আমার মেয়ের পুতুল – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
গাড়িটা থেমে আসছে।
আমরা যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। এতক্ষণ ক্লান্ত একটানা শব্দের তালে তালে অলস নাচের ছন্দে গাড়িটা কোমর দোলাচ্ছিল। নাচের ছন্দটা ছড়িয়ে পড়ছিল আমার রক্তের মধ্যে। আমি জেগে ছিলাম। শুধু আমার মনটা নেশার ঘোরে থিতিয়ে যাচ্ছিল।
গাড়িটা থেমে আসছে। শান্তা আমার দিকে তাকাল। অনেকক্ষণ পর ও চোখ মেলল। খুব ক্লান্ত অবসন্ন কণ্ঠে বলল, ‘জানালাটা বন্ধ করে দাও না।’
আমি হাত বাড়িয়ে জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে ওর কাছে বসলাম। বললাম, ‘শীত করছে তোর?’
‘না, শীত করছে না। আমি একটু বসব এবার। বাবা, তুমি আমার মুখোমুখি বসছ না কেন!’
আমি ওর গায়ে কম্বলটা ভাল করে জড়িয়ে দিতে দিতে একটু হাসলাম। ওর চুলগুলো রুক্ষ লালচে। আমি ওর মাথায় হাত রাখলাম। গরম। উত্তাপটা আমার হাতটাকে কাঁপিয়ে দিল, আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল। আমি ওর মুখোমুখি বসলাম।
‘এটা কী স্টেশন বাবা? গাড়িটা থেমে আসছে যে!’
আমি জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখে বললাম, ‘রংটং।’
‘বাঃ, কী মজার নাম। রংটং, রংটং’, ও টেনে টেনে বলল, ঠিক যেন মনে হয় ঢং ঢং ঢং ঢং।’
শব্দ হচ্ছে ঢং ঢং। ঘণ্টার শব্দ। নিস্তব্ধ, জংলি স্টেশনটার চার পাশে পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে শব্দটা ফিরে এল। আবার পিছিয়ে গেল। গাড়ি ছাড়বার সংকেত। বিদায়ের সংকেত। শান্তা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমার হাসি পাচ্ছে না। রজতশুভ্রর কথা আমার মনে পড়ছে।
‘কার্সিয়াং আর কতদূর বাবা?’
‘এখনও অনেক দূর।’ আমি আস্তে আস্তে ভেঙে ভেঙে বললাম। আমার গলার স্বরটা কাঁপল। জানালায় কাঠের ওপর আমার হাতটা শক্ত। আমি মনে মনে কথা বলছি। সে-কথা কেউ শুনছে না। আমি মনে মনে বলছি, শান্তা, তুই ঘুমো। এই স্টেশনগুলোকে পার হয়ে যেতে দেখিস না, এই জঙ্গলকেও না, এই পাহাড়কেও না। বড় বিস্বাদ আজকের দিনটা। তোর জ্বর বেড়েছে। আরও বাড়বে। তুই ঘুমিয়ে পড়। খুব শান্ত ছোট্ট পুতুলের মুখের মতো তোর মুখটা কম্বলের ওপর জেগে থাক। তুই ঘুমিয়ে পড়। আমি জেগে থাকি।
‘লুডোটা একটু বার করো না বাবা। একটু খেলব।’
আমি চমকে উঠলাম। তাকালাম। হাসলাম। শান্তা কাচের শার্সির বাইরে তাকিয়ে আছে। আমার হাসিটাকে ও দেখল না।
আমি উঠে বাস্কেট থেকে লুডোটা বের করলাম। গাড়ির দেওয়ালের আয়নায় আমার ছায়া পড়ল। অতি প্রবীণ একটি মুখ। এই মুখটা আমার। আমি কী আশ্চর্যভাবে বুড়ো হয়ে গিয়েছি। একটা নিশ্বাসকে চেপে রাখি বুকের ভিতর। আমার সতেরো বছরের মেয়ে ওই নিশ্বাসটার শব্দ শুনলে চমকে উঠবে। কিন্তু নিশ্বাসটা আছে। প্রতি মুহূর্তেই সেটা বেরিয়ে আসতে চায়। আমি তাকে যত অনুভব করি, তত যন্ত্রণার ছাপ আমার মুখে বার্ধক্যের চাবুক মেরে কতগুলো নতুন রেখা এঁকে দেয়। শান্তার মতো আমিও রজতশুভ্রকে ভুলতে চেষ্টা করি।
আমরা লুডো খেলতে শুরু করেছি। আমি হারছি। শান্তার চোখ দুটো আনন্দে জ্বলজ্বল করছে। ও হাসছে, ‘বাবা, তুমি হেরে যাচ্ছ যে। ওমা, এক ছয়-তিন দিয়ে তুমি আমার গুটিটা খেতে পারতে না?’
আমি কিছু শুনছি না, কিছু দেখছি না। অলস নাচের ছন্দে গাড়িটা কোমর দোলাচ্ছে, টাল খাচ্ছে, বেঁকে যাচ্ছে, আবার সোজা হচ্ছে। শান্তা হাসছে। আমার বুকে নির্জন যন্ত্রণা। একক, অসহনীয়।
‘থাক বাবা, খেলতে আর ভাল লাগছে না। এসো, একটু গল্প করি।’ শান্তা বলল। ওর মুখটা আমি দেখছি। সুন্দর, কোমল, কিন্তু শুষ্ক। শুধু চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে।
আমি বললাম, ‘কেন, বেশ তো খেলছিলি।’
‘কিন্তু তুমি মন দিয়ে খেলছ না। তার চেয়ে আমাকে গল্প বলো। ভাল গল্প বলো, সুন্দর গল্প, যে গল্প শুনে মন খারাপ হয়ে যায় না।’
আমি একটু হাসলাম, ‘কিন্তু এখন যে তোর ওষুধ খাওয়ার সময় হল শানু।’
‘ওষুধ থাক বাবা। আর ভাল লাগে না ওষুধ খেতে।’
‘কিন্তু যেখানে যাচ্ছ, সেখানে যে তোমাকে আরও নিয়মে থাকতে হবে মা, ছেলেমানুষি করলে অসুখ সারবে কী করে?’
‘অসুখ আমার সারাবে না বাবা। আমি জানি।’ কথাটা বলেই শান্তা আমার দিকে তাকাল। হাসল। আমার বুকের ভিতরটা পাক খাচ্ছে।
‘আমি জানি বাবা, আমি জানি।’ খুব হাল্কাভাবে একটুও না ভেবে কথাগুলোকে উচ্চারণ করল শান্তা। আমি আমার নিজের মুখটা দেখতে পাচ্ছি না। শান্তা দেখছে। ও হাত বাড়িয়ে আমাকে স্পর্শ করল, বাবা, ডাক্তার সেনের কথাগুলো আমি শুনেছি। আমি নিজেও টের পাই যে, আমি বাঁচব না। তোমাকে আমি দিন দিন শুকিয়ে যেতে দেখছি, বুড়ো হয়ে যেতে দেখছি। আমার জন্যে ভেবে ভেবেই তোমার এমনটা হচ্ছে। থাক বাবা, তুমি কষ্ট পাচ্ছ। থাক, আমি এই চুপ করলাম। দাও, আমাকে ওষুধ দাও।’
ওষুধ খেতে মুখটা বিকৃত হয়ে গেল ওর। তারপর চুপ করে রইল। এ-কামরায় আর কেউ নেই। আমি ডাকলাম, ‘শানু, একটু শুয়ে থাকবি?’
ও হাসল, বলল, ‘না’।
‘কার্শিয়াঙে আমাকে রেখে আসতে তোমার কষ্ট হবে বাবা?’
আমি চুপ করে রইলাম। শান্তা হাঁটু দুটো বুকের কাছে জড়ো করে নিয়ে সকৌতুকে আমার দিকে তাকাল। ওর চোখ দুটো হাসছে। থিরথিরে, হাল্কা চপল হাসি। ওর থুতনিটা হাঁটুর ওপর। আমি কথা বলছি না। আমি অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। শান্তা এবার শব্দ করে হাসল, ‘তুমি যে আমাকে এত ভালবাস বাবা, অসুখ হওয়ার আগে কিন্তু বুঝতেই পারতাম না।’
এ-কামরায় আর কেউ নেই, থাকলে ওর কথা শুনে সে নিশ্চয়ই হেসে উঠত। আমি ওর দিকে তাকালাম। ওর সুন্দর ঠোটে একটা কোমল হাসি প্রজাপতির মতো কাঁপছে। আমি মনে মনে বলছি, শানু, তুই ওভাবে হাসিস না। তুই ওভাবে হাসলে আমার ভয় করে। তোর হাসির অর্থ আমি বুঝি। তুই সব জেনে গেছিস। তোর অসুখের খবরটা আর তার শেষ পরিণতিটা তোর কাছে লুকোন নেই। ওরকম হাসি হাসতে তোর কষ্ট হয় না? আমাকে দয়া কর শানু, তুই ঘুমিয়ে পড়। সব কিছু বুঝে কোনও সুখ নেই। সব কিছু বুঝে গেলে শুধু দুঃখ।
‘আমরা এখানে আসবার আগের দিন সুকুমারী শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরল।’ শান্তা আস্তে আস্তে যেন আপনমনেই বলল, ‘কী মোটাসোটা আর ফর্সা হয়েছে সুকুমারী, যেন আর চেনাই যায় না।’
‘সুকুমারী কে?’ আমি প্রশ্ন করলাম।
‘বাঃ রে, কলকাতায় আমাদের পাশের বাড়ির পরেশবাবুর মেয়ে! তুমি সব ভুলে যাও বাবা, সুকুমারী তোমাকে এসে প্রণাম করল না সেদিন।’
‘ওঃ হো, মনে পড়েছে, সেই রানাঘাটে যার বিয়ে হয়েছে, সেই তো?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু তুমি তো ওর ছেলেটাকে দ্যাখোনি। কী মোটাসোটা আর সুন্দর ছেলেটা, এক গা গয়না, ঠিক ডল পুতুলের মতো। ছেলেটা খুব হাসে, শুধু হাসেই, কাঁদতে যেন জানেই না। আমার ইচ্ছে করছিল ছেলেটাকে একটু কোলে নিই, কিন্তু—’
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ‘এখন নিশ্চয়ই তোর খিদে পেয়েছে শানু, একটা আপেল কেটে দিই?’
শান্তা করুণ চোখে আমার দিকে তাকাল। কথা বলল খুব ক্লান্ত, অবসন্ন কণ্ঠে, ‘না, খিদে পায়নি। খিদে আমার পায় না। বোধহয় জ্বরটা বাড়ছে, জিভটা তেতো তেতো। আমাকে একটু মৌরি দাও। থার্মোমিটারটা দিয়ে জ্বরটা দেখবে একটু?’
‘না’, আমি বললাম, না, থাক। জ্বর আসছে না নিশ্চয়ই। অনেকক্ষণ বসে আছিস কিনা। এবার একটু শুয়ে থাক।’
শান্তা হাসল। বেরালের মতো গুটিশুটি হয়ে শুল। গাড়িটা থামল। আবার চলল। গাড়িটা একঘেয়ে। বাইরে নিস্তব্ধ, নির্জন পাহাড়ের ধূসর অনড় শরীর। শীত আর কুয়াশা। ঠাণ্ডা বাড়ছে। গাড়িটা ঘুরে ঘুরে আপনমনে ওপর দিকে উঠছে।
‘বাবা, ছেলেবেলায় আমি খুব পুতুল খেলতে ভালবাসতাম। শান্তা বলছে। যেন স্বপ্নের ঘোরে কথা বলছে ও, তুমি আমাকে কত পুতুল কিনে দিয়েছ যে তার হিসেব নেই। আমার কাঠের বাক্সে পুতুলগুলো সাজানো আছে, কিছু আমি চন্দ্রাকে দিয়ে দিয়েছি। কিন্তু একটা পুতুলের কথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে। তুমি জন্মদিনে আমাকে দিয়েছিলে। পুতুলটা মস্ত বড়, ঠিক সুকুমারীর ছেলেটার মতো বড়। সেই পুতুলটাকে তোমার বোধহয় মনে নেই বাপি?’
‘কোন পুতুলটা? শোবার ঘরের আলমারিতে যে ডল-পুতুলটা আছে, সেইটে?
‘হ্যাঁ, সেইটেই। বড় হয়ে আমি আর পুতুল খেলি না। কিন্তু মাঝে মাঝে খেলতে ইচ্ছে করে। তোমাকে বলতে লজ্জা নেই, সুকুমারীর ছেলেটাকে আমি আদর করতে পারিনি। কিন্তু তার বদলে সেই পুতুলটাকে নিয়ে আমার বিকেলটা কেটেছিল।’
বাঁ দিকের পাহাড় মুছে গিয়েছে। ট্রেনটা এখন অনেক ওপরে। পাহাড়গুলো মাথা নিচু করে আছে। কালো মেঘে আকাশ ঢাকা। ধূসর সমতলটা কী বিষণ্ণ! ট্রেনটার গতি শ্লথ। শান্তা আস্তে আস্তে উঠে বসল। ওর মুখের কাছে জানালাটাকে ঘষা কাচের মতো অস্বচ্ছ মনে হচ্ছে। ওর নিশ্বাস কাচটার ওপর বারবার একটা বাষ্পের বৃত্ত এঁকে দিয়ে মুছে দিচ্ছে। ওর মুখটা অন্ধকার।
আমার মনে পড়ছে খুব ছোটবেলায় যখন সবেমাত্র একটু একটু লিখতে শিখছে শান্তা, তখন ওই পুতুলটার কপালে পেনসিল দিয়ে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লিখে রেখেছিল—‘আমার ছেলে’। সেই লেখাটা এখন আর নেই। বড় হয়ে ও নিজেই সেটা মুছে ফেলেছে। আমার চোখের সামনে পাতলা একটা জলের পর্দা দুলছে। কামরাটাকে আঁকাবাঁকা বন্ধুর মনে হচ্ছে। আমি মনে মনে শান্তাকে যেন বলছি, তোর পুতুলগুলোকে তুই ফেলে এসেছিস, কিন্তু পুতুলখেলাকে ফেলে আসিসনি। শানু, আমরা সবাই অমনিভাবে পুতুল খেলি। তোর পুতুলগুলোকে আমি চিনি। রজতশুভ্র তেমনি পুতুল। তাকে তুই মেরে ফেলেছিল। কলকাতা ছাড়বার পর গাড়িতে তুই গম্ভীর দৃষ্টিতে অ্যালার্ম চেনটাকে দেখছিলি। ওটা টানলেই গাড়িটা থেমে যাবে। রজতশুভ্র নিজেকে অমনিভাবে থামিয়ে দিয়েছিল, অমনিভাবে চেনটার মতো দুলতে দুলতে, তোর আঙুলগুলো বেঁকে যাচ্ছিল, তোর মুখটায় জলরঙের কতকগুলো রেখা খেলা করে গেল। আমি জানি, ওরকমই হয়। রজতশুভ্ররা মরবার জন্যেই জন্মায়। রজতশুভ্র আর সুকুমারী—অনেক তফাত। একজনের জন্য প্রেম, আর একজনের জন্য ঘৃণা। একজনকে সাজিয়ে গুছিয়ে আলমারিতে তুলে রাখিস, আর একজনকে তীব্র ঘৃণায় দূরে ছুড়ে ফেলে দিস। কিন্তু তোর ভাগ্য তাকে কুড়িয়ে এনে তোর সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। আলমারির পুতুলটা বার বার চুরি হয়ে যায়।
ধোঁয়ার মতো কুয়াশা জানালার কাছে পিঠ ঘষছে। আলো আর অন্ধকার আমাদের ঘিরে ঘিরে খেলছে। শান্তা আমার দিকে তাকাল।
‘তুমি কাঁদছ বাবা?’
‘না, না তো। ও এমনিই।’
‘আমি তোমাকে কষ্ট দিলাম বাবা? সবাইকেই আমি কষ্ট দিই।’
‘দুর পাগলি!’
শান্তা নিশ্বাস ফেলল। শব্দটা ছোট্ট একটা পাখির মতো ডানা দিয়ে বাতাস তাড়াতে তাড়াতে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। শান্তা, তোর নিজেকে ঘিরে একটা অদৃশ্য বৃত্ত আছে। সেই বৃত্তের পরিসরে তোর দুঃখটা তোকে ঘিরে ঘিরে পাখির মতো ওড়ে। তুই নিজের দুঃখে কাঁদিস, তুই নিজের সুখে হাসিস। রজতশুভ্র, সুকুমারী, আমি, আমরা সবাই রঙচঙে পুতুলের মতো সেই অদৃশ্য বৃত্তটার বাইরে থেকে তোকে দেখি। আমাদের জন্যে তোর ক্রোধ, ঘৃণা, প্রেম, স্নেহ কিছুই নেই। আমরা পুতুলের মতো মিথ্যে। তোর কান্নাটা, তোর আনন্দটা তোর আপন। আমরা সবাই এই রকম শানু। আমাদের অনুভূতিগুলো সব একরকম, সব অদ্ভুত।
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশের রং ছাইয়ের মতো। সুদীর্ঘ, সরল পাইনের বনে গম্ভীর নির্জনতা। শানু তোর শেষ কথাটা শোনবার জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে আছি। তুই কি কাঁদতে ভুলে গেছিস?
‘কার্শিয়াং আর কতদূর বাবা?’
‘এখনও দেরি আছে। এবার কিন্তু তোর কিছু খাওয়া উচিত শানু।’
‘কী দেবে দাও। ও ডান হাতটা আমার দিকে প্রসারিত করে দিয়ে ছেলেমানুষের মতো একটু হাসল।
কার্শিয়াং এসে গেল প্রায়। আর দুটো বাঁক ঘুরলেই কার্শিয়াং। আমি অপেক্ষা করে আছি শান্তার সেই কথাটা শোনবার জন্য। ও বলবে, বাবা, আমার বাঁচতে ইচ্ছে করছে। রজতশুভ্র আমার ভালবাসাটাকে চুরি করে নিয়ে পালিয়ে গেল! শেষ হয়ে গেল! সুকুমারীকে আমি ঘৃণা করি সেই কারণেই। অথচ ওর কী দোষ! রজতশুভ্র মরে গেল, আমি রইলাম। সুকুমারীও বেঁচে রইল, অথচ ওর কিছুই হারাল না। ওর ছেলেটা মোটাসোটা, সুন্দর—ওর মুখের মতো সুন্দর, ওর ভবিষ্যতের মতো সুন্দর। সুকুমারীর সবটুকু দেখবার জন্য আমার বাঁচতে ইচ্ছে করছে। এই তীব্র ইচ্ছাশক্তি আমাকে বাঁচিয়ে তুলবে।
‘শানু, কী দেখছিস?’
‘যা চোখে পড়ছে তাই। বাবা, আমি সবকিছুকে দেখতে চাই।’
আমি হাসলাম। তারপর চুপি চুপি হাসিটাকে গিলে ফেললাম। আমি অপেক্ষা করে থাকব। কিন্তু শান্তা সেই কথাটা বলবে না। আমি জানি, ও বলবে না। এ-সব কথা বলতে নেই। কিন্তু আমি তবু অপেক্ষা করে থাকব।
শানু, তোকে একটা গল্প বলতে ইচ্ছে করছে। জানালার ঠাণ্ডা কাচে গালটা চেপে তুই বাইরের দিকে তাকিয়ে আছিস। তোর চোখে গাম্ভীর্যের গভীরতা। গল্পটা তুই শুনবি না। আমার ইচ্ছে করছে, তবু আমি কোনও দিন তোকে গল্পটা বলব না। শুধু মনে মনে ভাবব, রানু, তুই বড় হয়ে গেছিস। মস্ত বড়। একপাল ছেলেমেয়ে ঘরভর্তি। সংসারটা উপচে পড়ছে সম্পদের আধিক্যে।
শানু, কার্শিয়াং আর কয়েক মিনিটের পথ। তোর মুখের পাশে জানালার কাছে তোর নিশ্বাস বার বার একটা বাষ্পের বৃত্ত এঁকে দিয়ে মুছে দিচ্ছে। তোর মুখটা অন্ধকার। করুণ, গভীর অন্ধকার।
১০ মে ১৯৫১