আমার দেশ আমার বিদেশ – ২০

কুড়ি

পেশাদার দলের যাত্রাপালা ও কবিগান ছাড়াও কারখানার অফিসার এবং করণিকরা নিজেরাও নাটক প্রযোজনা ও অভিনয় করতেন। সেগুলি তিন দিক দিয়ে ঢাকা মঞ্চে থিয়েটার। লক্ষ্মীনারায়ণের প্রযোজিত কোনও নাটকের কথা বিশেষ ভাবে মনে নেই। বোধ হয় সেগুলি একেবারেই শৈশবে অভিনীত হয়েছিল। একবারের কথা সামান্য মনে পড়ে। সম্ভবত আফগান সম্রাট শেরশাহের জীবন-ভিত্তিক কোনও নাটক। শেরশাহের মৃত্যু দৃশ্যটি আবছা মনে পড়ে। একটি মেয়ে,অবশ্যই পুরুষ শিল্পী অভিনীত, হাতের মশাল দিয়ে সম্রাটের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। মনে থাকার একটি কারণ হতে পারে সেবার ছোটোদেরও একটি নাটকের তালিম দেওয়া হয়। নাটকের নাম চন্দ্রগুপ্ত। নারী-বর্জিত কিশোর নাটক। সাধারণত ওই সময় ছোটোদের জন্য নাটকে নারী চরিত্র রাখা হত না। বার অ্যাকাডেমির ক্লাস টেনের ছাত্ররা একবার স্কুলের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ‘মহারাজা নন্দকুমার’ নামে তখনকার দিনের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় নাটক মঞ্চস্থ করেছিল। অবশ্যই এই অংশগুলি বাদ দিয়ে যেখানে নারী চরিত্র আছে। দীর্ঘদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের একসঙ্গে অভিনয় নিষিদ্ধ ছিল। প্রতিবাদে সিরাজদৌল্লা খ্যাত নাট্যকার শচীন সেনগুপ্তর ছেলে দীপেন সেনগুপ্ত একটি নাটক লিখেছিলেন। নাম মনে নেই, তবে নাটকের মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করত অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। নাটকটি বোধ হয় ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি ড্রামা অ্যাসোসিয়েশন (কুডা) প্রযোজনা করছিল। কুডা বিখ্যাত গ্রুপ থিয়েটার নান্দীকারের পূর্বসুরি। ওই নাটকের এক দৃশ্যে অজিতেশ (চরিত্রের নাম মনে নেই) বাড়ি ফিরে চিৎকার করে বউদিকে চা দিতে বলে। চা দিতে মঞ্চে ঢোকে এক হোঁদলকুতকুত গুঁফো জোয়ান। বিরক্ত অজিতেশকে সে মনে করিয়ে দেয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়ে একসঙ্গে অভিনয় কদাপি নয়। অতএব গোঁফ থাকলেও তাকেই বউদি মেনে নিতে হবে। লক্ষ্মীনারায়ণের চন্দ্রগুপ্ত নাটকে একেবারে কাটা সৈনিক না হলেও আমারও একটা ছোটো ভূমিকা ছিল। যুদ্ধ পলাতক দুই সৈনিকের একজন। এক লাইন সংলাপও স্পষ্ট মনে আছে। ভিতু অপবাদের প্রতিবাদে বলতে হবে, দেউড়ির পিছনে লুকিয়ে ছিলুম কিন্তু কাঁপিনি। চন্দ্রগুপ্ত শেষ পর্যন্ত মঞ্চস্থ হতে পারেনি। মহড়ার সময় অতি উৎসাহে চেঁচামেচির দৌলতে সব অভিনেতার গলা বসে যায়। শত চেষ্টাতেও গলা দিয়ে খানিকটা ফ্যাস ফ্যাস শব্দ ছাড়া আর কিছু বেরোয় না। এমনকী দুই পলাতক সৈনিকেরও। বাসকপাতা জ্বাল দিয়ে ঘটি ঘটি পাঁচন গিলেও যখন কারও কোনও উন্নতি দেখা গেল না অগত্যা নাটক বন্ধ করাই সাব্যস্ত হয়।

শখের থিয়েটার প্রযোজনায় একবার পাশের চিত্তরঞ্জন কটন মিলসের অফিসাররা লক্ষ্মীনারায়ণকে টেক্কা দিয়েছিলেন। ডি. এল. রায়ের ‘সাজাহান’ নাটকটি তারা অতি সাফল্যের সঙ্গে প্রযোজনা করেন। অভিনয়, সাজপোষাক, মঞ্চসজ্জা, আবহসংগীত সব কিছুতেই পেশাদারিত্বের ছাপ। তবুও আমরা ছোটরা হার মানার পাত্র নয়। চিত্তরঞ্জনের সমবয়েসিদের উঁচু গলায় শুনিয়ে দিতাম লক্ষ্মীনারায়ণের সাহায্য ছাড়া তাদের নাটক সফল হওয়া সম্ভবই ছিল না। সাহায্য বলতে অভিনেতাদের তালিকায় লক্ষ্মীনারায়ণের স্পিনিংমাস্টার সুশীল মজুমদারও ছিলেন। তিনি নাটকে মেবারের রাণা যশোবন্ত সিংহের ভূমিকায় অভিনয় করেন। ছাপা প্রোগ্রামে তার নামের পাশে ‘লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসের সৌজন্যে’ উল্লেখ করা ছিল। সম্রাটের দরবারে ঔরঙ্গজেব রাণাকে সদর্পে প্রশ্ন করেন তাকে বন্দি করা হলে কে রক্ষা করবে? যশোবন্ত সুশীল মজুমদার অতি ক্ষিপ্রতায় উন্মুক্ত অসি তুলে ধরে ঔদ্ধত্যপূর্ণ জবাব দেন এই তরবারি সম্রাট। দর্শকরা তুমুল হাতাতলি দিয়েছিল। মুসলমান সম্রাটকে হিন্দু রাজার মুখের মতো জবাব বলে কথা। সেটাই ছিল আমাদের ক্যাপিটাল। অফিসাররা অবশ্য ওতেই মুখ রক্ষা হয়েছে মনে করতে পারেননি। তারা ঠিক করলেন লক্ষ্মীনারায়ণেও থিয়েটার হবে। নাটক ‘মহারাজ নন্দকুমার’। ঐতিহাসিক স্টার থিয়েটারের মহেন্দ্র গুপ্তর পরিচালনায় এই নাটকটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। ‘মহারাজ নন্দকুমার-ই কলকাতার কমার্শিয়াল থিয়েটারে আমার দেখা প্রথম নাটক। প্রোজেক্টর মেশিন চালিয়ে মঞ্চের পেছনে সাদা পর্দায় লন্ডনের ছবি দেখানো হত। সঙ্গে মাইক্রোফোনে কমনস সভায় ওয়ারেন হেস্টিংসকে অভিযুক্ত করে এডমন্ড বার্কের বিখ্যাত বক্তৃতা। পরিচালক মহেন্দ্র গুপ্ত নিজে মীর কাশিমের ভূমিকায় অভিনয় করতেন। একই দৃশ্যে দুবার পোশাক পরিবর্তন করে মহেন্দ্র গুপ্তর মঞ্চে প্রবেশ সেই কিশোর বয়সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ছিল।

‘মহারাজ নন্দকুমার’ নাটকে কার্ভালো নামে ভাড়াটে পর্তুগিজ সৈনিকের একটি চরিত্র ছিল। স্টারে ভুমেন মিত্র এই চরিত্রে অভিনয় করতেন। লক্ষ্মীনারায়ণের অফিসার্স ক্লাবে দাদা সুকুমার এই চরিত্রের জন্য নির্বিচিত হয়েছিলেন। অভিনয় নিখুঁত হতে হবে। তাই দাদা বাড়িতেও একা একা সংলাপ মুখস্থ করতেন— পর্তুগিজ বো যায় না, পর্তুগিজ বো যায় না, শিশুকালে সাগর ডিলকাইতে ডিলকাইতে বো ভুলিয়া যায় (পর্তুগিজ ভয় পায় না। শিশু বয়সেই সাগর ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে ভয় ভুলে যায়)। মহারাজ নন্দকুমারে একটি শিশু চরিত্রও ছিল। সিরাজের বেগম লুৎফুন্নেসার নাবালিকা মেয়ে। বোধ হয় কোনও সংলাপ ছিল না। শুধু মায়ের হাত ধরে মঞ্চে প্রবেশ ও মা যখন কাঁদে তখন কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে থাকা। যেহেতু বালিকারাও থিয়েটারে অভিনয় করতে পারবে না অতএব এই নির্বাক চরিত্রে আমাকে বাছা হয়েছিল। এজন্য আমার বাল্যবন্ধু দীপুর (উইভিং মাস্টার ক্ষেত্রমোহন ঘোষের বড়ো ছেলে দীপঙ্কর) আমার প্রতি কিছুটা ঈর্ষাই হয়ে থাকবে। তবে মুখে সেটা কখনও সে স্বীকার করেনি। উল্টে মেয়ে চরিত্রে অভিনয় করব বলে আমাকে সে বন্ধু মহলে ঠাট্টা করত। দু-চারটে নতুন শেখা অশালীন ইঙ্গিতও যে করত না তা নয়। তবে খুব একটা পরিমিতি ছাড়িয়ে নয়। কারণ বড়োদের কানে উঠলে কঠোর শাস্তির আশংকা ছিল। তখনকার পরিবেশে অভিভাবকরা কখনও ছোটোদের বিন্দুমাত্র বেয়াদপি সহ্য করতেন না। বড়োদের নাটকে পার্ট পাওয়ার সুবাদে রিহের্সালের অজুহাতে কিছুদিন সন্ধ্যার পরেও বাড়ির বাইরে থাকার লাইসেন্স মিলেছিল। সমবয়েসি বন্ধুদের ঈর্ষার এটাও একটা বড়ো কারণ। মহড়ার সময় শুনে শুনে মহারাজ নন্দকুমার নাটকের অনেক সংলাপ আমারও মুখস্থ হয়ে গেছিল। মনে মনে কল্পনা করতাম বড়ো হয়ে নাটকের নাম ভূমিকায় আমিই অভিনয় করব। সংলাপ বলব, ভুলে যাও আমি মহারাজ নন্দকুমার, ভুলে যাও তুমি মহম্মদ রেজা খাঁ। আজকের দিনে শুধু মনে রেখ ভাই, আমরা একই দুখিনী মায়ের দুই অভাগা সন্তান। মহারাজ নন্দকুমার শেষ পর্যন্ত মঞ্চস্থ হতে পারেনি। তার আগেই পূর্ববাংলার অধিকাংশ হিন্দুর সঙ্গে লক্ষ্মীনারায়ণের স্টাফ কোয়াটার্সের সুখি পরিবারেও আকস্মিক অপরিমেয় বিপর্যয় নেমে আসে। দেশভাগের পর তিন বছরের মাথায় সেই অভিশপ্ত কাহিনি আপাতত থাক।

মহারাজ নন্দকুমার নাটকে আমাকে সুযোগ দেওয়া অথবা ছোটোদের নিয়ে চন্দ্রগুপ্ত মঞ্চস্থ করার পরিকল্পনা কিছুটা ব্যতিক্রমই ছিল। অন্যথায় লক্ষ্মীনারায়ণের স্টাফ কোয়াটার্সের সংস্কৃতি চর্চায় বলতে গেলে শিশু ও কিশোরদের কোনও ভূমিকাই ছিল না। ঘরে ঘরে মেয়েরা গানের চর্চা করত। তাদের নিয়ে অন্তত সরস্বতী পুজোতেও কোনও অনুষ্ঠান করার কথা ভাবা হয়েছিল মনে পড়ে না। স্কুলেই যা কিছু সাংস্কৃতিক প্রতিভা প্রদর্শনের সুযোগ পাওয়া যেত। সেক্ষেত্রেও যথাযথ তালিমের অভাবে নীচু ক্লাসের ছাত্রদের কৃতিত্ব অনেক সময়ই হাসির খোরাক জোটাত। একবার স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী উৎসবে আমি আবৃত্তি করতে মঞ্চে উঠে কবিতা ও কবির নামই ভুলে গেছিলাম। সরাসরি ‘রাবণের ছোটোভাই নাম বিভীষণ/ম্যাট্রিকেতে পেল সে থার্ড ডিভিশন’ শুরু করতেই দর্শকরা হইহই করে উঠেছিল। কবিতা ও কবির নাম জানতে চেয়ে। হট্টগোল-হাসাহাসিতে আমি গোটা কবিতাটাই ভুলে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে মঞ্চ থেকে নেমে এসেছিলাম। অথচ এখন এই প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেও বোধ হয় গোটা কবিতাটাই মোটামুটি ঠিকঠাক মুখস্থ বলতে পারব। একবার অফিসার্স ক্লাব গানের জলসার আয়োজন করল। নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন আব্দুল লতিফ, আব্দুল হালিম, লায়লা আরজুমান, লিলি, বিলকিস বানু, ভুরি বেগম, ঝুনু ভৌমিক। আমার ছোটো তাউইমশাই জ্ঞানরঞ্জনের দুই মেয়ে অনু বেণু সহ তখনকার ঢাকা রেডিওর প্রায় সব নামী শিল্পীই আমন্ত্রিত। আমার দিদি প্রতিমাও তখন ঢাকা রেডিওর স্টাফ আর্টিস্ট। কিংবদন্তী লোকসংগীত শিল্পী আব্বাসউদ্দিনের কাছে কলকাতায় এসে রেকর্ড করার জন্য তালিম নিচ্ছেন। রেকর্ড করা অবশ্য শেষ পর্যন্ত হয়নি জ্ঞানরঞ্জনের দাদা মনোরঞ্জনের তীব্র আপত্তিতে। বাড়ির মেয়ে একা একজন মুসলমানের সঙ্গে অতদূর পথ কলকাতা যাবে হতেই পারে না। সে অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ। আশ্চর্যের ব্যাপার লক্ষ্মীনারায়ণের অফিসার্স ক্লাবের জলসায় কেন জানি না দিদিকে গাইতে ডাকা হয়নি।

ঢাকা থেকে শিল্পীরা এসে অনুষ্ঠানে দিদি উপস্থিত নেই দেখে সকলেই অবাক। প্রশ্ন করে আয়োজকদের কাছ থেকে সদুত্তর না পেয়ে তারা দল বেঁধে সোজা আমাদের কোয়াটার্সে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। তাদের সহশিল্পী আমন্ত্রিতই নয় শুনে তারা কেউ অনুষ্ঠানে না গেয়ে ঢাকা ফিরে যাবেন স্থির করেন। ফুলু (দিদির ডাক নাম) ঘরের মেয়ে। ঘরের মেয়েকে নিমন্ত্রণ করার কি আছে ধরনের ছেঁদো কথায় তারা ভুলবেন না। অবশেষে অনেক অনুরোধ উপরোধের পর ঢাকা শিল্পীদের শর্তে আপোশ হয় অনুষ্ঠানে দিদি ঘোষিকা হবেন। দিদি অবশ্য অনুষ্ঠান শেষে জাতীয় সংগীতে অন্যদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গেয়েছিলেন, পাকিস্তান জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ…। ওপার বাংলায় ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাওয়ার দিন আসতে তখনও অনেক পথ বাকি। দিদিকে গানের জলসায় না ডাকা হয়ত ‘গেঁয়ো যোগী ভাত পায় না’ প্রবাদ বাক্যের আর একটি দৃষ্টান্ত। তবে ঈর্ষা, স্বজনপোষণ কত প্রতিভাকে অকালে গলা টিপে মারে সে দৃষ্টান্তের অভাব নেই। ঝুনু ভৌমিককে পূর্ব পাকিস্তান সরিষার ‘বুলবুল’ উপাধি দিয়েছিল। সেই ঝুনুকেই আকাশবাণীর তৎকালীন কর্তারা গলা মাইক ফিটিং নয়, অজুহাতে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ঝুনু ঢাকা রেডিওর সঙ্গে তার কন্ট্রাক্টের গোছা গোছা চিঠি আকাশবাণী কর্তাদের ছুঁড়ে দিয়ে এসে গানের জগতের সঙ্গে চিরকালের মতো সম্পর্ক চুকিয়ে দেন। প্রতিশ্রুতিময় সেই শিল্পী অবশেষে কলকাতার সিটি কলেজে করণিকের চাকরি নিয়েছিলেন।

আমরা ওপার বাংলায় থাকতে থাকতেই সবাক বাংলা সিনেমা দক্ষযজ্ঞ, ভক্ত প্রহ্লাদ, রাজা হরিশচন্দ্রর যুগ ছাড়িয়ে প্রমথেশ বড়ুয়া, যমুনাদেবী, পাহাড়ি সান্যাল, অহীন্দ্র চৌধুরী, জগন্ময় মল্লিক, কাননবালা, (তখনও দেবী বা ভট্টাচার্য নন) মলিনা দেবীদের দ্বিতীয় প্রজন্মে প্রবেশ করেছে। ডাক্তার, মুক্তি, রজতজয়ন্তী, বিল্বমঙ্গল, চন্দ্রশেখর এর মতো ছবির নাম মুখে মুখে। যুবক যুবতিদের গায়ে সঙ্গতি থাকলে, সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের স্টাইলে পোশাক উঠতে শুরু করেছে। ছেলেদের শার্টের বড়ুয়া কলার, কাননদেবীর ঘটিহাতা ব্লাউজ তো এক রকম ‘লেজেন্ড’-ই। সম্পন্ন বাড়িতে মেয়েরা কলের গান (গ্রামাফোন) চালিয়ে সিনেমার গান গলায় তোলে। ফচকে ছেলেরা রাস্তায় দূর থেকে কদাচিৎ যুবতি মেয়ে চোখে পড়লে বেসুরো হেঁড়ে গলায় গান ধরে ‘গেয়ে যাই গান গেয়ে যাই, গানের এই অগ্নিমালা দেব কারে ভেবে না পাই’। নারায়ণগঞ্জে দুটো সিনেমা হল ছিল তখন। একটা ডায়মন্ড অন্যটি হংস। কলকাতার একইসঙ্গে না হলেও নতুন রিলিজ হওয়া বাংলা ছবিগুলি নারায়ণগঞ্জের হলে পৌঁছে যেতে খুব বেশি দেরি হত না। আমার মা ছিলেন সিনেমার পোকা। তখন অবশ্য সিনেমা না বলে বায়োস্কোপই বেশি বলা হত। এমনও হয়েছে একই দিনে মা দুটি ছবি দেখেছেন। সিনেমায় গেলে মা আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতেন। তখন আমারই কিছু বোঝার বয়স হয়নি। ছোটো বোন দুটির কথা তো বলাই বাহুল্য। ‘তুফান মেল যায়’ গাইতে গাইতে একটি মেয়ে রেলগাড়ির পেছনে পেছনে ছুটছে অথবা একজন কাঁধ পর্যন্ত লম্বাচুলওয়ালা লোক হাতের মাছ ধরার ছিপ একটি মেয়ের কপালে সপাৎ করে মারল— এরকম শুধু দুই একটা ছবি ছাড়া ওইসব সিনেমায় কিছুই মনে নেই। উত্তর কলকাতার মিত্রা সিনেমা হলটির আগে নাম ছিল চিত্রা। ১৯৫০-এর দশকে প্রতি রবিবার সকাল দশটায় একটি বিশেষ শো-এ পুরনো দিনের বক্স হিট ছবিগুলি দেখান হত। সেই সময় যা দু-একটা দেখেছি এবং কিছুটা উপলব্ধি করতে পেরেছি।

বাউল বৈরাগী ভিখারিদের গানও ওপার বাংলার সংস্কৃতিকে বৈচিত্র দিয়েছে। লন্ডন প্রবাসী ‘আননোন ইন্ডিয়ান’, প্রয়াত নীরোদচন্দ্র চৌধুরীর জন্মভূমি মৈমনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জে কোনও এক জমিদার বাড়িতে একবার ডাকাতি হয়েছিল। জমিদারের বন্দুক ছিল। কিন্তু ডাকাতদল সংখ্যায় ভারী। তা ছাড়া জমিদার বাড়িরই একজন ভৃত্য ডাকাতদলের সহযোগী। ডাকাতদের ঠেকিয়ে রাখতে কয়েক ঘণ্টা ধরে গুলি চালাতে চালাতে বন্দুকের গুলি ফুরিয়ে যায়। বিশ্বাসঘাতক ভৃত্যের কাছ থেকে সে খবর পেতেই ডাকাত দল হা-রে-রে-রে করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে নির্বিচারে জমিদার পরিবারের সকলকে খুন করে। মহিলা বৃদ্ধ শিশুরাও রেহাই পায়নি। এক বাউলের মুখে বারবার গান শুনে এই কাহিনির একটা ছবি আমাদের মনে তৈরি হয়ে গেছিল। মনে হত যেন ডাকাতদের হামলা, জমিদারের গুলি ফুরিয়ে যাওয়া, নির্বিচারে খুন ও লুঠ সবই যেন নিজেরাই চোখে দেখেছি। গানের প্রথম এক আধ কলি আজও মনে আছে: কি কহিব ভবের লীলা, মৈমনসিংহের জেলা, লুঠে নিল দিনের বেলা, গেরাম (গ্রাম) সাতখানা। এক মহিলা ‘মাগন’ নিতে আসতেন হাতে একটি কুলো নিয়ে। কুলোতে একটি ছোট্ট দেবী মূর্তি, যেটির তেল সিঁদুর মেখে মেখে চোখ নাক কিছুই বোঝার উপায় ছিল না। মূর্তির সামনে আমের পল্লবসহ একটি ছোটো জল ভর্তি পিতলের ঘট থাকত। ঘটের গায়ে সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিক আঁকা। এই কুলোতেই গৃহস্থ চাল তরকারি ফলমূল তুলে দিতেন। মহিলা বাড়িতে ঢুকেই গান ধরতেন— সুবচনীর (দেবী শুভচণ্ডী) মায় গো আমার বাড়িতে যায়, তেল সিঁদুর পান সুপারি সেই বাড়িতে পায়। মাঝে মাঝেই আমাদের বাসাবাড়িতে এক জটাজুটধারী সন্ন্যাসী আসতেন। তার মাথার জটা আজানুলম্বিত, পরণে এক ফালি রক্তবর্ণ কৌপিন, গলায় রুদ্রাক্ষ কড়ি আর পুঁতির কয়েক ছড়া মালায়। প্রায় মালার আধিক্যে তার রোমশ বুক ঢাকা। দুই হাতেও তামা লোহা রূপোর নানা মাপের বালা। রক্তবর্ণ চোখ সন্ন্যাসী সদর দরজা পেরিয়ে উঠোনে ঢুকেই তার কাঁধে ঝোলানো বিশাল শিঙাটি মুখে দিয়ে প্রচণ্ড আওয়াজ তুলতেন ফুঁ-উ-উ-উ। সেই প্রাণ কাঁপানো শব্দ শুনলেই ছুটে ঘরে ঢুকে পড়তাম। সন্ন্যাসী শুধু একবারই বিড়বিড় করে বলতেন, ‘জয় বাবা পাগলা লক্ষণ সাধু’ এবং আবার শিঙা ফুঁকতেন। পরে শুনেছি এই সন্ন্যাসী লক্ষণ সাধু নামে কোনও এক সিদ্ধ পুরুষের শিষ্য। পুজ্যপাদের ক্ষুন্নিবারণের জন্যই তিনি মাধুকরী বৃত্তি গ্রহণ করছেন।

পশ্চিমবাংলায় চৈত্রমাসে সাধারণত গ্রামের নিম্নবিত্তদের বহু মেয়ে পুরুষ শিশু বৃদ্ধ গেরুয়া ধারণ করে সন্ন্যাস নেয়। চৈত্রের খর রৌদ্র উপেক্ষা করে তারা হাতে নতুন মালসা নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভিক্ষা করে। ভিক্ষায় পাওয়া চাল-ডাল-তরকারি হয় তাদের দিনান্তের ভক্ষ্য। এই সাময়িক সন্ন্যাস পর্ব শেষ হয় সংক্রান্তিতে চরম পুজোয়। বহু জায়গাতেই চড়ক পুজোয় মেলা বসে। একে গাজনের মেলাও বলা হয়ে থাকে। প্রচুর ঢাকঢোল কাড়া-নাকাড়া বাজে। এক বিশেষ শ্রেণির সন্ন্যাসী পিঠে লোহার মোটা বড়শি বিঁধিয়ে ধর্মকাঠে ঘুরপাক খায়। পূর্ববঙ্গে চৈত্রমাসে সন্ন্যাস নেওয়া অথবা বাণফোঁড় প্রথা ছিল মনে পড়ে না। বাড়িতে প্রতিবছর পি এম বাগচির পঞ্জিকা আসত। ওই পাঁজিরই শ্রেষ্ঠ পৃষ্ঠাগুলিতে অতি বৃহৎ লাল মূলা বাঁধাকপি ফুলকপির বীজের সচিত্র বিজউাপনের মতোই ৩১ চৈত্রের পাতায় বাণফোড় ছবিও আকর্ষণয় চিল। ওপার বাংলায় সন্ন্যাস গাজনের মেলা হতে শুনিনি। গাজন বলতে আমরা জানতাম নজরুলের কবিতা— গাজনের বাজানা বাজা/কে মালিক কে সে রাজা/কে দেয় সাজা মুক্তি পাগল সাত্যকিরে। তবে লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসের পশ্চিমে মাইল খানেক দূরে গোদনাইল গ্রামে চৈত্র সংক্রান্ততে এক মেলা বসত। চলত একমাস। সংক্রান্তির দিনে ওই মেলাতলায় এক বিশাল বটগাছের নীচে বাস্তু পুজা হত। ওইদিন পূর্ববঙ্গের ঘরে ঘরেই বাস্তু পুজার রেওয়াজ ছিল। দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে মুঠো ভর্তি ছাতুহাওয়ায় ওড়ান হত। মেলা তলার বটগাছে থালা ঘটির মাপের বড়ো বড়ো চিনির কদমা এবং গুড়ের তিলা ঝুলিয়ে দেওয়া হত। মেলা বলতে মাটির হাঁড়ি কলসি সরা কাঠের বাটি বারকোশ লোহার বাঁটি হাতা খুন্তি কোদাল খুরপি ডালের কাঁটা তালপাতার পাখা শীতলপাটি হোগলা পাতার মাদুর জাতীয় গ্রামীণ নিম্নবিত্তের দৈনন্দিন গৃহস্থালি সামগ্রীর সারি সারি দোকান। মাটির পুতুল টিনের বাঁশি কাগজের চরকির মতো ছেলে ভোলানো টুকিটাকির দোকানও অনেক বসত। নেতাজি বাঘ আর বিড়ালের চাহিদাই বেশি ছিল। অনেকেই ঘর সাজানোর জন্য এসব মাটির পুতুল কিনে নিয়ে যেত। বাবার সঙ্গে মেলায় গিয়ে আমি একবার সামরিক পোশাকো নেতাজির একটি মূর্তি কিনেছিলাম। এইসব পুতুলের শিল্পমান বোঝাতে একদিনের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করা যেতে পারে। অনেকেরই মনে থাকবে, এক সময় কলকাতার ফুটপাথে বড়ো বড়ো আর্টপেপার ভুসোকালিতে আঁকা মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুভাষচন্দ্র, ক্ষুদিরাম, শরৎচন্দ্র প্রমুখের ছবি বিক্রি হত। এখন আর চোখে পড়ে না। আমাদের ছাত্রাবস্থায় একদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসের বিপরীতে কলেজ স্কোয়ারের রেলিংয়ের গায়ে এরকম কিছু ছবি ঝুলিয়ে এক প্রৌঢ় শিল্পী ক্রেতার অপেক্ষা করছিলেন। এখন যেমন বইমেলায় উঠতি চিত্রকররা তাঁদের শিল্প পসরা সাজিয়ে বসেন তারই আদি সংস্করণ। বয়স ধর্ম বলে একটা কথা আছে। আর একটু মোটা কথায় বললে ফচকেমি। আমাদের এক বন্ধু কলেজ স্কোয়ার রেলিংয়ের ওই ছবির একটির দিকে আঙুল তুলে চটুল রসিকতা করেছিল, দ্যাখ দ্যাখ এটা রবীন্দ্রনাথ। সান্তাক্সস ভাবিস না যেন। ক্ষুব্ধ পথশিল্পী বন্ধুকে জবাব দিয়েছিলেন, এ ছবি যদি রবীন্দ্রনাথের না হয় তাহলে আপনি চিনলেন কি করে?

গোদানাইলের গ্রামীণ মেলার মাটির পুতুলের শিল্পমান নিয়ে প্রশ্ন করা যেতেই পারে। কিন্তু শীতল্যক্ষা নদীর পুবপারে লাঙ্গলবন্ধের মেলার কাঠের পুতুল ও ঘোড়ার প্রশংসা না করে পারা যাবে না। রঙে, শিল্পশৈল্পীতে, দেশে বিদেশে সমান প্রশংসিত যামিনী রায়ের ছবির সঙ্গে অসাধারণ সাদৃশ্য। লাঙ্গলবন্ধের গ্রামীণ শিল্পকলা শিল্পী যামিনী রায়কে প্রভাবিত করেছিল অথবা প্রশিক্ষণ বিহীন গ্রামীণ শিল্পীরাই যামিনী রায়কে অনুকরণ করতেন আমার অন্তত জানা নেই। এসব গুঢ় তত্ত্ব শিল্প সমঝদারদের গবেষণার বিষয় হতে পারে। তবে সময়ের বিচার করলে মোটা বুদ্ধিতে প্রথম বিকল্পটির সম্ভাবনাই বেশি মনে হয়। কথা হচ্ছিল গোদনাইলের মেলার। এসে গেল লাঙ্গলবন্ধ। গোদনাইলে চৈত্রসংক্রান্তিতে যেখানে মাস ব্যাপী মেলা বসত, বৃষ্টি পড়লে সেখানেই হত ধানের চাষ। বর্ষায় মাইলের পর মাইল এক কোমর বা তারও বেশি জল। ডিঙি নৌকোয় পরিচিতের বাড়ি গেছি। ধানখেতের মধ্যে লগি ঠেলে নৌকা বিহার এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। সেকালে আমন ধানের জাত ছিল অন্য রকম। মাঠে জল বাড়লে ধানের চারাও লম্বায় বাড়ে। প্রলয়ঙ্করী বন্যা না হলে ধানের গোছা-সহ ডগা কখনও জলে ডোবে না। জলে ডোবা ধানের খেতেই আবার কই শিঙি মাগুর পুঁটি ট্যাংরা বেলে কত মাছ। যারা মাছ ধরতে পারে তাদের মহা মোচ্ছব। জাল ফেলা যাবে না। ধানের চারার ক্ষতি হবে। ডিঙি নৌকোয় বসে বড়শি অথবা কোঁচ বা ট্যাটায় গেঁথে তুলতে হবে। মাছ ভ্রমে বিষধর সাপের মাথায় কোঁচ বা ট্যাটা বিধিয়ে দেওয়া খুব একটা বিরল ছিল না। সেই আদিগন্ত বিস্তৃত সদৃশ জলাভূমিরই চৈত্র-বৈশাখে ভিন্ন চেহারা। খটখটে শুকনো অচষা এবড়ো খেবড়ো জমিতে বেতের ধানা ঝুড়ি, পাঁপড় ভাজা, জিলিপি, নানা রঙের সরবতের সারি সারি দোকান। কলকাতার রাস্তায় যেমন পুদিনা পাতার সরবত তেমনি গোদনাইলের গ্রামীণ মেলায় তোকমারি ভেজানো সরবতের খুব চাহিদা ছিল। নিজে কখনও দুইয়ের কোনওটি চেখে দেখিনি। তোকমারি ভেজানো সরবত দেখলে কেমন যেন ঘেন্নাই হত। তোকমারির পুলটিশ লাগিয়ে ফোঁড়া ফাঠানোর কথা মনে পড়ে যেত। অন্যথায় গ্রীষ্মের খর রৌদ্রে সরবতের দোকানে নানা রঙের সারি সারি সিরাপের বোতল দেখে লোভ হত না তা নয়। তখনও তো কলেজ স্কোয়ারের প্যারাগন আর প্যারামাউন্টের আভিজাত্যের খবর রাখি না। পেপসি, কোকাকোলা, থামসআপ, লিমকারা তখনও জন্মায়নি। তবে দেশি লেমোনেড পাওয়া যেত মিল কম্পাউন্ডের গেটের মুখেই এক দোকানে। পাওয়া যেত গোদনাইলের মেলায় সরবতের দোকানে। সেই মিষ্টি পানীয়ের বোতলের মুখ বন্ধ করা হত কাচের গুলি দিয়ে। গুলি ঠুকে নীচে নামিয়ে বোতলের মুখ খুলতে যতেষ্ট দক্ষতার প্রয়োজন ছিল। ভুলচুক হলেই বোতলে বিস্ফোরণ ঘটে বড়োসড়ো বিপদ ঘটার আশঙ্কা ছিল। দাঙ্গার সময় গ্রীষ্মের পানীয় সোডা লেমনেডের বোতলই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হত। ঝাঁকিয়ে ছুঁড়ে দিলে উড়ন্ত অবস্থাতেই বোতলে বিস্ফোরণ ঘটে চারিদিকে কাচের টুকরো ছিটকে যেত।

গোদনাইলের ধান খেতের মেলায় বোধ হয় দু’একটি ম্যাজিক অথবা সার্কাসের তাঁবুও পড়ত। তবে নাগরদোলা আসত মনে পড়ে না। এলে নিশ্চয়ই তাতে ঘুরপাক খেতাম এবং তা মনেও থাকত নিশ্চয়ই। কিন্তু মনে আছে অনেক লটারির দোকান বসত। সে সময় রেডক্রশ না কারা যেন জনসেবার জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে বড়ো লটারির আয়োজন করত। ফার্স্ট প্রাইজ সম্ভবত দশ হাজার টাকা ছিল। লটারির ফল বোধ হয় খবরের কাগজে প্রকাশ হত না। কজনই বা তখন খবরের কাগজ পড়ে। টিকিট কিনলে সংগঠকরা ক্রেতার ঠিকানা জেনে নিত। লটারি জিতলে তাকে ব্যক্তিগত ভাবে জানিয়ে দেওয়া হত। একবার কাছেপিঠে কেউ একজন লটারির টাকা পেয়েছিল। সে এক বিশাল ব্যাপার। মাঠে ঘাটে বাজারে কেবল সেই আলোচনা। লটারি জিতে হার্টফেল করেছে এমন গল্পও বাজারে চাউর ছিল। মেলার লটারি সেসব কিছু নয়। এক পয়সা দু-পয়সা বড়োজোর চার পয়সার টিকিট। কাচের গ্লাস বাটি সস্তার সাবান চিরুনি টর্চলাইট এইসব প্রাইজ। এখনও গ্রামীণ মেলায় এরকম লটারির দোকান বসে। তবে মেলা বড়ো হলে কোনও কোনও দোকানে টেলিভিশন মোটরসাইকেল বৈদ্যুতিক পাম্প স্টিলের আলমারি সাজিয়ে রাখতে দেখা যায়। এসব পুরস্কার কেউ পেয়েছে দেখিনি। লটারির দোকানের ধারে কাছে ঘেঁষা আমাদের নিষিদ্ধ ছিল। তবুও লুকিয়ে অভিভাবকবিহীন মেলায় গেলে লটারির দোকানের সামনে অশেষ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। খেলার উপায় ছিল না। কারণ পকেটে পয়সা নেই। সেসব দিনে বিনা উপলক্ষে ছোটোদের হাতে পয়সা দেওয়া অন্তত মধ্যবিত্ত পরিবারের অভাবনীয়। বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন টাকাটা সিকিটা হয়ত বা ‘থোল খরচ’ (হাত খরচ) পাওয়া যেত। এমন অমাবস্যায় চাঁদ অবশ্য কদাচিৎ উঠত। সেদিন আমাদের উল্লাসের সীমা থাকত না। একবার দুর্গাপুজোয় রাস্তায় দাদার সঙ্গে দেখা হতে দুআনা পয়সা চেয়েছিলাম। দাদা হাতে একটি আধুলি গুঁজে দিতে বিস্ময়ের সীমা ছিল না। ছ আনা ফেরত দিতে হবে কিনা অনেক্ষণ মনে মনে ভেবেছি। এ গল্প পরে এপারে এসে। মেলার মাঠের লটারিতে এক পয়সার টিকিট কেটে একটি ছেলে একবার একটি কাচের গ্লাস পেয়েছিল। ছেলেটি গ্লাসটি দুহাতে মুঠোয় ধরে আকাশে তুলে যেভাবে উল্লসিত চিৎকার করতে করতে নিজের বাড়ির দিকে ছুটেছিল দাদার কাছ থেকে আধুলি পেয়ে আমার আনন্দ তার চেয়ে কিছু কম হয়নি।

শীতল্যক্ষা পেরিয়ে মিল কম্পাউন্ডের মাত্র মাইল খানেক পুবে হলেও লাঙ্গলবন্ধের মেলায় কোনোদিন যাওয়া হয়নি। লাঙ্গলবন্ধ পুববাংলার এক হিন্দু তীর্থ। পৌষ সংক্রান্তিতে সাগর স্নানের মতোই লাঙ্গলবন্ধেও শীতল্যক্ষায় স্নান করতে দূর দূর থেকে বহু পুণ্যার্থী আসতেন। আমার বাবা-মা নাস্তিক ছিলেন না। মা তো শেষ বয়সে সংসারের দায়দায়িত্ব মোটামুটি সম্পন্ন হওয়ায় পর সকাল সন্ধ্যায় বেশ কিছুটা সময় ঠাকুর ঘরেই কাটাতেন। তবু কি জানি কেন আমরা কেউ এত কাছের লাঙ্গলবন্ধের স্নানে যাইনি। কুমুদিনির কথা আলাদা। তিনি মরুতীর্থ হিংলাজ, অমরনাথ অথবা বৈষ্ণোদেবীর মতো কয়েকটি অতি দুর্গম তীর্থ ছাড়া অবিভক্ত ভারতে এমন খুব কম ধর্মস্থানই আছে যেখানে একা একা সফর করেননি। লাঙ্গলবন্ধেও কাউকে কিছু না জানিয়ে সুদূর বরিশালের বাঁকাই গ্রাম থেকে একাই চলে এসেছিলেন পৌষ সংক্রান্তির স্নান করতে। আমরা জানতে পারলাম যখন স্নান সেরে ভর দুপুরে বাসাবাড়িতে এসে ডাকাডাকি শুরু করেছিলেন। ঠাকুরমা একাহারী। দিনান্তে প্রায় সন্ধ্যার মুখে আতপ চালের প্রায় গলা ভাত আর দু’চারটা সব্জি সেদ্ধ এই ছিল তার খাবার। সব্জি সেদ্ধকে আমরা বলতাম ভাতে। আলুভাতে, কুমড়ো-ভাতে, উচ্ছে-ভাতে। ঠাকুরমার হাতের মাখা এই ভাতে খেতে খেতে মনে হত অমৃত আর এর চেয়ে কি বেশি সুস্বাদু হবে। ঠাকুরমার খাওয়ার সময় পাশে গিয়ে হাত পেতে বসতাম। নিজে খেতে খেতে মাঝে মাঝে সেদ্ধ মাখা ভাত দলা পাকিয়ে হাতে তুলে দিতেন। অবশ্য এই দলা পাওয়ার জন্য ঠাকুরমার খাওয়ার কাছে যেতে হত সম্পূর্ণ নিরাভরণ হয়ে। উচ্ছিষ্ট সর্বত্র পরে ছুঁয়ে দিলেই ঠাকুরমার সেদিনের খাওয়া বন্ধ। অনেক বড়ো হয়েও ঠাকুরমার দলার লোভ যায়নি। বলা বাহুল্য তখন আর নগ্ন হতে হত না। হবিষ্যি-ঘরের চৌকাঠের ওপর থেকে হাতের তালুতে ভাতের দলা ফেলে দিতেন। সেবার লাঙ্গলবন্ধ ফেরত ঠাকুরমার বাসাবাড়িতে বিনা খবরে আসা আরও আনন্দের ছিল। তিনি মেলা থেকে কাঠের পুতুল আর পাকা বেল নিয়ে এসেছিলেন। শ্রাবণ মাসে ‘বাবার’ মাথায় জল ঢালতে যারা পায়ে হেঁটে তারকেশ্বর যান ফেরার পথে তাদের সকলের হাতে থাকে একটি বিশাল কুমড়ো। বোধ করি এটা কোনও ধর্মীয় আচার নয়। তারকেশ্বরে প্রচুর কুমড়ো ফলে। দামেও সস্তা। সবাই তাই একটি দুটি নিয়ে আসে। লাঙ্গল বন্ধের বৈশিষ্ট্য ছিল বেল। দক্ষিণ কলকাতার কুঁদঘাট বাজারে লাঙ্গলবন্ধের পূর্ব বাসিন্দা এক সব্জি বিক্রেতা দাদাকে বলেছেন সে বেল নাকি ওজনে দশ বারো কিলো পর্যন্ত হত।

বাসাবাড়ির এত কাছে হওয়া সত্ত্বেও কেন কোনোদিন লাঙ্গলবন্ধের স্নানে যাওয়া হয়নি তার একটা কারণ হতে পারে শীতল্যক্ষা নদী পার হতে হয়। তা ছাড়া সেদিন পৌষপার্বণ। বাড়িতে হাঁড়ি হাঁড়ি পিঠে পায়েস রান্নার ধুম। সারাদিন নানা জনের আনাগোনা। পিঠেরই বা কত বাহার। পশ্চিমবাংলায় যে চাঁচের পিঠের নাম পূবে তারই রকম ফের চিতই পিঠা। নারকেল কোরা আর ঝোলাগুড় দিয়ে খেতে হয়। দুধ চিনি দিয়ে আঁশালে সে পিঠেরই অন্য স্বাদ। আর এক রকম ছিল ‘ঢুলাইন্যা চিতই’। ছাঁচের বদলে কড়াইতে চালবাটা ঢেলে কড়াইটি এদিক ওদিক ঢুলিয়ে দক্ষিণীদের ধোসার মতো তৈরি করা হত। সেও খেতে হত নারকেল কোরা আর ঝোলাগুড় দিয়ে। পাটিসাপটা, চিড়ার পুলি মুগের পুল-কত রকমের যে পিঠে হত তার ঠিক নেই। কোনও পিঠের মধ্যে ক্ষীরের মতো ঘন জ্বাল দেওয়া দুধে ভোজন। পায়েস তো ছিলই। তারও আবার রকম ভেদ। সাধারণত গোবিন্দভোগ চালেই পায়েস হত। এক সের খাঁটি দুধে এক ছটাক চাল মোটামুটি এই মাপ। কাউন ধানের ক্ষুদে ক্ষুদে চালেও পায়েস হত। তবে দেখনে স্বাদে গন্ধে চুসির পায়েসের ধারেকাছে কোনোটি যায় না। বাড়ির মেয়েরা দিনের পর দিন দুপুরে সংসারের কাজ, খাওয়া শেষে বসে বসে লেচি কেটে বুড়ো আঙুল ও তর্জনি নিয়ে সামান্য পিঠুলি খুঁটে নিয়ে নিপুণ কৌশলে হাতের তালুতে ঘষে ঘষে গোবিন্দভোগ চালের মাপের চুষি তৈরি করতেন। বাঁশের কুলোয় করে কড়া রোদে সেই চুষি শুকনো হত। দুধে ফেলে তৈরি হত পায়েস যার অন্য নাম পরমান্ন। এখন উইমেন লিবের যুগে এত ঝক্কি কে পোয়াবে। এখন তো মেয়েরা মাকে টেলিফোনে ‘পরমান্ন রেঁধে বলে ফেন ফেলবে কি’।

চৈত্র সংক্রান্তিতে বাস্তুপুজো আর গোদনাইলের মেলার কাহিনি শেষ হওয়ার আগেই এসে গেল পৌষপার্বণের গল্প। উপায় নেই, বাস্তবিক পুব বাংলার ছিল বারো মাসে তেরো পার্বণ। এক না যেতেই আর এক। একের সঙ্গে আরের মেশামেশি। কেন যে মাস জুড়ে চৈত্রের সন্ধ্যায় লক্ষ্মীনারায়ণের কোয়াটার্সগুলিতে বহুরূপীর আনাগোনা শুরু হত, অন্য সময়ে নয়, সেটা আর জানা হয়ে ওঠেনি। শরৎচন্দ্রের শ্রীনাথ বহুরূপীর গল্প পড়ে পড়ে মনে যে ছবি তৈরি হয়ে আছে তার সঙ্গে মিলবে না। পূর্ববঙ্গে আমরা যে বহুরূপী জানতাম তাকে বলা হত কালীনাচ। দলের একজন খড়গ হাতে করালবদনা কালী সাজত, একজন জটাজুটোধারী মহাদেব এবং কয়েকজন বিকটদর্শন পিশাচ। ঢাক ঢোল কাঁসর ঘণ্টার কর্ণবিদারী বাজনার তালে তালে এরা না হোক আধঘণ্টা ধরে উদ্দাম নৃত্য করত। প্রতিটি দলের সঙ্গেই একটি বিশাল ভালুকও থাকত। নাচতে নাচতে সে ভালুকের আবার জ্বর আসত। যেমন তেমন জ্বর নয়। ‘এক হাত দু হাত তিন হাত সাড়ে তিন হাত আর ইটুন’ সে জ্বর মাপার জন্য ছিল প্রায় মানুষ সমান তেল চুকচুকে বাঁশের লাঠি। জ্বর মাপা হয়ে গেলে ভালুক তড়াক করে লাফিয়ে উঠে আবার দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে নাচতে শুরু করত। নাচ শেষে গোটা দল পেত এক থালা চাল দু’চারটে আলু বেগুন ঝিঙা, ঢ্যাঁড়স আর গৃহস্থ খুব দয়ালু হলে সঙ্গে দু’চার আনা খুচরো পয়সা। রং কালি সাজপোশাক আছে। ভালুকের পেট ভরানো আছে, হ্যাজাক লন্ঠনের কেরোসিন তেল ম্যান্টেল কিনতে হয়। এসব খরচখরচার পর দিনের আয়ের কতটা অবশিষ্ট থাকে এবং দলের কার ভাগে কতটা পড়ে সে হিসেবে অনন্ত তখন কেউ করত মনে হয় না। দোলের দিনে সন্ধ্যায় কোম্পানির পশ্চিমা দারোয়ানরা বাসাবাড়ির উঠোনে এসে গান করত। পুববাংলায় দোল ছিল তিনদিনের। প্রথম দিন শুধুই আবির মাখামাখি। দ্বিতীয় দিনে গোলা রঙ। গ্রামঘরে পলাশ ফুল, শিউলি ফুলের শুকিয়ে রাখা বোঁটা, পুঁইয়ের পাকা বিচি আরও কী কী যেন জলে এক রাত্রি ভিজিয়ে রেখে হলুদ বেগুনি এইসব রঙ নিজেরাই তৈরি করা হত। আমাদের রং অবশ্য আসত কারখানার ডাইং ডিপার্টমেন্ট থেকে। টকটকে লাল গাঢ় বেগুনি সবুজ যার যেমন পছন্দ। এখনকার মতো রং খেলার সময় বেঁধে দিত না পুলিশ। দোলের দিন যে যখন খুশি যাকে খুশি রং দেবে। প্রায় সব বাড়িতেই বিশাল বিশাল পিতলের পিচকিরি ছিল। অধিকন্তু আমাদের সকলের নামে নামে কারখানার ওয়ার্কশপ থেকে বয়স অনুযায়ী ছোটো বড়ো নানা মাপের লোহার পাইপের অথবা টিন বাঁকিয়ে ঝালাই করে পিচকিরি তৈরি করে আনা হত। প্লাস্টিক সে সময় অজানা। রঙের বালতিও টিন অথবা পিতলের। কেউ রং নিতে আপত্তি করলে জোর করে তার গায়েই রং দেওয়াই ছিল বেশি মজা। একবার পাশের কোয়াটার্সের কাকিমা কিছুতেই রং নেবেন না, সকাল থেকেই দরজা জানলা বন্ধ করে ঘরের মধ্যেই লুকিয়ে রইলেন। তাকে হদিশ করাই গেল না। দুপুর গাড়িয়ে রঙের হুল্লোড় স্তিমিত হলে কাকিমা কিছুটা অসতর্ক হয়ে ভাতের থালা নিয়ে বসেছিলেন। স্ফূর্তিবাজ প্রভঞ্জন কাকা ঠিক সেটা নজরে করেন। আর কথা নেই। পা টিপে টিপে পেছন দিকের বেড়ার ফুটো দিয়ে পিচকিচির গলিয়ে নিখুঁত নিশানায় ভাতের থালা শুদ্ধু কাকিমাকে টকটকে লাল রঙে প্রায় আপাদমস্তক রাঙিয়ে দিয়েছিলেন। অনিবার্যভাবেই কাকিমার চিৎকার চেঁচামেচিতে সেদিন গোটা কম্পাউন্ডের লোক এসে জড়ো হয়েছিল।

দোল প্রসঙ্গে আমার একবারের অভিজ্ঞতা সুখস্মৃতি বলা যাবে না। সেবার কি জানি কেন দোলের সময় খাটের নীচে এক টিন আলকাতরা রাখা ছিল। আমাদের দু তিনটে পরেই ডঃ অনিল সেনের কোয়াটার্স। ডাক্তারবাবুর দুই মেয়ে নাম বুড়ি আর মলু। আমাদের খেলার সাথি। মতলবে ছিলাম ওদের গালে আলকাতরা মাখতে হবে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। দুই হাতের তালুতে আলকাতরা মেখে নিয়ে ডাক্তারবাবুর কোয়াটার্স গিয়ে হাজির হলাম। হাত পেছনে লুকিয়ে সবে ডাক্তারবাবুর কোয়াটার্সে গিয়ে দুই বোনকে ডেকেছি। তাদের দাদা ছিল বয়সে অনেক বড়ো, প্রায় আমার দাদার সমবয়সি। পরে হুগলি জেলার রিষড়াতে লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসের দু-নম্বর ফ্যাক্টরিতে তিনি ম্যানেজার হয়েছিলেন। ডাক শুনে সেই রবিদাই বেরিয়ে এসে’ছিলেন। আমার মতলব ধরে ফেলতে তার একটুও দেরি হয়নি। সুতরাং যা হওয়ায় তাই। আমাকে জাপটে ধরে আমারই হাতের আলকাতরা আমারই প্রায় গোটা গায়ে চটচটে করে মাখিয়ে দিয়েছিলেন। কেরোসিন তেলে ভেজানো ন্যাকড়া দিয়ে ঘসে ঘসে মা সেই আলকাতরা তুলতে আমার সারা গায়ের ছালচামড়াই তুলে ফেলেছিলেন। সেই থেকে আর কোনোদিন আজেবাজে রং নিয়ে খেলার কথা মাথায় আসেনি। দোলের তৃতীয় দিনে প্যাক (পাঁক) খেলার ধারও মাড়াই। ওইদিন পুকুরে ডোবার কাদা, গোবর, বাড়ির যত রাজ্যের বর্জ্য নিয়ে মাখামাখিতে কোন আনন্দ ছিল আজও বোধগম্য নয়। আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লাগত পশ্চিমা দারোয়ানদের হোলির গান। ফাল্গুন মাস পড়লেই রোজ সন্ধ্যায় দারোয়ানদের ডেরায় কারও দাওয়ায় সবাই গোল হয়ে বসে ঢোল বাজিয়ে গান। গানের কথা কিছু বুঝতাম না। খালি কানে বাজত ছ্যারা-রে-রা ছ্যারা-রে-রা, ধিক চলি যা, বাহরে ব্যাটা পহরে ব্যাটা। সমবেত কণ্ঠে সেই উদ্দাম সংগীত চলত অনেক রাত্রি পর্যন্ত। রাত্রে খাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে যখন ধীরে ধীরে ঘুমে ঢুলে পড়তাম দূর থেকে তখনও তাদের ঢোল সহবত গানের আওয়াজ ভেসে আসত। মনে মনে দিন গুনতাম দোল এসে গেল। হোলি অর্থাৎ দোল পূর্ণিমার সন্ধ্যায় এরা সদলে গান গেয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াত। টকটকে লাল আবিরে আপাদমস্তক রঞ্জিত থাকায় সে সন্ধ্যায় তাদের কাউকে আর আলাদা করে চেনার উপায় ছিল না। আকন্ঠ পান করা ভাঙের সরবতের মহিমায় তাদের চোখগুলিও রক্তবর্ণ। প্রতিটি স্টাফ কোয়াটার্সে ঢুকে তারা বেশ কিছুক্ষণ হোলির গান গাইত। পরে থালায় করে নিয়ে আসা আবির এক টিপ করে বড়দের পায়ে এবং ছোটোদের কপালে দিত। অফিসারদের মধ্যে উদারপন্থী কেউ কেউ ওদেরই থালা থেকে এক মুঠো আবির তুলে ওদেরই মুখে মাখিয়ে দিলে মহানন্দে ওই কোয়াটার্সে আর একদফা গান চলত। আবিরের থালায় সব বাড়ি থেকেই চার আনা, আটা আনা, কিছু খুচরো পয়সা দেওয়া হতো। কোনও বাড়ি থেকে পুরো ষোলোআনা বকশিশ পেলে বার বার করে কৃতজ্ঞতা জানাত।

একুশ

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ প্রবাদ পূব বাংলায়ই সার্থক। দোল, দুর্গোৎসব, কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী পুজোর সঙ্গে কার্তিক মনসা তিন্নাথ সুবচনী শীতলার মতো কিছুটা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক দেবদেবীরাও মহা উৎসাহে পূজিত হতেন। সেই সঙ্গে ছিল মাঘমণ্ডলের ব্রত পৌষ পার্বণ চৈত্রসংক্রান্তির ছাতু ওড়ান ষষ্টীব্রত প্রভৃতি আধা ধর্মীয় আধা সামাজিক আচার বিচার। মুসলমানদের ইদ সবেবরাত। এমনতর সব উৎসব আনন্দে মেতে থেকেই প্রত্যহের দুঃখ দৈন্য অভাব অনটন কিছুটা হলেও ভুলে থাকা সম্ভব হত। লড়াই সংগ্রামও ছিল। সকলের আগে স্বাধীনতার লড়াই। কংগ্রেসে মুসলিম লিগ হিন্দু মহাসভা ফরোয়ার্ড ব্লক কমিউনিস্ট পার্টি আরও কত ধারায়। তবে সকলেরই লক্ষ বিদেশি শাসনের অবসান। স্বাধীনতা। প্রতি বছর ২৬ জানুয়ারি খেলার মাঠে কংগ্রেসের ত্রিবর্ণ পতাকা তোলা হত। ওই দিনটিই তখন স্বাধীনতা দিবস হিসেবে চিহ্নিত। ওই দিনেই সমবেত কণ্ঠে ‘বন্দেমাতরম’ স্লোগান উঠত। সকলের আকাঙ্খা, ‘ওঠো গো ভারত লক্ষ্মী এসো আদি জগত জন পূজ্যা।’ অবশেষে মধ্য রাতের স্বাধীনতা যখন এল পূববাংলার সংখ্যালঘু হিন্দুরা কি সেই খণ্ডিত স্বাধীনতাকে আন্তরিক অভ্যর্থনা করতে পেরেছিল? অবশ্যই প্রথম দিনেই কেউ ভিটেমাটি ছাড়ার কথা ভাবেনি। প্রথম স্বাধীনতা দিবসের উৎসবে হিন্দুরাও শামিল হয়েছিল যথার্থ আন্তরিকতা নিয়েই। কম্পাউন্ডে আমাদের সবকটি বাসাবাড়ির মাথাতেই তিনভাগ সবুজ একভাগ সাদা মাঝে একফালি চাঁদ ও তারা নবীন রাষ্ট্র পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উড়েছিল। কোম্পানির খরচেই বাড়ি বাড়ি পতাকা বিতরণ করা হয়। আগে থেকেই আমাদের বাসাবাড়িতে একটি কংগ্রেসের ত্রিবর্ণ পতাকা ছিল। পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার সঙ্গে সেটিও টাঙানো হয়। তবে মনে আছে দুটি আলাদা দণ্ডে সমান উচ্চতায় দুটি পতাকা টাঙানো সমীচীন হবে কি না, বড়রা নিজেরা অনেকক্ষণ সে আলোচনা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত একই দণ্ডে সবুজ-সাদা জাতীয় পতাকার নীচে কংগ্রেসের পতাকা টাঙানো হয়। দেশ ছাড়ার কথা প্রথম দিকে কল্পনাতেও ছিল না ঠিকই। তবু কেন যেন পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা আমাদের কাছে খুব একটা আদরণীয় হয়নি কোনও দিনই। মা কোম্পানির দেওয়া পতাকাটি কেটে সে সময় কোলের শিশু আমার সবচেয়ে ছোটো বোনটিকে একটি সুন্দর ফ্রক বানিয়ে দিয়েছিলেন। অবশ্য ১৯৪৭ সালে আমাদের পরিবারের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিই বোধ হয় এর কারণ ছিল। জাতীয় পতাকার প্রতি অশ্রদ্ধা বা অনাদার নয়। অর্থনৈতিক পরিস্থিতিই বোধ হয় এর কারণ ছিল। জাতীয় পতাকার প্রতি অশ্রদ্ধা বা অনাদর নয়। অর্থনীতিবিদ ও কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবী.ড. অশোক মিত্র তার আত্মচরিত ‘আপিলাচাপিলায়’ জানিয়েছেন যে, দেশ ভাগের পরে পরেই কলকাতায় এক আন্তর্জাতিক যুব সম্মেলনে যোগ দিতে তিনি শিয়ালদহ স্টেশনে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা কাঁধে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমেছিলেন। পুব বাংলার অধিকাংশ হিন্দুই তখন পাকিস্তানকে নিজেদের দেশ বলেই মনে করত। তবু যেন আস্তে আস্তে পরিবেশ পাল্টে যাচ্ছিল। টুকটাক একটা দুটো পরিবার দেশ ছেড়ে নিঃশব্দে চলে যাচ্ছিল।

আগেই বলেছি আমি প্রথম স্কুলে ভর্তি হই ১৯৪৭-এ। ক্লাস ফোরে। আমার সেকশন হয়েছিল ‘বি’। ক্লাস ফোরে ‘এ’, ‘বি’, মোট দুটি সেকশান ছিল। ভালো ছাত্রদের জন্য ‘এ’ সেকশন। পরীক্ষার ফল অনুযায়ী রোল নম্বর। ফার্স্ট বয়ের রোল নম্বর ওয়ান। পরের বছর ক্লাস ফাইভে উঠতেই আমার সেকশন বদলে গেল। আমি ‘এ’ সেকশনে জায়গা পেলাম। রোল নম্বর হল টু। অর্থাৎ পরীক্ষায় আমি সেকেন্ড হয়েছি। ফার্স্ট বয়ের নাম বকুল। সে ক্লাস ক্যাপ্টেনও। ক্লাস ক্যাপ্টেনের কাজ টিচার ক্লাসে আসার আগেই সকলের কাছ থেকে হোমওয়ার্কের খাতা সংগ্রহ করে টিচারের টেবিলে পরপর সাজিয়ে রাখা। টিচারের অবর্তমানে কেউ গোলমাল করলে তার নাম টুকে রাখা। ফার্স্ট বয় তথা ক্যাপ্টেন ক্লাসে খুবই সম্মানিত ব্যক্তি। অন্য ছাত্রদের তাকে সমীহ করে চলতে হয়। ক্যাপ্টেন টিচারের কাছে কারও সম্পর্কে অভিযোগ করলে শাস্তি অনিবার্য। সে অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং ব্যক্তিগত রেষারেষির কারণে হলেও। অভিযুক্তের কোনও সাফাই-ই গ্রাহ্য হবে না। কোনও কারণে কোনোদিন ফার্স্ট বয় স্কুলে না এলে ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব সেকেন্ড বয়ের ওপর বর্তাত। ওই ক্লাস ফাইভেই সরস্বতী পুজোর পর থেকে বেশ কয়েকদিন বকুল আর স্কুলে আসে না। অতএব আমি কার্যনিবাহী ক্যাপ্টেন। বেশ চলছিল আমার মাতব্বরি। হঠাৎ একদিন ক্লাস টিচারের নজরে পড়ল বকুল স্কুলে আসছে না অনেক দিন হয়ে গেল। কোনও অসুখ বিসুখ হল কিনা উৎকণ্ঠা প্রকাশ করতেই ক্লাসের পিছন দিকের কেউ একজন দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিল ‘বকুলরা হিন্দুস্থান’ চলে গেছে। ও আর আসবে না। ওই সময় ভারত আমাদের কাছে হিন্দুস্থান। বকুল আর আসবে না খবরে গোটা ক্লাস কেমন যেন নিঃশব্দ হয়ে গেল। মাস্টারমশাইও খানিকক্ষণ আনমনা চুপচাপ বসে রইলেন। তারপর এক সময় ঘণ্টা বাজার আগেই তিনি কিছু না বলে ধীরে ধীরে টিচাস রুমের দিকে হেঁটে গেলেন। যেন খুবই ক্লান্ত। সেদিন বাড়ি ফিরে বকুলরা হিন্দুস্থানে চলে গেছে খবরটা শোনাতেই মা ও দাদাও কয়েক মুহূর্ত নীরব হয়ে গেছিলেন। তারপর অবশ্য দাদা বলেছিলেন ভালোই হয়েছে। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী থাকল না। এখন থেকে যেন প্রতি ক্লাসে আমিই ফার্স্ট হই। ব্যাপারটাকে আরও স্বাভাবিক করার জন্য বোধ হয় তিনি এও শুনিয়েছিলেন যে, স্কুলে পড়ার সময় তিনি প্রথমে ক্লাসে সেকেন্ডই হতেন। কোনও কারণে ফার্স্টল বয় স্কুল ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে বারবার তিনি ফার্স্ট হয়েছেন।

লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসের স্টাফ কোয়াটার্সগুলির একটিতেও কোনও মুসলমান পরিবার ছিল না। খেলার মাঠেও কোনও মুসলমান ছেলেমেয়ে আসত বলে মনে পড়ে না। একটি দুটি খুবই গরিব মুসলমান মেয়েই যা কাঠ অথবা কয়লার টুকরো কুড়োতে মাঝে মধ্যে অতি ভীরু পায়ে কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকত। আমরা তাদের কখনও খেলতে ডেকেছি মনে পড়ে না। ডাকলেও সাড়া দেওয়ার সাহস করত না। এখন কিন্তু একজন দুজন করে মুসলমান ছেলেরাও মিল কম্পাউন্ডের মাঠে ঢুকতে শুরু করল। প্রথমে তারা চুপচাপ ঘুড়ি ওড়াত। ধীরে ধীরে দল বেঁধে খেলতে শুরু করল। স্কুলের পরিবেশও যেন বদলাচ্ছিল। আমাদের বার অ্যাকাডেমিতে মুসলমান ছাত্র খুব বেশি ছিল না। হিন্দু প্রধান নারায়ণগঞ্জ মহকুমা শহরে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত মুসলমানের সংখ্যাই ছিল কম। বেশিরই ভাগই নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী। তাদের ঘরের ছেলেমেয়েরা স্কুল কলেজে যেতই না ব্যতিক্রম ছাড়া। উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরা বেশিরভাগই আইটি কলেজিয়েট স্কুলেই ভর্তি হত। সেখানে বোধ হয় শরিয়তি শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। ছেলেরা স্কুলে যেত লুঙ্গি পাঞ্জাবি মাথায় ফেজ টুপি পরে। বার অ্যাকাডেমিতে অল্প কয়েকজন মুসলমান ছাত্র ছিল। বোধ হয় বিজ্ঞান শিক্ষার আগ্রহেই তাদের অভিভাবকরা এই স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। স্কুলে একজন মৌলবি সাহেবও ছিলেন। তবে তাদের অস্তিত্ব খুব একটা টের পাওয়া যেত না। নীচের ক্লাসের মুসলমান ছাত্ররা হিন্দু ছাত্রদের মতোই হাফপ্যান্ট হাফশার্ট পরে স্কুলে আসত। ওপরের ক্লাসে হিন্দু ছাত্ররা ধুতি আর মুসলমান ছাত্ররা আলিগড় পাজামা পরত। ধীরে ধীরে মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে নিজেদের জাহির করার একটা প্রবণতা দেখা দেয়। মৌলবি সাহেবও যেন একটু বেশি মাথা উঁচু করে হাঁটেন, কথা বলেন অতিরিক্ত বক্তৃতা সহকারে। স্কুলে সংস্কৃতের সঙ্গে হিন্দু ছাত্রদের হাতেও উর্দু বইও ওঠে। যদিও উর্দু শেখার জন্য তেমন কোনও চাপ দেওয়া হত না। স্কুলে সাপ্তাহিক ছুটির দিন পাল্টে গেছে। শনিবার হাফ রবিবার ফুল ছুটির পরিবর্তে বৃহস্পতিবার হাফ শক্র অর্থাৎ জুম্মাবারে ফুল ছুটি। মৌলবি সাহেব ও মুসলমান ছাত্ররা স্কুলে ঢুকে পরস্পর ‘সেলাম আলায়কুম’ এবং ‘ওয়ালেকুম আসসালাম’ বলে সম্ভাষণ প্রতি সম্ভাষণ করে। একদিন উঁচু ক্লাসের একটি ছেলে মৌলবি সাহেবকে আস সালাম আলায়কুম সম্ভাষণ করার পর পাশেই দাঁড়ানো স্কুলের প্রবীণতম শিক্ষক জ্ঞানবাবু কিংবা নগেনবাবু কিংবা শিশিরবাবু কোনও একজনের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিল। এই কাফেরি আচরণকে উপলক্ষ করে অন্য মুসলমান ছাত্ররা সেদিন বেশ খানিকটা ঘোঁট পাকিয়েছিল। তবে ঘটনা বেশিদূর গড়ায়নি।

প্রথম দিকে ধীরে হলেও পরিবেশ যে পাল্টাচ্ছে তা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছিল। আগে রাস্তাঘাটে শ্রমজীবী নিম্নবিত্ত মুসলমানরা হিন্দু বাবুদের সমীহ করেই চলত। দেশভাগের পর সমীহের পরিবর্তে প্রথমে উদাসীনতা এবং পরে ক্রমে ক্রমে উপেক্ষা ও অশ্রদ্ধা দেখা দিল। যারা অনুমতি না নিয়ে কোনোদিন বাসাবাড়ির সদর পার হয়নি তারা এখন সোজা এসে দাওয়ায় বসে পড়ে। এ নিয়ে বড়রা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতেন ঠিক। তবে গোড়াতেই খুব একটা উদ্বেগ অথবা দুশ্চিন্তা দেখা যায়নি। আশা ছিল ‘হোমল্যান্ড’ পাওয়ার প্রাথমিক উচ্ছ্বাসটা কেটে গেলেই আবার সবকিছু আগের মতোই হয়ে যাবে। কেউ কেউ এমনও আশা করতেন পাকিস্তানের আয়ু আর কতদিন। এতদিন পাশাপাশি বাস, সুখে দুঃখে একে অপরের ভাগীদার হওয়ার পর হিন্দু মুসলমানের দুটি পৃথক দেশ হবে এ কখনও ভাবাই যায় না। পাকিস্তান হিন্দুস্তান দু-দেশ এক হয়ে আবার অখণ্ড ভারতবর্ষ হল বলে। এই আশা নিরাশার মধ্যেই এমন একটা দুটো ঘটনা হঠাৎ ঘটে যায় যাতে হিন্দুদের মনের ভরসার ভিত দুর্বল হয়। স্টাফ কোয়াটার্স কমপ্লেক্সের আশেপাশেই কোথাও থাকত নয়ন নামে একটি কিশোর। স্কুলের ছাত্র। দেশভাগ হওয়ার পর থেকেই সে খেলার মাঠে আনাগোনা শুরু করেছিল। প্রথমে ঘুড়ি লাটাই নিয়ে একা একা। পরে আরও কয়েকজনকে জুটিয়ে নিয়ে। আমরা ওদের খেলার সাথিও করে নিয়েছিলাম! যদিও মনে দ্বিধা ছিল। মুসলমানরা বিধর্মী। জলচল নয়। ওদের ছোঁয়াছুঁয়ি একসাথে খেলাতে জাত যাবে কি না। নয়ন শুধু খেলার দলে ঢুকে পড়াই নয় কর্তৃত্বও করতে চায়। এই নয়ন একদিন স্টাফ কোয়াটার্সের একটি কিশোরীকে প্রেমপত্র দিলে গোটা মিল কম্পাউন্ডে হইচই পড়ে যায়। মেয়েটির বাবা ডাইংমাস্টার না স্পিনিংমাস্টার কোনও অফিসার। নয়নের বাবাও লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসেই কাজ করতেন। তবে নীচু পদে। ম্যানেজার সুনীল বসু বাবা-ছেলেকে ডাকিয়ে আনলেন। ছেলের অপরাধের জন্য বাবা ক্ষমা চাওয়ার পরেও ম্যানেজারবাবু নয়নকে বেশ করে উত্তমমধ্যম দিয়েছিলেন। তার মনে হয়েছিল গোড়াতেই উচিত শিক্ষা না দিলে এরকম ঘটনা আরও ঘটবে। বাবা ক্ষমা চাওয়া সত্ত্বেও ম্যানেজারবাবু ছেলেকে মারধর করায় ‘সদ্য শাসক’ সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রবল বিক্ষোভ দেখা দয়ে। ‘শাসিতরাও দ্বিধাগ্রস্ত’। নরমে গরমে একটা মিটমাট করে নেওয়াই বোধ হয় সমীচীন ছিল। শেষ পর্যন্ত ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে কিশোরীটিকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়।

তা হলেও হিন্দুদের জীবন যাপনের খুব বেশি ইতর বিশেষ হয়নি। বাবা মারা যান দেশভাগের এক বছর আগেই ১৯৪৬ সালের ৪মে। দেশের বাড়ির দুর্গাপুজোর সেবার আমাদের পালা ছিল। কালাশৌচের কারণে এক বছর আমাদের পরিবারে পুজো অথবা অন্য কোনও শুভানুষ্ঠান বারণ। অথচ মহাপুজো বন্ধও রাখা যায় না। নোয়াদাদুই সে বছর পুজোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বরাবরের মতো আমরা সেবার আর পুজোয় দেশের বাড়ি যাইনি। যাওয়া হয়নি পরের বছরও। কালাশৌচ কেটে গেলেও সেবার আমাদের পালা নয়। সেটা বড়ো কথা নয়। পালা থাকুক বা না থাকুক আমরা প্রতি পুজোতেই দেশের বাড়ি যেতাম। সেবারে নাতি নাতনিদের গাছের আম, লিচু, কাঁঠাল খাওয়াতে ঠাকুমা গ্রীষ্মেই মিথ্যা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দেশের বাড়ি ডেকে নিয়ে গেছিলেন। দাদার নতুন চাকরি। একই বছরে দু’বার বড়ো ছুটি পাওয়া সম্ভব ছিল না। দেশের বাড়ি অনেক দূরের পথ, যেতে আসতে প্রায় চারদিন কেটে যায়। অতএব ১৯৪৬, ১৯৪৭ আমরা পুজোয় বাসাবাড়িতেই ছিলাম। পাশের চিত্তরঞ্জন কটন মিলসের পুজো মণ্ডপেই ঠাকুর দেখতে গেছি। নারায়ণগঞ্জ শহরেও কয়েকটি বারোয়ারি দুর্গাপুজো হত। একদিন বোধ হয় সেগুলিও দেখতে গেছিলাম। তবে যেহেতু আমাদের মধ্যে কলকাতার মতো বারোয়ারিতলা ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখার সংস্কৃতি ছিল না তাই খুব একটা উৎসাহ বোধ করিনি। আমাদের দিন কাটত নিজেদের দুর্গামণ্ডপে। দিনে এক আধবার মধ্যের বাড়ি দক্ষিণের বাড়ির মণ্ডপে। মধ্যের বাড়ির পুজো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর শুধুই দক্ষিণের বাড়িতে। খুব দূরে গেলে বোসদের বাড়ি পর্যন্ত। তাও ছিল বিরল ব্যতিক্রম। আমরা আশেপাশের পাঁচ গ্রামের প্রতিমা দেখতাম নিরঞ্জনের দিন। স্থানীয় ভাষায় ‘পিত্তিমা বুড়ান’ দেওয়া। আমাদের তিন শরিকের প্রতিমা নৌকোয় হাটখোলার খালে নিয়ে যাওয়া হত। আশেপাশের গ্রামের সবকটি পুজোর প্রতিমা প্রদক্ষিণ করে না যাওয়া পর্যন্ত তিন শরিকের তিনটি নৌকো হাটখোলার খালে প্রতিমা-সহ দাঁড়িয়ে থাকত। হাটখোলায় সেদিন মোটামুটি মেলাই বসে যেত। অন্যদের সব প্রতিমা ঘুরে যাওয়ার পর মধ্যরাত্রি পার করে আমাদের তিন বাড়ির তিনটি প্রতিমা পরপর জলে পড়ত। যে দুবছর দেশের বাড়ি যাইনি নিরঞ্জনের ব্যবস্থা ছিল কি না তাই জানি না। একবার বিজয়া দশমীর দিন বিকেলের পর থেকেই প্রবল বৃষ্টি নেমেছিল। মা ঘরের মেঝেতে বিসর্জনের ঘট বসিয়েছিলেন। আমরা যতটা সম্ভব বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচিয়ে বাসাবাড়ির বাইরে কোনওক্রমে একবার বেরিয়েই আবার ঘরে ঢুকে মাকে প্রণাম করে সেবারের মতো বিজয়া সেরেছি। আটচল্লিশ উনপঞ্চাশে পুজোয় দেশের বাড়িতেই গেছি। সেই পদ্মা মেঘনা ধলেশ্বরী বেয়ে স্টিমারে তারপাশার হোটেলে ইলিশ মাছ ভাত খেয়ে। সব কিছু আগের মতোই।

মিল কম্পাউন্ডেও আগের মতোই কালীপুজো আর সেই উপলক্ষে তিন চাররাতি যাত্রাগান হয়। দেশভাগের পরেও দল আসে কলকাতার চিৎপুর পাড়া থেকেই। সাতচল্লিশেই বোধহয় এক রাত্রের পালার গল্প ছিল সুভাষচন্দ্রের জীবন-ভিত্তিক। সখির নাচ শেষ হতেই প্রথম দৃশ্যে হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা চলছে। অর্ধেক সাদা সবুজের ওপর চাঁদ তারা টুপি মাথায় একজন চোঙা মুখে আবেদন করল, হানাহানির দিন শেষ হয়ে গেছে। বিদেশি ইংরেজ চলে গেছে। দেশের মানুষই এখন দেশের মালিক। হিন্দু মুসলমান ভাই ভাই নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য বিধাতা। এই ঘোষণার পর মঞ্চের দাঙ্গা থেমে গেল। হিন্দু মুসলমান একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরল। স্লোগান উঠল পাকিস্তান জিন্দাবাদ। এই পালায় সুভাষচন্দ্রের বাবা জানকীনাথ বসুর একটি সংলাপ অনেক সময়ই মনে পড়ে, ‘সাগরে যখন ঝাঁপ দিয়েছ মানিক তোলা চাই’। জলসা, থিয়েটার, বিকেলে ফুটবল, ভলিবল, রাত্রে ব্যাডমিন্টনের সঙ্গে ছোটদের চোর-পুলিশ, গোল্লা ছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, কপাট গুলতি, ডাংগুলি, মার্বেল সবই আগের মতো। আবার আগের মতো নয়ও। বিশেষ করে যখন ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলি দুর্বল অথবা ভেঙে পড়তে লাগল। গান্ধীজির মৃত্যুর পর থেকেই হিন্দু সংখ্যালঘুদের মনে নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। ওই বছরই গ্রীষ্মের এক দুপুরে হঠাৎই বাসাবাড়িতে কাউকে কিছু জানান না দিয়ে একদল পুলিশ ঢুকে পড়ে। সঙ্গে ফ্যাক্টারি ম্যানেজার সুনীল বসু। তিনি বারবার মাকে প্রশ্ন করতে থাকেন বাড়িতে কোনও পুরুষ আছে কি না। পুলিশ তখন হুটহাট এঘর ওঘর করছে। এটা টানছে ওটা ভাঙছে। দেশভাগের আগে একবার ব্রিটিশ পুলিশ পাশের বেণীবাবুর কোয়াটার্সে সার্চ করেছিল। বেণীবাবু মিল কম্পাউন্ডের ডাকঘরের পোস্টমাস্টার ছিলেন। তার বিরুদ্ধে বোধহয় তছরূপের অভিযোগ ছিল। সার্চের সময় বেণীবাবুদের বাসাবাড়ি প্রায় লণ্ডভণ্ড করে ফেলেছিল পুলিশ। ঘটি বাটি ভেঙে বাক্স প্যাঁটরার সব কিছু উল্টে ফেলে লেপ তোশক বালিশ ছিঁড়ে তুলো উড়িয়ে কোয়াটার্স থেকে কিছু ডাকটিকিট উদ্ধার করেছিল। তিনি নাকি ডাকে ফেলা চিঠি থেকে নতুন টিকিট খুলে নিয়ে ব্যবহৃত ডাকটিকিট সেঁটে দিতেন। সেকালে যে ডাকমাশুল ছিল তাতে এভাবে বেণিবাবু কত উপারি রোজগার করত পারতেন তিনিই জানতেন। তবে তার পরিবারটি বড়ো ছিল। হয়ত আধা গ্রামীণ পোস্ট অফিসের মাস্টারবাবুর সরকারি বেতনে সংসার চালনো কঠিনই ছিল। যে সংসারে আবার একগুচ্ছের মেয়ে।

আমাদের বাসাবাড়িতে পুলিশের হানার সময় চেয়ার টেবিল বাক্স প্যাঁটরা এটা ওটা এদিক ওদিক টানা হ্যাঁচড়া করলেও বিছানা বালিশ ছেঁড়াছেঁড়ি করেনি। তার কারণ পুলিশের সন্ধানের বিষয় ছিল মানুষ। বলা বাহুল্য পুরুষ মানুষ। তাই ফ্যাক্টরি ম্যানেজার বারবার কিছুটা উদ্বিগ্ন ভাবেই বাড়িতে শুধু পুরুষ কে আছে প্রশ্ন করেছিলেন। তখন বাড়িতে পুরুষ বলতে আমি। জ্বর ছিল বলে স্কুলে যাইনি। বিছানায় শুয়ে ছিলাম। বছর আট নয়ের এক বালককে পুলিশ পুরুষ বলে গণ্য করেনি। সে যে সুভাষচন্দ্র বসুর ‘তরুণের বিদ্রোহ’ পড়েছিল সেটা বোধহয় নজরে পড়েনি। পরে শুনেছিলাম ম্যানেজারের ভয় ছিল দাদা ‘যদি কোয়াটার্সে থেকে থাকেন। দাদার সেদিন নুন শিফট ডিউটি ছিল। মর্নিং অথবা নাইট শিফট ডিউটি কোয়াটার্সে থাকতেই পারতেন। এবং তেমন হলে পুলিশ দাদাকে নিশ্চিত ধরে নিয়ে যেত। সেদিন শুধু আমাদেরই নয়, পুলিশ মিল কম্পাউন্ডের প্রতিটি ফ্যামিলি কোয়াটার্স এবং ব্যাচেলার মেসেও হানা দিয়েছিল। পুরুষ যাকেই পেয়েছে ধরে নিয়ে গেছে। সন্ধ্যায় যখন অধিকাংশ ছাড়া পেয়ে ফিরে আসে তাদের তখন প্রায় আধমরা অবস্থা। প্রত্যেকেরই হাতে পায়ে মাথায় দুটো চারটে পট্টি বাঁধা। বেশ কয়েকটি পরিবারের লোকজনকে তাদের হাত পা পিঠে নুনের পুলটিশ সেঁক দিতে হয়েছে। সুনীল বসু দাদাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। পরে মাকে বলেছিলেন সুকুমার সে সময় কোয়াটার্সে থাকলে তিনি রক্ষা করতে পারতেন না। পুলিশ সেদিন কারখানার মধ্যে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টেও হানা দিয়েছিল। উইভিং ডিপার্টমেন্ট ও ক্যালেন্ডার ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন কর্মী নতুন কাপড়ের স্তুপের তলায় লুকিয়েছিল। পুলিশ খুঁজে ঠিক তাদের বের করেছিল। ওই পুলিশ হানার বিষয়ে ওই বয়সে আমার কোনও ধারণা থাকার প্রশ্নই ছিল না। বড়রাও যে খুব একটা বুঝে উঠতে পেরেছিলেন তা নয়। ওই ঘটনার পর কোম্পানি ইউনিয়ন অফিসে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিল। হয়ত ইউনিয়নের অনুমোদনও বাতিল করা হয়েছিল। পুলিশি হানার পর বেশির ভাগকেই মারধর করে ছেড়ে দেওয়া হলেও ইউনিয়ন সম্পাদক শ্রীকান্ত ও কয়েকজন মুখিয়া কর্মীকে বেশ কয়েকদিন লকআপে আটকে রাখা হয়। এরপর থেকে বহুদিন ইউনিয়নকে নড়াচড়া করতে দেখা যায়নি। অনেক পরে বোনাস না কী মহার্ঘভাতা বাড়ানোর দাবিতে একটা গেট মিটিং করা হয়। খুব বেশি না হলেও কিছু কর্মী জড়োও হয়েছিল। প্রথম বক্তা বক্তৃতা শেষ করে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ লালঝাণ্ডা কি জয়’ স্লোগান দিতেই একে একে শ্রোতারা সুড়সুড় করে সরে পড়ে। তাদের মধ্যে ফিসফিসানি এসব আবার কেন। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানের একটিই কমিউনিস্ট পার্টি ছিল। ওই বছর কলকাতায় পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস থেকে বি টি রণদিভে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পার্টির রাজনৈতিক লাইনও বদলে যায়। সঙ্গে গঠিত হয় পৃথক পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি। একই বছরে সি.পি.আই.-র পশ্চিমবঙ্গ কমিউনিস্ট পার্টি মুসলিম লিগ সরকারের নির্দেশ বেআইনি হয়। তারই জোর লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসের শ্রমিক ইউনিয়নের ওপর হামলা। এসব অবশ্য জেনেছি অনেক বড়ো হয়ে। কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস পড়ার পর।

বরাবরই স্কুলে ২৬ জানুয়ারি ‘স্বাধীনতা দিবস’ এবং ২৩ জানুয়ারি নেতাজির জন্মদিনে অঘোষিত ছুটি থাকত। ছেলেরা আসত সকলেই। কিন্তু এগারোটায় স্কুল বসার ঘণ্টা বাজতেই দল বেঁধে সব ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাওয়া হত। ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর ২৬ জানুয়ারি স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের প্রশ্ন ছিল না। স্বাধীনতা দিবস ১৪ আগস্ট। ওই দিন সরকারি ছুটি। কিন্তু ১৯৫০ পর্যন্ত দেখেছি ২৩ জানুয়ারি নেতাজির জন্মদিনে স্কুলে ধর্মঘটের রীতি বজায় ছিল। তবে মুসলমান ছাত্ররা আর ক্লাস থেকে বেরোয় না। বার অ্যাকাডেমিতে মুসলমান ছাত্র খুব কমই ছিল। এক এক ক্লাসে দুচার জন। এত কম ছাত্র নিয়ে ক্লাস চালিয়ে যাওয়া অর্থহীন। তাই মৌলবি সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে হেডমাস্টার মশাই বুঝিয়ে সুঝিয়ে প্রায় অনুনয় বিনয় করেই তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন। হেডমাস্টার মশাইয়ের অবাধ্য না হলেও হিন্দু নেতা সুভাষচন্দ্রের জন্মদিনে ক্লাস বন্ধ থাকতে তাদের ক্ষোভ চাপা থাকত না। মৌলবি সাহেব যে খুশি মনে হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গী হতেন বোধ হয় তাও নয়। নারায়ণগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে অনেক মুসলমান ছাত্র ছিল। আইটি কলেজিয়েট স্কুলের সব ছাত্রই মুসলমান। দেশ ভাগের পর এই দুই স্কুলে নেতাজি জয়ন্তীতে আর ধর্মঘট হত না। গার্লস স্কুলে কী হত মনে নেই। আমরা নীচের ক্লাসের ছেলেরা ২৩ জানুয়ারি স্কুল বসার ঘণ্টা পড়তেই হইহই করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসতাম। কিন্তু ওপরের ক্লাসের দাদাদের মধ্যে যেন কিছু দ্বিধা দেখা যেত। হয়ত ধর্মঘট করা সমীচীন কি না এ নিয়ে তাদের মনে প্রশ্ন ছিল। আমি সাধারণত প্রভঞ্জন কাকার ছোটোভাই ক্লাস এইটের ছাত্র নীহারের সঙ্গেই স্কুলে যাওয়া আসা করতাম। ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসার পর যত তাড়াই দিই নীহারকাকার বাড়ি ফেরার উৎসাহ দেখতাম না। শেষ মুসলমান ছাত্রটি স্কুল ছেড়ে না যাওয়া পর্যন্ত নীহারকাকা গম্ভীর মুখে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতেন। ছাব্বিশ ও তেইশ জানুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট হত প্রধানত কংগ্রেসের নেতৃত্বে। নারায়ণগঞ্জের কালীবাজারে কংগ্রেসের একটি অফিস ছিল। দেশভাগের পর সে অফিস আর বড়ো একটা চোখেও পড়ত না। কমিউনিস্ট পার্টি তখন সুভাষ ভক্ত নয়। তা ছাড়া পাকিস্তান হওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই তো সে পার্টি বেআইনি ঘোষিত।

বকুলের পর ধীরে ধীরে এক দুই করে ক্লাসে হিন্দু ছাত্রের সংখ্যা কমা শুরু হয়েছিল। লক্ষ্মীনারায়ণের স্টাফ কোয়াটার্সগুলির একটি দুটি পরিবারও চলে যাচ্ছিল। তারা অবশ্য পাকাপাকি দেশ ছাড়ার কথা প্রকাশ্যে জানায়নি। কেউ কেউ প্রথমে পরিবারের যুবতি মেয়েদের অন্যত্র সরিয়ে দেয়। নিঃসন্তান সুনীল বসু আমাদের খেলার সাথি তার দুই ভাগিনী রমা ও দীপ্তিকে নিজের কাছে রেখেছিলেন। রমা বড়ো, দীপ্তি নেহাতই বালিকা। দুজনকেই কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া প্রতিবেশী অন্য পরিবারগুলিতে যথেষ্ট দুশ্চিন্তার কারণ হয়েছিল। সুনীল বসু ম্যানেজার বলেই নয়, নানা সমস্যায় তার সাহসিক সিদ্ধান্তের কারণে সকলেই তার বুদ্ধি পরামর্শকে গুরুত্ব দিতেন। কানাঘুষোয় জানাজানি হয়ে যাচ্ছিল অনেকেই বিষয়সম্পত্তি হিন্দুস্তানের মুসলমানদের সঙ্গে বিনিময় করে নিচ্ছেন। দেশের বাড়িতে নোয়াদাদু প্রভাতরঞ্জন ধনুর্ভাঙা পণ করেছিলেন জীবন থাকতে পিতৃপুরুষের ভিটে ছাড়বেন না। আমৃত্যু তিনি এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছিলেনও। ঢাকার দুই তাউইমশাই মনোরঞ্জন, জ্ঞানরঞ্জনও অন্তত গোড়াতে দেশছাড়ার কথা ভাবেননি। আমাদের নিজেদের ছোটো ঠাকুরদা (বাবার খুড়োমশাই) সতীশচন্দ্র বরাবর জামশেদপুরবাসী। ক্বচিৎ কদাচিৎ পুজো কাটাতে আসা ছাড়া তিনি দেশের বাড়ি নিয়ে বড়ো একটা মাথা ঘামাতেন না। ডাউরিকাকু বোধ হয় বছর বছর সম্পত্তির আয়ের প্রাপ্য অংশ তাকে জামশেদপুর পাঠিয়ে দিতেন। কোনও সমস্যা দেখা দিলে আমাদের দেশের বাড়ি গিয়ে থাকার পরামর্শ দিয়ে দায়িত্ব সারতেন। তখন যা বয়স আমাদের দু’ভাইয়ের কোনও স্বাধীন সিদ্ধান্তের প্রশ্নই ছিল না। মা ঠাকুরমাও ডাউরিকাকুর বিলিব্যবস্থাতেই আশ্বস্ত ছিলেন। না থেকে উপায়ও ছিল না। পূর্ববঙ্গের সংখ্যালঘু হিন্দুর অনুপাতে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু মুসলমানরা ব্যাপক দেশত্যাগ করেনি। সম্পত্তি বিনিময় প্রধানত শহরবাসী ধনী সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পশ্চিম থেকে অভিবাসিত আরবি সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত উর্দুভাষী ধনী মুসলমানরা পুরের হিন্দু প্রভাবিত সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেনি। পূর্ববঙ্গের আদি মুসলমান ধনকুবের শিল্পপতি আদমজি ইসমাহানিরাও উর্দুভাষী ছিলেন। শুনেছি ঢাকার নবাব বাড়ির মেয়ে পুরুষ সকলেই নিজেদের মধ্যে উর্দুতেই কথা বলতেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরী রহমত আলি প্রথম পাকিস্তানের দাবি তুলেছিলেন ঠিকই (১৯৩৩, ১৯৩৫)। তাহলেও প্রকৃতপক্ষে ১৯০৬ সালে মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠা করে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাই দেশ ভাগের প্রক্রিয়ার সূচনা করেন। এই উর্দুভাষী অভিজাতরা পূর্ববঙ্গের বাংলাভাষী মুসলমানদের খাঁটি মুসলমান বলেই গণ্য করতেন না। পাকিস্তানের জনক কায়েদ-ই-আজম মহম্মদ আলি জিন্না যে একবারের বেশি পূর্ববঙ্গ সফর করেননি সেটা বোধ হয় নিছকই দুর্ঘটনা ছিল না। ১৯৪৮ সালে কায়েদ-ই আজামের ঢাকা সফর তার বাকি জীবনে খুব একটা সুখস্মৃতি হয়নি। তার জনসভায় একদল ছাত্র ‘উর্দু নয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল। জিন্নার নির্দেশে অবশ্য পুলিশ ওই ছাত্রদের জোর করে সভা থেকে বের করে দেয়। তাহলেও এরপর আর কোনোদিন জিন্না পূর্ব পাকিস্তানে যাননি। প্রথম জীবনে সন্দেহাতীত ধর্মনিরপেক্ষ এবং পরবর্তীতে দেশভাগের নায়ক অবশ্য দীর্ঘজীবী হননি। ওই ১৯৪৮ সালেই দুরারোগ্য ক্যানসার রোগে তার মৃত্যু হয়। অনেকে মনে করেন জিন্নার এই কালান্তক রোগের কথা কংগ্রেস নেতারা জানলে হয়ত ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য এত তাড়াহুড়ো করতেন না। কায়েদ-ই-আজমের মৃত্যু পর্যন্ত রয়ে সয়ে দেশভাগ ছাড়াই ইংরেজ শাসনের অবসানের কোনও সূত্র সন্ধান করা যেত। কী হতে পারত তা নিয়ে এখন গবেষণা অর্থহীন। দেশভাগ হয়েছে, এবং হয়েছে পাঞ্জাব ও বাংলার বুক চিরে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হয়েছে দ্বিমুখী অভিবাসন। ঐতিহাসিকরা যাকে বলেছেন ‘গ্রেট একসোডাস’। ১৯৪৬-এর ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’-এর পর থেকেই শুরু গ্রেট একসোডাসের। দফায় দফায় যা এক নতুন শতাব্দী শুরু হয়ে সাত বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও অব্যাহত। তবে বর্তমান ‘একসোডাস’ সম্পূর্ণ একমুখী।

দেশভাগের অব্যবহিত পরেই, ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে, পাঞ্জাবের পশ্চিমের সংখ্যালঘু হিন্দু এবং পূবের সংখ্যালঘু মুসলমানদের লোক বিনিময়ের মাধ্যমে দুই পাঞ্জাবেই সংখ্যালঘু সমস্যার পাকাপাকি সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রে তা হয়নি। ভারত সরকারের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি ও পশ্চিমবঙ্গবাসীদের অসাম্প্রাদায়িক চেতনার কারণে গোড়াতে কিছু অনিশ্চয়তা দেখা দিলেও এপারের বাংলাভাষী মুসলমানরা নিরাপত্তার অভাব কখনও তেমনভাবে বোধ করেনি। পশ্চিম থেকে পূবে অভিবাসনও তাই হয়েছে অকিঞ্চিৎকর। লোক বিনিময়ের দাবিও পশ্চিমবাংলায় তেমন করে ওঠেনি। পুবের ক্ষেত্রে সেকথা কোনও মতেই বলা যায় না। নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর শেখ মুজিবর রহমানের তিন-সাড়ে তিন বছরের প্রশাসন কাল বাদ দিলে দেশভাগের পর দীর্ঘ ছাপান্ন বছরে একটা দিনও একটি রাত্রিও ওপারের সংখ্যালঘুদের শংকাবিহীন কাটেনি। তারা নিজভূমে পরবাসী। দিনের আলোয় হীনমন্যতা, রাতের অন্ধকারে ত্রাস। জন্ম ভিটের প্রতি নাড়ির টানে এবং নিতান্ত নিরুপায় হয়েই ওপার বাংলার হিন্দুদের উদ্বিগ্ন জীবন ও বিনিদ্র রজনী যাপন করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। তবু দেশ ছাড়তে হয়েছে। প্রশাসনের কখনও প্রচ্ছন্ন কখনও স্পষ্ট প্রশ্রয়ে পূর্ববঙ্গে হিন্দু বিতাড়ন চলছেই। আদমসুমারির রিপোর্ট অনুসারে ১৯৫১ সালে পূববাংলার মোট জনসংখ্যার ২৩.১ শতাংশ ছিল হিন্দু। ১৯৬১ সালে কমে ১৯.৬ শতাংশ, ১৯৭৪ সালে ১৪.৬ শতাংশ। ১৯৮১ সালে ১৩.৪ শতাংশ এবং ১৯৯১ সালে ১১.৪ শতাংশ। সর্বশেষ আদম সুমারির হিসেব ১১ কোটি ৩০ লক্ষ বাংলাদেশির মাত্র ৬ শতাংশ হিন্দু। ১৯০১ সালে ছিল ৩৫ শতাংশ।

একথা ঠিক, পূব থেকে পশ্চিমে অভিবাসন ধারাবাহিক হয়নি। কোনও বছর বেশি কোনও বছর কম। সীমাপারের হিন্দুরা এক দফায় সবচেয়ে বেশি দেশত্যাগ করেছে ১৯৫০ সালে। পশ্চিমবঙ্গ পুনর্বাসন কর্মসূচি পর্যালোচনা কমিটি (কমিটি অফ রিভিয়্যু অফ রিহ্যাবিলিটেশন ওয়ার্ক ইন ওয়েস্টবেঙ্গল)-র তথ্য অনুযায়ী এগারো লক্ষ বাহাত্তর হাজার নশ আটাশ। এই প্রায় পৌনে বারো লক্ষের আমিও একজন। বার তারিখ মনে নেই। মাসটা বোধহয় ফেব্রুয়ারি। মার্চও হতে পারে। শীতের আমেজ কমে গেছে। গরম পোশাক ছেড়ে গায়ে সুতির জামা উঠেছে। কদিন আগে ক্লাস সেভেনে উঠেছি। একটু বড়ো বড়ো ভাব। অন্য পাঁচটা দিনের মতোই খেয়েদেয়ে কোম্পানির নৌকায় স্কুলে গেছি। নৌকোর মাঝি মুসলমান। তার ব্যবহারে অন্যদিকের চেয়ে আলাদা কিছু নজরে পড়েনি। নদীর ঘাট এসডিও বাংলার বিপরীতে। সেখানে থেকে স্কুল হাঁটাপথে মিনিট দশ। সে পথেও অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েনি। স্কুলও বসেছিল যথা সময়েই। হঠাৎই বোধ হয় দ্বিতীয় পিরিয়ডের মাঝামাঝি ছুটির ঘণ্টা বেজে উটলো। হাফ ছুটি হলে আগেই জানা থাকে। সেজন্য মানসিক প্রস্তুতও থাকে। অনির্ধারিত কোনও কারণে আগে ছুটি হলে ক্লাসে নোটিশ আসে। আর এসব ক্ষেত্রে ছুটির ঘণ্টা বাজতেই বিশেষত নীচের ক্লাসের ছাত্রদের মধ্যে খুশির কলরব ওঠে। এদিন সেসব কিছু নয়। শুধুই বিস্ময়, শুধুই একে অপরের মুখের দিকে তাকানো। এমনকী মাস্টারমশাইও। যতদূর মনে পড়ে ক্লাসে তখন যিনি ছিলেন সেই মাস্টারমশাই আমাদের কাছেই জানতে চেয়েছিলেন ফার্স্ট পিরিয়ডে কোনও ছুটির নোটিশ এসেছিল কিনা। বাইরে বেরিয়ে দেখা গেল স্কুলের উঠোনের মাঝে হেডমাস্টারমশাই ও মৌলবীসাহেব দাঁড়িয়ে। একে একে শিক্ষকরা এসে জড়ো হচ্ছেন। নীচু গলায় উদ্বিগ্ন মুখে নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। মৌলবীসাহেবের কর্তৃত্বই যেন এদিন একটু বেশি। অল্প সময়ের মধ্যেই মাস্টারমশাইরা ছড়িয়ে পড়ে যে যার ক্লাসের ছাত্রদের এক মুহূর্তও দেরি না করে বাড়ি যেতে নির্দেশ দিলেন। রাস্তায় যেন কেউ কোথাও দাঁড়িয়ে জটলা না করে বারবার সেকথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। এদিকে মৌলবীসাহেব মুসলমান ছাত্রদের সকলকে জুটিয়ে এক জায়াগায় দাঁড় করিয়ে রাখলেন। তাদের বলা হয়েছিল হিন্দু ছাত্ররা সব চলে যাওয়ার পর তাদের ছুটি হবে। উঁচু ক্লাসের কয়েকটি মুসলমান ছাত্র প্রতিবাদ করেছিল। তারা অপেক্ষা করতে রাজি নয়। তবে মৌলবীসাহেবকে তারা অমান্য করেনি।

আমরা যারা কোম্পানি কোয়াটার্সে থাকি মুশকিল হল তাদের। স্কুলে যাতায়াত করি কোম্পানির নৌকোয়। নৌকো সকালে নামিয়ে দিয়ে গেছে। বিকেল চারটেয় ফেরত আসবে। তাই পায়ে হেঁটেই বাড়ি যেতে হবে। খুব একটা দুঃসাধ্য কিছু নয়। আধঘণ্টা কী চল্লিশ মিনিটের পথ। কতবারই ইচ্ছে করেই হেঁটে বাড়ি ফিরেছি। শীতল্যক্ষা নদীর ধার বরাবর গেলে চৈত্রমাসে নদীর চরায় খেত থেকে ক্ষীরই তুলে খাওয়া যায়। জেলে পাড়ার মধ্যে দিয়ে গেলে গাছে ঢিল ছুঁড়ে শীতে টোপাকুল, ফাল্গুন-চৈত্রে কাঁচা আম চুরি করার মজা। সুযোগ পেলে রোদে শুকোতে দেওয়া আমসত্ত্ব, কুল, জলপাই, আমের আচারও। পাকা রাস্তা ধরে গেলে পথে পড়ত বহুদিনের পুরোনো বিশাল এক দুর্গের ভগ্নাবশেষ। ওই দুর্গ নাকি বানিয়েছিলেন বার ভুঁইঞাদের অন্যতম ঈশা খাঁ। এই জনশ্রুতির কোনও ভিত্তি আছে কি না বলতে পারব না। ঝোপ জঙ্গল ভেদ করে দূর্গের ভেতর ঢোকার সাহস কোনোদিন হয়নি। যদিও ইচ্ছে হত খুবই। মফস্বল শহর নারায়ণগঞ্জের নারায়ণ লাইব্রেরিতে কলকাতার দেবসাহিত্য কুটিরের ছোটোদের মাসিক পত্রিকা ‘শুকতারা’ পাওয়া যেত। তা ছাড়া পাওয়া যেত চার আনা সিরিজের মনীষীদের জীবনী, আনন্দমঠ, কৃষ্ণকান্তের উইল, বিষবৃক্ষ প্রভৃতি বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের কিশোর সংস্করণ, সুধীন রাহার কিশোর উপযোগী বাংলা অনুবাদে শেক্সপিয়রের ট্রাজেডি, শেক্সপিয়রের কমেডি, এ টেল অফ টু সিটিজের মতো সব বই। সুভাষচন্দ্র বসুর ‘তরুণের বিদ্রোহ’ও নারায়ণ লাইব্রেরি থেকেই কিনেছিলাম। বোধ হয় দাম ছিল আট আনা। দেশ ছাড়ার সময় কীভাবে কেমন করে যেন এই একখানা বই সঙ্গে চলে এসেছিল। শুকতারা কিন্তু ছিল ওই বয়সে আমার সব থেকে প্রিয় পাঠ্য। প্রতি মাসের নির্দিষ্ট দিনে ঠিক গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম নারায়ণ লাইব্রেরিতে কতক্ষণে কলকাতা থেকে প্রিয় পত্রিকার প্যাকেটটি এসে পৌঁছবে। গোগ্রাসে গিলব হেমেন্দ্রকুমার রায়ের যখের ধন, আবার যখের ধন অথবা অন্য কোনও ডিটেকটিভ কাহিনিতে জয়ন্ত কুমারদের বুদ্ধি ও বীরত্বের কাহিনি। সেইসঙ্গে ডাকসাইটে পুলিশ অফিসার সুন্দরবাবুর হুম হুঙ্কার।

ওই শুকতারাতেই পড়েছিলাম এক ভাঙা পরিত্যক্ত প্রাসাদের কল্পকাহিনি। ঘটনাস্থল মুর্শিদাবাদে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌল্লার প্রাসাদের দরবার কক্ষ। একদল পর্যটক গেছে গঙ্গার পাড়ে নবাবের প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ দেখতে। দরবারে তখন মীরজাফরের বিচার চলছে। সিংহাসনে নবাব সিরাজদৌল্লা আসীন। তার জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বরে দরবার কক্ষ গমগম করছে— জাফর আলি খান আমি আপনার বিচার করব। সিরাজের প্রাসাদ কবে গঙ্গাগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারি, মীরজাফরের কোনও এক বংশধরকে ইংরেজদের উপটৌকন। এসব তথ্য তখন জানা ছিল না। ঈশা খাঁর দুর্গ কথিত ইটের পাঁজার পাশ দিয়ে যেতে যেতে কল্পনা করতাম একবার ভেতরে যেতে পারলে আমাদের চোখের সামনেও কোনও বিচার দৃশ্য ফুটে ওঠা অসম্ভব নয়। সেই বিশাল ভগ্নস্তূপের ঠিক লাগোয়া একটি মাজার ছিল। কোনও পীর ফকিরের হবে। সব সময়ই দেখা যেত চাদর ঢাকা মাজারের পাশে বসে এক ফকির চামর দুলিয়ে মরহুম পীর সাহেবকে বাতাস করছেন। প্রতিবারই ইনি আমাদের দূর্গে ঢোকার চেষ্টা থেকে নিবৃত্ত করতেন। ভাঙা ইঁটের পাঁজার মধ্যে বিষাক্ত সাপ থাকতে পারে। অসতর্ক মুহূর্তে ছোবল দিলেই সর্বনাশ। তা ছাড়া ঝুরঝুরে ইটের দেওয়ালের কোনও অংশ মাথায় ভেঙে পড়বে না তারই নিশ্চয়তা কি। মাজারের সেবাইত সাদা স্মিতমুখ ফকির সাহেব আমাদের দেখলেই কুশল জানতে চাইতেন। দুচার মিনিট গল্পগাছাও করতেন। সেদিন যেন কিছুটা অন্যরকম। ফকিরসাহেব কেমন আছে প্রশ্নের জবাবে কঠিন মুখে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। আমরাও আর কথা বাড়াইনি। সেদিন যেন সবই অন্য রকম। রাস্তায় লোক নেই বললেই চলে। দোকানপাট বন্ধ। বাড়ি ঘরের দরজা জানালাও বন্ধ। আদমজি জুট মিলের গেটের সামনে সব সময়েই একদল শ্রমিককে জটলা করতে দেখা যেত। সেদিনও জটলা ছিল। কিন্তু শ্রমিকরা কথা বলছিলেন অত্যন্ত নিচু গলায়। সবই কেমন যেন একটা ছমছমে ভাব।

মিল কমপাউণ্ডে ঢুকতেই চোখে পড়েছিল প্রায় প্রতিটি বাসাবাড়ির সদরে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা দাঁড়িয়ে আছেন। স্কুল ছুটির সময় থেকেই কেমন যেন মনের মধ্যে একটা চাপা আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল। কিছুটা পরিবেশের প্রভাবেই। মাস্টারমশাইদের তো বটেই, রাস্তায় ক্কচিৎ কদাচিৎ দু’একজন পথচারী যাদের দেখা যাচ্ছিল তাদেরও সকলের মুখ গম্ভীর। সকলেরই চলায় অস্বাভাবিক দ্রুততা। যেন দৌড়ে চললেই ভালো। চলতে চলতে বিপদের আশঙ্কায় এদিক ওদিক সন্ত্রস্ত দৃষ্টি। কিছু হয়েছে কী প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায় না। সকলেরই সংক্ষিপ্ত উপদেশ ‘তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও’; কী হয়েছে জানা গেল বাড়ি পৌঁছে। রায়ট শুরু হয়েছে। রায়ট বা দাঙ্গা শব্দ কোনও অজানা ছিল না। ঢাকা শহরে দাঙ্গা এক অর্থে মরশুমি ব্যাপার ছিল। মহরমের মিছিল বেরলে রায়ট, জন্মাষ্টমীতে রায়ট বাঁধাই ছিল। তাছাড়াও উপলক্ষের অভাব হত না। ঢাকায় দুই তাউইমশাইয়ের বাড়িতে সব সময়ই কয়েকদিনের মতো চাল ডাল ডিম নুন তেল মশলাপাতি মজুত থাকত। দাঙ্গা শুরু হলে কদিন বাজার হাট বন্ধ থাকবে ঠিক কী। কিন্তু ঢাকার দাঙ্গা কখনও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছায়নি। ১৯৫০-এ সেই নারায়গঞ্জেও রায়ট। রায়ট অথবা দাঙ্গা শব্দ অবশ্য ১৯৪৭-এর মধ্যরাত্রির স্বাধীনতার পর থেকে অর্থহীন। সঠিক শব্দবন্ধ হবে সংখ্যালঘু নিধন। ইংরেজিতে ‘প্রোগ্রাম’ অথবা ‘জেনোসাইড’। নারায়ণগঞ্জে অথবা তার আশেপাশের গ্রামগুলিতে সেই অর্থে পঞ্চাশের রায়ট অথবা প্রোগ্রাম কোনোটাই হয়নি। শহরে একজনই হিন্দু ছুরিকাঘাতে মারা গিয়েছিল। তবে ওই একটি ছুরিকাঘাতের ঘটনাই হিন্দু জনগোষ্ঠীর মনোবল ভেঙে দিতে যথেষ্ট ছিল। সংখ্যালঘুদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ শুরু হয়েছিল দেশভাগের একেবারে পরে পরেই। এবারে স্পষ্টতই ভয় দেখানো শুরু হল। আমাদের বাসাবাড়ির বৈঠখানাতেও তথাকথিত শুভার্থী মুসলমান ভদ্রজনেরা চেয়ারে বসে পায়ের ওপর পা তুলে নাচাতে নাচাতে পরামর্শ দিতেন, না না ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। নারায়ণগঞ্জের ঘুম নাকি লজ্জা যখন একবার ভেঙেছে কখন কী হয় বলা যায় না। এ পরামর্শের অর্থ একটাই। বাঁচতে চাও তো দেশ ছাড়ো। সেইসঙ্গে নানা গুজব।

পশ্চিমবাংলার সংখ্যালঘু মুসলমান নেতাদের মধ্যে একমাত্র শহিদ সোরাহবর্দি ছাড়া তেমন নাম করা কেউ দেশত্যাগ করেননি। বিপদে আপদে তারা ধর্মভাইদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। নেতাদের উপস্থিতিই সংখ্যালঘুদের মনে আস্থা জুগিয়েছে। পূর্ববঙ্গে অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। দেশভাগ নিশ্চিত হবেই হিন্দু নেতারা ‘হিন্দুস্থানের’ নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে এসে মন্ত্রিত্বের দৌড়ে জুটে গেছেন। বরিশালের সতীন সেন ও নমশূদ্র সম্প্রদায়ের অবিসম্বাদিত নেতা যোগেন মণ্ডল ব্যতীত নাম করার মতো অন্য কেউ পিতৃপুরুষের ভিটে ছাড়তে দ্বিধা করেননি। পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং বাঙাল ডঃ প্রফুল্ল ঘোষ, সতীন সেনকেও দেশ ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। নেতা অর্থ অবশ্যই কংগ্রেস নেতা। অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি পাকিস্তান শাখার কর্মী ও নেতাদের দেশ না ছাড়তে নির্দেশ দিয়েছিল। বরং ভারত থেকে সাজাদ জাহির, মনসুর হাবিবুল্লাহ, কৃষ্ণবিনোদ রায় প্রমুখ কয়েকজনকে পার্টি সংগঠন মজবুত করতে পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছিল। তখন পশ্চিম পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি বলতে বাস্তবে কিছুই ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দুচার জায়গায় পার্টির কিছু প্রভাব ছিল। এই বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলিতেও হিন্দুরাই ছিল কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান জনভিত্তি। প্রথম সারির নেতারাও সব হিন্দু। সাম্প্রদায়িক বৈরিতা নিয়ন্ত্রণ করার মতো রাজনৈতিক প্রভাব অথবা সংগঠন কোনোটাই কমিউনিস্ট পার্টির ছিল না। তা ছাড়া আটচল্লিশের কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনিও হয়ে যায়। অসহায় প্রতিপন্ন হয়ে সাজাদ জাহির, মনসুর হবিবুল্লাহ, কৃষ্ণবিনোদ রায়রা ভারতে ফিরে আসেন। মণি সিংহ, খোকা রায়, মনোরমা বসুর মতো কয়েকজন ছাড়া পূবের অন্য প্রায় সব হিন্দু কমিউনিস্ট নেতাও পশ্চিমবাংলার চলে আসেন। পূর্ববঙ্গের হিন্দু জনগোষ্ঠী বাস্তবে নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে।

বরিশাল, খুলনা, নোয়াখালি, মৈমনসিং, চাঁদপুর প্রভৃতি বিভিন্ন জেলায় হিন্দুদের গণ বিতাড়ণ শুরু হয়েছিল ১৯৫০-এর জানুয়ারির শেষ দিক থেকেই। তা হলেও মিল কম্পাউন্ডের মধ্যে সেই আঁচ ফেব্রুয়ারির শেষাশেষির আগে অনুভূত হয়নি। সাম্প্রদায়িক হিংসার ছ্যাঁকা লাগতে শুরু করেছিল নারায়ণগঞ্জের রাস্তায় ছুরিকাঘাতের ঘটনার পর। ওদিনের পর থেকে আমাদের স্কুল যাওয়াও বন্ধ। প্রতিদিন কোনও না কোনও রোমহর্ষকর ঘটনার খবর কানে আসে। একদিন শোনা গেল নারায়ণগঞ্জের কোনও এক ধনী হিন্দু পরিবারের লোকেরা সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে পাকা বাড়ির দেওয়ালে একটি শিশুর শব গজাল লোহা দিয়ে গেঁথে রাখা হয়েছে। দেয়ালে রক্তে লেখা হুঁশিয়ারি, অবিলম্বে দেশ না ছাড়লে কী হতে পারে। ওই পরিবারটি ‘হিন্দুস্থান’ পাড়ি দিতে আর একদিনও দেরি করেনি। যাদের সঙ্গতি ছিল কী হয় দেখার জন্য অপেক্ষা না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশ ছাড়তে শুরু করে। ধনীরা ভারতে যাচ্ছিল বিমানে। ট্রেন ও স্টিমারেও নাকি পলায়নপর হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হয়। হানাদাররা যুবতি মেয়েদের ধর্ষণ করে, টাকা পয়সা, সোনাদানা কেড়ে নেয়। কখনও কখনও গোটা ট্রেনের হিন্দু যাত্রীদের নৃশংস খুন করে। একদিন নাকি কলকাতাগামী একটি ট্রেনের কোনও এক বগি আক্রান্ত হতেই পাশের বগির এক হিন্দুযাত্রী চটপট লুঙ্গি পরে নেয়। খুনের ওই বগিতে পৌঁছতেই সে নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দেয়, অন্য হিন্দুদের শনাক্ত করে নিজের জীবন বাঁচায়। বিপদে মানুষ স্বার্থপর হয়। শুধু নিজের কথাই ভাবে। একদিন শোনা গেল ঢাকা বিমানবন্দরও আক্রান্ত হয়েছে। কলকাতা উড়ানের জন্য অপেক্ষাকৃত সব যাত্রীকে কুপিয়ে মেরেছে খুনেরা। ঠিক তার আগের দিনের উড়ানেই আমার দিদিকে কলকাতা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

পরিবেশ এমনই হয়েছিল যে নিজের ছায়া দেখেও হিন্দুরা আঁতকে ওঠে। লক্ষীনারায়ণ কটন মিলসের গোটা কয়েক বন্দুক ছিল। একটি ম্যানেজার সুনীল বসু নিজের হেফাজতেই রাখতেন। যদিও সেটি কাঁধে বেয়ে বেড়াত আমিনুদ্দিন নামে তার ব্যক্তিগত পিয়ন। অন্যগুলি পশ্চিম দারোয়ানদের হাতে থাকত। তাদের পালা করে চব্বিশ ঘণ্টা মিল কম্পাউন্ডের চারধারে টইল দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। রাতের অন্ধকারে গোপনে কারখানার ওয়ার্কশপে পাইপগান, তরোয়াল, ছুরি তৈরি করে প্রতিটি কোয়াটার্সে আত্মরক্ষার জন্য বিতরণ করা হয়। সত্যি সত্যি আক্রমণ হলে এগুলির কটি আত্মরক্ষায় ব্যবহৃত হত অথবা আক্রমণকারীদেরই ব্যবহারে লাগত সে গবেষণার কাজ কী। একদিন মাঝ রাত্রের কাছাকাছি দূরে কোথাও আল্লা-হো-আকবর ধ্বনি শোনা গেল। আর যায় কোথায়। প্রতিটি বাসাবাড়ির মেয়ে মদ্দ জোয়ান সব দে ছুট ম্যানেজারের কোয়াটার্সে। এটি শুধু পাকা বাড়িই নয় প্রায় দেড় মানুষ উঁছু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। যদি এখানে থেকে প্রাণ বাঁচানো যায়। ওয়ার্কশপে তৈরি করা পাইপগান তরোয়াল ছুরি ছেড়ে আসা কোয়ার্টাসগুলিতেই পড়ে ছিল। সঙ্গে নিয়ে আসার কথা কারও মনে আসেনি। সকলেই আতঙ্কে দিশাহারা। মনে আছে ভয়ে আমার সারা শরীর মৃগী রোগীর মতো থরথর করে কাঁপছিল। মা দুহাতে ভাইবোনদের জড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও। ছোটো বোন দুটির কিছু বোঝার মতো বয়স হয়নি। তারা চিৎকার করে কেঁদে চলেছে। ম্যানেজারের কোয়াটার্সে জড়ো হওয়া সবকটি পরিবারেরই এই অবস্থা। দারোয়ানরা বন্দুক নিয়ে সজাগ। ম্যানেজার নিজেও। যদিও তার বন্দুকটি তখনও আমিনুদ্দিনের কাঁধেই। একজন মুসলমানের হেফাজতে বন্দুক রাখা কতটা বিবেচনার হচ্ছে কেউ কেউ বোধ হয় চাপা গলায় আলোচনাও করেছিল। এদিক আল্লা-হো-আকবর চলছেই। শব্দ যেন ক্রমেই এগিয়ে আসছে শীতল্যক্ষা নদীর দিক থেকে। সুনীল বসুর মা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী এবং স্থির বুদ্ধি। তিনিই সকলকে ঘুরে ঘুরে সাহস যোগাচ্ছিলেন। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদেরই ডেকে বলেছিলেন, তোমরাও বন্দেমাতরম ধ্বনি দিয়ে নদীর দিকে এগিয়ে যাও। দারোয়ানরা বন্দুক নিয়ে সঙ্গে যাক। তাই করা হয়েছিল। তবে গলা দিয়ে যে বন্দোমাতরম বেরচ্ছিল সেটা স্থির প্রতিজ্ঞের মাতৃবন্দনা নয়, অসহায়ের আর্তনাদ মনে হচ্ছিল।

সেই রাত্রে শেষ পর্যন্ত মিল কোয়াটার্সগুলিতে কোনও হামলা হাঙ্গামা হয়নি। বোধ হয় রাত্রেই খবর এসেছিল হিন্দুদের ওপর হামলার উদ্দেশ্য নিয়ে মুসলমানরা কোথাও জড়ো হয়নি। আল্লা-হো-আকবর ধ্বনি নিয়ে আগাম জানানও দেয়নি। শীতল্যক্ষা নদীর পূব পারের এক গ্রামে জনৈক সদ্য মৃতকে কবর দিতে নিয়ে যাওয়ার সময় নিকট আত্মীয় বান্ধবরা ঈশ্বরের দোয়া ভিক্ষা করছিল। সন্ত্রাস যখন পরিমণ্ডল ব্যাপ্ত করে তখন এরকম রজ্জুতে সর্পভ্রম আশ্চর্যের নয়। ওই রাত্রের ঘটনার পর আর কোনও সন্দেহই রইল না যে, এভাবে প্রতিদিন মরে বেঁচে থাকা যায় না। যাদের কলকাতা বা ভারতের অন্য কোথাও সাময়িক ওঠার মতো কোনও আত্মীয় পরিজন ছিল তারা আর দেরি না করে চলে যেতে লাগল। সবার আগে সুনীল বসুই তার পরিবারের সকলকে কলকাতা পাঠিয়ে দিলেন বিমানে। দিদিকেও ওই সঙ্গেই পাঠানো হয়েছিল সম্পূর্ণ অনিশ্চিতের মধ্যে। কলকাতায় আত্মীয় বা পরিজন বলতে ছিলেন বাবার অভিন্ন-হৃদয় বন্ধু আইনজীবী বঙ্কিমচন্দ্র দেব। থাকতেন বাগবাজারে হরলাল মিত্র স্ট্রিটে। দিদিকে আপাতত সেখানেই পাঠানো হল। সুনীল বসুর আত্মীয়রাই পৌঁছে দিয়েছিলেন। আমরাও প্রথম বঙ্কিমকাকুর ওখানেই ওঠা ঠিক করেছিলাম। তারপর দেখা যাবে কী হয়। খবর পেয়েছিলাম বরিশাল থেকে মেসোমশাইরা সপরিবারে আগেই কলকাতা চলে গেছেন। উল্টোডাঙায় বাড়ি ভাড়া করে আছেন। বাগবাজার ও উল্টোডাঙার মধ্যে দূরত্ব খুব বেশি নয়। মেসোমশাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে যা হোক কোনও ব্যবস্থা করা যাবে। এইটুকু ভরসা করেই শুরু হয়ে গেল চিরতরে দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি। শুধু পথ খরচের কিছু টাকা ছাড়া সঙ্গে আর কিছু না নেওয়াই ভালো। যদি অন্য কোনও অঘটন নাও ঘটে বর্ডারে কাস্টমস কর্মচারী ও আনসাররা (হোমগার্ডের মতো আধা পুলিশ) সবকিছু কেড়ে নেবে। সুতরাং দুড়দাড় করে কয়েকদিনের মধ্যেই থালা ঘটি বাক্স প্যাঁটরা তৈজসপত্র যা কিছু সব বিক্রি করে দেওয়া শুরু হয়। বিক্রি শব্দটি কতটা প্রযোজন সেটা অবশ্যই বিচার্য। দাম যা পাওয়া যাচ্ছিল তা ভিক্ষার দানের সমান। দিদির ডোয়ারকিনের হারমোনিয়ামের দাম পাওয়া গেছিল মাত্র দশ টাকা। আশ্চর্যের কী। সবাই বেচতে চায়। সকলেরই তাড়া। যারা কেনার তারা সুযোগ ছাড়বে কেন। বেচতে পাগল অনেকেই ছিল। কিন্তু অন্তত ওই সময়ে কিনতে ছাগলের দেখা মিলত না। যারা কেনে তারা যেন নেহাতই দয়াপরবশ হয়েই কেনে। বিপদে সাহায্য করা আর কি।

আমার মা চিরকালই জেদি। আত্মবিশ্বাসও প্রবল। মা স্থির করেছিলেন কিছু জিনিস সঙ্গে নেবেনই। বিদেশ বিভুঁয়ে নতুন সংসার পাততে হবে। গোটা সংসারের সবকিছু নতুন করে কেনা যায় না। গোটা দুই বড়ো ট্রাঙ্ক সঙ্গে নেওয়া হল। তার মধ্যে কিছু শাড়ি জামা কাপড়। প্রয়াত বাবার স্মৃতি ওমেগা হাতঘড়ি, ধূমপানের বার্মিজ পাইপ ও কোনও শিকার প্রিয় জমিদারের দেওয়া উপহার একটি হাতির দাঁতও ট্রাঙ্কে জায়গা পেয়েছিল এবং অবশ্যই সর্পদেবতার নবরূপে বাবার পেতলের হুঁকাদানি-সহ ঠাকুরের আসনের কয়েকটি দেবদেবীর ফ্রেম বাঁধান ফটোও। বলা বাহুল্য নেতাজির সঙ্গে ফরোয়ার্ড ব্লক নারায়াণগঞ্জ মহকুমা কমিটির সম্পাদক আমার পিতৃদেবের গ্রুপ ফটোটি আমরা ফেলে আসিনি। বাবার ব্যবহার করা রুপো বাঁধানো বেতের ছড়িটি নেওয়া হয় বেডিংয়ের মধ্যে। বেডিংটি নেহাত ছোটো হয়নি। সাময়িক কাজ চলে যাওয়ার মতো মশারি বিছানা বালিশ তো ছিলই, কিছু থালা, বাটি, গ্লাসও নেওয়া হয়েছিল। প্রখর বাস্তব বোধ থেকে মা জানতেন সম্পূর্ণ এক অজানা দেশের অজানা পরিবেশে যাবতীয় প্রয়োজনীয় সামগ্রী একসঙ্গে কেনায় কত অসুবিধা। দিদির হারমোনিয়াম বেচে দিলেও মা নিজের সিঙার কোম্পানির হ্যান্ড সুইং মেশিনটি ছেড়ে আসতে রাজি হননি। দেশ ছেড়ে আসার পর অবস্থা কিছুটা সামলে না ওঠা পর্যন্ত কয়েক বছর মা নিজের ও দিদির সায়া সেমিজ ব্লাউজ, বোনদের ফ্রক, প্যান্ট এবং আমার নিমাও (হাফ জামা) এই মেশিনে নিজেই সেলাই করতেন। সব মিলিয়ে লটবহর খুব একটা কম হয়নি। নৌকো, স্টিমার, রেল বদল করে সে সময়ের সন্ত্রাসের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ থেকে কলকাতা প্রায় দুদিনের দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়া খুব সহজ ছিল না। গোটা পথে প্রতি মুহূর্তে উৎকণ্ঠা। কখন কোন দিক থেকে আক্রমণ আসে, আমাদের নিরাপদে পৌঁছে দিতে দাদার সহকর্মী বোধ হয় জনা দুই শুভার্থী যুবক পথসঙ্গী হয়েছিলেন। একজনের নাম কালাচাঁদ নাহা। অন্যজনের নাম মনে নেই। কোনও যোগাযোগও নেই। এমনই হয়। বিপদ কেটে গেলে আর বিপদের বন্ধুকে মনে থাকে না।

নারায়ণগঞ্জ থেকে গোয়ালন্দ স্টিমারে সেই চোখ জুড়ানো দুকুল ছাপান নদী। শীতল্যক্ষা, পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী। এবার সফরে সেদিকে কারও চোখ নেই। সব এক জায়গায় জড়ো হয়ে বসে শুধু সময় মাপা। কখন পথ শেষ হবে। ক্ষিধে, তৃষ্ণারও তেমন বোধ ছিল না। এমনকী আমরা ছোটরাও রাত্রে বারবার জেগে উঠেছি। বড়োরা তো পালা করে জাগছিলেনই। নদীপথের কোনও স্টিমারঘাটায় স্টিমার ভিড়লে সকলেই নতুন কে উঠল কে নামল নজর রাখে। বাসাবাড়ি থেকে দেশের বাড়িতেও যাওয়া আসা ছিল নদীপথে নৌকো স্টিমারেই। তখনও স্টিমার ঘাটাতে স্টিমার ভিড়ত। নতুন যাত্রী উঠত। পুরোনো যাত্রীদের কেউ কেউ নেমে যেত। ছোটো ছোটো ডিঙি নৌকোয় স্টিমারের গায়ে লাগিয়ে ফেরিওয়ালারা রসগোল্লা পানতুয়া ছানার গজা কালোজাম মিষ্টি দই ক্ষীর কলা আনারস সোনালি রঙের মোটা আখ যব স্থানীয় নাম গ্যান্ডারি ফেরি করত। ছোটরা বায়না করতাম সেসব কেনার জন্য। এবার সেসব কিছু নয়। বা ফেরিওয়ালা এলেও আমাদের লক্ষ্য ছিল না। স্টিমার ঘাটে থামলেই তাড়া খাওয়া পশুর মতো হুড়মুড় করে নতুন যাত্রী ওঠে। সকলের সঙ্গেই যার যতটা সম্ভব লটবহর। সকলেই পলায়নপর। নতুন যাত্রীদের মধ্যে হানাদার আছে কি না নজর রাখতে হচ্ছিল। তবে রেলের কামরায় আক্রমণের খবর যেমন ছড়িয়েছিল স্টিমার আক্রান্ত হয়েছে তেমন কোনও কাহিনি কানে আসেনি। তাছাড়া আমরা যখন দেশ ছাড়ি তখন নেহরু-লিয়াকৎ চুক্তি-হেতু দুই বাংলাতেই সংখ্যালঘু খেদানো কিছুটা কমেছিল। তবু সাবধানের মার নেই। প্রতিটি মুহূর্তে প্রতি যাত্রীর ওপর নজর রাখা হচ্ছিল। মুসলমান যাত্রী স্টিমারে খুব বেশি ওঠানামা করছিল না। সে সময় কলকাতামুখী স্টিমার ট্রেনগুলিকে ইভাকুয়ি স্পেশাল বললে যথার্থ হত। তা হলেও দু’চারজন মুসলমান যাত্রী যারা উঠেছিল তাদের সকলকেই সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে। এই মুসলমান যাত্রীদের চোখে কিন্তু স্পষ্ট উপেক্ষা। দু’একজন অযাচিতভাবে সমবেদনা জানিয়েছে। তাদের সেই ‘আহা উহু’ কিন্তু সেই সময় কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতো মনে হয়েছে।

এক সময় নদীপথ শেষ করে গোয়ালন্দ পৌঁছালাম। বাকি পথ ট্রেনে। গোয়ালন্দ মেল না বরিশাল এক্সপ্রেস কি যেন ট্রেনের নাম ছিল। তবে এটা মনে আছে ট্রেনটির রং ছিল সবুজ। দাদা এবং সফর সঙ্গী দুই যুবকের তৎপরতায় রেলের ইন্টার ক্লাসের একটি কামরায় আমরা গোটা একটা লম্বা বেঞ্চের দখল নিতে পেরেছিলাম। তবে গোটা কামরায় ছিল দম বন্ধ করা ভিড়। গোটা রাস্তা এক জায়গায় ঠায় বসে থাকতে হয়েছিল। হাত পা নাড়াচাড়া করারও সাধ্য ছিল না। কি করে কে বাথরুম পায়খানায় গেছি মনে করতে পারি না। নাকি তখনকার পারিপার্শ্বিকতার চাপে এসব প্রাকৃতিক প্রয়োজনগুলি ভুলেই যাওয়া হয়েছিল কে জানে। আমরা পূব বাংলার রেলগাড়ির সঙ্গে তেমন পরিচিত ছিলাম না। আমাদের কোথাও দূরের যাওয়া আসা ছিল জলপথে নৌকো লঞ্চ স্টিমারে। রেলগাড়ির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ছিল বইয়ের পাতায়। বাসাবাড়ির পেছন দিয়ে যে রেললাইন ছিল সে লাইনে গুডস ট্রেন আসত কালে ভদ্রে। আর রেলগাড়ি দেখেছিলাম সিনেমার পর্দায়, যে গাড়ির পেছনে ‘তুফান মেল যায়’ গাইতে গাইতে কাননবালা ছুটে যাচ্ছিলেন। জ্ঞান হবার পর গোয়ালন্দ থেকে শিয়ালদহ ছিল রেল সফরের প্রথম অভিজ্ঞতা। এত দ্রুত কোনও যান চলতে পারে সেটা কল্পনাতেও ছিল না। প্রথম রেল ভ্রমণের উত্তেজনা তারিয়ে উপভোগ করার মানসিকতা স্বাভাবিকভাবেই তখন ছিল না। সর্বক্ষণ দুঃশ্চিন্তা কী হয় কী হয়। ওয়েসাইড কোনও স্টেশনে গাড়ি যতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে যাত্রীদের উৎকণ্ঠার পারদ ক্রমেই ওপরে চড়ে। সিগন্যাল না পেয়ে ট্রেন মাঝপথে কোথাও দাঁড়িয়ে পড়লে গোটা বগি জুড়ে ‘কী হল কী হল’ রব ওঠে। সকলেই জিজ্ঞাসু কে কাকে উত্তর দেবে। এরই মধ্যে কোনও শিশু ককিয়ে কেঁদে উঠলে ভয়ের বাতাবরণ আরও ভারী হয়।

এভাবেই ক্ষণে ক্ষণে মরে বাঁচতে বাঁচতে পূর্ব পাকিস্তানের শেষ স্টেশন দর্শনা এসে যায়। তখনও পাসপোর্ট ভিসা চালু হয়নি। পাকিস্তান সরকারের নোট খুচরো পয়সাও বোধহয় চালু হয়নি। ইংরেজ প্রশাসনের ছাপা ব্রিটিশ ভারতের নোটের ওপরই ‘হুকুমত-এ-পাকিস্তান’ না কী যেন স্ট্যাম্প দিয়ে দেওয়া হয়েছিল সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে। কয়েনের বেলা সে সবও কিছু নয়। তবুও টাকা সঙ্গে কত নেওয়া যাবে তার বোধ হয় একটা উর্ধ্বসীমা ছিল। কাস্টমসের লোকেরা দর্শনা স্টেশনে যাত্রীদের বাক্স-প্যাঁটরা বিছানা তল্লাশি করে দেখত। সঙ্গে থাক আনসার বাহিনী। এই আনসাররা দেহ তল্লাসির নামে যুবতি ও কিশোরীদের সঙ্গে অশালীন ব্যবহারও করত। সোনাদানা বা অন্য দামি জিনিপত্র কেড়ে নেওয়া তো ছিলই। কিছু করার নেই। শুধু কী থাকে, কী যায়, কতক্ষণে পরীক্ষার শেষ হয় তার অপেক্ষা করা। আমাদের সঙ্গে নগদ টাকা অনেক না হলেও অনুমোদিত সীমার বেশিই ছিল। দর্শনা স্টেশনে ট্রেন ঢোকার আগেই সেই টাকা ভাগ ভাগ করে সকলের কাছে আলাদা করে রাখা হয়েছিল। কিছু টাকা আমার পকেটেও দেওয়া হয়। মতলব ব্যক্তি না পারিবারিক উর্ধ্বসীমা এই বিতর্কের সুযোগ নিয়ে যতটা বাঁচিয়ে নেওয়া যায়। আশ্চর্যের বিষয় আমাদের বগিতে তল্লাশি তেমন কিছু হলই না। ওই বাক্সে কী আছে, কত টাকা সঙ্গে নিয়েছেন এমন দুচারটি মামুলি প্রশ্ন করেই কাস্টমস অফিসার ও আনসাররা চলে গেছিলেন। হতে পারে ইন্টার ক্লাসের যাত্রীরা পোশাকআশাকে কিছু ধোপদস্তুর বলে সমীহ করা হয়েছিল। কারও কারও ধারণা হয়েছিল কাস্টমস পার্টির প্রধান সম্ভবত হিন্দু ছিলেন। তাই এই ব্যতিক্রম। তখনও পাকিস্তান প্রশাসনের উচ্চপদেও অনেক হিন্দু ছিলেন। কারণ যাই হোক, তল্লাশিতে এভাবে রেহাই পাওয়ায় আমরা পরম স্বস্তি বোধ করেছিলাম। এক সময় ট্রেনও আবার চলতে শুরু করে পাকিস্তানের সীমানা ছাড়িয়ে। ক্রমেই ভারতের মাটি এগিয়ে আসতে থাকে। ট্রেন দর্শনার প্লাটফর্ম ছাড়তেই যেন জাদুকাঠির ছোঁয়ায় গোটা কামরাটা জেগে ওঠে। শ’দেড়শ মানুষের কোলাহল ক্রমেই উচ্চগ্রামে হতে থাকে। এবার আমরা নো ম্যানস ল্যান্ড দিয়ে চলেছি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই হিন্দুস্তান পৌঁছে যাব। নো ম্যানস ল্যান্ড থেকে অদূরে দেখা যাচ্ছে অশোকচক্র রঞ্জিত ভারতের তেরঙ্গা জাতীয় পতাকা। নিরাপত্তার নিশ্চিত্ত আশ্বাস। ধীরে ধীরে যে ভূমি পেছনে আরও পেছনে সরে যাচ্ছিল একটু আগেও সেটা ছিল আমার দেশ। সেই দেশই পলকে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে হয়ে গেল বিদেশ। অধিকার রইল না দেশ কোথায়-এর জবাবে গ্রাম বাঁকাই, পোস্ট অফিস বাঁকাই, থানা গৌরনদী আর জেলা বরিশাল বলার। দিনটা ২ মে ১৯৫০।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *