আমিই গোয়েন্দা – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

আমিই গোয়েন্দা – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

অনেকদিনের সাধ, ওই কলমটা কিনব, যেটা আমি মোক্তারবাবুর পকেটে দেখেছি। কী একটা কাজে গিয়েছিলুম। তিনি আমাকে দেখিয়েছিলেন। ভদ্রলোকের খুব কলমের শখ। আমারও কিছু কম নয়। তবে মোক্তারবাবুর প্রচুর পয়সা, আর আমি সামান্য কাজ করি। কলমটা নেড়েচেড়ে দেখেছিলুম লোভীর মতো। জাপানি কলম। টানলে বড় হয়। চেপে দিলে ছোট্ট এতটুকু। সোনার নিব। কোল্যাপসিবল কলম। কলমটা দেখার পর তিন রাত ঘুমোতে পারিনি। ওইরকম কলম আমার চাই। যতক্ষণ না পাচ্ছি, শান্তি নেই। লোভের মতো বিশ্রী অসুখ আর দুটো নেই।

মোক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করলুম, “কোথায়। পাওয়া যায় এমন কলম?”

“এসব বিদেশি জিনিস, সহজে পাওয়া যায় না বাবা। খবর রাখতে হয়। তোমাকে আমি কয়েকটা ঠিকানা দিচ্ছি।”

তিনটে দোকানের ঠিকানা দিলেন। যা টাকা-পয়সা ছিল, সব পকেটে ভরে কলমের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লুম। কলমটা আমার চাই-ই চাই। অ্যাট এনি কস্ট। প্রয়োজন হলে হাতঘড়িটা বেচে দেব। কলমটার জন্য খেপে গেলুম। কলম ছোট হয়, কলম বড় হয়। সরু চুলের মতো রেখা পড়ে। ছাই রং। স্টেনলেস স্টিলের ব্যান্ড লাগানো। কী জিনিস তৈরি করেছে জাপান!

প্রথম দোকানের মালিক বললেন, “দু’পিস এসেছিল, বিক্রি হয়ে গেছে।” পরে আর আসবে কি না বলতে পারছেন না। দ্বিতীয় দোকান বললে, ওরকম কলম তাঁরা জীবনে দেখেননি। “শেফার আছে, পার্কার আছে, সবই জাতের কলম, নিতে হয় নিন। কলম ছোট হয়, কলম বড় হয়, তাতে আপনার কী! লিখবেন, না ম্যাজিক দেখাবেন।”

বেরসিক মানুষটিকে বোঝাই কী করে, সব কলমই তো লেখে, কিন্তু কোন কলম ছোট বড় হয়। তৃতীয় দোকানের মালিক বললেন, একটা আছে, তবে তাঁর কাছে নেই, আনিয়ে দিতে পারেন। “অপেক্ষা করতে হবে। ঘণ্টাখানেক পরে কলমটা পাওয়া যেতে পারে। আপনি নেবেন তো, না দেখে ছেড়ে দেবেন।”

“আরে মশাই, আমি নেব। টাকাটা না হয় আপনি আগেই নিয়ে নিন।”

সহকারীকে কী একটা বললেন গুজরাতি ভাষায়, তিনি বেরিয়ে গেলেন। আমার অপেক্ষার পালা। সেই কলম আসছে। ছাই ছাই রং। স্টিলের ব্যান্ড। ছোট্ট, সোনার নিব। এই ছোট, তো টানলে বড়। সেই মুহূর্তে আমার মতো সুখী সারা কলকাতা শহরে আর একজনও কেউ ছিল কি! এক ঘণ্টা পরেই একটা কলমের মালিক হব আমি।

ব্যবসায়ীদের তল্লাট। কিছু দূরেই স্টক এক্সচেঞ্জ। শেয়ার মার্কেট। কলকাতার যত পয়সাঅলা লোক চারপাশে ব্যস্ত গণ্ডারের মতো ঘুরছেন। তাঁরা টাকা ছাড়া আর কিছু বোঝেন না। পাশেই চিনাবাজার। লরি, ঠেলা আর মোটরবাইকের গুঁতোগুঁতি। উত্তাল কলকাতা তিড়িংবিড়িং লাফাচ্ছে। তার মাঝে আমি এক পাগল। কলমপাগল।

সময়টা কাটাতে হবে। কী করি! রাস্তায় দাঁড়ানো যাচ্ছে না। লোকের পর লোক গুঁতিয়ে চলে যাচ্ছে। এ-পাড়ায় কলকাতার সেই বিখ্যাত শিঙাড়ার দোকান। এক- একটার জামদানি চেহারা। পুরোটাই ঘিয়ে ভাজা। ভাবলুম, ওই গরম শিঙাড়া নিয়ে বসলে সহজেই অনেকটা সময় কেটে যাবে। একটু করে ভাঙব, ফুস করে গরম বাতাস বেরোবে, মুখে পুরে হু হা করব। এ-পাড়ায় সামোসা মরিচের ঝালে উগ্র। একটাকে কাবু করতেই একঘণ্টা কাবার।

দোকানটা তেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নয়। কিন্তু খাবার উত্তম। উঁচু জায়গায় বসে ভীমের মতো এক ভদ্রলোক শিঙাড়া ভাজছেন। বিশাল কড়া, বিশাল তাওয়া। ভাল ঘিয়ের গন্ধে বাতাস আকুল। একটা নয়, দুটো শিঙাড়ার অর্ডার দিলুম। যা ভেবেছিলুম তাই, আগুন দিয়ে তৈরি। পাতার ওপর খেলাতে খেলাতেই সময় কেটে গেল। গরমে আর ঝালে জ্বলেপুড়ে কলমের দোকানে হাজির হলুম। কলম এসে গেছে, আমার স্বপ্নের কলম। পাতলা প্লাস্টিকের খাপে। দাম দিয়ে কলম পকেটস্থ করে কলকাতার ভিড়ে ঝাঁপ মারলুম। ব্র্যাবোর্ন রোড ধরে হাঁটছি আর ভাবছি, কেউ জানে না, আমার কত সুখ। এই কলমটা পাওয়ার জন্যই আমি যেন জন্মেছিলুম। মিনিট দশেক হাঁটার পর মনে হল, কলমটা পাশপকেটে রাখার চেয়ে বুকপকেটে আটকে রাখাই ভাল। পাশপকেট থেকে যদি পড়ে যায়! ট্রামে বাসে উঠছি না যখন, তখন পকেটমারের ভয় নেই। বুকপকেটে হৃদয়ের কাছাকাছিই থাক না। খাপ খুলে কলমটা বুকপকেটে রেখে হাঁটছি। একটু একটু গান গাইছি। ভাবছি, প্রথম লেখাটা কী লিখব! আমার জামশেদপুরের বন্ধুকে একটা চিঠি! না, একটা কবিতা!

নিজের চিন্তায় মশগুল হয়ে পথ হাঁটছি। বুকপকেটে সেই আহামরি কলম। বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে পড়লুম। যাব ভিক্টোরিয়া হাউসের দিকে। বাঁ দিকের ফুটপাথ। তেমন একটা ভিড় নেই। ভিক্টোরিয়া হাউসের বাক্সে ইলেকট্রিক বিলের চেক ফেলব। গেটের কাছ বরাবর গিয়ে বুকপকেটের দিকে তাকিয়ে দেখি পেনটা নেই।

মাথা ঘুরে গেল।

পাশপকেটে নেই, বুকপকেটে নেই। কোথাও নেই। মাথা ঘুরে গেল। পেন পকেটমার। বাসে ট্রামে উঠলুম না৷ ফাঁকা রাস্তা দিয়ে এলুম। পকেটমার এল কোথা থেকে। এ কি ইটালিয়ান পকেটমার। শুনেছি ইটালির পকেটমাররা অসাধ্য সাধন করতে পারে। সামনে, পেছনে যত দূর দৃষ্টি যায়, তাকালুম। পকেটমারের মতো কাউকেই দেখলুম না। সব নিরীহ, শান্ত ভদ্রলোক নিজেদের কাজে আসা-যাওয়া করছেন।

চোখে জল এসে গেল। ভগবান। কলমটা তুমি দিয়েও নিয়ে নিলে! এ কোনও মানুষের কাজ নয় ভগবান, এ তোমারই খেলা। তবু মন মানতে চাইছে না। কলমটা এইভাবে ভ্যানিশ হয়ে যাবে? এইভাবে আমি বোকা বনে যাব?

অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলুম। এতটাই বোকা আমি। পকেট থেকে পড়ে যায়নি। যেতে পারে না। ক্লিপের গ্রিপটা যথেষ্ট ভালই ছিল। আমি একবারও সামনে ঝুঁকিনি। সেই কখন থেকে খাড়া হেঁটে আসছি। অদৃশ্য কোনও হাত কলমটা তুলে নিয়েছে। আমার ধারেকাছে কেউ আসেনি। কোনও ভিড় ছিল না। কেউ গা ঘেঁষাঘেঁষি করেনি। তা হলে হাতটা এল কোথা থেকে!

ভাবতে ভাবতে নিজেই একজন গোয়েন্দা হয়ে গেলুম। ফেলে আসা পথের দিকে তাকালুম। বোম্বে সুইটস-এর দোকানটা যেখানে, সেখানে আমি একবার পকেটে হাত চেপে দেখেছিলুম পেনটা আছে। বোম্বে সুইট্‌স থেকে ভিক্টোরিয়া হাউস, এর মাঝেই ঘটনাটা ঘটে গেছে। যখন আসছিলুম, তখন আমার বাঁ দিকে সার সার দোকান। পরিষ্কার ফুটপাথ ধরে হাঁটছি। ডানপাশে রাস্তা। এই তো ঘটনা। আমার ত্রিসীমানায় কেউ আসেনি। বলো গোয়েন্দা, কে আমার কলম নিয়েছে! ভূতে!

ফেলে-আসা ফুটপাথের মাঝামাঝি জায়গায়, একপাশে দাঁড়িয়ে একটা লোক গামছা বিক্রি করছে। একটা গামছার পাট খুলে দু’হাতে ধরে দোলাচ্ছে এ-পাশে ও-পাশে আর হাঁকছে, “গামছা, গামছা।” গামছার ঝাপটা কোনও কোনও পথচারীর গায়ে লাগছে। এইরকম একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে লোকটা গামছা বিক্রি করছে কেন! আবার গামছাটা বিছিয়ে এ-পাশ, ও-পাশ দোলাচ্ছে! মাথায় একটা ঝলক খেলে গেল।

লোকটার দিকে এগিয়ে গেলুম।

ভেবেছে, খদ্দের!

ঝপ করে গামছার কোনাটা চেপে ধরলুম। তলার দুটো কোণ একসঙ্গে। শক্তমতো একটা কী ঝুলছে। লোকটা অবাক হয়ে বললে, “কেয়া বাবু?”

“মেরা কলম।”

“কলম?”

আমি ততক্ষণে ঝুলন্ত কলমটা গামছার জালি জালি আঁচল থেকে উদ্ধার করে ফেলেছি। আমার সেই ছাই ছাই রঙের সুন্দর জাপানি কলম।

লোকটা হতভম্ব। বলছে, “মেরা কুছ কসুর নেহি।”

কলম পেয়ে গেছি। সেই আনন্দেই আমি বিভোর। লোকটাকে আর বলব কী! পরে এক পুলিশ অফিসার আমাকে বলেছিলেন, ওই গামছাঅলা খুব ইনোসেন্ট ছিল না। ওটাও একটা কায়দা।

না, তা নয়, লোকটা নিরপরাধ। কারণ, লোকটাকে ধরার আগে আমি অনেকক্ষণ তাকে চোখে চোখে রেখেছিলাম। লোকটা, আপন মনে গামছা দোলাচ্ছে। দুলিয়েই যাচ্ছে। অসৎ উদ্দেশ্য থাকলে, বঁড়শি থেকে মাছ খুলে নেওয়ার মতো গামছা থেকে পেনটা খুলে নিত। তা করেনি।

আবার এও হতে পারে, লোকটা আমাকে নজরে রেখেছিল।

কী জানি কী!

২৩ ডিসেম্বর ১৯৯২

অলংকরণ : দেবাশিস দেব

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *