আমার সম্পাদক শিকার
হাম কিংবা টাইফয়েড়, সর্পাঘাত কিংবা মোটরচাপা, জলে ডোবা কিংবা গাছ থেকে পড়ে যাওয়া, এগজামিনে ফেল করা, কিংবা কাঁকড়া-বিছে কামড়ানো–জন্মাবার পর এক কোনো না কোনটা কারু-না-কারু বরাতে কখনো কখনো একবার ঘটেই। অবশ্য যে মোটর চাপা পড়ে তার সপার্ঘাত হওয়া খুব শক্ত ব্যাপার, সেরকম আশঙ্কা প্রায় নেই বললেই হয়, এবং যার সর্পাঘাত হয় তাকে আর গাছ থেকে পড়তে হয় না। যে ব্যক্তি জলে ডুবে যায় মোটরচাপা পড়ার সুযোগ তার যৎসামান্যই এবং উঁচু দেখে গাছ থেকে ভাল করে পড়তে পারলে তার আর জলে ডোবার ভয় থাকে না। তবে কাঁকড়া-বিছের কামড়ের পরেও এগজামিনে ফেল করা সম্ভব, এবং অনেকক্ষেত্রে হামের ধাক্কা সামলাবার পরেও টাইফয়েড হতে দেখা গেছে। হামেশাই দেখা যায়।
কিন্তু বলছিই, এসব কাজ কারু না কারু অদৃষ্টে ঘটে কখনো বা কদাচ। কিন্তু একটা দুর্ঘটনা প্রায় সবারই জীবনে একটা নির্দিষ্ট সময়ে অনিবার্যরূপে প্রকট হয়, তার ব্যকিক্রম খুব বড় একটা দেখা যায় না। আমি গোঁফ ওঠার কথা বলছিলেন–তার চেয়ে শক্ত ব্যারাম–গোঁফ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে লেখক হবার প্রেরণা মানুষকে পেয়ে বসে।
আমরাও তাই হয়েছিল। প্রথম গল্প লেখার সূত্রপাতেই আমার ধারণা হয়ে গেল আমি দোলগোবিন্দবাবুর মতো লিখছে পেরেছি। দোলগোবিন্দকে আমি রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ মনে করতাম–কেননা একই কাগজে দুজনের নাম একই টাইপে ছাপার অক্ষরে দেখেছিলাম আমি। এমন কি অনেক সময়ে দোলগোবিন্দকে রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বড় লেখক আমার বিবেচনা হয়েছে– তার লেখা কেমন জলের মতো বোঝা যায়, অথচ বোঝার মতন মাথায় চাপে না! কেন যে তিনি নোবেল। প্রাইজের জন্য চেষ্টা করেন না, সেই গোঁফ ওঠার প্রাক্কালে অনেকবার আমি আন্দোলন করেছি–অবশ্যি মনে মনে। একন বুঝতে পারছি পণ্ডিচেরী, কিংবা পাশাপাশি, রাঁচীতে তার পরামর্শ দেবার কেউ ছিল না বলেই। আরও দুঃখের বিষয়, রবীন্দ্রনাথের লেখা এখনও চোখে পড়ে থাকে কিন্তু কোনো কাগজ কোনো কাগজ-পত্রেই দোলগোবিন্দ বাবুর আর দেখা পাই না।
যাই হোক, গল্পটা লিখেই বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ মাসিকপত্রে, দোলগোবিন্দ বা বরীন্দ্রনাথের রচনার ঠিক পাশেই সেটা প্রকাশ করার জন্য পাঠিয়ে দিলাম। নিশ্চিন্তে বসে আছি যে নিশ্চয়ই ছাপা হবে এবং ছাপার অক্ষরে লেখাটা দেখে কেবল আমি কেন, রবীন্দ্রনাথ, এমন কি স্বয়ং দোলগোবিন্দ পর্যন্ত পুলকিত হয়ে উঠবেন–ও হরি! পর পর তিন মাস হবার পরে একদিন দেখি বুকপোস্টের ছদ্মবেশে লেখাটা আমার কাছেই আবার ফিরে এসেছে। ভারী মর্মাহত হলাম। বলাই বাহুল্য! শোচনীয়তা আরও বেশি এইজন্য যে তিন মাসে তিনখানা কাগজ কিনেছিলাম–খতিয়ে দেখলাম সেই দেড়টা টাকাই ব্যাটাদের লাভ!
তারপর, এক একে আর যে-কটা নামজাদা মাসিক ছিল সবাইকে যাচাই করা হল–কিন্তু ফল একই। আট আনার পেট-মোটাদের ছেড়ে ছ-আনার কাগজদের ধরলাম–অবশেষে চার আনা দামের নব্যপন্থীদেরও বাজিয়ে দেখা গেল। নাঃ, সব শেয়ালের একই রা! হ্যাঁ, গল্পটা ভালই, তবে ছাপতে তারা অক্ষম! আরে বাপ, এত অক্ষমতা যে কেন তাতো আমি বুঝতে পারি নে, যখন এত লেখাই অনায়াসে ছাপতে পারছ তোমরা! মাসিক থেকে পাক্ষিক–পাক্ষিক থেকে সাপ্তাহিক নামলাম; অগত্যা লেখাটার দারুণ অমর্যাদা ঘটছে জেনেও দৈনিক সংবাদপত্রেই প্রকাশের জন্য পাঠালাম। কিন্তু সেখান থেকেও ফেরত এল। দৈনিকে নাকি অত বড় সংবাদ ধরবার জায়গাই নেই। আশ্চর্য! এত আজেবাজে বিজ্ঞাপন যা কেউ পড়ে না তার জন্য জায়গা আছে, আমার বেলাই যত স্থানাভাব? বিজ্ঞাপন বাদ দিয়ে ছাপলেই তো হয়। কিন্তু অদ্ভুত এঁদের একগুয়েমি–সব সংবাদপত্র থেকেই বারম্বার সেই একই দুঃসংবাদ পাওয়া গেল।
তখন বিরক্ত হয়ে, শহর ছেড়ে মফঃস্বলের দিকে লক্ষ্য দিতে হল । অর্থাৎ লেখাটা দিগ্বিদিকে পাঠাতে শুরু করলাম। মেদিনীপুর-মন্থন, চুঁচুড়া-চন্দ্রিকা, বাঁকুড়া–হরকরা, ফরিদপুর- সমাচার, গৌহাটি-গবাক্ষ, মালদহের গৌড়বান্ধব–কারুকেই বাদ রাখলাম না। কিন্তু শহরে পেট-মোটাদের কাছ থেকে যে দুর্ব্যবহার পাওয়া গেছে, পাড়াগেঁয়ে ছিটে ফোঁটাদের কাছে তার রকমফের হল না। আমার বিরুদ্ধে দেশব্যাগী এক দারুণ ষড়যন্ত্র আমার সন্দেহ হতে লাগল।
এইভাবে সেই প্রথম ও পুরোবর্তী লেখার ওপরে ট্রাই এন্ড ট্রাই এগেন পলিসির কার্য্যকারিতা পরীক্ষা করতেই বাংলা মুলুকের তাবৎ কাগজ আর সাড়ে তিন বছর গড়িয়ে গেল বাকি রইল কেবল একখানি কাগজ কৃষি সম্বন্ধীয় সাপ্তাহিক। চাষাড়ে কাগজ বলেই কি ওর দিকে এতাবৎ আমি মনোযোগ দিইনি, তারা কি আমার এই সাহিত্য রচনার মূল্য বুঝবে? ফেরত তো দেবেই, হয়তো সঙ্গে সঙ্গে বলে পাঠাবে, মশাই আপনার আষাড়ে গল্প আমাদের কাগজে অচল; তার চেয়ে ফুলকপির চাষ সম্বন্ধে যদি আপনার কোনো বক্তব্য থাকে তা লিখে পাঠালে বরং আমরা বেয়ে চেয়ে দেখতে পারি।
এই ভয়েই এতদিন ওধারে তাকাইনি কিন্তু এখন আর আমার ভয় কি? (ডুবন্ত লোক কি কুটো ধরতে ভয় করে?) কিন্তু না; ওদের কাছে আর ডাকে পাঠানো নয়, অনেক ডাকখরচা গেছে অ্যাদ্দিন, এবার লেখা সমভিব্যাহারে আমি নিজেই যাব।
দেখুন আপনি–আপনিই সম্পাদক, না? আমি–আমি একটা একটা লেখা এনেছিলাম আমি–? উক্ত সম্পাদকের সামনে হাজির হয়ে হাঁক পাড়লাম।
গভীর ভদ্রলোক চশমার ফাঁকে কটাক্ষ করলেন–কই দেখি!
একটা গল্প। একেবারে নতুন ধরনের–আপনি পড়লেই বুঝতে পারবেন। লেখাটা বাড়ির দিলাম আনকোরা প্লটে আনকোরা স্টাইলে একেবারে–
ভদ্রলোক গল্পে মনোযোগ দিয়েছেন দেখ আমি দেখে আমি বাক্যযোগ স্থগিত রাখলাম। একটু পড়তেই সম্পাদকের কপাল কুঞ্চিত হল, তারপর ঠোঁট বেঁকে গেল, নাক সিটকাল, দাড়িতে হাত পড়ল,যতই তিনি এগুতে লাগলেন, ততই তা চোখ-মুখের চেহারা বদলাতে লাগল, অবশেষে পড়া শেষ করে যখন তিনি আমার দিকে তাকালেন তখন বদলাতে লাগল, অবশেষে পড়া শেষ করে যখন তিনি আমার দিকে তাকালেন তখন মনে হল তিনি যেন হতভম্ব হয়ে গেলেন। হতেই হবে। কিরকম লেখা একখান!
হ্যাঁ, পড়ে দেখলাম-নিতান্ত মন্দ হয়নি। তবে এটা যে একটা গল্প তা জানা গেল আপনি গল্পের নামের পাশে ব্র্যাকেটের মধ্যে কথাটা লিখে দিয়েছেন বলে –নতুবা বোঝার আর কোনো উপায় ছিল না।
তা বটে। আপনারা সম্পাদকরা যদি ছাপেন তবেই নতুন লেখক আমরা উৎসাহ পাই। বলতে বলতে আমি গলে গেলাম, এ গল্পটা আপনার ভাল লেগেছে তাহলে?
লেগেছে এক রকম। তা এটা কি–
হ্যাঁ অনায়াসে! আপনার কাগজের জন্যেই তো এনেছি।
আমার কাগজের জন্য? ভদ্রলোক বসেই ছিলেন কিন্তু মনে হল যেন আরো একটু বসে গেলেন, তা আপনি কি এর আগে আর কখনও লিখেছেন?
ঈষৎ গর্বের সঙ্গেই আমি জবাব দিলাম–নাঃ, এই আমার প্রথম চেষ্টা।
প্রথম চেষ্টা? বটে? ভদ্রলোক ঢোঁক গিললেন, আপনার ঘড়িতে কটা এখন?
ঘড়িটা পকেট থেকে বার করে অপ্রস্তুত হলাম, মনে পড়ল কদিন থেকেই এটা বন্ধ যাচ্ছে, অথচ ঘড়ির দোকানে দেওয়ার অবকাশ ঘটেনি। সত্য কথা বলতে কি, সম্পাদকের কাছে ঘড়ি না হোক অন্ততঃ ঘড়ি চিহ্নমাত্র না নিয়ে যাওয়াটা বে-স্টাইলি হবে ভেবেই আজ পর্যন্ত ওটা সারাতে দিইনি। এখান থেকে বেরিয়েই বরাবর ঘড়ির দোকানে যাব এই মতলব ছিল।
ঘড়িটাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম–নাঃ বন্ধ হয়ে গেছে দেখছি। কদিন থেকেই মাঝে মাঝে বন্ধ যাচ্ছে।
তাই নাকি? দেখি তো একবার? তিনি হাত বাড়ালেন।
ঘড়ি মেরামতও জানেন নাকি আপনি? আমি সমভরে উচ্চারণ করলাম।
জানি বলেই তো মনে হয়। কই দেখি, চালানো যায় কিনা।
আমি আগ্রহভরে ঘড়িটা ওঁর হাতে দিলাম–যদি নিখরচায় লেখা আর ঘড়ি একসঙ্গে চালিয়ে নেওয়া যায়, মন্দ কি!
ভদ্রলোক পকেট থেকে পেনসিল-কাটা ছুরি বার করলেন; তার একটা চাড় দিতেই পেছেনের ~ ডালার সবটা সটান উঠে এল। আমি চমকে উঠতেই তিনি সান্ত্বনা দিলেন, ভয় কি? জুড়ে দেব আবার।
সেই ভোতা ছুরি এবং সময়ে সময়ে একটা চোখা কলমের সাহায্যে তিনি একটার পর একটা ঘড়ির সমস্ত অল্প-প্রত্যঙ্গ খুলে ফেলতে লাগলেন। মিনিট এবং সেকেন্ডের কাঁটাও বাদ গেল না। খুঁটিনাটি যত যন্ত্রপাতি টেবিলের উপর পাকার হলো তিনি এক একটাকে চশমার কাছে এনে গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সূক্ষ্ম তারের ঘোরানো কি একটা জালের মতো বোধহয় হেয়ার স্প্রিংই হবে দুহাতে ধরে সেটাকে লম্বা করার চেষ্টা করলেন। দেখতে দেখতে সেটা দুখান হয়ে গেল, মৃদু হাস্য করে আমার দিকে তাকালেন; তার মানে, ভয় কি, আবার জুড়ে দেব।
ভয় ছিল না কিন্তু ভরসাও যেন ক্রমশ কমে আসছিল! যেটা জুয়েলের মধ্যে সবচেয়ে স্থূলকায় সেটাকে এবার তিনি দাঁতের মধ্যে চাপলেন, দাঁত বসে কিনা দেখবার জন্যই হয়ত বা। কিন্তু দন্তস্ফুট করতে না পেরে সেটাকে ছেড়ে মাথার দিকের দম দেবার গোলাকার চাবিটাকে মুখের মধ্যে পুরলেন তারপর। একটু পরেই কটাস করে উঠল; ওটার মেরামৎ সমাধি হয়েছে বুঝতে পারলাম।
তারপর সমস্ত টুকরো-টাকরা এক করে ঘড়ির অন্তঃপুরে রেখে তলাকার ডালাটা চেপে বন্ধ করতে গেলেন; কিন্তু ডালা তাতে বসবে কেন? সে উঁচু হয়ে রইল। ওপরের ডালাটা আগেই ভেঙেছিল, এবার সেটাকে হাতে নিয়ে আমাকে বললেন, আঠার পাত্রটা আগিয়ে দিন তো দেখি। এটাকে।
অত্যন্ত নিরুৎসাহে গাম–পটটা বাড়ির দিলাম। তিনি আঠার সহায়তায় যথেষ্ট সগ্রাম করলেন কিন্তু তাঁর যৎপরোনাস্তি চেষ্টা সমস্ত ব্যর্থ হলো। আঠায় কখনও ও জিনিস আঁটানো যায়? তখন সবগুলোয় মুঠোর করে নিয়ে আমার দিকে প্রসারিত করলেন এই নিন আপনার ঘড়ি।
আমি অবাক হয়ে এতক্ষণ দেখছিলাম, বললাম–এ কি হল মশাই?
তিনি শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন–কেন, মেরামৎ করে দিয়েছি তো।
বাবার কাছ থেকে বাগানো দামী ঘড়িটার এই দফারফা দেখে আমার মেজাজ গরম হয়ে গেল–এই বুঝি মেরামৎ করা? আপনি ঘড়ির যদি কিছু জানেন। না তবে হাত দিতে গেলেন কেন?
কেন, কি ক্ষতি হয়েছে? একথা বলে তিনি অনায়াসে হাসতে পারলেন–তাছাড়া, আমারও এই প্রথম চেষ্টা।
আমি অনেকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইলাম, তারপ বললাম, ওঃ। আমার প্রথম লেখা বলেই এটা অপনার পছন্দ হয়নি? তা-ই বললেই পারতেন ঘড়ি ভেঙে একথ বলা কেন? আমার চোখ ফেটে জল বেরুবার মতো হলো, কিন্তু অবাঞ্ছিত অঞ কোনমতে সম্বরণ করে, এমনকি অনেকটা আপ্যায়িতের মতো হেসেই অবশেষে বললাম কাল না হয় আর একটা নতুন গল্প লিখে আনব, সেটা আপনার পছন্দ হবে। চেষ্টা করলেই আমি লিখতে পারি।
বেশ আসবেন। এ বিষয়ে সম্পাদকের বিশেষ উৎসাহ দেখা গেল, কিন্তু ঐ সঙ্গে আর একটা নতুন ঘড়িও আনবেন মনে করে। আমাদের দুজনেরই শিক্ষা হবে তাতে। আপনারও লেখার হাত পাকবে, আমিও ঘড়ি সম্বন্ধে পরিপক্কতা লাভ করব।
পরের দিন মরীয়া হয়েই গেলাম এবং ঘড়িয়া না হয়েই। এবার আর গল্প না, তিনটে ছোট ছোট কবিতা–সিম, বেগুন, বরবটির উপরে।
আমাকে দেখেই সম্পাদক অভ্যর্থনা করলেন–এই যে এসেছেন, বেশ। ঘড়ি আছে তো সঙ্গে?
আমি বললাম না–দেখুন এবারে একেবারে অন্য ধরনের লিখেছি। লেখাগুলো সময়গাপযোগী, এমন কি সব সময়ের উপযোগী। এবং যদি অনুমতি করেন তাহলে অনুগ্রহ–
আরও খানিকটা মুখস্থ করে আনা ছিল। কিন্তু ভদ্রলোক আমার আবৃত্তিতে বাধা দিলেন–ধৈর্য, উৎসাহ, তিতিক্ষা এসব আপনার আছে দেখছি। পারবেন আপনি। কিন্তু আমাদের মুশকিল কি জানেন, বড় লেখকেরই বড় লেখা কেবল আমরা ছাপতে পারি। প্রবন্ধের শেষে বা তলায় দিকে দেওয়া চলে এমন ছোট-খাট খুচরা-খাচরা যদি আপনার কিছু থাকে তাহলে বরং–। এই ধরুন, চার লাইনের কবিতা কিংবা কৌতুক–কণা–
আমি তার মুখের কথা কেড়ে নিলাম–হ্যাঁ, কবিতা। কবিতাই এনেছি এবার। পড়ে দেখুন আপনি, রবীন্দ্রনাথের পরে ওমন কবিতা কেউ লিখেছে কিনা সন্দেহ।
তিনি কবিতা তিন পিস হাতে নিলেন এবং পড়তে শুরু করে দিলেন—
সিম।
সিমের মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর।
ধামার মাঝে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর।
সঙ্গে সঙ্গে তার সপ্রশংস অভিব্যক্তি দেখা গেল–বাঃ, বেশ হয়েছে। আপনি বুঝি সিমের ভক্ত? সিম খেয়ে থাকেন খুব? অত্যন্ত ভাল জিনিস, যথেষ্ট ভিটামিন।
সিম আমি খাইনে। বরং অখাদ্যই মনে করি। তবে এই কবিতাটা লিখতে হিমসিম খেয়েছি।
হ্যাঁ এগুলো চলবে। খাসা কবিতা লেখেন আপনি; বরবটির সঙ্গে চটপটির মিলটা মন্দ না। তুলনাটাও ভাল–তা, এক কাজ করলে তো হয়।–অকস্মাৎ তিনি যেন গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হলেন।দেখুন, ভিটামিনের কাগজ বটে কিন্তু ভিটামিন আমরা খুব কমই খাই। কলা বাদ দিয়ে কলার খোসা কিংবা শাঁস বাদ দিয়ে আলুর পোসার সারাংশ প্রায়ই খাওয়া হয়ে ওঠে না–এইজন্যে মাস কয়েক থেকে বেরিবেরিতে ভুগতে হচ্ছে; তা আপনি যদি–তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন।
হ্যাঁ, পারব। খুব পারব। ঝুড়ি ঝুড়ি কলার খোসা আপনাকে যোগাড় করে দেব। কিন্তু শুধু খোসা তো কিনতে পাওয়া যায় না, কলার দামটা আপনিই দেবেন। তার সমর্থনের অপেক্ষায় একটু থামলাম, কলাগুলো আমিই না হয় খুব কষ্টে-সৃষ্টে-যদিও অনুপকারী, তবু বেরিবেরি না হওয়া পর্যন্ত খেতে তো কোন বাধা নেই?
না সে কথা নয়। আমি বলছি কি, আমি তিন মাসের ছুটি নিয়ে ঘাটশিলায় হাওয়া বদলাতে যেতাম, আপনি যদি সেই সময়ে আমার কাগজটা চালাতেন।
আমি? এবার আমি আকাশ থেকে পড়লাম যেন।
তা, লিখতে না জানলেও কাগজ চালানো যায়। লেখক হওয়ার চেয়ে সম্পাদক হওয়া সোজা। আপনার সঙ্গে আমার এই চুক্তি থাকবেঃ আপনাকে নামজাদা লেখকদের তালিকা দিয়ে যার, তাঁদের লেখা আপনি চোখ বুজে চালিয়ে দেবেন কেবল কপি মিলিয়ে প্রুফ দেখে দিলেই হল। সেই সব লেখার শেষ পাতায় তলায় যা এক-আধুট জায়গা পড়ে থাকবে সেখানে আপনার এই ধরনের ছোট ছোট কবিতা আপনি ছাপতে পারবেন, তাতে আমার আপত্তি নেই। এই রকম কৃষি কবিতা–ওলকপি, গোলআলু, শকরকন্দ–যার সম্বন্ধে খুশি লিখতে পারেন।
বলা বাহুল্য, আমাকে রাজি করতে ভদ্রলোককে মোটেই বেগ পেতে হল না, সহজেই আমি সম্মত হলাম। এ যেন আমার হাতে স্বর্গ পাওয়া গাছে না উঠতেই এক কাঁদি! সম্পাদক শিকার করতে এসে সম্পাদকতা স্বীকার– তোমাদের মধ্যে খুব কম অজাতশ লেখকেরই এরকম সৌভাগ্য হয়েছে বলে আমার মনে হয়।
সম্পাদনা-কাজের গোড়াতেই এক জোড়া চশমা কিনে ফেললাম; ফাউন্টেন পেন তো ছিলই। অতঃপর সমস্ত জিনিসটাই পরিপাটিরকম নিখুঁত হলো। কলম বাগিয়ে -কৃষিতত্ত্বের- সম্পাদকীয় লিখতে শুরু করলাম। যদিও সম্পাদকীয় লেখার জন্য ঘুণাক্ষরেও কোন অনুরোধ ছিল না সম্পাদকের, কিন্তু ওটা বাদ দিলে সম্পাদকতা করার কোন মানেই হয় না, আমার মতো। এতএব লিখলাম।
আমাদের দেশে ভদ্রলোকের মধ্যে কৃষি সম্বন্ধে দারুণ অজ্ঞতা দেখা যায়। এমন কি, অনেকের এরকম ধারণা আছে যে এই সব তক্তা আমরা দেখি, দরজা, জানালা কড়ি, বরগা, পেনসিল তক্তপোষে যেসব কাঠ সাধারণতঃ দেখতে পাওয়া যায় সে সমস্ত ধান গাছের। এটা অতীব শোচনীয়। তারা শুনলে অবাক হয়ে যাবেন যে ওগুলো ধান তো নয়ই, বরঞ্চ পাট বলা যেতে পারে। অবশ্য পাট গাছ ছাড়াও কাঠ জন্মায়; আম, জাম, কাঁঠাল, কদবেল ইত্যাদি বৃক্ষেরাও তক্তাদান করে থাকে। কিন্তু নৌকার পাটাতনে যে কাঠ ব্যবহৃত হয় তা কেবলমাত্র পাটের।…
ইত্যাদি—এইভাবে একটানা প্রায় আড়াই পাতা কৃষি তত্ত্ব। কাগজ বেরুতে না বেরুতে আমার সম্পাদকতার ফল প্রত্যক্ষ করা গেল। মোটে পাঁচশ করে আমাদের ছাপা হত, কিন্তু পাঁচশ কাগজ বাজারে পড়তেই পেল না। সকাল থেকে প্রেস চালিয়ে, সাতগুণ গেছেও অনেক হকারকে শেষে ক্ষুণ্ণমনে আর শূন্যহাতে ফিরিয়ে দিতে হল।
সন্ধ্যায় পরে যখন আপিস থেকে বেরুলাম, দেখলাম একদল লোক আর বালক সামনের রাস্তায় জড়ো হয়েছে; আমাকে দেখেই তারা তৎক্ষণাৎ ফাঁকা হয়ে আমার পথ করে দিল। দুএকজনকে যেন বলতেও শুনলাম–ইনি, ইনিই। স্বভাবতঃই খুব খুশি হয়ে গেলাম। না হব কেন?
পরদিনও আপিসের সামনে সেই রকম লোকের ভীড়; দল পাকিয়ে দুচারজন করে এখানে ওখানে ছড়িয়ে, রাস্তার এধারে ওধারে, দূরে সুদূরে (কিন্তু অনতি নিকটে) প্রায় সমস্ত জায়গাটা জুড়েই ব্যক্তিবর্গ। সবাই বেশ আগ্রহের সঙ্গে আমাকে লক্ষ্য করছে। তাদের কৌতূহলের পাত্র আমি বুঝতে পারলাম বেশ; এবং পেরে আত্মপ্রসাদ হতে লাগল।
আমি কাছাকাছি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনতা বিচলিত হয়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল, আমি দ্বিধাবোধ করার আগেই মন্ডলীর দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে আমার পথ পরিষ্কার করে দিচ্ছিল। একজন বলে উঠল ওর চোখের দিকে তাকাও, কি রকম চোখ দেখেছ! আমিই যে ওদের লক্ষ্য এটা যেন লক্ষ্য করছি না এই রকম ভাব দেখাচ্ছিলাম, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, মনে মনে বেশ পুলক সঞ্চার হচ্ছিল আমার। ভাবলাম, এ সম্বন্ধে লম্বা-চওড়া বর্ণনা দিয়ে আজই বড়দাকে একখানা চিঠি ছেড়ে দেব।
দরজা ঠেলে আপিস-ঘরে ঢুকতেই দেখলাম দুজন গ্রাম্যগোছের লোক আমার চেয়ার এবং টেবিল ভাগাভাগি করে বসে আছে–বসার কায়দা দেখলে মনে হয় লাঙ্গল ঠেলাই ওদের পেশা। আমাকে দেখেই তারা তটস্থ হয়ে উঠল। মুহূর্তের জন্য যেন তাদের লজ্জায় ম্রিয়মাণ বলে আমার বোধ হলো কিন্তু পরমুহূর্তেই তাদের আর দেখতে পেলাম না–ওধারের জানলা টপকে ততক্ষণে তারা সটকেছে। অপিস-ঘরে যাতায়াতের অমন দরজা থাকতেও তা না ব্যবহার করে অপ্রশস্ত জানলাই বা তারা কেন পছন্দ করল, এই অদ্ভুত কান্ডের মাথামুন্ড নির্ণয়ে মাথা ঘামাচ্ছি। এমন সময়ে একজন ভোঢ় ভদ্রলোক সযত্নলাললিত ছড়ি হস্তে আমার সম্মুখে আবির্ভূত হলেন। তাঁর দাড়ির চাকচিক্যা দৃষ্টি আকর্ষ করার মতো। চেয়ারে ছড়ির ঠেসান দিয়ে দাড়িকে হস্তগত করে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন–আপনি কি নতুন সম্পাদক?
আমি জানালাম, তাঁর অনুমান যথার্থ।
আপনি কি এর আগে কোন কৃষি কাগজের সম্পাদনা করেছেন?
আজ্ঞে না, আমি বললাম, এই আমার প্রথম চেষ্টা।
তাই সম্ভব। তিনি পুনরায় প্রশ্ন করলেন, হাতে-কলমে কৃষি-কাজের কোন অভিজ্ঞতা আছে। আপনার?
একদম না। স্বীকার করলাম আমি।
আমারও তাই মনে হয়েছে। ভদ্রলোক পকেট থেকে ভাজ করা এই সপ্তাহের একখানা কৃষি তত্ত্ব বার করলেন–এই সম্পাদকীয় আপনার লেখা নয় কি?
আমি ঘাড় নাড়লাম–এটাও আপনি ঠিক ধরেছেন।
আমার আন্দাজ ঠিক। বলে তিনি পড়তে শুরু করলেন?
মূলো জিনিসটা পড়বার সময় সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক। কখনই টেনে ছেঁড়া উচিত নয়, ওকে মূলোর ক্ষতি হয়। তার চেয়ে বরং একটা ছেলেকে গাছের ওপরে পাঠিয়ে দিয়ে ডালপালা নাড়তে দিলে ভাল হয়। খুব কসে নাড়া দরকার। ঝাঁকি পেলেই টপাটপ মূলোবৃষ্টি হবে, তখন কুড়িয়ে নিয়ো ঝাঁকা ভরো।…..
এর মানে কি আমি জানতে চাই। ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বরে যেন উন্মার আভাস ছিল।
কেন? এর মানে তো স্পষ্ট। বৃদ্ধ ব্যক্তির বোধশক্তি-হীনতা দেখে আমি হতবাক হলাম, আপনি কি জানেন, কত হাজার হাজার, কত লাখ লাখ মূলো অর্ধপক্ক অবস্থায় টেনে ছিঁড়ে নষ্ট করা হয় আমাদের দেশে? মূলো নষ্ট হলে কার যায় আসে? কেবল যে মূলোরাই তাতে অপকার করা হয় তা নয়, আমাদের আমাদেরও ক্ষতি তাতে। দেশেরই তাতে সর্বনাশ, তার হিসেব রাখেন? তার চেয়ে যদি মূলোকে গাছেই পাকতে দেওয়া হত এবং তারপরে একটা ছেলেকে গাছের ওপরে
নিকুচি করেছে গাছের! মূলো গাছেই জন্মায় না।
কি! গাছে জন্মায় না। অসম্ভব–এ এখনও হতে পারে? মানুষ ছাড়া সবকিছুই গাছে জন্মায়, এমন কি বাঁদর পর্যন্ত।
ভদ্রলোকের মুখবিকৃতি দেখে বুঝলাম বিরক্তির তিনি চরম সীমায়। রেগে কৃষি-তত্ত্বখানা ছিঁড়ে কুচি কুচি করে ফুঁ দিয়ে, ঘরময় উড়িয়ে দিলেন। তারপরে নিজের ছড়িতে হস্তক্ষেপ করলেন। আমি শঙ্কিত হলাম–লোকটা মারবে নাকি? কিন্তু না আমাকে ছাড়া টেবিল, চেয়ার দেরাজ, আলমারি, ঘরের সবকিছু ছড়িপেটা করে, অনেক কিছু ভেঙেচুরে, অনেকটা শান্ত হয়ে, অবশেষে, সশব্দে ঘরের দরজায় ধাক্কা মেরে তিনি সবেগে বেরিয়ে গেলেন। লোকটা কোনো ইস্কুলের মাস্টার নয় তো?
আমি অবাক হলাম, ভদ্রলোক ভারী চটে চলে গেলেন তা তো স্পষ্টই, কিন্তু কেন যে কি সম্বন্ধে তার এত অসন্তোষ তা কিছু বুঝতে পারলাম না।
এই দুর্ঘটনার একটু পরেই আগামী সপ্তাহের সম্পাদকীয় লেখবার জন্য সুবিধে মতো আঁকিয়ে বসছি এমন সময়ে দরজা ফাঁক করে কে যেন উঁকি মারল। যারা জানলা-পথে পালিয়েছিল সেই ‘চষ্য’-রাজাদের একজন নাকি? কিন্তু না, নিরীক্ষণ করে দেখলাম বিশী বেহারার জনৈক বদখৎ লোক। লোকটা ঘরে ঢুকেই যেন কাঠের পুতুল হয়ে গেল, ঠোঁটে আঙুল চেপে, ঘাড় বেঁকিয়ে কুঁজো হয়ে কি যেন শোনবার চেষ্টা করল। কোথাও শব্দমাত্র ছিল না। তথাপি সে শুনতে লাগল। তবু কোনো শব্দ নেই। তারপরে অতি সন্তপর্ণে দরজা ভেজিয়ে পা টিপে টিপে আমার কাছাকাছি এগিয়ে এসে সুতীব্র ঔৎসুক্যে আমাকে দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ একেবারে নিষ্পলক, তারপরেই কোটের বোতাম খুলে হৃদয়ের অভ্যন্তর থেকে একখণ্ড কৃষি-তত্ত্ব বার করল।
এই যে, তুমি! তুমিই লিখেছ তো? পড়-পড়–এইখানটা তাড়াতাড়ি। ভারী কষ্ট হচ্ছে আমার।
আমি পড়তে শুরু করলামঃ
মুলোর বেলা যেরকম আলুর বেলা সেরকম করা চলবে না। গাছ ঝাঁকি দিয়ে পাড়লে আলুরা চোট খায়, এই কারণেই আলু পচে আর তাতে পোকা ধরে। আলুকে গাছে বাড়তে দিতে হবে যতদূর খুশি সে বাড়ুক। এরকম সুযোগ দিলে এক-একটা আলুকে তরমুজের মতো বড় হতে দেখা গেছে। অবশ্য বিলাতেই; এদেশে আমরা আলু খেতেই শিখেছি, আলুর যত্ন নিতে শিখিনি। আলু যথেষ্ট বেড়ে উঠলে এক-একটা করে আলাদা আলাদা ফজলি আমের মতন তাকে ঠুসি পাড়া করতে হবে।
তবে পেঁয়াজ অমরা আঁকশি দিয়ে পাড়তে পারি, তাতে বিশেষ কোন ক্ষতি হবে না। অনেকের ধারণা পেঁয়াজ গাছেল ফল, বাস্তবিক কিন্ত তা নয়। বরং ওকে ফুল বলা যেতে পারে–ওর কোনো গন্ধ নেই, যা আছে কেবল দুর্গন্ধ। ওর খোসা ছাড়ানো মানেই ওর কোরক ছাড়ানো। এনতার কোরক ওর। পেঁয়াজেরই অপর নাম শতদল।
অতি প্রাচীনকালেও এদেশে ফুলকপি ছিল তার পরিচয় পাওয়া যায়, তবে তাকে আহার্যের মধ্যে তখন গণ্য করা হত না। শাস্ত্রে বলেছে অলাবুভক্ষণ নিষেধ, সেটা ফুলকপি সম্বন্ধেই। আর্যেরা কপি খেতেন না, ওটা আনর্য হাতিদের খাদ্য ছিল। গজভুক্ত কপিখ এই প্রবাদে তার প্রমাণ করেছে
বাতাবিলেবুর গাছে কমলালেবু ফলানোর সহজ উপায় হচ্ছে এই–
ব্যস, ব্যস–এতেই, হবে। আমার উৎসাহী পাঠক উত্তেজিত হয়ে আমার পিঠ চাপড়াবার জন্য হাত বাড়াল। আমি জানি আমার মাথা ঠিকই আছে, কেননা তুমি যা পড়লে আমিও ঠিক তাই পড়েছি, ওই কথাগুলোই। অন্তত আজ সকালে, তোমার কাগজ পড়ার আগে পর্যন্ত ওই ধারণাই আমার ছিল। যদিও আমার আত্মীয়স্বজন আমাকে সব সময়ে নজরে নজরে রাখে তবু এই ধারণা আমার প্রবল ছিল যে মাথা আমার ঠিকই আছে–
তার সংশয় দূর করার জন্য আমি সায় দিলাম–নিশ্চয়ঃ নিশ্চয়! বরং অনেকের চেয়ে বেশি ঠিক একথাই আমি বলব। এইমাত্র একজন বুড়ো লোক কিন্তু যাক সে কথা।
লোকটাও সায় দিল–হ্যাঁ, যাক। তবে আজ সকালে তোমার কাগজ পড়ে সে ধারণা আমার টলেছে। এখন আমি বিশ্বাস করি যে সত্যি সত্যিই আমার মাথা খারাপ। এই বিশ্বাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি এক দারুণ চিৎকার ছেড়েছি নিশ্চয়ই তুমি এখানে বসে তা শুনতে পেয়েছে?
আমি ঘাড় নাড়লাম, কিন্তু আমার অস্বীকারোক্তিতে সে আমল দিল না–নিশ্চয় পেয়েছ। দু মাইল দূর থেকে তা শোনা যাবে। সেই চিৎকার ছেড়েই এই লাঠি নিয়ে আমি বেরিয়েছি, কাউকে খুন না করা পর্যন্ত স্বস্তি হচ্ছে না। তুমি বুঝতেই পারছ আমার মাথার যা অবস্থা তাতে একদিন কাউকে খুন আমায় করতেই হবে–তবে আজই তা শুরু করা যাক না কেন?
কি জবাব দেব ভেবে পেলাম না, একটা অজানা আশঙ্কায় বুক দূর দূর করতে লাগল।
বেরুবার আগে আর একবার তোমার প্যারাগুলো পড়লাম, সত্যিই আমি পাগল কিনা নিশ্চিত হবার জন্যে। তার পরক্ষণেই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে আমি বেরিয়ে পড়েছি। রাস্তায় যাকে পেয়েছি তাকেই ধরে ঠেঙিয়েছি। অনেকে খোঁড়া হয়েছে, অনেকের মাথা ভেঙেছে; সবসুদ্ধ কতজন হতাহত বলতে পারব না। তবে একজনকে জানি, সে গাছের উপর উঠে বসে আছে। গোলাদীঘির ধারে। আমি ইচ্ছা করলেই তাকে পেড়ে আনতে পারব। এই পথ দিয়ে যেতে মনে হল তোমার সঙ্গে একবার মোলাকাৎ করে যাই–
হৃৎকম্পের কারণ এতক্ষণে আমি বুঝতে পারলাম–কিন্তু বোঝার সঙ্গে সঙ্গে হৃৎকম্প একেবারেই বন্ধ হবার যোগাড় হল যেন!
কিন্তু তোমায় আমি সত্যি বলছি, যে লোকটা গাছে চেপে আছে তার কপাল ভাল। এতক্ষণ তবু বেঁচে রয়েছে বেচারা। ওকে খুন করে আসাই উচিত ছিল আমার। যাক, ফেরার পথে ওর সঙ্গে আমার বোঝাপড়া হবে। এখন আসি তাহলে–নমস্কার!
লোকটা চলে গেলে ঘাম দিয়ে আমার জ্বর ছাড়ল। কিন্তু এতগুলো লোক যে আমার লেখার জন্যই খুন-জখম হয়েছে হাত-পা হারিয়েছে এবং একজন গোলদীঘির ধারে এখনও গাছে চেপে বসে আছে এই সব ভেবে মন ভারী খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু অচিরেই এই সব দুশ্চিন্তা দূরীভূত হলো, কেননা—’কৃষি-তত্ত্বের’ আটপৌরে সম্পাদক অপ্রত্যাশিতরূপে প্রবেশ করলেন।
সম্পাদকের মুখ গম্ভীর, বিষণ্ণ, বিলম্বিত। চেঞ্জ গিয়ে অবিলম্বে ফিরে আসার জন্যেই বোধ হয়। আমার দুজনে চুপচাপ। অনেকক্ষণ পরে একটি মাত্র কথা তিনি বললেন–তুমি আমার কাগজের সর্বনাশ করেছ।
আমি বললাম, কেন, কাটতি তো অনেক বেড়েছে।
হ্যাঁ, কাগজ বহুত কেটেছ, আমি জানি। কিন্তু আমার মাথাও কাটা গেছে সেই সঙ্গে। তারপরে দাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের কীর্তিকলাপ তাঁর দৃষ্টিগোচর হল, চারিদিকে ভাঙাচোরা দেখে তিনি নিজেও যেন ভেঙে পড়লেন–সত্যি বড় দুঃখের বিষয়। ‘কৃষি-তত্ত্বের’ সুনামের যে হানি হলো, যে বদনাম হলো তা বোধহয় আর ঘুচবে না। অবিশ্যি কাগজের এত বেশি বিক্রী এর আগে কোনোদিন হয়নি বা এমন নামডাকও চারদারে ছড়িয়ে পড়েনি–কিন্তু পাগলামির জন্য বিখ্যাত হয়ে কি লাভ? একবার জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখ দেখি চারধারে কি রকম ভীড় কি সোরগোল! তারা সব দাঁড়িয়ে আছে তোমাকে দেখবার জন্যে। তাদের ধারণা তুমি বদ্ধ পাগল। তাদের দোষ কি? যে তোমার সম্পাদকীয় পড়বে তারই ওই ধারণা বদ্ধমূল হবে। তুমি যে চাষবাসের বিন্দুবিসর্গও জানো তা তো মনে হয় না। কপি আর কফিখ যে এক জিনিস একথা কে তোমাকে বলল? গোল আলুর সম্বন্ধে তুমি যে গবেষণা করেছ, মূলো চাষের যে আমূল পরিবর্তন আনতে চেয়েছ সে সম্বন্ধে তোমার কোনই অভিজ্ঞতা নেই। তুমি লিখেছ শামুক অতি উৎকৃষ্ট সার, কিন্তু তাদের ধরা অতি শক্ত। মোটেই তা নয়, শামুক মোটেই সারবান নয়, এবং তাদের দ্রুতগতির কথা এই প্রথম জানা গেল। কচ্ছপেরা সঙ্গীতপ্রিয়, রাগ-রাগিণীর সম্মুখে তারা মৌনী হয়ে থাকে, সেটা তাদের মৌনসম্মতির লক্ষণ, তোমার এ মন্তব্য একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। কচ্ছপদের সুরবোধের কোনই পরিচয় এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এমনিই ওরা চুপচাপ থাকে, মৌনী হয়ে থাকাই ওদের স্বভাব-সঙ্গীতের কোন ধারই ধারে না তারা। কচ্ছপদের দ্বারা জমি চষানো অসম্ভব একেবারেই অসম্ভব। আপত্তি না করলেও জমি তারা চষবে না–তারা তো বলদ নয়! তুমি যে লিখেছ, ঘোড়ামুগ ঘোড়ার খাদ্য আর কলার বীচি থেকে কলাই হয়, তার ধাক্কা সামলাতে আমার কাগজ উঠে না গেলে বাঁচি! গাছের ডাল আর ছোলার ডালের মধ্যে যে প্রভেদ আছে দেড় পাতা খরচ করে তা বোঝাবার তোমার কোনই দরকার ছিল না। কেবল তুমি ছাড়া আর সবাই জানে। যাক, যা হবার হয়েছে, এখন তুমি বিদায় নাও। তোমাকে আর সম্পাদকতা করতে হবে না। আমার আর বায়ু পরিবর্তনের কাজ নেই– ঘাটশিলায় গিয়েই আমাকে দৌড়ে আসতে হয়েছে তোমার পাঠানো কাগজের কপি পেয়ে অবধি আমার দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। পরের সপ্তাহে আবার তুমি কি গবেষণা করে বসবে সেই ভয়েই আমার বুক কেঁপেছে। বিড়ম্বনা আর কাকে বলে! যখনই তোমার ঘোষণার কথা ভেবেছি জাম জামরুল আর গোলাপ জাম কি করে একই গাছে ফলানো যায়, পরের সংখ্যাতেই তুমি তার উপায় বলে দেবে, তখন থেকেই নাওয়া-খাওয়া আমার মাথায় উঠেছে- বেরিবেরিতে প্রাণ যায় সেও ভাল–তখনই আমি কলকাতার টিকিট কিনে গাড়িতে চেপেছি।
এতখানি বক্তৃতার পর ভদ্রলোক এক দারুণ দীর্ঘশ্বাস মোচন করলেন। ওরই কাগজের কাটতি আর খ্যাতি বাড়িয়ে দিলাম, আরও বেড়ে গেল কত অথচ উনিই আমাকে গাল-মন্দ করলেন! ভদ্রলোকের নেমকহারামি দেখে আমার মেজাজ বিগড়ে আমাকে গাল-মন্দ করছেন! ভদ্রলোকের নেমকহারামি দেখে আমার মেজাজ বিগড়ে গেল। অতএব, শেষবিদায় নেওয়ার আগে অমিই বা ক্ষান্ত হইয়া কেন? আমার বক্তব্য আমিও বলে যাব। এত খাতির কিসের?
বেশ আমার কথাটাও শুনুন তবে। আপনার কোন কাণ্ডজ্ঞানেই নেই, আপনি একটি আস্ত বাঁধাকপি। এরকম অনুদার মন্তব্য যা এতক্ষণ আমাকে শুনব বলে কোনদিন আমি কল্পনাও করিনি। কাগজের সম্পাদক হতে হলে কোনো কিছু জানতে হয় তাও আমি এই প্রথম জানলাম। এতদিন তো দেখে আসছি যারা বই লিখতে পারে না তারই ফুটবল খেলা দেখতে যায়। আপনি নিতান্তই শালগম, তাই একথা বুঝতে আপনার বেগ পেতে হচ্ছে। যদি নেহাৎ ভুনিকুমাণ্ড না হতেন তাহলে অবশ্য বুঝতেন যে কৃষি-তত্ত্বের কি উন্নতি আর আপনার কতখানি উপকার আমি করেছি! আমার গায়ে জোর থাকলে আপনার মত গাজরকে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে যেতাম! কি আর বলব আপনাকে, পালং শাক, পানিফল, তালশীল, যা খুশি বলা যায়। আপনাকে পাতিলেবু বললে পাতিলেবুর অপমান করা হয়–
দম নেবার জন্য আমাকে থামতে হল। গায়ের ঝাল মিটিয়ে গালাগালের শোধ তুললাম, কিন্তু ভদ্রলোক একেবারে নির্বাক। আবার আরম্ভ করলাম আমি–
হ্যাঁ, একথা সত্যি, সম্পাদক হবার জন্য জন্মভূমি যারা সৃষ্টি করে আমি তাদেরই একজন, আমি হচ্ছি লেখক। উঁইফোড় কাগজের সম্পাদক হয় কারা? আপনার মতো লোক নিতান্তই যারা টম্যাটো। সাধারণত যারা কবিতা লিখতে পারে না, আট-আনা সংকরণের নভেলও যাদের আসে না, পিলে চমকানো থিয়েটারী নাটক লিখতেও অক্ষম, প্রথম শ্রেণীর মাসিক পত্রেও অপারগ তারাই অবশেষে হাত-চুলকানো থেকে আত্মরক্ষার জন্য আপনার মতো কাগজ বের করে বসে। আমি আমার সঙ্গে যেরকম ব্যবহার করেছেন তাতে আর মুহূর্তও এখানে থাকতে আমার রুচি নেই! এই দণ্ডেই সম্পাদক-গিরিতে আমি ইস্তফা দিচ্ছি! চাষাড়ে কাগজের সম্পাদকের কাছে ভদ্রতা আশা করাই বাতুলতা! ঘড়ির দুর্দশা দেখেই আমার শিক্ষা হওয়া উচিত ছিল। যাব তো আমি নিশ্চয়, কিন্তু জানবেন, আমার কর্তব্য আমি করে গেছি, যা গেছি, যা চুক্তি ছিল তা অক্ষরে পালন করেছি আমি। বলেছিলাম আপনার কাগজ সর্বশ্রেণীর পাঠ্য করে তুলব–তা আমি করেছিও। বলেছিলাম আপনার কাগজের কুড়ি হাজার গ্রাহক করে দেব–যদি আর দু-সপ্তাহ সময় পেতাম তাও আমি করতে পারতাম। এখন-এখনই আপনার পাঠক কারা? কোন চাষের কাগজের বরাতে যা কোনদিন জোটেনি সেইসব লোক আপনার কাগজের পাঠক–যত উকিল, ব্যারিস্টার, ডাক্তার, মোক্তার, হাইকোর্টের জজ, কলেজের প্রফেসার, যত সব সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। একজনও চাষা নেই ওর ভেতর-যত চাষা গ্রাহক ছিল তারা সব চিঠি লিখে কাগজ ছেড়ে দিয়েছে-ঐ দেখুন টেবিলের ওপর চিঠির গাদা! কিন্তু আপনি এমনই চাল-কুমড়ো যে পাঁচশ মুখ্যু চাষার জন্যে বিশ হাজার উচ্চশিক্ষিত গ্রাহক হারালেন! এতে আপনারই ক্ষতি হলো, আমার কি আর! আমি চললাম।