আমাদের মনোরমা
আমাদের এই খেপুতে জগুদার চায়ের দোকান ছিল খুব বিখ্যাত। এই খেপুতে আরও দুটো চায়ের দোকান আছে, কিন্তু সেগুলো হল রেস্টুরেন্ট। সে দুটোই বাজারের মধ্যে, একটা জুতোর দোকানের পাশে আর একটা বনশ্রী সিনেমা হলের গায়ে। সেখানে চায়ের সঙ্গে চপ-কাটলেটও পাওয়া যায়। সেই রেস্টুরেন্টে ঢুকলেই পেঁয়াজ আর বাসি মাছের আঁশের গন্ধে কেমন যেন গা গুলিয়ে ওঠে। টেবিলে ভনভন করে নীল রঙের ডুমো ডুমো মাছি, সেগুলো উঠে আসে কাঁচা নর্দমা থেকে। পয়সা খরচ করে মানুষ অমন নরকেও খেতে চায়!
আমাদের জগুদার চায়ের দোকান ছিল একদম আলাদা। এ দোকানের কোনো ছিরি-ছাঁদ নেই। বাজার থেকে অনেকটা দূরে, একটা ছোটো টিনের ঘর, সেখানে চারটে নড়বড়ে কাঠের টেবিলের সঙ্গে আটখানা চেয়ার। তার আগে দুখানা বেঞ্চি, দরজার কাছে আড়াআড়ি করে পাতা—বেশি ভিড় হলে খদ্দেররা সেখানে বসে। অবশ্য তেমন বেশি ভিড় হয় কালেভদ্রে।
জগুদার দোকানে শুধু চা আর নোনতা বিস্কুট ছাড়া অন্য কিছু পাওয়া যায় না বেশির ভাগ সময়। আর কেউ যদি সন্ধে ছটা থেকে আটটার মধ্যে গিয়ে পড়তে পারে জগুদার দোকানে, তাহলে সে পেতে পারে তিরিশ পয়সার এক প্লেট মাংসের ঘুগনি। আহা, তার যা সোয়াদ, বহুক্ষণ জিভে লেগে থাকে। আমরা বাজি রেখে বলতে পারি অমন ঘুগনি বদ্ধোমান বা কলকেতার কোনো দোকানেও কেউ পাবে না। তা আমাদের যখন ইভিনিং ডিউটি থাকে, তখন আর ওই ঘুগনি আমাদের ভাগ্যে জোটে না। ডিউটি শেষ করে বেরুতে বেরুতে রাত দশটা বাজে, ততক্ষণে ওই ঘুগনি ফিনিশ। কত করে আমরা বলেছি, জগুদা, তোমার ওই ঘুগনি একটু বেশি করে বানালেই পারো।
জগুদা ঘাড় নেড়ে বলেছে, না ভাই, তা হয় না। ওসব মাল একসঙ্গে বেশি রান্না করলে ঠিক সোয়াদ আসে না। সে ম্যাড়মেড়ে বারোয়ারি তারের জিনিস হয়। তা ছাড়া খদ্দেরের মর্জির ওপর কী বিশ্বাস আছে? আজ তোমরা রাত দশটায় ঘুগনি খেতে এলে, কাল যদি না আসো? দোকানের মাল তাড়াতাড়ি ফিনিশ হয়ে যাওয়াই বিজনেসের লক্ষ্মী!
জগুদার মাংসের ঘুগনির নাম ছিল প্যাঁটার ঘুগনি। শুধু খেপুতে কেন, আশপাশের সাত-আটখানা গাঁয়ের কোন মানুষটা অন্তত একবার জগুদার দোকানের বিখ্যাত প্যাঁটার ঘুগনি খায়নি?
ইভিনিং ডিউটির পর আমরা অনেক সময় জগুদার দোকানে শুধু চা খেতেও আসতাম। বারো নয়া পয়সায় এক কাপ গুড়ের চা। জগুদা সবাইকে বলে দিত, এই মাগগিগন্ডার বাজারে সে চিনি দিতে পারবে না। তবে সেই গুড়ের সঙ্গে আদা-টাদা মিশিয়ে এমন চা বানাতো যে একদিন খেলে রোজ না খেয়ে উপায় নেই।
আমরা জিজ্ঞেস করতাম, কী জগুদা, তুমি কি চায়ে আফিং মেশাও নাকি? নইলে এত টানে কেন?
জগুদা হেসে বলত, হ্যাঁ ভাই, আপিং বুঝি মাগনা পাওয়া যায়? বারো নয়ার চায়ে আমি কি আপিং মিশিয়ে ফৌত হব?
জগুদার দোকানে ধারের কারবার নেই। কোনো খদ্দের এক কাপ চা নিয়ে বেশিক্ষণ বসে থাকলেই জগুদা হাঁক দিতেন, এই মনো, টেবিল মুছে দে!
ওইটাই খদ্দেরকে উঠে যাওয়ার ইঙ্গিত।
পথ চলতি মানুষ অবশ্য জগুদার দোকানে বিশেষ আসে না। শনি মঙ্গলবারের হাটের দিনে তবু কিছু ভিড় হয়। আর বাদবাকি দিন আমাদের এই দেশলাই কারখানার ওয়ার্কাররাই আসে। কারখানার দরজা থেকে বিশ পা গেলেই জগুদার দোকান। তাও রাস্তা ছেড়ে খানিকটা দূরে মাঠের মধ্যে। দোকানের পেছনে দশ কাঠা জমি জগুদারই, সেখানে সে মটর ডাল আলুর চাষ করে। ওই দোকানেরই লাগোয়া একখানা ঘরে জগুদার শোয়ার জায়গা।
এই দোকান আমরা দেখে আসছি আজ বিশ বছর ধরে। দোকানের অবস্থা একই রকম আছে, ক্ষতিও হয়নি, বৃদ্ধিও হয়নি।
বিয়ে-থা করেনি জগুদা। নিজের বলতে কেউ নেই। তবে বছর সাতেক আগে তার এক বিধবা মাসি এসে হাজির। সঙ্গে আবার বারো-তেরো বছরের একটি মেয়ে। অবস্থার বিপাকে মাসির ভিটেমাটি উচ্ছন্নে গেছে, দু-মুঠো অন্ন জোটে না। তাই জগুদার কাছে কেঁদে পড়েছিল।
জগুদা তাদের ফেলে দেয়নি একেবারে। দোকানের কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। মাসির মেয়েটি হয়ে গেল দোকানের বয়। এর আগে জগুদা নিজেই খদ্দেরের টেবিলে চা এনে দিত, তখন থেকে সেই মেয়েটা এনে দেয়। আর মাসি বাসনপত্তর মাজে, ঘর মোছে, খেতের কাজ দেখে। অনেকদিন বাদে জগুদার ভাগ্যে খানিকটা আরাম জুটল। মাঝে-মাঝে জগুদা নিজেও এক কাপ চা নিয়ে খদ্দেরের সঙ্গে গল্প করতে বসত।
আড়াই বছর বাদে সেই মাসি মারা গেল ওলাওঠায়। আমরাই কাঁধ দিয়ে মাসিকে পুড়িয়ে এসেছিলাম নদীর ধারে।
মাসির মেয়ের নাম মনোরমা। এর মধ্যেই সে দোকানের কাজ বেশ শিখে নিয়েছে। ঠিক জগুদার মতনই চা বানায়। তার হাতের প্যাঁটার ঘুগনি বুঝি জগুদার থেকেও বেশি স্বাদের। আর পয়সা-কড়ির হিসেবেও বেশ পাকা। জগুদা তার ওপরে দোকানের ভার ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তি।
মনোরমার বয়েস আর কতই বা, বড়ো জোর পনেরো-ষোলো, কিন্তু দেখে মনে হয় যেন পঁচিশ ছাবিবশ। বেশ লম্বা, বড়ো-সড়ো চেহারা। একটু মোটার দিকে ধাত। রংটা তো বেশ কালোই, তার ওপর আবার ছেলেবেলায় পান বসন্ত হয়েছিল বলে মুখে একটা পোড়া পোড়া ভাব। মনোরমার গলার আওয়াজটা অনেকটা ছেলেদের মতন। লোকের মুখে মুখে চটাস চটাস করে কথা বলে সে।
জগুদা আর মনোরমা তখন থেকে সেই দোকানঘরেই একসঙ্গে থাকত বলে কেউ কেউ অকথা-কুকথা বলতে শুরু করেছিল। লোকের তো আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই। সব সময় জিভ সুড়সুড় করে, একটা কিছু পেলেই হল। মনোরমার মতন সোমত্ত মেয়ে রাত্তির বেলায় জগুদার মতন একটা পুরুষমানুষের কাছাকাছি শোয়—নিশ্চয়ই এর মধ্যে মন্দ কিছু থাকবে। হোক না মাসির মেয়ে—কী রকম মাসি তাই-বা কে জানে!
এসব কথা জগুদার কানে আসার পর সে দুঃখ পেয়েছিল। আমরা যারা পুরোনো খদ্দের, আমাদের কাছে আপসোস করে বলেছিল, আচ্ছা তোমরাই বলো দিকিনি, এমন পাপ কথাও লোকের মনে আসে? মেয়েমানুষে আমার অরুচি, নইলে এতগুলো বছর কেটে গেল একটা কি বিয়ে-থা করতে পারতুম না? ছি ছি ছি, ঘেন্না—নিজের মাসতুতো ভগ্নী, তাকে নিয়ে এমন কথা! মেয়েটা এখানে শোবে না তো কোথায় শোবে? ও মেয়েকে যদি কেউ বিয়ে করতে চায়, আমি এক্ষুনি বিয়ে দিতে রাজি আছি। ধার দেনা করেও বিয়ে দেবো। তোমরা দ্যাখো না , কোনো পাত্তর আছে?
না, মনোরমার বিয়ে দেওয়া সহজ কথা নয়। তার পোড়া পোড়া মুখে বসন্তের দাগ—তাকে কে বিয়ে করবে? তা ছাড়া মনোরমার অমন দশাসই চেহারা, তার সঙ্গে মানাবে এমন জোয়ান মদ্দই-বা কোথায়?
আমি, রতন, পরাণ আর জিতেন—আমরা ডিউটি সেরে রোজই একবার জগুদার চায়ের দোকানে যাই। আমরা জানি, জগুদা মানুষটা মন্দ না। মেয়েমানুষের দিকে তার টান নেই সত্যিই, নইলে এতগুলো বছরের মধ্যে একদিনও তো অন্তত একটা খিস্তি-খেউড় শুনতে পেতুম ওর মুখে।
তা, জগুদা আর মনোরমাকে নিয়ে বদনামটা রটবার পর কিন্তু জগুদার দোকানে ভিড় বেশ বেড়ে গেল! এক একসময় এসে আমরাই জায়গা পাই না। মনোরমার মুখখানা নাই-বা সুন্দর হল তার জামা উপছোন বুক আর ভারী পাছার দিকে নতুন খদ্দেররা হ্যাংলার মতন তাকিয়ে থাকে। তারা দু-তিন কাপ করে চা খায়। বাজারের দুটো রেস্টুরেন্টের কোনোটাতেই তো কোনো মেয়ে এসে চা দেয় না।
এত খদ্দের বেড়ে যাওয়ায় জগুদা কিন্তু খুশি হয়নি। তার নিরিবিলি দোকানের বাঁধা খদ্দেরই পছন্দ। অচেনা খদ্দেররা কখনও একটু বেশি চেঁচিয়ে কথা বললে জগুদা হাঁক দেয় আস্তে, আস্তে, এটা হাটবাজার নয়।
যাই হোক, তবু তো বেশ চলছিল! এর মধ্যে জগুদা একটা মহা নির্বুদ্ধিতার কাজ করল। এই বছর প্রথম বর্ষার শুরুতে জগুদা একদিন হুট করে মরে গেল। মেয়ের কী দশা হবে, সেটা একবার ভাবল না পর্যন্ত।
সেদিন আমাদের নাইট ডিউটি ছিল। নাইট ডিউটি শেষ হয় ভোর সাড়ে পাঁচটায়—ডিউটি সেরে আমরা ক’জন, না, সেদিন পরাণ ছিল না, তার বদলে আমাদের সঙ্গে ছিল পঞ্চু—গুটিগুটি এলাম জগুদার দোকানে। এমন অনেকবার হয়েছে, আজ ভোরে জগুদার দোকানের ঝাঁপ ওঠেনি, আমরাই ডেকে তুলে উনুনে আঁচ দিয়েছি। অসময়ে এলেও জগুদা অসন্তুষ্ট হত না।
সেদিন এসে দেখি মনোরমা মড়াকান্না কাঁদতে বসেছে! ও দাদা, দাদাগো—বলে সুর টেনে চলেছে মনোরমা। তাকে এর আগে আমরা তো কখনও কাঁদতে শুনিনি, তার মায়ের মৃত্যুর সময়েও সে চেঁচিয়ে কাঁদেনি—সেইজন্য তার ভাঙা ভাঙা গলা শুনে আমরা একেবারে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম।
ওপাশের ঘরটায় উঁকি দিয়ে দেখি মেঝের ওপর টানটান হয়ে শুয়ে আছে জগুদা। চোখ দুটো খোলা, ওরে বাবারে, ওরকম চোখ দেখলেই ভয় করে। পঞ্চু নীচু হয়ে জগুদার গায়ে হাত ছুঁয়ে বলল, এ তো একেবারে ঠান্ডা কাঠ। অনেকক্ষণ আগেই মারা গেছে।
পাশাপাশি দুটো বালিশ। জগুদা আর মনোরমা পাশাপাশি শুত তাহলে। সেমিজের ওপরে একটা আলুথালু শাড়ি জড়িয়ে মনোরমা হাপুস হয়ে কাঁদছে। আমি অন্যদের অলক্ষ্যে মনোরমার বালিশটা পা দিয়ে ঠেলে ঘরের কোণের দিকে সরিয়ে দিলাম। এরপর পাঁচটা লোক আসবে, তারা এ নিয়ে আবার পাঁচ রকম কথা বলবে, কী দরকার।
শরীরে কোনো রোগব্যাধি ছিল না জগুদার। তবু এমন করে মরে গেল কেন? সবাই বলল, সন্ন্যাস রোগ। ও রোগে মানুষ এমনিই রাত্তিরবেলাই নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে হঠাৎ চলে যায়। আমাদের পঞ্চু বলল, জগুদার নিশ্চয়ই হার্ট উইক হয়ে গেশল। হোমিওপ্যাথিতে এর ভালো চিকিচ্ছে আছে। আহা, আগে জানলে—
যাই হোক আমরা সবাই মিলে তো জগুদাকে পুড়িয়ে-ঝুড়িয়ে এলুম। কিন্তু এবার মেয়েটার কী গতি হবে? সেই কথা বলেই মনোরমা কাঁদছিল। ও মা গো, আমি এখন কোথায় যাবো গো। আমি কার কাছে যাবো!
দু-তিন দিন তো এইভাবেই কাটল। আমরা রোজই আসি। চা বন্ধ, কিন্তু এই দোকানটাতে আসাটাই যে আমাদের নেশা। গত কুড়ি বছর ধরে আসছি, হঠাৎ কি না এসে পারা যায়?
শেষে আমরাই মনোরমাকে পরামর্শ দিলাম, তুই আবার দোকান খোল দিদি। তোকে তো খেয়ে পরে বাঁচতে হবে, এই দোকানই তোর ভরসা। তা ছাড়া এই দোকানটাই ছিল জগুদার প্রাণ, এটাকে বাঁচিয়ে না রাখলে যে জগুদার আত্মা তৃপ্তি পাবে না।
ছ’দিনের মাথায় মনোরমা চোখের জল মুছে আবার দোকানের ঝাঁপ তুলল। আবার খদ্দের আসতে লাগল। জগতে কেউ কারুর জন্যে বসে থাকে না। অমন যে জবরদস্ত হাসি-খুশি মানুষটা ছিল জগুদা, সে চলে যাওয়ায় কিছুই ঘাটতি পড়ল না, কিছুই থেমে থাকল না।
তবে ধন্য সাহস বটে মনোরমার। ওই মাঠের মধ্যে দোকানঘরে সে একলা থাকে। যে ঘরে জগুদা মরেছে, সেই ঘরেই সে এখন একলা শোয়, একটুও ভয়ডর নেই তার। আমরা বলেছিলুম কোনো একটা বুড়ি মেয়েমানুষকে ওর কাছে রাখতে। কাজকম্মেও সাহায্য হবে, রাত্তিরেও কাছে থাকবে। মনোরমা বলেছে, তার কোনো দরকার নেই। একটা লোক রাখা মানেই তো বাড়তি খরচ।
এক বচ্ছর কেটে গেছে, এর মধ্যে একদিনের জন্যেও একটা চোর পর্যন্ত ঢোকেনি ওই দোকানঘরে। আমাদের এদিকে চোর ছ্যাঁচোড়গুলোও সব রোগা প্যাংলা, তাদের এমন সাহস নেই যে, মনোরমার মতন অমন খান্ডারনি মেয়েমানুষের ঘরে ঢোকে। মনোরমার এখন ভারভাত্তিক চেহারা, দেখে কেউ ওর বয়স বুঝবে না। আমরা জানি, ওর বয়েস বাইশ। কিন্তু লোকে ভাববে বত্রিশ।
অ্যাদ্দিন কোনো সাইনবোর্ড ছিল না, এখন মনোরমা দোকানের সামনে একটা সাইনবোর্ড লাগিয়েছে। ‘জগুদার চায়ের দোকান’। জগুদা এখন নেই, তবু দোকানের সঙ্গে তার নামটা টিকে গেল।
দোকান বেশ ভালোই চালাচ্ছে মনোরমা। আমরা ক’জন হলুম’গে তাঁর গার্জেন। আমরা সবচেয়ে পুরোনো খদ্দের, আর বলতে গেলে জগুদার বন্ধুই ছিলাম, তাই, আমাদের সে অধিকার আছে। মনোরমাও আমাদের তেমনভাবেই মান্য করে। আমাদের পরামর্শ-টরামর্শও মন দিয়ে শোনে। রোজ একবার করে আমরা খবর নিতে আসি। আমি, তরুণ, পরাণ আর জিতেন, মাঝে মাঝে পঞ্চুও এসে আমাদের সঙ্গে জোটে।
আমাদের দেশলাই কারখানায় তিন-রকমের ডিউটি। ডে, ইভিনিং আর নাইট। আমাদের কোন সপ্তায় কখন ডিউটি থাকবে, তা পর্যন্ত মনোরমার মুখস্থ। সেই অনুযায়ী সে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে। কখনও যদি আমাদের চারজনের এক শিফটে ডিউটি না পড়ে, তাহলে হয় গণ্ডগোল। তখন আর একসঙ্গে আসা হয় না। তবু একবার করে ঘুরে যাই সবাই।
একহাতে দোকান চালাবার ক্ষমতা রাখে বটে মনোরমা। সে-ই চা বানাচ্ছে, সে-ই ঘুগনি রাঁধছে, সে-ই টেবিল পরিষ্কার করছে। আজকাল আবার সে মামলেটও বানায়। নোনতা বিস্কুট ছাড়া, সে একটা কাঁচের বোয়ামে কেকও এনে রেখেছে।
এক এক সময় আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখি তার কেরামতি। কোনো একটা খদ্দের একটা অচল আধুলি দিয়েছিল। এক পেলেট ঘুগনি আর এক কাপ চা খেয়ে সে খুচরো আট পয়সা ফেরত চাইল না। বাবুগিরির কায়দায় সে মনোরমার সামনে আধুলিটা রেখে বলল, খুচরোটা তুমিই নিও!
সে খদ্দের দোকানের দরজার কাছে পৌঁছবার আগেই মনোরমা ছুটে গিয়ে তার কাছা ধরেছে। কড়কড়ে গলায় মনোরমা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ওরে আমার ভালোমানুষের ছেলে! আমি কি তোমাকে নকল খাবার দিয়েছি যে তুমি আমাকে নকল পয়সা চালাচ্ছ?
খদ্দের যেন কিছুই জানে না , আমসিপানা মুখটি ভরে বলল, নকল পয়সা! কে বলেছে? এই তো আমি সিগ্রেটের দোকান থেকে একটু আগে ভাঙিয়ে আনলাম।
মনোরমা আধুলিটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললো, সে তুমি সিগ্রেটের দোকানদারের সঙ্গে বোঝো গে। আমার খাঁটি জিনিসের খাঁটি পয়সা দিয়ে যাও!
পয়সাটা মাটিতে পড়ে ঠং করে শব্দ পর্যন্ত হল না।
খদ্দের পকেট উলটে বলল, আর তো পয়সা নেই!
খাবার বেলা সে কথা মনে ছিল না?
আমরা চারজন কোণের টেবিলে বসে মিটিমিটি হাসছি। আমরা তো জানিই, ও খদ্দের ব্যাটা বেশি ট্যান্ডাই-ম্যান্ডাই করলে তক্ষুনি গিয়ে ওর টুঁটি টিপে ধরব। আমরা মনোরমার গার্জেনরা এখানে বসে আছি। ও ভেবেছে মনোরমা অবলা মেয়েছেলে!
আমাদের সে রকম কিছু করবার দরকার হল না। মনোরমা নিজেই দোকানের বাকি খদ্দেরের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, আপনারাই পাঁচজনে বলুন, আমি খেটেখুটে দোকান চালাচ্ছি, কোনো দিন কারুকে খারাপ জিনিস দিইনি—কাল দুটো পচা ডিম বেরুল, তাও আমি প্রাণে ধরে ফেলে দিলুম—আর আমাকে এরকমভাবে লোকে ঠকাবে? এই কি ধর্ম?
যেসব নতুন খদ্দেররা মনোরমার গতর দেখতে আসে। তারা সঙ্গে সঙ্গে বললে, খুব অন্যায়! নিশ্চয়ই ওর ট্যাঁকে আরও পয়সা আছে।
মনোরমা তখনো লোকটার কাছা টেনে ধরে আছে। লোকটার তখন কাঁদো কাঁদো অবস্থা। মনে হয় কোনো সাধারণ হাটুরে লোক। তা বলে ওকে ছেড়ে দেবার কোনো কথাই ওঠে না।
পরাণ হাঁক দিয়ে বললে, ওর জামা খুলে নে, মনো!
লোকটা হাত জোড় করে বললে, আমাকে আজ ছেড়ে দিন। আমাকে একটা শ্রাদ্ধবাড়িতে যেতে হবে। আমি কাল ঠিক এসে পয়সা দিয়ে যাবো!
শ্রাদ্ধবাড়ির কথা শুনে আমরা সবাই হেসে উঠলাম। রতন বললে, ব্যাটা শ্রাদ্ধবাড়িতে যাবি তো জুতো পরে যাবার দরকার কী? জুতো জোড়া খুলে রেখে যা!
লোকটার পায়ে প্রায় নতুন এক জোড়া রবারের পাম্পশু। জামার বদলে শেষ পর্যন্ত জুতো জোড়া খুলে রেখে লোকটা নিস্তার পেল। সে লোকটা আর জুতো নিতে আসেনি। জুতোজোড়া পড়েই ছিল দোকানে, শেষ পর্যন্ত আমাদের কারখানার দারোয়ান দেড় টাকা দিয়ে সে-দুটো কিনে নিল।
আর একবার একটা লোক নাকি দুপুর দুপুর এসে ইচ্ছে করে মনোরমার গায়ে হাত দিয়েছিল। পয়সা দেবার সময় ইচ্ছে করে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল একেবারে মনোরমার বুকের ওপর। ঘটনাটি আমি নিজের চোখে দেখিনি, রতনের মুখে শুনেছি। আমাদের মধ্যে শুধু রতন ছিল দোকানে।
রতন লাফিয়ে উঠে গিয়ে লোকটার ঘাড় চেপে ধরেছিল। তাকে ঠেলতে ঠেলতে দোকানের বাইরে করে দিচ্ছিল, সেই সময়ে মনোরমা এসে বলেছিল, দাঁড়াও রতনদা, এ লোকটার বেশি রস উথলে উঠেছে, একটু শিক্ষা দিয়ে দিই! এই বলে মনোরমা লোকটার নাকে এমন ঘুষি মারল যে রক্ত বেরিয়ে গেল! মনোরমার ওই গোদা হাতের মার সহ্য করার ক্ষমতা আছে কার?
মনোরমা লোকটাকে সেই অবস্থায় দোকানের বাইরে ঠেলে ফেলে দিয়ে বলেছিল, ফের যদি এদিকে আসিস তোর একটা হাড়ও আস্ত রাখব না। গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দিয়ে দেব মুখে, বুঝলি।
এরপর থেকে রসিক ছোকরারা শুধু চাউনি দিয়ে মনোরমার গা চেটেই যা সুখ পায়, ধারে কাছে ঘেঁষতে আর সাহস করে না কেউ।
জগুদার সঙ্গে মনোরমার একটা ব্যাপারে বেশ মিল আছে। বেশি খদ্দের টেনে এনে বেশি লাভ করার দিকে তারও লোভ নেই। বাছাই করা খদ্দের নিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট দোকান চালাতেই সে চায়। সে খাঁটি জিনিস দেবে। তার বদলে ভেজাল খদ্দের তার দরকার নেই।
যে যে হপ্তায় ইভিনিং ডিউটি থাকে, সেইসব সময়েই জগুদার দোকানে আমরা বেশিক্ষণ কাটাই। ডিউটি শেষ হয় রাত নটায়—কোনো কোনোদিন সাড়ে আটটার মধ্যেই বেরিয়ে আসি। আট ঘন্টা ডিউটির পর আমাদের শরীর ক্লান্ত থাকে তবু তখুনি বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে হয় কোথাও নিরিবিলিতে বসে একটু সুখ-দুঃখের গল্প করি।
তা রাত নটার পর জগুদার দোকান একেবারে নিরিবিলিই হয়ে যায়। লাস্ট বাস চলে যায় ন’টা দশে, তারপর এ রাস্তায় তো আর মানুষজন থাকেই না বলতে গেলে। মনোরমা আমাদের ডিউটির সময় জানে , আমরা দোকানে ঢুকে বসবার সঙ্গে সঙ্গে সে চা এনে দেয়। অ্যাসট্রের ছাই ফেলে পরিষ্কার করে আনে। তারপর সে ক্যাশের সামনে বসে সারাদিনের হিসাব করতে বসে। সেই সময় সে আপন মনে গান গায়।
মনোরমার গান ভারী অদ্ভুত। তার গলা ভালো না। কথা বলার সময় তার গলাটা পুরুষমানুষের মতন হেঁড়ে হেঁড়ে মনে হয়। কিন্তু গান গাইবার সময় সে একটা অদ্ভুত সরু গলা বার করে, অনেকটা কুকুরের কুঁইকুঁই-এর মতন। যে কুকুর ঘেউ ঘেউ করে সেই কুকুরই তো আবার কুঁইকুঁই করে এক সময়। মনোরমাও সেই রকম। আর রোজ সে একই গান গায় :
যে জ্বরে জ্বরেছে মা, তোর কানাই
মা, তোমায় কেমনে জানাই
এমন ছেলের এমন রোগ দেখি নাই—
শুধু ওইটুকুই আর বেশি না। ওই ক’টা লাইনই বার বার ঘুরে ফিরে গায়। এই অদ্ভুত গান। এই অদ্ভুত গান কোথা থেকে সে শিখল তাও জানি না।
রতন জিজ্ঞেস করে, আজ কত বিক্কিরি হল মনোদির?
মনোরমা উত্তর দেয়, সাতাশ তিরিশ নয়া। তা ভালোই হয়েছে।
যেদিন বিক্কিরি অনেক কম হয়, সেদিন সে কোনো আফসোস করে না। রোজই পয়সা গোনার সময় সে এ রকম সন্তুষ্টভাবে গান গায়।
এক একদিন সে আমাদের জন্য ঘুগনি বাঁচিয়ে রাখে। বিশেষ করে শনিবার। মনোরমা জানে। রবিবার আমাদের অফ ডে, তাই শনিবার রাত্রে স্ফুর্তি করি। চায়ের কাপ নিয়ে আমরা চুপচাপ বসে থাকি এক কোণের টেবিলে। কোনো কথাও বলি না। শেষ খদ্দেরটি চলে যাবার পর আমরা আড়মোড়া ভাঙি। তখন রতন বলে, মনো দিদি, চারটে গেলাস দিবি?
মনোরমা আমাদের সামনে এসে কোমরে হাত দিয়ে জাঁদরেল ভঙ্গিতে দাঁড়ায়। তারপর চোখ পাকিয়ে বলে, এখন বুঝি ওইসব ছাই-ভস্ম খাওয়া হবে আবার?
আমাদের একজনের পকেট থেকে একটা বাংলার পাঁইট বেরোয়। আমরা বলি, এই তো এইটুকুনি, এ তো এক চুমুকেই শেষ হয়ে যাবে!
মনোরমা বলে, ঠিক? আর বেশি খাবে না?
না দিদি, আর পাবো কোথায়?
আমরা মনোরমার গার্জেন। কিন্তু এই সময় সে-ই আমাদের ওপর গার্জেনি করে। আমাদের প্রত্যেকের পকেটেই যে একটা করে পাঁইট আছে, সে কথা জানতে দিই না ওকে।
মনোরমা চারটে গেলাস নিয়ে আসে। নাক সিঁটকে বলে, ইঃ কী বিচ্ছিরি গন্ধ। তোমরা এসব খেয়ে যে কী আনন্দ পাও!
তুই একটু খাবি নাকি? তাহলে তুইও আনন্দ পাবি!
রক্ষে করো! আমার আর আনন্দ পেয়ে দরকার নেই। আমি বেশ আনন্দেই আছি!
প্রত্যেক শনিবার ঠিক এই একই কথা হয়। প্রত্যেকবারেই আমরা এতে আনন্দ পাই। মনোরমা আমাদের জন্যে চার প্লেট ঘুগনি নিয়ে আসে। তখনও গরম। আমাদের জন্য যত্ন করে ঘুগনিটা আবার গরম করেছে, এই জেনে বেশ সুখ হয়।
মনোরমা কিচেনে গেলেই আমরা পকেট থেকে বোতল বার করে আবার গেলাসে ঢেলে নিই। ক্রমে ক্রমে নেশা ধরে, আমাদের চোখ চকচকে হয়ে আসে, কপালে বিন বিন করে ঘাম। পরাণ একটু গান ধরতে গেলেই জিতেন তাকে ধমকে ওঠে, চোপ। তুই গান গাইবি না। এখন আমরা মনোরমার গান শুনবো।
রতন বলে, মনো, আমাদের কাছে একটু আয় না দিদি!
মনোরমা মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, তোমরা আর কত দেরি করবে?
এই তো হয়ে এলো, আর একটু বাদেই চলে যাব। আয় না, আমাদের কাছে এসে একটু বোস, দুটো কথা বলি।
মনোরমা একটা চেয়ার টেনে এনে বসে। একটু দূরে, যাতে বাংলার গন্ধটা তার নাকে না যায়।
জিতেন বলে, ধর তো মা তোর ওই গানটা!
মনোরমা অমনি তার সেই গান ধরে, এমন ছেলের এমন রোগ দেখি নাই—
বার বার শুনতে শুনতে আমাদের ঘোর লেগে যায়। মনে হয়, আহা, কী আশ্চর্য গান! এমনি কখনও শুনিনি! পরাণ টেবিল চাপড়ে তাল দেয়। রতন আহা আহা বলতে বলতে কেঁদে ফেলে।
মনো, তুই নাচ জানিস না দিদি?
মনো চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, দেখবে? আমার নাচ দেখবে?
অমনি সে দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে চোখ বুজে বোঁ বোঁ করে ঘুরতে থাকে। ঠিক আনি মানি জানি না খেলার মতন। এই রকম বোঁ বোঁ করে ঘোরাকে যে কেন ও নাচ বলে, তা আমরা বুঝি না। তবু প্রত্যেক শনিবার আমরা মনোরমাকে নাচতে বললেই সে এরকম ঘোরে।
তখন মনোরমাকে বড়ো সুন্দর লাগে আমাদের! হোক না সে কালো, বসন্তের দাগওয়ালা পোড়া পোড়া মুখ, হাত-পাগুলো মুগুরের মতো, আর বিরাট বিরাট দুই বুক আর পাছা—তবু সুন্দর দেখায় তাকে।
মনোরমার নাচের সময় আমরা চারজন উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ি। ওর নাচটা আমাদের খেলা। আমরা বয়স্ক চারজন লোক সেই সময় খেলায় মেতে উঠি। আমরা দূর থেকে বলি, মনো, আমাদের ধর দেখি!
মনোরমা ঘুরতে ঘুরতে এসে আমাদের একজনের গায়ের ওপর পড়ে। সে তখন টুঁ শব্দটি করে না। তখন মনোকে বলতে হবে, সে কাকে ছুঁয়েছে।
মনোরমা চোখ না খুলেই তার গায়ে হাত বুলোয়। থুতনি ধরে নাড়ে, দুষ্টুমি করে কান দুটো টানে, তারপর চেঁচিয়ে বলে ওঠে, ও এ তো বঙ্কুদা!
মনোরমা যখন আমাকে ধরে এরকম গায়ে মুখ হাত বুলোয়। আমার শরীরটা একেবারে জুড়িয়ে যায়। ইচ্ছে হয়, মনোরমা অনেকক্ষণ ধরে আমাকে চিনতে না পারুক!
অন্যরা তখন হিংসে হিংসে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে দূরে। এক রাত্তিরে এই খেলা দু’বার খেলে না মনোরমা। সুতরাং একজনেরই ভাগ্যে শুধু মনোরমা আসে এক এক শনিবারে।
আমাদের বাড়িতে বউ ছেলেপুলে আছে। বুড়ি মা আছে, অভাব আছে, ফুটো টিনের চাল আছে। পোকা লাগা বেগুন আছে। আর অনেক কিছুই নেই। বাড়িতে গেলেই তো শুনতে পাই হ্যানো নেই, ত্যানো নেই। কিন্তু শনিবার রাত্তিরে এ সময়টা আমরা সেসব কিছু ভুলে যাই। তখন শুধু আমরা চারজন আছি, আর মনোরমা।
ছেলে-ছোকরারা হাতে পয়সা পেলেই বাজারের সিনেমা হলে ছোটে। সেখানে ধর্মেন্দর আর হেমা মালিনীর জাপটা-জাপটি দেখে তারা কী সুখ পায় কে জানে। আমাদের সিনেমা হলটাও হয়েছে এমন, হপ্তায় দুবার করে বই পালটায়। আমরা ওসব দেখতে যাই না কখনও। আমাদের মনোরমা আছে।
রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটা বেজে যায়। মনোরমা বলে, ওগো, তোমরা বাড়ি যাবে না? এরপর বাড়ি গেলে যে বউ তোমাদের প্যাঁদাবে।
আমরা হা হা করে হেসে উঠি। মনো এমন মজার কথা বলে। আমরা জানি, মনোরমা এরপরই একটা গল্প বলবে। প্রত্যেক শনিবারই বলে। বর্ধমানে ওরা কিছুদিন এক কাকার বাড়িতে ছিল। সে বাড়ির ওপরতলায় থাকত এক ভদ্রলোক আর তার বাঁজা বউ। ভদ্রলোকটি রোজ রাত্তিরে মাল টেনে আসত আর বাড়ির দরজায় ঢুকেই বলত, আর করব না, আর কোনোদিন করব না! কিন্তু তার বউ তখুনি ছুটে এসে তাকে দুমদাম করে মারত। সে কী মার! অনেক দূর থেকে সেই শব্দ শোনা যায়। লোকে শুনে ভাবে, ছাদ পেটাই হচ্ছে।
গল্প শুনে আমরা হেসে হেসে গড়িয়ে পড়ি। প্রত্যেক শনিবার। জিতেন পেট চেপে ধরে বলে, থাম, মনো থাম, আর বলিস না! ওসব ভদ্রলোকদের কথা আর বলিস না! টাকা রোজগার করে যে বউকে খাওয়াবে আবার সেই বউয়ের হাতে মারও খাবে, এসব ভদ্রলোকেরাই পারে!
পরাণ বলে, মনো, আমাদের মতো কেউ যদি তোকে বিয়ে করত, তুই তাকে মারতিস!
মনোরমা বলে, মারতাম না আবার! মেরে একেবারে পাট করে দিতাম।
রতন বলে, ভাগ্যিস আমি তোকে বিয়ে করিনি! তোর হাতের মার খেলে আমি মরেই যেতাম!
রতন এক-এক দিন নানারকম দুষ্টু বুদ্ধি বার করে। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে হঠাৎ উ-হু-হু করে ওঠে। তারপর বলে, ইস পায়ে খিল ধরে গেল। মনো একটু টেনে তোল তো আমাকে!
মনোরমা এসে তাকে টেনে তুলতেই সে মনোরমার গলা জড়িয়ে ধরে। ঠিক যেন বাতের রুগি। কিন্তু ওসব চালাকি কি আর আমরা বুঝি না!
পরাণ আজ বলে, আমাদেরও পায়ে খিল ধরেছে। কি রে বঙ্কা, তোর ধরেনি? জিতেন?
আমরা বলে উঠি, হ্যাঁ আমাদেরও পায়ে খিল ধরেছে। আমরা তো একসঙ্গে বসে আছি।
জিতেন বলে, রতনকে মনো টেনে তুলেছে। আমাদেরও টেনে তুলবে!
মনো হেসে ফেলে বলে, তোমরা সব বুড়ো খোকা! তোমাদের নিয়ে আর পারি না! এবার যাও, নইলে ঝেঁটিয়ে বিদায় করব বলছি!
ব্যাস, ওই পর্যন্ত। ওর বেশি আর আমরা এগোই না। এবার আমাদের বাড়ি ফেরার পালা। আমাদের তো ঘরসংসার আছে। একটা করে বাড়ি আছে। সে বাড়িতে কত কিছুই নেই। আমরা বেরিয়ে আসার পর মনোরমা ঝাঁপ বন্ধ করে দেয়। আমরা চারজন পাশাপাশি হাঁটি।
এক সময় রতন বলে, আমাদের মনো বড়ো ভালো মেয়ে।
আমরা বাকি তিনজন তখন ওই এক কথাই ভাবছিলাম।
রতন বলে, এমন ভালো মেয়ে, অথচ তার একটা বিয়ে হল না! মেয়েটা সারা জীবন এরকম কষ্ট পাবে?
আমরা আমাদের মনের মধ্যে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখি। মনোরমার সঙ্গে বিয়ে দেবার মতো কোনো পাত্রের কথা মনে পড়ে না।
রতন কাঁদতে আরম্ভ করে। একটু নেশা হলেই কান্নাকাটি করা রতনের স্বভাব। ফোঁপাতে ফোঁপাতে এক সময় সে বলে, আমি যদি আগে বিয়ে না করে ফেলতাম তাহলে আমিই মনোকে বিয়ে করতাম। এ কথা নিশ্চয় করে বলছি। আহা মনোরমার হাতে মার খেয়েও আমার সুখ হত।
বলতে বলতে রতন হঠাৎ থেমে যায়। আমাদের চোখের দিকে তাকায়। আমরা ওর দিকে কটমট করে চেয়ে আছি। রতনটা স্বার্থপরের মতো কথা বলছে। আমরাও তো ভুল করে ফেলেছি আগে। আমাদেরও বাড়িতে প্যানপেনে রোগাপটকা, অসুখে-ভোগা, হাড়-জ্বালানি বউ আছে। তার বদলে মনোরমাকে বিয়ে করলে অনেক বেশি সুখ হত। কিন্তু, একজন কেউ বিয়ে করলেই তো মনোরমা শুধু তার হয়ে যেত। বঞ্চিত করা হত আর তিনজনকে। তখন কি আর অন্য কেউ পায়ে ঝিঁঝি ধরেছে বলে মনোরমার গলা জড়িয়ে ধরতে পারত?
না! আমরা আগে বিয়ে করেছি, ভালোই হয়েছে। আমরা কেউ আর মনোরমাকে বিয়ে করতে পারব না। সেইজন্যই, মনোরমা আমাদের চারজনের হয়ে থাকবে। তাই তো আমাদের আড্ডায় পঞ্চুকেও সঙ্গে আনি না।
আমাদের দেশলাই কারখানায় দুম করে পাঁচজন লোক ছাঁটাই হয়ে গেল। তার মধ্যে আমরা কেউ পড়িনি বটে, কিন্তু শুনছি আরও ছাঁটাই হবে। কখন কার ওপর কোপ পড়বে তার ঠিক নেই। সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি। বাজার খুব মন্দা! ম্যাড্রাস থেকে সস্তা দামের দেশলাই এসে বাজার ছেয়ে ফেলেছে।
ডিউটি শেষ করে বেরুবার সময় মুখটা তেতো তেতো লাগে। প্রত্যেকদিন ভয় হয়, কাল এসে কী নুটিস ঝুলতে দেখবে কে জানে। আবার কেউ কেউ বলছে, লক আউট হবে!
ব্যাজার মুখ করে জগুদার চায়ের দোকানে আসি। মনোরমা দোকানটাকে বেশ দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। প্রায় সে বলে, দোকানের জন্য এবার সে ফার্নিচার করবে। চেয়ার টেবিলগুলো নড়বড়ে হয়ে গেছে, কয়েকখানা না বদলালেই নয়।
আমরা মনোরমাকে ঠান্ডা মাথায় উপদেশ দিই। এক্ষুনি হুট করে কিছু করে ফেলিস না দিদি! দিন কাল ভালো নয়। হাতে পয়সা থাকা ভালো।
মনোরমা বলে, তোমরা আজকাল এত গোমড়া মুখে থাকো কেন গো? আর বুঝি এ দোকানের চায়ে স্বাদ নেই?
আমরা হাহা করে উঠি। সে কি কথা! মনোরমার চায়ের হাত দিন দিন মিষ্টি হচ্ছে। গুড় দিতে ভুলে গেলেও মিষ্টি।
আমরা মনোরমার দোকানে কখনও ধার রাখি না। এ নিয়ম সেই জগুদার আমল থেকে চলে আসছে। ধার রাখলেই ধার জমে যায়—পরে আর শোধ করা হয় না। ধার রাখলেই দোকানের মালিকের সঙ্গে ভাব নষ্ট হয়। আমরা চারজন এখন মনোরমার গার্জেন, কিন্তু কেউ বলুক দেখি কোনো একদিনও ওর দোকানে মাগনায় খেয়েছি। হাতে পয়সা না থাকলে সেদিনটা আর দোকানেই আসি না। তবে, আমরা সকলেই জানি। আমাদের একজন না গেলেও অন্য তিনজন যাবে, মনোরমার দেখাশোনা করে আসবে।
তবে, শনিবারের আড্ডায় কেউ বাদ পড়ি না। কারখানার ফোরম্যানকে ঘুষ দিয়ে হাত করা আছে, কোনো রবিবার আমাদের নাইট ডিউটি দেবে না!
শনিবার দিন পকেট থেকে আমরা মালের বোতল বার করলে প্রত্যেকবার মনোরমা বকাঝকা করে। কিন্তু আমরা জানি, শনিবারের এই মজাটুকু মনোরমাও পছন্দ করে খুব, সারা হপ্তা মনোরমাও মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খাটে, ওর তো জীবনে আর কোনো আনন্দই নেই। আমাদের সঙ্গে ওইটুকু খেলাধুলোই ওর ফুর্তি।
তা এক শনিবার আমরা অনেকক্ষণ থেকে উসখুস করছি, শেষ লোকটা আর কিছুতেই ওঠে না। লোকটা এক টেবিলে একা বসে আছে, একটা হাত থুতনিতে, কী যেন ভেবেই চলেছে। রোগা লম্বাটে চেহারা লোকটার, জামাকাপড় বেশ ফরসা। একে আগে কখনও দেখিনি। প্রথমে ভেবেছিলাম, লোকটা বুঝি মনোরমার দিকে হ্যাংলা দৃষ্টি দিচ্ছে, তারপর বুঝলাম, তা না, লোকটার চোখ শুধু দেয়ালের দিকে—সে অন্য কিছুই দেখছে না।
আমাদের এ দোকান থেকে বিনা দোষে কোনো খদ্দেরকে কখনও তাড়িয়ে দিই না। কেউ যদি একটু বেশিক্ষণ বসতে চায় বসুক না! কিন্তু লোকটা এক কাপ মাত্র চা নিয়ে বসে আছে তো বসেই আছে।
রতন গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ক’টা বাজল।
পরাণ বলল, ন’টা বেজে গেছে!
জিতেন বলল, লাস্ট বাস এক্ষুনি চলে যাবে বোধহয়!
আমরা ভাবলাম, যদি এসব কথা শুনে লোকটা উঠে পড়ে। ভিনদেশী লোক, লাস্ট বাস চলে গেলে ফিরবে কী করে?
লোকটা এসব কথা শুনেও উঠল না। বরং টেবিলের ওপর মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল। আমরা এ ওর মুখের দিকে তাকালাম। এ আবার কী ব্যাপার!
আমরা মনোরমাকে চোখের ইশারা করলাম। মনোরমা লোকটির সামনে দাঁড়িয়ে তার সেই ক্যারকেরে গলায় বলল, আপনি চা খাবেন না? এ তো অনেকক্ষণ ঠান্ডা হয়ে গেছে!
লোকটা কোনো কথা না বলে শুধু মুখ তুলে মনোরমার দিকে তাকাল।
মনোরমা আবার বললে, আমি এবার দোকান বন্ধ করব।
লোকটা আস্তে আস্তে বলল, আমি এই টেবিলের ওপর শুয়ে থাকব শুধু আজকের রাতটা।
এ আবার কেমনধারা কথা! সুবিধে মনে হচ্ছে না তো! গলার আওয়াজ শুনে মনে হল লোকটা নেশাখোর। ওসব ট্যান্ডাই-ম্যান্ডাই এখানে চলবে না। ও তো জানে না, আমরা মনোরমার গার্জেন, এখানে উপস্থিত আছি!
রতন উঠে গিয়ে বললে, এই যে মশাই উঠুন! এটা ঘুমোবার জায়গা নয়!
লোকটা বললে, শুধু রাতটা…এখানে থাকব…তার জন্যে পয়সা দেব।
রতন এবার লোকটার প্রায় ঘাড়ের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে বলল, ঘুমোতে হয় তো হোটেলে যান না, এখানে কেন?
হোটেল আছে এখানে?
বাজারের কাছে আছে অন্নপূর্ণা হোটেল, সোজা সেখানে চলে যান।
তাই যাব, আমাকে একটু ধরে তুলুন তো, উঠতে পারছি না।
রতন লোকটার গায়ে হাত দিয়েই চমকে বলে উঠল, ওরে বাবা, এ কী?
তারপর আমাকে ডেকে বলল, বঙ্কু, একবার এদিকে আয় তো।
আমি উঠে যেতেই রতন বলল, লোকটার কী হয়েছে, দ্যাখ তো?
লোকটা আবার ঘাড় গুঁজে শুয়ে পড়েছে। আমি তার একটা হাত ছুঁয়ে রতনের মতনই চমকে উঠলাম। লোকটার গা অসম্ভব গরম।
আমি বললাম, এ লোকটার তো খুব জ্বর হয়েছে দেখছি।
লোকটি আবার মুখ তুলল, চোখ দুটো অসম্ভব লাল। সে বলল, আমাকে একটু তুলে ধরুন, আমি ঠিক যেতে পারব।
লোকটির কথাবার্তা আমাদের মতন নয়। বোঝাই যায়, শহুরে ভদ্দরলোক। টিকোলো নাক, টানা টানা চোখ, ফরসা রং—সিনেমায় এমন চেহারা দেখা যায়। এমন লোক হঠাৎ আমাদের এখানে এসেছে কেন?
আমি আর রতন লোকটিকে দুদিক থেকে ধরে তুললাম। লোকটি মাতালের মতন টলতে লাগল। রতন জিজ্ঞেস করল, আপনার কী হয়েছে?
লোকটি বললে, মাথায় অসহ্য ব্যথা!
জিতেন চেঁচিয়ে বলল, বোধহয় ম্যালেরিয়া ধরেছে।
আমি বললাম, আপনি এই অবস্থায় যাবেন কী করে? মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন যে। আপনার বাড়ি কোথায়?
অনেক দূর।
এখানে কোথা থেকে এসেছেন?
সে কথার উত্তর না দিয়ে লোকটা বলল, আমাকে দয়া করে একটু রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছে দিন!
মনোরমা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিল। এবার সে জিজ্ঞেস করল, জ্বর হয়েছে, না নেশাভাঙ করেছে?
আমি বললাম, নেশা করলে গা গরম হয় না।
রাস্তা দিয়ে কি হাঁটতে পারবে?
বোধহয় পারবে না!
তাহলে ওই টেবিলের ওপরই শুইয়ে রাখো!
এই কথাটা আমিও ভাবছিলাম। একটা অসুখে পড়া অসহায় লোককে রাস্তায় ফেলে রেখে আসার কোনো মানে হয় না। চেহারা দেখেই বোঝা যায় ভদ্রলোক, পয়সাওয়ালা বাড়ির ছেলে। সে এখানে মরতে এল কেন?
লোকটাকে আমরা টেবিলের ওপরেই শুইয়ে দিলাম। একটা ডাক্তার এনে দেখালে ভালো হত। কিন্তু অত রাত্তিরে ডাক্তারই বা কোথায় পাওয়া যাবে?
আমি বললাম, আপনি কিছু ওষুধ-টষুধ খাবেন না!
লোকটা বলল, না, দরকার নেই, কাল সব ঠিক হয়ে যাবে।
মনোরমা বলল, একটু জল দিয়ে মাথাটা ধুইয়ে দেব?
তা দাও না।
মনোরমা ঘর মোছার বালতিতে করে নিয়ে এল এক বালতি জল আর মগ। মগে করে মাথায় জল ঢালতে গিয়ে বলল, ও মা, এর মধ্যে দেখছি অজ্ঞান হয়ে গেছে। ডান পায়ের গোড়ালিটা দ্যাখো রতনদা, কতখানি ফুলে আছে , নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে পায়ে। সাপে-টাপে কামড়ায়নি তো?
রতন বলল, দূর! সাপে কামড়ালে কি এতক্ষণ কেউ কথা বলতে পারে? এমনি জ্বর-জারি হয় না মানুষের! সত্যি কি অজ্ঞান হয়ে গেছে? দেখি—রতন দু’চার বার নাড়াচাড়া দিয়ে দেখল, তবু লোকটার আর সাড়া নেই। সত্যিই অজ্ঞান হয়ে গেছে। মনোরমা তবু জল দিয়ে তার মাথাটা ধুইয়ে দিল।
এত হাঙ্গামার মধ্যে আর আমরা পকেট থেকে বাংলার বোতল বার করতেই পারিনি। রাত বাড়ছে, বাড়িতেও তো যেতে হবে।
পরাণ অধৈর্য হয়ে বলল, ও মনো চারটে গেলাস দে ভাই, আর দেরি করতে পারছিনি।
সেদিন খাওয়া হল বটে, কিন্তু জমল না। মনোরমা গান গাইল না। আমরা তাকে নাচতে বলতেও পারলাম না। ঘরের মধ্যে একটা অচেনা লোক হাত পা চিতিয়ে পড়ে আছে। এর মধ্যে কি আমরা আনি মানি জানি না খেলতে পারি! প্রতি শনিবার রাতে মনোরমার সঙ্গে আমাদের এই যে খেলাটা—সেটা তো সারা পৃথিবীর অজান্তে। তখন আর বাইরের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকে না। আজ শুধু আমরা চারজন আর মনোরমা। এর মধ্যে আবার এই উটকো উৎপাত এল কেন? এর বদলে একটা ডাকাত এলেও আমরা প্রাণপণে লড়াই করে তাকে মনোরমার কাছে ঘেঁষটে দিতাম না। কিন্তু এ যে একজন অসুস্থ লোক, একে রাস্তায় ফেলে দেওয়া যায় কী করে? মনোরমা এর মাথা ধুইয়ে দিলেও আমরা আপত্তি করতে পারি না।
অনেকটা ঝিম মেরে বসে থেকেই আমরা সময় কাটিয়ে দিলাম। এবার যেতে হবে। উঠে এসে আমরা প্রত্যেকে আবার লোকটার কপাল ছুঁয়ে দেখলাম। আমরা সঠিক জেনে নিতে চাই লোকটা সত্যিই অসুস্থ কিনা। যদি অসুখের ভান করে ঘাপটি মেরে থাকে, তাহলে এই দণ্ডেই আমরা ওকে লাথি মেরে বার করে দেবো।
না। গা এখনও গরম আগুন। এখনও জ্ঞান নেই। নিজের গা কেউ ইচ্ছে করে গরম করতে পারে না!
আমরা বিদায় নেবার জন্যে তৈরি হচ্ছি দেখে মনোরমা জিজ্ঞেস করল, এ এমনিই শুয়ে থাকবে? রাত্তিরে খাবে-টাবে না কিছু?
রতন বলল, খাওয়ার আর ক্ষমতা নেই।
ও রতনদা, যদি লোকটা মরে-টরে যায়?
আরে না। মরা অত সহজ নাকি? জ্বর হলে কেউ মরে না। লোকটা থাক এ রকম শুয়ে। সকাল হলে বিদায় করে দিবি।
আমরা বেরিয়ে এলাম। মনোরমা ঝাঁপ বন্ধ করে খিল লাগাল। আমাদের চার জনেরই মনের মধ্যে অস্বস্তি। আমরা মনোরমার গার্জেন , আর রাত্তিরবেলা তার কাছে আমরা অচেনা লোককে রেখে এলাম। এ ছাড়া আর উপায়ই বা কী?
একটু বাদে জিতেন বলল, লোকটা কে? চোর ছ্যাঁচোড় না তো?
পরাণ বলল, দেখে তো তা মনে হয় না।
আরে রাখ রাখ! চেহারা দেখে কি আর মানুষ চেনা যায়? বড়ো বড়ো শহরের চোরদের চেহারা ওরকম ভদ্দরলোকের মতনই হয়!
তা শহরের চোর জগুদার চায়ের দোকানে কী চুরি করতে আসবে?
রাজবন্দি নয় তো? জেল-টেল থেকে পালাতে পারে!
লোকটা নাম বলেনি, ধাম বলেনি! কোথা থেকে এল!
পুলিশ-টুলিশের হাঙ্গামা হবে না তো!
রতন থমকে দাঁড়াল। চিন্তিত ভাব করে বলল, আমাদের কারো আজ রাতে মনোরমার কাছে থাকা উচিত ছিল। যদি কোনো বিপদ-টিপদ হয়।
আমরা বাকি তিনজন তীক্ষ্ণ চোখে ওকে বিঁধলাম। রতনটা স্বার্থপরের মতন কথা বলছে। আমাদের প্রত্যেকেরও কি সেই ইচ্ছে হচ্ছে না? মনোর বিপদের সময় তার পাশে বুক পেতে দাঁড়াতে কি আমরা চাই না? কিন্তু এ কথাও জানি, আমাদের মধ্যে একলা কেউ মনোর সঙ্গে সারারাত থাকলে সে একলা একলা আনি মানি জানি না খেলা খেলবে। তাতে আমাদের বাকি তিনজনের বুক জ্বলে যাবে না।
রতন আমাদের তীক্ষ্ণ চোখ দেখে থতমত খেয়ে গেল। আবার চলা শুরু করে সে বলল, বাড়ি না ফিরলে বউ কি আমাকে ছাড়বে? নিজেই ছুটে আসবে হয়তো! জানে শনিবার এই সময়টা কোথায় থাকি!
আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। আমাদেরও ঘরে বউ ছেলেপুলে আছে। অশান্তি এত বেশি আছে যে আর বেশি অশান্তি ডেকে এনে কোনো কাজ নেই। মনোরমার কাছে যদি রাত্রে থেকে যাই, তাহলেই বাড়িতে অশান্তি। মনোর কাছে কেউ একা এল কিনা, সেটা দেখবার জন্যে আমরা বাকি তিনজন তক্কেতক্কে থাকি। মনোরমা আমাদের চারজনের একা কারুর না।
রোববারটা আমাদের চারজনেরই ছুটি। সকালবেলা বাজারের থলি নিয়ে বেরিয়ে আমি চলে এলাম জগুদার দোকানে। আর তিনজনও এসে গেল অল্পক্ষণের মধ্যে। যেন আগে থেকেই ঠিক করা ছিল।
চায়ের জন্য তখন আর কোনো খদ্দের আসে নি। শুধু আমরাই চারজন। সেই লোকটা টেবিলের ওপর নেই।
ও মনো, মনোদিদি!
কোনো সাড়াশব্দ নেই। পিছনে রান্নাঘর। অন্যদিন তো উনুনে আঁচ পড়ে যায় এই সময়। সেখানে উঁকি দিয়ে দেখি, রান্নাঘরের মেঝেতেই আঁচল পেতে শুয়ে ঘুমুচ্ছে মনোরমা। আবার আমাদের ডাক শুনে সে ব্যস্ত হয়ে উঠে বসল। চোখ মুছে বললে, তোমরা এসে গেছ।
তুই এখানে ঘুমুচ্ছিস কেন?
ঘুমুচ্ছিলাম কোথায়, শুয়েছিলাম! সারা রাত একটু ঘুমুতে পারিনি। আমার এত ভয় করছিল!
আমরা অবাক! মনোরমার ভয়? তাকে আমরা কোনোদিন এ রকম কথা বলতে শুনিনি। বলি, কেন মনোদিদি, ভয় করছিল কেন? কী হয়েছে?
মনোরমা আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে বলল, সারারাত লোকটার বুকের মধ্যে ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছিল, আর মাঝে মাঝে মা মা বলে ডেকে উঠছিল। আমি ভাবছিলাম, ও বুঝি যে-কোনো সময় মরে যাবে। এ রকম একটা লোককে তোমরা এখানে রেখে গেলে কী আক্কেলে। আমার কথাটা ভাবলে না?
ভেবেছিলাম মনো, আমরা তো সারারাতই তোর কথা ভেবেছি। পাশে শোয়া রোগা বউ, ছেলেমেয়েগুলোর চ্যাঁ ভ্যাঁ কান্না, এর মধ্যেও তো আমরা তোর কথাই ভাবি। তুই ছাড়া আমাদের কী আর আছে! কিন্তু আমাদের উপায় ছিল না। ইচ্ছে থাকলেও আমরা একলা কেউ তো এখানে থাকতে পারি না। তা লোকটা গেল কোথায়? চলে গেল?
কোথায় চলে যাবে? দেখো গে শুয়ে আছে আমার ঘরে।
তোর ঘরে? নিজে নিজে উঠে গেল? তাহলে তো মানুষটা অতি বদ।
নিজে নিজে যাবে কেন! সে শক্তি কি আছে? রাত্তিরবেলা অমন ঘড়ড় ঘড়ড় করছিল, আমার ভয় হল যদি টেবিল থেকে উলটে পড়ে যায়? তাহলে তো সেই অবস্থাতেই মরবে। তখন আমারই তো হাতে দড়ি পড়বে।
আমরা তাড়াতাড়ি গিয়ে উঁকি দিলাম মনোরমার ঘরে। যে-বিছানায় জগুদাকে মরে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম, সেইখানে ঠিক সেই রকম হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে লোকটা। আমাদের বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠল একবার। সত্যি মরে গেছে নাকি?
পরেই বুঝলাম, না। নিশ্বাসে বুক উঁচু নীচু হচ্ছে। লোকটার কপালে জলপটি। মনোরমা যত্ন করে তার গায়ে একটা চাদর টেনে দিয়েছে।
মনোরমা নিজেই একে পাঁজাকোলা করে তুলে এনেছে টেবিল থেকে। মনোরমার সে শক্তি আছে। লোকটিকে কিন্তু এখানে মানায় না। ঠিক যেন মনে হয় গরিবের ঘরে এসে ঘুমিয়ে আছে কোনো রাজপুত্তুর!
কিন্তু এ কতক্ষণ এখানে আরাম করে ঘুমোবে। একটু পরেই লোকজন আসবে। ব্যাপারটা জানাজানি হলে পাঁচজনে পাঁচকথা বলতে পারে। যা হোক, একটা কিছু বলে দিতে তো মানুষের জিভে আটকায় না—
আমরা চারজন দরজার কাছে ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছি। কে আগে লোকটিকে ডাকবে ঠিক করতে পারছি না। এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছি। এমন সময় লোকটি নিজেই চোখ মেলল।
আমাদের চারজনকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যেন ভয় পেয়ে গেল। চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেল। আস্তে আস্তে বলল, আমি কোথায়?
রতন বললে, আপনার অসুখ করেছে।
আপনারা কারা!
পরাণ বললে, কাল আমরাই তো আপনাকে টেবিলের ওপর শুইয়ে দিয়ে গেলাম, মনে নেই?
ও। কিন্তু এটা তো বিছানা।
হ্যাঁ, বিছানা। এটা চায়ের দোকানের মালকিনের বিছানা।
রতন লোকটির কপালে হাত রেখে বললে, এখনও তো বেশ জ্বর আছে দেখছি। তাহলে তো ডাক্তার ডাকতে হয়। আপনি হাসপাতালে যেতে পারবেন?
লোকটি বললে, কোনো দরকার নেই! আমি খানিকটা বাদে ঠিক হলে আপনা আপনি চলে যাবো। আমি যে এখানে আছি, সে কথা কারুকে বলার দরকার নেই।
কেন? আপনি কে?
লোকটি হাত জোড় করে বললে, বিশ্বাস করুন। আমি কোনো খারাপ লোক নই। আমার পরিচয় এখন জানাবার অসুবিধে আছে।
কোনো ভদ্রলোকের ছেলে আমাদের সঙ্গে হাত জোড় করে কথা বললে আমাদের গা চিড়চিড় করে। এরকম ন্যাকাপনা আমার একদম সহ্য হয় না। দরকারের সময় হাত জোড় করে আবার অন্য সময় চোখ রাঙানো, এসব আমরা ঢের দেখেছি। কিন্তু লোকটির মুখের ওপর কোনো কথা বলতে পারলাম না। লোকটি এমনভাবে কথা বলছে, যাতে মনে হয়, ওর খুব কষ্ট হচ্ছে , বেশ ভোগাবে মনে হচ্ছে।
বাড়িতে বাজার করে নিয়ে যাবার কথা। আর তো বেশি দেরিও করা যায় না। হপ্তায় এই একটা দিনই তো নিজের হাতে বাজার করা।
বেরিয়ে এসে দেখি, মনোরমা রান্নাঘরে উনুন ধরিয়ে ফেলেছে। দুধ জ্বাল দিচ্ছে। আমাদের দেখে বললে, তোমরা একটু বসো গো। চায়ের জল এবার চাপাব। কেমন দেখলে।
এখনও তো বেশ জ্বর!
কাল কিছু খায়নি। এখন একটু গরম দুধ খাইয়ে দিই, কি বলো?
দে, তাই দে!
চা-টা খেয়েই আমরা দৌড় লাগালুম। সেদিন সারাদিনে আর চায়ের দোকানে যাওয়া হল না। কারখানা বন্ধ থাকলে আর এত দূরে বার বার আসা হয় না। রবিবারে এই জন্যই এ দোকানে খদ্দের খুব কম থাকে।
এরপর দিন তিনেকের মধ্যেও লোকটি গেল না। জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় বুকে অসহ্য ব্যথা। রতনের ধারণা ওর নিমোনিয়া হয়েছে। জিতেনের ধারণা, ক্ষয়কাশ। এসব ছোঁয়াচে রোগ নিয়ে মনোরমার কি থাকা উচিত? কিন্তু মনোরমা দিনরাত সেবা করছে লোকটাকে। এমনকি দোকান চালাবার দিকেও তার মন নেই, খদ্দেররা চায়ের জন্যে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে করে চলে যায়। এমনকি আমরা যে মনোরমার গার্জেন, আমাদের দিকেও তার নজর নেই আর। আমরা কিছু বলতে গেলেই ও বলে, তা বলে কী লোকটাকে মরে যেতে দেব। একটা ভদ্দরলোকের ছেলে, সে কি আমার হাতে জল খেয়ে মরতে এসেছে? তোমাদের মায়া হয় না।
রতন এক কবিরাজের কাছ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে ওষুধ এনে দিয়েছে। কথাটা সে আমাদের কাছ থেকে গোপন করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমাদের নজর এড়াবার উপায় নেই। ধরা পড়ে গিয়ে সে বলল, বুঝলি না, ওকে তাড়াতাড়ি সারিয়ে তুলে বিদায় করতে পারলে তো আমাদেরই সুবিধে। নইলে, মনো যেমন নাওয়াখাওয়া ভুলে গেছে, তাতে দোকানটাই না উঠে যায়!
জিতেন বলল, আজ সকালে বটতলায় শুনলাম, দুটো লোক বলাবলি করছিল যে, জগুদার চায়ের দোকানে কে একটা লোক নাকি লুকিয়ে আছে। এখন এ কথাটা চাউর হয়ে গেলেই তো বিপদ!
আমরা গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ালাম। সত্যি তো বিপদের কথা। লোকটা নিজের পরিচয় জানাতে চায় না। আমরা মনোরমার বিপদে-আপদে সাহায্য করতে চাই। কিন্তু মনোরমাকে এই বিপদ থেকে কী করে বাঁচাবো।
পাঁচদিনের মাথায় লোকটা অনেকটা সুস্থ হয়ে বিছানায় উঠে বসল! এর মধ্যে গত দু’দিন মনোরমা চায়ের দোকান বন্ধই রেখেছিল। সবাই জানে মনোরমার অসুখ। শুধু আমরা আসল ঘটনাটা জানি। আমরা চুপিচুপি সন্ধের দিকে একবার এসে খবর নিয়ে যাই। সে-সময় মনোরমা আমাদের চা খাওয়াতেও ভুলে যায়।
লোকটা বিছানায় উঠে বসেছে, আমরা দরজা দিয়ে উঁকি মারলাম। মনোরমা ঘরের কোণে বসে একদৃষ্টে চেয়ে আছে লোকটার মুখের দিকে।
লোকটা আমাদের দেখে বলল, এ যাত্রা বেঁচেই গেলাম মনে হচ্ছে।
আমরা চারজনে ঘরে ঢুকে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালাম। আমাদের বুকের ভেতরে একটা চাপা আনন্দ। লোকটা তাহলে এবার বিদায় হবে। আবার শনিবার এসে গেছে, আবার আমরা মনোরমাকে নিজেদের করে পাবো।
লোকটা মনোরমার দিকে তাকিয়ে বলল, এঁর সেবাতেই বেঁচে গেলাম। এঁর শরীরে খুব দয়া-মায়া আছে! নইলে, আমি অচেনা-অজানা লোক।
মনোরমার শরীরে যে দয়া-মায়া আছে, এ কথা আমরা প্রথম অন্য কারুর মুখে শুনলাম। সবাই জানে, সে দুর্দান্ত রাগী আর জাঁদরেল। অবশ্য মনোরমা কী রকম সে-কথা আর আমাদের বলতে হবে না। দয়া না থাকলে সে আমাদের কারুর পায়ে ঝিঁঝি ধরলে হাত ধরে টেনে তোলে?
লোকটি বলল, এর ঋণ কী করে শোধ করে যাবো, জানি না। আমার কাছে টাকাপয়সা কিছুই নেই—
মনোরমা ঝংকার দিয়ে বলল, থাক আপনাকে আর ঋণ শোধের কথা চিন্তা করতে হবে না , এখনও হাঁটতে গেলে পা টলটল করে।
লোকটি বলল, তবে আমি উপকার ভুলি না। একদিন ঠিক আবার ফিরে আসব, যদি বেঁচে থাকি।
সে তো পরের কথা। এখন আপনাকে যেতে দিচ্ছে কে? আগে খেয়ে-দেয়ে গায়ে জোর করুন।
লোকটা বলল, তা মন্দ না। বেশ, খেয়ে-দেয়ে গায়ে জোর করে তারপর আমি এই রেস্টুরেন্টে বয়ের কাজও করতে পারি। লোককে চা দেব, কাপ ডিশ ধুয়ে দেব।
পরদিন আমরা গিয়ে দেখি, দোকান খোলা, কিন্তু একজনও খদ্দের নেই। ক্যাশ কাউন্টারে মনোরমা একা বিমুখ হয়ে বসে আছে। আমাদের দেখেও একটা কথা বললে না।
আমরা জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় গেল? সেই লোকটা কোথায় গেল? মনোরমা ডান হাতখানা হাওয়ায় ফেরালো শুধু?
কী হয়েছে, মনো দিদি? হলটা কী?
মনোরমা চেঁচিয়ে ধমকিয়ে বলল, চলে গেছে। সে চলে গেছে।
আমাদের আনন্দে নৃত্য করতে ইচ্ছে করছিল। চলে গেছে তো আপদ গেছে!
আবার চায়ের দোকানের বয় হবার কথা বলছিল! রাজপুত্তুরের মতো চেহারা নিয়ে চায়ের দোকানে বয়গিরি, যতসব ন্যাকাপনা কথা?
কখন গেল? কী করে গেল?
সে কি আমাকে বলেছে? একবার ঘুণাক্ষরে জানতেও দিলে না। আমি তাকে একলা রেখে একটু খালপাড়ে চান করতে গেছি—ফিরে এসে দেখি সে নেই। যে মানুষটা ভালো করে হাঁটতে পারে না, সে এমনি এমনি চলে গেল!
নিশ্চয়ই ওর মতলব ভালো ছিল না। কিছু নিয়ে-টিয়ে যায়নি তো?
মনোদিদি, সে কিছু চুরি করেনি তো?
মনোরমা বললে, আহ তোমরা চুপ করবে, আমার ভালো লাগছে না। কী এমন হাতি ঘোড়া আছে আমার, যে সে নেবে!
ধমক খেয়ে আমরা চুপ করে গেলাম।
তারপর শনিবার এলো, কিন্তু মনোরমা আর গাইল না। নাচল না। আমাদের আনি মানি জানি না খেলা হল না। মনোরমা আর সেই মনোরমা নেই, সে আর আমাদের গ্রাহ্য করে না। ঠায় চুপচাপ বসে থাকে। এমনি করেই দিনের পর দিন যায়। আমরা বুঝতে পারি, সেই লোকটা অন্য কিছু চুরি না করলেও সম্পূর্ণ চুরি করে নিয়ে গেছে মনোরমার মন। সেই মনটার চেহারা যে কীরকম তা আর কখনও বুঝিনি।
রতন একবার সাহস করে বলেছিল, ও মনো, সে লোকটা চলে গেল বলে তুই কতদিন আর এমনি করে থাকবি? দোকানটা যে যায়।
মনোরমার চোখের কোণে জল আসে। আস্তে আস্তে বলে, কিন্তু সে যে আবার ফিরে আসবে বলেছে!
ওসব শহুরে লোকের ন্যাকাপনা কথা। এর কি কোনো দাম আছে? এ কথা আমরা মনোরমাকে বোঝাই কী করে?
যদি সম্ভব হত, আমরা লোকটাকে ঘাড় ধরে নিয়ে আসতাম এখানে। কিন্তু কোথায় তাকে খুঁজতে যাব? আমাদের কারখানায় যে-কোনোদিন লক আউট হতে পারে, এখন একটি দিনও কাজ কামাই করতে ভরসা হয় না।
তবু রাগে আমাদের গা জ্বলে যায়। আমাদের আর কিছু নেই। সংসারেও শুধু নেই, নেই, নেই। আমাদের ধর্মেন্দর-হেমা মালিনী নেই, বাকি পৃথিবীর কিছুই জানার দরকার নেই। শুধু আমাদের মনোরমা ছিল, কিন্তু সেই লোকটা, রাজপুত্তুরের মতন চেহারা, শহুরে মানুষ—ওদের তো কত কিছু আছে, কত রকম আমোদ আর রঙ্গ রস। তবু সে কেন আমাদের মনোরমার মনটা কেড়ে নিয়ে গেল।