আমার দেশ আমার বিদেশ – ১০

দশ

বাড়ি যাওয়ার জন্য আমাদের নামতে হত ফরিদপুর জেলার মাদারিপুরে। সেখান থেকে নৌকোয় বাঁকাই গ্রাম। স্টিমারে প্রায় দেড়দিন স্বপ্নের মতো কেটে যেত। কি জানি কেন স্টিমার সাধারণত মাঝ নদী দিয়ে চলত না। চলত কোনও একটা ধার ঘেঁসে। এতে নদীর পারের একের পর এক গ্রাম, গাছপালা, মানুষজন, কোথাও কোথাও বাজার হাটও দেখতে পেতাম। তবে দূরত্বের কারণে চোখের দৃষ্টিতে বেশ কিছুটা ছোটো। অনেক সময় লোকজনের অবয়বও খুব স্পষ্ট বোঝা যেত না। মুসলমান ধর্মের বিধান অনুযায়ী পুরুষদের থুতনিতে নুর রাখা আবশ্যিক। ‘আল্লায় দিচ্ছে নুর, না ছোঁয়াইও ক্ষুর, হাত আর কেচি (কাঁচি) দিয়া পারো যত দূর’। পূর্ববঙ্গে দেখেছি বারবারই অধিকাংশ মুসলমান ধর্মের অনুশাসন মেনে দাড়ি রাখায় নিস্পৃহ। সুতরাং দাড়ি দেখে হিন্দু মুসলমান বিভেদ করা যেত না। ধর্মীয় পরিচয় জানতে পথে ঘাটে শোনা যেত ‘আপনে মিঞা না মশয়’ প্রশ্ন। আমাদের ছোটোদের কাছে ব্যাপারটা ভারী মজার ছিল। নবলব্ধ জ্ঞানটি আমরা স্টিমার থেকে নদীর পাড় ধরে হেঁটে যাওয়া মানুষজনের উদ্দেশে চেঁচিয়ে ছুঁড়ে দিতাম। সন্দেহ নেই আমাদের রিনরিনে গলায় ‘আপনে মিঞা না মশয়’ প্রশ্ন উদ্দিষ্ট ব্যক্তি শুনতে পেতেন না। শুনলেও নিশ্চয়ই উপেক্ষা করতেন। বিশালতার কারণে অধিকাংশ নদীরই পাড় প্রায় অদৃশ্য, বড়ো জোর কোথাও কোথাও অনেক দূরে দেখা যেত অতি সরু দিগন্তরেখাটি। সেখানে আকাশে জলে মেশামেশি। কখনও কখনও আকাশে উড়ে যেত এক ঝাঁক পাখি কত কে জানে। ‘যাচ্ছি যত ফিরব তত, তার অর্ধেক তার পাই, তোমায় নিয়ে একশত ভাই’ তো যাদব চক্রবর্তীর পাটিগণিতের ধাঁধা। কখনও আবার কোনও মহাজাদুবলে পাখিরা জলেরই ওপর নেমে পড়ত, নদীর ঢেউ-এর মাথায় চেপে নদীরই সঙ্গে এগিয়ে যেত। এরা কিন্তু ‘জলে সাঁতার কাটত না। স্রেফ ভেসে থাকত। নদীর স্রোতই তাদের ঠেলে নিয়ে যেত। মাঝেমধ্যে কোনও দলছুট পাখি স্টিমারের মাথায় এসেও বসত। তখনও কোলরিজের এনসিয়েন্ট মেরিনার পড়া হয়নি। পড়া থাকলে হয়ত এই পাখিই সেই অমঙ্গলের আগাম বার্তাবাহী অ্যালব্যাট্রাস ভেবে নিয়ে ভয়ে সিঁটিয়ে যেতাম। আমাদের চিন্তা হত এই দলছুট পাখি একা পথ চিনে নিজের আত্মীয় বান্ধবদের মধ্যে ফিরে যেতে পারবে তো?

নদীতে মাঝে মাঝেই চোখে পড়ত লঞ্চ ও নানা আকারের নৌকো। কখনও পাশাপাশি একই দিকে কখনও বিপরীতমুখী। একই দিকে চললে বেশ কিছুক্ষণ দুইয়ের গতির প্রতিযোগিতা দেখা যেত। স্টিমার খুব গতিশীল যান নয়। বরং ছোটো লঞ্চই কখনও কখনও স্টিমারকে হারিয়ে দিয়ে এগিয়ে যেত। কোনও নৌকোই সেটা পারত না। বরং স্টিমার আসতে দেখলে নৌকো নদীর পাড়ের কাছাকাছি সরে যেত। স্টিমারের বিশাল বিশাল দুটি চাকা যেভাবে নদীর জলে ঢেউ তুলত, নৌকা ছোটো হলে সেই ঢেউয়ের ধাক্কায় উল্টে যাওয়ার আশঙ্কা তো থাকতই। এক ধরনের বিশাল নৌকোকে বলা হত গয়নার নৌকো। আকারে যে-কোনোও ঘরের চেয়ে বড়ো। দশ বাই বারো ফুট অথবা আঠারো বাই চোদ্দ ফুট অন্তত। গলুইয়ে পিতলের গহনা বসানো। এগুলি দূরপাল্লার যাত্রীবাহী। একবার সওয়ারিও করেছি বোধ হয় মামাবাড়ি যেতে। লঞ্চ ডুবি হত না এমন নয়। ঝড় বৃষ্টির সময় নদী মাতাল হয়। দক্ষিণ বাংলার সুন্দরবনের যে অংশ আছে সেখানে একটি নদীর নামই মাতলা। পূর্ববঙ্গের নদীগুলিতে পলি জমে এখন নাব্যতা অনেক কম। বাংলদেশ সরকারের অভিযোগ ফরাক্কা বাঁধের জন্যই তাদের নদীগুলি শুকিয়ে যাচ্ছে। ভারত-বাংলাদেশ গঙ্গার জলবণ্টন চুক্তিও দুদেশের মধ্যে টানাপোড়েনের অবসান করতে পারেনি। নদীর গভীরতা এখন অনেক কম। তা হলেও প্রতি বছরই বর্ষাকালে বাংলাদেশে একাধিক লঞ্চডুবিতে বহু মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। অন্তত একবার ঝড় বৃষ্টির মধ্যে পূর্ববঙ্গের নদীতে লঞ্চে সফর করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। যাচ্ছিলাম নারায়ণগঞ্জ থেকে পাতানো কাকা প্রভঞ্জন দত্তর বাড়ি ব্রিক্রমপুরে। ঝড় বৃষ্টির দাপটে লঞ্চ একবার বাঁয়ে হেলে আবার ডাইনে। প্রায় নদীর ছুঁই ছুঁই অবস্থা থেকে যেন মন্ত্রবলে লঞ্চ আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ভেতরে তখন ভীত-ত্রস্ত যাত্রীদের মধ্যে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার শুরু হয়েছে। মেয়ে ও শিশু যাত্রীদের মধ্যে কান্নার রোল। অবুঝ যাত্রীদের হুড়োমুড়িও সেদিন বিপদ বাড়িয়েছিল। সারেঙ ও মাল্লাদের কোনও আবেদন নিবেদনেই আতঙ্কগ্রস্ত যাত্রীদের শান্ত করা যাচ্ছিল না। উল্টে কোনও কোনও যাত্রী সারেঙ ও মাল্লাদের ওপর চোটপাট শুরু করে দেন। পাড়ে ভেড়াও, মালপত্র সব ফেলে দিয়ে লঞ্চের বোঝা কমাও। এটা করো, সেটা করো উপদেশ তো ছিলই। এর মধ্যে একমাত্র মা-ই ছিলেন নির্বিকার। তিনি দু-হাত দিয়ে আমাদের ভাইবোনেদের জড়িয়ে ধরে নিশ্চুপ বসেছিলেন। যেমন করে পাখি মা তার শাবকদের ডানা মেলে আগলে রাখে। বৃষ্টি আর নদীর জলে আমাদের জামাকাপড় গা মাথা সব ভিজে জবজবে। ধুতি অথবা শাড়ি কী যেন একটা বাক্স থেকে বের করে নিয়ে মা যতটা সম্ভব বারবার আমাদের গা মাথা মুছিয়ে দিচ্ছিলেন। মা জানতেন ওই পরিস্থিতিতে তার কিছু করার ছিল না। তিনি অস্থির হলে আমাদের আতঙ্ক বাড়বে। আমাদের পরিবারে বহুবার বহু ঝড়ঝাপটা এসেছে। প্রতিবারই দেখেছি অতি ধীর স্থিরভাবে মা সমস্ত প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছেন। আর সেটাই ছিল আমাদের সবচেয়ে বড়ো মানসিক শক্তি। সেদিনও শেষ পর্যন্ত কোনও বড়ো বিপদ ঘটেনি। যাত্রীদের কাছে অনন্তকাল মনে হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই ঝড় বৃষ্টি হয়ে নদী আবার শান্ত হয়েছিল। লঞ্চও গন্তব্য স্থলে পৌঁছেছিল নিরাপদেই। দেশের বাড়ি যাওয়ার পথে শরতের আচমকা বৃষ্টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু স্টিমারে কোনও বড়ো ধরনের ঝড় বৃষ্টির মধ্যে একবারও পড়তে হয়নি। যদিও শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসে ‘কাপ্তেন কইছে সাইক্লোন হতি পারে’ পড়ার সময় মনে হয়েছে একবার সাইক্লোনের অভিজ্ঞতা হলে মন্দ হত না।

গঙ্গা যমুনা এবং অন্তঃসলিলা সরস্বতীর সঙ্গম ক্ষেত্র প্রয়াগের কথা জানে না এমন ভারতীয় খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। প্রয়াগে কুম্ভমেলার কারণে তিন নদীর এই সঙ্গম আন্তর্জাতিক পরিচিতি লাভ করেছে। কালকূট কলম নামে সমবেশ বসুর অমৃত কুম্ভের সন্ধানে উপন্যাস ও পরে তার বাণিজ্য সফল চিত্রায়ণ বাঙালীর প্রয়াগমুখী করেছে এমন কথা বলা বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। তেমন পরিচিতি হয়ত নেই। ওপার বাংলাতেও কিন্তু মেঘনা ধলেশ্বরী দুই নদী দীর্ঘ পথ গলাগালি করে বয়ে চলেছে। গঙ্গা যমুনা ও অন্তঃসলিলা পদ্মা সরস্বতীর সঙ্গমস্থল প্রয়াগের সঙ্গে ধর্ম মিশে আছে। এই সঙ্গমকে ভিত্তি করেই রচিত হয়েছে জনপ্রিয় পৌরাণিক কাহিনি। সর্বোপরি প্রয়াগেই সম্ভবত বিশ্বের সর্ববৃহৎ মেলা হয়। তবু ভিন্নভাষী রাজ্যে হাওয়ায় আমাদের বাংলাভাষীদের যেন কিছুটা দূর সম্পর্কের। ভাষার বন্ধনেই ভিন্ন দেশে হলেও মেঘনা ধলেশ্বরীর প্রেম বন্ধনই হতে পারে আমাদের প্রিয়তর। আন্তর্জাতিক খ্যাতি না থাকলেও প্রয়াগে যুক্তবেণীর খ্যাতি মুখে মুখে ফিরলেও আদিসপ্তগ্রামে গঙ্গা যমুনা সরস্বতীর মুক্তবেণীর সন্ধান কতজন রাখেন? ছোটো বয়সে বাসাবাড়ি থেকে দেশের বাড়ি যাওয়ার সময় মেঘনা ধলেশ্বরীকে দীর্ঘপথ পাশাপাশি বয়ে যেতে দেখেছি। ওই দৃশ্য দেখার জন্য গোটা স্টিমারের যাত্রীরাই তখন রেলিং ধরে ঝুঁকে থাকতেন। মেঘনার জল ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, ধলেশ্বরী ধবল। ওই ছোটো বয়সে কোথায় দুইয়ের মেলবন্ধনের শুরু কোথায় মুক্তি সে ভূগোল জানার কৌতূহল ছিল না। পুঁথিগত বিদ্যাও স্কুলস্তর ছাড়ায়নি। ভূগোলের স্কুলপাঠ্য বইয়ে মেঘনা ধলেশ্বরীর সঙ্গমের উল্লেখ চোখে পড়েনি। ওপার বাংলার সাহিত্যসেবীদের লেখা পড়ার সুযোগ খুবই কম হয়েছে। যা পড়েছি তাও অনিয়মিত। তা থেকে জানতে পারিনি মেঘলা ধলেশ্বরীর মিলনকে ভিত্তি করে কোনও পৌরাণিক অথবা লোককাহিনি আছে কিনা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার অর্ধেক জীবনে ওপার বাংলার স্মৃতির উল্লেখ করেছেন। নীরোদ সি চৌধুরীর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ‘অ্যান অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’-এওআছে অনেক কথা। দুজনের একজনও কিন্তু মেঘলা ধলেশ্বরীর উল্লেখ করেননি। অন্য কেউ করে থাকলে জানা নেই। যদি কোনও পৌরাণিক অথবা লোককথা নাও থেকে থাকে তা হলেও কল্পনা করে নিতে ক্ষতি কি। মেঘনা এক কৃষ্ণকায় মুসলমান যুবক, ধলেশ্বরী গৌরবর্ণা হিন্দু যুবতি। চলার পথে তারা কোথাও একজন আর একজনকে ভালোবাসল। একসঙ্গে চলার প্রতিজ্ঞা করল। এ নিয়ে দুই সম্প্রদায়েরই মৌলবাদীদের প্রচণ্ড আপত্তি। আপত্তি থেকে বিরোধ, বিরোধ থেকে দাঙ্গা। অবশেষে মেঘনা ধলেশ্বরীই তাদের প্রেমকে নিজেরাই বলি দিয়ে সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনল। স্থায়ী সম্প্রীতি কি ফিরল? এ কাহিনি যদি পছন্দ নাও হয় তা হলেও মেঘনা ধলেশ্বরীর পাশাপাশি দীর্ঘ পথ অতিক্রমের নৈসর্গিক শোভা দেখার অভিজ্ঞতাও বড়ো কম সম্পদ হবে না।

তারপাশার হোটেলের কথা না বললে নারায়ণগঞ্জ থেকে মাদারিপুর স্টিমার সফরের সুখ স্মৃতি বর্ণনা অসম্পূর্ণ থাকবে। শুধু তারপাশা নয়, নদীপথের সমস্ত মধ্যবর্তী স্টিমারঘাটেই একাধিক হোটেল ছিল। এসব হোটেলে কোনও তাড়ার বালাই নেই। এগুলি ছিল বাঁশের খুঁটির ওপর ছন অথবা খড়ের ছাউনি এবং পাটকাঠির বেড়া দেওয়া লম্বা চালাঘর। বসার জন্য মাটিতে ছোটো ছোটো চৌকো পাটির আসন। প্রতিটি আসনের মাথার ওপর বেড়ায় নম্বর লেখা। খাবার দেওয়া হত দুখানা কলার পাতায়। হিন্দুরা পাতা পাততেন চিৎ করে মুসলমানরা উপুড় করে। মাটির গ্লাসে জল। এগুলি ছিল পাইস হোটেল। হোটেলে ঢুকতেই মুখোমুখি পাটকাটির বেড়ায় কালো রঙের টিনের বোর্ডে দিনের খাদ্য তালিকা ও দাম লেখা থাকত। মালিক হিন্দু হলে হোটেলের নাম হত হিন্দু দেবদেবীর নামে। আবশ্যিক ভাবেই হিন্দু উল্লিখিত হত। শ্রীদুর্গা হিন্দু হোটেল, মা তারা হিন্দু হোটেল, শিবদুর্গা হিন্দু হোটেল এই রকম। কোনও কোনও হোটেলে অতিরক্ত লেখা থাকত ‘ব্রাহ্মণের রান্না খাদ্য পরিবেশিত হয়।’ কোনও হোটেলের নামের আগে মুসলমান লেখা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তবে তাজ হোটেল, আজাদ হোটেলের মতো নামেই মালিকের ধর্মীয় পরিচয় পাওয়া যেত। স্টিমার ঘাটে ভিড়লেই মাল্লারা ভারী ভারী কাঠের পাটাতন ফেলে অস্থায়ী জেটি বানিয়ে ফেলতেন। তারা লম্বা লম্বা বাঁশ আড়াআড়ি ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকতেন। ওইগুলিকে হাতল হিসেবে ব্যবহার করে যাত্রীরা নিরাপদে পাড়ে নেমে যেতেন। বড়ো বড়ো স্টিমারঘাটে পাশাপাশি পাতা কাঠের পাটাতনের ওপর কয়ার ম্যাটও পেতে দেওয়া হত। যাত্রীরা ওই অস্থায়ী জেটি দিয়ে নেমে এসে হুড়মুড় করে যে যার পছন্দের হোটেলে ঢুকে পড়তেন। হোটেল কর্মীদের ডাকাডাকি, হাত ধরে টানাটানি, যাত্রীদের তাড়াহুড়ো সব মিলিয়ে স্টিমারঘাটে কিছুক্ষণ হইহুল্লোড় পড়ে যেত। হোটেল আজ যেখানে আছে বরাবর সেখানেই থাকবে এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। বর্ষায় নদী ফুলেফেঁপে অনেক দূর পর্যন্ত প্লাবন ঘটায়। শীতে সেই নদীই শীর্ণকায়া, জল নেমে গিয়ে বিশাল চরা জেগে ওঠে। নদীর সঙ্গে সঙ্গে স্টিমারঘাটের চালাঘরের হোটেলকেও আগুপিছু করতে হয়।

সফরের দ্বিতীয় দুপুরে আমরা তারপাশায় হোটেলে মুসুর ডাল, ইলিশ মাছ, ভাত খেতাম। এখানে স্টিমার কিছু বেশি সময় থামতো। পেটে যখন বিশ্বের খিদে তখন মসুর ডাল আর নদীর জলে পার্থক্য করা যায় কি না অথবা ইলিশ মাছে তেল পড়েছে কিনা তা নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন ছিল না। পদ্মা নদীর মাঝিতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছেন তেল ছাড়াও ইলিশ মাছ রান্না করা যায়। মাছের তেলে মাছ ভাজা প্রবাদটি ইলিশকে মনে রেখেই এমন ভাবলে ভুল হবে না। ভুল হবে যদি ভাবা হয় ইলিশ শুধু বাঙালদেরই প্রিয় মাছ। যদিও এই ভুল ভাবনাটি আজও দূর হয়নি। পঞ্চাশের দশকে জনপ্রিয় রোমান্টিক জুটি উত্তম-সুচিত্রার একটি ছবিতে ঘটি বাঙালদের ঝগড়া মেটাতে দুই প্রতিবেশী পরিবারের পংক্তি ভোজে চিংড়ি ইলিশ দুইয়েরই ব্যবস্থা নয় থাকল। তাই বলে একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় বছরেও ঘটি বাঙালদের ঝগড়াকে থিম করে ছবিই বা হবে কেন আর তার নামই বা দেওয়া হবে কেন চিংড়ি ইলিশ। নামের কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল। আজকাল তো ‘বাবা কেন চাকর’-ও বাংলা ছবির নাম হয়। কিন্তু ইলিশ যদি বাঙালদেরই মাছ হয় তাহলে কোলাঘাট গঙ্গার ইলিশ কারা খেতেন। এখন কিন্তু পার্ক স্ট্রিটের অভিজাত রেস্তোরাঁগুলিতেও ক্র্যাব ফেস্টিভ্যাল, মাশরুম ফেস্টিভ্যালের মতো হিলশা ফেস্টিভ্যালও হয়। তবে হ্যাঁ, পদ্মার ইলিশ নিয়ে পূর্ব বাঙালদের উচ্ছ্বাস আদিখ্যেতার পর্যায়েই হয়ত পড়ে। আমার দাদার কাছেই ইলিশের প্রসঙ্গ তুললে হাজারটা গল্প শুনিয়ে দেবেন। দাবি করবেন দেশের বাড়িতে সাড়ে তিন পয়সা দিয়ে তিনি বাজারের সবচেয়ে বড়ো ইলিশটি কিনেছিলেন যার ওজন দেড়-দু’সের হবে। তবু ঠাকুমার মনে হয়েছে তার অনভিজ্ঞ নাতিটি ঠকে এসেছে। ওই একই দিনে নোয়াকর্তা (জ্ঞাতি দেওর) চার পয়সায় জোড়া ইলিশ এনেছেন।

আমি নিজে সাড়ে তিন পয়সায় দেড়-দুসের হোক অথবা চার পয়সার জোড়া ইলিশ কোনোটাই কিনিনি। ফুটো তামার পয়সা দেখলেও আধলা কখনও দেখিনি। তবে পঞ্চাশের দশকে এক সরস্বতী পুজোয় হাতিবাগান বাজার থেকে তিনটাকা সের দরে জোড়া ইলিশ কিনেছিলাম মনে করতে পারি। এখন তেমন মাছ হলে এক কেজি পাঁচশো টাকাতেও বিক্রি হয়। পূর্ব-বাঙালরা আজও অনেকেই সরস্বতী পুজোয় জোড়া ইলিশ ঘরে তোলার রীতি বজায় রেখেছেন। বিজয়া দশমীর দিনে বছরের শেষ ইলিশ খাওয়া। যারা এই রীতি প্রবর্তন করেছিলেন তাদের দূরদৃষ্টির প্রশংসা করা উচিত। আশ্বিন-কাতির্ক মাসেই ইলিশ পূর্ণবয়স্কা, তার পেট-ভর্তি ডিম। এই গর্ভবতী ইলিশ মেরে খাওয়ার অর্থ লক্ষ-হাজার ইলিশের বংশবৃদ্ধির সম্ভাবনা ভ্রূণেই হত্যা করা। মাঘে ইলিশের সবে কৈশোর। অন্তত দুটো না হলে পরিবারের সকলের পাতে এক টুকরো পড়া কষ্টকর। অত্যাধিক ইলিশ প্রীতির কারণে দাদার একবার জীবন সংশয় হয়েছিল। আমরা দেশ-ছাড়ার পরেও নতুন দেশে নতুন চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত দাদাকে বেশ কিছুদিন সেই লক্ষ্মীনারায়ণেই কাজ করতে হয়েছিল। পুজোর ছুটিতে আগের মতো দেশের বাড়ি যাওয়ার ব্যাপার ছিল না। দাদা আসতেন এক কামরার পূর্ব কলকাতার উল্টোডাঙায় ভাড়া বাড়িতে, মা ভাইবোনদের কাছে। সঙ্গে নিয়ে আসতেন পদ্মার ইলিশ। নারায়ণগঞ্জ থেকে গোয়ালন্দ স্টিমারে, গোয়ালন্দ থেকে শিয়ালদহ রেলগাড়িতে। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় বরিশাল এক্সপ্রেস নামের সেই সবুজ স্বপ্নের ট্রেনটি বন্ধ হয়ে গেছে। ১৯৭১-এ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার পর থেকেই দুই বাংলার মধ্যে ফিরে রেল চলাচল শুরু হওয়ার কথা চালাচালি চলছে। কিন্তু শুরু হয়নি। শুরু হলে অবশ্যই ধর্মের প্রাচীর ভেঙে এপার ওপারের বাঙালির সখ্য নিবিড়তর হত।

গোয়ালন্দে ছিল পদ্মার ইলিশের বড়ো আড়ত। গোয়ালন্দে পৌঁছে ট্রেনে সহযাত্রীর কাছে সুটকেস জিম্মা করে দিয়ে দাদা ইলিশ কিনতে আড়তে ছুটতেন। মাছ কিনে কেটে নুন মাখিয়ে মাটির হাঁড়িতে সেই মাছ নিয়ে ট্রেনের কামরায় বসার পরে তবে নিশ্চিন্ত। সেবারে মাছ কিনতে কিছু দেরি হয়েছিল। স্টেশনের মুখে পৌঁছে দেখেন ট্রেন চলতে শুরু করেছে। দাদা প্রাণপণ ছুটেও পৌঁছোনোর আগেই ট্রেন প্লাটফর্ম পার হয়ে যায়। ট্রেনে সহযাত্রীর কাছে শুধু সুটকেস নয়, ওই সুটকেসেই পাসপোর্টও। ঊর্ধ্বশ্বাসে দাদা লাইন ধরে ছুটতে লাগলেন ট্রেনের পেছন পেছন। কি কারণ জানা নেই, সে সময় বরিশাল এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন কিছুদূর পর্যন্ত পেছন দিকে থাকত, পেছন থেকেই ট্রেনকে সামনের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হত। হয়ত সেদিন ইঞ্জিনের ড্রাইভার অথবা কোনও খালাসি হঠাৎই দেখে থাকবেন ট্রেনের পেছনে একজন কেউ প্রাণপণ ছুটছে। করুণা বশেই হয়ত ড্রাইভার ট্রেনের গতি বাড়াননি। তা হলেও দাদা যখন ইঞ্জিনের কাছাকাছি পৌঁছেছেন তখন তিনি তার শক্তির শেষ সীমায়। রেল ইঞ্জিনের এক খালাসির বাড়ানো হাত ধরে ফেলতে না পারলে লাইনের ওপরই মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতেন। ওই খালাসিই তাকে টেনে ইঞ্জিনে তুলে নেন। পরে যখনই এ নিয়ে কথা উঠেছে মহা আত্মতুষ্টির সঙ্গে দাদা বলেছেন যত বড়ো কারণই হোক হাতে ঝোলানো ইলিশের হাঁড়ি তিনি ছাড়েননি। পূর্ব-বাঙালদের ইলিশ প্রীতির পরিচয় পেতে এই গল্প প্রাসঙ্গিক।

এমনিতেই সেকালের লোক ভাত পরিমাণে কিছু বেশিই খেতেন। তার ওপর ইলিশ হলে তো কথাই নেই। তারপাশার হোটেলে বারবার ভাত ঝোলের চাহিদা উঠত। এতে মালিকের মুনাফায় টান পড়ে। সারঙের সঙ্গে ব্যবস্থা করতে হয় মাঝে মাঝে স্টিমার ছাড়ার হুটার বাজানোর জন্য। বলা নিষ্প্রয়োজন নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই। ভোঁ বাজলেই হোটেল মালিক তাড়া দিতেন দেরি করলে স্টিমার ছেড়ে যাবে। বাস্তবিক অনেককেই খাওয়া ফেলে পড়িমরি স্টিমারের দিকে ছুটতেন। কিন্তু অভিজ্ঞ যারা তারা বলতেন আরে ছাড়ে ছাড়ুক আমরা পরের স্টিমারেই যামু।

এগারো

মাদারিপুরে স্টিমার পৌঁছাত ভোররাতে। বাঁকাই গ্রামে যাওয়ার জন্য তারপরেও কিছুটা পথ নৌকোয় যেতে হবে। দাদা বলেন ভোরের আলো না ফোটা পর্যন্ত স্টিমারঘাটেই অপেক্ষা করা হত। শেষ রাত হলেও অন্ধকারে অচেনা মাঝিদের সঙ্গে চলা নিরাপদ নয়। পূর্ববঙ্গের নৌকোর মাঝিদের কেউ কেউ সুযোগ পেলে সওয়ারির সর্বস্ব কেড়ে নিত এমন অভিযোগ ভিত্তিহীন ছিল না। একবার ফিরতি পথে আমাদের নৌকার মাঝি নিজেই স্বীকার করছিলেন উজিরপুরে মামাবাড়ির এঁদোপুকুর পাড়ে রাত্রে মাণিক্যমালাকে যারা খুন করেছিল সেও তাদের একজন ছিল। মাণিক্যমালা অনুনয় করেছিলেন যে তাকে খুন করার জন্য যত টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তিনি তার দ্বিগুণ টাকা তো দেবেনই, অধিকন্তু গলার আটভরি সোনার হারও দেবেন। কিন্তু আততায়ীদের দ্বিগুণ টাকা ও আটভরি সোনার লোভ ছাড়তে হয়েছিল কারণ ‘ঠাইরেণ আমগো চিইন্যা ফেলাইছিলেন। হ্যাসে (শেষে) অতি লোভ কইরা হাজতে যামু?’ কিন্তু আমার যেন মনে পড়ে আমরা মাদারিপুর পৌঁছোতেই নৌকো করে বাড়ির দিকে রওনা দিতাম। ভোর হওয়ার আর তর সইত না। অবশ্য ভোর না হলেও রাত গভীরও নয়। নৌকো নদী ছেড়ে খালে পড়তেই দেখা যেত দু’পারের গ্রামে একটা দুটো লোক জেগে উঠে এদিক ওদিক যাচ্ছেন। কোনও খেয়াঘাট বা হাটে একটা দুটো রেড়ির তেলের টিমটিমে লম্ফ জ্বলছে। সেখানে বাঁশের মাচায় বসে এক দুজন লোক হুঁকোয় গুড়গুড় শব্দ তুলে তামাক টানছেন। সেখানে বাঁশের কেউ হয়ত ডেকে হাঁক দিয়ে জানতে চাইতেন, ‘কেডা যায়’। মাঝির ‘বাঁকাই চোধরি (চৌধুরি) বাড়ি জবাব শুনে দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল বড়কর্তা (বাবা প্রমোদরঞ্জন) নৌকায় আছেন কি না। দূর থেকেই বড়কর্তাকে ‘পেন্নাম’ (প্রণাম) জানাতেন। আমরা ছোটরা অবশ্য প্রায় গোটা পথটাই নৌকোর ছইয়ের তলায় ঘুমে কাদা না হলেও আধো ঘুমিয়ে আধো জেগে ঢুলছি। মাঝে মাঝে কানে আসত জলে দাঁড় পড়ার ছপাৎ ছপাৎ শব্দ, বৈঠা ঠেলতে ঠেলতে অন্ধকারে ভিন্ন নৌকার মাঝিকে চিৎকার করে সাবধান করে দেওয়া ‘আপন বাঁয়ে’।

কোনও কোনও বার মাদারিপুরেই আমাদের দুই জ্ঞাতি ঠাকুরদা দক্ষিণের বাড়ির মনোরঞ্জন জ্ঞানরঞ্জনদের সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। তাদের আমরা বড়ো তাউইমশাই, ছোটো তাউইমশাই ডাকতাম। দুজনেই আইনজীবী। ছোটো কুমুদরঞ্জন ঢাকা জজ কোর্টের সরকারি উকিল। আর্থিক দিক থেকে তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি স্বচ্ছল ছিলেন। আমরা স্টিমার ধরতাম নারায়ণগঞ্জ থেকে। তাউইমশাইরা আসতেন ঢাকা থেকে ভিন্ন স্টিমারে। কাজেই স্টিমারে দুই পরিবারের দেখা হওয়ার সুযোগ ছিল না। মাদারিপুরে দেখা হয়ে গেলে বাকি পথটা সেবার মহা হইচই করতে করতে যাওয়া হত। তাউইমশাইদের একান্নবর্তী পরিবার। জ্ঞানরঞ্জনের একমাত্র ছেলে গণেশ, আমাদের কুট্টিমামা, প্রায় দাদারই সমবয়সি ছিলেন। স্বভাবে বাবু প্রকৃতির। অল্প বয়সেই সব সময় তার পরনে থাকত ইস্ত্রি করা ধুতি এবং গিলে করা পাঞ্জাবি। মনোরঞ্জনের ছেলে ফটিক দাদার বড়ো। ফটিক জ্যেঠুর ফটো তোলার শখ ছিল। তার তোলা আমাদের বাড়ির দুর্গামূর্তির ফটো এখনও পারিবারিক অতীতের অমূল্য দলিল। ফটিক জ্যেঠু কিন্তু নিজে দীর্ঘজীবী হননি। জ্ঞানরঞ্জনের তিন মেয়ের দুজনের নাম মনে আছে। বেণু ও ইথা। আমার দিদি প্রতিমার সঙ্গে বেণু ঢাকা রেডিওর সংগীত শিল্পী ছিলেন। তাউইমশাইদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে সেবার মাদারিপুর থেকে বাঁকাই হই-হই করে পৌঁছে যেতাম। তাউইমশাইরা সঙ্গে কলের গান (গ্রামোফোন) নিয়ে যেতেন। হাতল ঘুরিয়ে চাবি দিয়ে চালাতে হয়। মাঝে মাঝেই মাইক্রোফোনের পিন পাল্টানো জরুরি। পথে নৌকোতেই সেই কলের গান বাজানো শুরু হয়ে যেত। কানা কেষ্টোর (কৃষ্ণচন্দ্র দে) গলায় দ্বিজেন্দ্রলালের গান ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার হতে কি সংগীত ভেসে আসে’ অথবা কাননবালার রবীন্দ্রসংগীত ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো, ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধ সুধা ঢালো’ এইরকম। তাদের একটা দোনলা বন্দুকও ছিল। দু-চারবার সেই বন্দুক থেকে ফাঁকা আওয়াজও করা হত। কলের গান আর বন্দুকের শব্দ শুনে আশপাশের গ্রামের মানুষ বুঝে যেতেন বাঁকাইয়ের চৌধুরী বাড়ির কর্তারা আসছেন। অনেকেই খালপারে এসে প্রণাম জানিয়ে যেতেন।

বাঁকাই গ্রামে ঢোকার মুখে ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তা থেকে বাড়ির সীমানা পর্যন্ত খালের অংশ নাকি চৌধুরী পরিবারের পূর্বপুরুষেরই কাটানো। উত্তর থেকে দক্ষিণে বাড়ির সীমানা পর্যন্ত গিয়ে পুবে বেঁকে গেছে। খালের এই অংশেই পুব পারে হাটখোলা, বর্তমান নাম ঘোষের হাট। চৌধুরী পরিবারেরই এজমালি সম্পত্তি। সপ্তাহে দুদিন হাট বসত, যতদূর মনে পড়ে মঙ্গল ও শনিবার। হাটবার ছাড়াও প্রতিদিন সকালেই ছোটোখাটো বাজার বসত প্রধানত মাছ ও কিছু আনাজপাতি নিয়ে। মনে আছে এক আনায় (ষোলো আনায় একটাকা) এক সের খাঁটি দুধ পাওয়া যায় এটা আমাদের কাছেই বিস্ময়ের ছিল। লক্ষ্মীনারায়ণ মিলস কোয়াটার্সে গোয়ালা প্রতি সকালে দুধ দিয়ে যেত। তার দাম ছিল চার আনায় একসের। পৌষসংক্রান্তিতে পায়েস পিঠের উৎসব। সেদিন দাম চড়ে যেত ছআনা সের পর্যন্ত। ১৯৫০ সালে কলকাতায় এসে উল্টোডাঙার খাটাল থেকে সামনে দাঁড়িয়ে দোয়ানো দুধ কিনতাম আট আনা সের। তবে হাটখোলার চার পয়সা সেরের দুধের স্বাদই ছিল আলাদা। দুধ জ্বাল দেওয়ার পর যে আধ ইঞ্চি পুরু সর পড়ত তার ওপর বড় দানার চিনি ছড়িয়ে খেলে কৃষ্ণনগরের সরভাজাকে হার মানাতে পারত। কলকাতার কোলে মার্কেটেরে সামনে তলা থেকে গলা পর্যন্ত একই মাপে যে সরু হাঁড়িতে খেজুর গুড় বিক্রি করে তেমনি হাঁড়িতে দুধ নিয়ে আসতেন মুসলমান গোয়ালারা। হাঁড়ির মুখে খেজুর পাতা দেওয়া। দুধে জল মেশানো হয়েছে সন্দেহ হলেই কোনও ডাক্তার বাবুর ডিসপেনসারি থেকে ল্যাক্টোমিটার এনে পরীক্ষা হত। জল মেশানো প্রমাণ হলে দুধ ফেলে দেওয়াই নয়, অপরাধীর কিছু চড়চাপড়ও জুটত। হাটখোলায় দু’জন অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তারের ডিসপেনসারি ছিল। আবগারি লাইসেন্স পাওয়া গাঁজা আফিমের দোকানও ছিল একটি। হাটখোলার বেশ কয়েকটি বড়ো বড়ো মুদিখানা ছিল। চাল ডাল তেল নুন মসলাপাতি ছাড়াও এগুলিতে বেনারসের তামাকও পাওয়া যেত। দোকানে সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই তামাকের ভুরভুর গন্ধ নাকে ঢুকত।

বাবা ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই ধূমপান বিলাসী। শহরে সিগারেট অথবা বিড়ি খেতেন। ধূমপানের মাত্রা এতই বেশি ছিল যে খরচ কমাবার জন্য কোপ পড়ত দেশলাইয়ের ওপর। ব্লেড দিয়ে আধখানা করে চিরে ত্রিশ কাঠির দেশলাইকে ষাট কাঠির করে ফেলতেন। এতে সত্যি কোনও ব্যবহারিক সাশ্রয় হত কিনা অথবা নেহাতই খেয়াল তা বলতে পারব না। গ্রামের বাড়িতে বিড়ি সিগারেট নয়। বাবা গড়গড়া অথবা হুঁকোয় বেনারসের তামাক সেবন করতেন। গুড়গুড় শব্দ তুলে রাজা যখন গড়গড়া বা হুঁকো টানতেন তখন গোটা বাড়িতেই বেনারেসী-তামাকের মোহময় গন্ধ। তবে তামাকের গন্ধ নয়, আমার আকর্ষণ ছিল গড়গড়ার শব্দের প্রতি। নল মুখে দিয়ে লুকিয়ে আমিও একবার পরখ করার চেষ্টা করছিলাম ওরকম শব্দ করা যায় কিনা, পারিনি। গলায় তামাকের জল ঢুকে হেঁচে কেশে অস্থির। নেহাত কপাল ভালো সেদিন ধরা পড়িনি। বাবার হুঁকো বসানো থাকত অপূর্ব শিল্পশৈলীর এক ফণা তোলা পেতলের গোখরোর মাথায়। তিনি মারা যাওয়ার পর মনসাদেবীর প্রতিভূ হিসেবে গোখরোটি বাড়ির ঠাকুরের আসনে জায়গা পেয়েছে। নারায়ণগঞ্জে শীতল্যক্ষা নদীর কিনারায় বাবাকে দাহ করার পর তার বন্ধুরা শ্মশানে সিগারেটের প্যাকেট ও দেশলাই রেখে এসেছিলেন। নীলচাঁদ সাহা, জগবন্ধু সাহা, গিরি ভুইঞা, ভাগ্য ভুইঞা এরা সব ছিলেন হাটখোলার বড়ো ব্যবসায়ী। জগবন্ধু কংগ্রেসের স্থানীয় কর্মকর্তা। তার দোকানেই রাজনৈতিক আলোচনার আসর বসত। স্বাভাবিকভাবেই মধ্য ১৯৪০-এর দশকে দেশ ভাগের আশঙ্কাই ছিল মানুষের রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। র‌্যাডক্লিফ সাহেবের নাম সে সময় বাঁকাই গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছেছে কি না জানা নেই। সাধারণের বিশ্বাস ছিল দেশভাগ যদি হয় তাহলে হিন্দু প্রধান অঞ্চল হবে হিন্দুস্থান এবং যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সে অঞ্চল পাকিস্তান। অবশ্য যদি গান্ধি মহারাজ দেশ ভাগে সম্মতি দেন।

বরিশাল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা। হাটখোলার রাজনৈতিক আলোচনায় কোনও সংশয়ই ছিল না যে বরিশাল হিন্দুস্থানেই যাবে। বড়দের এই বিশ্বাস বালক মনকেও সংক্রমিত করেছিল। আমার এক জ্ঞাতি কাকা দুলাল আমার চেয়ে এক-দুমাসের ছোটো। সে গ্রামের বাড়িতেই থাকত। মনে আছে, একদিন দুজনে খাল পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। একটি ছোটো পানসি লগি দিয়ে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিলেন লুঙ্গি পরা খালি গা এক মধ্য বয়স্ক মুসলমান। সম্ভবত আমাদেরই কোনও প্রজা। তাকে দেখা মাত্র দুলাল হতাশা ছুঁড়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল, পাকিস্তান ছুটাইয়া দিমু। মনিব বাড়ির ছেলে হওয়াতেই বোধ হয় ওই লোকটি নিঃশব্দে তার পানসি নিয়ে চলে গেছিলেন। কমিউনিস্ট মতাদর্শও সে সময় বাঁকাই গ্রামে পৌঁছে গেছে। বাবার দূর সম্পর্কের মাসি মনোরমা বসুই ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেত্রী। ভারত বাটোয়ারার পরেও তিনি দেশ ছাড়েননি। প্রথমে পূর্ব পাকিস্তানে এবং ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি করার জন্য প্রাণপাত করেছেন। গোটা পূর্ববঙ্গেই তিনি ছিলেন এক ডাকে চেনা মনোরমা মাসি। নির্যাতিতা অনাথা মহিলাদের আশ্রয় দিয়ে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করার জন্য বরিশাল শহরে তিনি একটি নারী কল্যাণ সমিতি চালাতেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাকে মন্ত্রী করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে সাড়া না দিয়ে আমৃত্যু তার নারী কল্যাণ সমিতি পরিচালনায় নিয়োজিত ছিলেন। মনোরমা মাসির দুই মেয়ে সাধনা ভজনাও কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী ছিলেন। সেকালের কমিউনিস্টরা একালের পশ্চিমবাংলার অধিকাংশ কমিউনিস্টের মতো দুধে ভাতে আলালের ঘরের দুলাল-দুলালী ছিলেন না। তাদের কাছে লেনিনের শিক্ষাই ছিল আদর্শ। মাত্র দুবিঘা জমির মালিক কৃষক নব্বুই দিন পর কয়েক মণ ধান আশা করতে পারে। কিন্তু একজন কমিউনিস্ট কর্মী নব্বুই বছর পরেও হয়ত যক্ষারোগ ছাড়া আর কিছু পারে না। মনোরমা মাসির সাধনা ভজনা দুই মেয়েই যক্ষা রোগেই মারা যানা। কমিউনিস্ট পরিবার হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু বাঁকাই গ্রামের বোসের বাড়িতে দুর্গাপুজো হতে বাধা ছিল না। বোধহয় মনোরমা মাসি কমিউনিজমকে মৌলবাদে পরিণত করেননি বলেই।

হাটখোলা এবং বাড়ির মধ্যে মাত্রই একটি বাঁশের সাঁকোর দূরত্ব। বাড়ি থেকে হাটখোলা যেতে খালের ওপর এই সাঁকো। একবার এই সাঁকো থেকে খালের জলে পড়ে গিয়ে অনাসৃষ্টি বাঁধিয়ে ছিলাম। দিনটা আবার ছিল মহাষ্টমী। বাড়ি গেলে বাবা প্রতি সকালে হাটখোলা বাজারে সস্তার মাছ দুধ কিনতে যেতেন। সঙ্গে আমিও। সেদিন সাঁকো পার হওয়ার সময় হঠাৎ হাতল থেকে হাত পিছলে পপাত সলিলে। সাঁতার জানা ছিল না তখনও। হাবুডুবু খেতে খেতেই স্রোতে ভেসে যাচ্ছিলাম। সাঁকোর ঠিক নীচেই মাছ ধরার জন্য চেরা বাঁশের সরু সরু কাঠি দিয়ে তৈরি চিকের মতো দেখতে এক ধরনের লম্বা ঘেরা। ওই ঘেরাতেই আটকে গেছিলাম ডুবে যাওয়ার আগেই। অবশ্য ওই ঘেরাই আবার অন্য বিপদের কারণ হতে পারত। জলে না পড়ে সরাসরি ওই ঘেরার ওপর পড়লে গেঁথে যেতে পারতাম। শুনেছি এক জ্ঞাতি কাকাও নাকি ছোটোবেলায় একই ভাবে এই সাঁকো থেকে পড়ে যাচ্ছিলেন। তবে পাদানি ধরে ফেলতে পেরে ঝুলে থেকে চিৎকার করে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারায় জলে পড়ার আগেই উদ্ধার হয়েছিলেন। ছোটোদের পক্ষে বাঁশের সাঁকো পারাপারে যথেষ্ট ঝুঁকি থাকে। বাড়ি ঢোকার মুখেই বিশাল শরিকি পুকুর। নালা কেটে খালের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ায় পুকুরে জোয়ার ভাটা খেলত। পুকুরের জল টলটলে স্বচ্ছ। আমরা এই পুকুরেই স্নান করতাম। মনে হয় এই পুকুরের জলেই সাঁতার কাটতেও শিখেছিলাম। একবার পুকুরে জাল ফেলতে দেখেছিলাম। সে এক অভিজ্ঞতাই বটে। রুই কাতলা চিতলের সঙ্গে সরপুঁটি গলদা চিংড়ি চাপলে কি মাছ নয়। সংখ্যায় যে কত তারও ঠিক নেই। জালের সঙ্গে উঠে আসা একটা নারকেল গাছের গুড়ির ফোঁকর থেকে শয়ের বেশি ছোটো বড়ো চিতল মাছ ধরা পড়েছিল। এক জেলে হাতখানেক মাপের ছোটো একটা চিতলের বাচ্চা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় ছিল। গামছায় জড়িয়ে কোমরে বাঁধার মুহূর্তে নোয়াদাদুর নজরে পড়ে যায়। চিতল আর তার নেওয়া হয়নি। কপালে জুটেছিল নোয়াদাদুর কয়েক গণ্ডা জুতোর বাড়ি।

বাড়ি ঢোকার মুখে পুকুরের উত্তর-পশ্চিম কোণে এক বাঁশ ঝাড়। বাঁশ ঝাড় শেষ হতেই বিশাল বেল গাছ। আমরা বেলগাছের গোড়া হোগলা দিয়ে মোড়া দেখতাম। মা বাবা বলতেন বোধন হয়ে গেছে। বোধন দুর্গাপুজোর প্রথম আচার অনুষ্ঠান। পুকুরের উত্তর-পশ্চিম কোণের কথা বলা হল, দীর্ঘক্ষণ-পূর্ব কোণের কথা না বললে একটি মজার গল্প বলার সুযোগ থাকবে না। পুকুরের এই কোণে এক বিশাল বেতঝাড় ছিল। বেতের সাদা রঙের কচিপাতাকে বলা হত বেথই। বরিশাল জেলায় এই বেথই দিয়ে শুক্তো রান্না হত। উচ্ছে করলা অথবা নিমপাতার বিকল্প বেথাই। এবার সেই গল্প। জামাই এসেছে শ্বশুরবাড়ি। ভিন জেলার জামাইয়ের জন্য শাশুড়ি বেযাইয়ের শুক্তো রান্না করলেন। খাওয়ার পর জানতে চাইলেন কেমন লাগল। নিম তেতো বেথই কারো মুখরোচক হওয়ার কথা নয়। কিন্তু শাশুড়ির মুখের ওপর সেকথা বললে অভদ্রতা হয়। জামাই অতএব বেথইয়ের শুক্তোর উচ্ছ্বসিত প্রশংসাই করেছিল। এমন অমৃত সে এর আগে কোনোদিন খায়নি। শাশুড়ি মায়ের আপশোস জামাইয়ের সাধ মিটিয়ে খেতে, সেদিন বেথইয়ের শুক্তো অবশিষ্ট ছিল না। পরদিন সে আপশোস মেটাতে এক কড়াই বেথইয়ের শুক্তো রান্না হয়েছিল। ওই কড়াই-ভর্তি শুক্তো দেখে জামাই বাবাজীবন শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়েছিল কি না সেকথা গল্পে বলা নেই।

এজমালি পুকুরের পশ্চিম পারে ছিল বিশাল এক পরিত্যক্ত ভিটা। এখানে নাকি কোনও এক সুদূর অতীতে কাছারি বাড়ি ছিল। আমি যখন দেখেছি তখন সেখানে অনেকগুলি বড়ো বড়ো শিউলি ও স্থলপদ্ম গাছ। বোঝা যায় বহুদিনের গাছ। শিউলি গাছতলায় প্রতিদিন কয়েকধামা ফুল ঝরে। স্থলপদ্ম গাছের ডাল পলকা হয়। কিন্তু গাছ অনেক দিনের পুরোনো হওয়ায় আমরা মগডালে চড়েও ফুল পাড়তাম। একবার অসাবধানে বোলতার চাকে হাত দিয়ে ফেলেছিলাম। বিরক্ত এক বোলতা আমার কানে হুল ফুটিয়ে দেয়। কানের চেহারা হয়েছিল যেন খাঁটি ঘিয়ে ভাজা চিনির রসে ডোবানো মস্ত এক জিভেগজা। অপরাধ না মানলে এখানেও একটি গল্প বলা যায়। এক সময় পশ্চিমবাংলার ডাকসাইটে ছাত্রনেতা প্রয়াত বন্ধু প্রতুল লাহিড়ী বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমা যাপনের উদ্দেশ্যে শ্রীক্ষেত্রে গিয়েছিল। সমুদ্র সৈকতের ভিড় এড়াতে স্ত্রীকে নিয়ে গিয়ে বি. এন. আর হোটেল ছাড়িয়ে নিরিবিলি এক গাছের তলায় গিয়ে বসে। দৃশ্যটি স্থানীয় কয়েক যুবকের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়াবে আশ্চর্য নয়। গাছে ছিল বেশ বড়ো ভীমরুলের চাক। ওই যুবকদের কেউ একজন ঢিল ছুঁড়ে ভিমরুলদের খেপিয়ে দেয়। প্রতুল তার পরনের ধুতি খুলে প্রবল বেগে মাথার ওপর ঘোরাতে ঘোরাতে স্ত্রী শিবানীর হাত ধরে প্রাণপণে ছুট। শিবানীও ততক্ষণে নিজের শাড়ি খুলে অস্ত্র করেছে। নবদম্পতির এক জনের পরনে তখন আন্ডারওয়ার এবং অন্যজনের পেটিকোট। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। অতএব প্রতুল-শিবানীর মধুচন্দ্রিমা পুরীর হাসপাতালে বেশ কয়েকদিন প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় কাটে।

আমাদের নিজেদের পুবের ঘর পশ্চিমের ঘর, তারপর মধ্যের বাড়ি এবং সব শেষে দক্ষিণের বাড়ি মিলিয়ে বেশ কয়েক বিঘা জমির ওপর ছিল চৌধুরীদের শরিকি বসতবাড়ি। দক্ষিণের বাড়ির সীমানার ঠিক পরেই আরও একটি বড় বাড়ি। গ্রামে সাধারণত যেমন হয়, এ বাড়ির লাগোয়া পুকুর বাগান ছিল। ওই বাড়ির কর্তা নাকি আমাদের পিতৃকুল মাতৃকুল দুদিক থেকে আত্মীয়। তা হলেও কোনোদিন তার কাছে ঘেঁসার চেষ্টা করিনি। সব সময় খালি গা, কাঁধ পর্যন্ত বড়বড়ো চুল, লম্বা দাড়ি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, পায়ে কাঠের খড়ম— ভদ্রলোককে দেখলেই গা ছমছম করত, যেন কোনও কাপালিক এই মাত্র তন্ত্র আসন থেকে উঠে এলেন। দূর থেকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে কোনোদিন এই ভয়াবহ ব্যক্তিটি ছাড়া ওই বাড়িতে অন্য কারও অস্তিত্বের আভাস আমি পাইনি। পুবের ঘর আমাদের নিজেদের অংশ, পশ্চিমের ঘরে থাকতেন নোয়াদাদুরা। দুইয়ে মিলিয়ে আমরা অর্ধেক সম্পত্তির মালিক। লোকে আমাদের আটআনার জমিদার বলত। তবে সেই প্রবাদের ‘তালপুকুরে ঘটি ডোবে না’ অবস্থা। একই সমান্তরালে তিন শরিকের তিনটি পৃথক পৃথক দুর্গামণ্ডপ। তিনটিই দক্ষিণমুখী। দুর্গামণ্ডপ ছাড়া আমাদের অংশে আলাদা একটি ঠাকুরঘর ছিল। এটি পশ্চিমমুখী। ঠাকুরঘরে রাধা কৃষ্ণর নিত্য সেবার ব্যবস্থা ছিল। আমাদের পূর্বপুরুষরা পৈতাধারী ক্ষত্রিয়। বাংলার বার ভুঁইঞার অন্যতম প্রধান প্রতাপাদিত্য ঘোষের বংশধারার কোনও একটি শাখার উত্তরাধিকারী বলে নিজেদের পরিচয় দিই। ধর্মপ্রচারে শাক্ত। দুর্গাপুজো কালীপুজোতে পশুবলি হয়। তা সত্ত্বেও বাড়িতে রাধাকৃষ্ণের স্থান হল কীভাবে সেটা একটা জিজ্ঞাসা হতে পারে। চৌধুরীরা নামে জমিদার হলেও তাদের কোনও শরিকেরই পাকা বাড়ি ছিল না। গ্রামে প্রজাদের অনেকেরই পাকা বাড়ি। একবার কোনও এক সম্পন্ন প্রজা কোঠাবাড়ি তৈরি করার আগে মনিব বাড়ির ঠাকুর ঘরটি পাকা করে দিতে চেয়েছিলেন। তার এই ‘ঔদ্বত্যের’ জন্য কম মূল্য দিতে হয়নি।

ঠাকুর ঘরের মূল বিগ্রহ ছিল রাধাকৃষ্ণ। তাছাড়া গণেশ, লক্ষ্মী, নৃসিংহ অবতার শালগ্রাম শিলা এসবও ছিল। এক কথায় বলা যায় কাঁসা পিতলের দোকানে ছোটো ছোটো যেসব দেবদেবীর মূর্তি পাওয়া যায় তাদের সকলেরই জায়গা হয়েছিল এই ঠাকুর ঘরে। প্রায় দুফুট মাপের কৃষ্ণ মূর্তিটি কষ্টিপাথরের তৈরি। রাধা মূর্তি পিতলের, উচ্চতায় কৃষ্ণ মূর্তির সঙ্গে মানানসই। কৃষ্ণের ডানহাতের কড়ে আঙুলটি ছিল ভাঙা। প্রথম যেদিন নজরে পড়ে বাড়িতে হইহই পড়ে যায়। দেবতার আঙুল ভাঙার অর্থ পরিবারে কোনও বড়ো ধরনের অমঙ্গল ঘটতে চলেছে। এই অনর্থের দায় বর্তায় প্রতিদিন যিনি পুজো করেন সেই ব্রাহ্মণ পুরোহিতের ওপর। কুলপুরোহিত পরিবারকে জমি পত্তনি দেওয়া ছিল। পরিবারের প্রধান যিনি তিনি দুর্গাপুজো ও কোজাগরী লক্ষীপুজো করতেন। প্রতিদিনের রাধাকৃষ্ণের পুজো ও অন্যান্য পুজো করতেন ওই পুরোহিতের পরিবারেরই কেউ। একইভাবে কুমোর, ধোপা, নাপিত, কাহার প্রভৃতি নানা পেশার এক একটি পরিবারকে জমি পত্তনি দেওয়া ছিল। এরা খাজনার পরিবর্তে মনিব বাড়ির পণ্য ও পরিষেবার প্রয়োজন মেটাত। রাধাকৃষ্ণের পুজো যিনি করতেন তার প্রতিদিনের কাজ ছিল সকালে দেবদেবীদের ‘ঘুম’ থেকে জাগিয়ে স্নান করানো। তারপর বিধিমতো ভোগ সাজিয়ে পুজো। দিনের শেষে আবার সন্ধ্যারতি দিয়ে মশারি টাঙিয়ে দেবতাদের শুইয়ে দেওয়াও তার কর্তব্যের মধ্যে পড়তো। আমরা যাকে এই দায়িত্ব পালন করতে দেখেছি তাকে কানাই ঠাকুর বলে জানতাম। তার পুরো নাম কোনোদিন জানার চেষ্টা করিনি। কৃষ্ণের কড়ে আঙুল ভাঙার জন্য কুলপুরোহিত পরিবারকে ভিটে থেকে উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। ধরেই নেওয়া হয়েছিল, সেবাইতদের অসাবধানতাতেই এই ভয়ংকর দুর্ঘটনা। কিন্তু সেই রাত্রেই বাড়ির কর্তা এই নিষ্ঠুর রায় কার্যকর না করার জন্য ‘স্বপ্নাদিষ্ট’ হয়েছিলেন।

জমির অধিকার নিয়ে বাংলার ভূস্বামীদের মধ্যে সরাসরি লাঠালাঠি খুন-রাহাজানি পরিণতিতে মামলা মোকদ্দমা স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। এরকমই এক মোকদ্দমায় চৌধুরী পরিবারের কোনও এক পূর্বপুরুষের পরাজয় অনিবার্য হয়ে ওঠে। কিন্তু সওয়াল জবাবের একেবারে শেষ পর্যায়ে আদালতে আকস্মিক ঘোর কৃষ্ণবর্ণ এক অজানা সাক্ষী উপস্থিত হয়ে মামলার পরিণতি সম্পূর্ণ উল্টে দেন। চৌধুরী বাড়ির কর্তা স্বপ্নে জানতে পেরেছিলেন ওই অপরিচিত সাক্ষী আর কেউ নন স্বয়ং কৃষ্ণঠাকুর। ঠিক সময়ে আদালতে পৌঁছনোর জন্য মাঠঘাট ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে ছুটতে ছুটতে তিনি পড়ে গেছিলেন। তাতেই তার ডান হাতের কড়ে আঙুল ভেঙেছে। দেবদেবীদের দুর্ঘটনায় অঙ্গহানি হলে আধুনিক সার্জারির ব্যবস্থা ছিল না নিশ্চয়। এখন সুরলোকের চিকিৎসাশাস্ত্র কতটা এগিয়েছে খোঁজখবর করা যেতে পারে। আরও একবার আমাদের এক পূর্বপুরুষ স্বপ্নাদিষ্ট হয়েছিলেন। দেবী দুর্গা অতসীবর্ণা। কিন্তু আমাদের বাড়ির মণ্ডপে যে দেবী মূর্তির পুজো হত তার রং ছিল অপরাজিতা ফুলের মতো। স্বয়ং দুর্গামার স্বপ্নাদেশেই নাকি তিনি আমাদের বাড়িতে নীলবর্ণা। আগে আমাদের বাড়িতেও চিরাচরিত অতসী রঙের দুর্গারই পুজো হত। একবার পুজোর দিন দুই আগে প্রবল ঝড় বৃষ্টিতে দুর্গা মণ্ডপের টিনের চাল উড়ে যায়। বৃষ্টির তোড়ে মূর্তির গায়ের মাটি খসে পড়ে। নতুন মূর্তি বানানো ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। হাতে দেড়-দুদিনের বেশি সময় নেই। ওই সময়ের মধ্যে মৃৎশিল্পী নতুন মূর্তি গড়ে দিয়েছিলেন। তবে ষষ্ঠীর সকালে দেখা গেল গা ভরা জ্বর নিয়ে ষাটোর্ধ্ব শিল্পী আগের গোটা রাত জেগে যে মূর্তির রূপ দিয়েছেন তার গায়ের রং অপরাজিতা ফুলের মতো। এত বড়ো অপরাধের সমুচিত শাস্তি দিতে শিল্পীর হাত পা বাঁধা শুরু হয়ে গেছিল। শেষ মুহূর্তে ভিতর বাড়ি থেকে স্বয়ং কর্তা বেরিয়ে এসে বিধান দিলেন অপরাজিতা রঙের মূর্তিরই পুজো হবে। এটা দেবীমারই ইচ্ছা। মা স্বপ্নে তার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন। এসব স্বপ্নাদেশের কাহিনি বড়োদের মুখে শোনা। কিন্তু মৃৎশিল্পীর অজ্ঞতা অন্তত একবার গভীর মনঃপীড়া ঘটিয়েছিল। প্রতিবারই বাড়ি পৌঁছে প্রথমেই বয়সে ছোটো কাকা দুলালকে নিয়ে তিনি দুর্গামণ্ডপের মূর্তি দেখতে যেতাম। উদ্দেশ্য, কাদের মূর্তি বেশি সুন্দর হয়েছে যাচাই করা। একবার দেখা গেল, সর্বনাশ, দক্ষিণের বাড়ির দুর্গাঠাকুরের সিংহের বেশ বড়সড় পুরুষাঙ্গ রয়েছে। অথচ আমাদের সিংহের একেবারেই পুরুষাঙ্গ নেই। প্রথম ঝড়ঝাপটা দুলালের ওপর দিয়েই গিয়েছিল। সে দেশের বাড়িতেই থাকে। এই অত্যন্ত জরুরী বিষয়গুলি সে নজরে করবে না কেন? তখনকার মতো চুপ করে সে অভিযোগ মেনে নিয়েছিল। মৃৎশিল্পীকে ধরে হম্বিতম্বি করাতে কৈফিয়ৎ দিয়েছিলেন তিনি সিংহ নয় সিংহী বানিয়েছেন। সিংহীর পুরুষাঙ্গ থাকে না। সিংহীর পুরুষাঙ্গ থাকে না ঠিকই। কেশরও থাকে না সেটা মনে হয় শিল্পীমশাইয়ের জানা ছিল না। আমাদের কথিত সিংহীর মাথায় কিন্তু কেশর ছিল। তবুও আমি নিজেও তখন অন্তত কেশর থাকা না থাকার প্রশ্ন তুলে সেদিন মৃৎশিল্পীকে কোণঠাসা করতে পারিনি।

বারো

প্রায় দুদিন সফরের পর যখন দেশের বাড়ির মাটিতে পা পড়ত তখন শরতের নির্মেঘ আকাশে সবে ভোরের আলো ফুটেছে। পশ্চিমের ঘরের সামনের বারান্দা থেকে নোয়াদাদু প্রভাতরঞ্জনের গড়গড়ার গুড়গুড় এবং ঘনঘন হাঁচির শব্দ শোনা যেত। নোয়াদাদুর সম্ভবত কোনও অ্যালার্জি ছিল। রোদের তেজ না বাড়া পর্যন্ত তিনি অনবরত হাঁচতেন। এর জন্য তাকে লোকের বিস্তর কথাও শুনতে হয়েছে। আমার ঠাকুরমা তো সন্দেহ করতেন তার এই দেবরটি কারও ভালো দেখতে পারে না। তাই ‘সর্বকাজে বাধা সৃষ্টির জন্য ‘দিনের শুরুতে হাঁচতে থাকেন। কাজের শুরুতে কেউ হাঁচলে অশুভ সংকেত মনে করা হয়। দিনের শুরুতে তো বটেই। আমরা আসব জানা থাকলেই নোয়াদাদু কাকভোরে বারান্দায় অপেক্ষা করতেন। হাঁচির বিড়ম্বনা উপেক্ষা করেই। বাবা মার সঙ্গে আমরা ভাইবোনেরাও নিজেদের ঘরে ঢোকার আগে তার পায়ের ধুলো নিতাম। ততক্ষণে দুলাল ঘুম থেকে উঠে এসে সবচেয়ে জরুরি সংবাদটি পরিবেশন করেছে। ‘এউক্কা’ (একটি) কেনা হয়ে গেছে। ‘প’ আকারে ‘পা’ ‘ঠ’ আকারে ‘ঠা’, ‘পাডা’। বলির পাঁঠা কেনা হয়ে গেছে। আমরা যখন নিজেদের পুবের ঘরে ঢুকতাম সচরাচর তখন আমাদের অভ্যর্থনা করতে সে ঘরে কেউ উপস্থিত থাকত না। ঠাকুরমা তখন নোয়াদাদুর ছোটো মেয়ে নিভারানিকে নিয়ে পুজোর ফুল তুলতে বাগানে। আমাদের এই নিভা পিসিই প্রায় সারা বছর নিঃসঙ্গ কুমুদিনীর সর্বক্ষণের সঙ্গী। যদিও দেবরকন্যার সঙ্গে কুমুদিনীর সম্পর্ক ছিল বাস্তবিক বিচিত্র। বয়সের ভারে শোকতাপে তিনি কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ ধরনের হয়ে গেছিলেন। সবকিছু সব সময় মনে রাখতে পারতেন না। হাতের কাছে কিছু না পেলেই দোষ দিতেন দেবরকন্যাটিকে, ও নিভারানিই সরিয়েছে। খুড়িমার এহেন ভিত্তিহীন অভিযোগে দুঃখ পেলেও নিভাপিসিই ঠাকুমার হারানো সম্পত্তি খুঁজে দিত। এবং অচিরাৎ বৃদ্ধা ও বালিকার ফের বরাবরের গলাগলি। সন্ধি মূল্য হত খুড়িমার ঠাকুরের আসনের এক আধটা কোনও আধপচা ফল অথবা দুচার টুকরো বাতাসা। তাতেই বালিকার মুখে এক গাল হাসি। আমরা যে ঘরে পৌঁছে গেছি এবং সংবাদটি যথা সময়ে কুমুদিনীর কানে না পৌঁছোনোয় নিভারানির ওপরেই চোটপাট শুরু হত। শাপশাপান্তও বাদ যেত না। কথায় কথায় শাপমন্যি করা ঠাকুরমার এক বড়ো ব্যাধি ছিল। পান থেকে চুন খসলেই তিনি নিজের একমাত্র পুত্রবধূকেও ‘আমার মতো হয়ো’ অভিশাপ দিতেন। অর্থাৎ ঠাকুরমা নিজে যেমন অকালে বিধবা হয়েছেন নয় নয় করে বারোটি সন্তান হারিয়েছেন পুত্রবধূও যেন একই রকম শোকতাপ পায়। মা তার অভিশাপের তাৎপর্য মনে করিয়ে দিলে নিজের বুক চাপড়ে গলা ফাটিয়ে কান্না জুড়তেন এ কোন মহাপাতকের কাজ করলেন। আমাদের বাড়ি পৌঁছানোর খবর পাওয়া মাত্রই ঠাকুরমা হাউমাউ করে চিৎকার করতে করতে ছুটে আসতেন, ‘আমার খোকার’ (বাবা) গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেটে একসা হতেন। তবে এ কান্না অপার আনন্দের। এরপর আবার এক দফা পায়ের ধুলো নেওয়ার পালা। ততক্ষণে ডাউরিকাকু এসে নিঃশব্দে হাত জোড় করে দরজায় দাঁড়িয়েছেন। এখন ঘণ্টা খানেক অন্তত বাবাকে তিনি গোটা বছরের হিসেব বোঝাবেন।

ডাউরিকাকুর সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্পর্ক নেই সেটা জেনেছিলাম অনেক পরে। তার পরণের লুঙ্গি, একগাল লম্বা দাড়ি ও মাথায় সর্বদা সাদা রঙের টুপি দেখেও কখনও কোনও কৌতূহল হয়নি। কেউ হয়ত এই মুসলিম ভদ্রলোককে ‘কাকু’ ডাকতে বলে দিয়েছিল তাই ডাকতাম। অথবা যেহেতু মাকে তিনি সুন্দর বউদি ডাকতেন আমরা ধরেই নিয়েছিলাম তিনি আমাদের পিতৃব্যই হবেন। পুরের ঘর পশ্চিমের ঘরের দুই পরিবারের যে ছেলেরাই মাকে ‘বউদি’ সম্বোধন করতেন তারাই আমাদের কাকু। যে কোনও কারণেই হোক, জ্ঞাতি ভাইরা বাবাকে সুন্দরদা ডাকতেন। তাই বউদির আগে ‘সুন্দর’ বিশেষণ। ডাউরিকাকু আমাদের গোমস্তা ছিলেন। তার নিজের বাড়ি ছিল ডাশা নামের পাশের গ্রামে। আমাদের অবর্তমানে ঠাকুরমা এই ডাউরিকাকুর প্রযত্নেই থাকতেন। অবশ্য পশ্চিমের ঘরের নোয়াদাদুও নিয়মিত খোঁজখবর করতেন। আর নিভাপিসি তো ছিলই। প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায়, খাস জমিতে বর্গা বসানো, বর্গাদারের কাছ থেকে ধানের ভাগ আদায় এ সবই ডাউরিকাকুর কাছেই জমা থাকত। আমাদের বাড়ির দুর্গাপুজো পালা করে একবার পুরের ঘরের পরের বার পশ্চিমের ঘরের খরচে হত। আমাদের পালা পড়লে ডাউরিকাকু তার কাছের টাকা দিয়ে সব আয়োজন করে রাখতেন। অধিকন্তু ঠাকুরমার প্রতিমাসের খরচ-খরচা তো ছিলই। পুজোর পাঁচদিন ডাউরিকাকুকে সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হত। দুপুরে একবার নাওয়া খাওয়ার জন্য নিজের বাড়িতে যেতেন। বিজয়া দশমীর দিন সে ফুরসতও মিলত না। আমাদের পালার বারে বিজয়া দশমীর দিন গ্রামের সমস্ত মানী পরিবারের নিমন্ত্রণ থাকতো। সমস্ত আয়োজনের দায়িত্ব সেই ডাউরিকাকুর। বিকেলে মূর্তি বিসর্জন, তিনদিন পর লক্ষ্মীপুজো, তারপর আমরা নারায়ণগঞ্জ ফিরে যাওয়ার আগে ‘তিন্নাথের’ (ত্রিনাথ ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব) মেলারও আয়োজন করতে হত।

নায়েব গোমস্তারাই অ্যাবসেন্টি ল্যান্ডলর্ডদের ভিটের ঘুঘু চড়ার ব্যবস্থা করতেন এমন অভিযোগ ভিত্তিহীন নয়। তবে আমাদের ক্ষেত্রে ‘ল্যান্ডলর্ড’ বিশেষণ যোগ করা শব্দের অপচয় ছাড়া কিছু নয়। কিছু জমিজমা ছিল ঠিকই। বিশেষত গ্রামের নিম্নবিত্তরা মনিব বলেও মানতো। তা হলেও ঠাকুরদার আমল থেকেই আমাদের বসবাসের জন্য একটি কোঠাবাড়িও ছিল না। মাটির ভিটা, বাঁশের বেড়া দেওয়া টিনের আটচালা বাড়ি। বন্যার সুরক্ষার জন্য মাটির ভিটা ছিল প্রায় দেড় মানুষ সমান। নিজেরা কখনও দেখিনি। তবে শুনেছি বন্যায় উঠোনে জল উঠলে পুবের ঘর থেকে পশ্চিমের ঘর অথবা রান্নাঘরে যাওয়া আসার জন্য সাঁকো বেঁধে দেওয়া হত। আমার দাদা নাকি ঘরের দাওয়ায় বসে উঠোনে বন্যার জন্য জলে ছিপ ফেলে মাছ ধরতেন। একবার মধ্য রাত্রে ঘুমের ঘোরে বঁড়শি নিয়ে মাছ ধরতে বেরিয়েছিলেন। মা জেগে ওঠায় সে চেষ্টা সফল হয়নি। বরং সেদিন থেকে তার মাছ ধরা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। মার নিশ্চিন্ত ধারণা হয়েছিল দাদাকে মেছোভূতে পেয়েছে। ১৯৫০ সালে দেশ ছেড়ে চলে আসার সময় ভারত সরকারের সিল মারা যে বর্ডার স্লিপ দেওয়া হয়েছিল তাতে আমাদের ফেলে আসা বিষয়-সম্পত্তির বার্ষিক এক লক্ষ টাকা উল্লিখিত ছিল। সম্পত্তির দাম যাই হোক, তার দলিল দস্তাবেজ ডাউরিকাকুর কাছেই থাকত। তিনিই সরকারি খাজনা জমা দিতেন, সেটেলমেন্টের সময় নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মাপজোক বুঝে নিতেন। মামলা বাঁধলে তদবির তদারকি করতেন। তার মাস বেতন কত ছিল ঠিক জানা নেই। বিশ-পঁচিশ টাকার বেশি ছিল মনে হয় না। তা হলেও ডাউরিকাকুর বাড়িঘর কিন্তু যে-কোনও স্বচ্ছল পরিবারের মতোই ছিল। নোয়াদাদুর সঙ্গে একবার তার বাড়ি গিয়ে বিষয় বৈভবে তিনি আমাদের উঁচুতেই মনে হয়েছে।

ডাউরিকাকুর বাড়ি যাওয়ার পথে একটি উপকাহিনি শোনাতে হবে। গ্রামের পথ যেমন হয়, দুধারে বড়ো বড়ো আম জাম নারকেল তাল সুপারি গাছ। মাঝে মাঝে পথের পাশে খানাখন্দ ডোবা জলা। গাড়িঘোড়ার ব্যাপার নেই। এখান ওখান যেখানেই যাওয়া হোক পায়ে হেঁটেই পথ চলতে হয়। সেদিন চলতে চলতে নোয়াদাদু হঠাৎ একটি ডোবার ধারে দাঁড়িয়ে পড়ে মনোযোগ দিয়ে কিছু দেখলেন। ঘোলা জলে এক জায়গায় শুধু কিছুটা ভুড়ভুড়ি দেখা গেল। নোয়াদাদুর চোখ সেদিকে। আমাদের সঙ্গে চিল মুসাই নামে এক মুসলিম ভৃত্য। মুসাই সারাদিন পুবের ঘর পশ্চিমের ঘর দু’বাড়িই জঙ্গল পরিস্কার করা, তরকারি অথবা ফুলের বাগানের বেড়া বাঁধা, খালের জলে চাঁই পেতে মাছ ধরা জাতীয় নানা কাজ করত। একবার বাবা তাকে একটি পুরোনো এন্ডি বা মুগা জাতীয় কোনও সিল্কের পাঞ্জাবি দিয়েছিলেন, মুসাই সেটি সারা বছর মাটির কলসির ভিতর রেখে দিত। কেবলমাত্র বিজয়া দশমীর দিন ওই পাঞ্জাবি পরে মাথায় একটি গামছা বেঁধে হাতে লাঠি নিয়ে বিসর্জনের শোভাযাত্রার আগে আগে চলত। সম্ভবত তার পূর্বপুরুষরা যে লেঠেল ছিল সেটা জাহির করতেই মুসাইয়ের এই বেশবাস। অন্যথায় প্রতিদিন খালি গা এবং হাঁটুর অনেক ওপরে ল্যাঙ্গোটের মতো করে বাঁধা লুঙ্গি এই তার পোশাক। গায়ের চামড়া সারা বছরই খড়ি ওঠা। এখানে ওখানে খোস প্যাঁচড়াও। নোয়াদাদু মুসাইকে হুকুম করলেন জাল নিতে আয়। ডোবায় জালের এক ক্ষেপেই সেদিন প্রায় এক বিঘত মাপের বড়ো বড়ো দুই-আড়াই সের ভ্যাদা মাছ উঠে এসেছিল। পশ্চিমবাংলায় এ মাছের নাম ন্যাদোস। ওপার বাংলাতেও কোথাও এ মাছের নাম মেনি আবার কোথাও রয়না। একই দিনে ডাউরিকাকুর বাড়ির পুকুরে মাছ ধরার অভিযানও নেহাত বিফলে যায়নি। দক্ষিণমুখী ঘরের লাগোয়া তকতকে নিকানো উঠোনের ঠিক পরেই পুকুরটি খুব বড়ো নয়। তবে পানা পরিস্কার করা, পাড় বাঁধানো, পুকুরটি যে নিয়মিত যত্নআত্তি পায় সেটা বলে দিতে হয় না। মাছের চাষও হয় হিসেব কষেই। রক্ষণাবেক্ষণে ছিমছাম টিনের বাড়িটির গায়েও সচ্ছলতার স্পষ্ট ছাপ। বাড়ির সকালের পরণেই ধোয়াকাচা জামাকাপড়। ছেলেমেয়েদের মুখচোখে শিক্ষার উজ্জ্বল দীপ্তি। পরে শুনেছি ডাউরিকাকুর একছেলে বড়ো হয়ে কলেজে অধ্যাপনা করেছে। ঠাকুরমা খোলখুলিই অভিযোগ করতেন যে, আমাদের ঠকিয়েই ডাউরি মিঞা ফুলে ফেঁপে উঠছে। অবশ্য অপরাধী ডাউরিকাকু একা নয়। ঠাকুরমা তার ছেলেকে বোঝাতেন নিজে বিষয়-সম্পত্তি দেখাশুনা না করায় ডাউরি মিঞা আর নোয়াকর্তা মিলে আমাদের ভাগের অংশ হজম করছেন। বাবার ওপর এই নালিশের কোনও প্রভাব পড়ত মনে হয় না। তিনি জানতেন বিদেশ বিভুঁইয়ে যখন চাকরি করতেই হবে তখন শুধু বিষয়সম্পত্তি নয় তার মার দেখাশোনার জন্যও অন্যের ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। ডাউরি মিঞাকে ছাড়িয়ে অন্য কাউকে বহাল করলে সে ধোয়া তুলসীপাতা হবে এমন নিশ্চয়তা কে দেবে।

বাবার অকাল মৃত্যুতে ডাউরিকাকুর ওপর আমাদের নির্ভরতা আরও বেড়েছিল। সে সময় দাদা সদ্য কৈশোর পেরিয়ে আঠারোয় পা দিয়েছেন। আমি নেহাতই বালক। দাদার চেয়ে বারো বছরের ছোটো। পাছে গলগ্রহ হয়ে দাঁড়াই এই আশঙ্কার নিকট আত্মীয়রা দূরে দূরে থেকেছেন। যার ওপর সবচেয়ে বেশি আশা ভরসা ছিল সেই জ্ঞাতি ঠাকুর্দা সতীশচন্দ্র জামশেদপুর থেকে একটি পোস্টকার্ড পাঠিয়ে দেশের বাড়িতে গিয়ে সেখানেই পাকাপাকি থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। খাওয়া পরার কষ্ট হবে না। তেমন হলে কখনও সখনও তিনি সম্পত্তি থেকে উপার্জনে তার নিজের অংশও না হয় ছেড়ে দেবেন। ঠাকুরদা সতীশচন্দ্রের সদুপদেশ আমরা মানিনি। দেশের বাড়ির বিষয়সম্পত্তি ডাউরিকাকুর হেফাজতে যেমন ছিল তেমনই থাকে। ঠাকুরমার দেখাশোনাও আগের মতো তিনিই করতেন। বাবা মারা যাওয়ার পর প্রতিবছর নিয়ম করে দেশের বাড়ি যাওয়া হত না। অতএব ডাউরিকাকুর দায়িত্ব বেড়েছিল। ঠাকুরমাকে নিয়েই হয়েছিল সবচেয়ে বড়ো সমস্যা। একে একে তেরোটি সন্তানের মৃত্যুতে তিনি সম্পূর্ণ অবুঝ হয়ে গেছিলেন। আজ তিনি নাতিদের কাছে নারায়ণগঞ্জ যাবেন বায়না করেন তো কাল হুকুম দেবেন চাইবাসায় (ঝাড়খণ্ড) তাকে মেয়ে শোভারানির বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। তীর্থে যাওয়া তার আর এক বাতিক ছিল। একমাত্র মরুতীর্থ হিংলাজ ছাড়া অবিভক্ত ভারতবর্ষের হেন তীর্থস্থান নেই যেখানে তিনি একা একাই যাননি। তার যাতায়াতের ব্যবস্থা করার ঝক্কি ডাউরিকাকুই পোহাতেন। এই মধ্যবয়স্কা অনাত্মীয় ভদ্রলোকের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞই ছিলাম। কোথায় কীভাবে দুপয়সা সরিয়েছেন তা নিয়ে কোনোদিন মাথা ঘামাইনি। বিষয়সম্পত্তি বুঝে নেওয়ার যোগ্যতাও আমাদের ছিল না।

১৯৪০-দশকের মাঝামাঝি থেকে আমাদের পরিবারকে পরপর কয়েকটি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়। ১৯৪৬ সালে বাবা মারা গেলেন। ১৯৪৭-এ দেশভাগ। ১৯৫০ সালে সাবেক পূর্বপাকিস্তানে সংখ্যালঘু বিতাড়নের উদ্দেশ্যে ব্যাপক দাঙ্গার পর আমরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হলাম। বাবা মার যাওয়ার পর একবারও যাওয়া হয়নি। ডাউরিকাকুই নিয়মিত চিঠি দিয়ে খবরাখবর রাখতেন। প্রতি বছর দুর্গাপূজোর আগে জানতে চাইতেন আমরা যাব কি না। গেলে পুজোর আয়োজন করবেন। আমাদের দিক থেকে চিঠির ঠিক ঠিক জবাব হত কি না মনে নেই। শেষে স্বাভাবিকভাবেই ডাউরিকাকুর চিঠির সংখ্যাও কমতে থাকে। শেষ চিঠি পেয়েছি ১৯৬৫ সালে। সে বছর পূর্ব-পশ্চিম সীমানার দুপারেই আর একদফা সংখ্যালঘু নিপীড়ন হয়েছিল। দুপারেই সংখ্যালঘুর সম্পত্তি জবরদখল হয়েছে। বাঁকাই গ্রামে আমাদের তালাবন্ধ বাড়িটিও দখল করার ষড়যন্ত্রের নায়ক ছিল ডাউরিকাকুরই নিজের জামাই। পরিকল্পনার ছকও তৈরি হয় তারই বাড়িতে বসে। আড়াল থেকে ডাউরিকাকুর মেয়ে সবই শুনে ফেলেছিল। আগেভাগেই সে মনিববাড়ি দখলের ষড়যন্ত্রের কথা বাবাকে জানিয়ে দেয়। রাত্রে জামাই যখন পূর্ব পরিকল্পনা মতো দলবল নিয়ে আমাদের বাড়িতে হাজির হয়েছে তার আগেই সেখানে ডাউরিকাকু লেঠেল নিয়ে পাহারা দিচ্ছেন। বলা বাহুল্য শ্বশুরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের বাড়ি দখলের সাহস আর জামাইয়ের হয়নি। ডাউরিকাকু কোনোদিন আমাদের এসব কথা জানাননি। শুনেছি লোকমুখে। আমরা শুধু ডাউরিকাকুর শেষ পোস্টকার্ডটি পেয়েছিলাম, একবার দেশে এসে নিজেদের বিষয়সম্পত্তির বিলি ব্যবস্থা করে যাও। আমার বয়স হয়েছে। আমার পক্ষে আর দেখাশুনা সম্ভব নয়।

তেরো

আর্থিক অবস্থা যাই হোক, দুর্গাপুজো মানে চৌধুরী পরিবারের বিশাল ব্যাপার। ষষ্ঠী থেকে শুরু হয়ে কালীপুজো পর্যন্ত টানা উৎসব। আমাদের অংশে অবশ্য কালীপুজো হত না। তার আগেই বাবাকে কর্মস্থলে ফিরে যেতে হত। কালীপুজো হত দক্ষিণের বাড়িতে। যেহেতু ঠাকুরদা মনোরঞ্জন ও জ্ঞানরঞ্জন দুজনেই উকিল ছিলেন তারা দীর্ঘদিন দেশের বাড়ি থাকতে পারতেন। দেশভাগের আগে পূর্ববঙ্গের আদালতগুলিতেও লম্বা পুজোর ছুটি চলত। কালীপুজো পর্যন্ত না হলেও আমরাও দিন পনেরো দেশের বাড়িতে কাটাতাম। আমাদের পূবের ঘরের সতীশচন্দ্রের মতো পশ্চিমের ঘরের অনেকেই জামশেদপুরে টাটা কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তারাও সবাই সপরিবারে বাড়ি আসতেন। বরিশাল শহর থেকে আইনজীবী জ্যেঠামশাই, কোনও বার চাইবাসা থেকে পিসি পিসেমশাই ছাড়াও জুড়ানি ঠাকুমার মতো দূরের আত্মীয়রাও আসতেন। এক মধ্যের বাড়ির ঘরদুয়ারই বেশিরভাগ সময় বন্ধ দেখেছি। তা হলেও পুজোর ছুটিতে চৌধুরী বংশের বাকি তিন পরিবারের সদস্যের সংখ্যা কিছু কম ছিল না। এদের একটা বড়ো অংশই ছিল তরুণ। পনেরো থেকে পঁচিশের মধ্যে বয়স। এই বয়সের বিশ পঁচিশজন ছেলেমেয়ে এক জায়গায় হলে যে দিনভর হইহুল্লোড় চলবে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সব ঘরেই আত্মীয়স্বজনে ভর্তি। অতএব এই পুজোর সময় সব ঘরেই অতিরিক্ত কাজের লোক বহাল হল। আমাদের পুবের ঘরেই সারাদিন না হোক পাঁচ-ছ’জন মহিলাকে দেখেছি চিঁড়েমুড়ি খই ভাজছেন, মোয়া মুড়কি তৈরি করছেন, নারকেল কুড়িয়ে নাড়ুতক্তি বানাচ্ছেন। এই মহিলারা হোগলা ফুলের রেণু মিলিয়ে ক্ষীরের যে নাড়ু তৈরি করতেন, যে না খেয়েছেন তারা কল্পনাও করতে পারবেন না বরিশালে হোগলাগুঁড়ির নাড়ুর কি অপূর্ব স্বাদ। এইসব মোয়া মুড়কি নাড়ু তক্তি আর ঠাকুরমার আগেই তৈরি করে রাখা আমসত্ত্ব, আম ও জলপাইয়ের তেল আচার আমরা বড়ো বড়ো টিন ও চিনেমাটির বয়েম ভর্তি করে বাসাবাড়িতে নিয়ে যেতাম। সেখানে প্রতিবেশীরা অপেক্ষা করে থাকতেন বিশেষ করে হোগলাগুঁড়ির নাড়ুর জন্য।

যত কাজের লোকই বহাল হোক না কেন, রান্নাঘর কিন্তু সেই মা-ই সামাল দিতেন। পশ্চিমের ঘরে নোয়াদিদি। রান্নাও হতে হবে পঞ্চ নয় পঞ্চান্ন ব্যঞ্জনেই। বাঙালদের ডালই হয় কয়েক রকমের, বিশেষ করে কাজের বাড়িতে— তিতার ডাইল, চুকার (টকের) ডাইল, মুগের ডাইল, বুটের (ছোলা) ডাইলের না হোক যে কোনও দুটো দিনে হবেই। ভোর না হতেই মুসাই খাল থেকে চাই তুলে নিয়ে আসত। তাতে খলসে পুঁটি ট্যাংরা সরপুঁটি বেলে গলদা চিংড়ি মিলিয়ে আড়াই তিন সের পাঁচ মিশালি মাছ মিলতই। এই মাছ দিয়ে টুকিটাকি নানা রান্না। গোটা গোটা সরপুঁটি অথবা গলদা চিংড়ির মাথা ভাজা, খলসে পুঁটি ঢ্যাঁড়া বেলের ঝাল ঝোল চচ্চড়ি, মাথা বাদে চিংড়ির বাকি অংশ, দাঁড়া দিয়ে চালকুমড়োর ঘণ্ট যা রান্না হত, প্রাচীনা কোনও পূর্ব-বাঙালের কাছ থেকে রেসিপি জোগাড় করতে পারলে অভিজাত রেস্তোরাঁর উচ্চবেতনের শেফরা জিভে জল বাড়ানো নাম দিয়ে ফেস্টিভ্যাল লাগিয়ে দিতে পারবেন। গলদা চিংড়ির মাথা ভাজার ঘিলু দিয়ে একবার যিনি ভাত খেয়েছেন কেবল তিনিই বলতে পারবেন দেবভোগ কাকে বলে। অধিকন্তু হাটখোলার বাজার থেকে আসত রুই কাতলা ইলিশ মাছ। মাংস বিজয়া দশমীতে একদিনই। নবমীতে যে পাঁঠা বলি হত তার নিরামিষ মাংস। পুজোর কদিন নিজের ঘরই লোক ভর্তি থাকত। তা ছাড়া পশ্চিমের ঘরেরও অনেকেই তাদের সুন্দর বউদির কাছে আবদার করত তারা পূবের ঘরেই পাত পাড়বে। কারও খুড়ি কারও জেঠি পশ্চিমের ঘরে নোয়াদিদির বিরুদ্ধে এই শহুরে তরুণদের অভিযোগ ছিল রোজই ‘ভগবতীর নাড়’ খাইয়ে খাইয়ে তাদের মেরে ফেলা হবে। মুসাই রোজ ভোরে খাল থেকে এক বোঝা শাপলা তুলে আনত।। নোয়াদিদি সেগুলি কিছুতেই ফেলবেন না। কাজেই পশ্চিমের ঘরে প্রতিদিন ভাতের পাতে শাপলার কোনও না কোনও ব্যঞ্জন পড়বেই। এই শাপলাকেই জামসেদপুরের তরুণরা রসিকতা করে নাম দিয়েছিল ‘ভগবতী দুর্গার নাড়ি-ভুঁড়ি’। নোয়াদিদিকে চটিয়ে দেওয়ার জন্য তারা বলত পুজোর মধ্যে ‘ভগবতীর নাড়’ খাওয়া পাতকের কাজ। নোয়াদিদিও সারাদিন গজর গজর করতেন তিনি মুখ্যু সুখ্যু মানুষ হওয়ায় চিরকাল সকলের লাথি ঝাঁটা খেয়েই থাকতে হবে। ছেলেছোকরারা নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করার সময় নোয়াদিদিকে নকল করে বিকৃত উচ্চারণে বলত— ‘আছি আছি মুখ্যু সুখ্যু মানুষ একটা লাথ্যি লাগাইয়া দ্যান’।

দশমীতে মূর্তি জলে না ভাসানো পর্যন্ত পাঁচদিন শুধু হইহুল্লোড়। আনন্দ উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু বলা বাহুল্য দুর্গা মণ্ডপ। সেখানে প্রহরে প্রহরে নানা ছন্দে ঢাক বাজছে। সঙ্গে কাঁসর আর পুরোহিতের হাতের ঘণ্টা। আমাদের দুই ঢাকির নাম ছিল বলাই কাহার ও রবি কাহার। আমাদের বাড়ির অদূরেই তাদের জমি পত্তনি দেওয়া ছিল। পরিবর্তে বাড়ির সব পুজোপার্বণে তাদের ঢাক বাজাতে হত। বলাই রবি দুজন পিতাপুত্র। আমরা কিন্তু দুজনকেই কাকু ডাকতাম। বলাই কাকু আর রবির বেলায় উচ্চারণ বিকৃত করে রইব্যা কাকু। বলাই কাকু তার জামার ওপর একটা বেনিয়ান পরতেন। তাতে বেশ কয়েকটি রুপোর মেডেল ঝুলত কে সেগুলি দিয়েছিল কে জানে। সুঠাম দেহী রইব্যা কাকুর বরাবর উদোম গা, বড়ো জোর কখনও একটি স্যান্ডো গেঞ্জি পরতেন। আমাদের উৎসাহ ছিল বাপ ছেলের ঢাকের লড়াইয়ে। বিশেষ করে সন্ধ্যারতির সময় ডান হাতে ধুনুচিঁ, পঞ্চপ্রদীপ, শঙ্খ, পদ্ম, শাড়ি নিয়ে এবং বাঁ হাতের ঘণ্টা বাজিয়ে পুরোহিতের দেবী মূর্তির সামনে আরতি পুজোর অঙ্গ। যুবাদের উৎসাহ ছিল দুহাতে যত বেশি করে ধুনুর্চির ওপর ধুনুচি চাপিয়ে উদ্দাম নাচে। সঙ্গে সমান তালে বলাই কাকু রইব্যা কাকুর ঢাকে কাঠি। দুহাতে একের ওপর এক সাজানো পাঁচ পাঁচ দশটি ধুনুচি নিয়ে নাচা ছিল অতি সাধারণ ব্যাপার। কেউ কেউ সঙ্গে দাঁতে কামড়ে অতিরিক্ত আরও দু-তিনটি ধুনুচি নিয়েও নাচত। আরতির নানান মুদ্রা, দুরন্ত নেশা। এক ধরনের মাদারির খেলাও। কখনও কোমর থেকে পিঠটা পিছন দিকে বেঁকিয়ে কপালের ওপর একটি ধুনুচি রেখে ঢাকের তালে তালে অঙ্গভঙ্গি করা। কখনও ধুনুচির জায়গা দুই কাঁধে। মাথায় পিতলের কলসি রেখে তার ওপর না হোক গোটা তিন ধুনুচি নিয়ে ব্যালেন্সের খেলা দেখানো। নাচতে নাচতে কেউ কেউ অজ্ঞান হয়েও যেত। তখন তাকে চোখে মুখে জল দিয়ে সুস্থ করতে হত। আমরা ছোটরা এতসব কসরৎ করতে পারতাম না। আমরা শুধু দুহাত দিয়ে একটি ধুনুচি ধরে ঢাকের তালে তালে নিজেদের মতো করে নাচতাম।

ওই সময় সন্ধ্যা নামতেই গ্রাম বাংলা নিঝুম হয়ে যেত। এমন গ্রামও ছিল যে গ্রামের অধিকাংশ লোকই দেখা দূরস্থান ইলেকট্রিক লাইটের নামও শোনেনি। সূর্য ডুবতে না ডুবতেই গ্রামের পর গ্রাম শুধুই অন্ধকার আর অন্ধকার। দূরে দূরে হয়ত কোনও বাড়ির খোলা জানলা দিয়ে ঘরের হ্যারিকেন অথবা কুপির আলোর ক্ষীণ রেখা দেখা যেত। স্বাভাবিক, নেহাত জরুরি না হলে কেউ বড়ো একটা বাইরে বের হত না। পুজোর সময় ভিন্ন কথা। সারা দিনই দুর্গা প্রতিমা দেখতে দলে দলে লোক আসত। হাত ভরে প্রসাদ নিত। মূর্তি দেখতে মুসলমানরাও আসত। তবে তাদের কখনও দুহাত বাড়িয়ে প্রসাদ নিতে দেখেছি মনে পড়ে না। দুর্গাপুজো মুসলমানরা কি চোখে দেখত সে সম্পর্কে বাবার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু কলকাতার সিটি সিভিল কোর্টের আইনজীবী বঙ্কিমকাকু (দেব) একটা ভারি মজার ছড়া শোনাতেন, হিন্দুগো দুগ্গা পূজা বেলপাতা বোঝা বোঝা। ঠাকুর দেখলাম নানী, দুগ্গা দেখলাম চাচী। কেমন দেখলো, ছড়ার সেই লাইনগুলিও মনে থাকলে বেশ হত। যেমন গণেশ হলো এক ব্যাটা থোম্বা মতন, কান দুইডা তার কুলার মতন। দাঁত দুইডা মুলার মতন। ঠ্যাংয়ের উপর ঠ্যং ছড়াইয়া বইস্যা আছেন বোঁচা। ছড়াটি বঙ্কিমকাকুর স্বরচিত হতে পারে। সারা দিনের মতো সন্ধ্যায় আরতি দেখতেও ভিড় কিছু কম হত না। আরতি চলত অনেক রাত পর্যন্ত। দুর্গা মণ্ডপে হ্যাজাক বাতি জ্বলত। সেখানে আলো দিনের মতোই উজ্জ্বল। যারা আরতি দেখতে আসতেন তাদের সুবিধার জন্য বাবা মশালের মতো বড়ো বড়ো লম্ফ বানিয়ে আনতেন। হাটখোলা থেকে দুর্গা মণ্ডপ পর্যন্ত গাছে গাছে রেড়ির তেলের ওই লম্ফগুলি বেঁধে দেওয়া হত। আকাশে শুক্লপক্ষের ক্রমে বড়ো হওয়া চাঁদ তো ছিলই। সারাদিন প্রায় পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণ, চণ্ডীপাঠ, ধূপ গুগ্গুল ও ফুলের গন্ধে একটি পবিত্র ভাব মনে আপনি জাগত। দক্ষিণের বাড়ির মণ্ডপে চণ্ডীপাঠ করতেন জ্ঞানরঞ্জন ঠাকুরদা নিজেই। অব্রাহ্মণের চণ্ডীপাঠের অধিকার আছে কি না বিতর্কের তোয়াক্কা না করেই। উত্তেজনার পারদ সব চাইতে উঁচুতে চড়ত নবমীর দুপুরে বলির সময়। শুনেছি আগে নাকি সপ্তমী অষ্টমী নবমী পুজোর তিনদিনই পশুবলি হত। আমরা কখনও দেখিনি। আমরা দেখেছি সপ্তমী অষ্টমীতে কলা, শশা, চালকুমড়ো ও আখ বলি। পাঁঠা বলি কেবল নবমীতে। আর সব শেষে ‘শত্রু’ বলি। বাড়ির মেয়েদের কেউ পিটুলি দিয়ে মানবাকৃতি তৈরি করতেন। তাতে আলতা ও কালি দিয়ে চুল ও চোখ নাক মুখ ও বিশাল গোঁফ এঁকে বীভৎস রূপ দেওয়া হত। এই পিটুলি মানব মূর্তিই শত্রু। ওই শত্রুকে হাড়িকাঠে চাপিয়ে ছেলেবুড়ো সকলে একসঙ্গে রামদার হাতল ধরে কুপিয়ে কুপিয়ে খণ্ড খণ্ড করে কাটা হত। শত্রু নিধনের এই সাফল্যে কতই না উল্লাস ছিল। বরাবর দেখেছি আমাদের বাড়ির ‘শত্রু’ তৈরি মা-ই করতেন। পিটুলি গুলে আলপনা তিনিই দিতেন। তার এই শিল্পকীর্তি দেখতে বাড়িতে দলে দলে লোক আসত। তিনচার বছর বয়স থেকেই আমার মেয়ে পাঞ্চালীও সুন্দর আল্পনা দেয়। কেউ প্রশংসা করলে ওই শিশু বয়সেই সে দেমাক করে বলত, ঠাকুরমার হাত পেয়েছি। শত্রু বলির বেলা বাড়ির পুরুষেরা সবাই হাত লাগালেও পাঁঠা বলির দায়িত্ব নেওয়ার সাহস কারও ছিল না। খাঁড়ার (আমরা বলতাম রামদা) এক কোপে পাঁঠার ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা না করতে পারলেই চিত্তির। বাড়ির মহিলা মহলে কান্নার রোল উঠত। নির্ঘাত পরিবারের কোনও দুর্দৈব আসন্ন। আমাদের বাড়িতে ওই অঘটন কোনোদিনই ঘটেনি। তবে দুর্ঘটনা একটা ঘটেছিল। আমার জন্মের আগেই। সম্ভবত দিদিও তখন জন্মায়নি। বলির সময় ছেলে বুড়ো মেয়ে পুরুষ বাড়ির সকলেই এসে হাড়িকাঠ ঘিরে ভিড় জমাত। আসতেন গ্রামের বহু লোকও। বলাইকাকু রইব্যাকাকুর ঢাকের সঙ্গে কাহার বাড়ির ছোটো দু-তিনটি ছেলের তাল মিলিয়ে কাঁসরের বাজনা, পুরোহিতের গলায় শিরা ফুলিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ, বলির পাঁঠার মৃত্যুপূর্ব আর্তনাদ এবং সমবেত জনমণ্ডলীর মুহুর্মুহু দুর্গামার জয়ধ্বনিতে সেখানে তখন মহাহট্টোগোল। বলিকে ঘিরে উপস্থিত সকলের তখন এক ধরনের নেশাগ্রস্ত অবস্থা। বলি সফল হওয়ার আনন্দে একে অপরকে জড়িয়ে ধরা, হাড়িকাঠের চারধারে মাটি থেকে কাটা পশুর রক্ত তুলে গা মাথায় মাখামাখি করতে করতে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ঢাকের বাজনার তালে তাল মিলিয়ে উদ্দাম নাচ চলত অনেকক্ষণ ধরে। রক্তের লোভে সেখানে অনেক পথের কুকুরও জুটে যেত। একবার এরকমই একটা কুকুর দাদার ডান পায়ের বুড়ো আঙুল কামড়ে প্রায় ছিঁড়ে নেওয়ার উপক্রম করেছিল। দাদা তখন কোলের শিশুই বলা যায়। সেইবার মাসিমা চারুবালা পুজোয় দিদির বাড়িতে ছিল। সেও তখন বালিকা। তারই কোলে চেপে দাদা বলি দেখছিল। রক্তের লোভে ঘুরঘুর করা একটি কুকুরকে লাথি দিয়ে তাড়াবার চেষ্টা করতেই কুকুরটি লাফ দিয়ে দাদার পায়ের বুড়ো আঙুল কামড়ে ধরে। কুকুরের মুখ থেকে ছাড়াবার আগেই আঙুল পা থেকে প্রায় আলাদা হয়ে গেছে। এখন হলে নিশ্চয়ই হাসপাতাল নার্সিংহোম ছোটাছুটি হত। সার্জেন অপারেশন করতেন। কয়েক প্রস্থ অ্যান্টিবায়োটিক চলত। অ্যান্টি-র‌্যাবি ইনজেকশন তো অবশ্যই। হাটখোলায় দু-দুজন অ্যালোপাথ ডাক্তার থাকলেও গ্রামের কোনও এক গুণিন নাকি দাদার চিকিৎসা করেছিলেন। তিনি কি একটা পাথর ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেন। বিষ সম্পূর্ণ টেনে না নেওয়া পর্যন্ত ওই পাথর নাকি ক্ষতস্থানে আটকে ছিল। বিষমুক্ত হলে নিজে নিজেই পড়ে যায়। তারপর কোনও জড়িবুটি দিয়ে আঙুলটি বেঁধে দেওয়া হয়। অশিক্ষিত গেঁয়ো বলতে যা বোঝায় বোধহয় সে সময়ও আমাদের পরিবার ওই পদবাচ্য হতে পারত না। তবুও সাংঘাতিক বিপজ্জনক পথের কুকুরের কামড়ের চিকিৎসা এক গুনিনের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল ভাবতেও অবাক লাগে। তবে এখনও কিন্তু দাদার পায়ে কুকুরের কামড়ের দাগ কষ্ট করে খুঁজে পেতে হয়।

দাদাকে কুকুরে কামড়ানো নয়, বলি প্রসঙ্গে আমাদের সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে বাবার অকাল মৃত্যু। আগেই বলা হয়েছে কোনও এক সময় পশু বলি হত সপ্তমী অষ্টমী নবমী তিনদিনই। পরে আমরা দেখেছি কেবল নবমীতে। সেবার দক্ষিণের বাড়ির মনোরঞ্জন তাউইমশাই আওয়াজ তুললেন পশুবলি একেবারেই বন্ধ করতে হবে। তাউইমশাইকে নাস্তিক কিছুতেই বলা যাবে না। বর্ণক্ষত্রিয় সুবাদে তিনি পৈতেধারী। আমার বাবার গলায়ও পৈতে ছিল আমাদের প্রজন্মের কেউ আর পৈতে নেয়নি। বর্ণনানুসারে আমরা ক্ষত্রিয় অথবা কুলীন কায়স্থ তা নিয়ে মাথা ঘামানো হয় না।) দুর্গা মণ্ডপে নিজেই চণ্ডীপাঠ করতেন। সর্বোপরি সে সময় পূর্ববঙ্গে অঘোষিত রাজধানী ঢাকায় হিন্দু মহাসভার বড়ো পাণ্ডা। তাউইমশাই ঘোষণা করলেন, পশুবলি একটি নৃশংস আচার। মা দুর্গা যদি নিতান্তই রক্ত বিনা তুষ্ট না হন তাহলে নিজেদের বুক চিরে রক্ত দাও। একটি অসহায় পশুকে হত্যা করা কেন? ১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝি তার এই ঘোষণা নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক। স্বাভাবিকভাবেই তার মতামতে চৌধুরী পরিবারে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। একজন ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আমার বাবা কিন্তু তাউইমশাইয়ের প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। এমনও হুমকি দিয়েছিলেন যে অন্য যে যাই বলুক তিনি আমাদের দুর্গা মণ্ডপে পশুবলি বজায় রাখবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাবাকেও তাউইমশায়ের কথা মেনে নিতে হয়েছিল। তবে তা যুক্তি দিয়ে নয়, গুরুজনকে শ্রদ্ধাবশে। অতএব সেবার বলি বন্ধ হল। আর বাবাও বছর না ঘুরতেই মারা গেলেন। মৃত্যুর আগে তার গলা দিয়ে ঘটি ঘটি রক্ত উঠেছিল। বলি বন্ধ হওয়া ছাড়াও সেবারে আরও একটি অঘটনে বাবা অশুভের সঙ্কেত পেয়েছিলেন। দুর্গাপুজোর পরেই লক্ষ্মীপুজো। আমাদের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজোর কোনও মূর্তি আনা হত না। পুজোও দুর্গামণ্ডপের পরিবর্তে ঘরেই। পুজো হত কলাবউয়ের সামনে। ধান, মান কলা, হরিদ্রা বেল ও ইক্ষু কলাবউ তৈরির উপকরণ। যতদিন বেঁচে ছিলেন বাবা-ই কলাবউ বানাতেন। লালপেড়ে নতুন শাড়ি পরাতেন। পুজোয় মূর্তি না থাকলেও লক্ষ্মীর সরা থাকত। একটি নয় দুটি লোকশিল্পের অপূর্ব নিদর্শন এই দুই সরার একটিতে লক্ষ্মী এক চোখো। অন্যটিতে অবশ্য দুচোখই থাকত। একচক্ষু লক্ষ্মীর তাৎপর্য আজও জানি না। পূর্ববঙ্গের মৃৎশিল্পীদের আঁকা এই মাটির সরা কোনও বিচারেই কালীঘাটের পটুয়াদের শিল্প সৃষ্টির চেয়ে ন্যূন গণ্য হবে না। দেশান্তরী মৃৎশিল্পীরা এখন এই বাংলার লক্ষ্মীপুজোতেও সরার প্রচলন ঘটিয়েছেন।

সেবারও সারাদিন কোজাগরী লক্ষ্মীর পুজোর আয়োজন হয়েছে। বাবা কলাবউ বানিয়েছেন। মা গোটা বাড়ি আলপনা দিয়েছেন। প্রদোষ পুজো। আয়োজনও প্রায় শেষ। সন্ধার মুখেই পুরোহিত পৌঁছে গেলেন। আমাদের বাড়ির রীতি ছিল লক্ষ্মী পুজোয় ঢাক কাঁসর ঘণ্টা কিছুই বাজবে না। উৎকট আওয়াজে লক্ষ্মী বাড়ি ছেড়ে যান। তাই লক্ষ্মী পুজোয় শুধু শঙ্খ আর উলুধ্বনি। পুজোর এক একটি উপকরণ সাজানো হচ্ছে সঙ্গে শঙ্খ ও উলুধ্বনি। সেকালে বরিশালের গ্রামে আপেল আঙুর অথবা কমলালেবুর মতো অভিজাত ফল কদাচিৎ মিলত। প্রসাদের ফল ছিল কলা শশা জাম্বুরা (বাতাবি লেবু) আখ নারকেল চিলু নারকেল কোরা। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দুটি বিশেষ উপকরণ ছিল পাথরের গ্লাসে ডাবের জলের ওপর নারকেলের ফোঁপল ভাসানো এবং তালশাঁস। ভাদ্রমাসে তালের বড়া, তা লক্ষ্মীর খাওয়ার পর আঁটিগুলি ফেলে রাখা হত ছাইয়ের গাদায়। আশ্বিন-কার্তিকে লক্ষ্মীপুজোর দুই আবশ্যিক উপকরণ। ফুলের মধ্যে নলটুনি। সাদা পাপড়িতে বেগুনি রঙের ছিট এই ছোটো ছোট জলজ ফুলটি পশ্চিমবাংলায় বড়ো একটা চোখে পড়ে না। যে-কোনও পুজোতেই চাল কলার নৈবেদ্য দেওয়া হয়। বরিশালে দ্বিতীয় নৈবেদ্যর উপকরণ ছিল কাঁচামুগ ডাল ভেজানো, নারকেল কোরা ও চিনি। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় মোয়া মুড়কি নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু তক্তি কদমা চিনির খেলনা হবে না ভাবাই যায় না। সেবার সব আয়োজনই সম্পূর্ণ। শুধু কুমোর বাড়ি থেকে লক্ষ্মীর সরা আসতেই যা দেরি হচ্ছে। সরাও এসেছিল ঠিক সময়েই। তবুও তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে একটি সরা বাবার হাত থেকে মাটিতে পড়ে ভেঙে যায়। পুরুতমশাই বাবাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। সরা পুজোর আসনে বসিয়ে প্রাণপ্রতিষ্ঠার আগে ভেঙেছে এতে অমঙ্গলের কিছু নেই। কুমোরবাড়িতে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কত সরা মূর্তিই তো ভাঙে। পুরোহিতের আশ্বাসে বাবার মনে কোনও প্রভাব পড়েছিল কি না বোঝার উপায় ছিল না। কুমোর বাড়ি থেকে নতুন সরা আনিয়ে পুজো হয়েছে। অন্যান্য বছরের মতোই বাসাবাড়িতে ফিরে যাওয়ার আগে তিন্নাথের মেলা হয়েছে। কীর্তনের দল এসেছে। গান হয়েছে। অন্ধে দ্যাখে খোঁড়ায় নাচে বোঝায় বলে বোম ভোলা, কলিতে তিন্নাথের মেলা। শুধু বাবা যেন ছিলেন কিছুটা আনমনা। আশ্বিনে বলি বন্ধ হল, লক্ষ্মীর সরা ভাঙল। মাত্র ছমাস পরেই বাবা মারা গেলেন বৈশাখে। লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসের বাসাবাড়িতে। সেটা ১৯৪৬ সাল। পূর্ববঙ্গে বস্ত্রশিল্পে ধর্মঘট চলছে। মিল চত্বর নিঃশব্দ। মাঝে মাঝে মিল গেটে ধর্মঘটি শ্রমিকদের স্লোগান। এরই মধ্যে এক সন্ধ্যায় বাবার গলা দিয়ে ঝলকে ঝলকে রক্ত উঠল। বাবার ছিল রক্তের উচ্চচাপ। অনেকেই বললেন খুব ভালো হল। সাংঘাতিক কিছু হওয়ার বিপদ কেটে গেল। বাবাও বলেছিলেন তিনি নাকি বেশ ভালো বোধ করছেন। তার শরীর ঝরঝরে হালকা লাগছে। সাতদিনের মাথাতেই আর এক সন্ধ্যায় বাবা বুকে ব্যথার কথা বললেন। ডাক্তার এসে কিছু ওষুধপত্র দিয়ে শুয়ে থাকতে বললেন। আমাদের ছোটোদের, মা তাড়াতাড়ি খাইয়ে শুইয়ে দিয়েছিলেন। কান্নার শব্দ শুনে উঠে দেখলাম সব শেষ। ডাক্তার আবার এসেছিলেন। মাথা নীচু করে বেরিয়ে যাচ্ছেন। পরে মা মুখে শুনেছি অসহ্য বুকের ব্যথায় বাবা শুতেও পারছিলেন না। বুক চেপে বসেছিলেন। ডাক্তার এসে একটা ইনজেকশন দেন। বাবা নাকি শেষ কথা বলেছিলেন— ডাক্তার কিছু করতে পারলেন না। সেদিন অক্ষয়তৃতীয়া।

চোদ্দো

বাবার মৃত্যুর সময় দাদা ছিলেন বরিশালে মাসি বাড়িতে। মুখাগ্নি, তার আগে ঘি মাখিয়ে স্নান করানো, নতুন কাপড় পরানো, মন্ত্রোচ্চারণ ক্রিয়াকর্ম শেষকৃত্য যা যা করণীয় সবই আমি করেছিলাম। কোনও কিছুর তাৎপর্য না বুঝেই। পরে বড়ো হয়ে মাঝে মাঝেই মনে হয়েছে এ কেমন ধর্মের বিধান, সদ্য পিতৃহারা ছ-বছরের একটি বালককে তার বাবার মৃতদেহে অগ্নিসংযোগ করতে বাধ্য করা। একই কথা সেদিনই বোধহয় ভাবছিল শীতল্যক্ষা নদীর ধারে বাবার জ্বলন্ত চিতার সামনে সজল চোখে বসে থাকা বাবার অতি প্রিয় কুকুর ডলি। ডাক্তার বাবার মৃত্যু ঘোষণার পর বাড়িময় কান্নার রোল ওঠা থেকেই ডলি বারবার লাফিয়ে বাবার বিছানায় উঠেছে, এর ওর কাছে ছুটে গিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করেছে ব্যাপারটা ঠিক কী হল। শবযাত্রীদের সকলের পিছনে পিছনে একটাও শব্দ না করে নদীর ধারে গিয়ে সেখানে ধর্মীয় আচার আচরণের প্রতিটি খুঁটিনাটি লক্ষ করেছে। ডলি সম্ভবত বুঝেছিল ওই পরিবেশে চুপচাপ থাকাই সমীচীন। একবারই শুধু ডলি আকাশের দিকে মুখ তুলে বুকফাটা আর্তনাদ করেছিল। যখন চিতার আগুন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। ও নিশ্চয়ই বুঝেছিল প্রিয় প্রভু চিরতরে হারিয়ে গেল। বাবার দেহ পুড়ে ছাই হওয়ার পর আমাকে আর এক দফা নানা আচার পালন করতে হয়েছিল। মাটির কলসিতে শীতল্যক্ষা নদীর জলে চিতার আগুন নিভিয়ে একটি লোহার দা দিয়ে পিছনে কলসিতে শীতল্যক্ষা নদীর জলে চিতার আগুন নিভিয়ে একটি লোহার দা দিয়ে পিছনে ফিরে ওই কলসি কুপিয়ে ভেঙে দিয়ে ফিরে এসেছিলাম। এরপর আর পিছনে তাকানো নিষেধ। পিছন ফিরতেই প্রেতাত্মার দেখা পাওয়া যায়। শ্মশান থেকে ফিরে আসার পর কারও খেয়াল হয়নি ডলি সঙ্গে এল কিনা। ডলির কথা মনে পড়ে দুতিন দিন পর শোকের প্রথম ধাক্কা স্তিমিত হওয়ার পর। আর তখনই জানা যায় প্রভুবিহীন ঘরে সে আর ফিরে আসেনি। কেউ বলেছিল বাবার শ্মশানের সামনে ওই দুতিন দিন তারা ডলিকে ঠায় বসে থাকতে দেখেছে। আবার কেউ বলেছে ভোরের আলো ফোটার মুহূর্তে একটা কুকুরকে চিতা প্রদক্ষিণ করতে দেখা যায়। ঠিক যেমন আমি পুরোহিতের নির্দেশে আগুন নেভার পর প্রদক্ষিণ করেছিলাম। কোনটা সত্যি যাচাই করে দেখার মতো তখন বাড়িতে কারও মনের অবস্থা ছিল না। তা ছাড়া দুঃসংবাদ পেয়ে ঠাকুরমা দেশের বাড়ি থেকে চলে এসেছিলেন। ঘরে কুকুর ঘুরে বেড়াবে এমন অনাচার তিনি কিছুতেই সহ্য করতেন না। ডলির ঠাকুরঘরেও ঢুকতে বাধা ছিল না জানতে পেরে কুমুদিনীর স্থির বিশ্বাস হয়েছিল এই অধর্মের কারণেই তার জওয়ান ছেলের অকাল মৃত্যু ঘটেছে। বাস্তবিক বাবার তখন মাত্রই ৪২ বছর বয়স।

বাবার শেষ কাজ করার শাস্ত্রীয় অধিকার বড়ো ছেলের। আমি জেনে গেছিলাম দাদা চলে আসলেই আমাকে শ্মশানঘাটে যে নতুন কাপড় পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল তা আর পরতে হবে না। দাদাই ওই কাপড় পরবেন। গলার ধরাও দাদার হাতেই তুলে দেব। বেশ খুশিতেই ছিলাম। ওইসব কাপড় রং করা থিয়েটারের সিন হতে পারে। বরিশাল থেকে দাদা চলে আসারই যা অপেক্ষা। তিনি চলে এসেছিলেনও দিন তিনেকের মাথাতেই। আর তারপরেই দাদা ও মায়ের মধ্যে বারবার নিভৃতে আলোচনা, দুইয়েরই মুখে সর্বদা দুশ্চিন্তার ছাপ দেখে একটু একটু আন্দাজ করতে শুরু করেছিলাম যে, আমাদের পরিবার এক গভীর অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়েছে। জামশেদপুর থেকে ঠাকুরদা সতীশচন্দ্র ভ্রাতুষ্পুত্রের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে চলে এসেছিলেন। তিনি আমাদের দেশের বাড়ি চলে যাওয়ার সহজ সমাধান বাতলে দেন। সেখানে অন্তত খাওয়াপরার অভাব হবে না। কথাটা নেহাতই ভিত্তিহীন ছিল না। দেশের বাড়িতে ভাত কাপড় হয়ত জুটে যেত। কিন্তু প্রশ্ন ছিল আমাদের লেখাপড়ার কি হবে। বাঁকাই গ্রামে সে সময় একটা প্রাথমিক স্কুলও ছিল না। গ্রামের বর্ণহিন্দুদের ছেলে যারা স্কুল কলেজের মুখ দেখেছে তারা প্রবাসী। পাঁচসাত মাইল ঠেঙিয়ে পাশের জেলা ফরিদপুরের সেদাকুল নামের গঞ্জে ছিল একটি হাইস্কুল। মেয়েদের কি উপায় ছিল জানা নেই। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার চিন্তাই সম্ভবত সে সময় মাকে সবচেয়ে বেশি পীড়িত করছিল। ঢাকার দুই তাউইমশাই মনোরঞ্জন ও জ্ঞানরঞ্জন মনে করেছিলেন দেশের বাড়ি গেলে আমাদের লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার আশংকাই বেশি। নারায়ণগঞ্জে অথবা কাছাকাছি কোথাও বাড়ি ভাড়া করে থাকা যেতে পারে। কিন্তু দেশ থেকে ডাউরিকাকু ঠিকমতো টাকা পাঠাতে না পারলে অসুবিধা দেখা দেবে। ঝটতি কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছিল না। শেষপর্যন্ত সহজ সমাধান করে দিলেন বাবারই নিয়োগকর্তারা। কর্মস্থলে অবসর পরবর্তী পেনসন গ্রাচ্যুইটি প্রভিডেন্ট ফান্ডের মতো কোনও আইনি সামাজিক নিরাপত্তার সংস্থান তখনও হয়নি। অবসরেরও কোনও নির্দিষ্ট বয়স ছিল না। কর্মক্ষম থাকলে এবং মালিক চাইলে আমৃত্যু চাকরি করা যেত। কর্মরত অবস্থায় মৃত্যু হলে মৃতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ বা সাহায্য দেওয়া হত মালিকের মর্জি মতো। লক্ষীনারায়ণ কটন মিলসের কর্তৃপক্ষ বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের পরিবারের প্রতি নজিরবিহীন উদারতা দেখিয়েছিলেন। হতে পারে ম্যানেজিং ডিরেক্টর রমেশ রায় চৌধুরী ও ম্যানেজার সুনীল বসু বাবার ব্যক্তিগত বন্ধু হওয়ার সুবাদে। তাছাড়া, স্বদেশি শিল্প। স্বংয় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এখানে এসেছিলেন। ডিরেক্টরস বোর্ডের সদস্য এবং অফিসারদের সঙ্গে তাঁর ছবিও আছে। ১৯৩৯ সালে তোলা সেই ছবিতে বাবার উজ্জ্বল উপস্থিতি। সে ছবি আমাদের পরিবারের আজও অমূল্য সম্পদ। ঢাকার মনোরঞ্জন তাউইমশাইয়ের রাজনৈতিক প্রভাবও ছিল। সবমিলিয়ে লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস কর্তৃপক্ষকে পারিবারিক বিপর্যয়ে আমাদের পাশে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করে তাকবে। কোম্পানি আমাদের পরিবারকে দুটি ভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছিল। প্রথম প্রস্তাবে দাদা যতদূর পর্যন্ত পড়তে চাইবেন, এমনকী বিলেত গিয়েও, কোম্পানিই সমস্ত খরচ দেবে। দ্বিতীয় প্রস্তাবে দাদাকে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে শিক্ষানবিশের চাকরি দিতে চাওয়া হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়াতে দিদি, আমি অথবা আমার দুটি বোনের কোনও ভূমিকা ছিল না। সবচেয়ে ছোটো বোন মঞ্জু তখন মাস কয়েকের কোলের বাচ্চা, সেজো বুলুর (অরুণা) বছর দুই বয়স, আমি ছয় এবং দিদি বছর বারো। দিদি তবু কিছুটা গম্ভীর, পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে। চুপচাপ এর ওর মুখের দিকে তাকানো ছাড়া আমার কিছু করণীয় ছিল না। ছোটাছুটি হেসে কেঁদেই দিন কাটে। এরই মধ্যে একদিন দেখা গেল কোথা থেকে একখণ্ড চকখড়ি জোগাড় করে বুলু সিমেন্ট বাঁধানো মেঝেয় বাংলা বর্ণমালার বেশ কয়েকটি অক্ষর লিখে ফেলেছে। কে কবে ওইটুকু শিশুকে লিখতে শেখাল সবাই তাজ্জব। পরেও দেখেছি লেখাপড়ার সর্ব্বোচ্চ ধাপ পেরিয়ে অধ্যাপনাকে পেশা করার পেছনে পারিবারিক সহায়তার চেয়ে বুলুর ব্যক্তিগত চেষ্টাই বেশি ছিল। বাবার মৃত্যুর পর দেশের বাড়ি চলে গেলে এই চেষ্টা কতটা সফল হত অনুমানের বিষয়। দাদা আর পড়াশোনা না করে লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসেই শিক্ষানবিশের চাকরি নেবেন, মা ও দাদার এ মতো সিদ্ধান্ত নিতে আপাত ছোটো এরকম ঘটনাও হয়ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।

দাদা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে শিক্ষানবিশ হয়ে ঢুকলেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল আমরা থাকব কোথায়। যে কোম্পানি কোয়াটার্সে আছি— জ্ঞানরঞ্জন তাউইমশাইয়ের বিশেষণে স্যানাটোরিয়াম— সেটি একজন শিক্ষানবিশকে বরাদ্দ করা যায় না। আমাদের পাতানো কাকা প্রভঞ্জ নদত্ত আমাদের বাড়িতেই থাকতেন। তার স্ত্রী কণিকাও। আমাদের সে সময় বউদি ডাকার মতো কোনও আত্মীয় মহিলা ছিল না। অতএব ভাইবোনেরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কণিকাকে আমার কাকি নয় বউদি ডাকব। পাতানো সম্পর্কে ডাকাডাকির ব্যাপারটা যুক্তির ধার ধারে না। বিক্রমপুরের অখ্যাত এক গ্রাম থেকে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ যুবক প্রভঞ্জন লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসে শিক্ষানবিশ হয়ে ঢুকে বাবার সুনজরে পড়েছিলেন। বাবাকে দাদা সম্বোধন করতেন। সেই সুবাদেই আমাদের কাকা। কিন্তু আমাদের মাকে তিনিও মা-ই ডাকতেন। আমাদের বাসাবাড়ি থেকেই তার বিয়ে হয়েছিল। প্রভঞ্জন কাকা কণিকা বউদি আমাদের পরিবারেরই হয়ে গিয়েছিলেন। কালক্রমে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কর্মস্থলে তার পদোন্নতি হয়েছে। অফিসারের মাত্রই একধাপ নীচে তখন তিনি। প্রভঞ্জন কাকা কোম্পানির কাছে দরবার করলেন বাবার নামের কোয়াটার্সটি তাকে বরাদ্দ করা হলে আমাদের থাকার কোনও সমস্যা থাকে না। কোম্পানির কর্তাদের বোধ হয় প্রস্তাবটি বিচার করতে তেমন আপত্তি ছিল না। কিন্তু বেঁকে বসেছিলেন মা। মার যুক্তি ছিল রক্তের সম্পর্কও যখন ভেঙে যায় তখন পাতানো সম্পর্ক বরাবর বজায় থাকবে তার স্থিরতা কোথায়। মা সরাসরি কোম্পানির কর্তা ব্যক্তিদের জানিয়ে দিলেন, আমাদের বাসাবাড়ি দাদার নামে বরাদ্দ করা সম্ভব না হলে বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে। তেমন হলে স্টাফ কোয়াটার্স-কম্পাউন্ডের বাইরে কোনও ভাড়া বাড়িতেও আমরা উঠে যেতে পারি। কিন্তু আবারও ম্যানেজিং ডিরেক্টর শচীন্দ্রনাথ চৌধুরী ও ম্যানেজার সুশীল বসু আমাদের পরিবারের প্রতি বহুজনের ঈর্ষণীয় পক্ষপাতিত্ব করেছিলেন। আমাদের বাসাবাড়ি দাদার নামেই নতুন করে বরাদ্দ হয়েছিল। আমাদের অন্য কোথাও যেতে হয়নি। অল্প দিনের মধ্যেই প্রভঞ্জন কাকাই গ্রামের বাড়ি থেকে নিজের মা ভাইদের নিয়ে এসে ভিন্ন কোয়াটার্সে নতুন সংসার পেতেছিলেন। ১৯৯১ সালে বর্তমান বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় কার্যনির্বাহী সফরের সুযোগ হয়েছিল। শৈশব স্মৃতি সব সময়ই সুখের। ঢাকা গিয়ে মাত্র কয়েক কিলোমিটার ব্যবধানে লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসে যাব না হতেই পারে না। আমাদের সেই বাসাবাড়ি এখনও লোকে ঘোষবাবুর কোয়াটার্স বলে শুনে স্মৃতিমেদুরতায় কতটা আচ্ছন্ন হয়েছিলাম তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। চোখ দিয়ে জল ঝরেনি ঠিকই, তবে ভিতরে থেকে উথলে ওঠা কি যেন এক বোধে গলা আটকে আসছিল।

সিদ্ধান্ত নিতে মার যে কদাচিৎ ভুল হয় তার প্রমাণ আরও বহুবার পেয়েছি। বাবা মারা যাওয়ার এক বছর ঘোরেনি। হঠাৎ এক দুপুরে পরিধানে রক্তবর্ণ কাপড়, প্রায় অনুরূপ রক্তবর্ণ চোখ, মাথায় জটা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, পায়ে কাঠের খড়ম, হাতে কমণ্ডলু জনৈক তান্ত্রিক মহারাজকে সামনে নিয়ে কয়েকজন পুরুষ ও মহিলা আমাদের বাসা বাড়িতে উপস্থিত। তাদের গায়ে শাড়ি জামা গহনার বহর দেখে বলে দিতে হয় না যে তারা ধনাঢ্য। পরিচয় দিলেন তারা পূর্ববঙ্গের কোনও এক বিশাল জমিদার বংশ। জমিদার না বলে রাজা বলাই নাকি সমীচীন। অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজনেই তারা আমাদের বাসাবাড়িতে এসেছেন। দাদা তখন কারখানায়। তাকে খবর দিয়ে আনা হল । রবাহূত আগন্তুকদের জলযোগের ব্যবস্থাও হল। আবশ্যিকভাবেই তান্ত্রিক মহারাজের জন্য ফল দুধ। এবং জানা গেল অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজনটাও। জমিদারমশাই তার একমাত্র ছেলের জন্য সুন্দরী সুলক্ষণা ও সৎবংশজাত একটি পাত্রীর সন্ধান করছেন। তান্ত্রিক মহারাজ গণনা করে জেনেছেন সেই পাত্রী রয়েছে আমাদের বাড়িতে। বলা নিষ্প্রয়োজন আমার দিদিই সেই উদ্দিষ্ট পাত্রী। আগন্তুকরা প্রস্তুত হয়েই এসেছেন। আমরা রাজি হলে সেদিনই তারা পাত্রীকে আশীর্বাদ করে যাবেন। বিয়ের দিনক্ষণও তাদের স্থির করাই আছে। আকস্মিক এমন এক প্রস্তাবে মা ও দাদা কতটা বিস্মিত হয়েছিলেন অনুমান করা যায়। দিদির বয়স তখন মাত্র বারো। সেকালে মেয়েদের অল্প বয়সেই বিয়ে হত। তা হলেও সেকালের বিচারেও দিদি তখন বিবাহযোগ্য হয়নি। শুনেছি মার বিয়ে হয়েছিল চোদ্দো বছর বয়সে। তবে সে তো না হোক বিশ বাইশ বছর আগের কথা। তবুও অতিথি নারায়ণ। তাদের মুখের ওপর রূঢ় কথা বলা যায় না। অকাট্য যুক্তি দিয়ে অতি বিনয়ের সঙ্গেই মা মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। দিদির বয়স লেখাপড়া ইত্যাদি তো বলেছিলেনই, তা ছাড়া বাবার মৃত্যুর কারণে আমাদের যে কালাশৌচ চলছে, এক বছর পার না হলে কোনও শুভ অনুষ্ঠান করা শাস্ত্রসম্মত হবে না সে কথাও তান্ত্রিক মহারাজকে বলা হয়। সর্বোপরি ঠাকুরদা সতীশচন্দ্র, দুই তাউইমশাই মনোরঞ্জন-জ্ঞানরঞ্জন, নোয়াদাদু প্রভাতরঞ্জন-সহ অভিভাবক স্থানীয়দের সম্মতি ছাড়া কোনও আগাম সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তান্ত্রিক মহারাজের এসব কোনও যুক্তিই ন্যায্য মনে হয়নি। মনে আছে রক্তচক্ষু মহারাজের গলা সপ্তমে চড়িয়ে শাপমন্যি, যেখানে স্ত্রী নায়ক, শিশু নায়ক ও বহু নায়ক সে সংসারের কোনোদিন মঙ্গল হয় না। আমাদের সর্বনাশ হবে। সর্বনাশ আমাদের হয়নি। দিদি লেখাপড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ধাপ পার হয়েছেন, ঢাকা রেডিওতে গান করেছেন, রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালিত কলেজে অধ্যাপনা করেছেন এবং আমাদের মতো মাঝারি বিত্তের পরিবারের বিচারে যথা সময়ে বিয়ে হয়েছে। পরে লোকমুখে শুনেছি তান্ত্রিক মহারাজ যে সুপাত্রের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন সেই ছেলেটি জন্ম থেকেই মানসিক প্রতিবন্ধী ছিল। কোনও এক গরিব ঘরের অতি সুলক্ষণা ও সুন্দরী একটি মেয়ের সর্বনাশ করেও মহারাজ তার শিষ্যপুত্রকে স্বাভাবিক জীবন দিতে পারেননি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *