আমাদের বড়দিন
ডিসেম্বর মাস খ্রীষ্টের জন্মমাস। তাইই খ্রীষ্টমাস। কিন্তু সে তো আমাদের কাছে। আসলে মাস শব্দটি তো আমাদের। খ্রীষ্টমাস আদি ইংরিজিতে cristes maesse, masesse শব্দটি লাটিন missa শব্দ থেকে উৎসারিত। missaর অর্থ পবিত্র উৎসব। এই উৎসব এখন সমস্ত পৃথিবীর। বড়দিন আমাদের পৌষের ৮-৯ তারিখ পড়ে। ২৫শে ডিসেম্বর যিশুখ্রীষ্ট জন্ম গ্রহন করেছিলেন বেথেলহেমের এক ঘোড়ার আস্তাবলে। কিন্তু সঠিক তারিখ কী করে জানা গেল? খ্রীষ্টিয় বিশ্বাস অনুসারে যিশুর জন্মোৎসবই বড়দিন। আদি খ্রীষ্টিয় পুরাণে আছে এইদিনের ঠিক ন’মাস আগে ঈশ্বর পুত্র মাতা মেরির গর্ভে প্রবেশ করেন। মেরি-মরিয়ম ঈশ্বরের ইচ্ছায় গর্ভধারণ করে ছিলেন। বাইবেলের মথি লিখিত সুসমাচারে জানা যায় পবিত্র আত্মা থেকে মরিয়ম গর্ভবতী হয়েছিলেন। মানুষের স্নিগ্ধ কল্পনা যাই হোক, যিশুর জন্মদিন খুব বড় এক দিন তো নিশ্চয়। সূযের অয়নান্তের সময় এইটি। দক্ষিণায়ন থেকে উত্তরায়ণ শুরু হয় ২৩শে। আর এই অয়নান্ত উপলক্ষ্য করেই বড়দিন উৎসবের সূচনা। শীতের দেশে সূর্যের অয়নান্তের এই উৎসব নিশ্চিত ভাবেই আনন্দময়। আরো আলো আরো রৌদ্র এস। দিনের আলো দীর্ঘ হোক। বড়দিন তাই শেষ অবধি আলো আর রৌদ্রেরই উৎসব। হ্যাঁ, প্রাচীন গ্রীক ভাষায় X বর্ণটি (সি) Christ শব্দের প্রথম অক্ষর। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে তাই খ্রীষ্ট শব্দের পরিবর্তে X mas, এক্সমাস ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে বড়দিন এখন আর শুধুমাত্র খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীদের উৎসব নয়। বড়দিন সকলের উৎসব। ইংরিজি নববর্ষ আসছে, তার আগে আগে ঈশ্বরপুত্রের জন্মোৎসব। আমরা ছেলেবেলায় বড়দিনের উৎসব কিছুই বুঝতাম না। আমাদের সেই গ্রাম দণ্ডীরহাট, ওই গ্রামে কোনো খ্রিস্টান ছিলেন না। বড়দিন ছিল না। ইস্কুল তখন পরীক্ষার পর ছুটিই থাকত। এই উত্তর কলকাতায় কীই বা ছিল বড়দিন। শুধু দোকানে দোকানে কেক। শীতের সকালে কেক খাওয়া হতো। এরপর আমার পুত্র-কন্যার জন্য সান্তাক্লজ হয়ে তাদের বালিশের নিচে রেখেছি উপহার। সকালে ঘুম থেকে উঠে তারা বিস্মিত হয়ে যেত। সান্তাক্লজ এক রূপকথার সকাল উপহার দিত তাদের। পুত্রের জন্য তাকে নিয়ে শ্যামবাজার থেকে ক্রিসমাস বৃক্ষ আর টুনি বাল্ব কিনে এনে বাড়িতে সাজিয়েছি। এর সঙ্গে কোনো ধর্ম জড়িয়ে নেই। বড়দিন এক আশ্চর্য রূপকথা। গভীর শীতের ভিতরে বেথেলহেমের আস্তাবলে যিশুর জন্ম আর আকাশে এক নতুন তারা দেখে ঈশ্বরপুত্রের সন্ধানে আসা সাধুদের কাহিনি ছেলেবেলায় কী অপরূপই না লাগত। এখনো সেই কাহিনির বিস্ময় ফুরোয়নি। বাঙালি খ্রিস্টান পাড়ায় বড়দিন হয়। প্রয়াত লেখক বিমল কর আমাদের বলেছিলেন, বড়দিনের রাতে যিশুর নাম-কীর্তন শোনার অভিজ্ঞতা। রীতিমত খোল-কত্তাল বাজিয়ে সেই নামগান সমস্ত রাত ধরে হতো। তাঁর গল্পের ভিতরে খ্রিষ্টীয় পুরানের ছায়া আছে অনেক। যিশুর জন্মের ভিতরে যিশুর জীবনের ভিতরে এক শান্ত পুরোহিত ও রাজার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। এই কাহিনি বালকমনে গভীর অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল। বেথেলহেমে জন্ম নেওয়া শিশুই যে বড় হয়ে বেথেলহেমের রাজা হেরদের রাজত্বের অবসান ঘটাবে, এই কথা জ্যোতিষীদের কাছে শুনেছিলেন হেরদ। সেই কারণে পাঁচ বছর পযর্ন্ত শিশু বালকদের তিনি হত্যা করেছিলেন। সন্তান নিয়ে মেরি ও যোশেফ তখন মিশরের পথে। তারপর তাঁরা যান ইস্রায়েলের গালিলি প্রদেশের নাজারথে। সেখানেই ঈশ্বরপুত্র বড় হয়ে ওঠেন। নাজারথ থেকেই তাঁর ক্ষমার ধর্ম প্রচারে বের হন। যিশুর জীবন কাহিনি, তাঁর ক্রুশবিদ্ধ রূপ আমাকে তার জন্মোৎসবে মনে মনে সামিল করেছে। বড়দিন উৎসব আমাদের এই শহরে সেই সায়েব আমল থেকেই আলোর উৎসবের মতো করেই পালন করা হয়। মধ্য কলকাতার গির্জাগুলিতে উপাসনা শুরু হয় পঁচিশের শুরু, রাত বারোটা থেকে। পার্ক স্ট্রিট অঞ্চল উৎসবে মাতে। সেই উৎসব আনন্দের। ধর্মীয় নয় কিছুতেই। আমাদের শহরতলীতে, গ্রামাঞ্চলে বহু খ্রিস্টান পল্লী আছে। বাঙালি খ্রিস্টান তার নিজের মতো করে এই উৎসব পালন করে। আলো আর ফুল-পাতা, রঙিন শিকলি দিয়ে সাজায় ঘর-বাড়ি। কলকাতার কাছেই কেষ্টপুরের ক্যাথলিক গির্জা বহু প্রাচীন। সেখানে মেলা বসে বড়দিনের। আমি সেই মেলায় গিয়েছি। চমৎকার এক গল্প আছে কবিতা সিংহর। কলকাতার বাঙালি খ্রিস্টান পরিবারের। “টুলির বড়দিন”। টুলির বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে। টুলির বাবা আবার বিয়ে করেছেন। টুলি থাকে মায়ের সঙ্গে। এই গল্প বড়দিনের আগের দিনের গল্প, ক্রিসমাস ইভের গল্প। ইস্কুলে ছুটির ঘন্টা পড়ল, নীল কারডিগান আর শাদা টিউনিকের স্রোত নামতে লাগল সিঁড়ি দিয়ে। এদের ভিতরে টুলি আলাদা। অনেক শুকনো আর ক্লিষ্ট মুখের ভিতরে সেও একজন। তার তাড়া নেই বাড়ি ফেরার। ক্রিসমাস ইভে বাড়ি ফিরে যে বিছানায় শুয়ে আরাম করে এনিড ব্লাইটন নিয়ে বসবে, সে উপায় নেই, তার সুখের স্বর্গে হানা দেবে ধুতি পাঞ্জাবি পরা সেই লোকটা, হিরণমামা। তাঁকে টুলির ভাল লাগে না। নিচু গলায় লোকটা মায়ের সঙ্গে, তার সঙ্গে কথা বলে। টুলির বাবার কথা মনে পড়ে শুধু। ক্রিসমাসের আগে বাবা মায়ের সেই ঘর সাজানো। তারপর পার্টি…এখন সব অবাস্তব মনে হয়। মা খুব কষ্ট করে টুলিকে মানুষ করছে। এক পয়সাও অ্যালিমনি নেয় না টুলির বাবার কাছ থেকে। ইস্কুল থেকে বেরিয়ে টুলি ওষুধের দোকানে গিয়ে বাবাকে ফোন ঘোরায়। খুব যে মন খারাপ লাগছে বাবার জন্য। বাবা আজ তুমি আসবে বাবা? টুলি কাঁপছিল থরথর করে, ‘বাবা লক্ষ্মীটি বাবা, এস, খ্রিসমাসে যেমন তুমি সাজিয়ে দিতে তেমনি করে সাজিয়ে দেবে…।’ টুলির বাবা ফোন কেটে দিল। পবিত্র জন্মোৎসবে খ্রিস্টান পল্লীর একটি বালিকার মন নিয়ে কী বেদনাঘন সেই গল্প। বড়দিন আমাদের সাহিত্যে ছায়া রেখেছে অনেক। গ্রামের মাটির গির্জার বড়দিনের উৎসব পবিত্রতায় অনন্য। দিন বড় হোক। সকলের জীবন পবিত্র হোক।