আমার ঘড়ি

আমার ঘড়ি
My Watch

(একটি শিক্ষামূলক ছোট্ট কাহিনী)

আমার সুন্দর নতুন ঘড়িটা আঠারো মাস ধরে চলছে। এর মধ্যে সময়ের কোন হেরফের হয় নি, কোন যন্ত্রাংশ ভাঙে নি, বা থেমে ও যায় নি। আমার বিশ্বাস জন্মেছে যে সময় রক্ষার ব্যাপারে ঘড়িটি অভ্রান্ত; এ গঠন ও দেহয়ন্ত্র অক্ষয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একদিন রাতে ঘড়িটা হাত থেকে পড়ে গেল। আমি দুঃখ পেলাম; মনে হল, এটা যেন কোন আসন্ন বিপদের অগ্রদূত ও পূর্বাভাষ। যা হোক, মনের সে ভাব কাটিয়ে আন্দাজ মতে ঘড়িটা চালিয়ে দিলাম এবং কু-চিন্তা ও বিপদের আভাষ মন থেকে দূর করে দিলাম। পরদিন একজন বড় ঘড়িওয়ালার দোকানে গেলাম ঘড়িতে সঠিক সময় দেবার জন্য। দোকানের বড়-কর্তা ঘড়িটা আমার হাত থেকে নিয়ে সময় ঠিক করতে লাগল। তারপর বলল, ঘড়িটা চার মিনিট স্লো যাচ্ছে-রেগুলেটারটা একটু তুলে দেওয়া দরকার।

আমি তাকে থামাতে চেষ্টা করলাম-বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে ঘড়িটা সঠিক সময় দিচ্ছিল। কিন্তু না; এই মাথা-মোটা লোকটা তখন শুধু একটা কথাই বুঝেছে যে ঘড়িটা চার মিনিট স্লো যাচ্ছে আর রেগুলেটারটাকে একটু তুলে দিতে হবে। উদ্বিগ্ন চিত্তে আমি অনেক আপত্তি করলাম, ঘড়িটাতে হাত না দিতে বললাম, কিন্তু সেই লজ্জাজনক কাজটাই সে শান্ত চিত্তে নিষ্ঠুরভাবে করে গেল। আমার ঘড়িটা এবার আগে বাড়তে শুরু করল। প্রতিদিনই ফার্স্ট হয়ে চলল। এক সপ্তাহের মধ্যেই ঘড়িটার যেন প্রচণ্ড জ্বর হল, তার নাড়িটা একশো পঞ্চাশে উঠে গেল। দুমাস পরে দেখা গেল, সে শহরের অন্য সব ঘড়িকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেছে; পঞ্জিকার তারিখ থেকে তেরো দিনের বেশী এগিয়ে গেল। অক্টোবরের পাতা থাকতে থাকতেই ঘড়িটা নভেম্বরের বরফ–ঝরা দিনে পা দিল। বাড়ি ভাড়া ও অন্য থাকতে থাকতেই ঘড়িটা নভেম্বরের বরফ–ঝরা দিনে পা দিল। বাড়ি ভাড়া ও অন্য সব দেয় বিল এমন ভয়ঙ্করভাবে সে এগিয়ে দিতে লাগল যে আমি আর পেরে উঠলাম না। সময় ঠিক করবার জন্য ঘড়িটাকে নিয়ে গেলাম একজন ঘড়ি-ওয়ালার কাছে। সে জানতে চাইল ঘড়িটা কখনও মেরামত করিয়েছি কি না। আমি বললাম, না, মেরামতের কখনও দরকার হয় নি। অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে সে ঘড়িটাকে খুলে ফেলল, নিজের চোখে একটা ছোট গোল বাক্স বসাল এবং যন্ত্রটাকে ভালভাবে দেখতে লাগল। সে বলল, ঘড়িটাকে পরিষ্কার করতে হবে, তেল দিতে হবে এবং সময়ও ঠিক করতে হবে-এক সপ্তাহ পরে আসবেন। পরিস্ফূর করে, তেল দিয়ে, সময় ঠিক করিয়ে নেবার পরে আমার ঘড়িটা এত বেশী স্লো হয়ে যেতে লাগল যে তার টিক্ টিক্ শব্দ বড় ঘণ্টা বাজার তালে তালে চলতে লাগল। ফলে আমি পৌঁছবার আগেই ট্রেন ছেড়ে দিতে লাগল, কারও সঙ্গে দেখা করতে হলে সময় মত উপস্থিত হতে পারতাম না, খাবার সময় ঠিকমত হাজির হতে পারতাম না; যেখানে চার দিন হবার কথা সেখানে আমার ঘড়িতে হত তিন দিন। ক্রমে ক্রমে আমি পিছিয়ে পরতে লাগলাম-প্রথমে গতকালে, তারপর তার আগের দিনের, তারপর গত সপ্তাহে একসময়ে আমার মনে হল সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ ও একাকী আমি গত সপ্তাহের আগের সপ্তাহে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আর পৃথিবীটা আমার দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে। আমার মনে হলব সংগ্রহশালার মমির সঙ্গে কোথায় যেন আমার একটা গোপন মিল আছে। আবার একজন ঘড়িওয়ালার কাছে গেলাম। আমার সামনেই ঘড়িটাকে পুরো খুলে ফেলে সে বলল ব্যারালটা একটু ফেঁপে উঠে ছে, তিন দিনের মধ্যেই সে ঠিক করে দিতে পারবে। তারপর থেকে ঘড়িটা মোটামুটি চলতে লাগল, কিন্তু ওই পর্যন্তই। দিনের প্রথম অর্ধেকটা সময় ঘড়িটা এমন দুষ্ট ছেলের মতই ছুটতে লাগল; এমনভাবে খট খট, ঝরঝর, হ্যাঁ হ্যাঁচ, হিহি, শব্দ করতে লাগল যে নিজের সব ভাবনা চিন্তাই মাথায় উঠল; আর সেই সময় সে এত দ্রুত ছুট ত যে এ অঞ্চলের আর কোন ঘড়ি তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারত না। কিন্তু দিনের বাকিটা সময় ঘড়িটা আবার এমন স্লো হতে আরম্ভ করত যার ফলে যে সব ঘড়িকে সে পিছনে ফেলে এসেছিল সেগুলি আবার তাকে ধরে ফেলত। কাজেই শেষ পর্যন্ত চব্বিশ ঘণ্টার পরে সে যথাসময়ে ঠিক জায়গায় এসেই দাঁড়াত। ঘড়িটা একটা মোটামুটি সময় রেখে চলত; কাজেই কেউ বলতে পারত না যে সে তার কর্তব্য বেশী বা কম কিছু করেছে। কিন্তু মোটামুটি সময় রাখা তো একটা ঘড়ির পক্ষে কোন সদ গুণ নয়, কাজেই আমি সেটাকে আর একজন ঘড়ি-ওয়ালার কাছে নিয়ে গেলাম। সে বলল, কিং-বোল্ট টা ভেঙে গেছে। আমি বললাম, তার । চাইতে গুরুতর কিছু যে ঘটে নি সে জন্য আমি খুশি। সত্যিকথা বলতে কি, কিং-বোল্ট, যে কি বস্তু সে ধারণাই আমার ছিল না, কিন্তু একজন অপরিচিত লোকের কাছে আমি নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করলাম না। সে কিং-বোল টা মেরামত করে দিল কিন্তু তাতে ঘড়িটায় একদিকে যতটুকু লাভ হল, অন্যদিকে ততটুকু ক্ষতি হল। ঘড়িটা কিছুক্ষণ চলত, আবার কিছুক্ষণ বন্ধ থাকত। তারপর আবার চলত, আবার বন্ধ হত, এবং এইভাবেই তার মর্জি মত চলতে লাগল। আরও একটা ব্যাপার, ঘড়িটা যখনই চলত তখনই বন্দুকের কুঁদোর মত পিছনে একটা ধাক্কা দিত। কয়েকদিন বুকের উপর একটা প্যাড বেঁধে নিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘড়িটাকে আর একজন ঘড়ি-ওয়ালার কাছে নিয়ে গেলাম। সে ঘড়িটাকে টুকরো টুকরো করে খুলে ফেলল এবং চোখে একটা কঁচ লাগিয়ে সেগুলোকে উল্টে পাল্টে দেখতে লাগল। তারপর সে বলল, মনে হচ্ছে যেন হেয়ার স্প্রিং-এ কিছু গোলমাল হয়েছে। হেয়ার স্প্রিং-টা ঠিক করে সে ঘড়িটাকে নতুন করে দম দিয়ে দিল। এবার ঘড়িটা ভালই চলল, তবে দশটা বাজবার দশ মিনিট আগে কাঁটা দুটো সবসময়ই কঁচির মত একসঙ্গে জুড়ে যেত এবং তখন থেকে দুটো কাটা একসঙ্গে এগিয়ে চলত। কাজেই পৃথিবীর প্রাচীনতম লোকও এই ঘড়ি দেখে সময়ের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারত না। আবার ঘড়িটাকে নিয়ে গেলাম মেরামতের জন্য। এ লোকটি বলল, ক্রিস্টালটা বেঁকে গেছে, আর মেইন স্প্রিং-টাও সোজা নেই; এ ছাড়া আরও কিছু কিছু মেরামত দরকার। সে সবকিছু ঠিকঠাক করে দিল, আর আমার ঘড়িটাও ভালভাবেই চলতে শুরু করল। তবে একটা অসুবিধা দেখা দিল। প্রায় আট ঘণ্টা ঠিকভাবে চলবার পরে ভিতরের সবকিছু কেমন। গোলমাল হয়ে যেত এবং মৌমাছির মত শব্দ করত; তাছাড়া কাটা দুটো এত জোরে অবিরাম ঘুরতে থাকত যে তার কোন হিসাব পাওয়া যেত না-মনে হত ঘড়িটার মুখের উপর একটা মাকড়সা জাল বুনে চলেছে। মাত্র ছয় বা সাত মিনিটের মধ্যে ঘড়িটা চব্বিশ ঘণ্টা পরিক্রমা শেষ করত আর তারপরেই সশব্দে বন্ধহয়ে যেত। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আর একজন ঘড়ি-ওয়ালার কাছে গেলাম। সেও ঘড়িটাকে টুকরো টুকরো করে খুলে পেলল। ব্যাপারটা গুরুতর হয়ে উঠছে; তাই স্থির করলাম তাকে বেশ কড়া করে জেরা করব। ঘড়িটা কিনতে আমার লেগেছিল দুশ ডলার আর যতদূর মনে হয় তার মেরামতের জন্য খরচ করেছি দু-তিন হাজার। বসে বসে লোকটাকে দেখতে হঠাৎ মনে হল এই ঘড়ি-ওয়ালাটি আমার অনেকদিন আগের একজন পরিচিত লোক-তখন সে ছিল একজন স্টিম্-বোট ইঞ্জিনিয়ার; আর তাও ভাল ইঞ্জিনিয়ার নয়। অন্য ঘড়ি-ওয়ালাদের মত সেও সবকিছু সযত্নে পরীক্ষা করল এবং একই রকম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তার রায়টি ঘোষণা করল।

সে বলল, ঘড়িটাতে বড় বেশী বাষ্প জমছে-সেফটি–ভাল্বের উপরে মাক্কি-রেঞ্চ টা ঝোলাতে চাও কি?

সেখানেই মাথায় আঘাত করে তাকে মেরে ফেললাম; নিজের খরচে তাকে কবর দিলাম।

আমার খুড়ো উইলিয়ম (হায়! আজ সে মৃত) বলত, একটা ঘোড়া যতদিন পালিয়ে না যায় ততদিনই সেটা ভাল ঘোড়া, আর একটা ঘড়ি যতদিন মেরামত-ওয়ালাদের হাতে না পুড়ে ততদিনই সেটা ভাল ঘড়ি। আর খুড়ো প্রায়ই জিজ্ঞাসা করত, যে সব কাসারি, বাসনওয়ালা, মুচি, ইঞ্জিনিয়ার ও কামার জীবনে কিছু করতে পারে নি তারা সব যায় কোথায়; কিন্তু কেউ তাকে সে কথা বলতে পারেনি।

[১৮৭০]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *