গাড়িতে গুছিয়ে বসতে বসতে ন’টা বেজে গেলো। প্রথম কথা হয়েছিলো একটিতে যাবে শুধু মালপত্র। অন্য দু’টির একটিতে জামিল ও সাব্বির এবং আরেকটিতে দিলুরা। কিন্তু নিশাত বললো, আমি মা, বাবুকে নিয়ে একটি গাড়িতে একা যেতে চাই।
কেন?
কোন কেন-টেন নেই। এমনি যেতে চাই।
সব সময় তুই একটা ঝামেলা করতে চেষ্টা করিস।
ঝামেলা করতে চেষ্টা করি না। কমাতে চেষ্টা করি। আমি মা একা যেতে চাই।
নিশাত শেষ পর্যন্ত অবশ্যি একা একা গাড়িতে উঠেনি। রেহানা উঠেছেন তার সঙ্গে। প্রথম গাড়িটিতে বাবা, দিলু ও বাবু। মহিষের গাড়িটিতে জামিল ও সাব্বির।
গাড়ি চলা শুরু করা মাত্রই সাব্বির মাথার নিচে একটা হ্যাণ্ড ব্যাগ দিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়লো। জামিল বললো—কি, ঘুমুচ্ছেন নাকি?
হ্যাঁ। রাতে ভাল ঘুম হয়নি।
এই ঝাঁকুনিতে ঘুম হবে?
হবে। আমার অভ্যেস আছে।
ঘুমুবার আগে একটা সিগারেট খাবেন?
জ্বি না, আমি সিগারেট খাই না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সাব্বির ঘুমিয়ে পড়লো। জামিল একটা সূক্ষ্ম ঈর্ষা বোধ করলো। এত সহজে কেউ অমন ঘুমিয়ে পড়তে পারে? একা বসে থাকা ক্লান্তিকর ব্যাপার। নেমে গিয়ে প্রথম গাড়িটিতে উঠা যেতে পারে। সেখানে সিগারেট খাওয়া যাবে না এই একটা ঝামেলা। তাছাড়া সঙ্গী হিসাবে ওসমান সাহেব বেশ বোরিং হবেন বলেই তার ধারণা। লোকটির রসবোধ নেই। অফিসের বাইরে যে আরো কিছু থাকতে পারে তা খুব সম্ভব তিনি জানেন না।
এক সময় জামিলের মনে হলো এখানে আসা কি সত্যি দরকার ছিলো? মানুষ বেড়াতে যায় ফূর্তি করবার জন্য। এখানেও কি সে রকম কিছু হবে? সম্ভাবনা খুব কম। জামিল গাড়োয়ানের পাশে এসে বসলো। রাস্তায় ধুলো উড়ছে। গরুর গাড়ি খুব ধীরে চলে বলে যে ধারণা আছে সেটা ঠিক নয়। বেশ দ্রুতই চলছে। গান শুনতে শুনতে যেতে পারলে হতো। কিন্তু ক্যাসেট প্লেয়ারটি নিশাতদের সঙ্গে। ওদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে আসবে নাকি?
নিশাতের নাক ভার হয়ে আছে। মাথায় একটা ভোঁতা যন্ত্রণা। সে বললো—মা, তোমার কাছে প্যারাসিটামল আছে?
আছে। তোর জ্বর নাকি?
না সর্দি। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে।
রেহানা তার গায়ে হাত দিলেন—গা তো বেশ গরম। শুয়ে থাক।
শুয়ে থাকতে হবে না। তুমি দু’টি ট্যাবলেট দাও।
পানি তো নাই। পানির বোতল পেছনের গাড়িতে।
পানি লাগবে না। তুমি দাও।
রেহানা দু’টি ট্যাবলেট দিলেন। নিশাত একটুও মুখ বিকৃত করলো না। ট্যাবলেট দু’টি গিলে ফেললো।
শুয়ে থাক।
আমার শুয়ে থাকার যখন প্রয়োজন হবে আমি শুয়ে থাকব। তোমার বলতে হবে না।
তুমি এত রেগে আছিস কেন?
নিশাত মায়ের চোখে চোখ রেখে শীতল গলায় বললো—সাব্বির সাহেব আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে কেন? ঠিক করে বল তো মা।
বেড়াতে যাচ্ছে, আবার কেন? ও বাংলাদেশের অনেক ছবি তুলে নিতে চায়। আমরা গ্রামের দিকে যাচ্ছি শুনে সেও আগ্রহ করে যেতে চাইলো।
না, সে কোন আগ্রহ দেখায়নি। তুমি ঝুলাঝুলি করছিলে।
যদি করেই থাকি তাতে অসুবিধা কি? আমাদের আত্মীয়, এতদিন পর দেশে এসেছে। ঘুরে-ফিরে দেখতে চায়।
আসল ব্যাপার কিন্তু তা নয় মা।
আসল ব্যাপারটা কি শুনি?
তুমি চাচ্ছ ঐ ছেলেটি যাতে আমাকে পছন্দ করে ফেলে। এবং পুরানো দুঃখ-কষ্ট ভুলে আমি তাকে বিয়ে করে ফেলি।
যদি চেয়েই থাকি সেটা কি খুব অন্যায়?
হ্যাঁ অন্যায়। তুমি যা ভাবছ সেটা ঠিক নয়।
আমি কি ভাবছি?
তুমি ভাবছ আমার স্বামী নেই। একটা বাচ্চা আছে, কাজেই আমার একটা অবলম্বন দরকার। এটা মা ঠিক না। আমি তোমাদের বিরক্ত করব না, আমি নিজের দায়িত্ব নিজে নেব। অনেকবার তো তোমাদের বলেছি।
নিশাত দেখলো জামিল এগিয়ে আসছে। সে চুপ করে গেলো।
ক্যাসেট প্লেয়ারটা তোমাদের কাছে?
জ্বি না, দিলুর কাছে।
জামিল এগিয়ে গেলো। সামনের গাড়িটি অনেক দূর চলে গেছে। নিশাত দেখলো জামিল দৌড়াতে শুরু করেছে। এই দৃশ্যটি তার কেন জানি ভালো লাগলো। রেহানা বললেন—জামিলকে বলে দে পানির বোতলটা নিয়ে যাক।
কেন?
অষুধ খেয়ে তোর মুখ তেতো হয়ে আছে না?
মা, আমার জন্যে তোমাকে এত ভাবতে হবে না।
দিলু ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছিলো। ওসমান সাহেব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন তিনি দিলুর কথা বেশ মন দিয়ে শুনছেন এবং তাঁর ভালোই লাগছে।
সোগাগী নাম কেমন করে হয়েছে শুনবে বাবা?
বল শুনি।
আমার দিকে তাকাও বলছি। অন্যদিকে তাকিয়ে আছ কেন?
ওসমান সাহেব মেয়ের দিকে তাকালেন। দিলু হাত নেড়ে নেড়ে গল্পটা বললো। ওসমান সাহেব বললেন—এই জাতীয় মীথ প্রায় সব পুকুর সম্পর্কেই থাকে। এটা ঠিক নয়। একটা নির্দিষ্ট গভীরতায় মাটি কাটলেই পানি আসবে। শীতের সময় যদি নাও আসে বর্ষার সময় বৃষ্টির পানি ভরে যাবে। দিলুর মন খারাপ হলো। গল্পটা তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হচ্ছে। ওসমান সাহেব বললেন—রাজার মেয়ের নাম সোহাগী এটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়।
বিশ্বাসযোগ্য নয় কেন?
রাজাদের মেয়ের এমন সাধারণ নাম থাকে না। ওদের গালভরা নাম থাকে। ফুলকুমার, রূপকুমারী, নূরজাহান, নূরমহল।
দিলুর মন বেশ খারাপ হলো। সে মুখ ফিরিয়ে বাইরে তাকালো এবং অবাক হয়ে দেখলো জামিল ভাই আসছেন।
ক্যাসেট প্লেয়ারটা তোর কাছে?
হ্যাঁ।
ওটা নিতে এসেছি।
জামিল গরুর গাড়ীর পেছনে পা ঝুলিয়ে বসলো।
দিলু, ভালো দেখে কয়টা ক্যাসেট দে।
রবীন্দ্র সঙ্গীত?
না হিন্দী-ফিন্দী।
দিলু ক্যাসেট বাছতে বাছতে বললো—বাবা কিন্তু সোহাগী পুকুরের গল্পটা বিশ্বাস করেন নি। বাবা বলছেন মাটি কিছু দূর খুঁড়লেই পানি আসবে।
এটা ঠিক নয়। ঢাকা আর্ট কলেজে একটা বিরাট পুকুর আছে। খুব গভীর। বর্ষাকালে পর্যন্ত সেখানে এক ফোঁটা পানি থাকে না।
সত্যি?
হ্যাঁ। এবং অমাবশ্যা-পূর্ণিয়ায় কেউ যদি সেই পুকুরে নামে তাহলে খিলখিল হাসির শব্দ শোনে।
ওসমান সাহেব পাইপে তামাক ভরতে ভরতে বললেন—জামিল, সত্যি নাকি?
পুকুরে পানি নেই বর্ষাকালেও এটা সত্যি, আমি নিজে দেখেছি। তবে হাসির কথাটা জানি না, ওটা বানানোও হতে পারে।
দিলু বললো—আমাকে ঐ পুকুরটা দেখাবেন?
একদিন গিয়ে দেখে এলেই হয়। তোদের বাসার কাছেই তো।
জামিল ক্যাসেট প্লেয়ার নিয়ে নেমে গেলো। দিলু বললো—জামিল ভাই অনেক কিছু জানে। ওসমান সাহেব জবাব দিলেন না।
জামিল ভাই, আমাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করেছিলো, সেটা দারুণ মজার, তোমাকে জিজ্ঞেস করব?
কর।
আচ্ছা মনে কর তোমার কাছে দশ সের পানি দেয়া হলো। এখন তুমি কি পারবে এই দশ সের পানি একবার এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিতে। বালতি টালতি কিছু ব্যবহার করতে পারবে না। শুধু হাত দিয়ে নেবে এবং একবারে নেবে।
ওসমান সাহেব ভ্রু কুঁচকে ভাবতে লাগলেন। দিলু মিটি মিটি হাসতে হাসতে বললো—খুব সহজ বাবা। চেষ্টা করলেই পারবে। একটু হিন্টস দেব?
না হিন্টস দিতে হবে না।
ওসমান সাহেব সত্যিই গভীরভাবে চিন্তা করতে শুরু করলেন।
জামিল নিজের গাড়িতে ফিরে এসে দেখে সাব্বির উঠে বসেছে। ক্যামেরা নিয়ে কি সব যেন করছে।
কি ঘুম হয়ে গেলো?
হ্যাঁ।
কি করছেন?
একটা ব্লু ফিল্টার লাগাচ্ছি।
ব্লু ফিল্টার দিয়ে কি হয়?
দিনের বেলা ছবি তুললে মনে হয় জ্যোৎস্না রাত্রিরে ছবি তোলা হয়েছে।
আপনি নিজে তো একজন ইন্জিনিয়ার?
জ্বি।
আপনাকে দেখে মনে হয় ছবি তোলাই আপনার একমাত্র কাজ।
এটা আমার একটা হবি।
খুব বড় ধরনের হবি মনে হচ্ছে?
সাব্বির শান্ত স্বরে বললো—আমি কিন্তু খুব নামকরা ফটোগ্রাফার। আমার নিজের তোলা ছবি নিয়ে আমেরিকান এক পাবলিশার একটি বই বের করেছে, নাম হচ্ছে—অন দি টপ অব দি ওয়ার্লড।
আপনার কাছে কপি আছে?
আছে, দিচ্ছি।
সাব্বির আহমেদ তিনশ পৃষ্ঠার একটি বই বের করলো তার স্যুটকেস থেকে। জামিলের বিস্ময়ের সীমা রইলো না।
এই বইটির কথা কি দিলুরা জানে?
না। নিজের কথা বলতে ভাল লাগে না।
সাব্বির ছবি তুলতে শুরু করলো। ক্যামেরার শাটার পড়ছে। কোন কিছু যে সে দেখছে মন দিয়ে তা মনে হচ্ছে না।
একটা গ্রাম্য বধু লম্বা ঘোমটা মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শাটার পড়তে লাগলো ঘটাঘট।
ছাগলের গলার দড়ি ধরে একটা আট-ন’ বছরের বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে। ঘটাঘট শাটার পড়তে শুরু করলো। জামিল বললো—এই ছবিটা আপনার ভাল হবে না। জোছনা রাতে কেউ ছাগল চড়াতে বের হয় না। আপনি বরং ব্লু-ফিল্টার বদলে নিন।
সাব্বির হালকা গলায় বললো—উল্টোটাও হতে পারে। ছবি দেখে মনে হতে পারে রাতের রহস্যময়তায় মুগ্ধ হয়ে একটা শিশু তার পোষা প্রাণীটি নিয়ে বের হয়েছে। দু’জনের চোখেই বিস্ময় ও ভয়, তাদের ঘিরে আছে জোছনা।
আপনি কি ফটোগ্রাফার না কবি?
আমি একজন ইন্জিনিয়ার।
জামিল বইটির পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললো—আপনার এই বইটিতে তো মানুষের কোন ছবি নেই। শুধুই জড়বস্তুর ছবি। মানুষের ছবি বেশী তোলেন না?
আমার অন্য একটি বইয়ে মানুষের ছবি আছে। সবই অবশ্যি ‘নূড’ ছবি।
বইটি আছে?
আছে।
আমেরিকায় আপনি কতদিন ধরে আছেন?
প্রায় এগারো বছর।
দেশে ফিরবেন না?
না।
কেন?
থাকবার জন্য ঐ জায়গাটি ভালো। বিশাল দেশ ঘুরে বেড়ানোর চমৎকার সুযোগ। এরকম পাওয়া চায় না। তাছাড়া…।
তা ছাড়া কি?
সাব্বির কথা শেষ করলো না। মাঠের দিকে চোখ ফিরিয়ে বললো—এগুলি সর্ষে ফুল না? হলুদ রঙের কি চমৎকার ভেরিয়েসন।