আমার দেখা ভি বালসারা

আমার দেখা ভি বালসারা

অনুরোধে মানুষ ঢেঁকি গেলে তেমনি আমিও অনুরোধে বালসারাজির সম্পর্কে কিছু লেখার প্রস্তাব গ্রহণ করলাম৷ ওঁর সম্পর্কে লিখবার বাসনা যতটা আছে, মুগ্ধতা যতটা আছে, আমার ওঁর সম্পর্কে লেখার অক্ষমতাটা তার শতগুণ বেশি৷ বোধ তবুও মাঝে মাঝে অবুঝ৷ বালসারাজির গুণপণাকে পুরো জানবার আমার সুযোগ, শিক্ষা সবটাই অপরিণত, তা বলে তাঁর সঙ্গে যে হৃদ্যতার বিনিময় ছিল, জনমানসে এ সংবাদ পৌঁছে দেওয়ার প্রলোভন কি সহজে সামলানো যায়? যে জাদুকরি তাঁর প্রয়োগ শিল্পে ছিল তার মাপের কাছে আমার অস্তিত্ব এতটাই বামন যে চাঁদধরা শক্ত ব্যাপার জানি, তবু জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হয়েছি, এটুকু বলতে ইচ্ছে করে৷ দ্বিধাও নেই— শুধু পাঠকবর্গকে নিবেদন করতে চাই— আমার এই রচনাকে কোনও পূর্ণাঙ্গ তো নয়ই, অর্ধাঙ্গও বলে ভুল করবেন না৷ তাঁর জীবনের প্রথম প্রকাশ বম্বে ফিল্ম-এর অঙ্গনে৷ যার সম্পর্কে আমার বেশি কিছু জানাই নেই৷ আমি তাঁকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি যতটুকু তা সবটাই এই পশ্চিমবাংলার মাটিতে এবং বাংলা সংগীত জগতের প্রেক্ষাপটে৷ আর তিনিও পার্সি অস্তিত্বকে বাঙালিপনায় পূর্ণ স্বকীয়তায় প্রকাশ করে বাংলার ঘরের মানুষ হয়েছিলেন বলে তা সম্ভব হয়েছিল৷ তাঁকে একবার ইংরেজিতে চিঠি দেওয়ায় দুঃখ পেয়ে লিখেছিলেন আমি বাংলা জানি৷ যা আমার কাছে লজ্জার, তাঁর কাছে বেদনার৷

নচিকেতা ঘোষ মানেই একটা নতুন ভাবনা৷ নতুন উদ্ভাবনী৷ বাজারে একটি গান জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে এল শ্রীমতী আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় গীত ছড়ার গান ‘হাট্টিমা টিম টিম’— সুরস্রষ্টা নচিকেতা ঘোষ৷ তখন বাংলা সংগীতের জগতে Music Arranger বলতে যে শিরোনাম তার আমদানি হয়নি৷ যাঁরা সুরকার তাঁরাই সংগীতায়োজন করেন আর তাঁর মধ্যে Orchestral brilliance-এর মনস্কতা যা থাকত তার থেকে মূল গানের আন্তরিক সহযোগিতা বেশি থাকত৷ কিন্তু এই ‘হাট্টিমা টিম টিম’— গানটিতে এক চমকপ্রদ বাজনার সংযোজন হওয়াতেই রেকর্ডটি জনমানসে ভাললাগার এক ভিন্নমাত্রা স্থাপন করল! সবাই জানতে পারল V Balsara নামে এক পার্সি ভদ্রলোক— যন্ত্রসংগীত বাজাতে ও সুর নির্মাণ করতে পারেন একেবারের জাদুকরের মতো— এসেছেন বোম্বাই থেকে এবং নচিদা এইভাবে তাঁকে কাজে লাগিয়েছেন৷ নচিদা বরাবরই যন্ত্রসংগীত পরিচালনা করতেন নতুন ভাবনায় উদ্ভাবন নিয়ে এবং তা মূল গানের বিষয় বিস্তারের বোধের প্রেক্ষিতে৷ রাতারাতি আমরা খুব আন্তরিকভাবে পরিচিত হয়ে গেলাম সেই জাদুকরের নামের সঙ্গে ‘ভি বালসারা’৷

আমার সাংগীতিক জীবনের বয়স এখন অনেক কিন্তু এখনও বড় তালের মাপ ঠিক রাখতে হিমশিম খাই৷ এখনও যদি কেউ বিলম্বিত খেয়াল বা তিন তালের বন্দিশ, ঢিমে একতালের বন্দিশ পরিবেশন করেন কণ্ঠে যা যন্ত্রে আমি তালের মাপ রেখে হাতে বা পায়ে বিট রাখি এবং বলতে দ্বিধা বা লজ্জা নেই— প্রায়ই ভুল তাল ফেলি৷ যাদের এই রকম তাল যথাযথ রাখবার দক্ষতা আছে তারা আমার কাছে বিশেষ শ্রদ্ধার্হ— যেমন আধুনিক গানে ধনঞ্জয়দা, মান্নাদা, নির্মলা, হৈমন্তী৷ মানবদার লয়কারি আমার তাল দক্ষতার সাধনায় শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেছে৷ এ হেন আমি একদিন গ্রামোফোন কোম্পানির নলিন সরকার স্ট্রিটের রিহার্সাল বাড়িতে বসে একটা তিনতালের বন্দিশ শুনছি৷ একটি আবর্তের ১৩ মাত্রার মাথায় একজন অচেনা ভদ্রলোক ঘরে প্রবেশ করে পরের আবর্তে সম এ মাথায় তালের বিট ফেললেন৷ আমি তো অভিভূত— এ কে রে বাবা৷ এতটা ছন্দের ওপর দখল৷ অনুসন্ধানে নাম জানলাম ভি বালসারা—বম্বে থেকে সদ্যাগত সেই যন্ত্রসংগীতের জাদুকর৷ এই বালসারাজির জীবনের শেষ প্রান্তে, যখন তিনি কলকাতার মিউজিসিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, রাজ্য সংগীত আকাদেমির সভাপতি, তখন রবীন্দ্রসদনে কলকাতার যন্ত্রসংগীত শিল্পীরা তাঁকে একটা সংবর্ধনা দিলেন এবং তিনি তাঁর সৃষ্টি দু-একটা পরিবেশন করলেন ওই যন্ত্র শিল্পীদের কয়েকজনকে নিয়ে৷ স্বদেশি ও বিদেশি যন্ত্রের সমন্বয়ে৷ যেমন বাবলু বিশ্বাস তবলায়, নিজে পিয়ানোয়৷ সেই সময়ে গুরুর কৃপায় তখন বাংলা সংগীতের আমি একজন প্রবীণ ব্যক্তিত্ব৷ সম্মানে, মর্যাদায় ভূষিত এবং ওই অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত৷ সামনে একটা সিটে বসে একটি ৭ মাত্রার বন্দিশ শুনছি, তাঁর Composition আর মাত্রা গুনছি৷ বলতে দ্বিধা নেই, লজ্জা নেই কিন্তু প্রচণ্ড বেদনা আছে, বেশিরভাগই সময় আমি সম এ পড়তে পারছিলাম না৷ বাবলু বিশ্বাস তবলায় ছিল৷ সে যখন অনায়াস সেটা বাজাচ্ছিল তখন মনে হচ্ছিল এ তো আমার সন্তানতুল্য কিন্তু কত দক্ষ একজন তবলাশিল্পী সে৷ যে মাত্রা আমি গুনতে পারছি না ঠিক মতো, সে তা অনায়াসে বাজাচ্ছে৷ আর মনে মনে তখন প্রণাম জানালাম বাবলুকে, সেদিনের পিয়ানোবাদক সুরস্রষ্টা ভি বালসারাজিকে, সেই অসাধারণ যন্ত্রশিল্পী জাদুকরকে৷ মাপ যার বড়, তাকে বড় ভাবে দেখতেই ভাল লাগে৷ দীর্ঘদিনের পরিচয়ে তার বাজনা বাজানোর সম্মুখীন হয়েছি— নিজের কাজেও বহুবার তাঁর শিল্পী অঙ্গুলি ব্যবহার করেছি— আর সবসময় লক্ষ্য করেছি ছন্দের গান বাজানোর সময় তাঁর দাঁতে দাঁত লেগে চোয়ালের ওপর ছন্দ নৃত্য করছে৷ বুঝতাম ছন্দ তার স্নায়ুতে, রক্তে, সারা শরীরে৷ তাঁর সংগীত পরিবেশনা, উপস্থাপনার কথা লিখে বোঝানো যায় না৷ কারণ প্রয়োগ শিল্পের উৎকর্ষ যথাযথ বোধগ্রাহ্য হয় প্রয়োগের মারফত৷ পাঠ ছেড়ে যদি কেউ তার কাজের শ্রবণে প্রবেশ করেন তাঁরাই বুঝবেন আমার উক্তির তাৎপর্য৷

সলিলদা [সলিল চৌধুরি] আমায় একটা চিঠিতে লিখেছিলেন Urban Music আমাদেরই করে যেতে হবে৷ এ কথাটা ভি বালসারা-র সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে আসবেই৷ ভারতীয় গ্রামীণ সভ্যতার ক্রমবিকাশে শহর ও নাগরিক জীবনের প্রেক্ষিতে সমস্ত শিল্প সংস্কৃতির ভাষার চলন বলন বদলে গেল এবং এই আঙ্গিক বদলের নেতা হচ্ছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ৷ এই ঐতিহাসিক তত্ত্ব বালসারাজির জীবনে জীবন্ত সত্য হয়ে উঠেছিল৷ যে বালসারাজির সংগীতভিত্তিতে ভারতীয় ঐতিহ্য সুর ও ইউরোপীয় সংগীতের চলমান হয়েছিল তা যে রবীন্দ্র অনুসারী হয়েছিল তা বুঝতে পারি বালসারাজির একটি সকরুণ মন্তব্যে৷ চলে যাওয়ার কিছুদিন আগে, পরিপূর্ণতার বোধে যে ভাব পুষ্টি পেয়েছিল, তা রাজ্য সংগীত আকাদেমির বার্ষিক অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসদন অঙ্গনে দু’জনে বসে আছি চেয়ারে, ক্লান্ত কণ্ঠে প্রকাশ করলেন, ‘এখন শুধু রবীন্দ্রসংগীত বাজাতে ইচ্ছে করে৷’ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে, যখন দুরারোগ্য ক্যান্সারে তিনি মৃত্যু পথযাত্রী সেই সময় তাঁর সাধু আত্মা থেকে উঠে এল এই উক্তি৷

সংগীতের বিভিন্ন বিচিত্র পথ অতিক্রম করা মানুষটির জীবনের অস্তগামী মুহূর্তে এমন একটি অভিব্যক্তি উঠে এল বাংলা সংগীতকে নিয়ে, তার সার নির্যাস আত্মীকরণ করে, জীবনের অন্তিম মুহূর্তে এই উদাহরণকে আমি ঐতিহাসিক সত্য বলে মনে করি৷ অবশ্যই তার মৌলিক যত সৃষ্টি— কোনও তাগাদার কাজ নয়, তাঁর প্রাণ থেকে উঠে আসার কাজ, সেখানে তাঁর সব সময় ঐতিহ্য ও প্রগতির সম্মেলন ঘটেছে৷ শ্রদ্ধেয় শ্রীজ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ যিনি নিজস্ব ভারতীয় সংগীতের একজন মহাবিদ্যালয়, যিনি বৈদিকমন্ত্র থেকে ইউরোপীয় সিম্ভনি সব জানতেন, তিনি কিন্তু বালসারাজির মতো জ্যোতিদীপ্ত হীরকখণ্ডটি চিনতে ভুল করেননি৷ আকাশবাণীর রম্যগীতি বিভাগ যখন শুরু করলেন জ্ঞানদা তখন যে কজন বিশিষ্ট সৈনিককে পাশে নিয়ে এগোলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ভি বালসারা৷ আমার সীমিত সংগীতবোধ নিয়ে আমার মনে হয়েছে, ভি বালসারার সংগীত নির্মাণের শ্রেষ্ঠ দক্ষতার পরিচায়ক তাঁর এই রম্যগীতি বিভাগের জন্যে সৃষ্টি সংগীত সম্ভার৷ বিশেষ করে শ্যামল মিত্র গীত, গীত তো অতুলনীয়৷ অনবদ্য৷ শাস্ত্রীয় সংগীতের মহাবিদ্যালয় শ্রীজ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ বালসারাজির নাড়ির সংগীতকে বের করে আনতে পেরেছেন৷ দু’জনের পরিচয়ের বেশ কিছু বছর পর সৃষ্টি উভয়ের যুগল বাজনা হারমোনিয়াম ও পিয়ানো মিলিত সুদক্ষ পরিবেশনায় এমন কিছু সংগীত তরঙ্গ তুলতে সক্ষম হয়েছিল নবধারায় যা বাংলা সংগীত জগতের ইতিহাসে এক অমূল্য সংযোজন বলে আমি মনে করি৷ বাঙালির দুর্ভাগ্য যে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ও ভি বালসারার পশ্চাতে ‘খাঁ’ পদবিটি ছিল না— থাকলে এতবড় সৃষ্টি হয়ত ভারতীয় সংগীত ইতিহাসে একটা আলাদা জায়গা পেত৷

আমি সুরকার জীবনে প্রবেশ করেছিলাম যখন, তখন আমি গণনাট্য সঙ্ঘের একজন সক্রিয় সৈনিক৷ আমার সংগীত ঝুলিতে তখন রবীন্দ্রসংগীত, সামান্য উচ্চাঙ্গ সংগীত ও নাগরিক মনস্কতা আচ্ছন্ন লোকগীতির শিক্ষা৷ অবশ্যই পঙ্কজকুমার মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল, হিমাংশু দত্ত সুরসাগররা আমার সুরবোধের প্রেরণার মন্দিরের সব বিগ্রহ৷ আর মনের মধ্যমণি— একদিকে সলিল চৌধুরি, অন্যদিকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়৷ তার অর্থ এইটাই রবীন্দ্রত্তোর সংগীত ধারার সমকালীন বোধ নিয়েই আমার সুরকার জীবনে প্রবেশ৷ যে ধারায় রবীন্দ্রসংগীত নির্মাণ পদ্ধতিতে পঙ্কজকুমার মল্লিক, সলিল চৌধুরি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও গণনাট্যের সুরপ্রদীপ শ্রদ্ধেয় জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রর বেড়ে ওঠা, সেই পথের আমিও পথিক৷ এঁদের রচনা যেমন ইউরোপীয় সিম্ভনি পদ্ধতিতে নির্মাণ, আমার রচনাও সেই পথে হাঁটতে শুরু করল৷ কিন্তু আমার তো অন্ধের পথ চলা৷ তখন নিজেকে একটু তৈরি করার কথা আমায় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতে শুরু করল৷ তখনই আমি শাস্ত্রীয় সংগীত শিক্ষা শুরু করলাম শ্রদ্ধেয় ঊষারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের কাছে আর পিয়ানো শেখা শুরু করলাম ভি বালসারার কাছে৷ কর্ড বোধ আমার অজান্তেই আমার মধ্যে প্রকাশ করেছিল কিন্তু তার রাস্তাঘাট চিনতাম না— তাই পিয়ানো শেখবার চিন্তা৷ আমি বেশিদিন শিখিনি— ফলে আমি পিয়ানো বাদক হতে পারিনি ঠিকই কিন্তু theory of chords-এর fundamental বেশ কিছু জেনেছি— যে জানা আরো সমৃদ্ধ হয়েছে, শ্রদ্ধেয় বালসারাজীকে যখন আমার বিভিন্ন কাজে বাজনা বাজাবার জন্যে নিয়েছি সেই সব কাজের মধ্যে দিয়ে৷ তবে chord কী, কেন তার সঙ্গে মূল সুরের সম্পর্ক, ব্যবহার চলন বলন সব শিক্ষাই সলিলদার কাছে— যে সলিলদাকে ভি বালসারাজি বলতেন ‘Musical Prophet’৷

বালসারাজির বাজনা কেমন তা সারা দেশের মানুষের অজানা নয়৷ অজস্র মানুষের শ্রবণকে সমৃদ্ধ, পরিতৃপ্ত করেই তিনি গণদেবতার অন্তরে স্থায়ী, শ্রদ্ধাযুক্ত আসন করে নিয়েছিলেন৷ তাঁর সংগীত প্রতিভা ও অস্তিত্ব অনায়াস ও স্বতঃস্ফূর্তভাবেই রাজ্য সংগীত আকাডেমির, Cine Musician Association-এর মতো প্রতিষ্ঠানের সভাপতি পদ অলঙ্কৃত করিয়েছিল৷ তাঁর সাংগীতিক উৎকর্ষ সর্বজনবিদিত৷ তবু আমি সংগীত নির্মাণকারী হিসাবে আমার যে দেখা তার একটা ভিন্ন মাত্রা নিশ্চয় থাকতে পারে কারণ তাঁর সঙ্গে অনেক কাজ করেছি৷ সর্বপ্রথমেই বলতে হবে— তার নির্ভুল বাদন৷ আজ পর্যন্ত মনে হয় কেউ বলতে পারবেন না যে তাঁর বাজাতে গিয়ে note slip করেছে৷ অথবা কোনও take তাঁর ভুলের জন্যে আবার নিতে হয়েছে৷ মনে পড়ছে ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ছবির আবহ সংগীতের কাজের কথা৷ সলিল চৌধুরির composition মানে তাতে হাত সাধা যায়৷ বিভিন্ন musician-কে দেখেওছি— সলিলদার তৈরি পুরো title music একা বাজিয়ে বাজনা অভ্যাস করছে৷ সলিলদা ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ছবিতে, বাচ্চা ছেলেটা বাড়ি থেকে পালাচ্ছে এই theme-এর ওপর একটা music compose করেছেন যেটা খুব fast, speedy একটা piece. বাজাবে চারজন univox বাদক— যার অন্যতম একজন হিসাবে বালসারাজি নির্বাচিত৷ সলিলদার ওই composition বাজনার মতো দক্ষবাদক কলকাতায় নেই বললেই চলে৷ তবু সলিলদা চারজনকে ডাকলেন যার মধ্যে বালসারাজিও একজন৷ বাকিরা রিহার্সালে এল কাঁপতে কাঁপতে— রিহার্সালে করল দুদিন ঘামতে ঘামতে— বালসারাজি জানালেন ঈশ্বরের দয়ায় তিনি বিনা রিহার্সালেই বাজাতে পারবেন৷ সলিলদার সঙ্গে তাঁর তখনও ব্যক্তিগত পরিচয় ও হৃদ্যতা গড়ে ওঠেনি৷ সলিলদাও সহজে কথাটা হজম না করে যতটা complicated পারা যায় pieceটা compose করলেন৷ মনে আছে recording-এর দিন India Film Laboratory-র floor-এ রিহার্সাল চলছে আর যতবার একটা রিহার্সাল শেষ হয় আর একটি শুরুর break হচ্ছে— চারজন player-ই নিজেদের বাজনা নিজেরা অভ্যাস করছে৷ মনে আছে— সলিলদা মুচকি হেসে বলেছিলেন, ওই দ্যাখ মকশো করছে৷ কিন্তু দক্ষ বালসারাজি যতবার বাজালেন প্রতিবারই নিখুঁত অথচ বাকিরা প্রচুর ভোগালেন৷ এই হচ্ছে ভি বালসারা৷ আমি তাঁর আঙুলগুলো চেয়ে চেয়ে দেখতাম৷ লম্বা লম্বা নয়— আর fingeringটার ভঙ্গিটাও ঠিক সাধারণ pattern তো নয়ই আর bookish বলে মনে হত না৷ সব বাজনার style-এ He is institution of his own style & method. পিয়ানোর বাঁ হাতের কারুকাজ তাঁকে বেশি করতে শুনিনি কিন্তু তার ডান হাত ছিল পুরো ঝর্নার কলরবের মতো মিষ্টি ও গতিশীল৷ একটা প্লাকিংও এত মাধুর্যময় যে কল্পনা করা যায় না৷ কথা দিয়ে তার বাজনায় দক্ষতা (skill) মাধুর্য (brilliance) বোঝানো যাবে না কারণ ওই এক কথা প্রয়োগ শিল্পকে কথায় সাজানো যায় না— প্রয়োগেই তার সমস্ত উৎকর্ষ৷ বালসারাজিকে ভালবাসলে, তার কাজে শ্রবণকে আনন্দদান করতে হলে, তাঁর নির্মাণ শুনতে হবে৷

মূলত যন্ত্রসংগীত নিয়েই তিনি কাজ করতেন বলে কণ্ঠসংগীতের সুরসৃষ্টিতে তাঁর বিচরণ অনেক কম ছিল৷ তথাপি বহু জনপ্রিয় গানের সুরকার তিনি৷ সে সব গানের শিল্পীদের মধ্যে আছেন শ্যামল মিত্র, তালাক মামুদ, মুকেশজি, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্রাবন্তী মুজমদার, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় প্রমুখ৷ যেহেতু তিনি আমাদের মতো শুধুমাত্র সংগীত পরিচালক ছিলেন না, সংগীতের নানা বিভাগে ছিল কাজ ও বিস্তৃতি, তাই তাঁর সুরস্রষ্টা অবদানের অনেকটার মূল্যায়ন হয়নি যথাযথভাবে৷ আর তাঁর যন্ত্রী হিসাবে প্রতিষ্ঠা ও জনপ্রিয়তা এমন তুঙ্গে উঠেছিল যে তার অন্য সত্তাটির প্রকাশের ওপর মূল কাজের সাফল্যের আবরণ পড়ে গিয়েছিল৷ সংগীত গবেষক যাঁরা অনেক গবেষণার মধ্যে যদি সুরস্রষ্টা বালসারাজিকে আবিষ্কার করতে পারেন প্রভূত আনন্দরস পাবেন৷ তিনি arranger হিসাবে সব থেকে বেশি ধারাবাহিকভাবে কাজ করেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আর এইটাই তাঁর শ্রেষ্ঠত্বর প্রমাণ যে ধ্রুপদী সংগীতস্রষ্টা শ্রীজ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ও সহজিয়া শ্রীহেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো স্বতঃস্ফূর্ত সুরকারের সঙ্গে যুগপৎ সমদক্ষতায় কাজ করেছেন৷ আবার সলিল চৌধুরির মতো জটিল পর্দার সুরচারীর সঙ্গে দক্ষতার চূড়ান্ত রূপ দেখাতে সক্ষম হয়েছেন৷ বালসারাজির সঙ্গে মিশে মনে হয় না তিনি কোনও সুরস্রষ্টা বা বাজনদার৷ মনে হয় মানুষটার নামই সংগীত৷ তাঁর দেহের স্নায়ুগুলোর নাম আলাদা— সুষুম্না বা পিঙ্গলা নয়— ওগুলোর নাম সা রে গা ম প ধ নি সা৷

সত্যিই মানুষটা কেবল সংগীত বা সঙ্গত নয়— বিদায়ও নিয়েছেন সত্যিকারে এক সাধুর জীবন নিয়ে৷

শুরু থেকে বলি৷ বোম্বে থেকে সদ্য আগত— চারিদিকে নাম শুনছি৷ একদিন একটা কাজে গিয়েছি টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে, দেখি নচিকেতা ঘোষের সুরে একটা ছবির গান recording হচ্ছে— arranger V. Balsara. ফ্লোরের মধ্যে গিয়ে দেখি Musician-রা বাজাচ্ছে আর একটা Baby Piano ডালার ওপর কানের ওপর হাত ঠেকিয়ে মাথাটা তার ওপর রেখে এক আধাসাহেব শুয়ে শুয়ে তাঁর নিজের arrangement শুনছেন৷ সংগীত পরিচালক দাপুটে নচিকেতা ঘোষের ওপর দিয়ে যেন তাঁর দাপট৷ আমাদের সময়ে যে সব লোককে দেখে আমরা বলতাম, ‘পুরো কাপ্তান’— এই ভদ্রলোকও তাই৷ সেই কাপ্তান দাপটে ভি বালসারাকে কাছ থেকে দেখেছি, মিশেছি, বুঝেছি কত রসিক আর চোখের সামনে দেখেছি তাঁকে রবীন্দ্রপূজারী এক সাধু সাধক হিসাবে প্রকাশিত হতে৷ সাধুত্ব ভুঁইফোড় নয়— হঠাৎ গজায় না— সুপ্ত সংস্কারই বিকশিত হয়ে দিব্য শোভায় শোভিত হয়৷ পথ চলতে চলতে এরকম অনেক দৃষ্টান্ত চোখের সামনে দেখেছি৷ সাধুত্বর বীজ বালসারাজির মধ্যে ছিল, যা ঘাত প্রতিঘাতের হৃদয় চেতনার মধ্যে দিয়ে, কখনও সূক্ষ্ম রসিকতার মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে৷ একটা ঘটনা বলি৷ আমি জানতাম তিনি Musician নিয়ে যত কাজ করেন তার চেয়ে কম গড়েন না Musician৷ তাঁর হাতে গড়া অনেক সাধারণ মাপের যন্ত্রশিল্পী পরে তারা পূর্ণাঙ্গভাবে বাণিজ্যিক জগতে প্রবেশ করে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে গেছে৷ আমি পুলক মুখোপাধ্যায় বলে একটি কমবয়সী ছেলে, ঢোল বাজায়, ওঁর কাছে পাঠালাম৷ উনি ওঁকে, যতদিন বেঁচে ছিলেন নিয়ে কাজ করেছেন৷ একেবারে নিজের আপন সন্তানের মতো লালন করেছেন৷ এই সহৃদয়তার সঙ্গেও রসিকতা কী সুন্দরভাবে একদিন জড়িয়ে দিলেন৷ ছেলেটিকে ওঁর কাছে পাঠানোর সময় ওঁকে একটা চিঠি দিই৷ তাতে প্রথম লাইনে লিখেছিলাম, ” I know your heart is always open for the opner.” বহুবছর বাদে আমাদের আশ্রম ‘শ্রীশ্রী বিজয়কৃষ্ণ সাধন আশ্রম’-এর একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল রবীন্দ্র সদনে, যেখানে উনি বাজাতে এলেন৷ আমায় চুপি চুপি কথা বলার ভঙ্গিতে কাছে ডাকলেন৷ সামনে খোলা univox ও বুকে ঝোলানো accordian— এই অবস্থায় আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, ”Your heart is also always open for the opner”, অর্থাৎ একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তাঁকে বাজাতে বলেছি৷ এই ধরনের অনুষ্ঠানে তিনি নবাগত৷ সূক্ষ্ম রসিকতা শেষ বয়সে তাঁর স্বভাবের একটা আলঙ্কারিক প্রকাশ ছিল৷ বিগত হওয়ার বছরখানেক আগে একটি সরকারি কাজের পর কাগজ সই করিয়ে বলা হল, বছরখানেক লাগবে অর্থটা পেতে— বুকে ব্যথা মুখে হাসি নিয়ে রসিকতা করলেন, তবে কি nominee-র নাম লিখে দেব?

সেই মানুষই জীবনে বড় হয়— যার মধ্যে বড়ত্বর সদগুণ থাকে৷ বালসারাজীর হৃদয়টা অনেক কিছু ধারণ করার মতো যেমন উদার, বিস্তীর্ণ ছিল— ক্ষুদ্রকেও সম্মান জানানোর দক্ষতা ছিল, তেমনি স্বভাবের সব শাখাতেই ছিল তার মূল্যবোধের প্রভাব৷ নিয়মানুবর্তিতা তার মধ্যে অন্যতম প্রধান এবং তা সত্যনিষ্ঠভাবে তিনি রক্ষা করতেন৷ কাজে দেরিতে উপস্থিত হওয়া তাঁর নীতিবিরুদ্ধ৷ শুনেছি, একটি অনুষ্ঠানে তিনি কিছু দেরিতে উপস্থিত হওয়ার কারণে শ্রোতাদের কাছে বিনীতভাবে কৈফিয়ত দেন, আমার আজ পুত্র বিয়োগ হয়েছে— তাই তার সৎকার করে আসতে দেরি হয়ে গেল৷

যুবক বয়সে যতই লাঠি ঘুরিয়ে থাকুন— ধীরে ধীরে এক সচঞ্চল স্রোতস্বিনী কীভাবে শান্ত গভীর প্রবাহে এসে মিশে গেল, তা চোখের সামনে দেখলাম৷ যে মানুষের কাছে ঘেঁষতে ভয় পেত মানুষ, শেষ বয়সে মানুষ পেল তাঁরই স্নেহচ্ছায়ার আশ্রয়৷ ধীরে ধীরে অঘোষিত অলিখিত শর্তে ভি বালসারা যেন এই সংগীত জগতের অভিভাবক হয়ে উঠলেন৷ আর যেন এক সহনশীল বটবৃক্ষের মতো বাংলা সংগীত আকাশ জুড়ে বসে রইলেন৷ শুনেছি তিনি শেষ দিকে চেয়েছিলেন বাঙালি প্রথায় তাঁর সৎকার হোক৷ যদিও পরিবার পরিজন তা হতে দেননি৷ Peace haven-এই অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন হয়৷ আদ্যন্ত বাঙালি হয়ে গেলেন এক পার্সি-শিল্পী৷ বাংলার মাটির মতো সহনশীল হয়ে৷

আমার গুরুদেব, শ্রীমৎ স্বামী পরমানন্দ সরস্বতী, কবি-সন্ন্যাসী দুঃখের মহৎ জয়গান গেয়ে গেছেন৷ বলেছেন, ‘দুঃখ রাজা৷ বড় জীবন বড় দুঃখ দিয়ে হয় গড়া৷ আবর্জনা পোড়ালে ছাই হয় কিন্তু অলঙ্কার পোড়ালে হয় খাঁটি৷’ শিল্পী, কবি, গায়কদের জীবনে যদি দুঃখ না আসে তবে তার বিকাশ হয় না৷ ভারতীয় অধ্যাত্ম দর্শনে দুঃখ বারবার মহৎ জীবনের বিকাশভূমিকে ঊর্বর করেছে— যার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ৷ বালসারাজির জীবনেও এ সত্য প্রমাণিত৷ সেই দাপটে সংগীতকার কলকাতায় এসে— পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ও স্বীকৃতি পাওয়ার পর তাকে সহ্য করতে হল এক একটা দুঃখের আঘাত— আর ভাঙতে থাকলো তাঁর অহংয়ের চূড়া৷ ধীরে ধীরে তাঁর আমিত্ব স্থিতিলাভ করতে থাকল তাঁর আত্মার সত্যবোধে৷ এক আধটা উল্লেখ করছি— শ্রাবণ সন্ধ্যার বর্ষণঘন অন্ধকারে প্রকৃতির মুখ যেমন কৃষ্ণবর্ণ বিষাদগ্রস্ত লাগে সেই মুখ দর্শন করেছিলাম বালসারাজির, যেদিন কম বয়সে একটি মাত্র record করে তার প্রিয় সংগীত সংগঠন ‘সাঁঝ ও আওয়াজে’র সংগীত নক্ষত্র মলয় মুখোপাধ্যায় গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন৷ সেই দিন যে বিষণ্ণ বদন দেখেছিলাম— তার পেছনে যেন এক ভবিষ্যৎ সাধুর রূপ দেখেছিলাম৷ তাঁর দাপটে, মেজাজি সত্তা ছিল তাঁর কর্ম— কর্ম অঙ্গন, আর ঐ পশ্চাতের বৈরাগী রূপই তাঁর শাশ্বত সত্তা৷ অনেক ফুলের ডালি সাজিয়ে তৈরি তাঁর ‘সাঁঝ ও আওয়াজ’-এ যে ভাঙনের সুর বেজে উঠল— সেই সুরই ধীরে ধীরে ফাটল ধরাল বালসারাজির বুকে৷ রূপের মধ্যে থেকে উঠে আসতে থাকল অরূপের ভাববিলাস৷ আমার গুরুদেব বলেছিলেন, ‘অবতার পুরুষের বিকাশের জন্যে যেমন চাই শক্তি— প্রতিভা বিকাশের জন্যেও চাই তেমনি শক্তি৷’ আর বালসারাজিকে একদিন হারাতে হল তাঁর সেই সৃষ্টি শক্তিকে৷ সেদিন থেকেই তিনি নিঃস্ব৷ সমস্ত হৃদয় জুড়ে উদার আকাশের নিঃসীম বৈশাখী দীর্ঘশ্বাস— মনে চোখে শ্রাবণের আকুতি৷ তখন থেকেই যেন তিনি বেদনা তড়িদাহত বিদগ্ধ প্রাণ— মুখে রসিকতা— ভিতরে কান্নার সুরে হৃদয়ে বীণার ধ্বনি৷ সহনশীলতা, ভালবাসাভরা বুক নিয়ে নিজেকে মেলে ধরলেন৷ জীবনকে— সংগীতকে সেবা করলেন হোমসিদ্ধ সাগ্নিক ঋত্বিকের মতো৷ তাপ যেন তাঁকে আর স্পর্শ করে না৷ তার সমস্ত সংগীত বোধ এসে আশ্রয় নিল রবীন্দ্র সাগর সংগীতে— অন্তিম সময়ে তাঁর শ্রেষ্ঠ অবলম্বন৷ কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই— কারও ক্ষতির চিন্তা নেই— দুরারোগ্য ক্যানসারকে দেহে চাপিয়ে সবার ডাকে হাজির হতেন বারেবারে৷ চলে যাবার কদিন আগে আমার বড় পুত্র অমিত দেখতে গিয়েছিল— অমিত একটি ‘গুণগুণ’ নামে সংগীত পত্রিকার সম্পাদক৷ তাকে বললেন— গুণগুণ প্রকাশ বন্ধ কোর না৷ বন্ধ হয়েছে তাঁর জীবন-স্পন্দন কিন্তু কোনওদিন বন্ধ হবে না তাঁর প্রেরণার ধারা৷ তাঁর সৃষ্টি নিয়ে শুরু হোক গবেষণা— তৈরি হোক archive— অবাঙলি এক মহান শিল্পী, স্রষ্টা ধীরে ধীরে যে যোগী হয়ে গেলেন তার সৃষ্টি ইতিহাস নিয়ে আমি কেবল ভূমিকাটা লিখলাম— আসনটা অনেক বড়৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *