আমার এখন সময় নেই – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
খবরটা পেলাম রাত ন’টায়। দরজা খুলেই সুজাতা বলল, শুনেছ কী হয়েছে? —কী? —তুমি জানো না! অনুতোষদা মারা গেছে। কফিহাউস থেকে ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি ফিরেছি, কথাটা প্রথমে আমার মাথাতেই ঢুকল না, কে মারা গেছে? —অনুতোষদা! আমাদের অনুতোষদা!
অনুতোষ মারা গেছে! যাহ্, তা কী করে হয়! দিব্যি পঁয়তাল্লিশের টগবগে মানুষ, জোয়ানই বলা যায়, অসুখবিসুখেরও কোনও খবর শুনিনি, সে হঠাৎ মারা যাবে কেন! মৃত্যু কি এতই সুলভ!
সুজাতা বলল, একটু আগে দীপিকাদির ফোন এসেছিল। নামখানাতে নদীতে ডুবে গিয়ে…
সুজাতার গলা বুজে এল। আমিও ধপ করে সোফায় বসে পড়েছি। এতক্ষণ কফিহাউসে ছিলাম, কেউ তো কিছু বলল না ওখানে! নাকি ওখানেও কেউ খবর পায়নি! আমারই মতো!
ঘনিষ্ঠ কারুর মৃত্যুসংবাদ শুনলে আমার বুক ধড়ফড় করে, পা কাঁপতে থাকে, হাতের জোর কমে যায়, তালু শুকিয়ে আসে অজানা ভয়ে। এখন সে রকমটাই হচ্ছে! তার মানে অনুতোষ আমার ঘনিষ্ঠজন ছিল!
দু-এক মিনিট রুদ্ধবাক আমি কোনও ক্রমে প্রশ্ন করলাম, কবে? কখন?
সুজাতা পাশে বসে আমার কাঁধে হাত রাখল। তারও স্বর কাঁপছে, আজই সকালে। বকখালি যাবে বলে হাতানিয়া দোয়ানিয়া পার হচ্ছিল, হঠাৎ নৌকো থেকে পড়ে…
—কীভাবে পড়ল! ওখানে তো নৌকো-ফৌকো উল্টোয় না! এতটুকু সরু নদী!
—আমিও তো সে কথাই ভাবছি। একটা জলজ্যান্ত মানুষ হঠাৎ কেন জলে পড়ে যাবে!
—আত্মহত্যা করল!না অ্যাক্সিডেন্ট! সঙ্গে কে ছিল?
—আমি অত ডিটেলে জিজ্ঞেস করতে পারিনি। তুমি দীপিকাদিকে একটা ফোন করো না।
—দীপিকা ফোনে আমার কথা কিছু বলল?
—না তো! কী বলবে?
—আমার কালকের প্রাইজ পাওয়া নিয়ে কিছু…? বলেই কোঁত করে গিলে ফেলেছি কথাটা। এ কথা কেন মুখ থেকে বেরিয়ে এল? এমন অসময়ে?
বিভাবতী স্মৃতি পুরস্কার কমিটি এ বছরের শ্রেষ্ঠ গল্পকার হিসেবে আমার নাম ঘোষণা করেছে। গত সোমবার। তারপর থেকে অজস্র অভিনন্দন পেয়ে চলেছি। ঘরে। বাইরে। রাস্তায়। অফিসে। বাড়িতেও মাঝে মাঝেই ফোন বেজে উঠছে। এই তো আজই কফিহাউসে ছোটখাটো একটা সম্বর্ধনা পেলাম। তরুণতর প্রজন্মের লেখকদের কাছ থেকে। সমসাময়িক লেখকরা ঈর্ষা গোপন করে আমার প্রশংসা করছে। কষ্ট লুকিয়ে বন্ধুবান্ধবরাও। সুবীর। বিমান। নির্মল। দীপাঞ্জন।
ব্যতিক্রম শুধু দু’জন। অনুতোষ। আর দীপিকা।
মৃত মানুষের ওপর অভিমান সাজে না। কিন্তু দীপিকা?
দীপিকা একটু দেরিতে লেখা শুরু করেছে। এখন মাঝে মাঝেই নানান পত্রপত্রিকায় তার গল্প-উপন্যাস বেরোয়। আমার মতো না হলেও লেখার জগতে নামও হয়েছে অল্পস্বল্প। যদিও লেখা খুব একটা আহামরি নয়। মেয়েদের মধ্যে মোটামুটি। কানাদের মাঝে ঝাপসা। তা ছাড়া মেয়ে হওয়ার আলাদা সুবিধেটাও তো আছে। ভ্রূকুটির ধনুর্বাণ আছে। চপল হাসির পাশুপত অস্ত্র আছে। একটু আহ্লাদি আহ্লাদি স্বরে কথা বললে গল্প না ছেপে উপায় আছে সম্পাদকের! আরে বাবা, এটা তো অবধারিত সত্য মেয়েদের মধ্যে কোনও গভীর ভাববোধ নেই! দৃষ্টিভঙ্গিও সংসারের পানাডোবার বাইরে বেরোয় না। মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি কি মেয়েদের দিয়ে হয়? তবু ওই এলেবেলেরও কী ডাঁট! অহঙ্কারে মাটিতে পা পড়ে না!
এই সব আকাশপাতাল দ্বিধায় ইতস্তত আমি, সুজাতা আবার বলল, কী হল? ফোন করো।
—কী হবে ফোন করে? দীপিকা কি অনুতোষের সঙ্গে ছিল? অনুতোষকে স্বচক্ষে জলে পড়ে যেতে দেখেছে?
আমার কথার ভঙ্গিতে সামান্য রুক্ষতা ছিল। সুজাতা ম্লান মুখে বলল, দীপিকাদি খবরটা দিয়ে তোমাকেই খুঁজছিল। দ্যাখো না যদি আরও ডিটেলস-এ জানা যায়।
—ডিটেলস আবার কী? মৃত্যুর আবার ডিটেলস হয় নাকি?
সুজাতা হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমার গলায় এতক্ষণে একটা কষ্ট চাক বাঁধছিল। পুটপুট করে পিন ফুটছিল শরীরে। বেশ খানিকক্ষণ পর ঢোক গিলে বললাম, আমার ভাল্লাগছে না সুজাতা। একটা লোক… সকালেও বেঁচে ছিল… আরও কত কাল বেঁচে থাকার কথা… অথচ এখন বেঁচে নেই! আমি কিছু ভাবতে পারছি না।
পাশের ঘর থেকে টুকাইয়ের গলা ভেসে আসছে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ইতিহাস মুখস্থ করছে টুকাই। ইউরোপের ইতিহাস। ক্রুসেড! শার্লমেন! সিংহহৃদয় রিচার্ড! জোরে না পড়লে কোনও কিছুই টুকাইয়ের মাথায় ঢোকে না। আজ টুকাইয়ের ভাঙা স্বর বড় কানে বাজছে। সুজাতাকে বললাম, টুকাইকে একটু আস্তে পড়তে বলতে পারো না? আজকাল ওই ভাবে গাঁক গাঁক করে পড়ে কেউ!
সুজাতা এখনও দেখছে আমাকে, তুমি তা হলে ফোন করবে না? তোমার একটুও জানতে ইচ্ছে করছে না অনুতোষদার কথা?
করছে। ভীষণ ভাবে করছে। কিন্তু দীপিকাকে আমি ফোন করব না। গত সাত দিনে সে আমাকে একটি বারও অভিনন্দন জানানোর সৌজন্য দেখায়নি, আমি কেন তাকে ফোন করতে যাব!
জানলার পাশে গিয়ে সিগারেট ধরালাম। ও পারে পুষ্পহীন কৃষ্ণচূড়া গাছ ধোঁয়াশা মেখে দাঁড়িয়ে। একা। আমাকে দেখছে।
সুজাতা নিচু স্বরে বলল, শুনেছি সাত পা একসঙ্গে হাঁটলে নাকি বন্ধুত্ব হয়। তুমি অনুতোষদার সঙ্গে কুড়ি বছর ধরে একসঙ্গে হাঁটছিলে।
সারা জীবন একসঙ্গে হেঁটেও কি সত্যিকারের বন্ধু পাওয়া যায়! মানুষ তো আজীবন একাই। তা ছাড়া সৃষ্টিশীল শিল্পীদের বন্ধু থাকেও না। থাকে বড়জোর জোট। অথবা শুভার্থী। সময়ের সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে তাদেরও নাম গন্ধ বর্ণ বদলে যায় বারবার। প্রয়োজন অনুসারে। স্বার্থের তাগিদে। সেই সুবাদে অনুতোষও কবেই দূরের মানুষ। তবু আজ একটা খবর নেওয়া উচিত। বিমানকে ফোন করলে কেমন হয়! আমাদের মধ্যে বিমানের সঙ্গেই যা শেষ পর্যন্ত যোগাযোগ ছিল অনুতোষের।
বিমান নয়, বিমানের বউ ফোন ধরেছে। উত্তেজিত গলায় বলল, ইশশ্, কী হয়ে গেল বলুন তো! ও তো ভীষণ ভেঙে পড়েছে। একটু আগে অনুতোষদার বাড়ি থেকে ফিরল। ফিরেই ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। ডাকব?
—ডাকো।
বিমানের গলা ধরা-ধরা, তুই কার কাছে খবর পেলি?
—দীপিকা ফোন করেছিল এখানে। ব্যাপারটা ঠিক কী হয়েছিল বল তো?
—কী আর হবে। নিয়তি।
—নৌকো থেকে পড়লটা কী করে? নেশা-টেশা করেছিল নাকি?
—নাহ্, সেরকম তো কিছু শুনলাম না। কেউ বলছে নৌকোর ধারে বসেছিল, হঠাৎ উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পা স্লিপ করে…। কেউ বলছে ইচ্ছে করে…। কিছু দিন ধরে খুব ডিপ্রেশানেও ভুগছিল তো।
—সঙ্গে কেউ ছিল না? ইদানীং শুভেন্দু বলে কে এক নতুন বন্ধু হয়েছে শুনেছিলাম?
—না না, সে-ও ওর সঙ্গে বেরোত না। ও একাই ছিল। একা-একাই হুটহাট বেরিয়ে যেত। কে ওর বোহেমিয়ানিজমের সঙ্গে পাল্লা দেবে বল?
—হুঁ। একটু সময় নিয়ে বললাম, বাড়ির অবস্থা কী দেখলি?
—রিমা একেবারে পাথর হয়ে গেছে। ছেলেটা প্রাণপণে স্টেডি থাকার চেষ্টা করছে, কিন্তু কী করে পারবে বল? মাত্র তো সতেরো বছর বয়স। আমাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে চোখের জল আর সামলাতে পারে না…
—অনুতোষকে নিয়ে এসেছে?
—না। বড় শালা আনতে গেছে। ওখানকার হসপিটালে ফোন করা হয়েছিল। পোস্টমর্টেম করে বডি আনতে আনতে কাল সকাল দশটা এগারোটা হয়ে যাবে। বিমান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। —কী যে কাণ্ডটা করে বসল অনুতোষ! তুই কাল সকালে আসছিস তো? ওর বাড়িতে? সুবীর, দীপাঞ্জনরা অবশ্য স্ট্রেট শ্মশানে চলে যাবে বলেছে। অফিস ঘুরে।
কে যেন আমার স্নায়ুতন্ত্রী ঝেঁকে দিয়ে গেল। দম চেপে বললাম, কী করি বল তো? কাল সকালেই আমার আবার বর্ধমান যাওয়ার কথা…
বিমান একটু চুপ মেরে গেল। তারপর বলল, ও। তোর সেই প্রাইজের ব্যাপারটা আছে, না?
—হুঁ। সক্কালবেলায়ই বেরিয়ে পড়ব ভেবেছিলাম…
—তুই তা হলে আসছিস না?
—ইচ্ছে তো করছে। ওদিকে প্রাইজ না নিতে যাওয়াটাও খুব বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে না? আমারই জন্য অনুষ্ঠান? দেখি যদি সময় পাই সকালে একবার ঘুরে যাব।
ফোন ছেড়ে দিয়ে মনে মনে বললাম, কী করে যাব আমি? আমার এখন সময় নেই। আমার এখন সময় নেই।
খাওয়াদাওয়া সেরে খাতা-কলম নিয়ে বসেছি আমি। কালকের সভার জন্য একটা সুন্দর ভাষণ তৈরি করতে হবে। একরাশ লোকের সামনে দাঁড়িয়ে কী লিখি, কেন লিখি, কীভাবে লিখি, এ সব বিশ্লেষণ করা কি মুখের কথা? আগে থেকে খসড়া করে নিলে অনেক সুবিধে হয়, ঘাবড়ে গিয়ে গুলিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে না। তার ওপর কাল ওখানে দু’জন মন্ত্রী আসবেন। ভারতীয় সাহিত্য পরিষদের দু’-একজন প্রতিনিধিও থাকবেন। তাঁদের সামনে বক্তৃতা দিতে উঠব আমি। প্রস্তুত হয়ে যাওয়াটাই তো ভাল।
বহুক্ষণ ঘষে ঘষেও খুব বেশি এগোনো গেল না। শুরুটা কিছুতেই মনঃপূত হচ্ছে না। একটা-দুটো লাইন কলমের ডগায় এসেও পিছলে পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে কাগজ থেকে। প্রথম ছাপানো কবিতাটা দিয়ে শুরু করব? পাথরে কোঁদা বুক/ দাও হে কুঠারে শান/…সে নয় শুরুটা হল, তারপর?
সুজাতা মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়েছে, পাশবালিশ সরিয়ে রেখে হঠাৎই উঠে বসল বিছানায়। ফ্যাসফেসে গলায় বলল —অনুতোষদা তোমায় খুব ভালবাসত।
যে দু-চার লাইন মাথায় আসছিল, তাও হুশ করে বেরিয়ে গেল জানলা দিয়ে। অনুতোষ যে আমাকে ভালবাসত, তা কি আমি জানি না? আমার চেয়ে সে কথা আর কে বেশি জানে!
‘জল’ পত্রিকায় প্রথম আমার একটা গল্প পড়েছিল অনুতোষ। কয়লাখনির গল্প। তখন আমি সদ্য আসানসোল থেকে কলকাতায় বদলি হয়ে এসেছি। ওখানকার কুলিকামিনরা তখনও আমার রক্তে মিশে আছে। গল্পটা মূলত ছিল তাদের নিয়েই। গল্পটা পড়ে মুগ্ধ অনুতোষ পত্রিকা অফিস থেকে আমার ঠিকানা জোগাড় করে ফেলল। খুঁজে খুঁজে সাতসকালে আমার বাড়ি এসে উপস্থিত। বেহালা থেকে চেতলায়। আলাপের আধ ঘণ্টার মধ্যে আপনি থেকে তুমি। দু’ঘণ্টার ভেতর তুই। অনুতোষ তখন নিজেও একটা কাগজ বার করছে। শুভম্। খুবই ছোট পত্রিকা। বহু দিন ধরে পত্রিকাটা চালিয়েছিল অনুতোষ। শুধুই গল্পের পত্রিকা। আমাকে সেখানে একটা বড় গল্প লিখতে বলল। পুজোসংখ্যার জন্য। আমার তখন কলমের হাল সদ্য দাঁত-ওঠা শিশুর মতো। অবিরাম শুলোচ্ছে। বুকের ভেতর যত কথা জমে আছে, সবই তখন অক্ষরের স্রোত হয়ে ধেয়ে আসতে চায়। স্মৃতি থেকে স্বপ্ন, বেদনা থেকে আসক্তি, জন্মমুহূর্ত থেকে পঁচিশ বছর বয়স, সব।
মন প্রাণ ঢেলে অনুতোষের কাগজে গল্প লিখেছিলাম। একটি নৈঃশব্দ্যের অপমৃত্যু। গল্পটা লিখে নাম হয়েছিল কি না জানি না, তবে তুফান যে একটা উঠেছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তুফানটা তুলেছিল অনুতোষ স্বয়ং। কফিহাউসের আড্ডায়। বইমেলায়। গল্পপাঠের আসরে। বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের দপ্তর থেকে শুরু করে নামি দামি লেখকদের বাড়ি গিয়ে গিয়ে আমার গল্পের বিজ্ঞাপন করত অনুতোষ। কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় একটা ছেলে আমার লেখার সমালোচনা করেছিল বলে তার নাকে ঘুষি মেরে হইহই ফেলে দিয়েছিল চারদিকে।
অথচ অনুতোষ তখন নিজেও লিখছে। একটা গল্পের কালেকশান বার হয়েছে। দুটো উপন্যাস। উদীয়মান তরুণ সাহিত্যিকদের মধ্যে সে-ও তখন প্রথম সারিতে। নিজের খ্যাতির জন্য না ভেবে অন্যের স্তুতির জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তে একমাত্র অনুতোষই পারত। কেউ একটু ভাল লিখলেই তার জন্য পাগল হয়ে ওঠা ছিল অনুতোষের স্বভাব।
সেই অনুতোষ আজ ডুবে গেছে হাতানিয়া দোয়ানিয়ায়।
যে নেই, সে নেই। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোথাও নেই।
আমি আছি। আমি থাকব। আমাকে কাল যেতেই হবে বর্ধমানে। সুজাতার দিকে ফিরে তাকালাম, শোনো, আমি কিন্তু কাল সাতটার মধ্যে বেরিয়ে যাব।
—অনুতোষদার বাড়ি যাবে? আমিও যাব। এই সময়ে আমাদেরই তো রিমার পাশে গিয়ে দাঁড়ানো উচিত।
বিরস মুখে বললাম, আমি যাচ্ছি না। আমার বর্ধমান যাওয়া আছে। পারলে তুমি ঘুরে এসো।
—তুমি অত সকালে বর্ধমানে গিয়ে কী করবে?
—দশটার সময় ওদের লোক আমার জন্য স্টেশনে ওয়েট করবে।
—অনুষ্ঠান তো তোমার দুটোয়। সকালে একবার ঘুরে যেতে অসুবিধে কী?
—বলছি না সকলে অপেক্ষা করবে। আমাকে নিয়ে ব্যাপার, আমি যদি টাইমলি না পৌঁছই…
—তুমি তাহলে কাল অনুতোষদার ওখানে যাবেই না?
—পরে যাব।
—পরে কেন? একবার শেষ দেখাও করবে না?
এ তো মহা গেরো হল! কী করে সুজাতাকে বোঝাই, আমাকে কাল একটু আগে যেতেই হবে। মন্ত্রী, ভাষা পরিষদের লোকজনদের সঙ্গে হোটেলে লাঞ্চ আছে। যে কোনও পরিচয়ই খাবার টেবিলে সব থেকে বেশি গাঢ় হয়। মূল্যবান সম্পর্ক গড়ে তোলার এমন স্বর্ণসুযোগ হাতছাড়া করে কেউ!
আবেগ আমারও আছে। অনুতোষের জন্য আমারও কম মন খারাপ হচ্ছে না। তবে সুজাতার মতো বেহিসেবি আবেগ আমার সাজে না। অন্তত যৌবনের এই প্রান্তসীমায় এসে। তার চেয়ে বরং নিক্তিতে মেপে গল্প-উপন্যাসে আবেগ ছড়িয়ে দেব, পড়তে পড়তে থম মেরে যাবে পাঠকের বুক। ছেলেমানুষি জোলো সেন্টিমেন্ট কি আমাকে মানায়? অনুতোষের মতো?
অনুতোষের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল মহাবোধি সোসাইটি হলে। মাস পাঁচেক আগে। এক তরুণ কবির মৃত্যুতে শোকসভা হচ্ছিল, একদম শেষ বেঞ্চে বসেছিল অনুতোষ। আমাকে দেখে উঠে এল, হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল বাইরে, চল, একটু কলেজ স্কোয়ারের বেঞ্চিতে গিয়ে বসি। এখানে আমার কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে।
গ্রীষ্মের সন্ধ্যা। গোলদিঘি থেকে জোলো বাতাস উঠছিল। পাশাপাশি বসে রইলাম দু’জনে। বহুক্ষণ।
অনুতোষই প্রথম বরফ ভাঙল, ছেলেটার কী প্রতিভা ছিল, অথচ দ্যাখ কেমন দুম করে মরে গেল! এত তাড়াতাড়ি কী করে যে মরে মানুষ!
আমি কপালে আঙুল ঠেকালাম, ভাগ্য। আমাদের কার যে কখন কোথায় মৃত্যু হবে!
অনুতোষ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, তুই ভাগ্য মানিস?
—এমনিতে মানি না। আমি হেসে ফেললাম, চাকরির প্রোমোশনের সময়ে মানি। বই বিক্রির সময় মানি। ছোটবেলাতেও মানতাম। পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর আগে।
—যাক, এখনও তা হলে সত্যিটা স্বীকার করার সৎসাহস তোর আছে!
—তুই কী বলতে চাইছিস?
অনুতোষ বিষণ্ণ চোখে তাকাল, দীপেন, তুই অনেক বদলে গেছিস রে। আগে তো নিজের ওপর কনফিডেন্স এত কম ছিল না। তোর লেখা শেষ হয়ে আসছে দিন দিন। কথায় কাজে কন্ট্রাডিকশান থাকলে ভাল লেখা বেরোয় না রে।
আমার রাগ হয়ে গেল। সিগারেট ধরিয়ে তাচ্ছিল্যের স্বরে বললাম, ফুরোচ্ছিস তুই। আমি না। এ বছরও আমি তিনটে উপন্যাস লিখছি। গোটা কুড়ি ছোট গল্প।
অনুতোষ তড়াং করে উঠে দাঁড়াল, নাম্বার রিপ্রেজেন্টস নাথিং। তুই যা বিশ্বাস করিস না, তাই লিখিস। ইউ আর এ বিগ জিরো।
অনুতোষ এখন শুয়ে আছে লাশকাটা ঘরে।
আমি পাচ্ছি এ বছরের শ্রেষ্ঠ তরুণ গল্পকারের পুরস্কার।
ওই মূর্খের জন্য সময় নষ্ট করব আমি?
জানলার পর্দা ছিঁড়ে ভাষণের লাইন ক’টা আবার ঢুকে পড়ছে ঘরে। টেবিল ল্যাম্পের চার দিকে ঘুরপাক খেল কিছুক্ষণ। তারপর ডানা মেলে কাগজে বসল। সঙ্গে কিছু দৃশ্যকল্পও নিয়ে এসেছে তারা। আমার প্রথম জীবনের সাহিত্যের অনুপ্রেরণা।
কয়লাখনির খাদানে বেলচা মারছে মজুর। ঘামে কালিতে তাদেরই শরীর কখন কালো মানিক। হঠাৎ কোনও অজ্ঞাত ফাটল দিয়ে জল ঢুকতে শুরু করল খনিতে। একে একে ডুবে গেল সার সার শ্রমিকের দেহ। ফ্রক পরা বালিকা শবদেহের ঢাকা সরিয়ে নিজের বাবার শরীর খুঁজছে। জলের নীচে বাবা তখন পরিপূর্ণ অঙ্গার।
আমি কাতর গলায় সুজাতাকে বললাম, তুমি তো জানো সুজাতা, আমি একদম ডেডবডি স্ট্যান্ড করতে পারি না? কেন আমাকে বার বার জোর করছ?
সুজাতা তবু অবুঝ, ভাল করে ভেবে দ্যাখো কেন জোর করছি।
কী করে ভাবব! শব্দরা এসে গেছে! শব্দরা এসে গেছে!
আমি ফিসফিস করে বললাম, চুপ থাকো। এখন আমার সময় নেই।
—বন্যার ওপর লেখা আপনার উপন্যাসটা এখনও আমার হাড় কাঁপিয়ে দেয়।
মন্ত্রীবাক্যে আমার রোমে রোমে হর্ষ জাগছিল। এত কাজের মাঝেও আমার মতো একজন লেখকের লেখা ইনি পড়েছেন!
—খরা বা অনাহারের ওপর আপনার তো তেমন লেখা দেখি না! এ সব নিয়েও তো আপনাদের লেখা উচিত। এই যে কালাহাণ্ডিতে এত বড় একটা অনাবৃষ্টি চলছে..
—না মানে… আমি ঘাড় চুলকোলাম, —ওদিকে তো বড় একটা যাইনি। স্বচক্ষে না দেখলে আমি আবার ঠিক লিখতে পারি না।
—দেখে আসুন। ঘুরে আসুন। কে বলেছে আপনাকে না দেখে লিখতে! অন্ধ্র ওড়িশার দিকে কিছু কালচারাল ডেলিগেট পাঠাচ্ছি, যাবেন আপনি? সঙ্গে ট্যুরিং স্পটগুলোও দেখে আসতে পারেন। আমি নীরব থাকি। নীরব থাকাটাই এ মুহূর্তের দস্তুর। শব্দহীনতাই শ্রেষ্ঠ সম্মতি।
স্থানীয় এক অডিটোরিয়ামে বেশ বড়সড় সভার আয়োজন করেছেন উদ্যোক্তারা। আমার পুরস্কারটিও ভারী মনোরম। সপ্তাশ্ববাহিত রথে ছুটছেন সূর্যদেব। ব্রোঞ্জের মূর্তি। বেশ পাকা হাতের কাজ। সঙ্গে একটা শাল। ফুল। আর দশ হাজার টাকার চেক।
সভা ভাঙার পর স্থানীয় পত্রিকার কয়েকটা ছেলে আমার সাক্ষাৎকার নিতে এল। তারা শুধুই আমার স্টেজের ভাষণে তৃপ্ত নয়, নতুন করে তাদের আবার আমার লেখার উদ্দেশ্য বোঝাতে হবে।
ছেলেগুলোর প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে আমি যখন প্রায় বিধ্বস্ত, এক ছোকরা ঝপ করে জিজ্ঞাসা করে বসল, আপনি তো লেখক অনুতোষ দত্তকে খুব কাছ থেকে চিনতেন, তাই না?
এ প্রশ্ন যে কখনও না কখনও উঠবেই আমি জানতাম। আজই সমস্ত বাংলা দৈনিকে অনুতোষের মৃত্যুসংবাদ বার হয়েছে। গহীন জলে ডুবে গেলেন উদীয়মান সাহিত্যিক! অনুতোষ দত্তর অপমৃত্যু! নদীতে তলিয়ে গেলেন সত্তর দশকের গল্পকার!
মুখ থেকে হাসি মুছে নিলাম, কে না তাকে চিনত ভাই! সে তো শুধুই গল্পকার ছিল না, সে ছিল আমার এক সময়ের সুহৃদ। আমরা একসঙ্গে গল্পের কাগজ করেছি। গল্প নিয়ে কত হইচই করেছি। জীবনমুখী গল্পের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলেছি।
—কিন্তু আমরা তো গত পাঁচ-সাত বছর ধরে অনুতোষবাবুর সেরকম লেখা পাইনি? উনি কি লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন?
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারলাম না। প্রশ্নটা আমাকেও ধাক্কা মেরেছে অনেক বার। অনুতোষটা বড় এলোমেলো ছিল। সেটাই কি কারণ? আজ ক্যানিং ছুটছে, কাল বসিরহাট, পরশু মালদা, পরদিন কেঁদুলি। প্রবাদ ছিল অনুতোষকে নাকি একসঙ্গে একই সময়ে দক্ষিণেশ্বর, বেহালা আর সন্দেশখালিতে দেখা যায়। যে মানুষ এক মুহূর্ত নিজেকে স্থিত করতে পারে না, যার চিন্তায় কোনও গৃহস্থালি নেই, সে কী করে সাজিয়ে-গুছিয়ে গল্প লিখবে? শুধুই এক বুক ভাব নিয়ে কি লিখে ওঠা যায়? আশ্চর্য! এই নিয়ে অনুতোষের কোনও দুঃখবোধ ছিল না। কিংবা হয়তো ছিল। কোনও কিছু ঠিক মনোমত লিখতে পারছিল না বলেই ছটফট করত দিন-রাত। উন্মত্তের মতো দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াত! লেখার উপকরণ খুঁজতে গিয়ে লেখাটাকেই হারিয়ে ফেলেছিল অনুতোষ।
আমি যুবকের দিকে তাকালাম, হয়তো অনুতোষ পারছিল না। লেখকরা অনেক সময়ই ভেতর থেকে ফুরিয়ে যায়। এক তরুণ কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন ছুঁড়ল, এই যে স্যাড দুর্ঘটনাটা, অনুতোষবাবুর হঠাৎ নৌকো থেকে পড়ে মারা যাওয়া, এর সঙ্গে কি ওঁর হতাশার কোনও যোগ আছে বলে মনে হয়?
এত কচকচি আমার ভাল লাগছে না। অনুতোষ যখন জলে পড়ে যায়, তখন তার মনের অবস্থা কী ছিল আমি কী করে বলব? তাকে নিয়ে এত প্রশ্নের জবাবই বা কেন আমি দেব?
হঠাৎ আমার নাকে যেন ঘুষি মারল কেউ। আমি অনুতোষকে নিয়ে ভাবব না ঠিকই, কিন্তু অনুতোষ আমাদের জন্য ভাবত একসময়। আমাদের অনেকের জন্যই ভাবত। এই যে দীপিকা আজ দীপিকা হয়েছে, তার মূলেও তো অনুতোষ। কারণ ছাড়াই কী নাচানাচিটাই না করত দীপিকার লেখা নিয়ে! সেই দীপিকা গত মাসে কফিহাউসে বসে অবলীলায় নিন্দা করে গেল অনুতোষের। অনুতোষ আর আগের মতো বন্ধুবৎসল নেই! অনুতোষ অন্য সকলের লেখা নিয়ে এখন ভীষণ জেলাস! অনুতোষ এখন যাচ্ছেতাই!
আর একটা ঘুষি পড়ল নাকে। শুধু দীপিকা কেন, যার লেখা যখন ভাল লেগেছে, তার জন্য জীবন পাত করেনি অনুতোষ? নামি পত্রিকা থেকে নিজের গল্প তুলে নিয়ে অন্যের গল্প সম্পাদকের হাতে তুলে দেওয়াকে কী বলে?
শুধু লিখতে না পারার হতাশা? না সঙ্গীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা? কোনটা বেশি পীড়িত করেছিল অনুতোষকে?
দূর, সঙ্গীরা কী করবে? আমি কী করব? অনুতোষের টালমাটাল চলার সঙ্গে যদি পা মেলাতে না পারি, সে দোষ কি আমার? তা ছাড়া অনুতোষ এখন ফুরিয়ে যাওয়া শক্তি। তার পত্রিকাটাও উঠে গেছে। কেউ আর তাকে পাত্তা দেয় না। কীসের জন্য বন্ধুরা তাকে আঁকড়ে থাকবে? হৃদয় ছাড়া আর কী ছিল তার? সে নিজেই এক মূর্তিমান ব্যর্থতা।
আমি কথা ঘুরিয়ে বললাম, হতাশা সব লেখকের মনেই থাকে। কোনও না কোনও ভাবে। হেমিংওয়ে তো লিখতে না পারার দুঃখে রিভলভার দিয়ে সুইসাইড করেছিলেন।
পাঁচটা বেজে গেছে। হেমন্তের দুপুর নির্জীব হয়ে আসছে ক্রমশ। উপহার কিটসব্যাগে গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, চলি ভাই।
যুবকদের মুখে অতৃপ্তির ছাপ ফুটে উঠেছে, আরও কয়েকটা প্রশ্ন ছিল যে! আচ্ছা, আপনি যখন লেখেন, তখন কি গল্পের পূর্ণ চেহারাটা আপনার চোখের সামনে ভেসে থাকে?
এ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে লাভ নেই। উত্তর দিলেই নতুন প্রশ্ন আসবে। আসবেই। এই বয়সে শুধুই প্রশ্ন জমা হতে থাকে বুকে। সার সার। বর্ষাঋতুর আগে পিঁপড়েদের মতো।
সামনের ছেলেটির কাঁধ চাপড়ে দিলাম, আবার আসব আমি। তখন যত খুশি প্রশ্ন কোরো। এখন আমার একদম সময় নেই।
রাতের শরীর মাড়িয়ে ফাঁকা বাস সাঁইসাঁই ছুটছিল। বর্ধমান থেকে লোকাল ধরে হাওড়া স্টেশন, স্টেশন থেকে বাস, এবার আমার ফেরার পালা। পুজোয় বেরোনো উপন্যাসটা নিয়ে আজ রাত থেকেই সব ভাবছি। পুজোসংখ্যার জন্য তাড়াহুড়ো করে লেখাতে অনেক ফাঁকফোকর থেকে গেছে, বইমেলায় বই হয়ে বেরোবার আগে ভাল মতো ঘষামাজা দরকার। মাঝের দিকের চ্যাপ্টারগুলো বাড়াতে হবে, প্রকাশকরা বলে উপন্যাসটা একটু মোটার দিকে থাকলে কাটতিটা ভাল হয়।
হাজরা মোড় পার হয়ে বাসটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। ড্রাইভার কন্ডাক্টররা মিলে চেষ্টা করল খানিকক্ষণ, কয়েকবার গরগর করল বাস, হেঁচকি তুলল, তারপর পুরোপুরি নিথর।
গোটা পনেরো যাত্রী রয়েছে বাসে, সকলের মুখেই গৃহে ফেরার উদ্বেগ। হেমন্তের শিরশিরে বাতাসে কম্ফর্টার জড়ানো এক প্রৌঢ় কন্ডাক্টরদের উদ্দেশে হাঁক মারল, কী হে, পুরোপুরি দেহ রাখল নাকি?
কন্ডাক্টর হেল্পারের কাছ থেকে বিড়ি নিয়ে ধরাল, —বোধহয় সেলফ ফেঁসে গেছে। কী বলো পার্টনার?
ড্রাইভার গম্ভীর মুখে বলল, হ্যাঁ, ঠেলতে হবে।
চার মহিলা ছাড়া বাকিরা বাস থেকে নেমে পড়েছে। সকলের দেখাদেখি আমিও হাত লাগিয়েছি। হেঁইও মারি জোয়ারদারি! হেঁইও মারি জোয়ারদারি। একটু গড়িয়ে এবার একটা জোর হিক্কা তুলল বাস, তারপরেই পুরোপুরি মৃত।
অন্য যাত্রীরা ভাড়া ফেরত নিয়ে কন্ডাক্টারের সঙ্গে বচসা জুড়েছে, ছোট্ট ভিড় জমেছে রাস্তায়। মেহনতি জনগণের কাছ থেকে পয়সা উদ্ধার করা তাদের নিয়ে গল্প লেখার থেকে অনেক বেশি কঠিন। আমি আর দাঁড়ালাম না। বাড়ি পৌঁছতে মাইলখানেকও বাকি নেই, রাত হয়েছে হোক, এটুকু রাস্তা হেঁটেই মেরে দেব আজ।
চেতলা ব্রিজের কাছে এসে একটা সিগারেট ধরালাম। দুপুরের খাওয়া বেশ হেভি হয়ে গেছে, এখনও মাংসের ঢেকুর উঠছে। সপ্তাশ্ববাহিত সূর্য আমার কাঁধে। মূর্তিটা তেমন ভারী নয়, তবু ঘাম হচ্ছে অল্প অল্প। ক্লান্তিতে। শারীরিক অস্বস্তিতে।
একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলী ধেয়ে এল হঠাৎ। শ্মশানের দিক থেকে। মাংস হাড় আর চর্বি পোড়ার ধোঁয়া।
আমি নিথর। অনুতোষ তো এই শ্মশানেই এসেছিল আজ! কখন এসেছিল? কীসে পোড়ানো হল অনুতোষকে? ইলেকট্রিক চুল্লিতে? কাঠে? নাকি অনুতোষ লাশকাটা ঘর থেকে এখনও এসে পৌঁছতে পারেনি এখানে? কিংবা হয়তো এই এসে পৌঁছল সবে? আচমকাই ধোঁয়ামাখা বাতাস ফিসফিস করে উঠেছে, আয় দীপেন, তোর জন্যই অপেক্ষা করছি রে। তোরা না এলে আমি যাই কেমন করে?
আমার গা ছমছম করে উঠল। আমার কান্না পেয়ে গেল। মাংসপোড়া গন্ধ আষ্টেপৃষ্টে জাপটে ধরেছে আমাকে। দুপুরের মাংসের ঢেকুর জ্বালিয়ে দিল বুক।
কটু বাতাস আবার টানছে, আয় দীপেন। আয় দীপেন।
হেমন্তের কুয়াশায় আমার স্বর ডুবে গেল, আমাকে ছেড়ে দে অনুতোষ। আমার হাতে এখন অনেক কাজ। আমার এখন সময় নেই রে।
০৭. ০৫. ১৯৯৫
লেখক পরিচিতি
সুচিত্রা ভট্টাচার্য: ১০ জানুয়ারি ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ভাগলপুরে জন্ম। পেশায় সরকারি অফিসার। বহু জনপ্রিয় ছোটগল্প ও উপন্যাসের স্রষ্টা। প্রসিদ্ধ গ্রন্থের তালিকায় আছে কাছের মানুষ, কাচের দেওয়াল, ভাঙনকাল, গভীর অসুখ, ময়নাতদন্ত, বুকের ব্যথা, দহন, পরবাস ইত্যাদি।