আমার জীবনে মহাস্থবির প্রেমাঙ্কুর – প্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়
মহাষ্টমীর সকালে যথারীতি খবরের কাগজখানা খুলে পড়তে পড়তে হঠাৎ ভীষণ ধাক্কা লাগল বুকে। আগের দিন সকালে ‘বুড়ো’ চুপিসারে চিরদিনের মতোই পালিয়ে গেছে। চিরকালই ঘর-পালানো স্বভাব ছিল বুড়োর, সেই শিশুকাল থেকেই বার বার পালিয়েছে–আবার ফিরেও এসেছে। আর সেই পথে-পথেই হয়েছে তার শিক্ষা, যে-শিক্ষা বুড়োকে করেছে মহাস্থবির। দীর্ঘ এ জীবনের প্রায় সত্তরটি বছর ধরে অবিচ্ছিন্ন যে সৌহার্দ্যের বাঁধনে আমরা বাঁধা ছিলাম, বুড়ো সে-বাঁধন ছিঁড়ে পালাল–আর সে ফিরে আসবে না। আমিই শুধু খবর পাইনি-তাই শেষ-দেখাটাও তাকে দেখতে পেলাম না; আমার বাড়িতে টেলিফোন নেই।
অনেকদিন ধরে শয্যা আশ্রয় করে ছিল ও। আর ওইরকম শয্যা আশ্রয় করেছে অমল (শ্রীঅমল হোম) আর গিরীন (শ্রীগিরীন মিত্র)। আমি এতদিন ধরে সুযোগ পেলেই এদের শয্যার পাশে গিয়ে বসি–কত পুরোনো স্মৃতির অনুরণন চলে মনে মনে। বুড়োর কাছেও সুযোগ পেলেই গিয়ে বসতাম; বয়সটা হু হু করে কমে যেত।
কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে, সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের মন্দির-এর ঠিক উল্টোদিকে লাহাবাবুদের প্রাসাদোপম অট্টালিকা–এখন যার নম্বর ১৩নং বিধান সরণী–বাবা ভাড়া নিয়েছিলেন। সেই বাড়ির দক্ষির অংশটিতে ছিল ব্রাহ্ম গার্লস স্কুল, আর উত্তর অংশটিতে থাকতাম আমরা, আর আমাদের বড় ভগ্নীপতি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পরিবার। আমাদের বাড়ির ঠিক দক্ষিণ গায়ে লাগানো ছোট্ট দোতলা বাড়িটাতে ভাড়া নিয়ে থাকতেন বুড়োর বাবা মহেশচন্দ্র আতর্থী মশায়। আমাদের ভাই-বোন-এর সংখ্যাও ছিল অনেকগুলি, তার উপরে ভাগ্নে-ভাগ্নীর দলও ছিল বেশ ভারী; তাই বাড়িতে সর্বক্ষণ বেশ হুলস্থুল চলত। ভাগ্নে-ভাগ্নীদের মধ্যে সবাই পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যে লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সুকুমার, সুখলতা, সুবিনয়, পুণ্যলতা এরা তো প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক। বাড়ির আওতা ছেড়ে আমার যে বন্ধু পরবর্তী জীবনের সাহিত্য-জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে–সে ‘বুড়ো’ ওরফে প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। কবে যে তার সঙ্গে প্রথম আলাপ হয় মনে’ নেই, জ্ঞান হওয়া অবধি যতদূর মনে পড়ে সে আমার বন্ধু পদেই অধিষ্ঠিত আছে। তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব শুরু হয়েছিল সেই হাঁটি-হাঁটি পা-পা’র যুগ থেকেই তারপর ইস্কুল-জীবনেও সে-ই হল আমার প্রথম বন্ধু। আমাদের বাড়িরই অপর অংশে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম গার্লস স্কুলেই আমাদের দু’জনেরই বিদ্যালয়-জীবন শুরু হয়। সেই স্কুলে পড়তে-পড়তেই আমরা দুই বন্ধুতে মিলে অনেক পাঠ্য-তালিকা-বহির্ভূত বই পড়ে ফেলেছিলাম। আমাদের বাড়িতে আমাদের তিনজন মাতুলও থাকতেন। তাঁদের ছিল অসীম জ্ঞান-পিপাসা; রোজগারের অধিকাংশই তাঁরা বই কিনবার জন্যে খরচ করতেন। এইভাবে বই কিনে কিনে তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন একটা বড়-গোছেরই পারিবারিক লাইব্রেরি। সে-লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে দুই বন্ধুতে জমিয়ে পড়া হত।
প্রেমাঙ্কুর তার ‘মহাস্থবির জাতক’-এর প্রথম খণ্ডে আমাদের সেই পাঠ্য-তালিকা- বহির্ভূত পাঠ্য-পাঠ সংক্রান্ত বিবরণ তার স্বভাবসিদ্ধ অননুকরণীয় ভঙ্গিতে লিখেছে। উদ্ধৃতি দেবার লোভটুকু সামলাতে পারলাম না। সে লিখেছে :
“আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি…বঙ্কিমচন্দ্রের কয়েকখানি উপন্যাস শেষ করে ফেলেছি। কুন্দনন্দিনীকে বিষ খাওয়ানো বঙ্কিমচন্দ্রের ঠিক হয়েছে কি না তাই নিয়ে প্রাণের বন্ধুর সঙ্গে গোপনে আলোচনা করি। আমার এই বন্ধুটির নাম প্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। প্রভাত হচ্ছে বিখ্যাত ‘অবলাবান্ধব’ পত্রিকার সম্পাদক–ভারত-সভার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের পুত্র। প্রভাত আমার চেয়ে আট মাসের ছোট, কিন্তু এসব বিষয়ে সে আমারই মতো পরিপক্ক ছিল। সে যে সেই বয়সেই কত লোক আর কত বইয়ের নাম জানত, তা ভাবলে এখনও বিস্মিত হই। প্রভাতের মা ছিলেন সে-যুগের বিলেত ফেরত ডাক্তার। এইসবের জন্য সে-সময়ে তাদের বাড়িতে একটা উঁচু সংস্কৃতির আবহাওয়া ছিল। সে তাদের বাড়ি থেকে সব বই নিয়ে আসত, আর আমরা দুই বন্ধুতে মিলে লুকিয়ে এক জায়গায় পড়তুম, আর মশগুল হয়ে যেতুম।
স্বদেশী আন্দোলনের কিছুদিন আগে টহলরাম নামে একজন পাঞ্জাবী ভদ্রলোক বেশ হৈচৈ লাগিয়েছিলেন। ইনি বিডন-উদ্যানে প্রত্যহ বিকেলে ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতেন–ইংরেজ জাতি ও তদানীন্তন বড়লাট লর্ড কার্জনকে নিয়ে বাপাত্ত করতেন। আমি ও বিশেষভাবে আমার বন্ধু প্রভাত টহলরামের একনম্বর চেলা হয়ে পড়লুম।” [য]
টহলরাম গঙ্গারাম নামে পাঞ্জাবী ভদ্রলোকটি রাওয়ালপিণ্ডি শহর থেকে কলকাতায় এসে সেই সময়ে যে হৈচৈ লাগালেন, প্রেমাঙ্কুর আর আমি সেই হৈচৈ-তে মেতে উঠে আর-একজন বন্ধু লাভ করলাম, সে হল প্রসাদ। পরবর্তী জীবনে আমাদের এই প্রসাদ– হেমেন্দ্রকুমার রায় এই ছদ্মনামেই সাহিত্যের পথে যথেষ্ট যশ অর্জন করে সামান্য কিছু দিন আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।
টহলরামের বক্তৃতার পর তাঁরই লেখা–’গড় সেভ আওয়ার এনশেন্ট ইন্ড্, এনশেন্ট বাট গ্লোরিয়াস হিন্দ’ গানটি সমস্বরে গেয়ে গেয়ে আমরা পথে পথে ঘুরতাম। বোধ হয় সেটা ইংরেজি ১৯০৪ সালের কথা। সেই গানের দলে আমার পূর্বপরিচিত সত্যানন্দ রায় একজন সুবেশ সুদর্শন আমাদের সমবয়সি কিশোরকে সঙ্গে করে আনতেন। সেই কিশোরটি আবার একখানা রাজনৈতিক পুস্তিকাও সেই বয়সেই লিখে ফেলেছিল। আমাদের সঙ্গে তার ভাব জমে উঠতে, আমি মহোৎসাহে তার লেখা সেই পুস্তিকাখানা বিক্রির জন্য প্রচুর চেষ্টা শুরু করলাম। অল্পদিনেই সে আমাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেল–হেমেন্দ্র আমাদের দলে এল।
আমাদের বই-পড়া আর আলোচনা এবার ‘ডবল মার্চ’ করে চলল বলা যায়। তিন বন্ধুতে মিলে সারা বিকেল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত্রি পর্যন্ত তর্কবিতর্কের বন্যা বহানো হতে লাগল। আমার আর বুড়োর বাড়ি ছিল ঠনঠনে অঞ্চলে, আর হেমেন্দ্র থাকত তখন পাথুরেঘাটা অঞ্চলে। তর্ক-বিতর্কের শেষ হত না আমাদের। একবার আমরা দুই বন্ধু হেমেন্দ্রের বাড়ি পর্যন্ত তর্ক করতে করতে যেতাম [য ]–সেখানেও সমাপ্তি না ঘটার জন্যে হেমেন্দ্র আবার আমাদের পৌঁছতে আসত–এমনি করে রাত গম্ভীর হত, আর আমাদের গলাও চড়ত পর্দার পর চড়া পর্দা। সেই ত্রয়ী কণ্ঠের মুহূর্মুহূ হুঙ্কারে পাড়া-পড়শীদের ছোট ছেলেরা আঁতকে উঠে কাঁদত। শেষে অতিষ্ঠ হয়ে আমাদের আলাপচারি করার রাস্তার অধিবাসীরা আমাদের কাছে দরবার করলেন তর্কের সেই পাগলা ঘোড়াটার বলগা একটু টেনে ধরতে, অন্যথায় তাঁরা শান্তিভঙ্গের নালিশ জানাতেও কুণ্ঠিত হবেন না–পুলিশের সাহায্য নেবেন এ-কথাও শুনতে হল আমাদের এই তিন তর্কবাগীশকে।
এরপর আমরা তিন বন্ধুতে মিলে ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি (এখনকার ন্যাশনাল ‘লাইব্রেরি) অভিযান শুরু করলাম। ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরির অবস্থান ছিল তখন গঙ্গার ধারে স্ট্র্যান্ড রোডে। আমরা সেখানে বই-এর রাজ্যের মধ্যে বসে মহানন্দে সময় কাটাতাম। এইখানে পেলাম আর এক বন্ধু–যাঁর সঙ্গে তাঁর আমৃত্যু আমাদের প্রাণের সংযোগ অক্ষুণ্ণ ছিল। তিনি কবি সত্যেন্দ্ৰনাথ দত্ত। সত্য-কবি আমাদের থেকে বছর আটেকের বড় ছিলেন বয়সে; কিন্তু প্রায় অজাতশত্রু এই কিশোর তিনটিকে তিনি যেন কি মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে নিলেন অল্পদিনের মধ্যেই। তাঁর বাড়িতেও ছিল পারিবারিক প্রচুর পুস্তক-সংগ্রহ। সত্য-কবি আমাদের হাতে তুলে দিলেন সেই সংগ্রহ ব্যবহারের অবাধ অধিকার। শুধু শর্ত রইল এইটুকু যে,’ আমরা সেইসব বই খুব যত্ন করে মলাট দিয়ে নিয়ে পড়ে ফেরত দেব। আর একটা গোটা রাজ্য যেন আমাদের হাতের মুঠোর মধ্যে এসে গেল।
এইরকম করে বই পড়ে তর্ক-বিতর্ক করে আমাদের তিন বন্ধুর বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। ইতিমধ্যে হেমেন্দ্র তার শিল্পবিদ্যালয়ের পাঠ ছেড়ে দিয়েছে আর প্রেমাঙ্কুর তো ছোটবেলা থেকেই বার বার বাড়ি ছেড়ে বেপাত্তা হয়ে সারা ভারতবর্ষে চর্কী-পাক খেয়েছে। পথে পথে ঘুরে ঘুরে দেখেছে বিচিত্র মানুষের জীবনযাত্রা, অযাচিতভাবে পেয়েছে পথের প্রান্তে স্নেহ-প্রেম-ভালোবাসা আর জীবনের পাত্রটিকে নিয়েছে সে সুধায় বিষে মেশা অভিজ্ঞতার রসে কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে ভরে।
ইতিমধ্যে বোধ হয় ইংরেজি ১৯০৮ সালে কলিকাতায় এসেছিলেন তৎকালীন সুবিখ্যাত শেক্সপীয়ার-নাটকের পরিবেশক ও অভিনেতা স্যার ম্যাথিসান ল্যাঙ্গ। প্রেমাঙ্কুর, হেমেন্দ্র আর আমি অনেক কষ্টে ল্যাঙ্গ-সম্প্রদায়ের অভিনয় দেখবার টিকিট সংগ্রহ করে দেখতে যাই। আমাদের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বনিম্নতম শ্রেণীর টিকিটই আমরা সংগ্রহ করেছিলাম। প্রথম দিনের অভিনয়-সূচিতে ছিল ‘হ্যামলেট’। দৃশ্যসজ্জা, পোশাক-পরিচ্ছদ আর অভিনয়–এই ত্রিধারার সেই চরমোৎকর্ষ দেখে আমরা তো হতবাক্। ঠিক করা হল ল্যাঙ্গ-সম্প্রদায়ের সব-ক’টি নাটকের অভিনয়ই আমাদের দেখতে হবে। একে একে তারপর শেক্সপীয়ারীয় নাটক ‘ওথেলো’, ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’, ‘কিং লিয়ার’, ‘মিডসামার নাইট্স্ ড্রিম্’ আর আধুনিক রচনা ‘পাসিং অফ থার্ড ফ্লোর ব্যাক’ দেখে ফেলে আমাদের মনে জাগল ল্যাসাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলোচনা করবার বাসনা। আমরা তাঁকে চিঠিতে লিখলাম যে, আমরা যদিও বয়সে এখন কিশোর কিন্তু মনে আমাদের আকুল সাহিত্য আর শিল্পতৃষ্ণা; তিনি যদি আমাদের সেই তৃষ্ণায় কিঞ্চিৎ জ্ঞান-বারিসেচন করেন তবে আমরা কৃতার্থ হব।
সাহস করে চিঠি লিখে ফেললেও তিন বন্ধু কিন্তু স্বপ্নেও ভাবিনি যে, সত্যি সে চিঠির উত্তর আমরা পাব। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, আমরা চিঠির জবাব তো পেলামই–উপরন্তু গ্র্যান্ড-হোটেলে তাঁর কক্ষে মধ্যাহ্ন ভোজনের নিমন্ত্রণ।
নির্দিষ্ট দিনে দুরু-দুরু বক্ষে তিন বন্ধু গিয়ে গ্র্যান্ড-হোটেলে স্যার ম্যাথিসান ল্যাঙ্গ-এর বিলাসকক্ষের দরজায় ঘা দিলাম। আমাদের চমৎকৃত করে ল্যাপত্নী সুবিখ্যাত অভিনেত্রী হিউটিন ব্রিটন দ্বারপথে এসে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন। ভোজনকালে স্যার ল্যাঙ্গ আমাদের সহিত অত্যন্ত হৃদ্যতার সঙ্গে শেক্সপীয়ার-সাহিত্য আলোচনা করলেন আর নির্দেশ দিলেন কিভাবে আমাদের পাঠতৃষ্ণা মিটবে সেই পথের।
ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে আমাদের অভিযান চলতেই লাগল নিয়মিত। আমাদের পাঠতৃষ্ণা দেখে তৎকালীন সুপারিনটেন্ডেন্ট শ্রীযুক্ত কুমার একদিন অযাচিতভাবে এগিয়ে এসে সন্ধান দিলেন বহু মূল্যবান বই-এর রাজ্যের, আর কবি সত্যেন্দ্রনাথ এগিয়ে এলেন তাঁর বাড়ির অমূল্য সংগ্রহ থেকে নরউইজিয়ান, সুইডিশ, জার্মান ও রুশ বই-এর ইংরেজি অনুবাদে সেরা সেরা বই আমাদের হাতে তুলে দিতে।
এই সময়ে আমরা তিন বন্ধুতে প্রায়ই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেও রবীন্দ্র-সন্দর্শনে যেতাম। সেখানে ঋষিপ্রতিম দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে পরিচয় হল, আর সুধীন্দ্রনাথের স্নেহধারাও অকৃপণভাবে আমাদের মাথায় এসে পড়ল। নলিনীরঞ্জন পণ্ডিত মহাশয় এই সময়ে ‘জাহ্নবী’ পত্রিকা পরিচালনা-ভার ত্যাগ করলে, সুধাকৃষ্ণ বাগচী নামে একজন ভাগ্যান্বেষী যুবক ওই পত্রিকার ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে খুব নাজেহাল হচ্ছিলেন। সুধীন্দ্ৰনাথ আমাদের অনুরোধ করলেন সুধাকৃষ্ণকে সাহায্য করতে। আমরা তিন বন্ধু মহোৎসাহে ‘জাহ্নবী’ পত্রিকার সম্পাদনায় লেগে গেলাম।
‘জাহ্নবী’-কার্যালয়ে আমাদের বৈঠক খুব জোর জমে উঠল। এই ‘জাহ্নবীতেই প্রেমাঙ্কুরের প্রথম ছোটগল্প আর হেমেন্দ্রকুমারের একখানা উপন্যাস প্রকাশিত হয়।
কিন্তু আমাদের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত সুধাকৃষ্ণর মনান্তর হয়ে গেল এবং আমরা ‘জাহ্নবী’ পত্রিকার পরিচালনা-ভার ছেড়ে দিলাম। এবার আমরা সদলবলে এলাম ‘যমুনা’ পত্রিকার আসরে। ‘যমুনা’ সম্পাদনা করতেন ফণীন্দ্রনাথ পাল মশায়। তিনি নিজেও বেশ লিখতে পারতেন। কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে এখন যেখানে ডি. রতন কোম্পানির ছবি-তোলার দোকান, ঠিক সেই ঘরে ছিল ‘যমুনা’র অফিস। এই ‘যমুনা’র জন্য ভালো লেখা খুঁজতে গিয়েই শরৎচন্দ্রের সঙ্গে পরিচয়। আর আমাদের তখনকার মতো জীবনের ব্রত হল শরৎচন্দ্রকে সবাইকার সঙ্গে পরিচিত করে দেওয়া। প্রেমাঙ্কুর এবং আমি শরৎবাবুর লেখা নিয়ে তখন জনে জনে পড়িয়ে বেড়াতাম।
লিখতে বসেছি প্রেমাঙ্কুরের কথা কিন্তু লিখে চলেছি আমাদের তিনজনের গল্প–প্রেমাঙ্কুর, হেমেন্দ্রকুমার আর আমার। কত চেষ্টা করছি আমাকে বাদ দিতে কিন্তু বাদ তো যায় না–’আমি টা দেখি কখন অজান্তে ঢুকে জায়গা করে বসে আছে। এই সত্তরটা বছর একসঙ্গে পা ফেলে চলার পর অন্য দু’জনের পদযাত্রা একে একে কখন নিঃশব্দে ওপারের দূত এসে থামিয়ে দিয়ে গেল–পড়ে রইলাম আমি। এই ‘আমি’টাকে এ গল্প থেকে বাদ দি’ কি করে!
.
ইতিমধ্যে সাহিত্য আর রাজনীতির মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে একমাত্র আমারই লেখাপড়ার জীবনটাও চলছিল, প্রেমাঙ্কুরের বিদ্যালয়ের সঙ্গে সংস্রব ছুটে গিয়েছিল বহুদিন আগেই। তারপর বার বার বাড়ি থেকে সে পালিয়েছে, ঘুরে ফিরে জগৎটাকে দেখেছে–রঙিন কাঁচের পরকলার মধ্যে দিয়ে নয়– খোলা চোখে, আর সেই জ্ঞান পরবর্তী জীবনে স্বাভাবিকভাবেই ছায়া ফেলেছে তার সাহিত্যে। আর হেমেন্দ্র পুরোপুরি সাহিত্য-জীবনকেই অবলম্বন করেছে।
গৃহপলাতক প্রেমাঙ্কুর পলাতক-জীবনেও নানা ভাবে রোজগার করেছে, পেটের দায়ে–পথের মজুরবৃত্তি থেকে শুরু করে–অনেক কিছুই। একবার লখনউ শহরে গিয়ে চশমার ব্যবসায়ী বি. এন. বৈতাল-এর কাছে চশমার কারুকার্য শিখে ও ফিরে এসে কলকাতার শ্রীমানী বাজার অঞ্চলে তাদের কারবারে চাকরিও নিয়েছিল। চশমা-ব্যবসায়ী বৈতাল-মশায়ের এক ভাই ছিলেন কলকাতার পুলিশ-অফিসার। একবার তাঁর কাছ থেকে-আমার বাড়িতে রাজনৈতিক-নিষিদ্ধ জিনিস লুকোনো আছে এবং তার সন্ধানে পুলিশ হানা দেবে–এই খবর পেয়ে প্রেমাঙ্কুর সেইসব জিনিসপত্র সরিয়ে নিয়ে গিয়ে গোপনে তার সদ্গতিও করেছিল। তা ছাড়া ‘হিন্দুস্থান’ পত্রিকায় কাজ করে তার সাংবাদিকতায়ও দীক্ষা হয়েছিল। তারও আগে ‘কার এন্ড মহলানবীশ’-এর চৌরঙ্গীর খেলাধুলার সরঞ্জাম আর বাদ্যযন্ত্রের দোকানে দোকানদারীও করেছে।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের’ নেতৃত্বে স্বরাজ্য-দল কাউন্সিলে প্রবেশ ও নগর-সংস্থা দখলের সঙ্কল্প নিলেন। ঠিক হল আন্দোলনকে জোরদার করবার জন্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করা হবে। বন্ধু অ্যাটর্নি নির্মলচন্দ্র চন্দ্রের সম্পাদকত্বে বেরোল সান্ধ্য দৈনিক ‘বৈকালী’। নামে নির্মলচন্দ্ৰ সম্পাদক হলেও, তাঁর নিজের কাজ ছেড়ে এসে পত্রিকা- পরিচালন তাঁর পক্ষে সম্ভবপর নয়। আমার অক্ষম স্কন্ধে দেশবন্ধু তুলে দিলেন সেই ভার। ইতিমধ্যে আমি ওকালতি পাস করে ফেলেছিলাম আর খুব সমারোহ করেই চলচিল রোজ আদালত-অভিযান। কিন্তু দেশবন্ধুর ডাকে আদালতের জোব্বা ছুঁড়ে ফেলে এসে হাতে তুলে নিলাম সাংবাদিকতার কলম,–শুধু একা তো কাজ চালানো যায় না–তাই আবার সেই পুরোনো বন্ধুদ্বয় প্রেমাঙ্কুর আর হেমেন্দ্রকুমার।
“বৈকালীতে তিন বন্ধু বেশ চুটিয়ে লেখনী চালাতাম, অনেক মজার ঘটনাও ঘটেছিল সে-সময়। সে-কথা ইতিপূর্বে ‘যুগান্তর’-এর পাতায় লিখেছি (‘যুগান্তর’, ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪–”সাংবাদিকতার ভূত : দৈনিক পত্রিকায়”)। সুতরাং পুনরাবৃত্তি থেকে বিরত থাকলাম। কিন্তু সেই ‘বৈকালী’ও আমাদের ছাড়তে হল একদিন। নির্মলচন্দ্র তখন একটি থিয়েটারের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন; সেই থিয়েটারের যিনি কর্মকর্তা, তাকে তিনি ‘বৈকালী’র কর্মাধ্যক্ষ করে নিয়ে এলেন, ‘বৈকালীতে প্রেমাঙ্কুর আর হেমেন্দ্র তখন শিশির ভাদুড়ীর প্রচারও খুব জোর করে করছে। আমাদের কর্মাধ্যক্ষ ছিলেন শিশির-বিদ্বেষী; তিনি ফতোয়া দিলেন রাজনৈতিক পত্রিকায় শিশির-প্রচার চলবে না। ব্যস্, আমরা ‘বৈকালী’ ছাড়লাম! হেমেন্দ্র তো সোজাসুজি শিশিরের প্রচারের জন্য বের করল ‘নাচঘর’ পত্রিকা। প্রেমাঙ্কুরও চলচ্চিত্রে যোগ দিল। ‘নাচঘরে’ আমি সেই কার্যাধ্যক্ষকে জোরসে ঠুকে এক প্রবন্ধও লিখে ফেললাম–যদিও সেই ভদ্রলোক ছিলেন আমার মাতৃকুলের নিকট-আত্মীয় এবং আজও তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত প্রীতির সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ আছে।
তারপরে তো হেমেন্দ্র শিশিরের নাটকের গান লিখেছে, নাচের পরিকল্পনা করেছে মণিলালের সঙ্গে একযোগে মিলে। মণিলাল আর হেমেন্দ্র যখন সেইসব ভারতীয় নাচের পরিকল্পনা করেছে তখন রবীন্দ্রনাথও নৃত্যের উজ্জীবনে এতটা মাথা ঘামাননি, আর উদয়শংকরেরও তখন এমন পরিচিতি ঘটেনি দেশে। তা ছাড়া চারু করেছে শিশিরের জন্যে পিছনে-ঝোলানো আঁকা সিন উঠিয়ে দিয়ে ত্রিমাত্রিক সেটের ও ইতিহাসাশ্রয়ী পোশাকের পরিকল্পনা। শিশিরের আগ্রহে প্রেমাঙ্কুর তার জন্য সেইসময়ে দু’খানা নাটকও লিখে দিয়েছিল। একখানা ইতিহাস-আশ্রয়ী ‘তত-এ- তাউস’ আর দ্বিতীয়টি গোর্কীর ‘লোয়ার ডেপ’ অবলম্বন করে এদেশের ঘরের কথার সুরে গেঁথে ‘মাটির ঘর’। শিশির সে-দুটোর পাণ্ডুলিপিই হারিয়ে ফেলেছিল সে-সময়ে, তাই অভিনয় হয়নি। পরবর্তী যুগে শ্রীরঙ্গম্ রঙ্গমঞ্চের শেষদিকে ‘তত-এ-তাউস’-এর পাণ্ডুলিপি খুঁজে পেয়ে শিশির সে-নাটকের অভিনয় করে। ওই নাটকের জাহাঙ্গীর শা’র চরিত্রে শিশিরের অবিস্মরণীয় অভিনয় যিনি দেখেছেন, একটা অবিস্মরণীয় চরিত্র-অভিনয় দেখার স্মৃতি তিনি ভুলতে পারবেন না। ‘মাটির ঘর’-এর পাণ্ডুলিপিটি বোধহয় আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমাদের পুরোপুরি দলবলই সেদিন শিশিরের পিছনে দাঁড়িয়েছে বলা যায়। শিশিরকে ঘিরে সেদিন তাই বাংলাদেশের সাহিত্য আর শিল্পকলার নতুন দিগন্ত উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। চলচ্চিত্রের জগতে প্রেমাঙ্কুর অভিনয়, চিত্রনাট্য লেখা আর পরিচালনা–তিনটে বিভাগেই সুনাম আর সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছে। কলকাতা, লাহোর ও বোম্বাই–এই বিশাল পরিধি নিয়ে রচিত হয়েছে তার কর্মক্ষেত্র। দু’হাতে টাকা রোজগার করেছে, আবার খরচও করেছে দু’হাতে।
ত্রিশ-সালের আন্দোলনের শেষে জেল খেটে বেরিয়ে এসে দেখি আমার স্ত্রীর মরণাপন্ন অসুখ। বায়ু-পরিবর্তনের জন্য চিকিৎসক-সহ যেতে হল দেওঘর। সেখানেও প্রেমাঙ্কুর। সেবার সেই দেওঘরেই ঘটেছিল একটা অদ্ভুত ঘটনা। প্রেমাঙ্কুরের চুলে তখন বেশ পাক ধরেছে, দাড়িতেও; তখন তার মুখমণ্ডলে হঠাৎ গুম্ফের আবির্ভাব হল। এর আগে ওর দাড়ি থাকলেও মুখমণ্ডলে গুম্ফের রেখা দেখা দেয়নি। সে সেই সদ্যোজাত ঘোর কৃষ্ণবর্ণ গুম্ফরাজিকে বেশ সযত্নে রেখে দিয়েছে। খুব হাসাহাসি হল।
এমনিভাবে জীবন কাটিয়ে লোকে যখন বাণপ্রস্থ নেয়, তখন হঠাৎ প্রেমাঙ্কুর আবার সাহিত্য-জীবনে ফিরে এল। আর এল একেবারে বিজয়ীর নিশান হাতে করে। ‘মহাস্থবির জাতক’ লিখে রাতারাতি প্রেমাঙ্কুর দিগ্বিজয় করে নিল বলা যায়।
জীবনের বহু স্থূল বাস্তবের মধ্যে ডুব দিয়ে শুধু সুন্দরকে ছেঁকে তুলে সাহিত্যের ‘নৈবেদ্য সাজিয়েছে [সে]। বহু পঙ্কিলতার মধ্যে থেকেও অদ্ভুত নিরাসক্ত মন নিয়ে সে শুধু যেন জীবনকে দেখে গেল দুচোখ ভরে। পাঁক তার অন্তর স্পর্শ করল না; পঙ্কজের মতোই তার আত্মা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে রইল। তার লেখাতেও সেই নিস্পৃহ নিরাসক্তির ছাপ সর্বত্র।
ছেলেবেলায় পড়া একটা উপন্যাস থেকে সে তার জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করবার হদিশ পেয়ে তাকে জীবনের ‘মটো’ করে নিয়েছিল, তা হচ্ছে–”Out of wreck I rise past Zeus to throne above.” বিচারাসনে আসীন বিশ্বনিয়ন্তা, তাঁর অন্তরালে যে প্রেমময় সত্তা বর্তমান, তাকে উপলব্ধি করে জীবনের সকল পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হবার সাধনা সে নিয়েছিল। মনের নিভৃতে এই সাধনার প্রকাশ যথাসাধ্য গোপন রাখত–তবে আমাদের মতো অন্তরঙ্গ দুই-একজনের কাছে তা অজানা ছিল না। এই আদর্শের অনুরণন তার প্রায় সকল সৃষ্টির মধ্যেই বর্তমান এবং সেই আলোকের বিচারেই তার সৃষ্ট সাহিত্যের সম্যক্ বিচার সম্ভব।
[ ‘রবিবাসরীয় যুগান্তর সাময়িকী’, ৮ নভেম্বর, ১৯৬৪ ]