1 of 2

আমার মায়ের গল্প

আমার মায়ের গল্প

১.

চোখ হলুদ হচ্ছিল মা’র,
শেষে এমন, যেন আস্ত দুটো ডিমের কুসুম!
পেট এমন তেড়ে ফুলছিল, যেন জেঁকে বসা বিশাল পাথর
নাকি এক পুকুর জল–বুঝি ফেটে বেরোবে!
মা দাঁড়াতে পারছেন না,
না বসতে,
না নাড়তে হাতের আঙুল,
না কিছু।
মা’কে মা বলে চেনা যাচ্ছিল না, শেষে এমন।
আত্মীয়রা সকাল সন্ধে শুনিয়ে যাচ্ছে
ভাল একটি শুক্রবার দেখে যেন তৈরি হন মা…
যেন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলতে বলতে
যেন মুনকার নকি সওয়াল জবাবের জন্য এলে বিমুখ না হয়
যেন পাক পবিত্র থাকে ঘর দুয়োর, হাতের কাছে থাকে সুরমা আর আতর।

হামুখো অসুখ মা’র শরীরে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে সেদিন,
গিলে ফেলছে দুফোঁটা যে শক্তি ছিল শেষের, সেটুকুও।
কোটর থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে চোখ,
চরচর করছে জিভ শুকিয়ে,
ফুসফুসে বাতাস কমে আসছে মা’র,
শ্বাস নেবার জন্য কী অসম্ভব কাতরাচ্ছেন–
যন্ত্রণায় কুঁচকে আছে কপাল, কালো ভুরু
গোটা বাড়ি তখন চেঁচিয়ে মা’কে বলছে তাদের সালাম পৌঁছে দিতে নবীজিকে,
কারও কোনও সংশয় নেই যে মা জান্নাতুল ফিরদাউসে যাচ্ছেন,
নবীজির হাত ধরে বিকেলে বাগানে হাঁটবেন,
পাখির মাংস আর আঙুরের রস খাবেন দুজন বসে,
অমনই তো স্বপ্ন ছিল, মা’র অমনই স্বপ্ন ছিল।
আশ্চর্য, মা তবু কোথাও এক পা যেতে চাইছিলেন না।
চাইছিলেন বিরুই চালের ভাত বেঁধে খাওয়াতে আমাকে,
টাকি মাছের ভর্তা আর ইলিশ ভাজা। নতুন ওঠা জাম-আলুর ঝোল।
একখানা কচি ডাব পেড়ে দিতে চাইছিলেন দক্ষিণের গাছ থেকে,
চাইছিলেন হাতপাখায় বাতাস করতে চুল সরিয়ে দিতে দিতে–কপালের কটি এলো চুল।
নতুন চাদর বিছিয়ে দিতে চাইছিলেন বিছানায়,
আর জামা বানিয়ে দিতে, ফুল তোলা…

চাইছিলেন উঠোনে খালি পায়ে হাঁটতে,
হেলে পড়া কামরাঙা গাছটির গায়ে বাঁশের কঞ্চির ঠেস দিতে
 চাইছিলেন হাসনুহেনার বাগানে বসে গান গাইতে গো মায়াভরা চাঁদ আর
মায়াবিনী রাত, আসেনি তো বুঝি আর জীবনে আমার।…

বিষম বাঁচতে চেয়েছিলেন মা।

.

২.

আমি জানি পরকাল, পুলসেরাত বলে কিছু নেই।
আমি জানি ওসব ধর্মবাদিদের টোপ
ওসব বেহেসত, পাখির মাংস, মদ আর গোলাপি মেয়েমানুষ!

আমি জানি জান্নাতুল ফিরদাউস নামের কোনও বেহেসতে
যাবেন না, কারও সঙ্গে বাগানে হাঁটবেন না মা!
কবর খুঁড়ে মা’র মাংস খেয়ে যাবে পাড়ার শেয়াল
শাদা হাঁড়গুলো বিচ্ছিরিরকম ছড়িয়ে–
গোরখাদক একদিন তাও তুলে ফেলে দেবে কোথাও,
জন্মের মত মা নিশ্চিহ্ন হবেন।

তবু আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে
সাত আসমানের ওপরে অথবা কোথাও
বেহেসত বলে কিছু আছে,
জান্নাতুল ফিরদাউস বলে কিছু,
চমৎকার কিছু,
চোখ ঝলসানো কিছু।
মা তরতর করে পুলসেরাত পার হয়ে গেছেন
পলক ফেলা যায় না দেখলে এমন সুদর্শন, নবীজি,
বেহেসতের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে মা’কে আলিঙ্গণ করছেন;
মাখনের মত মা মিশে যাচ্ছেন নবীজির লোমশ বুকে।
ঝরণার পানিতে মা’র স্নান করতে ইচ্ছে হচ্ছে
মা’র দৌড়োতে ইচ্ছে ইচ্ছে
বেহেসতের এ মাথা থেকে ও মাথা–
মা স্নান করছেন,
দৌড়োচ্ছেন, লাফাচ্ছেন।
রেকাবি ভরে পাখির মাংস এসে গেছে, মা খাচ্ছেন।
মা’কে দেখতে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা পায়ে হেঁটে
বাগান অবদি এসেছেন।
মা’র খোঁপায় খুঁজে দিচ্ছেন লাল একটি ফুল,
মা’কে চুমু খাচ্ছেন।
আদরে আহ্লাদে মা নাচছেন, গাইছেন।

মা ঘুমোতে গেছেন পালকের বিছানায়,
সাতশ হুমা’কে বাতাস করছে,
রূপোর গেলাশ ভরে মা’র জন্য পানি আনছে গেলবান।
মা হাসছেন, মা’র সারা শরীর হাসছে
আনন্দে।
পৃথিবীতে এক দুঃসহ জীবন ছিল মা’র, মা’র মনে নেই।

এত ঘোর নাস্তিক আমি,
আমার বিশ্বাস করতে ভাল লাগছে বেহেসত বলে কিছু আছে কোথাও।

1 Comment
Collapse Comments

Khub chomotker akta kobita, Khub valo laglo.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *