আমার চোখে সত্যজিৎ রায়
আমি ছবি আঁকি, গল্প-টল্প লিখি, রেখায়-লেখায় কমিক্স বা চিত্ৰকাহিনিও রচনা করি, তাই বলে শিল্পী কিংবা সাহিত্যিক নই, নিতান্তই পেটের ধান্দায় ওই সব অনধিকার চর্চা বা দুষ্কর্ম করে থাকি। শুনেছি আমার লেখা আর আঁকা বই নাকি বাজারে ভালোই বিক্রি হয়, কিন্তু বিক্রি হওয়াই যদি ভালোর নিরিখ হয়, তাহলে তো রগরগে হিন্দি ফিল্মে আর ইয়ের ছবিগুলোই সবচেয়ে ভালো। কারণ, ওইগুলোর বিক্রি সাংঘাতিক। তবে ব্যবসায়ী জগৎ পয়সার কথাই আগে ভাবে, চিরায়ত সাহিত্য বা অমর শিল্পকলা প্রভৃতি যুগান্তকারী বস্তু সৃষ্টি করতে না পারলেও যাকে দিয়ে কাজ করালে পয়সা পাওয়া যায়, তাকে দিয়ে প্রকাশকরা বই লেখান আর ছবি আঁকান, যদিও উন্নাসিক শিল্পী আর সাহিত্যিকের কাছে আমি হচ্ছি না ঘরকা, না ঘাটকা অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে Jack of all trades…
প্রবচন শেষ করলাম না, লজ্জায় কলম থেমে গেল। আমি খুব সত্যনিষ্ঠ বটে, কিন্তু সত্যের খাতিরেও নিজেকে অপদার্থ বলতে কি কারও ভালো লাগে?
হে পাঠক! আপনি কি রেগে যাচ্ছেন? মনে করছেন সত্যজিৎ রায়ের কথা বলতে গিয়ে লোকটা নিজের কথা বলে কেন? এটাও কি আত্মপ্রচারের চেষ্টা নাকি?
আরে না মশাই, আত্মপ্রচার, আত্মনিন্দা বা আত্মশুদ্ধি কোনোটাই আমি করতে চাই না, কিন্তু শিরোনামটা দেখেছেন? যে-লোকটির চোখ দিয়ে আপনারা সত্যজিৎ রায়কে দেখবেন তার চোখ ট্যারা-বাঁকা কিনা দেখবেন না? যদি বলেন সত্যজিৎ আজ বিশ্ববন্দিত, তাঁর সম্পর্কে আপনার মতো ইয়ের কথা কে শুনতে চায়?
হ্যাঁ মশাই, শুনতে চায়। অনেকেই শুনতে চায়। পশ্চিমবঙ্গের কিছু প্রাপ্তবয়স্ক নাবালক আর অপ্রাপ্তবয়স্ক সাবালক আমার কথা ভাবে, আর তাদের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। তাই ব্যবসার খাতিরেই এই কাগজের সম্পাদক মশাই সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে কয়েকটা কথা আমায় লিখতে বলেছেন সেইজন্যেই দুর্ভাবনা গল্প লিখি, ছবি আঁকি, কিন্তু প্রবন্ধের মতো গুরুতর বস্তুর কাছাকাছি কখনো যাইনি। তবে আমি হচ্ছি পূর্বে উল্লিখিত পেশাদার Jack, কুম পেলে প্রবন্ধই বা লিখব না কেন? আমার কলমে প্রবন্ধ যদি কবন্ধ হয় তাতেই বা কি? পয়সা পেলেই হল। অতএব কলম ধরলাম।
সত্যজিৎ আজ বিশ্ববিখ্যাত, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তিনি সম্মান লাভ করেছেন। অবশেষে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডউপাধি দিয়ে বলেছেন, স্বদেশকে তিনি বিশ্বের সামনে রূপবাণীতে মূর্ত করেছেন বলেই তার প্রাপ্য স্বীকৃতি দিয়ে উক্ত প্রতিষ্ঠান আনন্দিত। যারা নিয়মিত খবরের কাগজ পড়েন, তাঁরা জানেন এই দুর্লভ উপাধির প্রাপক রবীন্দ্রনাথ (১৯৪০খৃঃ)। সিনেমাটোগ্রাফার হিসাবেও তিনি দ্বিতীয়, ফিলমি দুনিয়ার সর্বপ্রথম ওই পুরস্কার পেয়েছেন চার্লি চ্যাপলিন আজ থেকে ষোলো বছর আগে। ওই উপাধি দেওয়া হয়েছে চারটি বিভাগে ড, অব সিভিল ল, ড, অব মিউজিক, ড. অব সায়েন্স এবং ড. অব লেটার্স। অক্সফোর্ডের সমাবর্তন উৎসবে প্রথম তিনটি বিভাগের প্রত্যেকটি বিভাগেই একাধিক ব্যক্তি উপাধি লাভ করেছেন, কিন্তু শেষোক্ত ড, অব লেটার্স পেয়েছেন একমাত্র সত্যজিৎ রায়।
এইসব কথা খবরের কাগজ যারা নিয়মিত পড়েন তাদেই অবশ্যই জানা আছে, তাহলে এই প্রসঙ্গের অবতারণা কেন?
সেই কথাই বলছি। সত্যজিৎ সম্পর্কে অধিকাংশ পত্র-পত্রিকায় দেখা যায় প্রশস্তি আর উচ্ছ্বাস, কয়েকটি কাগজে প্রকাশিত হয় সমালোচকদের ছদ্মবেশে নির্লজ্জ কুৎসা অর্থাৎ ঈর্ষাদগ্ধ প্রাণের বিষাক্ত উদ্গার।
নিন্দুকের কথা ছেড়ে দিলাম তারা আলোচনার অযোগ্য। যাঁরা প্রশংসার নামে অতিশয়োক্তি আর প্রশস্তিতে পঞ্চমুখ, তাঁদের জানাচ্ছি সত্যজিৎ রায় আমাদের দেশের গৌরব এবং অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী হলেও সমালোচনার ঊর্ধ্বে তিনি স্থান গ্রহণ করতে পারেন নি।
সত্যজিতের প্রত্যেকটি ফিল্ম সার্থকতার সাক্ষর বহন করে না। পথের পাঁচালি, অপুর সংসার, তিনকন্যা, চারুলতা প্রভৃতি চলচ্চিত্রের পরিচালকের কাছে কাপুরুষ ও মহাপুরুষ বা চিড়িয়াখানা নামক ফিল্ম গুণমুগ্ধ দর্শকবৃন্দ আশা করতে পারেন কি? এমনকী যে অশনি সংকেত দুর্লভ গোল্ডেন বেয়ার লাভ করেছে, তার সম্বন্ধেও সত্যজিতের কোনো কোনো ফ্যান বলে থাকেন, উক্ত চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকার মধ্যে গ্রাম্যভাব অনুপস্থিত। বিদেশিরা চলচ্চিত্রের আঙ্গিক দেখেই মুগ্ধ, গ্রামীণ মানুষের চালচলনে শহরের sophisticated নাগরিকের অস্তিত্ব অনুভব করলে গ্রাম-বাংলার পটভূমিতে নির্মিত সমগ্র ফিল্মটি যে ব্যর্থ হয়ে যায় একথা উপলব্ধি করা বিদেশিদের পক্ষে অসম্ভব– তাই শুধুমাত্র আঙ্গিকের গুণে আকৃষ্ট হয়েই তারা নাকি পরিচালককে পুরস্কৃত করেছেন। এই অভিমত যাঁদের, তাঁদের মধ্যে অনেকেই সত্যজিতের গুণমুগ্ধ দর্শক, তাদের বক্তব্য একেবারে নিন্দুকের নিন্দা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় কি? আপনারা কি বলেন?
উপরে উল্লিখিত বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে কোনো মতামত প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, ফিল্ম সম্পর্কে কিছু কিছু ধারণা থাকলেও ওই বিষয়ে আমি বিশেষজ্ঞ নই। আমি আড্ডাবাজ মানুষ, আড্ডার মোহে অনেক সময় কাজের ক্ষতিও করে থাকি। আড্ডা দিতে বসে বিভিন্ন মানুষের কাছে যে-সব মতামত শুনেছি, সেইগুলো আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। সত্যাসত্য নির্ধারণের ভার রইল আপনাদের উপর।
সত্যজিৎ সম্পর্কে কয়েকজন লেখক অত্যন্ত বিরূপ। ভদ্রলোকের অপরাধ, তিনি চলচ্চিত্রের মাধ্যম ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে, অর্থাৎ সাহিত্যের ক্ষেত্রেও আত্মপ্রকাশ করেছেন এবং বহু লেখকের চিত্তবিক্ষোভ ঘটিয়ে অগণিত কিশোর-কিশোরীর কাছে অসামান্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। যে সব লেখক সাহিত্যের ক্ষেত্রে সত্যজিতের আবির্ভাবকে অনধিকার চর্চা বলে মনে করেন, তাদের কথা বোধ হয় ধর্তব্য নয়। শিল্পের (কথাশিল্পও শিল্প তো?) বিভিন্ন ক্ষেত্রে একটি মানুষের দখল থাকতে পারে– একথা স্বীকার করার মতো মানসিক উদারতা যাঁদের নেই তারা কোন শ্রেণীর পর্যায়ভুক্ত, সেকথা আপনারাই ভেবে দেখুন। সত্যজিৎ রায় অসাধারণ চিত্ৰ-পরিচালক, তার কারণ সাহিত্য বস্তুটিকে তিনি ভালোভাবেই বুঝতে পারেন। যে শিল্পী চলচ্চিত্র ও সাহিত্য নামক দুটি মাধ্যমকেই সঠিক বুঝতে পারেন, তার পক্ষেই সার্থক চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব। সত্যজিৎ জানেন, কাগজের ভাষা আর সেলুলয়েডের ভাষা এক হতে পারে না, দুটি মাধ্যমের সীমা সম্পর্কেও তিনি সম্পূর্ণ সচেতন, তাই আজ তিনি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রপরিচালক।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে তার কলম সীমাবদ্ধ। কিন্তু নিজস্ব সীমানায় অর্থাৎ কিশোর সাহিত্যে, বর্তমানে প্রেমেন্দ্র মিত্র ছাড়া তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই বলেই মনে হয়। সত্যজিৎ রায় লিখিত প্রোফেসর শঙ্কু এবং ফেলুদা নামক চরিত্র দুটি শুধু ছোটোদের কাছে নয়, বড়োদের কাছেও অতিশয় প্রিয়। সত্যজিৎ বড়োদের জন্য কলম ধরতে অনিচ্ছুক, কিন্তু যদি কখনো তিনি বড়োদের জন্য লেখেন তবে সেই লেখা যে রসোত্তীর্ণ হবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমার কথা অন্ধ স্তাবকতা নয়, বাস্তব সত্য। জীবনে কোনো ক্ষেত্রেই তিনি মাঝারি মানষ বলে পরিগণিত হন। নি। সেইজন্যই পূর্বোক্ত মন্তব্য করলাম।
ফিল্ম এবং সাহিত্য ছেড়ে এবার অন্যান্য ক্ষেত্রে তার ক্ষমতার বিষয় নিয়ে একটু আলোচনা করি, কি বলেন?
চিত্রশিল্পী হিসাবে তার ক্ষমতাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। সন্দেশ পত্রিকায় তার আঁকা ছবিগুলো চিত্রশিল্পী হিসাবে তার ক্ষমতার পরিচয় বহন করছে। তা ছাড়া এক সময়ে তিনি ডি, জি, কিমার নামক বিখ্যাত বিদেশি প্রতিষ্ঠানে অন্যতম প্রধান শিল্পী (কমার্শিয়াল আর্টিস্ট) হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। বিদেশি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কারো মুখ দেখে পয়সা দেয় না, এ-কথাটা বিশেষভাবে জানা আছে বলে সত্যজিতের চিত্রশিল্প সম্পর্কে খুব উন্নাসিক বুদ্ধিজীবীরাও নীরব।
এবার সংগীতকলা :
উক্ত বিষয়ের উপর সত্যজিতের অসামান্য অধিকার অস্বীকার করা যায় না। তাঁর পরিচালিত বিভিন্ন ফিল্মে তিনি স্বয়ং সংগীত পরিচালনা করেছেন এবং তার ফলাফল আজ সকলেই জানেন। গুপী গাইন বাঘা বাইন নামক চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায় রচিত বাণী ও সুরের আশ্চর্য সমন্বয় দর্শকদের মুগ্ধ করেছে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনায় উৎকর্ষ শুধু গানের ভালো সুর দেওয়ার উপর নির্ভর করে না। পটভূমি থেকে বহমান শব্দলহরী যে-নাটক সৃষ্টি করে, সে বিষয়ে যিনি সচেতন থাকেন, তিনিই সার্থক সংগীত পরিচালক। তিনকন্যা সিরিজের প্রথম কাহিনি মণিহারা গল্পে নৌকাডুবির সময়ে অত্যন্ত অস্পষ্টভাবে ভেসে-আসা আর্তকণ্ঠের আভাস প্রমাণ করে দেয়, সংগীত পরিচালক হিসাবেও সত্যজিৎ রায় অনন্য। প্রসঙ্গত উল্লেখ করছি ফরাসি টেলিভিসনের প্রযোজনায় সত্যজিতের আগামী তথ্যচিত্রটির নাম মিউজিক অব রাজস্থান।
এবার অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক।
একদল লেখক (অধিকাংশই ফিলমি দুনিয়ার মানুষ) বলেন, সত্যজিৎ রায় নাকি বিশ্বের দরবারে ভারতবর্ষকে ছোটো করেছেন, হীন প্রতিপন্ন করেছেন। ভারতের দারিদ্র্য, কুসংস্কার প্রভৃতি বিষয় পশ্চিমী দুনিয়ার সামনে তুলে ধরেছেন বলেই নাকি তারা খুশি হয়ে তাকে বারংবার পুরস্কৃত করেছেন।
এই কথার উত্তরে আমার বক্তব্য উপস্থিত করছি, পশ্চিমী দুনিয়ার বহু দেশেই স্থানীয় লেখক ও চলচ্চিত্র পরিচালকবর্গ নিজের দেশের অন্যায় দুর্নীতিকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছেন। সেইজন্য তাদের কেউ দোষারোপ করেছে বলে তো শুনি নি! আমার বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করার জন্য বহু বিদেশি ফিল্মের নাম করতে পারতাম, স্থানাভাববশত মাত্র দুটি আমেরিকার ফিল্মের নাম উল্লেখ করছি- Soldier Blue এবং The Liberation of L. B. Jones. ছবি দুটির পরিচালকদের নাম যথাক্রমে- Ralph Nelson এবং William Wyler. প্রথম ছবিটিতে রেড ইন্ডিয়ানদের উপর শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের অমানুষিক অত্যাচার দেখানো হয়েছে। দ্বিতীয় ছবিটির বিষয়বস্তু হচ্ছে আমেরিকার একটি অঞ্চলে স্থানীয় পুলিশ বিভাগে প্রচলিত দুর্নীতি। পরিচালক দু-জন এখানে সমালোচকের ভূমিকা গ্রহণ করেছেন মাধ্যম, কাগজের পরিবর্তে সেলুলয়েড। যতদূর জানি, আমেরিকায় কেউ এজন্য তাদের দোষারোপ করে নি। দুটি ছবিই ভারতবর্ষে মুক্তিলাভ করেছিল।
সত্যজিতের যাঁরা শত্রু নন, কিন্তু খবরাখবর না জেনেই তাঁর সমালোচনা করেন এমন মানুষের সংখ্যাও একেবারে নগণ্য নয়। পূর্বোক্ত ভদ্রলোকদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন, পশ্চিম বাংলার চলচ্চিত্র শিল্পকে উন্নত করার জন্য সত্যজিৎ রায় কিছু করেন না কেন?
উত্তরে জানাচ্ছি, তার পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব সবই তিনি করেন। তিনি যে পদ্ধতিতে কাজ করেন সেটাকে অনুসরণ করলেই হয়, এই ব্যাপারে সত্যজিতের গোপণীয় Trade Secret বলে তো কিছু নেই। ফিল্ম করতে ইচ্ছুক এমন কোনো ব্যক্তি তার পরামর্শ চাইলে তিনি প্রার্থীকে বিমুখ করেন না। কোন বই চলচ্চিত্রে রূপায়িত করা সম্ভব, কোনটা নয় অথবা ব্যক্তিবিশেষের পক্ষে কোন গল্পের চলচ্চিত্রে রূপায়ণ সম্ভব, বা কোনটা সম্ভবপর নয়- এই সব বিষয়ে তার কাছে পরামর্শ চাইতে এলে তিনি সরলভাবে তার মতামত প্রকাশ করেছেন এবং তার ফলে সাহায্যপ্রার্থী অসন্তুষ্ট হয়েছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে। চলচ্চিত্র নির্মাণ কার্যে চিত্রনাট্য রচনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তার উপর নির্ভর করেই সমগ্র চিত্রটির রূপায়ণ হয়ে থাকে। উপযুক্ত ব্যক্তি চিত্রনাট্য নিয়ে উপস্থিত হলে সত্যজিৎ উক্ত ব্যক্তিকে যথাসাধ্য সাহায্য করে থাকেন। এর পরেও কি আপনারা বলবেন, সত্যজিৎ রায় পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য কিছুই করেন নি? তবে অপাত্রে দান করলে দানের মর্যাদা থাকে না, দানও হয় বিফল। আশা করি এ-কথাটা পাঠক স্বীকার করবেন।
সাহিত্য, সঙ্গীত চিত্রকলা প্রভৃতি বিষয়ে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেছেন বলেই চলচ্চিত্র রূপায়ণে সত্যজিৎ শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে পারেন। চলচ্চিত্র হচ্ছে এমন একটি মাধ্যম, যেখানে পূর্বে উল্লিখিত বিভিন্ন মাধ্যম একাকার হয়ে গেছে। একটিমাত্র মানুষের পক্ষে শিল্পকলার এতগুলি বিভাগের উপর এতখানি দখল চিন্তা করা যায়? আপনারাই বলুন?
পরিশেষে বলছি, বিভিন্ন আঙ্গিকের উপর অধিকার থাকলেই অসাধারণ কিছু করা যায় না। সার্থক সৃষ্টির জন্য চিত্তের উদার বিস্তৃতি অবশ্য প্রয়োজনীয়। আঙ্গিককে আয়ত্ত করে ক্রাফটসম্যান হওয়া যায়, আর্টিস্ট হওয়া যায় না। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে যাঁদের ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করার সুযোগ হয়েছে, তারা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেন, এমন খোলামেলা মেজাজের উদার চরিত্র মানুষ অতিশয় বিরল।
ব্যক্তিবিশেষ হয়তো ক্ষেত্রবিশেষে অন্য রকম ঘটনার উদাহরণ দিতে পারেন। সে-রকম ক্ষেত্রে আমি বলব, পরিবেশ আর ব্যক্তিবিশেষের ব্যবহার একটি মানুষের চরিত্রের বিপরীত দিকটিকে ফুটিয়ে তুলতে পারে। কিন্তু সেটাই তার আসল চরিত্র নয়। একটি প্রতিভাবান মানুষ তার প্রাপ্য সম্মান সম্পর্কে সচেতন থাকতে পারেন, তাই বলে তাকে দাম্ভিক আখ্যা দেওয়া যায় কি?
এসব কথার পরেও যদি কেউ তর্ক তোলেন, তাহলে হাতজোড় করে বলব– আমার মতামত অভ্রান্ত বলে মেনে নিতে হবে এমন দিব্যি তো দিই নি। নিজে যা বুঝেছি তাই লিখেছি– দেখছেন তো প্রবন্ধের নাম আমার চোখে সত্যজিৎ রায়।
[নবকল্লোল, শ্রাবণ ১৩৮৫]