আমাদের সম্ভাবনাময়ী মেয়েরা

আমাদের সম্ভাবনাময়ী মেয়েরা

আজ থেকে মাত্র ৩০-৪০ বছর আগেও গ্রামের কোনো মেয়ে যদি সুলে যেত, সেটা ছিল এক বিস্ময়! সমাজের কাছে দৃষ্টিকটু। মানুষের সমালোচনার বিষয়। অথচ আজ যদি নিরেট গ্রামেরও। কোনো মেয়ে স্কুলে না যায়, সেটাই অবাক হওয়ার বিষয়। মেয়েটা স্কুলে যাচ্ছে না–সেটাই বিস্মিত হওয়ার বিষয়। বাংলাদেশের এমন কোনো গ্রাম খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে মেয়েদের স্কুলে যেতে নিরুৎসাহিত করা হয়। আমার কাছে, স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন নারীশিক্ষায় জাগরণ!

আমার মা স্কুলে যেতে পারেননি। অথচ আমি তার ভেতর শিক্ষার তাড়না দেখেছি। তার বুদ্ধিদীপ্ত কথা, ভাবনা আমার বহু মৌলিক শিক্ষার সঙ্গে গেঁথে আছে। পড়াশোনার জন্যে সারাটা জীবন কী তাড়াটাই না আমাকে দিয়েছেন তিনি। আমাদের দেশটাতে এমন লাখো মা, যারা কোনো দিন স্কুলে যাননি, অথচ তাদের ভেতর লুকিয়ে ছিল কত কত প্রতিভাবান, বুদ্ধিদীপ্ত, বিদুষী নারী। নপোলিয়ান বলেছিলেন, আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে একটি শিক্ষিত জাতি দেব।

শিক্ষার পাশাপাশি এখন প্রয়োজন মেয়েদের ভেতর শক্তি গানো। তাদের ভেতর আত্মবিশ্বাস জোগান দেওয়া। আমাদের অসংখ্য মেয়ে এখনো যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী না। এখনো। পারিবারিকভাবে বহু মেয়েকে মানসিক শক্তিটুকু দেওয়া হয় না। সাহসটুকু জোগানো হয় না। এই সাহসটুকু জোগাতে হবে শৈশব থেকেই। একটি মেয়ে যেন কখনো ভাবতে না পারে, মেয়ে বলেই তার দ্বারা বিজ্ঞানী হওয়া সম্ভব নয়। মেয়ে বলেই তার দ্বারা পর্বতজয়ী হওয়া সম্ভব নয়। মেয়ে বলেই তার দ্বারা ডুবুরি হওয়া সম্ভব নয়। পারিবারিকভাবে একটি মেয়েকে একটি ছেলের মতোই সব ধরনের সাহস, শক্তি ও সাপোর্ট দিতে হবে। গ্রামের অসংখ্য পরিবার মেয়েদেরকে শিক্ষিত করে ভালো বিয়ে দেওয়ার জন্য। এমন অনেক দুর্বল ভাবনা গেঁথে আছে প্রান্তিক সমাজে। এগুলো থেকে মুক্তির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়িত্ব নিতে হবে। শুধু যে পড়াশোনাতেই তাদের ভালো করতে হবে, তা নয়। তারাও যেকোনো কাজ করে সফল হওয়ার কথা ভাবতে পারে। তারা হতে পারে ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, আলোকচিত্রী, খেলোয়াড়, খামারি ইত্যাদি যেকোনো কিছু।

আমাদের মেয়েদের নবাব ফয়জুন্নেছার গল্প শোনান, যিনি প্রায় দেড় শ বছর আগে নারী শিক্ষার কথা ভেবে মেয়েদের জন্য ভারতবর্ষের অন্যতম পুরোনো প্রতিষ্ঠান গড়েছিলেন। সে প্রতিষ্ঠানের নাম কুমিল্লা ফয়জুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয়। অথচ সে সময় বাঙালি মুসলিম সমাজেই শিক্ষার আলো ছিল যথেষ্ট ক্ষীণ। আমাদের মেয়েদেরকে নবাব ফজিলেতুন্নেছার গল্প শোনান, যিনি প্রায় এক শ বছর আগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে প্রথম। শ্রেণিতে প্রথম হয়ে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন পিএইচডি করতে। তাদেরকে প্রীতিলতার গল্প শোনান। শতবর্ষ আগে যিনি। দেশরক্ষায় নেমেছিলেন রণক্ষেত্রে। তাদেরকে দুনিয়াখ্যাত নারীদের গল্প শোনান। তাদের ফাতিমা আল ফিহরির গল্প শোনান, যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন। বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের মেয়েদের বিজ্ঞানী মারিকুরি, লিসামাইটনার, ডরথি হজকিনের গল্প শোনান। দুনিয়া জয়ের চ্যালেঞ্জটুকু নেওয়ার সাহসের দানা বাঁধুক তাদের কোমল মনে।

আমাদের মেয়েদের এখন বিশ্বজয়ের স্বপ্ন নিয়ে নামতে হবে। তারা গণিত অলিম্পিয়াড, বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে সোনা জয় করবে। তারা গবেষণা করবে। উদ্ভাবন-আবিষ্কারে পৃথিবীর চ্যালেঞ্জ নেবে। তারা খেলোয়াড় হবে। ডুবুরি হবে। নভোচারী হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন শৈশব থেকেই তাদের প্রস্তুত করা। ঘরে, স্কুলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সাহস দেওয়া। এখনো আমাদের দেশের বহু মেয়ে অবিবাহিত বলে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে পারে না। বহু পরিবার চায়, বিয়ে করে স্বামীকে নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাবে! অন্যদিকে বহু বিবাহিত নারী, স্বামী-সংসারের সাপোর্ট না থাকায় উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন না। আজ হোক, কাল হোক, এ ধরনের প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতেই হবে। নারীর মেধা ও শৌর্য নিয়ে সামাজিক যে হীন ধারণা, সেটা বদলাতে হবে। আমাদের সবার প্রিয় দেশটাকে যদি আমরা পৃথিবীর মঞ্চে দেখতে চাই, তাহলে নারীকে কোনোভাবেই পুরুষের চেয়ে মেধায়, মননে ও সাহসিকতায় ছোট করে দেখলে হবে না। মনে রাখতে হবে, আমাদের নারীরা, আমাদের পুরুষদের সমসম্ভাবনাময়ী।