আমার শ্যামল
আমরা পাঁচ বোন আর দুই ভাই। আর্থিক স্বচ্ছলতা আমাদের পরিবারে ছিল না তেমন। বেশ কিছু টিউশনি করতাম আমি। যে সময়টার কথা বলছি, ওই ১৯৫৯-৬০ সাল, কিছুদিন মাত্র হয়েছে, আমার আরেক বোন নীতির সঙ্গে বিয়ে হল মতি নন্দীর। বাড়িতে তখন আমারও বিয়ের সম্বন্ধ দেখা চলছে। অনেক সম্বন্ধই এসেছিল। এরপর, এক পাত্রকে নিয়ে এল মতি। না, জানতাম না যে, আমার বিয়ের জন্যই তাকে নিয়ে আসা হয়েছে। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় যেদিন প্রথম মতির সঙ্গে আমাদের সালকিয়ার বাড়িতে এলেন, সত্যিই সেদিন আমি ওই চক্রান্তটি ধরতে পারিনি। মতি সাহিত্যিক, সেই সূত্রে কত সাহিত্যিকই তো আসতে পারে আমাদের বাড়ি! টিউশনি করে বাড়ি ফিরলাম, দেখি এক ভদ্রলোক এসেছেন, বেশ সুদর্শন, ধুতি-পাঞ্জাবি নয়, একেবারে ধোপদুরস্ত প্যান্ট-শার্ট পরা, পায়ে মোজা। আমার সঙ্গে সেই দিন তাঁর কোনোরকম কথাবার্তা বা আলাপ না হওয়ার ফলে মনে কোনো সন্দেহ তৈরিই হল না। পরে জানলাম, সে-ই নাকি আমার পাত্র। হিসেবটা মিলল। কিন্তু জানতে পেরে আমি যে খুব একটা উৎসাহী হয়ে উঠলাম, তাও নয়। শুধু এটুকু বুঝলাম, আমার সঙ্গে কথা না বলেও চুপিসারে নিজের জন্য পাত্রী দেখে গেলেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। শুনেছি আমাকে দেখে ফেরার পথে তিনি নাকি বিয়ের ব্যাপারে যথেষ্টই উৎসাহ প্রকাশ করেছিলেন মতির কাছে। আর আমি কেন ততটা উৎসাহী হতে পারলাম না? বংশে কেউ তো সাহিত্য বা লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। আর সাহিত্যের বিষয়ে আমারও তেমন কোনো দখলদারি বা ভালোবাসা ছিল না। কাজেই, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তখন আমার কাছে একজন সাধারণ পাত্র মাত্র। অনেক সম্বন্ধের মধ্যে একটা।
কিন্তু পাত্র না হয় এল। পাত্রী না হয় তার পছন্দসই-ও হল। ঠিক আছে, আমারও পছন্দ হল। তবু, এটুকু হলেই কি আর বিয়ে হয়? কত শর্তই তো জড়িয়ে থাকে এর সঙ্গে। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে চাপ ছিল পণের জন্য। গয়নাগাটির কথাও উল্লিখিত হয়েছিল। প্রথমেই বলেছি, আমাদের পরিবার স্বচ্ছল ছিল না। গয়নাগাটি কিংবা পণ তো দূর-অস্ত! ফলে গঙ্গোপাধ্যায় পরিবারের পক্ষ থেকে শ্যামলের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা একরকম নাকচই করে দেওয়া হল। খুব স্বাভাবিকভাবে ব্যাপারটা আমিও মেনে নিয়েছিলাম। মানেননি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় নিজে। আজ মনে হয়, এ-বুঝি হয়তো তাঁর লেখক সত্তারই জেদ! তাই, একপ্রকার পরিবারকে অমান্য করেই শ্যামল স্ত্রী হিসেবে আমাকে মান্যতা দিল। নিজের বিয়ে নিয়ে পরিবারের সাত-ঝামেলায় অস্থির শ্যামল দেরি করল না মোটে, বিয়ে যবে হয় হোক, আগে সেরে ফেলল রেজিস্ট্রি। দিনটা ছিল ১৯৬০ সালের ৫ মে। আমাদের এই আইনি বিবাহের সাক্ষী ছিলেন পবিত্র সরকার। এছাড়া, মতি তো ছিলই। তবে আনুষ্ঠানিক বিয়েও হল তার কয়েকদিনের মধ্যেই। সে-মাসেরই ২২ তারিখ। তবে, একেবারে পণ না দিয়ে বা খালি হাতে-গলায় বিয়ে হল না আমার। পণের পরিমাণ ছিল ৫০০ টাকা। আমাদের তো আর গাড়ি পাঠানোর ক্ষমতা ছিল না। একটা ট্যাক্সি চেপে বিয়ে করতে এসেছিল শ্যামল।
বিয়ের দিন সকালে আমাকে বিয়ে করতে যাওয়ার অপরাধে নিজের বড়দা সুখেন্দুবিকাশ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে বেধরক মার খেয়েছিল শ্যামল। গাল একেবারে ফুলে গিয়েছিল। সেই ফুলে যাওয়া গাল নিয়ে সে যখন বিয়ের পিঁড়িতে বসে, সবাই তখন তার রূপের সুখ্যাতি করলেও শ্যামল হাড়ে হাড়ে জানত নিশ্চয়ই, বউ নিয়ে যখন বাড়ি ঢুকবে তখন তার জন্য কী অভ্যর্থনা অপেক্ষা করছে।
বিয়ের যে আচার-অনুষ্ঠান, আমাদের বাড়ি থেকে তার সবই পালন করা হয়েছিল। তবে শ্যামলের বাড়িতে সেসব তেমন হয়নি। পরের দিন যখন শ্বশুরবাড়ি যাই আমি, বরণ করে ছেলে বউকে ঘরে তোলা থেকে যাবতীয় স্ত্রী-আচার সম্পন্ন হয়েছিল পাশের বাড়ির মেয়ে-বউদের দিয়েই। সে অর্থে বলতে গেলে আমার শাশুড়ি বা জায়েরা আমাকে ঘরে তোলেননি। ঘরে ঢোকার পর দেখি খড়ম পায়ে শ্বশুর পায়চারি করছেন আর নিজের মনেই বলছেন, ‘ওই আইছে!’ শ্যামলের বড়ো বউদি দেখি নিজের মনেই ঘর ঝাড়- পোছ করে যাচ্ছেন। শাশুড়িরও কোনো তাপ-উত্তাপ নেই। বিয়ের পুরো ব্যাপারটাই শ্যামল ছাড়া বাড়ির সকলের কাছেই বড়ো অবাঞ্ছিত। যাই হোক, ছোটো একটা অনুষ্ঠান করে বউভাতও হয়েছিল। বউভাতের খাবার-দাবারের দায়িত্বে ছিলেন দেবু বারিক। আজকে আমরা অনেকেই বিজলি গ্রিলের রসনায় তৃপ্ত। দেবুবাবু ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের পূর্বসূরি। এখনও মনে আছে, খাওয়ানোর খাতে সে-যুগে খরচ হয়েছিল একশো নব্বই টাকা। আমাদের বাড়ির পক্ষ থেকে একশো টাকার ফুলসজ্জার মিষ্টি এসেছিল। ভীমনাগের সন্দেশ। ভীমনাগের নাতিই এই মিষ্টি পাঠিয়েছিলেন। এও বলি, নগদের ওই পাঁচশো টাকা দিয়েছিলেন তাঁরাই। আসলে ভীমনাগের নাতি আমার দাদার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।
শ্যামলের সঙ্গে আমার যখন বিয়ে হল, তার মাত্র সতেরো দিন আগে ও ঢুকেছে আনন্দবাজারে। বন্ধুদের মধ্যে ও-ই প্রথম ছিল আনন্দবাজারের পার্মানেন্ট কর্মী। এর আগে শ্যামল কী করত? শ্যামলের নিজের মুখেই শুনে নিই তা — ‘সেই সময় একটি জিনিস আমাকে সাহায্য করেছিল। সবদিক থেকে অপমানের ঝাপটা। সবদিক থেকে ব্যর্থতার বাতাস। বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ছাত্র-রাজনীতির জন্য আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে স্বচ্ছন্দ্যে ফোর্থ ইয়ারের শেষে ডিসকলেজিয়েট করলেন। তখন আর কিছুই করার নেই। এর কিছু আগে আমার ওপরের সহোদরকে পটাসিয়াম সায়ানাইডে শেষ হতে দেখলাম। নিম্নবিত্ত পরিবারের একটি গ্র্যাজুয়েট মানে কিছু আশা। তা হওয়া গেল না। কলকাতা তখনও কলকাতা। খালাসির চেয়ে কিছু ওপরে — ফার্নেস হেল্পার হয়ে তিরিশ টনের ওপেন হার্থ ফার্নেসে ঢুকলাম। সে- কারখানায় সেদিন যিনি টেকনিক্যাল ম্যানেজার ছিলেন, পরে তিনি দুর্গাপুর ইস্পাতের এমডি হন।
অনেক পরে একদিন গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলাম। জিনিসটা এত বাজে তার আগে জানতাম না। গ্র্যাজুয়েট হয়ে গেলাম অথচ গায়ে একটা ঘামাচিও বেরোল না।
কারখানায় একরকমের হিন্দি শিখলাম। হিন্দি ছবি দেখে আরেক রকমের হিন্দি শিখেছিলাম তার আগে। এখানে আমার সহকর্মী ফৌজদার সিং, অযোধ্যা সিং, গুণ্ডু রাও, সুব্বা রাও, মায়ারস। ফার্নেস বেড থেকে সিঁড়ি নেমে গেছে বিলিতি ছবির মতো। শেডের নীচে ম্যাগনেটিক ক্রেন এসে ঝুপ করে স্ক্র্যাপ দাঁতে কামড়ে তুলে নিয়ে যায়। সেই ক্রেনকে নামতে বলার সময় বলতে হয় আড়িয়া, আড়িয়া। তুলবার সময় হাফেজ, হাফেজ।
একখানা উপন্যাসই লিখে ফেললাম। নাম দিলাম, আড়িয়া হাফেজ। ছাপানো হয়নি। একরকম ইচ্ছে করেই হারাই।’
এখানে দুটো জিনিস বলার আছে। ফার্নেসে কাজ করা ছাড়াও বেশ কিছু টিউশনি করত শ্যামল। মথুরানাথ বিদ্যাপীঠে কিছুদিন বাংলাও পড়িয়েছিল। আরেকটা কথা হল, আমার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগেই কিন্তু শুরু হয়ে গিয়েছিল ওর লেখালেখি। বিয়ের আগে ও পরে আজীবন শ্যামলের কাছে ঘুরে ঘুরেই প্রেম এসেছে। শ্যামল অংশ নিয়েছে তাতে। মনে হয়, শুধু প্রেমের জন্যই প্রেম করেনি শ্যামল। প্রেম ও সম্পর্কগুলো ধরা দিয়েছে লেখা হয়ে। মীরা সরকার বলে এক মহিলার সঙ্গে খুব ভাব হয়েছিল শ্যামলের। আমার বিয়ের আগের ঘটনা মীরা সরকার। বিদেশে পড়াশোনা করেছিল সে। প্রচুর চিঠি লিখত শ্যামলকে। শ্যামলও লিখেছে নিশ্চয়ই। মীরার অনেক চিঠিই শ্যামল আমাকে পড়িয়েছিল। সম্বোধনে থাকত ‘শ্যামলু সোনা’। শ্যামল তখন কাঠ বেকার। মীরা ওকে টাকা পাঠাত, শুনেছি সোয়েটারও। মীরা সরকারের বৃত্তান্তই বোধ হয় ‘তুষারহরিণী’; আমাদের বিয়ের আগেই সে গল্প লেখা এবং ছাপাও। ১৯৫৮ সালের সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায়। সেটাই ‘দেশ’-এ প্রকাশিত ওর প্রথম গল্প। ওই সময় নাগাদ আরও বেশ কিছু গল্প লিখেছিল শ্যামল। যেমন ‘ব্রিজের ওপাশে’, ‘ফোয়ারার ওপারে’, ‘অরবিন্দবাবুর ডায়েরি এবং স্ত্রী’।
মীরা সরকার ছাড়াও শ্যামলের আরও বেশ কয়েকজন প্রেমিকার নাম তো আমার এখনও মনে আছে। ওর ছোটোবেলাকার প্রেম ছিল রাণু। বড়ো হয়ে আবার দেখা একদিন সন্ধ্যায় পার্ক হোটেলের উলটোদিকে; বিজ্ঞাপনের জ্বলে ওঠা নিভে যাওয়া আলোর ভেতর রাণুকে ও দেখেছিল একটি বিদেশি গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। পরে, এই রাণুই কৃত্তিবাসের জন্য বিজ্ঞাপন জোগাড় করে দিয়েছিল শ্যামলকে। আবার এই রাণুই শ্যামলের ‘পরীর সঙ্গে প্রেম’ উপন্যাসের নায়িকা। শ্যামলের এক বাল্যবন্ধু মনোজের বোন ছিল আশা। তার প্রতিও দুর্বলতার কথা শ্যামল জানিয়েছে। এসব প্রেম-টেমের কথা চিরকাল অবলীলায় আমাকে এসে বলত শ্যামল। আমি খুশি না হলেও বলত কেননা কোনো কিছুকেই ও গোপন রাখতে চাইত না। সেটা একদিকে যেমন যন্ত্রণার ছিল তেমনই দিনে দিনে সেই যন্ত্রণাকে সয়ে নেবার মন্ত্রও আয়ত্ত করেছিলাম আমি।
যাইহোক, বিয়ের পরে রীতি মেনে দ্বিরাগমনে গিয়েছিলাম আমরা। প্রথমবার নিজের শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে শ্যামল, আমাকে নিয়ে। তেমন আর্থিক অবস্থা তো ছিল না। অথচ, পরবর্তীকালে তার যে নবাবি মেজাজের সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত হয়েছি, সেদিনও তার কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। ফলে, দ্বিরাগমনের যাত্রাপথটা হয়ে উঠেছিল মজার। প্রথমে আনোয়ার শাহের বাড়ি থেকে ট্রামে করে যাওয়া হল এসপ্ল্যানেড। তারপর সেখান থেকে ট্যাক্সি করে সালকিয়া। শ্বশুরবাড়িতে কি আর অভাব দেখানো যায়!
শ্যামল নেই, আমি এখনও যে বাড়িতে আছি, আনোয়ার শাহ রোডের এই বাড়িতেই আমি প্রথম এসে উঠেছিলাম। যৌথ পরিবার। ভাই-বোন-আত্মীয়-জ্ঞাতি নিয়ে কম করে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জন তখন থাকত এ-বাড়িতে। দেখেছি, গোড়া থেকেই এ-বাড়ির লোকেদের মধ্যে মাংস খাওয়ার রেওয়াজ। এমনকী ধার-বাকিতেও মাংস আসত, সে-যুগে মাংসের দোকানে ছ’শো টাকা পর্যন্ত ধার জমে গিয়েছিল।
সদ্য সদ্য বিয়ে হয়েছে, অথচ তেমন করে শ্যামলের সঙ্গে আর ব্যক্তিগত কথাবার্তা হত কই, অত লোকের মাঝে। কখনো-সখনো শ্যামল আমাকে নিয়ে ঘুরতে বেরোত। বলা যেতে পারে ওটুকুই ছিল আমাদের নিজেদের সময়। একবার লেকে নিয়ে গিয়েছিল আমাকে। যদিও শ্যামল তখন নিয়মিত মদ্যপান করে না, কিন্তু কী জানি কেন, সেদিন তার খুব বিয়ার খেতে ইচ্ছে হল। আমাকেও বলেছিল খাওয়ার জন্য। আমি খাইনি। নেশা ব্যাপারটার সঙ্গে আমার পরিচয় তো শ্যামলের সূত্রে নয়, তার আগে থেকেই। আমাদের পরিবারে একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি আমার দাদা অত্যন্ত মদ্যপান করতেন। যেদিন-যেদিন নেশা করতেন সর্বস্ব খুইয়ে বাড়ি ফিরতেন। ফলে, নেশায় মানুষ কী কী করে তা আমার জানা। তো, সেদিন শ্যামল মাত্র এক বোতল বিয়ার খেয়েই করল কী, টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল লেকের ঘাসে, ঘুমিয়েও পড়ল। আমি তো হতবাক। এবার ওকে নিয়ে বাড়ি ফিরব কী করে। বাড়ির লোকেরাই বা কী বলবে। একে তো আমাকে তাদের তেমন পছন্দ নয়, তার ওপর যদি তাদের ছেলেকে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বাড়ি নিয়ে যাই, কী কান্ডটাই না ঘটবে, এই ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়ছি। না, তেমন বিপদে অবশ্য পরিনি। খানিক ঘুমিয়ে শ্যামল দিব্যি ফ্রেশ হয়ে উঠল।
আরেকবার মনে আছে, আমাকে নিয়ে বিয়ের পর-পরই শ্যামল একদিন সুনীলের অফিসে গিয়েছিল। সেই দিনের কথা শ্যামলের জবানবন্দিতেই না হয় বলি, ‘… সুনীলের অফিসে গেলাম। দুপুরবেলা। গরম। নতুন বউ নিয়ে গেছি। সুনীল বেরিয়ে এল। আমরা বেড়াতে গেলাম। কোথায়? পার্ক সার্কাস কবরখানায়। মাইকেলের কবরে। কেন গিয়েছিলাম জানি না। কত কত পাথর ভেঙে পড়ে আছে। তার ভেতর দিয়ে সতেজ বুনোলতা — নাম না-জানা ফুল। সাম্রাজ্য করতে এসে অসুখ-বিসুখ, যুদ্ধ বিগ্রহে কত লোকের অকালবিয়োগ। তার ভেতর অবিবাহিত সুনীল, সদ্যবিবাহিত শ্যামল, আনকোরা ইতি।’
চাকরিতে প্রথম শ্যামলের মাইনে ছিল আড়াইশো টাকা। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই শ্যামলের খরচ বাড়ছে দেখে, সন্তোষকুমার ঘোষ ওর মাইনে আরও একশো টাকা বাড়িয়ে দিলেন। সঙ্গে আরও একশো টাকা বরাদ্দ করলেন ডিয়ারনেস অ্যালাওয়েন্স খাতে। প্রুফরিডার থেকে কিছুদিনের মধ্যেই শ্যামলের উপর এসে পড়ল আরও কাজের দায়িত্ব। সাব-এডিটরের কাজ তখন থেকেই শুরু। সেসময় ওর ছিল শিফটিং ডিউটি। কখনও সকাল আটটা থেকে দুপুর একটা, কখনো দুপুর দুটো থেকে রাত দশটা। এক সপ্তাহ করে মাঝেমাঝেই চলত নাইট ডিউটি। খবরের কাগজের কাজ ছিল ওর প্রিয়। আসলে সময়টাও তো তখন অন্যরকম ছিল। ওখানেই তো ওর যত বন্ধুবান্ধব, গল্প, আড্ডা। ধর্মঘট থাকলে বালিশ- শতরঞ্চি নিয়েও অফিস যেত। এসময় ও লেখালেখির তেমন ফুরসত পায়নি। ফুরসত পেলেও আনোয়ার শাহ রোডের বাড়িতে ছিল স্থানাভাব। যদিও তারই মধ্যে শ্যামল লিখে ফেলেছে ওর প্রথম উপন্যাস ‘বৃহন্নলা’ (১৯৬১) যা পরে ১৯৭৭ সালে মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স থেকে আবার যখন বেরোল তখন তার নাম হয়েছিল ‘অর্জুনের অজ্ঞাতবাস’। খুব ভালো করে ভেবে দেখলে, সেসময় থেকেই বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের চাকরি সূত্রে ঘরের বাইরে বেরোনো। সামাজিক এই পরিবর্তনটি শ্যামলের নজর এড়ায়নি। ‘বৃহন্নলা’-য় সুধা নামের সেরকম একটি চরিত্রের প্রবেশ সে- কারণেই, ‘সন্ধ্যার মুখে-মুখে আগাছা-ঢাকা প্রাঙ্গণে সাপ-খোপ দেখা দিলে আমরা সিওর হওয়ার জন্য থ্যাতা করে বাঁশের বাড়ি মারি। তাতে নিষ্ঠুরতা এবং নিশ্চয়তা থাকে। এরকম বিষয় নিয়ে গল্প লিখে ফেললাম। বৃহন্নলা উপন্যাসে সুধা নামের একটি চাকুরে মেয়ে এসে গেল। সে ওরকম আহত অবস্থায় প্রত্যাখ্যাত হল। তার যন্ত্রণা আমি নিজে টের পেলাম।’ একথা শ্যামল নিজেই লিখেছে। কিন্তু এসব উপন্যাস কোথায় বসে লিখত ও? বাড়িতে তো নয়ই। ‘অনিলের পুতুল’ উপন্যাসটি লেখার ক্ষেত্রেও যা ঘটেছে, ‘লেখার সময়টাও বিচিত্র ছিল। বেলা তিনটে নাগাদ। বউবাজারে ব্যোমকেশবাবুর প্রেসে। সকালে শিফটের পর ওখানে গিয়ে লিখতাম। প্রকাশক রবি রায় মশায় তা ছোটো ট্রেডলে ছেপে বের করেছিলেন। অনিলের পুতুল।’
ক্ষুধার্তের মতো শ্যামল লেখার জায়গা খুঁজছিল একটা। তার সঙ্গে হয়তো খুঁজছিল লেখার নতুন বিষয়ও। কারণ, এই সময় থেকেই তো ওর মধ্যে একটু-একটু করে চাড়িয়ে উঠছিল জমির নেশা। আর, এরই মধ্যে, আমাদের বিয়ের এক বছর পরই, ৬১ সালে ভূমিষ্ঠ হল আমাদের প্রথম সন্তান মলি। আর মলির জন্মের ঠিক চার বছরের মধ্যেই আমাদের দ্বিতীয় সন্তান ললির আগমন। লেখার জন্য স্থানাভাব, সন্তানদের নিয়ে একটু গুছিয়ে থাকা আর জমির নেশায় ১৯৬৫ সালের লক্ষ্মীপুজোর পরদিন আমাদের চম্পাহাটির দিকে রওনা দেওয়া। মলি তখন চার বছরের আর ললির মাত্র সাড়ে তিন মাস। যদিও চম্পাহাটির নিজেদের বাড়িতে আমাদের প্রবেশ আরও দু’বছর পরে, ১৯৬৭ সালের জুলাই মাসে। মাঝের ওই সময় আমরা ছিলাম বেশ কয়েকটি ভাড়াবাড়িতে। সে-নিয়েও রয়েছে দারুণ একটা গল্প।
‘জমি। এর সঙ্গে জড়িত দখল। এর সঙ্গে জড়িত আশ্রয়। এর সঙ্গে জড়িত অঙ্কুর। কিংবা নবজন্ম। আর জড়িত লোভ। সামান্য একটুখানি দিয়ে শুরু হয়েছিল। তা বাড়তে থাকল। সে কী নেশা! অফিসে যাই না। জমি দেখে বেড়াই। একবার মনে আছে — কোনো এক বিখ্যাত চৌধুরীদের বড়ো কাছারিতে গেছি। সেখানে গেট-লাগানো একটি বিশাল ঘরে শুধু দলিল থাকে। বাবুরা সাদা হাফশার্ট আর ধুতি পরেন। ওঁরা স্টেটের দারোয়ান সঙ্গে দিলেন। একলপ্তে আশি বিঘা বিক্রি করবেন। জলে ডোবা জমি। সস্তায় দেবেন। বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টির ভেতর দিয়ে কোমর-জল ভেঙে রেললাইনের পাশে পৌঁছলাম। কয়েক মাইল জায়গা জলে সাদা হয়ে পড়ে আছে। বাতাস উঠলে সেখানে ঢেউ খেলে। স্টেটের দারোয়ান দূরের একটি ধ্যানস্থ মাছরাঙা দেখিয়ে বলল, পুবে চৌধুরী বাবুদের জমি ওই পর্যন্ত। পশ্চিমে আর মাছরাঙা পেল না বেচারা। জল ভাঙছি তো ভাঙছিই। একরকম নেশা।
আকাশের নীচে নির্জনে কত মাঠ পড়ে থাকে। তাদের ওপর দিয়ে হাঁটবার সময় অদ্ভুত লাগে। প্রান্তরের সাতটা তালগাছ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। এরাই এই প্রান্তরের রক্ষক। ধানখেত খুঁড়ে লোকে কচ্ছপ বের করছে। পুকুর কাটতে গিয়ে বারো হাত নীচে নৌকার গলুই পাওয়া গেল। একদা তাহলে এখানে নদী ছিল! জমির অনন্ত রহস্য। তার সঙ্গে কোর্ট-কাছারি। দলিল-দস্তাবেজ। উকিল -মুহুরি। লোভ। শরিকানি। অন্তহীন। আসলে পৃথিবীটা যেমন আছে, তেমন থাকে। যুগে যুগে মানুষ এসে দখল দাবি করে। কখনও অর্থবলে। কখনও লোকবলে।
এই ব্যাপারগুলো লেখায় আসতে লাগল।’
১৯৭৬ সালের ‘দেশ’ পত্রিকার সাহিত্য সংখ্যায় এই লেখাটি লিখেছিল শ্যামল। এই যে আমাদের শহর ছেড়ে চম্পাহাটির দিকে রওনা দেওয়া, তার কেন্দ্রে ছিল শ্যামলের জমির নেশা, চাষাবাস, গ্রামকে চেনা, গ্রামের মানুষকে আরও কাছ থেকে জানা। নাহলে কেউ শহর ছেড়ে এত দূরে আসে! অফিস-কাছারি, বন্ধুবান্ধব সবই তো শহরে। দুই মেয়ে, একজনের ক্লাস-থ্রি, অন্যজনের কে.জি. ওয়ান, দুজনেরই স্কুল কলকাতায়, ডায়সেশন। তবু শ্যামল আসতে চাইল, সপরিবারে। বাড়ি করতে চাইল চম্পাহাটিতে। চলে আসার কেন্দ্রে যদি জমির নেশা হয় তবে, জমির কেন্দ্রে ছিল লেখার তাগিদ। যে জীবন সে নিজে যাপন করেনি, যার মধ্যে নিজের উন্মোচন নেই, যে জিনিস তার করতলধৃত আমলকী নয়, সেসব নিয়ে সে লিখবে কেন? তার যে চাই একেবারে জ্যান্ত, টাটকা নিজের অভিজ্ঞতা। এসব যেমন সে বলত, আবার লিখেওছে তো তার বিভিন্ন লেখায়। তাই চম্পাহাটিতে আমাদের চলে আসা যেন নির্ধারিতই ছিল।
কিন্তু চলে এলেই তো হল না, যতক্ষণ না সেখানে বাড়ি তৈরি হবে, থাকব কোথায়! অগত্যা, আশ্রয় নিতে হল ভাড়া বাড়িতে। সাউথ গড়িয়ার একটি বাড়িতে কিছুদিন ভাড়া ছিলাম আমরা। সে-বাড়িকে বলা হত ‘খুনের বাড়ি’। বাড়ির মালিক ছিলেন সুহৃদবাবু। তাঁর স্ত্রী অন্য পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন। সেই সম্পর্কের কারণেই নিজের স্বামী সুহৃদবাবুকে খুন করেন ওই মহিলা। খুনের প্রক্রিয়াটা শুনুন। স্বামী ঘুমের ওষুধ খেতেন। একদিন বিকেলের চায়ে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিলেন। একটু ঝিমুনি আসতেই মাথায় আঘাত করা হল ভারী কোনো জিনিস দিয়ে। খানিকক্ষণের মধ্যেই সুহৃদবাবু মারা গেলেন। মহিলা চিৎকার করতে থাকেন, ‘কী হল, কী হল!’ পাশেই ছিল বর্ধিষ্ণু অজিত রায়ের বাড়ি। তাঁরা ছুটে এসে দেখেন এই কাণ্ড। সেই মহিলার জেল হয়েছিল।
বাড়ির এই গল্প শুনেই শ্যামল উৎসাহী হয়ে উঠল। অন্য সব বাড়ি দেখা বন্ধ করে সিদ্ধান্ত নিল থাকতে হবে এই বাড়িতেই। সুহৃদবাবুর দিদির কাছ থেকে মাসিক সত্তর টাকা ভাড়ায় অবিলম্বে পেয়েও গেল বাড়িটি। বাড়িটা এক অর্থে বিশাল। দোতলা, অনেকগুলো ঘর। শুধু একটি মাত্র ঘর সবসময়ের জন্য বন্ধ। ওই ঘরটাতেই থাকতেন সুহৃদবাবু। যেহেতু খুনের বাড়ি, তাই মোটপঁয়তাল্লিশটা আলো লাগিয়েছিল শ্যামল। পরে সুহৃদবাবুর স্ত্রী জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সেখানে থাকবেন বলে আমাদের উঠে যেতে হল। সেসময়ে একদিন ওই বন্ধ দরজাটা খোলা হয়েছিল। সুহৃদবাবু নিশ্চয়ই সেতার বাজাতেন। দেখলাম সেতার রাখা আছে সেই ঘরে। একটা অপূর্ব আরামকেদারা। বিশাল পালঙ্ক।
এ-বাড়িতে থাকার সময়েই শ্যামল লিখেছিল ‘খরার পরে’ গল্পটি। এর অনেক পরে ওর লেখা একটি উপন্যাস ‘হননের আয়োজন’-এও সেই খুনের ঘটনাটা ফিরে আসে। একদিকে ভালোই হল, ভাড়া বাড়ি ছেড়ে চলে এলাম নিজেদের বাড়ি। ১৯৬৭ সাল, ৯ জুলাই, উলটোরথের দিন আমাদের ছিল গৃহপ্রবেশ। এখন যে কো-অপারেটিভ সিস্টেমে জমি কেনা বা বাড়ি বা ফ্ল্যাট তৈরির চিত্রটি হামেশাই দেখি, তখনকার সময়ে ওই প্রথাটি ছিলই না। বলা যেতে পারে শ্যামলই প্রথম সেই উপায়টির আবিষ্কর্তা। চম্পাহাটিতে শুধু সে একা থাকবে কেন! তার কথায় একে একে উৎসাহী হয়ে উঠলেন অন্যান্য লেখকবন্ধুরাও। মতি নন্দী, কবিতা সিংহ, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, সন্তোষকুমার ঘোষ এবং আরও বেশ কয়েকজন শ্যামলের দেখাদেখি জমি কিনলেন চম্পাহাটিতে। কয়েকদিনের মধ্যেই শহর থেকে বহু দূরের এই চম্পাহাটি গ্রাম ভরে উঠল কলকাতার লেখক-কবিদের প্রাণোচ্ছ্বাসে। যারা জমি কিনলেন না, তাঁরাই বা চম্পাহাটির নিসর্গ থেকে বঞ্চিত হবেন কেন। সুনীল-স্বাতী, শক্তি-মিনাক্ষী, সমরেশ বসু, তারাপদ রায় এবং আরও অনেকেই ভিড় জমাতে শুরু করে দিলেন আমাদের বাড়িতে। আড্ডার কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না। এমনও হয়েছে, রাতে অফিস থেকে ফেরার সময় শ্যামল তার বন্ধুদলকে নিয়ে চলে এল বাড়িতে। রাত দুটোয় উনুন জ্বলল। মাংস রান্না হবে। প্রচুর লোকে এলেও স্থান সংকুলানের কোনো প্রশ্নই ছিল না। আমাদের জমিটি ছিল ৩১ কাঠার। তার মধ্যে অবশ্য ১৬ কাঠাই পুকুর। পাঁচতলার ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আমাদের মূল বাড়িটি ছিল ন’ কাঠার। পুকুরটি ছিল অপূর্ব। শ্যামলেরই পরিকল্পনা সব। সেখানে নামার জন্য মোট সাতাশটি সিঁড়ি। পুকুরের চারিদিকে গাছগাছালি আর সেইসব গাছের ফাঁকে ফাঁকে বসার জন্য সিমেন্টের পাকা বেদি। এখানেই জমত বন্ধুবান্ধবদের আড্ডা। দুটো বিশাল কদমগাছ ছিল পুকুরের দু’দিকে।
কিন্তু শ্যামলের বন্ধুবান্ধব তো শুধু লেখক সম্প্রদায়েরই ছিল না। বজরা, পঞ্চানন হাজরা, মদন, বদন, ভগীরথ, গণেশ, লক্ষণ, এরা ছিল গাঁয়ের চাষাভুসো মানুষ, শ্যামলের বন্ধু। পুকুরের ধারে বসে শ্যামল এদের সঙ্গে তাড়ি খেত, গল্প করত, প্রচুর তাড়ি খেয়ে ওদেরই মতো একসময় নিজেও হুঁশ হারাত। গল্প শুনত ওদের, গাঁয়ের গল্প। ও হ্যাঁ, আর তাড়ির সঙ্গে চাট হিসেবে থাকত একদম হাতে-গরম চিতি কাঁকড়া ভাজা। গণেশের বোন ছিল গাঁ-ঘরের শিক্ষিত মেয়ে। কিন্তু গণেশ তো গণেশ-ই। সে কী করল, ওর বোনের জন্য কোত্থেকে দুই পাত্রকে ধরে একজনকে একটি ঘরে এবং অন্যজনকে আরেকটি ঘরে বেঁধে রাখল। অসহায় পাত্রদুটির মুক্তিশর্ত ছিল এই, যে বিনা পণে বিয়ে করতে রাজি হবে, তাকে রেখে অন্যজনকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
গ্রামগঞ্জের এরকম অনেক ঘটনাই শ্যামলের সূত্র ধরে আমাদের কানেও আসত। হাসি পেত। কিন্তু সবসময় যে ভালো লাগত, তা নয়। নিয়মিত বন্ধুবান্ধবদের অ-তিথি আগমন কিংবা হাজরা বজরাদের সঙ্গে শ্যামলের যে জীবনযাপন — সামলাতে যথেষ্টই বেগ পেতে হত আমাকে। ভাবতাম, এত সময় ব্যয় করে এদের সঙ্গে আড্ডা মেরে শ্যামল কী পায়!
‘একবার একটা ইটখোলা করেছিলাম। লক্ষণ, পঞ্চানন হাজরা ইট কাটতে আসত শেষ রাতে। লাথগঞ্জের ইট। হাজার চোদ্দ টাকা। পাঁজা বসালাম। হাজারে ছ’মন কয়লা। মাসখানেক পরে পাঁজা ভেঙে বাসা, ছাই, এক নম্বর ইট, নিরেট ইট তুললাম। ইটখোলার ছাই ছেঁকে বস্তাবন্দী করলাম। তাই দিয়ে বাড়ি গেঁথে তুললাম। দেখলাম ইটখোলার কিছুই ফেলা যায় না। বাসা ভেঙে খোয়া। ছাই হল গাঁথুনির মশলা। পৃথিবীর খানিকটা কেটে নিয়ে তাই দিয়ে পৃথিবীর গায়ে বাড়ি। গোরুর মতো।
কত মায়া এর মধ্যে। কিছুই ফেলার নেই। এসব আমায় ভাবায়। বড়ো বড়ো ইটখোলার গর্ত আমায় অন্ধকারে ডাকে।’
এ শ্যামলের নিজের কথাই। শুধু বাড়ির একাংশ নির্মাণই নয়, খালের পাশ দিয়ে ছিল মাটির বড়ো রাস্তা। বন্ধুরা আসবে গাড়ি নিয়ে, তাদের জন্য খাল কেটে মাটি জোগাড় করে গাঁয়ের লোকেদের সঙ্গে এক হয়ে শ্যামল খুলে বসেছিল এক ইটভাটা। সেখানকার ইট দিয়েই সেই কাঁচা রাস্তা পাকা হয়েছিল। ইটের ছাপে থাকত আমাদের দুই মেয়ে মলি আর ললির নাম। কিন্তু রাস্তা তৈরি করলেই তো হল না, চোখের শ্রী যেমন কাজলে বাড়ে, তেমনই রাস্তার শ্রী ফিরল দুপাশের অগুনতি গাছের সৌজন্যে। বারুইপুর থেকে অজস্র গাছের চারা কিনেছিল শ্যামল। সেগুলোই পথকে করে তুলেছিল দৃশ্যত সুন্দর। শ্যামলের লেখা ‘গত জন্মের রাস্তা’য় তো সেই পথকেই দেখা গেল।
শ্যামলের কোনো কিছুর ক্ষেত্রেই ছোটোতে মন ছিল না। তাকে জমি কিনতে হবে অনেকটা, পুকুর থাকবে সেখানে বেশ বড়ো মাপের। আমাদের যথেষ্ট বড়ো ওই চম্পাহাটির বাড়িতে চারটে বড়ো বড়ো শোয়ার ঘর, একটা বিশাল বড়ো খাওয়ার ঘর, চারটে ঘরেরই ছিল আলাদা আলাদা বারান্দা এবং অ্যাটাচড বাথরুম। খাওয়ার টেবিলের আয়তনও ছিল আমার দেখা অন্য যে কোনো টেবিলের থেকেই অনেকটা বড়ো। কুড়িজন খেতে পারেন একসঙ্গে, এরকমই সে টেবিলের মাপ।
এদিকে গ্রাম মানেই তো অভাব। আগেই তো বলেছি, খাল কাটার ব্যবস্থা করেছিল ও, তাতে গভীরতা বেশি হওয়ায় মাছ জন্মাতে শুরু করল আরও বেশি। আর চাষাবাদ? মূলত দু-ধরনের ধান, আমন ও বোরো ধান চাষ ছাড়াও বিশেষ একরকম হাইব্রিড ধানের চাষ গ্রামে শুরু করল শ্যামল। ভূমিহীন চাষিরাই তো ওর বন্ধু। লোক-লশকরের অভাব হল না। যতদিন না পর্যন্ত চারা বড়ো হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত ধানের চাষ হত নিজের বাড়ির ছাদেই। এ পদ্ধতি সম্পূর্ণতই বিদেশের। শ্যামলই প্রথম এই চাষকে এদেশীয় করে তুলল। চারাগুলো বড়ো হলে তাদের বুনে দেওয়া হত জমিতে। ধান পেকে উঠলে তাদের রং দেখত শ্যামল। আমার সঙ্গে পঞ্চানন বা লক্ষণদের কোনো সখ্যই ছিল না। তা নিয়ে ওদের কিছু বলার ছিল। শ্যামল ওদের চোখে ভগবান, তাই ‘বাবু ভালো কিন্তু বউটা ময়াটে-চটা’ বলত ওরা।
‘জমির সঙ্গে সঙ্গে আমার অজান্তে আমি ফসলে চলে গিয়েছিলাম। একটি ধানচারা। তাকে বড়ো করে ধান তোলা। তার স্বভাব। সেই ধানের সঙ্গে আমাদের দেশের মানুষের কোন অতীত থেকে নাড়ির যোগ — সবই আমাকে ভাবাতে লাগল। সেই প্রথম দেখলাম — হাল দিতে দিতে চাষি বলদের সঙ্গে আপন মনেই জীবন, সংসার, বর্ষা, বউ, চাষবাস নিয়ে কথা বলে আর লেজ মোচড়ায়। চাষি ও বলদ একসঙ্গে ডোবার জলে মুখের ছায়া দেখে। চাষি বউয়ের হাতে গড়া রুটি গোহাটা থেকে ফেরার পথে চাষি খিদের চোটে নতুন কেনা বলদের সঙ্গে ভাগ করে খায়। এসব দেখে গল্প লিখলাম — হাজরা নস্করের যাত্রাসঙ্গী, যুদ্ধ ইত্যাদি।’
একবার একটা গোরু-ও পুষেছিল শ্যামল। বাছুর সমেত। হরিয়ানা গাই। শ্যামলের নিজের ভাষায় ওই গোরুর ‘চোখে গাঢ় করে কাজল টানা।’ ক্রমশ সে-ও বন্ধু ও লেখার বিষয় হয়ে উঠল শ্যামলের। ‘ঈশ্বরীতলার রূপোকথা’ এবং ‘সরমা ও নীলকান্ত’ উপন্যাসে সেই গোরুর দেখা মেলে। শুধু গোরু তো নয়, হাঁস-মুরগি-ছাগল, জগতের প্রায় সমস্ত গবাদিকেই পুষেছিল শ্যামল। গ্রামের লোকেরা বলত, শ্যামল বাঙালের চিড়িয়াখানা। ‘ঈশ্বরীতলার রূপোকথা’ -র অনাথবন্ধুর সেই চিড়িয়াখানার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
আর ছিল গ্রামের ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করার নেশা। এখন আমরা দেখি না, বিভিন্ন ছোটো ছোটো স্কুল গড়ে উঠেছে গ্রাম মফসসলের পাড়ায় পাড়ায়, অঙ্গনওয়াড়ির মতো, যেখানে মিড ডে মিলের ব্যবস্থাও করা হয়, এই সিস্টেমও শ্যামলের মাধ্যমে অনেক আগেই প্রবর্তিত হয়ে গেছে চম্পাহাটিতে। স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি মিড ডে মিল হিসেবে বুলগারের খিচুড়ি, গুঁড়ো দুধ আর বিস্কুটের ব্যবস্থা করেছিল শ্যামল। এই বুলগার আসত আমেরিকার একটি সংস্থা থেকে। এবং এই বুলগারকে কেন্দ্র করেই মূলত শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিরোধ বাধল গ্রামের বেশ কয়েকজন হম্বিতম্বিদের। সে কথায় পরে আসছি, তার আগে আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার কথা বলা যাক, শ্যামলের নিজের ভাষায়, ‘বাসুদেব সাহিত্য পত্রিকা বের করল। তাতে সুনীল লিখল গল্প। খুবই ভালো গল্প। আমি লিখলাম ধারাবাহিক উপন্যাস। তিনটে সংখ্যা বেরিয়ে কাগজ বন্ধ হয়ে যায়। উপন্যাসের নাম ছিল ‘গণেশের বিষয় আশয়।’ তখন ধানচাষ করছি। ইটখোলা করছি। গোরুর নেশায় মজে আছি। এর ভেতর একদিন কলকাতার বাইরে আমাদের বাড়িতে সাগরদা — সাগরময় ঘোষ এলেন। সঙ্গে আনন্দ পাবলিশার্সের ফনিদা। বন্ধু-বান্ধবরাও এল।
এর ক’দিন বাদে সাগরদা আমায় সাপ্তাহিক দেশ-এ ধারাবাহিক উপন্যাস লিখতে বললেন। কিন্তু লিখব কী। তখন যে বাসুদেবের কাগজে গণেশের বিষয় আশয় তিন কিস্তি পড়ে আছে। আর আমিও জমি, পরচা, মৌজা ম্যাপ এসব নিয়ে পড়ে আছি। তার ওপর ট্রেনে করে কলকাতা গিয়ে আনন্দবাজারে খবর লিখি।
ব্যাপারটা বললাম সাগরদাকে। সাগরদা বললেন, ‘ওইটেই লেখো’। লিখলাম। নাম দিলাম ‘কুবেরের বিষয় আশয়’। … একদিন বিকেলের ডিউটিতে অফিসে গিয়ে দেখি ‘দেশ’-এর একটা খাম পড়ে আছে লেটার বক্সে। আমার নামে। সাগরদার হাতের লেখা। খুলে ভীষণ ঝাঁকুনি খেলাম। ‘শ্যামল, চার সপ্তাহের ভেতর উপন্যাস শেষ করে দাও।’
হ্যাঁ, ওই চম্পাহাটি পর্বেই ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ লেখা এবং তার সমাপ্তি। শ্যামল আঘাত পেয়েছিল কতখানি তা ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়, আরও বোঝানো অসম্ভব, প্রকাশ মাত্রেই সেই ধারাবাহিক লেখার জনপ্রিয়তা। পরে নিজের একটি লেখায় এই বই নিয়ে শ্যামল লিখেছে:
‘… সাপ্তাহিকে বেরোবার সময় সম্পাদক ওটাকে উপন্যাস বলেই গণ্য করেননি। ক্ষমা- ঘেন্না করে বিজ্ঞাপন করতেন : ধারাবাহিক রচনা। আচমকা চিঠি দিয়ে বলেছিলেন, আর চার কিস্তির ভেতর শেষ করে দাও।
তাই শেষ করেছিলাম।
সেই সম্পাদক বারো বছর পরে সেদিন বললেন, কী বই লিখেছিলে। ক্লাসিক। আমি ধন্য হয়ে কৃতার্থের হাসি হেসেছিলাম।’
বিপিনবাবুকে আপনারা অনেকেই চেনেন। শ্যামলের লেখা ‘পরী’ গল্পের নায়ক তিনি। বেহালা বাজিয়ে জোছনা রাতে যিনি পুকুর থেকে পরির উঠে আসা আমাদের দেখিয়েছিলেন। আসলে বিপিনবাবু আমাদের দেখাতে পারেননি কিছুই। দেখেছিলেন উনি নিজেই, পরিকে, কল্পনায়। কিন্তু তাঁর কল্পনার এত জোর ছিল যে শ্যামল নিজেই ওই ‘পরী’ গল্পে সেই রাতটিকে ফুটিয়ে তুলতে বাধ্য হল। বহুরকম হুজুগের মধ্যেই তো থাকত শ্যামল, একে তাকে ধরে আনত বাড়িতে। বিপিনবাবুও তেমন।
স্বপ্ন বা ভ্রম যে কত রকমের, আর সেই স্বপ্নের মধ্যেই তো শ্যামল ডুবে থাকত সারাক্ষণ। এবার আমার নিজের একটা স্বপ্নের কথা বলি। চম্পাহাটিতে চলে এসেছি অথচ শ্যামলের মা এ বাড়িতে আসতেই পারলেন না। তার আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। শ্যামলের খুব ইচ্ছে ছিল এ বাড়িতে মাকে নিয়ে থাকার, আমারও। সেই ইচ্ছে পূর্ণ না হওয়ায়, মায়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে প্রায় একমাস ধরে শ্যামলের বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে সে কী হাপুস নয়নে কান্না। একদিন ঘুমের ভিতর আমি টের পেলাম শাশুড়ি-মা খুব ভোর ভোর, আলো ততটা ফোটেনি সকালের, দরজা খোলাই ছিল, বাড়িতে ঢুকলেন। গেলেন যে ঘরটায় ঠাকুর রাখতাম, সেখানে। লালপেড়ে শাড়ি পরে এসেছিলেন সেদিন। দৃশ্যটা আজও ছবির মতো স্পষ্ট। হাঁটু মুড়ে ঠাকুরকে প্রণাম করে যে দরজাটা দিয়ে এসেছিলেন, নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন ঠিক তার উলটো দরজাটি ধরে। কেউ টের পায়নি সেদিন। এমনকি বাঘাও।
বাঘা ছিল শ্যামলের প্রথম পোষা কুকুর। যে সে কুকুর নয়, অ্যালসেশিয়ান। মাত্র একমাস বয়স যখন, তখন ওকে কিনে আনে শ্যামল। কয়েকদিনের মধ্যেই বাঘা হয়ে উঠল শ্যামল গাঙ্গুলির হট্টগোল কোম্পানির অন্যতম সদস্য। বাঘাকে শ্যামলের বন্ধুবান্ধবেরা ইনটেলেকচুয়াল ডগ বলে ডাকত। সুনীল-শক্তি-শরৎ-সন্দীপনরা যখন এসে আড্ডায় বেশ জমাটি, পাহারাদার বাঘা তার ডিউটি ভুলে যোগ দিত সাহিত্যচর্চায়। বাঘার বুদ্ধিজীবীতা এখানেই থেমে ছিল না। ওরা ট্রেনে করে ফেরার সময় বাঘাও যেত পিছু পিছু, শিয়ালদহ স্টেশন থেকে বিদায় জানিয়ে ফিরতি ট্রেনে ফিরে আসত ফের। এভাবেই একদিন গুঁড়ো দুধ আর মাংসের ছাঁট মেশানো বুলগার খেয়ে বিপুলবপু বাঘা হারিয়েও গেল, প্রায় আটমাসের জন্য। সন্তান হারিয়েছে যেন, শ্যামল সেভাবেই তন্নতন্ন করে খুঁজতে শুরু করল বাঘাকে। যখন হাল প্রায় ছেড়েই দিয়েছে, ঠিক তখনই কে যেন সন্ধান দিল, বাঘা আছে, বারুইপুরের একটি বাড়িতে। সেখানেও গিয়ে পৌঁছল শ্যামল। বাড়ির মালিককে জিজ্ঞেস করল বাঘার কথা। সেই বাড়ির লোক ‘না’ বলতে শ্যামল জোরে ‘বাঘা’ বলে হাঁক দিল। চেন ছিঁড়ে দৌড়ে বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এল বাঘা। এক লাফে শ্যামলের কোলে। কোলে কাঁখেই তো মানুষ।
পাড়ায় সারমেয়কূলের কাছে বাঘা ছিল নায়ক। রাস্তায় মেয়ে কুকুরেরা ওকে দেখলে আল্হাদী হয়ে পড়ত। আমাদের বাড়িতে শ্যামলের সঙ্গে যেসব চাষিরা তাড়ি খেত, তারাই আবার রাতে ওই এলাকায় ডাকাত। যেদিন ডাকাতি থাকত না, সেই রাতগুলোয় তারাই ছিল যাত্রাপালার অভিনেতা। রাত করে আমরা যাত্রা দেখতে যেতাম। দুই মেয়ে, শ্যামল আর আমি। এবং বাঘাও। যেহেতু বাঘা যাচ্ছে সেহেতু পাড়ার সব মেয়ে-কুকুররাও। কিন্তু যাত্রায় বাঘা ছাড়া আর কারুরই প্রবেশাধিকার না থাকায় ওই কুকুরগুলো বাইরে থেকেই চেঁচিয়ে বাঘাকে ডাকত। কিন্তু বাঘা তখন সংস্কৃতিমনস্ক। শান্তিগোপালের হাতে বন্দুক গর্জন করতেই বাঘার সে কী হুংকার! গাঁয়ের লোকেরা বলতে লাগল, ‘এই শোন, শ্যামল বাঙালের কুকুরটা এইছে রে।’ বাঘাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে ডাকাতদের কেউ। শ্যামলের অনেক লেখাতেই বাঘা ঘুরে ফিরে এসেছে। অনাথবন্ধুর চিড়িয়াখানার সেও তো এক সদস্য। এছাড়াও, বাঘাকে আমি আবার খুঁজে পেলাম শ্যামলের লেখা ‘হাঁসুলীডাঙার বিপদ’-এও।
চম্পাহাটি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল বিভিন্ন কারণে। রাজনৈতিক অস্থিরতা তো ছিলই, ছিল ডাকাতদের উৎপাত, তার উপর গ্রামের নিম্নবিত্ত লোকেদের কাছে শ্যামল ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় সেই গ্রামেরই বেশ কয়েকজন মাতব্বর আর সহ্য করতে পারছিল না ওকে। গ্রামে তখন বিচার চললে শ্যামলই মোড়ল। এই অবস্থা সবাই মেনে নেবেন কী করে। এদিকে মেয়েরাও বড়ো হয়ে উঠেছে। তাদের কলকাতায় স্কুল। এতদূর থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করা তো কষ্টের। নাচ-গানও তো শেখাতে হবে ওদের। চম্পাহাটির বাড়িতে উঠেছিলাম উলটোরথের মেলার দিনে। ১৯৭২ সালে, ঘুটিয়ারি শরিফের মেলা যেদিন বসেছিল, সেই উৎসবের দিনেই সপরিবারে শ্যামল চম্পাহাটি ছাড়ল। গ্রামের নৈঃশব্দ মিশে গেল কলকাতার যানজটে।
চম্পাহাটি থেকে চলে এলেও শ্যামলের লেখা কিন্তু চম্পাহাটিকে ছাড়ল না। ‘চন্দনেশ্বরের মাচানতলায়’, ‘কন্দর্প’ এই রকম বহু লেখা ও লিখেছিল চম্পাহাটিতে বসেই। কিন্তু আরও অজস্র লেখায় গ্রামজীবনের সঙ্গে কথা বলেছিল শ্যামল, কলকাতায় এসেও। একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘চম্পাহাটি তো ছাড়লে, কোনো মায়া রয়ে গেল কি?’ শ্যামলের নাতিদীর্ঘ উত্তর, ‘ওটা নিয়ে আমার সব হয়ে গেছে।’ গ্রামকে সম্পূর্ণভাবে জেনে-শুনে-বুঝে-লিখে তবেই গ্রাম-ছাড়া হল শ্যামল।
চম্পাহাটি থেকে চলে আসার পর আমাদের নতুন ঠিকানা হল প্রতাপাদিত্য রোড। প্রথম তিন মাস কল্যাণ মুখার্জির বাড়িতে ভাড়ায় ছিলাম। তারপর উঠে গেলাম ৫০/১ প্রতাপাদিত্য রোডে। শ্যামল যেখানেই নতুন যায়, গিয়ে সেখানকার পাড়ার লোকজন, কমবয়সি ছেলেপিলেদের সঙ্গে আড্ডায় মজে যেত। পাড়ার ছেলেপিলেদের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব আড্ডা আসলে, নিজের গল্পের খোঁজ। ওরাই ওকে খবর দিল, কাকু, আরও বড়ো বাড়ি খুঁজছেন? আছে। এ-পাড়াতেই। সেই সূত্রেই পরিচিত কল্যাণবাবুর বাড়ি ছেড়ে সপরিবারে আমাদের নতুন বাড়িতে উঠে আসা। সেখানে বেশ কিছুদিন আমাদের সঙ্গেই ছিল শ্যামলের আরেক ভাই তরুণ গঙ্গোপাধ্যায় ও তার পরিবার। শ্যামলের জীবনের নানা উত্থান-পতনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই বাড়ি। বাড়ির ভাড়া ছিল ৪০৫ টাকা, যা তখনকার সময়ে যথেষ্টই বেশি। শ্যামল অবশ্য তাতে ঘাবড়াত না। বলত, লিখে টাকা জোগাড় করে ফেলব।
প্রতাপাদিত্যের এই বাড়িতে থাকাকালীন মাসিক কৃত্তিবাস নিয়ে আরও মেতে উঠল শ্যামল। এ কথা বললে বেশি বলা হবে না আজ, শ্যামল গাঙ্গুলির কাঁধ ছিল চওড়া। বরাবরই নিজের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নেওয়ার এক অপরিসীম ক্ষমতা লক্ষ করেছি ওর মধ্যে। কৃত্তিবাস মানে প্রায় গোটা পঞ্চাশের দশক। আর কৃত্তিবাস মানেই তো ওর সব বন্ধুরা। কেমন সেই বন্ধুত্ব, তার নমুনা শ্যামলের নিজের ভাষাতেই আমরা শুনে নিতে পারি:
১. ‘আসলে পানীয়ের চেয়ে সঙ্গটাই বড়ো ছিল। ঠিক এভাবেই আজকে বলতে পারি — লেখালেখিও ছিল একটা অছিলা মাত্র। আসলে লক্ষ্য ছিল বন্ধুত্ব। মেশামেশি। ঘন ভালোবাসাবাসি। একদম কনডেন্সড। যা দিলে অনেকগুলো হৃদয় একসঙ্গে একটি পায়েসে মিশে যায়।
সেই ঘন মেশামেশির জন্য সারা কলকাতা একখানি কাঁসার থালা হয়ে তার উপরে আমাদের তুলে ধরেছিল …’
২. ‘আজ যাকে পঞ্চাশের দশক বলা হয় — সেই তখনটা ছিল আমাদের কাছে অর্ডিনারি সময়। বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, অনুসন্ধান, আবিষ্কারের ময়াম গায়ে মেখে তা হয়ে গেল যুগ।
অনেকে লিখতে এসেছিলাম। বলা ভালো বন্ধুত্ব করতে। এক ঝাঁক ঝাঁজাল যুবা। তার ভেতর লেখালেখিটা ফাউ। কখন যে এই ফাউ হয়ে দাঁড়াল আসল, তা টেরও পায়নি কেউ।’
৩. ‘কৃত্তিবাসের একটি বড়ো সংখ্যা বেরোবে। সুনীল তখন মৌলালির মোড়ে চাকরি করে। আমি একটি বড়ো গল্প লিখেছি। সেই সংখ্যায় গিন্সবার্গ কবিতা লিখেছিলেন। বৃষ্টির বিকেল। সুনীল প্রুফের বান্ডিল নিয়ে প্রেসে যাচ্ছে। গম্ভীর থমথমে মুখ। লালবাজারের দিকে রাস্তা ভিজে কাই। সুনীলের পা কাদায় মাখামাখি। আমায় বলল, দেশে একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে দিবি?’
৩ নম্বর নমুনায় যা উল্লিখিত, তা কিন্তু পঞ্চাশ দশকের ঘটনা। সময় বয়ে যেতে যেতে এসেছে মধ্য-সত্তর দশকে যখন মাসিক কৃত্তিবাসের বিজ্ঞাপন জোগাড়ের জন্য শ্যামল আরও ঘটা করে নেমে পড়ল, না হলে পত্রিকা চলবে কীভাবে। প্রতাপাদিত্য রোডের বাড়ি থেকে প্রতিদিন সকাল নটায় শ্যামল ওর এক জ্ঞাতিভাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ত পত্রিকার বিজ্ঞাপন সংগ্রহে। সারাদিন বিভিন্ন কর্পোরেট হাউসে সেই সূত্রে যাতায়াত। মধ্যেকার সময়ে আনন্দবাজারের ডিউটি। ডিউটি খতম তো আবার সেই বেরিয়ে পড়া, কৃত্তিবাসেরই বিজ্ঞাপন জোগাড়ের কাজে। মাঝের সময় ব্যস্ততার কারণে বহুদিন হয়েছে খেতেও পারেনি লোকটা। রাতে কর্পোরেট হাউসের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিজ্ঞাপনসংক্রান্ত আলোচনা চলত শহরের কোনো পানশালায়। সেখানে অবাধ মদ্যপান। দিনের পর দিন এরকম তো কারোর চলতে পারে না। শ্যামলও অসুস্থ হয়ে পড়ল। আক্রান্ত হল প্লুরিসি- তে। আমরা ব্যতিব্যস্ত শ্যামলকে নিয়ে। আর শ্যামল চিন্তিত ওর প্রিয় আনন্দবাজারের চাকরি, বন্ধুত্ব আর কৃত্তিবাসের বিজ্ঞাপন বিষয়ে।
শ্যামলকে নিয়ে এই লেখা প্রস্তুত করার সময় বিভিন্ন বইপত্তর তো ঘাটতেই হচ্ছে। এমন সময় হাতে উঠে এল দুটো সংকলন, ওর মৃত্যুর পর যা প্রকাশিত হয়েছিল। অভিন্ন হৃদয়ের দুই বন্ধু সুনীল আর শ্যামল। সুনীল তো নিজেই লিখেছে বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র শ্যামলের সঙ্গেই ওর তুই- তোকারি সম্পর্ক। বন্ধুত্বের সেই আবহকে ফুটিয়ে তুলতে সংকলন দুটো থেকে সুনীলের লেখার কিছু অংশ ধার করছি:
১. দুটি শব্দবন্ধ শ্যামল আমাদের মধ্যে চালু করে দিয়েছিল, ‘মেশামেশি’ আর ‘লাভ, লাভ অ্যান্ড লাভ কোম্পানি’। প্রায়ই বলত, আয় আমরা মেশামেশি করি, কিংবা আয় লাভ, লাভ অ্যান্ড লাভ কোম্পানি খুলি।
২. শ্যামল কবিতার ধার ধারে না, তা বলে কি আমাদের ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় ওর কোনো লেখা ছাপা হবে না? শ্যামল যে আমাদেরই একজন। এক সংখ্যায় শ্যামলের ‘সুন্দর’ নামে একটি রচনা ছাপা হল, যেটি কবিতা নয়, কিন্তু অনবদ্য। এর কিছুদিন পর শ্যামল একটা গল্প পড়ে শুনিয়েছিল, একেবারে অভিনব আঙ্গিক, বাংলা ভাষায় যে- জাতের গল্প আগে কেউ লেখেনি। সঠিক মনে নেই, গল্পটির নাম ‘বিদ্যুৎচন্দ্র পাল বিষয়ে কিছু জ্ঞাতব্য বিষয়’ বা, এইরকম কিছু। অমন চমকপ্রদ গল্পটি আমি কৃত্তিবাসে ছাপার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমার কোনো কোনো বন্ধুর তাতে আপত্তি ছিল, তাদের ধারণা, গল্প ছাপা হলে বিশুদ্ধ কবিতা পত্রিকা কৃত্তিবাসের সতীত্ব নষ্ট হবে। সতীত্ব বিষয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না এবং কৃত্তিবাসের সম্পাদক হিসেবে আমি ছিলাম অটোক্র্যাট। সেই গল্পটি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। পরবর্তীকালে ‘কৃত্তিবাস’ যখন মাসিক পত্রিকা হিসেবে বেরোতে শুরু করে, তখন শ্যামল এর পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
৩. সমগ্র বাংলার লেখক সমাজে শ্যামল ছাড়া আর কেউ আমাকে তুই বলে না। একটা সময় শ্যামলের সঙ্গে আমার কোনো প্রেমিকাকে নিয়ে চুম্বন ভাগাভাগি করতেও রাজি ছিলাম। শ্যামল অবশ্য সে- ভালোবাসার মূল্য সবসময় দেয়নি।
৪. চম্পাহাটি নিয়ে শ্যামল অনেকখানি জড়িত হয়ে পড়েছিল বলেই শুধু নয়, গোষ্ঠীবদ্ধভাবে আড্ডা শ্যামলের তেমন পছন্দ ছিল না। দু-একজনের সঙ্গে নিবিড় হয়ে থাকতেই সে স্বচ্ছন্দ বোধ করত। যখন আমি জনসেবক নামের পত্রিকায় সান্ধ্য চাকরি করি, শ্যামল চলে আসত শেষের দিকে। দুজনে বেরিয়ে একটা রামের বোতল কিনে চলে আসতাম নাগেরবাজারে। সেখানে বারান্দায় বসে গল্প ও তর্কাতর্কি হত সারারাত। কয়েক ঘণ্টা ঘুমের পর সে স্বাতীকে বলত, এক্ষুনি তৈরি হয়ে নাও, আমরা চম্পাহাটি যাব। জোর করে রাজি করাত স্বাতীকে, সরাসরি চম্পাহাটি গিয়ে আবার ছেঁড়া আড্ডায় সংযোজন।
এরকম হয়েছে অনেকবার, কিন্তু বহুবছর চলতে পারে না। মাঝখানে ছেলেমেয়েরা এসে পড়ে, দায়িত্ব চাপে কাঁধে, জীবিকার ক্ষেত্র বদলে যায়, সাহিত্য সম্পর্কে ধারণাও বিভিন্ন হতে বাধ্য। তৈরি হয়ে যায় দূরত্বও। বৃত্তও হয়ে যায় নানারকম।
ক্রমেই সুস্থ হয়ে উঠল শ্যামল। কিন্তু, বন্ধুত্বে টের পেতে শুরু করল অন্যরকম স্বাদ, ‘… লেখার শুরু হয় যন্ত্রণা, আবেগ থেকে। তা থেকে বাড়ি- ঘরদোর হয়ে গেলে — লেখাটা প্রফেশন হয়ে গেলে তার ভেতর দক্ষতা যেমন আসে তেমনি হারাবার জিনিসও অনেক ঘটে। যার প্রথম বলি — বন্ধু। কারণ, লেখককে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়। বন্ধু আর লেখাকে মিলিয়ে মিশিয়েই তো আমরা হয়ে উঠেছিলাম। তার ভেতর বন্ধু হয়ে গেল ব্যস্ত। কেজো। দরকারের কড়ি জোগাড়ে সে জড়িয়ে গেল। পড়ে থাকল লেখা।’
খুব শান্ত, স্তব্ধতার মধ্যে দিয়ে কৃত্তিবাসের সঙ্গে যেন শ্যামলের তৈরি হয়ে গেল দূরত্ব। ঠিক এরকম একটি সময়েই ওর প্রিয় কাজের দপ্তরে এমন একটি ঘটনা ঘটে গেল যার জন্য আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করতে হল শ্যামলকে। ওর প্রিয় কর্মক্ষেত্র ছিল ওটি। তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার খেদ ওকে কষ্ট দিয়েছে আজীবন।
ঠিক কী ঘটেছিল ওর কর্মক্ষেত্রে? শুনেছি অনেকেই নিজেদের মতো করে সেই ঘটনার কথা নাকি বলে থাকেন। সন্তোষকুমার ঘোষের সঙ্গে শ্যামলের কী এমন ঘটল যার ফলে ওকে সরে আসতে হল প্রিয় কর্মস্থল থেকে।
শ্যামলের লেখা থেকেই দেখা যাক সেই ঘটনাটিকে:
‘রূঢ় অপমানকর ব্যবহার অবশ্যই করেছেন। সিরাজ যে লিখেছে, একজন মেরে হাত ভেঙে দিয়েছিল — কথাটা ঠিক নয়। একজনকে সোয়াইন বলেছিলেন। আরেকজন পরে রেগে গিয়ে একটি চড় মেরেছিল। তাতে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে যায়। তখন সেই আরেকজন সাবধানে তুলে নিয়ে গিয়ে ইজিচেয়ারে তাকে শুইয়ে দিয়েছিল। জল এনে খাইয়ে দিয়েছিল। আয়োডেক্স এনে ব্যথার জায়গায় লাগিয়ে দিয়েছিল। তারপর সে অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। এ সব কথা সিরাজের জানার কথা নয়। তখনও সিরাজ সেই অফিসে যোগ দেয়নি। অপ্রীতিকর ঘটনার সময়ে সেখানে সুনীল ছিল। সুনীলের তখন কিছু করার ছিল না। তবু আমি বলব — দোষ আমারই। তাঁর কাছে আমি কাজ শিখেছি। ভালোবাসাও পেয়েছি।
অফিসে, আইনের ভাষায় একটি domestic enquiry হয়েছিল। সারা প্রতিষ্ঠানের কেউ আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেননি। আমাকে সাসপেন্ড করা হয়। সাসপেনশনের নিয়ম ছ-মাস হাফ পে। তারপর নিষ্পত্তি না হওয়া অব্দি আমাকে চাকরির মেয়াদ, আরও প্রায় ১৮ বছর শতকরা ৭৫ ভাগ মাইনে দিয়ে যেতে হত। বসিয়ে-বসিয়ে। ইনক্রিমেন্ট সমেত। ডমেস্টিক এনকোয়ারিতে আমাকে দোষী প্রমাণ করা গেল না। এই সময়ে সমরেশ বসু আমার খোঁজ নিয়েছেন। অন্যত্র আমার লেখা প্রকাশে সাহায্য করেছেন। সম্পাদক হিসেবে মধুসূদন মজুমদার, মণীন্দ্র রায় লেখা চেয়েছেন। এই প্রকাশই তখন আমার একমাত্র ভরসা ছিল। অভীকবাবু অনুরোধ করেন আমাকে। ফিরে আসুন। সন্তোষদা বললেন, তুমি কষ্ট পাও, তা আমি চাই না। প্রতিষ্ঠান বলল — আপনি আর সন্তোষবাবু letter of regret নিজেদের ভেতর বিনিময় করুন।
আমি আর সন্তোষদা এলফিনে গেলাম। উনি নিলেন জিন। আমি নিলাম হুইস্কি। দুপুরবেলা। ভেতরটা ঠান্ডা, বাইরে কড়া রোদ্দুর। আমার তেতাল্লিশ। ওঁর পঞ্চান্ন। খাওয়া-দাওয়া হল। চিঠি বিনিময় হল। দু-জন দুঃখপ্রকাশ করে দু-জনকে চিঠি লিখলাম। আমার চিঠি ওঁকে দিলাম। ওঁর চিঠি আমাকে দিলেন। সেদিন বোধহয় আমরা সিজলিং চিকেন খেয়েছিলাম সঙ্গে। শব্দ- তোলা, ধোঁয়া-ওড়ানো। ওঠার সময় সন্তোষদা বললেন, আমার চিঠিখানা দাও, শ্যামল। সব তো মিটে গেল। আর ও চিঠি রেখে কী করবে! মিটেই যখন গেছে, তখন ও চিঠি দিয়ে আর কী করব। সন্তোষদার চিঠি সন্তোষদাকে দিয়ে দিলাম। আমার দুঃখপ্রকাশ করে লেখা চিঠিখানি সন্তোষদার কাছ থেকে নেবার দরকার মনে হয়নি সেদিন।
ওঃ! একটা কথা ভুলে গিয়েছিলাম। ওই অপ্রীতিকর ঘটনার মাসখানেক আগে সন্তোষদার কথায় শরৎচন্দ্র ও পতিতাদের বিষয়ে তিন কিস্তিতে একটা লেখা লিখি আনন্দবাজারে। সে বছর সম্ভবত শরৎ জন্মশতবার্ষিকী ছিল। সন্তোষদা লেখাগুলোর ল্যাজামুড়ো কেটে ছেপেছিলেন। সেখানেই ক্ষোভের শুরু। তার ২০-২২ দিন পর, যত দূর মনে পড়ছে জানুয়ারির শেষদিকে, ভুবনেশ্বরে পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি সম্মেলন ছিল। সন্তোষদা গিয়েছিলেন। আমি সে সভা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যাই। এবং কিছু লিখি না।
আমি কোনারকে চলে যাই। সেখানেই রাগারাগির কারণ আরও জোরালো হয়েছিল। তার কয়েকদিন পরেই তো ওই ঘটনা।
যাক গিয়ে। সন্তোষদার চিঠি সন্তোষদা আমার কাছ থেকে চেয়ে নিলেন। আমার দুঃখপ্রকাশের চিঠি সন্তোষদার কাছে থেকে গেল। প্রতিষ্ঠান আমাকে চিঠি দিল — আপনি সন্তোষবাবুর কাছে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। সে চিঠি আমরা পেয়েছি। আপনাকে ক্ষমা করে শাস্তি তুলে নেওয়া হল। আপনার কাটা বেতন ফেরত দেওয়া হচ্ছে। আপনি কাজে যোগ দিন। অবিলম্বে। প্রতিষ্ঠানের চিঠিতে আমাকে ‘ক্ষমা’ করার কথাটি আমার ভালো লাগল না। অপমানকর মনে হল। তাছাড়া সন্তোষদা যে আমার কাছে দুঃখপ্রকাশ করেছেন, সে কথা তো প্রতিষ্ঠানের চিঠিতে নেই। সন্তোষদাকে বললাম, কী ব্যাপার? এরকম হল কেন? আমাকে লেখা আপনার দুঃখপ্রকাশের চিঠি অফিসকে দেননি? যে-চিঠি আমার কাছে থেকে চেয়ে সন্তোষদা বলেছিলেন, ভুলে যাও শ্যামল। অভীকবাবুকে বললাম। তিনিও বললেন ভুলে যান। কয়েকটি ইনক্রিমেন্ট দিয়ে আমাকে প্রমোশন দেওয়া হল। এর কয়েক মাস আগে শীর্ষেন্দু ও সিরাজ কাজে যোগ দিয়েছিল। আমি কিন্তু ভুলতে পারিনি। ‘ক্ষমা’ কথাটি আমার ভালো লাগেনি। এই সময়ে আমার বাবা মারা যান। শ্রাদ্ধে অভীকবাবু এসে অনেকক্ষণ ছিলেন। এর কিছুদিন পরে আমি পদত্যাগের চিঠি দিই। আমার পরের ভাই তরুণ গঙ্গোপাধ্যায় তখন হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড-এ। তাকে অভীকবাবু বলেছিলেন, আপনার দাদাকে আটকান। পদত্যাগের চিঠি বেশ কিছুদিন ওঁরা রেখে দিয়েছিলেন। যাতে আমি না- যাই। অভীকবাবুকে আমার আগাগোড়াই আন্তরিক লেগেছিল।
কিন্তু তখন আমার মন ভেঙে গিয়েছিল। ‘ক্ষমা’ কথাটির জন্যে। আর নিজের দুঃখপ্রকাশের চিঠি সন্তোষদা অফিসকে না- দেওয়ায়। কিংবা অফিস সে চিঠির কথা উল্লেখ না করায়। চাকরি ছেড়ে আমি একটি সাহিত্য সাপ্তাহিকে যাই। সেখানে কয়েক মাসের ভেতরে সন্তোষদার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার যত্ন করে ছেপেছিলাম। সন্তোষদা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোটোগল্পের ওপর তিনটি বক্তৃতা দেন। তাতে আমার এতই প্রশংসা করেন যে আমি খুব লজ্জা পাই।
এরপর সন্তোষদা এসেছেন। আমি গেছি। সব মুছে গেছে।’
সে সময় আমরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত। শ্যামলও ভেঙে পড়ত নিশ্চয় যদি না দৈবাৎ ‘যুগান্তর’ পত্রিকার কর্ণধার তুষারকান্তি ঘোষ পাশে এসে দাঁড়াতেন। শ্যামলকে দায়িত্ব দেওয়া হল সেখানকার সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘অমৃত’-র। সংবাদপত্র জগতের সঙ্গে দ্বিতীয় জীবন শুরু হল শ্যামলের। ‘অমৃত’ নিয়ে শ্যামল বিস্তর চিন্তাভাবনা শুরু করে দিল অবিলম্বে। ও বিশ্বাস করত যে কোনো পত্রিকাকেই প্রাণ দিতে পারে একমাত্র তরুণদের রক্ত। তারুণ্যের অভাব হলে পত্রিকা জীর্ণ হয়ে পড়ে। ফলে ‘অমৃত’য় সে স্বাগত জানাল তরুণদের। তরুণ লেখক-কবিই শুধু নয়, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী — এঁদেরকেও জড়ো করে আনল ‘অমৃত’-র পাতায়। অনেক তরুণ লেখকের অভিষেক যেমন ‘অমৃত’-য় তেমনই সেইসব গল্প-উপন্যাসের ছবিও এঁকেছেন তরুণ শিল্পীরাই। আজ যাঁরা বাংলা সাহিত্যে উজ্জ্বল নাম, তাঁরা প্রায় সকলেই শ্যামলের সূত্রে তখন ছিলেন ‘অমৃত’-র লেখক। ফলে অচিরেই শ্যামলের নতুন বন্ধুবান্ধব হয়ে উঠল ওই নতুন লেখকরাই। প্রতাপাদিত্য রোডের বাড়িতে তখন সকাল-বিকেল তরুণ লেখক-শিল্পী-নাট্যকারদের আসা-যাওয়া-আড্ডা-তর্ক এবং শ্যামল থাকলে যা খুব স্বাভাবিক — খাওয়া-দাওয়া। শৈবাল মিত্র, পবিত্র মুখোপাধ্যায়, অমর মিত্র, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, একরাম আলি, তুষার চৌধুরী, সমীর চট্টোপাধ্যায়, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, কিন্নর রায়, শচীন দাশ, প্রভাত চৌধুরী, অনন্য রায়, নীলকণ্ঠ সেনগুপ্ত, প্রবীর সেন, সুব্রত চৌধুরী — এইসব নতুন মুখ তখন শ্যামলের পাশে। মনে পড়ছে পরিতোষ সেন, রবি বসু, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত — এরাও খুব আসতেন। আরও অনেকের নাম তো মনেই পড়ছে না।
এরকমই একটি সময়ে শ্যামলের একটি বই প্রকাশিত হল —’অদ্য শেষ রজনী’। শুনেই বোঝা যাচ্ছে, বইটির কেন্দ্রে রয়েছে নাট্যজগৎ। এখনও মনে পড়ে প্রতাপাদিত্য রোডের বাড়িতে অজিতেশের সেই উদ্দাম প্রাণখোলা হাসি। রুদ্রপ্রসাদও তো আসতেন। সঙ্গে ওঁর স্ত্রী কেয়া। কী মিষ্টি ছিল। কেয়ার আকস্মিক জীবনাবসান শ্যামলকে দুঃখিত করেছিল। নাট্যজগতের সঙ্গে ওর যে একাত্ম হয়ে ওঠা, তারই ফসল ‘অদ্য শেষ রজনী’। শ্যামল নিজেও সে-কথা জানিয়েছেন —
‘তখনই অজিতেশ, কেয়া, রুদ্রপ্রসাদ, অসীম চক্রবর্তী — কিছু পরে মনোজ মিত্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। গান শুনি প্রভার মেয়ে কেতকী — ছোড়দির। কলকাতার স্টেজের ধুলো তখন নাকে যেত। রিহার্সাল দেখতাম। বেপরোয়া অসীম, সাহসী কেয়া, অকুতোভয় অজিতেশ, রসিক মনোজ — এরা সবাই এক একজন দিকপাল লোক। নাটক লেখা, মহলা, হল আর টাকা জোগাড়, দর্শক ভোলানো —সব ব্যাপারেই এরা যেন বালজাকের হিউম্যান কমেডির এক একটি অংশ। এদের দেখেই আমার মনে অদ্য শেষ রজনী এসেছিল।’
এবার আবার একটু পিছনে ফিরে যাচ্ছি। বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, আনন্দবাজারে চাকরির সময়ে, শ্যামল ‘ভূমিলক্ষ্মী’ পাতার কৃষি বিভাগের সম্পাদক। কাজের সূত্রেই বিদেশে চাষবাস কেমনভাবে হয়, তা দেখে আসার জন্য শ্যামলকে অফিস থেকে পাঠানো হয়েছিল ফিলিপিন্সের রাজধানী ম্যানিলায়। জাপানেও গিয়েছিল ওই একই কারণে। আর ফসল তো শ্যামলের আত্মা।
সুনীলের স্ত্রী স্বাতীর একরকমের আত্মীয় ছিল শীতল চৌধুরী। তিনি আবার শ্যামলদেরও বন্ধু। বেহালার দিকে তাঁর একটা বাগানবাড়ি ছিল। অবসরে বহুবার কৃত্তিবাসীরা স্বস্ত্রীক অথবা নিজেরাই আড্ডা মারত সেখানে গিয়ে। সেই বাগানবাড়ির অনেকটা অংশ ছিল একেবারে ফাঁকা। অনেকটা মানে কিন্তু অনেকটাই। সেই জমির প্রায় আঠারো বিঘা জুড়ে শ্যামল শুরু করে দিল ফের ধানচাষ। এছাড়া চম্পাহাটি গ্রামে ভাগচাষিরা যাতে অনাহারে না থাকে, তার জন্য শ্যামল আমাদের বাড়িটিকে বন্ধক রেখে সেখানেও ভাগচাষিদের দিয়ে শুরু করেছিল চাষবাস। যেহেতু জমিটা ছিল আমাদেরই, তাই, ফসলের উপর আমাদের ভাগ ছিল দশ আনা আর বাকি ছ’আনা প্রাপ্য চাষিদের। মূলত ধানচাষ হত। ফসল বিক্রির জন্য নিয়মিত যেতে হত সেখানে। প্রথম প্রথম শ্যামল যেত। এ-প্রসঙ্গেও রয়েছে একটি গল্প। বিয়ের সময় আমার বাড়ি থেকে যে সামান্য গয়নাগাটি পেয়েছিলাম, তার মধ্যে হাতের দুটি কঙ্কনও ছিল। শ্যামলের মা যখন অসুস্থ হন, তখন একটি কঙ্কন বিক্রি করে তাঁর চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। আরেকটি কঙ্কনও বিক্রি করেছিলাম শ্যামলের কারণেই। আনন্দবাজারে থাকার সময়েই ও দিল্লিতে গেল আরও ভালো একটা ইন্টারভিউ দিতে। যাতায়াতের প্রয়োজনেই ওই কঙ্কনের বিক্রি। এভাবেই দুটো কঙ্কনই যে আমার চলে গেল তা কিন্তু শ্যামলের মনে ছিল। ফলে, চম্পাহাটির ফসল বিক্রি করে যে অর্থ ও পেত, তা দিয়েই শ্যামল আমাকে দুটো বালা গড়ে দিয়েছিল। পরে শ্যামল আর যায়নি চম্পাহাটিতে। আমাকেই যেতে হত। ধান বিক্রি করে, বারুইপুরের ব্যাঙ্কের লোন শোধ করেও হাতে থাকত তখনকার দিনেই প্রায় তিন-চার হাজার টাকা। শ্যামল বলেই দিয়েছিল, ও টাকায় শুধু আমারই ভাগ। এত টাকা নিয়ে আমি কী করি! ফেরার সময় দেদার শপিং করতাম, একা-একাই। মেয়েরা অপেক্ষায় থাকত, মা এবার কী বিশেষ জিনিস এনে চমকে দেবে তাদের! টাকা-পয়সা জমানোর ধাত আমারও ছিল না সেরকম। কদিনের মধ্যে সে টাকাও শেষ হয়ে যেত। যাই হোক, যা বলতে গিয়ে উঠে এল এতগুলো কথা, শীতলবাবুর বাগানবাড়িতে শ্যামলের চাষবাস। চম্পাহাটিতে ধান চাষ করে লাভ করলেও শীতলবাবুর বাগানবাড়িতে ওর ধানচাষ ছিল তুমুলভাবে ফ্লপ। বেশ কিছু টাকার লোকসান মেনে নিতে হয়েছিল।
কিন্তু, শ্যামল মানেই যেন একটা নেশা। কিছু একটা নিয়ে মেতে থাকার নেশা। ওর একটা বইয়ের নামই তো ছিল ‘নবীন থাকার উপায়’। মনে হয়, এই নেশার মধ্যে দিয়েই শ্যামল ওর নবীনতাকে ছুঁতে চাইত। চম্পাহাটিতে চাষবাস যেমন ওর নেশা হয়ে উঠেছিল, অবাক হয়ে দেখলাম, প্রতাপাদিত্য রোডের এই বাড়িতে এসেও নেশাকে ছাড়তে পারেনি শ্যামল। তবে, তখন আর ধান চাষ নয়, পেয়ে বসল গাড়ির নেশা। সে এক মারাত্মক ব্যাপার বটে। একটা করে সেকেন্ড হ্যান্ড চারচাকার গাড়ি কিনছে, আর দুদিন বাদেই সেই গাড়িগুলোকে সাজিয়ে গুছিয়ে, চালিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে। বিক্রি করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না। আবার আর একটা নতুন সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ি কিনছে। আর কেনা মানে কী? আবার তা বিক্রি।
সে সময় পণ্ডিতিয়া রোডে থাকতেন মুরারি সেন। তার গ্যারাজে ছিল এরকম প্রচুর সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি। শ্যামলের গাড়ি কেনার যে নেশা, তার অভিষেক ঘটে ওই মুরারিবাবুর গ্যারেজ থেকেই একটা গাড়ি কিনে। সেটা ছিল ল্যান্ডমাস্টার। ১৯৭৪ সালে কিনেছিলেন শ্যামল। কিন্তু ওই যা বলেছি, কয়েকদিনের মধ্যেই তা বিক্রি করে দিল চিকিৎসক বন্ধু বংশী মজুমদারকে। কারণ ততদিনে ও জেনে গিয়েছে আমি কী গাড়ি পছন্দ করি। সেই অনুযায়ী এল দ্বিতীয় গাড়িটি। নূপুর চক্রবর্তী নামের এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে অ্যাম্বাস্যাডার কিনে আমায় খুশি করে দিল শ্যামল। সেকেন্ড হ্যান্ড হলেও গাড়িটি ছিল বেশ হৃষ্টপুষ্ট। তাতে কী। সেটাও বিক্রির তালে ছিল শ্যামল। এক্ষেত্রে আমি বাদ সাধি। গাড়িটি তাই বেশ কিছুদিন আমাদের সঙ্গে ছিল। তারপর ষোলো হাজার টাকায় সেই গাড়িটিকে বিক্রি করে ১৯৭৭ সালে শ্যামল নিয়ে এল আবার একটা গাড়ি। এবারের গাড়িটি ছিল ভক্সল। এ-গাড়িও বিক্রি হয়ে গেল পরের বছরের শেষের দিকে। মাঝে আবার একটি ভিনটেজ গাড়িও এসেছিল আমাদের পরিবারে। আমাদের প্রায় প্রত্যেকটি গাড়িরই একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। বেশ কিছুদিন ভালোয় ভালোয় চলার পর রাস্তায় নামলেই নিজেদের মর্জিমাফিক হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়ত। না ঠেললে তারা চলতেই চাইত না। এমনও হয়েছে, ড্রাইভার সুগ্রীব চেঁচিয়ে বলছে, ‘জোরে, আরও জোরে’, আর পিছন থেকে গাড়িটি ঠেলছেন শ্যামলবাবু নিজেই।
গাড়ি কেনার রহস্য ফাঁস হল কয়েক বছর পরেই, ১৯৭৯ সালে, যখন শ্যামলের লেখা নতুন উপন্যাস ‘হাওয়াগাড়ি’ প্রকাশিত হল। সত্তরের মাঝামাঝি সময় থেকেই তো নানা উত্থান-পতন ওর জীবনে। ‘হাওয়াগাড়ি’ বইটির ভূমিকা যেন ধরে রয়েছে শ্যামলের সেই অনুভব — ‘বারবার ভেঙে পড়েও কিছু মানুষ বারবার উঠে দাঁড়ায়। কিছু বানাবে বলে। বানানোর আনন্দে মশগুল এই মানুষকে কখনও শয়তান, কখনও স্বার্থপর — কখনও ঈশ্বর মনে হয়। এমনই একজন মানুষ মধ্যবয়সে পৌঁছে দেখলেন — এতদিন যাঁদের সঙ্গে মিশেছি — তাঁরা আমার কেউ নয়! আমিও তাঁদের কেউ নই। এই আবিষ্কার তাকে থেঁতলে দিল। কয়লার খাদান থেকে মোটর গাড়ি — একটার পর একটা আত্মঘাতী অভিযানে তার অবগাহন শুরু হল। এবার ভেঙে পড়েও সে উঠে দাঁড়াতে চাইল। কিছু বানিয়ে তোলার নেশায় সে আবার কাজে ডুবল।’
প্রতাপাদিত্য রোডের বাড়িতে থাকতে আরও দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে আমাদের পরিবারে। আমাদের দুই মেয়ের বিয়ে। বড়ো মেয়ে মলির বিয়ে— সে বছর মারাত্মক বন্যা হয়েছিল পশ্চিম বাংলায়। ১৯৭৮ সাল। কলকাতা জলে ডুবে ছিল বেশ ক’দিন। তার বেশ কিছু মাস আগে থাকতেই শ্যামলের দুই তরুণ বন্ধু জুটল। তুষার আর সমীর। ক্রমে ওদের সঙ্গে জড়িয়ে গেল শ্যামল। আড্ডা শুরু হলে তা আর ভাঙতেই চায় না। অতএব রাত্রিবাস একসঙ্গেই। আর দিন শুরু হল তো আড্ডারও শুরু। এবং কলকাতায় তখন প্রবল বন্যা। তুষার চাকরি করত ইনকাম ট্যাক্স বিভাগে। আর সমীর ব্যাঙ্কে। দুজনেই কবি। দুজনেই প্রবল আড্ডাবাজ। দুজনেই পাল্লা দিয়ে মদাসক্ত, তুষার সম্ভবত একটু বেশি। মলি-তুষারের প্রেম সবে জমেছে কি জমেনি, শ্যামল জানতে পেরে গেল। তুষারকে সরাসরি জিজ্ঞেস করল — শুধুই ঘোরাঘুরি করবে নাকি বিয়ে করারও মতলব আছে। তুষার বিয়ে করার পক্ষেই সায় দিয়। আর মলিকে সাতদিন সময় দিয়েছিল শ্যামল ভেবে দেখার জন্য। মলি মাত্র সাত মিনিটের মধ্যেই ঘোষণা করে দিল, তুষারই হবে ওর পাত্র।
আমারও তুষারকে অত্যন্ত ভালো লাগত। অমন রূপবান ছেলে সেসময় খুব কম দেখেছি। কবি বন্ধুদের সঙ্গে কবিতাকেন্দ্রিক আলোচনা ততটা কখনওই জমেনি শ্যামলের। যদিও বিভিন্ন সময়ে কবিতা নিয়ে অনেক গদ্যই লিখেছে শ্যামল। তবে, বাজার চলতি কবিদের ও হাবা মনে করত। সে জন্য কবিতা বা কবি সম্পর্কে কোনো মৌখিক আলোচনা বা আড্ডায় শ্যামল রসিকতা করত কবিদের নিয়ে। তুষার-সমীর এসে যাওয়ায় সে -রসিকতার ইতি হল। তুষারের কবিতাবোধ, পড়াশোনা সে সময়ের অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিকদের থেকে অনেক অনেক বেশি, এ-কথা শ্যামলই জানিয়েছে। তাই আলোচনায় কবিতা একটি মুখ্য অঙ্গ হল ওদের। এছাড়া বিভিন্ন দেশের সাহিত্য, রাজনীতি নিয়ে আলোচনা, তর্কাতর্কি এবং অবশ্যই প্রাণখোলা রসিকতা, একে অপরকে ঠোকাঠুকি এসব তো চলতেই থাকল। মলি বোধ হয় এইসব কারণের জন্যই তুষারকে ভালোবেসে ফেলেছিল। প্রায় সব মেয়ের বাবাদের মতো শ্যামলও নিজের বড়ো মেয়ের বিয়ে নিয়ে একটু টেনশনে ছিল। কিন্তু দুজনের বিয়ের ক্ষেত্রে আমার প্রবল সায় থাকায় মেঘ অবিলম্বে কেটে গেল। ১৯৭৮ সালের ২৬ নভেম্বর ছিল মলি-তুষারের পরিণয়ে আবদ্ধ হওয়ার দিন।
যে কোনো সাধারণ বিষয়কেই শ্যামল পরিণত করত উৎসবে। আর দুই মেয়ের বিয়ে ওর কাছে ছিল দুর্গোৎসব। তার আয়োজন শুনলে আপনারাও হাসবেন বইকি! এমনিতেই যে কোনো সময় কোনো কিছু কেনাকাটা করতে গেলে, সে পুজো উপলক্ষ্যেই হোক বা কারও জন্মদিন, সবসমই শ্যামল বেরোত আমাকে নিয়ে। আমরা একসঙ্গে পছন্দ করতাম, সেইসব দিনগুলোয় বাড়িতে হাঁড়ি চড়ত না, শপিং মানে রেস্তোরাঁয় খাওয়া। সে সূত্রে কলকাতার অনেক রেস্তোরাঁয় ঘোরা হয়েছে আমার। প্রসঙ্গ থেকে একটু সরে যাচ্ছি, তবু না বললেই নয়, বিভিন্ন পার্টিতে যখন শ্যামল আমন্ত্রিত থাকত, সঙ্গে যেতাম আমিও, সুস্বাদু কোনো খাবার ওর মনে ধরে গেলেই নির্দেশ দিত, ইতি, জিভে করে স্বাদটা নিয়ে চলো। বাড়িতে গিয়ে রান্নায় ঠিক ওরকমই ফোটাতে হবে।
মলি-ললির বিয়ের কেনাকাটাতেও আমরা বেরিয়েছি সপরিবারে। যে কোনো কাজের মতো এই কেনাকাটার ব্যাপারেও শ্যামলের কোনো আগাম পরিকল্পনা থাকত না। হঠাৎ হঠাৎ স্থির করত, বলত, চলো। দুই মেয়ের গয়না কেনার ক্ষেত্রেই যা হয়েছিল বলি। সাদামাটা, সবজির বাজারের ব্যাগ নিয়ে শ্যামল সপরিবারে ঢুকত গয়নার দোকানে। লোকে ভাবছে ব্যাগ ভরতি বাজার। আমরা জানতাম, ব্যাগ ভরতি গয়না। বিয়ের খাবার-দাবারের মেনু কী হবে তা নিয়েও প্রায় সভা ডাকত শ্যামল। তাতে প্রতিদিন একেকজন ঠাকুরের উপস্থিতি মাস্ট। ঠাকুর একের পর এক মেনু বলে যেত এবং তার খরচও। শ্যামল শুনত, তারপর মনে মনেই বলত নেক্সট। আরেক ঠাকুর যথারীতি তার মেনু ও খরচ-তালিকা নিয়ে হাজির। ভিয়েনদের এভাবেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ইন্টারভিউ নিয়ে তবেই শ্যামল ঠাকুর নির্বাচন করেছিল মেয়েদের বিয়ের জন্য। মলির বিয়ে হয়েছিল গড়িয়াহাটের কণিষ্ক শাড়ির দোকানটা যেখানে, তার উলটোদিকের ব্যামবিনোর গলির একটি বাড়িতে। আমন্ত্রিত ছিলেন প্রায় সাতশো জন।
বিয়েতে প্রভূত মদ্যপান করে সবার আগে মাতাল হয়ে গেল শ্যামল নিজেই। পাত্রকে আনার দায়িত্ব ও দিয়েছিল ছোটো ভাই তরুণকে। তরুণ তুষারকে আনতে গিয়ে দেখে, তুষারদের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে একটি মাঠে আগাম দাঁড়িয়ে রয়েছে শ্যামল। আকন্ঠ খেয়ে রয়েছে। চলে গিয়েছিল কারণ, ওর নাকি আর তর সইছিল না। তারপর তরুণের বকাবকিতে ফিরেও আসে।
বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে একমাত্র শীর্ষেন্দুই যা মলির বিয়েতে আসতে পারেনি। ললির বিয়েতে এসেছিল। শীর্ষেন্দু আমাকে বউঠান বলে ডাকত। শ্যামলের আর সব বন্ধুদের মতো শীর্ষেন্দু নয়। মদ্যপান করে না। অনুকূল ঠাকুরের ভক্ত। কাজেই, মাছ-মাংস ছোঁয়ারও প্রশ্ন নেই। ললির বিয়েতে শীর্ষেন্দু যেখানে মূল খাবার-দাবারের জায়গা, তার কিছুটা দূরে আমাকে নিয়ে এসে অনুরোধ জানাল, ‘বউঠান, আমাকে যা দেবার দিন, আলাদা করে।’ একবার শীর্ষেন্দুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘আপনিও লেখেন, অথচ একপাত্র মদও ছোঁন না।’ শীর্ষেন্দু বলেছিলেন, ‘সে বউঠান আপনি বুঝবেন না।’
মলির বিয়েতে যে উৎসব, তারই রেপ্লিকা যেন ললির বিয়েও। দুই মেয়ের বিয়ের পরই শ্যামল ভেঙে পড়েছিল একেবারেই। খাওয়া নেই, দাওয়া নেই, লেখালেখিতেও মন নেই, মেয়েরা চলে যেতে একেবারে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল শ্যামল। মলির বিয়ের জন্য শ্যামল ওর ভক্সল গাড়িটি বিক্রি করে দেয়। যদিও তখনও একটা অস্টিন ছিল আমাদের। সেটা করেই ও যাতায়াত করত যুগান্তরে। মাঝে টানা সতেরো দিন আমাদের ড্রাইভার সুগ্রীব কামাই করল। ‘গাড়ি থেকেও যদি ব্যবহার না করতে পারি তাহলে গাড়ি রেখে লাভ কী।’ নিজের মনেই গজগজ করতে করতে শ্যামল ওর শেষ গাড়িটিও বিক্রি করে দিল। আর ততদিনে তো ‘হাওয়া গাড়ি’রও দুখণ্ড লেখা শেষ শ্যামলের।
এই লেখা লিখতে গিয়ে ভাবছি, শ্যামল ঠিক কে। সে কখনওই ঈশ্বর নয়, রক্তমাংসের মানুষ। একজন মানুষের যা যা গুণ থাকে, শ্যামলেরও তাই ছিল। পার্থক্য যদি কোথাও থেকে থাকে তা হল এই যে সে একজন লেখক। লেখার জন্য বিবিধ উন্মাদনায় সে নিজেকে জড়িয়েছে। কেউ যদি ভেবে নেন, সবসময়ই শ্যামল আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করত তা কিন্তু নয়। আর আমিও এই লেখায় শ্যামল-স্তুতি করতে বসিনি। বলতে চাইছি, আমাদের জীবনের কথা। ফলে অন্ধকার দিকগুলিও আসতে বাধ্য। নাহলে, এই লেখাই তো বানানো হয়ে যাবে। সময়ে সময়ে শ্যামল কী নিদারুণ অসহ হয়ে উঠত। কখনো কখনো নেশা করে এসে অশান্তি বাঁধিয়েছে শ্যামল। আবার বাজার-রান্নাবান্না নিয়েও সুস্থ অবস্থায় অশান্তি করেছে তুমুল। একদিন রাতে ডিমের ঝোল হয়েছিল। কেন রাতে মাছ আনা হয়নি? রাত এগারোটা নাগাদ আমাকেই ছুটতে হল বাজারে। তখন বাজার করতাম নিয়মিত। মাছ বিক্রেতারা চেনা জানা। একজন দোকান বন্ধ করে সবে বেরোবার মুখে। দোকান খুলিয়ে তার থেকে ট্যাংরা মাছ কিনে তবেই ফিরলাম বাড়ি। তারপর সেই মাছ রান্না হল আলু-বড়ি দিয়ে। শ্যামল রাত একটায় তার তৃপ্তির খাওয়া খেয়ে উঠল। মলি এখনও বলে, ওরকম নিষ্ঠুর হতে বাবাকে খুব কম দেখেছি।
আরেকবার পাঁচরকম রান্না হয়েছে বাড়িতে। কিন্তু লটে মাছটা করা হয়নি। শ্যামলের নির্দেশ, এক্ষুনি করে দাও লটে মাছ। আমি শুধু এটুকুই বলেছিলাম, কাল করলে হয় না। তাতে শ্যামলের স্পষ্ট জবাব, ‘করতে যদি নাই পারবে তা হলে থাকার দরকার কী। চলে যাও।’ শুনে এতটাই অভিমান হয়েছিল, মুহূর্তেই বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। শাড়ির আঁচলে চাবি বাঁধা থাকত সবসময়। আর থাকত কিছু টাকা। বেরিয়ে তো এলাম, কিন্তু কোথায় যাব। বাপের বাড়ি? বোনের বাড়ি? ননদের বাড়ি না ললি-মলির বাড়ি? কার কাছে যাব? ভেবে স্থির করলাম ললির বাড়ি যাওয়াই ভালো। ও নিজে ডাক্তার। সেখানে আশ্রয়, আহার আর চিকিৎসারও কোনো অভাব হবে না। সে মুহূর্তে সত্যিই কিন্তু এ কথাগুলো ভেবেছিলাম আমি। সেজন্যই গিয়ে উঠলাম ললির বাড়ি।
আমি নেই। শ্যামল ততক্ষণে চেনা- জানা সব বাড়িতে ফোন করতে শুরু করে দিয়েছে। ললির বাড়িতেও জানিয়েছে আমার বাড়ি ছাড়ার কথা। কাজেই, ও দরজা খুলতেই বলে উঠল,’ও, এসে গেছো? এসো। টাকা আছে? কত উঠেছে ট্যাক্সি ভাড়া?’ বুঝলাম, ওর অবাক না হওয়ার কারণ। শ্যামলের ফোনালাপ।
টানা বারোদিন ছিলাম ছোটো মেয়ের বাড়ি। অবশেষে ফিরেও এলাম। আমাদের বাড়িতেই থাকত নেপাল বলে একটি ছেলে। বাড়ির কাজ-টাজ করে দিত। শ্যামল তাকেই পাঠিয়েছিল আমাকে নিয়ে আসার জন্য। ফিরে এলাম, তাতে শ্যামলের যেন কোনো ভ্রূক্ষেপও নেই, অনুতাপ তো দূরের কথা। শ্যামলের এহেন স্বভাব আমাকে দুঃখ দিয়েছে আজীবন। তার যা চাই এক্ষুনি চাই। এতে যে অন্য পক্ষের কোনো অসুবিধে হতে পারে, তা সে বুঝত না। নিজের চাহিদাগুলোর ক্ষেত্রে শ্যামল এতটাই নিষ্ঠুর।
তবে এটা যেমন শ্যামলের চরিত্রের একটা দিক, অন্য দিকটিও ছিল। সেটা কিন্তু যথেষ্ট নরম, অনুভবপ্রবণ ও উৎসবমুখর। বিয়ের পর, এমন কোনো পুজো আসেনি আমার জীবনে যে, শ্যামল আমাকে তখনকার দিনের সবথেকে ভালো শাড়ি কিনে দেয়নি। দাম-টাম পাত্তা দিত না ও। পুজোয় সাধারণত আমাকে কিনে দিত গরদ, তসর কিংবা মুগা সিল্কের শাড়ি। বিবাহবার্ষিকীতেও শাড়ি কিনে দিত। একবার একটা শাড়ি দিয়েছিল, খুবই পছন্দ হয়েছিল আমার, কালো রঙের রোলেক্স পারের সিল্ক। শ্বশুরবাড়িতে সবাই আমাকে কালো বলত। শাশুড়ি বললেন, কালো মেয়েকে কালো পরলে ভালো দেখায় না। সেই কথা শুনে অভিমানে একবার ট্রামলাইনের দিকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলাম কাজলের কৌটো আর প্রিয় ওই শাড়িটি দিয়ে দিয়েছিলাম বাসনওলিকে।
শ্যামলকে নিজের জমানো টাকা থেকে আমিও নিয়মিত জিনিসপত্র কিনে দিতাম। বেশিরভাগ সময় দিতাম মিলের ধুতি-পাঞ্জাবি। তবে জন্মদিনে তাঁতের ধুতি। ওই দিন আমার দেওয়া নতুন ধুতি পরে শ্যামল অফিস যেত। তবে এই উপহার বিনিময় নিয়ে আমরা কেউই পরস্পরকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করিনি কোনোদিন। সবটাই যেন খুব স্বাভাবিক।
ললির বিয়ের পর প্রতাপাদিত্য রোডের বাড়িটি আমাদের ছেড়ে দিতে হল। এগারো বছর ছিলাম সেখানে। উঠে এলাম কাশীপুরে সরকারি আবাসনে। আবাসনটির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তৎকালীন মন্ত্রী যতীন চত্রুবর্তী। তবে কাশীপুরের বাড়িতে খুব কম দিনই ছিলাম আমরা। মেরে- কেটে দুবছর। তারপর উঠে এলাম টালিগঞ্জের জুবিলি পার্কে। কাশীপুরের ওই কোয়ার্টার শ্যামল ললিকে দিয়ে এল। কারণ, ললির তখন সদ্য প্রথম সন্তান হয়েছে। এবং সেসময় ওকে সল্টলেকের একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটে থাকতে হত খুবই কষ্ট করে । জুবিলি পার্কের বাড়িতেও আমরা ছিলাম ও-ই দু’বছর।
জুবিলি পার্কের বাড়িতে শ্যামলের লেখার ঘরের পাশে একটা ডুমুর গাছ ছিল। বাড়িটির ধার ঘেঁষে একটা ছোটো ঝিলও ছিল। ওই গাছটি ছিল শ্যামলের ‘সাক্ষী ডুমুরগাছ’ গল্পের প্রেরণা। সুনীলের লেখাটি যেখান থেকে নিয়েছিলাম, সেই একই সংকলনে রয়েছে শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়েরও একটি লেখা। সেখানকার একটি অংশ একবার পড়ে নিই: ‘একবার ‘সাক্ষী ডুমুরগাছ’ নামে শ্যামলের এক দুর্ধর্ষ গল্প আমি নির্বাচন করে দিয়েছিলাম ভারতীয় শ্রেষ্ঠ গল্প সংকলনে প্রকাশের জন্য। গল্পটি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে দিল্লিবাসী অনুবাদক হিমসিম খেতে থাকে, কারণ ওতে কালবাচক ক্রিয়াপদগুলির মধ্যে সঙ্গতি নেই। গল্পটি লাফিয়ে লাফিয়ে বর্তমান কাল থেকে অতীত কালে, আবার অতীত কাল থেকে ভবিষ্যতে, আবার ফিরে বর্তমানে, এমনভাবে বিচরণ করে যে ইংরেজির নিয়মকানুনে তাকে আটানো যাচ্ছে না। অথচ বাংলায় পড়তে আমার কোনো খটকা লাগেনি। প্রকাশিত হওয়ার পর গল্পটি রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পায়।’
এই পুরস্কারের সুবাদেই শ্যামলের সঙ্গে আমার দিল্লি যাওয়া। এর আগে ১৯৭৯ সালে স্টেট গেস্ট হয়ে শ্যামল গিয়েছিল আমেরিকা। দেখা হয়েছিল সাহিত্যিক সলবেলোর সঙ্গে। সলবেলো তখন নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেছেন। শ্যামল সোজা সলবেলোকে অনুরোধ জানাল, ‘আমার বহুদিনের ইচ্ছে, কোনো নোবেলজয়ী সাহিত্যিক আমার গাড়ি ড্রাইভ করবেন। আপনি কি এ-প্রস্তাবে সম্মত?’ সলবেলো সহাস্যে সে- প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন। যতদিন আমেরিকার শিকাগো শহরে ছিল শ্যামল, সলবেলো নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে শহর দেখাতে বেরোতেন শ্যামলকে। আরেকবার শ্যামল কোনো বিশেষ আমন্ত্রণে গিয়েছিল বাংলাদেশে, আমাকে নিয়ে, তবে সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
জুবিলি পার্কের বাড়িতেই পরপর বেশ কতগুলো ঘটনা ঘটল। সামলে ওঠা শ্যামলের জীবনে আবার দেখা দিল অনিশ্চয়তা। ওই সময়েই প্রথম ‘যুগান্তর’ বন্ধ হয়ে যায়। আবার আমরা মুখোমুখি হই প্রবল অর্থকষ্টের। তার মধ্যে দুর্ঘটনায় পা ভেঙে গেল ওর। সংসার চালাব কী করে। রোজগার কোথায়। শ্যামলও চিন্তিত। ঠিক এরকমই একটি সময় ‘আলোকপাত’এবং ‘মনোরমা’ এই দুটি পত্রিকা থেকে শ্যামলের কাছে এল লেখার অনুরোধ। এতদিন শ্যামল গল্পের ছলে অথবা উপন্যাসের ভঙ্গিমায় নিজের জীবন, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পরিবেশ এবং ইতিহাসকে নিয়ে কী প্রবল লেখালেখি করে গেছে। বোধ হয় এই আঙ্গিক থেকে স্বেচ্ছায় কিছুদিনের জন্য বিরতি চাইল। তাই ‘আলোকপাত’-এ ওর লেখা শুরু হল নিজের জীবনের কথা দিয়েই, তবে সেটি আর গল্প বা উপন্যাসের খাঁচায় আটকে রইল না। এই আত্মকথা হয়ে উঠল ওর জীবনের স্মৃতির জানালা। সেই জানালা দিয়ে নিজের অতীত সরাসরি আলোর মতো এসে পড়ল ‘জীবনরহস্য’ লেখায়, যা ধারাবাহিকভাবে ‘আলোকপাত’ – এ বেরোতে শুরু করল। এছাড়া ‘মনোরমা’য় লেখালেখি তো চলতেই থাকল। এখন একটি গল্প বা উপন্যাস লিখে লেখকরা যতটা অর্থ উপার্জন করেন, তখন কিন্তু ততখানি অর্থ লাভ করা যেত না। কিন্তু ‘আলোকপাত’- এর কর্তৃপক্ষ শ্যামলকে সেই সময়ের তুলনায় অনেকবেশি অর্থ দিয়েই লেখাটি লিখিয়েছিলেন। পারিবারিক দিক থেকে আর্থিক অভাব কিছুটা লঘু হল। এমনিতেই শ্যামল ধারবাকির কারবারে বিশ্বাসী ছিল না। নিজের সম্পর্কে বারেবারেই বলে এসেছে ‘আমি অঋণী লোক’। আরেকটি কথা, ঠিক এই সময়েই ‘আজকাল’ থেকে শ্যামলের কাছে অনুরোধ আসে ছোটোদের জন্য একটি লেখার। শুরু হয় কিশোরদের জন্য শ্যামলের নতুন উপন্যাস ‘ভাস্কোদাগামার ভাইপো’। যদিও ছোটোদের দুনিয়ায় ওর প্রবেশ এই বইটি দিয়েই নয়। ও যখন আনন্দবাজারের সঙ্গে যুক্ত তখনই ওই দৈনিক সংবাদপত্রের রবিবারের ‘আনন্দমেলা’ পাতায় ছোটোদের জন্য একটি অসামান্য উপন্যাস লিখেছিল। অনেকেরই মনে আছে নিশ্চয়ই লেখাটির নাম, ‘ক্লাস সেভেনের মিস্টার ব্লেক।’ পরবর্তী সময়ে ওই লেখা ‘আনন্দ পাবলিশার্স’ থেকে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়। এই লেখারই পরের অংশ ছাপা হয় মাসিক ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায়। বিজ্ঞাপন জোগাড়ের পাশাপাশি শ্যামল এই লেখাটি তখন নিয়মিত লিখেছিল ‘কৃত্তিবাস’-এ। লেখাটির নাম ‘অগস্ত্ব্যযাত্রা’।
শ্যামল কিন্তু জন্মেছিল খুলনায়। সেখানেই কেটেছে ছেলেবেলা। কিন্তু কথাটা বললাম কেন? কারণ অনেকে এটাই জানেন যে, শ্যামল জন্মেছে বরিশালে। আসলে বরিশালে ওর পিতৃপুরুষের জমিভিটে। ও যে স্কুলে পড়ত সেই স্কুলে আমিও গিয়েছি। আমাকে ও নিয়ে গিয়েছিল। ওই স্কুলেরই প্রেক্ষাপটে ছোটোদের জন্য একটি সিরিজ লিখেছিল শ্যামল, ‘সাধু কালাচাঁদ’ নামে ওই সিরিজটি বই হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল।’সাধু কালাচাঁদের’-এর প্রায় সব লেখাই শ্যামল লিখেছিল প্রতাপাদিত্য রোডের বাড়িতেই। অন্যান্য বাড়িতেও থাকার সময় লেখা হয়েছে এই সিরিজের বেশ কিছু গল্প। সাধু কালাচাঁদের কিছু গল্প নিয়ে ১৯৮৩ সালে ‘তিন সঙ্গী’ থেকে প্রকাশিত হয় বই। শ্যামলের মৃত্যুর পর সাধু কালাচাঁদের সমস্ত গল্প নিয়ে সংগ্রহ প্রকাশ করেছে ‘দে’জ পাবলিশিং’। সাধু কালাচাঁদ সমগ্র।
অনেক ক্ষেত্রেই শ্যামল গল্প লিখে আমাদের একদম বোকা বানিয়ে দিত। অকাজের সময়ে বা অবসরে ললি-মলি এবং আমার সঙ্গে আড্ডা তো চলতই। সে সময় নিজের জীবনের বহু মজার কথা বলে হাসাত সকলকে। সেই হাসির রেশ কেটে যেতে না যেতেই ললি-মলি এবং আমি টের পেতাম শ্যামলের বলা ঘটনাগুলি কখন যেন গল্পের আকারে লেখা হয়ে গেছে। আমাদের সঙ্গে কথায় কথায় এই গল্পগুলো বলে ও আসলে যাচাই করে নিত পাঠকের মন। ‘সাধু কালাচাঁদ’ সিরিজের প্রত্যেকটি ঘটনাই এভাবে ও ললি -মলির সঙ্গে মজার ছলে কথা বলতে বলতে ঠিক তার পরের দিন লিখে ফেলত।
শ্যামলের প্রায় সব লেখাই আমার পড়া। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেটা ঘটেছে, ম্যাগাজিনে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই ওর সমস্ত লেখা আমার পড়া হয়ে যেত। ফলে বই হিসেবে বেরোনোর পর সব সময় আর পড়া হত না। এছাড়াও ও যখন কোনো লেখা লিখবে বলে থিমটা ভাবছে কিংবা এক, দুই, তিন, চার করে পরপর সাজিয়ে নিচ্ছে লেখার বিভিন্ন ধাপ, তখনই গল্পটা আমাকে বলে ঝালিয়ে নিত একবার। কোন পরিচ্ছেদে কী লিখবে, কোন ঘটনার অনুষঙ্গে কোন ঘটনা আসবে, এ সবও বলত। আমার সায়কে গুরুত্ব দিয়েছে শ্যামল।
কিন্তু আমার সায়, সেটা এতই সংক্ষিপ্ত মনে হত ওর যে বিরক্তও হত মাঝে মাঝে। আসলে শ্যামল মানেই টাটকা একটা উদ্দামতা। সব সময়ই নতুন কিছু না কিছু করার দিকে মন। আর আমি সারাদিন রান্নাবান্না, সংসার সামলে এবং কিছুটা স্বভাববশত, খুবই শান্ত আর নিস্পৃহ থাকতাম। আমার এই সব সময়ের শীতলতা শ্যামলের চরিত্রের প্রেক্ষিতে বেমানান।
এতদূর চলে এসেছি অথচ বলাই হল না শ্যামল কখন লিখত, কী ভাবে লিখত। একজন গদ্যলেখককে নাকি গায়ে গতরে খেটে খনি শ্রমিকের মতো পরিশ্রম করে, তবেই মাটি থেকে প্রয়োজনীয় রসদ বের করে আনতে হয়। শ্যামলকেও নিশ্চয়ই ঠিক ততটাই পরিশ্রম করতে হয়েছিল। তবে সেই প্রক্রিয়া ছিল এতই স্বতঃস্ফূর্ত এবং সিস্টেমেটিক যে, শ্যামলকে দেখে বোঝাই যেত না লেখা লিখতে গিয়ে কতখানি ঘাম ঝরে পড়ল ওর শরীর থেকে। কখন লিখত শ্যামল? আমরা সবাই ঘুমোচ্ছি, জানছিও না যে ভোর হয়ে গেল। চারটে-পাঁচটার মধ্যে উঠে কাচের গেলাস হাতে কেউ বেরোল। পাড়াতেই চায়ের দোকান। সেখানেই চা-পান। তারপর ফিরে এসে দাড়ি কামিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে ধুতি পাঞ্জাবি পরে যেন একেবারে নতুন জামাই সে। ততক্ষণে উঠে পড়েছি আমি। শ্যামলেরও আরেক রাউন্ড চা খাওয়া হয়ে গেছে। এবার সংবাদপত্রের দিকে চোখ তার। খবরের কাগজ পড়া শেষ হলে নিজেই ঠিক করত কী তরকারি খাওয়া হবে সেদিন, মাছের বাজার থেকে নিয়ে আসবে কী মাছ, বাজারে যাওয়ার আগে ছক কষে নিত সারাদিনের লেখালেখির। বাজার থেকে ফিরে কিছু জলখাবার খেয়ে, এই আটটা-সাড়ে আটটা নাগাদ লেখার কাজ শুরু হত। চলত বেলা বারোটা অব্দি। তারপর স্নান, দুপুরের খাওয়া-দাওয়া। একটু ঘুম। তারপর আবার লিখতে বসা। অফিস থাকলে বেলা তিনটের সময় চা খেয়ে বেরিয়ে পড়া। না হলে আরও কিছুটা সময় লেখালেখি। কখনোই রাতে লিখতে দেখিনি। ওটা ছিল ওর আড্ডার সময়। রোজ ঠিক করে নিত আজ ক’পাতা লিখতে হবে। সেই অনুযায়ী প্যাড থেকে পাতা ছিঁড়ে নিত। কোন পরিচ্ছদটি লিখবে ততক্ষণে সেটিও স্থির। লেখা হয়ে গেলে তা চলে যেত জেরক্সের দোকানে।
অন্য কারোর কখনও মনে হয়েছে কিনা জানি না, আমি যখনই শ্যামলের কোনো লেখা পড়েছি, তার মধ্যে বারে বারেই টের পেয়েছি সুরের সৌন্দর্যকে। শ্যামল কি সুরেলা ছিল? এ-কথা আমি বলতে পারব না। তবে সুরপাগল ছিল। সুরের মধ্যেই নিজেকে ভাসিয়ে দিতে ও পছন্দ করত। কতবারই তো এভাবে সে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছে। সুর নিয়ে এত কথা বলছি কেন আমি? আসলে, শ্যামলের লেখার প্রক্রিয়াটি বলার ক্ষেত্রে সুরের কথা তো আসবেই। কারণ, লেখার সময় সুর যে তার পূজার উপাচার। যে-মুহূর্তে কাগজ-কলমে সে তার মন নিয়োজিত করল, ঠিক তখন থেকেই চালিয়ে দিত গানের রেকর্ড। গানের রেকর্ড চলছে আর শ্যামল আরও বেশি ঢুকে যাচ্ছে নিজের লেখায়। যতক্ষন কাগজের সামনে সে, ততক্ষণই আবহে সুর। মাঝেমাঝে নিজের মনেই ভেবেছি, গান চালিয়ে এভাবে লেখা যায়! যায়-ই তো, সে-ভাবেই তো লিখত শ্যামল। এমনও ভেবেছি, রেকর্ডে চলা সুর হয়তো ওকে এবড়ো-খেবড়ো বাইরের পৃথিবীর থেকে লেখালেখির অন্তরমহলে নিয়ে ফেলত। কী ধরণের গান শুনত শ্যামল? কার কার গান?
ক্লাসিক্যাল মিউজিক ছিল সব থেকে প্রিয়। ফৈয়াজ খাঁ-র গান শুনত তন্ময় হয়ে। করিম খাঁ, গাঙ্গুবাই, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় কিংবা গওহরজানের সংগীতে ডুবে যেতে যেতে শ্যামল খুঁজে পেত নিজের অক্ষর। আর ছিলেন বেগম আখতার। সেমিক্লাসিক্যাল গানের ক্ষেত্রে ও ছিল কে.এল. সায়গলের ফ্যান। রবীন মজুমদার, কাননদেবী, শচীনদেব বর্মণ — এঁরা তো ছিলেনই, আর ছিলেন অখিলবন্ধু ঘোষ। অখিলবন্ধু ঘোষের একেকটি গান শুনত আর সারাঘর ঘুরঘুর করতে করতে গাইত সেই গান। সিনেমার গানের ক্ষেত্রে কিশোরকুমারের গান শুনে কী বিস্ময়ই না প্রকাশ করত শ্যামল। বারে বারে বলত, কী দরাজ গলা! আর প্রিয় ছিল রফির গান। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছিল ব্যক্তিগত সম্পর্ক। আমার ছোটোমেয়ে ললির বিয়েতে হেমন্তবাবু এসেছিলেন।
অশোককুমারের সঙ্গে শ্যামলের বন্ধুত্ব ছিল গভীর। দুই বন্ধুতে চলত রাতের দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনালাপ। অশোককুমারের ‘অচ্ছুৎকন্যা’ সিনেমায় সম্ভবত, একটা গান ছিল ‘ম্যায় বন কি চিরিয়া’, গানটি শ্যামল কেবলই গুনগুন করে গাইত আর হাসত নিজের মনেই।
কিন্তু শ্যামল যেমন, যা ওর সঙ্গে থাকবে, তাকেই ও বিষয় করে তুলবে। গানকে কেন্দ্র করে শ্যামলের রয়েছে বেশ কয়েকটা বই। এ-মুহূর্তেই আমার মনে পড়ছে ‘মাতৃচরিতমানস’ ও ‘তারসানাই’ উপন্যাস দুটির কথা। এছাড়াও মনে পড়ছে ‘পুরকায়েতের আনন্দ ও বিষাদ’, ‘ঝিঁঝোঁটি দাদরা’, ‘গানের বাগান’, ‘তবলাগলির কাফি’ গল্পগুলির কথাও।
শ্যামল বেশ গর্বের সঙ্গে বলত ওর নাম নাকি অসাধ্যসাধন গাঙ্গুলি। সেই শ্যামল-ই জুবিলি পার্কের বাড়ি ছেড়ে ব্রহ্মপুরের নতুন ভাড়াবাড়িতে উঠে এসে এক অদ্ভুত মুশকিলের সম্মুখীন হল। ব্রহ্মপুরের এই বাড়িটি ছিল সমীর রায়চৌধুরীর। সপরিবারে সমীর থাকতেন কলকাতার বাইরে। বিশাল বড়ো দোতলা বাড়ি। যদিও ওপরের তলাটা সবসময় বন্ধ থাকত। আমরা নীচের তলায় থাকতাম। সামনেই ছিল একটা গ্রিলে ঘেরা বারান্দা। আর তার সামনে একটা সাজানো বাগান। মালি প্রতিমাসে এসে বাগানটিকে সাজিয়ে যাবে এরকম ব্যবস্থাই করে রেখেছিলেন সমীর রায়চৌধুরী। আর ছিল একটা বড়ো ঝিল।
মুশকিলের কথা বলছিলাম না, ব্রহ্মপুরের বাড়িটি সব দিক থেকেই ভালো হওয়া সত্বেও, সেখানে ছিল বিশাল সাইজের এক-একটি মশা। একটি দুটি তো নয়, অজস্র, অগণিত। শ্যামলের লেখা-পড়া-খাওয়াদাওয়া-ঘুমোনো বন্ধ হওয়ার জোগাড়। মশারা অচিরেই হয়ে উঠল ওর পরম শত্রু। আমরাও অপেক্ষায় রইলাম এটাই দেখতে, শত্রু শিবিরকে শ্যামল কীভাবে জব্দ করে।
কয়েকদিনের মধ্যেই বিশাল একটা মশারি কিনে আনল। এত বড়ো মশারি! কোথায় পেলে? বানালাম, জানাল শ্যামল। কী করবে? দেখি পুরো বারান্দায় লেখার টেবিল আর চেয়ারের উপর শ্যামল টাঙিয়ে দিল সেই বিশাল মশারি। আমাকে বলল, ইতি, আর দুটো-তিনটে চেয়ার দিয়ে যাও তো। আমি তো অবাক। কী করতে চাইছে! উত্তর পেলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই। মশারির ভিতর ঢুকে শুরু হল শ্যামলের সাহিত্যযাপন, লেখালেখি। সে-সময়ে ওর সঙ্গে কেউ দেখা করতে এলে তাকেও ঢুকতে হত মশারির ভিতর। আমার থেকে যে দুটো তিনটে চেয়ার চেয়েছিল, যাঁরা আসতেন, তাঁদের ঠাঁই হত সেখানেই।
যে বাড়িতেই গিয়েছে শ্যামল, লেখালেখির জমিতে সেখানেই ফুটিয়ে তুলেছে ধান। ব্রহ্মপুরের এই বাড়িটি হয়তো চিরকালের মতো বিখ্যাত হয়ে গেল ‘শাহজাদা দারাশুকো’, শ্যামলের লেখা এই বইটির জন্য। এখানে, মশারির ভিতর বসেই শ্যামল লিখেছিল ওই বই। নিজেকে নিয়ে শ্যামল সবসময়ই রসিকতা করে গেছে। সেই রসিকতায় কখনো সখনো আক্রান্ত হয়েছে নিজেই। কোনো এক বক্তৃতায় কি বলেছিল শুনুন, ‘আমি টুকে একটা উপন্যাস লিখেছিলাম শাহজাদা দারাশুকো — সেইটে বেরোবার পর বহু ইতিহাসের পণ্ডিত সমঝে নিয়েছেন যে আমি ভয়াবহ পণ্ডিত। কিন্তু তাঁরা জানেন না যে পাশের বাড়ির একটা ক্লাস টেন-এর মেয়ের কাছ থেকে নাইন-টেন-এর স্বদেশ ও সভ্যতা বইটি নিয়ে — সামনে রেখে লেখা।’ নিজের সম্পর্কে এরকম মতামত দিলে সাধারণ লোকজন তো মেনে নিতেই পারেন, শ্যামলবাবু হয়তো এভাবেই লিখেছেন, ‘শাহজাদা দারাশুকো’। কিন্তু আমি জানি, আর জানেন তাঁরাই, যাঁরা ওই সময় তার সঙ্গে ছিলেন, কী বিপুল পরিশ্রম, পড়াশুনো, গবেষণা ও নিষ্ঠার সহজাত ফসল শ্যামলের এই দু’খণ্ডের অনবদ্য উপন্যাস। সে সময় বাড়ি ভরতি হয়ে গিয়েছে এই উপন্যাসটি লেখার জন্য প্রয়োজনীয় বই-এ। বাড়িতে শ্যামল আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন ঐতিহাসিক, পণ্ডিত, অধ্যাপকদের। ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে এই বইটি লেখার ক্ষেত্রে শ্যামলকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্যামল পড়ে থাকত সে সময় ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। আর একজনের কথাও এই প্রসঙ্গে না বললেই নয়। বইটি লেখার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য জোগাড়ের দায়িত্ব নিয়েছিলেন শ্যামলেরই এক অনুরাগিনী। সে সত্যিই ছিল শ্যামলের মুগ্ধ পাঠিকা। শ্যামলের একটি বইয়ের নাম ছিল ‘সময় বড়ো বলবান।’ সময় যে কী জিনিস তা অনুভব করত শ্যামল। ঠিক এই মুহূর্তে আমি যেমন সময়কে অনুভব করতে পারছি। ‘শাহজাদা দারাশুকো’ লেখার সময় থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছি বলেই, এতটা সময় অতিক্রান্ত হয়েছে বলেই হয়তো খানিকক্ষণ আগে শ্যামলের সেই অনুরাগিনীকে মুগ্ধ পাঠিকা বলতে পারলাম। সে সময়ে পারিনি। সে আমার মোটেই সুখের সময় নয়। সময়ের দূরত্বে আমিও তো খানিকটা থিঁতিয়ে গিয়েছি। কাছ থেকে অনেক কিছুই দেখতে ভালো লাগে না। দূর থেকে দেখতে পারলে তখন ভারটা অনেক কম লাগে।
সেই মুগ্ধ পাঠিকার সঙ্গে শ্যামলের সম্পর্ক গ্রন্থাগারের বই, মোঘল সাম্রাজ্যের সম্পর্কে জোগাড় করা তথ্য এবং আরও অনেক কিছু পেরিয়ে এক অন্য নিবিষ্টতায় পৌঁছল। যাকে এক অর্থে বলে প্রেম। যাকে কোনো অর্থেই আমি মেনে নিতে পারব না বলে জানিয়ে দিলাম শ্যামলকে। সেই নিয়েই বিবাদ, মানসিকভাবে আমার শ্যামলের থেকে অনেক দূরে চলে যাওয়া। একদিকে ‘শাহজাদা দারাশুকো’ লেখা চলছে, অন্যদিকে শ্যামল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যে, বাকি জীবন ও থাকবে আমি আর সেই মুগ্ধ পাঠিকা, দুজনের সঙ্গেই। শ্যামলের এই সাধ পূরণ করার ক্ষমতা আমার ছিল না। আবার শ্যামলও ছিল ভেতরে ভেতরে পরিবারের মধ্যে মজে থাকা একটি লোক। ঝড়ের মতো সেই মুগ্ধ পাঠিকা শ্যামলের জীবনে এলেও, চলে তাকে যেতেই হত, গেলও। কিন্তু ওই যে, শ্যামলের কোনো গোপন ছিল না। ছিল শুধুমাত্র জীবন। শ্যামলের বিভিন্ন উপন্যাস, গল্পে রয়ে গিয়েছেন সেই মুগ্ধ পাঠিকা। ‘শাহজাদা দারাশুকো’ উপন্যাসের শাহজাদার সঙ্গে রানাদিলের যে উদ্দাম সম্পর্ক সেখানে রয়েছে অবশ্যই লেখক ও সেই মুগ্ধ পাঠিকার মুহূর্ত বিনিময়। ‘তারসানাই’ ও ‘অদৃশ্য ভূমিকম্প’ উপন্যাসেও দেখা যায় সেই পর্বকে। এছাড়াও অনেক ছোটো গল্পেই লেগে আছে সেই সম্পর্কের আতর। কিন্তু শ্যামল, কোনো মায়া রয়ে গেল কি? চম্পাহাটির বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পথে কী বলেছিল শ্যামল? ‘ওটা নিয়ে আমার সব হয়ে গেছে।’ নিজের দুই মেয়ে, দুই জামাই, নাতিনাতনিদের মধ্যেই আরও পারিবারিক হয়ে উঠল শ্যামলের জীবন। আমি হয়তো শ্যামলের মতো ততটা আধুনিক নই, যতদিন ও ছিল, ততদিন ওর প্রতি স্ত্রী হিসেবে আমার অভিমান থেকেই গিয়েছে।
‘শাহজাদা দারাশুকো’ উপন্যাসের দারাকে শ্যামল বলত নিজের পুত্র। আমাদের তো কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। যখন আবার ভাবছি অভাবে পড়ব কিনা, ঠিক সেই মুহূর্তেই সাংবাদিক রবি বসুর ছেলে অশোক ব্রহ্মপুরের বাড়িতে এসে শ্যামলকে অনুরোধ জানায়, ‘সাপ্তাহিক বর্তমান’-এ ধারাবাহিক কিছু লেখার জন্য। ‘শাহজাদা দারাশুকো’ প্রকাশিত হতে শুরু করল। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকমহলে তুমুল আলোড়ন। ব্রহ্মপুরে আরও একটা বাড়িতে কিছুদিনের জন্য ভাড়া ছিলাম আমরা। সুনীল ভুঁইয়ার বাড়ি।
ব্রহ্মপুর পর্ব শেষ। তারপর সামান্য কিছুদিনের জন্য ছিলাম কুঁদঘাটের একটি ভাড়াবাড়িতে। শ্যামলের একদম পছন্দ হয়নি সে বাড়ি। ওর ভাই তাপস তখনও রয়েছে টালিগঞ্জ ফাঁড়িতে ওদের আদি বাড়িতে। জানাল, পাশের ফ্ল্যাট খালি হচ্ছে। অতএব, আমাদের ফের উঠে আসা টালিগঞ্জের সে বাড়িতেই। শ্যামল সে-সময় বেনারসে। এদিকে ঘোষণা শুনলাম, ‘শাহজাদা দারাশুকো’ সাহিত্য অকাদেমি পাচ্ছে। পরিবারে স্বাভাবিকভাবেই খুশির আবহাওয়া। শ্যামলও ফিরে এল বেনারস থেকে। জাতীয় স্বীকৃতিতে সেও যথেষ্ট আপ্লুত। শ্যামল যে দারাকে নিজের পুত্রসন্তান বলত, আজ বুঝি, সেটা ওর দূরদৃষ্টি। এখনও এই বয়সে ‘শাহজাদা দারাশুকো’র রয়ালটি শ্যামলবিহীন আমাকে বেঁচে থাকার রসদ দিয়ে যাচ্ছে।
এখানে থাকার সময়েই আবার শ্যামলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হল আনন্দবাজারের। সেসময় ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন অমিতাভ চৌধুরি (শ্রী নিরপেক্ষ)। তাঁরই ইচ্ছা ও অনুরোধে ‘দেশ’-এ আবার শ্যামলের গল্প লেখার শুরু। ‘প্রত্নজিজ্ঞাসা’, ‘অচেনা সঙ্গী’, ‘শেষবার একসঙ্গে’ এইসব গল্প ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল। ‘সানন্দা’-তেও বেশ কিছু গল্প লিখেছিল শ্যামল, যেমন ‘জগুবাবুর বন্ধু’, ‘নিমফুলের মধু’। আর এই সময়-পর্বেই তো শ্যামল যুক্ত হয়ে গিয়েছিল ‘আজকাল’ পত্রিকার সঙ্গেও। প্রতি সপ্তাহে ‘আজকাল’ -এ তখন প্রকাশিত হচ্ছে ‘বাজারসফর’। কলকাতার বিভিন্ন বাজার ঘুরে ঘুরে সবজিওয়ালা, মাছওলিদের সঙ্গে কথা বলে ‘বাজারসফর’-এর রসদ সংগ্রহ করত শ্যামল। আহারে রসনায় যে এত তৃপ্ত, বাজার তো তাকে ডাকবেই। ‘বাজার সফর’ তাই শুধু কলকাতার বিভিন্ন বাজারের রিপোর্টাজ হয়েই রইল না, অন্যান্য লেখার মতো সেখানেও মিশে গেল শ্যামলের ম্যাজিক।
ইতিমধ্যে অনুরোধ এল ‘সানন্দা’ থেকে, ধারাবাহিক উপন্যাস লেখার। শুরু হল ‘আলো নেই’ — ‘অদুরেই স্বাধীনতা। দেশভাগ ঘনিয়ে এসেছে। কোথাও যেন আলো নেই। অখন্ড বঙ্গে দমবন্ধ অবিশ্বাসের আবহাওয়া। শতাব্দীর পরে শতাব্দী যারা একে অন্যের পড়শী তাদের ভেতর রাজনীতির বিষ ছড়িয়ে পড়ায় বিশ্বাস, ভালোবাসা ছিন্নভিন্ন। মহাত্মা গান্ধীর অনুরোধে বঙ্গিমচন্দ্রের দেশভক্তির গান বন্দেমাতরম ছেঁটে ছোটো করতে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথকে। অবিশ্বাসের রাজনীতির সাম্প্রদায়িক প্রচারে দেশের একদল মানুষ স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে সরে যাচ্ছেন। জওহরলাল তাঁদের ফিরিয়ে আনতে বৃথাই জনসংযোগের ডাক দিয়েছেন। সুভাষচন্দ্র বলছেন, এখনই ইংরাজের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাত আনতে হবে। গান্ধীজি বললেন, না, এখনও সময় হয়নি। দীর্ঘদিনের স্বাধীনতা আন্দোলন — সেই আন্দোলনকে ঘিরে আশা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন বুঝি খানখান করে ভেঙে যায়। … আবুল কাশেম ফজলুল হক ভোটে জিতে প্রথমেই কংগ্রেসের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গড়ার প্রস্তাব দিলেন। কংগ্রেস সাড়া না দেওয়ায় তিনি লিগের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গড়তে বাধ্য হলেন। সেদিনই বাঙালির ভাগ্য স্থির হয়ে গেল। পড়শীতে পড়শীতে ভিন্ন হয়ে যাওয়ার বাজনা ঝনঝন করে বেজে উঠল।’
‘আলো নেই’ উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের ভূমিকা থেকে কিছু অংশ তুলে ধরলাম। শ্যামলের জন্ম এমন একটি সময়, যাকে আজকের প্রজন্ম শত পড়াশোনার পরেও অনুভব করতে পারবে না। অধিকাংশ পঞ্চাশ দশকের লেখকদের মতো শ্যামলেরও শৈশবকাল, যখন ভারত স্বাধীন হচ্ছে আর তার পিছু পিছু চলে আসছে দেশভাগ। দুই বাংলার মাঝে বসছে কাঁটাতার। দেশভাগের এই ব্যথা উঠে এসেছে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে’ উপন্যাসে। কিংবা প্রফুল্ল রায়ের ‘কেয়াপাতার নৌকো’-য়, কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অর্জুন’-এ। আর জীবনের প্রায় সায়াহ্ন সময়ে শ্যামল স্পর্শ করল দেশভাগের প্রতি তার নিজস্ব অনুভব, প্রশ্ন, আর বিষণ্ণতাকে।
‘আলো নেই’ উপন্যাসটিও শ্যামলের দেশভাগ কেন্দ্রিক নিরন্তর গবেষণার একটি ফসল। ‘শাহজাদা দারাশুকো’-র সময়ও যা দেখা গিয়েছে যে, বিপুল পড়াশুনোর মধ্যে ডুবে থাকছে শ্যামল, সেই একই ব্যাপার লক্ষ করলাম ‘আলো নেই’ উপন্যাসেও। কিন্তু শ্যামলের লেখাই এমন, তাতে গবেষণার বা পাণ্ডিত্যের লেশমাত্র প্রকাশ থাকত না। কল্পনার উড়াল ও ভাষার সৌন্দর্য তা স্পর্শ করত, ঘিরে থাকত পাঠকের মন।
বাংলাদেশে যাওয়ার ইচ্ছে বহুবার আমার কাছে প্রকাশ করেছে শ্যামল। আমরা গিয়েছিলাম। দু’বার। আমন্ত্রণ পেয়ে। প্রথমবারের যাত্রায় শ্যামল আমাকে নিয়ে খুলনায় গিয়েছিল। সেখানে কোথায় ওর স্কুল, কিংবা খুলনার পর বরিশালে গিয়ে, কোথায় ওর জন্মভিটে, সমস্তই দেখিয়েছিল। ইছামতীর সামনে দাঁড়িয়ে আবেগে বিহ্বল হয়ে পড়ে শ্যামল। বলেছিল, দ্যাখো ইতি, এই হল বিভূতিভূষণের ইছামতী। লঞ্চে করে আমরা পাড়ি দিয়েছি বুড়িগঙ্গা নদীতে। শ্যামল আমাকে বাংলাদেশ থেকে কিনে দিয়েছিল ঢাকাই শাড়ি। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদের আপ্যায়ন আজও মনে আছে।
‘কুবেরের বিষয় আশয়’ লেখার সময় শ্যামল পত্রিকার তরফ থেকে চিঠি পেয়েছিল চার কিস্তির মধ্যেই লেখাটিকে গুটিয়ে আনার। ‘আলো নেই’ -এর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিন্তু হল না। শ্যামলের কোনো একটা জন্মদিন ছিল, বাড়িতে ফোন এল ‘সানন্দা’র অফিস থেকে। বলা হয়েছিল লেখাটিকে যদি একটু দ্রুত গুটিয়ে আনা যায়। শ্যামল সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেনি। ওর আরও দুটো কিস্তি লেখাই ছিল, তাও জানিয়ে দিল, দ্রুত নয়, বন্ধ আগামী সংখ্যা থেকেই।
পাক্ষিক ‘সানন্দা’য় ‘আলো নেই’ ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছিল এক বছর। বই হল যখন, তখন চেহারা পেল দু’খণ্ডে। বেশ মোটা। আর কতটুকুই বা লিখত শ্যামল। বেশি সময় লাগত না। শ্যামলের আক্ষেপ ছিল, একটু সময় পেলে একটা লজিকাল এন্ড হত লেখাটার! ২০০০ সাল। ‘আলো নেই’-এর প্রথম খণ্ডটি বেরিয়ে গিয়েছে এর এক বছর আগেই। সামনে পুজোর মাস। ‘আজকাল’-এ উপন্যাস পাঠিয়ে দিয়েছে শ্যামল। ‘এক সিংহ ও তার রমণী’। এর ঠিক আগেইশ্যামল ‘দেশ’-এর জন্য লিখে ফেলল উপন্যাসোপম এক দীর্ঘ গল্প ‘দশ লক্ষ বছর আগে’। তখনও লিখছে শ্যামল, আর কেবলই বলছে, আমার সারা শরীরে কেন এত ঘুম!
ঘুম বিষয়ে ওর একটি ছোটো লেখার কথাও মনে পড়ছে এ প্রসঙ্গে। কিন্তু সে তো ছিল মজার ঘুম! এখন যে ঘুমের কথা বলছে তা আমরা কেন, শ্যামল নিজেও কি তা চেয়েছিল! আমার ছোটো মেয়ে ললি পেশায় চিকিৎসক। ওই প্রথম টের পেল এবং সমীরও। বাবা অসুস্থ। কী হয়েছে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। পুজোর আগে আগেই ললি ওকে নিজেদের বাড়ি কাশীপুরে নিয়ে গেল। বেলা শেষের গান খুব বেশি গাইতে ভালো লাগছে না। সংক্ষেপেই যা বলার বলছি। ব্রেনে টিউমার ধরা পড়ল শ্যামলের। ললি বারে বারেই প্রার্থনা করেছিল ঈশ্বরের কাছে এবং আমরাও, টিউমারটি যাতে নন ম্যালিগনেন্ট হয়। ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিল না শ্যামল। ঈশ্বর সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে রসিকতা করে বলেছিল, ‘ঈশ্বর বা ম্যানেজিং ডিরেক্টর অব দ্য ওয়ার্ল্ড বা চেয়ারম্যান, বোর্ড অফ ডিরেক্টরস — যাই বলো — লোকটা কেমন, মিটিং-এ কতক্ষণ থাকে, পি.এ. কে, পারকুইজিটস কী কী জানতে ইচ্ছে করে।’
ঈশ্বরের রায় শ্যামলের বিরুদ্ধে গেল। শ্যামলের দুই মেয়ে, দুই জামাই, দুই ভাই, বোন এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজনেরা বেদনায় মুষরে পড়ল। আমার কথা কী আর বলব! বলতে ভালো লাগছে না। একের পর এক কেমো চলতে লাগল শ্যামলের উপর। শ্যামল ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ছে। লেখার চেষ্টা করছে আকুল, কিন্তু লিখতে পারছে না। এরই মধ্যে ললি আর সমীর শ্যামলকে নিয়ে ওদের বাড়িতে পালন করল ওর শেষ জন্মদিন। মিত্র ও ঘোষ পাবলিকেশন থেকে শ্যামল পেল প্রথম গজেন্দ্রকুমার মিত্র স্মৃতি পুরস্কার। তৎকালীন রাজ্য সরকার প্রদান করল ‘কথাশিল্পী’ পুরস্কার। শরৎ সমিতি দিল শরৎ স্মৃতি পুরস্কার। মাঝে ছিল ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হসপিটালে যাওয়া। আমরা শুনলাম শ্যামলের মেয়াদ আর ছ’মাস। ললি-সমীরের অক্লান্ত সেবায় সেই মেয়াদ আরও ছ’মাস বেড়েছিল। এই অবস্থায় শ্যামলকে আমি দেখতে যাইনি। আসলে দেখতেই চাইনি। ললির সঙ্গে থাকার ওই গোটা এক বছরে গিয়েছি এক বা দুবার।
২৪ সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে দুপুর দশটা নাগাদ আমরা চিরকালের মতো শ্যামলকে হারালাম। সেদিন আমার চোখে এক ফোঁটাও জল ছিল না। না কি ছিল? কাউকে জড়িয়ে কেঁদেছিলাম দু’মুহূর্ত? হয়তো। মনে নেই। ওটুকুই।
আমার দুই দেওর ও দুই জামাই পরে জানিয়েছে সরযূ নার্সিংহোম থেকে শ্যামলের শেষযাত্রার ঘটনা। নার্সিংহোমেই এসেছিল মতি। ও তো আসবেই। শ্যামলকে তো ও-ই নিয়ে এসেছিল আমার জীবনে। সেদিনের ছবিটি মতির চোখে ঠিক কীরকম? ‘… ওর সেই নিস্পন্দ মুঠোটা ধরলাম। ঠান্ডা চটচটে ঘাম-মাখা বুকে হাত রাখলাম। ওঠানামা করল না। ভাসাভাসা আয়ত চোখদুটি দেখতে পেলাম না, প্রেমিকের চোখ, প্রেম অন্বেষণের চোখ, প্রেম গ্রহণের চোখ, প্রেম দেওয়ার চোখ, আর কোনোদিনই দেখতে পাব না। চোখ বুজে ঘুমোচ্ছে, মুখে বিন্দুমাত্র বিকার নেই। শান্ত সমাহিত। শ্যামল যেন তার কাঙ্খিত ঘুমটি পেয়েছে। গত একবছর ধরে এই ঘুমের জন্য লড়াই করে আজ সে জিতে গেল।’
অনুজ লেখকদের মধ্যেও এসেছিল অনেকেই। অমর মিত্র, কিন্নর রায়, অরিন্দম বসুরা এই দিন থাকবেন না শ্যামলের কাছে, হতে পারে? সরকারি শবশকটে যাত্রা শুরু শ্যামলের। সামনে সরকারি হুটার, ফাঁকা করে দিচ্ছে রাস্তা। শেষ যাত্রার ওই গোটাপথের ধারাবিবরণী দিচ্ছেন স্বপ্নময় চক্রবর্তী, শোনা যাচ্ছে আকাশবাণীতে। সরকারের অনুরোধে শবদেহ নিয়ে যাওয়া হল বাংলা আকাদেমিতে। পশ্চিমবাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পক্ষ থেকে সেখানে শ্যামলকে শ্রদ্ধা জানান সনৎ চট্টোপাধ্যায়। তারপর নিয়ে আসা হয়েছিল আমাদের টালিগঞ্জ ফাঁড়ির বাড়িতে। সেখানে আগে থাকতেই ভিড় করে ছিল সারা পাড়ার লোকজন। শ্যামল তো ওদের প্রিয় ছিল, ওদের সঙ্গেই তো ওর সকালের প্রথম চা-খাওয়া, আড্ডা। বাড়ি থেকে এরপর নিয়ে যাওয়া হল কেওড়াতলা শ্মশানে। শুনেছি, দাহকার্য শুরু হওয়ার সময় থেকে অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া অবধি সেখানে ঠায়উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা পশ্চিমবাংলার আজকের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই লেখা লিখতে গিয়ে আবার অনেকদিন পর দেখা হয়ে গেল শ্যামলের সঙ্গে। ওর সম্পর্কে আর কি-ই বা বলার। বরং, মৃত্যু বিষয়ে শ্যামলের যা মনে হওয়া, তা দিয়েই এই লেখার শেষে পৌঁছতে চাহ — ‘মৃত্যু যেন ঘুমের মধ্যে আসে। একটা বড়ো লেখা লিখলে মানুষ টের পায় যে মৃত্যুর দিকে এগুচ্ছে। আর কিচ্ছু না। মৃত্যু মানে কী। একটা বড়ো ঘুম। ছোটো ঘুমের ভেতর দিয়ে বড়ো ঘুমে চলে যাওয়া। স্মৃতি ও বিস্মৃতি।’