আমার নাটক দেখা, নাটকে জীবন দেখা
আমাদের আদি নিবাস, পূর্ববঙ্গের গ্রাম, সাতক্ষীরার কাছেই। ধূলিহর ধুরলের কথা তেমন মনে নেই। তবে বাড়ির একটা কামরায় নাটকের বা যাত্রার সিন থাকত গোটানো তা মনে আছে। সেই সময় নাটক বা যাত্রায় সিন থাকত। নদী, গ্রাম, শহর, তাজমহল, দুর্গ ইত্যাদি। যাত্রা কিংবা থিয়েটার হতো সমস্ত রাত ধরে। শেষ রাত বা মধ্যরাতে সকলে বাড়ি ফিরত। কাজকম্মো সেরে, গৃহবধূ সমেত পরিবার গিয়ে বসত থিয়েটার বা যাত্রার আসরে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে আমোদ। সেই গল্পে ভূমিহীন চাষাটি একদম পেছনে দাঁড়িয়ে, ডিঙি মেরে মেরে কী দেখল, কী দেখল না, সমস্ত রাত কাটিয়ে, বাজনা আবছা শুনে, ডায়ালগ একটু শুনে শুনে রাত পার করে দিল। দেখুক না দেখুক, আমোদ তো হলো। থিয়েটার শেষ হতে ভোর। সে চলল জমিতে। নিড়েন দেবে। সেই দেখা নিয়ে সে কতদিন বুঁদ হয়ে থাকবে। এই অল্পতে খুশি হওয়াই সাধারণের জীবন দর্শন। আর এও মনে হয়, থিয়েটারের দর্শনও তাই। থিয়েটারে মোটর রেসিং নেই, হেলিকপ্টারে করে খল নায়কের পালানো নেই, শতবার পোশাক বদলে নৃত্যগীত নেই, কিন্তু থিয়েটার হাউসফুল। হ্যাঁ, অনেক থিয়েটার দর্শক আনুকূল্য পায় না, সে তো বহু সিনেমাও লোকে দ্যাখে না। না, আমি সিনেমা থিয়েটারের তুলনামূলক আলোচনা করতে আসিনি। থিয়েটার সম্পর্কে আমার জ্ঞান তেমন নয়, সিনেমাও তেমন জানি না। দুটোই নিজের মতো করে দেখেছি অনেক। মনের টানে, নিজের প্রয়োজনে দেখেছি। দেখে ঋদ্ধ হয়েছি। আমার কাছে বই আর থিয়েটার, সিনেমা শ্রেষ্ঠ বিনোদন। বিনোদন শব্দে কোনো আপত্তি দেখি না। কেন না ভিন্ন ভিন্ন রুচির মানুষের কাছে বিনোদনের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। মারীচ সংবাদ, রাজরক্ত বা চাকভাঙা মধু আমাকে মোহিত করেছিল প্রায় বছর ৪৭-৪৮ আগে, প্রযোজনা অভিনয় আমাকে মুগ্ধ করেছিল বলেই না বার বার দেখেছিলাম। আমার মনের অনেক চাহিদা আছে। সেই চাহিদা পূরণ করে থিয়েটার ও বই, এবং সিনেমাও। থিয়েটার হলো দৃশ্য কাব্য। আমি তার কথা বলতে চেষ্টা করব।
ছেলেবেলা কেটেছে দণ্ডীরহাট নামের একটি গ্রামে বেশ কিছুদিন, পরে বেলগাছিয়া। দণ্ডীরহাট গ্রামটি ছিল থিয়েটার আর খেলা, দুয়েই পাগল। পাশে একটি বিল জমি পেরিয়ে ধলতিথা। বিভূতিবাবুর পথের পাঁচালী উপন্যাসে ধলতিথার কথা আছে। ধলতিথা পেরিয়ে পানিতরে তাঁর প্রথম বিবাহ। থাক, দণ্ডীরহাট গ্রামের থিয়েটারের কথা বলি। আমি তখন কত হবো, বছর সাত-আট, মা-কাকিমাদের সঙ্গে গিয়ে প্রথম অসামান্য এক থিয়েটার দেখি, ডি.এল.রায়ের শাজাহান। শাজাহানের ভূমিকায় ছিলেন আমাদের গ্রামের অতিমান্য এবং শ্রদ্ধেয়জন, সুধীর বসু। তিনি ওই গ্রামের পোস্টমাস্টার ছিলেন। তাঁর ভাই সূরথবাবু ছিলেন স্থানীয় স্কুলের হেড মাস্টার, থিয়েটার সাহিত্যে উৎসাহী। সেই শাজাহান নাটকে জাহানারার ভূমিকায় ছিলেন মমতা চট্টোপাধ্যায়, সেই আমলের এক বিখ্যাত অভিনেত্রী। দারার ভূমিকায় শ্যামল ঘোষ, দিলদার মনোজ মিত্র। মনোজ মিত্রই হয়তো এই আয়োজন করেছিলেন। মনে আছে শাজাহান এবং জাহানারার হাহাকারের কথা, দূরে তাজমহলের মাথায় পূর্ণচন্দ্র। সিন আর গ্লোব আলো দিয়ে তা ফোটানো হয়েছিল। বিস্ময়ের ঘোর কাটতে কয়েকদিন কেটেছিল। যাঁকে নিত্য দেখি তিনি কীভাবে মঞ্চে শাজাহান হয়ে গেলেন। সেই প্রথম দেখা এখনো অবিকল মনে আছে। আমাদের ওই গ্রামে তরুণ ভট্টাচার্য নামে এক যুবক ছিলেন থিয়েটার আর বই পাগল। আমি ক্লাস সিক্স এবং সেভেন ওই গ্রামের ইস্কুলে পড়েছিলাম। তারপর পালিয়ে কলকাতা চলে আসায় কলকাতার বাসা বাড়ি বেলগাছিয়ায় ফিরে এলাম। কিন্তু ঐ দুবছরেই তরুণ’দা আমাকে থিয়েটার আর বই পড়ায় দীক্ষিত করেন। দণ্ডীরহাট গ্রামের বসু জমিদারদের রেখে যাওয়া বাড়িতে ছিল বড় এক পাঠাগার। সেই পাঠাগার ছিল তরুণ’দার দায়িত্বে। এ ব্যতীত তিনি ছিলেন পোস্ট অফিসের ডাক পিয়ন। চিঠি বিলি করতেন। সাব পোস্ট অফিসের অনেক কাজই করতেন। চিঠিতে সিল মারা, ডাকের থলেতে ভর্তি করা। হরকরার চিঠি রিসিভ করা… সব। আড়াইটে অবধি হয়তো এই কাজ, তারপর লাইব্রেরি। আমাকে হেমেন্দ্রকুমার রায় থেকে দীনেন্দ্রকুমার রায়ের রবার্ট ব্লেক, অনুবাদে অলিভার টুইস্ট, এ টেল অফ টু সিটিজ, হ্যাঞ্চব্যাক অফ নতরদম…। কত বই দিয়েছেন। তাঁর উচ্চাশা ছিল বড় অভিনেতা কিংবা থিয়েটার পরিচালক হবেন। গ্রামের বালকদের নিয়ে প্রায়ই তিনি থিয়েটারের আয়োজন করতেন। আমার প্রথম অভিনয় সুনির্মল বসুর কিপ্টে ঠাকুরদা নাটকে। ঠাকুরদা হয়েছিলেন তরুণদা।… … …। নিজেরাই স্টেজ বেঁধেছি হরিতলায়, হ্যাজাগ ভাড়া করা হয়েছে চাঁদা তুলে। রাত আটটায় অভিনয় আরম্ভ। মা-কাকিরা হেরিকেন নিয়ে থিয়েটার দেখতে হাজির। হঠাৎ হঠাৎ থিয়েটারের নেশা জাগত। পাঠ্য পুস্তক কিশলয় বা পাঠসঞ্চয়নের নাট্যাংশ নিয়ে নিজেরা রিহার্সাল আরম্ভ করতাম। অমল ও দইওয়ালা, হলদিঘাটের যুদ্ধ এসব আমরা বালকেরাই করতাম। দুটি পরপর অভিনয় হচ্ছে। এমন নাটক পাগল গ্রাম আর দেখিনি। আমি তো সমস্ত জীবনে কম গ্রাম ঘুরিনি। কোথাও দেখিনি। কিশোর বালকেরা থিয়েটার করছে, তা দেখতে রাতের বেলা গাঁ ভেঙে পড়ছে প্রায়, আশ্চর্য লাগে এখন। আমিও ছেলেবেলায় অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। প্রায়ই নেমে পড়তাম নাটক নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের প্রহসন ছাত্রের পরীক্ষায় ছাত্র হয়েছি, আরো কী কী যেন অভিনয় হয়েছিল। হ্যাঁ, তরুণদাকে নিয়ে আমি একটি উপন্যাস লিখেছিলাম, মালতী মাধব। ডাকপিয়ন তরুণদা ছিলেন সেখানে অলৌকিক হয়ে। বেনামে চিঠি লিখে ডাকপিয়ন ডাকঘরের সিল মেরে সেই চিঠি যাকে গোপনে ভালবাসতেন, তার কাছে পৌঁছে দিতেন।
কলকাতায় তখন রবীন্দ্রজয়ন্তীতে ইস্কুলে পাড়ায় রবীন্দ্রনাটক করার রেওয়াজ ছিল। বাড়ির ছাদেও মঞ্চ বেঁধে অভিনয় হতো ছাত্রের পরীক্ষা, পেটেও পিঠে…। ইস্কুলে আমি মুকুট নাটকে হয়েছিলাম ধুরন্ধর। প্রাইজ পেতে পেতে পাইনি। রাজধর যে হয়েছিল, সে পেয়েছিল। পরিবারে দেখেছি অগ্রজ নাটক নিয়ে থাকেন। ঠাকুরদাকে নিয়ে মৃত্যুর চোখে জল নাটক লিখে তাঁর নাম হয়েছে। তখন ক্লাস ফাইব, আনন্দ- বাজারে নবনাট্য আন্দোলন নিয়ে লিখতেন প্রবোধবন্ধু অধিকারী। দাদাকে নিয়ে লিখেছিলেন তিনি। ছবি সমেত সেই লেখা বেরিয়েছিল, পরম বিস্ময়। সুতরাং আমি নাটক লিখব এবং অভিনেতাও হবো, এই ছিল সুপ্ত বাসনা। ক্লাস এইটে ঋতায়ন নাট্যদলের ‘নীলা’ নাটকে আমি বড় একটি রোল করেছিলাম। আনন্দ। আনন্দবাজার নাট্য সমালোচনায় লিখেছিল, ‘বাবুজি মিত্রের আনন্দ নিরানন্দ নয়। ‘বাবুজি’ আমার ডাক নাম। নীলার দুটি অভিনয়ে আমি ছিলাম, মিনার্ভা ও থিয়েটার সেন্টারে। মিনার্ভায় অভিনয় করতে গিয়ে দেখেছিলাম কল্লোল নাটকের জাহাজের সেট। এখন মনে পড়লে শিহরিত হই। আমি কল্লোল দেখিনি। কত নাটক দেখিনি, কত বই পড়িনি, এমন তো হয়েই থাকে। ক্লাস ইলেভেনে ‘বিনি পয়সার ভোজ’ – অক্ষয়বাবুর সেই স্বগত কথনে আমি চরিত্র বসিয়ে নাটক বানিয়ে মঞ্চায়িত করলাম বন্ধুদের নিয়ে। আমিই অক্ষয়বাবু। এরপর কলেজ। তখন গল্প লেখা চলছে আর নাটকও। পাড়ার একাঙ্ক নাট্য প্রতিযোগিতায় নাটক নিয়ে নামলাম, পার্থপ্রতিম চৌধুরীর একাঙ্ক। আমি অভিনেতা এবং নির্দেশক। কিছু হলো না। খেলনা পিস্তলকে রিভলবার বানাতে আলকাতরা দিয়ে কালো করেছিলাম। সিল্কের পাঞ্জাবির পকেটে সেই পিস্তল আটকে গিয়েছিল। লাইটম্যান মঞ্চটাকে ভুতুড়ে করে দিয়েছিল। চরিত্রদের দেখাই যাচ্ছিল না। কলেজ ছিল স্কটিশ চার্চ। নাটকে সাহিত্যে সেই কলেজের কত সুখ্যাতি। আমি কেমিস্ট্রি অনার্স। যে উদ্দেশে স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম, তা সফল হলো না। বার্ষিক অনুষ্ঠানে ঋত্বিক ঘটকের ‘জ্বালা’ অভিনয় হবে, গেলাম যদি একটা চান্স হয়। পেলাম না। গল্প দিলাম কলেজ ম্যাগাজিনে, নির্বাচিত হলো না। নাটক আর গল্প লেখার জন্য স্কটিশে ভর্তি হয়ে কোনোটাতেই সুবিধে হলো না। আর রেজাল্টও খারাপ হলো। স্কটিশ চার্চ কলেজে তখন কেয়া চক্রবর্তী পড়াতেন। দূর থেকে দেখতাম। কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল ও নিশীথ ভড়ের তখনই খুব নাম। এত অতি সাধারণ হয়ে কলেজ ত্যাগ করেছিলাম যে কলেজের শতবর্ষ উৎসবেও আমার ডাক আসেনি। কিন্তু আমার মাথায় নাটক আর সাহিত্যের ভূত হয় তো স্কটিশ চার্চ কলেজই দিয়েছিল। বাংলাদেশ নিয়ে তরুণ সান্যালের বক্তৃতা এখনো স্মৃতিতে অমলিন। কত ডিবেট, সাহিত্যের অধ্যাপক- দের সেমিনার, আমি রসায়নের ছাত্র, একাই শুনতাম। সত্তর দশক। নক্সাল আন্দোলন, জেলখানায় সহপাঠী বন্ধুরা, বাংলা নাটক তখন প্রতিবাদের মুখ। আমি তখন থেকে নাটকের পোকা। নাটক দেখছি সুযোগ পেলেই। মনে পড়ে এবং ইন্দ্রজিৎ দেখতে দুপুরে মুক্তাঙ্গনে গিয়ে টিকিট কেটেছি, সময়ে এলে যদি টিকিট না পাই। চারঘন্টা অপেক্ষা করেছি একা একা। তারপর নাটক দেখে ২ নম্বর ডাবল ডেকার বাসে চেপে দক্ষিণ থেকে উত্তরে। তখন টিউশনি ভরসা। সেই সময়ে আমি নাট্যরূপ দিলাম চেকভের গল্প। মুখোস। সেই নাটক সূত্রে এক বন্ধু হলো, তার নাম গৌতম লাহিড়ী। পাইকপাড়ায়, দু’নম্বর বাস স্ট্যান্ডের কাছে থাকতেন, গণেশ মুখোপাধ্যায়ের নাট্যদল শ্রীমঞ্চে অভিনয় করতেন। গৌতম আমার ওই চেকভের গল্পের নাটক চেষ্টা করলেন মঞ্চে আনার। হলো না। কিন্তু সে ছিল থিয়েটার নাটকে নিবেদিত প্রাণ। তার সঙ্গে আমার নাটক দেখা শুরু হলো। সেই সময়, আমাদের বাংলা নাটকের স্বর্ণ যুগ। বহুরূপী, লিটল থিয়েটার গ্রুপ, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্তর পরের প্রজন্ম প্রবেশ করেছেন, তাঁদের পরের প্রজন্মও। উত্তর কলকাতায় রঙ্গনা থিয়েটার হল হলো। আর পুরোন ব্যবসায়িক থিয়েটার তখনো রমরম করে চলছে। জনপ্রিয় সাহিত্যের নাট্যরূপ দিয়ে নাটক হতো বিশ্বরূপা, স্টার, রংমহল থিয়েটার হলে। এখানে চলচ্চিত্রের প্রবাদ প্রতিম অভিনেতারা অভিনয় করতেন, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, হরিধন মুখোপাধ্যায়, অজিত চট্টোপাধ্যায়দের আমি এখানেই দেখেছি অভিনয় করতে। উত্তমকুমারের শ্যামলী নাটকের কথা শুনেছি, তখন আমাদের খুব কম বয়স, দেখিনি। হাতিবাগানের থিয়েটার পাড়া ছিল আমাদের সত্যিকারের গর্ব। শুনুন এক কথোপকথন, বাংলাদেশের খুলনা জেলার এক গৃহবধূ আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। দীপালি মণ্ডল। তিনি একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, দাদা আপনার বাড়ি কোথায়?
উত্তর কলকাতায়।
কলকাতার যেখেনে খুব থিয়েটার হয়, রংমহল হল কি কাছে?
হ্যাঁ, কেন?
আপনার ভাই, থিয়েটার পাগল, সে বলে আবার একবার গিয়ে হাতিবাগানে থিয়েটার দেখবে।
সেই ব্যক্তি আমারই বয়সী। অনেক বছর আগে কলকাতায় এসে একবার রংমহল থিয়েটারে কোনো একটি নাটক দেখেছিলেন। এখনো আশা করে আছেন কলকাতায় এসে দেখবেন জহর রায়, হরিধন বন্দ্যোপাধ্যায়, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়দের কমেডি।
আমাদের বাড়িতে অনেক নাট্যপত্র আসত। এপিক থিয়েটার, গন্ধর্ব, সুত্রধর, নাট্য পাক্ষিক, বিংশ শতাব্দী… আরো কী কী যেন। কোন একটা সময়ে আমি এপিক থিয়েটার শারদীয় সংখ্যায় পড়ি উৎপল দত্তের মানুষের অধিকারে। সে এক অসামান্য অভিজ্ঞতা। নাট্যপত্রগুলি আমি পড়তাম। আমাদের বাড়িতে ছেলেবেলা থেকেই নাটকের লোক আসতেন। পার্থপ্রতিম চৌধুরীকে ছেলেবেলা থেকে দেখেছি। যখন কলেজে সেই সময়ে বোধ হয় ‘চাকভাঙা মধু’ লেখা হয়। একদিন পার্থদা এলেন। সমস্ত রাত তাঁরা হয়তো সেই নাটক পাঠ আর আলোচনা করেছিলেন। আমার প্রবেশাধিকার নেই। সেই নাটক এক্ষণ পত্রিকায় ছাপা হলে আমি পড়লাম। সঙ্গে হাসান আজিজুল হকের ‘জীবন ঘষে আগুন’। সেই নাটক করলেন থিয়েটার ওয়ার্কশপ, বিভাস চক্রবর্তী, অশোক মুখোপাধ্যায়, মানিক রায়চৌধুরী, রাম মুখোপাধ্যায় এবং মায়া ঘোষ। মানিক রায় চৌধুরীর কথা খুব মনে পড়ে। খুব শক্তিমান অভিনেতা ছিলেন। অল্প বয়সে চলে গেছেন। ‘পাঁচু ও মাসি’ নাটকে মানিকদার অভিনয় এখনো মনে আছে। ‘চাকভাঙা মধু’তে জোতদার অঘোর ঘোষের ছেলে শঙ্করও অসামান্য। থিয়েটার ওয়ার্কশপ ‘চাকভাঙা মধু’র আগে করেছিল মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের ‘রাজরক্ত’। ‘রাজরক্ত’ দেখা ছিল এক অসামান্য অভিজ্ঞতা। মোহিত চট্টোপাধ্যায় আমার প্রিয় নাটককার। মৃত্যু সংবাদ, ক্যাপ্টেন হুররা তো পাঠ্য নাটক। নক্ষত্র করেছিল এই দুই নাটক। শ্যামল ঘোষ ছিলেন কারিগর। কত কম বয়সে মোহিতদার কিমিতিবাদী নাটক ‘গন্ধরাজের হাততালি’ দেখেছিলাম, ঋতায়ন করেছিল এক রবিবার সকালে রংমহলে। সত্তর দশক বিদ্রোহের দশক। নাটকের দশক। বিদ্রোহ ছিল সেই সব নাটকেও। চেতনার মারীচ সংবাদ, ও লু সুনের গল্প অবলম্বনে জগন্নাথ নাটক নিয়ে এসেছিল বাংলা নাটকে নতুন বাঁক, বিশেষত মারীচ সংবাদ। সাম্রাজ্য বাদের বিরুদ্ধে এই নাটক সেই সময়কে চিহ্নিত করেছিল। কী সমস্ত নাটক দেখেছি, পিপলস লিটল থিয়েটারের টিনের তলোয়ার, তীর, মধুসূদনের প্রহসনে উৎপল দত্ত, একেই কি বলে সভ্যতা, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ… অসিত বসু করেছিলেন ‘কলকাতার হ্যামলেট’ চাকভাঙা মধুও ছিল বাংলা নাটকের এক বাঁক। এর পর থিয়েটার ওয়ার্কশপ দুটি নাটক নরক গুলজার, অশ্বত্থামা…। আর নতুন হল রঙ্গনায় নান্দীকার চেকভ থেকে মঞ্জরী আমের মঞ্জরী, গ্রেট অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়… জমি বাগান কিনে নিতে নিতে উরুতে চড় মারতে মারতে উল্লাস প্রকাশ…। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় দেখা এই জীবনের পরম সৌভাগ্য। শের আফগান, ভালো মানুষ, তিন পয়সার পালা, যখন একা, নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র, খড়ির গণ্ডী… তখন গোটা কলকাতা নান্দীকার এবং বিদেশী নাটকে ভেসে গিয়েছিল। দূর মফস্বল থেকেও মানুষ আসত নাটকে। চারদিকের ভয়ানক অবস্থায় নাটকের ভিতরেই যেন পরিত্রাণ খোঁজা। অজিতেশ, কেয়া চক্রবর্তী, রুদ্রপ্রসাদ…। তিন পয়সার পালা এবং ভালোমানুষ নাটকে কেয়া চক্রবর্তীর অভিনয় তো ভুলিনি। শান্তা এবং শান্তা প্রসাদ। নান্দীকারের হে সময় উত্তাল সময় কিন্তু তেমন সফলতা পায়নি, দেখেছিলাম। পরে অজিতেশ নান্দীমুখ নাট্যদল করে তলস্তয়কে মঞ্চে এনেছিলেন, পাপ পুণ্য। গ্রেটনেস বোঝা গিয়েছিল সেই নাটকেও। কেয়া চক্রবর্তীর অভিনয় সুষমার কথাও এখন মনে পড়ে। বছর ৪৫ আগের কথা সব। বিভাস’দা থিয়েটার ওয়ার্কশপ ছেড়ে অন্য থিয়েটার করলেন, মৈমনসিংহ গীতিকা নিয়ে মাধব মালঞ্চী কইন্যা করেছিলেন আটের দশকে।
আমি ‘মৃত্যুর চোখে জল’ নাটক দেখিনি, পড়েছি। নাটক পাঠ আমার পুরনো অভ্যাস। রক্তকরবী, ডাকঘর ও বিসর্জন আমি মাঝে মধ্যে পড়ি সাহিত্য পাঠের মতো করেই। আমার প্রিয় পাঠ চাঁদ বণিকের পালা। কতবার পড়েছি। পড়েছি এবং ইন্দ্রজিৎ, যা নেই ভারতে, অশ্বত্থামা, কিনু কাহারের থেটার, পরবাসও। মনোজ মিত্রের নাটকে সাহিত্যগুণ আছে। মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের নাটক পড়তে হয়। মধুসূদনের প্রহসন। দেবাশিস মজুমদারের ‘অসমাপ্ত’ দেখে মনে হয়েছিল একটি ছোটগল্প। ‘তখন বিকেল’ দেখে সেই উপলব্ধি হয়েছিল। কবিতা। নাটকের গল্প, ব্রাত্য বসুর সিনেমার মতো, মনে হয়েছিল উপন্যাস। ফিরে যাই সেই সত্তরে, আমি নাটক লিখব, অভিনয় করব, এইসব ভাবতে ভাবতে চাকরি নিয়ে দূর মফস্বলে চলে যাই। ধীরে ধীরে নাটক লেখার ইচ্ছে অস্তমিত হয় নিজের ভিতরে। গল্প লিখতে মন দিই। কিন্তু কলকাতায় এলে নাটক দেখা বন্ধ হয়নি। নাটক মূলত সংলাপ নির্ভর। কিন্তু মনে হয় সংলাপের ভিতরে কোথাও কি গভীর এক নীরবতাকে রক্ষা করা যায় না? সংলাপ যেন কথা কথা আর কথা না হয়। কথা যেন হল্লা না হয়ে ওঠে। নাটক লিখিনি, কিন্তু আমার গল্পে সংলাপ থাকে অনেক। সংলাপে সংলাপে আমি গল্প লিখেছি। সাতের দশকে সাজানো বাগান তো কিংবদন্তীর মতো হয়ে গেছে। এই সময়ে বালুরঘাটে বসে হরিমাধব মুখোপাধ্যায় করলেন অভিজিৎ সেনের গল্প নিয়ে নাটক দেবাংশী, মহাশ্বেতা দেবীর গল্প নিয়ে জল। আমি কোন নাটক ছেড়ে কোন নাটকের কথা বলব?নীলকন্ঠ সেনগুপ্ত করেছিলেন, প্রেমচাঁদের গল্প নিয়ে দানসাগর। দেবাশিস মজুমদারের নাটক। মনে আছে। শাঁওলি মিত্রর একক অভিনয়ে নাথবতী অনাথবত। মহাভারতের অসামান্য এক বিনির্মাণ ছিল তা। নয়ের দশকে দায়বদ্ধ, দুই হুজুরের গল্প চন্দন সেনের নাটক, বিভাস চক্রবর্তী করেছিলেন শ্বেতসন্ত্রাস… আসলে আমার নাটক দেখা সুখস্মৃতিতে পূর্ণ। মনে পড়ছে উইংকিল টুইংকিল, ব্রাত্যর নাটক, দেবেশের নির্দেশনা। ওই নাটক একটি বাঁক ছিল। স্থবির সময়ে আঘাত ছিল। ভাল নাটক দেখেছি অনেক। লিস্ট করতে গেলে দীর্ঘ হয়ে যাবে । আর সেই ভাল নাটকের দিন এখনো রয়েছে। সাম্প্রতিক নাটকের তালিকাও দীর্ঘ। আমি বলছি বিজয় তেন্ডুলকারের নাটক কন্যাদানের কথা। জীবনের এক আশ্চয ভাষ্য তা। অভিনয়ের শীর্ষে পৌঁছন এখানে ব্রাত্য, মেঘনাদ আর…। সাম্প্রতিক নাটকের ভিতরে শান্তিপুরের এক নাট্যদলের নাটক গন্ধজাল যেমন আছে, আছে মিনারভা রিপারটরির দেবী সরপমস্তা, আছে ফাগুন রাতের স্বপ্ন, সিনেমার মতো, বোমা, মুম্বই নাইটস, তুঘলক, রক্তপুষ্প…। ব্রাত্য, কৌশিক, দেবেশ, অর্পিতা, তরুণ প্রধান, দেবাশিস রায়, তাঁদের আগে কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের কিশোর সেনগুপ্ত…, রস নাটক করেছেন কৌশিক কর…, অর্পিতা আর সুজন মুখোপাধ্যায়কে দেখেছি, ‘আপাতত এইভাবে দুজনের দেখা হয়েছিল’। আলাদা নাটক। অনাটকীয় নাটক। এমনি বহুজন থিয়েটারকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। …কত অভিনেতা অভিনেত্রী, পরিচালক, গ্রিনরুমের ভিতরে থাকা নাট্যকর্মী, এইসব নিয়ে থিয়েটার। সদর এবং মফস্বল দুইই এখন সক্রিয়। বিলাসীবালা করেছেন আশিস দাস, কর্নেল’কে কেউ চিঠি লেখে না, আশিস চট্টোপাধ্যায়। এখানে আলস্যের কোনো জায়গা নেই। যিনি গল্প লেখেন, উপন্যাস লেখেন, তিনি আসলে অলস এক ব্যক্তি। তাঁর দ্বারা নাটক হয় না। কিন্তু নাটকে তাঁর আগ্রহ প্রবল, বাড়িতে তো নাটক ছাড়া কথা নেই, সেই মৃত্যুর চোখে জল থেকে। আমাদের ঠাকুরদা ওই নাটকের বঙ্কিম। আমি যে লিখিনি তা নয়। নিজের গল্প কুলছুমের হাত ও আসনবনি রেডিও নাটক করে দিয়েছিলাম। টিভির স্ক্রিপ্ট লিখেছিলাম কয়েকটি গল্পের। আমার উপন্যাস এবং গল্প নিয়ে নাটক হয়েছে। আমি এতে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়েছি। কেন না জীবনে একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক লিখে বসে আছি, কেউ নেননি, মানে হয়নি।
আমার উপন্যাস ‘অশ্বচরিত’ কল্যাণীর কিশোর সেনগুপ্ত মঞ্চে আনেন। উনি যখন টেলিফোনে প্রস্তাব দেন, আমি বলেছিলাম হয় না। কী করে হবে? উনি ভানু দাস ছন্দক আর ঘোড়া কন্থকের কাহিনি মঞ্চে এনে আমাকে মুগ্ধ করেছিলেন। অশ্বচরিতের পর কিশোর ধ্রুবপুত্র করতে চেয়েছিলেন। নাটক লিখে ফেলেছিলেন। কিন্তু শেষ অবধি হয়নি। সেই সময় ধ্রুবপুত্রের একটি বড় আলোচনা বেরিয়েছিল চতুরঙ্গ পত্রিকায়। লিখেছিলেন কুমার রায়। কোনো এক পয়লা মে একাডেমিতে বহুরূপীর জন্মদিনে আমাকে যেতে বলেছিলেন অমিয় হালদার। তিনি তখন বহুরূপীর সঙ্গে জড়িত। অভিনেতা। আমি গিয়ে কুমার রায়কে প্রণাম করতে তিনি আমার হাত ধরে বলেছিলেন, তিনি তাঁর শেষ প্রযোজনাটি করতে চান ধ্রুবপুত্র নিয়ে। আমাকে নাটক লিখে দিতে বলেছিলেন। লিখেছিলাম কয়েকটি দৃশ্য, কুমারদার বাড়িতে শোনাতে গিয়ে টের পেয়েছিলাম হয়নি। হবে না। না, আমি তখন বুঝেছিলাম নাটক এক আলাদা আর্ট ফর্ম। আমি তা পারি না লিখতে। আর সব উপন্যাসে নাটক হয় না। ধ্রুবপুত্র হয়নি। হ্যাঁ, তখন হয়নি। পরে ২০১৭ সালে আবার কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র সেই উপন্যাস মঞ্চস্থ করেন। কিশোর সেনগুপ্ত। ধ্রুবপুত্র চমৎকার প্রযোজনা।
মেঘনাদ ভট্টাচার্য এক রাতে টেলিফোন করে বলেছিলেন ‘বালিকা মঞ্জরী’ নাটক করতে চান। তখন ওঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না। ওই গল্প যে নাটক হতে পারে আমি ভাবিনি। ওঁকে নিরস্ত করতে চেয়েছিলাম টেলিফোনে। উনি নিরস্ত না হয়ে তো করলেন। তারপরেও আবার আবার। মেঘনাদ ভট্টাচার্য যে নাটক কটি করেছেন, প্রতিটি আমার বাড়িতে এসে শুনিয়েছেন। বালিকা মঞ্জরী বা পিঙ্কি বুলি যে কতবার পড়া হয়েছে। ইন্দ্রাশীস লাহিড়ী নাট্যরূপ দিয়েছিলেন। ছমাস আটকে ছিল সেই নাট্য রূপায়ন। মেঘনাদের সঙ্গে দেখা এক অনুষ্ঠানে। জিজ্ঞেস করলাম, হবে না তাহলে? উনি বললেন, হবে। আপনার মতামতও চাই। একটা গিট ছাড়াতে হবে। আমার বাড়িতে এলেন তিনি। পড়া হলো নাটক। আমি আমার মতামত জানিয়ে জড়িয়ে গেছি নাটক নির্মাণে। দামিনী হে নাটক বা পাসিং শো-নাটকেও একই ব্যাপার। তবে দামিনী হে নাটকে একটি গল্প নয়, আমার অন্য গল্প ও তার সংলাপ এসে মিশেছে। আর একটি উপাদান নাট্যকার চন্দন সেন নির্মিত। ফোটোগ্রাফার বিডিও এবং ঐ বিষয় আমার গল্পে ছিল না। আমার গল্পের বাইরে। কিন্তু তা বাদে আমার অন্য গল্পের সংলাপও এই নাটকে ব্যবহৃত। নাটককার, পরিচালক আমাকে এত পড়েছেন ভেবেই আমি রোমাঞ্চিত। সায়ক এখন অবধি যে শেষ নাটকটি প্রযোজনা করেছে, তা পুনরুত্থান উপন্যাসটি নিয়ে। ২০১৮-র প্রযোজনা। এই ধরণের উপন্যাস নিয়ে নাটক মঞ্চে আনার দুঃসাহস মেঘনাদ ভট্টাচার্যই দেখাতে পারেন। ২০১২ সাল নাগাদ নাটককার অভিনেতা নির্দেশক ব্রাত্য বসু তার ব্রাত্যজন পত্রিকায় আমাকে একটি নাটক লিখতে বলেন। লিখেছিলাম ‘শেষ পাহাড় অশ্রুনদী’। এই নাটক পরে অনেক পরিমার্জনা করেছি। ২০১৮-র ডিসেম্বরে কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রর নাট্টোৎসবে করিম- পুরের নাট্যদল সেই নাটক ‘অশ্রুনদী’ অভিনয় করেছে। আরো নানা উৎসবে করছে। একই নাটক শেষ পাহাড় নামে বেঙ্গালুরুর স্মরণিক নাট্যদল করছে সায়নদেব ভট্টাচার্যর নির্দেশনায়।
নাটক আমাদের জীবনে জড়িয়ে থাকে সবসময়। কবিতা গল্পও। চিত্রকলাও। গান। বাজনা। কিন্তু এর ভিতরে নাটক থাকে বেশি জড়িয়ে। অভিনয় তো করতেই হয় প্রতি পদক্ষেপে। যাপিত জীবনে অভিনয় করতে হয়, মিথ্যে বলতে হয়। জীবন তো অভিনয়ে, অভিব্যক্তির বৈচিত্রে পূর্ণ। তাইই মঞ্চে আসে। কিন্তু সত্যই কি তাই? একেক সময় তা অন্য রকম হয় না কি? অভিনয় করতে করতে ‘পরবাস’ নাটকের গজমাধব শেষে তো নিজের নিরালম্ব রূপ প্রকাশ করে ফেলে সত্য উচ্চারণ করে। নাটক এখন নাটক নয়, জীবন ভাষ্য। অভিনয় নয়, সত্য কথন। আর এই সত্য কত নিরাভরণ। চাঁদ বণিকের পালা পড়তে গিয়ে তা মনে হয়। ডাকঘর পড়তে গিয়ে বন্দী বালকের ভিতরে সভ্যতাকে বন্দী দেখি। কিন্তু একটা কথা ঠিক, সব শেষে তা বুঝি, না বুঝি, আমার কাছে আমোদ। বিভূতিবাবুর সেই চাষার মতো আমি তুচ্ছতেই বিশালত্বকে টের পাই। অভিনেতার অভিব্যক্তি আর সংলাপ উচ্চারণ অনেক কল্পনার দুয়ার খুলে দেয়। খুলে দিয়েই অভিনেতা চিরকালের মতো মাথার ভিতরে আসন পেতে বসেন। উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। মায়া ঘোষ। অরুণ মুখোপাধ্যায়। মনোজ মিত্র। মেঘনাদ ভট্টাচার্য। নীলকন্ঠ সেনগুপ্ত। ব্রাত্য বসু। বাংলা মঞ্চ চিরদিনই বড় অভিনেতাকে বরণ করে নিতে পেরেছে।