আমার শিল্পী জীবনে তরুণ মজুমদার

আমার শিল্পী জীবনে তরুণ মজুমদার

আমি তরুণ মজুমদারকে তনুদা বলি। যদিও আমার থেকে তিনি এক বছরের ছোটো। এটা সম্বোধনের ব্যাপার নয়। আমার কাছে তনুদা একটা নাম। আমি যখন শ্রীমতী পিকচার্সের ব্যানারে ‘দেবর’ ছবি করি তখন থেকে তনুদার সঙ্গে আমার আলাপ। এই ছবিতে তনুদা সহকারী ছিলেন হরিদাস ভট্টাচার্য মশায়ের। তনুদার কাজ ছিল ডায়লগ পড়ানো। তিনজন সহকারী শচীন, তনুদা আর দিলীপ। এঁদের মধ্যে দিলীপ ছিল একনম্বরের ফাঁকিবাজ। তনুদার সঙ্গে আমার প্রায়ই কথা কাটাকাটি হতো। স্ক্রিপ্টে যা লেখা আছে তাই বলতে হবে। কোনওরকম অদলবদল করা চলবে না। আমি অবশ্য পরিচালককে বলে একটু-ওদিক করে নিতাম ডায়লগ। তনুদার সবচেয়ে বড়ো গুণ হল কাজের প্রতি ওঁর ইনভলভমেন্ট। সমস্ত কাজটাই সিরিয়াসলি করত। সমস্ত বিভাগেই কাজ করার চেষ্টা করত।

তনুদার কাছ থেকে এতরকম চরিত্র পেয়েছি যে বলার কথা নয়। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি, ‘বরযাত্রী’ ছবিতে আমার অভিনয়, আমাকে কমেডিয়ান বানিয়ে দিল। আরে, কমিক রোল করা কি অত সোজা। সিরিয়াস রোল করার মানুষ অনেক পাওয়া যায়, কিন্তু কমিক রোল করে কজন। তনুদার ছবিগুলোর কথা ভাবুন। প্রায় প্রত্যেক ছবিতেই কিছু না কিছু অন্যরকম করেছি। এই ধরন ‘দাদার কীর্তি’ ছবিতে থিয়েটার ঘেঁষা অভিনয়। ইমপ্রোভাইজেশন কাউকে শেখানো যায় না। শিল্পীকে নিজেকে তৈরি করে নিতে হয়। যেমন, ‘দাদার কীর্তি’ ছবিতে তাপসকে শীতের গভীর রাতে নদীর জলের মধ্যে নামিয়ে দিয়ে আমি চাদরটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিই। কতটা ঠান্ডা সেটা দর্শকদের বোঝানো দরকার। আবার ‘আলোর পিপাসা’ ছবিতে একটা খারাপ লোকের চরিত্র করেছিলাম। একটা সংলাপ ছিল সন্ধ্যা রায়কে আমি বলছি, জেনটিলম্যান বন্যে। দিল্লগি মাৎ করো আউর উআপাস করো মেরা রুপাইয়া’। পান চিবোতে চিবোতে এই সংলাপটা বলছি। সংলাপ শেষ করেই একটু চুন নিয়ে জিভে ঠেকাই। এই যে চুন নেওয়াটা, এটাই ইমপ্রোভাইজেশন। এগুলো আমি নিজে থেকেই করতাম। আর তনুদা বলতেন, ‘অনুপকে বেঁধে দিলেই বিপদ। ওঁকে ওঁর মতো করতে দাও।’

আসলে আমাদের মধ্যে একটা অদ্ভুত বোঝাপড়া থাকত। উনি কী চাইতেন, বলবার আগেই আমি বুঝে যেতাম। আর কী করতে যাচ্ছি, করবার আগেই উনি বুঝে যেতেন। আসলে তনুদার ইউনিটে আমরা যাঁরা কাজ করেছি তাঁরা সবাই জানেন কী অসম্ভব ডিসিপ্লিনড উনি। অসম্ভব ডিটেলে কাজ করেন। ছোটো ছোটো শট নিয়ে কাজ করেন। অসম্ভব ভালো কম্পোজিশন। হবে নাই বা কেন? উনি ভালো ছবি আঁকেন। বুঝতে পারেন কোথায় কী থাকলে ভালো লাগবে। কোথায় কে থাকলে ছবিটা ছবির মতো হবে। ‘নিমন্ত্রণ’ ছবিটার কথাই ধরুন। ৮-১০ দিনের শুটিং শিডিউল ছিল। আমি আর সন্ধ্যা রায় ছিলাম। আমার দারুণ প্রিয় ছবি। আমি তনুদাকে বলেছিলাম শটগুলো একটু বড়ো বড়ো করে নিলে তো, দিন দুয়েক ছুটি পেতাম আমরা। তাতো হলই না, আরও হাফ শিফট বেশি লেগেছিল।

তনুদার পেপার ওয়ার্কস অসাধারণ। যে-কোনও অন্ধ লোকও বুঝে নেবেন উর্নি কী চান। মেক আপ রুমে চার্ট লাগানো থাকতো। কে কখন মেক আপ নেবে। প্রতিটা শট, প্রতিটা সময়, প্রতিটা দিন হিসেব করা। আমি যা কিছু পেয়েছি তা ওঁর কাছ থেকে। তাই ওঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আজও আমরা পরিপূর্ণভাবে পরস্পরের বন্ধু। আজও আমি তনুদাকে অসম্ভব ভালোবাসি। এখনও কাজ করে যাচ্ছি। জানি না, তনুদা তাঁর কোনও ছবিতে আমাকে দিয়ে শ্রেষ্ঠ অভিনয় করিয়ে নেবেন। আমি যখন অবসর নেব তখনও পান চিবোতে চিবোতে ভাবব তনুদার ওই ছবিতে ওই রোলটা পেলে সার্থক হতাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *