আমার বাবা সরসীকুমার দত্ত
বেশ খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে শুরু করতে হবে। যে মাহেশের রথ পশ্চিমবঙ্গে বিখ্যাত, সেই মাহেশের জমিদারের অষ্টাবিংশ শতকের শেষদিকে কী একটা কারণে চিত্ত পরিবর্তন হয়, তিনি সহসা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং জীবনযাত্রা থেকে হিন্দু চাল-চলন সম্পূর্ণ বিসর্জন দেন। আমার ঠাকুরমা শেষ জীবন পর্যন্ত বঁটি শিলনোড়া ব্যবহার করতেন। পরনের বেশবাস বিলিতি হয়ে গেল। আমার ঠাকুরমা মাহেশের জমিদারের কনিষ্ঠা কন্যা, নাম প্রিয়বালা, তাঁর দিদি লীলাবতী অপূর্বা সুন্দরী ছিলেন। দীর্ঘদেহিনী, শ্বেতচন্দনের মতো গাত্রবর্ণ। ঠাকুরদা সে তুলনায় অনেক সাদাসিধে দেখতে ছিলেন, পড়তেন স্কটিশ স্কুলের নবম কিংবা দশম শ্রেণিতে। পিতার নির্দেলশে এরা শাড়ি পরতে পেতেন না, যদিও ঠাকুরমা বিবাহের দিন থেকেই আমরণ শাড়িই পরতেন। তিনি ছিলেন বুদ্ধিমজী স্বল্পভাষিণী এবং শান্ত স্বভাবের।
বড় ঠাকুরমা লীলাবতীর বিয়ে হয়েছিল সোনাটিকরি গ্রামের জমিদার এবং পাশ করা ডাক্তারের সঙ্গে। ইনি মারা যান শেষ যৌবনেই, তার পর লীলাবতী সম্পত্তির কিছু অংশ নিয়ে ছোট বোনের সঙ্গে বাস করতে এলেন মহানাদ গ্রামে। সেইখানেই আমরা তাঁকে দেখেছি। পুরো সাহেবি ইংরেজি বলতেন ইংরেজি কেতায়। মুখ ফিরিয়ে থাকলে একেবারেই বোঝা যেত না, এ-ইংরেজি কোনও বাঙালিনী বলছেন! ও দিকে ঠাকুমাও এ রকম ভাল ইংরেজি বললেও তার বাংলাটি ছিল মধুর। বেয়ারা-বাবুর্চি-খানসামার সংসারে মানুষ হয়েও এঁরা গোপনে অনেকটা বাঙালিয়ানা বজায় রেখেছিলেন মৃত্যু পর্যন্ত। এঁর একটি খাতা দেখেছিলাম মুক্তোর মতো হস্তাক্ষরে। তাতে উনি আশপাশের সমাজের বহু জীবনরীতি, বিশ্বাস ও চালচলনের বর্ণনার সমালোচনা করেছিলেন। আমার প্রবল আত্মগ্লানি রয়ে গেল খাতাটি যথাকালে নিয়ে নিইনি বলে।
প্রিয়বালার চার ছেলেমেয়ে— বিদ্যুৎপ্রভা, সরসীকুমার, চারুপ্রভা ও নলিনীকুমার। জ্যেষ্ঠপুত্র সরসীকুমার আমার বাবা। তাঁর জ্যেষ্ঠভগিনী বিদ্যুৎপ্রভা এক অসামান্য নারী ছিলেন। বাবার জন্ম ১৮৯৩ সালের ৩০ আগস্ট, মৃত্যুদিন ২৩ অক্টোবর। বড় পিসিমা জন্মেছিলেন ১৮৮৯ সালের ২ জুলাই।
মাহেশের জমিদার খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে মেয়েদের বিয়ের জন্য প্রথম প্রজন্মের খ্রিস্টান ছেলে খুঁজছিলেন। যশোরে মাইকেল মধুসূদনের বাড়ি কপোতাক্ষ নদীর তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামে। সেখানে ঠাকুরদাদার ছেলেবেলার খেলার সঙ্গিনী ছিলেন এক বিধবা কিশোরী। ঠাকুরদা তখন কলকাতার কলেজে পড়েন, গ্রীষ্মের ছুটিতে দেশে গেছেন। প্রচণ্ড গরমের দিনে তিনি পাশের বাড়ির বন্ধুটির খুব কান্নার শব্দ পেয়ে মেয়েটির মাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ও কাঁদে কেন?’ মার উত্তর, আজ একাদশী, ওর তেষ্টা পেয়েছে, কিন্তু বিধবার তো আজ নিরম্বু উপবাস। অনেক অনুনয়-বিনয় করেও যখন বন্ধুর জন্য এতটুকু জলের ব্যবস্থা করতে পারলেন না, তখন সোজা কলকাতায় এসে বিশপস কলেজে বিএ পড়লেন। সাহেবকে বললেন, আমি এখনই খ্রিস্টান হব। ধর্মের তত্ত্বকথা পরে শুনে শিখব। কিছু তর্কাতর্কির পর সাহেব তাঁকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা দিলেন। দেশে ফিরে সে কথা জানাতে, তাঁর পিতা তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেন। বড় সম্পত্তি থেকে, জমিদারিতে তাঁর অংশ থেকে বিপিনবিহারী দত্ত বঞ্চিত হলেন। অত্যন্ত বুদ্ধিমান এই ছাত্র কলকাতার এক ধনী ছাত্রকে পড়িয়ে পাশ করাবার বিনিময়ে অন্ন ও আশ্রয় পেলেন। যাই হোক, তাঁর ছাত্র টেনেটুনে পাশ করলেও, ঠাকুরদা নিজে আশানুরূপ ফল করতে পারেননি। পরে তিনি mixed course-এ (তখন চালু ছিল) সংস্কৃত দর্শন ও কেমিস্ট্রি নিয়ে পাশ করলেন। তখন স্কটিশ চার্জ কলেজের কয়েকটি বিষয়ে এমএ পড়ানো হত।
বাবা স্কটিশ কলেজেই এমএ পড়তেন। পাশ করার পর প্রথমে হিমালয়ের সাধুদের সঙ্গে কিছুকাল ধর্মচর্চা করেন। এঁদের জীবনযাত্রা খুব কঠিন ছিল। অনিয়মিত সামান্য খাওয়া তাও প্রধানত শিলাজতু— পাথর কেটে কোথাও কোথাও গাঢ় গোলাপি চটচটে মধুর মতো ঘন রসবেরিয়ে জমা হত। খেতে মিষ্টি এবং বেশ কয়েক ঘণ্টা শরীরকে পুষ্টি ও উষ্ণতা দিত, ঝরনার জল এবং দৈবাৎ দু’-একটা ফলও মিলত।
তখনকার দিনে ধর্মজিজ্ঞাসা একটা চলতি ব্যাপার ছিল। কোন নামে রূপে ভগবান সত্য— এই নিয়ে খুব চর্চা-অনুসন্ধান চলত। এই আবহাওয়ার মধ্যে বাবাও আক্রান্ত হন এবং তাঁর বিশ্বাস জন্মায় প্রাচীন শাস্ত্রের ঋষিরা যখন হিমালয়ে, বেশি ভক্তিমান, কীর্তিমান, সাধু আছেন সে জন্যে ওখানে গিয়ে সাধনা করা দরকার, গেলেনও তাই। নানা দেশের নানা ভাষাভাষীর নানান দার্শনিক ঋষিদের সঙ্গে একে একে আলাপ করলেন। যা শুনলেন, তাতে ওঁর জিজ্ঞাসা মিটল না। ফিরে এলেন। এলেন কলকাতার রামকৃষ্ণ মিশনের আশ্রমে দক্ষিণেশ্বরে। পরে একে একে রাজস্থানের ও পাঞ্জাবের কয়েকটি স্কুলের হেডমাস্টারের কাজ করলেন। গরিবের ছেলেরও দেশভ্রমণের শখ থাকতে পারে। তখন এ ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। রাজস্থানে পশুবধ নিষিদ্ধ ছিল বলে রাস্তায় হাঁটলে হরিণ ও ময়ূরের দল নিৰ্ভয়ে পাশাপাশি হাঁটত, পিঠে হাত বুলিয়ে দিলে গা-ঝাড়া দিয়ে পরম নির্ভয়ে আগের মতো হাঁটত। পাঞ্জাবে অমৃতসর, আম্বালা, বাটালা ও আরও দু-তিন জায়গায় কয়েক মাস পড়ানোর সুবাদেই ঘুরেছিলেন।তাঁর স্বভাব ছিল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সব কিছু লক্ষ করা। তাই তাঁর কাছে এ সব জায়গার গার্হস্থ্য ও সমাজজীবনের বহু অনুপুঙ্খ শুনতে পেয়েছিলাম।
ধর্মানুসন্ধিৎসা তাঁকে নানা দিকে নিয়ে যেত। তাই রাজস্থান ও পাঞ্জাবে গমন। পরে তিনি ছোট ভাইকে নিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের আশ্রমে গেলেন দীক্ষা নেবার আশায়। স্বামীজিরা বিশেষ উৎসাহ দেননি। ভোজনশালায় আশ্রমিকরা খেতে বসতেন; বাবা ও কাকাকে খাবার দেওয়া হত দরজার বাইরে মাটিতে। আশ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ ছিল মাথাপিছু দু’খানি ধুতি, পরিধেয় ও উত্তরীয় হিসেবে। বাবা ও কাকাকে একখানি করে ধুতি দিয়ে বলা হল, আধখানা ধুতি ও অপরার্ধ উত্তরীয় হিসাবে ব্যবহার করতে। সর্বধর্মসমন্বয়ের পীঠস্থানে ওই জাতিভেদটা বাবাকে বড় ধাক্কা দেয়। যেমন দেয় আশ্রমে কেবল কালীপুজোর অনুষ্ঠান; অন্য কোনও ধর্মের অনুষ্ঠান হত না। নিজেদের আদর্শ থেকেই ওরা এমন বহু ছোট-বড় বিষয়ে সরে থাকতেন।
একবার পূর্ববঙ্গে বিধ্বংসী বন্যা হয়। ত্রাণকার্যে নিযুক্ত কিছু শিষ্যের সঙ্গে বাবাকেও যেতে হয়েছিল। প্রকাণ্ড বটগাছের উপর বিশাল পাটা পেতে গাছের ওপর খিচুড়ি রান্না করে মোটা গরুবাঁধা দড়িতে প্রকাণ্ড ডেকচি বেঁধে দড়ি ধরে অতি সাবধানে নামাতে হত। এ কাজ বাবাকেই দেওয়া হয়েছিল। নৌকোয় করে বারে বারে বন্যাপ্লুত গ্রামে প্রয়োজন মতো খিচুড়ি বিতরণ করতেন। কাজটা বিপজ্জনক। অতএব খ্রিস্টানের ছেলের প্রাণের ওপর দিয়ে বিপদটা যাক।
বেশ কিছুদিন পরে কাশীতে প্লেগের মহামারী শুরু হয়। সেখানেও বাবার সঙ্গে আর একজন শিষ্যকে পাঠানো হল। সে কাশীতে উধাও হল। বাবা একা কিছুদিন রোগীদের যথারীতি শুশ্রূষা করে েিজ পেটের অসুখে পড়লেন। সেটা প্লেগ না হলেও যথেষ্ট কষ্টদায়ক ছিল। শরীর যখন যন্ত্রণায় নিরতিশয় কাতর, তখন প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় দশাশ্বমেধ ঘাটের সিঁড়িতে শুয়ে পড়লেন। দু’দিন পরে এক অচেনা ভদ্রলোক (ইনি তৎকালীন বাংলা গভর্নর হরেন মুখোপাধ্যায়ের সহোদর ভাই তারক মুখোপাধ্যায়) এসে রুগ্ন বাবাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিজের বাড়িতে নিয়ে প্রথম ক’দিন ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করলেন। যদিও বাবা তখন খুবই দুর্বল ও শয্যাগত। সুস্থ হলে তাঁর সঙ্গে খ্রিস্টধর্ম ও অন্যান্য ধর্মের আলোচনায় ব্যাপৃত রইলেন। মূল সূত্র নিয়ে এই দুই ধর্মান্বেষী আলোচনা করে সিদ্ধান্তে এলেন যে খ্রিস্টধর্ম প্রাচ্যেরই সৃষ্টি। কিন্তু সর্বত্রই একে সাহেবি পোশাকে, ভাষায়, নামে ও আচার আচরণে বিদেশি আবরণে প্রকাশ ও প্রচার করা হচ্ছে। আর এ দেশের লোকেরা এটাকে সাহেবি ধৰ্ম বলে বাবতে অভ্যস্ত হয়েছে এবং নিজেদের ধর্মজীবন থেকে দূরে রেখেছে। এই মোহ আবরণ সরিয়ে দিয়ে একান্ত ভাবে ধর্ম বলে প্রকাশ করলে দেশের লোকের দ্বিধা হবে না, খ্রিস্টান বলে পরিচিত হতে। খ্রিস্টানের পক্ষেও ভারতীয় থেকেও পুরো খ্রিস্টান হয়ে থাকা সহজ হবে। এর জন্য আমার মামা ও কাকাকে সঙ্গে নিলেন। এর কিছু পরে উপযুক্ত কর্মকাণ্ডে এক রূপদান করে একটা অতি বাস্তব কর্মকাণ্ড সৃষ্টি করে এক অভিযানে সক্রিয় হওয়ার উদ্যোগ। পাঞ্জাবের লুধিয়ানা থেকে চিঠি লেখেন। এই সিদ্ধান্ত কাজে পরিণত করবার আগে অনেক দীর্ঘ প্রস্তুতি ছিল।
পিসিমা শান্তিনিকেতনে কাজে যোগ দিতে আসার পর তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন বাবা। রবীন্দ্রনাথ দর্শনের কিছু কিছু বিষয়ের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার জন্য বাবার সঙ্গে বেশ কিছুকাল আলাপ করেন। ১৯১৩ সালে নোবেল প্রাইজ পাবার পরে রবীন্দ্রনাথ যে ভাষণ দেন, তাতে দেশবাসীকে অনুরোগ করেন। বেশ কিছু কথা ছিল। বিদেশ কবিকে সম্মান করার আগে দেশ তাকে চেনেনি, এবং এর মধ্যে প্রতীচ্যকে প্রাধান্য দেওয়ার দীনতারও উল্লেখ ছিল। অধিকাংশ শ্রোতা এতে মনঃক্ষুণ্ণ হলেও বাবা কিন্তু রবীন্দ্রনাথের উক্তির ভাবার্থ স্বীকার করেন। অল্প কিছুদিন পরে রবীন্দ্রনাথ বিলেতে গেলেন, বাবা কলকাতায় ফিরলেন।
তত দিনে বাবাও পিসেমশায়দের প্রস্তাবিত ব্যাপারটি অনেকটাই বাস্তবায়িত হবার দিকে এগিয়েছে। টাকার জোগাড় হল। পিসেমশায়ের অনেক নিজস্ব টাকা দান, ঠাকুরমার দিদি লীলাবতী দেবীর কাছ থেকে বেশ কিছু ধার। লীলাবতী জমিদারবাড়ির বিধবা দিদিমা ও ঠাকুরমার কিছু টাকা নিয়ে একটা বড় মূলধনে প্রাথমিক কাজগুলো— জমি কেনা গিডনে গ্রামে, ধানজমি পুষ্টিকর খাদ্যে লালিত শুয়োর, যার চাহিদা কলকাতায় সাহেবদের কাছে প্রচুর ছিল এবং যা এদের কাছে প্রভূত লাভজনক ছিল ব্যবসায়িক দিক থেকে, সুবিস্তৃত ধানজমিতে তখনকার সবচেয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে ধানচাষ হত এবং সেটা খুবই লাভজনক হতে লাগল ক্রমেই। সাঁওতালদের বৃহৎ এক দরিদ্র দল সাগ্রহে এবং সানন্দে এগিয়ে এসেছিল। কারণ, এঁদের ব্যবহার ছিল মানবিক ও সমান আচরণে গঠিত।
গিডনিতে মা সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আমি অত্যন্ত দুরন্ত ছিলাম ওই তিন বছর বয়সেই। আর আমার বোন দেড় বছর বয়সে অত্যন্ত শান্ত ছিল। মা দু’জনের জন্য দুটি সাঁওতাল মেয়ে নিযুক্ত করেন দেখাশোনা করবার জন্য। আমারটির নাম রাইমণি, বোনেরটির নাম সুখী। একদিন জেদ করে ওদের বাড়ি গেলাম এবং অত্যন্ত জেদ করে ওদের যে-হাঁড়িয়া জ্বাল দেওয়া হচ্ছিল, তার থেকে অল্প একটু খেলাম। এর পরে বাড়ি নিয়ে যেতে, মা তাঁর তিন বছরের রক্তচক্ষু-কন্যাকে দেখেই রাইমণিকে ছাড়িয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। রাইমণির কাপড় জোর করে ধরে থেকে সে-যাত্রা রক্ষা হল। সুখী ও রাইমণি আমাদের শালবনে নিয়ে যেত। আমরা সেখানে রজন সংগ্রহ করতাম। মা-বাবা দু’জনই বেহালা বাজাতেন, ওঁদের কাজে লাগত। বনজঙ্গলে ওদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোই প্রধান কাজ ছিল এবং অত্যন্ত আনন্দ পেতাম ছোটখাটো ঝরনার ধারে নানা জাতীয় জীব গাছলতা দেখে বেড়াতে। বলা বাহুল্য, এই স্বপ্নস্পর্শ থেকে উৎখাত হওয়াটা ভীষণ কষ্টকর ছিল।
বেশ চলল বছর তিনেক, লাভ ভালই হচ্ছিল। চতুর্থ বছরে মারাত্মক খরা, খালবিল শুকিয়ে উঠল, চাষ একেবারে বন্ধ। শুয়োরদের স্নান ও পানের জলে এত টান পড়ল যে, সেগুলোকে বিক্রি করে দেওয়া হল। এক রাত্রির কথা মনে পড়ে, আমরা ছোটরা পাশের ঘরে শুয়ে শুনতে পাচ্ছিলাম, খুব জোর আলোচনা হচ্ছিল। সকালে বাবা, কাকা মামা ও পিসেমশায়কে সামনে রেখে সাঁওতালদের বললেন, ‘ভুখা মজুরদের পাতের ভাত ও শখের শুয়োরের মাংস বেচতে পারবেন না তাঁরা।’ সব চাবি ওদের হাতে তুলে দিলেন, ওরা সরবে কাঁদতে লাগল। অত্যন্ত ভারী মন নিয়ে আমরা সবাই কলকাতায় ফিরলাম দু’দিন পরে। খ্রিস্টধর্মকে ভারতীয় রূপ দেবার এই পর্ব ওখানেই শেষ হল। যতদূর জানি, এ চেষ্টা তেমন ভাবে পরে কেউ করেনি। কলকাতায় বাবা, মামা ও কাকা ফিরলেন ওদের অংশের বিপুল ঋণের বোঝা নিয়ে। সকলেরই আয় কম, ফলে দীর্ঘকাল ধরে অতি কষ্টে ঋণ শোধ করা হল।
***
মাহেশের জমিদারের কন্যাদায় জটিল হয়ে উঠল এই কারণে যে, তিনি কন্যাদের জন্য প্রথম প্রজন্মের খ্রিস্টান পাত্র খুঁজছিলেন এবং সেটা বেশ বিরল ছিল। এ দিকে বিপিনবিহারী দত্তেরও ওই সমস্যা। যাই হোক, লোকপরম্পরায় উভয়ের উভয়ের সন্ধান করে শেষ পর্যন্ত দুই পরিবারের যোগ হল। মাশেহের প্রথমা কন্যা লীলাবতী দেবীর বিয়ে হল হুগলির সোনাটিকরি গ্রামের জমিদার ও পাশ করা ডাক্তারের সঙ্গে। দ্বিতীয় কন্যা প্রিয়বালার বিয়ে হল মাইকেল মধুসূদনের জ্ঞাতিভ্রাতা বিপিনবিহারী দত্ত, আমার ঠাকুরদার সঙ্গে। মাহেশের জমিদারের শখ ছিল হুগলির মহানদ (লোকে মলে মহানাদ) গ্রামে মেয়ে জামাইয়ের বাস্তবাড়ি তৈরি করে দেবেন। বড় বড় ঘরের চওড়া বারান্দা দেওয়া একটি বাড়ি, খানিকটা জায়গা ছেড়ে চার ঘরের দোতলা একটি অতিথিসদন তৈরি করে দেওয়া। সঙ্গে বড় একটা বাগান; মাতাদিঘি নামে সুবিস্তৃত এক তৃতীয়াংশ। বাড়ির উঠোন ছাড়িয়েই বেশ বড় একটি বাগান। সেখানে মজবুত ও সুদৃশ্য এক দোলনা, আর মার্বেল পাথরের দুটি সুদৃশ্য আসন। সারাদিনের স্কুলের হেডমাস্টারি, গির্জার পাদরির কাজ সেরে ওই শ্বেতপাথরের আসনে বসে ঠাকুমার সঙ্গে বিদেশি সাহিত্য পাঠ, তার ভাষ্য ইত্যাদি দিয়ে ঠাকুমার জ্ঞান ও সাহিত্যের রসগ্রহণের পরিধি বাড়ানো। ঠাকুরমা এক সঙ্গে নানা সাহিত্যিক ধর্মীয়, সামাজিক, দার্শনিক আলোচনা করতেন। প্রেমালাপ ও হাস্যরসেরও কিছু মিলত এখানে।
বেশ চলছিল, এমন সময়ে ওঁদের প্রথম সন্তান কী এক রোগে ভুগে মারা গেল অতি শৈশবেই। স্নেহপ্রবণ মাহেশের শ্বশুরমশায় প্রায় তখনই জামাইকে ডাক্তারি পড়তে পাঠালেন। তিনি ফিরলে আশপাশের পাঁচখানি গ্রামের তিনি একমাত্র ডাক্তার হলেন। পরিশ্রম বাড়ল, দায়িত্ব ও কর্মভারও বাড়ল। শরীরের ওপর ধকল বাড়ল। যখন তাঁর তেতাল্লিশ বছর বয়স, তখন এক ভিন গ্রামের মানুষ ছাদছাড়া এক গরুরগাড়িতে করে রোগী দেখতে নিয়ে গেল। রোগী দেখে এসেই জ্বর। শরীরের যন্ত্রণা নিয়ে শয্যা। রোগটা ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া। তখন এ রোগের নির্ণয় হত না। ছেলেমেয়ে, চিকিৎসা কিছুই ছিল না। ছ’দিন ভুগে সাতদিনের দিন ঠাকুরদার দেহান্ত ঘটে।
ছত্রিশ বছরের ঠাকুরমার হাতে কোনও সঞ্চয় ছিল না। চারটি ছেলেমেয়ে। এমন সময়ে প্রেসবিটিয়ান মিশন ওঁদের পাশে এসে দাঁড়াল। বুদ্ধিমতী ছাত্রী বিদ্যুৎপ্রভাকে লুধিয়ানায় ডাক্তারি পড়তে পাঠালেন। সেখানে প্রত্যেকটি পাত্রেই অত্যুষ্ট নম্বর পেয়ে প্রথম হলেন। এমবিবিএস ডিগ্রি পেলেন না। কারণ, পিতার মৃত্যুর পরেই লুধিয়ানা চলে আসতে হয় এবং অর্থাভাবেই আইএসি পড়া হয়নি। বড় পিসিমার কর্তৃপক্ষের অনুরোধ, যেন ওঁকে এমবিবিএসের পুরো কোর্সটা পড়তে দেওয়া হয়। ডিগ্রির জন্য লালায়িত ছিলেন না, ছিলেন জ্ঞানের জন্য। পুরো কোর্সটা উনি একাগ্র নিষ্ঠায় শেষ করেন। পরবর্তী জীবনে গয়ায় কর্মকালে উনি প্রচুর যশ অর্জন করেন।
ওখানে পরীক্ষার প্রত্যেক পত্রে নব্বইয়ের ঘরে নম্বর পেয়েছিলেন তার প্রতিলিপি আমি দেখেছি। গয়ায় পাশ করে উনি আমন্ত্রিত হন দিল্লি লেডি আরউইন কলেজে। কিছু কাজ করার পর রবীন্দ্রনাথ লুধিয়ানা কর্তৃপক্ষকে লেখেন, একজন নির্ভরযোগ্য লেডি ডাক্তার পাঠাতে। তাঁরা উত্তরে জানান, যাকে পাঠাচ্ছি (পিসিমা) তেমন ছাত্রী আগে কখনও পাইনি, পরেও কখনও পাব বলে মনে হয় না। নিয়োগপত্র পেয়েই বড় পিসিমা সাহেবি মানের বেতন, কোয়ার্টাস ও দুটি অনুচরের (সরকারি নিয়োগের) পাওনা ছেড়ে পরের ট্রেনেই চলে এলেন খড়ের ছাউনির মাটির ঘরে। মহাখুশি। কবির কাছাকাছি থাকতে পারবেন বলে।
এর পর ছোটভাইকে স্কুলে দিয়ে পরপর বিশপস কলেজে আইএসসি পাশ করে, স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বিএসসি মিক্সড কোর্স অর্থাৎ দর্শন ইতিহাসের সঙ্গে কেমিস্ট্রি নিয়ে বিএ পাশ করেন। বাবা অসুস্থ হয়ে ক’দিনের জন্যে দেশে গেলে, এমএ ক্লাসে মিশনারি সাহেব ক্যামেরন হস্টেলে বাবার ঘরটা আর একজনকে দিয়ে দিলেন। ফলে মফস্সলের আশ্রয়হীন ছেলে এমএ পড়বার সময়ে ক্লাসের শ্রেষ্ঠ ছাত্র হয়েও পরীক্ষা দিতে পারলেন না। দেশে ফিরে গেলেন।
বাবার পরিচ্ছদ ছিল অতি সাধারণ। সেটা স্বাধীনতা সংগ্রামের যুগ অর্থাৎ দেশে বহুসংখ্যক লোকই গান্ধীবাদী, বাবাও তাই। পরনে সাদা খদ্দরের থান। খদ্দর ভারী বলে, বাবা নিজের কাপড় সর্বদা নিজেই কাটতেন। ঠিকের মেয়েটির উপর বাড়তি ওজন চাপাতেন না। খদ্দরের পাঞ্জাবি ও পায়ে বিদ্যাসাগরি চপ্পল। আমাদের এক জ্ঞাতির বিয়েতে কন্যাসম্প্রদান করেন, কন্যার পিতা মারাত্মক অসুস্থ হওয়ায়। ওদের বাড়ি থেকে অনুরোধ এল, বাবা যেন সম্প্ৰদান করেন। অবস্থা বুঝে বাবা রাজি হলেন। পরদিন সকালে সাজসঞ্জাম নিয়ে দর্জি হাজির। বাবা বাড়ির গৃহিণীকে বললেন, আপনি তো জানেন, আমি খদ্দর পরি, এ সব কেন? তিনি বললেন, তুমি তো রায়সাহেবের কন্যাকে সম্প্রদান করবে, এতটুকু না হলে কী চলে বাবা। বললেন, তাহলে কাপড়ই সম্প্রদান করুক, আমাকে বাদ দিন। কিছু বাকবিতণ্ডার পরে ওরা রাজি হলেন। খদ্দর পরেই বাবা সম্প্রদান করলেন।
এর পরে ঘটনার আনুপূর্বিকতায় হয়তো খানিকটা গোলমাল থাকবে। তবে যতদূর মনে পড়ে, এর পরে বাবা হিমালয়ে যান। গুহায় গুহায় নানা সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন। ওই সময়টার শিক্ষিত বাঙালি যুবকের একাংশে ধর্ম সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন ছিল। ধর্মের সত্যস্বরূপ কী এই নিয়ে নানা সংশয় ছিল আগেই বলেছি। বাংলা, ইংরেজি ও চলন-সই হিন্দি ও ওড়িয়া বলতে পারতেন। ও দিকে খাদ্যাভাব অর্থাভাব খুব ছিল। পাহাড়ি গরু-মোষের যৎসামান্য দুধের অংশ এবং শিলাজতু প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য উত্তর না পেয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই চলে আসেন।
এর পরে বাবা কাকাকে নিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনে আশ্রমবাসী হিসেবে থাকতে চান। কর্তৃপক্ষ এক পক্ষ এক বৎসর পরে দীক্ষা দেবেন বলেছিলেন। দেননি। তা ছাড়া তাঁদের সঙ্গে যা যা ঘটে তা আগেই বলেছি।
এর পর খ্রিস্টধর্মকে প্রাচ্যধর্ম প্রমাণ ও দেশে সে ধর্মের প্রচারের উদ্দেশ্যে গিডনিতে উদ্যোগের কথা আগেই লিখেছি।
এর পরে শুরু হল ঋণশোধের পর্ব। পিসেমশায়ের শিয়ালদায় ওমদাবাজা লেনে সুবৃহৎ তিনতলা বাড়ি ছিল। তার বিক্রয়মূল্য ছিল প্রকাণ্ড। উনি মামাকে নিজের কাছে রেখে ম্যাট্রিক পাশ করিয়ে দেবার দায়িত্ব নিলেন। মুশকিল হল বাবার। কাকাকে ম্যাট্রিক পাশ করাবার দায়িত্ব। তাই বালেশ্বরে স্কুলে হেডমাস্টারের পদ নিলেন। কাকার শিক্ষা ও থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব ও মাসে ঋণশোধ করতে লাগলেন। এরই মধ্যে একজন মহাজন একটা বড় অঙ্কের পরিশোধ দাবি করলেন, এক মাসের মধ্যেই। আমার তখন বছর ছয়েক বয়স, তবু বুঝতে পেরেছিলাম, ভীষণ একটা অর্থকৃচ্ছ্রতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছেন বাবা। তবু সদাপ্রসন্ন হাসিখুশি ও রসিক গল্প দিয়ে পরিস্থিতিকে জয় করেছিলেন তিনি।
বালেশ্বরের পরে আরও দু’-চারটে স্কুলে হেডমাস্টারের পদে কাজ করেন বাবা। আশ্চর্য ভাল শিক্ষক ছিলেন। যারা পড়েছে তাঁর কাছে তারা এই সেদিনও এমন গল্প করেছে যে, হঠাৎ শুনলে অত্যুক্তি মনে হতে পারে। এ খবরটা আমরা বাবার জীবৎকালে জানতে পারিনি। জেনেছি অল্প কিছুদিন আগে। এবং এ সব ক্ষেত্রে প্রায়ই যা হয়, স্কুল বাবাকে দিয়ে কঠিন দায়িত্বপূর্ণ কাজ করিয়ে নিত প্রায় বিনামূল্যেই। একটু বড় হয়ে জিজ্ঞেস করলে বলতেন, আমি দরাদরি করলে ওরা কাজটা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে অন্য কাউকে দিতেন। যিনি টাকাটা বেশি পেতেন, কিন্তু কাজটার গুরুত্ব বুঝে সেটা করতে পারতেন না। বাবা বাংলা সাহিত্য এত পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পড়েছিলেন যে, তাঁর বাংলা জ্ঞান ও সাহিত্যিক ভাষায় কিছু লেখা অতি সহজ ছিল। সেই ভাষা তাঁর সহকর্মীদের কারও আয়ত্তে ছিল না। ফলে অর্থের দিক দিয়ে প্রবঞ্চনা পেলেও সম্মান প্রচুর পেয়েছিলেন।
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাবার অনেক কথা হয়। কবি দর্শন সম্বন্ধে আলোচনা করতেন, কারণ উপনিষৎ ও গীতার বিভিন্ন যোগ এবং যোগাশাস্ত্রের সমবায় সূত্রগুলি আলোচনা হত। নতুন করে রাজযোগ সম্বন্ধে কবির আগ্রহ ছিল এবং এ নিয়ে আলোচনা ও হত বেশি। কবির পাশের ঘরে বাবার অবস্থান। যে দিন কবি নোবেল প্রাইজ পাবার পরে শান্তিনিকেতনের সমবেত জনগণকে কিছু কটু কথা বলেন, বাবা সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। বাবা বলতেন, রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতায় যে ক্ষোভ, দুঃখ ও অভিমান ছিল, সেটা সম্পূর্ণতই যথাযথ ছিল। কবি যথার্থই বলেন যে, তিনি যদিও দীর্ঘকাল ধরে কবিতা লিখছেন— প্ৰায় চল্লিশ বছর, সে কবিতার উৎকর্ষ দেশের লোক বোঝেনি। যখন বিদেশি পাঠক, বোদ্ধা প্রশংসা করল, তখন দেশের লোকের চেতনা হল যে, আমি কবিতা লিখে থাকি এবং সে কবিতা বিদ্বজ্জনের কাছে আদরণীয়। বিদেশি রসজ্ঞদের প্রশংসার পর দেশের লোকের স্বীকৃতি কবিকে আহত করে। এটা এতটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যে, বাবা একে অস্বাভাবিক বলে মনে করেননি। তাঁর কবিতা নিয়ে বেশ কিছু কবি অকবি নানা ব্যঙ্গপরিহাস করেছিল। কবি তার উত্তর দেন ছড়া বা সরস উক্তিতে। এর কিছুদিন পরে কবি আমন্ত্রিত হয়ে ইংল্যাণ্ডে চলে যান। বাবা কলকাতায় কাজে ফিরে আসেন। বাবা যথাসম্ভব লেখাপড়া ও পঠনে মনোযোগী ছিলেন। ১৯৪৫ সালে ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় ছ’দিন কাটাবার পরে সপ্তম দিনের সকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিছু কথা শেষে বলেছিলেন, তার মধ্যে মাকে দেখিস। এটুকু ছাড়া অন্য কথাগুলি আবছা, বুঝতে পারা যায়নি।
এ তো গেল বাবার কর্মজীবনের ছোট আলেখ্য। বাবার চিত্ত সর্বদাই নতুন ভাবে, চিন্তায় উদ্বেলিত থাকত। বাবা কেমিস্ট্রির জ্ঞান কাজে লাগিয়ে সোনা বানালেন। স্পেসিফি, গ্র্যাভিটি, নাইট্রিক অ্যাসিড না গলা এবং রং না হারানো এই তিনটি পরীক্ষায় পাস করলে ১৮ ক্যারাট পর্যন্ত সোনাতেই অনেক লাভ। বাবার মন ছিল ভীষণ বিজ্ঞাননিষ্ঠ। বিএসসি-তে কেমিস্ট্রি তাঁর পাঠ্য ছিল এবং অনেক বই পড়েছিলেন এবং অনেক ল্যাবরেটরির পরীক্ষানিরীক্ষাও করেছিলেন। লাভের মধ্যে মায়েরী গলার মটরমালার একটি করে মটর যেত। অবশেষে খাঁটি সোনার চেয়ে কম মানের সোনা হল, যা নাইট্রিট অ্যাসিডে গলে না। রং পালটায় না, শুধু নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে কম ওজনের সোনা পাওয়া গেল। ইংরেজিতে যাকে বলে specfic grouth ঠিক পাওয়া গেল না। মেদিনীপুরের সবচেয়ে বড় স্বর্ণকার আমাদের পারিবারিক বন্ধু হেমন্ত তখনকার বাজার দরের চেয়ে ভরি পিছু তিন টাকা দিয়ে বহু পরিমাণ সোনা কেনবার জন্যে বাবাকে বহু অনুরোধ করলেন কিন্তু ততক্ষণে সোনার টুকরো এবং রাসায়নিক দ্রব্য সব রাস্তায়। বাাব ছিলেন প্রকৃত আদর্শবাদী, অতএব যা করলেন এত মাস ধরে তা যখন খাঁটি সোনায় উত্তীর্ণ হল না, তখন তিনি তাঁর পরিশ্রমকে ব্যর্থ জ্ঞান করে ওর থেকে সরে এলেন। এবং একদিনও পিছনে ফিরে চাইলেন না। আঘাত নিশ্চয়ই পেয়েছিলেন, কিন্তু বাবার অনুশোচনার কোনও প্রকাশই ছিল না।
এর মধ্যে স্কুলের পরীক্ষার প্রচুর টাকার কালি স্কুল কেনে দেখে, ভাবলেন স্বদেশি রসায়নে প্রস্তুত কালি থাকলে দেশের অনেক টাকা বাঁচে। কাজেই এর পরই শুরু হল দীর্ঘদিন ধরে কালির পর্ব। নিশাদল এবং আরও চার-পাঁচটি উপাদানকে তাপে ও মিশ্রণের নানা প্রক্রিয়ায় কালিতে পরিণত করার বিচিত্র প্রচেষ্টা। ৭/৮টি বোতলে নানা গুণের সিদ্ধিযুক্ত কালি হত। এরই শেষদিকে ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় সাত দিন ভুগে সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার বাইরে চলে গেলেন। কয়েকদিন পর আমার ভাই ও আমি বোতলগুলো থেকে কালি ঢেলে দেখলাম, তলায় তলানি জমে না এবং নাইট্রিক অ্যাসিডে গলে না। শুকিয়ে গেলে জল দিলে রং একেবারে পাকা থাকে, তখন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় অনভিজ্ঞ আমরা দুই ভাইবোন সম্পূর্ণ বিমূঢ় অবস্থায় বসে রইলাম। রাসায়নিক পদার্থ সবই হাতের কাছে, কিন্তু কোনটা কতখানি কখন দিতে হবে, কতক্ষণ জ্বাল দিতে হবে তাও আমরা জানি না। বহু বছর বোতলগুলি ফেলতে পারিনি। ওই কালি ব্যবহার করেছি অনেকদিন কিন্তু ওর রহস্যমোচন করতে পারিনি। কারণ, রসায়ন সম্বন্ধে অতটা জ্ঞান ছিল না। ওই একনিষ্ঠ সাধনাও ছিল না।
বাবা যে কাজে হাত দিতেন সেটা নিখুঁত ভাবে না করে উঠতে চাইতেন না। তাঁর এ গুণটা আমাদের কারওরই ছিল না। এ সব রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যেই স্কুলের হেডমাস্টার ও অন্য এক ধনী লোক দুটি বৃহৎ গ্রন্থ ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করতে দেন। দুটি কাজই খুব কঠিন ছিল। শুধু ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ মাত্র নয়, বাবার আদর্শ ছিল অনুবাদটি যেন যথার্থ বাংলা বাগধারাকে মেনে চলে। বহু পরিশ্রম করে বই দুটি অনুবাদ করার পরে মোটামুটি ‘ভাল হয়েছে’, বেশ হয়েছে বলা হল এবং পরিশ্রুত অর্থের অর্ধেক দিয়ে বিদায় দেওয়া হল। বানিদ্দের অনুবাদ দুটির খুব প্রশংসা হওয়ার পরে বাবা আরও অনুবাদ করার জন্য আমন্ত্রিত হন, কিন্তু পরিশ্রমের মর্যাদা ও অর্থমূল্য না পাওয়ায় তিক্ত অভিজ্ঞতা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আর কোনও অনুবাদ করেননি। অথচ বাবা সংস্কৃত ভাল জানতেন বলে তাঁর বাংলা অনুবাদগুলি সহজ সুখপাঠ্য এবং যথাযথ হত।
বাংলা পড়াতেন। স্কটিশ চার্চ কলেজের পণ্ডিত দুর্গামোহন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বাবার হৃদ্যতা ছিল, সেটা অবশ্য বাবার সংস্কৃত জ্ঞানের ওপরে প্রোথিত ছিল।
তাঁর পড়ানোর পদ্ধতি সম্বন্ধে কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্রের মন্তব্য মনে পড়ে। ইংরেজির অধ্যাপক জ্যোতি ভট্টাচার্য প্রথম দর্শনেই আমাকে বলেন, বউদি, তুমি দাদার স্ত্রী হিসেবে আমার কাছে যতটা আপন ও সম্মানের তার চেয়েও বেশি দামি হয়েছ সরসীবাবুর মেয়ে হিসেবে। আমি দেশে-বিদেশে নানা শিক্ষকের কাছে পড়েছি, কিন্তু সরসীবাবুর মেধা এবং স্বয়মুদ্ভাবিত শিক্ষাপ্রণালীর কোনও তুলনা কোথাও পাইনি। প্রখ্যাত নাট্যকার বাদল সরকার আমার বিশেষ কনিষ্ঠ প্রিয়জন ছিল। এই সে দিন চলে গেল। সেও এই কথাই বলেছিল।
স্কুলে বাবা পড়াতেন নবম ও দশম শ্রেণিতে। কিন্তু স্কুলের নীচের শ্রেণিতে শিক্ষক না এলে ছেলেদের প্রচণ্ড কোলাহল বন্ধ করার জন্য অন্য যে কোনও শিক্ষককে সেই ছোট ক্লাসে পাঠানো হত। এমনই এক নীচের ক্লাসে গিয়ে বাবা দেখেন দুটি ছেলের মধ্যে প্রবল মারামারি হচ্ছে। তার মধ্যে ৬/৭ বছরের ছেলে বাবা ঢোকামাত্রই আদেশ দিল, ওকে মারো, ও আমার পেনসিল নিয়েছে। বাবা কিছুই করছেন না দেখে বাবার হাত ধরে টানতে টানতে হেডমাস্টারের ঘরে নিয়ে গিয়ে বাবাকে দেখিয়ে হুকুম দিল একে মারো। হেডমাস্টার ও বাবা যুগপৎ হেসে ফেললেন, মৌচাকে ঢিল পড়ল। ছেলেটি পরম বিরক্তি ও অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, তোমরা কেউ কোনও কাজের নয়। ফলে দু’জনকে দুটি চড় মেরে বেরিয়ে গেল।
আর একদিন বড়দের ক্লাসে তেমনই ডেঁপো ছেলেদের এটা ওটা জিজ্ঞেস করেন এবং প্রত্যেকটার ভুল উত্তর পেয়ে শেষে জিজ্ঞাসা করলেন, বল তো life is not a bed of roses মানে কী? ক্লাস চুপ। এক মিনিট পরে শেষ বেঞ্চির একটি অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ছেলে বলল, ‘আমি বলব স্যর?’ বল। সে পরম বিজ্ঞতা ও পরিতুষ্টির সঙ্গে বলল, জীবন ফুলশয্যা নয়।
এমন একাধিকবার ঘটেছে, বাবা না হেসে শুনেছেন। আবার অনেকে বলে, যাদের মধ্যে সূক্ষ্ম বুদ্ধির চিহ্ন দেখতেন, স্কুলের পরেও তাদের বহু জিজ্ঞাসার সমাধান করতেন। বাবার জীবৎকালে ওঁর কথায় কখনও জানতে পারিনি, শিক্ষক হিসেবে কী বিপুল পরিমাণ শ্রদ্ধা ওঁকে ঘিরে জমে উঠেছিল। নিজের থেকে এ সব কথা বলবার লোক তিনি ছিলেন না। তাই আমি এগুলি দশক কয়েক পর বিখ্যাত কিছু ছাত্র ও তাঁর সহকর্মীদের কাছে শুনে অবাক হই।
অবশ্য সেটা আমাদের অজ্ঞানতা। কারণ, আমাকেও তো বাবা ভারতীয় দর্শন ইতিহাস সাহিত্য কত প্রাঞ্জল ভাবে কত কিছু বুঝিয়েছিলেন। সে কথা ভুলবার নয়। তখন ভাবতাম বুঝি সব শিক্ষকই এত সমৃদ্ধ ভাবে পড়ান। ছেলেবেলায় পড়া বোঝার জন্যে বাবা যে ভাবে সহজে বোঝাতেন তার তুলনা নেই। কিন্তু অধ্যাপক বাবাকে ভাল করে চিনলাম কলেজে উঠে। জটিল কঠিন প্রশ্নের যেমন সহজে উত্তর দিতেন যুক্তির পরম্পরা দিয়ে, তার তুলনা নেই। আজ বুঝি বাবার ইচ্ছে ছিল, আমি দর্শন ভাল করে বুঝে শেষ পর্যন্ত দার্শনিক হই। তিনি দর্শন অত ভাল করে পড়াবার সুযোগ পাননি, পড়াতেন ইংরেজি, বাংলা ও ইতিহাস। প্রায় পাশ করে যখন বললাম সংস্কৃত পড়ব, তখন বাবার মুখটা বিষাদে মলিন হয়ে উঠল দু’-তিন মিনিট চুপ করে থেকে বললেন, ‘কেন, সংস্কৃত পড়তে চাস?’ বললাম, প্রাচীন ভারত কী ভাবে চিন্তা করত, যে আদর্শের নিরিখ তাঁরা রেখে গেছেন, সেটা কেন প্রয়োজন বা কোন উদ্দেশ্যে রেখে গেছেন, তা জানবার জন্য সংস্কৃত পড়তে চাই। অর্থাৎ প্রাচীন ভারতের চিত্ত বিবর্তন শিখতে চাই। তুমি কিন্তু আমাকে কিছু কিছু দর্শন পড়িও, কারণ দর্শনও প্রাচীন ভারতের চিন্তাকে পুষ্ট করেছিল। শর্ত হয়ে গেল, বাবা খানিকটা খুশি হলেন।
বাবার পড়ানোর পদ্ধতি প্লেটো অনুসারী। প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে বিষয়টা প্রাঞ্জল করে তোলা। বাবা পড়তেন খুব খুঁটিয়ে, পড়ে পুরো আয়ত্ত করতেন। ফলে, আমরা তাঁর কাছ থেকে যা পেতাম, সেটা এক পরিলক্ষিত সিদ্ধান্ত। পড়াতে বাবা ভালবাসতেন এবং পড়তেও। বাবার যুক্তিপরম্পরা গঠন থেকে শিখেছিলাম অনেক, যদিও কাজে লাগাতে পারিনি বিশেষ।। কিন্তু বাবার কাছে পড়া একটা আনন্দময় প্রক্রিয়া তার মধ্যে যুক্তির একটা সতেজ মেরুদণ্ড ছিল, যা কখনও কেবলমাত্র বিলাসিতা হয়ে ওঠেনি। সে মূলধন কি আজও ফুরিয়েছে? মনেও হয় না। এখনও কথা বা আলোচনায় তাঁকে মনে হয়, এই ধরনের প্রসঙ্গে বাবা তো এই কথা বলতেন। ওই স্মৃতিটুকুর মূল্য অনেক। এরই মধ্যে এক সময়ে বেশ খেটেখুটে হোমিওপ্যাথিক বই আনিয়ে পড়ে পরীক্ষা দিয়ে এম ডি এবং মাস দুয়েকের মধ্যে মানিকতলার শেষ প্রান্তে বড় রাস্তার ওপরে একখানি ঘর ভাড়া করে বইয়ের একটি আলমারি কিনলেন। রোগীর আগমন প্রথম দিন থেকেই, কিছু নাম ও পরিচিতি; কিছু কিছু রোগ সারতেই লাগল।
মাঝে মাঝে আমার ছুটির দিনে রবিবারে আমি ওই ডিসপেনসারিতে বসে থাকতাম। দেখতাম মাঝেমাঝেই বাবার স্থানীয় এক আজ্ঞাবহ অনুচর ছোট ছোট চিরকুট ও কোনও রোগীকে নিয়ে আমাদের বাড়ি যেত এবং ২/৩ কিলো চাল বা একখানি কাপড়, চাদর বা শীতবস্ত্র নিয়ে বাড়িতে যেত। বাবার স্কুলের পারিশ্রমিক এমন ছিল না যে, এই ভাবে খয়রাতি করা যেত। মায়ের এই প্রশ্নে বাবার উত্তর ছিল, সে রোগী অনাহারে বা অপুষ্টিতে ভুগছে সে তো শুধু ওষুধে সারবে না। খাদ্য ও শীতার্ত রোগীকে বস্ত্র দিতে হবে। দিল্লির ভবানী সেনগুপ্ত (বাবাকে মেসোমশাই বলত) বিশেষ সম্মান করত ও তার সংসারে অস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে বিবেকের প্রেরণায় আর্থিক অবস্থায় ওই দানধ্যানকে সম্ভ্রমের চোখে দেখত এবং নিজে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে বাবার কম্পাউণ্ডারের কাজ করল বেশ কয়েক মাস। অবশেষে একদিন মাকে জিজ্ঞেস করল ডাক্তারখানা থেকে এ পর্যন্ত ক’পয়সা বাড়িতে এসেছে? সেই সঙ্গে মাকে পরামর্শ দিল ‘ও ডাক্তারখানা তুলে দিন মাসিমা, নইলে অচিরেই আপনার পরিবার দেউলে হয়ে যাবে। কথাটা রূঢ় বাস্তবের হলেও ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে একেবারে সত্যি। উঠে গেল ডাক্তারখানা। দুটো বইয়ের আলমারি বিক্রি করা গেল। তৃতীয়টাতে বাবার দামি ওষুধের বইগুলো রাখা হল। ডাক্তারখানা উঠে যাওয়ার পর বাবাকে মাঝেমাঝে করুণ চোখে আলমারিটার দিকে তাকাতে দেখেছি। যদিও সারা জীবন লোককে ওষুধ দিয়েছিলেন। অধিকাংশই বিনামূল্যে। বেশ কিছু দুরারোগ্য রোগ সারাতে দেখেছি সেগুলি সব বলবার সময় নেই। একটির কথাই বলব যতদিন ডিসপেনসারি ছিল, আমার ছুটির দিনে প্রায়ই ডিসপেনসারিতে বসতাম। একবার সকাল ন’টা নাগাদ বসে আছি, এমন সময়ে প্রকাণ্ড এক বিলিতি লিমোজিন গাড়ি সামনে এসে দাঁড়াল। একজন প্রায় প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা নামলেন, সঙ্গে এক অপূর্ব সুন্দরী তরুণী। দুজনেরই মুখ বিষণ্ণ। ভদ্রমহিলা নেমে এসেছ বাবার পা জড়িয়ে ধরলেন, আমার একটা উপায় বের কর বাবা। এই মেয়েকে সাত মাস পেটে নিয়ে বিধবা হয়েছি। ও বড় হতে আমাদেরই সমান মানের এক জমিদারের ছেলে ওকে বিয়ে করে। কিন্তু আড়াই বছরেও ছেলেপুলে হল না বলে, ওর বাবা বলছেন, এত বড় জমিদার বংশ শেষ হয়ে যেতে দেব না, ছেলের আবার বিয়ে দেব। আমার আর মেয়ের কী অবস্থা হবে, বাবা? অনেক শুনেছি, তুমি বাবা ধন্বন্তরী। একটা উপায় করো বাবা। জামাই ডাক্তার দেখিয়েছে, তার নাকি কোনও দোষ নেই।
বাবা বললেন, অনেকটা দেরি হবে আপনার। কিছু খেয়ে আসুন। ঘণ্টাখানেক পরে ফিরলেন। আমাকে দিয়ে বাবা বাড়িতে বলে পাঠালেন, উনি দই মিষ্টি কলা খাবেন, ফিরতে অনেক দেরি হবে। বিস্তর বই নামিয়ে দেখে, নোট করে, অবশেষে ছ’টায় ওদের ওষুধ দিয়ে তিন মাস পরে খবর দিতে বললেন। তিন মাস গেল। ছ’মাস, ন-দশ মাস হল, কোনও খবর এল না। বাবা খুব হতাশ হয়ে পড়লেন।
অবশেষে এক বছর দু’মাস পরে সেই লিমোজেন গাড়ি ও অন্য একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। এক মাসের একটি বাচ্চা, দেবশিশুর মতো দেখতে, কোলে নিয়ে সোজা বাবার পায়ের কাছে নামিয়ে বললেন, এ হল তোমার আশীর্বাদ বাবা, তবে আশীর্বাদ করো, যেন মানুষ হয়। বলতে বলতে অন্য গাড়িটা থেকে বিশাল আকৃতি ছ’টা পিতলের বারকোশ নামল, সেগুলো থেকে সোনারূপার বস্তু এবং নানান মিষ্টান্ন পায়েস ফল ইত্যাদি নামল।
বাবা বললেন, মা আমাদের পেশায় উপহার নেওয়া বারণ। অনেক জবরদস্তির পর শুধু এক বারকোশ মিষ্টি ও পায়েস নিলেন। সে বারকোশটি এখনও আমার কাছে আছে। কিছুক্ষণ কথা বলে ওঁরা চলে গেলেন। বাবা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, যাক ওষুধটা কাজ করেছে।
প্রসঙ্গত বলি, বাবার হাতের লেখা মুক্তোর মতো ছিল। চশমার অনেক পাওয়ার ছিল। একবার একটি চালে রবীন্দ্রনাথের পুরো একটি কবিতা আর একটি পোস্টকার্ডে প্রকাণ্ড বড় কবিতা লিখে পুরস্কার পেয়েছিলেন।
আমাদের বাড়িটা খ্রিস্টান পরিবার; সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ খ্রিস্টান পরিবারে বেশ খানিকটা সাহেবিয়ানা অনুপ্রবিষ্ট ছিল। পোশাকে খাদ্যে কথাবার্তায় আচরণে এটা প্রকট হত। এই ব্যাপারটা বাবা একেবারেই বরদাস্ত করতে পারতেন না। বলতেন, যে কথার বাংলা প্রতিশব্দ আছে, তার জন্যে ইংরেজি বলে নিজের ভাষার অপমান করব কেন? যেমন বলতে, বাঙালি বাংলা বলবে স্বাভাবিক বাংলা স্বরক্ষেপে। তার মধ্যে আগন্তুক ইংরেজি উচ্চারণের লেশমাত্র থাকবে না। বাংলা সাহিত্যের ওপরে তাঁর গভীর আকর্ষণ ছিল। ঊনবিংশ শতকের সাহিত্য ভাল জানতেন ও আমাদের পড়তে বলতেন, এমনকী যাদুগোপাল চট্টোপাধ্যায় পর্যন্ত। বলতেন, এদের লেখা পড়লে বুঝতে পারবি মধুসূদ ও তাঁর সমসাময়িকরা কোথায় বড়, কেন বড়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছিলেন। বলতেন, তাঁর কাছে কবিতা শোনা অদ্ভুত মোহসৃষ্টিকারী, প্রধানত তাঁর শব্দপ্রয়োগ (একেবারে শেষ দিকটা ছাড়া)। বাবা পছন্দ করতেন কথ্য বাংলা, কিছু কিছু প্রচলিত বাগভঙ্গি সমেত। তার মধ্যে খনার বচন ইত্যাদি লোকচলিত ভাষায় এক ধরনের সাবলীলতা আনে, যাতে কথ্য ভাষার আকর্ষণ বাড়ে। শান্তিপুরের কথ্য ভাষার সঙ্গে খানিকটা মিল আছে।
পূজা-আর্চা ছিল না বটে, কিন্তু তিনটি উৎসব— খ্রিস্ট জন্মদিন (বড়দিন) ঈস্টার খ্রিস্টের পুনরুত্থানের কাহিনির দিন এবং বাড়ির সকলের জন্মদিন। এতে যার জন্মদিতন সে নতুন জামাকাপড় পেত। একটু ভাল খাবার ও অনিবার্য ভাবে থাকত পায়েস। কখনও চন্দনের ফোঁটাও দিতেন মা। কেক কখনও প্রাধান্য পেত না। প্রণামের চল ছিল, ক্রমে বন্ধ হয়ে যায়। লোক নেমন্তন্ন করা কখনও, জন্মদিনটায় হলেও সর্বদা নয়। সব মিলে পুজো আচ্চা বাদে হিন্দু উৎসবের সঙ্গে মিল ছিল খানিকটা।
বাবার স্বাদেশিকতা কিন্তু অন্ধ ছিল না। বিদেশের যা কিছু ভাল, গ্রহণীয় তার সম্বন্ধে মুক্ত দৃষ্টি ছিল। যা ভাল, তা কেন ভাল, বুঝিয়ে দিতেন এবং নিজেদের জীবনে তার স্থান করে দিতে শেখাতেন। সব যে পেরেছি, তা নয়, তিনু বাবার উদ্দেশ্য ও মনোভাব বুঝে নিতে পারতাম।
এই কারণে ভাল বিদেশি সাহিত্যে যাতে আমাদের অনুরাগ জন্মায় তারও চেষ্টা করতেন। মা বাবা দু’জনেই বেহালা বাজাতেন। দু’জনেই দুটো বেহালা বিবাহের উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন। মা বাবা দু’জনেই ছবি আঁকতেন। প্রতিকৃতিই শুধু, একটুও উঁচুদরের নয়, তবে ওই আগ্রহটা আমাদের আকৃষ্ট করত। দরিদ্র সংসারে সারা দিনের পর একটু সময় বের করে নিয়ে দৈনন্দিন প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে শিল্পজগতে একটু খানি পা রাখতে পেরে দু’জনেই কৃতার্থ বোধ করতেন। কোনও অর্থেই আমাদের বাড়িটা শিল্পচর্চায় লিপ্ত ছিল না। আমি শুধু বলতে চাই যে, শিল্প যে জীবনবোধের মানকে খানিকটা উঁচুতে গেলে সেটা সম্বন্ধে আমরা যাতে অবহিত হই সেই চেষ্টাটুকু ছিল। বড় শিল্পীদের প্রদর্শনীগুলোয় মা আমাকে নিয়ে যেতেন এবং দু-তিন ঘণ্টা সময় ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে কাটাতেন। এতে আমি শিল্পানুরাগী হয়ে উঠিনি কিন্তু আজ বুঝি যে জ্ঞান হয়ে অবধি এতে মুগ্ধ হতে শিখেছি। শিল্পী শম্ভু মামাকে বলেছি সে কথা। ওঁর পরিচিত যন্ত্রশিল্পী কয়েকবার আমাদের বাড়িতে এসে এস্রাজ বাজিয়েছেন। শম্ভু মামাও বাঁশি বাজাতেন। ছবিও আঁকতেন। ওই সময়টা একটা উচ্চতর পরিবেশে চলে যেত মনটা। বাবা শান্তিনিকেতনে যে পরিবেশে, যে উচ্চতর পরিবেশ উচ্চতর স্তরে মনটাকে নিয়ে যেতে পারতেন, কবিতা, নাটক, আবৃত্তি গানের কিছু প্রভাব রয়ে গিয়েছিল তাঁর জীবনে। এটা টের পেতাম গান, কবিতা ইত্যাদি শোনার সময়ে তাঁর মুগ্ধ তন্ময় দৃষ্টিতে। অথচ গদগদ ভাবটা একেবারেই ছিল না। ছিল শ্রদ্ধাপ্লুত তন্ময়তা। এই সময়টাই কেমন করে যেন ধীরে ধীরে অবচেতনে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে তা বুঝতে পেরেছিলাম।
বছরে প্রায় আট-ন মাস প্রতি শনিবারে বাবা আমাকে নিয়ে জাদুঘর দেখাতে নিয়ে যেতেন। এমনিতেই বাবা ইতিহাসে আকৃষ্ট ছিলেন, স্কুলের ওপরের তিন ক্লাসে পড়াতেন ও আমাকে প্রাচীন গ্রিস, রোম ও আলেকজান্দ্রিয়া, চিন এ সব দেশের প্রত্নবস্তু দেখিয়ে বুঝিয়ে দিতেন সেগুলি কোন ঐতিহাসিক পরিবেশে নির্মিত হয়েছিল। আর একটি জিনিস আমি প্রায় প্রত্যেক বারেই দেখতাম, সেটা হল পাথরের গায়ে লতাপাতার ছোপ। সে লতাপাতা ঝরে গেছে, কিন্তু তাদের অস্তিত্ব ছাপ রেখে গেছে। সে যে কী সুন্দর দেখতে, এখনও মনে গাঁথা তাদের মনোহারিণী রূপরেখাগুলি। প্রাচীন ঐতিহাসিক বস্তু নিয়ে সারা সপ্তাহ পড়ে শনিবারে আমাকে তাদের উৎপত্তির বিবরণ শোনাতেন। জাদুঘর যাত্রাটা আমার কাছে তীর্থযাত্রার মতো ছিল। কী আগ্রহ নিয়েই না যেতাম এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করতাম। অতি প্রাচীন ইতিহাসকে তাঁর বিবরণে কেমন যেন জীবন্ত করে তুলতেন। তার কিছু এখনও মনে আছে।
লেখাপড়ার ব্যাপারে বাবাকে তুষ্ট রাখা কঠিন ছিল। কারণ, সামান্যতম ত্রুটিও শুধরে দিতেন। যেমন তেমন করে কোনও কাজ করা একেবারেই পছন্দ করতেন না। একবার আমাকে বললেন, আমি কখনওই তোর কাছে এটা চাইব না যে, তুই ক্লাসে প্রতিবার প্রথম হবি। আমি শুধু বলব যে, পরীক্ষা দিয়ে তুই যেন নিজে বলতে পারিস এর চেয়ে ভাল করে আমি পড়া তৈরি করতে পারতাম না। দু’বছর পরে বাবাকে বললাম, তোমার দুষ্টুমি বুদ্ধি এ বার টের পেয়েছি। ছোট স্কুলে প্রত্যেকবার প্রথম হওয়ার চেয়ে অনেক কঠিন নিজের সাধ্যশক্তির চরম উৎকর্ষ রাখতে পারা। পরে অবশ্য সেই চেষ্টাই করতাম।
পড়াশোনার চেয়ে অনেক বড় এক উচ্চমানের দাবি করতেন, যেন সব নৈতিক ও সামাজিক অর্থে পুরো মানুষ হয়ে উঠতে পারি। সেটা পারিনি। গ্লানি কোনওদিন যাবে না। আমার অভিজ্ঞতায় বাবা ছিলেন, তেমনই এক সম্পূর্ণ মানুষই। তাঁর কন্যা বলেই আমার যা কিছু গর্ব উচ্চাশা এবং অপূর্ণতার বোধ।
বাবার আর একটা অভ্যাস ছিল, যা দেশের বাড়ি বা মামার বাড়িতে গেলে দেখা যেত। আমাদের নিয়ে সকালে বেড়াতে বেরিয়ে কামারের নেহই, কুমোরের চাক বা পোয়ান, জলের জাল, তাঁতির তাঁত এগুলি দেখিয়ে নাম বলে ও কোন যন্ত্রে কী ভাবে কাজ হয় তা বুঝিয়ে দিতেন। পুকুরের পাশে দাঁড়িয়ে টানা বেড়াজাল, খ্যাপলা জাল বাঁ কুড়োল, আরও কত রকমের জালের নাম ও কাজ বুঝিয়ে দিতেন। দীর্ঘ নগরজীবনের অভিজ্ঞতায় আজ সে সব বেশির ভাগই ভুলে গেছি। বাবা কিন্তু ভিন্ন পেশার লোকদের ও তাঁদের পেশার প্রতি সম্মান দেখিয়ে দাদা কাকা বলে সম্বোধন করতেন। তাদের অনেকেই জানত না যে, এমএ পর্যন্ত পড়া মানুষটি তাদের পেশার প্রতি যথেষ্ট সশ্রদ্ধ ছিলেন। আমায় বুঝিয়ে দিতেন এদের পেশাই আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে খাওয়া পরার জোগান দিচ্ছে। বলতেন, সর্বদা এদের সম্মান করবি, কারণ এরা যা তৈরি করছে, তাই দিয়েই আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা চলছে। কত বিভিন্ন বিষয়ে যে বাবার সজাগ সশ্রদ্ধ, কৌতূহল ছিল তা ভাবলে অবাক লাগে। পরে আর একটা জিনিস বুঝেছি, হাতে পায়ে খাটো যারা, তাদের বাবা সম্মান করতেন এবং আমাদেরও তাদের সম্মান করতে শেখাতেন। কিছু শিক্ষা এখনও মনের মধ্যে প্রোথিত হয়ে রয়েছে।
লেখাপড়ার চেয়ে যেটাতে বাবা বেশি জোর দিতেন তা হল চরিত্র। এবং সেটাও সরাসরি উপদেশ দিয়ে নয়। নিজের আচরণ যেখানে নীতিবিচ্যুত হয়েছে মৃদুস্বরে তার একটা বিবরণ। এটা সরাসরি বকুনির চোখে অনেক অনেক বেশি মর্মভেদী। অনেক বাবা মাকে দেখেছি অন্যের ছেলেমেয়ের ভুল ত্রুটি বিস্তারিত করে নিজের সন্তানদের শেখাতেন। এতে ফল বড় খারাপ হত। নিজের ছেলেদের একটা আত্মতৃপ্তি যেমন জন্মাত তেমনই অন্যদের প্রতি অবজ্ঞাও বাড়ত। এই সব ক্ষতিকর উপায় ত্যাগ করে নিজের সন্তানদের আচরণটা স্পষ্ট বর্ণনা করলে ছেলেমেয়ে নিজেরাই দেখতে পায়, তাদের নিজেদের আচরণের সমালোচনা নিজেরাই করতে পারে। এটাই তাদের মনে থাকে এবং হয়তো কতকটা স্থায়ী ভাবেই ববাবকি করে মারধোর করে যে সংশোধন বা শাসন তাতে গুরুজনদের ওপরে একটা বিদূষতা ও প্রচ্ছন্ন ক্রোধ জন্মাত, তাতে শিক্ষাটা বঙ্কিম ও কষ্টকর অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়।
আমাদের বাড়িতে মারধোর করে শাসন দেখিনি। মুখের কথায়, কখনও-বা গল্পচ্ছলে যা শাসন পেয়েছি তার অনেকটাই এখনও মনে আছে। বাবা স্বভাবে গম্ভীর ছিলেন কিন্তু হাসতে ও হাসাতে পারতেন। গল্পের মধ্যে হাসির উপাদান একটি স্নিগ্ধতা সঞ্চয় করত। স্কুলে শুনেছি বাবার পড়ানোর পদ্ধতিটা অনেকটা অন্য রকম ছিল, আগেই বলেছি সে কথা।
এমনিতেই মাঝেমাঝে অন্য কথার মাঝখানে প্রশ্ন করতেন, কেন? এমন করে হল, না হলে কী হত? পদ্ধতিটা সুপ্রাচীন। প্লেটো এই পদ্ধতিতে পড়াতেন। আমাদের দেশে উপনিষদের আখ্যানগুলিতেও মাঝে মাঝে এই পদ্ধতির প্রয়োগ দেখতে পাই। গুরু-শিষ্যে সংলাপে যখন এই পদ্ধতির প্রয়োগ দেখি, তখন বুঝি আত্মবিশ্লেষণ ঠিক এই ভাবেই হওয়া উচিত। গার্গী এই ধারায় বেশি দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন বলে যাজ্ঞবল্ক্য ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন, তুমি আর প্রশ্ন কোরো না, গার্গী তা হলে তোমার মাথা খসে পড়বে। এটা প্রায় প্রত্যক্ষ, নিজের অজ্ঞানের স্বীকৃতি। বাবা ততটুকুই এ পদ্ধতির অনুসরণ করতেন, যতটায় শিক্ষার্থীর জ্ঞান বাড়ে, আত্মবিশ্বাস না কমে যায়। কখনও প্রাচীন সাহিত্যের কোনও উপাখ্যান থেকে বিশ্লেষণ করে তার যে অংশটা কাজে লাগবে তাই দিয়ে শিক্ষার্থীর জ্ঞানের প্রসার বাড়াতেন, কখনওই তার আত্মবিশ্বাসে ঘা দিয়ে নিজের গৌরব বাড়াবার চেষ্টা করতেন না। আজ মনে হয় শিক্ষার্থীর কাছে যে শ্রদ্ধা ও ভক্তি তিনি পেতেন, তাতে বেশ খানিকটা ভালবাসাও মিশে থাকত। এই পিতাকে এত কম দিন পেয়েছি, তাঁর কাছে জ্ঞানের অনুশীলনের সময় এত কম বছর পেয়েছি যে, এখনও একটা ক্ষোভ রয়ে গেছে।
ধর্ম সম্বন্ধে অন্বেষা আমাকে বিশেষ স্পর্শ করত না। স্কুলের শেষের দিক থেকেই বিশেষত কলেজের দ্বিতীয়-তৃতীয় বর্ষ থেকে ধর্ম সম্বন্ধে নানা রকম বই পড়তাম এবং নানা ধর্মের বক্তব্য এবং নানা রকম দার্শনিক মতের সঙ্গে তাদের বিরোধ বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি করত। এ বিষয়ে বাড়ির সকলের থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছিলাম যদিও কাউকে না জানিয়ে। খুব কষ্ট হত কারণ, চিন্তাজগতে আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু বাবা, তার সঙ্গে মানসিক দূরত্ব বাড়ছিল। একদিন সাহসে ভর করে বাবাকে দুখানি বই পড়তে দিলাম। ফ্রয়েডের মনস্তত্ত্বের ওপরে একটি ও ডারউইনের বিবর্তনবাদ সম্বন্ধে একটি। বিস্মিত হয়ে দেখলাম, গভীর অভিনিবেশ নিয়ে বাবা দুটোই পড়ছেন। আমাকে শুধু বললেন, ‘আগে এগুলো পড়তে দিসনি কেন?’ দার্শনিক গঠনের মন ওগুলো থেকে যা পেতেন আমার পক্ষে ততটা বোঝা সম্ভব ছিল না। দেখতাম বাবা ভ্রূ কুঁচকে একমনে বই পড়ছেন, নোট নিচ্ছেন। নোটগুলো নিজেই ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। আমি রেখে দিলে আমারই লাভ হত। তা হল না। তার অল্প কিছু কালের মধ্যে বাবার মৃত্যু হয়। ফলে একেবারে শেষের দিকে কোনও সিদ্ধান্তের মনোভাব নিয়ে বই দুটো পড়তেন। দার্শনিক চিন্তাধারায় কৈশোরের শেষ দিক থেকেই তাঁর মনটা দীক্ষিত ছিল এবং বিজ্ঞানে তাঁর বরাবরের আগ্রহ। ফলে এই দুটো মনকে আমি যা পেয়েছিলাম, বাবা নিঃসংশয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছিলেন। বাবা বাংলা ভাষা সম্বন্ধে তাঁর যথার্থ অর্থাৎ নির্ভুল প্রয়োগ সম্বন্ধে খুব সচেতন ছিলেন। দুটি উপায়ে এটা নিশ্চিত করতেন। ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের বাংলা প্রচুর পরিমাণে পড়তেন, দুটো ভাষার পার্থক্য কোথায় তা দেখিয়ে দিয়ে আমাদের অবহিত করতেন। মান্য বাংলা ভাষার কাছাকাছি কথ্য ভাষা বলতে ও লিখতে শিখিয়েছেন। কথাবার্তার মধ্যে ভুল প্রয়োগ দেখলে শুধরে দিতেন।
খ্রিস্টান সমাজ ছোট সমাজ। ১৩৩৮ সালে তাদের যে সব ছাত্রছাত্রী পরীক্ষায় বিশেষ ভাল করেছিল, তাদের সংবর্ধনার জন্য একটি সভার আয়োজন করেছিল। আমাদের বসিয়েছিল ঠিক মাঝখানে। প্রচণ্ড ভিড়। সে ভিড়ের প্রান্তে দাঁড়িয়ে বাবা। একটি ছেলে বলল, ওই শাদা বুটিদার শাড়িপরা মহিলার সঙ্গে একবারটি দেখা করতে চাই। কী করা যায় বলুন তো। বাবা গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘আমারও ওই মহিলার সঙ্গে দেখা করা দরকার। দেখি ভিড়ের ওপাশ দিয়ে যদি কাছে হয়’ বলে চলে গেলেন এবং আমাদের পরিবারের সকলকে নিয়ে বাড়ি এলেন। পথে গল্পটা বললেন। এমন বেশ কয়েকবার গম্ভীর মুখে পরিহাস করতে শুনেছি। ওঁর ছাত্ররাও তাঁর এই ধরনের কয়েকটি পরিহাসের কাহিনি মনে রেখেছেন।
বাবা সহজে কাউকে তুচ্ছ করতেন না, কিন্তু যে অন্যায়কারী সে নিজের বাড়ির লোক হলেও ধীরে ধীরে বুঝিয়ে দিতেন, অন্যায়টা কেন অন্যায় এবং এর পরেও সেটা দেখতে কঠোর ভাবে তার প্রতিবাদ ও প্রতিবিধান করতেন। বাল্যে কৈশোরে অনেক সুশিক্ষা পেয়েছি। সব যে কাজে লাগাতে পেরেছি তা নয়। তবে যুক্তি সহ কথা বললে সাধারণত তার একটা প্রভাব পড়ে চরিত্রে।
এরই মধ্যে যুদ্ধ (প্রথম মহা) শুধু হল, জিনিসপত্রের দাম বাড়ল। এক স্কুলশিক্ষকের পক্ষে সংসার চালানো কঠিন হয়ে উঠল। বাধ্য হয়ে বাবা গৃহশিক্ষকের কাজ নিলেন। সকালে উঠে গোহাটা থেকে আমাদের দুধ এনে চা খেয়ে বাজার যেতেন, পরে স্নান সেরে খেয়ে স্কুলে যেতেন। সাড়ে চারটে নাগাদ ফিরে কয়েক মিনিট বিশ্রাম করে চা খেয়ে তৈরি হয়ে ছাত্রটিকে পড়াতে যেতেন। একদিন ছাত্রটির অসুখ, সে পড়বে না, তাই আমার সঙ্গে হাঁটতে বেরোলেন। সেই দিনের কর্মক্লিষ্ট মুখটা দেখে আমার একটা যন্ত্রণা হতে লাগল। একটি ক্লিষ্ট উত্তেজিত স্বদ্দের বাবাকে বললাম, যাই বলো বাবা, শিক্ষকদের পারিশ্রমিক বেশ খানিকটা বেশি হওয়া উচিত। বাড়িতেও তো তাঁর পঠন-পাঠনের জন্য প্রস্তুতি নেন। বিষয়টাকে আশপাশ থেকে বোঝবার জন্য। এই মানুষটাকে যদি সারাক্ষণ অন্যান্য কাজে খাটতে হয় ভাল করে পড়াবার জন্যে, তা হলে পুরো শিক্ষক জগৎটাকেই অবমাননা ও তাদের ওপরে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করা হয়। তোমাদের মর্মান্তিক দক্ষিণাটা নেহাৎ কম। এটা বেশ খানিকটা বাড়লে তোমাদের দক্ষতা ও পড়ানোর তৃপ্তিও বাড়ে। বাবা একটু থেমে বললেন— দেখ, শিক্ষকরা বহুকাল ধরে প্রয়োজনের তুলনায় কম টাকা পাচ্ছেন, টাকার প্রয়োজন এঁদের সত্যিই আছে। ফলে তলে তলে এদের লোভও জমেছে খানিকটা। হঠাৎ অনেক বেশি টাকা পেলে, এঁরা হয়তো নিচু হয়ে হরির লুট কুড়োবেন। সে জন্য এখন যা পাই, তার চেয়ে বেশ খানিকটা বেশি মাইনে হওয়া উচিত, যাতে সংসারে মোটামুটি সচ্ছলতা থাকে। বাবা দেখি যাননি, কিন্তু পরে আমরা অনেক শিক্ষককে নিচু হয়ে হরির লুট কুড়োতে দেখেছি। বেশ কিছু শিক্ষক যাঁদের সৎ বলে জানতাম, তাঁদের লোভী অর্থ সঞ্চয়ে একনিষ্ঠ হতে দেখেছি।
শিক্ষকরা শিক্ষা দেন দুভাবে। পঠনপাঠনের মাধ্যমে আপনি আরচি ধর্ম অপরে শিখাও। সচ্ছলতা প্রয়োজন, প্রাচুর্য নয়। তাঁর নিজের আচরণ ও আদর্শ থেকে বেশ কিছু সহকর্মী ও ছাত্রজীবনে নীতির একটা উচ্চ আদর্শ লাভ করেছেন। এ বস্তু আজকের জগতে এত বিরল হয়েছে যে, বাবার কথা প্রায়ই মনে পড়ে। এ আদর্শে অনুপ্রাণিত কয়েকজন বাবার সম্বন্ধে কথা বলতে গিয়ে এই নির্লোভ সংযমের কথা বলেছেন। পরে অবশ্য দেখেছি, কেউ কেউ আদর্শ দিয়ে শুরু করেও পরে অর্থসন্ধানী লোভীতে পরিণত হয়েছেন। বাবা একা নয়, তখনও দেশে নির্লোভ অর্থ সঞ্চয়ে বিমুখ, বরং নতুন বই ও নতুন শিক্ষার দিকে একান্ত আগ্রহী ছিলেন। এঁরা কেউ কেউ পরস্পরের সঙ্গে শিক্ষাভ্রাতৃত্ব বজায় রেখে চলেছিলেন। বাবার মত ছিল, বুনো রামনাথ আর বিলাসী শিক্ষাকর্মীর মাঝামাঝি একটা অবস্থান অনায়াসেই নেওয়া যায়।
শিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন বলে রসহীন কঠোর শিক্ষাব্রতী ছিলেন, এ কথা কিন্তু সত্য নয়। বাবা যথেষ্ট হাসতে এবং হাসাতে পারতেন। হয়তো এটাও তাঁর জনপ্রিয়তার একটা কারণ ছিল। ছাত্রদের উত্তরপত্রে নম্বর বা উচ্চ-নীচ নম্বর দেওয়া সম্বন্ধে তখনই তাঁর নিজস্ব ভিন্ন মতামত ছিল, যা আজকে আবার শিক্ষাজগতে আলোচনার বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে। ভাল ছাত্রের ধীরে ধীরে শিক্ষাগত অবক্ষয় ও খারাপ ছাত্রের ধীরে ধীরে উন্নতি কী ভাবে হয় তা অনুসন্ধান করতেন। ছাত্রদের ডেকে গল্পের বা আলাপের মধ্যে দিয়ে তাদের মানসিক গানে কোন বৈশিষ্ট্যের জন্য তাদের শিক্ষার উন্নতি হচ্ছে, তা খুঁজে বের করে আবার ওই গল্পের ছলে তাদের পথ দেখিয়ে দিতেন। বহুবার এর ফল পেয়েছেন। যাদের একেবারে পছন্দ করতেন না, তাঁরা হল ভেঁপো ছেলে বলে। প্রায়শই এরা ধনীগৃহের সন্তান। বাড়ি থেকে এরা প্রশ্রয় এবং ‘হাত খরচ’ বলে অনেকটা টাকা পেত। হোটেলে খাওয়া সিনেমা দেখা ইত্যাদিতে তাদের ‘পকেটমানি’ খরচ করে ফেলত। টাকা দিয়ে অনেক বিলাসব্যসনের বস্তু কেনা যায়, কিন্তু চরিত্র গঠনে টাকা সৎ ভাবেও খরচ করা যায়, সেটা অনেকেই জানত না, আর অনেকে জেনেও জানত না। এই শেষোক্তদের সঙ্গে বাবা কথা বলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন, তার কারণ, এ সব ছেলেরা পেত মা-বাবার আনুকূল্য। এ ছায়াটা এখনও বর্তমান।
বাবা বিশ্বাস করতেন, প্রায় সব ছেলেই যথাকালে যথোপযুক্ত শাসন পেলে এবং বেশি কাঁচা টাকা হাতে না পেলে খানিকটা শুধরোবেই। এর দৃষ্টান্ত, তাঁর সাধনায় বরাবরই সাফল্য পেয়েছিলেন। এখনও তাঁর কিছু ছাত্র যথাসময়ে স্বভাব পরিবর্তন করে সমাজের উন্নতির জন্য অসাধ্য কল্যাণব্রতে ব্রতী হয়েছেন। সাংখ্য বাবার বহুপঠিত বিষয় ছিল। মনস্তত্ত্বের সঙ্গে এর বেশ কিছু মিল ছিল। একটা বই লেখার অভিপ্রায় ছিল, সময়ের অভাবে সেটা আর হল না। বাবার বিজ্ঞানমনস্কতা তার কলেজের পাঠ্যতালিকায় বেশ কিছু বিজ্ঞানের বই পড়ার ফল। বাহান্ন বছর বয়সে মৃত্যু কতকটা অকালমৃত্যুই বটে। কত কিছু বলতেন, ভাবতেন হয়তো লিখতেনও। সে সবের সময় ছিল না।
তবু দু-একটা ঘটনা মনে পড়ে। বিএ পরীক্ষায় অনার্সে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার জন্য ঈশান বৃত্তি পাওয়ার কথা। কিন্তু ওই বৃত্তি দেওয়ার মালিকের নির্দেশ ছিল বৃত্তি প্রাপককে হিন্দু হতে হবে। আমার জন্ম খ্রিস্টান পরিবারে, কাজেই ওটা আমার নাগালের বাইরে। অন্যটা অনার্সের প্রাপকদের মধ্যে উচ্চতম নম্বর যায়, তার জন্য জুবিলি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বৃত্তি। সেটা পেলাম কারণ, তার ক্ষেত্রে জাতিবর্ণ নির্দেশ ছিল না। তখনকার দিনে তারও অর্থমূল্য ৩২ টাকা; সেটার জন্য খুশি ছিলাম বটে কিন্তু ৪০ টাকা— যা তখন একজন কেরানির মাসিক মাইনে, যেটা আমাদের গরিবের সংসারে সত্যকার সাহায্য হত, তা পেলান না বলে, বাড়ির সমস্যা আর্থিক ভাবে আর দূর করতে পারলাম না বলে অসম্ভব কষ্ট পেয়েছিলাম। আর এই জন্যে যে লেখাপড়ার জগতে জাতিবর্ণ দিয়ে মূল্যায়ন, আমার কাছে অত্যন্ত অসংগত মনে হয়েছিল। দিন কতক বেশ মনমরা হয়েছিলাম। সন্ধেবেলা বাবা ছাত্ৰ পড়াতে যেতেন, আমি একা ঘরে চুপ করে বসে থাকতাম। একদিন বাবার ছাত্র পড়বে না বলে তার সঙ্গে হাঁটতে বেরোলাম। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘গয়া স্টেশনে ট্রনে ঢোকার আগে কী হয় মনে আছে তোর?’ গয়ায় আমার বড়পিসিমা থাকতেন, আমরা মাঝে মধ্যে তাঁর কাছে যেতাম। তাই মনে ছিল। বললাম, হ্যাঁ পরপর পাঁচটা টানেলে ট্রেন ঢোকে। ঢোকবার সময়ে কী হয়? বললাম, ‘বাইরের আলোগুলো নিভে যায়।’ আর— ‘ট্রেনের ভেতরের আলোগুলো জ্বলে ওঠে। প্রায়ান্ধকার রাস্তায় বাবা আমার সামনে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ওই আলোগুলো কখনও নিভতে দেসনে।’ বাবার কথা ক’টি আমার জীবনের মূলমন্ত্র হয়ে আছে। জীবিনের অন্ধকারের দিনে ওই কথাগুলো অবলম্বন করে আসন্ন হতাশার গুহার থেকে বহুবার উঠে দাঁড়াতে পেরেছি।
বাবার দেশপ্রেম ছিল নীরব। একজন দরিদ্র শিক্ষকের পক্ষে কাজে যা করা সম্ভব ছিল, তা বিনা দ্বিধায় করেছেন। একটি নিঃসম্বল ছাত্রকে প্রতি সপ্তাহের মোটা খরচগুলি প্রত্যেক সপ্তাহে দিতেন। ছেলেটি বুদ্ধিমান ছিল এবং পরে পরীক্ষায় ভাল ফল করেছিল। এই ছেলেটির কৃতজ্ঞতার সীমা ছিল। কত রকমের ছোটখাটো জিনিসের— যেমন ছাতা, চটি, পাঠ্যপুস্তক, জল খাবারের পয়সা বা ওষুধ কেনার পয়সা দিয়ে তাদের ছোট-বড় সংকট থেকে উদ্ধার করেছেন যে তার ইয়ত্তা নেই। নিজে থেকে কাউকে জানাতেন না, কখনও কখনও শুধু মাকে জানাতেন। স্কুলের নির্দেশে দু’খানি বই লিখে দিয়েছিলেন। এবং একটি বেশ বড় অনুবাদ কর্মও করেছিলেন। ওই টাকাটা ছাত্রহিতের জন্য মূলত ব্যবহার করতেন। স্কুল তিনটি এই ধরনের পারিশ্রমিকে ওঁকে বেশ ঠকিয়েছিল। পরে আর কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এ রকম ভাবে আত্মসম্মান খর্ব হতে দেননি। সংসারের খরচ থেকেও গরিব ছাত্রদের সাহায্য করতেন। এক এক সময় খুব দরিদ্র ছাত্রদের পরীক্ষার আগে পড়িয়ে দিতেন। পুরো পাঠ্যতালিকার সমস্ত অংশটা বলা বাহুল্য, সবটাই বিনা পয়সায়। এমন কয়েকজন অনেক বড় পদ পেয়ে বড় পদের অধিকারী হয়ে কখনও কিছু উপহার নিয়ে এসে প্রণাম করেছে। চলে যাবার পর আমি জিজ্ঞেস করেছি, ‘ছেলেটি কে বাবা?’ বলতেন কবে লেখাপড়ার সংকটে হয়তো কিছু বুঝিয়ে দিয়েছি ওকে, ছেলেটা তা ভোলেনি তাই।’
এমন বহু লোককে সাধ্যমতো সাহায্য করতেন, কাউকে কিছু বলতেন না। না বলে নীরবে এই শিক্ষাটি দিতেন যে, বাইবেলে যে শিক্ষা আছে— তোমার ডান হাত কী করে, তোমার বাঁ হাত যেন তা জানতে না পারে।
একজন চিনা ফেরিওয়ালা জিনিস বেচতে এসে ভাষার ব্যবধান সত্ত্বেও ভাঙা ইংরেজি ও হিন্দিতে বাবার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিল। ওঁদের মধ্যে এক সঙ্গে চা-খাবার খাওয়া উপহার আদান প্রদানে বছর তিনেক খুববন্ধুত্ব হয়। বিদায় নেবার দিন দু’জনেরই চোখে জল।
বলতেন, কত দূর দেশ থেকে গাধা ভাড়া করে, কতকটা ট্রেনে, এই ভাবে মাথায় বেঁধে বোঝা নিয়ে আসে, কত টাকাই বা রোজগার, নিত্য নতুন দেশ দেখার আগ্রহ ওর প্রবল। এইখানটায় দুজনের মিল।
বাবার চরিত্রে নানা রকম বৈচিত্র্য ছিল, কিন্তু খুব চাপ ছিল বাবার ওপর।
একটা ঘটনা মনে পড়ে, আমাদের বাড়িতে একটা নীল এনামেল করা সাবানদানি ছিল। একদিন আমার হাত থেকে পড়ে গিয়ে তার একটা খুব ছোট্ট টুকরো খসে যায়। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ স্বরে বাবা বললেন, ভাঙলি তাও কার জিনিস? কবির। বললাম, তা হলে তুমি ওটা পেলে কী করে? বললে, কবি আর আমি পাশাপাশি ঘরে থাকতুম। এক স্নানের ঘরে স্নান করতুম। একবার উনি বিলেত গেলেন আমার সাবানকৌটো নিয়েই, বাড়ি আসবার সময়ে আমি ওঁরটা নিয়ে এলুম।’দুটো একই রকম ছিল। কবির ব্যবহার্য একটা বস্তুর সম্বন্ধেও এতটা দায়িত্ববোধ।
কবির আসন্ন মৃত্যুর কথা জেনে বাবা যৎসামান্য খেয়ে স্কুলে গিয়ে কিছু পরে ফিরে এলেন। উদভ্রান্তের মতো নয়, চোখ নামিয়ে প্রশান্ত ভাবে মাকে বললেন চলে গেলেন, taller than the tallest। আর কিছু না বলে কাচের পাত্র জলে ভরে সঙ্গে একটি গ্লাস নিয়ে উঠে গেলেন। তখন চারটে হবে, বললেন কেউ যেন না ডাকে। ছাদের ভেতর দিক থেকে তালা দিয়ে একা সারারাত রইলেন। সকালে থমথমে চেহারা ও জবাফুলের মতো লাল চোখ দেখে বুঝলাম কথা বলা যাবে না। পরদিন স্কুল বন্ধ, সেদিনও নীরবে একাকী আমাদের সাহস হয়নি কথা বলার। তৃতীয় দিনে দরকারি দু-একটা কথা বললেন। তার পর আমাদের সাহস বাড়লে খুব ধীরে দু-চারটি কথা বললেন। কোথায় ব্যথা লেগেছিল তা ওরই মধ্যে একদিন এ কথায় বলেছিলেন: ইন্দ্রপাত। অদ্ভুত এক স্থৈর্যে নিজেকে প্রকাশ বা অযুক্তি থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। ওই গাম্ভীর্য আমরা কেউ পাইনি, কিন্তু মাঝেমাঝে যেন বাবার সম্মান করার জন্যই বিশেষ বিশেষ পরিবেশেও গম্ভীর হয়ে যাই। তবে ভেবে দেখেছি, ওই পরিবেশে যে ধরনের আলাপ চলে, তার সঙ্গে সুর মেলালে বাবাকে তাঁর আচরণকে যেন নীচে নামিয়ে আনা হয়। অথচ বাবা সুরসিক ছিলেন, গম্ভীর মুখে এমন কথা বলতে পারতেন, যাতে শ্রোতা যথেষ্ট আমোদ পেতেন।
ঘনিষ্ঠ বন্ধু তেমন কেউ ছিলেন না বাবার। কিন্তু গুণী পণ্ডিত কিছু লোক বাবাকে শ্রদ্ধা করতেন, বাবাও তাঁদের শ্রদ্ধা করতেন। সংস্কৃতজগতে সর্বজনশ্রদ্ধেয় পণ্ডিত দুর্গামোহন ভট্টাচার্যের (যাঁর বহু বিদ্যাবিদ শ্রীমান সুধীর ভট্টাচার্য পিতার আরব্ধ কাজ উপনিষদ সংহিতার শেষ অর্থাৎ চতুর্থ খণ্ড শেষ করেছেন) সঙ্গে বাবার বন্ধুত্ব ছিল। আরও দু-চারজন বাঙালি ও অবাঙালি পণ্ডিতের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল।
বিদ্যাচর্চার বাইরে মানুষ বাবার নিজস্ব কিছু কিছু সমস্যা পরস্পরবিরোধী আগ্রহের কারণ ছিল। তা নিয়ে বাবাকে বিচলিত হতে দেখিনি। আমরা যখন বেশ ছোট, তখন এক পারিবারিক বন্ধুর সঙ্গে মা-বাবার বেশ উত্তেজিত আলোচনা শুনতাম, বলশেভিক তত্ত্ব নিয়ে। কোথাও কোনও সংগ্রাম বা বিপ্লব হচ্ছে ওই নামে। এতে আমাদের সরিয়ে রাখা হত ওই আলোচনা থেকে। তা ছাড়া আমরা এত ছোট ছিলাম যে বুঝিয়ে দিলেও বুঝতে পারতাম না। শুধু বলতে চাই যে, পৃথিবীর কোনও প্রান্তে যদি অশান্তি ও ক্ষয়ক্ষতি ধ্বংস-হিংসা হত, সে সব সম্বন্ধে বাবা (মা-ও) অবহিত থাকতে চাইতেন এবং যথাসম্ভব থাকতেনও।
মোটের ওপর গান্ধীবাদী হলেও গান্ধীবাদে বাবার বেশ কিছু আপত্তিও ছিল। বাবা বলতেন, এত বড় একটা দেশের মানুষের বস্ত্রসংকট মোচন করার জন্য খদ্দর বুনে সমাধান করা যাবে না। সে সময়ও লোকে দিতে পারবে না। সে মূল্যও না। তা ছাড়া গান্ধীজির যন্ত্রবিমুখতা আধুনিক যুগে সম্পূর্ণ অচল একটা তত্ত্ব। বিশের শতকে দ্বিতীয় শতকের জীবনযাত্রা যাপন করা চলে না। কাজেই গান্ধীজির স্বল্পব্যয়ের পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করার আদর্শকে সম্মান করলেন। নিশ্চিত ভাবে গান্ধীজির অনুসরণ করতে পারতেন না। এক দিকে গান্ধীবাদীদের নিষ্প্রশ্ন অনুসরণ অন্য দিকে গান্ধীজির ব্যবহার শাসকদলের সঙ্গে এই দুটোর কোনও টাই বাবা মেনে নিতে পারতেন না। ফলে গান্ধী সমন্বন্ধে যথেষ্ট শ্রদ্ধা থাকলেও, তাঁর রাজনীতি, সমাজনীতি নিয়ে ভিন্নমতও বেশ ছিল। মা-বাবার একা আলাপ থেকে ‘বলশেভিক ‘মনশেভিক’ শব্দ দুটো মাঝেমাঝে কানে আসত, মানে বুঝতুম না। কিন্তু বুঝতাম অন্যান্য দেশের রাজনীতির সঙ্গে কিছু পরিচয় ছিল। মোটের উপর দেশের স্বাধীনতার জন্য একনিষ্ঠ আগ্রহই দু’জনের মধ্যে একই রকম অনুপ্রেরণা জাগাত। বাবাকে বুঝতাম কতটুকুই বা? কিন্তু শ্রদ্ধা করার মতো বহু উপাদান চোখে পড়ত।