আমার বমা, তোদের কী!

আমার বমা, তোদের কী!

আমার জেঠিমা ছিলেন ঢাকার মেয়ে। খুব ফরসা আর গোলগাল চেহারা ছিল তাঁর। আর প্রতিমার মতো বড় বড় চোখ। একটু মোটাসোটা ছিলেন বটে, কিন্তু ভারী চটপটে আর কাজের মানুষ। আমরা, অর্থাৎ আমি, দিদি আর ভাইবোনরা তাঁকে ডাকতাম ‘বমা’ বলে। বমা হল বড়মার সংক্ষেপ। আমি জন্মাবধি বমা-র ন্যাওটা ছিলাম। বমা আমাকে ডাকতেন ‘সোনার গোপাল’, আমার আর সব তুতো-ভাইবোনেরা এই আদর-সোহাগ বিশেষ পছন্দ করত না। এক-এক জন বলেই ফেলত, সোনার গোপাল না গোবরের গোপাল। আসলে আমি ছিলাম যেমন দুষ্টু, তেমনই দামাল। কিন্তু হলে কী হয়, আমার দুটি খুঁটির খুব জোর ছিল। এক হল দাদু, আর বমা। এই দুজনের অমিত প্রশ্রয়ে আমি যা খুশি করেও দিব্যি রেহাই পেয়ে যেতাম। আমাদের দিশি ভাষায় রান্নাঘরকে বলে পাকঘর। আমাদের বাড়িতে দুটো পাকঘর ছিল— একটা আমিষ, একটা নিরামিষ। আমিষ পাকঘরটি ছিল বিশাল বড়, কাঠের জ্বালে রান্না হত। এক জন রান্নার ঠাকুরও ছিলেন। তাঁর নাম সুদর্শন, বাস্তবিকই সুদর্শন। লম্বা আর ফরসা চেহারা। বিহারি বামুন। তাঁকে বিক্রমপুরের রান্না শিখিয়েছিলেন বমা। তবে বমা নিজেই সকালের দিকটায় রান্নাঘরে বহাল থাকতেন। আমাদের বাড়ির রেওয়াজ ছিল, পইতে না-হওয়া বাচ্চারা সকালের জলখাবার হিসেবে ভাতই খাবে। তুতো-ভাইবোনদের নিয়ে আমরা পাঁচ-ছ’জন সকালের দিকে পাকঘরে পিঁড়ি পেতে গোল হয়ে বসতাম। মাঝখানে থালায় গরম ভাত আর গরম ফুটার ডাল। ফুটার ডাল মানে সেদ্ধ মুসুরির ডাল, যাতে সম্বরা পড়েনি তখনও, একটু ঘি দিয়ে মেখে সেই ভাত বমা আমাদের মুখে তুলে দিতেন। আর সেই সময় বমার সবচেয়ে কাছে, কোল ঘেঁষে বসানো হত আমাকে। অনেকে নালিশ করত, বমা নাকি আমার গরাসটা একটু বড় করে পাকাতেন। কখও-সখনও ডালভাতের সঙ্গে মাছভাজা জুটলে সেটাও নাকি আমাকেই বেশি করে খাইয়ে দিতেন। আমিও যে সেটা বুঝতাম না, তা নয়। তবে ব্যাপারটা আমার ন্যায্য বলেই মনে হত। বমা তো আমার, তোদের কী!

উঠোন ঘিরে চারটে আলাদা আলাদা ঘর ছিল আমাদের। উত্তরের ঘর বা বড় ঘর, পশ্চিমের ঘর, দক্ষিণের ঘর, পুবের ঘর আর বাইরে বিশাল কাছারি ঘর। জ্যাঠামশাই আর বমা তাঁদের চার কিশোর ছেলেকে নিয়ে থাকতেন দক্ষিণের ঘরে। সন্ধেবেলা দাদারা সব পুবের ঘরে পড়তে যেতেন। আর বমা সেই সময় আমাকে তাঁর বুকের ওপর শুইয়ে গল্প বলতেন। ডান হাতে হাতপাখাটা অবিরাম নড়ত। মুশকিল হত, সন্ধেবেলা বহুরূপী আর মুশকিল আসান এলে, ভয় পেয়ে আমি বমার বুকের মধ্যেই হিসি করে দিতাম। আর বমা চেঁচিয়ে উঠতেন, এইটা কী করলি রে, সোনার গোপাল?

আমাদের বাড়িতে তখনও পেঁয়াজ-রসুন ঢোকেনি। মাছ হত, কিন্তু মাংস হত খুব কম। তা-ও বলির মাংস। তাতে পেঁয়াজ, রসুন দেওয়া হত না। সেই সময়ও আমার রন্ধন-পটীয়সী বমা যা রান্না করতেন, তা তাক লাগার মতো। সবাই ধন্য ধন্য করত। মুড়িঘণ্ট, চিতলের মুইঠ্যা বা পোলাওয়ে হত অবর্ণনীয় স্বাদ। একটু তেল-মশলার আধিক্য ছিল, এই যা। দৈনন্দিন কচুর শাক বা মাছের ঝোল বা মরিচঝোল (আসলে পাঁচমিশেলি চচ্চড়ি) বা ধোঁকার ডালনা বা তেতো এবং টকের ডাল ইত্যাদিও ছিল চেটেপুটে খাওয়ার মতো।

যখন দেশ ছেড়ে মা-বাবার সঙ্গে কলকাতায় চলে এলাম, আমার মাত্র বছর চারেক হবে। মনোহরপুকুরের ভাড়াবাড়িতে থাকতাম, আর মনে হত যেন বিদেশে চলে এসেছি। কী যে খারাপ লাগত, বলার নয়।

সেই ভাড়াবাড়িতে এক বার বমা এলেন। সিঁড়ির তলা থেকেই ‘সোনার গোপাল রে’ বলে ডাকাডাকি। তার পর কত যে আদর! নাড়ু, তক্তি কত কী এনেছেন আমার জন্য।

কিন্তু দুষ্টুমি আমার মজ্জাগত। বাঁদর আর কাকে বলে! এক দুপুরে বমা শীতের রোদে লাগোয়া ছাদে মাদুর পেতে, এক পাশ ফিরে শুয়েছিলেন। আমাদের ঘরে একটা ভাঁড়ে একটু রসগোল্লার রস ছিল। আমি একটুও অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে সেই ভাঁড়ের রসটুকু সযত্নে বমার কানের মধ্যে ঢেলে দিলাম। ‘কী করলি রে সোনার গোপাল, কী করলি?’ বলে বমা চমকে উঠে বসলেন। সেই কান নিয়ে বিস্তর ভুগতে হয়েছিল বমাকে। কিন্তু আমার মা-বাবার শাসন থেকে আমাকে আগলে রাখলেন বমাই, আরে ও পোলাপান, ও কি আর বুইঝ্যা করছে?

দু-এক বছর পর,আমরা তখন কাটিহারের সাহেবপাড়ার এক রেল বাংলোর বাসিন্দা। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। কাটিহারে তখন মার্কিন আর ইংরেজ সেনাবাহিনীর বিস্তর ভিড়। লালমুখো দেখে দেখে আমাদের অরুচি। সেই সময় দাদু, ঠাকুমা, জ্যাঠামশাই, বমা সবাই এসে হাজির। বাড়ি সরগরম। সকালে এক দিন দাদুর সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়েছি, রাস্তায় একটা চকচকে জিনিস পেয়ে কুড়িয়ে নিলাম। মিলিটারি অফিসারদের টুপিতে এ জিনিস লাগানো থাকে বলে অনুমান হল। জিনিসটা সোনার নয়, কিন্তু ভারী চকচকে এবং সুন্দর পাথর-বসানো। দাদুকে দেখালাম। দাদু বললেন, তোমার কাছে রাইখ্যা দাও।

বাড়িতে ফিরে সবাইকে দেখালাম। বমাকেও। বমা জিনিসটা দেখে খুব খুশি। আমার কী ইচ্ছে হল, কে জানে। বললাম, এইটা তোমারে দিলাম। বমা হাসিতে লুটোপুটি, আমারে দিলা? ও মা, কই যামু রে, এইটা আমারে দিলা? আইচ্ছা, আমার সোনার গোপালের চিহ্ন হিসাবে আমার কাছেই থাকব।

বমাকে তাঁর বিপুল ভালবাসার বিনিময়ে তেমন কিছু দিতে পেরেছি কি? মনে পড়ে না। শুধু একটা কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *