আমার দেশ আমার বিদেশ – ১৫

পনেরো

আমরা আমাদের পুরনো বাসাবাড়িতেই রয়ে গেলাম। মিল কমপাউন্ডের পশ্চিম প্রান্তে সারি দিয়ে পূবমুখী স্টাফ কোয়াটার্স। ছবির মতো সাজানো। তিনটি বাদে সবকটি কোয়াটার্সেই সিমেন্ট বাঁধানো মেঝে, আধ মানুষ সমান, পাঁচ ইঞ্চি ইঁটের দেয়াল, বাকিটা বাঁশের বেড়া, টিনের আটচালা ছাউনি, নীচে বেড়ার সিলিং। দেওয়ালের ওপর বসানো জানালাগুলিতে লোহার গারদ, কাঠের পাল্লা। কোয়াটার্সের পেছন দিকে তিনটি শোয়ার ঘর, আমাদের কোয়াটার্সের একটি শোবার ঘরের এক অংশে পার্টিশন দিয়ে মা ঠাকুর ঘর করেছিলেন, বাকি অংশে প্রভঞ্জন কাকা ও কণিকা বউদির শোয়ার খাট, আলনা। শোয়ার ঘরের সামনে আধ কাঠাটাক উঠোন। উঠোনের বাঁহাতে অর্থাৎ উত্তরে পরপর স্টোররুম রান্নাঘর বাথরুম স্যানিটারি পায়খানা। পুব প্রান্তে বৈঠকখানা-কাম-গেস্টরুম। সব মিলিয়ে এক থার্ড ব্র্যাকেটের মতো প্ল্যান। সঙ্গে উঠোন যোগ করলেই পূর্ণ বর্গক্ষেত্র। কোয়াটার্সের বৈঠকখানাটি জ্ঞানরঞ্জন তাউইমশাই এলে দখল নিতেন। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠমাসে খুব গরম পড়লে কোনো কোনোদিন বাবাও এই ঘরে শুতেন। সঙ্গে আমি। বৈঠকখানার দক্ষিণেই কোয়াটার্সে ঢোকার গেট। উঠোনের দক্ষিণ সীমানা থেকেই পরের কোয়াটার্স ছিল। জাতপাতের কারণে ওটিতে যারা থাকতেন তাদের সঙ্গে মেলামেশা বড়ো একটা ছিল না। যদিও বাড়ির বাইরে সমবয়সি অজিতের সঙ্গে খেলাধুলায় নিষেধ ছিল না। তবে কড়া নির্দেশ ছিল অজিতদের বাড়িতে গেলে কোনও কিছু খাওয়া চলবে না। পরে জেনেছিলাম অজিতরা নমশূদ্র। ব্রাহ্মণ কায়স্থ নমশূদ্র প্রভৃতি বিভিন্ন পরিবার কোয়াটার্সগুলিতে পাশাপাশি থাকলেও বর্ণের ভেদাভেদ কঠোর ভাবে পালিত হত। আশ্চর্যজনক মধ্যে খেলার মাঠে কখনও কখনও বাইরে থেকে দুয়েকটি মুসলমান ছেলে আমাদের সঙ্গেই খেলতে আসত। তাদের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি বাঁচিয়ে চলার নির্দেশ ছিল। সে নির্দেশ যে খুব একটা মানা হত না সেটা অভিভাবকরাও জানতেন। কেবল কাঠ কুড়ানি ছাড়া কোনও মুসলমান মেয়েকে মিল কমপাউন্ডে ঢুকতে দেখেনি। অবশ্য দেশ-ভাগের আগে নারায়ণগঞ্জ ছিল ঢাকা জেলার হিন্দু-প্রধান মহকুমা। মধ্যবিত্ত মুসলমানের সংখ্যা ততধিক কম।

মেশামেশি আমাদের আগের কোয়াটার্সের পরিবারটি সঙ্গেও বেশি ছিল না, অবশ্য অন্য কারণে। পরিবারের প্রধান বেণীবাবুকে (দত্ত?) নিয়ে একাধিক রসালো গল্প চালু ছিল। কোম্পানির খরচে মিল কম্পাউন্ডের মধ্যে হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান তিন ধর্মেরই একটি করে উৎসব খুব ধুমধাম করে পালিত হত। হিন্দুদের কালীপুজো মুসলমানদের সবেবরাত ও খ্রিস্টানদের বড়োদিন। কালীপুজো এবং সবেবরাত ছিল সর্বসাধারণের উৎসব। কিন্তু বড়োদিনের উৎসবে কেবল ডিরেক্টর্স বোর্ডের সদস্য,হেড অপিসের স্টাফ ও কারখানার অফিসাররা যোগ দিতেন! হয়ত সে সময়ের শাসককুলের উৎসব বলে তাতে সাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল না। উৎসব বলতে অবশ্য কেক সন্দেশ কমলালেবু কলা একসঙ্গে খাওয়া। পানীয়েরও ব্যবস্থা থাকত কিনা ঠিক জানি না। একবার বড়োদিনে বেণীবাবুর সাধ হল ডিরেক্টরদের জন্য ডাকা থেকে আনানো দামি কেক সন্দেশের দুচারটি নিজের ছেলেমেয়েদেরও খাওয়াবেন। এক বেয়ারার হাতে দুচার পয়সা গুঁজে দিয়ে ব্যবস্থাও হয়েছিল। সমস্যা হল কেক সন্দেশ নেবেন কীভাবে। বেণীবাবু তার পায়ের মোজা জোড়া খুলে বেয়ারাকে দিয়েছিলেন তার মধ্যে কেক সন্দেশ পুরে দেওয়ার জন্য। বেয়ারা তাই করেছিল এবং গল্পটি চাউর করেও দিয়েছিল। তিনি নাকি একবার বাজার থেকে এক ফালি কুমড়ো চুরি করেছিলেন। ঝুলনের সময় পুতুল বানিয়ে এই চুরির ঘটনা দেখানো হয়েছিল, তা নিয়ে কমপাউন্ডে মহা হইচই। বেণীবাবুকে ঘিরে গল্পের শেষ নেই। একবার কজন সহকর্মীকে দুপুরে খেতে নিমন্ত্রণ করেছেন, কথা ছিল মাংস ভাত খাওয়াবেন। অতিথিরা ডাল তরকারি খাওয়ার পর বেণীবাবু মাংস আনতে গিয়ে আর ফেরেন না। পাতে বসা অতিথিরা শুনতে পেলেন বেণীবাবু চিৎকার করতে করতে বাড়ির কুকুরটিকে লাঠিপেটা করছেন আর কুকুরটি ‘আকাশ’ ফাটিয়ে আর্তনাদ করে চলেছে। কুকুরের ‘অপরাধ’ সকলের অলক্ষ্যে মাংসের হাঁড়িতে মুখ দিয়েছে। মহা লজ্জাতে বেণীবাবু অতিথিদের দইও খাওয়াতে পারেননি। অসতর্কতা বশে তার স্ত্রী হাত থেকে দইয়ের হাঁড়িও মাটিতে ফেলে ভেঙেছিলেন। আক্ষরিক অর্থেই সেদিন অতিথিরা ‘চাইড্ডা ডাইলভাত’ দিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করেছিলেন। এসব মুখে মুখে ফেরা কাহিনি কতটা সত্যি আর কতটা রং চড়ানো বলতে পারব না। তবে আমাদের কাছে তিনি তার বাড়ির আমাদেরই বয়েসি চাকরটির অনেক প্রশংসা করতেন। সে আমাদের মতো আদরের নাড়ুগোপাল নয়। জ্বর হলে সাবু বার্লি খেয়ে বিছানায় শুয়ে উঃ আঃ করে না। গা-ভরা জ্বর নিয়ে কাঁচালঙ্কা পান্তাভাত খেয়ে রুটিন মতো দিনের সব কাজ করে। প্রশংসায় বিগলিত ছেলেটিও পান্তাভাতের সঙ্গে কাঁচালঙ্কা কচকচিয়ে চিবিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিত সত্যি সে বাহাদুর। যদিও তখন লঙ্কার ঝালে তার চোখে জল এসে গেছে। জ্বরে মুখ লাল।

বেণীবাবুরা আমাদের আগেই দেশ ছেড়েছিল। স্পষ্টই মনে আছে যাওয়ার দিন জ্যৈষ্ঠের ভর দুপুরে তার ছেলেমেয়েদের গায়ে দামি সার্জের কোট ছিল। সেটা সন ১৯৫০। পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘু বিতাড়নের উদ্দেশ্যে পূর্বপাকিস্তানের নানা জায়গায় ব্যাপক গণহত্যা শুরু হয়। নারায়ণগঞ্জে তেমন কোনও বড়ো ঘটনা না ঘটলেও হিন্দুরা ঝুঁকি না নিয়ে দলে দলে ঘুরতে শুরু করেন। তাদের বিষয় সম্পত্তি জলের দামে বিক্রি হতে থাকে। বেণীবাবু এক পোশাকের দোকান থেকে প্রায় বিনা পয়সায় সকলের জন্য সার্জের কোর্ট শাল ইত্যাদি শীতের পোশাক কিনেছিলেন। বাক্সভর্তি করে ওগুলি নিয়ে গেলে আনসার বাহিনি কেড়ে নিতে পারে আশঙ্কায় গরমের মধ্যেই ছেলে মেয়েদের গায়ে পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এসব অবশ্য পরের কাহিনি।

আমরা আমাদের বাসাবাড়িতে ভালোই ছিলাম। এমনকী দেশভাগের পরেও বছর তিনেক। কোয়াটার্সের উঠোনে গাঁদা সূর্যমুখী গন্ধরাজ জিনিয়া দোপাটি যে ঋতুর যে ফুল তা ফুল ফোটাই। ঘরের চালে পুঁই লাউ কুমড়ো সাদা সবুজ সিমের লতা তুলে দেওয়া হয়। উঠোনে ফুলের সঙ্গে ধবধবে সাদা সাহেব ডাঁটা গোলাপি রঙের মেম ডাঁটা ঢেঁড়স বেগুনও ফলে। বৈঠকখানার লাগোয়া উত্তর দিকে আগে থেকেই সাদা হয়ে মনে হত কোনও ফুল গাছ। এরকম পাকা পেয়ারায় ঢাকা গাছ আর দেখেছিলাম এলাহাবাদে এক পার্কে। পেয়ারা গাছের পাশেই আমাদের সেই কিংবদন্তি মানকচুর ঝাড় যার উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। উঠোনের দক্ষিণ সীমান্তে গোটা তিনেক কাঁঠাল গাছ ছিল। আমরা যেবার চলে এলাম সেবারই প্রথম কাঁঠাল গাছে মুচি এল। কাঁঠাল খাওয়া হয়নি। বাগান পরিচর্চা করত গণপত নামে এক পশ্চিমা চাকর। আসলে সে ছিল কারখানার মজুর। আমাদের বাসাবাড়ির স্টোররুমে। থাকা আর খাওয়ার পরিবর্তে কয়লা ভাঙা বাসন মাজা কাপড় কাচার মতো ভারী কাজগুলি সে করে দিত। গণপতের খাওয়া ছিল দেখার মতো। মা তার থালায় পাহাড় প্রমাণ ভাত সাজিয়ে দিতেন। তার পরেও যতবার জিজ্ঞেস করতেন আর ভাত লাগবে কিনা ততবারই সে জবাব দিত, দিজিয়ে চাট্টি। সঙ্গে তরকারির ব্যাপারে তার মাথা ব্যথা ছিল না। দিলে ভালো। না দিলে শুধু নুন দিয়েই সে সাদা ভাত খেয়ে নিতে পারত। গণপতকে আমি খুবই ভয় পেতাম। একটিই মাত্র কারণ। আমার দুবলা পাতলা চেহারা তন্দুরস্ত করে দেওয়ার জন্য রোজ সে আমাকে পোয়াটাক সরষের তেল মালিশ করবে। তার মালিশের ধাক্কায় আমার হাড়গোড় ভেঙে চুরমার হওয়ার দশা। গণপত চলে যাওয়ার পর নতুন যে বহাল হয়েছিল তার নাম মহেন্দ্র।

জাতিতে পরামাণিক মহেন্দ্র এক চিজ বিশেষ। ‘ভদ্রলোক’ হওয়ার জন্য সে পারিবারিক পেশায় যায়নি। কারখানায় মজদুর হয়ে ঢুকেছে। সঙ্গে পার্টটাইম গৃহ পরিচারকের কাজ। এতে খাওয়া থাকার সমস্যা মেটে। কথায় বলে নরের মধ্যে নাপিত ধূর্ত। মহেন্দ্র একটু বেশিই ধূর্ত। রোজগারের তার নানা ফন্দিফিকির ছিল। কোনও কিছু কিনতে দিলে তা থেকে দুচার পয়সা রোজগার করবেই। তা বলে চুরি করে তেমন অভিযোগও করা যাবে না। কোনও না কোনও ওজর খাড়া করে প্রতি ক্ষেত্রেই সে বিক্রেতাকে দাম কম নিতে বাধ্য করত। আমাকে চুল ছাঁটতে নিয়ে গেল। রাস্তার ধারে ইঁটের ওপর বসে চুল ছাঁটলে মজুরি দুআনা। সেলুনে তিনআনা। মহেন্দ্র চায় আমি ইঁটে বসে চুল ছাঁটাই। আমি রাজি না হওয়ায় ব্যাজার মুখে সেলুনে ঢুকে সে প্রথমেই পামাণিককে সতর্ক করে দেয় ‘বাবুর পোলার’ গায়ে যেন একটাও চুল না পড়ে। ভালো করে ঢেকেঢুকে যত সাবধানেই ছাঁটা হোক গায়ে একটাও চুল পড়বে না এমন অবান্তর কথা কে কবে শুনেছে। তাহলেও ‘গায়ে কেন চুল পড়ল’ এই অজুহাতেই মহেন্দ্র দুআনা দিয়েই সেলুন থেকে গটমট করে বেরিয়ে আসে। অবশ্যই তার আগে না হোক মিনিট পাঁচ দশ তারস্বরে পরামাণিকের সঙ্গে বচসার পর। ‘জরিমানার’ এক আনা যে মহেন্দ্রের পকেটেই যাবে সে আর বলার কি আছে। মহেন্দ্র মাথায় জরজরিয়ে সরষের তেল মাখে। অনেক সময় স্নানের পরেও দুই জুলপি বরাবর তেল গড়িয়ে নামে। এজন্য আড়ালে আবডালে সবাই হাসাহাসি করে। মহেন্দ্র তা জানে কিন্তু মাথা ঘামায় না। স্নানের পর সে অনেক্ষকণ ধরে আয়না বাগিয়ে টেরি কেটে চুল আঁচড়ায়। ঘটিতে গরম জল ভর্তি করে সেই ঘটি দিয়ে ঘসে জামা ইস্ত্রি করে পরে। লোকে তাকে ঠাট্টা করে বাবু মহেন্দ্র ডাকে। সম্ভবত গ্রামের বাড়িতে নিজের বাবু পরিচয়ই দিয়েছিল। তার বাবাও মিল গেটে দারোয়ানদের কাছে বাবু ‘মাইন্দর’ শীলের বাড়ির সন্ধান করেন, তার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, বাবু কোয়াটার্সে থাকে। অনেক জেরা জিজ্ঞাসাবাদের পর বোঝা যায় বৃদ্ধ কোথায় কার বাড়িতে যেতে চান। বাবা মার যাওয়ার প্রবেশ কয়েক বছর আমাদের সংসারে সর্বক্ষণের পরিচারক রাখার সঙ্গতি ছিল না। মহেন্দ্র অতএব অন্য কোয়াটার্সে নিজের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে নেয়। এবং পথে ঘাটে দেখা হলে সে আমাদের উপেক্ষাই করে। একদিন মিল কম্পাউন্ডের পুকুরে ছিপ ফেলে বসে আছি। এই পুকুরে নিয়মিত মাছ ছাড়া হত। বছরে একবার কি দুবার জেলে নামিয়ে মাছ ধরা হত। সে মাছের ভাগ সবকটি কোয়াটার্সে যেত। এছাড়া অন্য সময়ে মাছ ধরা নিষিদ্ধ। এই পুকুরেই ছোটোদের সাঁতার প্রতিযোগিতা হত। আমি বোধ হয় এখানেই সাঁতার শিখেছিলাম। মাছ ধরায় খুব একটা উৎসাহ ছিল তা নয়। ধরতে পারতামও না। তবুও কি জানি কেন একটা ছিপ জোগাড় করে সেদিন পুকুর ঘাটে বসেছিলাম। আর কি আশ্চর্য বড়শিতে একটা গেঁথেও ছিল। আধসের টাক একটা মৃগেল। কিন্তু ওইটুকুন মাছেরই জলে প্রচণ্ড শক্তি। হলফ করে বলতে পারি কিছুতেই ওই মাছ আমি খেলিয়ে তুলতে পারতাম না। তখন ভর দুপুর। পুকুর ঘাটে কারও থাকার কথা নয়। কিন্তু কোথা থেকে মহেন্দ্রর আকস্মিক আবির্ভাব। এবং প্রথমেই নিষিদ্ধ পুকুরে ছিপ ফেলার অপরাধে অনর্গল হম্বিতম্বি। আমার হাত থেকে ছিপ কেড়ে নিয়ে সেই ওই মাছকে এক ঝটকায় ডাঙায় তুলে নতুন মনিব বাড়িতে ছুট। আমার দিকে পিছন ফিরে আর তাকিয়েও দেখেনি। আমার খুব একটা আপশোস হয়েছিল বলব না। বরং স্বস্তি পেয়েছিলাম এই ভেবে যে, সংরক্ষিত পুকুরে ছিপ ফেলার অপরাধের কৈফিয়ত দিতে হবে না। মহেন্দ্র তার নতুন মনিব বাড়িতে কি বাহাদুরি নিয়েছিল জানার আগ্রহ হয়নি।

ষোলো

 এই পুকুর ধরেই গোটা মিল কম্পাউন্ডের এক আভাস দেওয়া যেতে পারে। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে এক লাইনে কোয়াটার্সগুলির তিনটি বাদে বাকি সবকটিই এক প্যাটার্নের। একেবারে উত্তর প্রান্তে পাশাপাশি ম্যানেজার সুশীল বসু ও চিফ ইঞ্জিনিয়ার নলিনী গুহর দুটি কোয়াটার্স একতলা পাকাবাড়ি। মাঝামাঝি আর একটি পাকাবাড়ি ছিল গেস্টহাউস। ম্যানেজিং এজেন্সির কর্তাব্যক্তিরা এলে থাকতেন। না হলে খালিই পড়ে থাকত। আমরা ছোটরা লুকোচুরি খেলতাম। বোধ হয় দাদা দিদি স্থানীয়দের অতি সাহসী কেউ কেউ গোপন অভিসারের নিরাপদ জায়গা হিসেবেও ব্যবহার করত। এখানে দেয়ালে কাঠকয়লা দিয়ে কোয়াটার্স তুতো এক দাদা ও এক দিদিকে জড়িয়ে কিছু অশালীন লেখা পড়ে আমরা যৌনজীবনের প্রথম পাঠ নিয়েছিলাম। এই লেখা বড়োদের নজরেও এসেছিল এবং স্বয়ং ম্যানেজারবাবু দাঁড়িয়ে থেকে দেয়ালের সমস্ত লেখা মুছিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা চলে আসার আগেই চিফ ইঞ্জিনিয়ারের কোয়াটার্সের উত্তরে আরও কয়েকটি ছোটো ছোটো কোয়াটার্স এবং ম্যানেজারের কোয়াটার্সের দক্ষিণে একটি চার ফ্ল্যাটের দোতলা বাড়ি তৈরি হয়েছিল। এগুলি জুনিয়র অফিসারদের মধ্যে বিলি করা হয়। এরই একটিতে প্রভঞ্জনকাকা তার নতুন সংসার পেতেছিলেন। আমাদের লাইনে পরপর থাকতেন ক্ষেত্র ঘোষ, প্রসেনজিৎ মিত্র, সুশীল মজুমদার, প্রফুল্ল মিত্র, ডাঃ অনিল সেনের মতো সিনিয়র অফিসাররা। এরা কেউ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, কেউ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, উইভিং মাস্টার, স্পিনিং মাস্টার, ডাইং মাস্টারের মতো উঁচু পদে কাজ করতেন। ঠিক তেমন স্পষ্ট না হলেও মেলামেশার ব্যাপারে সিনিয়ার ও জুনিয়র অফিসারদের পরিবারগুলির মধ্যে একটা সূক্ষ্ম বিভাজন রেখা ছিল। তবে সেই রেখাটি শিশু কিশোর স্তর পর্যন্ত বিস্তার করেনি। আমরা ছোটরা খেলার সময় কে বড়ো অফিসারের ছেলে বা মেয়ে আর কে ছোট’র জানতামই না। খেলা বলতে চোরপুলিশ, গোল্লাছুট, খো-খো, কবাডি, আর একটু বড়ো হয়ে ফুটবল। ক্রিকেটের বোধহয় নামও শুনিনি। খেলতাম ডাংগুলি এবং মার্বেলও। একা একা খেলার মধ্যে গুলতি এবং চাকা ঘোরানো। কড়ে আঙুল কড়ে আঙুলে জড়িয়ে আড়ি ও বুড়ো আঙুলে বুড়ো আঙুল ঠেকিয়ে ভাব লেগেই থাকত। দল পাকিয়ে কাউকে আড়ি করে এক ঘরে করে দেওয়া হত যখন তখন আর তেমন হলে একা একা গুলতি ছোঁড়া আর চাকা ঘোরানো ছাড়া উপায় কি। নেট টাঙিয়ে দল বেঁধে রিং খেলাও হত।

একা অথবা দল বেঁধে যে খেলাই হোক স্কুল থেকে ফিরে সন্ধ্যা নামার আগে এক-দেড় বড়জোর দুঘণ্টার বেশি নয়। কারখানার ছটার বাঁশি বাজতেই যে যার ঘরে ফেরা বাধ্যতামূলক ছিল। ততক্ষণে প্রতিটি বাসাবাড়িতেই শাঁখ বেজে উঠেছে। শাঁখের আওয়াজ ভেসে আসছে কম্পাউন্ডের লাগোয়া গ্রামের বাড়িগুলি থেকেও। চটপট হাতমুখ ধুয়ে যে যার বই খুলে বসে পড়তাম। আমাদের ছোটোবেলায় চিৎকার করে পড়া মুখস্থ করাই রেওয়াজ ছিল। ভিন্ন ভিন্ন বাড়িতে ভিন্ন ভিন্ন ক্লাসের বই খোলা। কেউ উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারতের নদীগুলির নাম মুখস্থ করছে তো কেউ বাবরের সিংহ বা বাঘ অর্থ জেনে নিচ্ছে। সঙ্গে মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতার ভারত বিজয়ের ইতিহাস। একজন যদি ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘উই আর সেভেন’ মুখস্থ করে তো অপর বালক বিলের (স্বামী বিবেকানন্দ) ভাঙা ইংরেজিতে সাহেবের সঙ্গে কথা বলার দুঃসাহসিক কাহিনি পড়ে রোমাঞ্চিত হয়। এরই মধ্যে মেয়েরা হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে সুরের সাধনায় বসে যেত। গলার সুর থাকুক আর নাই থাকুক সেদিনের মেয়েদের শ্যামা সংগীত রাগপ্রধান আধুনিক মিলিয়ে খান তিনেক গান মকশো করতেই হত। মেয়ে দেখতে আসা পাত্রপক্ষের আবশ্যিক প্রশ্নগুলির অন্যতম প্রধান ছিল পাত্রী গান জানে কি না। ‘বল রে জবা বল কোনও সাধনায় পেলি রে তুই শ্যামা মায়ের চরণতল’ শুনিয়ে দিয়ে পাত্রীও জীবনের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সাধনা করত। পাত্রপক্ষীয়দের মধ্যে স্বয়ং পাত্র উপস্থিত থাকলে পাত্রীর গলা থেকে ব্যাকুল জিজ্ঞাসা ঝরে পড়ত, তুমি কি এখন দেখিছ স্বপন আমারে, আমারে, আমারে? তখন পাত্রীর পছন্দ অপছন্দের প্রশ্ন ছিল না। পাত্র হলেই হল, সোনার আংটির আবার সোজা বাঁকা কি। তখনও গানের স্কুল হয়নি। গানের মাস্টার ছিলেন। বাড়ি বাড়ি ঘুরে মেয়েদের গান শেখাতেন দুপাঁচ টাকা মাস বেতনে। নেহাত ধনীর দুলাল না হলে পড়ার মাস্টার রাখা হত না। আমাদের মিল কম্পাউন্ডে কারওরই ছিল না। সাধারণত বাড়িতে বাবা দাদারাই পড়া দেখিয়ে দিতেন। ভালো ছাত্র বলে গণ্যদের কাছে গিয়েও নীচের ক্লাসের ছাত্ররা পড়া দেখে নিত। আমার দাদার কাছে অনেক ছাত্রছাত্রীকে আসতে দেখেছি। পড়া ছেড়ে দিয়ে চাকরিতে ঢোকার পরেও।

আমরা স্কুলে যেতাম মাইল তিনেক দূরে মহকুমা শহর নারায়ণগঞ্জে। শহরে ছেলেদের তিনটি এবং মেয়েদের একটি স্কুল ছিল। মেয়েদের ও ছেলেদের একটি স্কুল সরকারি। একটি কলেজও ছিল। বাবু কোয়াটার্সের ছেলেদের মধ্যে আমরা কেউ সরকারি স্কুলে ভর্তি হইনি। এর পেছনে স্বদেশি আন্দোলনের কোনও ভূমিকা ছিল কিনা বলতে পারব না। তবে মিল কম্পা উন্ডে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী দুধরনের রাজনীতিরই প্রভাব ছিল। আমরা যে স্কুলে পড়তাম সেটির নাম ছিল বার অ্যাকাডেমি। স্থানীয় উচ্চারণে ‘ব্র্যাকাডেমি’। অপর বেসরকারি স্কুলটির নাম ছিল আই টি কলেজিয়েট স্কুল। আই.টি কিসের আদ্যক্ষর কোনোদিন জানা হয়নি। প্রধানত মুসলমান ছাত্ররা এই স্কুলে পড়ত। আমরা এই স্কুলে সম্পর্কে ছড়া কাটতাম। আই টি কলেজ হ্যাভ নো নলেজ, মাংকি টিচার ডাংকি বয়, ইস্কুলটি তো ভালো নয়’ ওই স্কুলের ছেলেরাও হয়ত আমাদের সম্পর্কে কোনও ছড়া বেঁধেছিল। পরস্পরকে হেয় করার এই খেলা সুপ্ত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কারণে হওয়া অসম্ভব নয়। শীতল্যক্ষা নদীর পারে লাইন ধরে পরপর চারটি কাপড়ের কলের স্টাফ কোয়াটার্সের ছেলেমেয়েরাই নারায়ণগঞ্জে স্কুলে যেতাম নৌকায়। কোম্পানি থেকেই নিজেদের স্টাফদের ছেলেমেয়েদের জন্য নৌকোর ব্যবস্থা। আমরা যে নৌকায় যেতাম সেটি ছইওয়ালা সাধারণ কান্ট্রিবোট বা দেশি নৌকো। পাশের চিত্তরঞ্জন কন্টন মিলসের নৌকোটির কৌলিন্য অনেক বেশি। ছইয়েরা বদলে কাঠের দরজাওয়ালা ঘরের মতো। ভেতরে দু সারি টানা লম্বা কাঠের বেঞ্চ। নৌকোটি সবুজ রঙ করা ছিল বলে গ্রিনবোট বলা হত। এ কারণে নৌকো নিয়ে আমাদের মধ্যে কিছুটা হীনমন্যতা ছিল না বলা যাবে না। লক্ষ্মীনারায়ণ কন্টন মিলস থেকে নারায়ণগঞ্জের দূরত্ব অন্য মিলগুলির চেয়ে অনেক কম। এজন্য মাঝেমাঝে আমরা কয়েকজন স্কুল থেকে ফেরার সময় নদীর পার ধরে অথবা জেলেপাড়ার মধ্য দিয়ে হেঁটেই ফিরতাম। বিনা মতলবে অবশ্য নয়। চৈত্রমাসে নদীর জল সরে যাওয়ার পর বেলে মাটিতে ক্ষীরইয়ের চাষ হত। খেত থেকে দু চারটি তুলে মুখে পুরলে কেউ বড়ো একটা কিছু বলত না। তবে মাঘ ফাল্গুনে জেলেপাড়ার টোপাকুল গাছে ঢিল ছুঁড়ে অনেকদিনই তাড়া খেতে হয়েছে। আমাকে কয়েকদিন শাস্তি হিসেবে হেঁটে স্কুলে যেতে হয়েছিল। স্টাফ কোয়াটার্সের ছেলেমেয়েরা মিলে সরস্বতী পুজো করা হত। চাঁদা তুলে কিংবা কোম্পানির অনুদানে মনে নেই। পুজোর জন্য একটি কমিটি গঠন করা হত বড়ো ছেলেদের নিয়ে। স্কুলে যাওয়ার পথে নৌকোতেই এই কমিটিতে কে থাকবে কে সম্পাদক হবে ঠিক হত। সেবার দাবি তুলেছিলাম আমরা ছোটরাই সংখ্যায় বেশি। কমিটিতে আমরা কেউ থাকব না এটা মানা যায় না। শুধু সদস্য নয় একজন সহসম্পাদকও ছোটোদের মধ্য থেকে চাই। এবং আমিই সেই সহসম্পাদক নিযুক্ত হয়েছিলাম। আমার এই বিদ্রোহের সংবাদ মিল ম্যানেজারের কানে পৌঁছোতে দেরি হয়নি। অচিরাৎ হুকুম হয়েছিল কমিটি ভেঙে দেওয়ার এবং আমার নৌকোয় স্কুলে যাওয়াও নিষিদ্ধ হয়েছিল। আমার মা এই শাস্তি অন্যায্য মনে করেছিলেন এবং নিজের হাতে মূর্তি গড়ে বাসাবাড়িতে সরস্বতী পুজোর প্রচলন করেছিলেন। এখনও সেই পুজো হয়। যদিও কয়েকদিন পরে আমার শাস্তি তুলে নেওয়া হয়েছিল।

আমার স্কুলের প্রথম দিনের অভিজ্ঞতাও খুব সুখস্মৃতি নয়। ১৯৪০-এর দশকে স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য ইঁদুর দৌড়ের ব্যাপার ছিল না। আপার নার্সারি, লোয়ার নার্সারি, কেজি এসব কিছু শুনিওনি। স্কুলগুলিতে ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত ছিল। দু-একটি স্কুলে বোধ হয় ইনফ্যান্ট বা শিশুশ্রেণিও থাকতো। তখনও টেন নাইন এইট যথাক্রমে ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস, থার্ড ক্লাস বলা সম্পূর্ণ উঠে যায়নি। দূরে হওয়ায় আমরা স্টাফ কোয়াটার্সের ছেলেমেয়েরা অন্তত ক্লাস ফোরের আগে স্কুলে ভর্তি হতাম না। অবশ্য আমরা চলে আসার দু-এক বছর আগে মিল কম্পাউন্ডের মধ্যেই একটি প্রাইমারি স্কুল খোলা হয়েছিল। সম্ভবত মেয়েদের কথা ভেবেই। ১৯৪৭ সালে আমি বার অ্যাকাডেমিতে ক্লাস ফোরে ভর্তি হয়েছিলাম। এই স্কুল থেকেই দাদা ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেছিলেন। আমার সঙ্গে একই বছরে প্রভঞ্জন কাকার এক ভাই নীহার কাকা ওই স্কুলেই থার্ড ক্লাসে ভর্তি হয়েছিল। তার সঙ্গেই প্রথম দিকে স্কুলে যাতায়াত করতাম। সেই কারণে নীচের ক্লাস আগে ছুটি হয়ে গেলেও গোটা এক পিরিয়ড থার্ড ক্লাসের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। ওই সময় থার্ড ক্লাস থেকেই ছেলেরা রীতিমতো সাবালক। নীহার কাকাকে হিংসে হত এজন্য যে তাকে ছোটো বাড়ি যেতে শিক্ষকের অনুমতি নিতে হয় না। ‘সার প্রস্রাব করতে যাই, বলে সটান ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেত। কল্পনা করতাম থার্ড ক্লাসে উঠলে আমারও এই অধিকার জন্মাবে। অবশ্য থার্ড ক্লাসের রেওয়াজ নেই। ক্লাস এইট নাইন টেন হয়ে গেছে। চলেও এসেছি কলকাতায়। কল্পনা করতাম ক্লাস টেনে উঠলে ধুতি পাঞ্জাবি পরে বিদ্যাসাগরী চটি পায়ে স্কুলে যাব। নীচের ক্লাসে আমরা বেশিরভাগ ছেলেই হাফ প্যান্ট হাফ শার্ট পরে খালি পায়ে সাত পিরিয়ডের এক বোঝা বইখাতা কাঁধে নিয়ে স্কুলে যেতাম। আমাদের সময় স্কুল ব্যাগের প্রচলন হয়নি। কখনও কখনও দড়ি দিয়ে বইখাতা বেঁধে নিতে হত। দাদাই আমাকে স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে গেছিলেন। ভালো ছাত্র হিসেবে তার সুনাম ছিল। অখণ্ড ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে ১৯৪৮ সালে তীব্র কাগজের সংকট দেখা দিয়েছিল। মনে আছে স্কুল থেকে কুপন নিয়ে বিশেষ কয়েকটি দোকান থেকে সোওয়া পাঁচ আনা দিস্তায় কাগজ কিনতাম। সে সময় আবার এক পয়সাও অমিল। দিতে হত সাড়ে চার আনা। পরিবর্তে এক দিস্তা কাগজের সঙ্গে একটি চকখড়ি মিলত। পয়সা সাশ্রয় করতে আমি একই কাগজে দুবার লিখতাম। প্রথমে কাঠ পেনসিল দিয়ে, তারপর আগের লেখার ওপরেই আবার কালি দিয়ে। বাড়িতে অঙ্ক কষতাম স্লেটে। আমাদের সময় স্লেট উঠে যায়নি। হাতেখড়ির পর প্রথম হাতের লেখাও মকশো করেছি তালপাতায়। তখন ইংরেজি বাংলা অঙ্কের ভিন্ন ধরনের খাতার কথা কল্পনা করতে পারতাম না। কাগজের অনটনের জন্য সে বছর স্কুলে ইংরেজি বাংলা অঙ্ক বাদ দিয়ে অন্য বিষয়গুলির মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। ইতিহাসের সবকটি প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর দিতে পারায় পরীক্ষক মাস্টারমশাই জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুই সুকুমারের ভাই নি রে? মাস্টারমশাই নিশ্চিত ছিলেন, যে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে এবং যার ঘোষচৌধুরি পদবী সে সুকুমারের ভাই ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে না।

সেই সুকুমার যখন হাত ধরে নিয়ে গেছে তখন স্কুলে ভর্তি হতে কোনও অসুবিধাই হয়নি। যতদূর মনে পড়ে এক নাম ছাড়া কোনও প্রশ্নও করা হয়নি। সুকুমারের সুবাদে হাফ ফ্রিও হয়েছিল। তখন টিউশন ফি ছিল মাসে দুটাকা। মাসের প্রথম দিনেই ক্লাস টিচার এক এক করে নাম ডেকে টিউশন ফি আদায় করতেন। রসিদও তিনিই দিতেন। কেউ দিতে না পারলে দিন প্রতি এক আনা জরিমানা দিতে হত। স্কুলে না গেলে অভিভাবকদের কাছ থেকে ছুটির দরখাস্ত নিয়ে যেতেই হবে। না নিলে জরিমানা ছিল এক টাকা। এভাবেই সেকালে বেসরকারি স্কুলের অর্থের বাড়তি সংস্থান হত। আমার অবশ্য কোনও কারণেই কোনোদিন জরিমানা হয়নি। তবে শাস্তি হয়েছিল প্রথম দিনই। বসেছিলাম ফার্স্ট বেঞ্চেই। স্কুল বসার ঘণ্টা বাজতেই ক্লাস টিচার নাম ডাকার খাতা, চক ডাস্টার এবং ইয়া লম্বা লিকলিকে এক বেত নিয়ে ক্লাসে ঢুকলেন। সেকালে বছরের গোড়ায় স্কুলে যে পঠন-পাঠন সামগ্রী কেনা হত তার মধ্যে ব্ল্যাকবোর্ড চক ডাস্টার গ্লোব মানচিত্র ইত্যাদির সঙ্গে শিক্ষকমশাইদের মাথা গুনে লিকলিকে বেতও থাকত। শিক্ষকরা যেমন ছাত্রদের সন্তান গণ্য করতেন তেমনি ‘মূর্খস্য লাঠ্যোষধি’ প্রয়োগ নীতিতেও বিশ্বাসী ছিলেন। শিক্ষক ছাত্রকে পিটিয়ে ছালচামড়া ছাড়িয়ে নিলেও কোনও অভিভাবক স্কুলে গিয়ে অভিযোগ করেছেন বলে শুনিনি। শাস্তি পেয়ে ছাত্রও বাড়ি ফিরে অভিভাবকের কাছে নালিশ করত না। তারা জানত অভিভাবকের কানে উঠলে দ্বিতীয়বার শাস্তির আশঙ্কা ছিল। কারও শাস্তি হলে আমরা সহপাঠীরা ‘বাড়ি গিয়া কইয়া দিমু’ ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করতাম। সেদিন ক্লাস টিচার ক্লাসে ঢুকে সমস্ত ছাত্রের মুখের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সোজা আমার সামনে এসে সপাং বেত চালাতে শুরু করেন। অন্য ছাত্ররা তখন স্থির নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। ‘নতুন ভর্তি হইছি’ বলার পর রেহাই পেলেও বুঝতে পারিনি শাস্তির কারণ কি। পাশের সহপাঠী কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে করে বলেছিল হ্যামবাবু (হেমবাবু) খুব কড়া। শিক্ষক ক্লাসে ঢুকলে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখাতে হয় এবং ‘সিট ডাউন’ না বলা পর্যন্ত বসতে নেই জানা ছিল না বলেই সেদিন শাস্তি হয়েছিল। পরে কিন্তু এই ‘কড়া হ্যামবাবুই’ সঠিক পড়া বলতে পারায় বহুবার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেছেন। গরমের ছুটি পড়ার দিন রাস্তার ধারের গাছ থেকে দেবদারু পাতা, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া ফুল পেড়ে এনে ক্লাসঘর সাজিয়ে সমবেত চাঁদায় কেনা আম লিচু মিষ্টি সাজিয়ে গলায় লিলি বিস্কুটের মালা পরিয়ে পা ছুঁয়ে নমস্কার করলে পয়সার অপচয় করার জন্য সস্নেহে তিরস্কার করে সব ফল মিষ্টি ছাত্রদেরই বিলিয়ে দিয়েছেন। বলতেন, তোরা আমারে খাওয়াবি ক্যান। ভালো কইরা সবাই পাশ করলে তগো (তোদের) আমিই খাওয়ামু। সগ্গলডির (সকলের) পাশ করোন লাগবে কিন্তু।

বার অ্যাকাডেমির ছাত্র ছিলাম মাত্রই তিন থেকে সাড়ে তিন বছর। তবু বলব জীবনে যা শিখেছি, যে জীবনবোধ হয়েছে তার শক্ত ভিত গড়ে দিয়েছিলেন ওই বার অ্যাকাডেমির মাস্টারমশাইরা। হেমবাবু সুশীলবাবু বিনয়বাবু নিশিবাবু নগেনবাবু জ্ঞানবাবুরা ছিলেন ঋষিতুল্য। শহরের মাঝামাঝি এস.ডি.ও-র বাংলোর সামনে নদীর ঘাটে নৌকো থেকে স্কুল মিনিট পাঁচেকের হাঁটাপথ। পিচঢালা মসৃণ রাস্তার দুধারে কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া আর দেবদারু গাছের সারি। একতলা স্কুলবাড়ির ক্লাসঘরগুলি ছিল থার্ড ব্রাকেট প্যার্টানের। ক্লাসঘরগুলির সামনে টানা বারান্দা। উল্টোদিকে পাশাপাশি খান চারেক ঘরে অফিস, হেডমাস্টার মশাইয়ের ঘর, টিচার্স রুম এবং লাইব্রেরি। এই চারটি ঘরের সামনেও টানা বারান্দা। মাঝে মাঝেই ওই বারান্দায় গুরুগম্ভীর হেডমাস্টার পিছমোড়া হাতে এ মাথা থেকে ওমাথা পায়চারি করতে করতে সবকটি ক্লাসের ওপর তীক্ষ্ন নজর রাখতেন। ওই যথেষ্ট। গোটা স্কুলে যাকে বলে ‘পিন ড্রপ সাইলেন্স’। কোনও কোনও মাস্টারমশাইর পড়া বোঝান অথবা কোনও ভালো ছাত্রর স্পষ্ট উচ্চারণে পড়া বলা ছাড়া একটি শব্দ শোনা যেত না। থার্ডব্র্যাকেটের মতো ক্লাসঘর এবং অফিস লাইব্রেরি, হেডমাস্টার মশাইয়ের ঘর, টিচার্স রুম মিলে গোটা স্কুল মিলে একটি বর্গক্ষেত্র। মাঝে হোলস্কোয়ারে টিফিনে খেলার মাঠ। স্কুলের ডাইনে রামকৃষ্ণ মিশন। হেডমাস্টার মশাইয়ের নামটা ঠিক মনে আসছে না। তবে তার একটি মুদ্রাদোষ চোখে ভাসে। বারান্দায় পায়চারি করতে করতে হাত বুলিয়ে তিনি হাতের পাকা রোম খুঁজে বের করে তুলতেন। ভালো করে নিরীক্ষণ করতেন বাস্তবিক সেটি পাকা কিনা। নিশ্চিত হওয়ার পর ফেলে দিতেন। সুশিলবাবু পড়াতেন ভূগোল। কোনও একটি বিষয় ব্যাখ্যা করার পর আবশ্যিক ভাবে তিনি বলতেন, বুঝঝস? ছাই বুজঝস আরও বুঝ (বুঝেছিস? ছাই বুঝেছিস আবার বোঝ)। একই বিষয় তিনি দ্বিতীয়বার ব্যাখ্যা করে তবেই স্বস্তি পেতেন। ইংরেজির মাস্টারমশাই নগেনবাবুর প্রতিজ্ঞা ছিল দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত জুতো পরবে না। ১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্ট মধ্যরাত্রের স্বাধীনতার পরেও কিন্তু তিনি পায়ে জুতো তোলেননি। সম্ভবত দেশভাগের বেদনায়। এই নগেনবাবুর কাছে মাত্র তিন সাড়ে তিন বছরে ইংরেজি অনুশীলনের যে সুযোগ হয়েছিল, পরবর্তী জীবনে ইংরেজি বিষয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিটি অর্জনে তার ভূমিকা অপরিসীম। জ্ঞানবাবুর বিষয় ছিল অঙ্ক। ক্লাসে ঢুকে বিনা ভুমিকায় বোর্ডে একের পর এক অংক কষে যেতেন। মাঝে মাঝে শুধু মনে করিয়ে দিতেন বুঝতে অসুবিধা হলে যেন আমরা তাকে বলি।

বাংলার মাস্টারমশাই বিনয়বাবু সর্বদাই ধোপদুরন্ত। তার পরণে কোনোদিন ইস্তিরিবিহীন ধুতি জামা দেখিনি। পায়ে চকচকে পালিশ করা পামশু। বুক পকেটে ফাউন্টেন পেনের সঙ্গে ভাঁজ করা রুমালের কোণাও উঁকি দিত। আমাদের অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন কারণ খুব একটা পড়া জিজ্ঞেস করতেন না। পাঠ্যবইয়ের বাইরেই তার বিচরণ ছিল বেশি। নেপোলিয়নের সততা, বালক বয়েসেই স্বামী বিবেকানন্দের সাহসিকতা, রাবেয়ার দুঃখ, হাজি মহম্মদ মহসীনের পরোপকারিতা, ছেটো ভাইয়ের প্রতি ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের স্নেহ, অন্ত্যজ দুই বালকের প্রাণ বাঁচাতে নফর কুণ্ডুর আত্মত্যাগ, বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সন্দেশ প্রীতির গল্প তিনি আমাদের শোনাতেন। বিনয়বাবুর কাছেই আমরা রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে কলকাতায় অদৃষ্টপূর্ব বিশাল শোকযাত্রার বিবরণ শুনেছিলাম। তবে সাপের প্রতিহিংসা বিষয়ে যে গল্পগুলি তিনি বলেছিলেন তা কতটা যুক্তিসংগত সে বিষয়ে অবশ্যই সন্দেহের অবকাশ আছে। অনেকেরই এমন ধারণা আছে যে-কোনও বিষধরকে আঘাত করলে সে সাপ যদি না মরে পালিয়ে যায় তাহলে কোনও না কোনও সময় ফিরে এসে আঘাতকারীকে ছোবল দেবেই। বিনয়বাবুর গল্পের সাপ প্রতিহিংসা নিতে তার আক্রমণকারীর কাছে ফিরে ফিরে আসত। কখনও সাপ ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকে, কখনও চলার পথে। একদিন মশারির মধ্যেও ঢুকে ফণা উঁচিয়ে বসেছিল। কিছুতেই সেই সাপকে মারা যায় না। জাতে গোখরো এই সাপের তীব্র গতি। অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ। যে আঘাত করেছিল তাকে ছাড়া অন্য কারওর ক্ষতি করার তার যে-কোনও ইচ্ছে নেই সকলই বুঝতে পারে। কাজেই দিবারাত্র পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। তবুও চিন্তার শেষ নেই। তা ছাড়া কতদিন বা এভাবে পাহারা দেওয়া যাবে। সাপটিকে মেরে ফেলা ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই সেটা সকলেই এক মত। অতএব সাপুড়ের খোঁজ চলছিল। অবশ্য শেষপর্যন্ত তার আর প্রয়োজন হয়নি। একদিন বাড়ির গিন্নি সকালে ঘুম থেকে উঠে বাইরে যাওয়ার জন্য ঘরের দরজা খুলতেই ধুপ করে সেই সাপ তার পায়ের কাছে পড়ে। আঁতকে সরে যেতে যেতে দেখেন সেটি তখন মরে কাঠ হয়ে আছে। অনুমান আগের রাত্রে যখন দরজা বন্ধ করা হয়েছিল তখন সাপ চৌকাঠ অথবা পাল্লায় জড়িয়ে ছিল। দরজা বন্ধ করার সময় দুই পাল্লায় চিপটে মারা যায়।

বিনয়বাবু বর্ণনায় গল্পটি অত্যন্ত রোমহর্ষক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কথা হল সাপ বিষয়ে বাংলা পাঠ্যবইয়ের যে প্রবন্ধটি প্রসঙ্গে তিনি এই গল্পটি বলেছিলেন তাতে বিষধর ও নির্বিষ দুজাতের সাপের সম্পর্কেই নানা তথ্য ছিল। সাপে কামড়ালে ক্ষতস্থানে দাঁতের দাগ কেমন হয়, প্রাথমিক চিকিৎসা কি করতে হবে সে সবই বিশদ বলা ছিল। কিন্তু সাপ প্রতিহিংসাপরায়ণ এমন কিছু ওই প্রবন্ধে ছিল মনে পড়ে না। সাপ অত্যন্ত ভীতু। আত্মরক্ষার তাগিদেই সে গাছের ঝরা পাতাকেও শত্রু মনে করে ছোবল দেয়। এমনটা যেন প্রবন্ধে ছিল। নিরাপত্তা বোধের অভাব থেকেই তো গোধরা কাণ্ডও ঘটে। সে অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ। সাপ কানে শুনতে পায় না ছোটোবেলাতেই জেনেছিলাম। মাটিতে বুকে হেঁটে চলতে চলতে বুক দিয়েই স্পন্দন অনুভব করে। আমরা তাই রাত্রে কোনও মেঠো পথে অথবা ঝোপঝাড়ের পাশ দিয়ে চলার সময় পা দিয়ে দুম দুম মাটিতে ঠুকে সাপ তাড়াতাম। সাপ সম্পর্কে গবেষণায় কোনোদিন উৎসাহ ছিল না। তবে শুনেছি সাপের স্মৃতিশক্তি নেই। অতএব প্রতিহিংসার প্রশ্নই ওঠে না। এসব প্রশ্ন অবশ্য সে সময় মনে ওঠেনি। গল্পেই মজে ছিলাম। তা ছাড়া বিনয়বাবুই তো রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়েছিলেন। তার মূল্য তো অপরিসীম। যেমন পরে, আর একটু বড়ো হলে কলকাতার টাউনস্কুলের বাংলার মাস্টারমশাই রাজেনবাবু টাউন স্কুলে ওপরের ক্লাসে বাংলা পড়াতেন। একই সঙ্গে রাজা মণীন্দ্র কলেজেরও পার্ট টাইম লেকচারার ছিলেন। আপনভোলা মানুষটির কদাচিৎ মাথার চুল আঁচড়ানো দেখেছি। কোনও কোনোদিন এক পায়ে মোজা ছাড়াই জুতো। ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ পড়াতে পড়াতে তিনি ব্ল্যাকবোর্ডে আঁকাবাঁকা নদী ও কদমফুল গাছ আঁকতেন। কত উঁচুতে আঙুল দেখিয়ে খোকাবাবু ‘চন্ন ফু’ আদেশ করেছিল তা চক ঠেকিয়ে দেখাতেন। সেই রাজেনবাবু একদিন থমথমে মুখে ক্লাসে ঢুকে ধরা গলায় ঘোষণা করেছিলেন তিনি ক্লাস নিতে পারবেন না। ইন্দ্র পতন ঘটেছে, যোশেফ স্তালিন আর বেঁচে নেই। ক্লাস তিনি নেননি। পরিবর্তে শুনিয়েছিলেন দুনিয়া কাঁপানো দশদিনের রুশ বিপ্লব এবং বিপ্লবের নায়ক লেনিনের মৃত্যুর পর নবীন সোভিয়েত রাষ্ট্রের সুরক্ষা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিজয়ে স্তালিনের অনন্য ভূমিকার ইতিহাস। দিনটা ছিল ৫ মার্চ ১৯৫৩। আমরা ক্লাস টেনের ছাত্র।

সতেরো

অতীত রোমন্থনে এই এক বিড়ম্বনা। কোন কথায় কোন কথা এসে পড়ে। অতএব লক্ষ্মীনারায়ণ কন্টন মিলসের কম্পাউন্ডে ফিরে যাওয়াই সমীচীন। স্টাফ কোয়ার্টার, এবং সংলগ্ন পুকুরের গল্প বলা হয়েছে। পুকুরের দক্ষিণে এক বিশাল মাঠ। ছোটোবড়ো সকলেই এই মাঠে খেলে। ছোটোদের খেলা সন্ধ্যার আগেই শেষ। বড়োদের খেলা চলে রাত্রেও, আলো জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন ভলিবল। বড়রা ফুটবল অবশ্য বিকেলেই খেলতেন। কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় একটি বেশ শক্তিশালী ফুটবল টিম ছিল। বাইরে নানা টুর্নামেন্ট খেলতে যেত। ফুটবল টিম গড়ার জন্য প্লেয়ার কোটায় চাকরিও দেওয়া হত। একজনের কথা মনে পড়ে। নাট্টুদা নাকি নাট্রুকাকু কী ডাকতাম। সম্ভবত কলকাতার মাঠেও কোনও ছোটো ক্লাবে খেলেছিলেন। এই নাটুদা বা নাটুকাকুকেই আমরা প্রথম বুট পায়ে ফুটবল খেলতে দেখেছিলাম। পাশাপাশি সবকটি কাপড়ের কলেরই নিজস্ব ফুটবল টিম ছিল। এক নম্বর ঢাকেশ্বরী কটন মিলসের টিমের নামী খেলোয়াড় ছিলেন নিখিলেশ দাস। শ্রমিক আন্দোলনেরও কর্মী। পরবর্তীকালে আর.এস.পি. দলের রাজ্য সম্পাদক হয়েছিলেন। লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসের ম্যানেজারের চেম্বারে ঢুকলেই প্রায় ছাদ পর্যন্ত লম্বা লম্বা বিশাল কাচের আলমারিতে সব সময়ই একটা বড়ো শিল্ড দেখা যেত। উত্তমকুমার জয়া ভাদুড়ি (বচ্চন) সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ত্রয়ীর অসাধারণ অভিনয়ে বাণিজ্য সফল বাংলা ছবি ‘ধন্যি মেয়ে’ যারা দেখেছেন তাদের নিশ্চয় মনে আছে হাড়ভাঙা গ্রামের মোড়লের (জহর রায়) প্রতিজ্ঞা ছিল শিল্ড কিছুতেই গ্রামের বাইরে যেতে দেবেন না। এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে কত না কাণ্ড। অতশত কাণ্ড না ঘটলেও ম্যানেজার সুনীল বসুর চেম্বারে শিল্ডের সদা উপস্থিতির পেছনে ওই রকমই কোনও না বলা ইচ্ছা ছিল কি না বলতে পারব না। সুনীল বসুর নিজের গ্রাম মালখানাগরে তাদেরই পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতি বছর একটি টুর্নামেন্ট হত। দেখা যেত প্রতি বছর শিল্ড উঠেছে লক্ষ্মীনারায়ণ মিলসের ঘরেই। একবার লঞ্চ ভাড়া করে শিল্ড ফাইনাল দেখতে ছোটোদেরও মালখানাগর যাওয়ার অনুমতি মিলেছিল। সে এক হইহই ব্যাপার।

আজকাল সারা বছর ধরেই সব খেলা হয়। আগে এমন ছিল না। ফুটবল গরমের খেলা। বর্ষাকালেও চলতে পারে যদি বৃষ্টিতে মাঠ ভেসে না যায়। তবে শীতে কখনও নয়। শীতের খেলা ভলিবল ব্যাডমিন্টন। আগেই বলেছি লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসে থাকতে ক্রিকেটের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়নি। পটৌডির নবাব, নরি কন্ট্রাক্টর, অজিত ওয়াদেকর, পলি উমরিগড়, ভিনু মানকর, দাত্তু ফাদকার, পঙ্কজ রায়, সোলকর, বুধি কুন্দরন, বাপু নাদকার্নির মতো সেকালের ক্রিকেট তারকাদের নাম শুনেছি ১৯৫০ সালের কলকাতায় এসে। তখনই জানতে পারি ক্রিকেট, সার্কাস আর কেক নিয়ে কলকাতার বড়ো দিন। লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসে শীতের খেলা ছিল ভলিবল এবং ব্যাডমিন্টন। খেলা সাধারণত সন্ধ্যা ছটায় দ্বিতীয় শিফট শেষের ভোঁ বাজার পর শুরু হত। তার আগে কোর্টগুলি থাকত আমাদের ছোটোদের দখলে। খেলার মাঠে অফিসার সাধারণ কর্মীর ভেদাভেদ করা হত না। ফ্যাক্টরি ম্যানেজার সুনীল বসুর প্রিয় খেলা ছিল ব্যাডমিন্টন। কোর্টে হয়ত তার জুটি একজন কৌলিন্যে অতি সাধারণ শ্রমিক। ফুটবল মাঠে সাধারণত কেরানি নাট্টুদা অথবা নাট্টুকাকার সঙ্গে স্পিনিং মাস্টার সুনীল মজুমদার উইভিং মাস্টার প্রসেনজিৎ মিত্রদের গায়ে জার্সি গলিয়ে নির্দ্বিধায় মাঠে নেমে পড়তে বাধা হয়নি। একবার স্পিনিং ডিপার্টমেন্টের এক শ্রমিক ডিউটি শেষে একটি সুতোর ববিন কোমরে গুঁজে বেরিয়ে আসার সময় দারোয়ানের হাতে বামাল ধরা পড়ে। গিন্নি হয়ত তার কাছে সেলাইয়ের সুতো চেয়েছিল। ধরা পড়ার পর ম্যানেজারবাবু ওই শ্রমিককে পিটিয়ে প্রায় আক্ষরিক অর্থেই ছালচামড়া ছাড়িয়ে নিয়েছিলেন। ওই শ্রমিকটি খুব ভালো ব্যাডমিন্টন খেলত এবং বরাবর ডাবলসে স্বয়ং ম্যানেজারের জুটি। চুরি ধরা পড়ে মার খেয়ে স্বাভাবিক ভাবেই লজ্জায় সেদিন আর সন্ধ্যায় সে খেলতে মাঠে আসেনি। ম্যানেজার সুনীল বসু না আসার কারণ জানতে পেরেই দারোয়ান পাঠিয়ে ডেকে আনে। ম্যানেজার বাবুর বিচারে অন্যায় করেছে, শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তার সঙ্গে খেলার মাঠের সম্বন্ধ থাকতে পারে না। প্রথম অপরাধের পর অপরাধীর প্রতি সব সময় এমন মানবিক দৃষ্ঠিভঙ্গি নিলে হয়ত অপরাধ ও অপরাধীর সংখ্যা কমে যেত। বিষয়টি অবশ্য মনোবিদ এবং অপরাধ বিজ্ঞানীদের এক্তিয়ারভুক্ত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই খেলার মাঠেই জাপানি বোমার ভয়ে কয়েকটি ট্রেঞ্চ খোঁড়া হয়েছিল। গোটা কয় বাড়ির মাথায় সাইরেনও বসানো হয়। সেই অর্থে ব্ল্যাকআউট না হলেও স্ট্রিট লাইটগুলিতে ঠুলি পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আকাশ পথে জাপানি বোমারু বিমান যাতে নীচে আলো দেখে জনপদের সন্ধান না পায়। স্টাফ কোয়াটার্সগুলিকে সন্ধ্যার পর দরজা জানলা বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। বড়ো হয়ে শুনেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার সাবেক বঙ্গপ্রদেশে পোড়ামাটির নীতি অনুসরণ করে সমস্ত দেশি নৌকো জলে ডুবিয়ে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে নির্দেশ দিয়েছিল। পঞ্চাশের মন্বন্তরের নাকি সেটাও অন্যতম কারণ। ধূসর ছবির মতো যুদ্ধের শেষ দিকের কিছু স্মৃতি মনে থাকলেও এসব জানা অথবা বোঝার বয়স তখনও হয়নি। সরাসরি যুদ্ধের আঁচ সম্ভবত পূর্ববাংলার এক মহকুমা শহরের শহরতলি দূরস্থান, গোটা বঙ্গ দেশেই পড়েনি। কলকাতার খিদিরপুর অথবা হাতিবাগানের বোমা কি এখন দক্ষিণ বাংলার কটা হাত গুনতি গ্রামে জনযুদ্ধ অথবা এম.সি.সি. বা উত্তরবাংলার শিক্ষানবিশ কে.এল.ও. জঙ্গিরা যেসব বিস্ফোরক ব্যবহার করে তার চেয়ে খুব বেশি মারাত্মক ছিল? বিংশ শতাব্দীর ষাট সত্তরের দশকে ঠাণ্ডাযুদ্ধের সময় শান্ত সমাবেশগুলিতে নেতাদের বলতে শুনেছি যুদ্ধের ভয়াবহতা কি ভারতবাসী তা জানেই না। দুটি মহাযুদ্ধের কোনোটিরও আঁচ সরাসরি ভারতবর্ষ পর্যন্ত পৌঁছায়নি। লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসে স্টাফ কোয়াটার্সে বড়োদের মুখে যুদ্ধের চেয়ে বিয়াল্লিশের ভারত ছাড়ো আন্দোলন, সুভাষচন্দ্র বসুর মহানিষ্ক্রমণ (১৭-১৮ জানুয়ারি ১৯৪০ মধ্যরাত্রি) আজাদ হিন্দ বাহিনীর কোহিমা পৌঁছানো (১৯৪৪), বার্লিনে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির অপ্রমাণিত মৃত্যু সংবাদ (১৮ অগস্ট ১৯৪৫) এই সবই ছিল আলোচনার বিষয়। জাপানিরা এসে ভারতকে মুক্ত করে দিয়ে যাক। আমরা ছোটরা সমবেত গলায় ছড়া কাটি ‘সারেগামা পাধানি, বোম ফেলেছে জাপানি, বোমের ভেতর কেউটে সাপ, ব্রিটিশ বলে বাপরে বাপ’। বাঙালি তখন সুভাষচন্দ্রে মজে। গান্ধীজি বাঙালিদের শ্রদ্ধার আসনের অনেক দূরেই হবেন। নয়ত একটি দুর্গন্ধ পতঙ্গ বাঙালির মুখে গান্ধীপোকা নাম পেল কী করে।

তবে কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ন্ত্রিত কটি ইউনিয়ন কিন্তু জনযুদ্ধের স্বপক্ষে নিরলস প্রচার চালিয়ে যাচ্ছিল। সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ ফৌজ যে পঞ্চম বাহিনী ছাড়া অন্য কিছু নয় সঙ্গোপনে সে প্রচারও চলত। অবশ্য সে প্রচার জনমানসে সামান্যই দাগ কাটত। বাঙালি মনন ও মানসে কেবলই সুভাষ এবং আজাদ হিন্দ ফৌজ। স্বদেশি শিল্প এবং বিপণির ক্যালেন্ডারে সুভাষের সঙ্গে ক্যাপ্টেন শাহনাওয়াজ কাপ্টেন সায়গল ঝাঁসি বাহিনীর সর্বাধিনায়িকা ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন প্রমুখেরও ছবি। আজাদ হিন্দ ফৌজের সমর সংগীতের উদ্ধৃতি ‘কদম কদম বাড়ায়ে যা খুশিসে গীত গায়ে যা এ জিন্দেগি হায় কৌম কি তো কৌম পে লুটায়ে যা’। সে সময় স্বাধীনতার দাবিতে মিটিং মিছিলে দু-রকম টুপি মাথায় দেখা যেত। সাদা খদ্দরের গান্ধী টুপি পরতেন কংগ্রেসিরা। সুভাষচন্দ্রের ফরোয়ার্ড ব্লক সমর্থকদের মাথায় থাকত ছাই রঙের আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনানীদের অনুরূপ সামরিক টুপি। আমাদের বাড়িতে এই টুপিই একটি ছিল। মুসলমানরা অবশ্য ফেজ টুপিই মাথায় দিতেন। ফরোয়ার্ড ব্লক নেত্রী লীলা রায় নিয়মিত আসতেন। বড়োদের সঙ্গেই আলাপ আলোচনা করতেন। শরীর চর্চার একটি আখড়াও হয়েছিল। সেখানে ডন বৈঠক রিং প্যারালাল বার স্কিপিংয়ের সঙ্গে ছুরি লাঠি চালনার অনুশীলনও চলত। টকটকে ফর্সা গায়ের রং, আন্দামান ফেরত, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে হবে তত্ত্বে বিশ্বাসী এক স্বদেশি নেতা তালিম দিতে আসতেন! ঠিক মনে নেই, নাম সম্ভবত ছিল অমৃতেন্দু হাজরা। অন্য কেউও হতে পারেন। এই নেতা আমাদের বালক বাহিনীর হাতেও কাঠের ছুরি ধরিয়ে দিয়ে ‘তামেচা বাহেরা শির’ প্রশিক্ষণ দিতেন। লাঠি খেলাও শেখানো হত। আশ্চর্য হল ছোটরাও যারা এই প্রশিক্ষণে সামিল হত তাদের মধ্যে কোনও মুসলমানকে দেখিনি। এখন মনে হয় ওই প্রশিক্ষণ সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধের নয়, দাঙ্গার প্রস্তুতি ছিল। কারখানার ওয়ার্কশপের নাইট শিফটে গোপনে তলোয়ার ছোরা বল্লম ও পাইপগানের আদি সংস্করণ তৈরি করে প্রতিটি কোয়াটার্সেই দেওয়া হয়েছিল। পাইপগানের বারুদ দিয়ে ছোটোখাটো একটা দুর্ঘটনাও ঘটিয়েছিলাম।

পাইপগান বলতে এখনকার গুণ্ডা মাস্তানদের হাতের আধুনিকতর সংস্করণ বুঝলে ভুল হবে। পাইপগান-প্রকৃত অর্থেই একদিকে সিল করা একখণ্ড পাইপ। সিল করা দিকে আগুন দেওয়ার জন্যে ছোটো একটি ফুটো করা হত। পাইপের খোলা মুখ দিয়ে বারুদ ঠেসে ভর্তি করে মুখে মোটা লোহার তৈরি দুতিনটে গুলি ভর্তি করতে হত। পেছনের ফুটোতে দেশলাই কাঠি জ্বেলে ধরলেই বারুদ ঠেলে ওই গুলি বের করে তো দিতই সেইসঙ্গে তুবড়ির মতো আগুনের ফুলকিও ছড়াত। প্রাচীনদের মনে থেকে থাকবে বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ ষাটের দশকে কালীপুজোয় কলকাতার রাস্তায় ছুঁচোবাজি পোড়ানো হত। ভারি বিপজ্জনক ছিল সেই বাজি। বাজিতে আগুন ধরিয়ে দিলে ধানীলঙ্কার সাইজের ওই বাজি এদিক ওদিক ছিটকে পথচারীর ত্রাসের কারণ হয়ে উঠত। ওপার বাংলায় ওগুলোকে মরিচ বাজি বলা হত। আমার ধারণা হয়েছিল পাইপগানের বারুদ দিয়ে আগে খেয়াল হয়নি পাইপগানের বারুদ যেদিকে আগুন দেওয়া হয় তার বিপরীত দিকে ছোটে। নিজের তৈরি মরিচ বাজির মুখ আগুনে ধরতেই সেটির পেছন দিকে বিস্ফোরণ হয়ে গোটা তিনেক আঙুলে ফোস্কা পড়েছিল। নেহাতই এক চিমটি পরিমাণ বারুদ দিয়ে তৈরি হওয়া বড়ো কোনও দুর্ঘটনা হয়নি। অভিভাবকরা জানতেও পারেননি।

মামা সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়েছিলেন বলে আমাদের পরিবারে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতির ওপর কিছু বাড়তি নজর ছিল। তবে সাধারণভাবে লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসের স্টাফ কোয়াটার্সে যুদ্ধ নিয়ে কোনও আতঙ্ক ছিল না। জাপানি বোমার ভয়ে সে সময় নাকি কলকাতা ছেড়ে অনেকেই গ্রামে পালিয়েছিলেন। নারায়ণগঞ্জের শহরতলির না গ্রাম না শহরের মানুষ তেমন চিন্তা মাথায়ও আনেনি। আকাশে উড়ো জাহাজের শব্দ শোনা গেলে ছেলে বুড়ো মেয়ে মদ্দ সবাই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে যতক্ষণ দেখা যায় একদৃষ্টে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত। জাপানি প্লেন না ব্রিটিশ সে নিয়ে জল্পনা তর্কবিতর্ক চলত। উড়োজাহাজ অদৃশ্য হলে যে যার ঘরে ফিরে যেত। একদিন বিকেলের দিকে বিমান হানার সংকেত দিয়ে সাইরেন বেজেছিল। বোধহয় সেটা ট্রায়াল ছিল। সাইরেন বাজার সঙ্গে সঙ্গে সবকটি ডিপার্টমেন্টের কর্মীরা মেশিন বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে আসেন। বেরিয়ে এসেছিলেন স্টাফ কোয়াটার্সের আবাসিকরাও। সকলেই জড়ো হন সেই বিশাল খেলার মাঠে। প্রশ্ন ওঠে এখন কি করণীয়। ট্রেঞ্চে আশ্রয় নেওয়া সমীচীন কিনা। কিন্তু যেকটা ট্রেঞ্চ ছিল তাতে অত লোকের কুলান হয় না। তাই কেউই ট্রেঞ্চে নামেনি। কয়েকজন বুদ্ধি করে ভলিবলের নেট টাঙিয়ে খেলা শুরু করেন। অন্যরা খেলার মজাতেই মেতে ওঠেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘অল ক্লিয়ার’ সংকেত দেওয়া হয়। ব্যস, সেদিনের মতো মজা শেষ। যুদ্ধের মতোই স্টাফ কোয়াটার্সের আবাসিকদের গায়ে পঞ্চাশের মন্বন্তরের আঁচও তেমন লাগেনি। সেবার নাকি বাজারে চালের মণ চল্লিশ টাকা হয়েছিল। বর্তমান প্রজন্ম যখন ১৬-১৮ টাকা কেজি দরে চাল কেনে তখন চালের দাম চল্লিশ টাকা মণ কতটা সামাজিক বিপর্যয় অনুমান করা বাস্তবিক কষ্টকর। ক’জন জানে যে সে সময় ভালো চাকুরেরও মাস বেতন খুব কম ক্ষেত্রেই ৪০ টাকা হত। লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসের কর্মীদের কিন্তু ৪০-টাকায় চাল কিনতে হয়নি। কোম্পানি ভর্তুকি দিয়ে রেশনে চাল সরবরাহ করত বোধ হয় ১২ টাকা মণ দরে। দুর্ভিক্ষ হয়েছিল ১৯৪৩-এ। তিন বছর পর নারায়ণগঞ্জের কাপড়কলগুলিতে এক দীর্ঘকালীন ধর্মঘট সংগ্রাম হয়েছিল। ধর্মঘটের অন্যতম দাবি ছিল ১০ টাকা মণ দরে চাল দিতে হবে।

স্টাফ কোয়াটার্সের আবসিকরা কেবল কোম্পানির ভর্তুকিতে কম দামে চাল পেতেন তাই নয়। গোপনে তাদের মাথাপিছু বরাদ্দের অনেক বেশি সরবরাহ করা হত। সব কথা মনে না থাকলেও এটা স্পষ্ট মনে আছে আমাদের বাসাবাড়ির খাটের তলায় সব সময় দু-আড়াই বস্তা চাল মজুত থাকত। ঢাকার তাউমশাইরা যথেষ্ট সম্পন্ন পরিবার ছিলেন। মন্বন্তরের উত্তাপ কিন্তু তারাও সম্পূর্ণ এড়াতে পারেননি। দুঃসময় অতিক্রম করতে তারাও জীবন যাপনে কিছু কাঁটছাঁট করেছিলেন। আমার বরাবরের অভ্যাস ছিল সকাল দুপুর রাত্রি তিনবেলা ভাত খাওয়া। ছোটো তাউই শাই জ্ঞানরঞ্জন বারবার পরামর্শ দিতেন অন্তত একবেলা ভাত খাওয়ার অভ্যাস ছাড়তে। সে অভ্যাস ছাড়তে হয়েছিল। তবে তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষে নয় পঞ্চাশে এপার বাংলায় আসার পর। ছোটো তাউইমশাই সপ্তাহে অন্তত একদিন ভাত মাছ তরকারির পরিবর্তে লা পসি খাওয়ারও পরামর্শ দিয়েছিলেন। খিচুড়িতে পাঁচমিশালি তরকারি ফেলে লপসি তৈরি হয়। এক সময় জেলের সাধারণ কয়েদিদের এ ধরনেরই কিছু একটা খেতে দেওয়া হত। ছোটো তাউইমশাই-এর পরামর্শ মতো দু-একদিন বাড়িতে লপসি হয়েছিল। খেতে মন্দ নয়। তা হলেও রোজ খাওয়া যায় না। আমরাও খাইনি। এক আধদিন চেখে দেখা হয়েছিল শুধু। মিল কম্পাউন্ডের বাইরে কিন্তু ছিল শুধুই অনাহার আর বুভুক্ষের মিছিল। দারোয়ানদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে কখনও কদাচিৎ বুভুক্ষের মিছিল স্টাফ কোয়াটার্সের আঙিনায়ও পৌঁছে যেত। এভাবে একদিন ঠিক রাত্রের খাওয়ার মুখে একদল অনাহারী আমাদের বাসাবাড়ির উঠোনে ঢুকে পড়েছিল। মার মুখে বারবার শুনে শুনে সেদিনের যে ছবি গেঁথে আছে তা যেন আনন্দমঠে বঙ্কিমচন্দ্রের ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের বর্ণনারই সমতুল্য। ”তখন সেইরূপ আর একটা ছায়া— শুষ্ক, কৃষ্ণবর্ণ, দীর্ঘাকার, উলঙ্গ,— প্রথম ছায়ার পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। তারপর আর একটা আসিল। তারপর আরও একটা আসিল। কত আসিল, ধীরে ধীরে নিঃশব্দে তাহারা গৃহমধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিল। সেই প্রায় অন্ধকার গৃহ নিশীথ-শ্মশানের মতো ভয়ঙ্কর হইয়া উঠিল।” বাসাবাড়ির উঠোনে যারা সেই রাত্রে ঢুকে পড়েছিল তাদের কিছু ছিনিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল না। ক্ষমতাও ছিল না। তাদের মুখ দিয়ে শুধু একটি আর্তনাদই শোনা গেছিল। ‘একটু ফ্যান দাও গো মা।’ মা ফ্যান নয়, রান্না করা হাঁড়ি ভর্তি ভাতই তাদের থালায় উপুড় করে দিয়েছিলেন।

আঠারো

মাঠের দক্ষিণপ্রান্তে ইংরেজি এল অক্ষরের মতো একটি ব্যারাক বাড়ি। এই ব্যারাক বাড়ির পেছনেই শরীরচর্চার জিম তৈরি হয়েছিল। ব্যারাকের অধিকাংশ ঘরই বণিকদের ব্যাচেলার্স কোয়াটার্স। আমরা চলে আসার কিছু দিন আগে এখানেই একটি অংশে মেয়েদের জন্য প্রাইমারি স্কুল খোলা হয়। একটি ঘরে ছিল অফিসার্স ক্লাব। ক্লাবঘরে একটি অলওয়েভ রেডিও সেট। তখনও ঘরে ঘরে রেডিও পৌঁছোয়নি। গোটা স্টাফ কোয়াটার্স কমপ্লেক্সে একটি বা দুটিতে বোধ হয় রেডিও ছিল। আমাদের বাসাবাড়িতেও রেডিও এসেছিল একেবারে শেষদিকে। তাও একটি লোকাল সেট। একমাত্র ঢাকা ছাড়া অন্য কোনও স্টেশন ধরা যেত না। প্রত্যেক অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে ঘোষণা করা হত অল ইন্ডিয়া রেডিও ঢাকা। ঢাকা থেকে যেদিন কুট্টিকাকু (ছোট তাউইমশাইয়ের ছেলে গণেশ) ওই লোকাল সেটটি কিনে নিয়ে এলেন সেদিন বাসাবাড়িতে ছোটোখাটো উৎসবই লেগে যায়। পাশের কয়েকটি কোয়াটার্স থেকেও রেডিও শুনতে অনেকে এসে জুটেছিলেন। তখন দিদি ঢাকা রেডিও স্টেশনে গান করেন। মাসে একদিন প্রোগ্রাম থাকতই। দিদির গান শুনতেই রেডিও আনা। তবে কিনা সেই গোড়ার যুগে ‘বেজে চলে রেডিও, সারাদিন, গোলমাল করতেই রেডি ও’। প্রতি সন্ধ্যা অফিসার্স ক্লাবের অলওয়েভ রেডিওটি ঘিরে খবর শোনার জন্যে বড়োদের ভিড় জমত। বিশেষ করে যুদ্ধের সময়। ঢাকা কলকাতা ছাড়াও অন্য কেন্দ্রের খবর শোনারও আগ্রহ ছিল। এমনকি বিদেশি কেন্দ্রের বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু সংবাদ রটার পর একদিন অফিসার্স ক্লাবের রেডিওর সামনের ভিড় ঘর ছাড়িয়ে মাঠ পর্যন্ত উপচে পড়েছিল। সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু সংবাদ কেউ বিশ্বাস করেনি। সেদিন গুজব রটে বার্লিন রেডিও থেকে নেতাজি ভারতীয়দের উদ্দেশে বক্তৃতা দেবেন।

সুভাষের মৃত্যু নিয়ে গুজব আগেও বোধ হয় একবার রটেছিল। কিন্তু তারপরই বার্লিন রেডিও থেকে নেতাজির গলা ভেসে আসে, আমি সুভাষ বলছি। আবারও নেতাজির মৃত্যু সংবাদ মিথ্যা প্রমাণিত হবে, আবার বার্লিন রেডিও থেকে সেই ‘আমি সুভাষ’ কথা বলবেন এ বিশ্বাসে সেদিন কোনও খাদ ছিল না। কিন্তু সুভাষ কথা বলেননি। অযথা যিনি রেডিওর নব ঘুরিয়ে বার্লিন কেন্দ্র ধরার চেষ্টা করছিলেন তিনি অন্যদের চোখে অপরাধী প্রতিপন্ন হন। উৎকণ্ঠিত শ্রোতাদের সন্দেহ হয়েছিল ঠিক সময়ে রেডিওর কাঁটা বার্লিন কেন্দ্রে সংস্থাপিত হয়নি। তীব্র উৎকণ্ঠা নিয়ে আরও একদিন সকলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেডিওতে কান পেতে ছিল। দিনটা দেশ ভাগের মাস পাঁচেক পর ৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮। দুপুরের মধ্যেই খবর ছড়িয়ে পড়ে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে প্রার্থনা সভায় আততায়ীদের গুলিতে মহাত্মা গান্ধী নিহত হয়েছেন। আততায়ী কে, কোন উদ্দেশ্যে ভারতের জাতির জনককে নৃশংস হত্যা করল, রেডিওর প্রাথমিক খবরে তার কিছুই জানানো হয়নি। খুব স্বাভাবিকভাবে নবগঠিত ভিন্ন দেশ পাকিস্তানে সংখ্যালঘু হিন্দুদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) বোধ হয় দু-আড়াই কোটি হিন্দু ছিল। তাদের অধিকাংশেরই প্রথম দিকে নিজেদের পিতৃ পিতামহের ভিটেমাটি ছেড়ে ওপারে ‘হিন্দুস্তানে’ যাওয়ার চিন্তা মাথায় আসেনি। অনেক টাকা আছে অথবা চাকরির সুবাদে বহুদিন আগে থেকেই এপার ওপার দুই ঠাঁই তারাও ভাবতেন দেখাই যাক না কী হয়। বিকল্প ব্যবস্থা তো আছেই।

আকস্মিক গান্ধীজির নিহত হওয়ার সংবাদে পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বোধ প্রচণ্ড ধাক্কা খেল। নোয়াখালিতে হিন্দুদের গণ সংহার ও অবাধ হিন্দু নারী নির্যাতনের পর ক্ষতে প্রলেপ দিতে গান্ধীজি এসে দাঁড়িয়েছিলেন। অনুরূপ ঘটনা আবার কোথাও ঘটলে মহাত্মার অবর্তমানে কে এসে পাশে দাঁড়াবেন। উৎকণ্ঠিত হিন্দুরা তাই আততায়ীর পরিচয় জানতে ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল। আশঙ্কা ছিল হত্যাকারীর ধর্মীয় পরিচয় ইসলাম হলে ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমান সংহার শুরু হবে। আর তারই প্রতিক্রিয়ায় পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু সংখ্যালঘুদের জীবন মান মর্যাদা বিষয়সম্পত্তি সব যাবে। লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসের স্টাফ কোয়াটার্সগুলিতে সেদিন এক অদৃষ্টপূর্ব নীরবতা। কথাবার্তা সবই অত্যন্ত নীচু গলায়। দুঃশ্চিন্তায় এক রকম অরন্ধনও। না হলে নয় তাই কিছু ফুটিয়ে নেওয়া। কারখানা চলছে। সেখানেও পাশাপাশি কর্মরত সহকর্মীরা একে অপরের সঙ্গে পারতপক্ষে কথা বলছে না। অতি প্রয়োজনে প্রায় অস্ফুটে। অন্যদিকে অফিসার্স ক্লাবে কয়েকজন সারাদিন রেডিওতে কান পেতে ছিলেন কখন কি খবর আসে। অবশেষে শীতের সন্ধ্যার কুয়াশাভারী আঁধার ভেদ করে আলোর ঝিলিকের মতো রেডিওতে ঘোষণা শোনা গেল গান্ধীজির হত্যাকারী এক ধর্মান্ধ ছিল। নাম নাথুরাম বিনায়ক গডসে। সাভারকর, ডঃ হেগড়েওয়াড়, গুরু গোলওয়ালকরের মন্ত্রশিষ্য। রাষ্টীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) একনিষ্ঠ অনুগামী। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গান্ধীজির হত্যাকারী হিন্দু জানার পর পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দুরা অপার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। অন্তত আপাতত তাদের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা নেই। বাবু কোয়াটার্সগুলি হঠাৎই কোনও জাদুকাঠির ছোঁয়ায় জেগে উঠল। এখন আর নীচু গলায় নয় বেশ জোরে জোরেই ভারতীয় নেতাদের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়ে যায়। অহিংসা নীতি ভুলে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তার ‘বাপুর’ হত্যাকারীর গালে সজোরে একটি থাপ্পড় বসিয়ে থাকবেন। ঘটনার আকস্মিকতা এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা কাটার পর কমিউনিস্ট পার্টি প্রভাবিত কর্মী ইউনিয়ন কম্পাউন্ডের বাইরে জলের ট্যাঙ্কের নীচে গোলঘরে ইউনিয়ন অফিসের সামনে লালঝাণ্ডা অর্ধনমিত করে। একটি ছোটোখাটো সমাবেশও হয়। অফিসারেরাও কেউ কেউ ওই সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। সমাবেশে নীরবতা পালন করে গান্ধীজির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়েছিল। সম্ভবত সেই প্রথম কমিউনিস্টরা প্রকাশ্যে গান্ধীজিকে সম্মান জানালেন। কয়েক দিন পর ভ্রাতুষ্পুত্র কানু গান্ধী মহাত্মার চিতাভস্ম নিয়ে আসেন। কোম্পানির উদ্যোগে একটি সুসজ্জিত নৌকায় বয়ে নিয়ে গিয়ে ওই চিতাভস্ম শীতল্যক্ষার মাঝ দরিয়ায় বিসর্জন দেওয়া হয়। কি জানি কীভাবে সাজানো নৌকায় চিতাভস্মের পাত্র হাতে কানু গান্ধীর একটি ছবি আমাদের পারিবারিক সংগ্রহে রয়েছে। কে ওই ছবি তুলেছিলেন জানা নেই।

লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসের কর্মী ইউনিয়ন যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। একটিই ইউনিয়ন। এখন যেমন একই কারখানায় হাজারটা দোকান সেদিনও কিন্তু তা ছিল না। বর্তমান কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি তত্ত্বগতভাবে এক কারখানায় অথবা শিল্পে এক ইউনিয়নের কথা বলে। সবকটি ইউনিয়ন মিশে গিয়ে একটিই কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন এই মুহূর্তেই সম্ভব না হোক কনফেডারেশন গড়া যেতে পারে এমন মহৎ প্রতিশ্রুতি বারবার শোনানো হয়। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কলকাতা কর্পোরেশনে কর্মীসংখ্যা হাজার পঁয়ত্রিশ হবে। সেখানে অনুমোদিত ইউনিয়নই আছে চোদ্দোটি। তারপরেও আছে একাধিক অনুমোদিত ইউনিয়ন। পশ্চিমবাংলার চটশিল্পে কর্মী সংখ্যা দু-আড়াই লক্ষ। সরকার অনুমোদিত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন আছে উনিশটি। পার্টি আনুগত্যের ভিত্তিতে পৃথক পৃথক দোকান খোলার ধুম পড়ে যায় বলা যায় দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। এমনকি একই রাজনৈতিক দলের ভিন্ন ভিন্ন উপদলের ভিন্ন ভিন্ন কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের দৃষ্টান্তও আছে। ঐতিহাসিকভাবে কংগ্রেসকেই ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে ভাঙন শুরু করার জন্য দায়ী করা হয়। মধ্যরাত্রির স্বাধীনতার প্রাক্কালে ১৯৪৭ সালের ৩ মে কংগ্রেসিরা অভিন্ন কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ান অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (এ আই টি ইউ সি) থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা ট্রেড ইউনিয়ন, ন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ান (আই এন টি ইউ সি) গঠন করেন। ষোলো বছর আগেই কিন্তু কমিউনিস্টরা এ আই টি ইউ সি ছেড়ে নিজেদের পৃথক রেড ফ্ল্যাগ ইউনিয়ন তৈরি করেছিলেন। তবে শ্রমিকশ্রেণিকে বিভক্ত করে শ্রমিক আন্দোলনকে শক্তিশালী করা যায় না বুঝতে পেরে ১৯৩৫ সালের মধ্যেই তারা আবার এ আই টি এউ সি-তে ফিরে এসেছিলেন। অতএব লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসে এ আই টি ইউ সি অনুমোদিত একটিই কর্মী ইউনিয়ন ছিল। শীতল্যক্ষা নদীর এপার ওপার বাকি চারটি কাপড়ের কলেও তাই। ১৯৪৬-এর মার্চে নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি কাপড়ের কলেই একসঙ্গে ধর্মঘট হয়। ধর্মঘট দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। ধর্মঘটী শ্রমিকদের ওপর গুলিও চলেছিল। গুলি চালান এক নম্বর ঢাকেশ্বরী কটন মিলসের ম্যানেজার যতীন মজুমদার। চারজন শ্রমিক নিহত এবং ১৬ জন আহত হয়েছিলেন। সরোজ মুখোপাধ্যায়ের দুই খণ্ড ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও আমরা’ গ্রন্থে ধর্মঘটের উল্লেখ আছে।

নানা কারণেই এই শ্রমিক সংগ্রাম স্মৃতিতে স্থায়ী হয়ে আছে। ধর্মঘটের প্রায় পরে পরেই বাবা মারা যান। ধর্মঘট কতদিন চলেছিল সেটা মনে থাকবার কথা নয়। কিন্তু মনে আছে ওই দিনগুলির সর্বগ্রাসী নীরবতা। স্টাফ কোয়াটার্সে কোনও অর্থনৈতিক ধাক্কা আসেনি। কারণ অফিসাররা ধর্মঘটী ছিলেন না। তথাপি বাবুদের বাসাবাড়িগুলিতে জীবন যাপন স্বাভাবিক থাকতে পারেনি। কারখানায় তিন শিফটের বাঁশি বাজে না, গেটে বাজে না ঘড়ি ধরে ঘণ্টা, শিফট বদলের সময় কয়েকশো লোকের কলকোলাহলও নেই। আমাদের ‘কোয়াটার্সের ঠিক পিছনেই কম্পাউন্ডের বাইরে রেল কোয়াটার্সের মতো দেখতে একটি বড়ো দোতলা ব্যারাকবাড়ি ছিল। এটি শ্রমিকদের মেসবাড়ি। এই মেসবাড়ির একতলায় একটি ঘরে ছিল পোস্ট অফিস। আমাদের কোয়াটার্সের পেছন দিকে একেবারে গা ঘেঁসে মেসবাড়ির রসুই ঘর। একবার কোনও এক জ্ঞাতির মৃত্যুতে আমাদের অশৌচ চলছিল। আমিষ খাওয়া বন্ধ। রক্তের সম্পর্ক না থাকায় প্রভঞ্জন কাকার এই ধর্মীয় অনুশাসন মানা বাধ্যতামূলক ছিল না। তাই মাঝে মাঝে তিনি মেসবাড়ির রসুই ঘরে মুখ বদলে আসতেন। একদিন লুকিয়ে অমাকেও সঙ্গে নিয়ে গেছিলেন। টানা নিরামিষ খেতে খেতে অরুচি ধরা মুখে ভাতের পাতে বোয়াল মাছের ল্যাজা অমৃত মনে হয়েছিল। ধর্মঘটের সময় সেই রসুইঘরে ঠাকুর চাকরদের পরিশ্রম বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। ধর্মঘট শুরু থেকেই কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের মেসবাড়ি খালি করে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। শ্রমিকদের চৌকিগুলি দখল নেয় এক দঙ্গল পুলিশ। বোধ হয় পুরো এক ব্যাটেলিয়ানই হবে। সকলের কাঁধে রাইফেল। কাজ নেই কর্ম নেই সারাদিন শুধু বায়নাক্কা। চা দাও মাখন পাউরুটি কলা দাও, আজ মাংস চাই, কাল ওই মাছ চাই। কারখানার দুই প্রধান ফটকে তাঁবু খাটিয়ে পিকেটরত স্বেচ্ছাসেবকরা গান বেঁধেছিলেন, ‘লক্ষ্মীনারায়ণ মিলের ম্যানেজার নাম সুশীল বোস, এই ব্যাটা পুলিশ ডেকে খাওয়ায় খাসির গোস্ত।’ ধর্মঘটীদের গান আর স্লোগানে আমিও গলা মেলাতাম কিছু না বুঝেই। কিন্তু বাড়ির অভিভাবকেরা আতঙ্কিত হতেন, বড়ো হয়ে এ ছেলে নির্ঘাত কমিউনিস্ট হবে। তখন তো কমিউনিস্টরা ‘ব্রিটিশ দালাল’। বাঙালির চোখের মণি সুভাষচন্দ্রকে কুইসলিং বলে, দলীয় মুখপত্র পিপলস ওয়ার-এ তোজোর কুকুর এঁকে দেখানো হয়। ছেলে কমিউনিস্ট পার্টিতে নাম লেখালে পরিবারের লজ্জার কারণ হবে।

মাঝে মাঝে রাইফেল কাঁধে ব্যারাক বাড়ির টানা ব্যালকানিতে পায়চারি করা ছাড়া পুলিশের কাজটা কি ছিল বোধগম্য হয়নি কোনোদিন। শ্রমিকদের ওপর গুলি তো চালিয়েছিলেন ঢাকেশ্বরী মিলের ম্যানেজার। অন্যরা সবাই চলে গেলেও মেসবাড়ির দোতালায় একটি ঘরে একজন শ্রমিক ছিলেন। তিনি কেন গেলেন না, কর্তৃপক্ষই বা তাকে কেন থাকতে দিল সে এক ধাঁধা ছিল। তাকে জিজ্ঞাসা করাতে বলেছিলেন তিনি ধর্মঘটে নেই। কারখানা চললেই কাজে যাবেন। অতএব তার মেসবাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা ওঠে কেন। বড়োজোর ফিসফাস করতে শুনেছি, ওই লোকটি অবশ্যই একজন স্পাই হবেন। কিন্তু কাদের চরবৃত্তি তিনি করতেন তা নিয়ে ধন্দ ছিল। ডবল ক্রসের দৃষ্টান্ত হওয়া অসম্ভব নয়। গুলি চলেছিল ঢাকেশ্বরী কটন মিলসের খেলার মাঠে। সেখানে বোধহয় ধর্মঘটীদের কোনও সমাবেশ ছিল। কর্মীদের দিক থেকে কোনও উসকানি ছিল কি না জানা নেই। তবে অদূরে ম্যানেজারের কোয়াটার্সের ছাদ থেকে গুলি চালান হয়। নিহত চারের দু’জনই ছিলেন লক্ষ্মীনারাণ কটন মিলসের শ্রমিক। স্টাফ কোয়াটার্সের দক্ষিণে গোলঘরের ইউনিয়ন অফিসের খানিক দূরে খোলা মাঠে দুই শ্রমিককে দাহ করা হয়। কোম্পানির কোনও নতুন কনস্ট্রাকশনের জন্য সেখানে তখন ইঁট-কাটানো হচ্ছিল। সেই ইঁটভাটার মাঠে দুই শহিদের অন্ত্যেষ্টিতে কারখানার শ্রমিক ছাড়াও আশেপাশের গ্রামগুলি থেকে নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ সবাই এসে যোগ দিয়েছিলেন। অন্ত্যেষ্টি সমাবেশ থেকে কর্মী ইউনিয়নের সম্পাদক শ্রীমন্ত রায় ঘোষণা করেছিলেন দুই কমরেডের খুনের বদলা নেওয়া হবে। কিন্তু বদলার প্রথম নমুনা অফিসার্স মহলে হাসির খোরাক জুটিয়েছিল।

মিল কোম্পাউন্ডের পশ্চিম বরাবর ঢাকেশ্বরী কটন মিলস পর্যন্ত একটা রেললাইন টানা ছিল। এই লাইনে যাত্রী গাড়ি চলত না। চারটি কাপড়ের কলের কয়লার জন্য কয়লা এবং সম্ভবত মূল কাঁচামাল তুলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য গুডস ট্রেন চলত। দুই শহিদের অন্ত্যেষ্টির দিন দুই পর এক সকালে ওই রেললাইন ধরে শ-সওয়াশো লোকের একটা বিশাল মিছিল স্লোগান দিতে দিতে কারখানার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। মিছিলে মহিলা ও শিশুর সংখ্যাই ছিল বেশি। স্লোগান শুনে ব্যারাক বাড়ির ব্যালকনিতে রাইফেল কাঁধে পুলিশ এসে দাঁড়াতেই মিছিল নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে পড়ে। রেললাইনের ধারে পড়ে থাকা কয়লার টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে মিছিলের জনা কয় পুলিশের দিকে ছুঁড়তে থাকে। অবশ্য ব্যারাকবাড়ি ও রেললাইনের মধ্যে ব্যবধান এতই বেশি যে মিছিল থেকে ছোঁড়া কয়লা ঢ্যালা পুলিশের গায়ে লাগা সম্ভব ছিল না। আর লাগলেও, ঢ্যালার যা সাইজ তাতে ক্ষতিবৃদ্ধি কিছু হত না। পুলিশ রাইফেল বাগিয়ে ধরতেই মিছিলের লোকেরা দুদ্দাড় পিঠটান। সেদিন থেকে কারখানার গেটের পিকেটারদের শিবিরগুলিও তুলে নেওয়া হয়। দু’চারজন করে কোম্পানির অনুগতরাও কারখানায় ঢুকতে আরম্ভ করে। কেউ বাধা দেওয়ার ছিল না। দেখে শুনে মনে হয়েছিল ধর্মঘটীরা বোধ হয় রণে ভঙ্গই দিল। এবার ধীরে ধীরে ধর্মঘট উঠে যাবে। আরও দুচার দিন দেখে পুলিশও ব্যারাকবাড়ি ছেড়ে চলে যায়। সব কিছুই যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি বিমান থেকে ডামি প্যারাট্রুপার ফেলার মতো সাজানো ব্যাপার সেটা বুঝতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি।

ধর্মঘট উঠে গেছে বোঝবার জন্য আবার ঘড়ি ধরে কারখানার বাঁশি বাজান শুরু হয়। দারোয়ানরা গেটে ঘণ্টাও দেয়। কোম্পানির ভাড়া করা পিটদের পেছন পেছন দুর্বল মনের কিছু শ্রমিকও শিফটে কারখানায় ঢোকেন। পেটের টানেও কেউ কেউ আসেন। কর্তৃপক্ষ তখন ধরেই নিয়েছে একে একে সব শ্রমিকই ফিরে আসবে। এখন পালের গোদাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া যায় ভাবা যেতে পারে। ধর্মঘট ভেঙে গেল ধরে নিয়ে পুলিশও থানায় ফিরে যায়। এই সময় আকস্মিক একদিন ইউনিয়ন তাদের সাথি হত্যার বদলা নেয়। সেদিন সকালে শীত্যলক্ষা নদী বেয়ে একটি ছিপ নৌকো কারখানার ঘাটে এসে ভেড়ে। নৌকোয় ছিল জনা পঁচিশেক সুঠাম যুবক। পরে জেনেছিলাম ওই যুবকদের মধ্যে প্রভঞ্জন কাকার দুই মামাতো না মাসতুতো ভাই স্বদেশ ধর ও বেণু ধরও ছিল। নারায়ণগঞ্জ শহরে ডায়মন্ড অথবা হংস কি নামে একটা সিনেমা হল ছিল। সে সময় স্বচ্ছল শিক্ষিত পরিবারের অনেক যুবকই কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিল। চোখে ছিল তাদের সমাজ বদলের স্বপ্ন। বেণু ধর পরে পার্কসার্কাস অঞ্চলে দীর্ঘদিন কলকাতা কর্পোরেশনের কাউন্সিলার ছিলেন। একটি উপনির্বাচনে জিতে কিছুদিন এম.এল.এ.-ও হয়েছিলেন সি.পি.আই.র টিকিটে। ছিপ নৌকোর যুবকদের সকলের পরণে ছিল সাদা হাফপ্যান্ট। গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। মাথায় লাল টুপি। প্রত্যেকের হাতে লালঝাণ্ডা। ঝাণ্ডার দণ্ডগুলি সব পাকা বাঁশের লাঠি। কোনও কোনোটির মাথায় বল্লম বসানো। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে দিতে নৌকো থেকে নেমেই এই যুবকেরা নির্বিচারে ‘দালাল’ পেটাতে শুরু করেন। বলতে গেলে প্রায় বিনা প্রতিরোধেই ঘণ্টা খানেক ধরে তাদের ‘অ্যাকশন’ চলেছিল। কেউ নিহত না হলেও প্রায় আধমরা হয়েছিল অনেকেই। তবে কমিউনিস্টদের রুদ্রমূর্তি দেখে আগেভাগেই বেশির ভাগ পালিয়েছিল। পুলিশ নেই কে রক্ষা করবে।

অ্যাকশনের প্রথম পর্ব-সফলভাবে শেষ করে ইউনিয়নের বহিরাগত কমিউনিস্ট স্বেচ্ছাসেবকরা স্টাফ কোয়াটার্সগুলির দিকে এগোতে থাকে। লক্ষ ম্যানেজার সুনীল বসু। তিনি ধর্মঘট ভাঙার জন্য পুলিশ এনেছিলেন। সুনীল বসুর নাগাল তারা পায়নি। তাদের হাতে পড়েছিলেন ছোটো ভাই সুশীল বসু। সুশীলের সঙ্গে কারখানা ধর্মঘটের কোনও সম্পর্কই ছিল না। কুকুর প্রীতিই তার কাল হয়েছিল। কাজকর্ম কিছু নেই। দাদার কোয়াটার্সে শুয়ে কাটান। একগাদা কুকুর পোষেন। যত নজর তার কুকুরের ভালোমন্দে। এই সুশীল বসুর সঙ্গেই আমার পিসতুতো ভাই নিতাই ‘কুকুর মামা’ পাতিয়েছিল। সুশীল তাকে একটা কুকুরের বাচ্চা দিয়েছিলেন। সেই সুবাদেই কুকুর মামা। নিতাই নিজেদের বাড়ি চাইবাসায় (ঝাড়খণ্ড) চলে গেছিল। কুকুর থেকে যায় আমাদের বাসাবাড়িতেই। তখন তার নাম হয়েছে ডলি। বাবার অত্যন্ত ন্যাওটা। বাবা মারা যাওয়ার পর শ্মশান থেকে কোথায় চলে গেল। আর ফিরে আসেনি। সেদিন লালঝাণ্ডাধারীদের এগিয়ে আসতে দেখে সব অফিসার্স কোয়াটার্সেরই সদর দরজা ঝপাঝপ বন্ধ হয়ে যায়। ম্যানেজার সুশীল বসুর কোয়াটার্সেরও। বাচ্চা একটি কুকুর গেটের বাইরে রয়ে গেছিল। সুশীল সেই কুকুরছানা উদ্ধার করতে গিয়েই মারমুখী কমিউনিস্টদের হাতে পড়ে। বড়ো কিছু না হলেও বেশ কিছুদিন তাকে হাতে মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে ঘুরতে হয়েছিল। এই ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যেই ধর্মঘটের মীমাংসা হয়ে যায়। সম্ভবত কর্তৃপক্ষ বারো টাকা মণ চাল এবং বাড়তি মাগ্গিভাতা-সহ ইউনিয়নের কয়েকটা দাবি মেনে নিয়েছিলেন।

উনিশ

মাগ্গিভাতা প্রসঙ্গে একটা মজাদার ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। ঘটনা ধর্মঘটের আগের অথবা পরের ঠিক মনে নেই। মনে হয় আগেরই হবে। জাদু সম্রাট পি. সি. সরকার (সিনিয়র) এসেছিলেন তার বিশ্ববিখ্যাত জাদু প্রদর্শন করতে। সঙ্গে কজন সহকারী ছিলেন কিনা মনে নেই। কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে বলেছিলেন ম্যাজিক দেখাবার জন্য তিনি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন ষাট টন জাদু সামগ্রী। তিনি নাকি সোজা বার্মা মুলুক থেকে এসেছিলেন। এত লোকজন সরঞ্জাম নিয়ে এত দৌড় ঝাঁপে তার বাবার প্রবল আপত্তি ছিল। মঞ্চ সাজাবার জন্য তিনি লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসের কর্তৃপক্ষের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এত ভালো মঞ্চ নাকি সব সময় কলকাতাতেও পেতেন না। জাদু সম্রাট হয়ত তার প্রদর্শনীর স্থানীয় প্রযোজকদের মন রাখা কথা বলেছিলেন। কথায় ফুলঝুরি ছোটানো জাদু প্রদর্শনের আবশ্যিক উপাদান। তবে একথাও সত্যি খেলার মাঠে যাত্রা কবিগান ম্যাজিকের জন্য যে মঞ্চ তৈরি হত জাঁকজমকে বাস্তবিক তা সেই মধ্য চল্লিশের দশকে অভাবনীয়ই। ইলেকট্রিক পোস্ট, কারখানার ক্যালেন্ডার ডিপার্টমেন্টের প্ল্যাটফর্ম নানা রঙের পপলিন কাপড় ব্যবহার করে মূল মঞ্চ তৈরি হত। সে সময় হ্যালোজেন বা ওই ধরনের কোনও আলো ছিল না ঠিকই। তাহলেও পাঁচশো ওয়াটের অগুনতি বাল্ব লাগিয়ে রাতের অন্ধকারে দিনের আলো ফুটিয়ে তোলা হত। সাধারণ দর্শকদের মাথার ওপরে চটের ছাউনি, যে চট দিয়ে মিলের কাপড়ের গাঁট বাঁধা হত। অফিসারদের বসার জায়গায় মাথার ওপর ভাগ্যকুলের জমিদার বাড়ি থেকে আনা শামিয়ানা। জাদু সম্রাটের তাসের খেলা খুব আকর্ষণীয় হয়েছিল। শুরু করেছিলেন লঙ্কেশ্বর রাবণ যে তাস নিয়ে খেলতেন তাই দিয়ে। যেহেতু দশাননের তাস অতএব তার সাইজও যে দশাসই হবে সে তো বলাই বাহুল্য। মাপে পাক্কা একটি কাঁঠাল কাঠের পিড়ির সমান। কিন্তু ছোটভাই বিভীষণ অত বড়ো তাস দিয়ে খেলবেন কী করে। জাদুসম্রাট তাই দুহাত দিয়ে চেপে চেপে সেই দশমণি তাসকেই বিভীষণের হাতের মাপে ছোটো করে দেন। পুত্র ইন্দ্রজিতের জন্য আরও ছোটো করতে হয়। সিনিয়র সরকার দাবি করেছিলেন তিনিও লঙ্কাধিপতির তাস দিয়েই খেলা দেখান। তবে চেপে চেপে নিজের হাতের উপযোগী করে নিতে হয়েছে। বয়স যখন পাঁচ বছর কম ছিল তখন তাসকে ছোটো করতে হত। প্রতি পাঁচ বছর আগেই তাকে তাস ছোটো করে নিতে হয়েছে। ঠিক যখন পাঁচ বছর বয়স তখন যে তাসে খেলা দেখাতেন চেপে চেপে ছোটো করে সে তাসও তিনি দর্শকদের দেখিয়েছিলেন। ঠিক যেন ফুরফুরে এক মুঠো শালিধানের ধবধবে চিড়ে। তাতে ইস্কাবন চিরিতন রুহিতন হরতন সবই আছে। আর তার পাঁচ বছর আগে? তখন তো জাদুসম্রাট জন্মানইনি। অতএব দুই হাতের চাপে তাসও ভ্যানিশ।

টুপির ভেতর থেকে পায়রা বের করে আনা, দড়ি কেটে দড়ি জোড়া দেওয়া, যে যেমন চায় তাকে নিজের আলখাল্লার হাত থেকে সেই ফল দেওয়া, মাথার গরমে পোলাউ রান্না করা এসব তখনকার চলতি জাদু অনেকেই দেখিয়েছিলেন। জাদুকরের চোখ দুটি প্রথমে ময়দা পুলটিশ দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারপর কালো কাপড় দিয়ে সেই বন্ধ চোখ কষে বেঁধে দেওয়া হয়। মঞ্চের ওপর রাখা ছিল একটি ব্ল্যাকবোর্ড। দর্শকরা সেই বোর্ডে খড়ি দিয়ে যা লিখছেন জাদু সম্রাট সেই চোখ বাঁধা অবস্থাতেই অবলীলায় তা পড়ে দিচ্ছিলেন। জাদুসম্রাটের ডাকে সাড়া দিয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের এক জঙ্গি কর্মী গটমটিয়ে মঞ্চে উঠে বোর্ডে লেখেন ‘মাগি ভাতা দিতে হবে’। জাদু সম্রাট ছিঃ ছিঃ করে উঠতেই গোটা দশর্কমণ্ডলী হো হো হাসিতে ফেটে পড়ে। অপ্রস্তুত ইউনিয়ন কর্মীটি কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার হাত থেকে খড়িটি নিয়ে সেই চোখ বাঁধা অবস্থাতেই জাদুকর যথাস্থানে আর একটি ‘গ’ বসিয়ে অশ্লীলতাকে শ্লীল করে দিয়েছিলেন। মাগ্গি ভাতার দাবি ছিঃ ছিঃ কিছু নয়। পূর্ববঙ্গে সেই শিল্পাঞ্চলে জাদুসম্রাট সিনিয়র সরকারের চেয়ে কিন্তু তার ছোটো ভাই এ সি সরকার অনেক বেশি বাহবা কুড়িয়েছিলেন। শিল্প সুষমার চেয়ে ব্ল্যাক ম্যাজিক দর্শক মনোরঞ্জনে অনেক বেশি কার্যকর। শূন্যে ভাসতে ভাসতে চায়ের পিরিচ পেয়ালা আসছে, অন্যদিক থেকে কেটলি, শূন্যেই কেটলি থেকে ধূমায়িত চায়ে পেয়ালা ভর্তি হচ্ছে এবং সব শেষে মূর্তিমান কঙ্কাল এসে সেই চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। এর চেয়ে রোমহর্ষক দৃশ্য আর কি হতে পারে। এ সি সরকার বোধ হয় হিপনটিজিম বা সম্মোহনের খেলাও দেখিয়েছিলেন। আমাদেরই এক বন্ধু বেণুকে তিনি হিপনটাইজ করার পর মঞ্চ থেকে জলজ্যান্ত উধাও করে দিয়েছিলেন। দর্শকদের মধ্যে সাধারণ শ্রমিকরা অবশ্য সবচেয়ে বেশি হাততালি দিয়েছিলেন যখন জাদুকর এক হাট লোকের মধ্যে ম্যানেজারবাবুর মাকে যারপরনাই অপ্রস্তুত করেন।

বোধ হয় ওই সময়ই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ইউনিয়নের বিরোধ পেকে উঠেছিল। কবে সরাসরি সংঘাত শুরু হয় সকলের মনেই সেই আশঙ্কা। পারস্পরিক বৈরিতার বাতাবরণে স্বয়ং ম্যানেজারের মা যদি কিছু বিড়ম্বিত হন তা হলে এক পক্ষের খুশি হওয়া আশ্চর্যের নয়। জাদুকর এ সি সরকার কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও শ্রমিকদের সেই পরম খুশি উপহার দিয়েছিলেন। দর্শকদের মধ্যে সুনীল বসুর বিধবা মাও ছিলেন। বৃদ্ধার গলায় মোটা সোনার হার। ম্যাজিসিয়ান সেই হারটি চেয়ে নেন। তিনি ওটি পুকুরে ফেলে দেবেন। কিছুক্ষণ পরে নিজে নিজেই সেটি আবার ভেসে উঠবে। যেমন কথা তেমন কাজ। হার পাশে পুকুরের জলে ছুঁড়ে ফেলা হল। জনা চার দারোয়ান তখন পাঁচ ব্যাটারির টর্চের জোরালো আলো ধরে আছে ঠিক সেইখানে যেখানে হারটি গিয়ে পড়েছে। দর্শক যারা সঙ্গে গেছিলেন তারাও দেখলেন জলের গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে অদৃশ্যও হয়ে গেল। জাদুকর ফিরে এলেন মঞ্চে অন্য খেলা দেখাতে। এক সময় খেলা শেষ হল। মঞ্চের সামনে এসে সহকারিদের নিয়ে জাদুকর কুর্নিশ করে দর্শকদের কাছ থেকে বিদায় নিতে উদ্যত। ওপর থেকে ধীরে ধীরে যবনিকাও নেমে আসছে। এমন সময় দর্শক আসনের সামনের সারি থেকে প্রায় আর্তনাদের মতো সুনীল বসুর মায়ের গলা শোনা গেল, আমার হার কোথায় গেল, হার ফেরত দিলেন না। কথা আর হাতের জাদুতে মুগ্ধ দর্শকরা বাস্তবিক হারের কথা একরকম ভুলেই বসেছিলেন। এবার কিন্তু গুঞ্জন উঠলো সত্যি তো হারের কি হবে! জাদুকর এ.সি. সরকার কিন্তু নির্বিকার। তিনি স্বীকারই করেন না কোনও হার নিয়েছেন। সবাই তাজ্জব। তবে কি জাদুকর জোচ্চোর। সরকার কিন্তু বলেই চলেছেন, ভালো করে মনে করুন। আপনি হয়ত গলায় হার পরেই আসেননি। হার বাড়িতেই রয়েছে। লোকে সেকথা মানবে কেন। সবাই দেখেছে ম্যানেজারবাবুর মা গলা থেকে হার খুলে দিয়েছেন। সে হার পুকুরের জলে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে, চার পাঁচটা ব্যাটারির টর্চের জোরালো আলোয় সে হার তলিয়ে যেতেও দেখা গেছে। এখন অন্য কথা মানবে কেন। বেশ কয়েক মিনিট ধরে টানাপোড়েনে জাদুকরও বিরক্ত। অবশেষে তিনি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন, বেশ তা হলে নিজের গলাতেই দেখুন। ও হরি আঁচল জড়ানো গলায় সত্যি তো সেই হার। এ সি সরকারের জাদুপ্রদর্শনীর একটি উপকাহিনিও আছে। জাদুকরের দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল আমাদের বাড়িতেই। মায়ের হাতের পঞ্চব্যঞ্জন সহযোগে তিনি ভাত খেয়েছিলেন। সেকালের গড় বাঙালির মানেও অনেক বেশিই। তবুও মা মেয়েদের স্বভাবধর্ম অনুযায়ীই ভদ্রতা করেছিলেন অতিথি বোধহয় লজ্জা করে কম খেয়েছেন। উত্তরে জাদুকর তাৎক্ষণিক পাতানো বউদিকে লজ্জা ভাঙতে অনুরোধ না করার পরামর্শ দিলেন। হাঁড়িতে টান পড়তে পারে। মাও পিছু হটার পাত্রী নন। দেখা যাক হাঁড়িতে টান ধরাতে পারেন কি না জাদুকর। দুইয়ের প্রতিযোগিতায় মাকেই হার মানতে হয়েছিল। সত্যি এক সময় দেখা যায় হাঁড়ি প্রায় ঠনঠন। যদিও বাড়ির অনেকেরই খাওয়া তখনও বাকি। এটা কিন্তু ম্যাজিক ছিল না। ভর দুপুরে সেদিন মাকে আবার হাঁড়ি চাপাতে হয়েছিল।

মিল কম্পাউন্ডে সবচেয়ে হইহই ব্যাপার ছিল কালীপুজোর সময় যাত্রা অনুষ্ঠান। চলতি কথায় যাত্রাগান। পাশাপাশি লক্ষ্মীনারায়ণ চিত্তরঞ্জন ঢাকেশ্বরীর মধ্যে এই পালাগান নিয়ে কমপিটিশন হত। শুরু হয়ে যেত দুর্গাপুজোর সময় থেকেই। কেন জানি না, অন্য মিলগুলির কোয়াটার্সে দুর্গাপুজো হলেও আমরা যতদিন ছিলাম লক্ষ্মীনারায়ণে হত না। ভালোই ছিল। আমরা তো পুজোর সময় দেশের বাড়ি যেতাম। মিল কোয়াটার্সেরও পুজো হলে দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপ থাকত। আমরা চলে আসার পর লক্ষ্মীনারায়ণেও দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল। তার আগে ছিল কালীপুজো। কালীপুজো উপলক্ষেই যাত্রার আসর বসত। দুর্গাপুজোয় চিত্তরঞ্জনে যদি তিনরাত্রি হয়ে থাকে তা হলে কালীপুজোয় লক্ষ্মীনারায়ণে চাররাত্রি পালাগান হতেই হবে। না হলে মান থাকে না। এখনকার মতো সেকালে যাত্রাপালা দু-আড়াই ঘণ্টার ছিল না। সন্ধ্যারাত্রে শুরু হয়ে পাঁচ অঙ্কের পালা শেষ হতে হতে অনেক সময় ভোর হয়ে যেত। তারপরেও কোনও কোনও বছর আবার সকাল থেকেই কবিগান। আমাদের একটা ছড়া ছিল— যাত্রা শোনে ফাতরা-লোকে, কবি শোনে ভদ্রলোকে। কবি গানের আসরে খুব একটা ভিড় হত তা নয়। তাতে কবিয়ালদের মাথা ব্যথা খুব একটা ছিল বলে মনে হয় না। তাদের টাকা পাওয়া নিয়ে কথা। পেশাদারিত্ব আর টাকার সম্পর্ক নিবিড়। যাত্রার আসরে কিন্তু মানুষের ঢল নামত। পরিবার পরিজন-সহ কারখানার দেড়-দু হাজার শ্রমিক কর্মচারী তো ছিলেনই। আশেপাশের গ্রামগুলি থেকেও দল বেঁধে ছেলে বুড়ো মেয়ে মদ্দ সবাই আসতেন। এখনকার মতো টিকিট কেটে যাত্রা নয়। কাজেই গরিব বড়োলোক নির্বিশেষে আসতে বাধা কি। আয়োজনও হল এলাহি। মাথার ওপর আচ্ছাদন। অতএব হেমন্তের শিশিরে মাথা ভেজার ভয় নেই। বসার জন্যেও থাকত গোটা মাঠ জুড়ে ত্রিপল বিছানো। বাবুদের জন্য অবশ্যই পদমর্যাদা অনুযায়ী কাঠের চেয়ার এবং গদি-মোড়া সোফা। আমাদের ‘বাবুর পোলাদের’ বসার জায়গা ছিল একেবারে মঞ্চের ওপর যেখানে বাজিয়েরা বসতেন তাদের পাশে। এদের বলা হত কনসার্ট পার্টি। বাঁশের বাঁশি ছোটোবড় ক্ল্যারিওনেট সানাই হারমোনিয়াম তবলা ঢোল এমনকি কাঁসর সবকিছুই থাকত এই কনসার্টে। সামান্য বিরতি দিয়ে তিনবার কনসার্ট বাজলে তবে পালা শুরু হত। প্রতিবার কনসার্ট শুরুর আগে এক দুই ও তিনবার ঢং করে ঘণ্টা বাজত। দুটো ঘণ্টার শব্দ শোনা গেলে তবেই আমরা ‘বাবুর পোলারা’ কোয়াটার্স ছেড়ে আসরে আসতাম। বাবু এবং বাবুর বাড়ির মেয়েরা আসতেন তিনটে ঘণ্টা বাজার পর। এ সবই আভিজাত্যের আচরণবিধি। যাত্রার আসর ঘিরে অসংখ্য চিনেবাদাম ঝালমুড়ি চানাচুর সস্তার লজেন্স বিস্কুট পাঁপড়ভাজা জিলিপির দোকান বসত। সবচেয়ে বেশি বসত বিড়ি আর সস্তার পাসিং শো নেভি সিজার ব্র্যান্ডের সিগারেটের দোকান। তখনও বোধ হয় ভাজির সুলতানের চারমিনার বাজারে আসনি। পুরুষ দর্শকদের মুখে মুখে বিড়ি। বিড়ির ধোঁয়ায় হেমন্তের কুয়াশাও চাপা পড়ে যাওয়ার অবস্থা। যাত্রার আসর থেকে ফেরার পর জামা প্যান্টে বিড়ির ধোঁয়ার গন্ধ পাওয়া যেত। অতএব সে সব জামা প্যান্ট সঙ্গে সঙ্গে জলে ডুবিয়ে দেওয়াই ছিল নিয়ম।

যাত্রাদল আসত কলকাতা থেকে। নট্ট কোম্পানি, আর্য অপেরা আরও কি কি। সব দলেরই মূল দপ্তর বা গদি ছিল কলকাতার চিৎপুরে। এখনও তাই আছে। উত্তর বাংলা ও আসামের চা বাগান, রানিগঞ্জ, আসানসোল, বরাকর, ধানবাদের কয়লাখনি অঞ্চলের মতো পূববাংলাতেও পালাগানের খুবই কদর ছিল। ছোটো ফণী বড়ো ফণী চপলরানি গোপালরানি তারারানির মতো নট নটীরা কোন বছর কোন দলে তার ওপর ব্যবসা অনেকটাই নির্ভর করত। তবে লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসের কি জানি কেন বরিশালের নট্ট কোম্পানির প্রতি কিছুটা পক্ষপাতিত্ব ছিল। কোনও কারণে নট্টকে না পাওয়া গেলে অন্য দলের চিন্তা। নট্টও পূববাংলায় তাদের এই পৃষ্ঠপোষককে খুশ রাখতে সতত সচেষ্ট থাকত। একবার তো কোনও অতিরিক্ত টাকা না নিয়ে একরাত্রি বেশি পালাগান শুনিয়েও এসেছিলতারা। সেবার পূর্বনির্ধারিত চাররাত্রির শেষ রাত্রিতে পালার ‘নায়িকার’ ধূম জ্বর ওঠে। আসরে নামার ক্ষমতা নেই। এ অবস্থায় সখির দল থেকে সুন্দর মুখের এক সখিকে সাজিয়ে গুছিয়ে নায়িকার ভূমিকায় নামিয়ে দেওয়া হয়। বোধ হয় ত্রিশ বছরের বেশি যাত্রাপালা দেখা হয়নি। তা হলেও সেই ত্রিশ বছর আগেই গ্রামীণ লোকশিল্পের এই শাখাটির বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটে গেছে। যাত্রার আসরে আলোর কারিকুরি, মাইক্রোফোন, নারী ভূমিকায় মহিলা শিল্পী— এসব সেই ত্রিশ বছর আগে উৎপল দত্তর ‘রাইফেল’ পালাতেই দেখেছিলাম। তবে সেই আধুনিক যাত্রাপালারও একটি বৃদ্ধার চরিত্রে একজন পুরুষ অভিনয় করেছিলেন। খবরের কাগজে এখন যে সব যাত্রাপালার বিজ্ঞাপন দেখা যায় তা পড়ে মনে হয় না এইসব পালাকে যাত্রা বলে চেনা যাবে। জানি না এখন আর তিন কনসার্ট শেষ হওয়ার পর মূল পালা শুরু হওয়ার আগে সখির দলের নাচ হয় কি না। সখির দল অর্থ একদল বালকের গালে মুখে পাউডার আলতা মাখিয়ে পরচুলা আর জরিদার শাড়ি পরিয়ে মেয়ে সাজিয়ে দেওয়া। এদের নাচ ও গানের একটা বিশেষ ঘরানা ছিল। গানের কথা হত ‘চল ধীরে ধীরে ফুলবনে। আমি হব সইয়ের বর সই হবে আমার কনে’ ধরনের। সখির দলে নাচতে নাচতে দু’একটি বালক বড়ো হয়ে অভিনেতাও হয়ে যেত। তবে সে তো অনেক দূরের পথ। তার আগে দিনের পর দিন মাসের পর মাস বছরের পর বছর এই বালকদের দলের রান্নার জল তোলা উনুন ধরানো বাসন মাজা মশলা বাটা কুটনো কোটার কাজ করতে হত। সেইসঙ্গে অধিকারী ও প্রধান অভিনেতা অভিনেত্রী বাজনা দারদের গা হাত পা টেপা মাথা ম্যাসেজ এবং তেল মাখানো। অনেক সময়ই এরা যৌন নিগ্রহেরও শিকার হত। এসব অবশ্য জেনেছি অনেক পরে। সখির দল থেকে বেছে নেওয়া বিকল্প নায়িকা সেদিন আসরে মোটেই সুবিধা করতে পারেননি। দর্শক শ্রোতারা নায়িকার সংলাপের চেয়ে প্রম্পটারের গলাই বেশি শুনেছে। অতএব যা হওয়ার। তুমুল বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল যাত্রার আসরে। শেষে নায়িকার জ্বর সারলে আর একদিন তারা পালা গাইবেন প্রতিশ্রুতি দিলে জনতা শান্ত হয়। মিল কর্তৃপক্ষকে অবশ্য দিন তিনচার গোটা দলটির খোরাকি দিতে হয়েছিল।

আমাদের ছোটোদের কাছে যাত্রাদলের ‘মেয়েদের’ আচার আচরণ মহাবিস্ময়ের ছিল। যাত্রাপালায় দুই দৃশ্যের মধ্যে কোনও বিরতি থাকে না। আগের দৃশ্যের পাত্রপাত্রীরা বেরিয়ে আসতে না আসতেই পরবর্তী দৃশ্যের পাত্রপাত্রীরা মঞ্চে উঠে পড়ে। চারদিক খোলা যাত্রা মঞ্চের এক কোণায় যেখানে মঞ্চে ওঠার সিঁড়ি সেখান থেকে মাঠের শেষ প্রান্তে অফিসার্স ক্লাব ও পরে প্রাইমারি স্কুলের ব্যারাকবাড়িতে সাজঘর পর্যন্ত দুধারে লম্বা টানা বাঁশ বেঁধে পাত্রপাত্রীদের যাওয়া আসার জন্য একটা প্যাসেজ তৈরি হত। পালা চলতে থাকলে এই প্যাসেজের শেষ প্রান্তে সিঁড়ির কোণায় পরবর্তী দৃশ্যের শিল্পীরা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতেন যাতে প্রবেশে দেরি না হয়। অনেক সময়ই দেখা যেত প্যাসেজে পালার রানি বা রাজকুমারী অথবা রাজমাতা বিড়ি ধরিয়েছেন। কোনও মহিলা, তাও আবার রানি মহারানির মতো সম্ভ্রান্ত কেউ ধূমপান করতে পারেন অভাবনীয়। সেই বালক বয়সে আমরা জানতাম না সবেদা গুঁড়ো মেটে সিঁদুর লাল সিঁদুর ও ভুষো কালিতে তেল গুলে সাজা অপরূপারা কেউই মেয়ে নয়। কত যুবকও তো পালা গানের ‘পুরুষ নায়িকার’ প্রেমে পাগল হয়েছে। যাত্রাপালার রাজকুমারীকে বিয়ে করে মদন নামে গল্পের যুবকের পরিবারে যে বিপর্যয় ঘটেছিল শালীনতার সীমা লঙ্ঘন না করে তা বর্ণনা সম্ভব নয়। নিউ রয়্যাল বীণা অপেরার ফণীরানির (ফণী ভট্টাচার্য) অভিজ্ঞতা কিন্তু গল্প নয়। সে কালের যাত্রার পুরুষ নায়িকারা পুরুষেরই লেখা বহু প্রেমপত্র পেতেন। বাংলাদেশের এক রাজনৈতিক নেতার ছেলে যে-কোনও মূল্যে ফণীরানিকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়েছিল। পালা শেষে গরুর গাড়িতে এক গ্রাম থেকে অপর গ্রামে যাওয়ার পথে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়াও হয়। এটা সম্ভবত ১৯৭০-এর ঘটনা। তখন আমরা এপার বাংলায়। যতদুর মনে হয় কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাখা ভারতীয় গণনাট্য সংঘই প্রথম তাদের ‘রাহুমুক্ত’ যাত্রাপালায় নারী চরিত্র মহিলা শিল্পীদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছিল। নট্ট কোম্পানি দীর্ঘদিন চেষ্টা করেছে নারী-বর্জিত দল গঠন করতে। অবশেষে সময়ের দাবিতে তাদেরও রক্ষণশীলতা ছাড়তে হয়। জনপ্রিয়তার ভাঁটা পড়লে ছায়াছবির নায়িকারা এখন যাত্রাদলে নাম লেখান। অবশ্য এক কালের ‘যাত্রাসম্রাজ্ঞী’ বয়স বাড়ার পর টিভি সিরিয়ালে ছোটোখাটো অভিনয় করেছেন এমন দৃষ্টান্তও আছে। রূপালি পর্দা এবং চারিদিকে খোলা মঞ্চের নায়করাও মাধ্যম পরিবর্তন করেছেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নতুন মাধ্যমে তারা যেন কিছুটা আড়ষ্টই বোধ করেছেন। ব্যতিক্রমও আছে। গায়ক নট সবিতাব্রত দত্ত ছিলেন ছবির পর্দায় ও মাঠের যাত্রায় সমান স্বচ্ছন্দ। ছায়াছবিতে মুকুন্দদাস রূপী সবিতাব্রতের গলায় ছেড়ে দাও রেশমী চুড়ি বঙ্গনারী কভু হাতে আর পোরো না’ এবং রাহুমুক্ত যাত্রায় তার বিবেকের গান ‘জাগছে, মানুষের ভগবান জাগছে’ অথবা ‘ওরে কার গলা তুই ধরবি টিপে সে গান ছড়িয়ে গেছে’ দর্শকদের সমান উদ্দীপ্ত করত।

যাত্রাপালায় নারীর চরিত্রে পুরুষের অভিনয়ে কখনও কখনও যে হাসির রোল উঠত তার একটি দৃষ্টান্ত দেওয়ার লোভ সংবরণ করা যাচ্ছে না। অভিজ্ঞতা যদিও এপার বাংলার। ১৯৫০-৬০-এর দশকে কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে কলকাতার ইডেন উদ্যানে প্রতি তিন বছর অন্তর যুব উৎসব হত। দেশে বিদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনে ভাঙনের পর এই উৎসব বন্ধ হয়ে গেছে। সাধারণত জুন মাসের গোড়ায়ান’দিনের এই উৎসবের এক বড়ো বৈশিষ্ট্য ছিল লোকশিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা। পূর্ণদাস বাউলের মতো বহু লোকশিল্পীই ইডেনের মাঠেই প্রথম পাদপ্রদীপের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনেরও অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তা হলেও বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনের লোক সংস্কৃতিকে যেন কিছুটা শোকেসে সাজানো কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল মনে হত। সেদিক থেকে ইডেনে গ্রামীণ শিল্পীরা আসতেন প্রকৃতই ঘষামাজা বিহীন গায়ে মেঠো গন্ধ নিয়ে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নির্মলেন্দু চৌধুরী, ডঃ ভূপেন হাজারিকারা নিশ্চয়ই ব্যতিক্রম ছিলন। তবে লোকসংগীতের এই দিকপালদের অনুশীলন পর্বের সাক্ষী আমি নই। ন’দিনের দু’দিন যুব উৎসব চলত রাতভোর। একদিন মুশায়ারা ও উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর। অন্যদিন যাত্রাপালা। সেবারের পালা ছিল আর্য অপেরার ‘বাঙালি’। সে সময় খুবই জনপ্রিয়। দল হিসেবেও আর্য অপেরার খুবই নামডাক। নট্ট কোম্পানির সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিতে পারে। কাজেই সেদিন যাত্রার আসরে প্রচুর ভিড় হয়েছিল। আমরা মঞ্চ থেকে বেশ কিছুটা দূরেই ঘাসের ওপর বসে দেখতে কিছুটা অসুবিধাই হচ্ছিল। যাত্রাপালার বিশেষ ঘরানায় পাত্রপাত্রীদের উচ্চগ্রামের সংলাপে বাঙালির গৌরব গাথায় মগ্ন হয়ে আছি। আকস্মিক এক দৃশ্য শেষে ‘নায়িকা’ রাজকুমারী একটি মর্মস্পর্শী সংলাপ বলে ছুটে মঞ্চ ছেড়ে চলে যেতেই সামনে বসা দর্শকদের মধ্যে হাসির রোল উঠল। আমরা যারা দূরে তাদের কাছে হাসির কথার তাৎক্ষণিক বোধগম্য হয়নি। বুঝলাম যখন পরের দৃশ্যের মুখ্য অভিনেতা পালার সেনাপতি দ্রুত মঞ্চে উঠতে গিয়ে পায়ে কিছু জড়িয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন এবং উঠে রাগে গরগর করতে করতে কোমর থেকে তলোয়ার খুলে নিয়ে মুক্ত অসির ডগায় তুলে সেটিকে দর্শকদের মধ্যে ছুঁড়ে দিলেন। বস্তুটি আর কিছু নয়। কাপড়ের তৈরি নকল স্তন যা হিন্দি সিনেমায় এখন জনি লিভারের মতো কমেডিয়ানদেরই নয় বিগ ‘বি’ অমিতাভ বচ্চন থেকে শুরু করে গোবিন্দ কমল হাসানের মতো নামী হিরোদেরও হামেশাই পরতে দেখা যায়। আগের দৃশ্যে ‘নায়িকার’ বুক থেকে সেই নকল স্তন খুলে পড়ে গেছিল। সেনাপতির বীরত্বে এবার গোটা ইডেন জুড়েই হাসির হুল্লোড় পড়ে যায়। লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসের যাত্রার আসরে এমন বাস্তব কমিক সিচুয়েশন কোনোদিন তৈরি হয়নি। যা হাসাবার হাসাতেন বিদূষকরাই। সেকালের প্রতিটি যাত্রা পালাতেই একটি বিদূষক চরিত্র আবশ্যিক ছিল। জনশ্রুতি, দলের অধিকারীরাই নাকি ওই চরিত্রের অভিনেতা। যেমন মনে করা হয় সার্কাসের জোকার কেবল কুশলী খেলোয়াড় নন অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনিই ট্রেনার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *