আমার ব্যাঘ্রপ্রাপ্তি
একবার আমাকে বাঘে পেয়েছিলো। বাগে পেয়েছিলো একেবারে—
আমার আত্মকাহিনী আরম্ভ হয়।
এতক্ষণে আমাদের চার-ইয়ারি আড্ডায় আর সকলের শিকার-কাহিনী চলছিলো। জন্তু জানোয়ারের সঙ্গে যে যার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করছিলেন। আমার পালা এলো অবশেষে।
অবিশ্য সবার আগে শুরু করেছিলেন এক ভালুক-মার। তার গল্পটা সত্যই ভারী রোমাঞ্চকর। ভালুকটা তার বাঁ হাতখানা গালে পুরে চিবোচ্ছিল কিন্তু তিনি তাতে একটুও না বিচলিত হয়ে এক ছুরির ঘায়ে ভালুকটাকে সাবাড় করলেন। ডান হাত দিয়ে–তাকে হাতিয়ে।
আমি আড় চোখে তার বাঁ হাতের দিকে তাকালাম। সেটা যে কখনো কোন ভালুক মন দিয়ে মুখস্থ করেছিল তার কোন চিহ্ন সেখানে নেই।
না থাক, আমার মনের বিস্ময় দমন করে আমি জিজ্ঞেস করি; ভালুক কি আপনার কানে কানে কিছু বলেছিলো।
না। ভালুক আবার কি বলবে? তিনি অবাক হন।
ওরা বলে কিনা, ওই ভালুকরা। আমি বলিঃ কানাকানি করা ওদের বদভ্যাস। পড়েননি কথামালায়?
মশাই এ আপনার কথামালার ভালুক নয়। আপনার ঈশপ কিংবা গাঁজার শপ পাননি। তাঁর মুখে-চোখে বিরক্তির ভাব ফুটে ওঠে। আস্ত ভালুক একেবারে জলজ্যান্ত।
ভালুক শিকারীর পর শুরু। এক কর্মবীর। তাঁর কচ্ছপ ধরার কাহিনী করলেন তাঁরটাও জলজ্যান্ত। জল থেকেই তিনি তুলেছিলেন কচ্ছপটাকে।
কচ্ছপটা জলের তলায় ঘুমোচ্ছিল অঘোরে। হেদো-গোলদীঘির কোথাও হবে। আর উনি ড্রাইভ খাচ্ছিলেন–যেমন খায় লোকে। খেতে খেতে একবার হলো কি ওঁর মাথাটা গিয়ে কচ্ছপের পিঠে ঠক করে ঠুকে গেল। সেই ঠোক্কর না খেয়ে তিনি রেগেমেগে কচ্ছপটাকে টেনে তুললেন জলের থেকে।
ইয়া প্রকাণ্ড এক বিশমণী কাছিম। বিশ্বাস করুন। তিনি বললেন। একটুও গাঁজা নয়, নির্জলা সত্যি। জলের তলা থেকে আমার নিজের হাতে টেনে তোলা।
অবিশ্বাস করবার কি আছে? আমি বলি? তবে নির্জলা সত্যি–এমন কথা বলবেন না।
কেন বলব না কেন? তিনি ফোঁস করে উঠলেন।–কেন শুনি?
আজ্ঞে, নির্জলা কি করে হয়? জল তো লেগেই ছিলো কচ্ছপটার গায়ে। আমি সবিনয়ে জানাই।–গা কিংবা খোল–যাই বলুন, সেই কচ্ছপের। আমি আরো খোলসা করি।
তারপর আরম্ভ করলেন এক মৎস্য অবতার–তার মাছ ধারার গল্প। মাছ ধরাটা শিকারের পর্যায়ে পড়ে না তা সত্যি, কিন্তু আমাদের আড্ডাটা পাঁচ জনের। আর, তিনিও তার একজন। তিনিই বা কেন বাদ যাবেন। কিন্তু মাছ বলে তার কাহিনী কিছু ছোটখাট নয়। একসা পেল্লায় সব মাছ তিনি ধরেছে, সামান্য ছিপে আর নাম মাত্র পুকুরে–যা নাকি ধর্তব্যের বাইরে। তার কাছে তিমি মাছ কোথায় লাগে।
তুমি যে-তিমিরে তুমি সে-তিমিরি। আমি বলি। আপন মনেই বলি–আপনাকেই।
মাছরা: যতই তার চার খেতে লাগল তার শোনাবার চাড় বাড়লে লাগল ততই তার কি, তিনি তো মাঝ ধরতে লাগলেন, আর ধরে খেতে লাগলেন আকচার। কেবল তার মাছের কাঁটাগুলো আমাদের গলায় খচখচ করতে লাগলো।
তার ফিস ফিসিনি ফিনিশ হলে, আমরা বাঁচলাম।
কিন্তু হাঁফ ছাড়তে না ছাড়তেই শুরু হলো এক গণ্ডার বাজের। মারি তো গণ্ডার কথায় বলে থাকে। তিনি এক গণ্ডার দিয়ে শুরু গণ্ডারটাকেই নয়, আমাদেরও মারলেন। তাকে বাদ দিয়ে আমরাও এক গণ্ডার কম ছিলাম না।
এক গণ্ডারের টেক্কায়–একটি ফুঙ্কালে আমাদের চার জনকেই যেন তিনি উড়িয়ে দিলেন। চার জনার পর আমার শিকারের পালা–এলো।
নাচার হয়ে আরম্ভ করতে হলো আমায়।
হ্যাঁ, শিকারের দুর্ঘটনা জীবনেও যে না ঘটছে তা নয়, আমাকেও একবার বাধ্য হয়ে.. আমার শিকারোক্তি শুরু করি।
মাছ, না মাছি? মৎস্য-কুশলী প্রশ্ন করেন।
আমি অস্বীকার করি মাছ? না, মাছ না। মাছিও নয়। মশা, মাছি, ছারপোকা কেউ কখনো ধরতে পারে? ওরা নিজগুণে ধরা না দিলে?
তবে কি? কোন আর্সোলা-টার্সেলাই হবে বোধ হয়?
আরশোলা? বাবা, আরশোলার কেই তার কাছে ঘ্যাঁষে? বলতেই আমি ভয়ে কাঁপি।-–না আরশোলার ত্রিসীমানায় আমি নেই, মশাই। তারা ফরফর করলেই আমি সফরে বেরিয়ে পড়ি। দিল্লী কি আগ্রা অদুরে যাই নে, যেতেও পারি নে, তবে হ্যাঁ, বালিগঞ্জ কি বেহালায় চলে যাই। তাদের বাড়াবাড়ি থামলে, ঠাণ্ডা হলে, বাড়ি ফিরি তারপর।
তা হলে আপনি কি শিকার করেছিলেন, শুনি? হাসতে থাকে সবাই।
এমন কিছু না, একটা বাঘ। আমি জানাই : তাও সত্যি বলতে আমি তাকে বাগাতে যাই নি, চাইও নি। বাঘটাই আমাকে মানে বাধ্য হয়েই আমাকে, মানে কিনা, আমার দিকে একটুও ব্যগ্রতা না থাকলেও শুধু কেবল ও তরফরে ব্যম্রতার জন্যেই আমাকে ওর খপ্পরে পড়তে হয়েছিলো। এমন অবস্থায় পড়তে হলো আমায়, সে তখন আর তাকে স্বীকার না করে উপায় নেই….
আরম্ভ করি আমার বাঘাড়ম্বর।
…তখন আমি এক খবর-কাগজের আপিসে কাজ করতাম। নিজস্ব সংবাদদাতার কাজ। কাজ এমন কিছু শক্ত ছিল না। সংবাদের বেশীর ভাগই গাঁজায় দম দিয়ে মনশ্চক্ষে দেখে লেখা এই যেমন, অমুক শহরে মাছবৃষ্টি হয়েছে, অমুক গ্রামে এক ক্ষুরওয়ালা চার পেয়ে মানুষে জন্মেছে (স্বাভবতঃই নাহিত নয়, কোন গহিন পাহাড়ে এক অতিকায় মানুষ গেল, মনে হয় মহাভারতের আমলের কেউ হবে, হিড়িম্বা–ঘটোৎকচ-বংশীয়। কিংবা একটা পাঠার পাঁচটা ঠ্যাং বেরিয়েছে অথবা গোরুর পেটে মানুষের বাচ্চা-মানুষের মধ্যে সে-সব গোরু দেখা যায় তার প্রতিশোধ স্পৃহাতেই হয়ত বা দেখা দিয়েছে কোথাও! এই ধরনের যত মুখরোচক খবর। ‘আমাদের স্টাফ রিপোর্টারেরা প্রদত্ত সংবাদ’ বাংলা কাগজে যা সব বেরোয় সেই ধারর আর কি! আজগুবি খবরের অবাক জলপান!…
আসল কথায় আসুন না! তাড়া লাগালো ভালুক-মার।
আসছি তো। সেই সময়ে গৌহাটির এক পত্রদাতা বাঘের উৎপাতের কথা লিখেছিলেন সম্পদককে। তাই না পড়ে তিনি আমায় ডাকলেন, বললেন, যাও তো হে, গৌহাটি গিয়ে বাঘের বিষয়ে পুঙ্খলনুপুঙ্খ সব জেনে এসো তো। নতুন কিছু খবর দিতে পারলে এখন কাগজের কাটতি হবে খুব।
গেলাম আমি–কাগজ পেনসিল আর প্রাণ হাতে করে। চাকরি করি, না গিয়ে উপায় কি?
সেখানে গিয়ে বাঘের কীর্তিকলাপ যা কানে এলো তা অদ্ভুত; বাঘটার জ্বালায় কেউ নাকি গোরু-বাছুর নিয়ে ঘর করতে পারছে না। শহরতলীতেই তার হামলা বেশি, তবে ঝামেলা কোথাও কম নয়। মাঝে মাঝে গ্রাম এলাকাতেও সে টহল দিতে আসে। হাওয়া খেতেই আসে বলাই বাহুল্য। কিন্তু হাওয়া ছাড়া অন্যান্য খাবারেও তার তেমন অরুচি নেই দেখা যায়। এবার এসে এক মনোহারি দোকানের সব কিছু সে ফাঁক করে গেছে। সাবান, পাউডার, স্নো, ক্রীম, লুডো খেলার সরঞ্জাম–কিছু বাকি রাখে নি। এমন কি, তার শখের হারমোনিয়ামটাও নিয়ে গেছে।
আরেকবার বাঘটা একটা গ্রামোফোনের দোকান ফাঁক করলো। রেডিয়োসেট, লাউডস্পীকার, গানের রেকর্ড যা ছিলো, এমন কি পিনগুলি পর্যন্ত সব হজম, সে সবের আর কোন চিহ্ন পাওয়া গেল না।
আমি যেদিন পৌঁছালাম সেদিন সে এক খাবারের দোকান সাবাড় করেছিল। সন্দেশ-রসগোল্লার ছিটেফোঁটাও রাখে নি, সব কাবার! এমন কি, অবশেষে সন্দেশওয়ালার পর্যন্ত ট্রেস পাওয়া যাচ্ছে না। আমি তক্ষুনি বাঘটার আশ্চর্য খাদ্যরুচির খবরটা তারযোগে কলকাতায় কাগজে পাচার করে দিলাম।
আর, এই খবরটা রটনার পরেই দুর্ঘটানটা ঘটলো। চিড়িয়াখানার কর্তা লিখলেন আমাকে আমি বা গৌহাটির কেউ যদি অদ্ভুত বাঘটাকে হাতে হাতে ধরতে পারি–একটুও হতাহত না করে– আর আস্ত বাঘটাকে পাকড়াও করে প্যাক করে পাঠাতে পারি তা হলে তারা প্রচুর মূল্য আর পুরস্কার দিয়ে নিতে প্রস্তুত আছেন।
আর হ্যাঁ, পুরক্ষারের অঙ্কটা সত্যিই লোভজনক–বাঘটা যতই আতঙ্কজনক হোক না! যদিও হাতহত না করে এবং না হয়ে খালি হাতাহাতি করেই বাঘটাকে হাতেনো যাবে কি না সেই সমস্যা।
খবরটা ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। গৌহাটি বড় বড় বাঘ শিকারী উঠে পড়ে লাগলেন বাঘটাকে পাকড়াতে।
এখানে বাঘাবার কায়দাটা একটু বলা যাক। বাঘরা সাধারণত জঙ্গলে থাকে, জানেন, নিশ্চয়? কোন কিছু বাগাতে হলেই তারা লোকালয়ে আসে। শিকারীরা করে কি, আগে গিয়ে জঙ্গলে মাচা বেঁধে রাখে। আর সেই মাচার কাছাকাছি একটা একটা গর্ত খুঁড়ে সেই গর্তের ওপর জাল পেতে রাখা হয়। জালের ওপরে জ্বালা! আবার শুকনো লতাপাতা, খড়কুটো বিছিয়ে আরো জালিয়াতি করা হয় তার ওপর, যাতে বাঘটা ঐ পথে ভ্রমণ করতে এলে পথ ভ্রমে ঐ ছলনার মধ্যে পা দেয়–ফাঁদের মধ্যে পড়ে, নিজেকে জলাঞ্জলি দিতে একটুও দ্বিধা না করে।
অবশ্যি, বাঘ নিজগুণে ধরা না পড়লে, নিজের দোষে ঐ প্যাঁচে পা না দিলে অক্ষত তাকে ধরা একটু মুশকিলই বইকি! তখন সেই জঙ্গল ঘেরাও করে দলকে দল দারুণ হৈ চৈ বাধায়। জঙ্গলের চারধার থেকে হট্টগোল করে, তারা বাঘটাকে তাড়া দেয়, তাড়িয়ে তাকে সেই অধঃপতনের মুখে ঠেলে নিয়ে আসে। সেই সময়ে মাচায় বসা শিকারী বাঘটাকে গুলি করে মারে। নিতান্তই যদি বাঘটা নিজেই গর্তে পড়ে, হাত-পা ভেঙে না মারা পড়ে তা হলেই অবশ্যি।
তবে বাঘ এক এক সময়ে গোল করে বসে তাও ঠিক। ভুলে গর্তের মধ্যে না পড়ে ঘাড়ের ওপরে এসে পড়ে–শিকারীর ঘাড়ের ওপর। তখন আর গুলি করে মারার সময় থাকে না, বন্দুক দিয়েই মারতে হয়। বন্দুক, গুলি, কিল, চড়, ঘুষি–যা পাওয়া যায় হাতের কাছে তখন। তবে কিনা, কাছিয়ে এসে বাঘ এ সব মারামারির তোয়াক্কাই করে না। বিরক্ত হয়ে বন্দুকধারীকেই মেরে বসে এক থাবড়াতেই সাবাড়ে দেয়। কিন্তু পারতপক্ষে বাঘকে সেরকমের সুযোগ দেওয়া হয় না–দূরে থাকতেই তার বদ-মতলব গুলিয়ে দেওয়া হয়।
এই হলো বাঘাবার সাবেক কায়দা। বাঘ মারো বা ধরো যাই করো–তার সেকেলে সার্বজনীন উৎসব হলো এই। গৌহাটির শিকারীরা সবাই এই ভাবেই বাঘটাকে বাগাবার তোড়জোড়ে লাগলেন।
আমি সেখানে একা। আমার লোকবল, অর্থবল, কিছুই নেই। সদলবলে তোড়জোড় করতে হলে টাকার জোর চাই। টাকার তোড়া নেই আমার। তবে হ্যাঁ, আমার মাথার জোড়াও ছিল না। বুদ্ধি-বলে বাঘটাকে বাগানো যায় কিনা আমি ভাবলাম।
চলে গেলাম এক ওষুধওয়ালার দোকানে–বললাম–দিন তো মশাই, আমায় কিছু ঘুমের ওষুধ।
কার জন্যে?
ধরুন, আমার জন্যেই। যাতে অন্ততঃ চব্বিশ ঘন্টা অকাতরে ঘুমানো যায় এমন ওষুধ চাই আমার।
বাঘের জন্যে চাই চেটা আর আমি বেফাঁস করতে চাইলাম না। কি জানি, যদি লোক-জানাজানি হয়ে সমস্ত প্ল্যানটাই আমার ভেস্তে যায়। তারপর গুজব যদি একবার রটে যায় হয়তো সেটা বাঘের কানেও উঠতে পারে, বাঘটা টের পেয়ে হুসিয়ার হয়ে যায় যদি?
তা ছাড়া, আমাকে কাজ সারতে হবে সবার আগে, সবচেয়ে চটপট, আর সকলের অজান্তে। দেরি করলে পাছে আর কেউ শিকার করে ফেলে বা বাঘটা কোন কারণে কিংবা মনের দুঃখে নিজেই আত্মহত্যা করে বসে তা হলে দাওটা ফসকে যাবে সেই ভয়টাও ছিল।
ওষুধ হাতে পেয়ে তারপর আমি শুধালাম–একজন মানুষকে বেমালুম হজম করতে একটা বাঘের কতক্ষণ লাগে বলতে পারেন?
ঘন্টা খানেক। হ্যাঁ, ঘন্টাখানেক তো লাগবেই।
আর বিশ জন মানুষ?
বিশ জন? তা দশ-বিশটা মানুষ হজম করতে অন্তত ঘন্টা তিনেক লাগা উচিত–অবশ্যি, যদি তার পেটে আঁটে তবেই। জানালেন ডাক্তারবাবু। তবে কিনা, এত খেলে হয়তো তার একটু বদ হজম হতে পারে। চোয়া ঢেকুর উঠতে পারে এক-আধটা।
তাহলে বিশ ইনটু তিন, ইনটু আট–মনে মনে আমি হিসেব করি–হলো চারশ আশি। একটা বাঘের হজম শক্তি ইজ ইকোয়াল টু চারশ আশিটা মানুষ। তার মানে চারশ আশি জনার হজম-শক্তি। আর হজমশক্তি ইজ ইকোয়াল টু ঘুমোবার ক্ষমতা।
মনে মনে অনেক কষাকষি করে, আমি বলি–আমাকে এই রকম চারশ আশিটা পুরিয়া দিন তো। এই নিন শষুধের টাকা। পুরিয়ার বদলে আপনি একটা বড় প্যাকেটও পুরে দিতে পারেন।
ডাক্তারবাবু ওষুধটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, আপনি এর সবটা খেতে চান খান, আমার আপত্তি নেই। তবে আপনাকে বলে দেওয়া উচিত যে এ খেলে যে প্রগাঢ় ঘুম আপনার হবে তা ভাঙবার ওষুধ আমাদের দাবাই খানায় নেই। আপনার কোনো উইল-টুইল করবার থাকলে করে খাবার আগেই তা সেরে রাখবেন এই অনুরোধ।
ওষুধ নিয়ে চলে গেলাম আমি মাংসের দোকানে। সেখানে একটা আস্ত পাঠা কিনে তার পেটের মধ্যে ঘুমের ওষুধের সবটা দিলাম সেঁধিয়ে,–তার পরে পাঁঠাটিকে নিয়ে জঙ্গল আর শহরতলীর সঙ্গমস্থলে গেলাম। নদীর ধারে জল খাবার জায়গায় রেখে দিয়ে এলাম পাঁঠাটাকে। জল খেতে এসে জলখাবার পেলে বাঘটা কি আবার না খাবে?
ভোর না হতেই সঙ্গমস্থলে গেছি– বাঘাটার জলযোগের জায়গায়। গিয়ে দেখি অপূর্ব্ব দৃশ্য। ছাগলটার খালি হাড় কখানাই পড়ে আছে, আর তার পাশে লম্বা হয়ে শুয়ে রয়েছেন আমাদের বাঘা মলে। গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন।
ঈস, কি ঘুম। রাস্তায় কোনো পাহারাওয়ালা কি পরীক্ষার্থী কোনো ছাত্রকেও এমন ঘুম ঘুমুতে দেখি নি!
বাঘটার আমি গায়ে হাত দিলাম, ল্যাজ ধরে টানলাম একবার। একেবারে নিঃসাড়। খাবার নখগুলো, গুণলাম, কোনো সাড়া নেই। তার গোঁফ চুমরে দিলাম, পিঠে হাত বুলোলাম-পেটে খোঁচা মারলাম–তবুও উচ্চবাচ্য নেই কোনো!
অবশেষে সাহাস করে তার গলা টিপলাম। আদর করলাম একটু। কিন্তু তার গালে আমার টিপসই দিতেও বাঘটা নড়লো না একটুও।
আরো একটু আদর দেখাবো কিনা ভাবছি। আদরের আরো একটু এগুবো মনে করছি, এমন সময়ে বাঘটা একটা হাই তুললো।
তার পরে চোখ খুললো আস্তে আস্তে।
হাই তুলতেই আমি একটা হাই জাম্প দিয়েছিলাম পাঁচ হাত পিছনে। চোখ খুলতেই আমি ভোঁ দৌড়। অনেক দূর গিয়ে দেখি উঠে আলস্যি ছাড়ছে– আড়মোড়া ভাঙছে; গা-হাত-পা খেলিয়ে নিচ্ছে একটু। ডন-বৈঠক হয়েতো সেটা, ওই রকমের কিছু একটা হতে পারে। কী যে-তা শুধু ব্যায়ামবীরেরাই বলতে পারেন।
তারপর ডন-বৈঠক ভেঁজে বাঘটা চারধারে তাকালো। তখন আমি বহুৎ দূরে গিয়ে পড়েছি, কিন্তু গেলে কি হবে, বাঘটা আমরা তাক পেলো ঠিক। আর আমিও তাকিয়ে দেখলাম তার চাউনি। অত দূর থেকেও দেখতে পেলাম। আকাশের বিদ্যুঝলক যেমন দেখা যায়। অনেক দূর থেকেও সেই দৃষ্টি–সে কটাক্ষ ভুলবার নয়।
বাঘটা গুঁড়ি এগুতে লাগলে আমার দিকে। আমারো দৌড় বেড়ে গেল আরো–আরোও।
গুড়ি গুঁড়ির থেকে ক্রমে তুড়ি লাফ বাঘটার।
আর আমি? প্রতি মুহূর্তের তখন হাতুড়ির ঘা টের পাচ্ছি আমার বুকে।
বাঘটাও আসছে–আমিও ছুটছি বাঁচবার আশায়। ছুটছি প্রাণপণ… বলতে বলতে আমি থামলাম দম নিতেই থামলাম একটু।
তারপর? তারপর? তারপর?…. আড্ডার চারজনার হসপ্রশ্ন। বাঘের সম্মুখে পড়ে বিকল অবস্থায় আমি যাই যাই, কিন্তু তাদের মার্জনা নেই। তারা দম দিতে ছাড়ছেন না।
ছুটতে ছুটতে আমি এসে পড়েছি এক খাদের সামনে। অতল গভীর খাদ। তার মধ্যে পড়লে আর রক্ষে নেই সাততলার ছাদ থেকে পড়লে যা হয় তাই একদম ছাতু। পিছনে বাঘ, সামনে খাদ–কোথায় পালাই? কোনদিকে যাই?
দারুণ সমস্যা। এধারে খাদ, ওধারে বাঘ–ওধারে আমি খাদ্য আর এধারে আমি বরবাদ!
কি করি? কী করি? কী যে করি?
ভাবতে ভাবতে বাঘটা আমার ঘাড়ের ওপর এসে পড়লো।
অ্যাঁ?
হ্যাঁ। বলে আমি হাঁফ ছাড়লাম। এতখানি ছুটোছুটির পর কাহিল হয়ে পড়েছিলাম।
তারপর? তারপর কী হলো?
কি আবার হবে? যা হবার তাই হলো। আমি বললাম : এ রকম অবস্থায় যা হয়ে থাকে। আমার গপপো শেষ হলো সেইখানেই।
কি করলো বাঘটা? তবু তারা নাছোড়বান্দা।
বাঘটা? আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম : কী আর করবে? বাঘটা আমায় গিলে ফেললো গল্প করে।