আমাদের জিপসি
সেবারে বটুকদাদা একটা কুকুরছানা নিয়ে এলেন আমাদের গ্রামের বাড়িতে৷
বটুকদাদা কাঁধে একটা ঝোলা নিয়ে কখন কোথায় ঘুরে বেড়ান তার ঠিক নেই৷ কখনও যান হরিদ্বারের কুম্ভমেলায়, কখনও যান কন্যাকুমারীতে৷ মাঝে-মাঝে ফিরে আসেন বাড়িতে, প্রত্যেকবারই কিছু-না-কিছু জিনিস নিয়ে আসেন আমাদের জন্য৷
কুকুরছানাটি একেবারেই বাচ্চা, ভেলভেটের মতন গায়ের চামড়া, নস্যির মতন রং৷ চোখ দুটো জুলজুল করছে৷ দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে৷
বটুকদাদা বললেন, ‘‘বাচ্চাটাকে বেশ পছন্দ হয়ে গেল, বুঝলি! তাই নিয়ে এলাম৷’’
বাচ্চাটাকে আমাদেরও যে খুবই পছন্দ হয়েছে, তা আর বলতে হবে না৷ শম্ভু, রতন আর তিন্নি ওটা কোলে নেবার জন্য কাড়াকাড়ি করছে৷ আমি এখনও একবারও ওর গায়ে হাত বুলোবার সুযোগই পাইনি৷
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘এটাকে কোথায় পেলে, বটুকদাদা?’’
বটুকদাদা হাসি-হাসি মুখে বললেন, ‘‘এটাকে যে-সে কুকুর ভাবিস না৷ আর একটু বড় হোক, তারপর দেখবি এর কত গুণ!’’
বটুকদাদাকে কোনও কথা জিজ্ঞেস করলেই সোজাসুজি উত্তর পাওয়া যায় না৷ যদি জিজ্ঞেস করি, ‘‘বটুকদাদা, হিমালয় পাহাড়ের কত উঁচুতে বরফ থাকে? হিমালয়ের ভাল্লুকদের গায়ের রং কালো না সাদা?’’
বটুকদাদা বলবেন, ‘‘একবার অসমের জঙ্গলে কী হয়েছিল জানিস? একটা গন্ডারের পাল্লায় পড়েছিলাম, সেটার গায়ের রং সবুজ!’’
তারপর সেই গন্ডারের গল্প যে ঘুরতে-ঘুরতে কখন হিমালয়ের ভাল্লুকে পৌঁছবে, তার ঠিক নেই৷ না পৌঁছতেও পারে!
শম্ভু জিজ্ঞেস করল, ‘‘ও বটুকদাদা, এই কুকুরটার কী জাত? অ্যালসেশিয়ান, না বুলডগ?’’
বটুকদাদা মুচকি হেসে বললেন, ‘‘রাজস্থানের মরুভূমিতে এবার একদল হাঙ্গারিয়ান জিপসির সঙ্গে দেখা হল৷ তাদের জামা-কাপড় কী সুন্দর রংচঙে, তোদের কী বলব! আহা, তোদের জন্য একটা করে নিয়ে আসার ইচ্ছে ছিল!’’
রতন বলল, ‘‘উঃ, বটুকদাদাকে নিয়ে আর পারা যায় না৷ কী গুল মারতেই পারো বাবা তুমি৷ হাঙ্গারি কত দূরের দেশ৷ সেখানকার জিপসিরা রাজস্থানে আসবে কী করে?’’
আমাদের মধ্যে তিন্নি বেশি পড়াশুনো করে৷ তিন্নি তো আর ফুটবল খেলে না, নৌকো চালাতেও জানে না, তাই বই পড়বার বেশি সময় পায়৷ বটুকদাদাকে সে খুব ভালোবাসে৷
তিন্নি মাথা ঝাঁকিয়ে বেণী দুলিয়ে বলল, ‘‘আহা, সেটা অসম্ভব কেন? জিপসিরা তো আমাদের দেশ থেকেই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেছে৷ হাঙ্গারির জিপসিরাও এককালে ভারতীয় ছিল৷ তাই তারা মাঝে-মাঝে তাদের আগেকার দেশ দেখতে আসতেই পারে!’’
বটুকদাদা তিন্নির মাথায় হাত রেখে, আদর করে বললেন, ‘‘তুই ঠিক বলেছিস রে! এরা দেশ দেখতেই এসেছে৷ ওদের কাছ থেকেই আমি কুকুরটা চুরি করেছি, আবার এটা ওরা আমাকে দান করেছে, তাও বলা যায়৷’’
রতন বলল, ‘‘একইসঙ্গে চুরির জিনিস আবার দান করা জিনিস কী করে হয়?’’
আমি বললাম, ‘‘এটা খুব সোজা! বটুকদাদা প্রথমে কুকুরছানাটা চুরি করে পালাচ্ছিলেন৷ তারপর ধরা পড়ে গেলেন৷ তখন বটুকদাদাকে দেখে জিপসিদের মায়া হল, তারা বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, এটা তোমাকে এমনি দিয়ে দিলাম!’’’
বটুকদাদা বললেন, ‘‘নিলু, তুই অনেকটা ঠিক ধরেছিস৷ জিপসিদের যে নেতা, সে আমাকে বলল, ‘বটুক, কুকুরটা নিচ্ছ নাও৷’’’
শম্ভু জিজ্ঞেস করল, ‘‘ওদের লিডার তোমার নাম জানল কী করে?’’
বটুকদাদা বললেন, ‘‘আমাকে সারা পৃথিবীর লোক চেনে৷ এই তো জাপানের সম্রাট চা খাবার নেমন্তন্ন করেছেন, আগামী মাসে যেতে হবে! তারপর শোন, জিপসিদের লিডার বলল, ‘বটুক, কুকুরটা নিতে চাও, নিয়ে যাও, কিন্তু সামলাতে পারবে তো? এই জাতের কুকুর, পৃথিবীতে মাত্র একজোড়া আছে, আর তাদের তিনটে বাচ্চা৷ এদের মতিগতি সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না!’’’
কুকুরের ছানাটা তিন্নির কোলে৷ সে আদর করে বলল, ‘‘এটা আমার খুব পোষ মানবে৷ আমি এর নাম রাখলুম জিপসি!’’
দু’দিন বাদেই আবার চলে গেলেন বটুকদাদা৷ অসমের জঙ্গলে, না রাজস্থানের মরুভূমিতে, না জাপানের রাজবাড়িতে চা খেতে, তা অবশ্য বলে গেলেন না৷
বড়মামা কুকুরছানাটাকে দেখে বললেন, ‘‘এটা আবার কী কুকুর রে? লেজটা মোটা, মুখের দিকটা ছুঁচোলো ধরনের৷ এটা শেয়ালের বাচ্চা নয় তো?’’
তিন্নি বলল, ‘‘না, মোটেই না৷ এটা খুব স্পেশ্যাল জাতের৷ পৃথিবীতে মাত্র একজোড়া আছে, আর তিনটে বাচ্চা৷’’
বড়মামা বললেন, ‘‘বটুকদাদা বুঝি তোদের এই বুঝিয়েছে?’’
এই বলে বড়মামা হোহো করে হাসতে লাগলেন৷
কিন্তু রাঘু বলল অন্য কথা৷ রাঘু এ গ্রামের পোস্টম্যান, আমাদের বাড়িতে মাঝে-মাঝে চিঠি দিতে আসে৷ তার রাঘু নামটা আমরাই রেখেছি৷ নাকের নীচে মস্ত বড় পাকানো গোঁফ, ঠিক রঘু ডাকাতের মতন দেখতে৷
রাঘু বলল, ‘‘এই কুকুরের বাচ্চাটা দারুণ তো? শুধু অস্ট্রেলিয়াতে পাওয়া যায়৷ আমি একটা ছবির বইতে দেখেছি৷ পৃথিবীতে এটাই একমাত্র সেই জাতের কুকুর, যারা পোস্টম্যান দেখলে তেড়ে যায় না!’’
সে-কথা অবশ্য ঠিক৷ আমরা আগে যত কুকুর দেখেছি, এমনকী রাস্তার নেড়ি কুকুরগুলো পর্যন্ত, কেউ রাঘুকে পছন্দ করে না৷ কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো রাঘুকে আসতে দেখলেই অন্য কুকুররা হিংস্র ভাবে ঘেউ-ঘেউ করে ওঠে৷ কিন্তু আমাদের জিপসি রাঘুকে দেখলে আনন্দে লেজ নাড়ে৷ তা হলেও, কোথায় হাঙ্গারি, আর কোথায় অস্ট্রেলিয়া!
দু’দিন পরেই কলকাতা থেকে এলেন পান্তুয়া-জামাইবাবু! ঠিক পান্তুয়ার মতন গায়ের রং আর মুখখানাও গোল ধরনের বলে আমরা আড়ালে তাঁর ওই নাম রেখেছি৷ পান্তুয়া-জামাইবাবু খুব বড় কাজ করেন আর সত্যি-সত্যি অনেক দেশ ঘুরেছেন৷
জিপসি পান্তুয়া-জামাইবাবুকে দেখে তাঁর পায়ে মাথা ঘষে একটু আদর জানাতে গেল৷ তিনি এক লাফ মেরে বলে উঠলেন, ‘‘ওরে বাবা, এটা কী রে? ভোঁদড় নাকি!’’
দিদির কাছে শুনেছি, জামাইবাবু অতি সাহসী মানুষ, পৃথিবীতে তিনি বাঘ-সিংহ-কুকুর-মাকড়সা-ইঁদুর—কিছুকে ভয় পান না৷ একমাত্র ভয় ভোঁদড় নামে প্রাণীটিকে৷ কিন্তু আমরা কখনও ভোঁদড় দেখিনি, কেমন দেখতে হয় তাও জানি না৷ শুধু ছড়াতে পড়েছি, ‘ওরে ভোঁদড় ফিরে চা, খোকার নাচন দেখে যা!’
আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে বলতে লাগলাম, ‘‘না, না, ভোঁদড় না, ভোঁদড় না, ও তো আমাদের জিপসি!’’
জামাইবাবু বললেন, ‘‘হুঁ, এ তো দেখছি উগান্ডার ওয়াইল্ড ডগ৷ খুব তেজি৷ এরা দল বেঁধে থাকলে মানুষ পর্যন্ত মেরে ফেলে, তবে একলা থাকলে ভয়ের কিছু নেই৷ কিন্তু একটা ব্যাপারে খুব সাবধান, পূর্ণিমার দিন, যখন আকাশে পুরো একটা গোল চাঁদ ওঠে, সেদিন উগান্ডার ওয়াইল্ড ডগ অদৃশ্য হয়ে যায়৷ কোথায় যে যায়, কেউ জানে না!’’
বড়মামা বললেন, ‘‘উগান্ডার কুকুর না ছাই! দেখবে মজা! এক্ষুনি এ গলা মেলাবে৷’’
এর পর বড়মামা মুখের কাছে দু’হাত নিয়ে খুব জোরে হুক্কা-হুয়া, হুক্কা-হুয়া করে শেয়ালের ডাক ডেকে উঠলেন৷ জিপসি কিন্তু সেই ডাকে যোগ দিল না৷ বরং বেশ মজা পাওয়ার চোখে বড়মামার দিকে চেয়ে রইল৷
বড়মামার তবু ঘোর বিশ্বাস, এই জিপসি আসলে শেয়ালের বাচ্চা৷ আমাদের তাতে প্রবল আপত্তি৷ শেয়ালের বাচ্চা একটু বড় হলেই জঙ্গলে পালিয়ে যায়৷ তাদের পোষ মানানো যায় না৷ সে চেষ্টা কি আর আমরা আগে করিনি!
শেষ পর্যন্ত কিন্তু পান্তুয়া-জামাইবাবুর কথাই সত্যি হল৷
কয়েক মাসের মধ্যেই বেশ বড় হয়ে গেল জিপসি৷ সারা বাড়িতে খেলে বেড়ায়৷ ভুক-ভুক করে মিষ্টি-মিষ্টি ভাবে ডাকে৷ কাউকে কামড়ায় না৷ বাইরে থেকে যারাই আসে, সবাই জিপসিকে আদর করে৷
সেদিন ছিল লক্ষ্মীপুজো৷ আমাদের বাড়িতে অনেক লোকের নেমন্তন্ন৷ তাই জিপসি কোথায় আছে, তার খোঁজ নিইনি৷ হঠাৎ তিন্নি কাঁদো-কাঁদো মুখ করে এসে বলল, ‘‘এই নিলু, জিপসি কোথায় রে, দেখেছিস?’’
রোজ রাত্তিরে তিন্নির খাটের তলায় জিপসি শুয়ে থাকে৷ আজ তিন্নি ঘুমোতে গিয়ে দেখে জিপসি তার জায়গায় নেই৷ আমরা সারা বাড়ি, আশ-পাশের বাগান, পুকুরধার সব খুঁজে দেখলাম, জিপসির নাম ধরে ডাকলাম কত, তবু তার পাত্তা পাওয়া গেল না৷ আকাশে তখন মস্ত বড় একটা গোল চাঁদ উঠেছে৷
সে রাত্তিরে আমাদের এমনই মন খারাপ হয়ে গেল যে, ঘুমই এল না প্রায়৷ পরদিন সকালেও জিপসিকে দেখা গেল না কোথাও!
সে ফিরে এল ঠিক তিনদিন বাদে সন্ধেবেলায়! তার ভুক-ভুক ডাক শুনে আমরা সবাই ছুটে এলাম উঠোনে৷ জিপসি তার মোটা লেজে ভর দিয়ে ঠিক উঠোনের মাঝখানে বসে কান লটপট করছে৷ কাছে গিয়ে দেখলাম, তার মুখ টাটকা রক্তে মাখামাখি৷
আমাদের প্রথমে মনে হল, কোনও জায়গা থেকে বুঝি জিপসি মারামারি করে এসেছে, তার মুখ ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে৷ তিন্নি ভিজে ন্যাকড়া এনে তার মুখ মুছে দিল৷ তখন দেখা গেল, তার মুখে কিংবা শরীরে কোনও কাটা-ছেঁড়া নেই, ওই রক্তটা সে বাইরে থেকে মেখে এসেছে৷
তিন্নি ধমক দিয়ে বলল, ‘‘জিপসি, কোথায় গিয়েছিলি? কিসের রক্ত মেখেছিস? বল, ঠিক করে বল!’’
জিপসি এমনভাবে তাকাল, যেন মনে হল, সে প্রশ্নগুলো ঠিকই বুঝেছে৷ উত্তরও দিতে চায়৷ কিন্তু বেচারি কুকুর তো মানুষের ভাষা বলতে পারে না৷
এরপর কয়েকদিন জিপসি আগের মতনই হয়ে রইল৷ এমনিতে সে খুব বাধ্য৷ কক্ষনো বাড়ি ছেড়ে বেশি দূর যায় না৷ তাকে যা দেওয়া হয় তাই সে খায়৷ ভাত, ডাল, পরোটা, পালংশাক, লাউ-ঘণ্ট, দই-চিঁড়ে, সব, সব৷ মাছের কাঁটা কুকুরকে দিতে নেই, মাংস পেলেও জিপসি খায়, কিন্তু আমাদের বাড়িতে মাংস আর ক’দিন হয়? বড় জোর মাসে একদিন!
ঠিক এক মাস বাদে জিপসি আবার নিরুদ্দেশ৷ এই ছিল, এই নেই! নেই তো নেই৷ একেবারেই নেই৷
এবারও সে ফিরে এল দু’দিন বাদে৷ এবারও তার মুখে মাখা টাটকা রক্ত৷
আমরা বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম৷ জিপসির এ কীরকম ব্যবহার? তার মুখে ওই রক্তই বা কিসের?
বড়মামা বললেন, ‘‘এটা রাক্ষুসে কুকুর৷ এটাকে দূর করে দে!’’
তাই শুনে তিন্নি কেঁদে ভাসাল৷ আমরাও জিপসিকে ছাড়তে চাই না৷ তা ছাড়া সে কোনও মানুষ কিংবা কারও বাড়ির পোষা গোরু-ছাগলকে কামড়েছে, এমনও কেউ অভিযোগ করে না৷ তা হলে তার মুখে ওই রক্ত আসে কী করে?
তিন-চার মাস এরকম হবার পর বটুকদাদা আবার এসে উপস্থিত হলেন৷ এবারে তিনি কোনও জন্তু-জানোয়ার আনেননি, এনেছেন তাঁর ঝোলা-ভর্তি মেওয়া৷ জাপানের সম্রাটের বাড়িতে চা খেতে গিয়েছিলেন কি না জিজ্ঞেস করলে, তিনি বলেন, ‘‘এ মেওয়াগুলো কোথাকার জানিস? আসল কাবুলিওয়ালাদের দেশ থেকে আনা৷ এই মেওয়া খেলে মাথার ঘিলু বাড়ে, কেউ পরীক্ষায় ফেল করে না৷ তোরা সবাই খা, খা, পেট ভরে খা৷’’
আমরা জিপসির স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে নালিশ জানাতেই বটুকদাদা গম্ভীর হয়ে গেলেন একটুক্ষণ৷ তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘‘সেই জিপসিদের নেতা আমাকে যা বলেছিল, তাই-ই দেখছি সত্যি হল৷’’
আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘কী বলেছিল? কী বলেছিল?’’
কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বটুকদাদা বললেন, ‘‘পান্তুয়া তোদের বলেছে যে, এটা উগান্ডার ওয়াইল্ড ডগ! পান্তু অনেক দেশ ঘুরেছে তো৷ গুলিয়ে ফেলেছে সব কিছু৷ ওয়াইল্ড ডগদের লেজ এত মোটা হয় না৷ এই ক’মাসে এত বড়ও হবে না৷ ঠিক পূর্ণিমার রাতে হাঙ্গারিয়ান কুকুর হঠাৎ খুব হাংরি হয়ে পড়ে৷ তারা অনেক কিছু দেখতে পায়৷ আমরা যাদের দেখতে পাই না, তাদেরও দেখতে পায়৷ তাদের মেরে রক্ত খায়৷’’
রতন বলল, ‘‘আমরা যাদের দেখতে পাই না, তার মানে অশরীরী, তার মানে কি ভূত?’’
শম্ভু বলল, ‘‘ধুত! ভূত যদিও বা থাকে, তবু তাদের গায়ে কি রক্ত থাকে নাকি! অদৃশ্য হলে তো চোখ, নাক, কান, রক্ত, মাংস, এসব কিছুই থাকবে না!’’
আমরা হট্টগোল থামালে বটুকদাদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘‘হুঃ! আমরা কতটুকুই বা জানি! এই অশরীরী মানে ভূত নয়, অন্য কিছু৷ তা হলে জিপসিকে তোরা রাখতে চাস না? আমাকে দিয়ে দে, আমি ওর আসল মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করব৷’’
আমরা সবাই মিলে বললাম, ‘‘না, না, জিপসি থাকবে৷ জিপসি থাকবে!’’
বটুকদাদা বললেন, ‘‘তা হলে এই পূর্ণিমার রাতটায় কী হয়, আমি নিজের চক্ষে একটু দেখি৷’’
ক্যালেন্ডারে দেখা গেল পূর্ণিমা আর মাত্র দু’দিন বাদে৷
সেদিন সকাল থেকেই জিপসিকে চোখে-চোখে রাখা হল৷ একজন-না-একজন সবসময় ওর কাছে থাকে৷ জিপসিও অন্যদিনের মতন খেলা করে, আদর করলে মাটিতে গড়াগড়ি দেয়৷ কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ করা গেল, কিছুই খাচ্ছে না৷ ভালো যা কিছু খেতে দেওয়া হচ্ছে, সে একবার শুঁকেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে৷ দুধ-মুড়ি ও খুব চেটেপুটে খায় অন্যদিন৷ আজ সে তাতে একবার জিভ ছোঁয়াল না পর্যন্ত৷ তাকে জোর করে কিছু খাওয়াবার চেষ্টা করেও কাজ হল না৷ আজ তার উপোস৷
সন্ধেবেলা বসবার ঘরে আমরা সবাই গোল হয়ে বসেছি৷ মাঝখানে বটুকদাদা, আর তিন্নির কোলে জিপসি৷ আমরা সবাই গল্প শুনছি, জিপসি এমন চুপ করে বসে আছে যেন সেও মন দিয়ে গল্প শুনছে৷ আকাশ মেঘলা, একসময় টিপিটিপি বৃষ্টিও পড়ছিল!
বেশ অনেকক্ষণ কেটে গেছে, হঠাৎ একসময় জিপসি ভুক-ভুক করে ডেকে তিন্নির কোল থেকে নামতে চাইল৷
রতন জানলার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘‘বৃষ্টি থেমে গেছে, চাঁদ উঠেছে!’’
সত্যিই চাঁদের আলোর একটা শিখা জানলা দিয়ে এসে ঘরের মধ্যে পড়েছে৷
তিন্নি জোর করেও জিপসিকে ধরে রাখতে পারছে না৷ সে অসম্ভব ছটফট করছে৷ শম্ভু আর রতন দু’জনে জিপসিকে চেপে ধরল৷
এবার জিপসি গোঁ গোঁ শব্দ করে উঠল, এক ঝটকায় ওদের ছাড়িয়ে নেমে পড়ল মাটিতে৷ দরজার দিকে চলে গিয়েও ঘুরে দাঁড়াল একবার৷
বটুকদাদা গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কী রে জিপসি, কোথায় যাচ্ছিস?’’
জিপসি মুখটা তুলতেই আমরা আঁতকে উঠলাম৷ এরকম দৃশ্য কখনও দেখিনি৷ ঠিক টর্চের আলোর মতন দুটো আলোর শিখা বেরোচ্ছে জিপসির চোখ দিয়ে৷
বটুকদাদা আপন মনে বললেন, ‘‘তা হলে ওরা ঠিকই বলেছিল৷ হাঙ্গারিয়ান জিপসি কুকুরের চোখ দিয়ে পূর্ণিমার দিন আলো বেরোয়৷ ভয় নেই, তোরা কেউ ভয় পাস না, জিপসিকে যেতে দে!’’
দরজা খোলা, জিপসি এক লাফে চলে গেল বাইরে৷ আমি আর রতন দরজার কাছাকাছি বলে আমরাও ওর পেছন-পেছন যাবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই বটুকদাদা বললেন, ‘‘খবর্দার, খবর্দার! ওর পেছনে যাসনি! গেলে যা দেখবি, তা সহ্য করতে পারবি না!’’
জিপসি বিদ্যুতের বেগে ছুটে গেল, না অদৃশ্য হয়ে গেল, তা বোঝা গেল না৷ চোখের পলক ফেলতে-না-ফেলতেই জিপসি যেন মিলিয়ে গেল কোথায়!
আমরা সবাই এবার বটুকদাদাকে চেপে ধরে বললাম, ‘‘ও বটুকদাদা, কী ব্যাপারটা হল বলো! জিপসি কোথায় গেল? কোথা থেকে ও রক্ত খেয়ে আসে?’’
বটুকদাদা বললেন, ‘‘দেখো বাপু, তোমাদের একটা কথা বলি! তোমরা নিজের চোখেই তো দেখলে পূর্ণিমার রাতে জিপসি কীরকম বদলে যায়! যদি এ কুকুরকে বাড়িতে রাখতে চাও, তা হলে আর কিছু জানতে চেয়ো না৷’’
তিন্নি কাঁদতে-কাঁদতে জিজ্ঞেস করল, ‘‘আমার জিপসি কার রক্ত খায়, তা তোমাকে বলতেই হবে৷ ও যদি খুনে কুকুর হয়, তা হলে আমি ওকে আর ভালোবাসব না!’
বটুকদাদা বললেন, ‘‘সেবার যখন মানস সরোবরে যাই, তখন কী কাণ্ড হয়েছিল শোন৷ একদিন জলের মধ্যে এমন তোলপাড় শুরু হল, ঠিক যেন মনে হল হ্রদের তলায় কোনও দৈত্য-দানব লুকিয়ে আছে৷’’
সম্পূর্ণ অন্য গল্প৷ এ-গল্প শেষ হতে-হতে আমাদের ঘুম পেয়ে গেল প্রায়৷
জিপসি যথারীতি ফিরে এল৷ একদিন বাদে৷ তার মুখে সেইরকমই টাটকা, টকটকে লাল রক্ত মাখানো৷ আবার সে নিরীহ, শান্ত কুকুর হয়ে গেল৷
এর পর থেকে পূর্ণিমার রাতটায় আমরা জিপসির কথা ভুলে থাকি!
—