আমার গোয়েন্দাগিরি
রবিবারে রবিবারে প্রশান্তবাবুর বৈঠকখানায় বসত একটি তাস-দাবা-পাশার আসর৷ দুপুর বেলার খাওয়া-দাওয়ার পর সভ্যরা একে একে সেখানে গিয়ে দেখা দিতেন৷ তারপর খেলা চলত প্রায় বেলা পাঁচটা পর্যন্ত৷
মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে বসতাম আমিও৷ তাস বা পাশার দিকে মোটেই ঘেঁষতাম না, কিন্তু দাবার দিকে আমার ঝোঁক ছিল যথেষ্ট৷ ওখানে জন তিনেক পাকা দাবা খেলোয়াড় আসতেন, তাঁদের সঙ্গে আমি করতাম শক্তি পরীক্ষা৷
বলা বাহুল্য, খেলার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ আলোচনাও চলত৷ বাজারে মাছের দর ও বক্তৃতামঞ্চে চড়ে জহরলাল নেহরুর লম্ফঝম্প, গড়ের মাঠের ফুটবল খেলা ও বিলিতি পার্লামেন্টে মন্ত্রীদের বাক্যবন্দুকনিনাদ, বাংলা রঙ্গালয়ে অভিনেতাদের অভিনয় ও ধর্মালোচনা অর্থাৎ জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত কোনো কিছুই থাকত না আমাদের উত্তপ্ত আলোচনার বাইরে৷
সেদিন তখন খেলা শুরু হয়নি, এমন সময় পুলিশ কোর্টের একটা মামলার কথা উঠল৷ সম্প্রতি একসঙ্গে তিনটে নরহত্যা হয়েছিল এবং ইনস্পেকটর সুন্দরবাবু কেসটা হাতে নিয়ে হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করে আসামিকে আদালতে হাজির করেছেন৷
একজন শুধোলেন, ‘মানিকবাবু, এ মামলাতেও আপনাদের হাত আছে তো? লোকে তো বলে, সুন্দরবাবু সব মামলার পিছনে থাকেন আপনি আর আপনার বন্ধু জয়ন্তবাবু৷’
-‘লোকের এ বিশ্বাস ভ্রান্ত৷ অবশ্য কোনো কোনো মামলায় সুন্দরবাবু আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে আসেন বটে৷ পরে সে সব ক্ষেত্রে জয়ন্তই হয় আসল পরামর্শদাতা, আমি তার সঙ্গে হাজির থাকি মাত্র৷’
হঠাৎ পিছন থেকে প্রশ্ন শুনলাম, ‘জয়ন্তবাবুর সঙ্গে এতদিন থেকে গোয়েন্দাগিরিতে আপনার কিঞ্চিৎ ব্যুৎপত্তি জন্মেছে তো?’
ফিরে দেখি নরেন্দ্রবাবু-সুবিখ্যাত ডাক্তার নরেন্দ্রনাথ সেন৷ বিলেত ফেরত৷ যেমন তাঁর হাতযশ, তেমনি তাঁর পসার৷ তাঁর আয়ের পরিমাণ শুনলে মাথা ঘুরে যায়৷ পাশের বাড়িতে থাকেন৷ মাঝে মাঝে হাঁফ ছাড়বার জন্যে এই আসরে উঁকিঝুঁকি মারতে আসেন৷
নরেনবাবু আবার শুধোলেন, ‘জয়ন্তবাবুর পার্শ্বচর হয়ে গোয়েন্দাগিরিতে আপনারও কিঞ্চিৎ ব্যুৎপত্তি জন্মেছে তো?’
আমি হেসে বললাম, ‘হ্যাঁ নরেনবাবু, জয়ন্তের সঙ্গে আমার তুলনা চলে না বটে; কিন্তু গোয়েন্দাগিরিতে সাধারণ লোকের চেয়ে আমি কিছু বেশি জ্ঞান অর্জন করেছি বই কী৷’
নরেনবাবু একখানা কাষ্ঠাসনের উপর নিজের অঙ্গভার ন্যস্ত করে বললেন, ‘তাহলে ছোট্ট একটি মামলার কথা শুনবেন?’
আমি বললাম, ‘আমার বন্ধু জয়ন্তের মতে গোয়েন্দাগিরিতে ছোটো বা বড়ো মামলা বলে কোনো কথা নেই৷ একমাত্র দ্রষ্টব্য হচ্ছে, মামলাটা চিত্তাকর্ষক কি না? এই দেখুন না, পুলিশ কোর্টের যে মামলাটা নিয়ে আজ গোয়েন্দাগিরির কথা উঠেছে, একদিক দিয়ে সেটা বড়ো যে-সে মামলা নয়৷ একসঙ্গে তিন-তিনটে খুন! কিন্তু অপরাধী ঘটনাক্ষেত্রে এত সূত্র রেখে গিয়েছিল যে ধরা পড়েছে অতি সহজে৷ আসলে একেই বলে ছোটো মামলা৷ কারণ এটা চিত্তাকর্ষক নয়, এর মধ্যে মস্তিষ্কের খেলা নেই৷ আবার এমন সব মামলাও আছে সেখানে অপরাধ হয়তো তুচ্ছ অথচ অপরাধীকে গ্রেপ্তার করবার মতো সূত্র পাওয়া অত্যন্ত কঠিন৷ এমন সব মামলাতে সফল হলেই গোয়েন্দার প্রকৃত কৃতিত্ব প্রকাশ পায়৷’
নরেনবাবু বললেন, ‘আমি যদি এরকম কোনো মামলারই ভার আপনার হাতে দিতে চাই, আপনি গ্রহণ করতে রাজি আছেন কি?’
বললুম, ‘আমার আপত্তি নেই৷’ মনে মনে ভাবলুম, একবার পরীক্ষা করে দেখাই যাক না, জয়ন্তের কোনো সাহায্য না নিয়েই নিজের বুদ্ধির জোরে মামলাটার কিনারা করতে পারি কিনা!
ঘরের অন্যান্য লোকেরা প্রশ্ন করতে লাগলেন, ‘কীসের মামলা ডাক্তারবাবু? খুনের না চুরির, না আর কিছুর?’
নরেনবাবু বললেন, ‘এখন আমি কোনো কথাই ভাঙব না, আসুন মানিকবাবু আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে চলুন৷’
দুই
নরেনবাবুর বাড়ি৷ একখানা মাঝারি আকারের ঘর৷ একদিকে দেওয়াল ঘেঁষে একখানা গদিমোড়া বড়ো চেয়ার, তার সামনে একটি টেবিল৷ টেবিলের উপরে দোয়াতদানে লাল ও কালো কালির দোয়াত, কলমদানে দু-টি কলম, ব্লটিংয়ের প্যাড-তার উপরে খানিকটা অংশ কালিমাখা, একটি টেলিফোনযন্ত্র৷ টেবিলের তিন পাশে খানকয়েক কাঠের চেয়ার৷ ঘরের দেওয়ালে একখানা অ্যালম্যানাক ছাড়া আর কোনো ছবি নেই৷ মেঝে মার্বেল পাথরের৷ কোনোরকম বাহুল্য বর্জিত পরিচ্ছন্ন ঘর৷
এই সব লক্ষ করছি, নরেনবাবু বললেন, ‘এই ঘরে বসে প্রত্যহ সকালে আর সন্ধ্যায় আমি রোগীদের সঙ্গে দেখা করি৷ পরশু সন্ধ্যায় এখানেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেছে৷’
-‘কীরকম ঘটনা?’
-‘মোহনতোষবাবুর এক বন্ধুর নাম বিনোদবাবু৷ বিনোদলাল চ্যাটার্জি৷ ভদ্রলোক কন্যাদায়ে পড়েছিলেন৷ মোহনতোষবাবুর বিশেষ অনুরোধে তাঁকে আমি পাঁচ হাজার টাকা ধার দিয়েছিলাম৷’
-‘মোহনতোষবাবু কে?’
-‘তিনি আমার প্রতিবেশীও বটে, রোগীও বটে৷ কিন্তু তাঁর একটা বড়ো পরিচয় আছে৷ আপনি কি শৌখিন নাট্যসম্প্রদায়ের বিখ্যাত অভিনেতা মোহনতোষ চৌধুরির নাম শোনেননি?’
-‘কারুর কারুর মুখে শুনেছি বটে৷’
-‘তাঁর কথাই বলছি৷’
-‘তারপর?’
-‘পরশু সন্ধ্যার সময় আমি এই ঘরে বসে আছি, এমন সময়ে বিনোদবাবু এসে তাঁর ঋণ পরিশোধ করে গেলেন৷ পাঁচখানি হাজার টাকার নোট৷ ঠিক তারই মিনিট পাঁচেক পরে ফোনে একটা অত্যন্ত জরুরি ডাক এল৷ বসন্তপুরের মহারাজাবাহাদুর ব্লাডপ্রেসারের দরুন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন, আমাকে সেই মুহূর্তেই যেতে হবে৷ তখনি যাত্রা করলুম৷ তাড়াতাড়ি যাবার সময়ে নোট পাঁচখানা ব্লটিংয়ের প্যাডের তলায় ঢুকিয়ে রেখে গেলুম৷ রাজবাড়ি থেকে যখন ফিরে এলুম রাত তখন সাড়ে নয়টা৷ এসে এই ঘরে ঢুকে দেখি, প্যাডের উপর লাল কালির দোয়াতটা উলটে পড়ে রয়েছে আর প্যাডের তলা থেকে অদৃশ্য হয়েছে হাজার টাকার নোট পাঁচখানা৷’
আমি বললুম, ‘নিশ্চয় চোর প্যাডের তলা থেকে যখন নোটগুলি টেনে নিচ্ছিল, সেই সময়ে দৈবগতিকে তার হাত লেগে লাল কালির দোয়াতটা উলটে পড়ে গিয়েছিল৷’
-‘খুব সম্ভব তাই৷’
-‘কারুর উপরে আপনার সন্দেহ হয়?’
-‘বিশেষ কারুর উপরে নয়৷’
-‘পুলিশকে খবর দিয়েছেন?’
-‘না৷’
-‘কেন?’
-‘কেলেঙ্কারির ভয়ে৷ আমি বেশ জানি পুলিশ এসে আমার বাড়ির লোকদেরই টানাটানি করবে৷ আমার পক্ষে সেটা অসহনীয়৷ কারণ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাড়ির কোনো লোকের দ্বারা ওই কাজ হয়নি-হতে পারে না৷ অন্দরমহলে থাকেন আমার বৃদ্ধ মাতা, পত্নী, আমার দুই বালিকা কন্যা আর শিশুপুত্র৷ তাদের কারুরই এ ঘরে আসবার কথা নয়৷ বাড়ির প্রত্যেক দাসদাসী পুরাতন আর বিশ্বস্ত৷ নোটগুলো যখন প্যাডের তলায় রাখি, তখন তাদের কেউ যে এ অঞ্চলে ছিল না, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত৷ সুতরাং তাদের কেউ প্যাড তুলে দেখতে যাবে কেন?’
-‘বাইরের কোনো জায়গা থেকে কেউ কি আপনার কার্যকলাপের উপরে দৃষ্টি রাখতে পারে না?’
-‘মানিকবাবু, পরশুদিন সন্ধ্যার আগেই এই দুর্দান্ত শীতেও হঠাৎ বেশ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল, মনে আছে কি? দেখুন এই ঘরের উত্তর দিকে আছে চারটে জানলা, আর পূর্ব দিকে আছে দুটো জানলা আর দুটো দরজা৷ দক্ষিণ আর পশ্চিম দিক একবারে বন্ধ৷ রাস্তায় দাঁড়িয়ে উত্তরের জানলাগুলোর ভিতর দিয়ে এই ঘরটা দেখা যায় বটে, কিন্তু বৃষ্টির ছাঁট আসছিল বলে উত্তর দিকের সব জানালাই বন্ধ ছিল৷ খোলা ছিল খালি পূর্ব দিকের জানালা দরজা৷ ওদিকে আছে আমার বাড়ির উঠান, তারপর বারো ফুট উঁচু পাঁচিল, তারপর মোহনতোষবাবুর বাড়ি৷ আমার বাড়ির উঠানে আলো জ্বলছিল, আমি সেখানে জনপ্রাণীকেও দেখতে পাইনি৷ বৃষ্টি আর শীতের জন্যে মোহনতোষবাবুর বাড়ির জানালাগুলো নিশ্চয়ই বন্ধ ছিল, নইলে ও বাড়ির ঘরের আলোগুলো আমার চোখে পড়ত৷ সেদিন আমি কী করছি না করছি, কেউ তা দেখতে পায়নি৷’
-‘আপনি রাজবাড়িতে যাওয়ার পর সেদিন অন্য কোনো রোগীর বাড়ি থেকে আর কেউ কি আপনাকে ডাকতে আসেনি?’
-‘এসেছিল বই কী! হরিচরণের মুখে শুনেছি, পাঁচ জন এসেছিল৷’
-‘হরিচরণ কে?’
-‘সে বালক বয়স থেকেই এ বাড়িতে কাজ করে, এমন বিশ্বাসী আর সৎ লোক আমি জীবনে আর দেখিনি৷ আমার সমস্ত আলমারি দেরাজ, বাক্সের চাবি থাকে তার হাতে, আমার সমস্ত টাকা সেই-ই ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে আসে, তাকে নইলে আমার চলে না৷ আমার অবর্তমানে সে-ই বাইরের লোকের সঙ্গে কথাবার্তা কয়৷’
-‘হরিচরণ কী বলে?’
-‘সেদিন পাঁচ জন লোক আমাকে ডাকতে এসেছিল৷ তাদের মধ্যে তিন জন লোক আমি নেই শুনেই চলে যায়, এক জন লোক ঠিকানা রেখে আমাকে কল দিয়ে যায়, কেবল এক জন লোক বলে, আমার জন্যে অপেক্ষা করবে৷ হরিচরণ তখন তাকে এই ঘরে এনে বসিয়ে নিজের অন্য কাজে চলে যায়৷ কিন্তু মিনিট দশেক পরে ফিরে এসে লোকটিকে সে আর দেখতে পায়নি৷ তবে এজন্যে তার মনে কোনো সন্দেহ হয়নি৷ কারণ এখানে কোনো মূল্যবান জিনিসই থাকে না, আর বাইরের লোকের আনাগোনার জন্য এ ঘরটা সর্বদাই পড়ে থাকে৷ হরিচরণের বিশ্বাস, আমার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে লোকটি আর অপেক্ষা না করে চলে গিয়েছিল৷’
-‘সে নাম-ধাম কিছু রেখে যায়নি?’
-‘না৷’
-‘তার চেহারার বর্ণনা পেয়েছেন?’
-‘পেয়েছি৷ তার দোহারা চেহারা, শ্যাম বর্ণ, দেহ দীর্ঘ৷ শীতের জন্যে সে মাথা থেকে প্রায় সমস্ত দেহটাই আলোয়ান জড়িয়ে রেখেছিল, দেখা যাচ্ছিল কেবল তার মুখখানা৷ তার চোখে ছিল কালো চশমা, মুখে ছিল কাঁচা-পাকা গোঁফ আর ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি৷ বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশের কম হবে না৷’
-‘লোকটির চেহারার বর্ণনা কিছু অসাধারণ৷ আপনার কি তারই উপরে সন্দেহ হয়?’
-‘মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এও মনে হয় যে, কোনো একজন বাইরের লোক আমার ঘরে এসে হঠাৎ টেবিলের প্যাড তুলে দেখতে যাবে কেন? এরকম কৌতূহল অস্বাভাবিক নয় কি?’
আমি নিরুত্তর হয়ে চিন্তা করতে লাগলুম৷ জয়ন্ত বলে, কোনো নতুন মামলা হাতে পেলে গোয়েন্দার প্রধান আর প্রথম কর্তব্য হচ্ছে, সকলকেই সন্দেহ করা৷ কিন্তু খানিকক্ষণ ভাবনাচিন্তার পর আমার সন্দেহ ঘনিভূত হয়ে উঠল, দুই জন লোকের উপরে৷ কে ওই আলোয়ান মুড়ি দেওয়া, কালো চশমাপরা ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িওয়ালা, রহস্যময় আগন্তুক? নরেনবাবুর প্রস্থানের পরেই ঘটনাক্ষেত্রে তার আবির্ভাব এবং কেমন করেই বা জানতে পারলে প্যাডের তলায় আছে পাঁচ হাজার টাকার নোট? তার মূর্তি, তার প্রবেশ ও প্রস্থান, তার কার্যকলাপ সমস্তই এমন অদ্ভুত যে, যুক্তি প্রয়োগ করেও কিছু ধরবার বা বোঝবার উপায় নেই৷
শেষটা আমি সাব্যস্ত করলুম এতটা যুক্তিহীনতা কিছুতেই সম্ভবপর নয়৷ ওই মুর্তির কোনো অস্তিত্ব নেই, ও হচ্ছে কাল্পনিক মূর্তি ঘটনাক্ষেত্রে তাকে টেনে আনা হয়েছে, অন্য কোনো ব্যক্তির স্বার্থের অনুরোধে৷
সেই অন্য ব্যক্তি কে? নিশ্চয়ই হরিচরণ৷ তার সাধুতা আর বিশ্বস্ততা সম্বন্ধে নরেনবাবুর কোনো সন্দেহ নেই৷ কিন্তু তার সার্টিফিকেট মূল্যহীন৷ সাধুতার আবরণে সর্বদাই নিজেদের ঢেকে রাখে বলেই অসাধুরা আমাদের চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ করতে পারে৷ আবার মানুষের মন এমন আশ্চর্য বস্তু যে, সত্যিকার সাধুও সময়ে সময়ে হঠাৎ অসাধু হয়ে ওঠে৷ হ্যাঁ, হরিচরণ, ওই হরিচরণ৷ কালো চশমাপরা মূর্তিটার সৃষ্টি হয়েছে তারই উর্বর মস্তিষ্কের মধ্যে৷ নিজে নিরাপদ হবে বলে হরিচরণই ওই রহস্যময় কাল্পনিক মূর্তিটাকে টেনে এনেছে ঘটনাক্ষেত্রে৷
অতএব হরিচরণকে ডেকে এনে খানিক নাড়াচাড়া করলেই পাওয়া যাবে মামলার মূল সূত্র৷
তিন
ঠিক এই সময়েই ঘরের বাইরে থেকে ডাক শুনলাম, ‘মানিক, অ-মানিক! তুমি এখানে আছ নাকি?’
এ জয়ন্তের কন্ঠস্বর! তাড়াতাড়ি উঠে ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দেখি, উঠানের রোয়াকের উপরে হাস্যমুখেই দাঁড়িয়ে আছে জয়ন্ত৷
-‘ব্যাপার কী? তুমি কেত্থেকে?’
-‘তোমাদের রবিবাসরীয় আড্ডায় গিয়েছিলাম তোমাকে অন্বেষণ করতে৷ কিন্তু সেখানে গিয়ে খবর পেলাম তোমাদের আজকের আসর এইখানে৷’
নরেনবাবুর সঙ্গে জয়ন্তের পরিচয় করিয়ে দিলাম৷ তিনি তাঁকে সাদরে ঘরের ভিতরে নিয়ে এলেন৷
জয়ন্ত শুধোলে, ‘ডাক্তারবাবু আপনি হঠাৎ আমার মানিক অপহরণ করছেন কেন?’
-‘আজ্ঞে, মানিকবাবুর হাতে আমি মামলার ভার অর্পণ করেছি৷’
-‘বটে, বটে, বটে৷ মানিকও তাহলে আজকাল স্বাধীনভাবে গোয়েন্দার ভূমিকা গ্রহণ করতে চায়৷ বেশ, বেশ, উন্নতিই হচ্ছে, প্রকৃতির নিয়ম৷’
আমি একটু লজ্জিতভাবে বললাম, ‘না ভাই জয়ন্ত, আমি তোমার উপযুক্ত শিষ্য হতে পেরেছি কি না, সেইটেই আমি আজ পরীক্ষা করতে এসেছি৷’
-‘দেখেছেন ডাক্তারবাবু, বন্ধুবর মানিকের বিনয়েরও অভাব নেই৷ এ হচ্ছে আসল গুণীর লক্ষণ৷ তারপর মানিক, মামলাটার মধ্যে তুমি প্রবেশ করতে পেরেছ তো?’
-‘মনে হচ্ছে পেরেছি৷ মামলাটার কথা তুমি শুনতে চাও?’
-‘আপত্তি নেই৷’
তারপর দুই চক্ষু মুদে জয়ন্ত আমার মুখে মামলার আদ্যপান্ত শ্রবণ করল৷ সেই কালো চশমাধারী মূর্তি ও হরিচরণ সম্বন্ধে আমার মতামতও তাকে চুপিচুপি জানিয়ে রাখতে ভুললুম না৷
জয়ন্ত চোখ খুলে উঠে দাঁড়াল, তারপর টেবিলের সামনে গিয়ে ডাক্তারবাবুর নিজস্ব চেয়ারের উপর বসে পড়ল৷ তারপর পূর্ব দিকের জানালা দিয়ে বাইরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল নিস্পলক নেত্রে৷ তারপর মুখ নামিয়ে টেবিলের প্যাডের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে৷ তারপর মৃদু হেসে চুপ করে বসে রইল প্রায় সাত-আট মিনিট ধরে৷ তার মুখ সম্পূর্ণ ভাবহীন; কিন্তু আমি বুঝতে পারলুম, তার মন এখন অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছে৷
হঠাৎ সে জিজ্ঞাসা করলে, ‘ডাক্তারবাবু, ঘটনার দিন যখন আপনি বাইরে যান তখন এই টেবিলের প্যাডের উপরে আর কোনো কাগজপত্র ছিল?’
-‘না৷’
-‘তাহলে যা ভেবেছি তাই৷ মানিক, তোমার বিশ্বাস চোর যখন প্যাডের তলা থেকে নোটগুলো টেনে নিচ্ছিল, সেই সময়েই লাল কালির দোয়াতটা দৈবগতিকে উলটে গিয়েছিল?’
-‘হ্যাঁ৷’
-‘তোমার বিশ্বাস ভুল৷’
-‘কী করে জানলে?’
-‘উলটে দেখো প্যাডের উপরে ছড়ানো লাল কালির মাঝখানে রয়েছে একটা চতুষ্কোণ (কিন্তু সমচতুষ্কোণ নয়) সাদা জায়গা৷ এ জায়গাটায় কালি লাগেনি কেন?’
-‘ওখানে বোধ হয় কোনো কাগজপত্র ছিল! কালির ধারা তার উপর দিয়েই বয়ে গিয়েছে৷’
-‘এতক্ষণে তোমার বুদ্ধি কিঞ্চিৎ খুলেছে দেখে সুখী হলুম৷’
নরেনবাবু বলে উঠলেন, ‘না মশাই, সেদিন ওই প্যাডের উপরে নিশ্চয়ই কোনো কাগজপত্র ছিল না৷’
জয়ন্ত সায় দিয়ে বলল, ‘আপনিও ঠিক কথা বলেছেন ডাক্তারবাবু৷ তবু এই সাদা অংশটার সৃষ্টি হল, কেন শুনুন৷ চোর টেবিলের উপর ঝুকে পড়ে প্রথমে প্যাডের তলা থেকে নোটগুলো বার করে নেয়৷ তারপর সেগুলো প্যাডের উপরেই রেখে গুনে দেখে৷ ঠিক সেই সময়েই তার গায়ের আলোয়ান বা অন্য কিছু লেগে লাল কালির দোয়াতটা উলটে যায়৷
আমি চমৎকৃত হয়ে বললুম, ‘তা হলে লাল কালি পড়েছিল সেই নোটগুলোর উপর?’
জয়ন্ত আমার কথার জবাব না দিয়ে বললে, ‘ডাক্তারবাবু, নোটগুলোর নম্বর নিশ্চয়ই আপনার কাছে নেই?’
-‘না মশাই, নম্বর টুকে নেবার সময় পাইনি৷ তবে বিনোদবাবুর কাছে খবর নিলে নম্বরগুলো পাওয়া যেতে পারে৷’
জয়ন্ত উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘আজকে এখনি খবর দিন৷ নম্বরগুলো পেলেই আমার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবেন৷ এখন আমি বিদায় নিলুম, হয় কাল সন্ধ্যার সময়ে নয় দুই-এক দিন পরেই আপনার সঙ্গে আবার দেখা করব-এটা চিত্তাকর্ষক হলেও সহজ মামলা৷ চলো মানিক৷ নমস্কার ডাক্তারবাবু৷’
রাস্তায় এসে জয়ন্তকে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘কে চোর সে বিষয়ে তুমি কিছু আন্দাজ করতে পেরেছ?’
জয়ন্ত ক্রুদ্ধস্বরে বললে, ‘আমি এইটুকুই আন্দাজ করতে পেরেছি যে, তুমি হচ্ছ একটি গাড়ল, গর্দভ, ইগ্নোরেমাস৷’
আমি একেবারে দমে গেলুম৷
চার
সোমবারের সন্ধ্যা৷ জয়ন্তের পিছনে গুটিগুটি যাত্রা করলুম নরেনবাবুর বাড়ির দিকে৷ দেখেছি কাল বৈকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত এবং আজ সকাল থেকে বৈকাল পর্যন্ত সে বাড়ির বাইরেই কাটিয়ে দিয়েছে৷ তার কার্যকলাপ সম্বন্ধে একটি ছোটোখাটো ইঙ্গিত পর্যন্ত আমাকে দেয়নি৷ আজও তার মুখ এমন গম্ভীর যে, কোনো কথা জিজ্ঞাসা করতেও ভরসা হল না৷
নরেনবাবু বসেছিলেন আমাদের অপেক্ষায়৷ সাগ্রহে শুধোলেন, ‘কিছু খবরাখবর পেলেন নাকি!’
পকেট থেকে একখানা খাম বার করে জয়ন্ত বললে, ‘এই নিন৷’
খামের ভিতর থেকে বেরুল পাঁচখানা নোট-প্রত্যেকখানা হাজার টাকার৷
জয়ন্ত বললে, ‘দেখছেন ডাক্তারবাবু, সব নোটের উপরেই কিছু-না-কিছু লাল কালির দাগ আছে৷ একখানা নোটে একদিকের প্রায় সবটাই লাল কালিমাখা, -এখানা ছিল সব উপরে৷’
বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে নরেনবাবু প্রায় আধ মিনিট নীরবে বসে রইলেন৷ তারপর বললেন, ‘নোটগুলোর উপরে লাল কালির দাগ এতটা ফিকে কেন?’
-‘চোর জল দিয়ে ধুয়ে ফেলবার চেষ্টা করেছিল৷’
-‘কিন্তু চোর কে?’
জয়ন্ত বললে, ‘ক্ষমা করবেন, চোরের কাছে আমি প্রতিজ্ঞা করেছি তার নাম প্রকাশ করব না৷ কেবল এতটুকু জেনে রাখুন, সে আপনার বাড়ির লোক নয়৷ ভবিষ্যতে সৎ পথে থাকবার জন্যে আমি তাকে সুযোগ দিতে চাই, কারণ এটা হচ্ছে তার প্রথম অপরাধ৷ আজ আমরা আসি, নমস্কার৷’
পাঁচ
বাইরে এসে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘ভাই জয়ন্ত, আমার কাছেও কি তুমি চোরের নাম প্রকাশ করবে না?’
জয়ন্ত হেসে বললে, ‘নিশ্চয়ই করব৷ চোরের নাম মোহনতোষ চৌধুরী৷’
সবিস্ময়ে বললুম, ‘তাকে তুমি কেমন করে সন্দেহ করলে?’
-‘কেবল পূর্ব দিকের দরজা-জানালা দিয়েই সেদিন নরেনবাবুর ঘরের ভিতরটা দেখবার সুযোগ ছিল৷ আর নরেনবাবুর চেয়ারে বসে পূর্ব দিকে তাকিয়ে আমি দেখতে পেলুম কেবল মোহনতোষের বাড়ির দোতলার ঘর৷ এই হল আমার প্রথম সন্দেহ৷ তারপর সেই কালো চশমাপরা ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িওয়ালা লোকটার কথা ভাবতে লাগলুম৷ সে শীতের ওজরে আবার মাথা থেকে প্রায় সর্বাঙ্গে আলোয়ান মুড়ি দিয়ে এসেছিল৷ কালো চশমা, সর্বাঙ্গে আবরণ-এসব যেন আত্মগোপনের চেষ্টা, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িও সন্দেহজনক! লোকটা হয়তো ছদ্মবেশের সাহায্য নিয়েছিল! কেন? পাছে হরিচরণ তাকে চিনে ফেলে, সে নিশ্চয়ই পরিচিত ব্যক্তি৷ তার আকস্মিক প্রস্থানও কম সন্দেহজনক নয়৷ আগেই শুনেছি, মোহনতোষ একজন অভিনেতা, তার ছদ্মবেশ ধারণের উপকরণ আছে৷ এই হল আমার দ্বিতীয় সন্দেহ৷ তার বন্ধু বিনোদ যে ঘটনার দিনেই সন্ধ্যা বেলায় নরেনবাবুর টাকা শোধ দিতে যাবে, এটাও নিশ্চয়ই সে জানতে পেরেছিল৷ আমার তৃতীয় সন্দেহ৷ তারপর আমি এখানে-ওখানে ঘুরে যেসব তথ্য সংগ্রহ করলুম তা হচ্ছে এই: মোহনতোষ বিবাহ করেনি, বাড়িতে একাই থাকে৷ বাড়ির একতলা সে ভাড়া দিয়েছে৷ তার আরও একখানা ভাড়াবাড়ি আছে৷ এই সব থেকে তার মাসিক আয় প্রায় সাড়ে তিন-শো টাকা৷ ওই আয়ে তার মতো একা লোকের দিন অনায়াসে চলে যেতে পারে, কিন্তু তার চলত না৷ কারণ সে ছিল বিষম জুয়াড়ি৷ বাজারে তার কয়েক হাজার টাকা ঋণ হয়েছিল৷ সে বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকেও টাকা ধার করতে ছাড়েনি৷ এই ঋণ কতক শোধ করতে না পারলে শীঘ্রই তাঁকে আদালতে আসামি হয়ে দাঁড়াতে হত৷
‘মানিক, সব কথা আর সবিস্তারে বলবার দরকার নেই৷ ইনস্পেকটর সুন্দরবাবুকে সঙ্গে নিয়ে আজ আমি মোহনতোষের সঙ্গে দেখা করেছিলুম৷ এই তার প্রথম অপরাধ৷ আমাকে দেখেই ভয়ে তার মুখ শুকিয়ে গেল৷ তারপর আমি কীভাবে কার্যসিদ্ধি করেছি তার একটা প্রায় সঠিক বর্ণনা দিলুম আর জানালুম যে নোটের নম্বর আমরা পেয়েছি, এখন এই কালিমাখা নোটগুলো ভাঙাতে গেলেই বিপদ অনিবার্য, তখন সে একেবারেই ভেঙে পড়ল৷
‘তার নিজের মুখেই শুনলুম, কোনোরকম চুরি করবার ইচ্ছাই তার ছিল না, জীবনে কখনো চুরিচামারি করেওনি৷ ঘটনার দিন সন্ধ্যার সময়ে তার অত্যন্ত মাথা ধরেছিল, ঘরের আলো নিবিয়ে সে বিছানায় আশ্রয় নিয়েছিল৷ সেখান থেকেই সে দেখতে পায় তার বন্ধু বিনোদ এসে নোটগুলো দিয়ে গেল নরেনবাবুকে আর তিনিও হঠাৎ ফোনে ডাক পেয়ে সেগুলো প্যাডের তলায় গুঁজে রেখে তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন৷ সঙ্গেসঙ্গে তার মাথায় গজিয়ে উঠল সস্তায় কিস্তিমাত করবার দুর্বুদ্ধি৷ কিন্তু মানিক, এটাই তার প্রথম অপরাধ বলে আমরা ক্ষমা করেছি৷’
-‘আর সেইসঙ্গে তুমি ব্যর্থ করে দিলে আমার প্রথম গোয়েন্দাগিরি৷’ দুঃখিতভাবে আমি বললুম৷