আমার দেশ আমার বিদেশ – ১

এক

বুকের মধ্যে অতীতকে নিয়ে চললে
 পদে পদে তার দেখা পাওয়া যায়।

 — লীলা মজুমদার

.

পূর্ববঙ্গে আদি দেশ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে এসেছি, বলা ভালো আসতে বাধ্য হয়েছি, প্রায় আটান্ন বছর হতে চলল। এখন পশ্চিমবঙ্গই হয়েছে স্থায়ী বাসস্থান। এখানেই লেখাপড়া, চাকরি, প্রেম, বিবাহ, একমাত্র সন্তানের জন্ম। মেয়েরও লেখাপড়া শেষ হয়েছে, চাকরি করে। তার বিয়েও দিয়েছি। এক নাতি আছে, নাতিও স্কুলে যাচ্ছে। তবু এতদিনেও সেই পূবের কথা ভুলতে পারি না। বোধহয় ভুলতে পারে না আমার বয়সি আদি পূর্ব-বঙ্গীয়রা— যারা একসময় ‘বাঙাল’ অভিহিত হত— কেউই। নিজেদের মধ্যে কথায় কথায় পূবের কথা আসবেই কোনও না কোনও প্রসঙ্গে। বুকের মধ্যে একটা টান টান ব্যথা। সেই ব্যথার কথাই লিখে ফেলা হল।

এই কাহিনিতে গভীর বক্তব্য কিছু নেই। থাকার কথাও নয়। দশ-বারো বছরের এক বালকের ভারী বক্তব্য কিছু থাকে না। থাকে শুধু ভালোবাসার স্মৃতি। বাড়িঘর, খেলার মাঠ, পুজো পার্বণ, গাছপালা, পুকুরখালনদী, হাটখোলা বাজার, স্কুল, অভিভাবকদের কর্মস্থল। সব কিছু যেন আজও চোখের সামনে দেখা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, অবিভক্ত বাংলার লক্ষ লক্ষ লোকের প্রাণহন্তক দুর্ভিক্ষ— সে সময় তো আমি নেহাতই বালক। তবুও যেন মনে হয় সব দেখেছি। হতে পারে বড়োদের মুখে শুনে শুনে নিজেরই চোখে দেখা মনে হয়।

নিজের মনে যেমন এই গল্প অন্যদের শোনানোর একটা তাগিদ ছিল, তেমনি বউদি নমিতা, স্ত্রী খুকু, মেয়ে পাঞ্চালী, জামাতা রাহুল মিত্র এবং অনুজসম বন্ধু পার্থ মুখার্জির উৎসাহ কিছু কম ছিল না। স্বাভাবিক, সাড়ে তিন বছরের দৌহিত্র তানিশ কিছুই বোঝে না। বড়ো হয়ে যাতে তার ‘দাদুমের’ মনোবেদনা কিছুটা অন্তত ভবিষ্যতে অনুভব করতে পারে তারও সংকল্প অবশ্যই আছে। অবশ্যই সপ্তর্ষি প্রকাশনের সৌরভ মুখার্জির আন্তরিক সহায়তা ছাড়া শেষ পর্যন্ত এই বই প্রকাশিত হত না। তার সর্বতো সাফল্য কামনা করি।

একটা বিশ্রী অস্বস্তিতে ছিলাম দীর্ঘদিন। নিজের জন্মস্থানটাই জানা ছিল না তেষট্টি ছুঁই ছুঁই বয়স পর্যন্ত। আবার বয়সটাও কতদূর সঠিক তাও হলফ করে বলা যাবে না। প্রমাণ সেই পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের স্কুল ফাইনাল পাশের সার্টিফিকেট। তবে সার্টিফিকেটে লেখা বয়সই যে নিখাদ খাঁটি সেকথা কজন পারে বুকে হাত দিয়ে বলতে। পুরনো পারিবারিক ছবির সঞ্চয় ঘেঁটে দাদার একটা বোর্ড বাঁধাই শিশু বয়সের ছবি পাওয়া গেছে। পেছনে বাবার নিজের হাতে লেখা জন্ম তারিখ ও জন্মস্থান। সুতরাং দাদার ক্ষেত্রে সংশয়ের অবকাশ নেই।

বাবা প্রমোদরঞ্জন মারা যান আমার যখন বয়স মাত্র ছয় বছর (১৯৪৬)। ওই বয়সে কবে জন্মেছি, কোথায় জন্মেছি এসব নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। মা কুসুমকুমারী বেঁচে ছিলেন ১৯৯০-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। মার কাছ থেকে জেনে নেওয়া যেত। কিন্তু নেওয়া হয়নি। হয়ত এতদিন জানাটা তেমন জরুরি মনে হয়নি। ‘দেশ’-এর বাড়িতেও জন্মে থাকতে পারি অথবা সেকালের রেওয়াজ অনুযায়ী মামাবাড়িতে। হয়ত ওইটুকু জানাই যথেষ্ট মনে হয়েছিল। ‘দেশ’ শব্দটিতে অত্যন্ত সচেতনভাবেই ঊর্ধ্বকমা ব্যবহার করা হল। আমি তো একজন ভারতীয় নাগরিক। বরিশাল জেলার যে বাঁকাই গ্রামকে দেশের বাড়ি বলা অভ্যাস অথবা ওই একই জেলায় মামাবাড়ি উজিরপুর তো এখন একটি ভিন্ন ‘সার্বভৌম রাষ্ট্র-এর অংশ। অতএব সে তো বিদেশই। তাছাড়া ওপার বাংলায় ছিলাম তো মাত্র দশ বছর বয়স পর্যন্ত। ওই বয়সে দেশ-বিদেশের ভেদাভেদ উপলব্ধিতে থাকার কথা নয়। মা এবং দাদা যখন দেশত্যাগ ছাড়া গতি নেই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন তখন আমার শৈশবের খেলার সাথি শুভঙ্কর (ঘোষ), যে তখনও ‘ক’-কে ‘ট’ উচ্চারণ করে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমার মাকে খবর শুনিয়েছিল, টাটিমা টাটিমা আমরা না টইলটাতা যামু (কাকিমা কাকিমা আমরা কলকাতা যাব)। এই কলকাতা যাওয়া যে আজীবন হৃদয়ে রক্তক্ষরণের কারণ হবে ওই বয়সে শুভঙ্করের সে বোধ ছিল না।

কবি কথাকার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতার শেরিফ হয়েও কিন্তু নিজেকে আজও কোলকাত্তাইয়া ভাবতে পারেন না। এটা তার নিজেরই স্বীকৃতি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আদিতে ওপার বাংলার লোক। মানসিকতায় এখনও তাই। যদিও দেশ ছেড়েছেন ১৯৫০ সালে। আমরাও দেশত্যাগী হয়েছিলাম ওই একই বছরে। সঠিক অর্থে বলা উচিত দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিলাম। নামী লোকের সঙ্গে নিজের তুলনা করা নিবুর্দ্ধিতা ছাড়া কিছু নয়। একথা ঠিক যে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রায় একই সময়ে কলকাতার টাউন স্কুলের ছাত্র ছিলাম। তবে পরিচয় ছিল না। সুনীল সম্ভবত দু-এক ক্লাস ওপরের ছাত্র ছিলেন। সুনীলেরই ‘অর্ধেক জীবন’ পড়ে জেনেছি প্রায় সমসময়ে কিছুকাল আমরা একই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। পরে অবশ্য দু-চারবার পেশা সুবাদে এখান ওখানে দেখা হয়েছে। একটি বিদেশি দূতাবাসের কোনও এক অনুষ্ঠানে পানপাত্র হাতে দুজনের একত্রে একটা ছবিও আছে। কিন্তু পরিচয় নিবিড় হয়নি। তবুও দুইয়ের মধ্যে সম্ভবত কিছু মানসিক মিল আছে। সে কেবল মতাদর্শের বিশ্বাসের ক্ষেত্রেই নয়।

কলকাতার শেরিফ হয়েও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যেমন নিজেকে কোলকাত্তাইয়া ভাবতে পারে না, তেমনি আমিও অর্ধশতাব্দীর বেশি ‘ঘটি’ বাংলার, যার প্রথম তেরো বছর খোদ কলকাতার বাসিন্দা হয়েও নিজেকে এখনও ‘বাঙাল’ ছাড়া অন্য কিছু ভাবি না। যদিও কথা বলি নির্ভেজাল কলকাতার উচ্চারণেই। আদি বাঙালদের জিভের অকৃত্রিম জড়তা ছাড়াই। আমি কেন, শাখাপ্রশাখা-সহ আমাদের পরিবারের আমার প্রজন্মের কেউই নিজেদের বাঙাল ছাড়া অন্য কিছু ভাবে না। কেউ কারও সঙ্গে দেখা হলে, পারিবারিক কোনও মিলন উৎসবে আবশ্যিকভাবেই বাঙাল দেশের কথা উঠবেই। পূর্ববাংলার নদী, নালা, খাল, বিল, পুকুর, শালুক নলটুনি, গাছ, ঝোপঝাড়, স্থলপদ্ম, শিউলি, পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, শীতলম্য, স্টিমারের ক্যান্টিনে হিন্দুদের নিষিদ্ধ মুরগির মাংস, নদীর চড়ায় চালাঘরের পেটচুক্তি হোটেল, ইলিশ মাছের ঝোলভাত এ হেন স্মৃতির মিছিল আন্তরিক আলোচনার প্রধান উপজীব্য। গভীর নস্টালজিয়া।

দাদা সুকুমার বিশ্বাসই করতে পারেন না ওপার বাংলা সম্পর্কে আমি যেসব ঘটনার কথা বলি সেসব আমার মনে থাকতে পারে। বিশ্বাস করার কথাও নয়। সরকারি নথিবদ্ধ জন্ম তারিখ ধরলে ওপার বাংলায় জন্মের পর ছিলাম মাত্র দশ বছর। দু-এক বছর এদিক সেদিক হতে পারে। অত ছোটো বয়সের স্মৃতিও কতটা বাস্তব-ভিত্তিক অথবা কতটা কল্পনা সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। হয়ত অন্যের মুখে শুনে শুনেও কোনও কোনও ঘটনা মনে গেঁথে গিয়ে থাকতে পারে। সেগুলি এখন আমার নিজেরই প্রত্যক্ষ মনে হবে হয়ত। তবুও আমি কিন্তু ওপার বাংলার অতীতের এক ছবি মুখে মুখেই এঁকে ফেলতে পারি। যারা আমারই মতো অল্প বয়সে স্বদেশকে বিদেশ আর বিদেশকে স্বদেশ করে নিতে বাধ্য হয়েছেন তারা অনেকেই আমার আঁকা সেই ছবির সঙ্গে নিজেদের মনে গাঁথা ছবির মিলও খুঁজে পান। সম্ভবত সে কারণেই আমার জামাইবাবু অধ্যক্ষ ড. বিশ্বজীবন মজুমদার বারবারই ওপার বাংলা সম্পর্কে কিছু লিখতে বলেন। এখানে ওখানে দু-একবার ওপার বাংলার কিছু বিচ্ছিন্ন প্রসঙ্গ লিখিনি তা নয়। পাঠক প্রতিক্রিয়া থেকে মনে হয়েছে সেসব লেখা কিছুটা হলেও পূর্ব-বাঙালদের হৃদয় স্পর্শ করেছিল। তাহলেও ব্যাপক পরিসরে কিছু লেখায় যথেষ্ট দ্বিধা ছিল। এখন লেখার কোনও প্রয়োজন আছে কিনা সংশয় সেখানেই।

আদি পশ্চিমবঙ্গীয়রা বরাবরই বাঙালদের অতিকথনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। কথায় রাজা-উজির মারাই যেন বাঙালদের জন্মলব্ধ স্বভাব। সকলেরই ছিল গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, গোয়ালে একাধিক দুধেল গাই। বাঙাল বংশোদ্ভূত নবীন প্রজন্মের ব্যবসা ঠাকুরদা, ঠাকুমাদের জন্মভিটা অথবা শৈশব সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ দেখা যায় না। কি ছিল তা নিয়ে তাদের মাথাব্যাথা নেই। কি আছে কি চাই-কে ঘিরেই নবীন প্রজন্মের সমস্ত চিন্তা-দুশ্চিন্তা। এটাই প্রকৃত পরিণতি নিয়ে কোনও গভীর অনুসন্ধানের জন্য দূরত্বের প্রয়োজন। শুনেছি ফরাসি বিপ্লবের গুরুত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে মাও-জে-দং বলেছিলেন পরিমাপের এখনও সময় হয়নি। ভারত বিভাজন ও লক্ষ লক্ষ মানুষের বাস্তুচ্যুতির প্রকৃত পরিণতি নিয়ে নির্মোহ আলোচনা সম্ভবত আরও দু-এক প্রজন্ম পর সম্ভব হবে। এখনও আমরা গভীর স্মৃতিমেদুরতায় আপ্লুত।

ওপার বাংলার স্মৃতি রোমন্থনে দ্বিধার একটি প্রত্যন্ত কারণও ছিল। ব্রিটিশ ভারতে জন্মানোর সুবাদে আমি ভারতীয় নাগরিক। ন্যাচারাল সিটিজেন। কিন্তু জানা ছিল না কোথায় আমার জন্মভিটা। কোনটা জন্মভূমি। অবশেষে প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে দিদি অধ্যাপিকা প্রতিমা মজুমদারের কাছে জানা গেল জন্মেছিলাম বরিশাল জেলার উজিরপুর গ্রামে মামাবাড়িতে। দিদির মনে থাকার কারণ তার ভয় ছিল আমার জন্মের কারণে বাবা মায়ের কাছে তার আদর কমে যাবে। অতএব পথের কাঁটা দূর করতে সুযোগ পেলে দা দিয়ে আমার গলা কেটে ফেলার সাধু সংকল্পও ঘোষণা করেছিলেন দিদি। সেকালে পরিবারে পুত্রসন্তানের আগমনে পিঠোপিঠি কন্যাসন্তানের প্রতি অবহেলার আশঙ্কা অহেতুক ছিল না।

দুই

মামাবাড়িতে জন্ম হলেও উজিরপুরে আমাদের যাতায়াত খুব বেশি ছিল না। অন্তত আমার জ্ঞান হওয়ার পর। এর কারণ সম্ভবত দিদিমা ক্ষেমঙ্করী দাসের আর্থিক দৈন্য। শুনেছি আমার দাদামশাই রাজকুমার দাস পূর্ববাংলার কোনও জমিদারের নায়েব ছিলেন। এক সময় দু’হাতে টাকা রোজগার করেছেন। পূর্বপুরুষেরাও সম্ভবত যথেষ্ট সম্পন্ন ছিলেন। অন্তত কোঠাবাড়ি, মনসা দালান, ঘাট বাঁধানো পুকুর দেখে তাই মনে হয়েছে। অবশ্য আমি যখন দেখেছি সেসব ততদিনে ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে। বসতবাড়ির কোনও অংশই বাসের যোগ্য না থাকায় দিদিমা উঠোনে একটি মাটির ঘরে থাকতেন। একা। মেয়ে বাপের বাড়ি গেলে বিশেষ আদর যত্ন করতে হয়। নাতি-নাতনিরাও মামাবাড়িতে কদিন ভালোমন্দ খাওয়ার আশায় থাকে। দিদিমার সে সঙ্গতি ছিল না। অতএব মা বাপের বাড়ি গিয়ে দিদিমাকে বিব্রত করতে চাননি।

কর্মজীবনে হাত ভরে রোজগার করলেও দাদামশাইয়ের শেষ জীবন কেটেছে কঠিন দারিদ্র্যের মধ্যে। একমাত্র ছেলে চিত্তরঞ্জন বাস্তব অর্থে সুযোগ্য হতে পারেননি। লেখাপড়াতেও স্কুলের গণ্ডি অতিক্রম করা হয়নি। মামা কিন্তু বখাটে ছেলে ছিলেন না। পরীক্ষা পাশের যথেষ্ট চেষ্টা ছিল। কিন্তু পাঠ্য বিষয় মনে রাখতে পারতেন না। হয়ত সেজন্য কিছুটা হীনমন্যতায় ভুগতেন। ভবঘুরে, স্বল্পবুদ্ধি, আধপাগল, সেয়ানা পাগল এইসব বিশেষণের কোনওটাই যেন এই অদ্ভুত চরিত্রের লোকটিকে মানায় না। তবে স্বীকার করতেই হবে মামা দীর্ঘদিন পরনির্ভর বা অন্যের বোঝা হয়ে থাকেননি। সেকালে চাকরি-বাকরি আজকের মতো দুর্লভ ছিল না। বিশেষত ভদ্রঘরের ছেলে হলে। আমার বাবা প্রমোদরঞ্জন নারায়ণগঞ্জে যে স্বদেশী কটন মিলের ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, শুনেছি তার ম্যানেজারের একটি ম্যাট্রিকুলেশন সার্টিফিকেটও ছিল না। মালখানগরের সম্ভ্রান্ত বসু পরিবারের ছেলে হওয়াতে একটি কটন মিলের ম্যানেজারের পদ পেতে অসুবিধা হয়নি। আমার নিজেরই জ্ঞাতি ঠাকুরদা (বাবার কাকা) সতীশচন্দ্র ক্লাশ এইট পাশ হয়েও জামশেদপুরে টাটা কোম্পানির হেড ক্লার্কের চাকরি করেছেন। তার সাহেবি ঢংয়ের ইংরেজি হাতের লেখা এবং কনস্ট্রাকশন অনেক গ্র্যাজুয়েট পোস্ট গ্র্যাজুয়েটের ঈর্ষণীয় ছিল। না বুঝতে পেরে বাবা তার একমাত্র শ্যালককে ওই কটন মিলেরই উইভিং ডিপার্টমেন্টে অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। পরে মাকে আক্ষেপ করতে শুনেছি লেগে থাকলে তার ভাইটি ওই কটন মিলে অনেক দূর পর্যন্ত উঠতে পারত। কিন্তু মামা লেগে থাকেননি।

তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাল। যুদ্ধের আতঙ্ক পূর্ববাংলার নারায়ণগঞ্জেও সংক্রমিত হয়েছে। জাপানি বোমা থেকে মাথা বাঁচাতে নানা জায়গায় ট্রেঞ্চও খোঁড়া হয়েছে। মাঝে মাঝে সাইরেন বাজিয়ে বিমান হানার মহড়া দেওয়া হয়। রাত্রে ব্ল্যাক আউট। এরই মধ্যে হঠাৎই চিত্তরঞ্জন উধাও। সম্ভাব্য সমস্ত জায়গায় বেশ কয়েকদিন খোঁজ খবর করেও তার কোনও সন্ধানই পাওয়া যায়নি। প্রকৃতির নিয়মেই পরিবারের উৎকণ্ঠা যখন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে স্বাভাবিক দিনযাপন শুরু হয়েছে তখন আকস্মিক চিত্তরঞ্জনের নিজের লেখা চিঠি এল। দিদির বাড়িতে জামাইবাবুর অভিভাবকত্বে দীর্ঘদিন থাকা সম্মানজনক মনে না হওয়াতে তিনি সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়েছেন। পরে মামার মুখে যুদ্ধের গল্প, লোহিত সাগরে জাপানি সাবমেরিনের মুখোমুখি হওয়ার বর্ণনা শুনে রোমাঞ্চিত হয়েছি। সে অবশ্য অন্য গল্প। চিত্তরঞ্জন কিন্তু স্বাভাবিক অবসর কাল পর্যন্ত সেনাবাহিনিতে টিঁকে থাকতে পারেননি। কোথাও একাদিক্রমে বেশি দিন টিঁঁকে থাকা তার স্বভাবেই ছিল না। দু-দুবার পুলিশে ঢুকেছিলেন। কিছুদিন জ্যোতিষ চর্চাও করেছেন। শেষ চাকরি করতেন উত্তর চব্বিশ পরগণার খড়দহে বিড়লাদের ওয়াগন কারখানায়। ওই চাকরি করতে করতেই শেষবারের মতো নিখোঁজ হয়ে যান। আর কোনও সন্ধানই পাওয়া যায়নি।

প্রবাসী দাদামশাই রাজকুমার সম্ভবত নিজের ছেলের ওপর ভরসা করতে না পেরে দেশে বিষয় আশয় দেখাশোনার ভার ভাইপোদের ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলেন। তার রোজগারেই একান্নবর্তী পরিবার চলত। মাস গেলে সংসার খরচ বাবদ টাকা ভাইপোদের কাছেই পাঠিয়ে দিতেন। ভাইপোরা জ্যেষ্ঠতাতের বিশ্বাসের মর্যাদা রাখেনি। টাকাপয়সা যথাসম্ভব সরিয়ে সুন্দরবনের বাদা অঞ্চলে (এখন পশ্চিমবাংলার দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার অন্তর্ভুক্ত) নিজেদের নামে পৃথক বিষয় সম্পত্তি করেছেন। তবে ভাইপোদের একেবারে কৃতঘ্ন বলা অন্যায় হবে। বাংলা ভাগের পর দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়ে দিদিমা নন্দীরলাটে (পোস্ট অফিস বৈকুণ্ঠপুর, গ্রাম কিশোরীমোহনপুর, জেলা দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা) জ্ঞাতি মামা ধীরেন্দ্রনাথের আশ্রয়েই ছিলেন। সেখানেই তিনি মারা যান। সেই আশ্রয় কতটা সম্মানের ছিল সে খোঁজ রাখার মতো আর্থিক সামর্থ্য সে সময় আমাদের ছিল না। দেওরের ছেলের আশ্রয় অসম্মানের না হলেও সুখের ছিল না বলাই বাহুল্য। গঞ্জনা সহ্যের বাইরে হলে অনাহূতভাবে বড়ো মেয়ের (আমার মা কুসুমকুমারীর) কাছে উঠতেন। বাস্তবিক নিষ্ঠুরের মতো বারবার মা দিদিমাকে সেই অনাদর অসম্মানের আশ্রয়েই ঠেলে পাঠাতেন। জ্ঞাতি দাদা-বউদিদের কাতর অনুনয় করে চিঠি লিখতেন যেন শেষ বয়সে তাদেরই জ্যেঠাইমার ভিখারির মতো রাস্তায় মৃত্যু না হয়। প্রথমে বাবার অকাল মৃত্যু এবং তারপর বাংলা ভাগ হওয়ার কারণে মা তখন নিজেই পাঁচ ছেলেমেয়ের সংসারকে চূড়ান্ত বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে অবিশ্বাস্য কঠিন লড়াই করে চলেছেন।

ভাইপোদের কৃতঘ্নতাই দাদামশাই দিদিমার শেষ জীবনের দুর্দৈবের একমাত্র কারণ ছিল না। মৃত্যুর আগে দাদামশাই বেশ কয়েক বছর বিছানায় সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী ছিলেন। সম্ভবত তাঁর পক্ষাঘাত হয়েছিল। তাছাড়া দৃষ্টিশক্তিও প্রায় সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কর্মজীবনে রোজগারের অবশেষ যা ছিল তার চিকিৎসাতেই তা সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যায়। দিদিমাকে কার্যত কপর্দকশূন্য রেখেই তিনি মারা যান। রাজকুমার-ক্ষেমঙ্করীর দুই মেয়ের ছোটো চারুবালা তখনও অবিবাহিত। দেওরেরা প্রায় সকলেই সপরিবারে দেশান্তরী হয়েছেন। সুন্দরবনে তাদের ক্রমবর্ধমান বিষয়-আশয়। মায়ের একজনই মাত্র জ্ঞাতিভাই উজিরপুরে রয়ে গিয়েছিলেন। আমরা তাকে সোনামামা ডাকতাম। এই সোনামামাই যাহোক কিছুটা অসহায় দিদিমার খোঁজখবর করতেন। এ সবই মায়ের মুখে শোনা।

তিন

জ্ঞান হওয়ার পর একবারই মামাবাড়ি উজিরপুরে গিয়েছিলাম। সেটা ১৯৪৫ সাল। মনে থাকার কারণ সে বছরই দাদা ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়েছিল। বাবা উজিরপুরেই টেলিগ্রামে পাশের সংবাদ পাঠান। মনে আছে টেলিগ্রাম পাওয়া মাত্রই দিদিমা গ্রামের কালী মন্দিরে পুজো দিতে যান। শাঁখ ও উলুধ্বনির শব্দ শুনে কৌতূহলী পাড়াপড়শিরাও খবর জানতে জড়ো হয়েছিলেন। সেকালের বিধবা হয়েও শিক্ষা সম্পর্কে দিদিমার অসীম আগ্রহ ছিল। নাতি ফার্স্ট ডিভিশন ছাড়া পাশ করতেই পারে না এ ছিল তার দৃঢ় বিশ্বাস। আর পড়শিদের কৌতূহল নিবৃত্ত করতে গলা উঁচু করে সেই কথাই শুনিয়েছিলেন। যদিও টেলিগ্রামে ডিভিশনের উল্লেখ ছিল না সম্ভবত শব্দ সংক্ষেপ করতে। দিদিমার আগ্রহেই দাদা বরিশাল শহরে ব্রজমোহন কলেজে আই. এস. সি-তে ভর্তি হন। ব্রজমোহন কলেজ ছিল ওই সময় যুক্ত বাংলার অন্যতম নামী আন্ডারগ্র্যাজুয়েট কলেজ। দিদিমার যুক্তি ছিল কলকাতার কোনও কলেজে পড়তে গেলে অনর্থক বেশি টাকা খরচ হবে। অথচ হস্টেল বা মেসের খাওয়া খেয়ে নীলুর (দাদার ডাক নাম) স্বাস্থ্য নষ্ট হবে। বরিশাল শহরে মাসিমা চারুবালা থাকেন। চারুবালার এক ভাসুর কন্যা সর্বাণীও সেবারই ম্যাট্রিক পাশ করেছে। সেও ব্রজমোহন কলেজেই পড়বে। মেসোমশাই কালীপদ দে-রা স্বচ্ছল একান্নবর্তী পরিবার। শহরের ওপরেই বিশাল টিনের দোতলা বাড়ি। তাদের একাধিক ব্যবসা। মাসিমার বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতে নীলুর কোনও অসুবিধা হওয়ারই কথা নয়। বাবা তার বিচক্ষণ শাশুড়ির পরামর্শ আগ্রহ্য করেননি।

বিংশ শতাব্দীর মধ্য-চল্লিশের দশকে গড় বাঙালির পর্যটন নেশা এখনকার মতো ব্যাপক ছিল না। উচ্চবিত্তরা সপরিবারে পশ্চিমে হাওয়া বদল করতে যেতেন। তবে তাতে পর্যটনের নেশার চেয়ে বিত্তের অহমিকা প্রদর্শনের আগ্রহই বেশি থাকত। যথেষ্ট সঙ্গতিপূর্ণরা মধুপুর, হাজারিবাগ, শিমূলতলা, দেওঘর, রাঁচি, পুরীর মতো পর্যটন কেন্দ্রে বাড়ি কিনেও রাখতেন। বছরের কোনও বিশেষ সময়ে সপরিবারে-সবান্ধবে সে সব বাড়িতে কিছুদিন হইহুল্লোড় করতে যাওয়া রুটিন মতো ছিল। অবশ্য কেউ কেউ চিকিৎসকের পরামর্শেও সমুদ্রের কিনারে অথবা কোনও শৈল শহরে স্বাস্থ্যদ্ধার করতেও যেতেন। আমার বাবার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন পেশায় আইনজীবী, বঙ্কিমচন্দ্র দেবের হাঁপানি ছিল। তিনি ডাক্তারের পরামর্শে প্রতি বছর বড়দিনের ছুটিতে পুরী গিয়ে থাকতেন। শীতের সময় হাঁপানির রোগীদের কষ্ট বাড়ে। সমুদ্রের বাতাসে ওজনের আধিক্য হাঁপানির কষ্টের যথেষ্ট উপশম করে। পরে আবার আমাদের এই বঙ্কিমকাকুর উল্লেখ করতে হবে।

প্রবাসে চাকুরিজীবী গড় বাঙালির পর্যটন ছিল ছুটিছাটায়, বিশেষত দুর্গাপুজোর ছুটিতে আবশ্যিকভাবে, দেশের বাড়িতে ফিরে আসা। একবার কর্তৃপক্ষ পুজোয় ছুটি দেওয়া সম্ভব হবে না বলায় বাবা চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দেশের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য কর্তৃপক্ষ দেশের বাড়ির ঠিকানায় টেলিগ্রাম পাঠিয়ে জানিয়েছিলেন তার ইস্তফাপত্র গৃহীত হয়নি, ছুটি মঞ্জুর হয়েছে। মেয়েদের বেড়ানো বলতে বাপের বাড়ি যাওয়া। সঙ্গে ছেলেমেয়েরাও। মামারবাড়ি ভারী মজা কিল চড় নাই। বিরল ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে বিয়ে-অন্নপ্রাশন শ্রাদ্ধের মতো উৎসব আচারে দূরবর্তী অতি নিকট আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়া হত। আমার জন্মের আগে বাবা-মা তখন তাদের দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে পূর্ববঙ্গের নারায়ণগঞ্জ থেকে ইস্পাত নগরী জামশেদপুর গিয়েছিলেন বোনের বিয়েতে। পরে মা দাদার কাছে যাত্রাপথের নানা রোমহর্ষক গল্প শুনেছি। নদী-নালার দেশ পূর্ববঙ্গ থেকে সাঁওতাল পরগণার জামশেদপুর যেতে নৌকো, স্টিমার, ট্রেন সহ নানা যানের প্রয়োজন হত। সময়টা সম্ভবত ছিল শ্রাবণ মাস, ভরা বর্ষার কাল। পূর্ববঙ্গের নদীগুলি দুকূল ছাপিয়ে ‘দুই ধারে কাশ বন ফুলে ফুলে ঢাকা’ ছাড়িয়ে গ্রাম-গঞ্জের একাংশও গিলে ফেলত। সে অর্থে বন্যা না হলেও এমনই ভরা নদীর বুকে প্রমোদ পরিবারের নৌকো মাঝিদের অনবধানতায় জলের তলায় আপাত অদৃশ্য এক তালগাছের মাথায় উঠে যায়। মাঝিদের ভয় ছিল জোর করে গাছের মাথা থেকে নৌকাকে টেনে নামাতে গেলে তলার কাঠ না খুলে যায়। তেমন ঘটলে আর একটা প্রাণঘাতী নৌকোডুবি অবশ্যম্ভাবী। দাদা দিদি উভয়েরই তখন শৈশব। তাদের পক্ষে বিপদের গুরুত্ব উপলব্ধি করা সম্ভব ছিল না। তারা তখন তুচ্ছ কারণে পরস্পর ঝগড়ায় মত্ত। দিদি দাদার এক পাটি জুতো নদীর জলের ছুঁড়ে ফেলেছে। গল্পটা অন্য রকমও হতে পারত। সম্ভবত আমিও তখন জন্মেছি। এবং আমিই দিদির জুতো জলে ফেলেছিলাম। গল্প যাই হোক, মাঝিরা শেষ পর্যন্ত নিজেরাই নৌকো তাল গাছের মাথা থেকে নামিয়ে এনেছিল।

কোনও উৎসব ১৯৪৫ সালে উজিরপুর যাওয়ার উপলক্ষ ছিল না। আগেই বলা হয়েছে দাদা ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেছিলেন। পরীক্ষার পর ফল বের হওয়ার আগে দীর্ঘ অবকাশ। ধরে নেওয়া যায় সময়টা মার্চ-এপ্রিল হবে। এপ্রিলের শেষ দিকেই হবে অনুমান করা সম্ভব। এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে বাংলা বৈশাখ মাস শুরু হয়। তার আগে চৈত্র মাসে বাঙালি হিন্দুরা ঘর ছেড়ে কোথাও যেত না। মামা বাড়িতে সেবার থাকাও হয়েছিল অনেকদিন। প্রায় আশ্বিনের দুর্গাপুজো পর্যন্ত। মাঝখানে দাদার কলেজে ভর্তি হওয়া উপলক্ষে জেলা সদর বরিশালে মাসিবাড়িতে কয়েকদিন বেড়ানো হয়। এই বরিশাল শহরেই ছিল মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের কর্মভূমি। সে সময় অবশ্য ওই কর্মকান্ডের তাৎপর্য বোঝার বয়স হয়নি। শুধু বড়দের মুখে শুনতাম মহাত্মা অশ্বিনী কুমার বরিশালের গর্ব। নিজের কানে শোনা হয়নি মুকুন্দ দাসের স্বদেশি যাত্রাও। তবে বড়োদের মুখে চারণ কবির এত গল্প শুনেছি যে মনে হত নিজের চোখের সামনেই তাকে আসরে গাইতে শুনেছি।

‘একটা দুটো পাশ করে যদি কারো মেলে আঁখি

ওমনি তাকে শক্ত করে চশমা দিয়ে ঢেকে রাখি’

গানটি নিয়ে আমাদের বাড়িতে খুবই আলোচনা হত। কোনও এক আসরে মুকুন্দ দাস যখন এই গানটি গাইছিলেন তখন শ্রোতাদের মধ্যে প্রথম সারিতে ছিলেন আমার জ্ঞাতি ঠাকুরদা সতীশচন্দ্র। তার চোখে ছিল চশমা। মুকুন্দর দাসের গানে ঠাকুরদা কতটা বিব্রত হয়েছিলেন সেটাই ছিল আমাদের পরিবারের হাসি মশকরার বিষয়। চারণ কবির নিজের গলায় স্বদেশি গান শোনা সুযোগ হয়নি ঠিকই। কিন্তু পরে বড়ো হয়ে কলকাতায় সবিতাব্রত দত্তর উদাত্ত কণ্ঠে সেসব গান শোনা বড়ো কম পাওয়া ছিল না। বরিশালের বিখ্যাত নট্ট কোম্পানির যাত্রা পালা অবশ্য একাধিকবার দেখেছি। তবে বরিশালে নয়, নারায়ণগঞ্জে।

চার

জেলা সদর বলতে আমরা যেমন বুঝি, ১৯৪৫ সালে বরিশাল তেমন অবশ্যই ছিল না। এখন কি হয়েছে জানি না। পূর্ববঙ্গ (পরে পূর্ব পাকিস্তান) একটি পৃথক সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ হওয়ার পর আগের জেলাগুলির অনেক প্রশাসনিক ভাঙচুর হয়েছে। ১৯৯০-এ রাজধানী ঢাকাতে দেখেছি মার্কিনি ডলারের দাক্ষিণ্যে বহিরঙ্গে যে-কোনোও পশ্চিমি শহরের তুলনীয়। ইচ্ছে থাকলেও শেষ বরিশাল যাওয়া হয়ে ওঠেনি। সুতরাং বলতে পারব না সেখানে পরিবর্তন কতটা চোখ ধাঁধানো। তা ছাড়া আগের বরিশাল এখন পাঁচ ভাগ হয়েছে। বরিশাল, পটুয়াখালি, ফিরোজপুর, ঝালকাঠি, ভোলা এবং বরগুণা। ১৯৪৫ সালে কিন্তু বরিশাল এখন কলকাতার কাছাকাছি কোনও গ্রামের চেয়ে সামান্য উন্নত ছিল। মনে হয় সে সময় মহকুমা শহর নারায়ণগঞ্জও বরিশালের চেয়ে নাগরিক ছিল। সেটা নবাবী শহর ঢাকার কাছাকাছি হওয়ার কারণে হতে পারে। পরিবহন পরিকাঠামোর অপ্রতুলতা বরিশালের দ্রুত নগরায়ণের প্রতিবন্ধক ছিল। যুক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতা থেকে বরিশাল এক্সপ্রেস নামে যে ট্রেনটি ছাড়ত তার যাত্রা বিরতি ঘটত গোয়ালন্দে, সেখান থেকে বরিশাল পৌঁছতে না হোক আরও ঘণ্টা বারো স্টিমারে। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাক যুদ্ধের সময় থেকে এই ট্রেনটি বন্ধ আছে। সবুজ রঙের শেষ যে রেলটি ওপার বাংলা থেকে এপারে এসেছিল, দীর্ঘদিন সেটি শিয়ালদহ ইয়ার্ডে পড়ে থেকে সাবেক বাঙালদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। এখন অবশ্য রেলটি আর চোখে পড়ে না। অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে অথবা রোদ ঝড় জলে স্বাভাবিক পঞ্চত্ব প্রাপ্তিও হতে পারে।

নদী-নালার দেশ হওয়ায় বরিশাল জেলায় কোথাও রেলপথ নেই। কতকটা এপারের উত্তরবাংলার দুই দিনাজপুরে মতো। দিনাজপুরে পথ পরিবহন যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। বরিশালে জলপথ। জেলা সদর থেকে গ্রামগঞ্জে, এক গ্রাম থেকে অন্যগ্রামে যাতায়াত নৌকোয়। নিম্নমধ্যবিত্তরা এক-আধবেলার পথ হেঁটেই মেরে দিতেন। বহির্জেলায় যাতায়াত করতে স্টিমার অথবা লঞ্চ। এখন রাজধানী ঢাকা থেকে বরিশাল পর্যন্ত বাস চালু হয়েছে। তবে বেশ কয়েক জায়গায় বাসগুলিকে গাদা বোটে নদী পার করাতে হয়। ঢাকা নারায়ণগঞ্জের মতো সে সময় বরিশাল শহরে ঘোড়ার গাড়ি, রিকশা চলত কিনা মনে নেই। থাকলে বরিশালবাসীরাও বিশেষ করে ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানদের রসবোধ উপভোগ করতেন কি না সেটাও অজানা। ঢাকাই কুট্টি (আদি বাসিন্দা) এবং গাড়োয়ানদের রসবোধ প্রবাদপ্রতিম। দু-একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখের লোভ সামলানো কঠিন। ঈদের মুখে নামাজের টুপি কেনাবেচা চলছে। জনৈক ক্রেতার প্রতিশ্রুত দাম প্রত্যাশার কম হওয়ায় ‘কুট্টি’ বিক্রেতার চটজলদি জবাব, একটু আউগ্গাইয়া যাও মিঞা, পাতিলের দোকান আছে। একখানা টোফা কিইনা লইয়া যাও। মাথায়ও দিবার পারবা, চিঁড়া ভিজাইয়াও খাইবার পারবা (মিঞা, একটু এগিয়ে গেলে মাটির হাঁড়ির দোকান আছে। সেখান থেকে একটি হাঁড়ি কিনলে টুপি পরা এবং চিড়ে ভিজিয়ে খাওয়া দুইয়েরই কাজ চলে যাবে)। আর একটি উদাহরণ। নব্য যুবক রাস্তায় চলতে চলতে আপন মনে গুনগুন করে গান করছিল সেকালে কানন দেবীর গাওয়া অত্যন্ত জনপ্রিয় গান— ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে, আমি বনফুল গো…। শুনে ঢাকার রাস্তার ঘোড়ার গাড়ির কুট্টি গাড়োয়ানের অচিরাৎ মন্তব্য, হালায় নিজেরে কয় বনের ফুল, ধর হালারে হুইঙ্গা দ্যাখ (শালা নিজেকে বনের ফুল বলছে। ধরে শুঁকে দ্যাখ তো)। প্রসঙ্গান্তর আর দীর্ঘ না করাই বাঞ্ছনীয়। তবে কৌতূহল স্বাভাবিক, এখনও কি ঢাকাই কুট্টিদের সেই প্রবাদপ্রতিম রসবোধ বজায় আছে?

পাঁচ বছর বয়সে মাত্র কয়েকটি দিন যে শহরে ছিলাম তার স্মৃতি ঝাপসা হওয়াই স্বাভাবিক। স্কুল কলেজ, অফিস-আদালত, থানা, জেল এসব বাদ দিলে বরিশাল শহরে পাকা বাড়ির সংখ্যা তখন হাতে গোনা। যে কারণেই হোক, স্বচ্ছল পরিবারগুলিরও ছিল টিনের বাড়ি। মেসোমশাই কালীপদ দে শহরের বড়ো ব্যবসায়ীদের একজন। শহরের প্রধান রাস্তার ওপর পরপর তিনটি দোকান। তার মধ্যে একটি রেশন শপ। যুদ্ধের বাজারে যারা রেশনের ডিলারশিপ পেয়েছিলেন তারা কীভাবে রাতারাতি ধনী হয়েছিলেন সে খবর কারও আজানা নয়। তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের সুযোগ নিয়ে কেউ কেউ তো ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়েছিলেন। তবে মেসোমশাই সম্ভবত ততটা করিৎকর্মা ছিলেন না। তা হলেও রেশন দোকান, মুদিখানা ও মণিহারি দোকান মিলিয়ে তারা যথেষ্ট ধনাঢ্যই ছিলেন। তবুও তাদের ছিল টিনের বাড়ি। তবে অনেকটা জায়গা নিয়ে এবং দোতলা। শহরের অধিকাংশ স্বচ্ছল পরিবারেরই বড়ো বড়ো প্লটে শান বাঁধানো একতলা, দোতলা বাড়ি ছিল। সেগুলির কোনওটি চারচালা আবার কোনওটি আটচালা। চালের নীচে কাঠের সিলিং, স্থানীয় ভাষায় বলা হত কার। এই কার যেমন একদিকে ঘরের অত্যধিক গরম থেকে রক্ষা করত, অন্যদিকে আধুনিক কালের লফটের মতো নানা আধা অপ্রয়োজনীয় জিনিস রাখাও যেত। সব বাড়িতেই কিছু আম, কাঁঠাল, জাম, জামরুল, নারকেল, সুপারি গাছ। প্রায় সকলের বাড়িতেই ছোটোখাটো কিচেন গার্ডেন ছিল। না থাকলেও বাড়ির উঠোনো লাউ, কুমড়ো, সিম, ডাঁটা গাছ লাগাতেন প্রধানত বাড়ির মেয়েরা। দু-চারটা গরু, দু-চারটে হাঁসও ছিল অনেক বাড়িতে। হিন্দু বাড়িতে মুরগি পোষার প্রশ্নই ছিল না। আমার মাসির বাড়িতেও গোটা কয়েক পোষা হাঁস ছিল। বাড়ির পেছন দিকে নিজেদের পুকুরেই সেগুলি সারাদিন সাঁতার কাটত। রাত্রে থাকার জন্য উঠোনে কেরোসিন কাঠের প্যাকিং বাক্স দিয়ে ঘর বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ধলু ডাক-নামে মেসো-মাসির বড়ো ছেলেটি ছিল জড়বুদ্ধি। সেই নিজে থেকে পোষা হাঁসগুলির নজরদারির দায়িত্ব নিয়েছিল। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ধলুর প্রথম কাজ ছিল প্যাকিং বাক্সের ঘর খুলে হাঁসগুলিকে পুকুরের জলে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া। বিকেলে সেই আবার সেগুলিকে ফিরিয়ে এনে প্যাকিং বাক্সের খাঁচা বন্দি করত। আমরা মাসির বাড়ি থাকতে একদিন একটি হাঁসকে সম্ভবত শেয়ালে নিয়েছিল। সে সময় বরিশাল শহরে শেয়ালের গৃহপালিত পশুপাখি নিয়ে যাওয়া আশ্চর্যের ছিল না। প্রথমে সে এসে তার জ্যাঠাইমাকে বলে, জ্যাঠাইমা প্যাঁক প্যাঁক। সম্ভবত সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ হয়েই দুঃসংবাদটি দেওয়া সমীচীন মনে করে আর কিছু না বলেই সে চলে যায় এবং বেশ কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলে, নেই নেই। প্রথমে প্যাঁক প্যাঁক এবং তারপর নেই নেই এই দুইয়ের তাৎপর্য বোধগম্য হতে সেদিন সকলকে যথেষ্ট গবেষণা করতে হয়েছিল।

বরিশালে তখন পিচঢালা পাকা রাস্তা খুব কমই ছিল। অধিকাংশ রাস্তাই ছিল খোয়া বাঁধানো। কোনও কোনওটি সুরকি বিছানো। ছোটোবড়ো সব রাস্তার দুধারেই সারি দিয়ে গাছ লাগানো। কেবল বড়ো রাস্তাগুলি ছাড়া অন্য কোনও রাস্তার ধারে মনে হয় বড়ো দোকান ছিল না। গাড়িঘোড়া চলত খুবই কম। মোটরগাড়ি চলতে দেখলে ছোটরা তো বটেই অনেক বড়ো মানুষও হাঁ করে তাকিয়ে দেখত। মোটরগাড়ি যাওয়া মানে নিশ্চিত কোনও সাদা চামড়ার রাজপুরুষ যাচ্ছেন। শহরে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে ঠিকই। কিন্তু ধনী গরিব অধিকাংশের বাড়িতেই বিজলি বাতির চল হয়নি। আমার মাসির বাড়িতেও যতদূর মনে পড়ে রাত্রে হ্যারিকেন লন্ঠনই জ্বলত। এপার বাংলায় আসার পর পেশাগত প্রয়োজনে উত্তর বাংলার জেলাগুলিতে বেশ কয়েকবারই যেতে হচ্ছে। সত্তরের দশক পর্যন্ত বিশেষত কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি শহরের বাড়িঘর, রাস্তা, দোকান, বাজার যেমন দেখেছি ১৯৪৫-এ বরিশাল যেন খানিকটা সেই রকমই ছিল। বলতে পারব না কোচবিহার জলপাইগুড়ির দৃশ্যপট মনে কোনও ছবি তৈরি করে দিয়েছে কি না। যে ছবিকে মনে হচ্ছে আসলে এটাই ছিল আমাদের বরিশাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *