আমার একটি পাপের কাহিনি

আমার একটি পাপের কাহিনি

মেয়েটির সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল একটা পার্টিতে। তখন আমি থাকতাম অ্যারিজোনায়। মন-টন খুব খারাপ—অনেকদিন বাড়ি থেকে চিঠি পাই না। বন্ধু-বান্ধবও বিশেষ নেই। আমার মনমরা অবস্থা দেখে আমাদের ডিপার্টমেন্টের এক অধ্যাপক রিচার্ডসন আমাকে জোর করে একটা পার্টিতে ধরে নিয়ে গেলেন। সেখানেও ভালো লাগছিল না। চুপচাপ একা বসেছিলাম।

পার্টি চললো রাত দুটো পর্যন্ত, তারপর আস্তে আস্তে বাড়ি ফেরার পালা। প্রায় পঞ্চাশজন নারী-পুরুষ উপস্থিত, প্রায় প্রত্যেকের সঙ্গেই একবার না একবার কথা বলা হয়ে গেছে। অনবরত ভদ্রতার হাসি হাসতে হাসতে চোয়াল ব্যথা হবার অবস্থা। মেয়েরা-ছেলেরা টুইস্ট নেচে-নেচে এখন ক্লান্ত, গ্লাসের পর গ্লাস শুধু বরফ মেশানো হুইসকি খেয়ে আমার মাথাটা ভারী ভারী লাগছে—এবার বাড়ি ফেরার পালা।

আমার গাড়ি নেই, সেখান থেকে আট মাইল দূরে আমার অ্যাপার্টমেন্ট—অত রাত্রে ফেরার অন্য কোনো উপায় নেই। অপেক্ষা করে আছি—অধ্যাপক রিচার্ডসন কখন উঠবেন—তাঁর সঙ্গে একসঙ্গে ফিরবো। রিচার্ডসনের বয়েস ষাটের কম নয়, কিন্তু ছেলে-ছোকরার মতন তিনিও স্যুট-টাই পরা ছেড়েছেন—প্যান্টের ওপর শুধু উলের গেঞ্জি—ছেলে-ছোকরাদের চেয়েও বেশি উৎসাহে হাসছেন, হাসাচ্ছেন—মাঝখানে একবার দু-চক্কর নেচেও নিলেন। উৎসাহ তাঁর কিছুতেই ফুরোয় না।

হাতের গ্লাস খালি, আর এক গ্লাস খাব কিনা মনস্থির করতে পারছি না, বেশি নেশায় যদি লটকে পড়ি—তাহলে এই বিদেশ-বিভুঁয়ে বদনাম হয়ে যাবে—এই সময় রিচার্ডসন এসে বললেন, ফিল লাইক গোয়িং হোম?

তক্ষুনি মনস্থির করে আমি তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বললুম ইয়েস। চলো, এবার বাড়ি যাওয়া যাক। ঘুমের কথা বললুম না, বললুম, কাল সকালে উঠেই একটা পেপার তৈরি করতে হবে। যেন কত লক্ষ্মী ছেলে আমি, পড়াশুনোয় কী মন আমার। অধ্যাপক হেসে আমার কাঁধ চাপড়ালেন।

রিচার্ডসনের থান্ডারবার্ড গাড়ি সদ্য স্টার্ট নিয়েছে, হঠাৎ তিনি বললেন, ওঃ হো—মণিকাকেও তো পৌঁছে দেবো বলেছিলাম! তুমি যাও তো সরকার, মণিকাকে ডেকে আনো।

মণিকা? পার্টিতে তো একটাও বাঙালি মেয়ে দেখিনি। অবাক হয়ে বললুম, কে মণিকা? চিনি না তো?

অধ্যাপক বললেন, এখনো মণিকাকে চেনোনি? তুমি একটা বুদ্ধুরাম। এই পার্টিতে সেই তো সবচেয়ে মিষ্টি মেয়ে। দাঁড়াও, আমি ডেকে আনছি।

অধ্যাপক যাকে ধরে আনলেন, সে মোটেই বাঙালি মেয়ে নয়, ছিপছিপে তরুণী মেম এবং মিষ্টিই-বা কোথায়—হিংস্র বনবিড়ালীর মতন রিচার্ডসনের বাহু-বন্ধনে ছটফট করছে—কিছুতেই সে আসবে না। তখন রিচার্ডসন বললেন, না, এবার বাড়ি চলো, বড্ড নেশা হয়ে গেছে তোমার।

বুঝতে পারলুম, মেয়েটি ইটালিয়ান। কয়েকদিন আগেই একটা ইটালিয়ান সিনেমা দেখেছিলাম, আন্তোনিয়ানি’র ‘রাত্রি’—সেই বইতে উপনায়িকা ছিল মোণিকা ভিট্টি নামে একটি মেয়ে। অনেক ইটালিয়ান মেয়ের নামই বাঙালি-বাঙালি শোনায়।

রিচার্ডসন জোর করে মেয়েটিকে গাড়ির মধ্যে বসালেন। বললেন—সরকার, এই হচ্ছে মোণিকা, আর মোণিকা, মিট সুনীল।

মেয়েটি দায়সারা ভাবে আমার দিকে ভালো করে না চেয়েই বলল, ‘হ্যালো—’ তারপর সেই ছেড়ে-আসা পার্টির দিকে সতৃষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল!

গাড়ি এসে দাঁড়াল আমার অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর সামনে। আমি নামবার আগেই মণিকা সেখানে হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়ল। অধ্যাপক হাত নাড়িয়ে বাই বাই বলে হুস করে গাড়ি ছেড়ে দিলেন।

নির্জন রাস্তায় আমরা দুজন দাঁড়িয়ে। মেয়েটি কাছাকাছি কোথাও থাকে বোধ হয়। ভদ্রতা করে আমি বিদায় নেবার জন্য বললুম, গুড নাইট! মেয়েটিও বলল, গুন্নাইট। আমি বাড়ির দিকে পা বাড়ালুম। মেয়েটিও সেদিকে এল। তারপর একই বাড়ির প্রবেশপথে এসে দুজনে আবার মুখোমুখি দাঁড়ালুম। আমার ধারণা হল, মেয়েটা অতিরিক্ত মাতাল হয়ে সব কিছু ভুলে গেছে নিশ্চয়ই! আজ ঝামেলা বাধাবে দেখছি! মণিকা ভুরু কুঁচকে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি আমার সঙ্গে আসছো কেন? লিভ মি অ্যালোন!

আমার রাগ হল। আমি বললুম, মাই ডিয়ার ইয়াং লেডি, আমি এই বাড়িতেই থাকি—তুমিই আমার পিছন পিছন আসছো!

মণিকা এবার হাসল! বলল, ইজ ইট সো? তারপর হাত ব্যাগ থেকে একটা চাবি বার করে বলল, এই দ্যাখো, আমার ঘরের চাবি, নাম্বার এইট্রি থ্রি! তোমার কত?

আমার ঘরের নম্বর তিয়াত্তর। ন-তলা বাড়িতে অন্তত নম্বই জন ভাড়াটে—সকলকে চেনা সম্ভব নয়। তা ছাড়া আমি এসেছি মাত্র একমাস। আমি বললুম, আমার নম্বর তিয়াত্তর—তার মানে তোমার ঠিক নীচের ঘরটাই আমার। আমি যে প্রায়ই ওপরে ধুপধাপ আওয়াজ শুনি, এখন বুঝলুম, সেটা তোমারই মধুর পায়ের ধবনি।

মণিকা এবার খিলখিল করে হেসে বলল, হ্যাঁ, আমি নাচ প্র্যাকটিস করি।

তারপর হঠাৎ যেন খেয়াল হল, জিজ্ঞেস করল, এই, তুমি কোন দেশের লোক? ইজিপ্ট?

আমি মুচকি হেসে বললুম, না।

তবে? জাপান?

ওঃ, পৃথিবী এবং তার মানুষজন সম্পর্কে কী জ্ঞান ওর! মজা দেখার জন্য আমি সেবারও বললুম, না।

বুঝতে পেরেছি, তুমি টার্কিশ।

উঁহু।

তবে, তবে আফ্রিকান?

না! এবারও হল না।

এই, বলছো না কেন? তুমি কে?

আমি একজন ইন্ডিয়ান।

ইন্ডিয়ান শুনে ও একটু সচকিত হয়ে তাকাল। একটু সন্দেহ আর অবিশ্বাস ওর মুখে খেলা করে গেল। বুঝতে পারছি, ও আমাকে আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান ভাবছে। ফের জিজ্ঞেস করল, রিয়েলি? ইউ আর অ্যান ইন্ডিয়ান?

হ্যাঁ, খাঁটি ইন্ডিয়ান।

এবার মণিকার চোখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, বুঝতে পেরেছি, ইউ আর অ্যান ইন্ডিয়ান ফ্রম ইন্ডিয়া—

আমি প্রাচীন নাইটদের কুর্নিশের ভঙ্গিতে দুহাত ছড়িয়ে কোমর বেঁকিয়ে বললুম, সি, সিনোরিটা!

হাউ ওয়ান্ডারফুল ইট ইজ টু মিট আ রিয়াল ইন্ডিয়ান—

গ্র্যাৎসি সিনোরিটা!

মণিকা বলল, এসো, এখানে একটু বসি।

আমরা দুজনে পর্চে সিঁড়ির ওপর বসে পড়লুম। মধ্যরাত ঝিমঝিম করছে। চওড়া রাস্তায় ধবধবে জ্যোৎস্না। ওপারে একটা উইলো গাছের মাথার ওপর দিয়ে হাওয়া বয়ে গেলে একটা করুণ শব্দ হয়—এগুলোকে এইজন্য উইপিং উইলো বলে। আগস্ট মাস—এখন শীতের চিহ্ন নেই।

মণিকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাকে আমার দেশের কথা জিজ্ঞেস করতে লাগল। ইটালির অবস্থাপন্ন পরিবারের মেয়ে মণিকা, আমেরিকায় পড়তে এসেছে—পড়াশোনার চেয়ে হই-হুল্লোড়েই বেশি উৎসাহ। ভারতবর্ষ সম্পর্কে ও কিছুই জানে না—যাকে বলে কিছু না—এমনকি গান্ধিজির নামটাও ওর পেটে আসছে মুখে আসছে না। কোথাও শুনেছে, মনে করতে পারছে না ঠিক। আমার ভারি মজা লাগতে লাগল। অথচ ইটালি সম্পর্কে আমরা অনেক খবর রাখি!

গল্প করতে করতে রাত তিনটে বাজলো, তখন উঠলুম। লিফটে কোনো চালক নেই, অটোমেটিক। বোতাম টিপে দুজনে দাঁড়িয়ে রইলুম। আমার সাততলা ওর আটতলা—আমাকেই আগে নামতে হবে—সাততলায় আসতে আমি বললুম, গুড নাইট মণিকা!

অভ্যেস মতন মণিকা গালটা এগিয়ে দিল। ওখানে বিদায়-চুম্বন দেবার কথা। ইচ্ছে ছিল ভদ্রতাসূচক একটা ঠোনা মারা চুমুই দেবো গালে—কিন্তু হঠাৎ মাথার গোলমাল হয়ে গেল—যাকে বলে ‘প্রগাঢ় চুম্বন’—হঠাৎ তাই একখানা দিয়ে ফেললুম, তারপর বললুম, কাল দেখা হবে তো?

পরের দিন রবিবার। সকাল থেকেই বৃষ্টি পড়ছে। আমি পূর্ববঙ্গের ছেলে—বৃষ্টি পড়লেই মনটা একটু উদাস হয়ে যায়। নিজে রান্না করে খেতে হবে—এই সব বৃষ্টির দিনে আর রাঁধতে ইচ্ছে করে না একটুও। সকালে গুটি চারেক হট ডগ সেদ্ধ করে নিয়েছিলাম, চায়ের সঙ্গে খাবার মতো—তাতেই পেট অনেকটা ভরে আছে—আজ আর দুপুরে রান্নার ঝামেলায় যাবো না—না হয় এক টিন চিকেন-অনিয়ন সুপ গরম করে নেবো!

একটা চেয়ার টেনে নিয়ে পূর্বদিকের বড়ো জানলাটার পাশে হাতে বই নিয়ে বসলুম। রাস্তার ওপারে একটা গ্যাস স্টেশন, দূরে দেখা যায় ক্যাপিটালের চূড়া।

দুপুর একটা নাগাদ দরজায় ধাক্কা। খুলতেই মণিকা এসে ঢুকল। তখনও ড্রেসিং গাউন পরা, চুল এলোমেলো, হাতে একটা চিঠি লেখার প্যাড আর কলম, খুব ব্যস্ত ভাব। সারা সকাল বোধ হয় বিছানাতেই শুয়ে ছিল। এই কাণ্ড কোনো ইটালিয়ান মেয়ের পক্ষেই সম্ভব। ড্রেসিং গাউন পরে, কোনো সাজ পোশাক না করে—এক দিনের চেনা কোনো বন্ধুর ঘরে আর কোনো জাতের মেয়ে আসবে না।

ব্যস্তভাবে মণিকা বলল, এই, তোমার পুরো নামের বানানটা কী? ছানিল? সুননীল? তারপর কি যেন?

আমি হাসতে হাসতে বললুম, কেন, আমার নাম দিয়ে কী হবে?

এই দ্যাখো না, মায়ের কাছে চিঠি লিখছি।

গড়গড় করে মণিকা ইটালিয়ান ভাষায় কী যেন পড়ে গেল! এক বর্ণও বুঝলাম না। জিজ্ঞেস করলুম, এর মানে কী? ইংরেজিতে বলো।

একটু হকচকিয়ে তাকিয়ে মণিকা ইংরেজি অনুবাদে বলল, মা, কাল রাতে আমার কী অভিজ্ঞতা হয়েছে, তুমি ভাবতে পারো? তুমি কল্পনাই করতে পারবে না! একজন ভারতীয়, সত্যিকারের ভারতবর্ষের লোক—সেই সুদূর বে-অফ বেঙ্গলের পাড়ে থাকে—তার সঙ্গে পরিচয় হল। শুধু তাই নয়, আমরা এক বাড়িতেই থাকি। ছেলেটি প্যান্ট শার্ট পরে, গায়ের রং জলপাই ফলের মতন, ইংরেজিতে কথা বলতে পারে, কথায় কথায় হাসে—

আমি হো-হো করে হাসতে লাগলুম। মণিকা বলল, এই হাসছো কেন? আমার ইংরেজি ট্রানস্লেশন খারাপ হচ্ছে?

উত্তর দেবো কী? আমি তখনও হাসছি। তারপর বললুম, আমিও আমার মাকে চিঠি লিখবো—না, মঙ্গলগ্রহের একটি মেয়ের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে, যে দুপুর একটাতেও ড্রেসিং গাউন পরে থাকে, বিশ্বসুদ্ধ সবাই ইটালিয়ান ভাষা জানে না শুনে অবাক হয়

এই-ই, ভালো হবে না বলছি!

আমার কাছে এসে মণিকা আমার মুখ চাপা দেয় হাত দিয়ে। আমি ওর হাত সরাবার জন্য ওকে কাতুকুতু দেবার চেষ্টা করি।

একটু বাদে মণিকা বলল, তুমি সত্যিই ইটালিয়ান ভাষা জানো না, তাহলে তো মুশকিল—আমি বেশিক্ষণ ইংরেজিতে কথা বলতে পারি না।

আমি বললুম, ইংরেজি সম্পর্কে আমারও সেই দশা! বেশ তো মাঝে মাঝে তুমি ইটালিয়ান ভাষায় কথা বলবে, আমি বাংলায় বলবো! ঠিক বুঝে যাবো।

গুড! বাংলা? এ-ই, তুমি আমায় বাংলা শেখাবে?

নিশ্চয়ই!

এখন একটা সেনটেন্স শেখাও।

আমি তক্ষুনি ওকে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ বাক্যটি শিখিয়ে দিলুম। বাক্যটির মানে জেনে নিয়ে তক্ষুনি আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে হাসতে হাসতে বলল—সুননীল, আমি টোমাকে বালোবাসি!—এবার তুমি ইটালিয়ান কোন কথাটা আগে শিখতে চাও, বলো?

আমি বললুম, আমি দু-চারটে শব্দ জানি। তা ছাড়া জানি, দু-লাইন কবিতা। শুনবে?

মণিকাকে চমকিত করে আমি আবৃত্তি করলুম ‘Incipit vita nova. Ecce deus fortior me, qui veniens dominibatur mihi.’ দান্তের সেই অমর কবিতা! তাঁর জীবনের পরম-রমণী সম্পর্কে কবি যা বলেছিলেন, ‘আজ থেকে আমার নতুন জীবন শুরু হল। আমার চেয়েও শক্তিমান এই দেবতা আমাকে আচ্ছন্ন করলেন।’ (মণিকা তো জানে না, বাঙালি ছেলেরা কত চালু হয়। কাল রাতে ওর সঙ্গে পরিচয় হবার পর আজ সকালেই আমি খুঁজে ওই লাইন দুটো বার করে বাথরুমে বারবার পড়ে মুখস্থ করে রেখেছি! কিন্তু, পরে বুঝেছিলাম, আমার ভুল হয়েছিল। মণিকাকে মুগ্ধ করার জন্য কোনো রকম চেষ্টা করার দরকার হয় না।)

মণিকা ডাগর চোখ মেলে সবিস্ময়ে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি দান্তের কবিতা পড়েছো? তুমি বুঝি কবিতা পড়তে খুব ভালোবাসো? আমি আস্তে আস্তে বললুম, যে কবিতা পড়তে ভালোবাসে না, আমি তাকে সম্পূর্ণ মানুষ বলেই মনে করি না।

আজ থেকে তাহলে আমরা দুজনে একসঙ্গে কবিতা পড়বো?

সত্যই মণিকাকে মুগ্ধ করার জন্য কোনো চেষ্টা করতে হয় না। সরল নিষ্পাপ ওর আত্মা। যা কিছু নতুন কথা শোনে, তাতেই অবাক বিস্ময় মানে। ভারতবর্ষ সম্পর্কে ও কিছুই জানতো না—তাই জানার নেশা ওকে পেয়ে বসে। রোমে কিছু ভারতীয় আছে বটে, কিন্তু মিলান শহর থেকে ২০ মাইল দূরে একটা ছোট্ট শহরের মেয়ে মণিকা, সেখানে কখনও কোনো ভারতীয় ও চোখে দেখেনি!

প্রায় প্রতিদিন সন্ধেবেলা মণিকা আমার ঘরে আসতে লাগল, দুজনে একসঙ্গে বসে গল্প করি, হাসি—খুনসুটি হয়—ক্রমশ আমরা অন্তরঙ্গ হয়ে পড়লুম। মাঝে মাঝে মণিকা আমার ঘরে এসে রান্না করে দেয়—দুজনে একসঙ্গে খাই। প্রথম প্রথম ভারতীয় রান্না সম্পর্কেও ওর ভয় ছিল। আমি যখন ওকে বললুম, আমরা, বাঙালিরা ম্যাকারুনি আর পিৎসা খাই না বটে, কিন্তু ভাত খাই, মশুর ডাল অর্থাৎ লেনটিল সুপ, নানা রকম মাছ—তোমাদের প্রিয় ইল অর্থাৎ বান মাছও খাই, ফুলকপি, বাঁধাকপি এবং মাংসের কোনোরকম রান্নাতেই আপত্তি নেই—অর্থাৎ ইটালিয়ানদের সঙ্গে আমাদের খাওয়ার খুব একটা তফাত নেই—তখন ও আশ্বস্ত হল।

কোমরে অ্যাপ্রন জড়িয়ে মণিকা যখন রান্নাঘরে গ্যাসের উনুনের সামনে দাঁড়াতো, তখন ভারি সুন্দর দেখাতো ওকে। এমনিতে খুব রূপসী নয় মণিকা—একটু বেশি লম্বাটে, উচ্চতায় প্রায় আমার কাছাকাছি—কিন্তু ভারি ছটফটে। সহজ স্বাভাবিকতার মধ্যে যে সৌন্দর্য—মণিকা সেই সুন্দরী। কোনোরকম আড়ষ্টতা নেই, কোনো পাপ নেই, অকপট সরল ওর ব্যবহার। ওর সাহচর্যে আমিও সৎ হয়ে উঠতে লাগলুম।

মাঝে মাঝে ওকে এক একটা কথা বলে ফেলে বিপদে পড়ি। একদিন ঠাট্টা করে ওকে বললুম, জানিস, আমাদের নিমতলার শ্মশানঘাটে একটা পাগলি দেখেছিলুম, তোকে দেখলে আমার তার কথা মনে পড়ে। এর পরই বিপদ—বোঝাও ওকে! প্রথমে বোঝাতে হবে নিমতলা কোথায়, তারপর বোঝাতে হবে শ্মশান কী জিনিস—সেখানে মানুষ পোড়ায় কেন? আমাদের দেশে সব পাগলিরাই রাস্ত-ঘাটে খোলা অবস্থায় ঘুরে বেড়ায় কিনা—তারা বৃষ্টির সময় কোথায় শোয়, কী খায়? বেশিক্ষণ ইংরেজি বলতে গেলেই আমার দম আটকে আসে—এসব বোঝাতে তো প্রাণান্ত!

একদিন কথায় কথায় ওকে শরৎচন্দ্রের একটা গল্প শোনাতে গিয়ে বলেছিলুম, জানিস, আমাদের দেশের মেয়েরা এমন—স্বামী অফিস থেকে ফিরলে বউরা অমনি তার জুতোর ফিতে খুলে দেয়, পাখার হাওয়া করে। মণিকা শুনে বলল, হাউ নাইস অ্যান্ড সুইট!

পরদিন আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরেছি, মণিকা আগে থেকেই আমার ঘরে বসেছিল, আমি ঢুকতেই হাঁটু গেড়ে আমার সামনে বসে বুটজুতোর ফিতে খুলতে গেল। মাথার ঝাঁকরা চুল দুলিয়ে বলল, এইরকমভাবে বসে তোমার দেশের মেয়েরা?

নানা কারণে সেই সময়টায় আমেরিকা আমার ভালো লাগছিল না। সব সময় পালাই পালাই মন। এখানে কোনো অভাব নেই, অফুরন্ত মদ, প্রচুর মেয়ের সাহচর্য, অর্থের চিন্তা নেই, কাজকর্মও বিশেষ নেই—তবু ভালো লাগছিল না, তবু কলকাতার ভিড়ের ট্রাম-বাস, রাস্তার কাদা আর চায়ের দোকানের বন্ধুবান্ধবের জন্য আমার মন কেমন করে। একমাত্র মণিকার জন্যই কিছুটা ভালো লাগছিল। মণিকার সঙ্গে খুনসুটি করতে করতে কিরকমভাবে যেন সময়টা বেশ কেটে যেত অজান্তে।

একদিন একটা পার্টিতে আমি আর মণিকা দুজনেই গেছি। খুব হইচই আর হুল্লোড়ের পার্টি। মণিকা নাচতে ভালোবাসে—এর ওর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে নাচছে। আমি অনবরত হুইসকি খেয়ে যাচ্ছি। এই সময় ডম বলে আমার চেনা একটা ছেলে এসে বলল, এ-ই সুনীল। তুমি কী খাচ্ছো স্কচ না বার্বন? এসো, একটু জামাইকা রাম খেয়ে দ্যাখো! খুব ভালো জিনিস।

একসঙ্গে দুরকম মদ আমার সহ্য হয় না। কিন্তু ঝোঁকের মাথায় রাজি হয়ে গেলুম। ডম খুব মস্তানি দেখাচ্ছিল—এক একটা রামের গেলাস নিয়ে এক চুমুকে শেষ করছে, আমিও ওর সঙ্গে পাল্লা দিতে লাগলুম। একটু বাদেই মাথায় নেশা লেগে গেল। আমি টলতে টলতে মণিকার সামনে গিয়ে বললুম, এসো মণিকা, তুমি আমার সঙ্গে নাচবে। তুমি আর কারুর সঙ্গে নাচবে না।

মণিকা খিলখিল করে হেসে বলল, ধ্যাৎ। তোমার নেশা হয়ে গেছে। তুমি চুপটি করে বসো।

না, নেশা হয়নি। আমি নাচবো।

আবার দুষ্টুমি? যাও, ওখানে গিয়ে বসো!

মণিকা, তুমি আমায় রিফিউজ করছো?

কী পাগলামি করছো। বলছি, তুমি ওখানে গিয়ে বসো। যাও—

মাতালের অপমানবোধ বড়ো সাংঘাতিক। আমার এমন অভিমান হল যেন মনে হতে লাগল, সমস্ত পৃথিবীই আমাকে অবজ্ঞা করছে! আমার আর বেঁচে থাকার কোনো মূল্যই নেই। আমি মাথা নীচু করে গুম হয়ে একটা সোফায় বসে রইলুম। আমার হাত থেকে বারবার সিগারেট খসে পড়তে লাগল।

বাড়ি ফিরতে হল একসঙ্গেই। ফেরার পথে আমি মণিকার সঙ্গে একটাও কথা বললুম না। লিফট এসে থামল আমার ঘরে তলায়। আমি বিদায় না জানিয়েই বেরুতে যাচ্ছি—মণিকা বলল, দাঁড়াও, আমি তোমাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসছি। আমার তখন মাথা ঘুরছে, আমার তখন হাত নেই, পা, নেই, গোটা শরীরটাই নেই, শুধু একটা প্রবল ভারী মাথা—তবু আমি রুক্ষভাবে বললুম, না কোনো দরকার নেই। থ্যাঙ্কস, থ্যাঙ্কস এ লট!

মণিকা জোর করে আমার বাহুর নীচে ওর হাত ঢুকিয়ে এগিয়ে এল। আমি ওকে সুদ্ধু দুলছি, তবু আমার মাথা প্রবল অভিমান ভরে বলছে, ওকে ছেড়ে দাও, ওকে ছেড়ে দাও, মেয়েদের কেউ কখনো বিশ্বাস করে?

কোনোরকমে অ্যাপার্টমেন্টের দরজাটা খুলে ঘরে পা দিয়েছি, কীসে একটা হোঁচট লাগতেই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড দুলে উঠল। আমি সেখানেই পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেলুম। আর কিছু মনে নেই।

জ্ঞান হল শেষ রাতে। সঙ্গে সঙ্গে ধড়মড় করে উঠে বসলুম। আমি কোথায়? আমি নিজের বিছানাতেই। আমার পা থেকে জুতো খুলে নেওয়া হয়েছে, গায়ে কোট নেই, গলায় টাই নেই—গায়ে কম্বল চাপা দেওয়া—পাশে মণিকা গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। শিশুর মতো প্রশান্ত ঘুম তার মুখে। দরজার কাছে যেখানে আমি পড়ে গিয়েছিলাম—সেখানে অল্প-অল্প বমির দাগ—নিজের মুখে হাত দিলাম, কিছু নেই। মণিকা আমার জামা-জুতো খুলে দিয়েছে, বমি মুছেছে—তারপর আমার এই হেভি লাশ টেনে এনে বিছানায় শুইয়েছে। অনুশোচনায় ও গ্লানিতে মন ভরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা গভীর মমতাবোধে আচ্ছন্ন হয়ে গেল মন। মনে হল, আঃ, এই যে এই পৃথিবীতে আমি শুধু বেঁচে আছি—এটাই কি বিরাট ঘটনা। আমাকে এক বুক কাদার মধ্যে যদি শেকল দিয়ে বেঁধে ক্রীতদাস করেও রাখা হয় তবুও আমি বেঁচে থাকতে চাইবো!

খুব নরমভাবে আমি মণিকার কপালে হাত বুলোলুম একবার। মণিকা একটু কেঁপে উঠে ঘুমের ঘোরেই আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি নুয়ে ওর কপালে একটা চুমু খেলাম। মণিকা চোখ মেলে তাকালো, বলল, উঃ, বড্ড শীত করছে। আরও দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গন করতেই এক নিমেষে চলে এল উষ্ণতা। পাখির বাসার মতন গরম ওর বুক—সেখানে মুখ গুঁজে কাতরভাবে আমি বললুম, মণিকা, তুমি আমার ওপর রাগ করোনি? আমার কানের কাছে মুখ এনে মণিকা বাংলায় বলল—সুননীল, আমি টোমাকে বালোবাসি।

আবার জ্ঞান হারালুম। আমাদের দুজনের পোশাক ছিটকে পড়ল খাটের বাইরে। চুমু খেতে খেতে আমার জিভ ওর আলজিভ স্পর্শ করতে ছুটে গেল। আমার পিঠে এমন খিমচে ধরল মণিকা যে স্পষ্ট টের পেলুম সেখান থেকে রক্ত ঝরছে। এক ধরনের অসহ্য সুখের যন্ত্রণায় গোঙাতে লাগলুম আমরা দুজনেই।

ঘুম ভাঙল বেলা ন-টায়। চোখ মেলেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ড্রেসিং গাউনটা চাপিয়ে, দরজার তলা থেকে খবরের কাগজটা টেনে নিয়ে আমি মুখ আড়াল করলুম। মণিকা তার আগেই স্নান সেরে নিয়েছে। কিচেনে টুং-টাং শব্দ শুনতে পাচ্ছি। একটু বাদে মণিকা আমাকে চা খেতে ডাকল।

চায়ের টেবিলে দুজনে নিঃশব্দ। পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিচ্ছি। বেশ কিছুক্ষণ বাদে আমি গাঢ় স্বরে ডাকলুম, মণিকা—। ও বলল, চুপ, এখন কোনো কথা বলো না।

আমাকে একটা কথা বলতে দাও।

না, কিছু বলো না।

আমাকে বলতেই হবে। শোনো, যা হয়েছে তার জন্য আমি কোনো অনুতাপ করতে চাই না। কিন্তু আমাকে স্বার্থপর, সুবিধাবাদীও তুমি ভেবো না। তুমি যা বলবে, আমি তার সবকিছুই করতে রাজি। এমনকি বিয়েও…

চুপ, ও কথা বলো না! না!

কেন?

বিয়ে কি ওই ভাবে হয়—কোনো অবস্থার চাপে কিংবা কোনো ঘটনার ফলে? বিয়ে হয় আরও পবিত্র কারণে।

মণি, তুমি তো জানো—

তাও হয় না, তুমি আঘাত পেয়ো না—এ নিয়ে আমরা আর কথা বলবো না। এসো, এটা আমরা ভুলে যাই। আমার মায়ের অনেক দিন থেকেই অসুখ—অন্য কোনো ধর্মের লোককে যদি আমি বিয়ে করি—তিনি সহ্য করতে পারবেন না। তাঁকে আমি আঘাত দিতে পারবো না। মাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। তুমি এ নিয়ে কিছু ভেবো না—দোষ তো আমারই।

রবিবার দিন ভোরবেলা মণিকা গির্জায় চলে গেল। ইটালিয়ানরা গোঁড়া ক্যাথলিক—মণিকাদের পরিবারে ধর্মবিশ্বাস খুবই প্রবল। গির্জার প্রধান পাদ্রির কাছে মণিকা তার পাপের কনফেশান দিয়ে এল এবং এক মাস মদ, সিগারেট ছোঁবে না ও মাছ ছাড়া আর কোনো আমিষ খাবে না ঠিক করল। কিন্তু সেদিনই রাত্তিরবেলা পাশাপাশি বসে পল ভেরলেইন-এর কবিতা পড়তে পড়তে আমি অন্যমনস্কভাবে যেই মণিকার কাঁধে হাত রেখেছি, মণিকা সঙ্গে সঙ্গে আমার দিকে ফিরে তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল। ঠোঁট দুটো কাঁপছে, অস্ফুটভাবে বলল, আমি পারছি না, আমি পারছি না! তুমি আমায় ভালোবাসবে না?

মণিকা আমার বুকের ওপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঈশ্বর বিশ্বাসের চেয়েও তীব্রতর কোনো শক্তিতে ওর শরীর ফুঁসছে। আমি ঈশ্বর মানি, না, ন্যায়-অন্যায়ের কোনো ঐশী সীমারেখা জানি না—আমার মনে হয়েছিল, জীবনের সেই মুহূর্তের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবার কোনো যুক্তি নেই। আমি মণিকাকে আলিঙ্গন করে ওর কোমরের কাছে হাত নিতেই তীব্র আবেগে মণিকা আমার বুকে কামড় বসিয়ে দিল।

তারপরের দিনগুলো কাটতে লাগল হু হু করে। দুজনে দুজনের মধ্যে ডুবে রইলাম। সেই সময়টায় আমার লেখাপড়া-টড়াও ডকে উঠে গিয়েছিল। স্থানীয় ভারতীয় ছেলেরাও আমাকে বয়কট করেছিল দুশ্চরিত্র বলে। কিন্তু মণিকার মধ্যে আমি এমন একটা জিনিস পেয়েছিলুম—আমি কদাচিৎ বাইরে বেরোই, অন্য লোকের সঙ্গে দেখাই করি না—মণিকা বাইরের দরকারি কাজগুলো দ্রুত সেরেই আমার ঘরে চলে আসে। আগে ওর আরও অনেক বন্ধু ছিল—এখন আর কারুর সঙ্গে দেখা করে না। আমরা দুজনেই যেন শৈশবে ফিরে গিয়েছিলুম—যেখানে কোনো অভাববোধ নেই, প্রয়োজনের গুরুভার নেই।

মাসখানেক বাদে এই আচ্ছন্ন অবস্থা কাটিয়ে উঠতেই হল। পনেরো দিন পরে মণিকার পরীক্ষা। আগের সেমেস্টারে ও পরীক্ষা দেয়নি, এবারও পরীক্ষা না দিলে ওর ভিসার সময় বাড়াতে অসুবিধা হবে। আমার তখন পরীক্ষা-টরীক্ষার বালাই নেই—তবু আমি মণিকাকে পড়াশুনো করার জন্য জোর করলুম। মণিকা আমার ঘরে বসেই বইপত্র ছড়িয়ে পড়াশুনো করে—আমি ওকে ছুঁই না, দূর থেকে ওকে দেখি।

আমি এ পর্যন্ত কোনো পাপ করিনি। একটা মেয়ের সঙ্গে আমার শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল—বিয়ে না করেও একসঙ্গে থাকতুম—এটাকে আমি পাপ মনে করিনি।

আমার পাপের কাহিনি এর পর থেকে শুরু। একদিন আমি স্নান করছি, বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে মণিকা বললে, সুননীল, শিগগির খোলো, একটা জরুরি কথা আছে। শিগগির!

ওর গলার আওয়াজ শুনে ভয় পেয়ে আমি তাড়াতাড়ি তোয়ালে জড়িয়েই বেরিয়ে এলুম। মণিকার মুখ ফ্যাকাশে—হাতে একটা ওভারসিজ টেলিগ্রাম। পড়লাম। ওর বাবা পাঠিয়েছে, ওর মায়ের খুব অসুখ।

মণিকা কাঁপতে কাঁপতে বলল, বুঝতে পারছি না, মা এখনও বেঁচে আছেন কিনা। মাকে আমি আর দেখতে পাবো না—তা কি হয়? তুমি বলো, তা কি হয়? অসম্ভব! আমি আজই যাবো।

মণিকার মায়ের বারণ ছিল, মণিকা যেন কখনও প্লেনে না চাপে। প্লেন সম্পর্কে তাঁর দারুণ ভয়। ইউরোপ-আমেরিকায় এখনও এরকম মা আছে! কিন্তু এখন জাহাজে যাবারও সময় নেই। মাকে দেখার জন্য মণিকা দারুণ ব্যস্ত হয়ে উঠল—সেদিনই প্লেনে চাপতে চায়! স্টুডেন্ট কনসেশন পেলেও প্লেনে ভাড়া প্রায় তিনশো ডলার লাগবে। মণিকার কাছে তখন সব মিলিয়ে দেড়শো ডলার ছিল, আমার নিজের কাছে ছিল বিরাশি ডলার—তার থেকে পঁচাত্তর ডলার ওকে দিয়ে দিলাম, বাকি টাকাটা ওর দুই বান্ধবীর কাছ থেকে ধার করে সেদিন বিকেলেই প্লেনের টিকিট কাটল। টিকিট পেতে অসুবিধে হল না!

আমি এয়ারপোর্টে মণিকাকে তুলে দিতে গেছি। তখনও সময় আছে। মালপত্র জমা দিয়ে এদিক-ওদিকে ঘুরছি আমরা। সঙ্গে টাকাকড়ির অবস্থা সঙ্কটজনক। ইচ্ছে থাকলেও এয়ারপোর্টের বার-এ গিয়ে বসার উপায় নেই। মেশিন থেকে দুটো কোকাকলার বোতল নিয়েই তৃষ্ণা মিটিয়েছি। মণিকা আমাকে বলল, গিয়ে যদি দেখি মা একটু ভালো হয়ে গেছেন—তাহলে আমি সাতদিনের মধ্যেই ফিরে আসবো। এবার আমি পরীক্ষা দেবোই।

আমি বললুম, আমার মনে হচ্ছে, তোমার মা ভালো হয়ে উঠেছেন এর মধ্যে!

আচ্ছা দেখি, ইন্ডিয়ান যোগীর কথা মেলে কিনা।

ঠিক মিলবে। মিললে তুমি ফিরবে তো?

নিশ্চয়ই!

নাকি বাড়িতে গিয়ে আমাদের কথা ভুলে যাবে?

ইস! ওরকম কথা বললে সবার সামনেই তোমার গালটা কামড়ে দেবো বলছি!

দাও না, আপত্তি নেই! কে জানে এই শেষবার কিনা—

আবার ওই কথা?

একটু বাদেই মাইকে যাত্রীদের নামে ডাক শোনা গেল। যাত্রী-যাত্রিনীরা একে একে লাইনে দাঁড়াচ্ছে। পাশের এক কাউন্টারে ইনসিওরেন্স করা হচ্ছে। প্লেনের সাধারণ ইনসিওরেন্স ছাড়াও এখানে যাত্রীরা অতিরিক্ত ইনসিওরেন্স করাতে পারে। খুব সস্তা। এক ডলারে পনেরো হাজার ডলার। মণিকা বলল, একটা ইনসিওরেন্স নেবো নাকি? কখনও করাইনি আমি। করবো?

আমি বললুম, কী হবে? শুধু শুধু টাকা নষ্ট!

মোটে তো এক ডলার!

এক ডলারই এখন আমাদের যথেষ্ট দামি।

তা হোক। তবু একটা করাই।

ও সেই কাউন্টারে গিয়ে একটা ফর্ম চাইল। ফর্মের এক জায়গায় নমিনির নাম লিখতে হয়। দুর্ঘটনা হলে টাকাটা যে পাবে। মণিকা ঝকঝকে হাসিমুখে বলল, এখানে তোমার নামটা বসাই। টাকা জমা দিয়ে ফর্মের একটা কপি ও আমার হাতে দিয়ে বলল, এই নাও, সাবধানে রেখো। আমি মরলে তুমি বড়োলোক হয়ে যাবে। আমি তখনও বিরক্তভাবে ওকে বলেছি, তুমি শুধু শুধু একটা ডলার বাজে খরচ করলে। যত পাগলামি।

এবারে যাত্রীদের প্লেনে উঠতে হবে। মণিকা দাঁড়িয়েছে লাইনে সবার শেষে। আমি ওর পাশে পাশে গল্প করতে করতে এগোচ্ছি। গেটের ওপাশে আর আমাকে যেতে দেবে না। গেট পেরিয়ে চলে গেল মণিকা, আমি ওকে রুমাল উড়িয়ে বিদায় দিলুম। হঠাৎ ও আবার এক ছুটে ফিরে এল। ওই একগাদা লোকের মধ্যেই আমাকে বিষম অপ্রস্তুত করে আমার ঠোঁটে একটা দ্রুত চুমু দিয়ে বলল—তুমি কিছু ভেবো না, আমি আবার সাতদিনের মধ্যেই ফিরে আসবো। লক্ষ্মী ছেলে হয়ে থেকো এই কটা দিন।

টিপ-টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। ইস, আজকের দিনে বৃষ্টি না পড়লেই ভালো হতো। বৃষ্টির সময় একটা পাতলা কুয়াশায় সব কিছু অস্পষ্ট হয়ে যায়। প্লেনে জানলার ধারে সিট পেয়েছে মণিকা, বৃষ্টি না পড়লে আরও কিছুক্ষণ আমি ওর শরীরের অস্পষ্ট আভাস দেখতে পেতুম। কাচের ভেতর দিয়ে ও আমাকে দেখতে পেতো স্পষ্ট। দারুণ তৃষ্ণার্ত মানুষের মতন মণিকাকে আরও একটু দেখার জন্য ছটফট করছিলাম। ইচ্ছে হচ্ছিল, সব বাধা ভেঙে ছুটে গিয়ে প্লেনের মধ্যে উঠে আরেকবার দেখে আসি। মায়ের অসুখ না সারলে আবার কবে ফিরবে মণিকা তার ঠিক কী! ততদিন আমি থাকবো কিনা কী জানি! মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলুম, মণিকা যদি ফিরতে না পারে—যেমন করেই হোক, দুএক মাসের মধ্যে আমি ইটালিতে চলে যাবো।

প্লেন ছাড়ার আগেই বৃষ্টি প্রবল এল। সঙ্গে সঙ্গে উঠল ঝড়। এখানে ঝড় সহজে আসে না, কিন্তু যখন আসে—তখন বড়ো দুর্দান্ত। তবু সেই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেই প্লেন উড়ল।

রানওয়ে দিয়ে ছুটে গিয়ে হঠাৎ ভেসে উঠল হাওয়ায়, চক্রাকারে ঘুরতে লাগল একটুক্ষণ। আমি সেই দিকে আকুল হয়ে তাকিয়ে রইলুম। আমার বুকের মধ্যে গুড়গুড় করতে লাগল।

ইস আজকেই এমন ঝড়-বৃষ্টি। মণিকার মায়ের অসুখ নিয়ে এমনিতেই তার মন খারাপ, তার ওপর ঝড়-বৃষ্টির জন্য আরও মন খারাপ লাগবে। যদি কোনো দুর্ঘটনা হয়? না, না, কোনো দুর্ঘটনা হবে না—এসব বোয়িং বিমান কয়েক মিনিটের মধ্যেই পঁচিশ-তিরিশ হাজার ফুট উঁচুতে উঠে যাবে—সেখানে ঝড়-বৃষ্টির কোনো চিহ্ন নেই।

দুর্ঘটনা? হঠাৎ অন্য ধরনের একটা অনুভূতি আমার শরীরে শিহরণ খেলিয়ে গেল! মণিকার বিমান সদ্য দৃষ্টি থেকে মিলিয়ে গেছে, আমি তখনও আকাশের দিকে চেয়ে আছি, আমার হাতে সেই ইনসিওরেন্সের কাগজ—হঠাৎ আমার মনে হল, দুর্ঘটনায় যদি বিমানটা ভেঙে পড়ে—তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আমি পনেরো হাজার ডলার অর্থাৎ একলক্ষ বারো হাজার টাকার মালিক হয়ে যাবো। এক লক্ষ বারো হাজার টাকা!

আমার মুখখানা ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে গেল। বুকের মধ্যে একটা তীব্র ব্যথা বোধ করলুম। ছি, ছি, এ আমি কী ভাবছি। মণিকা, তাকে আমি এত ভালোবাসি—আমি তার মৃত্যু চিন্তা করছি? এমন সরল সুন্দর মণিকা—কত শ্বেতাঙ্গ প্রেমিককে উপেক্ষা করে আমার মতন একটা সাধারণ ভারতীয়কে সে অমন সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসেছে—আমার সুখের জন্য, তৃপ্তির জন্য ও করেনি এমন কাজ নেই—আর আমি তার মৃত্যু চাইছি!

কিন্তু বুকের ভিতর থেকে আমার দ্বিতীয় আত্মা বলতে লাগল, না, না, তুমি তার মৃত্যু চাইছো না। বিমান দুর্ঘটনার ব্যাপারে তোমার তো কোনো হাত নেই। তোমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর কিছু নির্ভর করে না—কিন্তু ধরো যদি ঝড়-বৃষ্টিতে বিমানটা ভেঙেই পড়ে—তুমি তো তা আর আটকাতে পারছো না—তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই তুমি পেয়ে যাবে এক লক্ষ বারো হাজার টাকা—এক লক্ষ বারো হাজার টাকা কতখানি তা বুঝতে পারছো!

বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই বাড়ি ফিরে এলুম। সারা ঘরে মণিকার স্মৃতি। মণিকার চটিজুতো জোড়া আমার ঘরেই ফেলে গেছে। প্রায় রাত্তিরে চুপি চুপি আমার ঘরে নেমে এসে ও আমার বিছানায় শুতো। ওর শ্লিপিং স্যুটও রাখা আছে আমার এখানে। বালিশে এখনও লেগে আছে ওর কোমল মুখের স্পর্শ। ছড়ানো রয়েছে ওর বইখাতা, চিরুনি, নাইলনের মোজা। মণিকাকে ফিরে পাওয়ার জন্য আমার বুক মুচড়ে মুচড়ে উঠতে লাগলো। আগেও দু-চারজন মেয়ের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে এদেশে—কিন্তু মণিকার মতন এমন আর কারুর প্রতি নিবিড় আকর্ষণ বোধ করিনি।

দেয়ালে লাগানো বিশাল আয়না—এই আয়নার সামনে একদিন মণিকাকে দাঁড় করিয়েছিলুম , একে একে খুলে ফেলেছিলুম ওর সব পোশাক। মণিকা আপত্তি করেনি। মুখ টিপে-টিপে হাসছিল—ওর লিলিফুলের মতন নরম গাল দুটিতে আমি আলতোভাবে চুমু খেয়েছিলুম, ওর ঠোঁটে জিভ ঠেকিয়ে সুড়সুড়ি দিয়েছিলুম। পুকুরঘাটে বাংলাদেশের মেয়েরা জল আনতে গিয়ে কলসির গলা জড়িয়ে ধরে যে রকম আনন্দ পায়—সেই রকম শান্তিময় আনন্দ পেয়েছিলুম ওর সরু কোমর জড়িয়ে। ফর্সা উরু দুটিতে স্বর্গের সুষমা—দুই বুকের সন্ধিস্থলে মুখ গুঁজে বলেছিলাম, মণিকা, তুমি দেবীর মতন, তুমি সত্যিই দেবী, আমি তোমাকে ভালোবাসি—তুমি আমায় ছেড়ে যেও না। মনে হয়, মণিকা যেন এখনও সেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে—সেইরকমভাবেই আমার দিকে চেয়ে হাসছে।

চেয়ারে কতক্ষণ গুম হয়ে বসেছিলুম মনে নেই। হঠাৎ খেয়াল হল আমি সেই ইনসিওরেন্সের কাগজখানাই বার বার পড়ছি। পড়ে দেখছি, যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটেই—টাকাটা আমি পাবো কিনা—আইনগত কোনো অসুবিধা হবে কিনা। কোনোই অসুবিধে নেই, সে নিজে হাতে প্রাপক হিসেবে আমার নাম-ঠিকানা লিখে নীচে সই করে গেছে। মৃত্যু প্রমাণিত হলেই কোম্পানি বাড়ি বয়ে এসে আমাকে টাকা দিয়ে যেতে বাধ্য। এক লক্ষ বারো হাজার টাকা! উঃ কী নীচ, শয়তান, পাষণ্ড আমি! সামান্য টাকার জন্য আমি মণিকার মৃত্যু চাইছি! স্বর্গ-দুর্লভ ভালোবাসার স্বাদ দিয়েছে মণিকা আর আমি…

চেয়ারটা ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে আয়নার কাছে চলে এলাম। আয়নার গায়ে মুখ লাগিয়ে ব্যাকুল ভাবে বললাম, না, না, না—মণি, আমার সোনা, আমার দেবী, আমি তোমাকে ভালোবাসি—শুধু তোমাকেই—পৃথিবীর বিনিময়েও আমি তোমার মৃত্যু চাই না। না—। আমি শুধু তোমাকেই চাই। প্রচণ্ড রাগে ইনসিওরেন্সের কাগজটা আমি জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলুম।

সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, যদি একটা কিছু ঘটেই যায়—তাহলে টাকাটা শুধু শুধু নষ্ট করার কোনো মানে হয় না! এক লক্ষ বারো হাজার টাকা! আমি না নিলে ওটা আর কেউ পাবে না। তৎক্ষণাৎ ছুটে বেরিয়ে গেলাম—লিফটের জন্য অপেক্ষা না করে সাততলা সিঁড়ি হুড়মুড় করে নেমে চলে এলাম রাস্তায়। কাগজটা তখনও পড়ে আছে—একটু জল লেগেছে কিন্তু তাতে বিশেষ কিছু ক্ষতি হবে না।

নিজেকে সত্যিকারের পাপি মনে হয়েছিল আমার। আমি ভারতীয়, আমি ভিখিরি জাতের লোক—হঠাৎ টাকা পাবার লোভ কিছুতেই মাথা থেকে তাড়াতে পারি না! আমাদের চোখে এখন টাকার তুলনায় প্রেম, মমতা, কৃতজ্ঞতা এসবই তুচ্ছ। এক লক্ষ বারো হাজার টাকা পেলে আমি এই পোড়ার দেশে আর একদিনও থাকবো না। প্রবাসের রুক্ষ জীবন কে চায়? এক লক্ষ বারো হাজার টাকা পেলে তক্ষুনি আমি দেশের টিকিট কাটবো—প্লেনের না, জাহাজের—ফিরে গিয়ে কলকাতাতেও থাকবো না, চলে যাবো ফ্রেজারগঞ্জে। সেখানে একটা ছোটো বাড়ি বানাবো। আমার অনেক দিনের শখ। আর কারুর দাসত্ব করতে হবে না, কারুর কাছে মাথা নোয়াতে হবে না। সেখানে জমি কিনে আমি নোনা মাটিতে ফসল ফলাবো, সমুদ্রে মাছ ধরবো। জল-কাদার মধ্যেও পরিশ্রম করবো আমি, জেলে- ডিঙি নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে চলে যাবো ঝড়-বাদল তুচ্ছ করে। এই সব পরিকল্পনা করতে করতে ভয়ে কেঁপে উঠেছিলাম আমি। হঠাৎ যেন মনে হল, আমি মণিকার মৃতদেহের ওপর দাঁড়িয়ে আনন্দে খলখল করে হাসছি।

সেদিন সন্ধেবেলা আমার বন্ধু ডম আমাকে ডাকতে এল। বলল—এই সুনীল, চলো, আজ আমাদের একটা সোয়েল পার্টি আছে—মণিকা কোথায়? নেই? তাই তোমাকে এমন মনমরা দেখছি! চলো, চলো, তুমি একাই চলো—

জোর করে ধরে নিয়ে গেল আমাকে। গোপন নিষিদ্ধ পার্টি। এ পার্টিতে সামাজিক ভদ্রতা নেই, মদ নেই, খাবারও নেই। শুধু মেরুআনা (গাঁজা) আর এল এস ডি’র পার্টি! পুলিশ জানতে পারলে যে-কোনো মুহূর্তে এসে ধরে নিয়ে যাবে। সাতটা ছেলে আর ন-টা মেয়ে। মেয়েগুলোরই উন্মত্ততা বেশি। ডম প্রস্তাব করল, আজ সুনীল আমাদের ইয়োগা শেখাবে। আমি যতই বলি যে আমি যোগ, তন্তর-মন্তর কিছু জানিও না, বিশ্বাসও করি না—কিছুতেই ওরা শুনবে না। শেষ পর্যন্ত আমি ওদের পদ্মাসনে ওঁং তৎ সৎ জপ করা শেখাবার চেষ্টা করলুম। মাটিতে বসা অভ্যেস নেই—পা মুড়ে তো বসতে জানেই না, বসতে গেলে উল্টে পড়ে যায়। ঘরময় ছেলেদের গড়াগড়ি। সে একখানা দৃশ্য বটে!

মনের মধ্যে আমার দারুণ অস্বস্তি সবসময়, তাই আমি ওদের হইচইতে ঠিক যোগ দিতে পারছিলুম না সেদিন। মন অত অস্থির থাকলে এল এস ডি খাওয়া উচিত নয়—বলে আমি এড়িয়ে গেলাম। পাইপে খানিকটা মেরুয়ানা ভরে টানতে লাগলাম। তবু মনের অস্বস্তি কাটে না। পকেটে মাত্র সাত ডলার আছে—সপ্তাহ না ফুরালে আর টাকা পাবার আশা নেই। এই সপ্তাহটা এ দিয়েই কোনোক্রমে টেনে-টুনে চালাতে হবে। তখন কলকাতায় আমাদের বাড়ির সংসার খরচও আমাকে এখান থেকে চালাতে হয়। আমার নিজেরও রোজগার তখন বেশি নয়। সেদিন বিকেলেই বাবার চিঠি পেয়েছি—আমার জ্যাঠতুতো ভাইয়ের গুরুতর অসুখ—স্পেশালিস্ট দেখাতে হবে, বাড়িভাড়া তিনমাস বাকি—অর্থাৎ আরও টাকা পাঠাতে হবে।

নেশার ঝোঁকে অনেকেরই অবস্থা বেসামাল। ঘরের আলোটা নিবিয়ে দিয়ে ডম শুধু টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে রেখেছে। দরজা জানলা সব বন্ধ, ধোঁয়ার গুমোট আবহাওয়া, তার মধ্যে অতগুলি সুগঠিত স্বাস্থ্যবান প্রায় নগ্ন নারী-পুরুষ—এক অকল্পনীয় বিস্ময়কর দৃশ্য। দু-চারজন পরস্পরকে জড়িয়ে শুয়ে পড়েছে মেঝেতে, অনেকেই কিন্তু মুখোমুখি বসে নিস্পৃহের মতো গল্প করে যাচ্ছে। আমি ছিলাম জানলার কাছে। এই সময় ক্যারোলিন বলে একটা মেয়ে আমার কাছে এসে বলল—এ-ই, তুমি একা একা অমন গ্লাম ফেসেড হয়ে বসে আছো কেন?

আমি উত্তর না দিয়ে শুধু একটু হাসলাম। ক্যারোলিনের বিশাল চেহারা, শক্ত উন্নত স্তন, কলাগাছের মত দুই উরু, শিল্পীদের মডেল হয় ক্যারোলিন। কথা নেই বার্তা নেই ক্যারোলিন আমার কোলের ওপর বসে পড়ে গলা জড়িয়ে ধরে বলল, হ্যালো সু-ই-টি!

কী যেন হল আমার, রূঢ়ভাবে ধাক্কা দিয়ে আমি ক্যালোলিনকে নামিয়ে দিলাম। সেই মুহূর্তে আমি বুঝতে পারলাম মণিকা ছাড়া আর অন্য কোনো মেয়েকে আমি চাই না। অন্য কোনো মেয়েকে ছোঁয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মণিকার জন্য আমার শিরায় শিরায় ব্যাকুলতা জেগে উঠল, আর ক্যারোলিনের প্রতি এল ঘৃণা। ক্যারোলিন অবাক হয়ে বলল, হেই। ইউ আর ক্রস? কী হয়েছে তোমার?

আমি বললুম, মাপ করো, আমার ভালো লাগছে না। আই অ্যাম আ ড্রপ আউট টু নাইট!

তক্ষুনি আমি আমার কোট পরে নিলাম এবং সকলের অনুরোধ, মিনতি উপেক্ষা করে বাইরে চলে এলাম! বাইরের মুক্ত হাওয়ায় সুস্থভাবে নিশ্বাস নিয়ে মনে হল মণিকাকে যেন আমি আবার ফিরে পেয়েছি।

পরদিন সকালে রেডিয়োতে খবর বলা শেষ করার আগে সংক্ষিপ্তভাবে জানাল—সুইজারল্যান্ড আর ইটালির সীমান্তে একখানা বিমান ধবংস হয়েছে। যাত্রীদের কাউকে উদ্ধার করা যায়নি। বুকের মধ্যে ধক করে উঠে যেন দম-আটকে গেল আমার। রান্নাঘর থেকে রেডিয়োর কাছে ছুটে এলাম। খবর সেখানেই শেষ হয়ে গেছে। কাঁটা ঘুরিয়ে আমি অন্য স্টেশন ধরার চেষ্টা করলুম। কোথাও আর তখন খবর নেই। হারামজাদারা—ওইরকম সাংঘাতিক খবর অত সংক্ষেপে বলার কোনো মানে হয়? কোন কোম্পানির প্লেন, কোত্থেকে আসছিল, যাত্রীদের নামের তালিকা—আঃ অসহ্য, অসহ্য, সেই বিকেলবেলা খবরের কাগজ বেরুবে—তাতে যদি থাকে—অ্যালিটালিয়া বিমান কোম্পানির অফিসে ফোন করবো? মণিকার পুরো নাম—মণিকা আর্লিংগেটি—ইনসিওরেন্সের কাগজটা ড্রয়ারে রেখেছিলাম—ঠিক আছে তো? অন্য বিমানও হতে পারে অবশ্য—কিন্তু কাগজটা সাবধানে, একলক্ষ বারো হাজার টাকা—প্রায় উন্মাদের মতন ছটফট করছিলুম আমি—এক সময় সংবিৎ ফিরে এলো। নিজের প্রতি দারুণ ঘৃণায় বিমর্ষ হয়ে পড়লুম। মণিকা বেঁচে আছে কিনা। সেকথা আমি জানতে চাইছি না, আমি জানতে চাই মণিকা মরে গেছে কিনা। মণিকা যদি সত্যই মরে—তবে আমিই তার হত্যাকারী। আমি তো ওর নিরাপদে পৌঁছুবার কথা একবারও ভাবিনি, ওর মৃত্যুর কথাই ভেবেছি শুধু।

ঠিক করলুম, আর রেডিয়ো খুলবো না, আর খবরের কাগজ পড়ব না। আমি কিছু জানতে চাই না। আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। তার পরের কয়েকটা দিন যে নিরন্তর মানসিক যন্ত্রণায় কাটিয়েছি—তা বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই! মুহূর্তে মুহূর্তে মণিকার মুখ মনে পড়ায় আমার বুকের মধ্যে হু হু করে উঠেছে, আবার প্রতি মুহূর্তে আমি দরজার কাছে একটা ভারী জুতো পরা পায়ের আওয়াজের প্রতীক্ষা করেছি, পিওনের পায়ের আওয়াজ টেলিগ্রাম নিয়ে আসবে—যে টেলিগ্রামে থাকবে আমার এক লক্ষ বারো হাজার টাকা পাওয়ার খবর! ছয়দিনের মধ্যে মণিকার কোনও চিঠি এল না, ঠিক সাতদিনের মাথায় আমার দরজায় কে যেন বেল টিপলো। টেলিগ্রাম পিওন ভেবে আমি দৌড়ে দরজা খুলে দিতেই দেখলাম মণিকা দাঁড়িয়ে আছে। সত্যি, না স্বপ্ন? একটা নীল রঙের রেন কোট পরা, তার থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল পড়ছে, হাতে দুটো চামড়ার ব্যাগ, রক্তিম ঠোঁট ফাঁক করে ঝকঝকে দাঁতে আলো করে হাসলো মণিকা!

আমি কঠোর পুরুষ, জীবনে অনেক দুঃখকষ্ট সহ্য করেছি, অনেক নিষ্ঠুর নির্দয় ব্যবহার পেয়েছি ও দিয়েছি, কখনও আমার চোখে জল আসেনি। কিন্তু সেদিন আমার চোখ জ্বালা করে উঠল, শেষ পর্যন্ত কাঁদিনি কিন্তু ওই চোখের জল আসার ইঙ্গিতেই আমি বুঝতে পারলুম, আমার পাপের অবসান হয়েছে। আমি আর লোভী নই, আমি আর কিছু চাই না, শুধু মণিকাকেই চাই। আমি দুহাত বাড়িয়ে ডাকলুম, মণি,—সত্যি—তুমি—

হাতের ব্যাগ দুটো ঘরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মণিকা ছুটে এসে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। বলল, আমি কথা রেখেছি। দ্যাখো আমি ঠিক সাতদিনের মধ্যেই ফিরে এসেছি।

আমি কোনো কথা বলতে পারছিলুম না, ওকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে রইলুম। ও আবার খুশি খুশি গলায় বলল, তোমার কথাই কিন্তু সত্যি হয়েছে। গিয়ে দেখলুম, মা ভালো হয়ে গেছেন। আমি না গেলেও পারতুম—যাকগে গিয়েছি ভালোই হয়েছে, নিজের চোখে দেখে এলাম—এখন নিশ্চিন্তে পড়াশোনা করতে পারবো! এ-কদিন শুধু তোমার কথাই ভেবেছি—তুমি নিশ্চয়ই আমার কথা একটুও ভাবোনি তো? এ—ই?

আমি তবু চুপ করে রইলুম।

এ-ই, তুমি কথা বলছো না কেন?

মণিকা আমি খুব খারাপ লোক! এই কদিন শুধু ভাবছিলুম, যদি তোমার কোনো দুর্ঘটনা হয়—

তুমিও তাই ভাবছিলে!

মণিকা আমাকে ছেড়ে এবার সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর পরিপূর্ণ প্রস্ফুটিত ফুলের মতন হাসিমুখে বলল—জানো, আমার মাও শুধু ওই কথা ভাবছিলেন। মা যখন শুনলেন, আমাকে টেলিগ্রাম পাঠানো হয়েছে, তখন থেকেই মায়ের কী চিন্তা। আমি প্লেনে আসবো মা ভাবতেই পারেন না। ফেরার সময়েও যখন প্লেনে এলুম মায়ের কী কান্নাকাটি, কিছুতেই আসতে দেবেন না। প্রায়ই প্লেন অ্যাকসিডেন্ট হয়, আমি যদি মরে যাই—শুধু এই কথা। তুমিও দেখছি, আমার মায়ের মতনই।

না, সে রকম নয়। আমি খারাপ লোক, আমি তোমার মৃত্যুর কথা অনবরত ভাবছিলুম, আর—

জানি, তুমি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো।

না, আমি তোমাকে ভালোবাসার যোগ্য নই।

পাগল। তুমি কিছু বোঝো না। শোনো, যে যাকে যত বেশি ভালবাসে—সে তত বেশি তার বিপদের চিন্তা করে। দ্যাখো না—ছেলেমেয়েরা যখন বাইরে খেলাধুলো করতে যায়—মা তখন বলেন, দেখিস, গাড়ি চাপা পড়িস না, মারামারি করিস না, চোর ডাকাত যেন ধরে না নেয়—শুধুই বিপদের কথা, ভালো কথা কি বলে? ভালোবাসার নিয়মই এই। মায়ের মতন তুমিও আমার মৃত্যুর কথাই শুধু ভেবেছো। মা ছাড়া আমাকে আর কেউ এত ভালোবাসে নি—তোমার মতন।

আমি আচ্ছন্ন, অভিভূত মানুষের মতন দাঁড়িয়ে রইলুম। মণিকা অভিমানী গলায় বলল,—তুমি আমাকে একটুও আদর করোনি তখন থেকে এসে—

মণিকা নিজেই এসে আমার বুকে মাথা রাখলো। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজলাম ওর পিঠে। আমার দুই হাত ওর পিঠের ওপর রাখা। সেদিকে তাকিয়ে মনে হল, এই হাত মণিকাকে হত্যা করতে চেয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *