখলেও আজ ষোলো বছর মা, ভাই বা অন্য কোনো আত্মীয়স্বজনকে দেখেন নি। ভাইপো পাঁচ বছর ম্যানেজারের কাজ করলেও তার সামনে কোনোদিন যান নি। ভাইপোকে নাতজামাই করার কথা শুনে, তার স্বপ্ন সফল হতে যাচ্ছে জেনে ভীষণ খুশি হলেও স্বামীর উপর এত বছরের পুঞ্জীভূত অভিমান বারুদের মতো জ্বলে উঠল। কঠিন স্বরে না… বলে সালমা বেগম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।

ইকতিদার আলি স্ত্রীর মনের খবর কিছুটা বুঝতে পারলেন। তবু বললেন, এতে না করার কী আছে? আর কাঁদছই-বা কেন?

সামলে নিয়ে সালমা বেগম কঠিন স্বরেই বললেন, যে ইজ্জত বাঁচাবার জন্য আজ ষোলোটা বছর আমার পরিচয় গোপন করে রেখেছ, এখন আমার ভাইপোকে নাতজামাই করলে সেই ইজ্জতের হানী হবে না?

কথাটা অবশ্য তুমি ঠিক বলেছ এবং বলার অধিকারও তোমার আছে। তবে কী জান, সামসুদ্দিন ছাড়া এ তল্লাটে নিগারের উপযুক্ত কোনো ছেলে নেই। তা ছাড়া সামসুদ্দিন সুন্দর, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। তার সততা, কর্মদক্ষতা ও সদব্যবহার সবাইয়ের মন জয় করেছে। সে একটা রত্ন। আর রত্ন আমাদের ঘরেই শোভা পায়।  

তোমার কথার কখনো অবাধ্য হই নি। সারাজীবন ন্যায়-অন্যায় যা বলেছ, প্রতিবাদ না করে মাথা পেতে মেনে নিয়েছি। কিন্তু আজ আর মানব না। সামসুদ্দিনের সঙ্গে নিগারের বিয়ে কিছুতেই দিও না।

কেন? রাগ? অভিমান? না প্রতিশোধ?

কোনোটাই নয়।

তা হলে অন্য কারণটা বল।

নিগার তো আমাকে বলেছে, “সে আফজালকে ভালোবাসে। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে না”। যদি সামসুদ্দিনের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দাও, তা হলে সে আত্মঘাতী হবে।

ইকতিদার আলি গম্ভীর স্বরে বললেন, নিগার তোমাকে তাই বলেছে?

না বলে নি। তবে তার কথাবার্তায় তাই বোঝা গেছে। শোন, এক গুঁয়েমির জন্য ছেলেকে হারিয়েছ। এখন আবার সেই একগুঁয়েমি করে নাতনির বিয়ে দিলে বংশের একমাত্র প্রদীপ নাতনিকেও হারাবে। মনে রেখ, নিগারের শরীরে তোমারই রক্ত বইছে।

যুবক বয়স থাকলে ইকতিদার আলি স্ত্রীর এসব কথা পাত্তা দিতেন না। এখন বয়স হয়েছে, রক্তের গরম নেই। তবু একেবারে মেনে নিতে পারলেন না। বললেন,

তুমি সামসুদ্দিনের গুণগান গেয়ে নিগারকে বোঝাও। আমিও বোঝাব।

সালমা বেগম স্বামীকে ভালোভাবেই চেনেন, ভাঙবে তবু মচকাবে না। তার মনোভাব বুঝতে পেরে বললেন, তুমি যখন আমার এ কথাটাও রাখলে না তখন বলব, যাই কিছু বললো না কেন, জোর করে অথবা হঠাৎ করে সামসুদ্দিনের সঙ্গে নিগারের বিয়ে দিও না।

ঠিক আছে, আস্তে-ধীরে তোমাকে জানিয়েই যা করার করব।

সালমা বেগম দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, অনেক রাত হয়েছে, ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *