আমার আছে জল – ১১শ পরিচ্ছেদ

রোস্ট জিনিসটি যে খেতে এত ভাল হবে রেহানা কল্পনাও করতে পারেননি। তাঁর আফসোস হতে লাগলো তিনি পাশে বসে রান্নার পুরো ব্যাপারটা কেন দেখলেন না। সাব্বির বললো—আমি খুব গুছিয়ে লিখে রেখে যাব আপনার যখন ইচ্ছা রান্না করতে পারবেন।

বালি হাঁস ছাড়া সাধারণ হাঁস দিয়ে রান্না হবে?

জানি না। হওয়া তো উচিত। আমি অবশ্যি কখনো ট্রাই করিনি।

জামিল বললো, আমার মনে হয় না সাধারণ হাঁস দিয়ে এটা হবে। সাধারণ হাঁসগুলোর গায়ে প্রচুর চর্বি থাকে। বালি হাঁসের গায়ে চর্বি থাকে না।

নিশাত হাসিমুখে বললো—আপনি বুঝি পৃথিবীর সব জিনিস জানেন?

না, আমি খুব কমই জানি, মাঝে মাঝে লজিক খাটিয়ে দু’একটা কথা বলতে গিয়ে সবাইকে বিরক্ত করি।

ওসমান সাহেব বললেন—দিলুকে দেখছি না যে। দিলু কোথায়?

ও খাবে না। ওর মাথা ধরেছে।

চেখে দেখুক। ডেকে নিয়ে আয়তো নিশাত।

অনেক বলেছি বাবা।

জামিল বললো—আমি নিয়ে আসছি।

দিলু কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়েছিলো। জামিলকে ঢুকতে দেখে উঠে বসলো। ঘর অন্ধকার। আলো চোখে লাগে বলে হ্যারিকেন ডিম করে রাখা হয়েছে। জামিল বললো—দিলু আমাদের সঙ্গে এসে বস। জিনিসটা বেশ ভাল হয়েছে। তোমার ভাল লাগবে। দিলু জবাব দিলো না।

তুমি হয়তো লক্ষ্য করনি। আমি তুমি করে বলছি। এসো দিলু। খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা অনেক রাত পর্যন্ত আগুনের পাশে বসে গল্প করব।

আমার মাথা ধরেছে জামিল ভাই।

এমন মজার গল্প বলব যে মাথা ধরা সেরে যাবে। এসো!

দিলু উঠে এলো। গল্প খুব জমে উঠলো খাবার টেবিলে। ওসমান সাহেব পর্যন্ত একটা হাসির গল্প বলে ফেললেন। নাসিরুদ্দিন হোজ্জার গল্প। সবারই জানা তবু সবাই হাসলো। কিছু কিছু সময় আসে যখন সব কিছুই ভালো লাগে।

সাব্বির বললো নিউইয়র্কে এক হোটেলে তার অভিজ্ঞতার গল্প—তার বিছানার সঙ্গে একটা যন্ত্র ফিট করা। সেখানে লেখা গা ম্যাসাজ করতে হলে এখানে দু’টি কোয়ার্টার ফেলুন। বেচারা সরল মনে দু’টি কোয়ার্টার ফেললো। তারপর বিছানায় শোয়ামাত্র বিছানা কাঁপতে শুরু করলো। সে কি কাঁপুনি। বসে থাকা যায় না, ছুঁড়ে ফেলে দিতে চায়। মিনিট দশেক পর কাঁপুনি থামলো। কিন্তু যন্ত্রটির বোধ হয় কিছু একটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো, কিছুক্ষণ পর আবার শুরু হলো কাঁপুনি। থামে, আবার শুরু হয়। আমার থামে আবার শুরু হয়।

গল্প শুনে হাসতে হাসতে রেহানা বিষম খেলেন এবং মনে মনে স্বীকার করলেন ছেলেটি রসিক। প্রচুর রসজ্ঞান না থাকলে গল্পটি এত সুন্দরভাবে বলা সম্ভব নয়। ওসমান সাহেব বললেন—সবাই একটা না একটা গল্প করছে। নিশাত চুপ করে আছে কেন?

বাবা আমি শুনছি।

শুধু শুনলে হবে না। বলতেও হবে।

নিশাত মৃদুস্বরে বললো—একটা মজার জিনিস লক্ষ্য করলাম আমি। জামিল ভাই হঠাৎ করে দিলুকে তুমি তুমি করে বলছেন।

জামিল শান্ত স্বরে বললো—দিলু বড় হচ্ছে এখন আর ওকে তুই বলা ঠিক নয়।

বড় কোথায়, ওর বয়স চৌদ্দ বছর মাত্র।

দিলু শীতল কণ্ঠে বললো—নভেম্বরে আমার পনেরো হয়েছে আপা। তোমার কিছু মনে থাকে না।

পনেরো হলেই যদি তুমি বলতে হয় তাহলে তো আমাদেরকেও তুমি বলতে হয়।

দিলু কিছু বললো না। ওসমান সাহেব বললেন—দিলু মা’র মনটা মনে হয় খারাপ। নিশাত বললো ওর মন ভালোই আছে। লোকজন ওকে তুমি করে বলা শুরু করেছে। মন খারাপ হবে কেন?

আমার মন ভালোই আছে।

সাব্বির বললো—মন ভালো থাকলে আমাদের একটা হাসির গল্প শুনাতে হবে। দিলু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে গল্প শুরু করলো—পরীক্ষায় গরু সম্পর্কে রচনা এসেছে। সবাই লিখছে। একটি ছেলে বললো—স্যার জহির নকল করছে। স্কুলের মাঠে একটা গরু বাঁধা আছে। জহির জানালা দিয়ে গরুটা দেখছে আর লিখছে। ওসমান সাহেব ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলেন। মদ্যপানজনিত কারণে তিনি ইষৎ তরল অবস্থায় আছেন। ছোট ছোট হাসির ব্যাপারগুলো তাঁর কাছে অসাধারণ মনে হলো।

আরেকটা বলতো মা দিলু।

ইতিহাসের স্যার প্রশ্ন করলেন—আচ্ছা বলতো শেরশাহ কোথায় মারা গেছেন? ছাত্র বললো—ইতিহাস বইতে স্যার। পনেরো পাতায়।

রেহানার মনে হলো তার এই মেয়েটি একটু অন্যরকম হয়েছে। কারো সঙ্গেই ঠিক মেলে না। একটু যেন আলাদা। নিশাত বললো, দু’টি গল্পই জামিল ভাইয়ের কাছ থেকে শোনা তাই না?

হ্যাঁ। তাতে কোন অসুবিধা আছে?

দিলু একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে যেন সে সত্যি জবাবটি শুনতে চায়। সাব্বির বললো—এক কাপ চা খেতে পারলে মন্দ হতো না। কেউ কি কষ্ট করে চা বানাবে?

নিশাত উঠে দাঁড়ালো—আমি বানাবো। দিলু, তুই আয়তো আমার সঙ্গে, একা একা ভয় লাগে।

 

কেটলিতে চায়ের পানি ফুটছে। নিশাত এবং দিলু বসে আছে চুপ-চাপ। দিলুর মুখ থমথম করছে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে কিছুক্ষণের মধ্যে কাঁদবে। নিশাত বললো—তুই চা খাবি নাকি দিলু?

না।

আয় আমরা বরং কফি খাই। ইনসটেণ্ট কফির পটটা কোথায় দেখেছিস?

আপা, আমি কফি খাব না। তুমি কি বলবে বল।

আমি আবার কি বলব?

কিছু একটা বলবার জন্যেই আমাকে রান্নাঘরে এনেছ। এখন বল কি বলবে।

দিলু, তুই কি রাগ করেছিস?

দিলু চুপ করে রইলো।

নিশাত বললো, চল দু’জনে দু’কাপ চা নিয়ে পুকুর ঘাটে বসি। যা, গরম চাদর একটা গায়ে জড়িয়ে আয়।

তুমি কি ওখানে নিয়ে আমাকে কিছু বলতে চাও?

আয় না গিয়ে বসি, তারপর বলা যাবে। যা চাদর-টাদর কিছু একটা গায়ে দিয়ে আয়।

দিলু উঠে গেলো। লাল রঙের একটা শাল বের করে গায়ে দিলো। কাঁচঘরের পাশে জামিল সিগারেট টানছে। সে উঁচু গলায় বললো—কোথায় যাচ্ছিস রে?

দিলু জবাব দিলো না। জামিল ভাই তুই বললে সে আর জবাব দেবে না। জামিল বললো—দিলু কোথায় যাচ্ছ?

পুকুর ঘাটে।

একা একা? একটু সাবধানে থাকবে।

কেন?

ভূত আছে।

আপনার মাথা আছে।

জামিল শব্দ করে হাসলো—তুমি চাইলে আমি সাহস দেবার জন্যে সঙ্গে থাকতে পারি।

সাহস দিতে হবে না।

 

পুকুর ঘাটটি বড় বেশী নির্জন। মাঝে মাঝে হাওয়া আসে, গাছের পাতায় সরসর শব্দ হয়। ক্রমাগত ঝিঁঝিঁ ডাকে আবার কোন এক বিচিত্র কারণে হঠাৎ ঝিঁঝিঁর ডাক বন্ধ হয়ে চারদিকে সুনশান নীরবতা নেমে আসে। নিশাত বললো—একটু যেন ভয় ভয় লাগেরে।

ফিরে যাবে?

নাহ্‌, বস।

তারা বসলো। নিশাত ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললো। দিলু বললো—আপা, তুমি কি বলতে চাও বল। নিশাত চাপা স্বরে বললো—আমার যখন তোর মত বয়স তখন জামিল ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। জামিল ভাইরা তখন আমাদের পাশের বাসায় থাকতেন। মগবাজারে।

আপ, আমি জানি।

না, সবটা তুই জানিস না। তারপর কি হলো শোন। চৌদ্দ-পনেরো বছর বয়সটাতো খুব খারাপ। সেই বয়সে কাউকে ভালো লাগলে সেটা যে কত তীব্র হয় তা তুই বুঝতে পারছিস কিছুটা। পারছিস না?

দিলু তাকিয়ে রইলো, কিছু বললো না। নিশাত বললো—অল্প বয়সের ভাল লাগার অনেক রকম ব্যাপার আছে। যখন কলেজে উঠলাম তখন লক্ষ্য করলাম জামিল ভাইকে আর ভালো লাগছে না। এরকম হয়। বি. এ. পড়বার সময় বিয়ে হয়ে গেলো। যার সঙ্গে বিয়ে হলো সে জামিল ভাইয়ের ছোটবেলার বন্ধু।

এসব তো আপা আমি জানি।

সবটা জানিস না। শোন মন দিয়ে। তোর দুলাভাই একজন চমৎকার মানুষ ছিলেন। পৃথিবীর যে কোন মেয়ে তাকে বিয়ে করে সুখী হতে পারতো। কিন্তু আমি হইনি। আমার সারাক্ষণই জামিল ভাইয়ের কথা মনে হতো।

নিশাত চোখ মুছলো। দিলু বললো—আমাকে এসব শুনাচ্ছ কেন আপা?

জানি না কেন।

আমার এসব শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না।

নিশাত চুপ করে রইলো। কাছেই কোথাও সরসর শব্দ হচ্ছে।

দিলু বললো—চলো আপা ঘরে যাই।

আরেকটু বস। তোকে একটা মজার গল্প বলি। ক্লাস টেনে উঠলাম যেবার সেবার আমি আর জামিল ভাই মিলে ঠিক করলাম পালিয়ে যাব।

কোথায় পালিয়ে যাবে?

সে সব কিছু ঠিক হয়নি। ঐ বয়সে ভেবে চিনতে তো কিছু কখনো করা হয় না। ভেবে চিনতে কাজ করতে পারলে এত ঝামেলা হয়?

নিশাত হাসতে চেষ্টা করলো।

গল্প উপন্যাসের মত সত্যি সত্যি একদিন স্কুলে যাবার নাম করে চলে গেলাম কমলাপুর রেল স্টেশন।

তোমরা যাও নি নিশ্চয়ই?

না জামিল ভাই আসেন নি।

ভালোই করেছ যাওনি।
না ভাল করিনি। এখন তার জন্যে মনে একটা কষ্ট আছে আমার।

দিলু ছোট্ট করে বললো—তুমি কি জামিল ভাইকে বিয়ে করতে চাও?

নিশাত জবাব দিলো না। দিলু দ্বিতীয়বার বললো—তুমি কি জামিল ভাইকে বিয়ে করতে চাও?

হ্যাঁ। মনে হচ্ছে চাই।

দিলুর মনে হলো নিশাত কাঁদছে। গলার স্বর যেন ভাঙা ভাঙা। নিশাত খুব শক্ত মেয়ে। সে কি সত্যি সত্যি কাঁদবে? বিশ্বাস হয় না। দিলু মৃদুস্বরে বললো—জামিল ভাইকে কিছু বলেছ?

না

বল তাকে। তিনি তোমার জন্যেই আসেন।

নিশাত দিলুকে বুঝতে চেষ্টা করলো। শান্ত ভাবলেশহীন মুখ। লজ্জুল চোখ। বড় মায়াবতী চেহারা দিলুর।

নিশাতের মনে হলো আজ ঠিক এই মুহূর্তে দিলুর বয়স অনেকখানি বেড়ে গেছে।

লেবু ফুল ফুটছে কোথাও, মিষ্টি গন্ধ আসছে। গাঢ় অন্ধকার চারদিকে। নিশাত ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো—বেঁচে থাকা বড় কষ্ট।

আপা, চল যাই। শীত লাগছে।

আরেকটু বস? প্লীজ।

তারা দু’জন বসে রইলো প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত। এক সময় হাতে টর্চ নিয়ে তাদের খুঁজতে এলো জামিল—পানিতে ডুবে গেছো কিনা তাই দেখতে এলাম। মনে হচ্ছে ঠিক মতই আছ। কাজেই ডিস্টার্ব না করে চলে যাচ্ছি। শুধু একটা জিনিস তোমরা মনে রাখবে এ বাড়িতে ভূত আছে। ঠাট্টা না সত্যি।

নিশাত কিছু বললো না। দিলু বললো—জামিল ভাই, আপনি বসুন এখানে। আপা কি যেন বলবেন আপনাকে। টর্চটা দিন। আমি চলে যাই।

যেতে পারবে একা?

পারব।

দিলু যেতে যেতে থমকে পিছনে ফিরে তাকালো। অন্ধকারে জামিল ভাইয়ের জ্বলন্ত সিগারেট উঠানামা করছে। এর বাইরে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। কত কাছাকাছি বসে তারা দু’জন। নিশাত আপা যদি আজ বলে—জামিল ভাই চলুন আজ সারারাত আমরা গল্প করি তাহলে জামিল ভাই কি বলবেন?

 

রাত অনেক হয়েছে। ওসমান সাহেবের ঝিমুনি ধরে গেছে। তিনি উঠবো করছিলেন কিন্তু আবার ঠিক উঠতেও চাচ্ছিলেন না।

দিলু একসময় এসে দাঁড়ালো তার পাশে।

ঘুমোসনি মা?

না বাবা।

কোথায় ছিলি?

পুকুর ঘাটে বসেছিলাম আপার সঙ্গে। বাবা, আমি তোমার পাশে একটু বসি?

ওসমান সাহেব হাত বাড়িয়ে পাশের চেয়ারটি টানতে গেলেন। দিলু বললো—বাবা, আমি তোমার সঙ্গে বসবো। আমাকে একটু জায়গা দাও। ওসমান সাহেব সরে জায়গা করে দিলেন। নরোম স্বরে বললেন, দিলু তোর কি হয়েছে?

বাবা, আমার বড় কষ্ট!

কিসের কষ্ট?

জানি না বাবা।

ওসমান সাহেব মেয়েকে জড়িয়ে ধরে তাঁর মনে হলো দিলু কাঁদছে। কিন্তু দিলু কাঁদছিলো না।

ওসমান সাহেব ভরাট গলায় বললেন—যাও মা ঘুমুতে যাও। ঠাণ্ডা হওয়া দিচ্ছে শরীর খারাপ করবে।

 

রেহানা বাবুকে ঘুম পাড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে শুয়েছিলেন। দিলুকে দেখে বললেন—তোর কি শরীর খারাপ? তোকে এমন লাগছে কেন?

শরীর ভালই আছে।

নিশাত কোথায়?

পুকুর ঘাটে।

রেহানা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন-এত রাতে একা একা সেখানে কি করছে?

একা একা না মা। জামিল ভাই আছেন।

রেহানা উঠে বসলেন। তাঁর ধারণা ছিলো জামিলকে নিশাত সহ্য করতে পারে না। তিনি কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও জিজ্ঞেস করলেন না। দিলু বললো—মা আমি তোমার পাশে একটু শুয়ে থাকি?

দিলু মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো। ফিস ফিস করে বললো—নিশাত আপার সঙ্গে জামিল ভাইয়ের বিয়ে হলে ভালই হবে মা।

কি বলছিস বিড়বিড় করে। পরিষ্কার করে বল।

কিছু বলছি না মা।

দিলু আরো শক্ত করে মাকে জড়িয়ে ধরলো। চারিদিকে আবছা অন্ধকার। ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে। শীতের হিমেল হাওয়া। বাবু ঘুমের মধ্যেই কেঁদে উঠলো। একটা টিকটিকি ডাকলো—টিক টিক টিক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *