[সোর্স না জানা অজানা গল্প]
আমাদের ছোট নদী

আমাদের ছোট নদী

গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব দিক ঘেঁষে ছোট্ট নদী ধলাই দূষণ আর মানুষের লোভের ফাঁদে পড়ে আমাদের অনেক নদীই আজ শ্রীহীন। স্মৃতির প্রিয় স্রোতস্বিনী হারিয়েছে তাঁর সোনালি যৌবন। এই আয়োজন আদতে বাংলাদেশের সব বিপদাপন্ন নদ-নদীর জন্য এক শোকগাথা। বর্ষায় ফুটে ওঠে বাংলাদেশের নদ-নদীর সত্যিকার রূপ। তাই বর্ষার প্রারম্ভেই নদী নিয়ে আমাদের এই আয়োজন।

‘আমি এখন পড়ি যে ভাই বারহাট্টা হাইস্কুলে,
একে অন্যে থাকি হেথায় ভাই বন্ধু বলে।
এই স্কুলটি অবস্থিত কংশ নদের তীরে,
আমাদের বাড়ি হইতে দেড় মাইল উত্তরে।’

এটি হচ্ছে আমার রচিত প্রথম কবিতা। আমার ছেলেবেলা গ্রন্থে কবিতাটির জন্মকথা বর্ণিত হয়েছে। তা ছাড়া, বহু সাক্ষার‌্যাকারে আমি এই কবিতার জন্মকথা বলেছি। বলতে হয়েছে। তাই সেই পুরোনো কাহিনি আর বলছি না। আমার কবিতার কথা বাদ দিয়ে এই সুযোগে বরং পৃথিবীর প্রথম কবিতাটির জন্মকথা বলি।

মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।

এই বাক্যটিকেই পৃথিবীর আদিকবিতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর রচয়িতা হচ্ছেন বাল্মীকি। বিশ্ব-কবিসম্রাট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত-অভিনীত বাল্মীকিপ্রতিভা দ্রষ্টব্য। কবি হওয়ার আগে বাল্মীকি ছিলেন ‘দস্যু রত্নাকর’ হিসেবে খ্যাত। তিনি ডাকাতি করতে ভালোবাসতেন। মহর্ষি নারদের কৃপায় তিনি কবিত্বশক্তি লাভ করেন এবং বনের ভেতরে বৃক্ষশাখায় মিথুনরত পাখি নিধনকারী ব্যাধকে অভিশাপ দিয়ে অনেকটা নিজের অজান্তেই এই বাক্য উচ্চারণ করে বসেন। এই পঙিক্তকেই বলা হয় পৃথিবীর প্রথম কাব্যপঙিক্ত বা কবিতা। আদিকাব্যপঙিক্ত, আদিকাব্য।
প্রশ্ন উঠতে পারে, আমার জীবনের প্রথম কবিতাটির সঙ্গে ‘কংশ’ নদের সম্পর্কসূত্রটি না হয় পাওয়া গেল, কিন্তু পৃথিবীর প্রথম কবিতার বা তার রচয়িতা হঠার‌্যা-কবি বাল্মীকির সম্পর্ক কোথায়? সেখানে তো ‘আমাদের ছোট নদী’র কথা নেই। আমি বলছি, আছে। একটু ধৈর্য ধরতে হবে। আছে এইখানে যে, ‘মা নিষাদ’ রচনা করার সময় বাল্মীকি তমসা নদী-তীরবর্তী এক গভীর অরণ্যে বাস করতেন। বাল্মীকির নদী তমসা, আমার নদী কংশ। প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও, আমি তাই বাল্মীকি ও আমার জীবনের মধ্যে একটা মিল খুঁজে পাচ্ছি। মিলটা হচ্ছে নদীর মিল।
নদীসংখ্যা বিচারে আমি মনে হয় আদিকবির চেয়ে এগিয়ে রয়েছি। বাল্মীকির নদী ছিল একটি, আমার নদীসংখ্যা হচ্ছে দুই। পাঠকের সন্দেহ ভঞ্জনের জন্য বর্তমান রচনার মধ্যে আমার নদীযুগলের প্রামাণ্য আলোকচিত্র উপস্থাপিত হলো। যিনি আমার গ্রামে গিয়ে আমার দুই প্রিয় নদীর ছবি তুলে আমাকে পাঠিয়েছেন, তাঁকে অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। খুব সুন্দর ছবি হয়েছে। ছবি হচ্ছে স্মৃতির টনিক। কত কথাই যে মনে পড়ল ওই নদীর ছবি দেখে! আমার দুটো উপন্যাস আছে। কিশোর উপন্যাস কালো মেঘের ভেলা এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য রচিত উপন্যাস দেশান্তর। এই দুই উপন্যাসেই ধলাই নদীর প্রসঙ্গ এসেছে, ধলাই নদীর বর্ষাকালীন রূপের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু কবিতায় নয় কেন? মনে হয়, কোনো অব্যাখ্যাত অজানা কারণে আমার কবিতা দখল করে নিয়েছিল কংশ; ধলাই তা পছন্দ করেনি। অভিমানে দূরে সরে যাওয়া ধলাই ফিরে এসেছে আমার উপন্যাসে।
‘সব গ্রামেই তো আর নদী নেই, আমাদের গ্রামে আছে, তাই আমাদের বুকে ভয়।’ ১৯৭১ সালে এই কবিতাটি লেখার সময় আমি ধলাইকেই মনে রেখেছিলাম। আমার গ্রামের দক্ষিণ ও পূর্ব সীমানা ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া নদীটি আমার কবিতায় না এলেও আমার ছেলেবেলায় ওই নদীর বর্ণনা যথাযথ মর্যাদায় লিপিবদ্ধ হয়েছে।

‘আমাদের গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব দিক ঘেঁষে একটি ছোট্ট নদী আছে। নাম ধলাই। এটি কংশ থেকে বেরিয়ে আসা ধনাইখালির একটি শাখা। আমাদের গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গিয়ে মিশেছে রাজাখালি নদীর সঙ্গে। ঐ নদীতীরেই গাঁয়ের শ্মশান। আমাদের পূর্ব-পুরুষদের জায়গার অভাব ছিলো না বলে শ্মশানের জন্য অনেকটা জায়গা তাঁরা ছেড়ে দিয়েছিলেন। নদীতীরের ঐ উদ্বৃত্ত জায়গাটাকে আমরা খেলার মাঠে পরিণত করেছিলাম। মাঠটি ছিলো ত্রিকোনাকৃতির। একটু অসুবিধা হলেও আমরা ঐ রকম মাঠে খেলতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। মাঠটি ছিলো খুবই উঁচু, বৃষ্টির দিনেও মাঠে জল জমতো না, কাদা হতো না, ফলে আমরা প্রাণ ভরে ঐ মাঠে ফুটবল খেলতে পারতাম।’
(আমার ছেলেবেলা: পৃ-৬২)

এরশাদ সাহেব তাঁর শাসনামলে মাঠটি সরকারি দখলে নিয়ে সেখানে গুচ্ছগ্রাম বানিয়েছেন। এটি কখনোই সরকারি খাসজমি ছিল না, ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া দেবোত্তর সম্পত্তি। গ্রামের কিছু গৃহহীন মানুষ সেখানে আশ্রয় পেয়েছে বলে তখন আমি আর প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করিনি। মনে মনে করেছি। এখনো করি।
ধলাই নদীর ছবিগুলো দেখছি আমাদের শ্মশানঘাট থেকেই তোলা হয়েছে। মন্দ নয়, ধলাইয়ের ছবিতে সওয়ার হয়ে আমাদের গ্রামের শ্মশানঘাটের ছবিটিও ‘ছুটির দিনে’তে ছাপা হয়ে থেকে গেল।

রবীন্দ্রনাথ ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে-বাঁকে / বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে…’ বলে যে কবিতাটি লিখেছেন, সেটি একটি চমর‌্যাকার কবিতা। কোনোই সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি ভাবছি, যে নদীর গ্রীষ্মকালীন দৈন্যদশার নিখুঁত চিত্র তিনি এঁকেছেন তাঁর কবিতায়, সেটি তাঁর নিজের নদী ছিল না। নিজের নদীকে নিয়ে এমন কবিতা লেখা যায় না। আসলে তিনি তো জন্মসূত্রে কোনো নদী পাননি। মাইকেল পেয়েছিলেন কপোতাক্ষ, জীবনানন্দ ধানসিড়ি। ভাগ্যিস, শিলাইদহে এসেছিলেন তিনি। তাই পদ্মাকে পেয়েছিলেন বুকের মাঝে, আপন করে। আমার সে রকম সমস্যা নেই। আমার উত্তরে কংশ, দক্ষিণে ধলাই। এই দুই নদের মাঝখানের সমতটে আমার জন্মের বসতি। গ্রীষ্মকালে এই দুই ছোট নদীর দৈন্যজলদশা আমিও দেখেছি বটে, কিন্তু আমি আমার ধলাই বা কংশকে সেভাবে আঁকিনি। আমি কংশকে তুলনা করেছি সমুদ্রের সঙ্গে।

‘একবার এসেই দেখুন কংশ নদের সাথে সমুদ্রের বেশ মিল আছে।
হাসবেন না, দোহাই, আমাদের গাঁয়ের লোকেরা খুব কষ্ট পাবে।
একবার এসেই দেখুন নিজ চোখে, কংশ কোনো যা তা নদী নয়,
রীতিমতো, বেগবান—বেশ চওড়া-সওড়া। না, এর জল
সাধারণ নদীর মতোন এত মিঠা নয়, একটু লবণ লবণ ভাব আছে।
দুর্গা বিসর্জনে গিয়ে এর লবণজলের স্বাদে আমি বারবার আঁতকে উঠেছি—
আরে, এ তো শুধু নদী নয়, এ যে সমুদ্রের ছদ্মবেশী রূপ।
কোনো দিন কাউকে বলিনি, শুধু সুদূর শৈশব থেকে মনে-মনে
মিলিয়েছি বারহাট্টার সাথে কক্সবাজার, কংশের সাথে বঙ্গোপসাগর।’

(কংশের সাথে সমুদ্রের বেশ মিল আছে: তার আগে চাই সমাজতন্ত্র)

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১৮, ২০১১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *