আমলা ও বাঙলা
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে স্বাধীনতা পাওয়া দেশগুলোতে একটি মারাত্মক ব্যাধি দেয়া দেয়, ব্যাধিটির নাম ‘ঔপনিবেশিক ঘোর’ বা ‘কলোনিয়াল হ্যাংওভার’। এ-ব্যাধিতে সবচেয়ে দুরারোগ্যভাবে যাঁরা আক্রান্ত, তাঁরা আমলাসম্প্রদায়; অসুস্থ স্বার্থপরায়ণ চতুর কপট বিবেকহীন গোত্র। পাকিস্তানি আমলারা চ’লে যাওয়া শাদা আমলাদের গুণগুলো পরিহার ক’রে সূচারুরূপে আয়ত্ত করেছিলো তাদের দোষগুলো, এবং বাঙলাদেশের উদ্ভবের পরে বাঙালি আমলাদের মনোভাবের বিশেষ পরিবর্তন ঘটে নি, বরং তাঁদের পতন ঘটে আরো। স্বাধীনতার প্রথম বছরগুলোতে তাঁরা ক্ষমতাসীন রাজনীতিক দলের প্রচণ্ড নেতা-উপনেতা প্রভৃতির দ্বারা এতো লাঞ্ছিত-অপমানিত হন যে মনে মনে তাঁরা প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধে, এবং বাঙলা ভাষার বিরুদ্ধে, একটি শক্তিশালী দলরূপে সংহত হন; ক্রমশ মুঠোতে নেন সমস্ত ক্ষমতা। পাকিস্তানকালে উচ্চ আমলা হওয়ার জন্য ইংরেজিদক্ষতাই ছিলো প্রধান যোগ্যতা; সাধারণ বিশ্ব-ও সমকালীন-জ্ঞান ও ভালো ইংরেজি জ্ঞান নিয়ে পাকিস্তানকালে আমলাশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হওয়া যেতো। ইংরেজি যেহেতু তাঁদের সমস্ত প্রতিষ্ঠার মূলে, তাই ইংরেজির জন্যে তাঁদের রয়েছে গভীর দরদ-আবেগ। গরিব দেশগুলোতে আমলাসম্প্রদায় অত্যন্ত ‘স্নবিশ’ হ’য়ে থাকেন; বাঙলাদেশেও তাই, হয়তো আরো বেশি। জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই তাঁদের উন্নাসিকতা প্রকাশ পায়, এবং ইংরেজি ব্যবহারে তা চূড়ান্ত রূপ পায়, যদিও তাঁদের ইংরেজি অনেক দিনের বাসি। বাঙলা আমলাদের কাছে মর্যাদার ভাষা নয়, ইংরেজিকেই তাঁরা মর্যাদার আধাররূপে জ্ঞান করেন, কারণ এটাই তাঁদের অস্ত্র। বাঙলা ভাষার সাথে তাঁরা সাধারণত প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ শত্রুতায় লিপ্ত হন। কিন্তু তাঁরাই অবস্থান করেন রাষ্ট্রযন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে, এবং জড়িত থাকেন সামাজিক অগ্রগতির প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে। প্রধানত আমলাদের অবহেলা-বিরোধিতার জন্যই এখনো সরকারি কাজকর্মে বাঙলা ভাষা প্রতিষ্ঠিত হ’তে পারে নি।