আমার নীল কালির দিন

আমার নীল কালির দিন

সাতসকালেই জরুরি ডাক পেয়েছি।

আমি সাধারণত ডাক পাই পায়রা সিস্টেমে। আজকের যুগে এই সিস্টেমের কথা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। বলে, আর পাঁচটার মতো এটাও সাগরের একটা বাজে কথা। যদিও ঘটনা সত্যি। কীভাবে সত্যি সে কথায় পরে আসছি।

সাতসকালে যে কেউ যদি ‘জরুরি ডাক’ পায় তাহলে সেই দিনটা তার কাছে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। এইসব দিনকে ইংরেজিতে কায়দা করে বলা হয় রেড লেটার ডে। রেড লেটার ডে-র সহজ বাংলা হল ‘লাল কালির দিন’। আমি মোটেও ‘যে কেউ’ নই। আমি একজন বেকার, অলস এবং ‘গুড ফর নাথিং’ মানুষ। কোনও জরুরি কাজে ডাক পাওয়া আমার জীবনে বিরল ঘটনা। তাই আজকের দিনটা আমার কাছে শুধু ‘লাল কালির দিন’ নয়, আরও বেশি কিছু। আমার জন্য দিনটার একটা আলাদা নাম থাকা দরকার। লালের পর কী? নীল না? বাহ! নীল দিয়েই নাম হোক। নীল কালির দিন। ইংরেজিতে কায়দা করে বলব, আজ আমার ব্লু লেটার ডে।

নাম ভালো ভাবা হয়েছে। যদিও সকালে ভালো ভাবনাচিন্তা করা একটা কঠিন বিষয়। বিভিন্ন সার্ভেতে দেখা গেছে, সকালের দিকে মানুষের কল্পনা শক্তি থাকে নীচুর দিকে। লো লেভেলে। এই সময়টায় কল্পনায় দাপট দেখায় প্রকৃতি। বেটা এমন সব ভেলকি দেখায় যে মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড় হয়। অন্ধকার থাকতে থাকতেই শুরু হয়ে যায় তার বিরাট আয়োজন। ভোর হওয়ার মুখে মুখে সে আকাশ জুড়ে এমন এক মায়াময় আলো তৈরি করে যে মনে হয়, হাত বাড়ালে সেই আলো ছোঁয়া যাবে। এই সময়ে শিশিরের ফোঁটায় উঠোন ভিজিয়ে ফেলে প্রকৃতি। সবাই জানে শিশির পড়ায় কোনও আওয়াজ নেই, তবু কান পাতলে টুপটাপ, ফিসফাস আওয়াজ শোনা যায়। আশ্চর্য! যে পথ ফুলের নয়, সকালে সেই পথেই ফুল ঝরায়। ধারে কাছে নদী থাকে না, তবু কোথা থেকে যে নদীর ঠান্ডা বাতাস বয়ে আনে! অবাক কাণ্ড না? অবশ্যই অবাক কাণ্ড। উচ্চমার্গের কল্পনা শক্তি ছাড়া এ জিনিস অসম্ভব। এর সঙ্গে মানুষ কী পাল্লা দেবে? ফুস।

যাই হোক, ‘নীল কালির দিন’ নামটার জন্য আমার পিঠ চাপড়ানো উচিত। কিন্তু চাপড়াবে কে? কেউ নেই। আমি একা। দোতলায় বাড়িওলা থাকেন। গোকুলবাবু। গোকুলবাবুও একা। পার্মানেন্ট একা নন, টেম্পোরারি একা। ভদ্রলোকের একমাত্র পুত্র একই সঙ্গে চাকরি এবং বিয়ে জুটিয়ে আমেরিকায়। মেয়ে ফরাসি। নাম জ্যঁ। আমাদের এখানকার ঘ্যাম মানুষরা অনেকেই ফরাসি ভাষা জানেন। আমি জানি না। গোকুলবাবুর স্ত্রী গর্বিত ভঙ্গিতে বলেছেন, তাঁর পুত্রবধূর নামের মানে হল ‘ওগো, তুমি কেন এত সুন্দর?’ এত বড় মানে! গোকুলবাবুর স্ত্রী মৃদু হেসে বলেছেন, ‘বাইরে অমনই হয়। ছোট ছোট নামের বড় বড় মানে। পুরো এক পাতাও হয়। শুনবে?’ তিন মাস হল এই মহিলা আমেরিকায়। তিনি বেড়াতে যাননি, প্রয়োজনে গেছেন। পুত্রবধূ জ্যঁ-কে আচার তৈরি শেখাবেন। কুলের আচার। যাওয়ার সময়ে লাগেজে এক কিলো টোপা কুল নিয়ে গেছেন। এয়ারপোর্টে সেই কুল নিয়ে বড় ধরনের ঝামেলা হয়। অফিসাররা এসে কোনওরকমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং কুল সমেত গোকুলবাবুর স্ত্রীকে বিমানে তুলে দেন। সে গল্প অন্য।

তিনমাস হয়ে গেল গোকুলবাবুর স্ত্রীর সেই আচারমূলক ভ্রমণ সমাপ্ত হয়নি। গোকুলবাবুর সঙ্গে দেখা হলে তিনি আমার কাছে মাঝে মাঝে দু:খ করেন।

‘কী কাণ্ড বলো দেখি সাগর, এতদিন হয়ে গেল, সামান্য এক শিশি আচার তৈরি হল না!’

আমি খুব বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দিই। বলি, ‘স্যার, মনে হয় কুল বলে দেরি হচ্ছে। কাঁচা মিঠে আম বা মোরব্বা হলে এতক্ষণে হয়ে যেত।’

গোকুলবাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘মানে!’

‘একেকটা জিনিসের একেকরকম ক্ষমতা। টোপাকুল শুকোতে সময় লাগে স্যার। না শুকোলে আচার হবে কী করে?’ কথা শেষে আমি সুন্দর করে হাসি। যেন আচার সম্পর্কে ইউনিভার্সিটিতে পেপার জমা দিয়েছি।

‘তা বলে তিন মাস!’

আমি বিনয়ের সঙ্গে বলি, ‘আরও বেশি লাগতে পারে স্যার। এটা ডিপেন্ড করছে উঠোনের ওপর। উঠোন না থাকলে নেড়া ছাদ।’

গোকুলবাবু চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘উঠোন! নেড়া ছাদ! এসব তুমি কী বলছ সাগর?’

‘আমি কিছু বলছি না, যুগ-যুগান্তর ধরে এই নিয়ম চলছে। ঠাকুমা-দিদিমারা আচার বানানোর জন্য টোপাকুল, কাঁচামিঠে আম, আচারের লঙ্কা, আমলকি সবই শুকোতে দিতেন উঠোনে বা নেড়া ছাদে। আমেরিকায় উঠোন বা নেড়া ছাদ বলে কি কিছু আছে স্যার? আপনি জানেন?’

গোকুলবাবু চিন্তিত ভাবে বললেন, ‘উঠোন! নেড়া ছাদ! ছেলের কাছে আমেরিকার অনেক কিছু শুনেছি, উঠোন বা নেড়া ছাদ নিয়ে কিছু শুনেছি বলে তো মনে পড়ছে না।’

আমি সবজান্তা ধরনের হেসে বললাম, ‘ওটাই তো সমস্যা । টোপাকুল শুকোতে পারছে না। আমার মনে হচ্ছে, এই কারণে মাসিমার ফিরতে দেরি হচ্ছে। উঠোন আর নেড়া ছাদ খোঁজার কাজ চলছে। জ্যঁ সাহায্য করছে। বলা যায় না ওখানকার নিউজপেপারে হয়তো বিজ্ঞাপন দিয়ে ফেলেছে এতক্ষণে। বড়লোক দেশে স্যার সব বিজ্ঞাপনে হয়।’

গোকুলবাবু সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকালেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘উঠোন বা নেড়া ছাদ ছাড়া টোপাকুল শুকোয় না? এর পিছনে সায়েন্স কী?’

আমি মাথা চুলকে বললাম, ‘কেন শুকোবে না স্যার? অবশ্যই শুকোবে। আলবাত শুকোবে। কিন্তু তাতে আচারের টেস্ট হবে না। এমনকি স্যার আপনি যদি পাঁচিলওয়ালা ছাদে…।’

বাড়িওয়ালাকে কেউ ‘স্যার’ বলে না। আমিও বলি না। আমি ডাকি ‘মেসোমশাই’। মাঝেমধ্যে ‘স্যার’ ডাকতে বাধ্য হই। তিন মাসের ওপর ভাড়া বাকি পড়ে গেলে ‘পিসেমশাই’ ‘মেসোমশাই’ ডাকা ঠিক নয়। কানে লাগে। ভাড়া মিটে গেলে আবার পুরোনো ডাকে ফিরে আসি। এই সম্বোধন পরিবর্তন গোকুলবাবু মেনে নিয়েছেন। তিনি বকেয়া ভাড়া নিয়ে মুখে কিছু বলেন না। তার মতে বিনা ভাড়ায় অন্যের বাড়িতে গেঁড়ে বসে থাকাটা একধরনের অসুখ। এর জন্য বকাঝকা নয়, চিকিৎসার প্রয়োজন। প্রপার থেরাপি। মিথ্যে বলব না, মানুষটা আমার জন্য নানারকম থেরাপির ব্যবস্থাও করেন। মাঝে একবার বিচ্ছিরি ধরনের খাতির যত্ন শুরু করেছিলেন। খাতির যত্ন থেরাপি। ভালো মন্দ খাওয়া দাওয়া, মাথার কাছে টেবিল ফ্যান, স্নানের জল। এতে লজ্জা পেয়ে যদি ভাড়ার টাকা জোগাড় করি। ট্রিটমেন্ট ব্যর্থ হল। তিন, চার, পাঁচ দিনেও আমার মধ্যে কোনও লজ্জা ভাব এল না। আমি গোকুলবাবুর কাছে গিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বলেছিলাম, ‘আমাকে মুক্তি দিন। চিকিৎসা কাজ করছে না। দিব্যি আপনার খাতির-যত্ন নিচ্ছি। খাচ্ছি দাচ্ছি ঘুমোচ্ছি। আমার খুবই খারাপ লাগছে।’

সেবার আমার কথায় গোকুলবাবু লজ্জা পেয়ে আমাকে মুক্তি দিয়েছিলেন।

সম্প্রতি উনি প্লেট থেরাপি’ শুরু করেছেন। এই থেরাপি খুবই সহজ। ঝামেলা নেই। আমার ঘরের দরজায় নেমপ্লেটের ঢঙে একটা প্লেট লাগানো হয়েছে। যতদিন ভাড়া বাকি হবে প্লেটে চক দিয়ে গোটা গোটা হরফে সেই সংখ্যাটা লেখা থাকবে। সংখ্যা রোজ বদলানো হয়। আগে গোকুলবাবু নিজে এসে সকালবেলা বদলে দিতেন। এখন আমিই নিজেই বদলে নিই। নিজের কাজ নিজে করাই উচিত। বয়স্ক মানুষ উনি কেন এত খাটাখাটনি করবেন? এইমুহূর্তে যেমন লেখা আছে—’৩ মাস, ২ সপ্তাহ ৪ দিন’। আমি উঠে গিয়ে লিখব—’৩ মাস, ২ সপ্তাহ ৫ দিন’।

যাক গে, আগের কথায় ফিরে আসি। আমিও একা আবার গোকুলবাবুও একা। কিন্তু আমার ‘একা’র সঙ্গে তার ‘একা’র পার্থক্য আছে। যাকে বলে গুণগত পার্থক্য। মানুষ না থাকলেও বাড়িওলার সঙ্গে আস্ত একটা বাড়ি থাকে। আমার কী আছে? খান দুয়েক টিউশন। বইপাড়ার প্রুফ। বিভিন্ন জায়গায় ধার বাকি। সুতরাং ভালো কল্পনার জন্য নিজের পিঠ নিজেকেই চাপড়াতে হবে। আমি তক্তোপোষের ওপর উঠে বসে মনে মনে নিজের পিঠ চাপড়ালাম।

‘ওয়েল ডান সাগর। তোমার নীল কালির দিন শুভ হোক। সময় নষ্ট না করে ঝটপট মুখটুখ ধুয়ে নাও বাপু। সাঁ করে বেরিয়ে পড়ো।’

এবার পায়রার রহস্যটা বলি।

পায়রার বয়স এগারো আর বারোর মাঝামাঝি। বিরাট ধুরন্ধর ছেলে। হাফ প্যান্ট, গেঞ্জি, ছোট ছোট চুল। আমার বাড়ির ঠিক উলটো দিকে তার মামার চায়ের দোকান। ফুটপাত টপকালেই। পায়রা সেখানকার ‘ক্যাজুয়াল লেবার’। অস্থায়ী কর্মী। দুনিয়া জুড়ে অস্থায়ী শ্রমিক কর্মচারীরা স্থায়ী হওয়ার জন্য আন্দোলন করে। একমাত্র পায়রার ঘটনা উলটো। সে তার মামার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে স্থায়ী করার প্রতিবাদে। সে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চায়ের দোকানে কাজ করত। হঠাৎ একদিন বেঁকে বসল। বলল, আর পার্মানেন্ট চাকরি করবে না। তাকে দুপুরে চার ঘণ্টা, বিকেলে এক ঘণ্টা এবং রাতে আটটার পর ছুটি দিতে হবে। ব্যাপার কী? সে নাকি স্কুলে ভরতি হবে। দুপুরে চার ঘণ্টার জন্য স্কুলে যাবে, বিকেলে এক ঘণ্টা খেলবে, রাতে দু-ঘণ্টা পড়বে। মামা ভাগ্নের গালে দুটি চড় বসিয়ে দাবি অচিরেই নস্যাৎ করে দেয়। মামার কাছে আশ্রিত ভাগ্নের লেখাপড়ার লাটসাহেবি চলবে না। খুবই উচিত কথা। কিন্তু পায়রা উচিত কথা শুনল না। বদ ছেলেদের যা হয়। সে শুরু করল লড়াই। মালিকের বিরুদ্ধে শ্রমিকের লড়াই? নাকি মামার বিরুদ্ধে ভাগ্নের? লড়াইতে মোটে তিনজন মানুষের সাহায্য নিয়েছিল পায়রা। চায়ের দোকানের ছেলে ছোকরাদের সঙ্গে পাড়ার দু-ধরনের মানুষের সম্পর্ক হয় সবথেকে মধুর। বেকার এবং মাস্তান। এরা চায়ের দোকানে সময় দেয় বেশি। পায়রা পাকড়ালো মাস্তান গেবোকে। গেবো একদিন খটখটে দুপুরে ফ্রিতে চার কাপ গরম চা খেয়ে যাওয়ার সময়ে ঠান্ডা গলায় মামাকে হুমকি দিয়ে গেল।

‘কাল থেকে পায়রাকে স্কুলে না পাঠালে কাচের বয়ামগুলো সব ভেঙে দিয়ে যাব।’

এতে ফিফটি পার্সেন্ট কাজ হয়ে গেল। এরপর পায়রা ধরল তার মামিকে। নি:সন্তান মামি পায়রাকে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসেন। আদরে বাঁদর করার সবরকম উপকরণ সাপ্লাই দেন। পায়রার আবদার শুনে এবারও এগিয়ে এলেন। চায়ের দোকানের বালক শ্রমিককে লেখাপড়া শেখানো ‘বাঁদর’ তৈরি করা ছাড়া আর কী? তিনিও তার স্বামীকে হুমকি দেন। তবে ঠান্ডা গলায় নয়, গরম গলায়। দুপুরে নয়, মাঝরাতে।

‘পায়রার কথা না শুনলে কাল থেকে বাড়িতে রান্নাবান্না বন্ধ। চায়ের দোকানে থাকবে। চা দিয়ে ভাত মেখে খাবে।’

এতে বাকি ফিফটি পার্সেন্ট কাজও হয়ে গেল। দুয়ে মিলে হান্ড্রেড।

শোনা যায়, গোটা অপারেশনের মাস্টার মাইন্ড যার সে একজন বেকার, অলস এবং গুড ফর নাথিং যুবক। সে কে? নাম জানা যায়নি, তবে জানা গেছে, পায়রার মামার চায়ের দোকানে তার বিস্তর ধার বাকি। ধারের খাতায় পাতা শেষ। এখন খাতার মলাটে হিসেব রাখা হচ্ছে। এই লোকের নাম জানতে পারলে পায়রার মামা দোকানে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেবে। পায়রা সেই কারণে নাম গোপন রেখেছে।

এই পায়রা-ই আমাকে ‘ডাক’ পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে। বাড়িতে আমাকে কেউ খুঁজতে এসে না পেলে রাস্তা টপকে চায়ের দোকানে খবর দিয়ে যায়। আমি ফিরলে পায়রা সেই খবর নিয়ে আসে। কখনও কখনও পরদিনও দেয়। আমিই তাকে বলেছি—’আমার কোনও তাড়াহুড়ো নেই। খবর দু-একদিন পরে দিলেও চলবে। আমি তো দমকলের অফিস খুলে বসিনি যে খবর এলেই সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে হবে।’

‘পায়রা খবর দিয়েছে’ কথাটা কেউ সহজ ভাবে নিতে পারে না। সকলে ভাবে ফাজলামি করছি। রাজা-বাদশাদের আমলের কথা বলছি। যখন পায়রার পায়ে চিঠি বেঁধে খবর পাঠানো হত। পায়রা যে একটা ফুটফুটে এবং ছটফটে বালকের নাম কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। নামটাও আমি দিইনি। ঘটনাচক্রে হয়েছে। আসলে সবাই আমাকে ফাজিল বলেই জানে। প্রায় কোনও কথাই বিশ্বাস করে না। ঠিকই করে। মানুষ সিরিয়াস মানুষকে বিশ্বাস করতে পছন্দ করে। সে চোর-ডাকাত হলেও করে, গুন্ডা-বদমাইশ হলেও করে। যে গম্ভীর মুখে বলে, ‘আপনার মানিব্যাগটা না দিলে পেটে ছুরি বসিয়ে দেব’ মানুষ তাকে দ্রুত মানিব্যাগ বের করে দিয়ে দেয়। যে কাঁচুমাচু মুখে বলে, ‘দশটা টাকা দেবেন? সারাদিন খাওয়া হয়নি। আপনার টাকাটা পেলে একটা ট্রাই নিতাম।’ মানুষ তাকে ধমক দিয়ে চোখ পাকিয়ে বলে, ‘খিদে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করিস? ফাজলামি? চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব।’ সত্যি, ফাজিল মানুষকে বিশ্বাস করা যায় না।

খানিক আগে পায়রা খোলা জানলায় মুখ রেখে খবর দিয়েছে। পরিতোষ নাগ এসেছিলেন। আমি যেন আজই তার অফিসে গিয়ে দেখা করি। খুব দরকার। তারপর থেকেই আমি ভেতরে চাপা উত্তেজনা অনুভব করছি। এক তো বহুদিন পর কারও ‘ডাক’ পেয়েছি। তার ওপর পরিতোষ নাগ হেঁজি-পেঁজি কেউ নন। উনি তমালের জামাইবাবু। ওরিজিনাল নয়, শ্বশুরবাড়ির দিকের জামাইবাবু। শুনেছি, পুরুষ মানুষের জীবনে শ্বশুরবাড়ি খুবই সেনসিটিভ একটা বিষয়। গদগদ টাইপ। পুরুষ মানুষের কাছে ওরিজিনাল বাবা, মা, ভাই, বোন, জামাইবাবুর থেকে শ্বশুরবাড়ির বাবা, মা, ভাই, বোন, জামাইবাবুর দাম অনেক বেশি। শ্বশুরবাড়ির জন্য তারা যখন-তখন ওরিজিনাল ত্যাগ করতে পারে। আমি একজনকে চিনতাম যিনি নিজের বাড়ির কুকুর, বিড়ালকে দেখলে ‘দেখ মার, দেখ মার’ করতেন, কিন্তু শ্বশুরবাড়ির বিড়ালের জন্য মন কেমন করে বসে থাকতেন। বিড়ালের নামে কবিতা লিখে শাশুড়িকে প্রেজেন্ট করেছেন।

‘তুমি চলে গেলে চুপিসাড়ে

চোখের আড়ালে, মনের আড়ালে…।’

সম্ভবত এই কারণেই তমাল আমাকে হুমকি দিয়ে রেখেছে, আমি আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে নিয়ে ছেলেখেলা করলে তার কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু তার শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্মীয়স্বজন নিয়ে যেন কখনও কোনও গড়বড় না করি।

‘তোর শ্বশুরবাড়ির লোকের সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?’

‘বলা তো যায় না। যদি হয়। তাই আগেই বলে রাখলাম। খবরদার এদিক ওদিক কিছু করলে তোর বিপদ আছে। কয়েকজনকে তো তুই ভালোই চিনিস। আমার সঙ্গে তাদের বাড়িও গেছিস। গিলেছিস।’

বিপদে ঘাবড়ে যাওয়ার লোক আমি নই। কিন্তু তমালের হুমকি আমার কাছে উড়িয়ে দেওয়ার মতো বিষয় নয়। সে আমার শুধু বন্ধু নয়, আমার প্রথম এবং শেষ ভরসা। হারামজাদা বড় অফিসার। সেই অপরাধে তাকে আমার বহু আবদার শুনতে হয়। সে আমার বহু প্রশ্নের উত্তর। পকেট ফাঁকা? তমালের কাছে যাও। পেটে খিদে? তমালের কাছে যাও। থাকার জায়গা নেই? তমালের কাছে যাও। কাউকে চাকরি দিতে হবে? তমালের কাছে যাও। কারও মেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হবে? তমালের কাছে যাও। প্রতিটা কেসেই সে আমাকে তেড়ে গাল দেয়। ফোন কেটে দেয়, ঘর থেকে বেরও করে দিয়েছে বহুবার। তাতে কাজে কোনও সমস্যা হয়নি। সবথেকে বড় কথা হল, আমার বায়নাক্কা শোনার পরও আমি অনায়াসে তমালের সঙ্গে নানাবিধ বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজ করতে পারি। যেমন, যতবার সে আমার চাকরির চেষ্টা করেছে, ততবার আমি তাকে লজ্জায় ফেলে পালিয়ে গেছি। একবার ইন্টারভিউয়ের দিন…। তার পরও সে আমাকে সহ্য করে। ওর সামান্য অনুরোধটুকু কি শোনা উচিত না? অবশ্যই উচিত। আমি তমালের শ্বশুরবাড়ির দিকের জামাইবাবুর জরুরি প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করব। তার ওপর এই পরিতোষ নাগ ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার বেশ ভালোই চেনাজানা রয়েছে। তমালের বিয়েতে তো বটেই, এমনকি ওদের সল্টলেকের বাড়িতে আমি তমালের সঙ্গে বেশ কয়েকবার গিয়েছি। ভদ্রলোকের স্ত্রী মালবিকা। চমৎকার মহিলা। ফুটফুটে একটা মেয়ে আছে। মেয়েটার নাম পরাগ। ঝকঝকে বুদ্ধি। প্রথম আলাপে তাকে ঘাবড়ে দিতে বলেছিলাম, ‘পরাগ একটা বিচ্ছিরি নাম। তাই না?’ পরাগ বলেছিল, ‘সাগর একটা সুন্দর নাম। তাই না?’

পরিতোষ নাগের ‘জরুরি কাজ’ শুনে আমি ঘাবড়ে গেছি। অফিস ঘরের দরজা বন্ধ করে, গলা নীচু করে খুব সংক্ষেপে ঘটনা বললেন। তারপর টেবিলে রাখা আমার হাতটা চেপে ধরে বললেন, ‘এটা তোমাকে করতেই হবে সাগর।’

আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘আমি কি পারব জামাইবাবু?’

‘পারতেই হবে। তমাল আমাকে বলেছে যদি কেউ পারে সাগরই পারবে।’

আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম, ‘তমাল বলেছে!’

পরিতোষ নাগ কষ্ট করে হেসে বললেন, ‘নইলে জানব কী করে? আমি তোমার মোবাইল নম্বর চাইলাম, ও বলল ফোনটোন কিছু নেই। ঠিকানা দিচ্ছি। আপনি সোজা চলে যান। বাড়িতে না পেলে উলটো দিকের চায়ের দোকানে খবর দিয়ে আসবেন। পায়রা নামের একটা ছেলে আছে, ওকে বললেই হবে।’

আমি সামান্য বিরক্তি দেখিয়ে বললাম, ‘কই! তমাল আমাকে কিছু জানায়নি তো?’

‘বারণ করেছি। বলেছিলাম, আমিই সরাসরি কথা বলব। তাছাড়া আরও একটা কারণ আছে।’

‘কী কারণ?’

পরিতোষ নাগ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কাজটার মধ্যে চেনা-জানার অবলিগেশন রাখতে চাইছি না। আমি প্রফেশনালি করতে চাই। আই শ্যাল পে ফর দ্যাট। তমালকে সেটা বলে নিয়েছি। তুমি না বলবে না।’

আমি ‘না’ বলব না। টাকাপয়সা আমার দরকার। টানাটানি চলছে। টাকাপয়সা ছাড়া আমার ঘরের দরজা থেকে প্লেট উঠবে না। মনে হয়, তমাল আমার টানাটানির গন্ধ পেয়েছে। হারামজাদা সে-ই কারণেই এই বিদঘুটে কাজে জড়িয়ে দিল। সব প্ল্যান। আজ নয়, অড জবসে তমাল আমাকে আগেও ফাঁসিয়েছে। আমি মাথা নামিয়ে বললাম, ‘জামাইবাবু, আপনি গোটা ঘটনাটা কি আর একবার বলবেন? আগেরবার যখন বললেন, তাড়াহুড়োর কারণে পুরোটা বুঝতে পারিনি। আমার কতগুলো প্রশ্নও আছে।’

পরিতোষ নাগ ঘটনা আবার বললেন।

পরাগ ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় দারুণ রেজাল্ট করেছে। এবার বিদেশে যাবে গবেষণা করতে। গবেষণার বিষয় ‘আলো’। ফিজিক্সের ছাত্রী আলো, শব্দ, অণু-পরমাণু নিয়ে গবেষণা করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পরাগের আলো বাছার পিছনে নাকি শুধুই ফিজিক্সের আলো নয় অন্য আলোও আছে। রবীন্দ্রনাথের আলো। আলো বিষয়ক রবীন্দ্রসঙ্গীতে সে নাকি পাগলপারা মেয়ে। সেই আলোর ভেতর সে এবার পুরোপুরি ঢুকে পড়তে চায়। পারলে এক ছুটে প্লেনে গিয়ে ওঠে। আজই। পরাগের বাবা-মা মেয়ের এই উচ্চশিক্ষা সফরের পরিকল্পনা এবং তার বাড়াবাড়ি রকম উৎসাহে এতদিন আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলেন। কিন্তু দুদিন হল মালবিকাদির কাছে গোপন সূত্রে ভয়ংকর খবর এসেছে। আমেরিকাবাসী কোনও একটি ছেলের সঙ্গে পরাগের প্রেম হয়েছে। নরমাল প্রেম নয়, কম্পিউটার প্রেম। সেই ছেলেও নাকি ছাত্র। রোজগারপাতি নেই। বাইরে চলে যাওয়ার জন্য পরাগের ছটফটানির এটাই নাকি আসল কারণ। খবর এখানে শেষ নয়। ভয়ংকরের ওপর আরও ভয়ংকর খবর আছে। মালবিকাদির গোপন সূত্র জানিয়েছে, পরাগ নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ওদেশে গিয়ে আগে বিয়ে করবে তারপর অন্য কাজ।

পরিতোষ নাগ থামলেন। আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘এতে সমস্যা কোথায়?’

‘সমস্যা কোথায়? কী বলছ সাগর! যাকে মেয়ে কোনওদিন চোখেই দেখল না, তাকে বিয়ে করবে! তোমার দিদির সোর্স বলেছে, দুজনের আলাপ পরিচয় ঘনিষ্ঠতা সবই থ্রু কম্পিউটার। ভারচ্যুয়াল। তোমাদের ওইসব আছে না? ফেসবুক না কী যেন?’

আমার অবাক ভাব কাটল না। বললাম, ‘আজকাল তাই হয় জামাইবাবু। কম্পিউটারে আলাপ, বন্ধুত্ব, প্রেম, বিয়ে। ক্যালিফোর্নিয়ার সঙ্গে ক্যানিং, হালিশহরের সঙ্গে হনুলুলু, সল্টলেকের সঙ্গে সিডনি, টোকিওর সঙ্গে টালাপার্ক। এমন তো আকছার হচ্ছে। ভারচ্যুয়াল রিয়েলিটি টু হার্ড রিয়েলিটি।’

পরিতোষ নাগ প্রায় ধমকে উঠলেন, ‘রাখো তোমার রিয়েলিটি। মুখ দেখা নেই, গলা শোনা নেই প্রেম, বিয়ে সব হয়ে গেল! জীবন অত সহজ? কম্পিউটারের কি-বোর্ড টিপে আর মাউস নেড়ে সম্পর্ক? ছেলেমানুষরা খেলনা নিয়ে বিপজ্জনক খেলায় মেতেছে।’

আমি বিনয়ের সঙ্গে হেসে বললাম, ‘এটা কেমন কথা বলছেন জামাইবাবু! আজকাল কম্পিউটারে লাইভ ছবি দেখা যায়, গলা শোনা যায়।’

পরিতোষ নাগ তেড়েফুড়ে উঠলেন, ‘ছবির সঙ্গে আলাপ পরিচয় করে বিয়ে পর্যন্ত এগিয়ে যেতে হবে! ছবি আর মানুষ কি এক?’

আমি বললাম, ‘তাতে কী হয়েছে? আপনার মেয়ে বিয়ে তো আর ছবিকে করছে না, মানুষকে করছে। সে খুবই বুদ্ধিমতী। নিজের ভালোমন্দ বোঝে।’

পরিতোষ নাগ আরও কঠিন চোখে আমার দিকে তাকাতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন। একটু থেমে থমথমে গলায় বললেন, ‘তোমার দিদি রাতে ঘুমোতে পারে না। ঘুমোলে দু:স্বপ্ন দ্যাখে। তুমি জানো না সাগর এই সব কম্পিউটার আলাপ পরিচয় খুব খারাপ জিনিস। ফাঁদ। তোমার দিদির এক পরিচিত ছেলের এই ঘটনা ঘটেছে। জাপানের কোন মেয়ে তাকে…সেই ছেলে কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়েছে। জাপান যাওয়ার জন্য পাগলের মতো করছে। কে জানে পরাগ সেরকম কোনও ফাঁদে পা দিল কিনা। নিশ্চয় দিয়েছে। কতরকম ক্রাইম হয়।’

আমি শান্ত গলায় বললাম, ‘ফাঁদ না গুপ্তধন, ওখানে না গেলে তো পরাগ বুঝতে পারবে না।’

পরিতোষ নাগ বললেন, ‘ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার আমার মেয়ের হয়ে যাবে। আমি কিছু শুনতে চাই না। তুমি পরাগকে বোঝাবে। আমাদের কোনও কথাই সে শুনতে চাইছে না।’

আমি বললাম, ‘আমি বোঝাব! আমার কথা পরাগ শুনবে কেন?’

‘হ্যাঁ, যদি কারও কথা শোনে ওই গাধা মেয়ে তোমার কথাই শুনবে। আমাকে তমালও তাই বলেছে। ঠিকই বলেছে। পরাগ তোমাকে খুব বেশিদিন দ্যাখেনি, কিন্তু যে-ক’দিন দেখেছে তোমাকে পছন্দ করে ফেলেছে। দুনিয়ায় এত লোক থাকতে আমি এমনি এমনি তোমার শরণাপন্ন হইনি।’

পরিতোষ নাগের কথায় আমি লজ্জা পেলাম। আমাকে বিশ্বাস করে! তাও আবার কমবয়সি ছেলেমেয়ে? অসম্ভব। এই জেনারেশনের ছেলেমেয়েদের খুব বুদ্ধি। তারা চট করে বুদ্ধি বুঝতে দেয় না। জগৎ সংসার সম্পর্কে উদাসীন মুখ করে ঘুরে বেড়ায়। অথচ জগৎ সংসার নিয়ে ওরাই সবথেকে বেশি চিন্তিত। একটা পিঁপড়ের ওপর অবিচার হলেও ফেসবুকে লাঠালাঠি শুরু করে দেয়। পরাগ তো তাদেরই একজন। সে কোন দু:খে আমাকে বিশ্বাস করতে যাবে? চেয়ারের হাতলে হাত ঘসতে ঘসতে বললাম, ‘আমাকে বিশ্বাস করার মতো কী করেছি? খুব বেশি হলে তো মোটে তিন বা চারদিন আপনার মেয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। মাস তিনেক আগে একদিন হঠাৎ কলেজ স্ট্রিটে দেখা হয়ে গেল। পরাগ বলল, খুব খিদে পেয়েছে। চলুন কফি হাউসে ঢুকে চিকেন কাটলেট খাই। আমি বললাম, আমারও খুব খিদে পেয়েছে। কিন্তু আমার কাছে চিকেন কাটলেটের পয়সা নেই। পরাগ বলল, কোনও সমস্যা নেই, আমার কাছে ধার নিন। আপনি তো ধার নেওয়ায় স্পেশালিস্ট।’

পরিতোষ নাগ মন দিয়ে আমার এই সামান্য গল্প শুনলেন। তারপর কাতর গলায় বললেন, ‘তুমি আজই আমাদের বাড়িতে যাও সাগর। তুমিই পারবে। পরাগকে বোঝাও। সে যেন ওই ছেলের সঙ্গে কোনওরকম সম্পর্ক না রাখে। নইলে বিদেশ বিভুঁইয়ে গিয়ে বিরাট বিপদে পড়বে। আমার তো মনে হচ্ছে, আপাতত ওর রিসার্চের প্রাোগ্রামটাই বন্ধ রাখা উচিত। যা করার এখানে করুক। দিল্লি যাক। তারপর বিয়ে থা করে…। তুমি যে করেই হোক ওকে বোঝাও। অ্যাট এনি কস্ট। আশাকরি তুমিও নিশ্চয় চাও না পরাগের মতো একটা সুন্দর বুদ্ধিমতী মেয়ে জালিয়াতের পাল্লায় পড়ুক।

আমি শেষ চেষ্টা করলাম। বললাম, ‘জামাইবাবু, হতে পারে ছেলেটা ভালো। আমরা মিথ্যে ভয় পাচ্ছি। হতে পারে না? আমি যদি অন্য ভাবে খোঁজ খবর নিই? আমার পরিচিত একজন এখন ওদেশে আছেন। টোপা কুল শুকোচ্ছেন…।’

‘কী! কী শুকোচ্ছে?’

ভুরু কোঁচকালেন পরিতোষ নাগ। ব্যথিত গলায় বললেন, ‘তুমি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ সাগর? এটা কি ঠাট্টা করবার সময়? তুমি নিজেকে আমার জায়গায় প্লেস করে দ্যাখো তো।’

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ‘সরি। আমি বলছিলাম একবার ক্রশ চেক করা যায় না? ছেলেটার নাম কী? ঠিকানা? কোন শহর? নিউইয়র্ক?’

পরিতোষ নাগ জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললেন, ‘ওসবে কোনও লাভ হবে না। কম্পিউটারে সব বানানো যায়। মানুষের মুখ পর্যন্ত বদলে দেয়। হয়তো সত্যি কোনও ভালো ছেলের মুখ খারাপ লোকের মুখে বসিয়ে নিয়েছে। তুমি পরাগকে বারণ করো।’ একটু থেমে পরিতোষ নাগ বললেন, ‘তোমার কত টাকা লাগবে সাগর?’

আমি চুপ করে রইলাম। কথাটা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। পরাগ সত্যি সত্যি একটা গোলমালের মধ্যে জড়িয়ে পড়ছে না তো? হতে পারে। আজকাল সাইবার ক্রাইম মারাত্মক চেহারা নিয়েছে। আগে থেকে কিছু বোঝা যায় না। পায়রাদের দোকানে বসে আমি খবরের কাগজে এই বিষয়ে একটা গা ছমছমে ফিচার পড়েছি। কলকাতাতেই এসব অপরাধ অনেক হচ্ছে। আমেরিকাতে না জানি কত। যে কোনও ধরনের অপরাধে ওই দেশ সবার আগে যেতে পারে। পরাগের মতো একটা চমৎকার মেয়ে যদি ফেঁসে যায় সেটা খুবই দু:খের হবে।

পরিতোষ নাগ আবার বললেন, ‘তোমার কত টাকা লাগবে বললে না?’

আমি হেসে বললাম, ‘দাঁড়ান কাজটা আগে পারি।’

‘তুমি পারবে।’

আমি উঠে দাঁড়িয়ে পরিতোষ নাগের চোখে চোখ রেখে বললাম, ‘আপনারা কী চান বলুন তো?’

‘আমরা চাই আমাদের একমাত্র মেয়ে এখানে বিয়ে করুক। কম্পিউটার বিয়ে নয়, সত্যি বিয়ে। তার ভবিষ্যৎ নিরাপদ হোক। তারপর সে পৃথিবীর যেখানে গিয়ে লেখাপড়া করতে চায় করবে।’

আমি ঠান্ডা গলায় বললাম, ‘পাত্র?’

‘ঠিক আছে। তোমার মালবিকাদির বন্ধু সম্বন্ধ এনেছে। মজার কথা হল, সে-ও আমেরিকাবাসী। বড় চাকরি করে। গলফ খেলায় এক্সপার্ট। ট্রফি হাতে ফটো আছে। সে পরাগের বয়ফ্রেন্ডের মতো ভারচ্যুয়াল নয়, রিয়েল। তুমি প্রস্তাব দেবে পরাগ ইয়েস বললেই আমরা এগোব। এখন বৈশাখ, সেরকম হলে শ্রাবণেই বিয়ে হবে। ছেলে রেডি। ডাকলেই চলে আসবে। তারপর আমরা দল বেঁধে আমেরিকায় বউভাতে যাব। তুমিও যাবে। পাসপোর্ট আছে?’

আমি মাথা চুলকে বললাম, ‘প্রস্তাবটা আপনারা কেউ দিলে হত না? তমাল?’

‘তমালের শ্বশুরবাড়ির দিকের জামাইবাবু’ ভদ্রলোক এবার টেবিল টপকে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। হাত দুটো ধরে বললেন, ‘আমরা তোমাকে বিশ্বাস করি সাগর। আমরা সবাই তোমাকে বিশ্বাস করি। পরাগও করে। অনেক ভেবেচিন্তেই আমরা ঠিক করেছি, এই বিশ্বাস আমরা কাজে লাগাব। তোমার কত লাগবে?’

আমি একটু হেসে বললাম, ‘তিন মাস, দু-সপ্তাহ চারদিনের বাড়ি ভাড়া বাকি। না না চার নয় পাঁচদিন।’

পরিতোষ নাগ আমাকে অফিসের লিফট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘আমি জানি তুমি পরাগকে কনভিনস করাতে পারবে। কিছু কিছু মানুষ জন্মায় যারা অন্যকে নিজের ইচ্ছের মধ্যে নিয়ে আসতে পারে। তমাল বলেছে, তুমি সেরকমই একজন মানুষ। কাজটা হয়ে গেলে তোমার ঘরের একবছরের ভাড়া আমি তোমার বাড়িওলার হাতে অ্যাডভান্স দিয়ে আসব। বেস্ট অব লাক।’

রাস্তায় নেমেই আমার প্রথম গোকুলবাবুর কথা মনে পড়ল। একবছরের ভাড়ার টাকা হাতে পেয়ে মানুষটার প্রতিক্রিয়া কী হবে? তিনি কি ভয় কাঁপতে শুরু করবেন? নাকি অজ্ঞান হয়ে যাবেন?

পরাগের সঙ্গে কাজ শেষ। শ্রাবণ মাসের আগেই যাতে সে এখান থেকে কেটে পড়তে পারে তার জন্য সবরকম প্ল্যান প্রাোগ্রাম করে এসেছি। সেই প্ল্যান এখনই বলে দেওয়া ঠিক হবে না। ও রওনা হয়ে যাক তারপর বলব। পরাগ খুব খুশি। সকলে ভাববে এটা বিশ্বাসঘাতকতা হল। তমালের শ্বশুরবাড়ির কেস নিয়ে গড়বড় করলাম। দুটোর একটাও ঠিক নয়। ভেবেছিলাম ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে পরাগ আমার মতো কোয়ার্টার চেনা একজন মানুষের সঙ্গে কোনওরকম আলোচনায় যেতে রাজি হবে না। হালকা ধরনের অপমানও করবে। বয়েসে ছোট হলেও সেই অপমান আমি গায়ে মাখব না। কিন্তু ঘটনা হল অন্যরকম। পরাগ খুব উৎসাহের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিল। সুন্দর হেসে বলল, ‘আপনি কি ভারচ্যুয়াল রিয়েলিটি আর রিয়েলিটির কোনও সমস্যায় পড়েছেন সাগরমামা। আমার বাবা-মায়ের মতো?’

আমি স্মার্ট হাসার চেষ্টা করি। বলি, ‘আমি তো তোমার মতো ফিজিক্সের ছাত্র নই। এই জটিল বিষয় নিয়ে সমস্যায় পড়াটা কি আশ্চর্যের?’

‘অবশ্যই আশ্চর্যের নয়। কোনও সমস্যার মধ্যে পড়াটাই আশ্চর্যের নয়। তবে সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা থাকা উচিত। সেটা না থাকা আশ্চর্যের। পৃথিবীর সব প্রাণী সমস্যা থেকে বেরোতে চায়, একমাত্র মানুষই চায় সমস্যার মধ্যে ঢুকতে। আবার বেরিয়েও আসে।’

পরাগের কথা ইন্টারেস্টিং। সেটাই স্বাভাবিক। এই প্রজন্মের মানুষ। ইন্টারেস্টিং কথাই বলবে। খোঁচা দিলে এই বুদ্ধিমতী মেয়ে আরও ইন্টারেস্টিং কথা বলবে। আমি খোঁচা দিলাম।

‘কম্পিউটারের মাধ্যমে আলাপ পরিচয়ের পর তুমি একটি ছেলেকে ভালোবেসেছ পরাগ। এই ভালোবাসাকে তুমি কী বলবে? ভারচ্যুয়াল? নাকি রিয়েল?’

পরাগ হেসে ফেলল, ‘আমি আপনার ইঙ্গিত বুঝতে পারছি। যদি এই ভালোবাসা ভারচ্যুয়াল রিয়েলিটির মধ্যে পড়ে সমস্যা কোথায়? আপনি যখন কম্পিউটারে বসে ট্রেন-প্লেনের টিকিট কাটছেন, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট অপারেট করছেন সেটাও তো একধরনের ভারচ্যুয়াল রিয়েলিটি। শব্দটার বাংলা কী হতে পারে? প্রায়-বাস্তব? পারফেক্ট হল বলে মনে হচ্ছে না, তবে কাছাকাছি হয়েছে। তাই না? যাই হোক আসল বাস্তবের বহু গুণই প্রায় বাস্তবের মধ্যে থাকে। এটাই নিয়ম।’

‘যদি প্রায়-বাস্তব আর আসল বাস্তবে বিরাট ফারাক হয়ে যায়?’ পরাগকে লক্ষ্য করে আমি তির ছুঁড়ি।

পরাগ বলল, ‘সেটা একধরনের ডায়মেনশনাল ফারাক হবে। কম্পিউটারের ওয়েব ক্যামে দেখা আপনার ছবি আর সামনে দেখা আপনি কি এক? অথচ দুজনেই এক মানুষ। তাই তো? যে আলো তরঙ্গ আপনাকে কম্পিউটারের মধ্যে দিয়ে আমার কাছে এনে ফেলছে সে আপনার সব ডায়মেনশন আনছে না। আনতে পারছে না। আলো জিনিসটাই রহস্যময়? যুগ যুগ ধরে গবেষণা করেও তার সব রহস্যের সমাধান হল না। সে সবটা দেখায় না। যতটা দেখায় কেন দেখায় তাও সর্বদা স্পষ্ট করে না। মানুষের মুখ আলো দেখাতে পারে, মানুষের মন? অথচ দেখুন সাগরমামা, মানুষের আলো তো আসলে মনেরই আলো। তাই না? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খানিকটা বলেছেন।’

চমৎকার! দারুণ! আমি পরাগের কথায় এত মুগ্ধ হচ্ছি কেন! এই ছোট মেয়েটার কাছে আমি কি হেরে যাচ্ছি? পরাগ কি তার ইচ্ছের ভেতরে আমাকে ঢুকিয়ে নিচ্ছে?

নীচু গলায় বললাম, ‘তাই?’

অবশ্যই তাই। তাই উনি লিখতে পেরেছেন, ‘আলো যে আজ গান করে মোর প্রাণে গো। কে এল মোর অঙ্গনে কে জানে গো।’

অনেক হয়েছে, আর নয়। আর থাকলে এই মেয়ে আমাকে একেবারে ধরাশায়ী করে ফেলবে। এবার কন্ট্রোল নেওয়া দরকার। আমি মনে জোর এনে বললাম, ‘পরাগ, ওই ছেলে বাস্তবে যদি খারাপ হয়? জাল হয়? ভারচ্যুয়াল রিয়েলিটি তো একরকম মায়াও বটে।’

পরাগ আমার দিকে একটু তাকিয়ে থেকে বলল, ‘দাঁড়ান, আমি আপনাকে একটা জিনিস দেখাই। আপনি খুশি হবেন।’

পরাগ ফিরল হাতে খাম নিয়ে। বিদেশ থেকে উড়ে আসা খাম। খামের ভেতর সাদা পাতায় নীল কালি দিয়ে এলোমেলো, আঁকাবাঁকা, ছড়ানো হাতে ইংরেজিতে লেখা। বাংলা করলে সেটা এরকম— ‘পরাগ, তুমি তাড়াতাড়ি এসো। আমি অপেক্ষা করে আছি।’

আমি পরাগের দিকে তাকালাম। পরাগ মাথা নামিয়ে আছে। সেই অবস্থাতেই বিড়বিড় করে বলতে থাকে।

‘ও অন্ধ সাগরমামা। হি ইজ ব্লাইন্ড। ব্রেইলে পড়াশোনা শিখে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত গেছে। কম্পিউটারে বসে আমার সঙ্গে যখন কথা বলে তখন বারবার জানতে চায়, আমি কি কোনও ভুল করে ফেলছি? কোনও কী ভুল টিপছি? আমি কি ভুল লিখলাম? একটা ভারচ্যুয়াল জগতের মধ্যে দিয়ে সে আমার জীবনের সবথেকে কঠিন বাস্তব স্পর্শ করেছে। আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছি। পাগল ছেলে একটা। প্যাডের পাতায় লিখে, খামে মুড়ে আমাকে একটা রিয়েল প্রেমপত্র পাঠাবে বলে ও এই লেখাটা প্র্যাকটিস করেছে তিন মাস ধরে। এটা একটা পাগলামি না?’ পরাগ থামল। তার চোখ চকচক করছে। জলে? নাকি আলোয়? সামান্য হেসে বলল, ‘মজার কথা কী জানেন সাগরমামা, আমি এই চিঠি একবারের জন্যও চোখ দিয়ে পড়িনি। অন্ধ মানুষের মতো হাত বুলিয়ে পড়েছি। আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করছেন?’

আমি ফিসফিস করে বলি, ‘অবশ্যই করছি পরাগ। অবশ্যই।’

পরাগ মুখ তুলল। নীল কালির লেখা চিঠি ভাঁজ করে খামে ভরতে ভরতে বলল, ‘বাবা-মাকে এত কথা বলিনি। মেয়ে অন্ধ ছেলেকে বিয়ে করছে জানলে দু:খ পাবে। অথবা কে জানে হয়তো জেনে গেছে। তাই নানা ভাবে আটকাতে চাইছে। আরও চাইবে। ওদের কোনও দোষ নেই। এবার আপনি বলুন। আমি কি ভুল করছি? একজন অন্ধকারে থাকা মানুষের কাছে আলো নিয়ে যাওয়া কি ভুল?’

পরাগ হাসল। আমি মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। এই মেয়ে আলো নিয়ে গবেষণা করবে কী! এর হাসিই তো আলোয় ভরা!

উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘চলো পরাগ, তোমার বিয়ে উপলক্ষে আজ আবার আমরা কফি হাউসে চিকেন কাটলেট খাব এবং আজও তুমি আমায় ধার দেবে। তা ছাড়া আজ আমারও একটা স্পেশাল ডে।’

পরাগ কৌতূহলে উজ্জ্বল চোখে বলল, ‘তাই নাকি! আজ আপনার কী?’

আমি লাজুক হেসে বললাম, ‘আজ আমার নীল কালির দিন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *