আমাদের ছোট নদী : অজয়
এমন একটা সময় ছিল, যখন প্রতিবছর শীতকালে নেশার ঝোঁক কিংবা চুম্বকের টানের মতো চলে যেতাম কেঁদুলির মেলায়। শান্তিনিকেতনের পৌষমেলার চেয়েও এই মেলার আকর্ষণ ছিল অনেক বেশি।
তখন তো আমাদের এমন কিছু পরিচিত হয়নি, আমাদের কেউ খাতিরও করত না। থাকার জায়গাটায়গার নানান অসুবিধে ছিল। কেন্দুলির মেলা সারা রাতের, বীরভূমের হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে। এই মেলায় অনেক ছোট-বড় তাঁবু, একেকটা তাঁবুতে একেকজন বাউল শিরোমণির আখড়া। সারারাত শুধু গান। শীত কাটাবার জন্য বাউলদের সঙ্গে সঙ্গে আমি, শক্তি, ভাস্কর, দুয়েকবার শরৎকুমার ও গণেশদা গাঁজা টানতাম। তাতে সত্যিই শীত বোধ খানিকটা কমে যায়। লুকিয়ে-চুরিয়ে দুয়েকটা দিশি মদের ঠেকও থাকত, সে মদ্যপানে শীতের তেমন কিছু সুরাহা হয় না, তবে গান শোনার উৎসাহ বাড়ে।
আমরা এক তাঁবু থেকে অন্য তাঁবুতে ঘুরতাম নতুন-নতুন গানের সন্ধানে। শেষ রাতে ঘুমে চোখ টেনে এলে মাঠের মধ্যেই খোলা আকাশের নীচে শুয়ে থাকতাম একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে। তখন বয়েস কম, শরীরও বেশ টনকো, অসুখ-বিসুখ গ্রাহ্য করতাম না।
কেঁদুলির বাউল মেলায় সে সময় ইলেকট্রিসিটি ছিল না, সুতরাং মাইকও ছিল না। এক আখড়ার সঙ্গে অন্য আখড়ার গানের সংঘর্ষও হত না, সব গানই শোনা যেত আলাদাভাবে।
অজয় নদীর ধারে এই গ্রামে নাকি কবি জয়দেবের জন্ম। নাকি বলছি এই জন্য যে ওড়িশাতেও অনেকে দাবি করে, জয়দেব সে রাজ্যেই জন্মেছিলেন। জয়দেব বাঙালি কবি নয়, ওড়িয়া ভাষারও কবি নন, তিনি লিখেছেন সংস্কৃত ভাষায়। সুতরাং কোথায় তিনি জন্মেছিলেন, সঠিকভাবে তা নির্ণয় করা শক্ত।
জয়দেবের জন্মস্থানকে ঘিরেই কেন বাউলদের এত বড় মেলা উৎসব হয়, তাও ঠিক বোঝা যায় না। সংস্কৃত ভাষার এক কবি কী করে বাংলার বাউলদের গুরু হলেন? বাউলদের উদ্ভব জয়দেবের জন্মের অনেক পরে এবং কেঁদুলি থেকে অনেক দূরে অবিভক্ত বাংলার কুষ্টিয়া জেলাকে ঘিরে। এখনও সেখানে বাউলের সংখ্যা অনেক। বাউল-সম্রাট লালন ফকিরও কুষ্টিয়ারই মানুষ। কোন কারণে যে একেকটা মেলা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তা বলা অসম্ভব। পশ্চিম বাংলায় এখন কেঁদুলির মেলা বাউলদের জন্যই বিখ্যাত মেলা।
আমাদের ছেলেবেলায় বাংলার বাইরে বাউলদের তেমন পরিচিতি ছিল না। তাদের গান ছিল বাংলার একটা নিজস্ব ধারা। রবীন্দ্রনাথ বাউল গানে মুগ্ধ ছিলেন, তাদের থেকে কিছু গ্রহণও করেছেন, তাতেই শিক্ষিত সমাজে বাউলদের সম্পর্কে আগ্রহ জন্মায়। ক্রমে সাহেবদের নজর পড়ে বাউলদের দিকে। বাউলদের গান ও জীবনধারা তাঁদের আকৃষ্ট করে। কবি অ্যালেন গিনসবার্গ এদেশে থাকার সময় অনেক বাউলদের সঙ্গে মেশেন। আমাদের সঙ্গেও অ্যালেন গেছেন কেঁদুলির মেলায়, সারারাত জেগেছেন।
অ্যালেন গিনসবার্গ দেশে ফিরে গিয়ে বাউলদের কথা প্রচার করেন। আমেরিকার অতি বিখ্যাত গায়ক বব ডিলান একবার উডস্টক নামে একটা জায়গায় নানা ধরনের গায়কদের বিরাট এক সমাবেশের আয়োজন করেন। উডস্টক নামটিই এখন মার্কিনি গানের জগতে ইতিহাস হয়ে আছে। সেই সময় অ্যালেন গিনসবার্গের পরামর্শে বব ডিলান নিজস্ব বিমান পাঠিয়ে কলকাতা থেকে পূর্ণদাস বাউলকে উডস্টকে যোগ দেওয়ার জন্য নিয়ে যান। সেখানে পূর্ণদাসের একইসঙ্গে উদাত্ত গলার গান, গুপিযন্ত্র বাজনা ও নাচ দেখে অনেকেই মুগ্ধ হয়েছিলেন।
সেই থেকে অনেক বাউলই প্রায়ই নানা দেশ থেকে আমন্ত্রণ পান। চেনাশুনো অনেক বাউলই বিলেত-আমেরিকা-ফেরত। শান্তিনিকেতনের ট্রেনে গান গায় যে কার্তিক বাউল, সে একাধিকবার আমেরিকা-ইউরোপ ঘুরে এসেছে। পবন বাউল এখন থাকে প্যারিসে।
যাই হোক, সাহেব-মেমদের নজর পড়ার ফলে কেঁদুলির মেলার চরিত্রও অনেকটা বদলে যায়। ইতিমধ্যে ইলেকট্রিসিটি এসে গেছে, শুরু হয়েছে মাইকের উৎপাত। তাঁবুগুলি বেশি সাজানো, বাউলদের পোশাকও অনেক জমকালো। সবচেয়ে দুঃখের কথা, সব বড় বড় আখাড়াতেই মাইক লাগাবার ফলে কোনও গানই আলাদাভাবে মন দিয়ে শোনা যায় না। মনে হয় যেন একসঙ্গে অনেক শব্দের দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলেছে।
আমরাও তখন থেকে ওই মেলা সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি।
শেষবার ওই মেলায় যাই, যখন আমাদের বন্ধু আয়ান রশিদ খান ছিল বীরভূম জেলার এস পি। সে নিজে কবি এবং গান-পাগল। পদাধিকার বলে সে মেলার ওই তিনদিন উপস্থিত থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যবস্থা করত। একটা মস্ত বড় রঙিন তাঁবু, যার নাম সুইস কটেজ, সেখানেই তার অবস্থান। আমাকে আর শক্তিকে সে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।
শক্তি বলেছিল, রশিদ, তুমি হুকুম দিয়ে এতগুলো মাইক একসঙ্গে চালানো বন্ধ করে দিতে পারো না? শুধু একটা মাইক থাকবে, সকলেই পালা করে এসে সেটা ব্যবহার করবে।
রশিদ বলেছিল, বাঙালিদের কোনও ব্যাপারেই কি একমত করানো সম্ভব? আমি এ ব্যাপারে মাথা গলিয়ে বিপদে পড়তে চাই না।
রশিদ তার তাঁবুতে একটি অল্পবয়েসি বাউল ও তার সঙ্গিনীকে ডাকিয়ে এনে আমাদের গান শুনিয়েছিল। ওদের বয়েস বড়জোর উনিশ-কুড়ি। কী সুন্দর সারল্য মাখা মুখ। ওদের গান শুনে তো ভালো লেগেছিল বটেই, তার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছিলাম ওদের কথাবার্তা শুনে। এই বয়েসেই একটা চমৎকার দার্শনিক জীবন বোধ আছে। বাউলরা সব কমার্শিয়াল হয়ে গেছে, এই অভিযোগ আর মানতে ইচ্ছে করে না। এরকম ছেলেমেয়ে তো এখনও আসে।
ওদের নিয়ে আমি একটা গল্প লিখে ফেলেছিলাম।
এবারে নদীর কথা।
অজয় নদীর ধারে এই কেঁদুলি। মেলা চলার সময় সে নদীর ধারে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। একসঙ্গে অত মানুষের সমাবেশ, তারা বাথরুমে যাবে কোথায়? সবই ওই নদীর ধারে। এখন কোনও সুবন্দোবস্ত হয়েছে কি না জানি না। সে সময় ওদিকটায় দুর্গন্ধের চোটে ঘা ঘিনঘিন করত। ওরই মধ্যে অনেকে স্নান করত অজয় নদীর জলে।
এই অজয় নদীকে আমি আরও অনেক জায়গায় দেখেছি। বীরভুম আর বর্ধমান জেলার সীমান্ত ভাগ করেছে এই নদী। মেলা ছাড়া অন্য সময়েও আমি কেঁদুলির পাশ দিয়ে গেছি। তখন
এ নদীর চেহারা বেশ পরিষ্কার আর সুন্দর।
বীরভূমের অনেক নদীরই উৎপত্তি বর্তমান ঝাড়খন্ডের পাহাড়-টিলায়। অজয়ও সেখানেই জন্ম নিয়ে কালিপাথর নামে একটা জায়গার পাশ দিয়ে প্রবেশ করছে বীরভূমে। আমরা যখন ট্রেনে চেপে শান্তিনিকেতনে যাই, অজয় নদীর ওপর ঝমঝম শব্দে ট্রেনটা পার হলেই বুঝি, এবার ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে নিতে হবে, আর দশ মিনিটের মধ্যেই বোলপুর এসে যাবে। এখানেই অজয় বীরভূম আর বর্ধমানের স্পষ্ট সীমানা।
ট্রেন থেকে কেমন দেখি আমরা এই নদীর রূপ? প্রায় সারা বছরই যেন এই বিশাল নদীটি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। জল থাকেই না বলতে গেলে, চারদিকে শুধু বালি, এক জায়গায় শুধু তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে, সেটাই তার বেঁচে থাকার লক্ষণ। লোকজন হেঁটেই পার হয়, গরুর গাড়িও চলে।
বর্ষার সময় দুয়েকটা মাস দেখা যায় তার আসল রূপ।
শান্তিনিকেতনে গাড়ি করে যেতে গেলে ইলামবাজারের কাছে জঙ্গলে একটা সেতু পার হতে হয়। উনিশশো আটাত্তর সালে প্রবল বন্যায় সে সেতুর কী দশা হয়েছিল, তা আমি নিজের চোখে দেখেছি। বন্যা শেষের কয়েকদিন পরেই আমি ওদিকে গিয়েছিলাম। জলের এত তেজ? অতবড় একটা সেতু একেবারে দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে-চুরে গেছে। না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত।
একবার বর্ষার সময় শান্তিনিকেতনে থাকতে থাকতে শুনতে পেলাম যে অজয় নদীতে নাকি ইলিশ মাছ উঠেছে। প্রথমে মনে হয়, বাজে কথা, গুজব! ইলিশ তো সমুদ্রের মাছ, পদ্মা-গঙ্গায় কিংবা সুবর্ণরেখাতেও কিছুটা ঢুকে আসে। এতদূর আসবে কী করে? পরে মনে হয়, হয়তো একেবারে গুজব নয়, এই অজয় গিয়ে পড়েছে, গঙ্গার যেখানে নাম ভাগীরথী, সেইখানে। সেদিক থেকে কিছু ইলিশ এদিকে চলে আসতে পারে। সে ইলিশ অবশ্য আমার খাওয়া হয়নি।
একবার কবি সমরেশ মণ্ডলের মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে পাণ্ডবেশ্বর নামে এক গ্রামে গিয়েছিলাম, রাত্রিবাস করেছিলাম তার বন্ধু ও কবি সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের অতিথি ভবনে। গ্রাম বলছি বটে, কিন্তু পাণ্ডবেশ্বর বেশ প্রাচীন জায়গা, এখনও বেশ বর্ধিষ্ণু। শহরের সব চিহ্ন বর্তমান। এখানেও অজয় নদ।
এখানে পাণ্ডুরাজার ঢিবি খুঁড়ে অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। অর্থাৎ এককালে এখানে কোনও রাজ্যের রাজধানী ছিল। খুব সমৃদ্ধ ও বেগমান নদী না হলে তার তীরে কোনও বসতি গড়ে ওঠার কথা নয়। যদিও প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ, তবু অজয়ের সেই গৌরবের দিন আর নেই। বাংলার অনেক নদ-নদীর মতো অজয়েরও এখন করুণ দশা।
পাণ্ডবেশ্বরে বিখ্যাত মন্দিরটিও দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানেও নদীর প্রস্থ দেখে সম্ভ্রম জাগে, বোঝা যায় এককালে কত চওড়া নদী ছিল! কিন্তু নদী বলতে তো তার দৈর্ঘ্য প্রস্থ কিংবা দু-ধারের দৃশ্য বোঝায় না, নদী হচ্ছে এক খাতের মধ্যে প্রবাহিত জলধারা। সেই জলই আর নেই। সারা পৃথিবী থেকে নাকি জল কমে যাচ্ছে আর উষ্ণতা বাড়ছে। এর পরের মহাযুদ্ধ হবে নাকি দেশে দেশে জলের অধিকার নিয়ে।
আমাদের বাংলায় নদ-নদীর নাম অনুযায়ী পুরুষ কিংবা স্ত্রী বলে নির্ণয় করা হয়। গঙ্গা যেমন নদী, ব্রহ্মপুত্র সেই রকম নদ। অজয়ও সেই কারণে নদ। কিন্তু লেখার সময় বারবার নদ লিখতে কেমন যেন ভুল হয়ে যায়, সবই নদী বলে মনে হয়।
অজয়কেও আমি কয়েকবার নদী বলে ফেলেছি। কিন্তু শুধু আমি নয়। অজয়ের তীরবর্তী এক বিখ্যাত কবিও অজয়কে নদীই বলেছেন।
অজয়ের তীরে আরেকটি বিখ্যাত গ্রামের নাম কোগ্রাম। এই গ্রামের খ্যাতির প্রধান কারণ এখানে কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক জন্মেছিলেন, এখানেই তিনি বসবাস করতেন। অনেক বিখ্যাত লেখক তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য যেতেন কোগ্রামে।
সে গ্রামে আমিও গেছি দুয়েকবার, তখন অবশ্য কবি জীবিত নন। এখানে নদী কেমন যেন পাক ঘুরে গেছে। তাই নিয়ে কুমুরঞ্জন লিখেছেন:
বাড়ি আমার ভাঙন ধরা অজয় নদীর
বাঁকে
জল যেখানে সোহাগ
ভরে স্থলকে ঘিরে রাখে।