আমার ভ্যালেন্টাইন
ভ্যালেন্টাইনের দিন আমার কাছে বড়ই দুঃখের দিন, বেদনার দিন। এই দিনটা এলেই আমার শক্তি চাটুজ্জের কথা মনে পড়ে যায়, সে বড়ো সুখের সময় নয়, সে বড়ো আনন্দের সময় নয়। আক্ষরিক অর্থেই আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে। গায়ে কম্প দিয়ে জ্বর আসে, পেটের মধ্যে প্রজাপতির ওড়াউড়ি।
মোটমাট দিনটাকে আমি পারতপক্ষে এড়িয়ে চলতে চাই।
কী জিজ্ঞেস করছেন? ভ্যালেন্টাইন দিবস নিয়ে আমার পুরোন বেদনাটা কী?
সত্যি শুনবেন? আচ্ছা শুনুন তবে।
সভ্যতার ঊষাকালে আমার একটি গার্লফ্রেন্ড ছিল। উঁহু, এতেই এত ফিক ফিক করে হাসার কিচ্ছুটি হয় নি। আপনাদেরপুরো ষোল আনা ইয়ে থাকতে পারে, আর আমার নয়া পয়সা টাইপের একটা গার্লফ্রেণ্ড থাকলেই দোষ?
তিনি ছিলেন এইটে জেনে রাখুন ব্যস।কবে কোথায়, কীভাবে এসব বেত্তান্ত জেনে কাজ নেই। তিনি আপাতত সোয়ামী নে”, চুন্নুমুন্নু নে” সুখে শান্তিতে ঘরকন্না করতিছেন, তাতে আপনাদের এত নজর
ক্যান বাপু? এসব আমি মোটেও জানাব না, পাব্লিক ঠিক ল্যাটিচিউড লঙ্গিচিউড ধরে পৌঁছে যাবে।
যাই হোক। আমার এককালে একটি উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের একটি বান্ধবী ছিলেন। পরমাশ্চর্যের বিষয় এই যে তাঁকে আমি জোটাইনি। তিনিই আমাক জুটিয়েছিলেন। মানে সচরাচর যা হয়ে থাকে, ছেলেরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রীতিমতো সাধ্য সাধনা করে রমণীরত্ন লাভ করে থাকে।আমার ক্ষেত্রে ঠিক তেমনটি ঘটে নাই। আমি যাকে বলে কোনদিনই ত্যামন বলিয়ে কইয়ে স্মার্ট ছিলাম না ( পাশ থেকে গিন্নি বলছেন এখনওনই, হবেও বা!) ফলে আমি সেই বন্ধুদের টপাটপ প্রেমে পড়া, স্কুল কেটে সিনেমা দেখতে যাওয়া এসবদেখে, ঈর্ষায় সবুজ হয়ে দিন কাটাচ্ছি, এমন এক বসন্তদিনে তিনি ‘শুনলাম ফাঁকা আছ, আমার সদ্য থার্ড ব্রেকআপ হয়েছে, আপাতত ফ্রি আছি। ইন্টারেস্টেড?’ বলে কোলের পাশে জমাটি করে বসলেন।
এই করে আমার প্রথম প্রেমের যাত্রাশুরু।
এখানে বলে রাখা ভালো, মহিলা মানুষ হিসেবে অতি চমৎকার ছিলেন।অত্যন্ত মারকুটে হওয়া ছাড়া আর কোনও দোষ ছিল না। শুধু ইংলিশ মিডিয়ামের ধারালো স্টুডেন্ট বলে কেবলই ঝাঁইঝাকানাকা ইংরেজি গানা শুনতেন।আর মাঝেমধ্যে আমি প্রেমেন মিত্তির কি সুধীন দত্ত আওড়ালে সামান্য বেজার হতেন এই যা। তবে তেনার দৌলতেই প্রথম বব ডিলান শুনি। তিনিই আমাকে প্রথম শোনান বীটলস। আর শুনি ব্যাকস্ট্রীট বয়েজ, এম এল টি আর, বয়জোন, এবং স্করপিয়ন।
যাগগে যাক, সেই সুনয়নী তন্বীটির নাম ছিল, সোমা। আগে পরেও কিছু ছিল বটে। তবে বুইতেই পারছেন যে, সেসব আমি সেন্সরের কাঁচির ওইপারে ফেলে এয়েচি।
যাই হোক, শ্রীময়ী সোমার সঙ্গে আমার একমাত্র অমিল ছিল একটা জায়াগাতেই। তিনি ছিলেন উচ্চতায় চার ফুট এগারো ইঞ্চি, ওজনে চল্লিশ কিলো খানেক, আর আমি? নিজের মুখেআর কি বলি, মানে শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে আমি তখনই আশি তে এসে গেছি আর কি, আর উচ্চতাখান তো দেখেছই। জোরে হাওয়া দিলে তিনি বেশ করে আমাকে অঁকড়ে ধরতেন।না না, প্রেমের আবেশে নয়, স্রেফ ভয়ে! উড়ে যাবার ভয়ে! সেই থেকেই ‘ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস’ বা ‘পাগল হাওয়া’ কিংবা’ আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম’ গোছের যাবতীয় ঝঞ্ঝাসঙ্গীত আমার ভারী প্রিয়।
যাই হোক, সেবার আমাদের মোটামুটিরকম প্রেমের বেশ বয়েস হয়েছে, এই ধরুন মাস্ট আটেক এমন সময় এলো সেই কালান্তক ভ্যালেন্টাইন ডে।
তা সক্কাল থেকে মাঞ্জা টাঞ্জা দিয়ে বেরিয়েছি, লতুন জিন্স, লতুন পাঞ্জাবি। বন্ধুর কাছ থেকে পারফিউমের বোতল চেয়ে প্রায় আদ্দেকটা গায়ে ঢেলেছি। সে ছোকরার আবার সদ্য ব্রেকআপ হয়েছে। ফেব্রুয়ারির এমন মন উচাটন বসন্তদিনে সকাল থেক টেপ রেকর্ডারে লুপে ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে’ শুনছে।আমার সাজ পোষাক দেখে মোষের মতন ফোঁৎ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গাঢ় গলায় বললো ‘মনে রাখিস ভাই, ভালোবাসা মানেই কিন্তু প্রবঞ্চনা। কবি বলেছেন মানুষের ওপর বিশ্বাস মারানো চাপ।’
আমি অবশ্য এসব পাত্তা দিইনি। দেওয়ার কথাও নয়। দাড়ি কেটে গাল দুটো বেশ চকচকে। মোকাসিনটাকে আগের দিনই মুচিকে দিয়ে বেশ পালিশ করে এনেছি।শ্যাম্পু করে চুলটায় বেশ একটা উদাস কবি মার্কা জেল্লা এসেছে।
এসব পরেটরে সোজা পার্কস্ট্রীট। না, কিছু কেনার ছিলো না, কিন্তু তিনি সেখানেই দাঁড়াতে বলেছিলেন। তা পাক্কা একঘণ্টা বাদে তিনি উদয় হলেন, লাল কালোতে মেশানো একটা মারকাটারি অফ শোল্ডার ড্রেস (গুরু মুজতবা আলির ভাষায় দেরেশি) পরে। আহা, সমস্ত পার্কস্ট্রীট যেন ক্যায়াবাত ক্যায়াবাত করে উঠলো। তিনি এলেন, এসেই আমার পোশাক দেখে মন্তব্য করলেন ‘মোস্ট অর্ডিনারি গাঁইয়া ড্রেস’, তারপর হাতে হাত রেখে, চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘চলো’।
আমিও গলাটা প্রেমে আবেগে ভালোবাসায় গাঢ় করে বল্লুম’ কোথায়?’
‘হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের কাছে’।
বুঝতেই পারছেন মনের কি অবস্থা। গাঁইয়া ড্রেস বুইলুম, তাতে শপিং মল এ চল লো সখী, নতুন দেরেশি কিনবো না হয়। ডাক্তার ক্যানে?
প্রকাশ পেলো তেনার হাতে কিছু স্কিন প্রব্লেম দেখা দিয়েছে কদিন থেকে, ডাক্তারি পরিভাষায় ইহাকে বলে সোরিওসিস। অ্যালোপ্যাথিতে নাকি ইহার ট্রিটমেন্ট ঠিকঠাক হয় না।অতয়েব তেনার কালেজের জনৈকা আগরওয়ালা পদবীধারী বান্ধবীর দিদি, যিনি নাকি হুমোপ্যাথিতে সাক্ষাৎ চরক কি সুশ্রুত, তেনাকে দেখাতেই ম্যাডাম এখানে এসেছেন। পার্ক স্ট্রীটের আশেপাশের কোন একটা গলিতে সেই অশ্বিনীকুমারীর নন্দনকাননটি!
যাই হোক, সেই বান্ধবীর দিদির সকাশে তো দেখা হলোই। ‘মাই গুডনেস সোমা, ইউ আর লুকিং সো মাচ প্রিটিইই’ বলে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ভব্য আদানপ্রদানের পর আমাদের বসতে বলা হলো। তিনি তাঁর বরতনুটি গুছিয়ে স্থাপন করলেন, আমি আমার বপুটি থপ করে রাখলাম।আমার পরিচয় করানো হলো ‘স্পেশাল ফ্রেন্ড, ইউ নো, হি হি হি হি’ বলে। যাগগে যাক।
তা হুমোপ্যাথির সওয়াল জবাব বড় কড়া শুনেছি আদ্ধেক হুমোপ্যাথ ডাক্তারবাবু একটা বয়সের পর আদালতে পেশাদার সাক্ষীদের ট্রেইন করার ফ্রিল্যান্সিং করেন। প্রথম প্রশ্নেই মালুম হলো, ‘দিদিমার ছোট দেওরের কি অর্শ ছিলো?’
বিস্মিত হওয়ার অবকাশ পাইনি মাইরি, পরের প্রশ্ন, ‘স্ট্রেসে থাকলে স্ট্রেস রিলিভ করার জন্য কী করো?’
সোমাদেবী সলজ্জ মুখে জানালেন ‘আই শাউট অ্যাট হিম’। হিমটি যে হিমায়িত আমি, সেটা বলার জন্যে কোনও পুরষ্কার নেই।
‘কি খেতে বেশি ভালো লাগে, টক, ঝাল না মিষ্টি’।
এইবারে আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেল্লুম, ‘এসব তো পোয়াতী মেয়েদের জিজ্ঞেস করে!’
কলি, ঘোর কলি, নইলে সেইদিনই সেই যুগপৎ অগ্নিদৃষ্টির সামনে আমি স্রেফ মিহি ছাই হয়ে পড়ে থাকতাম, বডির একটা পার্টসও খুঁজে অবধি পাওয়া যেত না। শুধু একবার দাঁতে দাঁত ঘষার মধ্যে শুনলাম, ‘পোয়াতী? অবনক্সাস!’
আমি মাইরি নিজেকে চেয়ারের হ্যাণ্ডেলের মধ্যে ঝুলিয়ে রাখা বাজারের ব্যাগের মতন নেতিয়ে রইলুম। সামান্য রাগ হচ্ছিল যদিও।
যাই হোক, বাবার ওজন, মায়ের জুতোর সাইজ, বাড়ির দারোয়ানের কান কটকট করে কি না, পাশের বাড়ির বিড়াল রাত্তির বেলা খাম্বাজ রাগে কাঁদে নাকি বিলাওলে, আমার রাতে ঘুম কিরকম হয়, নাক ডাকে কি না, ইত্যাদির পর ডাক্তারম্যাডাম ফোঁস জিজ্ঞেস করলেন ‘হোয়াট ইজ ইওর সোর্স অফ স্ট্রেস?’
তিনি মৃদু হেসে আমাকে দেখিয়ে বললেন ‘ইতনা বড়া সাইজ কা সোর্স অফ স্ট্রেস নেহি দিখ রহি হ্যায় দিদি, খি খি খি’।
ট্যাং করে মাথায় কোথায় কে একটা ঘন্টি মারলো। বলি হ্যাঁ লা মেয়ে, সবসময়ই তোর মন যুগিয়ে চলি, পান থেকে চুন কেন, জলের ফেঁটাটা অবধি খসতে দিই না, আজ অব্ধি একটা কড়া কথা অবধি বলেছি বলে মনে পড়ে না, তোর সঙ্গে কথা বলার চক্করে আমার যৎসামান্য হাতখরচের টাকায় পাড়ার ফোনবুথ মালিকের দোতলা উঠলো বলে, আর আমিই তোর যাবতীয় স্ট্রেসের সোর্স? বটে?
মধুমাখা স্বরে জিজ্ঞেস করলাম ‘যখন প্রবলেম স্কিনকা হ্যায়, তখন স্ট্রেস লেভেল টাইপকা অপ্রয়োজনীয় চিজ নিয়ে ইতনা জিজ্ঞাসাবাদ কিঁউ?’
ডাক্তার ম্যাডাম উদাস স্বরে বললেন, ‘ক্যায়া করে, সোরিওসিস ইজ আ সাইকোসোমাটিক ডিজঅর্ডার…’
আমি চওড়া হেসে বল্লুম ‘সে তো হোগাই। এমনিতেই এর নামই সোমা, তার ওপর সাইকো। সাইকোসোমাটিক ডিজঅর্ডার তো হোনেকা কথাই থা।’
তারপর কী হল সেসব জিজ্ঞেস করে আর কাজ নেই। তবে ভালোবাসার ব্যাপারে এতটা কড়া জবাব দেওয়াটা হয়তো উচিত হয়নি বলে এখন মনে হয়।
ভালোবাসার পবিত্রতার ওপর আমার সামান্য হলেও যেটকু বিশ্বাস ছিল তাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে এই বছরের ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র হাড়কাঁপানো অভিজ্ঞতাটা। তাহলে মন দিয়ে শুনুন কী ঘটেছিল সেদিন।
সেদিন দুপুর বেলা আপিসে বসে কাজ করছি, মানে মার্চে টার্গেট নামের যে বাঁশটা এরিয়া ম্যানেজারদের প্রীতি উপহারস্বরূপ দেবো, তার লেংথ আর ডায়ামিটার নিয়ে খুবই চিন্তিত, এমন সময় মোবাইলে দেখি অচেনা নাম্বার থেকে ফোন।
ফোনটা তুলে হ্যালো বলতেই, ওপার থেকে সুরেলা গলায় ভেসে এলো, ‘কি ভাই চিনতে পারছো? আমি অমুকদি বলছি।’
পারলাম, মানে পারতেই হলো। পঞ্চাশোর্ধ এই ভদ্রমহিলাকে ফেসবুক সূত্রে চিনি ও দিদি বলে ডাকি। সোল্লাসে বললুম, ‘হ্যাঁ দিদি বলো, কি খবর?’
তা চাট্টি আগড়ুম বাগড়ুম বকে, প্রভূত নিন্দেমন্দ করে বেশ চনমনে হয়ে উঠেছি, এমন সময় তিনি বললেন, ‘এই শোন না, তোর কোন বন্ধুর নাকি একটা অনলাইন সাইট আছে? বললে তোরা ভ্যা লেন্টাইন ডে”এ গোলাপ ফুল পাঠিয়ে দিতে পারবি না??’
একটু সন্দেহ হলো, বুইলেন, ‘কাকে পাঠাবে শুনি?’
‘আমার বরকে।’
আপনারা তো জানেন আমি কেমন নরম মনের মানুষ। এই বয়সেও বুড়োবুড়ির ভালোবাসা দেখে মাইরি স্বভাবতই চোখে জল। আহা, একি অপূর্ব প্রেম দিলে বিধাতা এদের! এই বয়সেও গিন্নি নিজে হাতে তাঁর বরকে ভ্যালেন্টাইন ডে তে গোলাপ ফুল উপহার দিচ্ছেন। জয় হোক এই ভালোবাসার, আহা দুজনে যেন শেষ জীবন অবধি এইভাবেই… রুমাল বার করে চোখ মুছতে মুছতে ধরা গলায় জানালাম, ‘পাঠিয়ে দেবো দিদি’।
‘শোন না, একটু পারফিউম ছিটিয়ে দিতে পারবি ভাই?’
কি বলবো দাদা, শুনে আমারই বুকের মধ্যে কেমন কেমন করতে লাগলো, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো, মনের মধ্যে বসন্ত বাহার গেয়ে উঠলো কেউ…
কোনও মতে কান্না চেপে বললাম, ‘হ্যাঁ দিদি পারবো’।
‘আর পারলে একটা দামি দেখে ‘You are my Love’ মার্কা একটা দামি গ্রিটিংস কার্ড দিয়ে দিস তো।’
ওরে কে কোথায় আছিস, দৌড়ে আয়, আমাকে ধর। কে বলে ভালোবাসা কেবলই যাতনাময়? ওরে আছে, এখনও প্রেম বেঁচে আছে পৃথিবীতে…গাছে গাছে পাখি, মুখে মুখে হাসি, বাগানে কত ফুল, বাজারে কত ইলিশ…
‘আর শোন, লিখবি, ‘ফ্রম ইওর লাভ, নয়নিকা’!’
নয়নিকা? এইবারে সামান্য চমকাতে হলো, ‘নয়নিকাটা আবার কে?’
‘কে আবার, এই ডাইনিটাই তো দাদার মাথা খেয়ে ফেলছিলো আরেকটু হলে।’
আবার সব গুলিয়ে গেলো। ভদ্রলোককে খুবই ভালো করে চিনি। অমন নিরীহ নির্বিরোধী সজ্জন মানুষ আর হয় না! তিনি….আর যদি তাই হয়…আগুনে আবার ঘি ঢেলে.
‘কবে?’ নিজের গলা শুনে নিজেই ভাবিত হয়ে পড়ি, এ কি আমারই গলা?
‘আর বলিস না, সেই ক্লাস এইটে টিউশন পড়ার সময়। তোর দাদা ভালোমানুষ বলে প্রায় মাথাটা চিবিয়ে খেয়েই ফেলেছিলো ডাইনিটা’, ফেঁসফেঁস শব্দটা স্পষ্ট ফোনের এপারেও শোনা যায়।
এইবারে কেসটা পুরোটা ঘেঁটে যায় আমার। কেন, মানে এতদিন বাদে কিসের কে কি কোথায় কেন কিভাবে?
‘তারপর?’ সন্তর্পণে জিজ্ঞেস করি।
‘তারপর আবার কি। দুই বছর ফষ্টিনষ্টি করার পর ভালোমানুষটা বিগড়ে যাচ্ছে দেখে নেহাত বাধ্য হয়েই আমাকে খামচা মেরে লোকটাকে ছিনিয়ে আনতে হলো। আমার আর কি বল নেহাত চোখের সামনে একটা ভালো লোক উচ্ছন্নে যাচ্ছিলো বলেই তো…নইলে ওকে বিয়ে করতে আমার বয়েই গেছিল।’
‘তা খামচা মেরে লোকটাকে নিজের চামচা করেছো তা বেশ,’ আমার কনফিউশন শেষ হতেই চায় না, ‘তা এখন আবার তার নাম নিয়ে লোকটাকে গোলাপফুল আর গ্রিটিংস কার্ড পাঠানোর মানে কি? তাও আবার সেন্ট মেরে?’
‘আহা, দেখতে চাইছি, লোকটা এখনও শয়তানি মুটকিটাকে মনে রেখেছে কি না, বুঝলি গাধা?’
মনে হলো আমি একটা পাঁচনম্বরী ফুটবল, বাইচুং এক শটে মোহনবাগানের জাল ছিঁড়ে দিয়েছে, সেখান থেকে ফের লাথাতে লাথাতে আমাকে কে যেন সেন্টারে নিয়ে যাচ্ছে…
‘কিন্তু..কি দরকার কি ওসবের? এমন চমৎকার লোক বিল্টুদা, কারও সাতে নেই পাঁচে নেই, মুড়ি দিয়ে স্কচ খায়, তার সঙ্গে এসব করার মানেটা কি? কোনও বেচাল দেখেছো ইদানীং? ‘
‘আহা তা নয়। অফিস, মোহনবাগান, আর বার্সেলোনার বাইরে বোঝে কি ঘটিটা যে ফুলুকফালুক করবে? তিন চামচ চিনি ছাড়া চা খেতে পারে না, এখনও লুচিকে নুচি বলে, ”পেছনে” বলতে পারে না, বলে ”পেচুনে”, এমন লোককে কে প্রেম করবে রে? আর করতে এলেও কি, আঁশবঁটি নিয়ে গলা নামিয়ে দেবো না?’
বাঙাল মেয়ে কি পারে আর কি পারে না সে নিয়ে আমার প্রথম যৌবনের যথেষ্ট ভীতিকর অভিজ্ঞতা আছে, সভয়ে বলি ‘ইয়ে তাহলে এসবের দরকারটাই বা কি? মানে লোকটা যখন চাইলেও পাচ্ছে না, মানে ইয়ে, গলা না হলে আর চুমু খাবে কোথায় বলো?’ আমি মিষ্টি করে যুক্তির অবতারণা করি।
‘চুপ কর ছোঁড়া, পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করতে নেই। মাঝে মাঝে টোপ ফেলে দেখতে হয়, ঠোকরায় কিনা। একবার ঠুকরে দেখুক দেখি, আমিও রামতারণ মুখুজ্জের মেয়ে। আঁশ ছাড়িয়ে ছাদে টাঙিয়ে রেখে দেবো না?’
বুঝলাম, মা এবারে গোষ্ঠমামা অবতারে অবতীর্ণ হয়েছেন। বিল্টুদার জন্যে মায়াই হতে থাকে। ক্ষীণ গলায় বলি, ‘আচ্ছা ১৩৫ টাকা দিয়ে দিও, পেটিএম করে দিলেই হবে বুঝলে? গ্রিটিংস কার্ডের উপর পারফিউম ছড়িয়ে দেব, ওটা আমার পক্ষ থেকে কমপ্লিমেন্টারি’।
‘একশো পঁয়ত্রিশ না, দুশো সত্তর পাঠাচ্ছি, পেটিএম নাম্বারটা বল চট করে’
‘দুশো সত্তর কেন? এই তো বললাম কম্পলিমে…’
‘আহ, বড্ড বকিস তুই। দুটো কার্ড পাঠাবি, বুঝলি? একটা যেমন বললাম তেমন, আরেকটা শিলিগুড়ি যাবে’।
‘শিলিগুড়িতে কার কাছে?’ আমার বিস্ময় আর বাধ মানতে চায় না।
‘প্রিয়তোষের কাছে। আশ্রমপাড়া রোড। ঝটপট লিখে নে…’
‘প্রি..প্রিয়তোষ আবার কে?’ একটা সারিডনই খাই না কি? নাকি একটা বিয়ারের খালি বোতল নিজের মাথায় মেরে দেখবো সব ঠিকঠাক শুনছি আর বুঝছি কি না!
এইবার ফোনের ওদিক থেকে সলজ্জ হাসি ভেসে এলো, ‘আহা, ইয়ে মানে প্রিয়তোষ, বুঝলি কি না, ওই ক্লাস এইটেই, বুঝলি তো…’
আমার হাত থেকে মোবাইলটা ঠকাস করে নীচে পড়ে যায়.
এর পরেও যদি আপনি ভ্যালেন্টাইন্স ডে নিয়ে আমার সামনে আদিখ্যেতা করতে এসেছেন, তাহলে থান ইঁট ছুঁড়ে মারবো, এই বলে রাখলুম, হ্যাঁ!