আমার ভূত
আমার ছেলেকে আমি সাহেব বানাবো।
রঙে নয়। শিক্ষায়, দীক্ষায়, মেজাজে, সহবতে? আমি কালো? আমার ছেলে ঝুল কালো। যখন হাসে, মনে হয় ভাল্লুকে শাঁকালু খাচ্ছে। বাপ হয়ে ছেলের সমালোচনা করা উচিত নয়। বউ ফর্সা, ছেলেটা কেমন যেন আবলুস কাঠের মতো হল? অভিজ্ঞরা বলেন, ভেব না, মেয়ে তোমার মেম হবে। ছেলেরা বাপের দিকে যায়, মেয়েরা মায়ের দিকে। কৃষ্ণ কালো, কোকিল, কালো, কালো চোখের মণি! কালো জগৎ আলো।
সাহেব পাড়ার ইস্কুলে ব্যাটাকে ভর্তি করতে হবে।
পয়সা যখন আছে কেন করব না। কিন্তু পয়সায় তো আর নামকরা স্কুলের দরজা খুলবে না। সে অনেক হ্যাপা। শুনেছি, শিশু যখন মাতৃজঠরে ভ্রূণের আকারে গর্ভসলিলে হেঁট মুন্ডু উর্ধ্ব পুচ্ছ তখনই নাকি ভালো স্কুলের ওয়েটিং লিস্টে নাম লেখাতে হয়। স্ত্রীর কানের কাছে চিৎকার করে ইংরেজি বই পড়তে হয়। পুরোনো দিনের লেখকের লেখা চলবে না। হাল আমলের লেখক চাই। আমেরিকান লেখক হলে ভালো হয়। গোর ভাইডাল, সল বেলো স্টেইনবেক। স্ত্রী ডাকলে হ্যাঁ বলা চলে না। বলতে হবে ইয়েস! এমন কিছু বই পড়ে শোনাতে হবে যাতে ইয়াঙ্কি স্ল্যাw আছে। হ্যারলড রবিনস, হেডলি চেজ। এ সব করার উদ্দেশ্য, ভ্রূণের চারপাশে একটা ইংলিশ মিডিয়াম তৈরি করা। মানে বনেদটাকে বেশ শক্ত করে গেঁথে তোলা।
আমার শ্যালিকা এসব ব্যাপারে ভারি এক্সপার্ট। আমার বউয়ের মতো গাঁইয়া নয়। বহুকাল আগেই চুলে তেল মাখা ছেড়েছে। শ্যাম্পু করে করে চুলের চেহারা করেছে কী সুন্দর। ম্যারিলিন মনরোর মত। ফুরফুর করে হাওয়ায় উড়ছে। ঠোঁটে চকোলেট কালারের লিপস্টিক, তার ওপর লিপগ্লস। আজ পর্যন্ত, আমি একবারও ফ্যাক ফ্যাকে ঠোঁট দেখিনি। অলওয়েজ স্মার্ট। চোখে ব্ল্যাক প্যানথারের চোখের মতো বিশাল এক গগলস। সেক্সকে সোচ্চার করে রেখেছে। শাড়ি পরার অসাধারণ কায়দা কোথা থেকে সে রপ্ত করেছে! যেমন কোমর তেমনি তার কায়দার প্রদর্শনী। চীনে খাবার ছাড়া খায় না! মাঝেমধ্যে ফ্রাই খায়। স্যুপ দেখলে আমার বউয়ের মতো মেগগে করে ওঠে না। শুনেছি মাঝেমধ্যে একটা দুটো বিড়ি ফোঁকাও করে থাকে। নাইটি পরে শুতে যায়।
সেই মায়ের ছেলে পেট থেকে ড্যাডি ড্যাডি করে পড়বে, তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে! শ্যালিকা বলে, সাজ, পোশাক, আহার বিহারের ওপর মানুষের অনেক কিছু নির্ভর করে। বিকিনি পরলে বাঙালি মেয়েও, কিস মি কিস মি ডার্লিং বলে সি-বিচে ছুটতে থাকবে। শাড়ি পরলে, বলদ, গোয়াল, সাঁজালে, সিঁথির সিঁদুর, সন্ধ্যের শাঁখ, এই সবই মনে আসবে। মনে আসবে ঘুঁটে, গোবর, গুল, গঙ্গাজল। দোজ ডেজ আর গন পাঁচু!
এখন বাইকের পেছনে বয় ফ্রেন্ডের কোমর জড়িয়ে ধরে অফিসে যাবার যুগ পড়েছে। জীবনের পেছনে লেখা থাকে—কষষয বনক্ষন। সাঁঝের বেলায় আর সাঁঝালো নয় পার্ক স্ট্রীটের আলো-আঁধারী, ঝকাঝকম, ঝকাঝম বারে বসে লাল ঠোঁটে, লাল পানীয়ের গেলাস।
আমার ছেলের মা সারাজীবন কী করে এল? ছাপা শাড়ি পরে এতখানি একটা খোঁপা করে শ্বশুর, শ্বাশুড়ির সেবা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হেঁসেল ঠেলা। পেটে পুঁই শাক, লাউয়ের ডাল, ছ্যাঁচড়া, খোসা চচ্চড়ি। সেই মায়ের ছেলে ব্যাবা, ব্যাবা করবে না তো, কী করবে?
বউয়ের তো অনেক ধরন আছে। কেউ বউমা, মানে যার মধ্যে মা মা ভাবটা বেশ প্রবল। কেউ বধূ। যার মধ্যে কন্যাভাব প্রবল। কেউ শুধুই বউ, সাদামাটা, ঘরোয়া একটা ব্যাপার। কেউ ওয়াইফ। স্লিভলেস ব্লাউজ, অর্গান্ডির শাড়ি, সে এক আলাদা ব্যাপার। কেউ আবার মিসেস। একটু রঙ চটা। দেহে তেমন বিন্যাস নেই একটু এলোমেলো। বেঁচে থাকার ধরনটা গেলেও হয়, থাকলেও হয়। সংসার চলছে চলুক।
কথায় আছে, স্বভাব না যায় মলে, ইজ্জত না যায় ধুলে। ইজ্জত বলে না ইল্লত বলে কে জানে। একই মায়ের দুই মেয়ে। আমারটি এক রকম, শ্যালিকাটি আর এক রকম। ওই জন্যেই মানুষের উচিত শ্যালিকাকে বউ করে বউকে শ্যালিকা করা। সে তো আর হবার উপায় নেই, ভেতরে ভেতরে ফোঁস ফোঁস করে জীবন কাটাই।
একদিন, দু-দিন ইংরেজি সিনেমায় নিয়ে গেলুম। ঘুমিয়ে ঘণ্টা পার করে দিলে। কি গো, ঘুমোচ্ছ কী, ছবি দেখো। অত বড়ো একজন অভিনেতা মারলন ব্র্যাণ্ডো।
মুখে সুপুরি ঠুসে কী যে ইংরেজি বলছে কিছুই বুঝতে পারছি না, মাথামুন্ডু।
বোঝার চেষ্টা করো।
তুমি করো। পরে আমাকে গল্পটা বলে দিও।
লাও, বোঝো ঠ্যালা।
দ্বিতীয়বার ঘুমের আয়োজন করতে করতে বললে, মোগলাই খাওয়াবে তো?
ওই এক শিখে রেখেছে, কলকাতায় এলেই মোগলাই। মোল্লার দৌড়।
কেন চাইনিজ খাবে চলো।
না বাবা আরসোলার গন্ধ।
ফিস ফ্রাই।
না বাবা, হাঙরের তেলের গন্ধ।
আমাদের পাশে এক ভদ্রলোক বসেছিলেন, তিনি বললেন, স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার, ও সহজে ফয়সালা হবে না। এখন দয়া করে চুপ করুন, পরে বাইরে গিয়ে যা হয় করবেন।
ইস। লজ্জার একশেষ। তারপর থেকে কোনো দিন আর বউমাকে কোনো ব্যাপারে চাপাচাপি করিনি! যা হবার তা হবে। এখন ছেলেটা বেশ চড়কো হয়েছে, তাকেই মানুষ করার চেষ্টা করি।
অনেক ধরাধরির পর বেশ নামজাদা এক সাহেবী স্কুল থেকে একটা ভর্তির ফর্ম মিলল। আমার চোদ্দপুরুষের ভাগ্য। ফর্ম জমা পড়বে, তারপর পরীক্ষা দিতে হবে। রেজাল্ট দেখে দশজনকে নেওয়া হবে?
এইটুকু ছেলের কি পরীক্ষা হবে। মুখে এখনও আধো আধো বুলি। কোমর থেকে প্যান্ট খুলে খুলে পড়ে যায়। কেউ কোনো উলটো পালটা কথা বললে আঁচড়ে কামড়ে দেয়।
ওই আঁচড়ানো কামড়ানোটাই ভয়ের। স্কুলের প্রিন্সিপ্যালকে যদি কামড়ে দেয়। সারাজীবনের মতো হয়ে গেল। নারসারি রাইম আর পড়তে হচ্ছে না। দুলে দুলে পড়ে যাও, সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি। পাড়ার বাঙলা স্কুলে ইস্তিরি চটকানো জামা প্যান্ট পরা ছেলেদের সঙ্গে জীবন কাটিয়ে কেরানিগিরি করো। পিত্তি-চটকানো ভাত, ঢ্যাঁড়স ভাতে কচি কাঁচালঙ্কা দিয়ে বাকি জীবন গিলে মরো।
ছেলেকে খুব তালিম দিতে থাকলুম মাসখানেক ধরে। পাখির ইংরেজি, বার্ড। সাহেবরা উচ্চারণ করে ব্যার্ড। টিকটিকির ইংরেজী গেকো। পাখিটি—দ্য বার্ড, স্ত্রী লোকটি, দ্য উওম্যান। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নাম কি? মানুষ কবে চাঁদে গিয়েছিল? কি তাঁদের নাম? সুপ্রভাত, গুড মর্নিং। আমি স্যাণ্ডউইচ খাই, আই ইট স্যাণ্ডউইচেস। স্যান্ড মানে বালি, উইচেস মানে ডাইনিরা। আগামীকাল, টুমরো? হাড়ের ভেতর থাকে মারো। টুম্যারো। গতকাল ইয়েসটারডে। বলো বাবা, বলো। মানিক বলো! না, মানিক বড়ো সেকেলে, বাংলা নাম। বলো জ্যাকি, বলো! আমি ভালো ছেলে, আই অ্যাম এ গোড, গোড না গুডই বলো, আই অ্যাম এ গুড বয়!
পরীক্ষার দিন সাত সকালে স্বামী-স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে গেলুম পরীক্ষা দেওয়াতে। কর্মকর্তারা বললেন, আপনারা রাস্তায় দাঁড়ান, অভিভাবকদের ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। ছেলেকে আমাদের হাতে ছেড়ে দিন। ছেলেও শালা তেমনি। নিজের ছেলেকে কেউ শালা বলে। রাগে বলে। সে ব্যাটা মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় চেঁচাতে লাগল, না আমি যাব না।
বলতে চেয়েছিলুম, ডোন্ট বি ফাসসি জ্যাকি। রাগে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ভুতো, মারব এক চড় রাসকেল।
সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, ফাদার কিচলু। তিনি বললেন, ও, দ্যাটস নট দি ওয়ে।
কী করব ফাদার। রাগে মাথায় খুন চেপে যাচ্ছে।
ওঃ নো নো, খুন চাপিলে চলিবে না! বি সফট, বি এ ফাদার, নট এ বুচার।
কাম, মাই সান। মাই লিটল হোলি চাইলড।
ফাদার জানোয়ারটার কোমর দু-হাতে জড়িয়ে ধরে মিশনারি কায়দায় কাছে টেনে নিতে চাইলেন।
কোন মাল থেকে কী মাল বেরিয়েছে জানা ছিল না। ভুতো তার পুরোনো দাওয়াই ছাড়ল। ঘ্যাঁক করে ফাদারের ডান হাতে হাঁত বসিয়ে দিল।
ও গড, হি ইজ এ লিটল সেটান, অ্যান আগলি ডাকলিং। আই নিড সাম অ্যান্টিসেপটিক, এ টেট ভ্যাক।
টেট ভ্যাক লাগবে না ফাদার। ট্রিপল অ্যান্টিজেন দেওয়া আছে।
অ্যান্টি র্যাবিজ দিয়েছিলেন কি?
সে তো কুকুরকে দেয় ফাদার।
হি ইজ মোর দ্যান এ ডগ।
আমি ওকে একটা কষে চড় মারতে পারি ফাদার! ভীষণ রাগ হচ্ছে।
নো নো ডোন্ট ডু দ্যাট। একটি চড় আপনি আপনার গালে মারুন।
কামড়াবার পর ছেলে একটু শান্ত হল। ফাদারের গাউনের ঝোলা বেল্ট ধরে আমাদের দিকে তাকাতে তাকাতে স্কুলে গিয়ে ঢুকল। আহা চেহারার যা ছিরি হয়েছে। তখন অত করে বারণ করলুম, ভদ্রমহিলা শুনলেন না, চোখে কাজল পরাবার কোনও প্রয়োজন ছিল! সাহেবদের ছেলেরা কাজল পরে? সারা মুখে কাজল চটকেছে। ভ্যাগ্যিস, ভূতের মতো গায়ের রং, তা না হলে কী সুন্দরই না দেখাত!
স্কুল বাড়ির দিকে তাকিয়ে দু-জনে গাছতলায় বসে রইলুম পাশাপাশি। শালীর ছেলেটা কী স্মার্ট! এই বয়েসেই ইংরেজি গালাগাল দিতে শিখেছে। আধো আধো ভাষায় কী সুন্দর লাগে শুনতে! ও ছেলে বিলেত যাবেই। ওই জন্যেই লোকে মেম বিয়ে করে। ছেলেটা অন্তত সাহেব হবে! আমার বউটাকে দেখ! ঠিক যেন শাড়ি জড়ানো প্যাকিং কেস! প্যাকিং কেস থেকে ভূতই বেরোবে।
সারাস্কুল বাড়িটা হঠাৎ কেঁদে উঠল। অসংখ্য শিশু কাঁদছে। হাজার রকম সুরে। ঠিক যেন শুয়োরের খোঁয়াড়ে আগুন লেগে গেছে! কী হল রে বাবা! সব অভিভাবকই চঞ্চল হয়ে উঠলেন। কান্নার পরীক্ষা হচ্ছে নাকি। পরীক্ষক হয় তো প্রশ্ন করেছেন—হাউ টু ক্রাই! একটু পরে হয়তো হাসি শোনা যাবে। যাক বাবা, এই একটা আইটেমে আমার ছেলে ফুল মার্কস পাবে। কেউ হারাতে পারবে না।
এক বাঙালি ভদ্রলোক আমার ছেলেকে চ্যাংদোলা করে স্কুল বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন, ব্যাটা হাত পা ছুড়ে চেল্লাচ্ছে দেখো। কানের পোকা বেরিয়ে আসবে।
নিন মশাই, আপনার ছেলেকে বাড়ি নিয়ে যান। ত্রিসীমানা থেকে দূরে হয়ে যান। নিজে কেঁদে সব ছেলেকে কাঁদিয়ে এসেছে। নিয়ে যান, নিয়ে যান।
এসো বাবা এসো, কে মেরেছে বাবা।
মায়ের আদিখ্যেতা শুরু হল। আদর দিয়ে বাঁদর হয়েছে। দু-চোখ বেয়ে কালো জল পড়ছে। ভূতের কান্না তো কালোই হবে!
ওটাকে নর্দমায় ফেলে দাও!
আহা, বাছা আমার! ফুলে ফুলে কাঁদছে।
রাসকেল আমার।
কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে চললুম—চল, তোর আর সাহেব হয়ে দরকার নেই। তুই বাঙালিই হবি চল।