আমার যে দিন ভেঙে গেছে
নদীর ওপারে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। একটু আগেও চাক বেঁধে থাকা আগুনে কমলা আভাটা একটু একটু করে নববধূর লজ্জারাঙা গালের মতো গোলাপি বর্ণ ধারণ করে ছড়িয়ে যাচ্ছে ফিকে ধূসর রঙের আকাশের গায়ে। কতগুলো পাখি, হয়তো খুব চেনা, বক বা গাংচিল—একসঙ্গে ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে। আবছা অন্ধকারে জাত চেনার উপায় নেই তাদের। মন্দিরা গায়ের চাদরটা আঁটসাঁট করে জড়িয়ে নিল। তারপর মাথাটা এলিয়ে দিল আমার কাঁধে। শহর-কলকাতার মেয়ে ও। গ্রামবাংলাকে কখনও সেভাবে দেখা হয়নি। তাই সদ্য বিয়ের পর আমার সঙ্গে বিরামপুর আসার কথায় আপত্তি করেনি মন্দিরা। আপত্তি ছিল আমার।
বিরামপুরে আমাদের আদিবাড়ি। বিশাল বড়ো করে দুর্গাপুজো হয় প্রতিবছর। কমপক্ষে পাঁচহাজার লোক খায়! চারদিনে। আমার বাবা-মা নিয়ম করে প্রতিবার আসে এখানে। কখনো সময় পেলে আমার অতিব্যস্ত চিকিৎসক দাদাও আসে সপরিবারে। কিন্তু গত পনেরো বছর আমি আসিনি বিরামপুরে। এমন নয় যে আমি খুব বড়ো চাকরি করি। সরকারি অফিসে সামান্য কেরানি আমি, কাজেই অফিসের বাইরে সময়ের অভাব হয় না খুব একটা। ছোট থেকেই অতি সাধারণ মানের ছাত্র হওয়ায় মা-বাবার খুব একটা আশা-ভরসা ছিল না আমার উপর। দাদা ছিল ভালো ছাত্র। দাদার সাফল্য ও তার পিছনে ওর মানসিক চাপ দেখে নিজেকে অবশ্য ভাগ্যবান ভাবতাম আমি। সাধারণ ছাত্র ছিলাম বলেই হয়তো নিজের ইচ্ছামতো নানাধরনের বই পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। নইলে দাদার মতো আগে রেজাল্টের পিছনে, আর পরে পয়সার পিছনে ছুটে মরতাম। এভাবে নদীর ধারে বসে সূর্যাস্ত দেখার চোখটাই হারিয়ে ফেলতাম হয়তো।
মন্দিরার সঙ্গে আমার সম্বন্ধ করে বিয়ে। মা-ই পছন্দ করেছিল ওকে। মার অভিজ্ঞ চোখ বুঝতে ভুল করেনি যে আমার সাদামাটা জীবনে মানিয়ে নেওয়ার মতো ধৈর্য ও গভীরতা ওর আছে। গত সপ্তাহে বিয়ে হয়েছে আমাদের। বিয়ের পর মা-র তাড়নাতেই এখানে আসা। আমাদের আদিবাড়িতে যুগলকিশোরের অধিষ্ঠিত মূর্তি আছে। প্রতিদিন পুরোহিত এসে দু’বেলা পুজো করে যান। মা-র ইচ্ছে, বিয়ের পর আমরা যুগলে এসে যুগলকিশোরকে প্রণাম করে যাই। মা-ও আসত আমাদের সঙ্গে, কিন্তু বিয়ের ধকলে মা-র শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাই আমাদের দু’জনকেই আসতে হল।
আমাদের বিরামপুরের বাড়ি শরিকি হলেও সারাবছর খালি পড়ে থাকে। পুজোর সময় দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে আত্মীয়রা আসে, আবার ফিরে যায়। মালিদাদু বলে একজন বুড়োমানুষ আছেন বাড়ির দেখাশুনা করার জন্য। তাঁর মাইনে, পুরোহিতের মাইনে, বাড়ি ও মন্দিরের খরচ-সব মাসের শুরুতে পোস্টে পৌঁছে দেওয়া হয়। মালিদাদু আমার জন্মের আগে থেকে এ বাড়ির বাসিন্দা। মাত্র দু’মাস আগেই পুজো গেছে, তাই এখন বাড়ি একদম ফাঁকা। আমরা আসায় মালিদাদু খুব খুশি। যদিও আমরা আজই সবে এসেছি আর কাল দুপুরে চলে যাবো।
মন্দিরাকে গ্রামটা ঘুরে দেখাতে বেরিয়েছিলাম। নদীর ধারে এসে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল নিভে আসা চুল্লির মতো ডুবন্ত সূর্যটাকে। দু’জনে চুপ করে বসে পড়েছিলাম নদীর বাঁধানো ঘাটে। আমার কাঁধে মাথা রেখে মন্দিরা কি ভাবছিল জানি না। কিন্তু আমি ফিরে গিয়েছিলাম আজ থেকে সতেরো আঠারো বছর আগে। ঠিক এই সময় ঠিক এভাবেই সূর্য অস্ত যেত, এভাবেই পাখিরা অন্ধকারের আড়ালে নিজেদের পালক লুকিয়ে, কাউকে তাদের চেনার সুযোগ না দিয়ে, দিগন্তের দিকে উড়ে যেত বাসার খোঁজে। আর একটা জটপড়া রুক্ষ চুলের গোলগাল শ্যামলা মেয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে এসে দাঁড়াত, ঐ যে এখনও দেখা যাচ্ছে- ঐ গাব গাছটার পাশে। গাছের গুঁড়িতে শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে যখন এক হাত বুকে রেখে হাঁপাত ও, তখন সদ্যকিশোরী বুকের সঙ্গে হাতের ওঠানামা আমার নিঃশ্বাস বন্ধ করে আনত। আমার ফ্যাকাশে মুখটা আবছা অন্ধকারে দেখতে পেত না বটে, তবু নারীসুলভ ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের খোঁচাতেই বুঝি ভুরু কুঁচকে স্ফীত নাসারন্ধ্র উঁচু করে জিজ্ঞেস করত ‘কী দেখছিস?’ আমি জানতাম কথা বলতে গেলে গলা কেঁপে যাবে। তাই শুধু হাসতাম। আরও কিছুক্ষণ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দু’জনেই ধাতস্থ হওয়ার পর হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যেতাম নদীর ধার দিয়ে শ্মশানঘাটের দিকে। খুব যে কথা হত তা না। তবু! কিছুক্ষণ পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া, দেহের পাশে দুলতে থাকা হাতের অংশ ওর হাতে আচমকা ছুঁয়ে যাওয়া- এর জন্যই শুধু অপেক্ষা করা যায় সাতজন্ম। নদী থেকে ছুটে আসা দমকা হাওয়া ওর কতদিনের তেল না পড়া রুক্ষ চুলের কয়েক গাছি আমার মুখের উপর বুলিয়ে দিয়ে যেত। সারাদিনের ক্লান্তির পর ওর গা থেকে ভেসে আসা মৃদু ঘামের গন্ধ আমার বুকের ভিতরে তেহাই-এর বোল তুলত। মাঝে মাঝে সামান্য কারণে খিলখিলিয়ে হেসে উঠত ও আর সদ্যযুবক আমি পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভিজে যেতাম নববর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে। ইচ্ছে হত ওর ধুলোমাখা পা গালে চেপে ধরে বলি ‘স্মরগরলখণ্ডনং মমশিরসিমণ্ডনং দেহপদপল্লবমুদারম্’। কিন্তু সতেরো বছরের মুখে এসব কিছুই যোগায়নি। কখনো বলিনি ‘ভালোবাসি’। কখনো জানতে চাইনি ‘ভালোবাসিস?’ শুধু প্রথম যৌবনের মুগ্ধতা আর বুকের ভেতরে এক প্রবল টান— বুঝিয়ে দিত ওকে আমার চাই। ও কীভাবে বুঝেছিল জানি না। তবে বুঝেছিল নিশ্চয়ই। নইলে প্রতিদিন সন্ধেবেলা কেন ছুটে আসত আমার ডাকে নদীর ধারে?
বছরে তো মাত্র কয়েকদিন দেখা হত আমাদের। পুজোয় যখন আসতাম, দিন সাতেকের জন্য। তারপর ফিরে যাওয়ার আগের দিন ওর দিঘির মতো টলটলে কালো চোখদুটোতে দেখতে পেতাম ছেড়ে দেওয়ার কষ্ট আর ফিরে না-পাওয়ার আশঙ্কা একসঙ্গে ছায়া ফেলেছে। মুখে বলত ‘আবার আসবি তো?’ যেটা বলত না, সেটাও শুনতে পেতাম ‘ভুলে যাবি না তো?’ শুনেও ওর আশঙ্কা দূর করার চেষ্টা করতাম না। হয়তো উপভোগ করতাম ওর উদ্বেগটুকু। হয়তো বুকের কোথাও একটু অহংকার কাজ করত। আমি শহরের ছেলে, ওর চেয়ে অনেক সুন্দরী অনেক বুদ্ধিমতী মেয়েকে প্রেমিকা হিসেবে পেতে পারি আমি; তবু দেখো, কত ভালো কত দয়ালু আমি! সাধারণ একটা গ্রামের মেয়ের জন্য ছুটে ছুটে আসি প্রতি বছর। অন্যদিকে ও তো আমার চেয়ে ভালো প্রেমিক পেতেই পারে না। তাই ও থাকবে অপেক্ষায়, আর আমি ওকে এক বছরের জন্য নিশ্চিন্ত করতে ফিরব সাতদিনের জন্য।
পারুল… ওর নাম। আমাদের মালিদাদুর নাতনি। বছর তিনেক চলেছিল আমাদের এমন বাল্যপ্রেম। সাকুল্যে একুশদিনের কাছে আসার আয়ু যে প্রেমের।
পুজোর সময় কাজের জন্য প্রচুর লোক প্রয়োজন হত বলে মালিদাদুর গ্রাম থেকে ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনীরা আসত। এত আত্মীয় অনাত্মীয় মানুষের মধ্যে কেন আমার পারুলকেই ভালো লেগেছিল জানি না, মনে হয় ওর সাবলীল আচরণ, সহজে মিশে যাওয়ার প্রবণতা, অথবা এর কোনওটাই না, শুধু বিধির বিধান ছিল আমাদের কাছে আসা। তারপর নদীর ধারে দেখা করা, খুব সাধারণ কিছু কথা, আমার শিয়াল দেখে ভয় পাওয়া আর ওর হেসে গড়িয়ে পড়া, আমার কলকাতা থেকে ওর জন্য নিয়ে যাওয়া টিপের পাতা আর চুলের ক্লিপের পরিবর্তে গাছ থেকে বাতাবিলেবু পেড়ে নুন লঙ্কা দিয়ে মেখে খাওয়ানো, আর… আর মাত্র একদিন কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে অসময়ের বৃষ্টি থেকে বাঁচতে গ্রামের পরিত্যক্ত রথতলায় ভাঙা রথের আড়ালে দুটো কাঁচা বয়সের ছেলেমেয়ের প্রথম ভীতু চুম্বন….. আমার ঠান্ডা হয়ে আসা ঠোঁটের ফাঁকে তিরতির করে কাঁপছিল ওর পাতলা শুকনো ঠোঁটদুটো। পরদিনই ছিল আমাদের ফেরা। জানি না মা কী করে জেনেছিল আমাদের সম্পর্কের কথা। পারুলের বাবা-মাকে বাড়িভর্তি লোকের সামনে অকথ্য অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বাড়ি থেকে। পারুল আর ওর বোনও বেরিয়ে গিয়েছিল বাবা মায়ের পিছু পিছু। আমার ভেতরটা ফেটে গেলেও কিচ্ছু বলতে পারিনি। চুপ করে দেখেছিলাম শুধু। যাওয়ার আগে পারুল একবারও ফিরে তাকায়নি আমার দিকে। আমি চাইছিলাম একটিবার, শুধু একটিবার ও তাকাক, পড়ে নিক আমার চোখ থেকে আমার না-বলা কথা। আমি যে কত অসহায়, বুঝুক ও। কিন্তু না, একবারও তাকায়নি পারুল। সেই শেষ। আর আসেনি ওরা। আর খবর পাইনি পারুলের। অশিক্ষিত গ্রামের মেয়ে পারুল হারিয়ে গিয়েছিল বিস্মৃতির অতলে। কারণ এর পর থেকে আমিও আর আসিনি বিরামপুরে। মা-বাবাও জোর করেননি। আজ এত বছর পর মন্দিরাকে নিয়ে আসা। মা-র মনে আর কোনও আশঙ্কা নেই।
ঠান্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে আজ। নদীর ধারে উত্তুরে হাওয়াটা এতটাই প্রবল যে আর বসা যাচ্ছে না। উঠে পড়লাম। চলে আসার সময় একবার পিছনে তাকিয়ে কেমন অসাড় হয়ে গেলাম। গাবগাছের নীচে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে পারুল। যদিও ঝুপসি অন্ধকার নেমে এসেছে, তবুও যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ওকে! ওই তো, বুকে একহাত রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে অবাক দুটো চোখ তুলে আমাকে বলছে ‘ভুলে গেলি?’ মন্দিরা আমার হাত ধরে টানতে সম্বিত ফিরে এল। পিছন ফিরে চলে এলাম। আর তাকাইনি পিছনে। তবু বারবার মনে হচ্ছিল, দু’জোড়া কালো দিঘির মতো চোখ অনুসরণ করছে আমাদের যাত্রাপথ।
সেদিন রাতে খাওয়ার পর মন্দিরা তাড়াতাড়ি শুতে গেল। সারাদিনের ধকলে বড়ো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে মেয়েটা। আমার ঘুম আসছিল না। মাথায় একটা চিন্তা ঘুরছিল। মালিদাদুকে জিজ্ঞেস করব পারুলের কথা। খুব সংকোচ হচ্ছিল। কিন্তু কৌতূহলের হাতে আমি অসহায়। মন্দিরা জেগে থাকলে জানা হবে না। তাই দরজা বাইরে থেকে টেনে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম মালিদাদুর ঘরের উদ্দেশে।
মালিদাদু তখনও জেগে। আমাকে দেখে খুশি হয়ে নানা প্রশ্ন করতে লাগলেন। বেশিরভাগই বাবা, মা, দাদা এদের ব্যাপারে। আমি মনে মনে অধৈর্য হয়ে পড়ছিলাম। কথার মাঝখানে দাদুকে থামিয়ে আচমকা প্রশ্ন করলাম ‘পারুল কেমন আছে দাদু?’ দাদু একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না এই প্রশ্নের জন্য। হয়তো-বা একটু বিরক্ত হলেন। খানিক চুপ করে থেকে বললেন ‘ভালোই তো। বিয়ে হয়েছে, দুটো ছেলেমেয়ে।’ তারপর আবার কথা ঘুরিয়ে চলে গেলেন আগের আলোচনায়। আমি কিছুক্ষণ বসে উঠে পড়লাম। যা জানার জেনেছি। কিন্তু মন তো মানতে চাইছে না। আমার কেমন বিশ্বাস হয়ে গিয়েছিল, পারুল বেঁচে নেই। নইলে আজকে নদীর ধারে ওকে অমন স্পষ্ট দেখলাম! সেই পনেরো বছর আগের পারুল। সেই চতুর্দশী পারুল। অথচ মালিদাদু বলছে ও ভালো আছে। একবার ভাবার চেষ্টা করলাম পারুলের কথা। যতবার চিন্তা করছি, ওর গাবতলায় দেখা বিস্মিত মুখটাই মনে পড়ছে। এত স্পষ্ট… কখনো ভুল হতে পারে?
একটা সিগারেট ধরিয়ে বাড়ির বাইরে উঠোনে দাঁড়ালাম। বিরাট বাড়িটার দুটো ঘরে আর একটা বারান্দায় কেবল আলো জ্বলছে। আর গোটা বাড়ি অন্ধকারে ডুবে আছে। বারান্দার আলো কানাচে করে এসে পড়েছে উঠোনে। মনটা বড়ো হু হু করছে। কেন যে মা-র কথা শুনে রাজি হলাম আসতে! শেষ টান দিয়ে সিগারেটের ফিল্টারটা ছুঁড়ে ফেলে চলেই আসছিলাম। হঠাৎ একটা চেনা গলার স্বর আমার দু’পা চেপে ধরল।
–‘কেমন আছিস সন্তু?’
ঘুরে দাঁড়ালাম। উঠোনের মাঝখানে কুয়োতলার পাশে ঝিমঝিমে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে পারুল। সেই রুক্ষ তেলহীন এলোচুল, সেই সুতির ফ্রক, সেই চতুর্দশী। আমি কেমন নেশাগ্রস্ত মানুষের মতো টলতে টলতে এগিয়ে গেলাম— ‘পারুল, তুই! মালিদাদু যে বলল তুই এখন দুই ছেলেমেয়ের মা! কিন্তু তুই তো একটুও বড়ো হোসনি। এ কী করে সম্ভব!’
খিলখিল করে চেনা ভঙ্গিতে হেসে উঠল পারুল, ‘কেন সম্ভব না? আমার তো কথা ছিল তোর জন্য অপেক্ষা করার আর তোর ফিরে আসার। আমার এ জীবনটা তো তোরই। তুই ভুলে গেলি। আর ফিরলি না। আমার জীবনও এগিয়ে গেল ভবিষ্যতের পথে। কিন্তু অতীত… অতীত তো আজও তোর প্রতীক্ষায়। তুইও যদি নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারতিস ঐ বয়েসটায়, তাহলে দেখতে পেতিস সতেরো বছরের সন্তু আর চোদ্দ বছরের পারুল আজও হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়ায় নদীর চরে। রথতলায় ওদের আনাড়ি ঠোঁটদুটো আজও থরথর করে কাঁপে পরস্পরকে স্পর্শ করার উৎকণ্ঠায়। কিন্তু তুই তো ভুলে গেলি সন্তু।’
শেষের কথাগুলো বলার সময় গলা কেঁপে গেল পারুলের। আমি স্তম্ভিত, হতবাক! এও কি সম্ভব? পারুলের স্বচ্ছ শরীরটা রাতের কুয়াশায় আরও আবছা দেখাচ্ছে। আমার চোখের সামনে দুনিয়াটা কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। মাথা কাজ করছে না। অনুভব করলাম আমার দু’চোখ থেকে নেমে আসছে জলের ধারা। আমি কাঁদছি। আসুক কান্না, বান ডাকুক চোখের জলে। ধুয়ে যাক আমার সব বর্তমান, ভবিষ্যৎ। পড়ে থাকুক শুধু অতীত, শুধু আমার সতেরো বছর, আমার পারুল। জীবনের গাড়িটা এই মুহূর্তে ইউ টার্ন নিয়ে ছুটে চলুক পিছনদিকে। আমাকে ক্ষমা কর পারুল, ক্ষমা করো মন্দিরা, আমি তোমাদের দু’জনের কাছেই অপরাধী। বুকের মধ্যে সতেরো বছর নিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকবে খাতায় কলমে বত্রিশের একটা মানুষ? না কি ভুল বলছি? আসলে এভাবেই বেঁচে থাকে সবাই! বয়েস বেড়ে চলে নিজের ছন্দে, আর বুকের আনাচে-কানাচে বাসা বেঁধে থাকে চোদ্দ, সতের, বাইশ, পঁচিশ! স্থান, কাল, পাত্রভেদে কখনও কখনও এসে দাঁড়ায় চোখের সামনে। আদায় করে নেয় সমস্ত খাজনা। পারুলকে আর দেখতে পাচ্ছি না। এক আকাশ তারার নীচে দাঁড়িয়ে আছি আমি… একা। হিমে ভিজে গেছে আমার সারা শরীর, গরমজামা সব। আমার ঠান্ডার কোনও অনুভূতি হচ্ছে না। শুধু এক বিশাল শূন্যতা হঠাৎ গ্রাস করল আমার হৃদয়। আচমকা বুঝতে পারলাম, আমি সতেরোর সন্তু নই, আমি বত্রিশের সন্দীপ। আমি নদীর পারে পারুলের পাশে হেঁটে যাওয়া কিশোর নই, আমি মন্দিরার স্বামী। তোমাকে সারাজীবন প্রতীক্ষা করতে হবে হে চতুর্দশী, আমি কালই ফিরে যাব আমার বর্তমানে। যে জীবন আমি ফেলে এগিয়ে গিয়েছি, আর সেখানে ফেরা আমার পক্ষে সম্ভব না। সমুদ্রে দিশা হারানো নাবিক লাইটহাউসের আলো দেখতে পেলে ক্লান্ত শ্রান্ত শরীর সত্ত্বেও যেভাবে এগিয়ে চলে তার দিকে, তেমনভাবেই বারান্দা ধরে এগিয়ে চললাম আমি ঘরের দিকে। মন্দিরা একা আছে।