আমার দেখা সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী

আমার দেখা সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী

আমার সমসাময়িক যতজন অভিনেত্রী বা নায়িকার সঙ্গে অভিনয় করেছি তাঁদের মধ্যে তর্কাতীতভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। এই নিয়ে আমার মনে কোনও প্রশ্ন কখনই আসে না, মনে করি বেশিরভাগ বাঙালির মনেও এই নিয়ে কোনও প্রশ্ন আসে না। সাবিত্রী দেখতে খুব একটা সুন্দর নন। তিনি যে সময় সিনেমায় এসেছিলেন সেই সময় সুন্দরী নায়িকার অভাব ছিল না। তাঁদের মধ্যে থেকেও তিনি উজ্জ্বলভাবে এই পেশায় ফুটে উঠেছিলেন। তাঁর চেহারা সুশ্রী, তেমনই খুব সুললিত কণ্ঠস্বরের অধিকারীও ছিলেন না। কিন্তু সেই কণ্ঠস্বর আশ্চর্যরকম ভাবপ্রকাশে সক্ষম যা দিয়ে শুধুমাত্র সিনেমায় নয়, মঞ্চেও অবিসংবাদিত স্থানটি তৈরি করে নিতে পেরেছেন। আমি যাঁদের সঙ্গে কাজ করেছি তাঁদের মধ্যে দেখা একমাত্র অভিনেত্রী যিনি ট্র্যাজিক ও কমিক দুই ক্ষেত্রেই অত্যন্ত সফল। দু-ধরনের অভিনয়ের মধ্যেই তিনি তাঁর ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। রোমান্টিক দৃশ্যেও তিনি সফল। রোমান্টিক দৃশ্য সম্পর্কে দর্শকদের একটা ভুল ধারণা আছে। অনেকেই নায়ক-নায়িকার অবাস্তব প্রেমের দৃশ্যকে রোমান্টিক দৃশ্য বলে ভাবেন। সেটা কিন্তু ঠিক নয়। ছবির নাম এই মুহূর্তে মনে নেই। উত্তমকুমার-সাবিত্রী অভিনীত ছবির একটি রোমান্টিক দৃশ্যের কথা আজও ভুলতে পারিনি। দৃশ্যটি হল উত্তমকুমার স্বামী এবং তাঁর স্ত্রী সাবিত্রী। বাড়ির অমতে বিয়ে করে ঘর ছেড়ে চলে এসে দুজনে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকেন। স্বামী চাকরির সন্ধানে বাইরে গিয়েছেন। ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে স্ত্রী দরজায় স্বামীর ফিরে আসার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। স্বামী ফিরে এসে তাঁকে দেখেন এবং তাঁদের দুজনের মধ্যে ছোট দু-চারটি সংলাপ এমন অভিব্যক্তির মাধ্যমে ফুটে উঠেছিল যা আজও ভুলতে পারিনি। এইরকম বহু ছবির কথা বলতে পারি যেখানে তাঁর রোমান্টিক অভিনয় অসাধারণ মাত্রা এনে দিয়েছিল। মৃণাল সেনের ‘প্রতিনিধি’ ছবিতে তাঁর সঙ্গে প্রথমে কাজ করি। আমার নির্দেশনায় ‘রাজকুমার’ নাটকে অভিনেত্রী। ভীষণভাবে প্রতিষ্ঠিত। সিনিয়র একজন অভিনেত্রী। রিহার্সালে তিনি যখন আসতেন তখন তাঁর অ্যাপ্রাোচ এমন ছিল যেন সেইদিনই প্রথম এই পেশায় এসেছেন। অসম্ভব নিষ্ঠা, সিরিয়াসনেস এবং একাগ্রতা দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতাম, যা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। তাঁর কমিক চরিত্রে অভিনয়ের কথা মনে পড়ে। অরবিন্দ মুখার্জি পরিচালিত ‘মন্ত্রমুগ্ধ’ নামে একটি ছবিতে তাঁর সঙ্গে অভিনয় করেছিলাম। এই ছবিতে তিনি যে কমেডি করেছিলেন, তা আমাদের সকলকে মুগ্ধ করে দেয়। ওই ছবিতে উৎপলদা একটি বিশেষ দৃশ্যে কমেডি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। উৎপলদা সারাদিনের শুটিং-এর পর সাবিত্রী সম্পর্কে বলেছিলেন, একজন অভিনেত্রী যে এত বড় মাপের কমেডিয়ান হতে পারে তা আমার জানা ছিল না। এইরকম বহু দৃষ্টান্ত আছে। আমরা দুজনে একসঙ্গে অনেক ছবিতে কাজ করেছি। প্রতিটি ছবিতেই তাঁর অভিনয়ের মধ্যে একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠত। যে কোনও চরিত্র এমনভাবে করতেন যেন মনে হত না তিনি অভিনয় করছেন। মনে হত তিনিই সেই চরিত্র। এই ক্ষমতাটি তাঁর আশ্চর্যরকম ছিল। এটা তাঁর প্রায় সহজাত ক্ষমতা বলা যেতে পারে। তার পরে কোন দৃশ্যে কতটা মাত্রা দিতে হবে এবং কখন চোখের জলের প্রয়োজন, তা কোনও কৃত্রিম উপায় নিয়ে নয়, স্বাভাবিকভাবেই করতে পারতেন। কখন কোন দৃশ্যকে পরিহাসতরল বা ব্যঙ্গের সঙ্গে কমিক মাধুর্য দিতে হবে তা তিনি জানেন। অজয় কর পরিচালিত ‘মাল্যদান’ ছবিতে তাঁর অপূর্ব সংযত এবং সংবেদনশীল অভিনয়ের মাধ্যমে চরিত্রটিকে এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিল— যা আমি আজও ভুলতে পারি না। আমার মতে, যাঁদের সঙ্গে কাজ করেছি তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। আজকে যে সব মহিলা শিল্পী অভিনয় করছেন, তাঁদের প্রতি সিনিয়র অভিনেতা হিসেবে বলব, সাবিত্রীর অভিনীত ছবিগুলি যেন বারবার দেখেন। তা থেকে তাঁরা উপকৃত হবেন এবং শিখবেন। আমি চিরকালই তাঁর অভিনয়ের একজন ভক্ত। অনেক পরে হলেও তাঁকে যে আকাদেমি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে এটা আমাকে কিছুটা তৃপ্তি দিয়েছে। কারণ তাঁর মূল্যায়ন আরও আগে হওয়া উচিত ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *