ষষ্ঠ খণ্ড (পরম পূজনীয়া পরিব্রাজিকা প্রজ্ঞা হৃদয়া করকমলে)
সপ্তম খণ্ড (স্নেহের অলোক রায়চৌধুরী ও ইন্দিরাকে)
অষ্টম খণ্ড (ডা: শ্রী বিজয়চাঁদ কুমার ও শ্রীমতী তপতী কুমার শ্রদ্ধাভাজনেষু)
5 of 6

আমার সাজানো বাগান

আমার সাজানো বাগান

সময়ের বড়ই অভাব। আমি সম্রাট নই, প্রধানমন্ত্রী নই, সেনাধ্যক্ষ নই। সামান্য একজন মানুষ। তবু আমার সময় নেই। আলস্যে আমার দিন কাটে না। সব সময় চরকিপাক খেয়ে বেড়াচ্ছি। কিন্তু কারণটা কী? কারণ জানি না। এইটুকু জানি, সকালে বিছানায় কিছুক্ষণ গড়িমসি করার উপায় নেই। ছটা বেজে গেল। ছটা বেজে গেল। ছটা বেজে গেল তো কী হল? সংসার যেন অচল হয়ে গেল! মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।

হবে না কেন? যৌথ পরিবার ভেঙে বেরিয়ে আসার সময় মনে ছিল না? আরামে থাকব। স্বামী-স্ত্রী। মানানসই ফ্ল্যাট। একটি কি দুটি প্লাম কেকের মতো সুখী-সুখী সোহাগি বাচ্চা। আমার বউয়ের সঙ্গে তেমন বনিবনা হচ্ছে না, তাই। মা সেকেলে, বাবা বয়সে একটু খিটখিটে। যুগও পালটে গেছে। স্ত্রী মানে ক্রীতদাসী নয়। এখনকার স্ত্রী হল সখা, সচিব, কমরেড। তুমি আর আমি পাশাপাশি। আমার চাপে তুমি চ্যাপ্টা হবে না, তোমার চাপেও আমি চিঁড়ে হব না। মানে, হবার কথা নয়। তবে তোমার অত্যাচারকে আবদারকে ‘উইথ প্লেজার’ আমি মেনে নিতেও পারি। কারণ তুমি রমণী, মনোহারিণী। স্ত্রীদের আদল চরিত্র সবই যখন পালটে গেছে, তখন সংসারের চেহারা তো পালটাবেই। এখন আর দয়া করে যেন বলে বসো না, টকের জ্বালায় পালিয়ে এসে তেঁতুল তলায় বাসা। শুনতে পেলে, যাঁদের ছেড়ে পালিয়ে এসেছে তাঁরা খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হেসে উঠবেন। নির্ঝঞ্ঝাটে থাকব বলে সরে যখন এসেছি, তখন ভুগতে তো হবেই।

সেদিন তো আর নেই। বড় যাবে বাজারে, মেজো যাবে দুধ আনতে, সোনা বসবে বড়র ছেলেকে পড়াতে। বড় শুয়ে পড়লে বাকি তিনজন হাল ধরবে সংসারের। তুমি অচল তো আমি সচল। ভেন্ন হয়ে বড় সুখ, তাই না হরিদাস! ‘কেমন আছ’ প্রশ্ন করলে অত আমতা-আমতা করো কেন ভাই? হেঁকে বল, বেশ আছি, তোফা আছি। অমন কেঁউ কেঁউ করো কী জন্যে? যাও, সকালে গিয়ে দুধের লাইনে বোতল হাতে দাঁড়াও। সেখান থেকে যাও বাজারে। হন্তদন্ত হয়ে ফিরে দাড়ি কামাতে-কামাতে ছেলেকে গোটা দুই অঙ্ক। নাকে মুখে গুঁজেই ছেলেকে টানতে-টানতে স্কুলে। স্কুলে ফেলে দিয়েই ঝুলতে-ঝুলতে অফিস। ছেলেকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব স্ত্রীর।

এ সবের পুরস্কার? যৎসামান্য। যেমন? সকালে মাছের টুকরোটা একটু বড় হয়। রোজ একটা করে ডিম জোটে। দুধ এক কাপ। রাতের দিকে মাঝে মধ্যে ফুলকো লুচি। খেতে-খেতে মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার কথা। আমরা তিন ভাই, বাবা, কাকা, জ্যাঠা দেশের বাড়িতে পাতা পেড়ে খেতে বসেছি, মা পরিবেশন করছেন ঝুঁকে-ঝুঁকে। কোথায় গেল সেই অমৃত? এখন অমৃতকে কেন গরল মনে হয়। এই তো এত ভালো খাবার টেবিল, চিনে মাটির ভালো ভালো ডিশ, চকচকে চামচে, ঝকঝকে গেলাস। স্বার্থপরতার দেখি অসীম ক্ষমতা। মানুষের মনটাকেও মেরে দেয়।

যন্ত্রমানবের মতো কী সুখে যে বেঁচে আছি! জীবনের আকাশে সারাদিন লাট খাচ্ছি ছটফটে ঘুড়ির মতো, হাত-পা ছড়িয়ে দু-দণ্ড বসার অবকাশ নেই। মনও স্থির নয়।

অনিশ্চয়তার দৈত্য পেছন-পেছন তাড়া করছে। জীবনের চলার পথে তার ছায়া পড়ছে লম্বা হয়ে। কুরে-কুরে খাচ্ছে সেই ভীষণ দুর্ভাবনা—যদি পড়ে যাই, যদি আর চলতে না পারি, যদি নিবে যাই দপ করে, তাহলে এই স্বার্থপরের সাজানো বাগানের মালি কে হবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *