আমাদের সংসার

আমাদের সংসার

শীত না এলেও বেলা বেশ ছোট হয়ে গেছে। পাঁচটা বাজতে না বাজতেই দিনের চোখ বুজতে শুরু করে। ছটার মধ্যেই দিন বিছানা নিয়ে নিল। ছটা বাজা মাত্রই মোহনলালবাবু বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ার তাল খোঁজেন। বাড়িতে শুরু হয়ে যাবে পেটাই সেশান। দোতলায় বসে বসেই তিনি শুনতে পেলেন, একতলায় শুরু হয়ে গেছে তর্জন-গর্জন। মা বসেছে বছর চারেক বয়সের মেয়েটিকে পড়াতে। মা হল মোহনলাল-এর পুত্রবধূ; মেয়েটি হল শিউলির মতো সুন্দর নাতনি। মোহনলালের এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। সে চলে গেছে নিজের সংসারে। ছেলের বিয়ে দিয়ে মোহনলালবাবুকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে জীবনসঙ্গিনী ময়ূরপঙ্খী চেপে পান জরদা চিবোতে-চিবোতে স্বর্গে সরে পড়েছেন, বৈতরণীর পরপারে। যাওয়ার সময় বলে গেছেন, সারা জীবন বহুত জ্বালিয়েছ বুড়ো। এইবার বুঝবে কত ধানে কত চাল। বাড়িতে ইংলিশ মিডিয়াম বসিয়ে গেলুম। অ-এ অজগরের দিন শেষ।

পুত্রবধূটি অবশ্যই মনোরম। কলেজ-সঙ্গিনীদের মধ্যে থেকে তাঁর ছেলে বাছাই করে এনেছিল। একগাদা ছেলে আর একগাদা মেয়ে দিনের পর দিন এক জায়গায় মেলামেশার ফলে যা হয়! একটা কম্বিনেশান তৈরি হয়। ক-এর সঙ্গে ঙ—আর ঝ-এর ঞ-অর। প-এর সঙ্গে রফলার। এইরকম আর কী! ছেলের চেখের তারিফ করেছিলেন মোহনলাল। তাঁর বংশে এতকাল প্রায় সবাই ছিলেন মাটো সুন্দরী। পুত্রবধূটি প্রকৃত সুন্দরী। শ্বশুর হয়ে পুত্রবধুর রূপের প্রশংসা না করাই উচিত। দিনকাল সুবিধের নয়। লোকে অন্যরকম ভাববে। আজকাল নিজের ছোট্ট নাতনিটাকে নিয়ে রাস্তায় বেরোতে ভয় করে। লোকে ছেলেধরা বলে পিটিয়ে ভবসাগর পার করিয়ে দেবে। পুত্রবধূর কাঁধে হাত রেখে গঙ্গার ধারে বেড়াতে গেলে পুলিশ খুনের আসামি ধরতে না পারুক বুড়োকে ধরে নিয়ে হাজতে ভরে দেবে। ফুর্তি হচ্ছিল? সেদিন কে যেন নিন্দের গলায় বলছিল, অমুকের কথা আর বোলো না, ধর্ম ধর্ম করে নষ্ট হয়ে গেল। যে বলছিল তার দুটো ব্যামোই আছে মদ আর মেয়েছেলে। একালে ধর্মের নিন্দা, অধর্ম আর পাপের প্রশংসা।

 পেটাই সেশান মানে, বউমা তার কন্যাটিকে পড়াতে বসবে। শুরুটা হবে পাঁচ দিনের ক্রিকেটের ওপনিং ব্যাটসম্যানের মতো। ঠুস ঠাস। বই খোলা। পেনসিল কোথায়? পেনসিল! এই পেনসিল এক মারাত্মক জিনিস। মশা যেমন এক চাপড়ে মরার জন্যে জন্মায়, পেনসিল সেই রকম হারিয়ে যাওয়ার জন্যে জন্মায়। কোথায় পেনসিল? মেজাজ চড়ছে। রোজ রোজ একটা করে পেনসিল হারিয়ে আসবে বাঁদর মেয়ে। আমি জানি না, যেখান থেকে পারো পেনসিল বের করো। সার্চ আউট দি পেনসিল।

বিশাল সমুদ্রে নাবিক কম্পাস হারিয়ে ফেললে মুখের যেমন চেহারা হয় মেয়েটার মুখের সেই চেহারা। ডল পুতুলের মতো দেখতে। একালের ছেলেমেয়েরা খুব সুন্দর হয়ে জন্মায়। মোহনলালদের আমলের মতো নয়। সেই সময় ছেলেগুলো হত বজ্রবাঁটুলের মতো, মেয়েগুলো শাঁকচুন্নির মতো। বেশির ভাগই কালো। একটা-দুটো ফরসা। কালোদের সম্পর্কে সান্ত্বনাবাক্য—কালো জগৎ আলো। কালো মেয়ে সম্পর্কে বিশ্বাস—বড় হলে ফরসা হয়ে যাবে, এতটা কালো থাকবে না।

 সেকালের ছেলেমেয়েদের নামের তেমন বাহার ছিল না। যা হয় একটা রাখলেই হল। পচা, গদাই, কালীর কম্বিনেশানে কত নাম! কালিকিঙ্কর, কালিদাস, কালিশঙ্কর। ছেলের নাম পটল। ভাবা যায়! মেয়ের নাম পটলি। যেমন পটলকে বেসনে ফেলে ভাজা হয়েছে।

একালে নাম রাখার আগে কমিটি বসে। এরা নাতনির নাম রেখেছে সঞ্জনা। পছন্দ এখনও ফাইনাল হয়নি। শোনা যাচ্ছে, ওটাকে পালটে শ্রমণা করা হবে। মোহনলাল নাতনিকে ডাকেন, পুতুল বলে। আদরের সময় বলেন, পুল্লা।

যেখানে এই পাঠপর্ব চলেছে, সেই ডিভানের তলায় মোহনলালের জুতো জোড়া আছে। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেয়ে পুতুল করুণ মুখে তার দিকে তাকাল! তিন বছরের নিষ্পাপ শিশু। ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করল, ‘দাদাইয়া তুমি আমার পেনসিলটা জানো?’

‘তোমার পেনসিল তোমার দাদাইয়া জানবে কী করে!’ মায়ের দাবড়ানিতে পুতুলের জল-টলটলে করুণ মুখ আরও করুণ হয়ে গেল।

মোহনলাল সামান্য একটা পেনসিলের জন্যে কেন এমন দক্ষযজ্ঞ হচ্ছে বুঝতে পারছেন না। আজ শুরুটাই দেখছি বিগড়ে গেল। মোহনলাল বললেন, ‘আমার কাছে একটা পেনসিল আছে দোব এনে?’

পুত্রবধূর নাম মাধুরী। অন্য সময় সত্যিই মাধুরী। হাসছে ঘুরছে রান্না করছে কাজের লোকদের কাজ তদারকি করছে, তাদের গ্রামের গল্প শুনছে; কিন্তু মেয়েকে পড়াতে বসলেই ভয়ংকরী। থমথমে মুখ ধকধকে চোখ। কন্ঠস্বরে সুরেলা সঙ্গীতের বদলে মেঘের গর্জন।

মাধুরী প্রায় ধমকের সুরেই বললে, ‘না আপনি দেবেন কেন ওর পেনসিল, ও খুঁজে বের করবে। দুপুরবেলা ওকে আমি চিবোতে দেখেছি।’

পুতুল ভয়ে ভয়ে বলল, ‘তখন তুমিই তো আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে কোথায় যেন রেখে দিলে।’

গরম চাটুতে জল পড়ল, ‘আমি রেখেছি? আমি রাখলে কোথায় রাখতে পারি? তোর ব্যাগেই রেখেছি। ব্যাগ থেকে সব বের কর।’

মোহনলাল জুতো হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগোচ্ছেন, মাধুরী রাগ রাগ গলায় বললে, ‘এই ভর সন্ধেবেলা যাচ্ছেন কোথায়, একে চোখে কম দেখেন, তায় রাস্তাঘাট খানাখন্দে ভরা।’

মোহনলাল তবু এগোতে লাগলেন দরজার দিকে অটোমেটিক মানুষের মতো। কথাটার মধ্যে ভালোবাসা কতটা আছে বৈষয়িকতা কতটা আছে বলা কঠিন। পৃথিবীটাকে অনেকদিন দেখছেন। দেখতে দেখতে সিনিক হয়ে গেছেন। প্রেমপ্রীতি, শ্রদ্ধা, ভক্তি কিছু আছে কি না কে জানে। একটা কোম্পানিরই মতো। ফেলো কড়ি, মাখো তেল। নিজের ছেলেকে তো দেখছেন। অফিসের বড় কর্তাকে যতটা শ্রদ্ধা, ভক্তি সমীহ করে নিজের বাপকে তার সিকির সিকি করে বলে মনে হয় না। যখন চাকরিতে বহাল ছিলেন তখন হয়তো একটু সমীহ ভাব দেখাত নিজের স্বার্থে। রিটায়ার করার পর একটা প্রশ্ন সাতবার করলে তবে হয়তো দায়সারা একটা উত্তর আসে। কারণ একটাই, তখন তিনি ছিলেন প্রতিপালক, এখন তিনি প্রতিপাল্য। রোজগারটা গেছে, সঙ্গে সঙ্গে খাতিরও কমেছে। যুগও পালটেছে।

দরজার বাইরে রকে দাঁড়িয়ে জুতো পরছেন মোহনলাল। মাধুরী কর্কশ গলায় বলল,

—শুনতে পাচ্ছেন না আমি কী বলছি!

মানুষের একটা কমলে আর একটা বাড়ে। একজিমা কমলে হাঁপানি বাড়ে। ডাক্তাররা যেমন বলেন আর কী। মোহনলালের রোজগার কমেছে সহ্যশক্তি বেড়েছে। মেয়ের বয়সি একটা মেয়ের দাপটে দু:খ পেলেও রাগে ঝলসে ওঠার কোনও কারণ দেখতে পেলেন না। যার ওপর রাগ দেখাতে পারতেন, সে চলে গেছে। মোহনলাল গেটের দিকে এগোতে এগোতে শুনলেন মাধুরী বলছে, ‘আজ আপনার ছেলে আসুক এর একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। পাঁচ জনে পাঁচ কথা বলে যাবে আর আমাদের অকারণে সহ্য করতে হবে। আশ্চর্য ব্যাপার যা হোক।’

 মোহনলাল রাস্তায় পা রেখে মনে মনে হাসলেন। বাচ্চা ছেলেকে জুজুর ভয় দেখায়, বুড়োকে দেখাচ্ছে ছেলের ভয়। বুড়োর ধড় থেকে মুন্ডুটা খসিয়ে দেবে। দিতেও পারে। বড় বড় কোম্পানিতে উচ্চ দাবিকারিকে যেভাবে তাড়ায় সেই ভাবেই হয়তো তাড়াবে। প্রথমে চেয়ারটা সরিয়ে নিলে, তারপর টেবিলটা, শেষমেষ খাঁচাটা। যায় আর আসে, কোনও কাজ করতে দেয় না। শেষে অপমানের হাত থেকে আত্মসম্মান বাঁচানোর জন্যে রেজিগনেশান। সেই কায়দাই শুরু করেছে। সারাদিন দু’চারটের বেশি কথা কেউ বলে না। সাংসারিক ব্যাপারে মাথা ঘামাতে গেলে ভুরুটুরু কুঁচকে বলে, সব ব্যাপারে নাক গলাও কেন, তুমি তোমার লেখাপড়া নিয়ে থাকো না। ঠেলতে ঠেলতে ধাক্কা মারতে মারতে সংসারের বাইরে প্রায় বেরই করে দিয়েছে; এখন ধরে বাড়ির বাইরে করে দেওয়া।

অপ্রয়োজনীয় বলে রাস্তার আলোর ব্যবস্থা উঠে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও ইংরেজ আমলে কালো ঠুলি লাগিয়ে প্রত্যেকটা ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বালান হত। পথঘাট ঝকঝকে তকতকে। দুবেলা জল পড়ত। যাক, দু:খ করে লাভ নেই। টেনিসনের মতো বলাই ভালো, ওলড অর্ডার চেঞ্জেস, ইলভিং প্লেস টু নিউ। পুরোনোর জায়গায় নতুন আসবেই, সে যেমনই হোক না কেন!

বাড়ির অদূরেই একটি লাকসারি বৃদ্ধনিবাস হয়েছে। এর সামনে দিয়েই মোহনলাল রোজ টুকটুক করে হাঁটতে হাঁটতে প্রাচীন একটি কালী মন্দিরে গিয়ে কিছুক্ষণ বসেন। এই অঞ্চলে তাঁর অতীত পড়ে আছে ঝরা শিউলির মতো। আঁচল পেতে একটি একটি করে কুড়িয়ে নিলেই শৈশব, কৈশোর, যৌবন সবই পাওয়া যাবে। রাস্তার দু’পাশে বড় বড় বাগান বাড়ি। অতীতে শোভা ছিল, জমজমা ছিল। জুড়ি গাড়ি ছিল, সুন্দরী রমণী ছিল, মাইফেলের ঘুঙুরের শব্দ উপচে পড়ত। চুনোট করা ধুতি, ফিনফিনে পাঞ্জাবি পরা, পালিশ করা বাবু ছিল। সাধারণ মানুষ দু’হাত তুলে নমস্কার করত, তাঁরা ফিরেও তাকাতেন না। গঙ্গায় সাদা সাদা পানসি চেপে হাওয়া খেতেন। এইসব মানুষদের নিজেদের একটা মহল, ছিল, যেখানে সাধারণ মানুষ পাত্তা পেত না। যেখানে এখন আলো ঝকঝকে বৃদ্ধনিবাস হয়েছে সেখানে ছিল চৌধুরী জমিদারদের মার্বেল প্যালেস। বিশাল শেভ্রলে গাড়ি গেট ফুঁড়ে বেরুত ঢুকত। এঁরা ছিলেন যথেষ্ট শিক্ষিত, সংস্কৃতিমান। কলকাতার কালচারে এঁদের যথেষ্ট অবদান ছিল। সেকালে কংগ্রেসে ভূমিকা নিতেন। পুর্বপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দকে চিকাগো ধর্মসভায় আলোড়ন তোলার জন্যে প্রভূত সংবর্ধনা জানিয়েছিলেন। মোহনলালের শিক্ষক পিতামহ তার সাক্ষী ছিলেন। কালে সবই গেছে। সবই ভূতের বাড়ি। চৌধুরী জমিদারদের সেই মার্বেল অট্টলিকা উপড়ে ফেলে সর্বাধুনিক ডিজাইনের বৃদ্ধ নিবাস হ্যালোজেনের আলোয় ফটফট করছে। প্রতি ঘরে ঘরে জোড়া জোড়া বৃদ্ধ বৃদ্ধা মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। পশ্চিমে গঙ্গা সময়ের স্রোতের মতো বয়ে চলেছে। যেতে যেতে মোহনলাল বাড়িটির দিকে তাকাচ্ছেন। থ্রিস্টার হোটেল যেন। বড়লোকের নির্জনতা বিলাস। আধখানা ঘরের জন্যে জমা একলাখ, মাসে মাসে তেরোশো। মোহনলালের সামর্থ্যের বাইরে। নিজের বাড়িতেই দগ্ধে দগ্ধে মরতে হবে, যেমন একালের বউরা শ্বশুর শাশুড়ি ননদের নিপীড়নে, তিনি কী চান, সে কী চায়, বুঝতে না পেরে তিলে তিলে মরতে থাকে।

রাবিশ সংসার! ভগবান শ্রী রামকৃষ্ণ একেবারে এক কথায় চিরকালের সংসারের চিরসংজ্ঞা দিয়ে গেছেন সংসার যেন আমড়া, সার আঁটি আর চামড়া।

 গোটা পথটাই বেশ নিরিবিলি, নির্জন। পথের শেষে মহাশ্মশান। এই শ্মশানেই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের নশ্বর দেহের সৎকার হয়েছিল। প্রজ্জ্বলিত চিতার সামনে নরেন্দ্রনাথ প্রমুখ ভক্তগণ প্রস্তরীভূত মূর্তি। চিতাভস্ম করে ভেসে গেছে গঙ্গার স্রোতধারায় মহাসমুদ্রের পানে। চিন্তাধারা প্রবাহিত আজও শতগুণ শক্তিতে।

এই পথে চলতে চলতে মোহনলালের মনে হয় পেছন একটি শিশু আসছে। গলায় তিনপাট মাফলার জড়ানো। হাঁটছে আর কাশচে। শিশুটির হাত ধরে আছে এক হিন্দুস্থানী কিশোর। নাম ছিল তার বাবুয়া। শীতের সকাল। ঝলমলে রোদ। গঙ্গার পশ্চিমা বাতাস। বাঁপাশে মল্লিকদের বিশাল বাগান। ক্যাসল টাইপের বৃহৎ ইমারত। ভেতরে নানারকম দুলর্ভ পাখির চিড়িয়াখানা। দামি ম্যাকাও পাখির আকাশ ফোঁড়া ডাক। সঙ্গে কাকাতুয়ার সঙ্গত। আস্তাবলে ঘোড়ার চিহিৎকার। ওয়েলার ঘোড়া। তেলচুকচুকে বাদামি শরীর। দেউড়ির মাথার দুপাশে দুজন মাটির দারোয়ান। হাতে মোটা লাঠি। লাঠির মাথায় আলোকদান। আসলে ও দুটো ছিল কায়দার ল্যাম্প পোস্ট। কৃষ্ণনগরের শিল্পীর কাজ। জীবন্ত। দারোয়ান দুজন কালের সাক্ষী হয়ে আছে আজও। রাতে আর জ্বলে না। নাচমহলে নর্তকী আর নাচে না। বাবুদের ‘হয় হয়’ তারিফ আর ছিটকে আসে। না।

শিশুটি হল মোহনলাল। হিন্দুস্থানী কিশোরটির নাম বাবুলাল। ডাকত সবাই বাবুয়া। সাতসকালে দু’জনে চলেছে, শ্মাশানের কাছে জগৎবাবুর ডাক্তারখানায়। শুদ্ধ, সাত্বিক একটি মানুষ। দুগ্ধ শুভ্র গাত্রবর্ণ। এক মাথা পরিপাটি ভ্রমরকৃষ্ণ চুল। ধবধবে সাদা ধুতি সিল্ক টুইলের ধবধবে সাদা জামা। মানুষ এত সুন্দরও হতে পারে। মোহনলালের খুব সুন্দর হওয়ার শখ ছিল। জগৎবাবু ছিলেন নামকরা হোমিওপ্যাথ। ভীষণ পসার। চেম্বারে দু’বেলা রোগীর লাইন।

বাবুলাল মোহনলালকে ডাক্তারবাবুর সামনে দাঁড় করিয়ে বলত, ‘ডাক্তারবাবু খাসি হয়েছে, উলটি হয়েছে, বোখার থোড়া থোড়া।

ডাক্তারবাবু অনেক বয়স পেরিয়েছিলেন। হিমালয়ে তাঁকে টানত। বছরে একবার সন্ন্যাসীর মতো বেরিয়ে পড়তেন একা। আশি বছরেও একলা পথিক নেমে আসছেন গোমুখের দুর্গম পথ ভেঙে। সাধক ছিলেন। গৃহী সাধক। অপ্রয়োজনে একটি কথাও বলতেন না। বাড়ির নীচেই ছিল চেম্বার। মোহনলাল বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। ঘর আছে ডাক্তার নেই। কোথায় রুগির লাইন। কোথায় সেই জেল্লা! মন্দির আছে বিগ্রহ নেই।

 কেদারের পোড়ো বাগান বাড়ির জরাজীর্ণ গেট ঠেলে মোহনলাল ঢুকলেন। সামনের জমিটুকু পেরিয়ে কেদারের বৈঠকখানা। সামনে প্রশস্ত রক। পরিষ্কার করার বালাই নেই। ঘরের ভেতর পুরোনো পুরোনো একটা গন্ধ। সার সার আলমারিতে ঠাসা পুরোনো বই। সবই আইনের। কেদারের বাবা ছিলেন নামকরা অ্যাডভোকেট। কেদারও অ্যাডভোকেট; কিন্তু আইনে মন নেই। মাথায় সাহিত্য ঢুকেছে। উৎসাহী দু-একজন যুবককে নিয়ে একটা পারিবারিক পত্রিকা বের করে। বৈঠকখানাটা এখন সম্পাদকীয় দপ্তর।

বুড়ো বয়সে তার এই ছেলেমিকে বন্ধুবান্ধবরা উপহাস করেছিল—নেই কাজ তো খই ভাজ। সাহিত্য আর ঘুঁটে দুটোই এক কিসিমের মাল। গ্যাস এসে গেছে, দেয়ালের ঘুঁটে দেয়ালেই সেঁটে আছে। টিভি এসে সাহিত্যকে সমাধিতে পাঠিয়েছে। বড় বড় কাগজ এখন সাহিত্য ধরায় নানা কায়দায়। ভেলপুরি, চাট করে মশলা দিয়ে বাজারে ছাড়ে।

কেদার কারও কথায় কান না দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে বেশ। এখন আবার সবাই উলটো গাওনা গাইছে কেদার কেমন মেতে আছে, আমরা সবাই ভেটকে গেলুম। খাচ্ছি-দাচ্ছি আর নানা রোগের চর্চা করছি। সুগার, আর্থারাইটিস, হাইপার অ্যাসিডিটি, হার্ট।

মোহনলাল কিন্তু কেদারের ব্যাপারটাকে সমর্থন করেন। অলস পরচর্চার চেয়ে ঢের ভালো। কে কবে নাটাগড়ে মৃগেল মাছ ধরেছিল, কার জামাই আমেরিকায় রকেট ওড়ায়, কার পুত্রবধূ সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত বিছানায় পড়ে পড়ে কাজের মেয়েটাকে একের পর এক হুকুম করে যায়, কার ছেলে মাসে লাখ টাকা রোজগার করে, কে ভালো জোলাপ আবিষ্কার করেছে। একেবারে রাবিশ কিছু কথাবার্তা। মৃত্যু-ঘন্টা বাজাচ্ছে, কে কত বছর থাকছে জানা নেই, এখন কী আর নষ্ট করার মতো সময়ের রেস্তো আছে রে ভাই।

কেদারের চেম্বারে পীপুল এসে গেছে। নামটা জবরদস্ত। কে রেখেছিল, হয় দাদু না হয় ঠাকুরদা। সেকালের বৃদ্ধদের নাম রাখার প্রতিভা ছিল অসীম। কেদারের নাকের ডগায় আলো ঝুলছে। এটা সম্পাদকীয় আলো। পরের সংখ্যার কাজ চলছে। সামনে কাগজপত্রের ডাঁই। কেদারের চোখে গোল গুলগুলি চশমা। শখানেক বছর আগের মডেল। পীপুল কী একটা পড়ছে আর খুব হাসছে।

কেদার বললেন, ‘জাস্ট ইন টাইম। তোমার কথাই ভাবছিলুম। প্রশ্নোত্তর বিভাগে অনেক চিঠি এসে গেছে। আমি পড়ছি, তুমি জবরদস্ত উত্তরগুলো বলে যাও। স্বরাজ লিখে নিক। কালই প্রেসে যাবে। লাস্ট ফর্মাটা আটকে আছে।’

কেদার স্বরাজের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এক রাউন্ড চা দিতে বলো।’

চায়ের পরই পীপুলের হুকুম হল, ‘পিলাপতি জরদা দিয়ে একটা পান।’

এই জিনিসটাকে মোহনলাল খুব ভয় পান। ঘণ্টাখানেক কোঁক কোঁক করে হেঁচকি তুলবে। জল খেতে বললে খাবে না। হেঁচকি তোলাতেও সুখ।

মোহনলাল হাসলেন। সত্যিই তো, সহ্যই জীবন। জীবনটাকে সহ্য করতে করতে মৃত্যুর কোলে গিয়ে যন্ত্রণার অবসান।

কেদার বললেন, ‘স্টিম দেওয়া হয়ে গেছে, এইবার ইঞ্জিন চালু করা যাক। আমি প্রথম চিঠিটা পড়ছি।’

‘তোমাকে পড়তে হবে না, আমাকে চিঠিগুলো দাও, আমি ওই কোণের টেবিলে গিয়ে বসি।’

মোহনলাল পড়ছেন আর চটপট উত্তর লিখছেন।

প্রশ্ন : কম খরচে সংসার চালাবার উপায়টা কী?

উত্তর : ঠেলে।

প্রশ্ন : আমার স্ত্রীর সঙ্গে কিছুতেই আমার বনিবনা হচ্ছে না।

উত্তর : প্রকৃত স্ত্রীর সঙ্গে প্রকৃত স্বামীর কোনও কালে, কোনও অবস্থাতেই বনিবনা হতে পারে না। চিরশত্রুর নামই স্ত্রী।

প্রশ্ন : আমি ঝগড়া করে কখনও জিততে পারিনি, অথচ মারামারিতে কেউ আমাকে হারাতে পারে না। ঝগড়ায় জিততে হলে কী করতে হবে!

উত্তর : মহিলা হতে হবে।

প্রশ্ন : আমি যখনই যা খাই ঢেউ ঢেউ ঢেঁকুর। ভদ্রসমাজে লজ্জার। ওষুধেও হচ্ছে না কিছু।

উত্তর : খাওয়ার পর একটা পেপার ওয়েট গিলে ফেলবেন। চিরশান্তি।

প্রশ্ন : আমার মা, আমার পছন্দের মেয়েটিকে কিছুতেই বিয়ে করতে দিচ্ছে না। আমার কী করা উচিত?

উত্তর : বিয়ে করে ঘরে ভরে দিন, মা যথাসময়ে কেটে পড়বেন। অটোমেটিক। শীত গ্রীষ্ম এক জায়গায় থাকতে পারে না। অসম্ভব।

প্রশ্ন : আমার স্ত্রী সবসময় তোলো হাঁড়ির মতো মুখ করে ঘুরে বেড়ায়। আমার বিশ্রী লাগে। কী করব?

উত্তর : মনে করবেন। একটা হাঁড়িকেই বিয়ে করেছেন।

প্রশ্ন : আমার স্ত্রী সবসময় বেড়াতে ভালোবাসে। বাড়িতে থাকতে চায় না। তালা মেরে বেরিয়ে যায়। অরক্ষিত বাড়ি, ভয় হয়, কখন কী হয়ে যায়!

উত্তর : বাড়িটা বিক্রি করে একটা গাড়ি কিনে মোবাইল-সংসার পেতে ফেলুন। আজ টালায় তো কাল টালিগঞ্জে।

প্রশ্ন : ছেলেকে ঠিকভাবে মানুষ করতে হলে কী করতে হবে?

উত্তর : নিজেকে অমানুষ হতে হবে।

প্রশ্ন : মানুষ এত নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে কেন?

উত্তর : বাঘ-ভাল্লুকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলে।

প্রশ্ন : হাড়ে দুব্বো গজানো কাকে বলে?

উত্তর : বিয়ে করাকে।

প্রশ্ন : আচ্ছা প্রেমের সঙ্গে কীসের তুলনা করব? গোলাপের না পদ্মের?

উত্তর : প্যাঁকাটির।

প্রশ্ন : আমার খুব ভূত দেখতে ইচ্ছে করে। কোথায় গেলে দেখতে পাব?

উত্তর : কোথাও যেতে হবে না, বাড়িতেই আছেন। নিজের ছেলেকে দেখুন।

প্রশ্ন : মহাশয়! ইংলিশ মিডিয়াম কাহাকে বলে?

উত্তর : লেড়ির গলায় বিলিতি বকলশকে বলে।

প্রশ্ন : আয়ু বাড়াতে গেলে কী করতে হবে?

উত্তর : হাঁপানি ধরাতে হবে।

প্রশ্ন : গৃহশান্তি বজায় রাখতে গেলে কী করতে হবে?

উত্তর : গৃহত্যাগ করতে হবে।

প্রশ্ন : হিন্দিগান শুনলে আমার চুল খাড়া হয়ে ওঠে।

উত্তর : কামিয়ে ফেলুন।

প্রশ্ন : আমগাছ থেকে আম পাড়ার সহজ উপায় কী?

উত্তর : গাছটাকে কেটে মাটিতে শুইয়ে দিন।

প্রশ্ন : আমার বিপদ, আমি যা বলি আমার স্ত্রী ঠিক তার উলটোটা বলে, কী করা যায়?

উত্তর : স্ত্রী হলেন আয়না। আয়নার সামনে দাঁড়ালে মানুষের সব উলটে যায়। ডান বাঁ হয় বাঁ-ডান। আপনি সবসময় উলটো বলুন, দেখবেন সোজাটা পেয়ে যাবেন।

প্রশ্ন : লোকে টিভি দেখে কেন?

উত্তর : দেখে না তো, সামনে বসে থাকে।

প্রশ্ন : ভালোবাসা কাকে বলে?

উত্তর : ভালো বাসাকে বলে। দুটো ঘর, রান্না ঘর, বাথরুম, ডাইনিং স্পেস, ঝুল বারান্দা।

প্রশ্ন : আমাকে একটা জীবনমুখী গান লিখে দেবেন?

উত্তর : চেষ্টা করছি।

এই শুনছ জুতোটা তো নিয়ে গেছে কুকুরে

তোমার হাই হিল পরে যাই তবে বাজারে

এই শুনছ, জুতোটা তো নিয়ে গেছে কুকুরে।।

মেল আর ফিমেল একালে কোথায় বিভেদ,

শুনছ, স্কুটারে সামনে আর পেছনে,

আমার মাথায় হেলমেট, তোমার মাথায় গামলা,

কাজ করি একই অফিসে, চেয়ার সেই একই,

এই শুনছ, জুতোটা তো নিয়ে গেছে কুকুরে,

হাই হিল পরে তবে যাই আমি বাজারে….

যে কোনও সুরে অথবা বেসুরে গেয়ে দিলেই জীবনমুখী গান।

 প্রশ্ন : সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর শরীরটা ভীষণ ঢিস ঢিস করে, কী করা যায়!

উত্তর : বিকেলে উঠবেন। আপনি সূর্য নন, নক্ষত্র হন। নক্ষত্ররা সব রাতে ওঠে। উদাহরণ চিত্রতারকা!

প্রশ্ন : জলের বদলে কী খাওয়া যায়! জলে ভীষণ জার্মস।

উত্তর : মেঘ ধরে খান।

প্রশ্ন : আমার এমন অম্বলের রোগ যে চুমু খেলেও অম্বল হয়ে যাচ্ছে।

উত্তর : ঠোঁটে অ্যান্টাসিড মাখিয়ে খান।

প্রশ্ন : মায়ের কথা শুনব না বউয়ের কথা?

উত্তর : কালা হয়ে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

প্রশ্ন : বৃদ্ধবয়সে মানুষের কী ধর্ম নিয়ে থাকা উচিত?

উত্তর : না, শৈশব নিয়ে।

প্রশ্ন : মারা যাওয়াটা কী খুব কষ্টের?

উত্তর : বেঁচে থাকার চেয়ে আরামের।

প্রশ্ন : মরার সময় মুখে গঙ্গাজল দেওয়া হয় কেন?

উত্তর : যাতে পরের বার আমাশা নিয়ে জন্মাতে পারেন।

প্রশ্ন : আজকাল বাড়ির ছাত বিক্রি হচ্ছে, এটাকে আপনি কী বলবেন?

উত্তর : পরের মাথায় কাঁঠাল ভাঙা।

প্রশ্ন : কবে আমরা পাতাল রেলের ছাতে উঠতে পারব?

উত্তর : ট্যানেলের ছাতটা যবে ভেঙে পড়ে যাবে।

প্রশ্ন : সহজ কথা সহজ ভাবে বলতে পারেন না কেন?

উত্তর : জিলিপি খাই বলে।

মোহনলাল কাগজপত্র গোছগাছ করে কেদারের টেবিলে দিয়ে বললেন, ‘নাও করে দিয়েছি, দেখো পছন্দ হয় কিনা!’

পীপুল যথারীতি হেঁচকি তুলতে-তুলতে তার বিভাগের কাজ করছেন সেটা হল স্বাস্থ্য সম্পর্কে যাবতীয় সুপরামর্শ। কেদার বিভাগটির নাম রেখেছেন, শরীরম আদ্যম। পীপুলের এবারের বিষয়, শরীরের ওপর তামাকের কুফল। ঠিক লোকের হাতেই ঠিক জিনিসের ভার পড়েছে। যে নিজে জরদায় চুর হয়ে আছে সর্বক্ষণ সেই সাবধান করতে পারে তামাকের কুফল সম্পর্কে।

মোহনলাল বললেন, ‘দয়া করে একটু জল খাও না।’

‘জল খাওয়া যায় না মোহন। জরদা পেটে চলে গেলে, লিভারটা খারাপ হয়ে যাবে।’

কেদার বললেন, ‘ওদিকে মাথা দিয়ো না মোহন। তোমার জবাব খুব সুন্দর হয়েছে। আর একটা কাজ করে দাও না, এবারের সম্পাদকীয়?’

‘যে কোনও দিন কিছু লেখেনি তাকে দিয়ে এইসব করাচ্ছ?’

‘তুমি পারবে। তোমার ভেতরে মশলা আছে ভাই।’

‘বিষয়টা কী হবে?’

‘বর্তমান সমাজ। ভাঙা পরদালানে উদভ্রান্ত মানুষের নৃত্য। ধরার কিছু নেই, অনুসরণ, অনুকরণ করার মতো কিছুই নেই। খোলস আছে, মাল নেই। বন্য আর বারোয়ারি প্রেম আর পেটাই, হত্যা আর হরিনাম একই স্রোতে বয়ে চলেছে। ধর্মগুরু আর সাট্টাগুরু একাসনে। চোর আর পুলিশ এক গেলাসের বন্ধু। এই তো স্যাটায়ারের কাল মোহন। তোমার কলমে খুলবে খুব।’

‘সকালের কাগজ খুললেই, বাঁ-পাশে লম্বা একটা গণধর্ষণ, তলায় একটা অ্যাঙ্কার, অসহায় একটা ছেলেকে পথের পাশ থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে, প্রথমে ছাত থেকে ঠেলে ফেলে দিয়ে হাড়-গোড় ভাঙা হল, তারপর কনুইয়ের কাছ থেকে ডান হাতটা কেটে নুলো করা হল, তারপর একদিন নামিয়ে দেওয়া হল রাস্তায় ভিক্ষে করার জন্যে। ভেতরে তিনের পাতায়, বাপ নিজের কিশোরী কন্যাকে রেপ করে মেরে ডোবায় ফেলে দিয়েছে। ছেলে সম্পত্তির লোভে, আক্রোশে বাপকে খোঁটায় বেঁধে জীবন্ত পুড়িয়ে মারল। ছয়ের পাতায় মাস্তান রসগোল্লার মৃতদেহ পাওয়া গেল। রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে বেলগাছিয়ার পরিত্যক্ত একটা কুঠুরিতে। বউয়ের সামনে স্বামীকে কুপিয়ে খুন করে দলীয় বদলা নিচ্ছে দলীয় খুনিরা। লাল এলাকায় নাবালিকাদের যৌনকর্মী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে নির্বিচারে। পুলিশ লকআপে যাকেই নিয়ে যাচ্ছে তাকেই পিটিয়ে মেরে ফেলে দিচ্ছে। পুলিশ ব্যারাকে রেপ হচ্ছে। ডাইনি অথবা ছেলেধরা সন্দেহে নিরীহদের পিটিয়ে মারছে। ডাক্তার রুগির শ্লিলতাহানি করছে মাঝরাতে চিকিৎসাকেন্দ্রে। কুকুর ঢুকে সদ্যোজাতকে খাবলে খাচ্ছে। জমি জলা যেখানে যা ছিল নেতা আর ব্যবসাদাররা মিলে চৌপাট করে, খাঁচা তৈরি করে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিলে। অটো রিকশা জানোয়ারের মতো চালিয়ে স্কুলের কিশোরকে স্কুল গেটের সামনেই মেরে ফেললে। আর এক জায়গায় একদিন আগে ওই দলেরই এক জানোয়ার এক মাকে চাপা দিয়ে শেষ করে দিলে। ব্যাংকের লকারে দিনকয়েক আটকে থাকলেন এক মহিলা। ব্যাংকের টয়লেটে মরে পড়ে রইলেন বৃদ্ধ। কেউ খবর নিলে না। স্কুলে জল খেতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেল কিশোর বালক। অভাবের জ্বালায় মা মেয়ের গলা টিপে মেরে নিজে আত্মহত্যা করল। সন্ত্রাসবাদীরা আর ডি এক্স নিয়ে ঘুরছে নেতা শিকারে, খুনীরা ঘুরছে নিরীহ নাগরিক হননে, বিকৃত মনের মানুষ ঘুরছে যৌন অপরাধের ধান্দায়। ওদিকে বন্যার্ত মানুষের ত্রাণ মিলছে না, এদিকে টাকা উড়ছে বারোয়ারিতে। বাঙালি অনর্গল বকে মরছে, নি:শব্দে কাজ গুছিয়ে যাচ্ছে অবাঙালি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। এই কথাই তো থাকবে সম্পাদকীয়তে। যাঁরা পড়বেন তাঁরা বলবেন, জবরদস্ত লিখেছে ভাই। বাস ওই পর্যন্ত। তারপর সাপ যেমন ছোবল মারছিল সেইরকমই ছোবল মারবে, ইঁদুর যেমন বই কাটছিল সেইরকমই কাটবে, চোর যেমন চুরি করছিল সেইরকমই চুরি করবে, শাশুড়ি যেমন বধূহত্যা করছিল সেই রকমই করবে, দোকানে দোকানে চোলাই যেমন বিক্রি হচ্ছিল সেইরকমই হবে, সাধু সাধুই থাকবেন, লম্পট লম্পট। আর ফ্যাশানেবল আশাবাদীরা বলবেন, কেবল নেগেটিভ কথাবার্তা মশাই, আশার আলো দেখান,

আবার গাহিবে পাখি গান,

বহিবে মলয় বাতাস,

কৃষকের গোলাভরা ধান

গোয়ালে দুধের গরু

দালানে দালানে গোলাপ!!

শাসনে যাঁরা আছেন তাঁরা সেই কলমই চাইবেন যার মুখ দিয়ে ঝরবে শুধুই প্রশান্তি, আশার বাণী।

বাস্তবের নরকে প্রচারের স্বর্গ। এই করেই উলটে গেল রাশিয়া।’

‘তাহলে তুমি লিখবেটা কী? আশার কথাই লেখো। বহু বছর আগে এক জবরদস্ত নেতা মফসসলের এক সভায় বলেছিলেন, ‘কে বলেছে, আমরা দারিদ্র্য দূর করতে পারিনি, এই সভায় যাঁরা এসেছেন তাঁদের প্রত্যেকের গায়েই চাদর দেখছি।’ সময়টা ছিল শীতকাল। সকলের গায়েই আধময়লা, ছেড়া, তাপ্পিমারা একটা করে চাদর ছিল। এই তাদের সমৃদ্ধির চিত্র। তুমিও সেইরকম একটা কিছু আবিস্কার করে লেখো, এমন দেশটি কোথাও তুমি পাবে না কো খুঁজে।’

‘আমি ধর্মের ওপর লিখব।’

‘সর্বনাশ হয়ে যাবে। শখানেক কপি যাও বা ঠেলেঠুলে বিক্রি হচ্ছিল, তাও হবে না।’

‘আমি সেকেলে ধর্মের ব্যাখ্যা লিখব না, আমি আধুনিক ব্যাখ্যা করব।’

‘কীরকম?’

 ‘যেমন ধরো মা কালীর ব্যাখ্যা। শক্তি আর ব্রহ্মা এক হ্যানত্যান, এই সব নয়। মা কালীর তত্ব হল, সাদা টাকার ওপর কালো টাকা নাচছে। সাদা টাকা শুয়ে পড়েছে। কালো টাকায় গোটা তন্ত্রটাই ঢুকে আছে। পঞ্চ মকার-পাঁটটা ম- ই আছে, মাংস মদ্য মৎস্য মুদ্রা, মৈথুন। সন্ধেবেলা পার্ক স্ট্রিটের বারে মদের ফোয়ারা, টিপসের ছড়াছড়ি, পশ পাড়ায় মধুচক্র। এক একজন এক এক রাতে যা উড়িয়ে দেয় তাতে একজন মধ্যবিত্তের একমাস সংসার চলে যাবে।’

পীপুল এতক্ষণ একমনে প্রুফ দেখছিলেন, মুখ তুলে বললেন, পঞ্চ মকারের প্রকৃত ব্যাখাটা কী বলো তো! কথায় কথায় বলি, কিন্তু জানি না। জানতে ইচ্ছে করে।’

মোহনলাল বললেন, ‘তত্বটা অতি সুন্দর। সাধন জগতের কথা কোডে বলা হয়েছে। হেঁয়ালির মতো ‘একটু বলো না শুনি।’

‘মদ্য মানে বোতল নয়। আমাদের ব্রহ্মরন্ধ্রে একটি সহস্রদল পদ্ম আছে। যাকে সাধকরা বলেন সহস্রার। সাধনায় সিদ্ধ হলে, সহস্রদল এই পদ্ম থেকে অমৃত নি:সৃত হয়। এই সুধাপানে সাধক মত্ত হয়ে যান। ব্রহ্মানন্দরূপ মদ্যপানে মাতোয়ারা। রামপ্রসাদ গাইলেন, সুরাপান করিনে আমি সুধা খাই জয়কালী বলে। মজল আমার মন ভ্রমরা শ্যামাপদ নীল কমলে। এরপর মাংস। মাংসের ব্যাখ্যা অপূর্ব। মা মানে রসনা। রসনার অংশ হল মাংস। অর্থাৎ বাক্যের ভোজন। মৌনাবলম্বনই মাংস ভোজন। মৌনী থাকলে সাধকের সিদ্ধি হয়। রবীন্দ্রনাথ বললেন, এবার কথা কানে কানে, প্রাণে প্রাণে। এইবার শোনো মৎস্যের ব্যাখ্যা। আমাদের চঞ্চল আমাদের সদা চঞ্চল নিশ্বাস প্রশ্বাসই হল মৎস্য। সেই বায়ুটিকে ভক্ষণ করাই হল মৎস্য ভক্ষণ। তার মানে নিশ্বাস প্রশ্বাসকে রোধ করো। কুম্ভক করো। কুম্ভক যোগেই সাধকের সিদ্ধি। মুদ্রা কাকে বলে মুদ্রা হল আমাদের হৃদয়ের আটটি অবস্থা, আশা, তৃষ্ণা, গ্লানি , ভয়, ঘৃণা, মান, লজ্জা ও ক্রোধ। হৃদয়ের এই আটটি মুদ্রাকে জ্ঞানাগ্নিতে সুসিদ্ধ করে ভক্ষণ করো। অর্থাৎ আয়ত্বে আনো, স্মরণে আনো। মৈথুন হল, ব্রহ্মরন্ধ্রে রয়েছেন সহস্রধার সেই সহস্রধারে বিন্দুরূপে অবস্থান করছেন শিব, সেই শিবের সঙ্গে কুণ্ডলিনী শক্তির সম্মিলনই হল মৈথুন।

এর আরও একটু ব্যাখ্যা আছে, সেটা হল জ্ঞানের সঙ্গে ভক্তির সংমিশ্রণ। পঞ্চ মকারের আর এক ব্যাখ্যা আছে মহানির্বাণ। তন্ত্রে। নির্বিকার নিরঞ্জন ব্রহ্মে যুক্ত হতে পারলে সে প্রমোদজ্ঞান, সেইটি হল মদ্য। ব্রহ্মে সর্ব কর্মফলের সমর্পণই মাংস, সুখ-দু:খে সমান জ্ঞানরূপ সাত্বিক জ্ঞানই মৎস্য, অসৎসঙ্গ ত্যাগ ও সৎসঙ্গই মুদ্রা আর কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করে, ষটচক্রর ভেদ করিয়ে সহস্রধারের সহস্রদল পদ্মকণিকার মধ্যে যে পরম শিব আছেন, তাঁর সঙ্গে মিলন ঘটাতে পারলেই মৈথুন। ভায়া। এই হল কথা, তা সে-কথা কথাই থেকে গেল। আসল কথা হল, সুরা, সাকী, কাবাব, ফিশফ্রাই।’

পীপুল বললেন, ‘লেখা-পড়াটা এখনও রেখেছ, পণ্ডিত।’

ও ছাড়া আর কী করার ক্ষমতা আছে আমার! কালোয়ার হলে পার্কের রেলিং খুলে বিক্রি করতুম, প্রমোটার হলে বাড়ি তৈরি করে বেচতুম। শেঠ হলে গণেশ ওলটাতুম।’ কেদার পাইপে তামাক সেবন করেন। বনেদি অভ্যাস। ল্যান্ডো, রোলসরয়েস, হিরে, মধুপুরের বাগান বাড়ি, বেনারসের মন্দির হাতছাড়া হয়ে গেলেও রক্তটা আছে। পাইপ ধরানো শেষ করে, কেদার ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, ‘কাল আমি একটা মজার স্বপ্ন দেখেছি, এখান থেকে ফিরে গিয়ে মা কালীর কান কালা হয়ে গেছে। ভক্তদের প্রার্থনা শুনতে পাচ্ছেন না। স্বর্গের হাসপাতালে ই. এন. টি.-র আউটডোরে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বোমা আর লাগাতার ধাইধাপ্পাড় গানে এই অবস্থা। পরের বার পুজোর ফর্দে পুরোহিত মশাই বাড়তি একটা আইটেম লিখবেন, তুলো আর গ্লিসারিন । মায়ের দু’কানে গুঁজতে হবে।’

পীপুল বললেন, ‘মা তো চির কালা, সেই কারণে মানুষের কোনও কথাই কোনওকালে তাঁর কানে গেল না। দেব-দেবীরা সব হ্যান্ডিক্যাপড। বোবা, কালা।’

 মোহনলাল বললেন, ‘আমি আজ চলি। হস্টেলের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে।’ মোহনলাল চলে গেলেন। পীপুল আরও কিছুক্ষণ কাগজপত্র নাড়াচাড়া করে উঠে পড়লেন। তিন কামরার একটা ফ্ল্যাটে থাকেন। স্ত্রী আরথ্রাইটিসে পঙ্গু প্রায়। ছেলে পাসটাশ করে বসে আছে। কোথাও কোনও চাকরি নেই। ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। মুখের চেহারা ক্রমশই পালটাচ্ছে। গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হচ্ছে। সবসময় অন্যমনস্ক। থেকেও নেই। যেমন, মেয়ে প্রেম করে বিয়ে করেছে। জামাইয়ের ওষুধের দোকান। জেলুসিল কিনতে কিনতে অম্বল না সারলেও প্রেম পেকে গেল। পীপুলের খুব একটা ইচ্ছে ছিল না। শিক্ষিত একজন পাত্র চেয়েছিলেন। এখন বোঝেন, মেয়ের বাস্তব বুদ্ধি তার বুদ্ধির চেয়ে অনেক পাকা। এম ফিল ছেলে ভ্যারেন্ডা ভাজছে, স্কুল ফাইনাল জামাই ঠাকুর ঘরে মার্বেল বসাচ্ছে। এসি ফার্স্টক্লাসে সপরিবারে সিমলা যাচ্ছে। পুডিং-এর মতো একটা নাতি হয়েছে। মেয়েটার চেহারা হয়েছে বোম্বাই কুলের মতো। একশো টাকাকে একটাকা মনে করে। পীপুলের বাড়িতে ভাত ডালের অভাব থাকলেও ওষুধের অভাব নেই। সর্বত্র ক্যাপসুল আর ক্যাভিজের ছড়াছড়ি। জামাই ছেলেকে একটা অফার দিয়েছিল, আমার দোকানে বসে যাও। ও তোমার মঙ্গলকাব্য, ভট্টিকাব্য, বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ তোলা থাক, এখন ভিটামিন, অ্যালট্রাকসিন, প্যারাসিটামল চেনো। দুটো পয়সা পকেটে আসুক। সিলভার টনিক ইজ দ্য বেস্ট টনিক। পুত্র রাজি হয়নি। পেটে বিদ্যা ঢুকলে লিভার খারাপ হবেই। গুরুপাক জিনিস।

পীপুলের বাড়ি মোহনলালের বাড়ির বিপরীত দিকে। কেদারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে মোহন চলেছে ডান দিকে, পীপুল বাঁদিকে। পীপুল যাচ্ছে বটে, পা কিন্তু চলছে না। বাড়িটা শ্মশানের মতো। যৌবনে যাকে নিয়ে হুড়ুম দুড়ুম করেছেন, স্বপ্ন দেখেছেন, সে শয্যাশায়ী। ছেলেটা বসে আছে বারান্দার অন্ধকারে। আশার কথা শোনাতেও সঙ্কোচ হয় আজকাল। যেন ক্যাসেট বাজাচ্ছেন। চায়ে চিনির বদলে স্যাকারিন দিচ্ছেন। বেশি জ্ঞান দিতে গেলে উঠে চলে যায়। তখন খুব অপমানিত লাগে নিজেকে। মনে হয় জুতো মারছে। সময় সময় মনে হল তাকেই অপরাধী করছে। নীরবে বলতে চাইছে—তুমি এক মধ্যবিত্ত বাঙালি, স্টেশোনারি অফিসের কেরানি, তোমার বাবা কোর্টের মুহুরি, নাচতে নাচতে বিয়ে করে এলে কোন আক্কেলে। প্রেম উথলে উঠল একেবারে। বছরে বছরে পঞ্চাশ টাকা ইনক্রিমেন্ট। ভাব নেই কোথাও, সর্বত্রই অভাব। তারই মধ্যে টেনে আনলে দুটো প্রাণকে, একটা ছেলে, একটা মেয়ে। না পারলে কনভেন্ট এডুকেশন দিতে না পারলে ইওরোপ, আমেরিকা পাঠাতে। বাংলা ইস্কুল থেকে রগড়াতে রগড়াতে, গোয়ালমার্কা কলেজে, সেখান থেকে থাম ভাঙা, পায়রার বাসা ভ্যাপসা বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখান থেকে অব্যবহৃত জীবনের জুতোর গাদায়। এজন্যে দায়ী তুমি, তোমার সংসার বাসনা তোমার কামনা। বউটাকে চটকে চটকে ছিবড়ে করে বিছানায় ফেলে দিলে মাংসের পুঁটলি করে। শালা মধ্যবিত্ত, আদর্শবাদী পা-চাটা বাঙালি।

পীপুল নিজেকে গালাগাল দিতে দিতে এগোচ্ছে। ডানপাশে নাচ বস্তি। নামটা হওয়ার কারণ যাই হোক, জমজমাট জায়গা, হাজার খানেক ভোটের একটা লোভনীয় প্যাকেট। চায়ের গুমটি, সাট্টার-চুল্লুর ঠেক, হাফ গেরস্ত, ছিপলি যুবতি, লক্কা যুবক, বমকা বাচ্চা, দালাল, নেতা, যৌনকর্মী, মহিলা সমাজ সেবী, ছোঁকছোঁকে পড়তি বড়লোক দরদি সবই আছে এই আস্তানায়। গায়েগতরে মেয়েছেলেরা রাতের হাট বসিয়েছে। রেকর্ড প্লেয়ারে হিন্দি গান, কারগে খিস্তি হাওয়ায় উড়ছে। লম্বা চুলো, ঢোলা পাতলুন পরা চোয়াড়ে ছেলের দল, মাধুরীদের কোমরে কাতুকুতো দিচ্ছে। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, সঞ্জয় দত্ত সবই আছে।

পীপুল এই জায়গাটা পেরিয়ে যেতে যেতে ভাবছে, এই কালচারটাই আসছে। আর দশটা বছর। ছেয়ে যাবে। এরাই ঠিক করবে দেশ শাসন করবে কারা। সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, শিক্ষার ধরনটা কী হবে। কোন ভাষায় বাঙালি কথা বলবে, পরিবার কেমন হবে, বিবাহ প্রথা থাকবে না, একসঙ্গে কিছুদিন থাকা। মানুষ দেবতা হবে, না কুকুর। এরাই ঠিক করবে। এই মেয়েরা মা হবে, এই ছেলেরাই বাপ হবে। দাদু হবে, ঠাকুরদা হবে।

পীপুলের ভালো নাম, পিনাক চৌধুরী। পুর্বপুরুষ জমিদার ছিলেন। নামটার মধ্যে আভিজাত্য আছে অবশ্যই। চেহারায় বিশেষ কোনও আভিজাত্য নেই একমাত্র নাকটি ছাড়া। খাড়া একটা নাক আর্যদের মতো। কাঁচাপাকা চুলেরও একটা শোভা আছে। পীপুল দু-পাউন্ড পাউরুটি হাতে বাড়িতে ঢুকলেন। রান্না হয়েছে কী হয়নি বলা শক্ত। সেঁকা পাউরুটি আর ওমলেট সহজ খাদ্য। তারপর বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে থাকা। গুনগুন করে গান গাওয়া, জেগে আছি একা, জেগে আছি কারাগারে। ছাত্র জীবনে শোনা গান, সেকালে হিট।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে রান্নার সুন্দর গন্ধ এল নাকে। অবাক ব্যাপার। কে রাঁধছে। ওপরে উঠতেই রহস্যটা পরিষ্কার হল। শালি এসেছে। অনেক দিন পরে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের মতো, তুমি এলে অনেক দিনের পরে, যেন বৃষ্টি এল। সব মানুষেরই জীবনে অল্প বিস্তর কিছু পাপ থাকে, সুস্বাদু তরকারিতে হিং-এর মতো, সামান্য একটু ছিটে।

করবী পীপুলকে দেখেই বললে, ‘কী গো কোথা থেকে এলে, বগলে দুটো বালিশ নিয়ে।’ এই গো সম্বোধনটা পীপুলের বউয়ের অসহ্য লাগে! স্ত্রী ছাড়া কোনও মানুষকে কেউ কেন গো বলবে! করবী কিঞ্চিৎ বেপরোয়া ধরনের মেয়ে। বয়েস যখন কুড়ি তখন একজনের সঙ্গে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। বছর না ঘুরতেই সেই ছেলেটা আবার আর একটা মেয়েকে নিয়ে উধাও হয়ে গেল। সেই ছেলেটি এখন আর ছেলে নেই, জেন্টলম্যান, পাওয়ারফুল নেতা।

ঘটনাটা ঘটার পর করবী আর নিজের বাড়িতে ঢুকতে পারেনি। ঢুকতে দেওয়া হয়নি তাকে। শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত, বাপের বাড়ির দরজা বন্ধ, তখন পীপুলই আশ্রয়দাতা হয়েছিল, আর সেইটাই হয়েছিল কাল। স্ত্রী শ্রাবণী গোড়া থেকেই বোনের দিকে ছিল। তাদের বাড়িতে মাসখানেক রাখার পরেই বুঝেছিল, খুব ভুল করে ফেলেছে, খাল কেটে কুমির ঢুকিয়েছে।

করবীতে আর শ্রাবণীতে তফাৎ বিশেষ ছিল না। শ্রাবণী শান্ত নিরীহ করবী আগুন। যৌনতা অনেক বেশি। যে কোনও পুরুষকে মুহূর্তে কাবু করে দিতে পারে। উচ্ছল। প্রাণচঞ্চল। তার বলা-কওয়া-দাঁড়ানো, সামনে ঝুঁকে পড়া, পেছন ফিরে চলে যাওয়া সবই মারাত্মক। অন্যের সংসার নিমেষে ভেঙে দিতে পারে। সৎ মানুষকে দেওয়ালি পোকা করে দিতে পারে, আর সেইটাই তার কাছে আনন্দের। সেন্টার ফরোয়ার্ডের গোল করার আনন্দের মতো। পাড়ার কোনও কোনও ছেলে হাবুডুবু প্রেমে পড়ে গেল। নিজেদের মধ্যে মারামারি-ফাটাফাটি। একজনের আত্মহত্যা।

পীপুল বলেছিল, ‘কেন এমন করছ! বাড়ির বদনাম হয়ে যাচ্ছে। যে-কোনও একজনকে বিয়ে করে ফেললেই তো হয়!’

করবী বলেছিল, ‘প্রতিশোধ নিচ্ছি। যে কটা পুরুষ পারি শেষ করে যাই। ঘুঘু দেখেছ ফাঁদ দেখোনি। এসব আমি প্ল্যান করে করছি।’

শ্রাবণী বলেছিল, ‘তুই তাহলে অন্য কোথাও চলে যা, এখানে থেকে ওইসব চলবে না। এটা ভদ্রপাড়া। আমাদের বদনাম হয়ে যাবে। লোকে এই বাড়িটাকে বেশ্যা বাড়ি ভাববে।’

করবী হাসতে-হাসতে বলেছিল, ‘সব মেয়েই বেশ্যা। যার একজন স্বামী, সে সতী সাবিত্রী। যার অনেক স্বামী সে কুলটা।’

শ্রাবণী পীপুলকে বলেছিল, ‘চলো, আমরা কোথাও পালিয়ে যাই।’

পীপুল কোথায় পালাবে! পালাবার জায়গা তো নেই। তা ছাড়া পীপুল নিজেই তো মজে আসছিল ক্রমে। করবী ধীরে ধীরে তাকে গিলছিল। অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ। শ্রাবণী যখন দেখলে, সে হেরে যাচ্ছে, তখন সে গুটোতে লাগল নিজেকে। ধর্মের পথে সরতে লাগল। ব্রত, উপোস, মন্দির, ঠাকুর ঘর, দীক্ষা, গুরু, সুগার, বাত। মেয়েদের যৌবন তাড়াতাড়ি আসে, চলেও যায় তাড়াতাড়ি। শ্রাবণী বুড়ি হয়ে গেল।

করবী কিন্তু ধরে রেখেছে। সে যত উচ্ছ্বঙ্খলই হোক পীপুল তাকে ভালোবাসে। দেহ এবং মন দুটোই ভালোবাসে। করবীর মধ্যে বেশ একটা মজা আছে। সব সময় একটা পিকনিক, পিকনিক ভাব। এই পৃথিবীতে বাঁচার কায়দাটা বেশ রপ্ত করে ফেলেছে। করবী যেন ওমর খৈয়ামের মহিলা সংস্করণ। কীভাবে যেন জেনে গেছে,

জীর্ণ ভাঙা সরাইখানার

রাত্রি দিবা দুইটি দ্বার,

তারি ভিতর আনাগোনা

দুনিয়াদারি চমৎকার।

রাজার পরে আসছে রাজা,

সজ্জা কতই বাদ্যধুম

তুচ্ছ সে সব-কয়দিনই বা

তারপরে তো সব নিঝুম।

পীপুল মুক্ত মনের মানুষ। আদর্শ, চরিত্র, জীবন, সাংসারিকতা সমস্ত ব্যাখ্যা সে একটু অন্যভাবে করে থাকে। যৌবনে যতটা বেপরোয়া ছিল, এখন আর ততটা হতে পারে না। সেই সময় মনে করত, কর্তব্য করাটাই ধর্ম, মানুষকে আঘাত না করাটাই ধর্ম, অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন না করাটাই ধর্ম, স্ত্রীর ভরণপোষণের ব্যবস্থা বজায় রেখে অন্য মেয়েকে ভালোবাসাটা অধর্ম নয়, পাপ নয়। শ্রাবণী তার স্ত্রী হলেও করবীকে আদর করাটা অপরাধ নয়। শ্রাবণী হিংসা করতে পারে, সেটা তার নীচতা অবশ্যই।

এখন এই বয়সে তার মত পালটেছে। যৌবন মানুষকে ব্যাপারটা বোঝায়। ইন্দ্রিয় দিয়ে জগৎকে বোঝবার চেষ্টা করায়। ইন্দ্রিয়কে অতিক্রম করতে পারলে আর এক মহান জগতের অনুভূতি আছে। যেমন সূর্যের আর একটা স্নিগ্ধ মনোরম নীল আলো আছে যার আভাস পাওয়া যায় পূর্ণগ্রাস গ্রহণের সময়। বয়েস বেড়েছে, ইন্দ্রিয় শিথিল হয়েছে, প্রবণতা থাকলেও বিচার এসেছে। নির্বিচারে কোনওকিছু গ্রহণ করতে ইচ্ছে করে না। শুচি, অশুচির বোধ এসেছে। স্থায়ী আনন্দ, অস্থায়ী আনন্দের বিচার এসেছে। মৃত্যুর পরেও যে জীবন আছে, তার আভাস পাওয়া গেছে, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। জীবনের মুঠোমুঠো বছর বাজে খরচ হয়ে গেছে।

করবীর বয়েস বেড়েছে। নি:সন্তান, তাই শরীরের আঁটসাঁট বাঁধন এখনও আলগা হয়নি। তবে মুখে বয়েস ধরেছে। হরিণের মতো চোখ ছিল। সেই চোখে দু:খের ছায়া নেমেছে। আগুনে ছাই পড়েছে। বাতাস জোরে বইলে দু-এক কুঁচি ফুলকি ওড়ে বটে, তবে ছাই হয়ে যায় নিমেষে। শ্রাবণীর চেয়ে করবীকে দেখেই পীপুলের বেশি মমতা হয়। ভোগ করতেই চেয়েছিল, করেছেও কিছু কম নয়, বহু সংসার ছারখার করেছে, এখন একেবারে একা। মাঝেমাঝে আসে, দুমদাম করে চলে যায়। যাওয়ার সময় বিদায় খুব করুণ হয়। মন বলে থাকি থাকি, পীপুলও বলতে চায় থাকো থাকো, পরিস্থিতি বলে, যাও যাও চলে যাও। অদ্ভুত ধরনের একটা বাড়িতে থাকে। অনেক ভাড়াটে, কেউ ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, কেউ দোকানদার, কেউ সোনার কাজ করে, কেউ ধান্দাবাজ, একটা ঘর এক চিলতে রান্নাঘর কমন বাথরুম। করবী খুব কষ্টে আছে। এর চেয়ে অনেক ভালো থাকা উচিত ছিল, হয়নি। খুব ভালো থাকতে গেলে একেবারে নীচে নামতে হয়, আর তা না হলে একেবারে ওপরে উঠতে হয়, মাঝামাঝি থাকলে এই বিড়ম্বনা।

যে কোনও সময় থেকেই মানুষ সুখের জীবন শুরু করতে পারে। অতীতটাকে মুছে ফেলে, ভবিষ্যতকে দূরে রেখে বর্তমানকে পালিশ করে। ফুল কি ফুটেই ভাবে একটু পরেই ঝরে যেতে হবে। মানুষ স্রষ্টার এক বিচিত্র কেরামতি। তার মনের অলিতে-গলিতে, সাপ, হায়না, শেয়াল, বিছে। যথারীতি শ্রাবণী জানিয়ে দিলে, ভীষণ পেট ভার, রাতে সে কিছুই খাবে না।

পীপুল জানত এইরকমই একটা কিছু ঘটবে। করবীর রান্না শ্রাবণী ছোঁবে না। এক রাতের একটু আনন্দ মাটি হয়ে গেল। করবীর মন যথেষ্ট কঠিন। পীপুল কিন্তু বিব্রত বোধ করল। যারা মানুষের দেহে আঘাত করে তাদের ক্ষমা করা যায়, যারা মানুষের মনে আঘাত করে তারা নিষ্ঠুরতম। করবী একটু আনন্দ করতে এসেছিল।

খাওয়া-দাওয়ার পর বারান্দার আলোছায়ায় বসে করবী বললে,

‘রান্না কেমন হয়েছিল?’

‘তুলনাহীন। তুমি কিছু মনে করলে?’

‘কী কারণে?’

‘তোমার বোনের ব্যবহারে!’

‘আমি কিছু মনে করি না, ও চির অসুস্থ।’

‘মনে অসুস্থ দেহে অসুস্থ। শুচিবায়ুগ্রস্ত।’

‘কথাটা ঠিক বলেছ। যাক পুরোনো কথা থাক।’

করবী বললে, ‘চলো না, পুরীটুরি কোথাও দিনকতক ঘুরে আসি, তুমি আর আমি। কিচ্ছু করব না, খাব-দাব আর সমুদ্রের ধারে বসে বসে ঢেউ গুনব। এই খাঁচাটা ছেড়ে আমার সঙ্গে কিছুদিন না হয় শেষ বয়সে একটু খারাপই হলে! নতুন করে আর চাকরি তো করতে হবে না, ক্যারেকটার সার্টিফিকেটেরও প্রয়োজন হবে না। চলো না, কোথাও যাই।’

করবী এই প্রস্তাবটা গত দেড় বছরে যখনই দেখা হয়েছে তখনই দিয়েছে। পীপুলেরও মনে হয়েছে, একবার কোথাও গেলে বেশ হয়। কোনও দায়-দায়িত্ব নেই, কোনও খিচিরমিচির নেই, মনের আনন্দে কয়েকটা দিন; কিন্তু যাওয়ার অনেক বাধা। বউ, ছেলে, মেয়ে সবাই ছিছি করবে। বয়কট করবে, যেন এডসের রোগী।

শ্রাবণ ছিল সেই মাসটা, তাই না।

পীপুল অতীতে ফিরছে। শ্রাবণের সন্ধ্যা। আকাশ মেঘে মেঘে কালো। দমকা বাতাস আর অঝোরে বৃষ্টি। শ্রাবণীর জ্বর। ম্যালেরিয়ার মতোই। আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে পড়ে আছে। জ্বরের ঘোর ওষুধের ঘোর।

হিলহিলে বিদ্যুৎ চকিতে যেভাবে চমকায়, সেই ভাবেই।

করবী গা ধুয়ে বাথরুমে থেকে বেরিয়ে ভিজে শাড়িটা কোনওরকমে জড়িয়ে, বারান্দা দিয়ে ঘরের দিকে এগোচ্ছে। ভিজে সুঠাম একটি শরীর। সাবানের গন্ধ। সাপ যেন ছোবল মারলে।

তুমিও তাহলে পারলে না।

বাধা দেয়নি করবী, বরং মনে হয়েছিল, এই অপেক্ষাতেই সে দিন গুনছিল।

আমি আর পারলুম না, তোমার দেহে আছে পুরুষের সর্বনাশ।

পীপুল এইরকম একটা কিছু বলেছিল তখন। তখন তার মনে হয়েছিল, সে কারও স্বামী নয়, বাবা নয়, কর্তব্যপরায়ণ একজন নাগরিক নয়। উন্মত্ত এক প্রাণী। ঈশ্বর নেই, পরকাল নেই, শাস্ত্র নেই, দর্শন নেই, পাপ নেই, পুণ্য নেই, শুধু একটা বস্তুই আছে, লাল আগুন, আগ্নেয়গিরি, লাভা। একটা আবর্ত, একটা টান, একটা ঝড়, একটা তছনছ, একটা নিয়তি। শ্রাবণের সেই সন্ধ্যা!

করবী যদি দাবি করে, তুমি আমার স্বামী।

পীপুল বলবে, হ্যাঁ, শ্রাবণীকে আমি বিয়ে করেছি, করবীকে আমি চেয়েছি। অস্বীকার করব না, সেই সময়ে আমি এমনও ভেবেছি, ম্যালেরিয়াটা ম্যালিগন্যান্ট হয়ে শ্রাবণী যদি মারা যায় তো বেশ হয়। আমি খুনি।

আমার পাঞ্জাবির তলায় খুন ছিল। সাহস ছিল না বলে ফাঁসি হয়নি।

অন্ধকারে করবীর কণ্ঠস্বর, জমাট অবয়ব, উত্তাপ, চুলে চিরুনি চালাবার শব্দ, কালো পাথরের মতো চোখ। সমুদ্রের তীরে ঢেউ ভাঙার শব্দ, সরে সরে যাওয়া বালি, পাপ, কি না পুণ্য, উত্থান না পতন, সব বোধ লুপ্ত হতে চলেছে। পীপুল একটু ঘনিষ্ঠ হতে চাইছে, আরও একটু কাছে, ডান হাতের নাগালের মধ্যে। বহুদিন নারীসঙ্গ হয়নি। একটি শরীরের সঙ্গে আর একটি শরীরের নিবিড় সান্নিধ্য।

পীপুল সংযত করে নিল নিজেকে। চরিত্র নষ্ট করার বয়েস আর নেই। নতুন করে সংসার ফাঁদার শক্তিও নেই। আবার চাকরি, বাজার, হিসেব, চুলে কলপ, হাত কাটা পাঞ্জাবি। অতীতের দিকে তাকালে মনে হয়, কোন মনের জোরে তখন এইসব করেছিল! দুধের কৌটো, ছেলের মশারি। কোলে বাচ্চা নিয়ে বারান্দায় ঘোরাঘুরি, নাকি সুরে গান গেয়ে ভোলাবার চেষ্টা। এত সবের পুরস্কার মিনিট পাঁচেকের সহবাস। এই কুড়িয়ে পাওয়া পাঁচটা মিনিটের জন্যে জালে পড়ে গেল সিংহ। পকেটে পাঁচ, ফিরিস্তি পঁচিশের। কুড়ির জোগাড়ে ধার, দেনা, উঞ্ছবৃত্তি। সেই তিরিশ-বত্রিশের কালটা পেরিয়ে এসে তবেই বোঝা গেল সেই বাঁদরের গল্পটা। মুখ ফাঁদাল বোতলের ভেতর ছিল কলা। লোভী বাঁদর হাত ঢুকিয়ে ধরেছে মুঠোয়। মুঠো করা হাত আর বেরোতে চাইছে না। কলাটা ছাড়লে হাতটা বেরোতে পারে, তাও পারছে না, লোভ। বাঁদর বোতলে ঢোকানো হাত নিয়ে ঘুরছে। না পারছে খেতে না পারছে ফেলতে।

উপায় নেই! নারী হল শক্তি, মহামায়া। চৈতন্য হরণ করে, মোহগর্ভে নিপতিত করে।

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ একটি সুন্দর গল্প বলতেন, ‘বারোশো ন্যাড়া আর তেরোশো নেড়ি তার সাক্ষী উদম শাড়ি’। ‘কামিনি-কাঞ্চনে জীবকে বদ্ধ করে। জীবের স্বাধীনতা যায়, কামিনী থেকেই কাঞ্চনের দরকার। তার জন্যে পরের দাসত্ব। স্বাধীনতা চলে যায়। তোমার মনের মতো কাজ করতে পারো না। জয়পুরের গোবিনজির পূজারীরা প্রথম প্রথম বিয়ে করেনি। তখন খুব তেজস্বী ছিল। রাজা একবার ডেকে পাঠিয়েছিলেন, তা তারা যায়নি। বলেছিল, রাজাকে আসতে বলো। তারপর রাজা ও পাঁচজন তাদের বিয়ে দিয়ে দিলেন। তখন রাজার সঙ্গে দেখা করার জন্যে আর কারোকে ডাকতে হল না। নিজে নিজেই গিয়ে উপস্থিত—মহারাজ! আর্শীবাদ করতে এসেছি, এই নির্মাল্য এনেছি ধারণ করুন। কাজে কাজেই আসতে হয়, আজ ঘর তুলতে হবে, আজ ছেলের অন্নপ্রাশন, আজ হাতেখড়ি-এইসব।

‘বারশো ন্যাড়া আর তেরশো নেড়ি তার সাক্ষী উদম শাড়ি—এ গল্প তো জানো। নিত্যানন্দ গোস্বামীর ছেলে বীরভদ্রের তেরোশো ন্যাড়া শিষ্য ছিল। তারা যখন সিদ্ধ হয়ে গেল, তখন বীরভদ্রের ভয় হল। তিনি ভাবতে লাগলেন এরা সিদ্ধ হল, লোককে যা বলবে তাই ফলবে, যেদিক দিয়ে যাবে সেই দিকেই ভয়, কেন না, লোকে না জেনে যদি অপরাধ করে, তাদের অনিষ্ট হবে। এই ভেবে বীরভদ্র তাদের বললেন, তোমরা গঙ্গায় গিয়ে সন্ধ্যা-আহ্নিক করে এসো। ন্যাড়াদের এত তেজ যে, ধ্যান করতে-করতে সমাধি হল। কখন জোয়ার মাথার ওপর দিয়ে চলে গেছে। হুঁশ নাই। আবার ভাঁটা পড়েছে তবু ধ্যান ভাঙে না। তেরোশোর মধ্যে একশো বুঝেছিল বীরভদ্র কী বলবেন। গুরুর বাক্য লঙ্ঘন করতে নেই, তাই তারা সরে পড়ল, আর বীরভদ্রের সঙ্গে দেখা করলে না। বাকি বারোশো দেখা করলে। বীরভদ্র বললেন, ‘এই তেরোশো নেড়ি তোমাদের সেবা করবে। তোমরা এদের বিয়ে করো।’ ওরা বললে, ‘ যে আজ্ঞা, কিন্তু আমাদের মধ্যে একশোজন কোথায় চলে গেছে।’ ওই বারোশোর এখন প্রত্যেকে সেবাদাসীর সঙ্গে থাকতে লাগল। তখন আর সে তেজ নেই, সে তপস্যার বল নেই। মেয়ে মানুষ সঙ্গে থাকাতে আর সেই বল রইল না। কেন না, সে সঙ্গে স্বাধীনতা লোপ হয়ে যায়।’ ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের সামনে তখন বসেছিলেন শ্রীমৎ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজি। ঠাকুর তাঁকে বলছেন :

‘তোমরা নিজে নিজে তো দেখছ, পরের কর্ম স্বীকার করে কী হয়ে রয়েছ। আর দেখো, অত পাশ করা, কত ইংরাজি পড়া পণ্ডিত, মনিবের চাকরি স্বীকার করে তাদের বুট জুতার গোঁজা দু’বেলা খায়। এর কারণ কেবল কামিনী। বিয়ে করে নদের হাট বসিয়ে আর হাট তোলবার জো নাই। তাই এত অপমানবোধ, অত দাসত্বের যন্ত্রণা।’

করবীর এখনও অনেক চুল, শরীরে এখনও পুরুষের জমাট লোভ। পাশে কেন, দূরে থাকলেও আগুন জ্বলে। একটু বেসামাল হলেই, বাথরুমের পিছল মেঝেতে হড়কে পড়ে যাওয়ার মতো, অনিবার্য পতন। পীপুল পাশে থাকলেও মনে মনে সরার চেষ্টা করছে। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণকে স্মরণ করছে। তার কণ্ঠস্বর :

‘যদি একবার এইরূপ তীব্র বৈরাগ্য হয়ে ঈশ্বরলাভ হয়, তাহলে আর মেয়ে মানুষে আসক্তি থাকে না। ঘরে থাকলেও মেয়ে মানুষে আসক্তি থাকে না, তাদের ভয় থাকে না। যদি একটা চুম্বক পাথর খুব বড় হয়, আর একটা সামান্য হয়, তাহলে লোহাটাকে কোনটা লবে? বড়টাই টেনে লবে। ঈশ্বর বড় চুম্বক পাথর, তাঁর কাছে কামিনী ছোট চুম্বক পাথর! কামিনী কী করবে?’

পীপুল এক ঝটকায় চেয়ার থেকে নিজেকে তুলে নিল। ভীষণ একটা ঘৃণার ভাব এল মনে। পাঁচ, সাড়ে পাঁচ ফুটের লিকলিকে একটা শরীর। হাত দুটো যেন মুরগির ঠ্যাং। ফাটা ফাটা কোঁচকানো কোঁচকানো চামড়া। চোখ দুটো মরা মাছের মতো। বুক ভরতি বেতো চুল। এক সময় ফরসা ছিল, এখন তামাটে। পাটের ফেঁসোর মতো পাতলা-পাতলা চুল। শরীরের গর্ব তো কিছুই নেই, মনটাও গেল!

করবী বললে, ‘উঠছ কেন? এরই মধ্যে। সবাই তো ঘুমচ্ছে!’

পীপুলের হঠাৎ মনে এল রবীন্দ্রনাথের একটি গান,

তোর ভিতরে জাগিয়া কে যে,

তারে বাঁধনে রাখিলি বাঁধি।

হায় আলোর পিয়াসি সে যে

তাই গুমরি উঠিছে কাঁদি।

যদি বাতাসে বহিল প্রাণ

কেন বীণায় বাজে না গান,

যদি গগনে জাগিল আলো

কেন নয়নে লাগিল আঁধি?।

করবী বললে, ‘হাই থটস আমি বুঝি না। শুতে যাচ্ছ যাও। আজ আমি তোমার কাছে শোবো, দেখি কে কী বলে?’

পীপুলের শরীর হিম হয়ে গেল ভয়ে। মনে হল, বিছানায় নয়, চিতায় গিয়ে শুই।

বেশ একটা থমথমে পরিবেশের মধ্যে খাওয়া দাওয়া শেষ করে মোহনলাল নিজের ঘরে পড়ার টেবিলে ছোট্ট সুদৃশ্য একটি ল্যাম্প জ্বেলে বসেছেন। পারলে, শক্তিতে কুলোলে কেদারের কাগজের সম্পাদকীয়টা লিখবেন, হাজার খানেক শব্দের মধ্যে : আলোতে লেখাপড়ার জায়গাটুকুই আলোকিত হয়েছে, বাকি অংশে আলোর একটা আভা ছড়িয়ে গেছে। ডবল একটি খাটে সুদৃশ্য চাদর বিছানো। এক জোড়া মাথার বালিশ, একটি পাশ বালিশ। ডবল খাটে সিঙ্গল মনোহর। পাশের জায়গাটি যিনি দখল করতেন তিনি ছবি হয়ে দেয়ালে উঠে গেছেন, রোজ একটি করে মালা পরেন, আর মনোহরের দিকে তাকিয়ে মুচকি-মুচকি হাসেন। এক দেয়ালে স্বামীজির পরিব্রাজক বেশের বিশাল এক মূর্তি। অন্য দেয়ালে সমাধিস্থ ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ!

বসে আছেন মোহনলাল। রাতের আহার খুবই সামান্য। চিরকালই তিনি স্বল্পাহারী। একটু আগে নাতনি পুল্লা গুডনাইট করতে এসেছিল। চোখ দুটো লাল, ফোলা ফোলা। ধরা ধরা গলা। কপালের একটা পাশে আঁচড়। ধারালো একটা কিছু সামান্য ছুঁয়ে গেছে। মোহনলাল পিঠে হাত বুলিয়ে গুড নাইট বলেছিলেন। কোনও প্রশ্ন করেননি। জানেন কী হয়েছে। যা রোজই হয়, একটু বেশি আর কম। এ শিখতে দশ ঘা, বি শিখতে বিশ ঘা। কপালের কাটা দাগটা মনে হয় নখের মতো। গালে চড় মারতে গিয়ে খচাং করে লেগে গেছে। মোহনলাল মনে মনে বললেন, বেঁচে যদি থাকিস, তাহলে অবশ্যই আর একজন মাদাম কুরি হবি মা।

কাগজ টেনে নিয়ে মোহনলাল লিখলেন, দেশের অবস্থা। রাজার পাপে রাজ্য ধ্বংস হয়। প্রজাদের অকল্যাণ! রাজী ঈশ্বরের প্রতিনিধি। আদর্শভ্রষ্ট রাজা সাক্ষাৎ শয়তান। গণতন্ত্র আবার কী। সে তো কাগজে-কলমে। একটা প্রহসন, ধাপ্পা। মুখ্যমন্ত্রীই তো রাজা। টিভি, সিনেমা, সাহিত্য, সংবাদপত্র কী শেখাচ্ছে? শেখাচ্ছে সেক্স, ভায়োলেন্সে, রেপ। কমার্শিয়াল বিজ্ঞাপন কী দেখাচ্ছে, নারীর নগ্নতা। কী শেখাচ্ছে, ভোগ করো। ফল? জলসা থেকে তুলে নিয়ে গেল কলেজের ছাত্রকে তারই বন্ধুরা। একটা বাড়ি তৈরি হচ্ছিল। সেইখানে নিয়ে গিয়ে তারা মদ্যপান করল। মধ্যরাত। জগদ্ধাত্রী পুজো হয়েছে। সেই উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেখানে কিশোরকণ্ঠী, লতাকণ্ঠীর হিন্দি গান। এদিকে ছেলেটিকে হত্যা করা হচ্ছে। বারোয়ারি হত্যাকাণ্ড।

চপার দিয়ে মুন্ডুটাকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হল। হাত, পা, খণ্ড খণ্ড করা হল। মুন্ডুটা ফেলা হল পানা পুকুরে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিভিন্ন জায়গায়। দেহকাণ্ড পড়ে রইল খুনের জায়গায়। এটা কী! আনন্দ! ত্রিভুজ প্রেমের সিনেমা-অনুসারী পরিণতি! না কী দরিদ্র দেশের অপরাধ-সংঘটনে আমেরিকা হয়ে ওঠা। পাকা খুনিরাও লজ্জা পাবে ঘটনার বীভৎসতায়। বীতশ্রদ্ধ মায়েরা পুলিশকে বলছেন, আমরা আর পারছি না, তোমরা ধরতে পারলে আমার ছেলেকে নিয়ে গিয়ে যা পারো করো। কলেজ ইউনিয়ানে ছাত্র নির্বাচন মানেই খুনোখুনি। পুলিশ-অফিসার আহত হয়ে সংকটজনক অবস্থায় হাসপাতালে। সঙ্গে তাঁর দুই সাক্ষী।

রাজা! এই কী চেয়েছিলেন, গণধর্ষণ, খুন, নারী নির্যাতন, চরিত্রহীন শিক্ষক, আদর্শভ্রষ্ট সরকারি কর্মচারী, নিপীড়ক রাজনৈতিক কর্মী! এই চেয়েছিলেন! দেশটাই যদি গেল, তো রাজমুকুটে কী হবে সম্রাট। ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, বিশাল বইমেলা, লেখক সম্মেলন, সেমিনার, নারী দিবস, সদ্ভাবনা, মানবশৃঙ্খল। এদিকে প্রতিবাদের নামে জনগণের সহজ নির্যাতন। রাজার অপরাধে প্রজাদের শাস্তি। রেল রোকো, পথ অবরোধ, বনধ, অ্যাম্বুলেন্সে হার্টের রুগি। পথেই প্রাণ গেল। প্রসূতি পথেই প্রসব করলেন। পরীক্ষার্থী পথেই পড়ে রইল। ইন্টারভিউ দেওয়া হল না চাকরি-প্রার্থীর, মাঝপথে ট্রেনে আটকে রইলেন অসহায় যাত্রী। রাজার দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সারা দেশ ঘোঁট পাকিয়ে গেছে। পচে গেছে।

 মোহনলাল লিখছেন না কিছুই। লিখে কী হবে! কে পড়বে! পড়েই বা কী হবে! বলত, কলমের ধার ও শক্তি তরোয়ালের চেয়ে বেশি। মধ্যযুগে হয়তো তাই ছিল। ভলতেয়ার, রুসো, গ্যারিবল্ডি, মাৎসিনি, বার্ক। রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিপ্লব। ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, আমেরিকার ওয়ার অফ ইন্ডিপেনডেন্স, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা। কলম নয়, তরোয়ালের শক্তিই প্রকৃত শক্তি। স্বাধীনতার জন্ম নিপীড়ন থেকে নিষ্কৃতির উপায় রাইফেলের নল।

ধর্ম! ধর্মের কোনও শক্তি নেই। ধর্ম মানুষকে সন্ন্যাসী করে লোকালয়ের বাইরে নিজের মুক্তি খুঁজতে পাঠায়। স্বামী বিবেকানন্দ একজন। সমাজের জন্যে মোক্ষ বিসর্জনে প্রস্তুত। গুরু শ্রীরামকৃষ্ণও একজন। সংঘ নেই, গেরুয়া নেই, আশ্রম নেই। দক্ষিণেশ্বর থেকে কলকাতা। পথে পথে, গৃহে গৃহে ঘুরছেন। মানুষ তুমি মানহুঁশ হও। একালের গুরু জেট বিমানে। সি বি আই-এর জেরার মুখে। রাসপুটিনের শত সংস্করণ।

এই ছিল মানুষের ভাগ্যে। কোথা কৃষ্ণ, কোথা শ্রীচৈতন্য, শঙ্কর, বুদ্ধ, শ্রীরাম।

খট করে একটা আওয়াজ।

ঘুরে তাকালেন মোহনলাল।

পুত্র আর পুত্রবধূর প্রবেশ।

নিশ্চয় কিছু বলবে। দু’জনে একসঙ্গে যখন এসেছে, তখন এই কথাটাই বলবে, যে-কথাটা শোনার জন্যে অনেক দিন অপেক্ষা করে আছি, কোম্পানির দেওয়া পশ এলাকার পশ ফ্ল্যাটে আমরা চলে যাচ্ছি, এতে মেয়েটার লেখাপড়ার সুবিধে হবে। হাতের কাছেই বড় বড় স্কুল।

দু’জনে সাবধানে খাটের এক পাশে বসল!

মোহনলাল বললেন, ‘কিছু বলবে তোমরা?’

ছেলেই বললে, ‘আমরা খুব দু:খে আছি বাবা।’

‘কেন? তোমাদের তো কোনও অভাব নেই। রোজগার তো ভালোই হচ্ছে।’

‘আপনার এই উত্তরেই আমাদের দু:খটা ধরা আছে। মা যখন ছিলেন, তখন বলতেন আমাদের। এখন আর আমাদের বলেন না, বলেন তোমাদের। আপনি আমাদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন ক্রমশ। কেন? আমাদের অপরাধ!’

‘তোমাদের কোনও অপরাধ নেই, আমি নিজেই একটু সাবধান হতে চাইছি। তোমাদের একটা যুগ, আমাদের একটা যুগ। যুগের ব্যবধান যে বুঝতে পারে না, সে নির্বোধ। সে নিজে সরতে না পারলে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেটা খুব বেদনার, খুব অপমানের।’

‘আমাদের মধ্যে অন্য যুগের কী দেখলেন?’

‘তোমাদের কোনও আদর্শ নেই, তোমাদের জীবনে কোনও শৃঙ্খল নেই, তোমরা ভয়ংকর উচ্চাকাঙ্খী।’

‘আদর্শ নেই মানে! আপনি আমাকে যা শিখিয়েছেন, সেই ভাবেই চলছি, মিথ্যে কথা যতটা কম পারা যায় বলি, চুরি কোনওদিন করিনি, করবও না, চরিত্রহীন হইনি, মদ খাই না, পার্টিতেও যাই না, কুসঙ্গ করি না। আর উচ্চাকাঙ্ক্ষী! আপনি ছাত্রজীবনে শিখিয়েছিলেন, বড় হওয়ার ইচ্ছে না থাকলে বড় হওয়া যায় না। আপনি বলেছিলেন, অ্যাম্বিশান ভালো, সেটা একটা ফোর্স, অ্যাম্বিশাস হওয়া ভালো নয়, সেটা একটা ডিজিজ, অসুখ। আপনিই তো আমাকে ছাত্রজীবনে স্বামীজির মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন :

যে যা বলে বলুক, আপনার গোঁয়ে চলে যাও—দুনিয়া তোমার পায়ের তলায় আসবে, ভাবনা নেই। বলে—একে বিশ্বাস কর, ওকে বিশ্বাস কর, বলি প্রথমে আপনাকে বিশ্বাস কর দিকি। বল, আমি সব করতে পারি। নেই নেই বললে সাপের বিষ নেই হয়ে যায়।

আমি তো সেই আদর্শ নিয়েই চলছি বাবা।’

কিন্তু স্বামীজির ওই কথাটি মনে হয় তুমি ভুলেছ। যারা লক্ষ লক্ষ দরিদ্র ও নিষ্পেষিত নরনারীর বুকের রক্ত দিয়ে আয় করা টাকায় শিক্ষিত হয়ে এবং বিলাসিতায় আকন্ঠ ডুবে থেকেও তাদের কথা একটিবার চিন্তা করবার অবসর পায় না—তাদের আমি বিশ্বাসঘাতক বলি।’

‘বাবা আমি সেই বিশ্বাসঘাতক নই। আমি আপনার টাকায় মানুষ হয়েছি। এক ত্যাগী, আদর্শবাদী মানুষের পরিশ্রমের সৎ টাকায়, কালো টাকায় নয়। সারাটা জীবন যিনি, ডাল, ভাত আর একটা মাত্র তরকারি খেয়েছেন, পায়ে যাঁর সামান্য এক জোড়া চপ্পল, সারা বছরে যাঁর প্রয়োজন হত, চারখানা ধুতি আর চারখানা শার্ট, যিনি কখনও হাতঘড়ি পারেননি, থাকা সত্বেও, ব্যবহার করেছেন, পকেট-ঘড়ি, যিনি অকাতরে বিদ্যা বিতরণ করেছেন। সেই মানুষের ছেলে আমি, যিনি আমাকে স্বামীজির মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন, মনে রাখবে—ব্যক্তিগত চরিত্র এবং জীবনই শক্তির উৎস, অন্য কিছু নয়। আপনি আমার যেটাকে অ্যাম্বিশান ভাবছেন, সেটা আমার ড্রাইভ। আপনাদের কালে আমাদের কালের মতো এত সাংঘাতিক প্রতিযোগিতা ছিল না। একাল হল দৌড়ের কাল, দুটো কথা স্মরণে রাখতে হবে—রান অর রট—হয় দৌড়োও, নয় আবর্জনা হয়ে পচে মরো। কিন্তু আমি আপনার দেওয়া বিশ্বাসে অটল—সেই বিশ্বাস আপনি পেয়েছিলেন স্বামীজির কাছ থেকে,

উদ্যোগীনাং পুরুষ সিংহমুপৈতি লক্ষ্মী :
উদ্যোগী পুরুষসিংহেরই লক্ষ্মী লাভ হয়।

অনন্তবীর্য, অনন্ত উৎসাহ, অনন্ত সাহস ও অনন্ত ধৈর্য চাই,

তবে মহাকার্য সম্পন্ন হবে। দুনিয়ায় আগুন লাগিয়ে দিতে হবে।’

মোহনলাল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে। এ যে দেখি যৌবনের মোহনলাল। সেই রকমই তেজ। মাথা নত করব না। একেই কী বলে, ‘বাপকা বেটা সিপাইকা ঘোড়া।’ ল্যংাড়া আমের গাছে ল্যাংড়াই হবে। একেই কি বলে সংস্কার। জীবনে কখন এত সুখী হননি। দর্পণে নিজের মুখ দেখার মতো অনুভূতি।

মোহনলাল বললেন, ‘আমার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে।’

আপনার আর একটা অস্বস্তি আছে, আমি জানি। আপনার পুত্রবধূকে আপনি ঠিক চিনতে পারছেন না। সে কেমন, কতটা আধুনিক, সে আপনাকে শ্রদ্ধা করে কি না, আপনার আদর্শ সে ধরতে পেরেছে কি না। তার মুখেই শুনুন।’ মোহনলালের বউমা কথা বলবে কী। আবেগে কণ্ঠরুদ্ধ কোনওরকমে ‘বাবা’ শব্দটা উচ্চারণ করে মুখ নীচু করল। মোহনলাল অবাক হলেন। যাকে ভেবেছিলেন রাগি, অহঙ্কারী, উগ্র আধুনিকা, সে ভেতরে-ভেতরে এত নরম, এত কোমল!

মোহনলাল বললেন, ‘কী হল বউমা!’

ছেলে বললে, ‘আপনার ওপর খুব অভিমান। আপনি সন্ধের সময় বেরিয়ে যান একা। চোখে ক্যাটার‌্যাক্ট, ভালো দেখেন না। কোনও নিষেধ শোনেন না। আপনি ওকে ঘৃণা করেন। আপনার বিচারে ও ফেল করেছে।’

মোহনলাল বললেন, ‘তোমরা জানো, আমি এক প্রাচীনপন্থী শিক্ষক। লেখাপড়া আনন্দের জিনিস। মারদাঙ্গার নয়। যে পড়ছে, সে যদি ভয়ে সিঁটিয়েই রইল সর্বক্ষণ তাহলে সে এগোবে কি করে। বিদাচর্চায় ভয় ভয়ংকর ব্যাপার। সর্বনাশ হয়ে যায় বিদ্যার্থীর। এটাই কিছুতেই আমি সমর্থন করতে পারছি না। তোমার ধৈর্যই যদি না রইল তাহলে তুমি পড়াবার চেষ্টা করো কেন!’ ‘ঠিক এই কথাটাই ও বলছিল। ধৈর্য কম, মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না। মারধোর করে ফেলে। আপনি যাকে বলেন, পেটাই সেশান। ও বলছিল, নাতনিকে পড়াবার, মানুষ করার দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে।’

‘আমি আমি তো প্রাচীন ধারার মানুষ! আমার শিক্ষায় তো ইয়াঙ্কি হতে পারবে না, মিস ইউনিভার্সও হবে না। আমার আদর্শ নারী তো সিস্টার নিবেদিতা। আমার নারীর আদর্শ তো মা সারদা! তোমাদের বিপরীত!’

‘কেমন করে বুঝলেন বিপরীত!’

‘তোমরা ইংলিশ মিডিয়াম, যার পুরোটাই ওপরচালাকি!’

‘উপায় যে নেই বাবা, বাংলা স্কুল আর নেই। শেষ হয়ে গেছে, রাজনীতি শেষ করে দিয়েছে। তাই অ-এর আগে এ বি সি, এক দুয়ের আগে ওয়ান-টু। আপনি আপনার মতোই করবেন, কারণ দশ বারো বছর পরে মেয়ে যখন বড় হবে তখন দেখা যাবে আমরা আবার ঘরে ফিরে এসেছি। আমাদের দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত-ও আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে, আপনিও ওকে ভীষণ ভালোবাসেন, আজ থেকে ও আপনার কাছে শোবে। এটাই ওর ভীষণ ইচ্ছে!’

 মোহনলাল বললেন, ‘বড় আনন্দ পেলুম। এখন আমি আর তোমাদের সংসার বলব না, বলব আমাদের সংসার।’

 মোহনলাল সম্পাদকীয়টা কেদারের হাতে দিলেন।

‘কী লিখলে? শেষের ঘণ্টা কী বাজছে। পড়ো না, শুনি!’

 মোহনলাল বেশ খুশি খুশি আজ। নতুন একটা দর্শন তিনি দর্শন করেছেন। পীপুলের দিকে তাকালেন। মনমরা হয়ে বসে আছে। পীপুল বললে ‘পড়ো, কী লিখলে কাল সারাটা রাত জেগে!’

‘তোমার অনিদ্রা! অবাক কাণ্ড! অনিদ্রা তো আমার, কিন্তু কাল আমি তোফা ঘুম দিয়েছি!’ কেদার বললেন, ‘পড়ো পড়ো, বড় কৌতূহল।’

মোহনলাল পড়ছেন,

সুখে থাকার শ্রেষ্ঠ উপায়, শান্তিতে থাকার শ্রেষ্ঠ উপায় আমাদের পাঠক-পাঠিকাদের অবগতির জন্যে জানাতে চাই। সংবাদপত্র যত কম পড়বেন ততই ভালো। সংবাদপত্রে যে সমাজচিত্র প্রতিফলিত হয়, সে সমাজ আমাদের প্রকৃত সমাজ নয়। পৃথিবীতে ভালো আর মন্দ দুই-ই আছে, আগেও ছিল, পরেও থাকবে, অমৃতফলের গাছও আছে, বিষফলও আছে। আম যেমন আছে আমড়াও আছে। ফুল আছে, কাঁটাও আছে। যে-হাত ছুরি ধরে মানুষের প্রাণ বাঁচায়, তাঁকে বলি সার্জেন। যে-হাত ছুরি ধরে খুন করে তাকে বলি খুনি। যে-মাধ্যম কেবল মন্দটাই পরিবেশন করে, যে-মাধ্যম শুধু ভোগবাদের জয়গান করে, তারা ব্যাবসায়ী। দুধের বদলে মদ বিক্রি করে, কারণ মদে মানুষের নেশা হয়, আসক্তি বাড়ে। মদ যত বিক্রি হয় দুধ তত বিক্রি হয় না। তুলসী দাস বলেছিলেন, মদ এক ঠাঁয়ে বসে বিক্রি করা যায়, কারণ মানুষ ছুটে আসে, কিন্তু দুধ বিক্রি করতে হয় দ্বারে দ্বারে গিয়ে। মানুষকে যারা খুঁজে খুঁজে সমাজের খারাপ দিকটাই দেখান, তাঁরা অন্যায় করছেন, অবশ্যই অর্থের জন্যে। ক্ষমাহীন অপরাধ। মানুষ সন্দেহবাদী, আতঙ্কিত, বিমর্ষ হচ্ছে; কিছু মানুষ হচ্ছে বেপরোয়া শয়তান। যে-সমাজ, যে-সুন্দর সমাজ গড়ে উঠতে পারত, তা পারল না তিন দল মানুষের অপপ্রচেষ্টায়, তারা হল ব্যাবসাদার, রাজনৈতিক আর সংবাদ মাধ্যমের পরিচালকরা। ত্রয়ী ষড়যন্ত্রে সারা পৃথিবী বিপর্যস্ত। সমস্ত মানুষ আজ মনোরোগী।

তবে ভালোর ধারা যেমন প্রবাহিত থাকবেই, গঙ্গা যেমন বইবেই, সেইরকম নর্দমাও প্রবাহিত থাকবেই। তার অর্থ এই নয় যে নর্দমাটাই সব। মনে রাখতে হবে, ভালোর মধ্যে খারাপ আছে, খারাপের মধ্যেও ভালো আছে। ভালো আর খারাপ আলাদা করা যায় না, যেমন চাল আর চালের খোসা।

মা সারদার কথাই ঠিক। খারাপের দিকেই মন যায়, ভালোর দিকে যেতে হলে মনের কঠিন শক্তি চাই। সেই শক্তির ইন্ধনদাতারাই মানুষের প্রকৃত বন্ধু।

মোহনলাল থামলেন। কেদার বললেন, ‘ বেশ লিখেছ। এই কথাটাই ঠিক কথা।’

পীপুল সটান উঠে দাঁড়ালেন। কেমন যেন অসুস্থ দেখাচ্ছে।

‘কী হল তোমার’! কেদার উদ্বিগ্ন।

‘মোহনলাল আমাকে আত্মহত্যার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। এই দেখো স্লিপিং পিল। জানো তো আমি পাপী। তবে ওই যে বললে, খারাপের মধ্যেই ভালো থাকে, সেই খোঁজেও চললুম আমি।’ পীপুল বেরিয়ে গেল। কেদার আর মোহন স্তম্ভিত। কী বলতে চায় পীপুল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *