আমার দেশ আমার বিদেশ – ৫

পাঁচ

মেসোমশাইরা ছিলেন দুই ভাই। বড়ো প্রফুল্লই একান্নবর্তী পরিবারের কর্তা। যদিও রোজগেরে বলতে ছোটোভাই কালীপদই। কখনও কখনও প্রফুল্ল কোনও একটি দোকানে গিয়ে বসতেন তবে ছোটো ভাইকে ব্যবসায় সাহায্য করতে নয়, নানাজনের সঙ্গে গালগল্পে সময় কাটাতে। বাস্তবিক ক্রেতা ছাড়াও প্রফুল্লকে সঙ্গ দিতে পাড়া প্রতিবেশীদের বেশ-কয়েকজন জুটেও যেতেন। সে সময় পূর্ববাংলার প্রায় সমস্ত মধ্যবিত্ত পরিবারেই একজন পরজীবী অভিভাবক থাকতেন। সংসার প্রতিপালনে আর্থিক সহায়তা না করলেও এই স্বনিযুক্ত অভিভাবকরাই ছিলেন পরিবারের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। বিশেষত পরিবারের মেয়েরা এবং ছোটো ছেলেমেয়েরা এদের ভয়ে সব সময় তটস্থ হয়ে থাকত। আমার বাল্যবন্ধু কুকুন (পীযূষ মিত্র) ও গোপাল দুই ভাই তাদের কাকা ক্ষিতীশ মিত্রকে যমের মতো ভয় পেত। মালখানগরের জমিদার এবং নারায়ণগঞ্জের স্বদেশি কাপড়ের কল লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলের ম্যানেজার সুনীল বসুর বেকার ছোটোভাই সুশীল বসু সম্ভবত পরিবারে কর্তালি করতেন না। সেটা দাদার ব্যক্তিত্বের কারণে হতে পারে। অথবা তুচ্ছ সাংসারিক ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর চেয়ে তিনি হয়ত বাড়ির পোষা কুকুরগুলির পরিচর্যা করাই বেশি পছন্দ করতেন। আমার সামান্য ছোটো পিসতুতো ভাই নিতাইকে তিনি একটি কুকুরের বাচ্চা দিয়েছিলেন। সেই সুবাদে সুশীল বসু হয়েছিলেন নিতাইয়ের কুকুর মামা। এই কুকুর প্রেমের কারণেই সুশীলকে একবার কমিউনিস্টদের হাতে বেদম মার খেতে হয়েছিল। সে গল্প পরে বলা হবে। আমার বাবার কোনও ভাই ছিল না। কাজেই কোনও কাকা-জ্যাঠার শাসানি আমাদের ওপর ছিল না বলতে হবে। তবে পাতানো কাকা প্রভঞ্জন দত্তকে আমরা ভাই-বোনেরা কম সমীহ করতাম না।

সেকালে নিজেকে বিশেষ চিহ্নিত করার আগ্রহে পূর্ব-বাঙালদের অনেকে কথা বলার সময় শুদ্ধ বাংলা ব্যবহার করতেন। একথা অনস্বীকার্য যে পূর্ববাংলার কোনও কোনও জেলার কথা ভিন্ন জেলার লোকেদের অবোধ্য। আমার বাবার এক সহকর্মীর (এখন নাম মনে নেই) আদি বাড়ি ছিল নোয়াখালি জেলায়। একদিন তিনি তার ডানপিটে ছেলের বাঁদরামির দৃষ্টান্ত দিতে বলেছিলেন, আমাদের হত্যনি তো নাইরকোল গাছে আইরন কত্তি কত্তি ফঁড়ি গেছে। অর্থাৎ তার ছেলে সত্য, যে কিনা তখন মাত্রই ন-বছরের বালক, নারকেল গাছে চড়তে গিয়ে পড়ে গেছে। এ ক্ষেত্রেও শুদ্ধ ভাষা ব্যবহারের প্রয়াস লক্ষণীয়। গাছে চড়াকে তিনি বলেছেন ‘আইরন’ অর্থাৎ আরোহন। তবে সব ক্ষেত্রেই উচ্চারণ বিভ্রাট ঘটত তেমন নয়। এক গৃহশিক্ষককে ছাত্রের মা বাড়ির ছাগলের জন্য কটা কাঁঠাল পাতা পেড়ে দিতে বলেছেন। এই অনুরোধ গৃহশিক্ষকের কাছে অবমাননাকর মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। অতএব চট্টগ্রামবাসী ওই গৃহশিক্ষক ছাত্রকে বললেন, তোমার মাতা ঠাকুরাণীকে কহিয়া আইস, আমি কাঁঠাল গাছে আরোহণ করিতে পারি না। এটা অবশ্য গল্প এবং এ গল্পের পরবর্তী অংশ এখানে অপ্রয়োজনীয়। বরিশালের ভাষা চট্টগ্রাম নোয়াখালির মতো দুর্বোধ্য নয়। তবে কয়েকটি শব্দ বরিশালিয়াদের ভাষান্তর অথবা উচ্চারন্তরে বাস্তবিকই ভারী মজাদার। চড় বরিশালে ‘চোপার’, মুড়ি ‘উড়ুম’, ওহে আছ যেমন বরিশালের মুখে ‘মণি বাস কেমন’। বড়ো হয়ে কলকাতার কলেজে ঢুকে পাখা গজানোর পর এই ‘বাস কেমন’ আমাদের হাসি তামাশার উপকরণ হয়েছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাস কেমনের আবশ্যিক জবাব হত ‘ভালোবাসি না’। অর্থাৎ এখনও প্রেম করার সুযোগ হয়নি। ‘স’ আর ‘হ’-এর উচ্চারণ হেরফেরে বরিশালবাসীর হেনস্তার গল্প প্রবাদপ্রতিম। গল্পে দুই বন্ধুর সংলাপ ছিল এইরকম: তোরা তো ‘স’ কে ‘হ’ আর ‘হ’ কে ‘স’ বলিস। হেয়া কয় হাধারনে। এই তো হুইঁও বললি। ও তো সটাৎ কইরা মুখ দিয়া বাইরাইয়া গেল। এমত ‘সটাৎ’ করে বেঁফাস কিছুই মুখ দিয়ে বের হয়ে না যায় বুঝিবা সেজন্যই মেসোমশাইয়ের অগ্রজের মতো শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা সতর্কতার সঙ্গে শুদ্ধ বাংলা ব্যবহার করতেন। তা সত্ত্বেও বিপর্যয় ঘটত না তা নয়। যেমন অতি সতর্কতা সত্ত্বেও ‘প্রত্যেক’ হ য়ে যেত ‘পেত্তেক’। তবে কিনা প্রত্যেককে পেত্তেক বলতেন আর এক প্রফুল্লও। তিনি আরামবাগের গান্ধী পশ্চিমবাংলার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর আদি বাড়ি কিন্তু বরিশাল নয়, ছিল পাশের জেলা খুলনার সেনাহাটিতে। অবশ্য বরাবরই প্রবাসী হওয়ায় বাংলার চেয়ে ইংরেজি, হিন্দি ও উর্দুতেই অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন তিনি। বাংলা হাতের লেখাও ছিল অত্যন্ত খারাপ। কোনও একটি পরীক্ষায় (সম্ভবত স্কুলের শেষ পরীক্ষায়) অন্য সব বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেলেও বাংলায় ফেল করেছিলেন। তথাপি সেন মশাইয়ের কথাবার্তার কী করে আদি বাঙালিদের টান রয়ে গেল সে ব্যাখ্যা ভাষাবিদের দিলেও দিতে পারেন। কোন অপরাধে বরিশালিয়ারা ‘আইতে শাল, যাইতে শাল, তার নাম বরিশাল’ অপবাদ অর্জন করেছিলেন তা বোধগম্য নয়।

বড়ো ভাই প্রফুল্ল যেহেতু কর্তা, তারই স্ত্রীই পরিবারের গিন্নি হবেন এটাই স্বাভাবিক। কোনদিন কি রান্না হবে, কাকে কখন খেতে দিতে হবে এসব খুঁটিনাটি নির্দেশ তিনিই দিতেন। তার স্বামীর রোজগারে সংসার চলবে অথচ কর্তৃত্ব করবেন বড়ো জা এতে মাসির মনে ক্ষোভ ছিল। অধিকারের প্রশ্নে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির মেয়েদের মধ্যে মাঝেমধ্যেই ঠোকাঠুকি, রেষারেষি হত। কোনও কোনও সময় সংঘাতের উপলক্ষ অতি তুচ্ছ। পূর্ববাংলায় গ্রীষ্মকালে মাঠা অথবা ঘোল নামে একজাতীয় পানীয় অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। এই মাঠা বা ঘোল পাঞ্জাবের লস্যির প্রকার ভেদ অর্থাৎ দুগ্ধজাত। যাদের নিজেদের গরু ছিল, প্রতিদিন সকালে তারা নিজেরাই মাঠা তৈরি করে নিতেন। গোয়ালারাও বাঁক কাঁধে পাড়া ঘুরে বিক্রি করত। গ্রীষ্মের সকালে রোদ চড়তে শুরু হতেই তাদের ‘চাই মাঠা মাখখন (মাঘন)’ হাঁক অগ্রাহ্য করা কঠিন হত। মাসিবাড়িতে মাঠা ঘরেই তৈরি হত এবং সকালের জলখাবার খাওয়ার আগে সকলের হাতে হাতে মাঠার গ্লাস ঘুরত। একদিন এই মাঠা বিতরণ নিয়েই মাসিমারা দুই জা ধুন্ধুমার বাঁধিয়ে দেন। মাসিমার সন্দেহ হয় তার বোনপো বোনঝিদের যে মাঠা দেওয়া হয়েছে তাতে মাত্রাতিরিক্ত জল মেশানো হয়েছিল। বলাই বাহুল্য বড়ো জায়ের সরব প্রতিবাদ এমন নিচুমনা তিনি হতেই পারেন না। পিতৃপরিবারের সুশিক্ষা না পেলেই এমন ভিত্তিহীন অভিযোগ করা সম্ভব। অপরপক্ষের পাল্টা জবাব কি হতে পারে অনুমান করা শক্ত নয়। কখনও মুখোমুখি কখনও ভিন্ন ঘরে থেকে দুই জায়ের অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ, চিৎকার চেঁচামেচিতে সেদিন পুরো একটা বেলা শুধু নিজেদের বাড়ি নয় সম্ভবত গোটা পাড়াই মাত হয়েছিল। প্রতিবেশিরা কেউ অবশ্য বিবাদের কারণ জানতে উঁকিঝুঁকি দেননি। এ ধরনের ঝগড়াঝাঁটি থেকে কোনও বাড়িই মুক্ত ছিল না। আর মজার ব্যাপার ঝগড়া করতে করতেই নিয়মমতো যে যার হাতের কাজও সেরেছেন। এবং দুপুরে পাশাপাশি বসে কোন ব্যঞ্জনটি সুস্বাদু ও কোনটিতে আর একটু নুন পুড়লে আরও স্বাদ উঠত এমতো গল্পগাছা করতে করতেই দুপুরের খাওয়া সেরেছেন। এরকম মেঘ ও রৌদ্রের খেলা পূর্ববঙ্গের মধ্যবিত্ত পরিবারের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা। পুরুষরা মেয়েদের এই কুটকচালিতে জড়িয়ে না পড়লে কখনও মেঘের দাপট বাড়তে পারত না। পরিবারের হাঁড়ি অভিন্নই থাকত। দেশত্যাগের পর এপার বাংলায় এসেও দীর্ঘদিন মাসিমাদের পরিবার একান্নবর্তীই ছিল।

বরিশাল শহরে আমার এক জ্ঞাতি জ্যাঠা দেবেন্দ্রনাথ ঘোষচৌধুরী থাকতেন। পেশায় আইনজীবী ছিলেন। দুই ছেলের বড়টির মাথায় শিল্পপতি হওয়ার ভূত চেপেছিল। নিজস্ব ফরমুলায় কখনও দোয়াতের কালি, কখনও গায়ে মাখা সাবানের মতো এটা ওটা উৎপাদনে নেমে বেশ কয়েকবার বাবার পয়সার শ্রাদ্ধ করেছেন। শেষ পর্যন্ত জীবিকা হিসেবে কী বেছে নিয়েছিলেন জানা নেই। তবে বৃহৎ শিল্পপতির ধরণধারনটি যে বজায় রেখেছেন এপারে এসে শেষ দেখা হওয়ার সময়ও সেটা মালুম হয়েছে। ছোটোভাই তপন ডাক বিভাগে চাকরি করতেন। আমার স্থায়ী ঠিকানা বারাকপুরের নোনাচন্দনপুকুর ডাকঘরেই পোস্টমাস্টার হিসেবে অবসর নিয়েছেন। আমাদের বংশের আরও কয়েকজন ডাক বিভাগের কর্মী ছিলেন। জ্ঞাতি কাকা গোপাল ঘোষচৌধুরী নানা শহর ঘুরে শেষ পর্যন্ত উত্তর চব্বিশ পরগণার শ্যামনগর ডাকঘরের পোস্টমাস্টার হিসেবে অবসর নেন। বাবার জ্ঞাতি কাকা প্রভাতরঞ্জন ছিলেন আমাদের নিজেদের গ্রাম বাঁকাইয়ের ডাকঘরের পোস্টমাষ্টার। আমরা তাকে নোয়াদাদু ডাকতাম। শুনেছি তার ছেলে দুলালও দেশভাগের পর ওই পোস্টঅফিসেই পোস্টমাস্টার হয়েছিলেন। সম্পর্কে কাকা এই দুলাল আমারই সমবয়সি। পরে এদের কথা সবিস্তারেই উল্লিখিত হবে। দেবেন্দ্রনাথের মেয়ে কল্যাণীর ছিল প্রেম বিবাহ। স্বামী টুনু মিত্র খেলার জগতের লোক। এখন পশ্চিমবাংলার টেবিল টেনিস অ্যাসোসিয়েশনের একজন কর্মকর্তা এবং কোচ। সেকালে প্রেম বিবাহ একটি বৈপ্লবিক ব্যাপারই ছিল। তা হলেও সেই বৈপ্লবিক উপাখ্যান শোনার জন্য দেবেন্দ্রনাথের উল্লেখ নয়।

বরিশাল থাকতে একদিন অনন্ত দেবেন্দ্র জ্যাঠার (আমরা বড়ো জ্যেঠামশাই ডাকতাম) বাড়িতে যেতে হবে অথবা নিমন্ত্রণ আসবে জানাই ছিল। নিমন্ত্রণ এসেও ছিল দুপুরে খাওয়ার। নির্ধারিত দিনে মায়ের সঙ্গে আমরা ভাইবোনেরা পৌঁছোনো মাত্র প্রায় আক্ষরিক অর্থেই বড়ো জ্যাঠামশাই মায়ের ওপর হম্বিতম্বি শুরু করে দেন। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বারবার তিনি একটি অভিযোগই করছিলেন, বেলা পার কইরা ভাসুর বাড়ি নেমন্তন্ন খাইতে আইছ। বড়ো জা যে আখার (উনুনু) ধারে বইসা হাড় কালি করতে আছে সেইডা (তা) একবার ভাবলাও না। কথায় আছে একে মা মনসা তার ওপর ধুনোর ধোঁয়া। পেছন থেকে জ্যাঠাইমা সুর করে বলে চলেছেন, নেমন্তন্ন করা হইছে, নেমন্তন্ন খাইতে আইব না তো কি তোমার বাড়ির হাঁড়ি ঠ্যালতে আইব। হাঁড়ি ঠেলার জন্য তো বান্ধা দাসী আনছিলা, সেই আছে। এখন চ্যাঁচাইয়া (চিৎকার করে) পাড়া মাত কইরা লোক হাসাও ক্যান। আমার এই জ্যাঠাইমাটি সম্পর্কেও অনেক গল্প আছে। একদিন তিনি সম্ভবত কোনওএকটি ব্যঞ্জন রান্না করার সময় নুন দিতে ভুলে গেছিলেন। খাওয়ার সময় সেকথা উল্লেখ করতে ক্ষুব্ধ জ্যাঠাইমা জবাব দিয়েছিলেন যার প্রয়োজন হবে নুন মেখে নেবেন। পয়সায় কেনা জিনিস তিনি অপচয় করতে পারবেন না। সেদিন বড়ো জ্যাঠা এবং সঙ্গে জেঠিমার রুদ্রমূর্তি দেখে আমরা ছোটরা ঘাবড়ে গেলেও মাকে কিন্তু বিচলিত হতে দেখিনি। তখনকার দিনে ‘ক্যাটারার’ পরিষেবার প্রচলন তো হয়ইনি, শব্দটিই ছিল অশ্রুত। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের আচার-অনুষ্ঠানে দেড়-দুশো নিমন্ত্রিতেরও রসনা তৃপ্ত করতে অনেক সময়ই রান্নার ঠাকুরও ডাকা হত না। সর্বত্রই পাড়া প্রতিবেশিদের মধ্যে কিছু মহিলার রান্নার হাতের বিপুল সুখ্যাতি ছিল। এরাই কোমরে আঁচল জড়িয়ে কুটনো কাটা, মশলা বাটা থেকে শুরু করে কাঠের উনুনে হাঁড়ি কড়াই চড়ানো পর্যন্ত সব কিছুই সামাল দিতেন। নিমন্ত্রণ বাড়ির প্রয়োজন মেটাতে বড়ো হাঁড়ি কড়াই ডেকচি বালতিও পাঁচ বাড়ি মিলিয়ে জুটে যেত। আমার মা’র রান্নারও খুব সুখ্যাতি ছিল। আশেপাশের যে-কোনও কাজের বাড়িতেই তাঁর ডাক পড়ত। বড় জ্যাঠা জেঠির নিমন্ত্রণের রান্নারও মা-ই দায়িত্ব নেবেন আশা করা যেতেই পারে। মা’র সেটা বুঝতে দেরি হয়নি এবং ভাসুর ও জায়ের অনুযোগ উপেক্ষা করে সটান গিয়ে রান্না ঘরে ঢোকেন। একটু বেলা হয়ে গেলেও মায়ের রান্না পঞ্চব্যঞ্জন সেদিন সকলে তৃপ্তি করেই খেয়েছিল।

এই গল্পটি আমার নিজেরই স্মৃতিজাত নাও হতে পারে। হয়ত মা দাদাদের মুখে বারবার শুনে শুনেই কল্পনায় একটি দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে। তবে এখন যে গল্পের কথা বলা হবে সেটা হাসি তামাশার ছলে বারবার মায়েরই মুখে শোনা। মা কোথাও বেড়াতে গেলে বাড়ির ছোটরাও তার এক বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গেছিলাম। এরকম ক্ষেত্রে সব সময়ই কিছু বিশেষ জলখাবারের ব্যবস্থা হয়। অধিকন্তু মায়ের এই বন্ধুটি একটি মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের আধুনিকা গৃহবধূ। নিজের বিদ্যার বহর জাহির করার জন্য কথা বলার সময় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন। সেদিন বুঝি গৃহপরিচারক বাজার থেকে পান আনতে ভুলে গেছিল। সে কথাই মায়ের কাছে অনুযোগ করেছিলেন, সারভেন্টরে পান আনতে কইলাম আনে নাই। হাজব্যান্ড আইলে আইজ যদি তারে না কইছি। এরকম ‘অতি প্রয়োজনীয়’ সাংসারিক বিষয় আলোচনায় দুই বন্ধু মশগুল থাকায় গৃহকর্ত্রী সম্ভবত আমাদের অস্তিত্ব ভুলেই গেছিলেন। বলাই বাহুল্য ব্যাপারটা আমাদের মনঃপুত হয়নি এবং নীচু গলায় নিজেদের মধ্যে আলোচনাও করেছিলাম। আমাদের অসন্তোষ মায়ের বন্ধুর নজর এড়ায়নি। অতএব তিনি মার কাছেই পরামর্শ চান, ঘরে ময়দা ঘি সবই আছে। লুচি ভাজবেন না কি এতদিন বাদে যখন দুই বন্ধুর দেখা হয়েছে তখন গল্পগুজব করাটাই বেশি আনন্দের হবে। মা কি পরামর্শ দিয়েছিলেন অনুমান করা কঠিন নয়। ছোটোদের কাছে সে পরামর্শ যত বেদনাদায়ক হোক না কেন।

ছয়

বরিশাল শহর থেকে সেবার আমরা আবার মামাবাড়ি উজিরপুরেই ফিরে গেছিলাম। সময়ের তুলনায় এই গ্রামটি তখন বেশ অগ্রসর ছিল। গ্রামে ডাকঘর তো ছিলই, থানাও ছিল। বাংলাদেশের জন্মের পর নতুন প্রশাসনিক বিভাজনে উজিরপুর সম্ভবত একটি উপজেলা হয়েছে। তখনই গ্রামের রাস্তাগুলি যথেষ্ট চওড়া। শুনেছি পাকিস্তানি আমলে আয়ুবশাহীর বুনিয়াদি গণতন্ত্রে শত্রু সম্পত্তি চিহ্নিত হওয়ার পর মামাদের আদি বাড়ির ভগ্নস্তূপের ইঁট দিয়ে গ্রামের একটি রাস্তা পাকা করা হয়েছিল। পাকা বাড়ির সংখ্যা থেকেই গ্রামের সমৃদ্ধি অনুমান করা যেত। হাই স্কুল তো ছিলই, ওই ১৯৪৫ সালেই একটি হাসপাতাল হয়েছিল। হাসপাতাল বাড়িটি অবশ্য মুলিবাঁশের বেড়ায় ঘেরা এবং টিনের চাল। ওই হাসপাতালেরই ডাক্তার ছিলেন আমার সোনামামা। সম্ভবত এল. এম. এফ। যদিও বিদ্যুৎ গৌঁছায়নি উজিরপুরে তখনও। গ্রামের বাজারটির মতো বিশাল বাজার অনেক গঞ্জেও দেখা যায় না। এই বাজারে যে গলদা চিংড়ি দেখেছি এত বড়ো চিংড়ি এই আটষট্টি বছর বয়স পর্যন্ত আর কোনোদিন কোথাও দেখেছি মনে পড়ে না। এক একটি মাছের ওজন দুশো আড়াইশো গ্রামের মতো। তখন অবশ্য পূর্ববাংলায় ওজনে মাছ বিক্রি হত না। বড়ো মাছ হলে গোটা, জোড়া অথবা হালি (চারটেই এক হালি)। ছোটো মাছ থাউকা। ইংরেজিতে যাকে শ্রিম্প বলে সেই কুচো চিংড়ি, ট্যাংরা, পুঁটি, খলসে প্রভৃতি ছোটো মাছ ভাগার হিসেবে বিক্রি হত। এক এক ভাগে পাঁচ-সাতশো গ্রাম মাছ তো থাকতই। এক ভাগের দাম এক আনা বড়োজোর দু-আনা। তখনকার হিসেবে ষোলো আনায় একটাকা ছিল। চার পয়সায় এক আনা। অবস্থার চাপে খুব অল্প বয়স থেকেই বাজারে যেতে হত। দুআনা কি এক সিকিতে যে পরিমাণ মাছ কিনতাম অনেক সময় সত্যি তা এক হাতে বয়ে আনতে কষ্ট হত।

চিংড়ি মাছের প্রতি দুর্বলতা কোলকেত্তাইয়া ঘটিদের একচেটে এমন একটি বিশ্বাস কবে থেকে জন্মালো জানা নেই। বিশ্বাসটি কিন্তু বেশ ব্যাপকই। বাংলা সিনেমায় এযাবৎ সবচেয়ে রোমান্টিক জুটি সুচিত্রা-উত্তমের একটি কমেডি ছবির উপসংহারে ঘটি বাঙালের ঝগড়া মেটাতে ভাতের পাতে চিংড়ি-ইলিশ দুইয়েরই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। চিংড়ি ঘটিকে খুশি করতে আর ইলিশ বাঙালকে। ইলিশ বাঙালদের অতি প্রিয় সন্দেহ নেই। কিন্তু চিংড়ি মাছে তাদের এলার্জি হয় এমন কথা কোনোদিন শুনিনি। বরং বিশেষ করে বরিশালিয়াদের চিংড়ি এবং নারকেল প্রীতি একটু অতিরিক্ত মাত্রাই। নেহাত অখাদ্য না হলে সম্ভবত তারা পাঁঠার মাংসেও নারকেল দিতেন। শুক্তোতে কুচো চিংড়ি। আমার মা কুচো চিংড়ি দিয়ে যে মসুর ডাল রান্না করতেন সে ছিল অতি উপাদেয়। এই রেসিপিটি এখনও আমাদের বাড়িতে ব্যবহার করা হয়। লাউ চিংড়ি ঘটি-বাঙাল নির্বিশেষে সব বাঙালিরই জিভের জল ঝরায়। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের বিদূষক গোপাল ভাঁড়ের লাউঘণ্টে চিংড়ি ঝরিয়ে বধূ নিপীড়ক দজ্জাল পিসিকে শায়েস্তা করার গল্পে চিংড়ির প্রতি নিরামিষাশীরও দুর্বলতার ইঙ্গিত রয়েছে। সল্টলেকের যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে এক সর্বভারতীয় মহিলা প্রতিনিধিদের পংক্তি ভোজনের সময় দক্ষিণ ভারতীয় মহিলা প্রতিনিধিদের দেখেছিলাম ভ্যানিটি ব্যাগে কৌটো ভরে গুচো চিংড়ি নিরামিষ সবজিতে ছড়িয়ে নিচ্ছেন। বড়ো গলদা চিংড়ির মাথা ভাজা সহযোগে এক থালা গরম ভাত অতি উপাদেয়। শুধু রসনার তৃপ্তি নয় গলদার মাথার ঘিলু দিয়ে মাথা রাঙা ভাত অনুরূপ দৃষ্টিনন্দন। গলদার ঠোঁট এবং দাঁড়া চালকুমড়ো, শাপলার তরকারির স্বাদ পাল্টে দেয়। বরিশাল অথবা পূর্ববঙ্গের কোথাও বাগদা চিংড়ি চোখে পড়েনি। রপ্তানির সুবাদে পশ্চিমবাংলার বাগদা আভিজাত্য পেয়ে থাকতে পারে। ঘটিরা সেই আভিজাত্যের দাবিদার। একচেটে দাবির জবাবে একটি গল্প শোনালে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। এক বরিশালিয়া কলকাতায় এসে বন্ধুর সঙ্গে রেস্টুরেন্টে গেছে। অর্ডার দেওয়া হয়েছে প্রন কাটলেট। বেয়ারা টেবিলে কাটলেটের প্লেট রাখতেই বরিশালিয়ার তাচ্ছিল্যের উক্তি, ও চিঙ্গইড় মাছ তুমি কইলকাতায় আইয়া কাটলেট হইছ।

জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ও সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে বরিশাল জেলা যে অগ্রগণ্য ছিল তার স্বীকৃতি ইতিহাসেই আছে। সেই আন্দোলন নিচুতলাতেও পৌঁছে দিতে চারণ কবি মুকুন্দ দাসের স্বদেশি যাত্রা অবশ্যই সহায়ক হয়ে থাকবে। কল্পনা করতে ইচ্ছে হয় কবির উদাত্ত গলায় ‘ছেড়ে দাও রেশমি চুড়ি বঙ্গনারী কভু হাতে আর পোর না’ আহ্বান শুনে কুমারী সধবা যুবতি বৃদ্ধা নারী বিলেত থেকে আমদানি রংবেরঙের সাধের চুড়ি হাজারে হাজারে হাত থেকে খুলে ফেলে আসরের মাঝে ভেঙে ছড়িয়ে ফেলছে। সেইসঙ্গে আকাশ ভেদী স্লোগান উঠেছে ‘বন্দেমাতরম’। দেশ স্বাধীন হওয়া সত্ত্বেও আমরা আমাদের যৌবনে সবিতাব্রত দত্তর কণ্ঠে সেই গান শুনে রোমাঞ্চিত হয়েছি। যদিও রেশমি চুড়ি বর্জন আর এখন জরুরি নয়। মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত নিয়েছিলেন শিক্ষা বিস্তারের ব্রত। বঙ্গ বিভাজন সত্ত্বেও আজও বরিশাল শহরে ব্রজমোহন কলেজে অশ্বিনী দত্তের স্মৃতি বহন করে চলেছে। বরিশালের রাজনৈতিক নক্ষত্রদের সর্বাগ্রগণ্য না হলেও প্রথম সারির নেতা ছিলেন জনাব ফজলুল হক। অকৃত্রিম ধর্মনিরপেক্ষ হক সাহেবের সঙ্গে ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর কংগ্রেস সহযোগিতা করলে উপমহাদেশের ইতিহাস ভিন্ন হতে পারত। সুবক্তা এই নেতা বক্তৃতা করতেন নির্ভেজাল বাঙাল ডায়ালেক্টে। তাঁর বক্তৃতা নিয়ে অনেক সরস গল্প আছে। ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষে গরিব কৃষকদের দুর্দশা বর্ণনার পর হক সাহেবের বক্তৃতায় শ্রোতারা অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। শ্রোতারা ছিলেন প্রধানত মুসলমান। তারা পরনের লুঙ্গির খুঁট দিয়ে চোখের জল মুছছেন দেখে হক সাহেব শ্রোতাদের প্রতি আবেদন করেন, মিঞা ভাইরা বইয়া বইয়া কান্দেন (বসে বসে কাঁদুন)। মুক্তি আন্দোলনের ঢেউ উজিরপুরকে কতটা প্লাবিত করেছিল বোঝার বয়স তখন হয়নি। পরে জেনেছিলাম মার দীক্ষাগুরু নগেন্দ্র বিজয় ভট্টাচার্য এক সময় জেলা কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। খদ্দর ছিল তার আজীবন পরিধেয়। তার এক অবিবাহিতা মেয়েও, সম্ভবত তার নাম ছিল রাধা এবং আমার মার সামান্য ছোটো, খদ্দরের শাড়ি ব্লাউজই পরতেন। দেশ বিভাগের পর এপারে এসে নগেন্দ্র বিজয় পূর্ব কলকাতার উল্টোডাঙায় সারদা প্রসাদ ইনস্টিটিউশন নামে একটি অননুমোদিত হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকতা করতেন। এই স্কুলে ছেলে ও মেয়েদের জন্য পৃথক দুটি বিভাগ ছিল। সকালে মেয়েদের এবং দুপুরে ছেলেদের। রাধা এই স্কুলেই মেয়েদের বিভাগে শিক্ষকতা করতেন। ১৯৫০-এর মাঝামাঝি এপার বাংলায় এসে এই স্কুলে ভর্তির সুযোগ পাওয়ায় শিক্ষা জীবনে একটি বছর নষ্ট হয়নি। পরে অবশ্য রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে অনেকগুলি বছরই নষ্ট হয়েছিল। নগেন্দ্র বিজয়ের ইচ্ছে ছিল স্কুলটিকে আশ্রমের আদলে গড়ে তোলার। স্কুলে তিনি কোনও বেঞ্চ হাইবেঞ্চ রাখেননি। ছাত্রছাত্রীদের বসতে হত মেঝেতে সরু লম্বা মাদুরে। সামনে বই রাখা ও লেখার জন্য টানা জলচৌকি। মাস্টারমশাইরাও বসতেন মাদুরের আসনে এবং সামনে জলচৌকি। সে সময়ই নগেন্দ্র বিজয় স্কুলে বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রবর্তন করেছিলেন। মূর্তি গড়া, ছবি আঁকা, কাঠের আসবাব তৈরি, পোশাক তৈরি, ইস্ত্রি এইসব শেখানো হত। চরকায় সুতো কাটা তো ছিলই। ইচ্ছে ছিল টাকার ব্যবস্থা করতে পারলে তাঁতও বসাবেন। স্কুলের মেয়েদের বিভাগটি এখনও আছে এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অনুমোদনও পেয়েছে। তবে অন্য বাড়িতে। কালের নিয়মে নগেন্দ্র বিজয় অতীত হয়ে গেছেন। সঙ্গে স্কুলের আশ্রমিক আদলও।

নগেন্দ্র বিজয়ের বড়ো ভাইকে জানতাম সন্ন্যাসীঠাকুর নামেই। তাকে কোনও দিনও দেখিনি। তবে গার্হস্থ্য জীবনের নামও শুনিনি। মায়ের ঠাকুরের সিংহাসনে সন্ন্যাসী ঠাকুরের একটি বাঁধানো ছবি আছে। মায়ের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে আমার বউদি নমিতা এবং সে ছবির দখলদার। স্ত্রী প্রতিমাও মার কিছু দেবদেবীর উত্তরাধিকার পেয়েছে। সে কাহিনি এখানে অবান্তর হলেও পরে উপযুক্ত প্রসঙ্গে আবার উল্লেখের প্রয়োজন হবে। সন্ন্যাসী ঠাকুর কবে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন মাও তা জানতেন না। লোকশ্রুতি যৌবনে তিনি বিপ্লববাদী মুক্তিযুদ্ধের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। ঋষি অরবিন্দের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে অথবা সন্ত্রাসবাদী পথের অসারতা উপলব্ধি করেও সন্ন্যাস নিয়ে থাকতে পারেন। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের নামী কমিউনিস্ট ছাত্রনেতা বরিশালের ছেলে হীরেন দাশগুপ্তও অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি উগ্রবাম রনদিভে লাইন বর্জন করার পর সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্নভঙ্গের হতাশায় লোটা কম্বল নিয়ে কিছুদিন হিমালয়বাসী হয়েছিলেন। সম্ভবত মোক্ষলাভের এ পথও কম দুর্গম নয় বিবেচনা করে ফিরে এসে দীর্ঘদিন নির্ভেজাল সংশোধনবাদের চর্চা করেন। বরিশালে কমিউনিস্ট পার্টি বেশ ভালোভাবেই বিস্তার করেছিল। দেশভাগের পর পশ্চিমবাংলায় যারা কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের অনেকেই ছিলেন বরিশালিয়া। উত্তাল চল্লিশের কমিউনিস্ট রোমান্টিসিজম উজিরপুরের তরুণদেরও প্রভাবিত করেছিল। মার এক জ্ঞাতি ভাইয়ের ছেলে মণ্টু এই তরুণদের একজন। আবার এই মণ্টুর দৃষ্টান্তই দাদা সুকুমারকে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে দূরে রেখেছিল। দাদার চেয়ে বয়সে বড়ো মণ্টু ছিল মেধাবী ছাত্র। উজিরপুরে স্কুলে পড়ার সময় প্রতি ক্লাসেই ফার্স্ট হতেন। প্রথম ডিভিশনে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর মণ্টু ব্রজমোহন কলেজে পড়তে গিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির কার্ডধারী সদস্যা হন। সেই থেকে বছর বছর পরীক্ষায় ফেল করা অথবা পরীক্ষা না দেওয়া শুরু হয়। মেধাবী ছাত্র ছিলেন দাদাও। তিনি এই মহাজনী দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা বিজ্ঞজনোচিত মনে করেননি। পঁচাত্তর বছর বয়সে পৌঁছেও দাদা বরিশাল শহরের রাস্তায় আকাশের দিকে হাত ছুঁড়ে মণ্টুর স্লোগান দেওয়ার ভঙ্গিমা বর্ণনা করেন: জা-পা-ন-কে রুখতে হবে। রু-খ-তে হলে অস্ত্র চাই। বাস্তবিক দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কমিউনিস্ট পার্টি অক্ষবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে সাধারণ মানুষের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার দাবি করেছিল। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ তখন জনযুদ্ধে পরিণত হয়েছে।

বরিশাল জেলায় সংস্কৃতি চর্চাও ব্যাপক ছিল। মুকুন্দ দাসের স্বদেশি যাত্রার উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। পেশাদার যাত্রাদল নট্ট কোম্পানি কেবল যুক্ত বাংলা নয় অসম, বিহার, ওড়িশাতেও আসর মাতিয়েছে। ছোটোবেলায় আমি নট্ট কোম্পানিকে পালা গাইতে দেখেছি নারায়ণগঞ্জে। পালাগুলি অধিকাংশই পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক হলেও স্বদেশি আন্দোলনও গুরুত্ব পেত। নারায়গঞ্জে নট্ট কোম্পানির যে যাত্রাপালা দেখেছিলাম সেটি রচিত হয়েছিল সুভাষচন্দ্র বসুর সশস্ত্র সংগ্রামকে ভিত্তি করে। সুভাষের বাবা জানকীনাথ বসুর মুখে একটি হৃদয় নিংড়ানো সংলাপ কোনোদিন ভোলা সম্ভব হয়নি: ‘সাগরে যখন ঝাঁপ দিয়েছ মানিক তোলা চাই।’ পারিবারিক থিয়েটারের সম্পর্কে প্রথম জেনেছিলাম উজিরপুরেই। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির পারিবারিক থিয়েটার ও তাতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের অভিনয় বাংলার সংস্কৃতিকে কতটা সমৃদ্ধ করছিল তা বুঝবার বয়স তখনও হয়নি। দিদিমার এক প্রতিবেশির বাড়িতে আমারই সমবয়সি একটি ছেলের সঙ্গে খুব ভাব জমে গিয়েছিল। নাম মনে নেই। সেই একদিন তাদের বাড়ির কারে (টিনের চৌচালা ছাদের নীচে কাঠের সিলিং। এই সিলিং ও ছাদের মধ্যবর্তী অংশ কতকটা ম্যাজেনাইন ফ্লোরের কাজ দিত। কারে ওঠার জন্য কাঠের সিঁড়ি অথবা বাঁশের মই থাকত।) সারি সারি সাজানো বেশ কয়েকটি লোহার ট্রাঙ্কে রাজারানির ঝলমলে পোশাক, পরচুলা, টিনের তলোয়ার, তীরধনুক ও আরও নানা মেকি অস্ত্রশস্ত্র দেখি। দুর্গাপুজোর ছুটিতে প্রবাসে চাকুরিজীবী অথবা ছাত্র ছেলেরা দেশের বাড়িতে এসে থিয়েটার করেন। এসব তারই সরঞ্জাম। নারায়ণগঞ্জে যাত্রার আসরে রাজারানি দেবতাদের ঝলমলে পোশাক দেখে রোমাঞ্চিত হতাম। পরদিন সকালে আসরের মঞ্চের আশপাশে কুশীলবদের গলার মালা থেকে খসে পড়া পুঁতি কুড়িয়ে সংগ্রহ করতাম। বাড়ির সামনে ফুলের বাগানের বেড়া থেকে লোহার পাত খুলে তলোয়ার বানিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতাম। হাতের নাগালে সত্যিকারের থিয়েটারের পোশাকের আকর্ষণ ছিল দুর্নিবার। ঢলঢলে জরির পোশাক গায়ে চড়িয়ে তলোয়ার নিয়ে ওই কারের ওপরেই দুই বন্ধুর যুদ্ধের মহড়া চলেছিল বেশ খানিকক্ষণ।

দুর্গাপুজোর মতোই উজিরপুরে মনসা পুজোতেও মহা ধুমধাম হত। দুর্গাপুজো পাঁচদিনের। মনসা পুজোর আয়োজন প্রকরণ কিন্তু চলত গোটা শ্রাবণ মাস। আসল পুজো অবশ্য একদিনই শ্রাবণ সংক্রান্তিতে। যে-কোনও কারণেই হোক, উজিরপুরে সাপের আধিক্য ছিল। বিষধর গোখরো থেকে নিরীহ গোসাপ পর্যন্ত হেন জাত ছিল না যার দেখা গ্রামের পথেঘাটে যত্রতত্র যখন তখন পাওয়া যেত না। সন্দেহ নেই এদের বিষয় নজর থেকেই রেহাই পেতেই সর্পদেবী মা মনসার আরাধনায় এত জাঁকজমক ধুমধাম। এমন কোনও সম্পন্ন পরিবার খুব কমই ছিল যাদের একটি পৃথক মনসা মন্দির নেই। আদি মামাবাড়ি ধ্বংস্তূপে পরিণত হলেও আশ্চর্যজনকভাবে মনসা মন্দিরের দেওয়ালগুলি কিন্তু তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। যদিও সে দেওয়ালে বিশাল বিশাল বট অশ্বত্থ গজিয়েছে। ছাদ ধ্বসে মেঝেয় পড়েছে। বছরের পর বছর বেড়ে ওঠা ঝোপ জঙ্গলে মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢোকা অসম্ভব ছিল। বড়োদের অলক্ষ্যে আমরা দূর থেকে উঁকি দিয়ে মাথায় মণি ইচ্ছাধারী সাপের সন্ধান করতাম। প্রতিটি মনসামন্দিরেই গোটা শ্রাবণ মাস রয়ানি গান হত। উজিরপুরের রয়ানি গান লোকসঙ্গীতের এক অনন্য সম্পদ। রয়ানি এক অর্থে রামায়ণ গানের বিকল্প। রামায়ণ গানে থাকে রামচন্দ্রের কথা, রয়ানিতে মনসা মঙ্গল। চাঁদ বণিক বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনি। মা মনসাকে তুষ্ট করতে পাঁঠা বলি আবশ্যিক ছিল। সেবার কোনও এক প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে বলির মাংসের কিছুটা ভাগ আমাদের জন্য এসেছিল। টিভির পর্দায় যেসব শেফরা বাড়ির গৃহিণীদের নানান রেসিপি দিয়ে থাকেন, বরিশালের কোনও রন্ধন পটীয়সীর কাছ থেকে বলির পাঁঠার পেঁয়াজ-বিহীন নিরামিষ মাংস রান্না শিখে নিতে পারেন। উজিরপুর বাঙালির সঙ্গীত শিল্পকেও সমৃদ্ধ করেছিল। বিখ্যাত গাইয়ে সিদ্ধেশ্বর, রত্নেশ্বর, সত্যেশ্বর ও মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের আদি বাড়ি ছিল উজিরপুরে। সত্যেশ্বর ছিলেন মার বাল্যবন্ধু। দ্বিতীয় প্রজন্মের মানবেন্দ্র দাদার সমবয়সি। একই বছরে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেছে। সেবার আমরা যখন মামাবাড়ি যাই সত্যেশ্বরও উজিরপুরে ছিলেন। দিদিমার দাওয়ায় মাদুর পেতে বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শুনিয়েছিলেন, বৃন্দাবন পথযাত্রী চলার পথে থেমে যাও। একমুঠো ধুলি তুলে নাও অঙ্গে মাখাও দিবা রাত্রি, ওগো যাত্রী।

সাত

পাঁচ বছরের বালকের স্মৃতিশক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবুও মামাবাড়ির একটি নকশা এখনও চোখে ভাসে। বাজার থেকে একটি রাস্তা সোজা বাড়ির সদর পর্যন্ত পৌঁছেছে। সদর সম্ভবত ছিল দক্ষিণ দিকে। কারণ সেদিকে মুখ করেই দিদিমার ছনে ছাওয়া মাটির ভিটে ও মাটির দেয়ালঘেরা বসতবাড়ি। অধিকন্তু বাড়ির ঠিক পেছনেই মনসা দালান। দেবদেবীর মন্দির উত্তর দিকেই হয় যাতে মূর্তি বসানো যায় দক্ষিণমুখী। আমাদের নিজেদের বাড়ির দুর্গা মণ্ডপও ছিল উত্তরেই। সদর পেরিয়ে ঢুকে প্রথমেই বাঁ-হাতে ছিল বিশাল জায়গা জুড়ে ইঁটের পাঁজা। এগুলি মাতুলবংশের আদি পুরুষদের ভদ্রাসনের ধ্বংসস্তূপ। তারপরে কাফিলা গাছে ঘেরা কয়েক কাঠা জমিতে সবজি বাগান। যার পোশাকি নাম কিচেন গার্ডেন। কলা, মুলো, লাউ, কুমড়ো, শশা, ডাঁটা ফলানো হত। এই বাগানের সবজিতেই একহারি ও নিরামিশাষী বিধবা দিদিমার নিজের প্রয়োজন মিটত, কিছু দানধ্যানও সম্ভবত। এই সবজি বাগানে কয়েকটি কাফিলা গাছও ছিল। রবার গাছের মতোই ছাল চিরে দিলে কাফিলা গাছ থেকে এক ধরণের আঠা ঝরে। ‘পিরীত কাফিলার আঠা লাগলে পরে ছাড়বে না’ এ মাহাত্ম্য বড়ো হয়ে পূর্ণদাস বাউলের গান থেকে জেনেছি। তখন কিন্তু ঘুড়ি জোড়া ছাড়া কাফিলার আঠার অন্য কোনও প্রয়োজন আমাদের ছিল না। বাড়ির পশ্চিমে একটি পুকুর। পুকুরটি আম কাঁঠাল তাল সুপারি নারকেল গাছে ঘেরা। গাছের পাতায় সূর্য সর্বদাই ঢাকা থাকায় এ পুকুরের জল কোনোদিন আলোর মুখ দেখেনি। জল বরফ শীতল। এ জল বাসন মাজা ও কাপড়কাচা ছাড়া অন্য কাজে ব্যবহার হত না। কখনও সখনও মেয়েরা রাত্রে ছোটো বাইরের প্রয়োজনে পুকুর ঘাটে চলে যেত। ঘাট বলতে অবশ্য বড়ো বড়ো কয়েক খণ্ড পাথর ফেলা। গল্প শুনেছি এই পুকুর ঘাটেই কোনও এক কাল রাত্রে মাণিক্যমালা নামের মাতুল বংশের এক বালবিধবা আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিলেন। খুনের কারণ যে মাণিক্যমালার সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়া সে বিষয়ে কারও সন্দেহ ছিল না। কাকতালীয়ভাবে বছর তিন-চার পর খুনিদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এই পুকুর ধারেই জীবনে প্রথম গোসাপ দেখে ভয়ে আধমরা হয়েছিলাম। আবার এই পুকুর থেকে স্থানীয় ভাষায় ছাবি নামে নিজেদেরই তৈরি এক ধরণের খ্যাপলা জাল দিয়ে চিংড়ি মাছ ধরেছি। আড়াআড়ি দু-টুকরো বাঁশের কঞ্চির চার মাথায় চৌকো এক ফালি পুরানো কাপড় বেঁধে দিয়ে এই ছবি তৈরি হত। জলে ডোবানোর জন্য মধ্যে ইটের টুকরো জাতীয় ভারী কিছু এবং টোপ হিসেবে ধানের কুঁড়ো দিয়ে ছাবি জলে নামিয়ে দিলে পাঁচ দশ মিনিটেই শ-দেড়শ চিংড়ি ধরা পড়া অসম্ভব কিছু ছিল না। এভাবে বার দশেক ছাবি জলে ওঠানো নামানো করলেই কিলো খানেক মাছ ধরা পড়তই। মার রান্না সরষে বাটা দিয়ে ঝাল চচ্চড়ি অথবা ডাঁটা, কুমড়ো, কাঁঠালবিচি ঝিঙে জাতীয় পাঁচ মেশালি সবজিতে চিংড়ি ও পেঁয়াজ দিয়ে লম্বা ঝোলের স্বাদই ছিল আলাদা। পুকুরের জলে ভাসমান কচুরিপানা খুব আস্তে আস্তে তুলে আনলেও শিকড়ে ঝুলে থাকা চিংড়ি পাওয়া যেত।

মনসা দালানের বাঁয়ে বাড়ির দক্ষিণ দিকে আরও একটি পুকুর ছিল। এটি অনেক বড়ো এবং শান বাঁধানো ঘাট। এই পুকুর ঘাটই ছিল মাতুল বংশের আদি পুরুষদের শেষ অক্ষত স্মৃতি। পাড়া প্রতিবেশীরাও এই পুকুর থেকেই পানীয় জল নিয়ে যেতেন। দুবেলা জল নিতে এসে মহিলারা মিলনমেলা বসাতেন। বিকেলের এই মিলনমেলা বেশ দীর্ঘস্থায়ীই। এই অনির্ধারিত মহিলা মহলে সুখদুঃখের আদানপ্রদানের সঙ্গে পরনিন্দা পরচর্চাও চলত। মামাবাড়ির এই পুকুরেই প্রথম জলপদ্ম দেখেছিলাম। পদ্মফুল তোলার চেষ্টার প্রশ্নই ছিল না। কারণ প্রথমত সাঁতার জানতাম না। তা ছাড়া বড়োদের সতর্ক করা ছিল পদ্মফুলের ডাঁটায় (স্থানীয় ভাষায় নাল) গোখরো সাপ জড়িয়ে থাকে। পুকুরের উত্তর-পূর্ব কোণে একটি বারোয়ারি কালী মন্দির ছিল। দাদার ম্যাট্রিকুলেশন পাশের টেলিগ্রাম আসতে দিদিমা এই মন্দিরেই ফুল বাতাসা দিয়ে তাৎক্ষণিক পুজো দিতে গিয়েছিলেন। দিদিমার মাটির ঘর এবং ভাঙা মনসা দালানের মাঝে দেড়-দুকাঠার একটি উঠোন। উঠোনের পূব পশ্চিমে দুধারেই বেশ কয়েকটি আম, জাম, জামরুল, তাল, নারকেল, সুপারি গাছ ছিল। এসব গাছের ফলপাকুড় বেচেই দিদিমার তখন সংসার চলে। বাড়ির সামনে দক্ষিণের সবজি বাগান ও মাটির ঘরের মাঝে আরও একটি উঠোন ছিল। সামনে পেছনে দুটি উঠোনই সব সময় ঝকঝকে পরিষ্কার থাকত। প্রত্যেক দিন সকাল বিকেল দুবেলা দুই উঠোন ঝাড়পাটের দায়িত্ব ছিল গুনাই নামের অনাথা এক মহিলার ওপর। দিদিমার সবজি বাগানের দেখভাল, গাছ থেকে ফলফলাদি পাড়া, হাট বাজার সবই সে করত। দিদিমার নিঃসঙ্গ জীবনে অনাথা মহিলা ছিল পুরুষেরও বাড়া। সে জাল ফেলে পুকুর খাল বিল থেকে মাছ ধরত, নারকেল সুপারি গাছে অনায়াসে চড়তে পারত, প্রতিপক্ষ পুরুষ অথবা মহিলা যাই হোক শুধু গলার জোরে নয় প্রয়োজনে লাঠি, দা বঁটি নিয়েও প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করত। সে যখন কোমরে শাড়ির আঁচল জড়িয়ে ঝগড়ায় নামতো তখন দিদিমারও ক্ষমতা ছিল না তাকে সংযত করেন। দিদিমার ধমকের জবাবে সে পাল্টা ধমক দিত, আপনে চুপ করেন ঠাইরেন।

গুনাই ছিল নিশাচরী। রাত বিরেতে একা একা বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়াত। পাড়া প্রতিবেশীর অভিযোগ ছিল গাছের ফলপাকুড় চুরি করতেই গুনাই রাতে আম বাগানে ঘোরাঘুরি করে। গুনাই অভিযোগ স্বীকারও করত না অস্বীকারও নয়। সে বলত ফলপাকুড় সে চুরি করে না, গাছের তলায় ঝরে পড়লে কুড়িয়ে নেয়। মাটির ফল কুড়নো কোনও অন্যায় নয়। অকাট্য যুক্তি। সেই গুনাই-ই এক সময় দেখা গেল সন্ধ্যার পর আর এক পাও ঘরের বাইরে বেরোয় না। শত অনুরোধ উপরোধে বকাঝকাতেও গুনাইকে দিয়ে রাতে ঘরের বাইরে কোনও কাজ করানো যায় না। বহুজনের বহু বলা কওয়ার পর কারণটা জানা যায় যে, সে পেত্নীর সামনে পড়েছিল। সেদিন বাগানে ঘুরতে ঘুরতে অদূর ডোবায় ঝপ করে কিছু পড়ার শব্দ শুনে সে সেদিকে ছুটে যায়। সেটা ভাদ্র মাস ছিল। এ সময় গাছে গাছে তাল পাকে। গুনাইয়ের ধারণা হয়েছিল অবশ্যই পাকা তাল ডোবার জলে পড়ে থাকবে। ছুটে গিয়ে দেখে ধবধবে ফর্সা ঝাঁকড়া একমাথা চুলওয়ালা একটি নরমুণ্ডু জলে ভাসছে। অপরাধ-বিজ্ঞানীরা সন্দেহ করতে পারেন কেউ কোনও মেয়েকে খুন করে প্রমাণ লোপাটের জন্য কাটা মাথা জলে ছুঁড়ে ফেলে গেছিল। সেকালে গ্রামগঞ্জে রাতের বেলা খুনখারাপি খুব একটা বিরল ঘটনা ছিল না। যুক্তিবাদীরা অন্য ব্যাখ্যা দিতে পারেন। গাছ পাকা তাল খসে পড়ে জলের ধাক্কায় ফেটে গিয়ে ভেতরের হলুদ শাঁস বেরিয়ে পড়েছিল। তাকেই গুনাইয়ের ফর্সা মেয়ের মাথা মনে হয়েছে। গাঢ় বাদামি তালের খোসা হয়েছে সে মেয়ের মাথার ঝাঁকড়া চুল। গুনাইয়ের কিন্তু স্থির বিশ্বাস ছিল সে পেত্নীর সামনেই পড়েছিল। পাড়া প্রতিবেশীরাও খুব একটা অবিশ্বাস করেছিলেন তা নয়। সেকালে পূর্ববঙ্গের গ্রামে ভূতপ্রেতের আধিক্য সম্ভবত কিছু বেশিই ছিল।

আমার জন্মের আগেই প্রয়াত ঠাকুরদা নিবারণচন্দ্র একদিন এক পরলোকবাসিনীর মুখোমুখি হয়েছিলেন। ঠাকুরদার ছিল নিত্যদিন বৈকালিক ভ্রমণের অভ্যাস। বিকেল পড়লেই সাজগোজ করে হাতে দামি ছড়ি নিয়ে গ্রামের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন। এর ওর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ডাক দিয়ে খোঁজখবর করতেন। বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রতিদিনই সন্ধ্যা গড়িয়ে যেত। ততক্ষণে গোটা গ্রাম নিঝুম, রাস্তাঘাট শুনসান। সেদিন বোধ হয় ফিরতে একটু বেশি দেরিই হয়েছিল। সময়টা সম্ভবত ছিল শেষ বর্ষা। এই বৃষ্টি হচ্ছে, আবার এই বৃষ্টি থেমে ছেঁড়া মেঘের ভেতর থেকে শুক্লপক্ষের চাঁদ মুখ বের করছে। ঝলমল করে উঠছে বৃষ্টি ভেজা ঝোপঝাড়, গাছের পাতা। ঠাকুরদার দেখলেন পথের পাশে মানকচুর ঝাড়ের মধ্যে সাদা শাড়ি পরনে এক মহিলা দাঁড়িয়ে। গ্রামে গরিবগুর্বো ঘরের মেয়ে পুরুষ অনেকেই সন্ধ্যার পর প্রাকৃতিক প্রয়োজনে ঝোপঝাড়ে আসে। এই মহিলা ঠাকুরদাকে দেখে লজ্জায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। সৌজন্যবশে ঠাকুরদা মহিলাকে সরে যাওয়ার জন্য সময় দিতে খানিকক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিন্তু মহিলা সরে না। বরং ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে শরীরটাকে সামনে পেছনে দোলাতে থাকে। ঠাকুর্দার আর সন্দেহ রইল না যে, তার সামনে দাঁড়িয়ে কোনও প্রেতলোকবাসিনী। ভূতপ্রেতের মুখোমুখি হয়ে ভয় পেলে মৃত্যু অনিবার্য। তাই তিনি হাতের লাঠিটি দিয়ে সজোরে সেই ‘শ্বেতবসনাকে’ আঘাত করলেন। লাঠির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল একটি লকলকে মানকচুর ডগা। ডগার মাথার পাতা থেকে গড়িয়ে পড়েছিল জমে থাকা খানিকটা বৃষ্টির জল। পরে ঠাকুরদা নিজেই নিজেকে প্রবোধ দিতেন যে, সেদিন তিনি যা দেখছিলেন তাতে অলৌকিক কিছু ছিল না। গোটা ব্যাপারটাই প্রাকৃতিক। কচুপাতার বুকে বৃষ্টির জমা জলে চাঁদের আলো পড়ে ঝিকমিক করছিল। আসন্ন শরতের বাতাসে দুলছিল মানকচুর লম্বা ডগা। দুইয়ে মিলে তার দৃষ্টিভ্রম ঘটেছিল।

ঠাকুরমার কুমুদিনীর কিন্তু কোনোদিন মনে হয়নি তার কোনও বিভ্রম হয়েছে। তার নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল সদ্য মৃত প্রিয় বোনঝি তাকে দরজা ধাক্কা দিয়ে ডেকে ঘরে নেওয়ার অনুরোধ করছে। মাও খুব একটা অবিশ্বাস করেননি। তিনি তার শাশুড়ি-মাকে বাধ্য করেছিলেন বোনঝির এই ডাকাডাকির প্রতিকার করতে। আমরা বোনঝিকে কোনোদিন দেখিনি। বোনকে দেখেছি। তার ভালো একটা নাম নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু কোনও প্রসঙ্গ উঠলে বাবা যেহেতু জুড়ানি মাসি বলে উল্লেখ করতেন, আমরাও তাই জুড়ানি ঠাকুরমা বলতাম। আগে নিজের ঠাকুরমার সম্পর্কেই দুচার কথা জানানো জরুরি। তিনি নয় নয় করে চোদ্দোটি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। বারোটি শৈশবেই মারা যায়। মৃত্যুকালে একটি মাত্র মেয়ে ছাড়া আর কাউকে রেখেও যেতে পারেননি। তেরো সন্তানের মৃত্যু দেওয়ার পর কোনও মায়ের প্রকৃতিস্থ থাকা খুবই কঠিন। ঠাকুরমা আক্ষরিক অর্থে অপ্রকৃতিস্থ বলা যাবে না ঠিকই, তবে তিনি স্বাভাবিকও ছিলেন না। সন্তান শোক ভুলতে কুমুদিনী ঠাকুর দেবতাকে আশ্রয় করেছিলেন। বিভক্ত ভারতের এমন কোনও তীর্থস্থান খুব কমই ছিল যেখানে তিনি একা একাই যাননি। কেবল রাত্রে ঘুমনো ছাড়া দিনের বাকি সময়ের প্রায় সবটাই কাটত ঠাকুরের ঘরে। সন্ধ্যার মুখে একবার স্বপাকে সিদ্ধ ভাত খেতেন। পূর্ববঙ্গের হিন্দু বিধবারা ভাত খেতেন পাথরের থালায়, জল পাথরের গ্লাসে। খাওয়ার সময় নিকট আত্মীয়ও ছুঁয়ে দিলেই খাওয়া বন্ধ। বাসি রান্না খাবার কদাপি নয়। কুমুদিনী কিন্তু তার দীক্ষাগুরুর রান্না করা ভাত, তরকারি রেখে দিয়ে কয়েকদিন ধরে খেতেন। তার কাছে সেটা গুরুর প্রসাদ। এ নিয়ে মাকে কয়েকবার বিরক্তিও প্রকাশ করতে দেখেছি। গুরুর রান্না করা বাসি পচা ভাত তরকারি যদি প্রসাদই হয় তা হলে তাকে দিয়ে মাছ রান্না করিয়ে খেতে পারেন। খেলেও ক্ষতি কি। হিন্দু বিধবাদের সেকালে মাছ খাওয়া দূরস্থান, খাওয়ার কথা কানে শোনাও ছিল মহাপাপ। কেন হিন্দু বিধবাদের আহারে বিহারে সেকালের সমাজকর্তারা এত বিধিনিষেধ আরোপ করেছিলেন তা নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। কোনও কোনও সমাজতাত্ত্বিক বিধবা নিপীড়নের পেছনে অর্থনৈতিক কারণও খুঁজেছেন। কুমুদিনীর ক্ষেত্রে নিপীড়নের চেয়ে আত্মনিপীড়নের উপাদানই ছিল বেশি।

ঠাকুরমার জুড়ানি বোন বরিশাল জেলারই কোনও গ্রামে থাকতেন। তার স্বামী ভদ্রলোক ছিলেন সংসার নিরাসক্ত আত্মভোলা। আমাদের বাড়ির পুকুরেই তাদের একটি মেয়ে জলে ডুবে মরে গেছিল। অন্য আত্মীয় পরিজনেরা যখন মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ আয়োজন করছেন, মায়ের মুখে শুনেছি ভদ্রলোক তখন মাকে এসে বলেছিলেন তার খুব খিদে পেয়েছে, কিছু খেতে দিতে। এমন ধারা মানুষের সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকতে পারে না। ছিলও না। অধিকন্তু তাদের বেশ কয়েকটি ছেলেমেয়ে ছিল। একটি ছেলে আবার কিছুটা মানসিক প্রতিবন্ধী। দেশ ভাগের পর তারা হুগলি জেলার রিষড়াতে ডেরা বেঁধেছিলেন। মনে আছে এপারে এসে তাদের খোঁজ পাওয়ার পর পথ সন্ধান জুড়ানি ঠাকুরমা বলেছিলেন রিষড়া রেল স্টেশনে নেমে পাগলা মনুর বাড়ি কোথায় বললে যে কেউ দেখিয়ে দেবে।, জুড়ানি ঠাকুরমাও মাঝেমাঝেই সপরিবারে বড়ো বোন কুমুদিনীর কাছে এসে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে যেতেন। সেই সুবাদে তাদের একটি মেয়ে তার মাসির খুবই ন্যাওটা হয়ে পড়েছিল। সব সময় মাসির পাশে পাশেই থাকত। কিছুতেই নিজেদের বাড়িতে ফিরে যেতে চাইত না। এই মেয়েটিও বালিকা বয়সেই মারা যায়। মৃত্যু হয়েছিল নিজেদের বাড়িতেই। মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ঠাকুরমা ছুটে গেছিলেন শেষ দেখা দেখতে। মৃত বালিকার অন্ত্যেষ্টির পর ঠাকুরমা তার স্নেহের বোনঝির অস্থি নিয়ে বাড়ি ফেরেন। একটি টিনের কৌটো বন্দি করে অস্থি তিনি ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে মেঝে খুঁজে টাটির তলায় রেখে দিয়েছিলেন। ইচ্ছে ছিল সুযোগসুবিধামতো কোনও গঙ্গাতীরবর্তী তীর্থস্থানে গিয়ে পুণ্যতোয়া গঙ্গার জলে বিসর্জন দেবেন। অস্থি মাটির নীচে রাখার পর থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যা আহ্নিকের সময় ঠাকুরমা শুনতে পান কেউ তার দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। ঠাকুরমার কোনও সন্দেহই ছিল না যে, বোনঝির আত্মাই ঘরে আসতে চায়। দেহাবশেষ যে ঘরেই রয়েছে। চোখ বুজে মালা জপতে জপতে ঠাকুরমা বিড়বিড় করতেন, আসছ, আসবাই তো। এত ভালোবাসতা, না আইসা পার। এরপর বাড়ির অন্যরাও দরজায় ধাক্কা শুনতে লাগল। ভয়ে আধমরা অবস্থায় সন্ধ্যা হলেই সকলে এক জায়গায় জড়াজড়ি করে থাকে। কয়েকদিন এমন অবস্থা চলার পর মা তার শাশুড়িমাকে বাধ্য করেছিলেন বোনঝির অস্থি ঘর থেকে সরিয়ে নিয়ে উঠোনে তুলসী মঞ্চের সামনে পুঁতে রাখতে। সেই থেকে নাকি আর দরজায় ধাক্কা শোনা যায়নি।

খুব প্রাসঙ্গিক না হলেও অস্থি নিয়ে আর একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে এবং যার সঙ্গে আমার নিজের ও ঠাকুরমা কুমুদিনীর যোগ আছে। এই ঘটনা অনেক পরের এবং এর সঙ্গে আত্মার কোনও সম্পর্ক নেই। তা ছাড়া ঘটনার সমাপ্তিও হয়েছিল ইংরেজিতে যাকে বলে অ্যান্টিক্লাইমেক্সে। শেষ জীবনে ঠাকুরমা বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের চাইবাসা শহরে তার একমাত্র জীবিত সন্তান আমার পিসি, শোভারানি বিশ্বাসের কাছে থাকতেন। পিসির বাড়িতেই তিনি মারা যান। ঠাকুরমার ইচ্ছে ছিল তার অস্থি যেন গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। স্বভাবতই আমাদের দু’ভাইয়ের ওপরই এই কাজটা বর্তায়। আমরা তার ছেলের ঘরের নাতি। যাব যাচ্ছি করে আমি অথবা দাদা দুজনের কারওরই অস্থি আনতে যাওয়া হয়ে উঠছিল না। ইতিমধ্যে পিসির বড়ো মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। পিসির ভাসুর দেওর চাইছিলেন না শুভ কাজের সময় ভিন্ন বংশের কারও অস্থি বাড়িতে থাকুক। পিসি সেকথা জানিয়ে আমাদের চিঠি দিলেন। পিসির অশান্তি ঘটুক চাইনি। তাই আমি চাইবাসায় গেছিলাম অস্থি আনতে। পিসি বারবার বলে দিয়েছিলেন গঙ্গায় বিসজর্নের আগে ব্রাহ্মণ পুরোহিত দিয়ে অস্থির শান্তি স্বস্ত্যয়ন করতে। গঙ্গার ঘাটে পুরোহিতের অভাব হয় না। কিন্তু আমি যখন চাইবাসা থেকে হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। পুরোহিতরা চলে গেছেন। ভাবলাম ঠাকুরমার ইচ্ছে ছিল গঙ্গাপ্রাপ্তি। ব্রাহ্মণ দিয়ে শান্তি স্বস্ত্যয়ন আবশ্যিক নয়। অতএব হাঁটতে হাঁটতে হাওড়া ব্রিজে উঠে সেখান থেকেই অস্থি গঙ্গায় বিসর্জন দেব মনস্থির করলাম। সেটাই করতে যাচ্ছিলাম। ব্রিজের মাঝামাঝি পৌঁছে সুটকেস খুলে অস্থি বের করে নীচে ফেলার জন্য সবে রেলিং ধরে ঝুঁকেছি, কোথা থেকে ছুটে সাদা পোশাকের পুলিশ দুদিক থেকে আমাকে চেপে ধরল। তখন সত্তরের দশকের অশান্ত দিন চলছে। ঠাকুরমার অস্থি বালিমাটি দিয়ে বলের মতো বানিয়ে তার মধ্যে রাখা ছিল। পুলিশের ধারণা হয়েছিল ওটা বোমা ছাড়া অন্য কিছু নয়। নিজের পরিচয় দিয়ে অস্থি বৃত্তান্ত বলেও কোনও লাভ হল না। আমাকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হল এক থানায়। গঙ্গার পরিবর্তে অস্থির জায়গা হল এক বালতি বালির মধ্যে। কপাল ভালো ডিউটি অফিসারের জেরায় জেরায় যখন জেরবার হওয়ার অবস্থা তখন আকস্মিক এক পূর্বপরিচিত অফিসার থানায় আসায় সেদিন দুর্ভোগ আর বাড়েনি। ঠাকুরমার অস্থিও গঙ্গার বুকে জায়গা পেয়েছিল।

আত্মা ভুতপ্রেতের অস্তিত্ব নিয়ে বিশ্বাস অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব কোনোদিন শেষ হবে মনে হয় না। আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী না হলে রবীন্দ্রনাথ প্ল্যানচেট করতেন না। আমার বাবার অকাল মৃত্যুর পর তার কয়েকজন অনুরক্ত অধস্তন কর্মী শ্রাদ্ধশান্তির আগে আমাদের অশৌচের মধ্যেই তার কোনও নির্দেশ আছে কি না জানতে প্ল্যানচেটে বসেছিলেন। বাবার আত্মা তাদের ডাকে সাড়া দেয়নি। কোনও অজানা কারণে ভয় পেয়ে একটা অঘটন ঘটতে যাচ্ছিল। যাকে মিডিয়াম করা হয়েছিল তার বক্তব্য কেউ তাকে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দিয়েছিল। পরে সবকিছু জানাজানি হওয়ার পর প্রবীণরা তাদের খুবই তিরস্কার করেছিলেন। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে পিণ্ডদানের আগে আত্মা অশান্ত থাকে। সংসারের প্রতি টান তাদের তখনও অটুট। এই অবস্থায় আত্মাকে ডাকলে সে অত্যন্ত বিরক্ত হয়। পূর্বপুরুষের পুণ্যের জোরে সেদিন ওই অর্বাচীনের প্রাণ বেঁচে গেছিল।

আত্মা আছে কি নেই সে বিতর্ক ছেড়ে আমরা নারায়ণগঞ্জে বাবার কর্মস্থলে (পরে দাদার) যে কোয়াটার্সে থাকতাম সেখানকার ভূতের কাহিনি শোনাই। ভুত ছিল পায়খানায়। হঠাৎ পায়খানার দরজা খুললে দেখা যেত ভূত চট করে সরে গেল, এমনই ছিল বিশ্বাস। তবে দরজা আস্তে আস্তে খুললে ভূতকে দেখা যেত না। তাই দিনে অথবা রাতে কখনও ঝট করে পায়খানার দরজা খুলতাম না। আমরা ছোট ভাইবোনেরা কোনও অন্যায় করলে মা ভয় দেখাতেন পায়খানায় বন্ধ করে রাখবেন। মেজো বোন বুলুকে (অধ্যাপিকা অরুণা সরকার) এক সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ পায়খানায় বন্ধ করে রেখেও ছিলেন। সেদিন মা পাটিসাপটা তৈরি করেছিলেন। বিকেলে সকলকে পিঠে দিতে গিয়ে মা দেখলেন, গুণতিতে কম। মায়ের সন্দেহ আমার দু ভাইবোনের কেউ একজন চোর। কিন্তু বারবার জেরা সত্ত্বেও দুজনেই অস্বীকার করেছিলাম। শেষে সেই ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করা হল, সত্যি কথা না বললে পায়খানায় ভূতের সঙ্গে বন্ধ করে রাখা হবে। মিনিট দুই না যেতেই ভয়ে বুলু স্বীকার করল সেই পিঠে খেয়েছে. তার শাস্তি হয়েছিল সে পিঠে পাবে না। কারণ সে আগেই খেয়েছে। আজ স্বীকার করছি পিঠে সেদিন আমিই চুরি করে খেয়েছিলাম। ভূতের ভয়ে বুলু মিথ্যে কথা বলেছিল।

আট

কোথায় যেন পড়েছি গ্রাম থাকলেই তার পাশ দিয়ে একটি নদী বয়ে যায়। ‘আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’— চিত্রকরদের তুলিতেও গ্রামের এমনই ছবি ফোটে। উজিরপুরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কোনও নদী ছিল না। ছিল যে কোনও নদীকে হার মানানো খরস্রোতা এক খাল। খালটি যেমন চওড়া তেমনি তার জলও গভীর। এপার থেকে ওপারের দিকে খালের মাঝামাঝি পর্যন্ত একটি অর্ধনির্মিত ব্রিজ ছিল। প্রাচীনরা বলতেন, যতবার এই ব্রিজ নির্মাণের চেষ্টা হয়েছে ততবারই মাঝামাঝি পৌঁছানোর পরই সেটি ভেঙে পড়েছে। কোনও এক সাধু মহারাজ নাকি বিধান দিয়েছিলেন পিলারের গোড়ায় নরবলি না দিলে ব্রিজ কোনোদিনই তৈরি করা যাবে না। তৎকালীন বিদেশি প্রশাসন এই মহৎ কার্যটি সম্পন্ন করতে আগ্রহ না দেখিয়ে ব্রিজ বানানো বন্ধ করে দিয়েছিল। সেটি অর্ধ সমাপ্ত পড়েছিল বছরের পর বছর। এখানে একটি বিশাল সবুজ মাঠ ছিল। গ্রামের ছেলেরা সেখানে ঘুড়ি ওড়াতো। পূর্ববঙ্গে স্থান বিশেষ পৌষ সংক্রান্তি, সরস্বতী পুজো ও বিশ্বকর্মা পুজোয় কলকাতার আকাশ ঘুড়িতে ছেয়ে যায়। ষাটের দশকের গোড়াতে কলকাতার ঠনঠনেতে একটি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে কিছুদিন পড়িয়েছি। সেখানে ‘কাইট ফ্লাইট ডে’ তে ছুটি দেওয়া হত। উজিরপুরেও বিশ্বকর্মা পুজোতেই সম্ভবত ঘুড়ি ওড়ানো হত পৌষ সংক্রান্তিতে। সংক্রান্তির সঙ্গে ঘুড়ি ওড়ানো, ঘুড়ির প্রতিযোগিতার কি সম্পর্ক আজও জানা নেই। তবে ঢাকাই কুট্টিদের সংক্রান্তি সংজ্ঞাটি বেশ মজাদার: একখান মাস শ্যাস হয় আর একখানা মাস আহে (আসে), এই দুইয়ের চিপার (ফাঁকের) মধ্যে যে দিনখ্যান হ্যারে (তাকে) কয় হাকরাইন (সংক্রান্তি)। আমার ধারণা বাতাসের গতিমুখ এবং বাস্তু সংস্থানের সঙ্গেই ঘুড়ি ওড়ানোর সময়কালের সম্পর্ক থাকে। ঘুড়ির প্রতিযোগিতা ছাড়া উজিরপকুরে অন্য কোনও খেলা নিয়ে বিশেষ মাতামাতি দেখেছি মনে পড়ে না। তবে সেবারে মামাবাড়ি বেড়ানো একেবারে নিস্তরঙ্গ গেছে তাও নয়। বন্ধুর বড়দের অজ্ঞাতে থিয়েটারের বেঢপ পোশাক গায়ে চড়ানোর রোমাঞ্চকর উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। সে সময় কত অল্পতেই আমরা সন্তুষ্ট ছিলাম।

এক সকালে দিদিমার ঘরের চৌকির নীচে গোটা মেঝে জুড়ে ভুঁইফোড় গজাতে দেখে আমাদের ছোটোদের বিস্ময়ের সীমা ছিল না। এতদিন ছড়ার বইয়ে ব্যাঙের ছাতার ছবি দেখেছি। ছোট ছোট ধবধবে ছাতার তলায় বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ব্যাঙ গুটিসুটি বসে। ছবির সেই ব্যাঙের ছাতা বাস্তবে দেখা যায় সেটা জেনেছিলাম সেবার মামাবাড়িতে। সেকালে সম্ভবত অন্তত পূর্ববঙ্গে মাশরুমের চাষ হত না। ওই বয়সে উদ্ভিদবিদ্যা সম্পর্কে কোনও জ্ঞান থাকার প্রশ্নই ছিল না। বড়ো হয়েও জানার কৌতূহল হয়নি। লোকের মুখে মুখে শুনেছিলাম উইয়ের ঢিবিতে যেগুলি গজায় সেগুলি সাদা ধবধবে হয়। পচা বাঁশের গাদারগুলিতে সামান্য বেগুনি রঙের ছোপ। ভুঁইফোড় বারবার একই জায়গায় গজাবে এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। আজকাল বাজারে কাঁকরোল নামের সবজিটি খুব পাওয়া যাচ্ছে। আগে কৃষকরা এই সবজি চাষ করতেন না। লতানো কাঁকরোল গাছ বীজ থেকে জন্মে না। চারা বেরোয় শিকড় থেকে। এই শিকড় এক জায়গায় থাকে না। এক জমির শিকড় অন্য জমিতে চলে গিয়ে সেখানে লতানো চারা মাথা তোলে। এখন যে চঞ্চলা কাঁকরোল লতা অচলা হয়েছে সেটা উদ্ভিদবিদদের কৃতিত্ব। কৃষকরা এই সাফল্যের কল্যাণে একটি অতিরিক্ত অর্থকরী ফসলের চাষ করতে পারছেন। এখন মাশরুম সব দেশেই চাষ হয় এবং খাবার টেবিলে বেশ প্রিয়। তবে সর্বত্রই ইংরেজি মাশরুম নামে এটি পরিচিত নয়। বাংলারই বিভিন্ন গ্রামে নাম। একবার বাঁকুড়ায় নাম বিভ্রাটে এই সুখাদ্যটি হাতছাড়া হয়েছিল। কাজের তাগিদে বাঁকুড়া শহরে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে দিন দুই অতিথি হতে হয়েছিল। গৃহিণী জানতে চেয়েছিলেন ছাতু খাই কি না। ছাতু নামে যে বস্তুটি জানতাম, কাঁচালঙ্কা সহযোগে সেটি দিয়ে নিম্নবিত্ত হিন্দিভাষীরা দুপুরের খিদে মেটায়। দুচার দিন বাড়িতে শখ করে সকালে ছাতু দিয়ে জলখাবারও সেরেছি। তবে দুধ চিনি দিয়ে সে ছাতুকে তরিবৎ করে মণ্ড তৈরি করা হত। গরিব হিন্দিভাষী মজুরদের মতো কাঁচালঙ্কা নুন আর জল দিয়ে মেখে নয়। কাজেই গৃহিণীকে জবাব দিয়েছিলাম, ছাতু খাই না তা নয় তবে খুব একটা পছন্দের নয়। তারপর যখন খাবার টেবিলে বসে বুঝতে পেরেছিলাম ছাতু মানে মাশরুম তখন বেশ আপশোশ হয়েছিল। কারণ আমি পছন্দ করি না বলে গৃহিণী আমাকে দেননি। পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি রেস্টুরেন্টে বিফ চিকেন লেগ, কড ফিশ ফ্রাই জাতীয় খাদ্য যখন মুখরোচক মনে হয়নি তখন পাঁউরুটির সঙ্গে স্ক্র্যাম্বেলড এগ উইথ মাশরুম অথবা ওমলেট উইথ মাশরুম দিয়ে পেট ভরাতাম। কিন্তু মামাবাড়িতে সেই প্রথম দিন মা আলু পেঁয়াজ দিয়ে যে ভুঁইফোড় রান্না করেছিলেন তার স্বাদই ছিল আলাদা। গাঁ-গঞ্জে তখন কাটা মাংস বিক্রি হত না। হলেও দিদিমার কেনার সামর্থ্য ছিল না। সেই একদিন মনসা পুজোর সময় প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে বলির মাংস পাঠিয়েছিল। সে মাংস রান্না হয়েছিল পেঁয়াজ রসুন ছাড়া। সেই নিরামিষ মাংসের স্বাদ মায়ের হাতের ভুঁইফোঁড়ের স্বাদের ধারে কাছেও আসে না। অবশ্য একদিন পেঁয়াজ রসুন দিয়ে পাশের পুকুরে ধরা পড়া কচ্ছপের মাংসও বেশ তারিয়ে তারিয়েই খেয়েছিলাম। বাড়ির উঠোনে সোনামামার একটি জলজ্যান্ত কাছিম কাটতে দেখার অভিজ্ঞতাও কম উত্তেজক ছিল না। সেটির পেটে অনেকগুলি ডিমও ছিল।

অবশ্য চরম উত্তেজনার এবং শংকারও কারণ ঘটেছিল যেদিন বাড়িতে সিঁদেল চোর আসে। সিঁদ কেটে চুরি, সিঁদেল চোর বিষয়ে বড়োদের মধ্যে অনেক আলোচনা শুনেছি। প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম মামাবাড়ি গিয়ে। গ্রামে মেয়েরা বাপের বাড়িতে এলে সে বাড়িতে চোরের আনাগোনা শুরু হয়। শ্বশুরবাড়ির মান রাখতে মেয়েরা বাপের বাড়ি আসার সময় তাদের দামি অলঙ্কার শাড়িজামা সব সঙ্গে নিয়ে আসত। সুযোগ পেলে সেইসব শাড়ি গয়না হাতিয়ে নেওয়ার জন্য বাড়ির আশেপাশে চোর ঘুরঘুর করত। সব গ্রামেই এক দুজ’ন দাগি চোর থাকত। তারা গ্রামের লোকের অচেনা ছিল না, হাতেনাতে ধরতে পারলে উত্তমমধ্যমও দিত। কিন্তু ঘটনা খুবই বড়ো ধরণের না হলে পুলিশ কাছারি পর্যন্ত পৌঁছাত না। গ্রামের মাতব্বর ব্যক্তিরাই শাস্তির বিধান দিয়ে দিতেন। এখনকার মতো সে কালেও সম্ভবত পুলিসের ওপর মানুষের তেমন ভরসা ছিল না। শুধু চুরি নয়, যেকোনও সামাজিক অপরাধেই শাস্তির বিচিত্র সব ধরণ ছিল। মারধর ছাড়াও কখনও কখনও অপরাধীদের মাথার চুল অর্ধেক কামিয়ে মুখে চুনকালি মাখিয়ে গোটা গ্রাম ঘোরানো হত। শাস্তি হিসেবে মাথা ন্যাড়া করা বোধ হয় দীর্ঘকালের রীতি। এ নিয়ে মজাদার এক কবিতাও আছে। ছোটো ভাই বিভীষণ ম্যাট্রিকে থার্ড ডিভিশন পাওয়ায় লঙ্কেশ্বর রাবণ শাস্তি ঘোষণা করেছিলেন ‘মাথা তোর ন্যাড়া করে ঘোল ঢেলে শিরে, সাতদিন রেখে দেব সাগরের তীরে’। পরকীয়া প্রেম, ভিন্ন বর্ণে প্রেম বিবাহের মতো ক্ষমার অযোগ্য গণ্য সামাজিক অপরাধে সংশ্লিষ্ট পরিবারকে একঘরে করা হত। আমাদের জ্ঞাতি পরিবারের এক যুবক প্রেম বিবাহ করায় গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল। তার নাম ছিল জগদীশ। আমরা ছোটরাও ছড়া কাটতাম— জগদীশ কাঁচকলা ভাতে দিস, তুই না খেলে তোর বউকে দিস। বড়রাই কেউ শিখিয়ে থাকবে। তবে শাস্তির প্রশ্ন ওঠে ধরা পড়লে তবেই। কথায় আছে চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ে ধরা। মহাবিদ্যাধরদের ধরা না পড়ার ক্ষমতা অপরিসীম। ধরা যাতে না পড়ে সেজন্য অতীতে তারা নানা কৌশল অবলম্বন করত। প্রথমেই যাতে চিনতে না পারা যায় তার জন্য তারা মুখে চুনকালি মেখে নিত। চুনকালি মাখার অন্য উদ্দেশ্য হতে পারে ভয় দেখানো। অন্ধকারে একটি বীভৎস মুখ দেখলে আঁতকে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কয়েক মুহূর্তের বিহ্বলতার সুযোগ নিয়েই মহাবিদ্যাধরের পিঠটান দেওয়া অসম্ভব ছিল না। এখন অবশ্য চোর ডাকাতরা মুখে চুনকালি না মেখে মুখোশ পরে অথবা কালো কাপড় বেঁধে নেয়। অন্তত সিনেমা থিয়েটারে সেরকমই দেখা যায়। ধরা পড়েও যাতে হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে যেতে পারে, সেজন্য চোরেরা মাথায় কদম ছাঁট চুল রাখত, অর্থাৎ কদম ফুলের মতো ছোটো ছোটো খাড়া খাড়া যাতে হাতের মুঠোয় ধরা না যায়। তারা গায়ে জবজবে করে সরষের তেল মেখে নিত পাঁকাল মাছের মতো পিছলে বেরিয়ে যাওয়ার সুবিধার জন্য।

এসব কৌশল অবশ্য প্রয়োজন হত যদি গৃহস্থ টের পেত এবং হাঁকডাক করে পাড়াপ্রতিবেশীদের জড়ো করতে পারত। চোরেরা নিশিকুটুম্ব। সাধারণত রাতে গৃহস্থের ঘুমের মধ্যে বাইরে থেকে হাত গলিয়ে যতটা সম্ভব হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হত। একমাত্র দুঃসাহসীরাই ঘরে ঢুকে চুরি করার চেষ্টা করত। একবার জানলার গরাদ ভেঙে মার মাথার পেছনে রাখা ট্রাঙক বাইরে থেকে হাত গলিয়ে চুরি করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। তখনও চামড়ার সুটকেস তেমন জনপ্রিয় হয়নি। আধুনিক সফট লাগেজের তো প্রশ্নই ওঠে না। শুধু ঘরেই নয়, কোথাও যাওয়ার সময়ও টিনের ট্রাঙ্ক অথবা বাক্সে জামাকাপড় টাকাপয়সা অলঙ্কার প্রভৃতি যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস ভর্তি করে নেওয়া হত। গ্রামের মানুষের বাক্সের রং যেন আবশ্যিকভাবেই সবুজ হত এবং ডালায় (ঢাকনা) টিয়াপাখি, গোলাপ ফুল, তবলা, একতারা অথবা বাবুবিবির ছবি আঁকা থাকত। শহুরেদের ট্রাঙ্ক একরঙা, বেশিরভাগই কালো অথবা বাদামি ধরনের, আকারেও অনেক বড়ো। মহাত্মা গান্ধী রোড এবং লেনিন সরণিতে আর্য ফ্যাক্টরির মতো কয়েকটি প্রাচীন দোকানে এরকম বড়ো বড়ো ট্রাঙ্ক এখনও দেখা যায়। কারা ব্যবহার করেন জানা নেই। মার এরকমই একটি বড়ো ট্রাঙ্ক চুরির চেষ্টা হয়েছিল একবার দুর্গাপুজোর সময় নিজেদেরই বাড়ি থেকে। অক্ষত না থাকলেও এখনও যেটি স্মৃতি হিসেবে রেখে দেওয়া আছে। ভেতরে মা ও বাবার ব্যবহৃত কয়েকটি ছোটোখাটো জিনিস। সারাদিন পুজো বাড়ির কাজকর্ম, হইহুল্লোড়ে, ক্লান্ত বাড়ির সবাই মাঝরাতের পর ঘুমে প্রায় অচৈতন্য হয়ে ছিল। চোর এই সুযোগটাই নেওয়ার চেষ্টা করে এবং প্রায় সফলও হচ্ছিল। মার ঘুম ছিল পাতলা। গরাদ ভেঙে চোর সবে আঙটা ধরে বাক্সটি জানলার ফ্রেমের ওপর তুলেছে, ঠিক তখনই মার ঘুম ভেঙে যায়। তিনি বাক্সের অন্যদিকের আঙটা টেনে ধরে চেঁচামেচি শুরু করে দেন। টানাটানিতে মারই জয় হয়েছিল কারণ বিজ্ঞান ছিল তার সহায়। বাক্সের বেশি অংশটা ঘরের মধ্যে মার দিকে থাকায় তিনি ল অফ গ্রাভিটেশেনের সুবিধা পেয়েছিলেন। তা ছাড়া চোরেরও তাড়া ছিল। আকস্মিক সে আংটা ছেড়ে দিয়ে চম্পট দেয়। মা এই আকস্মিকতায় ল অব ইনারশিয়ার শিকার হয়ে পেছন দিকে ছিটকে পড়েন। বাক্সও আছড়ে পড়ে বিছানার ওপর যেখানে দাদা অথবা দিদির কেউ একজনের মাথা খুব কাছেই ছিল। আমার তখন জন্মই হয়নি। পরে কোনও চুরির প্রসঙ্গ এলেই মার এই সাহসিকতার কথা উঠত। মা নিজে কিন্তু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতেন ওই ভারী বাক্স তার সন্তানের মাথায় না পড়ার কারণে। পড়লে মৃত্যু অবধারিত ছিল।

সিঁদেল চোরদের আক্রমণের লক্ষ্য হত মাটির বাড়ি। সিঁদকাঠি এবং ভুষোকালি মাখানো মানুষের মাথার মাপের একটি মাটির হাঁড়ি তাদের চুরির সরঞ্জাম। সিঁদকাঠি আসলে এক হাত মতো একটি লোহার শাবল। এই সিঁদকাঠি দিয়েই বাড়ির ভিটে ও দেওয়ালের ঠিক জোড়ের কাছে একজন মানুষ ঢোকার উপযোগী সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়। এই সুড়ঙ্গ সিঁদ। সিঁদকাঠি প্রয়োজনে অস্ত্রেরও কাজ দেয়। সিঁদেল কখনও প্রথমেই সিঁদে মাথা ঢোকায় না। ভুষোকালি মাথা মাটির হাঁড়িটি ধীরে ধীরে সিঁদের মুখ দিয়ে গলিয়ে দেয়। চোরের আগমন টের পেয়ে বাড়ির লোক ধরার জন্য ওত পেতে বসে থাকলে এই কালো হাঁড়িকেই অন্ধকারে চোরের মাথা মনে করে আক্রমণ করবে। চোর পালিয়ে যেতে পারবে। সব সময়ই সিঁদেলের হিসেবে মিলবে এমন কোনও কথা নেই। সিঁদেলের ফন্দিফিকির যাদের জানা ছিল তারা ডামি চোরকে বিনা বাধায় ঢুকতে দিতেন। তারপর সিঁদেল নিজেই মাথা গলালেই লাঠির বাড়ি। অনেক সময় দা বঁটি দিয়ে কোপও। কিন্তু এজন্য সাহস ও শক্তি অথবা জনবল দুইই অত্যন্ত জরুরি ছিল। মামাবাড়িতে চোর সিঁদ কাটার কাজ শেষ করেছিল ঠিকই কিন্তু ঘরে ঢোকার সুযোগ পায়নি। আমরা যাওয়ার পর থেকে আমাদের নিরাপত্তার জন্য সোনামামা এসে রাত্রে ঘরে থাকতেন। সোনামামার বিছানা হত ঘরের মেঝেতে। চোর ঘরে ঢোকার আগেই তিনি জেগে উঠে চিৎকার করেন, কে রে? চোর বোধ হয় একের বেশিই ছিল তারা ঘরের খোলা বারান্দায় উঠে এসে পাল্টা ধমক দেয়— চুপ। সোনামামা ভয় পাননি, চুপ করেও থাকেননি। আকাশ ফাটা চিৎকার করে তিনি প্রতিবেশিদের জাগিয়ে তোলেন। এদিকে অদূরে নতুন হাসপাতালের নাইট ডিউটিতে যারা ছিলেন তারাও কম্পাউন্ডারবাবুর গলা চিনতে পেরে চিৎকার করে জানিয়ে দেন ভয় নেই তারা আসছেন। বলা নিষ্প্রয়োজন এরপর চোর অথবা চোরেরা অপেক্ষা করেনি। পরদিন সকালে গুনাই এসে চোরের কাটা মানুষ সমান সুড়ঙ্গ মাটি দিয়ে ভর্তি করে লেপেপুছে আগের অবস্থা ফিরিয়ে আনে। আমি ব্যস্ত ছিলাম গোয়েন্দাগিরিতে। আগের রাতের চোর পালিয়ে যাওয়ার পর বড়রা যে আলোচনা করছিলেন তা থেকে জানতে পারি চুরি করতে গিয়ে চোর ব্যর্থ হলে পরদিন সে বাড়ির আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে। উদ্দেশ্য বাড়ির লোকেদের প্রতিক্রিয়া অনুমান করা। সুযোগ বুঝলে একই বাড়িতে আবার চেষ্টা করা। অতএব কেউ দায়িত্ব না দিলেও সারাদিন নিজেই নজরদারিতে নেমেছিলাম। সন্দেহভাজন কাউকে পাকড়াও করতে পারলে নিশ্চিত বাহবা মিলত। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সন্দেহ করার মতো সেদিন কাউকে বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখা যায়নি।

আমরা থাকতে থাকতেই মামাবাড়িতে সেবার উচ্ছ্বাস আর আনন্দের ঢেউ উঠেছিল হঠৎ মামা এসে হাজির হওয়ায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে সেনাবাহিনীতে নাম লেখানোর পর মামা আর বাড়িমুখো হননি। আমার বাবাকে নিজের প্রয়াসে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সদিচ্ছা জানিয়ে একখানা চিঠি এবং কালেভদ্রে দিদিমাকে দু-একখানা পোস্টকার্ড পাঠানো ছাড়া তিনি কোনও যোগাযোগই রাখতেন না। সেই মামাই কাউকে কোনও খবর না দিয়ে শুধু বাড়ি এসে হাজির হওয়াই নয়, কে কোথায় কেমন আছে না জেনেই আত্মীয়স্বজন সকলের নামে উপহারও নিয়ে এসেছিলেন। অধিকন্তু দিদিমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন তখনকার বিচারে বেশ মোটা অংকের টাকাও। একমাত্র ছেলে ফিরে আসায় দিদিমা যে হাউমাউ কান্না শুরু করেন তাতে পাড়া প্রতিবেশীরাও জুটে যায়। গ্রামের মহিলাদের একটা বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দুঃখই হোক অথবা আনন্দ, নিজেরাই হোক অথবা পরের, তারা গলা ছেড়ে কান্না জুড়ে তাদের ভাবাবেগের প্রকাশ ঘটাতে পারেন। দিদিমার সঙ্গে আনন্দ অশ্রু বাড়াতে সেদিন বেশ কয়েকজন প্রতিবেশী মহিলা বাড়ির উঠোনে জড়ো হয়েছিলেন। স্নেহের ভাইটির আকস্মিক আগমনে বিহ্বল মা-ই ছিলেন নির্বাক নিশ্চুপ। যদিও খুশিতে তার চোখ দিয়েও অঝোরে জল ঝরছিল। এরপর কদিন মামাবাড়িতে শুধুই উৎসবের মেজাজ। মামা নিজে আমাদের ছোটোদের তো বটেই পাড়ার বড়োদেরও যুদ্ধের গল্প শোনাতে শোনাতে ক্লান্ত। কোন কোন দেশে অক্ষবাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ করেছেন, ক’টা সমুদ্র পাড়ি দিয়েছেন, মাঝ দরিয়ায় মিত্রশক্তির জাহাজের আকস্মিক জাপানি সাবমেরিনের সামনে পড়া এ সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তাঁকে বারবার দিতে হয়েছে। বাস্তবিক যুদ্ধ ফেরত চিত্তরঞ্জন এখন গ্রামে একজন সেলিব্রিটি। তবে চিরদিনই তার নতুন নতুন সমস্যা তৈরি করার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। মা ও দিদির স্নেহ এবং ভালোবাসার উত্তাপ পেয়ে চিত্তরঞ্জন স্থির করে ফেললেন তিনি আর সেনাবাহিনীতে ফিরে যাবেন না। সেনাবাহিনীতে চাকরি পাওয়া এবং ছাড়া দুইই অত্যন্ত কঠিন কাজ। চিত্তরঞ্জন হাল ছাড়ার পাত্র নন। তিনি গোটা উজিরপুর গ্রামের সমস্ত গণ্যমান্য ব্যক্তির স্বাক্ষর-সহ সেনাবাহিনীতে এক গণদরখাস্ত পাঠালেন। সেই দরখাস্তের সারমর্ম চিত্তরঞ্জন বিধবার একমাত্র ছেলে। তার অবর্তমানে বৃদ্ধা মার দেখাশোনার কেউ নেই। বিলাতে রাজাবাহাদুরের কাছে আপামর উজিরপুরবাসীর একান্ত প্রার্থনা যে হুজুর দয়াপরবশ হয়ে চিত্তরঞ্জনকে তার সেনাবাহিনী থেকে অব্যহতি দিন। এই দয়া প্রদর্শনের কারণে গরিব মা ও ছেলে আমৃত্যু ইংলন্ডেশ্বরের অনুগত থাকবে। চিত্তরঞ্জন সেনাবাহিনী থেকে রিলিজ অর্ডার ঠিকই আদায় করেছিলেন। কিন্তু ততদিনে আমরা আমাদের নিজেদের বাড়িতে ফিরে গেছি। কারণ দুর্গাপুজোর আর দেরি নেই।

নয়

আমাদের ছিল দুটি বাড়ি। তৎকালীন ঢাকা জেলার নারায়ণগঞ্জ মহকুমা শহরের গায়ে গোদনাইলে স্বদেশি কাপড়ের কল লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসে বাবা উঁচু পদে কাজ করতেন। মিল কম্পাউন্ডের মধ্যেই তাঁর কোম্পানির দেওয়া কোয়াটার্স আমাদের ছাড়তে হয়নি। কোম্পানি পরিচালনায় বাবার অবদানের স্বীকৃতিতে দাদাকে অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে চাকরি দেওয়া হয়েছিল। সেই সঙ্গে বাবার কোয়াটার্সেই থাকার উদার অনুমতি। ততদিনে সেটি ঘোষবাবুর কোয়াটার্স নামে পরিচিত হয়ে গেছে । তা হলেও সেটা আমাদের বাড়ি নয়, বাসা। বাড়ি ছিল বরিশাল জেলার গৌরনদী থানায় বাঁকাই গ্রামে। গোটা বছরে পুজোর সময় দিন পনেরো ছাড়া সেই বাড়িতে থাকার অবকাশ না হলেও ‘সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া’। বাড়িতে দুর্গাপুজো হত। আমরা ষষ্ঠী কিংবা সপ্তমীর সকালে পৌঁছতাম। লক্ষ্মীপুজোর দু’পাঁচ দিন পরেই আবার ফিরে যেতে হত মিল কম্পাউন্ডের বাসায়। ফেরার দিন এক বুক ভাঙা পরিবেশ তৈরি হত। বাবা ও ঠাকুরমা দুজনে দুজনের গলা জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতেন। পাশে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতেন মা-ও। আর বড়োদের এভাবে কাঁদতে দেখে আমরা ছোটরা বিহ্বল নির্বাক। এ কান্নার প্রাথমিক কারণ অবশ্যই ছিল মা ও ছেলের আসন্ন দীর্ঘ বিচ্ছেদ। তবে মাটির টানও কি ছিল না? যদি নাই থাকবে তা হলে নতুন বাংলা বছরের শুরুতেই প্রথমেই পাঁজি খুলে দুর্গাপুজো কবে দেখা হত কেন। আর আক্ষরিক অর্থেই সেদিন থেকে বাড়ি যাওয়ার দিন গোনা শুরু হত। অতীতের দিন গোনার কথা স্মরণ করে হয়ত দাদা তার এই সত্তরোর্ধ বয়সেও বিজয়া দশমীর পরদিন রসিকতা করেন, পুজোর আর মাত্র ৩৬৪ দিন বাকি।

গোদনাইলের বাসা বাড়ি থেকে জলপথে বাঁকাইয়ের দেশের বাড়ি পৌঁছতে প্রায় দুদিন লাগত। এখন নাকি সড়ক পথে বাসে অনেক কম সময়েই পৌঁছানো যায়। ১৯৯২ সালে কাজের সূত্রে ঢাকা যেতে হয়েছিল। সেই সুযোগে নারায়ণগঞ্জ ও গোদনাইলে লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসের বাসা বাড়িও দেখে এসেছি। যাওয়ার ইচ্ছে ছিল বাঁকাই গ্রামেও ঢাকায় পরিচিত বন্ধুরা পরামর্শ দিয়েছিলেন সড়ক পথে কম সময় লাগলেও অন্তত যাতায়াতের যে-কোনও একবার যেন জলপথে স্টিমারে সফর করি। দুর্ভাগ্য শারীরিক কারণে যাওয়াই হয়নি। সপ্তসিন্ধু কেন জলপথে কোনও সমুদ্রই আজ পর্যন্ত পার হওয়ার সুযোগ হয়নি। বাসাবাড়ি থেকে দেশের বাড়ি যে একের পর শীতল্যক্ষা, বুড়িগঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, আড়িয়াল খাঁর মতো বিশাল বিশাল নদী পাড়ি দিতে হতো বোধহয়। সেই জলপথ ভ্রমণের রোমাঞ্চ সপ্তসিন্ধু পার হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে কিছু কম নয়। ওই সব নদীতে যে স্টিমার চলত সেগুলিকে জাহাজ বলাই সমীচীন। কলকাতার প্রিন্সেপঘাট থেকে পোর্টব্লেয়ার যে জাহাজগুলি চলাচল করে সেগুলি পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরীতে যে স্টিমার চলত আকারে তার চেয়ে খুব বড়ো নয়। স্টিমারগুলি সাধারণত তিনতলা হত। একেবারে ওপরের তলায় সারেঙের কেবিন। জাহাজে যিনি ক্যাপ্টেন তিনিই স্টিমারে সারেঙ। দুইয়েরই কাজ এক হলেও এই নামান্তরের কারণ বর্ণবৈষম্য ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। সেকালে ভারতীয় জাহাজের ক্যাপ্টেনরা প্রায় সকলেই ব্রিটিশ হতেন। স্টিমারের সারেঙরা অধিকাংশই চট্টল মুসলমান। প্রভু ও নেটিভের এক নাম হতে পারে না। সারেঙকে সব সময় দেখতাম একটি বিশাল স্টিয়ারিং দুহাত দিয়ে ধরে সেটিকে কখনও বাঁয়ে কখনও ডাইনে ঘোরাচ্ছেন। মাঝে মাঝেই দূরবীন চোখে লাগিয়ে সামনে দেখে নিতেন। আমরা ছোটরা তার কেবিনের আশেপাশে ঘুরঘুর করলে অথবা উঁকিঝুঁকি দিলে যেভাবে কটমট করে তাকাতেন তাতে বুক হিম হয়ে যেত। অতএব সারেঙের কেবিনের ধারে-কাছে বড়ো একটা ঘেঁষতাম না। তবে মাঝে মাঝেই একতলায় ইঞ্জিন ঘরের কাছে নেমে যেতাম। সে জায়গাটা ছিল অসম্ভব গরম এবং কানে তালা ধরানো একটানা গোঁ ঘোঁ শব্দ। প্রায় সময়ই দেখা যেত কোনও একজন নাবিক বেলচায় করে বয়লারে কয়লা দিচ্ছে। তার মাথায় একটি রুমাল বেঁধে চুলগুলি ঢাকা দেওয়া, পরনে হাফপ্যান্ট ও স্যান্ডো গেঞ্জি। কয়লাগুঁড়ো জমে জমে মাথার রুমাল, পরনের প্যান্ট, গেঞ্জি সবই ঘোর কালো রং হয়ে গেছে। কয়লার গুঁড়োর কারণেই সেগুলির রং কালো অথবা কালোর রঙের রুমাল, প্যান্ট গেঞ্জি ব্যবহারই রীতি তা নিশ্চিত বলা যাবে না। পাথর খোদা মূর্তির মতো সবল সুঠাম এই নাবিকদের গা দিয়ে সব সময় ঘাম ঝরতে দেখা যেত। এরাও প্রায় সকলেই চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, ময়মনসিংহের মতো উপকূলবর্তী জেলার মুসলমান। ইঞ্জিন ঘরে আমাদের সবচেয়ে আকর্ষণের ছিল এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত মোটা চকচকে লোহার পাইপে চোঙার মতো দেখতে সারি সারি সাজানো কতগুলি সাদা চিনেমাটির কিছু একটা যন্ত্র। অ্যাথলিটরা যেমন প্যারালাল বারে কসরৎ দেখায় এগুলিও তেমনি সামনে পেছনে দুলত। যেন একজন ব্যায়ামবীর পিঠ ঝাঁকিয়ে একবার পেছনে ঝুঁকছেন। আবার সোজা হয়ে সামনে ঝুঁকছেন। এগুলির কি কাজ কোনোদিন জানা হয়নি। তা হলেও পলকহীন চোখে দাঁড়িয়ে সেই ব্যায়ামবীরের বাস্তব কেরামতি দেখতাম। হঠাৎ কোনও নাবিক মুখ তুলে আমাদের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসি ছুঁড়ে দিলে কৃতার্থ বোধ করতাম।

দিন গোনা শুরু হয়ে যেত অনেক আগে থেকেই। টুকটাক বাঁধাছাদা বিশ্বকর্মা পুজোর পরে পরেই আরম্ভ হত। বছরে একবারই দেশের বাড়িতে যাওয়া। নিজেদের ট্রাঙ্ক-ভর্তি জামাকাপড়, বড়ো বড়ো বেডিং ছাড়াও দেশের বাড়িতে আত্মীয় বান্ধবদের জন্যও উপহার নিয়ে যাওয়া হত। বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন পাড়া প্রতিবেশী প্রায় সকলের জন্য শাড়ি ধুতি নিয়ে যেতেন। এজন্য ওই লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিল থেকেই এক বেল ধুতি ও এক বেল শাড়ি কেনা হত। সপ্তমীর দিন সকালে বাবা দক্ষিণের বৈঠকখানায় বসতেন। একে একে পড়শিরা আসতেন বড়কর্তার সঙ্গে দেখা করতে। আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে বাবার চেয়ে বয়সে বড়ো অনেক থাকলেও সম্পত্তির ভাগের বিচারে বাবাই ছিলেন বড়কর্তা। দেশের বাড়িতে বরাবর থাকতেন বাবার জ্ঞাতি নোয়াকাকা (ন’কাকা), আমাদের নোয়াদাদু। গ্রামের সবাই তাকে নোয়াকর্তা বলতেন। বাবার নিজের কাকা সতীশচন্দ্র ছিলেন ছোটকর্তা। ঠাকুরদা নিবারণচন্দ্র ছিলেন বিষয় সম্পত্তির বড়ো শরিক। সেই সুবাদে গ্রামের বড়কর্তা নিবারণচন্দ্রের ছেলে প্রমোদরঞ্জনও তাই বড়োকর্তা। বড়ো কর্তার সঙ্গে দেখা করতে গ্রামের মানুষ হাতে একথালা বাতাসা ও একজোড়া নারকেল নিয়ে আসতো। বাবা তাদের কারও হাতে তুলে নিতেন একখানা ধুতি, কারও হাতে শাড়ি। দেশের বাড়ি যাওয়ার পথে সঙ্গের পর্বতপ্রমাণ লাগেজের মধ্যে একটি বিশাল মানকচুও থাকত। বিরানব্বুইয়ের লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসে ঘোষবাবুর কোয়াটার্সে দেখেছিলাম গ্যাস লাইন বসেছে। আমরা যখন ওই কোয়াটার্সে থাকতাম তখন উনুন জ্বলত কয়লার। কয়লায় ছাই ফেলা হত বাথরুম পায়খানার পাশে কোয়াটার্সের এক কোণায়। ওই ছাইয়ের গাদায় আপনা আপনি গজিয়েছিল এক মানকচুর ঝাড়। সে কচু আকারে যেমন বড়ো ছিল স্বাদও ছিল অসাধারণ। মুখ চুলকানোর প্রশ্নই ছিল না, গলে যেত মাখনের মতো। এমনকী কচুর ডগা দিয়েও মা অপূর্ব এক ছেঁচকি রান্না করতেন। কচু ওঠানো হলেই খণ্ড খণ্ড করে অন্য সব কোয়াটার্সে পাঠানো হত। আধমণটাক ওজনের একটি মানকচু দেশের বাড়িতেও নিয়ে যাওয়া হত। জ্ঞাতিদের দেওয়ার জন্য।

নারায়ণগঞ্জ থেকে স্টিমার ধরবার জন্য দুপুরের মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে হত। গোদনাইলের বাসাবাড়ি থেকে নারায়ণগঞ্জ শীতল্যক্ষা নদী ধরে নৌকায়। এ নদী আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। শীতল্যক্ষার পশ্চিম পাড়েই ছিল লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস। পাশাপাশি আরও দুটি স্বদেশি কাপড়ের কল চিত্তরঞ্জন ও ঢাকেশ্বরী ১ নম্বর। নদী পেরিয়ে পূবে ঢাকেশ্বরী ২ নম্বর। পরে আমরা থাকতে থাকতেই দু-নম্বরের পাশেই নতুন সূর্য কটন মিলস তৈরি হয়েছিল। পাঁচটি কাপড়ের কলেরই হিন্দু মালিকরা ছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থক। আমাদের বাসাবাড়িটি ছিল বলতে গেলে এই নদীর ওপরই। নদীর বুক থেকে ধেয়ে আসা হাওয়া আমাদের শরীর জুড়িয়ে দিত। মাথার ওপর পাখা ঘোরার প্রয়োজন হত না, ছিলও না। শেষ দিকে অবশ্য একটি টেবিল ফ্যান আনা হয়েছিল। আমাদের সম্পর্কে ঠাকুরদা জ্ঞানরঞ্জন ঘোষচৌধুরি ঢাকা জেলা আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটার এবং হিন্দু মহাসভার ডাকসাইটে নেতা ছিলেন। ঢাকা শহরেই টিকাটেলির বাসাবাড়ি গলিতে থাকতেন। তিনি আমাদের বাসাবাড়ির বৈঠকখানাকে স্বাস্থ্য নিবাস বিশেষণ দিয়েছিলেন এবং ছুটিছাটায় মাঝে মাঝেই এসে থাকতেন। প্রায় সারা বছরই নদী শান্ত শীর্ণকায়া। কেবল বর্ষাকালে দু-কূল ছাপিয়ে যেত। বর্ষার জল নেমে যাওয়ার পর জমা পলিমাটিতে স্থানীয় কৃষকরা ক্ষীরই ও বাঙ্গির চাষ করতেন। ‘ক্ষীরই খেতের কন্যা ক্ষীরই চেনে না’, প্রবাদটি পূর্ববঙ্গে খুবই প্রচলিত ছিল। পরিবেশ পরিজনকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলে জনান্তিকে এই প্রবাদটি ব্যবহার করা হত। ক্ষীরই ও বাঙ্গি এদেশের শশা ও ফুটির প্রকারভেদ। ক্ষীরই শশার চেয়ে আকারে ছোটো, বাঙ্গি ফুটির চেয়ে বড়ো। খেত থেকে তুলে ক্ষীরই খাওয়ার লোভে আমরা কোনও কোনও দিন নৌকা ছেড়ে নারায়ণগঞ্জের স্কুল থেকে নদীর কিনারা ধরে হেঁটে বাড়ি ফিরতাম। সারা বছরই ভাঁটার সময় জল নেমে গেলে পারের বেলে মাটিতে ছোটো ছোটো ফুটো দেখা যেত। ওগুলি চেউয়া মাছের বাসা। জেলেরা কোদাল দিয়ে মাটি কেটে এই মাছ ধরে। চেউয়া মাছ এদেশের গুলে মাছের মতোই দেখতে। রঙটা আলাদা, ফিকে বেগুনি। লোকে বলে খুব সুস্বাদু ও নীরোগ মাছ। কিন্তু দেখতে কেঁচোর মতো হওয়ায় বাড়িতে কোনোদিন আসত না। যেমন সাপের মতো দেখতে বলে বান মাছ (ওপার বাংলার উচ্চারণে বাইং) এবং কুঁইচ্চা (কুঁচিয়া) আসে না। শীতল্যক্ষা নদী সম্ভবত গভীর ছিল না। তাই এ নদীতে কোনও বড়ো স্টিমার চলত না। তবে লঞ্চ চলত। ঢাকেশ্বরী কটন মিলের নিজেদেরই একটি লঞ্চ ছিল। এক সময় তারা একটি সী প্লেনও কিনেছিল। সেটি যেদিন প্রথম এসে শীতল্যক্ষা নদীতে নামলো সেদিন এক মহা হইচই কাণ্ড। পাঁচটি কাপড়ের কলের হাজার কয়েক শ্রমিক কর্মী তো বটেই গ্রামগঞ্জ ভেঙে আরও অজস্র মেয়ে পুরুষ বাচ্চা নদীর ধারে ভিড় করেছিল সেই অদৃশ্যপূর্ব জিনিসটিকে একবার চোখের দেখা দেখতে। শীতলক্ষ্যা নদী দিয়ে বিশাল বিশাল নৌকো চলত প্রায় সারা দিনই। এগুলির অধিকাংশই পণ্যবাহী। পাঁচ মিলের কাঁচামাল তুলো সাধারণত এইসব অতিকায় নৌকোতেই আসত। আবার মিলে তৈরি শাড়ি ধুতি জামা প্যান্টের কাপড়ের বেলও এই নৌকোতেই চালান যেত। মাঝে মাঝে কাঁঠাল, আনারস, অথবা মালদহের ফজলি আম বোঝাই কোনও অতিকায় নৌকো মিলের জেটিতে এসে ভিড়লে সস্তায় কেনার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। অভিভাবকদের অজান্তে একবার আমরা কয়েক বন্ধু মিলে ছ’পয়সা (বর্তমান মুদ্রা মানে দশ পয়সা) দিয়ে একটি বিশাল কাঁঠাল কিনে নদীর ধারে বসেই খেয়েছিলাম। ছোটোদের কাছে বোধ হয় শীতল্যক্ষার সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ ছিল শুশুকের ডিগবাজি দেখা। এই নদীতে এই অদ্ভুত জলজ প্রাণীটি প্রচুর সংখ্যায় ছিল।

নারায়ণগঞ্জ থেকে বরিশালমুখী স্টিমারের দোতলায় কয়েকটি কেবিন ছিল। এগুলি বরাবর দেখেছি সাহেব মেমসাহেবদের দখলে। আমরা ছিলাম ডেকের যাত্রী। সাহেব মেমসাহেবরা দিনের বেশির ভাগ সময়ই দরজা বন্ধ করে কেবিনেই কাটতেন। কখনও কখনও সকাল-বিকেলে স্টিমারের সামনের দিকে বিশেষ করে তাদেরই জন্য পাতা ডেক চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসে সূর্যোদয় সূর্যাস্ত দেখতেন। সাহেবের পোশাক ছিল হাফপ্যান্ট ও হাফ শার্ট। মেমসাহেবদের ছোট গাউন। সাহেবদের মাথায় থাকত খাকি রঙের শোলার টুপি। মেমসাহেবরা পরতেন সাদা কাপড়ের টুপি। নদীর হাওয়ার ঝাপটায় মাঝে মাঝেই তাদের টুপি মেঝেতে পড়ে যেত। আমরা দূরে দাঁড়িয়ে তাই দেখে হেসে-কুটিপাটি। কখনও কখনও শরতের বৃষ্টি নামত। বৃষ্টির ছাট সাহেব মেমসাহেবদের বিরক্তির কারণ হয়ে উঠত। অথচ মাল্লাদের তারা স্টিমারের ধারের পর্দাও নামাতে দেবেন না। সাহেব মেমসাহেবদের অস্বস্তিতে আমরা খুব মজা পেতাম। দূরে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে ছড়া কাটতাম। ছড়ার ভাষা রুচিকর না হলেও প্রচ্ছন্ন স্বাদেশিকতা বোধ ছিল সন্দেহ নেই: বিষ্টি নামলো রোদ্দুর উঠলো পাতিশিয়ালের বিয়া, ইংরাজরা খাইতে বইছে বাঙালির গু দিয়া। আমাদের ছড়া নিশ্চয়ই সাহেব মেমসাহেবদের কানে পৌঁছত না। পৌঁছলেও তাদের বোধগম্য হওয়ার কথা নয়।

জাহাজের মতো স্টিমারের ডেকের যাত্রীদের জন্য কোনও বাঙ্ক ছিল না। ডেকের ঠিক মাঝখানে স্টিমারের প্রায় এ-মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হেলান দেওয়ার ব্যবস্থা সহ দুদিকে মুখ করে দুসারি টানা বেঞ্চ ছিল। কাছেপিঠের যাত্রী না হলে বড়ো একটা কেউ এই বেঞ্চে বসার আগ্রহ দেখাতেন না। মেঝেতেই সতরঞ্জি চাদর বিছিয়ে শোয়া বসার জায়গা করে নিতেন। আমরা তো আমাদের বাক্স-প্যাঁটরা কাপড়ের বেল সারি সারি সাজিয়ে স্টিমারের মধ্যেই পুরোদস্তুর একটি পৃথক কামরা তৈরি করে ফেলতাম। মাঝে একবার তারপাশা নামে এক স্টিমার ঘাটে নেমে হোটেলে ইলিশ মাছ ভাত খাওয়া ছাড়া দেড়-দুদিনের খাওয়া শোয়া বসা সবই ছিল আমাদের এই বাক্স-প্যাঁটরা ঘিরে বানানো ঘরে। রওনা হওয়ার দিন বাসাবাড়ি থেকেই দুপুরের খাওয়া খেয়ে বেরোতাম। অবশ্য অন্যান্য দিনের চেয়ে সেদিন অনেক আগে আগেই খেতে হত। দ্বিতীয় দিন দুপুরের খাওয়া তারপাশার স্টিমার ঘাটের ‘হিন্দু’ হোটেলে। তারপরেও দু’রাত্রির খাওয়া ও বারতিনেক জলখাবারের ব্যাপার ছিল। স্টিমারেই রেস্তোরাঁ ছিল। কেন জানি না, ওই রেস্তোরাঁকে বলা হত ‘বাটলার’। এই ইংরেজি শব্দটির আভিধানিক অর্থ যদিও মদ্য সরবরাহকারী বেয়ারা অথবা রসুই ঘরের প্রধান খানসামা। শুচিবাযুগ্রস্ত বৈয়াকরণরা শব্দার্থ নিয়ে মাথা ঘামাতে চান তো ঘামান। তবে এ বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশই নেই যে, চট্টল খানসামার হাতের রান্না বাটলারের মুরগির মাংস ভাতের স্বাদ আশপাশ দিয়ে ঘুরলে গন্ধেই মালুম পাওয়া যেত। খাওয়ার দরকার ছিল না। কিন্তু সে অমৃতে আমাদের অধিকার ছিল না। গোমাংসের মতোই মুরগির মাংসও সেকালে হিন্দুর অখাদ্য ছিল, মুসলমান খানসামার হাতের রান্নার তো প্রশ্নই ওঠে না। খানসামা মুসলমান, বিক্রেতারাও মুসলমান, সম্ভবত মালিকও। অতএব বাটলারের মাংসভাত দূরস্থান, পাঁউরুটি, কেক, চকোলেট, এমনকী কলা আপেলও আমাদের খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। অনেক পরে দাদা যখন একা একা নারায়ণগঞ্জ-কলকাতা যাতায়াত করতেন তখন বাটলারের মুরগির মাংস ভাত খাওয়ার বাধা দেওয়ার কেউ ছিল না। আর এখন সপ্তাহে অন্তত একদিন বাড়িতে মুরগির মাংস হবেই। এভাবেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে কুসংস্কারের আগড় ভেঙে পড়ে।

পথের খাবার আমরা বাড়ি থেকেই সঙ্গে নিতাম। টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি লুচি আলুর দম অথবা রুটি তরকারি ছাড়াও থাকত চিঁড়ে মুড়ি বিস্কুট কলা এইসব। বিভিন্ন স্টিমার ঘাটে স্টিমার ভিড়লেই ছোটো ছোটো ডিঙি নৌকোয় রসগোল্লা, পান্তুয়া, দই, আখ, আনারস, কলা এইসব নিয়ে বিক্রি করতে আসত। নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে ডিঙ্গি দুলুনি, ছলাৎ করে নদীর জল ছিটিয়ে গামলার ওপর দিয়ে চলে যাওয়া ছিল স্বাভাবিক দৃশ্য। ওই মিষ্টিও কখনও কখনও কেনা হত। চা তখনও ঘরে ঘরে নেশায় পরিণত হয়নি। চা জনপ্রিয় করার জন্য তখন স্টিমার ঘাট, রেল স্টেশনের মতো জনবহুল জায়গায় টি বোর্ডের বিলবোর্ড টাঙানো থাকত— চা সেবনে কাজে উৎসাহ বাড়ে। বাবা মায়ের চায়ের নেশা ছিল কি না মনে নেই। তবে একটা মজার ঘটনা মনে আছে। বাবার মুখেই শোনা। কোনও এক বাড়িতে বাবাকে চা মিষ্টি দেওয়া হয়েছিল। চা মিষ্টি লাগবে না মনে করে বাবা চায়ের কাপে আগে চুমুক দিয়েছিলেন। গৃহিণীর ধারণা হয়েছিল বাবা মিষ্টি খাবেন না। তিনি প্লেট তুলে নিয়ে গেছিলেন। বাবা জানতেন না আগে মিষ্টি খেয়ে তারপর চা খেতে হয়। এটা বাস্তব ঘটনা। কিন্তু এবার যে কাহিনি শোনানো হবে সেটা গল্পও হতে পারে। এক বাড়িতে ছেলে, ছেলের বউদের চা খেতে দেখে বাড়ির কর্তারও সাধ হয়েছিল একদিন চা খাবেন। শ্বশুরমশাইয়ের সাধের কথা জানতে পেরে বাড়ির মেজোবউ খুব যত্ন করে চা তৈরি করে পাথরের বাটিতে করে দিয়ে আসে। বাড়িতে চা বানানো ও বিতরণের দায়িত্ব বরাবরই মেজোবউ পালন করে। শ্বশুরমশাই কিন্তু চায়ে চুমুক দিয়েই হাত দিয়ে ঠেলে বাটি সরিয়ে রাখেন। সেই থেকে সারাদিন গুম, কারও সঙ্গে একটি কথাও নয়। শেষ পর্যন্ত গিন্নি নিজের মাথার দিব্যি দিয়ে কাকুতি মিনতি করার পর বৃদ্ধ গর্জন করে ওঠেন, আমি কি মেজোবউয়ের ইয়ার্কির পাত্র? একটু চা খাইতে চাইলাম, মেজোবউ আমারে এক বাটি গরম চা হাতে ধরাই গেল।

স্টিমারে খাওয়ার জন্য একবার প্রচুর তেল ঘি মশলা দিয়ে জম্পেশ করে লুচি আলুরদম বানিয়ে সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল। প্রথম রাতে সেসব খাওয়া হয়েছিল বেশ জুত করে। কিন্তু গোল বাঁধলো দ্বিতীয় রাতে। খাওয়ার জন্য আমরা সবাই গোল হয়ে বসেছি। মা সকলকে লুচি দেওয়ার জন্য টিফিন ক্যারিয়ারের বাটি খুলতেই দেখা গেল আলুরদমের ওপর ঘাসের ডগায় ধুনানির পেঁজা তুলোর মতো সাদা ছত্রাক জন্মেছে। সেইসঙ্গে ভ্যাপসা পচা গন্ধও। সে রাতে চিড়ে মুড়ি দিয়েই নৈশভোজ সারতে হয়েছিল। তাবে তাতে ক্ষোভ কিছু হয়নি। রাত ভোর হলে বাড়ি পৌঁছব সেই আনন্দেই তখন আমরা মশগুল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *