আমাদের জিপসি
সেবারে বটুকদাদা একটা কুকুরছানা নিয়ে এলেন আমাদের গ্রামের বাড়িতে।
বটুকদাদা কাঁধে একটা ঝোলা নিয়ে কখন কোথায় ঘুরে বেড়ান তার ঠিক নেই। কখনো যান হরিদ্বারের কুম্ভমেলায়, কখনো যান কন্যাকুমারীতে। মাঝে-মাঝে ফিরে আসেন বাড়িতে, প্রত্যেকবারই কিছু-না-কিছু জিনিস নিয়ে আসেন আমাদের জন্য।
কুকুরছানাটি একেবারেই বাচ্চা, ভেলভেটের মতন গায়ের চামড়া, নস্যির মতন রং। চোখ দুটো জুলজুল করছে। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে।
বটুকদাদা বললেন, ‘বাচ্চাটাকে বেশ পছন্দ হয়ে গেল, বুঝলি! তাই নিয়ে এলাম।’
বাচ্চাটাকে আমাদেরও যে খুবই পছন্দ হয়েছে তা আর বলতে হবে না। শম্ভু, রতন আর তিন্নি ওটা কোলে নেবার জন্য কাড়াকাড়ি করছে। আমি এখনও একবারও ওর গায়ে হাত বুলোবার সুযোগই পাইনি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটাকে কোথায় পেলে, বটুকদাদা?’
বটুকদাদা হাসি-হাসি মুখে বলল, ‘এটাকে যে-সে কুকুর ভাবিস না। আর একটু বড়ো হোক, তারপর দেখবি এর কত গুণ!
বটুকদাদাকে কোনো কথা জিজ্ঞেস করলেই সোজাসুজি উত্তর পাওয়া যায় না। যদি জিজ্ঞেস করি, ‘বটুকদাদা, হিমালয় পাহাড়ের কত উঁচুতে বরফ থাকে? হিমালয়ের ভাল্লুকদের গায়ের রং কালো না সাদা?’
বটুকদাদা বলবেন, ‘একবার আসামের জঙ্গলে কী হয়েছিল জানিস? একটা গন্ডারের পাল্লায় পড়েছিলাম, সেটার গায়ের রং সবুজ!’
তারপর সেই গন্ডারের গল্প যে ঘুরতে-ঘুরতে কখন হিমালয়ের ভাল্লুকে পৌঁছাবে, তার ঠিক নেই। না পৌঁছাতেও পারে!
শম্ভু জিজ্ঞেস করল, ‘ও বটুকদাদা, এই কুকুরটার কী জাত? অ্যালসেশিয়ান, না বুল ডগ?’
বটুকদাদা মুচকি হেসে বললেন, ‘রাজস্থানের মরুভূমিতে এবার একজন হাঙ্গারিয়ান জিপসির সঙ্গে দেখা হল। তাদের জামা-কাপড় কী সুন্দর রংচঙে, তোদের কী বলব! আহা, তোদের জন্য একটা করে নিয়ে আসার ইচ্ছে ছিল!’
রতন বলল, ‘উঃ, বটুকদাদাকে নিয়ে আর পারা যায় না। কী গুল মারতেই পারো বাবা তুমি। হাঙ্গারি কত দূরের দেশ। সেখানকার জিপসিরা রাজস্থানে আসবে কী করে?’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটাকে কোথায় পেলে বটুকদাদা ?’
আমাদের মধ্যে তিন্নি বেশি পড়াশুনো করে। তিন্নি তো আর ফুটবল খেলে না, নৌকো চালাতেও জানে না, তাই বই পড়বার বেশি সময় পায়। বটুকদাদাকে সে খুব ভালোবাসে।
তিন্নি মাথা ঝাঁকিয়ে বেণী দুলিয়ে বলল, ‘আহা, সেটা অসম্ভব কেন? জিপসিরা তো আমাদের দেশ থেকেই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেছে। হাঙ্গারির জিপসিরাও এককালে ভারতীয় ছিল। তাই তারা মাঝে-মাঝে তাদের আগেকার দেশ দেখতে আসতেই পারে!’
বটুকদাদা তিন্নির মাথায় হাত রেখে আদর করে বললেন, ‘তুই ঠিক বলেছিস রে! এরা দেশ দেখতেই এসেছে। ওদের কাছ থেকেই আমি কুকুরটা চুরি করেছি, আবার এটা ওরা আমাকে দান করেছে, তাও বলা যায়।’
রতন বলল, ‘একই সঙ্গে চুরির জিনিস আবার দান করা জিনিস কী করে হয়?’
আমি বললাম, ‘এটা খুব সোজা! বটুকদাদা প্রথমে কুকুরছানাটা চুরি করে পালাচ্ছিলেন। তারপর ধরা পড়ে গেলেন। তখন বটুকদাদাকে দেখে জিপসিদের মায়া হল, তারা বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, এটা তোমাকে এমনি দিয়ে দিলাম!’
বটুকদাদা বললেন, ‘নিলু, তুই অনেকটা ধরেছিস। জিপসিদের যে নেতা, সে আমাকে বলল, ‘বটুক, কুকুরটা নিচ্ছ নাও।’
শম্ভু জিজ্ঞেস করল, ‘ওদের লিডার তোমার নাম জানল কী করে?’
বটুকদাদা বললেন, ‘আমাকে সারা পৃথিবীর লোক চেনে। এই তো জাপানের সম্রাট চা খাবার নেমন্তন্ন করেছেন, আগামী মাসে যেতে হবে! তারপর শোন, জিপসিদের লিডার বলল, ‘বটুক, কুকুরটা নিতে চাও নিয়ে যাও, কিন্তু সামলাতে পারবে তো? এই জাতের কুকুর পৃথিবীতে মাত্র একজোড়া আছে, আর তাদের তিনটে বাচ্চা। এদের মতিগতি সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না!’
কুকুরের ছানাটা তিন্নির কোলে। সে আদর করে বলল, ‘এটা আমার খুব পোষ মানবে। আমি এর নাম রাখলুম জিপসি!’
দুদিন বাদেই আবার চলে গেলেন বটুকদাদা। আসামের জঙ্গলে, না রাজস্থানের মরুভূমিতে, না জাপানের রাজবাড়িতে চা খেতে, তা অবশ্য বলে গেলেন না।
বড়োমামা কুকুরছানাটাকে দেখে বললেন, ‘এটা আবার কী কুকুর রে? লেজটা মোটা, মুখের দিকটা ছুঁচলো ধরনের। এটা শেয়ালের বাচ্চা নয় তো?’
তিন্নি বলল, ‘না, মোটেই না। এটা খুব স্পেশ্যাল জাতের। পৃথিবীতে মাত্র একজোড়া আছে, আর তিনটে বাচ্চা।’
বড়োমামা বললেন, ‘বটুকদাদা বুঝি তোদের এই বুঝিয়েছে?’
এই বলে বড়োমামা হো হো করে হাসতে লাগলেন।
কিন্তু রঘু বলল অন্য কথা। রঘু এ গ্রামের পোস্টম্যান, আমাদের বাড়িতে মাঝে-মাঝে চিঠি দিতে আসে। তার রঘু নামটা আমরাই রেখেছি। নাকের নীচে মস্ত বড়ো পাকানো গোঁফ, ঠিক রঘু ডাকাতের মতন দেখতে।
রঘু বলল, ‘এই কুকুরের বাচ্চাটা দারুণ তো! শুধু অস্ট্রেলিয়াতে পাওয়া যায়। আমি একটা ছবির বইতে দেখেছি। পৃথিবীতে এটাই একমাত্র সেই জাতের কুকুর, যারা পোস্টম্যান দেখলে তেড়ে যায় না!’
সে-কথা অবশ্য ঠিক। আমরা আগে যত কুকুর দেখেছি, এমনকী রাস্তার নেড়ি কুকুরগুলো পর্যন্ত, কেউ রঘুকে পছন্দ করে না। কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো রঘুকে আসতে দেখলেই অন্য কুকুররা হিংস্রভাবে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। কিন্তু আমাদের জিপসি রঘুকে দেখলে আনন্দে লেজ নাড়ে। তাহলেও কোথায় হাঙ্গেরি, আর কোথায় অস্ট্রেলিয়া!
দু-দিন পরেই কলকাতা থেকে এলেন পান্তুয়া-জামাইবাবু! ঠিক পান্তুয়ার মতন গায়ের রং আর মুখখানাও গোল ধরনের বলে আমরা আড়ালে তাঁর ওই নাম রেখেছি। পান্তুয়া-জামাইবাবু খুব বড়ো কাজ করেন আর সত্যি-সত্যি অনেক দেশ ঘুরেছেন।
জিপসি পান্তুয়া-জামাইবাবুকে দেখে তাঁর পায়ে মাথা ঘষে একটু আদর জানাতে গেল। তিনি একলাফ মেরে বলে উঠলেন, ‘ওরে বাবা, এটা কী রে? ভোঁদড় নাকি!’
দিদির কাছে শুনেছি, জামাইবাবু অতি সাহসী মানুষ। পৃথিবীতে তিনি বাঘ-সিংহ-কুকুর-মাকড়সা-ইঁদুর––কিছুকে ভয় পান না। একমাত্র ভয় ভোঁদড় নামে প্রাণীটিকে। কিন্তু আমরা কখনো ভোঁদড় দেখিনি, কেমন দেখতে হয় তাও জানি না। শুধু ছড়াতে পড়েছি, ‘ওরে ভোঁদড় ফিরে চা, খোকার নাচন দেখে যা!’
আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে বলতে লাগলাম, ‘না, না, ভোঁদড় না, ভোঁদড় না, ও তো আমাদের জিপসি!’
জামাইবাবু বললেন, ‘হুঁ, এ তো দেখছি উগাণ্ডার ওয়াইল্ড ডগ। খুব তেজি। এরা দল বেঁধে থাকলে মানুষ পর্যন্ত মেরে ফেলে, তবে একলা থাকলে ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু একটা ব্যাপারে খুব সাবধান, পূর্ণিমার দিন, যখন আকাশে পুরো একটা গোল চাঁদ ওঠে, সেদিন উগাণ্ডার ওয়াইল্ড ডগ অদৃশ্য হয়ে যায়। কোথায় যে যায়, কেউ জানে না!’
বড়োমামা বললেন, ‘উগাণ্ডার কুকুর না ছাই! দেখবে মজা। এক্ষুনি এ গলা মেলাবে।’
এরপর বড়োমামা মুখের কাছে দু-হাত নিয়ে খুব জোরে হুক্কা-হুয়া, হুক্কা-হুয়া করে শেয়ালের ডাক ডেকে উঠলেন। জিপসি কিন্তু সেই ডাকে যোগ দিল না। বরং বেশ মজা পাওয়ার চোখে বড়োমামার দিকে চেয়ে রইল।
বড়োমামার তবু ঘোর বিশ্বাস, এই জিপসি আসলে শেয়ালের বাচ্চা। আমাদের তাতে প্রবল আপত্তি। শেয়ালের বাচ্চা একটু বড়ো হলেই জঙ্গলে পালিয়ে যায়। তাদের পোষ মানানো যায় না। সে চেষ্টা কী আর আমরা করিনি!
শেষ পর্যন্ত কিন্তু পান্তুয়া-জামাইবাবুর কথাই সত্যি হল।
কয়েক মাসের মধ্যেই বেশ বড়ো হয়ে গেল জিপসি। সারা বাড়িতে খেলে বেড়ায়। ভুকভুক করে মিষ্টি-মিষ্টিভাবে ডাকে। কাউকে কামড়ায় না। বাইরে থেকে যারাই আসে, সবাই জিপসিকে আদর করে।
সেদিন ছিল লক্ষ্মীপুজো। আমাদের বাড়িতে অনেক লোকের নেমন্তন্ন। তাই জিপসি কোথায় আছে, তার খোঁজ নিইনি। হঠাৎ তিন্নি কাঁদো-কাঁদো মুখ করে এসে বলল, ‘এই নীলু, জিপসি কোথায় রে, দেখেছিস?’
রোজ রাত্তিরে তিন্নির খাটের তলায় জিপসি শুয়ে থাকে। আজ তিন্নি ঘুমোতে গিয়ে দেখে জিপসি তার জায়গায় নেই। আমরা সারা বাড়ি, আশপাশের বাগান, পুকুরধার সব খুঁজে দেখলাম, জিপসির নাম ধরে ডাকলাম কত, তবু তার পাত্তা পাওয়া গেল না। আকাশে তখন মস্ত বড়ো একটা গোল চাঁদ উঠেছে।
সে রাত্তিরে আমাদের এমনই মন খারাপ হয়ে গেল যে, ঘুমই এল না প্রায়। পরদিন সকালেও জিপসিকে দেখা গেল না কোথাও!
সে ফিরে এল ঠিক তিনদিন বাদে সন্ধেবেলায়! তার ভুক ভুক ডাক শুনে আমরা সবাই ছুটে এলাম উঠোনে। জিপসি তার মোটা লেজে ভর দিয়ে ঠিক উঠোনের মাঝখানে বসে কান লটপট করছে। কাছে গিয়ে দেখলাম, তার মুখ টাটকা রক্তে মাখামাখি।
আমাদের প্রথমে মনে হল, কোনো জায়গা থেকে বুঝি জিপসি মারামারি করে এসেছে। তার মুখ ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। তিন্নি ভিজে ন্যাকড়া এনে তার মুখ মুছে দিল। তখন দেখা গেল, তার মুখে কিংবা শরীরে কোনো কাটাছেঁড়া নেই, ওই রক্তটা সে বাইরে থেকে মেখে এসেছে।
তিন্নি ধমক দিয়ে বলল, ‘জিপসি, কোথায় গিয়েছিলি? কীসের রক্ত মেখেছিস? বল, ঠিক করে বল!’
জিপসি এমনভাবে তাকাল, যেন মনে হল, সে প্রশ্নগুলো ঠিকই বুঝেছে। উত্তরও দিতে চায়। কিন্তু বেচারি কুকুর তো, মানুষের ভাষা বলতে পারে না।
এরপর কয়েকদিন জিপসি আগের মতনই হয়ে রইল। এমনিতে সে খুব বাধ্য। কখনো বাড়ি ছেড়ে বেশি দূর যায় না। তাকে যা দেওয়া হয়, তাই সে খায়। ভাত, ডাল, পরোটা, পালংশাক, লাউঘণ্ট, দই-চিঁড়ে, সব, সব। মাছের কাঁটা কুকুরকে দিতে নেই, মাংস পেলেও জিপসি খায় কিন্তু আমাদের বাড়িতে মাংস আর কদিন হয়? বড়োজোর মাসে একদিন!
ঠিক এক মাস বাদে জিপসি আবার নিরুদ্দেশ। এই ছিল, এই নেই। নেই তো নেই। একেবারেই নেই।
এবারও সে ফিরে এল দু-দিন বাদে। এবারও তার মুখে টাটকা রক্ত।
আমরা বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। জিপসির এ কীরকম ব্যবহার। তার মুখে ওই রক্তই বা কীসের?
বড়োমামা বললেন, ‘এটা রাক্ষুসে কুকুর। এটাকে দূর করে দে!’
তাই শুনে তিন্নি কেঁদে ভাসাল। আমরাও জিপসিকে ছাড়তে চাই না। তা ছাড়া সে কোনো মানুষ কিংবা তার বাড়ির পোষা গোরু-ছাগলকে কামড়েছে, এমনও কেউ অভিযোগ করে না। তাহলে তার মুখে ওই রক্ত আসে কী করে?
তিন-চার মাস এরকম হবার পর বটুকদাদা আবার এসে উপস্থিত হলেন। এবারে তিনি কোনো জন্তু-জানোয়ার আনেননি, এনেছেন তাঁর ঝোলা-ভর্তি মেওয়া। জাপানের সম্রাটের বাড়িতে চা খেতে গিয়েছিলেন কি না জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘এ মেওয়াগুলো কোথাকার জানিস? আসল কাবুলিওয়ালাদের দেশ থেকে আনা। এই মেওয়া খেলে মাথার ঘিলু বাড়ে, কেউ পরীক্ষায় ফেল করে না। তোরা সবাই খা, খা, পেট ভরে খা।’
আমরা জিপসির স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে নালিশ জানাতেই বটুকদাদা গম্ভীর হয়ে গেলেন একটুক্ষণ। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘সেই জিপসিদের নেতা আমাকে যা বলেছিল, তাই-ই দেখছি সত্যি হল।’
আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী বলেছিল? কী বলেছিল?’
কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বটুকদাদা বললেন, ‘পান্তুয়া তোদের বলেছে যে, এটা উগাণ্ডার ওয়াইল্ড ডগ! পান্তু অনেক দেশ ঘুরেছে তো। গুলিয়ে ফেলেছে সবকিছু। ওয়াইল্ড ডগদের লেজ এত মোটা হয় না। এই ক-মাসে এত বড়ো হবে না। ঠিক পূর্ণিমার রাতে হাঙ্গারিয়ান কুকুর হঠাৎ খুব হাংরি হয়ে পড়ে। তারা অনেক কিছু দেখতে পায়। আমরা যাদের দেখতে পাই না, তাদেরও দেখতে পায়। তাদের মেরে রক্ত খায়।’
রতন বলল, ‘আমরা যাদের দেখতে পাই না, তার মানে অশরীরী, তার মানে কী ভূত?’
শম্ভু বলল, ‘ধুৎ! ভূত যদিও বা থাকে, তবু তাদের গায়ে কী রক্ত থাকে নাকি! অদৃশ্য হলে তো চোখ, নাক, কান, রক্ত, মাংস এসব কিছু থাকবে না!’
আমরা হট্টগোল থামালে বটুকদাদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘হুঁ:! আমরা কতটুকুই বা জানি! এই অশরীরী মানে ভূত নয়, অন্য কিছু। তাহলে জিপসিকে তোরা রাখতে চাস না? আমাকে দিয়ে দে, আমি ওর আসল মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করব।’
আমরা সবাই মিলে বললাম, ‘না, না, জিপসি থাকবে। জিপসি থাকবে!’
বটুকদাদা বললেন, ‘তাহলে এই পূর্ণিমার রাতটায় কী হয়, আমি নিজের চক্ষে একটু দেখি।’
ক্যালেণ্ডারে দেখা গেল পূর্ণিমা আর মাত্র দু-দিন বাদে।
সেদিন সকাল থেকেই জিপসিকে চোখে-চোখে রাখা হল। একজন-না-একজন সব সময় ওর কাছে থাকে। জিপসিও অন্যদিনের মতন খেলা করে, আদর করলে মাটিতে গড়াগড়ি দেয়। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ করা গেল, কিছুই খাচ্ছে না। ভালো যা কিছু খেতে দেওয়া হচ্ছে, সে একবার শুঁকেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। দুধ-মুড়ি ও খুব চেটেপুটে খায় অন্যদিন। আজ সে তাতে একবার জিভ ছোঁয়াল না পর্যন্ত। তাকে জোর করে কিছু খাওয়াবার চেষ্টা করেও কাজ হল না। আজ তার উপোস।
সন্ধেবেলা বসবার ঘরে আমরা সবাই গোল হয়ে বসেছি। মাঝখানে বটুকদাদা, আর তিন্নির কোলে জিপসি। আমরা সবাই গল্প শুনছি, জিপসি এমন চুপ করে বসে আছে যেন সেও মন দিয়ে গল্প শুনছে। আকাশ মেঘলা, একসময় টিপিটিপি বৃষ্টিও পড়ছিল!
বেশ অনেকক্ষণ কেটে গেছে, হঠাৎ একসময় জিপসি ভুকভুক করে ডেকে তিন্নির কোল থেকে নামতে চাইল।
রতন জানলার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘বৃষ্টি থেমে গেছে, চাঁদ উঠেছে!’
সত্যি চাঁদের আলোর একটা শিখা জানলা দিয়ে এসে ঘরের মধ্যে পড়েছে।
তিন্নি জোর করেও জিপসিকে ধরে রাখতে পারছে না। সে অসম্ভব ছটফট করছে। শম্ভু আর রতন দুজনে জিপসিকে চেপে ধরল।
এবার জিপসি গোঁ গোঁ শব্দ করে উঠল, এক ঝটকায় ওদের ছাড়িয়ে নেমে পড়ল মাটিতে। দরজার দিকে চলে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল একবার।
বটুকদাদা গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে জিপসি, কোথায় যাচ্ছিস?’
জিপসি মুখটা তুলতেই আমরা আঁতকে উঠলাম। এরকম দৃশ্য কখনো দেখিনি। ঠিক টর্চের আলোর মতন দুটো আলোর শিখা বেরোচ্ছে জিপসির চোখ দিয়ে।
বটুকদাদা আপন মনে বললেন, ‘তাহলে ওরা ঠিকই বলেছিল। হাঙ্গারিয়ান জিপসি কুকুরের চোখ দিয়ে পূর্ণিমার দিন আলো বেরোয়। ভয় নেই, তোরা কেউ ভয় পাস না, জিপসিকে যেতে দে!’
দরজা খোলা, জিপসি এক লাফে চলে গেল বাইরে। আমি আর রতন দরজার কাছাকাছি বলে আমরাও ওর পেছন-পেছন যাবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই বটুকদাদা বললেন, ‘খবরদার, খবরদার! ওর পেছনে যাসনি! গেলে যা দেখবি, তা সহ্য করতে পারবি না!’
জিপসি বিদ্যুতের বেগে ছুটে গেল, না অদৃশ্য হয়ে গেল, তা বোঝা গেল না। চোখের পলক ফেলতে-না-ফেলতেই জিপসি যেন মিলিয়ে গেল কোথায়!
আমরা সবাই এবার বটুকদাদাকে চেপে ধরে বললাম, ‘ও বটুকদাদা, কী ব্যাপারটা হল বলো! জিপসি কোথায় গেল? কোথা থেকে ও রক্ত খেয়ে আসে?’
বটুকদাদা বললেন, ‘দেখো বাপু, তোমাদের একটা কথা বলি! তোমরা নিজের চোখেই তো দেখলে পূর্ণিমার রাতে জিপসি কীরকম বদলে যায়? যদি এ কুকুরকে বাড়িতে রাখতে চাও, তাহলে আর কিছু জানতে চেয়ো না।’
তিন্নি কাঁদতে-কাঁদতে জিজ্ঞেস করল, ‘আমার জিপসি কার রক্ত খায়, তা তোমাকে বলতেই হবে। ও যদি খুনে কুকুর হয়, তাহলে আমি ওকে আর ভালোবাসব না!’
বটুকদাদা বললেন, ‘সেবার যখন মানস সরোবরে যাই, তখন কী কান্ড হয়েছিল শোন। একদিন জলের মধ্যে এমন তোলপাড় শুরু হল, ঠিক যেন মনে হল হ্রদের তলায় কোনো দৈত্য-দানব লুকিয়ে আছে।’
সম্পূর্ণ অন্য গল্প। এ-গল্প শেষ হতে হতে আমাদের ঘুম পেয়ে গেল প্রায়।
জিপসি যথারীতি ফিরে এল। একদিন বাদে। তার মুখে সেইরকমই টাটকা, টকটকে লাল রক্ত মাখানো। আবার সে নিরীহ, শান্ত কুকুর হয়ে গেল।
এরপর থেকে পূর্ণিমার রাতটায় আমরা জিপসির কথা ভুলে থাকি!